অশ্বিনী ভবনের রহস্য - অভিষেক মিত্র

(১)

রবিবার দিন সাধারণত আমি একটু দেরী করেই ঘুম থেকে উঠি। সারা সপ্তাহের ক্লান্তি একদিনের ঘুমেই পুষিয়ে নিই। রোজ ভোর বেলা উঠে স্কুল আর বিকেলে পড়তে যাওয়ার ফাঁকে কোথায় যেন ঘুমের একটু ঘাটতি থেকে যায়। এই রবিবারটা তাই আমার ঘুমের দিন। কিন্তু আজ যদিও আমি বেশ তাড়াতাড়িই উঠে গেলাম। তার দুটো কারণ। এক আমার পরীক্ষা শেষ, তাই এখন দেড় মাস ছুটি, তাই ঘুমিয়ে ছুটি কাটানোর কোন মানেই হয় না। আর দ্বিতীয় কারণ হল, পড়াশুনার জন্য আমি আমার জ্যঠতুতো দাদা, বাবুদার সাথে বিশেষ সময় কাটাতে পারি না। এখন আমার সেই সুযোগ। আর একটু ঘুমের জন্য সেটা থেকে বিরত থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে দেখি ঘড়িতে সবে সাড়ে আটটা, আমার রবিবারের ঘুমের থেকে দু ঘণ্টা কম। বাইরে বৈঠকখানায় গিয়ে দেখি সোফার উপর আধশোয়া হয়ে বাবুদা বই পড়ছে। আর সামনে টেবিলের উপর একটা খাতায় কী সব হিজিবিজি লিখছে। একটু কাছে যেতে দেখি বইটার নাম চাইনিজ ল্যাংগুয়েজ ফর বিগিনারস। লেখক লি কুপার।

আগেই বলেছি, বাবুদা আমার জ্যাঠতুতো দাদা। আজকের দিনে যখন সর্বত্র নিউক্লিয়ার পরিবার, সেখানে আমরা থাকি একান্নবর্তী পরিবারে। সাদার্ণ এ্যাভিনিউতে আমাদের তিনতলা বাড়ি। ওর বয়স সাতাশ বছর আর আমার পনেরো।

ছোটবেলায় সবারই একটা হিরো থাকে, যাকে দেখে মনে হয়, ইস আমিও যদি এরকম হতে পারতাম? আমার সেই হিরো হল বাবুদা ওরফে ডাঃ জৈত্র মিত্র। ডাঃ জৈত্র মিত্র কিন্তু ডাক্তার নয়, বাবুদা ডক্টরেট কেমিস্ট্রিতে। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি পাড়ার পুজো হোক কিম্বা ফাংশন বাবুদাকে ছাড়া যেন কিছুই হয় না। আমাদের এই সাদার্ণ এ্যাভিনিউতে প্রায় সবাই বাবুদাকে এক নামে চেনে।

আরও একটা নাম আছে বাবুদার, গোয়েন্দা জৈত্র মিত্র। এটা যদিও হয়েছে গত মাস তিনেক। বোসপুকুরের রাহা বাড়িতে একটা জোড়া খুনের রহস্য সমাধান করে বেশ নাম করে ফেলেছে। আমি যদিও ঐ কেসটা নিয়ে বিশেষ কিছুই জানি না, কারণ বাবুদাকে জিজ্ঞেস করাতে ও বলেছিল, “শোন, সব কেসের ব্যাপারে তোকে বলা যাবে না। তুই বুঝবি না।”

আমি বলেছিলাম, “বলেই দেখ না। ঠিক বুঝব।”

