মারাং বুরুর শাপ - প্রলয় কুমার নাথ

অলংকরণ : সুমিত রায়
(১)
সাল ১৯৪৫

গোধূলির শেষে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়েছে চারিদিকে। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজমান পুরোনো মন্দিরটির চারিপাশে। এই জনমানবশূন্য বন্য-প্রান্তরের মাঝে যতদূর চোখ যায়, নজরে আসে শুধুমাত্র একজন সুপুরুষ দীর্ঘদেহী ব্যক্তিকে। শুভ্র পোশাক পরিহিত এই ব্যক্তি একান্তে ভগ্ন দেবালয়ের ভেতর কালীমূর্তির সামনে সন্ধ্যা-আরতি দিতে ব্যস্ত। ভক্তিভরে মন্ত্রোচ্চারণের সাথে ঘুরিয়ে চলেছেন ধুনচি। ধুপ ধুনোর পবিত্র গন্ধে ভরে উঠেছে চতুর্দিক। এই ব্যক্তি তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গদেশে অবস্থিত এই গ্রামের জমিদার, শ্রীযুক্ত সত্যচরণ মিশ্র।

মায়ের পূজা সমাপন করে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজ গৃহের পথ ধরলেন সত্যচরণ। তবে এখনো তার মনের মাঝে থাকা দুশ্চিন্তা এবং অস্থিরতার রেশ কাটেনি। এই পৃথিবীতে কি অতি-প্রাকৃত শক্তি বলে সত্যিই কিছু আছে? আজ রাতেই কি সত্যি হতে চলেছে সেই অভিশাপ? এই সব কথা ভাবতে ভাবতে এই শক্ত-সামর্থ চেহারার রাশভারী মানুষটাও যেন শিহরিত হয়ে উঠতে লাগলেন ক্ষণে ক্ষণে!

আজ রাতে আর খিদে পেলো না সত্যচরণের, ইচ্ছা করলো না সাজ-গোজ করে বাইজি মহলে যেতে। কোনো এক অজানা আতঙ্কের বশে তিনি সটান নিজের শয়নকক্ষে ঢুকে বন্ধ করে দিলেন সকল দরজা জানালা। কিছুদিনের জন্য তার স্ত্রী নিজের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছেন, তাই কি আজ হঠাৎ করেই সত্যচরণের বড্ড ফাঁকা লাগছে গোটা ঘরটাকে? ঘরের বাতি নিভিয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন প্রশস্থ পালঙ্কের একপ্রান্তে।

মধ্যরাত্রের কাছাকাছি একটি পুরুষকণ্ঠের তীব্র আর্তচিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল এই বাড়ির বেশ কিছু চাকর আর দারোয়ানদের! আরো এক দুইবার শোনার পর তাদের আর বুঝতে ভুল হল না, যে এই কণ্ঠস্বর হল তাদের কর্তাবাবু সত্যচরণের, এবং তা আসছে তারই শয়নকক্ষ থেকে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তারা রাতের অন্ধকারে ছুটে গেল সত্যচরণের শয়নকক্ষের দিকে। কিন্তু তাদের ডাক বা বন্ধ দরজার বাইরে ক্রমাগত তাদের করাঘাতের আওয়াজ নিষ্ফল হল, কেউ ভেতর থেকে দরজা খুলতে উদ্যত হল না! অগত্যা তারা সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে দরজা ভাঙার উপক্রম করতে লাগলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সশব্দে দরজা ভেঙে আলাদা হয়ে গেল দুই পাল্লা। তারা ঘরের ভেতর ছুটে এসে, পালঙ্কের দিকে তাকিয়েই শিউরে উঠলো। তাদের কর্তাবাবুর নিথর দেহটি পড়ে আছে তার এক প্রান্তে! ঠোঁটের কষ দিয়ে বেয়ে চলেছে বমনের ধারা! ওপরের দিকে চেয়ে থাকা নিষ্পলক চোখদুটি থেকে যেন এখনো কাটেনি আতঙ্কের রেশ!

(২)
সাল ২০১৯ (বর্তমান সময়)

কলকাতার বেশ কয়েকটি রহস্যময় খুনের কেসের সমাধান করে পুলিশ মহলের চোখে তাক লাগিয়ে দিয়েছে শখের গোয়েন্দা, শ্রীমান গৈরিক সেন। এবং প্রতিটা কেসেই তার একমাত্র সহকারীর ভুমিকা পালন করেছে তার খুড়তুতো বোন, ঐন্দ্রিলা সেন, ওরফে টুসু। তাই রাসবিহারী মোড়ে অবস্থিত গৈরিকের “সেন’স আই” নামক প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসঘরটিতে কিছুদিন ধরেই মক্কেলদের আগমন লেগেই আছে। তবে টুসু লক্ষ করেছে, যে ইদানিং কেস হাতে নেওয়াতে বেশ খুঁতখুঁতে হয়ে উঠেছে তার ‘গেরোদা’। খুব সাধারণ চুরি ছিন্তাই-এর কেসগুলিতে আর মজে না তার মন!

ট্যাক্সির ভেতর গৈরিকের পাশে বসে খোলা জানলার বাইরে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল টুসু। এই রাস্তাটির দুইপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত, সকালের সোনালী রোদের আলোর সাথে স্নিগ্ধ সবুজ সতেজতা মিলেমিশে একাকার হয়েছে চারিদিকে। সত্যি, এমন দৃশ্য কলকাতা শহরে বিরল। গতকাল গৈরিকের এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে সে এবং টুসু এসেছে বীরভূম জেলার নলহাটি ব্লকের ভদ্রপুর গ্রামে। আজ তারা আবার কলকাতার উদ্দেশে ফিরতি পথে।

“কীরে, বিয়েবাড়িতে এসে শুধু খাওয়া-দাওয়াই করলি, নাকি পছন্দ হয়েছে কোন ছেলে-ছোকরাকে?” কৌতুকের স্বরে মুচকি হেসে বলে উঠলো গৈরিক।

টুসুরও পাল্টা জবাব, “ছেলে-ছোকরাকে পছন্দ করার সময় কি পেরিয়ে যাচ্ছে বলো, আগে তোমার বিয়েটা তো খাই...”

এই বলে মুখ টিপে হাসতে লাগলো টুসু। গৈরিকও আবার পাল্টা কিছু একটা বলতে চলেছিলো টুসুকে, এমন সময় নিজের পাশে থাকা গাড়ির জানলার বাইরে একটা দৃশ্য দেখে থমকে গিয়ে চুপ করে গেল। টুসুও গৈরিকের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে, গাড়ির ড্রাইভারের উদ্দেশে বলে উঠলো, “একটু দাঁড়াও তো...”

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো গৈরিক আর টুসু। এই স্থানে রাস্তার একপাশে ধানক্ষেত শেষ হয়ে গিয়ে শুরু হয়েছে বনাঞ্চল। তার মাঝেই প্রেতপুরীর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরনো দিনের ধাঁচে গড়া একটি বৃহদাকার দোতলা বাড়ি। অতীতের সেই আভিজাত্যের গরিমা না থাকলেও অল্প মেরামতির ছাপ প্রমাণ করে যে এই বাড়িতে এখনো লোকের বাস আছে।

“এটা মিশ্র বাড়ি, স্যার... এরা আগে এই গ্রামের জমিদার ছিলো।” বলে উঠলো গাড়ির ড্রাইভার।

যে কোন গ্রামের শেষ প্রান্তে এমন জমিদার বাড়ি থাকা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সকলের কৌতূহলের কারণ হয়েছে একটি অন্য বিষয়।

আজ এই বাড়ির সদর দরজার সামনে জমায়েত হয়েছে বেশ কিছু গ্রামবাসী। পুলিশের গাড়িও দণ্ডায়মান একধারে। সেদিক থেকেই যেন ভেসে আসছে কাদের কান্নার আওয়াজ। টুসু লক্ষ করলো বিষয়টার প্রতি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে গৈরিক। সে ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে চলে যেতে বললো, তারপর টুসুর উদ্দেশে বলে উঠলো, “এখনো তো ট্রেনের সময় হতে বেশ কিছুক্ষণ দেরি আছে…চল তো একবার ওদিকে গিয়ে দেখি…”

গৈরিক আর টুসু গ্রামবাসীদের ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল বাড়িটির সদর দরজার দিকে। দোতলা বাড়িটার মাঝে বিশাল বড় উঠোন, তার একদিকে ঠাকুর দালান। উঠোনের দিকে তাকাতেই বেশ অপ্রস্তুত বোধ করলো টুসু, কারণ সেখানে স্ট্রেচারের ওপর রাখা রয়েছে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি মৃতদেহ। তার ওপর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন এক বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক। তার পাশে দাঁড়ানো একজন মাঝ-বয়সী মহিলাও করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন শবটির দিকে। বেশ কিছু খাঁকি পোশাকধারী পুলিশ কনস্টেবলদের আনাগোনা লেগেই আছে চারিপাশে, তাদের মাঝে থেকেই এক স্থূল চেহারার পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন গৈরিক আর টুসুর দিকে। তারপর ভূত দেখার মত চমকে উঠে তিনি বললেন, “আরে! গৈরিক বাবু যে…তা কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ এই স্থানে! দূর থেকেই রহস্যের গন্ধ পান নাকি মশাই? হাহাহা…”

পুলিশ মহলে গৈরিকের যাওয়া আসা থাকায়, এই অফিসারের কাছে গৈরিক এবং টুসু পূর্বপরিচিত। গৈরিক এই স্থানে নিজেদের আসার হেতু জানালে, তিনি বলে উঠলেন, “তা ভালোই করেছেন মশাই এখানে এসে পড়ে। একেতেই এখন মাথার ওপর ডাকাতির কয়েকটা কেসের যা চাপ…তার ওপর আবার এই ঝামেলা। আরে বাবা, দেখে যা বোঝা যাচ্ছে, এটা একটা প্লেন এন্ড সিম্পল হার্ট-অ্যাটাকের কেস…তা না…”

“নাহ… না সাহেব!” অফিসারের কথা শেষ না হতেই মাথা তুলে বিস্ফারিত চোখে চিৎকার করে উঠলেন মৃতদেহটার ওপর কান্নায় ভেঙে পড়া সেই ভদ্রলোক, “আমার ভাইয়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়, স্যার…এই গ্রামের ওপর কালো ছায়ার মত চেয়ে থাকা অভিশাপ আবার হাতে-নাতে ফললো…”

বেশ উত্তেজিত হয়ে টুসু বলে উঠলো, “কোন অভিশাপের কথা বলছেন আপনি?”

ভদ্রলোকের রক্তবর্ণ চোখ দিয়ে গড়িয়ে চলেছে অশ্রুধারা, তিনি অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “শাপ!…মারাং বুরুর শাপ!”

একটা চাপা উত্তেজনা যেন ছড়িয়ে পড়লো টুসুর সর্বশরীরে। তার মানে কি আবার কোন রহস্যময় কেস হাতছানি দিয়ে ডাকছে গৈরিক আর তাকে!

