বাগানের বেঞ্চ - মধুমিতা সেনগুপ্ত

অলংকরণ - মিশন মন্ডল

ইজিচেয়ারে আধ শোওয়া অবস্থায় বসে বিকাশ সেন খবরের কাগজ পড়ছেন। বছর তিনেক আগে রিটায়ার করেছেন। কলকাতার ফ্ল্যাটে ছেলে বৌমা নাতিকে রেখে পুরোনো ভৃত্য রতনকে নিয়ে কেশবপুরের এই পৈতৃক বাগানবাড়িতে চলে এসেছেন। ব্যস্ত শহরের শব্দদূষণ থেকে অনেক দূরে এসে এখানে বুকভরা শুদ্ধ বাতাস টেনে এক স্বর্গীয় আনন্দ পান তিনি।

তিনদিন আগে বুকে একটা চাপ অনুভব করেন। সঙ্গে অল্প শ্বাসকষ্ট। বহুবার বারণ করা সত্ত্বেও রতন বৌমাকে ফোন করে সব জানিয়ে দেয়। গত পরশু সকালেই সবাই এসে হাজির। সঙ্গে ডাক্তার সোম। ওনারা আসতে আসতে বিকাশবাবু পুরোপুরি সুস্থ। এই বয়সে একটু গ্যাস অম্বলের সমস্যা তো হবেই। ছেলে পলাশের মুখ গম্ভীর। বৌমা টিনা তাঁকে একটু ভয় পায় কিন্তু সেও এবাড়িতে তাঁর একা থাকার ব্যাপারে মৃদু গলায় আপত্তি জানায়। বৌদি ছাড়া বাড়ির অন্য কোনো মহিলাদের কথায় কোনো গুরুত্ব তিনি জীবনে দেননি তাই একবার কঠিন মুখে তাকিয়ে ছিলেন টিনার দিকে।

বাজার থেকে ফিরে একটা মোড়া নিয়ে পলাশ এসে মুখোমুখি বসে। মাঝখানে কাঠের নিচু সেন্টার টেবিলটা এনে দেয় রতন। টিনা দুটো কাঁচের প্লেটে রুটি আর আলু ছেঁচকি রেখে যায়। পলাশ এখানকার সবজির দর নিয়ে আলোচনা করে। এখানকার প্রায় আড়াই গুণ দাম দিয়ে তারা সবজি কেনে। সেগুলো এত সতেজ বা টাটকা থাকে না।

বিকাশবাবু বোঝেন পলাশ মানে তার বাবু কোনো ব্যাপারে তাকে রাজি করাতে এসেছে। না হলে সে একসাথে এত কথা বলার ছেলে নয়। নামী কনভেন্ট স্কুলের বোর্ডিং-এ রেখে মানুষ করেছেন ছেলেকে। দূরে থেকে মানুষ হওয়ায় দুজনের সম্পর্কে একটা দূরত্ব থেকেই গেছে।

―“বাবা, মাছের দোকানদার বিশুর সাথে কথা হলো। ও তিনটি ছেলের সাথে আলাপ করিয়ে দিলো যাদের বাড়ি অন্য জেলায়। তারা দীনবন্ধু কলেজে আলাদা আলাদা সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে এসেছে। ভদ্র চেহারা। এরকম ছোট মফস্বল শহরে একসাথে মেস করে থাকতে চায়। আমি একতলার রান্নাঘর ঘেঁষা দক্ষিণ দিকের দুটো ঘরে ওদের থাকার ব্যবস্থা করে দেব ভাবছি।” কথা শেষ করে চুপ করে উত্তরের অপেক্ষা করে পলাশ।

বিকাশবাবুর রাগ হয় কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন, “ওদের কি কথা দিয়ে ফেলেছ? যদি না বলে থাকো বারণ করে দাও। বাড়ির মধ্যে উটকো লোক থাকা আমি পছন্দ করি না তুমি জানো।”

―“আমি সব জানি বাবা। কিন্তু আমি এত দূরে থাকি, তিনটে অল্পবয়সী ছেলে নিচে থাকলে রাতবিরেতে যে কোন বিপদে রতনদা ওদের সাহায্য পাবে। আমি অনেক ভেবেই ওদের হ্যাঁ বলেছি।" বোঝানোর চেষ্টা করে পলাশ।

―“হুম... ঠিক আছে থাক ওরা। শুধু বলে দেবে কখনো যেন উপরে না আসে। বাগানে বা ছাদে না যায়। এদিক ওদিক ঘুরে না বেড়ায়। কোনো ধরনের জোরে গান শোনা যাবে না এখানে। রাত দশটায় গেটে তালা পড়ে যাবে।” বিরক্ত মুখে বলেন বিকাশবাবু।

―“তোমার কোনো অসুবিধা ওরা করবে না বাবা। কাল সকালে ওরা আসবে। কোনো আসবাবপত্র আনতে আমি না করেছি। ঘর দুটো বহুদিন খোলা হয়নি। রতনদাকে বলছি কাউকে দিয়ে ঘর দুটো পরিষ্কার করিয়ে রাখুক।” বাবাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পলাশ উঠে চলে যায়।

নিজের শোয়ার ঘরে এসে পলাশ দেখে টিনা একটা চাবির গোছা দিয়ে টেবিলের বড় ড্রয়ারটা খোলার চেষ্টা করছে চাবি পাল্টে পাল্টে। বিয়ের পর এই বাড়ি দেখাতে একবারই টিনাকে এনেছিল সে। একবেলা থেকেই চলে গিয়েছিল। এইবাড়িতে কেউ বেশিক্ষণ থাকুক এটা বাবা চাইতেন না। অনেক অভিমান হয়ত জমে আছে… অথচ এখন এখানেই বাস করছেন সবার আপত্তি সত্ত্বেও।

টিনার হাত থেকে চাবির গোছাটা হাতে নিয়ে চমকে ওঠে পলাশ।

―“এটা কোথায় পেয়েছ?”

―“বিছানার গদির তলায়। ওই দিকটাতে মোবাইলটা হটাৎ খাটের ফাঁকে ঢুকে গেছিল কাল রাত্রে। আজ ওটা বার করতে গিয়ে চাবিটা পেলাম। এটা দিয়ে দেখো না ড্রয়ারটা যদি খোলা যায়। এই আলমারির চাবি চাইলাম রতনদার কাছে বললো হারিয়ে গেছে। ড্রয়ারটা খুললে টাকাগুলো মোবাইলটা রাখতে পারতাম।" বলে টিনা।

―“এটা আমার মায়ের ঘর ছিল টিনা। এটা মায়ের চাবি।” একটা ছোট চাবি দিয়ে ড্রয়ারটা খুলে ফেলে পলাশ। ড্রয়ার টেনে খুলে ভিতরের জিনিষ গুলো সাবধানে টেবিলের উপর রাখে। একটা সেলাই এর বাক্স, একটা বড় কাঁচি, ছোট একটি স্লেট, একটা সরু হিসেবের খাতা, দুটো লাট্টু, এক পাতা করে টিপ বোতাম আর হুক, বিভিন্ন আকারের উলের কাঁটা আরো কত কী টুকিটাকি জিনিষ সযত্নে গোছানো। সব কিছুর মধ্যেই যে মা মা গন্ধ। ভীষণ এক অভিমানে পলাশের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।