এই ব্যাপারে বাবুদা আমায় আর কিছু বলেনি। যদিও খবরের কাগজ থেকে কিছুটা জেনেছিলাম। সে যাই হোক, এই কেসটার সমাধান করে কলকাতা পুলিশের কিছু উচ্চপদস্থ লোকের সাথেও বেশ ভালো পরিচয় হয়ে গেছে ওর। এটা ছাড়াও বাবুদা যদিও আরও একটা চুরি ও একটা অপহরণের মামলার সমাধান করেছে, আর সেগুলোর সম্বন্ধে আমাকে গল্পও বলেছে। ঐ রাহা বাড়ির মামলাটার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের প্রথম পাতায় ওর ছবি পর্যন্ত বের করতে চেয়েছিল, কিন্তু ও রাজি হয়নি। আমি জিজ্ঞেস করাতে বেশ চটে গিয়েই বলেছিল, “গোয়েন্দাদের ছবি কাগজে ছাপা হলে তারা টার্গেট হয়ে যাবে। তখন কোন মামলার ক্ষেত্রে দরকার পড়লে, শুধু নাম বদলালে চলবে না, ছদ্মবেশও ধরতে হবে। আর সেটা সব ক্ষেত্রে করা যায় না, বুঝলি।”

এই গোয়েন্দাগিরির উপর বাবুদার ইন্টারেস্ট ছেলেবেলা থেকেই। এই নিয়ে ও বিভিন্ন বই পড়েও নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে ঐ ভাবে। তাছাড়া আর দুটো ব্যাপার লক্ষ করেছি বাবুদার মধ্যে। একটা হল ওর পর্যবেক্ষণ শক্তি। যে কোন অচেনা মানুষকে দেখে ও অনেক কিছুই বলে দিতে পারে। আর ওর স্মৃতিশক্তি। এত প্রখর স্মৃতিশক্তি আমি আর কারুর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যে কোন জিনিষ একবার দেখলেই ওর মনে থেকে যায়, ওকে জিজ্ঞেস করাতে বাবুদা হেঁসে বলেছিল, “একে বলে ফটোগ্রাফিক মেমরি।”

এছাড়া বাবুদার বই পড়ার খুব সখ। বিভিন্ন বিষয়ের বই আছে ওর আলমারিতে। মহাকাশ থেকে সমুদ্র, ইতিহাস থেকে অর্থনীতি, কী নেই। ও বলে, “গোয়েন্দা হতে গেলে ভালো জেনারেল নলেজ থাকা খুব জরুরি। কখন কোথায় কোনটা কাজে লেগে যায়।”

হঠাৎ সকাল সকাল চীনা ভাষা নিয়ে পড়াশুনা করার কারণ অবিশ্যি আছে একটা। গত শনিবার আমরা সাউথ সিটি মলের ফেম সিনেমায় একটা চীনা ছবি দেখে এলাম ইংরেজি ভারশানে। ছবিটা যদিও ক্যারাটে নিয়ে ছিল, কিন্তু বাবুদার ইচ্ছে হল চীনা ভাষাটার সম্পর্কে জানার। ভারতের কোন কেসে যে চীনা ভাষা লাগবে তা আমি ঠিক বুঝলাম না। ছবিটা দেখে আমার যদিও ক্যারাটে শেখার ইচ্ছেটাই হয়েছিল।

আমাকে আসতে দেখে বাবুদা বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, “কী রে, আজ তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল যে ? কোথাও বেরবি নাকি?”

আমি বললাম, “কোথায় আর যাব, ভাবলাম তোমার কাছে ঐ অপহরণের মামলার গল্পটা আরেকবার শুনবো।” এই বলে আমি বাবুদার উল্টো দিকের সোফাটায় গিয়ে বসলাম। টেবিলের উপর খোলা খাতাটার উপর চোখ পড়তে দেখলাম ওখানে কী সব হিজিবিজি লেখা, মনে হল চীনা অক্ষর। আমি খাতাটার উপর ঝুকে পড়ে দেখছি দেখে বাবুদা বলল, “পৃথিবীতে কোন ভাষায় সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে জানিস?”

“জানি, চীনা ভাষায়। জিকে বইতে পড়েছি।”

“গুড! পৃথিবীর টোটাল জনসংখ্যার প্রায় ষোল শতাংশ। তা ভাষাটা কত পুরানো জানিস?”