(৩)

না, সেদিন আর কলকাতা-গামী ট্রেন ধরা হয়নি গৈরিক আর টুসুর। পুলিশি পরীক্ষা নিরীক্ষার শেষে অফিসারের বেশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও মৃতদেহ পোস্ট-মোর্টেমে পাঠানোর পর, এখন বাড়ির সামনে কৌতূহলী গ্রামবাসীদের ভিড় কেটে গিয়েছে। সেই স্থূল চেহারার অফিসারটির নাম অম্লান মাইতি। তিনিই গৈরিক আর টুসুকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ ভদ্রলোকটির সাথে। তিনিই হলেন এই বাড়ির জমিদার বংশের বর্তমান বংশধর, নাম কালীচরণ মিশ্র। তার স্ত্রী উর্মিলা দেবীও দেবরের এই আকস্মিক মৃত্যুতে যথেষ্টই বিমর্ষ। তাদের একমাত্র ছেলে চাকরিসূত্রে বিদেশে রয়েছেন। এদের সকলের সাথে গৈরিক আর টুসুর কথা হচ্ছিলো এই বাড়ির একতলার বৈঠকখানার ঘরে।

চারিদিকের পরিবেশটাকে থমথমে করে, গৈরিকের উদ্দেশে বলে উঠলেন অম্লান বাবু, “আসলে মিস্টার সেন, কালীচরণ বাবু মনে করেন যে তার ভাইয়ের মৃত্যুর পেছনে নাকি কোনো সুপারন্যাচারাল অ্যালিমেন্টের হাত আছে!”

গৈরিক কোনো কথা বললো না, সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইলো কালীচরণ বাবুর দিকে। অগত্যা টুসুই বলে উঠলো, “আপনি সবকিছু খুলে বলুন মিস্টার মিশ্র…কোন অভিশাপ, কোন অতিপ্রাকৃত কারণ আপনার ভাইয়ের মৃত্যুর পেছনে আছে বলে আপনার মনে হয়?”

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন কালীচরণ বাবু, অতঃপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ক্ষুব্ধ গলায় বলতে শুরু করলেন, “আজ থেকে প্রায় চুয়াত্তর বছর আগেকার কথা, তখন ১৯৪৫ সাল। সেই সময় আমার ঠাকুরদা, স্বর্গীয় সত্যচরণ মিশ্র ছিলেন এই গাঁয়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার তথা এই বাড়ির কর্তা। সকল গ্রামবাসীরাই তাকে মান্য করে চলতো, শুধুমাত্র কয়েকজন বাদে... অবশ্য তাদের ‘গ্রামবাসী’ না বলে, ‘আদিবাসী’ বলাই ভালো!”

“আদিবাসী?” কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো টুসু।

“এই গ্রামের শেষ প্রান্তে বেশ কয়েক ঘর সাঁওতালদের বাস…যা তখনও ছিলো, এখনো আছে। তাদের কথাই বলছি আমি,” প্রত্যুত্তর দিলেন কালীচরণ বাবু, “সেই সময় তারা মনে করতো যে তারা যে জমিতে বাস করছে, তার ওপর জমিদারের কোনো অধিকার থাকা উচিত নয়। তাই জমিদারের সাথে খাজনা দেওয়া নিয়ে এদের ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকতো!”

“এক সময় জমিদারের সাথে সাঁওতালদের এই বিবাদ তুঙ্গে উঠলো, যখন ঠাকুরদা তাদের বসতির পাশে একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থান কেটে পুকুর বানাতে চাইলেন…” বলে চললেন কালীচরণ বাবু।

তার কথা শেষ হবার আগেই টুসু জিজ্ঞাসা করলো, “গ্রামে একটা পুকুর হলে তো সকলের সুবিধাই হয়…এতে বিবাদ বাঁধলো কেন?”

গৈরিক একবার আড়চোখে চেয়ে দেখলো টুসুর দিকে, যেন বলতে চাইলো, “এত প্রশ্ন না করে, যা বলছেন তা শুনে যা।”

একটা আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো কালীচরণ বাবুর মুখে, তিনি বললেন, “তার কারণ যে স্থানে ঠাকুরদা পুকুর কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন, সাঁওতালদের মতে তাকে বলা হয় ‘জাহের’ বা ‘পবিত্র বনভূমি’ যেখানে তাদের প্রধান উপাস্য দেবতা ‘মারাং বুরু’-র বাস! এখনো এখানেই পূজা উপাসনা করে তারা, তাদের দেবতার বেদীও একটি প্রাচীন শাল গাছের নিচে এখনো উপস্থিত।”

“তবে ঠাকুরদা এদের কথায় কর্ণপাত করলেন না। তিনি পুকুরে কাটার কাজ শুরু করার জন্য সেই স্থানে লোক পাঠালে, এক পাল সাঁওতালকে নিয়ে তাদের দিকে তেড়ে এলো ওদের পালের গোদা বলরাম টুডু। জমিদারের পাঠানো লোকজনদের মেরে ধরে তাড়িয়ে দিলো তারা। ঠাকুরদার মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠলো এই খবর পেয়ে…পরের দিনই তিনি সশস্ত্র লেঠেলবাহিনী পাঠালেন সাঁওতালদের বসতিতে, তারা বেশ কয়েকটা কুঁড়েঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিলো, তছনছ করে দিলো বসতির বেশ কিছু অংশ…আর রাতের অন্ধকারে বলরামের বোন ফুলমনিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসে ঢোকালো সোজা ঠাকুরদার শয়নকক্ষে।”

“পরদিন ফুলমনির ধর্ষিত মৃতদেহটি পাওয়া যায় গ্রামের পূর্ব দিকে নদীর পারে। পুলিশকে পয়সা খাইয়ে নিজের বশে রাখা জমিদারদের কাছে খুব কঠিন কাজ নয়, তাই এই কাজের কোনো শাস্তিই হল না ঠাকুরদার। তবে সেদিন সকালেই উদ্ভ্রান্তের মত বলরাম একাই ছুটে এসেছিলো জমিদার বাড়িতে…সকলকে উপেক্ষা করে সে ঠাকুরদার সামনে চিৎকার করে বলে ওঠে,

‘আজ রাত্রেই তুই তোর পাপের সাজা পাবি, সত্যচরণ…স্বয়ং মারাং বুরু করবেন তোর বিচার! শুধু তুই না, তোর পরিবারের কেউ যদি আমাদের কোনো অনিষ্ট করতে চায় বা পবিত্র জাহেরস্থলটির দিকে একটি পাও বাড়ায়, তাহলে তাকে মারাং বুরুর আক্রোশের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। এই অভিশাপ জন্মজন্মান্তর ধরে কালো ছায়ার মত গ্রাস করে রাখবে তোর বংশকে!’

আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেদিন রাত্রেই নিজের শয়নকক্ষে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা যান আমার ঠাকুরদা। আপনারাই বলুন, যে মানুষটার কোনো হৃদরোগ ছিলো না, তার পক্ষে সম্পূর্ণ বন্ধ একটি ঘরে সেই রাত্রেই একান্তে মারা যাওয়াটা অস্বাভাবিক কি না?”

(৪)

এত কথা একসাথে বলে হাঁপাতে লাগলেন কালীচরণ বাবু। এতক্ষণ পর গৈরিক তাকে প্রশ্ন করলো, “সত্যচরণ বাবুর মৃত্যুর কি কোনো তদন্ত করা হয়েছিলো তারপর?”

“হ্যাঁ, সেই সময় যতটুকু সম্ভব ছিলো, সবকিছুই করেছিলেন ইংরেজ পুলিশ। বলরামকে গ্রেফতার করে মুখ খোলানোর জন্য অত্যাচারও করা হয়েছিলো। কিন্তু তেমন কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি তার বিরুদ্ধে…আইন তো আর বিশ্বাস করবে না মারাং বুরুর কথা! বিশেষ করে মৃত্যুটা ঘটেছে একটি বন্ধ ঘরের ভেতর, ঠাকুরদার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গিয়ে। কিন্তু সেই সময় এই ঘরে অপর কারোর উপস্থিতির প্রমাণ পাননি পুলিশ। ঠাকুরদার দেহে বা তার দ্বারা ব্যবহৃত খাবার, পোশাক-আশাক, পানীয় ইত্যাদি কোনো কিছুর মধ্যেই কোনো বিষের সন্ধানও পাওয়া যায়নি সেই সময়। বাধ্য হয়ে সকলেই মনে করে যে এটা একটা স্বাভাবিক মৃত্যু…কিন্তু আমি মনে করি না!”

থরথর করে কেঁপে উঠলো কালীচরণ বাবুর শরীরটা, যার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি কোন বিষয়কে তার ঠাকুরদার মৃত্যুর কারণ বলে মনে করেন। টুসুর যেন এবার কেমন গা ছমছম করতে লাগলো। এতক্ষণ পর অম্লান বাবু বলে উঠলেন, “বুঝলেন গৈরিক বাবু, কালীচরণ বাবু এটাও মনে করেন যে গতকাল রাতে ঘটা তার ভাই শ্যামাচরণ বাবুর মৃত্যুর পেছনেও এই সাঁওতালি দেবতা দায়ী!”

উন্মাদের মত চিৎকার করে উঠলেন কালীচরণ বাবু, “শ্যাম ছোটবেলা থেকেই কলকাতায় মানুষ হয়েছে। পড়াশোনা শিখে সেখানেই একটি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে চাকরি করছিলো। ছোটবেলা থেকেই খুব গোঁয়ার ছিলো ছেলেটা…হঠাৎ কী কুক্ষণে গ্রামে এসে ওই স্থানে বারবার যেতে লাগলো, তা ঈশ্বরই জানেন। এই নিয়ে গতকাল ওর সাথে বেশ বচসাও বাঁধে বলরামের নাতি রঞ্জনের সাথে। যেহেতু জমিদারী উচ্ছেদ হবার পরও ওই জমিটা আমাদের নামেই আছে, সেই অধিকারেই শ্যাম তাকে বলে যে এখন এই স্থানে পুকুর কেটে সে তার ঠাকুরদার ইচ্ছা পূরণ করবে। রঞ্জনও তাকে মনে করিয়ে দেয় সেই অভিশাপের কথা, কিন্তু তাতে কান দেয় না শ্যাম…”

কালীচরণ বাবুর কথা শেষ না হতেই, গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন অম্লান বাবু, “আর কাল রাতেই শ্যামাচরণ বাবুরও একই পরিণতি হয়, যা চুয়াত্তর বছর আগে তার ঠাকুরদার হয়েছিলো। একান্তে নিজস্ব বন্ধ ঘরে হার্ট-ফেল করে মৃত্যু…আজ সকালে তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ভেঙে তার শয়নকক্ষ থেকে আবিস্কৃত হয় তার মৃতদেহ। এই ক্ষেত্রেও গতকাল রাত্রে ওই ঘরে অন্য কারোর উপস্থিতির কোনো প্রমাণ আমরা এখনো অবধি পাইনি…বাকি পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল সময়ই বলবে।”

কিছুক্ষণ থেমে, বেশ বিনয়ের সুরে বলে উঠলেন অম্লান বাবু, “তবে আমি বলি কী, মিস্টার সেন, আপনি যদি এই বিষয়টি একটু খুঁটিয়ে দেখেন তাহলে খুব ভালো হয়…বুঝতেই পারছেন, এখন মাথায় যা চাপ…দরকার হলে কিছুদিনের জন্য এই বাড়িতেই আমি আপনাদের দুজনের থাকার ব্যবস্থা করতে বলছি।”

গৈরিক মুখে কিছু বললো না, শুধু নতুন কেসের আগমনে উত্তেজনায় ভরপুর টুসুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।

(৫)

এই বাড়ির দোতলায় দুটি পাশাপাশি ঘরে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে গৈরিক আর টুসুর। গতদিনের ধকলের ফলে পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হল টুসুর। বাড়ির এক পুরোনো চাকর এসে টুসুকে চা জলখাবার দিয়ে গেল। যে কোন রহস্যের সমাধানের মাঝে এক মুহূর্তের জন্যও গৈরিককে কাছ ছাড়া করতে চায় না টুসু। সে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলো। কিন্তু আশ্চর্য হল এটা দেখে, যে গৈরিকের বিছানা ফাঁকা। যাহ বাবা, এই সাত-সকালে কোথায় গেল গেরোদা!