―“এর ভিতরে এসব আছে জানলে আমি খুলতে বলতাম না। তুমি কষ্ট পেলে... সব ভুলে যাও প্লিজ।" দুহাতে সব জিনিস আবার যেরকম ছিল সেরকম ভাবেই রাখতে থাকে টিনা। সশব্দে ড্রয়ার বন্ধ করে চাবি দেয়।

পলাশ চোখ মুছে বলে ―“কী করে ভুলবো বলো তো? বোর্ডিং-এ সবাই বাবা মায়ের ছবি দেখাত গল্প বলত আমি চুপ করে থাকতাম। মিথ্যে বলতে শিখে গিয়েছিলাম লজ্জায়... বলতাম মায়ের অসুখ করে ছিল মা মারা গেছেন। তুমি প্রথম বান্ধবী যাকে প্রাণ খুলে আসল কথাটা বলতে পেরেছি..। আমার মা পরমা সুন্দরী ছিলেন, নামও ছিল পরমা। আমায় চোখে হারাতেন মা। অথচ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম মা নেই কোথাও নেই। বাড়ির লোকের আলোচনা শুনে বুঝলাম আগের রাতে মা পালিয়ে গেছেন তাঁর পূর্ব প্রেমিকের সাথে। তখন ছিল যৌথ পরিবার। নিঃসন্তান জ্যেঠু জ্যেঠিমা আর বাবার সাথে চলে গেলাম কলকাতা। কিন্তু সেই কষ্ট আমার আজও কমেনি। মায়ের সাথে দেখা হলে একটাই প্রশ্ন করতাম আমার মুখটা তোমার এক বারও মনে পড়লো না মা।"

টিনা কাছে এসে পলাশকে জড়িয়ে ধরে শান্ত গলায় বলে ―“শান্ত হও। ছেলের মুখটা মনে করো। এই জন্যেই আমি ওকে আনতে চেয়েছিলাম। জোর করে তুমি ওকে মা বাপির কাছে রেখে এলে। কী হতো দুদিন স্কুল কামাই হলে? ক্লাস ওয়ান সবে, দেখবো তোমার আমার ছেলে কত বিদ্যাসাগর হয়!"

পলাশ বুঝতে পারে টিনা প্রাণপণে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। আর সেটাই ঠিক। তিরিশ বছর আগের একটা দুঃখ ভুলে বর্তমানে বাঁচাই বুদ্ধিমানের কাজ।

 

সৈকত সপ্তর্ষি আর দিব্যেন্দু তাদের ব্যাগ সুটকেস নিয়ে চলে এলো পরদিন বেলা দশটার মধ্যে। তিনজনের বাবা মায়েরা পলাশকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে বিকাশবাবুকে ছেলেদের স্থানীয় অভিভাবক বানিয়ে দুপুরে দোতলায় নিমন্ত্রণ খেয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি গেলেন। পলাশ ও টিনা বিকেলের ট্রেনে কলকাতার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেল।

 

দুদিন বাদে সৈকত বাড়িতে ফোন করে জানায় এই বাড়িতে থাকতে তার ভালো লাগছে না। বড্ড নিয়মের কড়াকড়ি। সকালবেলা সে জানালা খুলে ‘আলো আমার আলো ওগো’ গানটা গাইছিল। রতনদা এসে জানালো এবাড়িতে জোরে গান গাওয়া চলবে না। বাগানের দিকের জানালার নিচের পাল্লা বন্ধ রাখতে হবে। তার বাবা তাকে বোঝান বাড়ির বাইরে এরকম অনেক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি আসবে এবং সেটা মানিয়ে নেওয়া শক্ত হলেও হাল ছাড়লে চলবে না। এত ভালো একটা বাড়ি কোথায় পাবেন এখন। এগুলো মানিয়ে নিতে হবে। কিছু করার নেই।

 

দিন সাতেক বাদে বাড়ির সামনে একটা কুকুর ছানাকে সাইকেল ধাক্কা দিল। রোজ রাতের খাওয়া সাড়ে নয়টার মধ্যে শেষ করে থালায় যা পড়ে থাকতো সেগুলো জড়ো করে দু তিনটি রুটির সাথে মেখে সপ্তর্ষি বাড়ির বাইরে একটা কুকুর মা আর তার নাদুসনুদুস তিনটে ছানাকে খেতে দিত। তার মধ্যে যে সবচেয়ে সুন্দর ছটপটে সেই কুকুরটাই ধাক্কা খেল একদম সপ্তর্ষিদের চোখের সামনে। সৈকত রগচটা ছেলে তাকে দিব্যেন্দু জাপটে চেপে ধরে না রাখলে সাইকেল চালকের অবস্থা করুণ হয়ে যেত। সপ্তর্ষি ছানাটাকে বুকে তুলে বাসার দিকে দৌড়ায়। পড়ার টেবিলে তাকে শুইয়ে পরীক্ষা করে দেখলো পায়ে লেগেছে কিন্তু হাড় ভাঙেনি। একটা পুরোনো গেঞ্জি কেটে ভালো করে পা-টা বেঁধে দিল সে। বাইরে ততক্ষণে তার মা চিৎকার করে কাঁদছে আর মরিয়া হয়ে বাচ্চাকে খুঁজছে।

সপ্তর্ষি ছানাটাকে একটা জুতোর বাক্সে বসিয়ে বাড়ির ভিতরে গেটের কাছে একটা জামরুল গাছের গোড়ায় বাক্সটা রেখে দরজা খুলে মাকে ভিতরে ঢুকতে দেয়। মা বাকি ছানাদের নিয়ে এসে অসুস্থ ছানা ভালো আছে দেখে কুঁই কুঁই করে লেজ নেড়ে পা চেটে দিয়ে সপ্তর্ষিকে অনেক কৃতজ্ঞতা জানায়।

একটু বাদেই রতনদা নেমে এসে বলে কর্তা জানিয়েছেন এসব আপদ বাড়িতে ঢোকানো যাবে না। তিনজন প্রচুর কাকুতি -মিনতি করে রতনদাকে বোঝায় এখন অসুস্থ বাচ্চাটা বাইরে গেলে অন্য কুকুর তাকে মেরে ফেলতে পারে। অনেক বোঝানোর পর রতনদা বলে ―“কর্তা বাবুর গায়ে জ্বর তাই উনি নামবেন না রাতে। কালকেই এদের বিদায় করবে।”

―“দাদু রাত্রে নিচে নামেন নাকি! কোনোদিন দেখিনি তো?” বলে ফেলে সৈকত। রতনের সাদা ভুরু দুটো কুঁচকে কাছাকাছি চলে এসেছে দেখে থেমে যায়।

―“হ্যাঁ বাবু রাতে মাঝেমাঝে নিচে নামেন। ঐদিকে শেষ ঘরটাতে প্রচুর বই আছে। কী যেন বলে, ও হ্যাঁ লাইব্রেরিতে কর্তা পড়তে নামেন। আবার কখনো জ্যোৎস্না রাত্রিরে বাগানে যান... ", রতনদা বলে চলেছিল কিন্তু উপরের অন্ধকার বারান্দা থেকে গম্ভীর গলায় সবাইকে চমকে দিয়ে বিকাশবাবু চিৎকার দিয়ে ওঠেন ―“রতন! আমি জ্বরে একা শুয়ে আছি আর তুই কোথায় গিয়ে মরে রইলি..রতঅঅন!”