আমি মাথা নেড়ে না বললাম।

বাবুদা টেবিলের উপর দুটো পা তুলে সোজা হয়ে বসে একটা সিগারেট ধরাল। বাড়িতে এমনিতে বাবুদা সিগারেট খায় না। খেলেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে খায়। আজ ঘরে সিগারেট ধরানোর প্রধান কারণ হল বাড়িতে কেউ নেই। আমার মা বাবা, ও জ্যঠা জেঠি সবাই কাল রাতের ট্রেনে পুরি বেড়াতে গেছে। আমারও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাবুদা থাকবে বলে কোন রকমে মাকে রাজি করিয়েছি যাব না বলে। মা যদিও যাওয়ার আগে বলে গেছে, “বাবু, সাবধানে থাকিস কিন্তু দুজনে। এর মধ্যে আবার কোন মামলা-টামলায় জড়িয়ে পড়িস না। আর বাবু কোথাও কাজে বেরলে তুই আবার ওর সাথে টংটং করে চলে যাস না।”

আমি তখন মাথা নেড়েছিলাম। কিন্তু মনে মনে খুব চাইছিলাম যে এই সময় বাবুদার কাছে কোন কেস আসুক, তাহলে আমিও থাকতে পারব ওর সাথে। কিন্তু এই কেস নেওয়ার ব্যাপারে বাবুদা যা খুঁতখুঁতে তাতে আমার আশা কতটা পূরণ হবে তা নিয়ে বেশ সংশয় ছিল আমার মনে।

সিগারেটে দুটো লম্বা টান দিয়ে বাবুদা বলল, “প্রায় ৩০০০ বছর আগের চীনা ভাষা লিখিত অবস্থায় পাওয়া যায় একটা কচ্ছপের খোলের উপর। এই ভাষা যে কত বছরের পুরানো তার একটা আইডিয়া পাওয়া যায় এর থেকে। আমাদের বাংলা ভাষার থেকে প্রায় হাজার বছর আগে। তখন এটাকে বলা হত সিনো-টিবেটিয়ান ভাষা।”

আমি মাথা নাড়লাম। একে তো সবে ঘুম থেকে উঠেছি, তার উপর সকাল সকাল এই চীনা ভাষা নিয়ে আলোচনা ঠিক ভালো লাগছিল না। এমন সময় আমাদের পরিচারক সুখেনকাকা আমাদের জন্য চা, বিস্কুট আর চীনা বাদাম দিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম, ‘উফ! আবার চীনা?’

বাবুদা প্লেট থেকে একটা চীনা বাদাম তুলে ডান হাতের দুটো আঙুলের মাঝে রেখে আলতো চাপ দিতেই বাদামটা খোলা থেকে সুড়ুত করে বেরিয়ে ওর বাঁ হাতের তেলোতে গিয়ে পড়ল। ও সেটা মুখে পুরে দিয়ে বলল, “এই চীনা ভাষা হল পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ভাষাগুলোর একটি। কতগুলো অক্ষর আছে জানিস এই ভাষায়?”

তারপর আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে লাগল, “দশ হাজার। যদিও সাধারণত পাঁচ হাজার অক্ষর জানলেই চলে। আর এর উচ্চারণ আরও কঠিন। একটা শব্দ এক এক ভাবে উচ্চারণ করলে এক একটা আলাদা মানে দাঁড়ায়।”

এই পর্যন্ত বলে হাতের সিগারেটটা ছাইদানিতে ফেলে দিল। তারপর চায়ের কাপটা তুলে তাতে একটা সশব্দে চুমুক দিয়ে বলল, “যেমন ধর ‘মা’ শব্দটা। এটার মানে মা অর্থাৎ মাতা, ঘোড়া, বকা আবার এক ধরনের ফুল। যে ভাবে উচ্চারণ করবি মানে সেই রকম হবে।”

এই বলে বাবুদা বিভিন্ন রকম ভাবে ‘মা’ শব্দটা উচ্চারণ করে তার বিভিন্ন মানে বুঝিয়ে দিল। আমার তখন ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কিন্তু বাবুদা ছাড়ার পাত্র নয়, অবার বলতে লাগলো, “শুধু তাই নয়, চীনা ভাষায় কোন সিঙ্গুলার প্লুরাল-এর ব্যাপার নেই। একটা ঘোড়াও মা আবার দশটা ঘোড়াও মা। আসলে...”