গৈরিকের কথা ভাবতে ভাবতে তার ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়িটির প্রশস্থ বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগলো টুসু। এমন সময় রেলিং-এর কার্নিশ দিয়ে তার চোখের দৃষ্টি নিচে উঠোনের দিকে পড়তেই বেশ হকচকিয়ে গেল সে। বাড়ির মূল ফটকের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটা বেশ বড় দামী ঝাঁ-চকচকে গাড়ি। এমন গাড়ি তো গতকাল সে আগে দেখেনি এই বাড়িতে। তার মানে সে আর গৈরিক বাদেও, অপর কোনো অতিথি এসেছে নাকি এখানে? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো টুসু। এমন সময় একতলায় কালীচরণ বাবুর ঘরের বাইরে আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।

ঘরের ভেজানো দরজার ভেতর থেকে কালীচরণ বাবুর গলার স্বর ভেসে আসছে। তিনি কাকে যেন ফিসফিস করে বলছেন, “আরে মশাই, আপনার কি আর তর সয় না নাকি? এখন কিছুদিন এখানে আসা বন্ধ করুন…বললাম না বাড়িতে পুলিশের ঠিক করা গোয়েন্দা রয়েছে।”

ওপর ব্যক্তিও এই কথা শুনে কিছু একটা বলতে চলেছিলেন, ঠিক এমন সময় টুসু লক্ষ করলো, যে বাড়ির চাকরটা চায়ের ট্রে হাতে এদিকেই আসছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে সে বুঝে যাবে যে টুসু এই ঘরের দরজার বাইরে আড়ি পেতেছে। তাই বাধ্য হয়ে টুসু কেটে পড়লো সেখান থেকে।

সবুজ বনাঞ্চলের মাঝে একফালি সরু রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছিলো গৈরিক। আর একটু এগোলেই ভাঙা-চোরা কালী মন্দিরটার সামনে চলে আসবে সে। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রকৃতির মাঝে এই ধরণের প্রাতঃভ্রমণ সত্যিই খুব মনোমুগ্ধকর। এখন মন্দিরটির জীর্ণ দশা হলেও এক সময় যে এখানে জাঁকজমকের কোনো অভাব ছিলো না, এই কথা প্রমাণ করে মন্দিরের দেওয়াল থেকে খসে পড়া পোড়ামাটির কাজের অবশিষ্ট অংশগুলো। তবে পাথরের তৈরি কালী প্রতিমা যেন এখনো খুব জাগ্রত। গৈরিক দেখে অবাক হল, যে এই সাত-সকালেও একজন পৈতেধারী ধুতি পরা শীর্ণকায় ফর্সা ব্যক্তি প্রতিমার সামনেই বসে আছেন। তাহলে ইনিই কি এই মন্দিরের পুরোহিত?

মন্দির প্রাঙ্গনের চারিপাশে বেশ বড় ফুলগাছের বাগান। গোলাপ, জবা, ডালিয়া, গাঁদা, টগর ছাড়াও আরো কত নাম না জানা রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে চারিদিকে। গৈরিক মন্দিরে প্রবেশ করে নিজে থেকেই আলাপ করার চেষ্টা করলো পুরোহিতের সাথে। বয়স্ক ভদ্রলোকটির কেমন যেন উদাসীন দৃষ্টি, বিদগ্ধ মুখের চাহনি। গৈরিক নিজের পরিচয় দিলে, তিনি প্রতিনমস্কার জানিয়ে বলে উঠলেন, “নমস্কার, আমার নাম গিরিধারী আচার্য্য…আমরা বংশ পরম্পরানুসারে এই মন্দিরের পূজারী...”

কিছুক্ষণের মধ্যেই কথাপ্রসঙ্গে গিরিধারী বাবু গৈরিকের সাথে পৌঁছে গিয়েছিলেন চুয়াত্তর বছর আগে ঘটা সত্যচরণ মিশ্র-এর সেই ভয়ঙ্কর পরিণতির দিনটিতে।

(৬)

“সেই সময় আমার ঠাকুরদা, স্বর্গীয় গুরুদাস আচার্য্য ছিলেন এই মন্দিরের পূজারী। তার মুখেই ছোটবেলায় শুনেছি সেই কথা। আহা, মা কালীর কৃপায় তখন এই বাড়ির যা অবস্থা ছিল, এখন তো তার কানাকড়িও নেই! ঠাকুরদার মুখেই শুনেছিলাম কত্তাবাবুর সাথে ওই সাঁওতালদের ঝামেলার কথা... বলরামের বোন ফুলমনির কথা... আর সেই অভিশাপের কথা!” শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে কেঁপে উঠলো গিরিধারী বাবুর ঠোঁট, “ঠাকুরদা বলেছিলেন, যেদিন রাতে কত্তাবাবু মারা যান, সেদিন সকালের দিকে এই মন্দিরেই বেশ বড় করে মায়ের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজার নাকি দায়িত্ব নিয়েছিলেন তৎকালীন নায়েব মশাই এবং তাঁর ছেলে। তাই ঠাকুরদাকে গোটা দিনই ব্যস্ত থাকতে হয়।”

গৈরিক জিজ্ঞাসা করলো, “এই নায়েব মশাইটি কে ছিলেন?”

“সুধাময় মিত্র ছিলেন সেই সময়কার নায়েব… এই তো এই বাড়ির দক্ষিণ দিকে চারটে বাড়ি ছেড়ে যে বাড়িটা আছে, ওখানে এখনো ওঁদের বংশধররা থাকেন।” প্রত্যুত্তর দিলেন গিরিধারী বাবু।

কিছুক্ষণ থেমে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন গিরিধারী বাবু, “প্রতিদিনের মত, সন্ধ্যাবেলায় মায়ের আরতির সময় মন্দিরে উপস্থিত থাকতেন স্বয়ং কত্তাবাবু... সেদিনও তিনি এসেছিলেন। তবে হয়তো সকালে বলরামের দেওয়া ওই অভিশাপের কথা শুনে একটু বেশিই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন কত্তাবাবু। তিনি নিজেই সারাদিনের কাজে ক্লান্ত আমার ঠাকুরদাকে বাড়ি চলে যেতে বললেন... বললেন যে মায়ের সন্ধ্যাপূজা তিনি নিজেই করবেন।”

একটা চাপা হাহাকার যেন বেরিয়ে এলো গিরিধারী বাবুর গলা থেকে, “পাপ বাবু! পাপ কাজ করে মাকে হাজার বার ডাকলেও যে তিনি বাঁচাতে আসেন না। পাপীকে যে শাস্তি পেতেই হয়, বাবু!”

আরও কিছু কথা যেন বলতে চলেছিলেন গিরিধারী বাবু, এমন সময় মন্দির চত্বরে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলো এক বছর পঁচিশের সুদর্শন যুবক। সে গিরিধারী বাবুর দিকে তাকিয়ে রাগত কণ্ঠে চিৎকার করে বলে উঠলো, “আবার তুমি এখানে এসেছ, বাবা... তোমাকে না বারণ করেছি এখানে আসতে! সেদিন সারা গ্রামের মাঝে ওই ভাবে অপমানিত হয়েও শিক্ষা হয়নি তোমার...”

গিরিধারী বাবু করুণ দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলেন যুবকটির দিকে। এবার যেন ছেলেটির চোখ পড়লো গৈরিকের দিকে। সে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে আবার কিছু বলার আগেই, গৈরিক তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না, ভাই!”

ছেলেটি কিছু বলার আগেই গিরিধারী বাবু বিমর্ষ গলায় বলে উঠলেন, “ও আমার ছেলে, বাবু... ওর নাম গৌতম।”

“চলো বাবা... চলো এখান থেকে...” আবার গর্জে উঠলো গৌতম। এবার বেশ দৃঢ় কণ্ঠে গৈরিক তাকে বলে উঠলো, “এক মিনিট, ভাই... কেন তুমি ওনাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইছ? আর একটু আগে কোন অপমানের কথা বললে তুমি?”

গিরিধারী বাবুর মুখটা পাংশুবর্ণ হয়ে উঠলো। তিনি হয়তো ইশারায় গৌতমকে কিছু বলতে বারণ করতে চাইছিলেন, কিন্তু সেদিকে কোন পাত্তা দিলো না গৌতম। হিংস্র ভঙ্গিতে দাঁতে দাঁত ঘষে সে বলে উঠলো, “শ্যামাচরণ বাবু মারা গিয়েছেন, বেশ হয়েছে! উচিৎ শিক্ষা হয়েছে তার! এতো বছর ধরে বাবা কাজ করছেন এই মন্দিরে, শুধুমাত্র একটা ভুলের জন্য তাকে এইভাবে অপমান করতে পারলেন তিনি গোটা গ্রামের মানুষজনের সামনে!”

কাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন গিরিধারী বাবু, “ছেলেটা কলকাতার একটা ভালো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলো, শুধুমাত্র কয়েকটা টাকার জন্য সবকিছু আটকে যাচ্ছিলো। অভাবে যে স্বভাব নষ্ট হয় বাবু! মন্দিরের মায়ের গহনার বাক্সের চাবি আমার কাছেই থাকে... মায়ের সোনার নাকছাবিটা আমি... ক্ষমা করে দাও মা...” আর বলতে পারলেন না তিনি, হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

“মন্দিরের প্রতিমাও হয়তো ক্ষমা করে দিয়েছিলেন বাবাকে, শুধুমাত্র ক্ষমা করলেন না শ্যামাচরণবাবু,” বলতে লাগলো গৌতম, “বাবা যে গহনার দোকানে জিনিসটা বেচে দেন, সেই দোকানদার বুঝে গিয়েছিলেন এটা চোরাই মাল, কারণ প্রতিমার নাকে জিনিসটা তিনি আগের বছর কালীপূজার দিন দেখেছিলেন। তিনিই খবর দেন শ্যামাচরণ বাবুকে। তিনি বাবাকে সকলের সামনে যা নয় তা বলে অপমান করে মন্দির থেকে তাড়িয়ে দেন। ঠাকুরের গহনা যথাস্থানে ফেরত পাঠানো হয়…আর আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কথা না ভেবে এখন থেকেই চাকরির সন্ধান করতে শুরু করলাম... এরপরেও বাবা কেন যে এখানে...”