রতন সিঁড়ির দিকে দৌড়ায়। সেদিন সারারাত কুকুর মা বাচ্চাদের আগলে গাছের তলাতেই বসে থাকে। মাঝরাতে একবার সৈকতের ঘুম ভাঙে। বাগানের দিকে শুকনো পাতার উপর খচমচ শব্দ শুনে বুঝতে পারে বাচ্চাদের সাথে মায়ের জোরদার খেলা চলছে। একটু হেসে সে আবার পাশ ফিরে ঘুম লাগায়।

পরের দিন সকালে উঠে কুকুর ছানাটা কেমন আছে দেখতে গিয়ে সপ্তর্ষি দেখে একটা ছেঁড়া কাদা লাগা গামছার অংশ নিয়ে কুটি কুটি করছে মা কুকুরটা। “সর্বনাশ করেছে! কী ছিঁড়ছিস?” চাপা গলায় ধমক দেয় সপ্তর্ষি। হাত বাড়িয়ে ধরতে যেতেই কুকুরটা দৌড় দেয় বাগানের দিকে। বাড়িতে এখনো কেউ ওঠেনি মনে হচ্ছে। কোনো জানালা খোলা নেই। তাও এদিক ওদিক তাকিয়ে বাগানে ঢোকে সে... এটা মনে হচ্ছে সৈকতের গামছা। রাতে মনে হয় বাইরের দড়িতে টানানো ছিল।

বাগানের একদিকে সিমেন্টের একটা বাঁধানো বসার বেঞ্চ মতো করা। চারপাশে প্রধানত ফলের গাছ। আম জামরুল কাঁঠাল কলা এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বসার জায়গার ধারে ধারে চৌকো চৌকো জমি ভাগ করে ফুলের চারা লাগানো হয়েছে। বিকাশ দাদু নিজে হাতে গাছ লাগান। লম্বা জলের পাইপ দিয়ে জল দেন। সিমেন্টের বেঞ্চের পিছন দিকে একটা ছোট গর্ত তাতে বাগানের যত শুকনো ঝরা পাতা জমিয়ে কিছুদিন বাদে বাদেই পুড়িয়ে দেন দাদু। দুদিন আগে বৃষ্টি হয়েছিল। নরম মাটিতে একটা লম্বা গর্ত খুঁড়ে ফেলেছে মা কুকুরটি। কাছে গিয়ে সপ্তর্ষি দেখে গর্তটার মধ্যে সৈকতের গামছাটা দিয়ে কিছু একটা জড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। খুব অবাক হয়ে সে ভাবে এটা আবার কী! তাড়াতাড়ি গামছাটা ধরে টান দিতেই একটা বড় হাতুড়ি বেরিয়ে আসে। দুদিন আগে সে হাতুড়িটা চেয়ে নিয়ে এসেছিল রতনদার কাছ থেকে। দুটো পেরেক পোঁতার পর রান্নাঘরের সামনে রেখেছিল কিন্তু ফেরৎ দেওয়া হয়নি। হাতুড়িটার লোহার দিকটাতে রক্ত শুকিয়ে গামছায় লেগে আছে। ব্যাপারটা সুবিধার নয় বুঝে ঘরের দিকে দৌড়ায় সে। পিছনে দুই শাবকসহ মা কুকুরটি।

 

এরপরের ঘটনাগুলি ঘটে দ্রুত লয়ে। আর সেটা হয় তিনটি ছেলের পক্ষে মর্মান্তিক। ঘরে এসে বাকি দুজনকে বাগানে কী দেখেছে বলতে বলতেই সদর দরজায় ধাক্কা। রাঁধুনি মাসি এসেছেন। অন্যদিন রতনদা এসে দরজা খুলে দেয় আজ তার দেরি হচ্ছে দেখে সৈকত একটু ধাতস্থ হয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দুধওয়ালাও এসেছে। সে মাঝে মাঝে দাদুকে গা হাত পা টিপে দিয়ে যায় তাই তার এবাড়িতে অবারিত দ্বার। সিঁড়ির দরজা ভেজানো ছিল। মাসি দুধওয়ালাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়। এই ফাঁকে তিনজন বাগানে ঢুকতে যায়। কিন্তু তখনই উপর থেকে মাসির বিকট চিৎকার ভেসে আসে। তার হাউমাউ করে কান্না আর দুধ ওয়ালার নীচে দৌড়ে এসে দরজার সামনে গিয়ে খুন খুন করে চিৎকার দেওয়া শুনে তিনটি ছেলের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। তিনজনেই উপরে দৌড়ায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে লম্বা হলঘর। বাঁ দিকে পরপর রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর, ঠাকুর ঘর, পলাশের ঘর ইত্যাদি আর ডানদিকে প্রথমে একটা বড় বসার ঘর। তারপর ছোট দুটো ঘর একটিতে রতন থাকতো। সেই ঘরের মেঝেতে রতন পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শরীরে প্রাণ নেই মাথায় বেশ বড় আঘাতের চিহ্ন। মাটিতে রক্ত ভর্তি।

―“ঢুকবি না কেউ ঘরে ঢুকবি না কিছুতে হাত দিস না। দাদু কোথায়?” কাঁপা গলায় বলে ওঠে সপ্তর্ষি। “খুনটা ওই হাতুড়ি দিয়ে... সেটা আমার গামছায়... হায় ভগবান!” দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে সে।

দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিশাল ঘরে থাকেন বিকাশবাবু। খাটের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন তিনি। দুচোখ বন্ধ। হাত দুটো দুদিকে ছড়ানো পা দুটো শক্ত করে খাটের দুই ছত্রীর সাথে বাঁধা। সপ্তর্ষি দৌড়ে সামনে যায়। দাদুর বুকে কান পেতে শোনে হৃদপিণ্ডের আওয়াজ। উৎকণ্ঠিত বাকি সবাইকে বলে ―“ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ দাদু বেঁচে আছেন। ডাক্তার ডাকতে হবে। পুলিশে খবর দিতে হবে। আগে পলাশদাকে ফোন কর সৈকত।" দুটো পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে বলে সপ্তর্ষি।

দাদুর মুখে জলের ছিটে দিতে দিতে জোরে জোরে তাঁকে ডাকতে থাকে দিব্যেন্দু। হঠাৎ নিচের থেকে একটা গোলমাল ভেসে আসে। “মার মার” শব্দে জনা কয়েক ছেলে উপরে উঠে আসে। তাদের লিডার সেই কুকুর ছানাকে ধাক্কা দেওয়া সাইকেল আরোহী যার সাথে সৈকতের কাল ঝগড়া হয়েছিল।

―“মার ব্যাটাদের। অন্য জেলার ছেলে এখানে এসে মাস্তানি! কাল আমাকে কী চমকাচ্ছিল... খুনি! দুটো মানুষকে মেরে দিলো। মার, মেরে ছাল তুলে নে।" লোকটা হিংস্র মুখে চিৎকার দেয়।