বাবুদা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু এমন সময় সুখেনকাকা এসে দাঁড়াতে ওকে থামতে হল।

সুখেনকাকা বলল, “দাদাবাবু, একজন লোক এসেছে। আপনাকে খুঁজছে। নাম বললেন দেবাঙ্গন ঘোষাল।”

“আচ্ছা, ওনাকে উপরে নিয়ে এস,” এই বলে বাবুদা বই আর খাতাটা বন্ধ করে টেবিলের নীচে রেখে দিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “অত উত্তেজিত হওয়ার কিছু হয়নি। পাতি কেস হলে আমি কিন্তু নেব না। আর কেসের ধরনের উপরও ডিপেন্ড করছে যে তোকে সাথে নেওয়া যাবে কি-না।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী করে বুঝলে? আমি তো...”

ও আঙুলের ইশারায় আমাকে থামতে বলে বলল, “তুই যদি উত্তেজিত না হতিস তাহলে সুখেনকাকা যখন মিঃ ঘোষালের আগমনের কথা বলল তখন হাত বাড়িয়ে টিভির রিমোটটা নিতে যাচ্ছিলিস। হঠাৎ করে কথাটা শুনে অর্ধেক হাত বাড়িয়ে আবার হাত ফিরিয়ে নিতিস না।”

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সুখেনকাকার সাথে একজন ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। বাবুদাও উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিনমস্কার করে ওনাকে উল্টো দিকের সোফাটায় বসতে বললেন। আমি তক্ষুনি উঠে গিয়ে বাবুদার পাশে বসলাম। মিঃ ঘোষাল সোফায় বসার সময় পকেট থেকে একটা বেশ বড় সাইজের মোবাইল ফোন বের করে টেবিলের উপর রাখলেন। ভদ্রলোক প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা। মোটামুটি বাবুদার মাথায় মাথায়। গায়ের রং ময়লা, বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, আর তাতে পাওয়ারও বেশ ভালোই। পরনে হলদে রঙয়ের সার্ট আর কালো প্যান্ট। ভদ্রলোক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বাবুদা তার আগেই বলে উঠল, “আপনি কিছু বলার আগে আমার একটা প্রশ্ন আছে।”

“নিশ্চই, বলুন।” ভদ্রলোক যেন একটু অপ্রস্তুত হয়েই বললেন।

“আপনি চা খাবেন না কফি?”

“চা-ই ভালো।”

“আচ্ছা। সুখেনকাকা, তিনটে চা দিয়ে যেও।”

সুখেনকাকা মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে বাবুদা মিঃ ঘোষালের দিকে ফিরে বললেন, “এবার বলুন, আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”

ভদ্রলোক একটু গলা খাকরিয়ে বললেন, “আমার নাম দেবাঙ্গন ঘোষাল। আমি এসেছি আমার বস মানে ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরীর হয়ে আপনাকে কল দিতে। উনি একবার আপনার সাথে দেখা করতে চান।”

“ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরী মানে কি সেই বিখ্যাত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“উনি তো বিখ্যাত মানুষ। ওনার লেখা বই ‘এ জিন টু স্টার্ট উইথ’ আমি পড়েছি। এক কথায় অসাধারণ।”

মিঃ ঘোষাল বললেন, “ওটা ছাড়াও ওনার আরও দুটো বই আছে। সুযোগ হলে পড়ে নেবেন। তা আপনার বুঝি জেনেটিক্সে ইন্টারেস্ট?”