“সারাটা জীবন যে এই স্থানেই কাটিয়েছি আমি... শেষ সময়ে কী করে থাকি মাকে ছেড়ে, বল...” বলে উঠলেন গিরিধারী বাবু।

গৌতম বাপের কথায় পাত্তা না দিয়েই, গৈরিকের সামনেই একরকম তাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেল সেখান থেকে। তাদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে গৈরিকের কপালে দেখা দিলো চিন্তার ভাঁজ।

(৭)

“উফফ গেরোদা, আমি তোমাকে কোথায় কোথায় খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুমি এখানে দাঁড়িয়ে!” পেছন থেকে টুসুর গলার আওয়াজ পেয়ে সম্বিত ফিরে এল গৈরিকের। ততক্ষণে গৌতম আর গিরিধারী বাবু সেই সরু রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়ে তাদের দৃষ্টিশক্তির বাইরে চলে গিয়েছেন। টুসু ফাঁকা মন্দিরের ভেতরে ঢুকে প্রতিমার উদ্দেশে একটা নমস্কার ঠুকেই, গৈরিককে বলতে শুরু করলো তার সকালের অভিজ্ঞতার কথা। গৈরিকের মুখটা যেন আরো বেশি গম্ভীর হয়ে উঠলো সেই কথাগুলো শুনে।

অবশেষে টুসু বলে উঠলো, “চাকরটাকে দেখে তো আমি নিজের ঘরে চলে এলাম…কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম সেই দামী গাড়ির মালিককে। লম্বা, চওড়া, বেশ পয়সাওয়ালা লোকই মনে হল। বাড়ি থেকে হনহন করে বেরিয়ে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল…কে ছিলো লোকটা তা কে জানে!”

গৈরিক যেন এই বাড়িতে এসে অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। সে কোনো উত্তর দিলো না টুসুর কথায়, শুধু সংক্ষেপে তাকে বললো, “আয় আমার সাথে, আরেকটা জায়গায় যাওয়ার আছে!”

সত্তর বছর বয়সী সোমশঙ্কর বাবু এখন নায়েব পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম। তার একমাত্র ছেলে সস্ত্রীক কলকাতার নিবাসী। বৃদ্ধ মা বাবাকে এই গণ্ডগ্রামে একেবারেই রাখতে চায় না সে, কিন্তু নেহাৎ নাড়ির টানেই যেন এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চান না সোমশঙ্কর বাবু। তিনি এবং তার স্ত্রী কুহেলী দেবীর ব্যবহার ভারী অমায়িক। তাদের বাড়িতে বসে তাদের সাথে কথা বলতে বলতে এই কথা বুঝতে পারলো টুসু, যে তারাও শ্যামাচরণ বাবুর এই আকস্মিক মৃত্যুতে ভীষণ ভাবে শোকাহত। শুধু তাই নয়, স্মৃতির ছায়াপথ বেয়ে সোমশঙ্কর বাবুও পৌঁছে গিয়েছিলেন চুয়াত্তর বছর আগেকার সেই মর্মান্তিক দিনটিতে।

পাশের খোলা জানলার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বলে চলেছিলেন, “আমার ঠাকুরদা স্বর্গীয় সুধাময় মিত্রের মুখে শুনেছিলাম সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা। যতদিন ওদের জমিদারী ছিলো, ততদিন আমার পরিবার ওদের নুন খেয়ে এসেছে, তাই কত্তাবাবুর এমন ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে খুব ভেঙে পড়েছিলেন আমার ঠাকুরদা।”

“আচ্ছা গিরিধারী বাবু বলছিলেন,” বলে উঠলো গৈরিক, “যে সেই দিন নাকি আপনার ঠাকুরদার নামেই ওই কালী মন্দিরে পুজো রাখা হয়…”

“ঠিকই বলেছেন তিনি,” বললেন সোমশঙ্কর বাবু, “কারণ সেদিন সন্ধ্যার ট্রেনেই ছিলো আমার বাবা স্বর্গীয় রামজীবন মিত্রের কলকাতার উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা…কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন আমার বাবা…তাই এই শুভ কাজের উদ্দেশ্যে রওনা হবার আগে ছেলের কল্যাণে ওই মন্দিরে পুজো রেখেছিলেন ঠাকুরদা।”

“বাহ, তখনকার দিনে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ মনে তো বিশাল ব্যাপার!” উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো টুসু।

সোমশঙ্কর বাবুর গলায় বেজে উঠলো হতাশার সুর, তিনি বলে উঠলেন, “না মা, পাশ আর করতে পারলেন কোথায়! বছর খানেক ওখানে থেকে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আবার ফিরে এলেন গ্রামে। কেন যে মা কালী তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রইলেন তা তিনিই জানেন…ছোটবেলা থেকেই গ্রামের এক বৈদ্যের কাছ থেকে কবিরাজি বিদ্যা শিখেছিলেন বাবা, গ্রামে ফিরে সেই বিদ্যাই কাজে লাগলেন অর্থোপার্জনের জন্য…”

এবার বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো গৈরিক, “আপনার কী মনে হয়, এই দুটি মৃত্যুর পেছনে কি সত্যিই কোনো অতি-প্রাকৃত শক্তি কাজ করছে?”

টুসুর বুকটা ধক করে উঠলো প্রশ্নটা শুনে। অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন বৃদ্ধ, “দেখুন, সত্যচরণ বাবুর মৃত্যুর সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে পারবো না, তবে শ্যামাচরণের মৃত্যুর পেছনে কোনো অতি-প্রাকৃত শক্তির হাত না থাকলেও, কিছু মানুষের স্বার্থ তো অবশ্যই জড়িয়ে আছে। খুব সহজেই বোঝা যায়, যে এরপর সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা পাবেন তার দাদা কালীচরণ…এছাড়াও…”

গৈরিক আর টুসুর জিজ্ঞাসু মুখের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ থেমে বলতে লাগলেন সোমশঙ্কর বাবু, “ইদানিং মনোহর বসাক নামক এক ধুরন্ধর প্রমোটারকে দামী গাড়ি করে প্রায় দেখতাম ওই বাড়িতে যেতে। স্টেশনের কাছেই অবস্থিত ওর বিশাল বড় বাড়ি এবং অফিস। পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখে শুনেছি, যে তিনি নাকি জমিদার বাড়িটি কিনে এই স্থানে প্রাকৃতিক শোভার মাঝে সেটাকে একটি মনোরম হোটেলে পরিবর্তিত করতে চান…কালীচরণ তার কথায় রাজিই ছিলো, শুধু বাধ সাধছিলো শ্যামাচরণ!”

“তার মানে আজ সকালে আমি যাকে দেখেছি, সে নিশ্চয় ওই মনোহর বসাক!” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো টুসু।

আর কয়েকটা অল্প-বিস্তর কথা বার্তা বলে সোমশঙ্কর বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো গৈরিক আর টুসু।

(৮)

“হ্যাঁ গৈরিক বাবু, আমি মানছি যে আপনি আমার আর মনোহর বসাকের সম্বন্ধে যা শুনেছেন তা সত্যি। আমি জানতাম যে এই কথা জানতে পারলে আপনাদের সন্দেহের দৃষ্টি আমার ওপরই উঠবে, তাই আজ সকালে ওকে এখানে আসতে বারণ করেছিলাম!” উত্তেজিত কণ্ঠে বলে চলেছিলেন কালীচরণ বাবু, “এই কথা সত্যি যে আমিও চাইছিলাম এই বাড়ি মনোহর বাবুর হাতে সপে দিয়ে তাঁর দেওয়া ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠি, কিন্তু শ্যাম এতে রাজি ছিলো না। তাই কলকাতা থেকে এখানে ফেরার পর ওর সাথে আমার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিলো, খুব একটা কথাও হত না ওর সাথে…কিন্তু বিশ্বাস করুন, এতকিছুর পরেও, দাদা হয়ে ছোট ভাইকে… না মিস্টার সেন, না…” কেঁপে উঠলো কালীচরণ বাবুর গলা।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। এর মধ্যে গোটা বাড়িটাকে যেন মনে হচ্ছে রূপকথার দৈত্যপুরী। সন্ধ্যার চা-পর্বের মাঝেই গৈরিক আর টুসুর কথা হচ্ছিলো কালীচরণ বাবুর সাথে। গৈরিক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর তাকে বলে উঠলো, “ঠিক আছে, মানলাম আপনার কথা। কিন্তু একটা অনুরোধ আছে আপনার কাছে, আমরা আপনার ভাইয়ের ঘরটা একটু দেখতে চাই।”

চা খাওয়া হয়ে গেলে কালীচরণ বাবু গৈরিক আর টুসুকে নিয়ে গেলেন এই বাড়ির দোতলার একটা ঘরে। তার বাইরে ভেজানো দরজার কাছে এসে কালীচরণ বাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আপনাদের যা দেখার তা দেখুন। আমি এই ঘরে একটা মুহূর্তও থাকতে চাই না…” এই বলে কোনো প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি সেখান থেকে বিদায় নিলেন।

সেই ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে টুসু কেমন যেন একটা আড়ষ্ট ভাব উপলব্ধি করলো নিজের সর্বশরীরে। গৈরিক এগিয়ে গেল ঘরটির ভেতর। ঘরের আলো জ্বেলে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঘরের চারিপাশে। মাঝারি আকারের ঘর, পেছনের দেওয়ালে বিশাল বড় একটি জানালা, একটি বইয়ে ঠাসা শো-কেস, একটি পড়ার টেবিল ও তার পাশে ইজি-চেয়ার এবং অদূরে রয়েছে একটি সেগুন কাঠের পালঙ্ক। এই ঘরের দরজা ভেঙে এর ওপর থেকেই শ্যামাচরণ বাবুর মৃতদেহ আবিষ্কার করে এই বাড়ির লোকজন, এই কথা ভেবেই আতঙ্কে শিউরে উঠলো টুসু।

গৈরিক এদিক সেদিক ঘুরে, সেই পড়ার টেবিলের কাছে এগিয়ে এলো। সেখানে বেশ কিছু খাতাপত্র রাখা হয়েছে। শ্যামাচরণ বাবুর ল্যাপটপটাও রয়েছে সেখানে। টুসু সেই ঘরের পালঙ্ক থেকে যতটা সম্ভব দূরে গিয়ে শো-কেসের বইগুলিকে দেখতে লাগলো। অধিকাংশই ইতিহাসের বই, মানে যে বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন শ্যামাচরণ বাবু। ঠিক এমনই সময় পড়ার টেবিলে থেকে একটি ডাইরি তুলে নিলো গৈরিক, তার মনে হল যেন কোনো শক্ত বস্তু লুকিয়ে আছে তার দুটি পাতার মাঝে। একটু চেষ্টা করেই জিনিসটাকে ডায়েরির পাতার ফাঁক থেকে বের করে নিলো গৈরিক। সেটা একটা সরু সোনার হার, যার একপাশে রয়েছে একটি লকেট! টুসু বুঝতেও পারলো না, কোন মুহূর্তে গৈরিক সেটাকে নিজের পকেটে চালান করলো।

টুসুর শো-কেসের বই দেখা হয়ে গেলে, সে এগিয়ে এলো গৈরিকের কাছে। সে দেখলো গৈরিক গম্ভীর হয়ে ডায়েরিটার একটি খোলা পাতার দিকে মনোনিবেশ করে আছে। টুসুও আগ্রহের সাথে হুমড়ি খেয়ে দেখতে পেলো, যে সেই ডায়েরির পাতার মুক্তের মত অক্ষরে লেখা রয়েছে একটি ছড়া:

“জাহের বনে ঘুমন্ত সে,

রঙটি যে তার কালো;

সামনে এলে দেখতে পাবে,

চতুর্দিকেই আলো।

তবে হও সাবধান,

বাঁচাতে চাইলে প্রাণ;

জানবে যে তার কানের সাজে,

সন্তর্পণে লুকিয়ে আছে,

অপরূপ এক মৃত্যুবাণ!”