দিব্যেন্দু বলে, “এখন এরকম করবেন না দয়া করে একজন ডাক্তারকে খবর দিন। দাদু, দাদু চোখ খোলো প্লিজ। "

ছেলেগুলি টানতে টানতে তিনজনকে নীচে নামিয়ে আনে। ওদের কথা কেউ শুনতে রাজি নয়। চারপাশ থেকে কিল চড় ঘুঁষি পড়তে থাকে ওদের উপর। বাইরে পুলিশের একটি জিপ এসে থামায় দরজা দিয়ে ভিড় পাতলা হয়ে যায়। এসব সাক্ষী হওয়ার ঝামেলায় কে পড়তে চায়। একটু হাতের সুখ করে হতাশা ঝেড়ে সবাই চলে যায়। নতুন করে কিছু মজা দেখার বেকার লোকজন জুটে যায়। দূর থেকে তারা তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যায়।

ঘন্টা দুয়েক পর ফার্স্ট এড দিয়ে তিনটি ছেলেকে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়। কয়েক ঘন্টা টানা জেরা করা হয় তাদের। মৃতদেহটিকে পোস্ট মর্টেম করার জন্য সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। গামছাসহ হাতুড়ি সঙ্গে নিয়ে যায় পুলিশ। যে ঘরে খুন হয়েছে তার বহু ছবি তোলা হয়। যেভাবে মৃতদেহ পড়েছিল চক দিয়ে সেই জায়গাটিকে এঁকে রাখে পুলিশ। ঘরটি সিল করে দেওয়া হয়।

বিকাশবাবুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর জ্ঞান ফিরলেও তিনি কোনো কথাই বলতে পারছেন না। পলাশ সবাইকে নিয়ে দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যায়। তিন জন ছেলের মা বাবারা এসে পৌঁছে যান তার আগে।

 

সন্ধ্যা সাতটায় তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারা পুলিশকে না জানিয়ে কোথাও যেতে পারবে না এই শর্ত রাখা হয়।

ওই বাড়িতেই সবাই ফিরে আসে। উপরের দুটি ঘর পুলিশ সিল করে দিয়ে গেছে। টিনা বাকি মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে উপরের রান্নাঘরে গিয়ে আলু ডাল চাল নামিয়ে এনে সৈকতদের রান্নাঘরে সবার জন্য আলু সেদ্ধ ডাল ভাত রান্না করার আয়োজন করে। অনেক কষ্টে চাবির গোছা খুঁজে পেয়ে নিচের লাইব্রেরি রুম খুলতে পারে পলাশ। চা আসে। সবার মুখ থমথমে। পলাশ বলে

―“কী কী ঘটেছে আমাকে বলো। সব দোষটা কিন্তু তোমাদের ঘাড়ে গিয়েই পড়ছে। কিছু লুকিয়ে রেখো না। "

সপ্তর্ষি সব ঘটনা বর্ণনা করে। কুকুরছানার ব্যথা পাওয়া থেকে পুলিশ স্টেশন থেকে ছাড়া পাওয়া অবধি সব গুছিয়ে বলে। পলাশ মন দিয়ে শোনে। অনেক আলোচনা হয়। সারাদিন সবার উপর অসম্ভব স্নায়ুর চাপ গেছে বলে সবাইকে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে।

পরদিন রতনের মরদেহ পুলিশ তুলে দেয় তার ভাইপোর হাতে। রতনের টাকাপয়সা সবই এই ভাইপোর নামেই রাখতো সে। ব্যাংকের সব কাগজপত্র পুলিশকে দেখিয়ে নিয়ে ভাইপোর হাতে তুলে দেয় পলাশ।

বেলা বারোটা নাগাদ পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের একজন অফিসার অগ্নি রায় আসেন তদন্তের কাজে, দুজন কনেস্টবল সহ। সারা বাড়ি ঘুরে ফিতে দিয়ে মেপে অনেক ফোটো তোলেন তিনি। একদম শেষে পলাশের দোতলার ঘরে গিয়ে বসেন। টিনার কাছে পারিবারিক অ্যালবাম চান যেখানে রতনের ফটো আছে। পলাশ মায়ের সেই চাবির গোছা বার করে ছোটবেলায় চেনা চাবি দিয়ে কাঠের আলমারিটা খুলে ফেলে। ভিতরে নিপুণ হাতে সাজানো কিছু শাড়ি। কিছু ব্লাউজ ইত্যাদি। বেনারসীর অপূর্ব কারুকাজ দেখে টিনা মুগ্ধ হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে যায়। একটা তাকে ছোট্ট একটি ছেলের অনেক জামা প্যান্ট। গোটা পাঁচেক সোয়েটার। বিছানার চাদর কিছু পশমিনা শাল জ্যাকেট এর নিচের থেকে দুটি অ্যালবাম বের হয়।

অগ্নি মন দিয়ে দেখেন। তারপর হঠাৎ বলে ওঠেন ―“আপনার মা? আপনার সাথে অনেকটা মিল। উনি কোথায়?”

―“আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে উনি... আমাদের ছেড়ে চলে যান।" ঠান্ডা ভাবে বলে পলাশ।

―“ওহো সরি। কী হয়েছিল? কোনো অসুখ বিসুখ?” অ্যালবাম থেকে পরমার একটা ছবি নিয়ে দেখতে দেখতে বলেন অগ্নি।

―“না উনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান।"

―“একা? আপনার সাথে যোগাযোগ আছে? ওনার চলে যাওয়ার কারণটা কী? সরি সব কিছুতেই ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে প্রশ্ন করতেই হয় আমাদের। আপনার কষ্ট হবে বলতে কিন্তু আমার জানাটা জরুরি। " বলেন অগ্নি।

―“বছর চার পাঁচেকের ছেলের পক্ষে সবটা জানা অস্বাভাবিক।"

―“বড় হয়ে কিছু শোনেননি? উনি কোথায় গেছেন, মানে কার সাথে গেছেন এখন কোথায় থাকেন? আপনার বাবা নিশ্চয়ই জানেন।" বলেন অগ্নি।

―“বাবা সুস্থ হলে ওনার কাছে গিয়ে জেনে নেবেন। আমি একটু আসছি।” বলে ঘর থেকে বার হয়ে যায় পলাশ। টিনা কঠিন ভাবে অগ্নির দিকে একবার চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

অগ্নি এটাই চাইছিলেন। দ্রুত হাতে আলমারির সব জিনিস একবার নেড়েঘেঁটে দেখে নেন। দ্বিতীয় অ্যালবাম জুড়ে শুধুই পলাশের বেড়ে ওঠার ছবি। টেবিলের ড্রয়ার খুলে মন দিয়ে সব দেখেন ইন্দ্র। তারপর হিসেবের খাতা খুলে পড়তে থাকেন। প্রতিদিনের বাজার খরচের হিসেব নিপুণ হাতের লেখায় যেন খোদাই করা আছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়। সবকিছুর ছবি তুলে রাখলেন অগ্নি।

 