বাবুদা মুচকি হেঁসে বলল, “আমি অনেক ব্যাপারেই ইন্টারেস্টেড মিঃ ঘোষাল। অনেকটা আমার পেশার খাতিরেই।”

ইতিমধ্যে সুখেনদা তিন কাপ চা আর দু প্লেট চানাচুর এসে রেখে গেছে টেবিলে। মিঃ ঘোষাল চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “আপনার যদি সময় হয় তাহলে আজ বিকেলে একবার স্যারের সাথে দেখা করে নিলে খুব উপকার হবে। উনি নিজেই আসতেন কিন্তু কাল একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়ে যাওয়ায়...”

“কী এক্সিডেন্ট? সিরিয়াস কিছু?” এবার প্রশ্নটা আমি করলাম। করে যদিও আড়চোখে বাবুদার দিকে একবার দেখে নিলাম যে মাঝখানে কথা বলায় ওর কী মনোভাব। ও দেখি আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হালকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

“না, সেরকম কিছু নয়। কালকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বাঁ পা-টা একটু মচকে গেছে। সে রকম সিরিয়াস কিছু নয়।”

বাবুদা মিঃ ঘোষালকে একটা সিগারেট অফার করে নিজে একটা ধরিয়ে বলল, “তা কী কারণে ডেকেছেন সেটা একটু জানতে পারলে ভালো হত।”

“আসলে ওনার বাড়িতে একটা চুরির চেষ্টা হয়েছে বলে ওনার সন্দেহ। তাই নিয়ে কিছু কথা বলতে চান আর কী। এর বেশি কিছু আমিও ঠিক... হেঁ হেঁ। স্যার সকালে আমাকে ফোন করে বললেন তাই তড়িঘড়ি করে চলে এলাম। ফোন করে এপয়েন্টমেন্টও করতে পারিনি।”

“আই সি, তা আপনি কদিন কাজ করছেন ওনার সাথে? যতদূর মনে পড়ছে উনি কাল্টিভেশন অফ সাইন্সে চাকরি করেন।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। যাদবপুরে। গত বিশ বছর ওখানেই আছেন। আমিও ওনার আণ্ডারেই পি এচ ডি করেছি বছর পাঁচেক হল। তারপর থেকে ওনার সহকারীর কাজ করি। শুধু অফিসে না, বাড়িতেও।”

“তা আপনি কি ওনার বাড়িতেই থাকেন?”

“আজ্ঞে না। আমি থাকি বেহালার পর্ণশ্রীতে। বাড়িতে আমার বাবা, স্ত্রী ও তিন বছরের মেয়ে আছে। তা আপনি কখন আসবেন যদি একটু বলেন?”

“কোন সময়ে প্ৰণব বাবু ফ্রি থাকবেন? আমার কোন সময়ই যেতে আপত্তি নেই।”

“আচ্ছা, তাহলে এই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ চলে আসুন। সাড়ে চারটে নাগাদ গাড়ি পাঠিয়ে দেব।”

“না, না গাড়ি পাঠানোর দরকার নেই। আপনি ঠিকানাটা এই কাগজে লিখে দিন, আমি ঠিক চলে যাব।” এই বলে বাবুদা, টেবিলের তলা থেকে একটা রাইটিং প্যাড বের করে মিঃ ঘোষালের দিকে এগিয়ে দিল।

মিঃ ঘোষাল হাতের সিগারেটটা ছাইদানিতে ফেলে ঠিকানা লিখতে লাগলেন। তারপর ওটা বাবুদার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের মোড়ে নেমে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। কলেজের পিছনে দুটো বাড়ি ছেড়ে তৃতীয় বাড়িটা। ফলকে নাম লেখা আছে ‘অশ্বিনী ভবন’।”

“ঠিক আছে,” বলে বাবুদা মিঃ ঘোষালের সাথে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “আপনার বুঝি পাখি পোষার শখ?”

কথাটা শুনে মিঃ ঘোষাল থমকে দাঁড়ালেন, বললেন, “হ্যাঁ, মানে আপনি কী করে...”