(৯)

সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না টুসু। কে ঘুমিয়ে আছে ‘জাহের’ বনে? সে কি সেই সাঁওতালি দেবতা ‘মারাং বুরু’? হতেও পারে, কারণ এই কথা সত্যি যে সাঁওতালি সম্প্রদায়ের মানুষদের চামড়ার রঙ কালো হয়! আর সে কাছে এলে চতুর্দিক আলোকিত হয়ে ওঠে, এই কথারই বা মানে কী? তার কানের সাজেই বা কোন অপরূপ মৃত্যুবাণ লুকিয়ে আছে? এই সকল প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে উঠেছিলো টুসুর মস্তিস্ক। তবে এই বিষয়ে সে নিশ্চিত, যে শ্যামাচরণ বাবুর ডায়েরিতে লেখা এই ধাঁধাটার নিশ্চয় কোনো সম্পর্ক আছে এই পরিবারের মৃত্যুগুলোর সাথে!

গভীর রাত অবধি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে টুসু বুঝতেও পারলো না, যে এই সময় দুটি ছায়ামূর্তি অতি সন্তর্পণে এগিয়ে এলো এই বাড়ি থেকে কিছু দূরে অবস্থিত সেই ‘জাহের’ বনের মাঝে!

পরদিন সকালে, স্টেশনের কাছেই অবস্থিত প্রমোটার মনোহর বসাকের হাল-ফ্যাশানে তৈরি তিনতলা বাড়িটার একতলায় তার অফিস ঘরে বসেছিলো গৈরিক আর টুসু। বাড়িতে গোয়েন্দার পদধূলি পড়ায় তিনি যে বিন্দুমাত্র খুশি হননি, তা তাঁর মুখ চোখের অভিব্যক্তি দেখেই বোঝা যায়। বেশ স্পষ্ট কণ্ঠে নানা ইংরাজি শব্দ উচ্চারণ করে তিনি বলে চলেছিলেন, “আপনি আমার এবং কালীচরণ বাবুর সম্পর্কে যা শুনেছেন, তা সকলই সত্যি। হ্যাঁ, ওই বাড়িটার একটা হিস্টোরিক্যাল ভ্যালু আছে, তাছাড়া ওটার লোকেশনটাও খুব আইডিয়েল, ওখানে একটা হোটেল ডেভেলপ করার জন্য। তাই আমি ওটা কিনতে চেয়েছিলাম, বিনিময়ে ওদের দুই ভাইকে দুটি সেপারেট ফ্ল্যাট দেওয়ার কথাও বলেছিলাম…কিন্তু কালীচরণ বাবু এতে রাজি হলেও শ্যামাচরণ বাবুকে হ্যান্ডেল করা খুব টাফ মনে হচ্ছিলো!”

এই কথা শুনে গোয়েন্দা কেন, যে কোনো মানুষেরই সন্দেহ মনোহর বসাকের ওপর আসতে পারে। তাই গৈরিক বা টুসুর কিছু বলার আগেই তিনি আবার বলে উঠলেন, “দেখুন মিস্টার সেন, আমি খুব স্পষ্ট কথার মানুষ। শ্যামাচরণ বাবুর মৃত্যুতে আমার বেনেফিট হলেও, আমি কিন্তু কোনো ভাবেই এর জন্য রেসপনসিবল নই…এন্ড আই রিয়েলি মিন হোয়াট আই সে!”

গৈরিক প্রসঙ্গ পাল্টে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনিও কি মনে করেন, যে এই পরিবারের মৃত্যুগুলোর পেছনে কোনো অতি-প্রাকৃত শক্তি কাজ করছে?”

একটু ক্রুর হাসি খেলে গেল মনোহর বাবুর মুখে, তিনি বললেন, “ওয়েল, নো কমেন্টস অন দ্যাট…কিন্তু একটা কথা বলতে পারি, যে এই শ্যামাচরণ বাবু কিন্তু ধোঁয়া তুলসী পাতা ছিলেন না! বিয়ে না করলেও নারীসঙ্গের অভাব ছিলো না তার…আরে, এই তো সাঁওতাল পল্লীটা পেরিয়ে, গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে এখানকার একটি রেড-লাইট এরিয়া আছে... গ্রামের লোকেদের কাছেই শুনেছি, যে সেখানকার ময়না নামের একটি মেয়ের সাথে শ্যামাচরণ বাবুর সে কী ঢলাঢলি!”

মনোহর বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে টুসুর যেন মাথা ঘুরতে লাগলো কেসটার কথা ভেবে। কত অসংখ্য চরিত্র ধীরে ধীরে যুক্ত হয়ে উঠছে দুটি মৃত মানুষকে কেন্দ্র করে!

(১০)

আবর্জনায় ভরা সরু গিঞ্জি গলিটার দুপাশে সারি সারি টিনের ঘর। এখন দুপুর বেলা, তাই এই নিষিদ্ধ পল্লীর বেশিরভাগ মেয়েদের জন্য এটা মক্কেল ধরার উপযুক্ত সময় নয়। তবুও কয়েকটি ঘরের সামনে উগ্র সাজগোজে ভূষিত কিছু মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকলেরই চোখ গৈরিক আর টুসুর দিকে। এমন সময় একটি পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজে সচকিত হয়ে পেছন ফিরে তাকালো গৈরিক। একজন হৃষ্টপুষ্ট কালো চেহারার লোক, হাঁটু ছেঁড়া জিন্স আর ডোরাকাটা গেঞ্জি পরে, এক মুখ গুটখা নিয়ে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। সে কুচ্ছিত ভাবে হেসে টুসুকে দেখিয়ে গৈরিককে বলে উঠলো, “কী দাদা, নতুন মাল তুলবেন বুঝি?”

রাগে গৈরিকের ফর্সা কানদুটি লাল হয়ে উঠলো। সে তৎক্ষণাৎ সেই লোকটিকে নিজেদের পরিচয় দিলে, তার মুখটি চুপসে এতটুকু হয়ে গেল। সে আমতা আমতা করে বলে উঠলো, “সরি দাদা…মাফ করবেন, ঠিক বুঝতে পারিনি… আমি এখানকার এক দালাল, আমার নাম রজত… তবে স্যার, আপনারা এখানে কেন? কোনো লোচা হয়েছে বুঝি?”

“এখানে ময়না বলে কে আছে? তার সাথে দেখা করতে চাই আমি।” দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো গৈরিক। লোকটি যেন চমকে উঠলো এই নাম শুনে, তবুও থতমত খেয়ে তাদেরকে ইশারা করে সামনের একটি টিনের ঘর দেখিয়ে দিলো।

গায়ের রঙ ফর্সা হলেও, অত্যন্ত সাধারণ চেহারার অধিকারিণী, ময়না নামক এই যৌনকর্মীটি বেশ জবুথবু হয়ে বসে ছিল গৈরিকের সামনে। তার ছোট্ট ঘরটির এক পাশে একটি দড়ির খাটিয়ার বিছানা, অন্যদিকে রাখা রয়েছে একটি ছোট টিভি। তার একপাশে রান্নার সরঞ্জাম। ঘরের অপর দিকে রয়েছে একটি ছোট্ট ড্রেসিং-টেবিল এবং তার সামনে রাখা রয়েছে বেশ কিছু ক্রিম, বডি-লোশন, পারফিউমসহ নানা প্রসাধনী সামগ্রী।

গৈরিক এই ঘরের চারিপাশে ঘুরে দেখছিলো, ওদিকে ময়না করুণ স্বরে বলে চলেছিলো, “খারাপ মানুষ ছিলেন না শ্যামাচরণ বাবু... অন্যান্য বাবুদের মত নন, যারা শুধু আমার শরীরটাকেই চেনেন, মনটাকে নয়! হয়তো ওনার মনেও আমার জন্য কিছু জায়গা ছিল… যে রাত্রে তিনি মারা গেলেন, সেদিন সন্ধ্যা বেলাও এসেছিলেন আমার কাছে। বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে তিনি ছিলেন সেই দিন!”

ময়নার ড্রেসিং-টেবিলের আয়নায় নিজের চুল ঠিক করতে করতে গৈরিক বলে উঠলো, “কীসের দুশ্চিন্তা?”

“ওনার দুশ্চিন্তার কারণ ছিল ওই সাঁওতালদের পাণ্ডা, রঞ্জন টুডু! ওদের বসতির পাশের জমিটা শ্যামাচরণ বাবুদের নামে থাকলেও ওরা সেটাকে জবর দখল করে রেখেছিলো... বাবু চেয়েছিলেন ওখানে একটা পুকুর তৈরি করে তার ঠাকুরদার ইচ্ছা পূরণ করতে, কিন্তু রঞ্জন আর তার দলবল তাকে বাধা দিচ্ছিলো, সেই অভিশাপের কথা বলে ভয় দেখাচ্ছিলো... কে জানে ওনার মৃত্যুর পেছনে ওদেরই হাত আছে কিনা!”

গৈরিক বেশ কিছুক্ষণ ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েই কী যেন ভাবতে লাগলো। আরও বেশ কিছু কথা বলে অবশেষে ময়না বলে উঠলো, “তাহলে বাবু, আর কিছু আপনাদের জিজ্ঞাসা করার আছে আমাকে?”

গৈরিক যেন সম্বিত ফিরে পেল এই কথা শুনে, অতঃপর সে ময়নাকে বিদায় জানিয়ে টুসুকে নিয়ে বেরিয়ে এলো সেই ঘর থেকে। রজত যেন তাদেরই জন্য ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছিলো, তবে তাদের দেখতে পেয়ে কিছু না বলেই কেটে পড়লো সে।

সেদিন বিকালের দিকে মিশ্র বাড়ি ফিরে, টুসু বেশ আহ্লাদ করে ছুটে গেল কালী মন্দিরের পাশে ফুল বাগানের মাঝে। সেখানে একটি মাঝারি আকৃতির ফুলগাছের ঝোপের ডালে ডালে খুব সুন্দর দেখতে থোকা থোকা লাল গোলাপী ফুল ফুটে আছে। টুসু মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সেই দিকে। তারপর গৈরিককে বলে উঠলো, “গেরোদা, এই গাছটার কাছে আমার একটা ফটো তুলে দাও না, প্লিজ!”

গৈরিক হাসি মুখে নিজের মোবাইল ফোনে টুসুর বেশ কয়েকটা ছবি তুলে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো সেই দিকে। তার মাথায় যে এখন কী চলছে, সেটা টুসুর বোঝার সাধ্যের বাইরে।

এমন সময় হঠাৎ করেই বেজে উঠলো গৈরিকের মোবাইলটা। টুসু দেখলো, যে গৈরিক ফোনটা কানে তুলে বলে উঠলো, “হ্যাঁ অম্লান বাবু... বাহ, শ্যামাচরণ বাবুর মোবাইল রেকর্ড চলে এসেছে... আর পোস্ট মর্টেম রিপোর্টও!”