বিকাশবাবুর ঘরে এসে আলমারি টেবিলের ড্রয়ার সব জায়গার চাবি নিয়ে নেন অগ্নি। বিকাশবাবু বেশ গোছানো মানুষ। সব কিছু ফাইলে ফাইলে গোছানো। ইনকাম ট্যাক্স বাড়ির দলিল কলকাতার ফ্ল্যাটের কাগজপত্র সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। আলমারির লকারে বেশ কিছু গয়না আর শেয়ারের কাগজ রয়েছে। একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভিতর থেকে বের হলো অনেক পুরোনো একটা পৃষ্ঠা। সেটা খুলতেই দেখা গেল গোটা গোটা অক্ষরে লেখা

‘চললাম। তোমার সঙ্গে আর ঘর করতে চাই না আমি। আমার পূর্ব প্রেমিকের সাথে অন্য দেশে গিয়ে ঘর বাঁধবো। কিছু গয়না আর টাকাকড়ি নিয়ে গেলাম। ছেলেকে দেখো।

ইতি

পরমা’

চিঠিটার দুটো ছবি তুলে রাখলেন অগ্নি। ভুরু কুঁচকে খানিকটা তাকিয়ে থাকলেন চিঠিটার দিকে।

পলাশকে ডেকে তার মামাবাড়ির ঠিকানা জানতে চান অগ্নি। পলাশের মামাবাড়ি বীরভূমে। কিন্তু সেখানে এখন কেউ থাকেন না। বড় মামা কলকাতায় থাকেন আর ছোট মামা কানাডায়। বড়মামা যোগাযোগ রাখেন পলাশের সাথে। যদিও লজ্জায় কুণ্ঠায় অপমানে বিকাশবাবুর সাথে তিনি কোনো সম্পর্ক রাখেন না। মাঝে মাঝে অফিসের ঠিকানায় তিনি চিঠিতে আশীর্বাদ জানান ভাগ্নেকে। বছরে একবার বিজয়ার ছুতোয় মামা মামীকে প্রণাম করে আসে পলাশ। মামার বসার ঘরে দুই মামার সাথে দুই বেণীবাঁধা ফ্রক পড়া মায়ের ছবিটার টান সে অস্বীকার করতে পারে না। মায়ের দুচোখ ভরা মায়া। কোনোদিন লজ্জায় সে ছবিটা চাইতে পারেনি মামার কাছে।

 

পরদিন পলাশের মামাবাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন অগ্নি রায়। সোজাসুজি জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো..

―“আপনার সাথে পরমা দেবীর কোনো যোগাযোগ আছে?”

―“না। তিরিশ বছর আগে ভাইফোঁটার দিন ওর সাথে আমার শেষ দেখা। তারপর ডিসেম্বরে তো...” বলেন পলাশের বড়মামা অনিমেষ বাবু।

―“উনি কার সাথে মানে ওনার পূর্ব প্রেমিককে কি আপনি চিনতেন?”

―“না। আমি ওর লেখা শেষ চিঠি পড়ে জানতে পেরেছি কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার বোন এরকম ছিল না। আমাদের সবার মুখে ও কালি দিয়ে কোথায় চলে গেল... ।" দুহাতে মুখ ঢাকেন অনিমেষ। “আমার ছোট ভাই আর ও ছিল অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। সেও এটা মেনে নিতে পারেনি, চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। কেন বিয়ের আগে আমাদের সব খুলে বলেনি, আমরা তার সাথেই বিয়ে দিতাম। আর ওইটুকু দুধের শিশুকে ছেড়ে... আমার বিশ্বাস হয় না কিছুতেই বিশ্বাস হয় না আমার বোন এরকম কাজ করতে পারে।”

―“বিকাশবাবুর সাথে ওনার সম্পর্ক কেমন ছিল? আপনার ভগ্নিপতি লোক হিসেবে কেমন?”

―“বিকাশ একটু রাশভারী গোছের লোক। উন্নাসিক কিন্তু দায়িত্বশীল। ওর বৌদি তখন বেঁচে ছিলেন তিনিই সংসারের আসল গিন্নি ছিলেন আরকী। একদিন এই নিয়ে মায়ের কাছে কিছু নালিশ করতে এসেছিল পরমা। মা শুনতে চাননি। বলেছিলেন ওখানে মানিয়ে নিতে হবে, ওটাই ওর ঘর। তারপর থেকে ও আর বেশি আসতো না। মা বলতেন নিশ্চয়ই ভালো আছে সুখে আছে।"

―“আপনারা যেতেন না। বা ওনার কী বলার ছিল জানতে চেষ্টা করেননি? কিছু অস্বাভাবিক চোখে পড়েছিল কি? কেউ দেখা করতে এসেছিল বা এরকম কিছু খুব ছোট কোনো ঘটনা চোখে পড়েছে কি?” বলেন অগ্নি।

―“আমি একটু বলতে চাই।” দু কাপ চা সেন্টার টেবিলে রেখে বলেন অনিমেষের স্ত্রী মল্লিকা।

―“হ্যাঁ নিশ্চয়ই। বলুন।” টানটান হয়ে বসেন অগ্নি।

―“পরমা সুকণ্ঠী ছিল। কিন্তু নন্দাই পছন্দ করতেন না যে বাড়ির বৌরা গান গাইবে। বিয়েতে দেওয়া হারমোনিয়ামটাও এসে এবাড়িতে রেখে দিয়ে গিয়েছিল। ওটা নিয়ে বোধহয় বাড়িতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। ওর জা শুনেছি ওটা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল। বাক্সের ভিতরে সব গানের খাতা আরো কীসব রেখে ও তাতে তালা মেরে রেখে গেছিল। আজও সেভাবেই রাখা আছে বড় খাটের তলায়।” থামলেন মল্লিকা।

কনেস্টবল বিশ্বনাথ আর ড্রাইভারকে দিয়ে অগ্নি বাক্সটা গাড়িতে তুলে নিলেন। কোয়ার্টারে ফিরতে গভীর রাত হয়ে গেল। একটা ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নিয়ে নিজের ছোট স্টাডিতে ঢুকে চেয়ারে বসলেন অগ্নি। ডায়েরিটা নিয়ে যা যা প্রয়োজনীয় তথ্য পুরোটা লিখে রাখলেন। সামনে মেঝেতে পরমার হারমোনিয়ামের তালাবন্ধ বাক্স। কাপটা নামিয়ে রেখে ড্রয়ার থেকে একটা মাস্টার-কী বার করে নিলেন। তারপর উবু হয়ে বসে মিনিট খানেকের চেষ্টায় ছোট তালাটা খুলে ফেললেন। বাক্সের ভিতরে বেশ পুরোনো দিনের একটা হারমোনিয়াম। তার উপরে কয়েকটা সরু বঙ্গলিপি খাতা। খাতা গুলো খুলে দেখতে লাগলেন অগ্নি। বেশির ভাগই সরগম লেখা। কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, অতুলপ্রসাদী আর কিছু লালন ফকিরের গান। তারমানে বেশ চর্চা ছিল গানের। এরপর একটা খাতা খুলতেই চমকে উঠলেন অগ্নি। পাতাগুলো কেউ দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। কয়েকটা পৃষ্ঠা সরু সরু কাগজ কেটে জোড়া দেওয়া হয়েছে। পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ একটা পাতায় চোখ আটকে গেল... পরমা লিখেছেন... “এরা দুজন আমাকে বাঁচতে দেবে না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার গায়ের ফর্সা রং বা গলার সুরেলা আওয়াজ কিছুর জন্যেই তো আমি দায়ী নই।"