বাবুদা মুচকি হেঁসে বলল, “আসলে আপনার প্যান্টের ডান পায়ের তলার দিকটায় একটা হলদে রঙের পালকের অংশ আটকে আছে। আর আপনার ডান হাতের আঙুলে বেশ কিছু আঁচড়ের দাগ। খুব সরু, যেটা বিড়াল কিম্বা কুকুরের নয়। আর বিড়াল কুকুর হলে একাধিক দাগ হত না। ওরকম দাগ আঙুলের মাথায় পাখি বসালে তার পায়ের আঁচড়ের ফলে পড়ে। ঠিক তো?”

মিঃ ঘোষালের মুখ প্রসন্নতায় ভরে গেল। বললেন, “ঠিক, ঠিক। আপনার কী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মশাই! আমি খেয়ালই করিনি। আসলে এত তাড়াহুড়োতে বেরিয়েছি যে ভালো করে লক্ষই করিনি, পালকটা লেগে আছে।”

মিঃ ঘোষাল নমস্কার জানিয়ে চলে গেলে বাবুদা আবার সোফায় গিয়ে পা-টা লম্বা করে দিয়ে বলল, “বুঝলি মান্তে, বিকেলে তিনটের সময় বেরোব। যাবি তো?”

আমি বললাম, “বা রে, যাব না? একটা কেসে তোমার সঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়েছি, সে কেউ হাতছাড়া করে? কিন্তু চুরির চেষ্টা মানে তো ঠিক চুরি নয়। তবে গোয়েন্দা ডাকার দরকার হল কেন? আর তুমিও যে ফস করে রাজি হয়ে গেলে? গিয়ে যদি দেখ সেরকম ইন্টারেস্টিং কিছু না, তখন?”

বাবুদা আবার সেই চীনা ভাষা শেখার বইটা মুখের সামনে খুলে বসেছে, বই থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “তেমন ইন্টারেস্টিং কেস না হলে না করে দেব। কিন্তু এই ফাঁকে ডাঃ প্রণব রায় চৌধুরীর মত মস্ত বৈজ্ঞানিকের সাথে আলাপ তো করা যাবে। গত বছরই ভারতের সেরা বৈজ্ঞানিকের পুরস্কার পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে। এরকম মানুষের সাথে আলাপ করার সৌভাগ্য আর কজনের হয়?”

(২)

সাড়ে চারটের সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি করে রাজাবাজার পৌঁছতে সোয়া পাঁচটা বেজে গেল। রাস্তায় যদিও কলেজ স্ট্রিটে নেমে বাবুদা প্রণব রায় চৌধুরীর লেখা ‘জেনেটিক ইন্টেরপ্রিটেশন’ নামক বইটা কিনে নিল। কলেজ স্ট্রীট থেকে বাটার দোকানের পাশের গলি দিয়ে রাজাবাজার যেতে মিনিট দশেক লাগল। এই সময়টুকু বাবুদা নতুন কেনা বইটা উলটে পালটে দেখে আমার পিঠের ব্যাগে রেখে দিল। রাজাবাজার মোড়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে ও বলল, “এখনও হাতে মিনিট পনেরো সময় আছে। চল এখান থেকে হেঁটেই যাই।”

এই বলে ও বাঁ দিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটা শুরু করে দিল। আমিও ওর পাশে পাশে হাঁটতে লাগলাম। খান তিনেক মাংসের দোকান পেরিয়ে মিনিট দুয়েক হেঁটে একটা সিগারেটের দোকানের সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম। বাবুদা এক প্যাকেট ফ্লেক কিনল। তারপর বাবুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। আরও মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর আমরা সায়েন্স কলেজের পাশের গলিটার মুখে এসে দাঁড়ালাম। একটা পানের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই সে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিল।