পরের কথাগুলো শুনে কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল গৈরিকের মুখ। সে আবার বলে উঠলো, “শুনুন অম্লান বাবু, আপনি এখনই বডি ডিসচার্জ করবেন না...” এই কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে হনহন করে এগিয়ে গেল গৈরিক। বেচারি টুসুর আর তার পরের কথাগুলো শোনা হল না!

(১১)

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়েছে শাল বনে। বইতে শুরু করেছে মৃদু হিমেল হাওয়া। দীর্ঘকায় শাল গাছগুলো যেন মূর্তিমান অশরীরীর সারির মত দাঁড়িয়ে আছে চারিপাশে। এক শিহরণকারী নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে গোটা বনাঞ্চলকে, কোনো পাখির ডাকও ভেসে আসছে না কানে। সামনের সুপ্রাচীন একটি শাল গাছের নিচে পোঁতা রয়েছে একটি সুবিশাল পাথরের চাঁই। তার গায়ে জড়ানো নানাবিধ শুকনো ফুলের মালা, হলুদ এবং সিঁদুরের প্রলেপও চোখে পড়ে তার বিভিন্ন অংশে। এছাড়া এই স্থানে বলি দেওয়া হাঁস-মুরগির শুকনো রক্তের ছিটেফোঁটাও এই পাথরের গায়ে লেগে থাকা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। ‘মারাং বুরু’ পাহাড়ের দেবতা, এবং এই ‘জাহের’ বনে এই পাথরটিই হল তার প্রতীক!

“প্রায় আধ ঘন্টা হয়ে গেল, গেরোদা… এখনো তো রঞ্জন টুডুর দেখা নেই!” পাথরটিকে দেখতে দেখতে অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো টুসু, “তাহলে কি এখানে আমাদের সাথে দেখা করতে আসার যে কথাটা সে তোমাকে ফোনে বলেছে, সেটা পুরোটাই ঢপ!”

কথা প্রসঙ্গে নিজের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা গৈরিকের দিকে ঘুরে গিয়ে আরো কিছু বলতে চলছিলো টুসু, কিন্তু হঠাৎ সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো, “গেরোদাআআআ…”

গৈরিক নিমেষে বুঝতে পারলো টুসুর উত্তেজনার কারণ, সে সটান মাথা নিচু করে বসে পড়লো মাটির ওপর। আর তখনই গৈরিকের পেছন থেকে, লাঠি হাতে তার মাথায় আঘাত করতে উদ্যত একটি সাঁওতাল লোক তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো পাশের ঝোঁপের ভেতর!

সেই মুহূর্তে কোথা থেকে আরো একজন সাঁওতাল লোক ছুটে এসে লাঠি হাতে আঘাত করতে গেল গৈরিককে, কিন্তু কেরাটে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত টুসু ছুটে এসে শূন্যে একটা ভোল্ট খেয়ে সটান পারলো এক লাথি লোকটার বুকে। লোকটা ছিটকে পড়লো পাথরের ফলকটির গায়ে। সাথে সাথে পাথরটির নিচের অংশ মাটি থেকে বেরিয়ে এসে লোকটির সাথেই অদূরে গড়িয়ে পড়লো। “ওয়েল ডান, টুসু…গুড স্টান্ট!” হাততালি দিয়ে বলে উঠলো গৈরিক। এবার আরো দুজন লোক বেরিয়ে এলো পাশের একটা ঝোঁপের ভেতর থেকে, তাদের মধ্যে একজন ছুটে এসে টুসুকে আঘাত করতে উদ্যত হলে, গৈরিক নিজের কোমরে গোঁজা পিস্তলটি বার তাক করলো অপর সাঁওতালি লোকটাকে দিকে।

“খবরদার রঞ্জন, আমাদের মেরে কিন্তু পার পাবে না তুমি!” গর্জে উঠলো গৈরিক। রঞ্জন টুডুর ইশারায় থেমে গেল অপর লোকটি।

“এতদিন ধরে আপনারা মেরে এসেছেন আমাদের…এবার আমাদের পালা!” হিংস্র গলায় বলে উঠলো রঞ্জন, “কী ভেবেছেন আপনারা, শ্যামাচরণ বাবুকে শাস্তি দিয়েছেন স্বয়ং আমাদের দেবতা, তার দায় বুঝি আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চান আপনি?”

“তোমার সাথে যে তার খুব একটা সুসম্পর্ক ছিলো না, এই কথা গ্রামের সকলেই জানে, রঞ্জন!..তবে আমি কিন্তু একবারও বলিনি যে শ্যামাচরণ বাবুর মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী! এখনো অবধি তো এটাই বোঝা যায়নি যে তার মৃত্যুটা সত্যিই অস্বাভাবিক কি না!” বলে উঠলো গৈরিক।

রঞ্জনের ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মুখে থাকা ছোট ছোট দুটি চোখের ক্রুদ্ধ ভাব যেন কিছুটা কমে গেল এই কথা শুনে, সে বলে উঠলো, “বিশ্বাস করুন বাবু…স্বয়ং ‘মারাং বুরু’-র দিব্যি করে বলছি, আমি সত্যিই ওনার মৃত্যুর সম্বন্ধে কিচ্ছু জানি না! আমরা কোনো অশান্তি চাই না, শুধু গ্রামের এক প্রান্তে আমাদের দেবতাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই…” যেন গলাটা ধরে এলো রঞ্জনের।

“বেশ, সে না হয় বিশ্বাস করলাম তোমার কথা…তবে আমাকে একটা কথা বলো, তোমরা কবে থেকে তোমাদের দেবতাকে এখানে দেখে আসছো?” জিজ্ঞাসা করলো গৈরিক।

“বাপ ঠাকুরদার মুখে শুনেছিলাম যে সেটা বোধহয় ছিলো সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়! এই গ্রাম থেকে আমাদের বেশ কিছু পূর্বপুরুষ যুক্ত ছিলেন এই আন্দোলনে। এক রাত্রে এই স্থানে দেবতার ফলক প্রতিষ্ঠা করে তার পূজা করেছিলেন তারা। তবে তার কিছু পরেই ইংরেজ পুলিশের গুলিতে তাদের সকলের প্রাণ যায়। সেই সময় থেকেই এই স্থান আমাদের কাছে পবিত্র ‘জাহের’ ভূমিরূপে পরিচিত।”

সেই রাত্রে রঞ্জন বা তার দলের লোকজনের সাথে গৈরিক আর টুসুর খুব বেশি কথাবার্তা হয়নি। দুই পক্ষই ফিরে গিয়েছিলো নিজ নিজ বাসস্থানে।

(১২)

পরদিন সকালে আবার দেরি করে ঘুম ভাঙলো টুসুর। গৈরিক যে তাকে এই অপরিচিত জায়গায় একা ফেলে কোথায় বেরিয়ে গিয়েছে, তা সেই জানে। তাকে একবার ফোন করেছিলো টুসু, সে শুধু বলেছিলো, “একটু কাজ আছে রে, আসতে দেরি হবে।” সারাটা দিন এই কেসের সম্বন্ধেই ভেবে চললো টুসু। একই পরিবারে ঘটা দুটি মৃত্যু যাদের মধ্যে ব্যবধান চুয়াত্তর বছর! এখনো সেগুলির মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতার সন্ধান পাওয়া যায়নি! তবে দ্বিতীয় মৃত্যুর ফলে স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে বেশ কিছু মানুষের, কাকে ছেড়ে কাকে সন্দেহের তালিকায় আনবে টুসু? আর সবশেষে তো ‘মারাং বুরু’-র অলৌকিকতা আছেই, আছে ডায়েরির পাতায় লেখা সেই অদ্ভুত ছড়া! এমন জটিল কেস বোধহয় টুসু আগে কখনো দেখেনি। কী জানি, গেরোদা পারবে তো এই কেসের সমাধান করতে!

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় অতি সন্তর্পণে কলকাতাগামী ট্রেনের উদ্দেশ্যে ভদ্রপুর স্টেশনে এলো এক মুসলমান দম্পতি। পুরুষটির পরনে পাজামা পাঞ্জাবী, মেহেন্দি করা চুল দাড়ি, চোখে সুরমা, মাথায় তাকিয়া, হাতে বড় একটি সুটকেস। নারীটির সর্বাঙ্গ বোরখায় আবৃত। তারা টিকিট কেটে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের একটি কামরায় উঠে নিজেদের জায়গায় বসে পড়লো। এই সময় খুব বেশি ভিড় হয় না ট্রেনে। কয়েকজন মাত্র যাত্রী বসে আছে এদিকে ওদিকে। সামনেই একজন ধোপ-দুরস্ত ধুতি পাঞ্জাবী পরা বাঙালী ভদ্রলোক বসে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে এই ট্রেন, এই কথা ঘোষিত হল স্টেশন চত্বরে।

চারিদিকটা একবার দেখে নিয়ে, ফিসফিস করে মুসলমান মহিলাটি তার পুরুষ সঙ্গীর কানে বলে উঠলো, “এত তাড়াতাড়ি করা ঠিক হল কি? আর কিছুদিন এখানে থাকলে ভালো হত না? কাল থেকে যখন সকলে জানবে যে আমরা নিখোঁজ, তখন তো সকলের সন্দেহ আমাদের দিকেই আসবে!”

“তুমি কোনো চিন্তা করো না…ততক্ষণে কেউ আমাদের টিকিটাও ছুঁতে পারবে না!” বলে উঠলো পুরুষটি।

হঠাৎ সামনে বসা বাঙালী ভদ্রোলকের মুখে খেলে গেল একটি মুচকি হাসি। সত্যিই, এই বাঙালী ফুলবাবুর সাজে পুলিশ অফিসার অম্লান মাইতিকে চেনে কার সাধ্য! তিনি পকেট থেকে নিজের সার্ভিস রিভলবারটি বার করে সেটাকে তাক করলেন সামনে বসা মুসলমান দম্পতির দিকে। তারপর বলে উঠলেন, “সম্পূর্ণ ভুল ধারণা! টিকি সমেত সশরীরে যে তোমরা দুজন এখন আমাদের হাতের মুঠোয়!” ঠিক সেই সময় আরো বেশ কিছু সাদা পোশাকের পুলিশরা এসে ঘিরে ধরলো এদের দুজনকে। বাকি যাত্রীরা হাঁ করে চেয়ে রইলো তাদের দিকে। কেউ একজন চেন টেনে থামিয়ে দিলো সদ্য চলতে থাকা ট্রেনের গতি। আরেকজন এসে হ্যান্ডকাফ পরাতে শুরু করলো সেই দম্পতির হাতে।

নিজের মোবাইল ফোনটা বার করে, খুশি মনে সেটাকে কানে রেখে বলে উঠলেন অম্লান বাবু, “অভিনন্দন গৈরিক বাবু, আপনার প্ল্যান সাকসেসফুল। আপনার কথামত ময়না আর রজতকে গ্রেফতার করতে পেরেছি আমরা!”