হারমোনিয়ামের নিচে পেলেন একটি সরু ডায়েরি। যেটাতে মাত্র দুটি পৃষ্ঠা লেখা। কিছু মনখারাপ করা কথা। সেগুলি তদন্তের জন্য অতি জরুরি আর ছেলেকে লেখা একটা চিঠি। মন দিয়ে পড়তে থাকেন অগ্নি।

 

ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে মিনিট পাঁচেকের জন্য বিকাশবাবুকে দেখতে তাঁর কেবিনে ঢুকলেন অগ্নি। ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন বিকাশ। সেদিনের মানসিক ঝড় এখনো সামলাতে পারেননি প্রৌঢ় মানুষটি।

―“নমস্কার আমি অগ্নি রায়। রতন বিশ্বাসের হত্যার তদন্তের ব্যাপারে দুটো কথা বলেই চলে যাবো। আচ্ছা একটু ভেবে বলুন তো সেদিন রাতে ঠিক কী ঘটেছিলো?”

―“রতন...” ডুকরে ওঠেন বিকাশ বাবু। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন “মাঝরাতে পাশের ঘরে কীসের একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম রতনের ঘরে আলো জ্বলছে। ডাকলাম ওকে। তারপরেই একটা কেমন শব্দ হলো রতনের একটা আর্তনাদ। দুজন মুখ ঢাকা লোক আমার ঘরে দৌড়ে এলো এসেই একজন আমার নাকে কী একটা স্প্রে করে দিলো আমার আর কিছুই মনে নেই।”

―“দুজন ছিল না তিনজন?”

―“দুজন।“

―“আচ্ছা, আপনার দাদা বৌদি এখন কোথায় থাকেন বিকাশবাবু?”

―“দাদা বৌদি! হঠাৎ এই প্রশ্ন করছেন কেন অফিসার?" বিকাশবাবু উঠে বসেন।

―“এমনি, কৌতূহল বলতে পারেন। পলাশ বাবু বললেন ওনাদের কথা তাই বলছি। ওনারা এখন কোথায় থাকেন?” অগ্নি একটু গম্ভীর গলাতেই বলেন।

―“বৌদি বছর পনের আগে ক্যান্সারে ভুগে মারা যান। দাদা সন্ন্যাস নিয়ে দেওঘরে আমাদের গুরুদেবের আশ্রমে চলে যান। আমাদের ওখানে যাওয়া বা খোঁজ নেওয়া বারণ তাই বলতে পারবো না দাদা কেমন আছেন।" বলেন বিকাশবাবু।

আশ্রম ও গুরুদেবের ঠিকানা জেনে নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে আসেন অগ্নি।

 

দিন দুয়েক বাদে দেওঘরের আশ্রমে এসে বিকাশবাবুর সন্ন্যাসী দাদা প্রকাশবাবুর সাথে কথা শুরু করেন অগ্নি।

―“আপনি সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী। আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাবো আশাকরি।” বলেন তিনি।

―“আমি ঠিক পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারবো। তারপর আমার ধ্যানে বসার সময়। আমি মিথ্যা বলি না। কিন্তু সব কথার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।" বলেন প্রকাশ যাঁর বর্তমান নাম প্রকাশানন্দ মহারাজ।

―“আপনি শুধু বলুন আপনি কবে সন্ন্যাস নেন? আপনার স্ত্রীর মৃত্যু হয় কত সালে? আর আপনার ভাতৃবধূ পরমা দেবী কেমন মানুষ ছিলেন। তিনি যাঁর সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে যান তাঁর নাম কি আপনি জানেন?” বলেন অগ্নি।

―“আমি এইট্টি নাইনে বাড়ি ছাড়ি। বিকাশের বৌদি মারা যান দুহাজার চার না পাঁচ কবে যেন। আর পরমা... খুব রুচিশীলা মেয়ে ছিল। আমাকে নিজের দাদার মতো যত্ন করতো। সন্তানের জন্য প্রাণ দিতে পারতো। বাকিটা আমি কিছু বলবো না।" বলেন সন্ন্যাসী।

―“ওনার কোনো বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল বলে জানতেন কি?”

―“না। যা ছিল না তা জানবার প্রশ্ন ওঠে না।..অবৈধ সম্পর্ক সবসময়ই বড় বিষাক্ত হয়ে যায় পরিবারের অন্যদের কাছে। কত পরিবার এর জন্য নষ্ট হয়ে যায়। কত মানুষ নিঃশব্দে শেষ হয়ে যায়। এই কথাগুলো পরমা একদিন বলেছিল আমার কাছে। আমি ওকে কোনো সাহায্য করতে পারিনি।... আচ্ছা আমায় যেতে হবে। শুধু কটা লাইন মনে পড়লো সেটাই বলি...

যেখানে দেখিবে ছাই,উড়াইয়া দেখো তাই

পাইলেও পাইতে পারো...

চলি অফিসার। জীবনে অনেক আঘাত পেয়ে সন্ন্যাসী হয়েছি। আজ আমি সব দুঃখ কষ্ট প্রতারণার উর্দ্ধে। ধ্যানযোগ ভক্তিযোগ মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়। পারলে ধ্যান করবেন। নমস্কার।

...ঈশ্বর আপনাকে পথ দেখান। সত্য সামনে আসুক। ওম শান্তি।” সন্ন্যাসী ভিতরে চলে যান।

অনেক প্রশ্নের কাঁটা ছেঁড়া চলতে থাকে অগ্নির মনে। একটা আলোর সন্ধান দিয়ে গেলেন সন্ন্যাসী। বাড়তি অংশ গুলো কেটে বাদ দিলেই বাকি উত্তরটা বেরিয়ে আসবে।

দুদিন বাদে কেশবপুরের থানা থেকে দুজন পুলিশ কনেস্টবল নিয়ে বিকাশবাবুর বাড়ি গেলেন অগ্নি। বিকাশবাবুকে আগের দিন ছেড়ে দিয়েছেন ডাক্তারবাবুরা। একতলার একটি ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেছে পলাশ। দুবেলা আয়া রাখা হয়েছে। তাঁর ঘরে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নেন অগ্নি।

―“খুনি কে ধরতে পারলেন?" জিজ্ঞাসা করেন বিকাশবাবু।

―“না এখনো পারিনি। দেখি কী হয়।” বলেন অগ্নি।

দুজন সঙ্গীকে নিয়ে বাগানে গিয়ে যেখানে হাতুড়িটা পোঁতা ছিল তার ধারপাশটা ভালো করে ওনাদের খুঁজে দেখতে বলেন। নিজে সিমেন্টের বেঞ্চের উপর বসে ভালো করে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

শনশন করে একটা দমকা বাতাস বয়ে যায়। বেশ কিছু শুকনো পাতা ঝরে পড়ে বাগানে। ছোট চারা গাছগুলো জলের অভাবে কেমন শুকিয়ে উঠছে। কয়েকদিন ঝাঁট না দেওয়া শুকনো পাতায় ঢেকে গেছে বাগানের এদিক ওদিক। বেঞ্চের পিছন দিকে দুহাত দূরেই একটা গর্ত তাতে ও বেশ কিছু পাতা জমেছে। একটা শুকনো গাছের ডাল দিয়ে পাতা সরিয়ে সরিয়ে দেখছেন কনেস্টবল দুজন। সেই গর্তটার পাতা সরিয়ে একজন বললেন ―“এখানে বোধহয় পাতা আর জঞ্জাল পুড়িয়ে ছাইগুলো রাখা হয়।”

―“ছাই! ছাই উড়াইয়া দেখো তাই… ও হো। শোনো এবাড়িতে কোদাল শাবল যা আছে এখুনি নিয়ে এসো। যাও...”

উত্তেজনা চাপতে পারেন না অগ্নি।

কোদাল আসে। পিছনে শাবল হাতে বিস্মিত পলাশ।

গর্ত বড় হতে থাকে কোদালের ঘায়ে। একহাত মত গর্ত খোঁড়ার পর শক্ত কংক্রিটে আঘাত করে কোদাল।

―“বাঁধানো এত বড় সিমেন্টের ভিত করে বাগানে বেঞ্চ বানানো হয়েছে পলাশ। এরকম আগে কখনো দেখেছেন? আমি তো কোনোদিন দেখিনি।” কনেস্টবলদের থামতে বলে থানায় ফোন করেন অগ্নি। জরুরি কিছু জিনিষ নিয়ে অফিসারদের আসতে বলে দেন। “একতলার বাগানের দিকের সব জানালা বন্ধ থাকবে। বাইরের গেটে একজন গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। পুলিশ ছাড়া কেউ যেন ঢুকতে না পারে বের হতেও না পারে। কেউ বাগানে আসবে না। যাও।”

―“অফিসার! কী থাকতে পারে এখানে? পারিবারিক গুপ্তধন! কী আশ্চর্য! আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না।” বলে পলাশ।

―“যে কোনো রহস্যের সমাধানই কিন্তু গুপ্তধনের মতোই মূল্যবান। তবে এতে আপনার কষ্ট বাড়বে না কমবে জানি না।"

থানার বড়বাবু ও মেজবাবু দৌড়ে আসেন। সঙ্গে চার জন। এঁরা রাজমিস্ত্রি ও লেবার। বড় বড় হাতুড়ির ঘায়ে বেঞ্চটি ধরাশায়ী হয়ে যায়। এরপর শাবলের ঘা পড়তে থাকে সিমেন্টের ভিতের উপর যা পিছনের গর্ত অবধি বিস্তৃত। সিমেন্টের মোটা স্ল্যাব ভেঙে ফেলে টুকরোগুলো সরিয়ে দেখা যায় নীচে একটা লম্বা গর্ত। অনেকটা কবরের মতো। তাতে শোয়ানো একটা কঙ্কাল। যাঁর পায়ে রুপোর মল আর হাতের আঙুলে একটি বড় মুক্তোর আংটি।

―“বুঝতে পারছেন কিছু?” অগ্নি প্রশ্ন করেন।

―“হ্যাঁ। এই পায়ের মল আর মুক্তোর আংটি আমার মায়ের... মা গো কে এভাবে তোমাকে…” দুহাতে মুখ ঢাকে পলাশ।

―“নিজেকে শক্ত করুন পলাশ। যান বাড়ির ভিতরে যান। আপনার বাবাকে এই কঙ্কাল বা ভিত খোঁড়া হয়েছে এই সম্বন্ধে কিছুই বলবেন না। বৃদ্ধ মানুষ হঠাৎ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। আমি আসছি একটু পরে। যান।” বলেন অগ্নি।

 

একটু বাদে বিকাশবাবুর ঘরে গিয়ে ঢোকেন অগ্নি। বিকাশবাবু বেঞ্চ ভাঙার শব্দ পেয়েছেন আগেই। বার বার জানতে চাইছেন কী ঘটছে তাঁর সাধের বাগানে। পলাশ ছাড়া আর কাউকে থাকতে মানা করেছেন অগ্নি।

―“ব্যস্ত হবেন না ব্যস্ত হবেন না। এবার আমি সব রহস্যে ইতি টানবো। পলাশ ধৈর্য্য ধরে চুপ করে বসুন।

আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর আগের কথা। পরমা দেবী এবাড়িতে বউ হয়ে আসেন...” হঠাৎ বিকাশবাবু বাধা দেন।

―“আঃ আবার সেই পারিবারিক কেলেঙ্কারির কথা কেন তুলছেন? রতনকে কে মারলো বলুন। জানা ঘটনা আবার শুনে কী হবে?” হাঁপাতে থাকেন বিকাশ।

―“একদম চুপ করে বসুন। যেটা সবার জানা দরকার সেটা তো আমি বলবই। শুনুন পলাশ আপনার মা অতি ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর নামে ভয়ঙ্কর নিন্দনীয় একটি ঘটনা জোর করে বাজারে ছড়ানো হয়েছে। আপনার মা কারো সাথে বাড়ি ছেড়ে চলে যাননি।”

―“জানি অফিসার। আমার মন বলতো এটা হতে পারে না। আমার মা যে খুব ভালো মানুষ ছিলেন অফিসার।” বলে পলাশ।

―“মিথ্যা কথা। তোর মা চিঠি লিখে রেখে গেছিল। পুলিশ সেটা দেখেছে।” চিৎকার দেন বিকাশ।

―“ওটা জাল চিঠি। হাতের লেখা নকল করা হয়েছে। হাতের লেখা নিয়ে আমিও কিছুটা পড়াশোনা করেছি। দাঁড়ান প্রমাণ করে দিচ্ছি।” এক অফিসারের হাতের থেকে একটা মোটা ফাইল নিয়ে সেটা খুলে সেই চিঠিটি এবং পরমার হিসেবের খাতা বার করে টেবিলের উপর রাখেন অগ্নি। “দেখুন হাতের লেখা অনেকটাই এক কিন্তু চললাম, ঘর আর চাই না তিনটি শব্দের ল, ঘ, আর চ এর সাথে আপনার মায়ের এই বাজারের লিস্টে লেখা লাউ, চিংড়ি আর ঘি এর যথাক্রমে ল চ আর ঘ এর পুরো মিল আছে কি? "

―“না… নেই, একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে অমিলগুলো। উফফ এই চিঠিটা দেখার পর আমি কত রাত ঘুমাতে পারিনি জানেন? আমার দশ বছরের জন্মদিনে বাবাকে অনুরোধ করেছিলাম মায়ের খোঁজ নিতে। বাবা সেদিন এই চিঠিটা দেখিয়েছিলেন। আর কোনোদিন আমি জন্মদিনে বাড়ি আসিনি। কিন্তু আমার মাকে আমার জীবন থেকে কে কেড়ে নিল? কে আমার মাকে কবরে শোয়ালো, আমাকে বলুন, আমি তার ফাঁসি চাই।” পলাশ টেবিলে জোরে ঘুঁসি মারে।