(১৩)

সেদিন রাতে গৈরিকের নির্দেশে মিশ্র বাড়ির বিস্তীর্ণ আঙিনায় একে একে জমায়েত হয়েছে এই নাটকের সমগ্র চরিত্র। গৈরিক আর টুসুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাড়ির কর্তা সস্ত্রীক কালীচরণ মিশ্র, প্রমোটার মনোহর বসাক, পূজারী গিরিধারী আচার্য্য ও তার ছেলে গৌতম, নায়েব পরিবারের বংশধর সস্ত্রীক সোমশঙ্কর মিত্র এবং গ্রামের সাঁওতাল বসতির পান্ডা রঞ্জন টুডু। এছাড়া পুরো টিম নিয়ে হাজির হয়েছেন পুলিশ অফিসার অম্লান মাইতি, তাদের মাঝেই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে মুসলমানের ছদ্মবেশধারী যৌনকর্মী ময়না এবং নিষিদ্ধ পল্লীর দালাল রজত।

গভীর নিস্তব্ধতা চারিদিকে, সকলের দৃষ্টিই গৈরিকের দিকেই নিবদ্ধ। গৈরিক বলতে শুরু করলো, “সবার প্রথমে বলবো, যে আমার তদন্ত অনুযায়ী সত্যচরণ বাবু এবং শ্যামাচরণ বাবুর মৃত্যুদুটি একেবারেই স্বাভাবিক নয়। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে তাদের দুজনকেই খুন করা হয়েছে... এবং এর পেছনে কোন অশরীরী দেবতার হাত নেই... এর জন্য দায়ী হল কিছু সুচতুর মনুষ্য মস্তিস্ক!”

“প্রথমে আসি, আজ থেকে চুয়াত্তর বছর আগে ঘটে যাওয়া জমিদার সত্যচরণ মিশ্রের অদ্ভুত মৃত্যুরহস্য বিশ্লেষণে। এই ক্ষেত্রে যেহেতু সেই সমসাময়িক কোন মানুষ আজ আর ইহলোকে জীবিত নেই, সেহেতু কিছুটা আন্দাজ এবং কিছুটা অতীতের পাতা থেকে উঠে আসা প্রমাণের ওপর নির্ভর করেই আমাদের এগোতে হবে। পাওয়া যাবে না অপরাধীর নিজমুখে করা স্বীকারোক্তি।”

একটু থামলো গৈরিক, সকলে যেন রুদ্ধশ্বাসে তার কথা গিলছে। আবার বলতে শুরু করলো সে, “সত্যচরণ বাবুর মৃত্যুটা ঘটেছিলো তার বন্ধ শয়নকক্ষের ভেতর। সেই ঘরে তার মৃত্যুর সময় অপর কারোর উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারেনি কেউ, আমিও মেনে নিচ্ছি এই কথা... তার শরীরে এবং তার দ্বারা ব্যবহৃত খাদ্য, পানীয়, পোশাক-আশাক ইদ্যাদিতেও কোন বিষাক্ত পদার্থের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেই সমসাময়িক মানুষ হলে আমিও এই কথা মেনে নিতে বাধ্য হতাম, কারণ তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনকার মত এত উন্নত হয়নি! তবে তার মৃত্যুটা এই যুগে হলে, একটু কাঠ-খড় পোড়ালেই পাওয়া যেত সেই বিষের সন্ধান, যার হদিস মিলেছে শ্যামাচরণ বাবুর পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টেও!”

“চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমরা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের সন্ধান পাই যাদের বলা হয় ‘কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড’। এই গোত্রের পদার্থগুলি হৃদ-রোগে আক্রান্ত মানুষদের হৃদপিণ্ডের সংকোচনের গতি বাড়াতে সাহায্য করে, তাই সেই জাতীয় ওষুধে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কোন সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করলে, এই পদার্থগুলি হৃদপিণ্ডের সংকোচন এতটাই বাড়িয়ে দেয়, যে সেটা আর প্রসারণ করার সুযোগ পায় না। ফলে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মৃত্যু অনিবার্য। তবে মানব দেহে প্রবেশ করার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর এই পদার্থগুলি তাদের প্রতিক্রিয়া দেখায়!”

“এখন প্রশ্ন হল, এই পদার্থ সত্যচরণ বাবুর শরীরে প্রবেশ করলো কীভাবে? তিনি তো সেই রাত্রে খাবারই খাননি। আমার বিশ্বাস, হত্যাকারী এই বিষ বহনকারী কিছু বস্তু রেখে দিয়েছিলেন কালী মন্দিরের ধুনচির মধ্যে! মনে করে দেখুন, সেই দিন তিনি নিজে হাতে একাই সন্ধ্যা-আরতি দিয়েছিলেন মন্দিরে, এবং ধুনচির মধ্যে রাখা নারকলের ছোবার ভেতরে থাকা সেই বস্তুর প্রতি স্বাভাবিক ভাবে কারোরই দৃষ্টি আকর্ষিত হবে না। ফলে সেটা জ্বালানোর পর, ধুপ ধুনোর গন্ধের সাথে সেই বিষাক্ত পদার্থও গ্যাসীয় আকৃতিতে নিশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করতে থাকে সত্যচরণ বাবুর শরীরে!”

উত্তেজনায় টুসুর প্রায় ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা। সে কোন মতে বলে উঠলো, “সেটা কী পদার্থ, গেরোদা?”

গৈরিক মৃদু হেসে, নিজের মোবাইল ফোনটা বার করে সকলের দিকে তুলে ধরলো। তার স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে টুসুর অনুরোধে, গতকাল বিকালে গৈরিক টুসুর সেই ফুলগাছের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় যে ছবিগুলো তুলেছিলো, তার একটি! সকলে অবাক হয়ে বলে উঠলো, “তার মানে এই গাছই হল সেই মৃত্যুবাণ!”

“করবী বা ‘ওলিয়েন্ডার’ (বিজ্ঞান-সম্মত নাম ‘Nerium oleander’) হল এমনই একটি গাছ যা পথে ঘাটে বা যেকোনো ফুলের বাগানে হামেশাই চোখে পড়ে। কিন্তু এই গাছের প্রতিটি অংশেই থাকে ‘ওলিয়েন্ড্রিন’ নামক এক ‘কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড’। আগুনে পোড়ালেও এই পদার্থ বিভাজিত হয় না, বরং গ্যাসীয় আকারে সেই স্থানে ছড়িয়ে পড়ে! অপরাধী সম্ভবত এই বাগান থেকেই সংগ্রহ করা এই গাছেরই কিছু ডাল লুকিয়ে রেখেছিলো ধুনচির মধ্যে!”

“কিন্তু কে করেছিলো এই কাজ এবং কেন?” উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন কালীচরণ বাবু।

“আমার বিশ্বাস, তারা আর কেউ নয়... তৎকালীন নায়েব মশাই, সুধাময় মিত্র এবং তার ছেলে রামজীবন!” গর্জে উঠলো গৈরিক।

“এ কী বলছেন আপনি? আপনার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা আনবো আমি...” চিৎকার করে উঠলেন সোমশঙ্কর বাবু।

“সেটা করার আগে একবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, সোমশঙ্কর বাবু... আপনার বাবা কোনকালেই প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সুযোগ পাননি, সেই বছরে ওই কলেজে ভর্তি হওয়া সকল ছাত্র-ছাত্রীর তালিকা আমি ইতিমধ্যেই কলেজের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জোগাড় করেছি। তাহলে সকল গ্রামবাসীদের কাছে এই মিথ্যা কথা রটিয়ে এক বছর তার কলকাতায় থাকার দরকার কেন হয়েছিলো বলুন?” দৃঢ় গলায় বলে চললো গৈরিক।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন সোমশঙ্কর বাবু, তারপর সকলকে অবাক করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। গৈরিক বলেই চললো, “এর দুটি কারণ... এক, বিকালের কালী পুজো হয়ে গেলে, পুরহিতের চোখে ধুলো দিয়ে কোন এক অছিলায় ধুনোর মধ্যে ওই বিষাক্ত গাছের ডাল মিশিয়ে দেওয়া। এটা করার জন্য তাদের কাছে সেই দিনটাই ছিলো উপযুক্ত সুযোগ, কারণ সেদিন সকালেই বলরাম সত্যচরণ বাবুকে এসে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছে, তাই সকলের মনে হবে এই মৃত্যুটা ওই দেবতার কারসাজি। কবিরাজি বিদ্যায় পারদর্শী রামজীবন জানতেন এই গাছের বিষক্রিয়ার কথা, আর এই কথাও জানতেন যে প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা সত্যচরণ বাবু একাই এই মন্দিরে সন্ধ্যা-আরতি দেন!আর দ্বিতীয় কারণ হল, জমিদার বাবুর মৃত্যুর সময় তিনি তো এই গ্রাম থেকে অনেক দূরে ছিলেন, সকলের কাছে এই আলিবাই তৈরি করা!”

“এবার বলি তারা বাবা ছেলে কেন করতে গেলেন এমন কাজ... অবশ্যই ফুলমনির সেই নিষ্ঠুর পরিণতির প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য! ফুলমনির সাথে যে রামজীবনের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো, তার প্রমাণ হিসাবে আমি আপনাদের সকলকে দেখাতে চাই এটা...” এই বলে গৈরিক নিজের পকেট থেকে সেই সোনার হারটি বার করলো, যেটা সে শ্যামাচরণ বাবুর ডায়েরির ভেতর থেকে পেয়েছিলো। হারটির লকেটটা খুলে দিতেই, সকলে দেখতে পেলো যে তার একদিকে ‘রামজীবন’ এবং অন্যদিকে ‘ফুলমনি’ খোদাই করা নামদুটি এত বছর পর এখনো জ্বলজ্বল করছে!

“এই হারটি নিশ্চয় রামজীবন তার প্রেমিকা ফুলমনিকে উপহার দিয়েছিলেন, পরে সম্ভবত জমিদারের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার সময় এটি তার গলা থেকে খুলে যায়। ফুলমনির লাশটিকে গ্রামের নদীর পাশে ফেলে দেওয়ার পর, নিশ্চয় সত্যচরণ এই হারটিকে নিজের শয়নকক্ষের কোন জায়গা থেকে খুঁজে পান, এবং নিজের ঘরের কোন স্থানে রেখে দেন। এরপর সেখান থেকেই হারটি কোনভাবে শ্যামাচরণ বাবুর হাতে আসে... কী সোমশঙ্কর বাবু, আর কিছু বলার আছে আপনার?”

সোমশঙ্কর বাবু কান্না ভেজা গলায় করুণ সুরে ফুঁপিয়ে উঠলেন, “আমি জানতাম যে এই পাপের কথা একদিন না একদিন লোকে টের পাবেই... আমি জানতাম...” এই কথা বলতে বলতে তিনি ধীর পায়ে বিদায় নিলেন সেখান থেকে।

(১৪)

সাময়িক নিস্তব্ধতা কাটিয়ে আবার বলে উঠলো গৈরিক, “এবার আসি শ্যামাচরণ বাবুর হত্যার কথায়। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, যে ময়না আর রজতকে তার জন্য গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এখন প্রশ্ন হল, ওরা কেন মারলো শ্যামাচরণ বাবুকে? কীভাবে মারলো তাকে? এবং আমিই বা ওদের কারসাজির কথা টের পেলাম কী করে?”