―“কবর! কোথায়!” বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বাগানের দিকের জানালার দিকে দৌড়াতে যান বিকাশ।

―“দাঁড়ান, দাঁড়ান, বিকাশ বাবু। আপনার অসুস্থতার নাটকটা নিজেই নষ্ট করে ফেললেন তো। ঠান্ডা মাথায় দুটো খুনের জন্য আপনাকে তো এবার একটু শ্রীঘরে যেতে হবে।” অগ্নি শান্ত গলায় কথাটা বলে অন্য অফিসারদের ইশারা করেন।

―“মিথ্যা কথা। আমি কেন খুন করতে যাবো! কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে?” ফুঁসতে থাকেন বিকাশ।

―“সেটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। কোর্টে যখন তুলবো আপনাকে সব কাহিনী গোছানো থাকবে। পলাশ মনকে শক্ত করে নিন। অনেক কিছু বলবো যাতে আপনার যন্ত্রণা বাড়বে।

আপনার জ্যেঠিমার সাথে আপনার বাবার অবৈধ সম্পর্কটা আপনার মা মানতে পারেন নি। হয়ত খুব খারাপ কোনো ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। উনি অবৈধ সবকিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন তাই আপনার বাবা ওনাকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেন।”

―“না বাবু আমি না। বিশ্বাস কর। তোর মাকে বৌদি একদিন রাতে খাওয়ারের সাথে বিষ মিশিয়ে দেয়। আমি তোর মা কে মারতে চাইনি। বিশ্বাস কর।” বিকাশবাবু করুণ মুখে বলতে থাকেন।

―“বিশ্বাস! এরকম কিছু আশা কোরো না আমার কাছ থেকে। জ্যেঠিমার কথায় আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়েছিলে... এখন সবটা বুঝতে পারছি। ছি ছি!”

―“আপনার মামাবাড়ি থেকে আপনার মায়ের কিছু জিনিস এনেছিলাম। পরে সব আপনাকে দিয়ে যাবো। তারমধ্যে এই ছোট্ট ডায়েরিটা ছিল। এটা থেকেই বুঝেছি এবং অনুমানও করেছি আপনার জ্যেঠিমার ছিল আকণ্ঠ ঈর্ষা আপনার মায়ের উপর। ওনার হাত থেকে ছোট ছেলেকে বাঁচাতে আপনার ঠাকুমা আপনার মাকে বৌ করে ঘরে আনেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। আপনার জ্যেঠিমার সাংঘাতিক কূট বুদ্ধির কাছে আপনার মা ছিলেন নেহাতই শিশু। তাই তাঁকে এভাবে প্রাণ দিতে হয়। আপনার বাবার স্বভাব চরিত্র নিয়ে আর কিছু বলার নেই। ও হ্যাঁ এর মধ্যে পরমা দেবী আপনাকে একটা চিঠি লিখে গেছেন। দেখুন।”

চোখের জল মুছে পলাশ চিঠিটি খোলে। তাতে লেখা

‘আমার সোনা বাবা,

এই চিঠি যখন তুই পাবি তখন আমি হয়ত থাকবো না। যাই ঘটুক জানবি মা তোর ধারে পাশেই থাকবে। একটা বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে আমার চারপাশে। এই বাড়িতে শুধুমাত্র তোর জ্যেঠু আমাকে প্রকৃত স্নেহ করেন। উনি সব জানেন কিন্তু ঘৃণায় কিছু বলতে পারেন না। পারলে সবাইকে ক্ষমা করিস বাবা। তোকে অনেক অনেক স্নেহ ভালোবাসা আর আশীর্বাদ জানাই। অনেক বড় হও বাবা আমার।

মা’

 

হাউ হাউ করে বাচ্চাদের মত কেঁদে ওঠে পলাশ।

―“আচ্ছা, রতনকে মারলেন কেন? ও তো আপনার ডান হাত। তাহলে? ব্ল্যাকমেল করছিল নাকি?” জিজ্ঞাসা করেন অগ্নি।

―“না। ও সেদিন বাগান নিয়ে ছেলেগুলোর কাছে কিছু বলছিল। আমি রাতে বাগানে যেতাম। এত বছর আগে রাতারাতি পুঁতে দিয়েছিলাম পরমার লাশ। তারপরে রতন নিজে হাতে তার উপর সিমেন্টের স্ল্যাব বানিয়ে দিয়েছিল। তখন ধারে পাশে কোনো বাড়ি ছিল না। কাক পক্ষী টের পায়নি। মিস্ত্রি ডেকে সিমেন্টের বেঞ্চ বানিয়ে নিয়েছিলাম। খুব গর্ব হতো এত বছরেও কেউ বুঝতে পারেনি কিচ্ছু। রাত হলেই বাগানে যেতে ইচ্ছা করত। এসব কেউ জানুক আমি চাইনি। এই সব উটকো ছেলেদের ঘাড়ে খুনের দায় দিয়ে বাড়ি থেকে আপদ দূর করতে গিয়েই...” থামেন বিকাশবাবু।

―“খুব কাঁচা কাজ করেছেন। ওদের কারো হাতের ছাপের সাথে হাতুড়ির গায়ে লেগে থাকা হাতের ছাপ মেলেনি। সিঁড়িতে ওঠার দরজায় আপনার হাতের ছাপ। তাছাড়া ওরা কেন খুন করতে যাবে? কোনো কারণ নেই তাই না? আর ওরা করলে এভাবে ওরা পুলিশের সাথে সহযোগিতা করে মার্ডার ওয়েপন দেখিয়ে দিত না। ওরা সত্যি বলছে বুঝতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। বাড়ির মেন গেট ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। তাই খুনি বাড়ির মধ্যেই ছিল এটা বোঝাই যাচ্ছিল। ছেলেরা যখন আপনাকে দেখে আপনার দুই পা বাঁধা কিন্তু দুহাত খোলা ছিল। বাকিটা আদালতে শুনবেন। যান ওনাকে নিয়ে যান বড়বাবু।” ভেঙে পড়া বিকাশবাবুকে নিয়ে পুলিশ অফিসার।

―“ওনার যেন ফাঁসি হয়। আমি যাই টিনাকে ঘটনাটা বলি। জানেন... মা টানটান চাদরে শুতে পছন্দ করতেন। সিমেন্টের বেঞ্চের তলায় মার না জানি কত কষ্ট হয়েছে... মাকে দাহ করতে হবে... মায়ের পারলৌকিক কাজও করতে হবে। আজ আমার বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল। আবার একই সাথে মাথায় যেন পাহাড় ভেঙে পড়লো। মা যা বলে গেছেন তাই হবে অফিসার। আমি বাবাকে ক্ষমা করে দেব। হয়ত পারবো। অন্তত চেষ্টা করবো। বাকিটা আইনের হাতে।”

―“আচ্ছা। আবার দেখা হবে। নমস্কার। চলি।” ঘর থেকে বেরিয়ে যান অগ্নি রায়। পলাশ সেদিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর টেবিলে মাথাটা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে।

বাইরে পুলিশের জিপ কর্কশ শব্দ করে চালু হয়...