“সত্যচরণ বাবুর মৃত্যু রহস্য পুরোটাই জানতে পেরেছিলেন শ্যামাচরণ বাবু। তার ল্যাপটপের আই.পি এড্রেস ট্রাক করে জানতে পারি, যে তিনি এই গ্রামে আসার পর অসংখ্য বার এমন সাইট খুলেছেন, যেখানে ‘ওলিয়েন্ডার’-এর বিষক্রিয়ার তথ্য দেওয়া আছে। তাছাড়া রামজীবনের ফুলমনিকে দেওয়া হারটি তো তিনি অনেক আগেই সংগ্রহ করেছিলেন। তবে সত্যচরণ বাবুর মৃত্যুর প্রতি তিনি ছিলেন উদাসীন। তার লক্ষ্য ছিলো অন্য কিছু!”

“শ্যামাচরণ বাবুর মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে এই গ্রামে এসে ওনার গতিবিধি লক্ষ করার চেষ্টা করি আমি। সেখান থেকে বুঝতে পারি, যে তিনি বেশ কিছু বার পাশ্ববর্তী পূর্বগোপালপুর গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন জমিদারী আমলে তৈরি কিছু ভগ্ন দেবালয়ের কাছে গিয়েছেন। সেই গ্রামের লোকজনদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, যে তিনি তাদের অনেকের কাছেই ওই মন্দিরগুলির ইতিহাসের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। আরেকটু খোঁজ নিয়েই আমার কাছে এলো একটি চমকপ্রদ তথ্য…এই ভাঙা মন্দিরগুলোর একটির মধ্যে অতীতে পূজিত হত একটি কষ্টি পাথরের কৃষ্ণমূর্তি। ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়, সাঁওতালদের দ্বারা এই মন্দিরটি লুণ্ঠিত হয়। অনেকে নাকি মনে করেন, যে সেই লুণ্ঠনে অংশগ্রহণকারী সাঁওতালরা এই গ্রাম, অর্থাৎ ভদ্রপুরের বাসিন্দা! তবে তারা সকলেই এক রাত্রে ইংরেজ পুলিশের গুলিতে মারা গেলেও, সেই মূর্তিটির সন্ধান এখনো কেউ পায়নি।”

“এই ঘটনাকে বলরাম টুডুর পূর্বপুরুষের দ্বারা ওই জাহের বনে ‘মারাং বুরু’-র পাথরের ফলকের প্রতিস্থাপনা করার ঘটনার সাথে সংযুক্ত করলেই, একটা সম্ভাবনা আমাদের সামনে উঁকি দেয়…তা হল ওই কষ্টি পাথরের কৃষ্ণমূর্তি লুকোনো আছে ‘মারাং বুরু’-র পাথরের ফলকের নিচেই! পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে এই লুটের মালটিকে ওখানেই পুঁতে রেখে, তার ওপর ওই পাথরের ফলক প্রতিষ্ঠা করে তার পুজো করেছিলেন বিদ্রোহীরা, তবে এই কথা তাদের বংশধরেরাও জানে না, কারণ সেদিনই সকল বিদ্রোহীদের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়!…আর এটাই আন্দাজ করেছিলেন শ্যামাচরণ বাবু! তাই ওই জমিতে পুকুর খনন করার পেছনে তার ঠাকুরদার ইচ্ছাপূরণ করা মূল উদ্দেশ্য ছিলো না, তিনি চাইতেন ওই প্রাচীন মূর্তির আবিষ্কারক হিসাবে সারা জগতের লোক যেন তার নাম জানে!”

“সেই জন্যই তিনি ডায়েরির পাতায় লিখেছিলেন ওই ছড়া। এখানে ‘জাহের বনে ঘুমন্ত সে/রঙটি যে তার কালো’ বলে বোঝানো হচ্ছে সেই কষ্টি পাথরের কৃষ্ণমূর্তিকে, যা ওই স্থানে মাটির নিচে পোঁতা আছে…’সামনে এলেই দেখতে পাবে/চতুর্দিকেই আলো’ বলতে বলা হচ্ছে যিনি এই মূর্তি আবিষ্কার করবেন, তিনি সন্মান এবং খ্যাতির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবেন (অর্থের স্বচ্ছলতায় নয়, কারণ বর্তমানে এমন প্রাচীন বস্তু হয় দেশের সরকারের সম্পত্তি)!”

“পরের চারটি লাইনের অর্থ বুঝতে গেলে আমাদের জানতে হবে শ্রীমদ্ভগবদ পুরাণের দশম স্কন্দে বর্ণিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ছোটবেলার একটি কথা। তিনি খেলার ছলে গাছ থেকে দুটি করবী ফুল তুলে নিজের কানের পেছনে গুঁজে দিয়েছিলেন। তাই কৃষ্ণের পূজায় করবী ফুল অপরিহার্য। আর এই করবী ফুলই সেই ‘অপরূপ’ দেখতে ‘মৃত্যুবাণ’ যার সাহায্যে সত্যচরণ বাবু হারিয়েছেন তার প্রাণ…কীরে টুসু, পুরো ছড়াটির অর্থ এবার ক্লিয়ার হয়েছে তো?”

টুসু বিস্ময়ের সুরে বলে উঠলো, “গেরোদা… ইউ আর গ্রেট!”

এবার ময়না আর রজতের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো গৈরিক, তারপর বলে উঠলো, “নিজের অপকীর্তির কথাগুলো নিজে মুখেই বলে ফেলো এবার…আর কিছু লুকোনোর উপায় নেই তোমাদের কাছে!”

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ময়না, তারপর বললো, “একদিন মদের নেশায় আমার কাছে সব কিছু বলে ফেলেন শ্যামাচরণ বাবু…ওই ফুলগাছের কথা.. ওই কৃষ্ণ মূর্তির কথা! তাই আমাদের মনে লোভ জেগেছিলো বাবু…”

ময়না কান্নায় ভেঙে পড়লে অপরাধী কণ্ঠে বলে উঠলো রজত, “ময়না আর আমি একে অপরকে নিজেদের প্রাণের থেকেও বেশি ভালবাসি, বাবু…কিন্তু শুধুমাত্র দুটো পয়সার জন্য আমাকেই প্রতিদিন ওর বিছানায় এক একজন নতুন মক্কেলকে পোঁছে দিতে হত…বুঝতে পারছেন কেমন লাগতো আমার তা করতে? ঘেন্না ধরে গিয়েছিলো নিজের ওপরে…কোনোভাবে বেশ কিছু পয়সা জোগাড় করে এই জীবন থেকে অব্যাহতি নিতে চাইছিলাম আমরা দুজনে!”

করুণ কণ্ঠে বলে উঠলো ময়না, “তাই আমরা ওই জমি খুঁড়ে মূর্তিটি হাতিয়ে কলকাতার চোরা বাজারে বেচে দেওয়ার প্ল্যান করলাম…কিন্তু বুঝতেই পারলাম যে ওটা না পেলে শ্যামাচরণ বাবু আমাদের ওপরই সন্দেহ করবেন, কারণ তিনি নিজেও জানেন যে একমাত্র আমাকেই তিনি বলেছেন ওই কথা। তাই তাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার দরকার হল। যখন ওই ফুল দিয়েই ওনার পূর্বপুরুষকে হত্যা করা হয়েছে আর ওনার ঝামেলাও হয়েছে রঞ্জনের সাথে, তাই সেদিনই ছিলো আমাদের কাজ সেরে ফেলার উপযুক্ত সময়! তাহলেই সব দোষ ওই দেবতার ঘাড়ে চাপানো যাবে!…সেদিন সন্ধ্যায় উনি আমার বিছানায় আসার আগেই, আমি গ্রামের পাশের জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা ওই ফুলের রস মেখে নিলাম নিজের বুকে, পেটে তথা শরীরের সেই সব স্থানে, যেখানে তিনি সঙ্গমকালে মুখ দিয়ে স্পর্শ করতেন! বিষটি শরীরে ঢুকে কাজ করতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় নেওয়ার ফলে, তিনি মারা গেলেন রাতে বাড়ি ফিরে নিজের বন্ধ শোবার ঘরের ভেতর!”

“কিন্তু এর জন্য তোমার চামড়ায় দেখা দিলো ‘ডার্মাটাইটিস’ যা দূর করতে তোমায় ব্যবহার করতে হল একটি ‘এন্টি-হিস্টামিন’ মলম, যা আমি দেখেছিলাম তোমার ড্রেসিং-টেবিলে অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীর মাঝে। সেই থেকেই তোমার ওপর সন্দেহ হয় আমার। এরপর যখন পোস্ট-মর্টেমের প্রচলিত সাধারণ টেস্টগুলো দিয়ে তেমন কিছু ধরা পড়লো না শ্যমাচরণ বাবুর শরীরে, আমি তখন অম্লান বাবুকে ‘হাই পারফরম্যান্স লিকুইড ক্রোম্যাটোগ্রাফি এন্ড মাস স্পেকটোমেট্রি’ নামক টেস্ট করতে বললাম শ্যমাচরণ বাবুর অটোপসিতে, এবং সেখান থেকেই ওই বিষের অস্তিত্ব প্রমাণ হল তার শরীরে!” বলতে শুরু করলো গৈরিক।

“তারপর যখন দেখলাম, সেই সাঁওতাল লোকটি ‘মারাং বুরু’-র পাথরের ফলকের ওপর পড়তেই সেটাও মাটি থেকে বেরিয়ে এলো, তখন বুঝতে পারলাম যে কিছু সময় আগেই ওই স্থানের মাটি খোঁড়া হয়েছে। বুঝতেই পারলাম, মূর্তিটাকে নিয়ে এবার তোমাদের কেটে পরার পালা…তাই অম্লান বাবুকে তোমাদের ওপর সাদা পোশাকে নজর রাখতে বললাম। তাই বোধহয় এই ছদ্মবেশও পালানোর পক্ষে কাজে এলো না তোমাদের জন্য!” কৌতুকের স্বরে বলে উঠলো গৈরিক।

রজতের হাতে ধরা সুটকেসে ভেতর থেকেই উদ্ধার করা হল সেই সুপ্রাচীন কষ্টি পাথরের কৃষ্ণ মূর্তিটাকে, বর্তমান সময়ে যার দাম হয়তো কয়েক লক্ষ টাকা! এটা দেশের সরকারের সম্পত্তি হলেও, তার আবিষ্কারক হিসাবে শ্যামাচরণ বাবুরই নাম জানবে দেশবাসী। মৃত্যুর পরেও যেন পূর্ণ হল তার মনোবাসনা! সেদিনই শ্রীঘরে ঢোকানো হল ময়না আর রজতকে।

পরদিন সকালের কলকাতাগামী ট্রেনে বসেছিলো গৈরিক আর টুসু। কালীচরণ বাবু এবং তার স্ত্রী একটু আগেই বিদায় নিয়েছেন স্টেশন থেকে। ধীরে ধীরে গতির সঞ্চার হল ট্রেনের চাকায়। ভদ্রপুরের স্মৃতি হিসাবে মিশ্র বাড়ির বাগানে পুষ্পমুখর করবী গাছের সামনে দাঁড়িয়ে গৈরিকের দ্বারা তোলা নিজের একটা ছবি ফেসবুকে আপলোড করলো টুসু, সাথে সংক্ষেপে স্ট্যাটাসে লিখলো…”সত্যিই, অপরূপ এই মৃত্যুবাণ!”