অষ্টআশি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, এক মস্ত পুরানো আমলের ফাটক ওয়ালা তিনতলা বাড়ি। সামনে একটা ছোট্ট বাগান পেরিয়ে আমরা বাড়ির দারজায় কলিং বেল বাজাতেই ভিতর থেকে পায়ের শব্দ পেলাম। আধ মিনিটের মধ্যে একজন চাকর গোছের লোক এসে দারজা খুলে দিল। রোগা, পরনে ছাই রঙয়ের ফতুয়া আর ময়লা নীল রঙের লুঙ্গি।

“আমার নাম জৈত্র মিত্র। ডাঃ প্রণব রায় চৌধুরীর সাথে এপয়েন্টমেন্ট আছে,” এই বলে বাবুদা ওর জামার বুক পকেট থেকে একখানা ভিজিটিং কার্ড বের করে লোকটার হাতে দিল।

লোকটা আমাদের বৈঠকখানায় বসতে বলে ভিতরে চলে গেল। বিরাট ঝাড়লণ্ঠনওয়ালা বৈঠকখানায় গিয়ে একটা লাল পেশমে মোড়া প্রকাণ্ড সোফায় গিয়ে বসলাম দুজনে। ঘরটা বেশ বড় হলেও তাতে আসবাবপত্র বিশেষ নেই বললেই চলে। প্রকাণ্ড সোফাটার সামনে একটা শ্বেতপাথরের টেবিল আর সেই টেবিল ঘিরে আরও দুটো পেশমে মোড়া আর্মচেয়ার। সোফাটার ডান দিকে তিনটে বই বোঝাই আলমারি। তাতে বেশির ভাগ বই-ই জেনেটিক্স সম্বন্ধে। আর অবাক হলাম এই দেখে যে একটা আলমারি ভর্তি গল্পের বই দিয়ে যার মধ্যে প্রায় নব্বই শতাংশ বই গোয়েন্দা গল্পের। এছাড়া আসবাব বলতে আর কিছুই নেই। আর সোফার বাঁ দিকের দেওয়ালে টাঙানো আছে একটা বিরাট পট্রেট। যার পট্রেট, তিনি যে বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলেন তা বোঝাই যায়। জমিদারের পোশাক পরে তিনি একটা পেল্লায় চেয়ারে বসে আছেন, মাথায় পাগড়ি, হাতে কারুকার্য করা লাঠি। ছবিটা যখন আঁকা হয়েছে তখন তাঁর বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ।

বাবুদা উঠে গিয়ে বইয়ের আলমারিটার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ঝুকে পড়ে ভিতরের বইগুলো দেখছে। আমিও ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

“এইটা কবে হল?” বই দেখতে দেখতে প্রশ্ন করলাম ওকে।

“কোনটা? ভিজিটিং কার্ড?” আমার দিকে না তাকিয়েই ও বলল।

“হু।”

“আমার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। ঐ কাকাই জোর করে ছাপিয়ে দিল। আজ সকালেই ডেলিভারি পেয়েছি। দেখবি?” এই বলে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আমার হাতে চালান করে দিল। তাতে কালো কালিতে বড় বড় করে লেখা আছে, Dr. Jaitra Mitra, Private Investigator নীচে ছোট ছোট করে লেখা আমাদের বাড়ির ঠিকানা আর বাবুদার মোবাইল ফোনের নম্বর।

আমি কার্ডটা উলটে পালটে দেখছি এমন সময় একজন বয়স্ক লোক ঘরে এসে ঢুকলেন। তাঁর গায়ের রং মাঝারি, নাকের নীচে মোটা সাদা গোঁফ। মাথার সামনের দিকটা ফাঁকা, আর কানের পাশ দিয়ে যেটুকু চুল আছে তা প্রায় সবটাই সাদা। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, বয়স আন্দাজ ষাটের কাছাকাছি। পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি আর ড্রেসিং গাউন।

ওনাকে আসতে দেখে আমরা দুজন নমস্কার করলাম। আমাকে দেখে ভদ্রলোক যেন ভুরুটা একটু কপালে তুললেন। বাবুদা বলল, “ও আমার খুড়তুতো ভাই, অভীক।”

ভদ্রলোক আমাদের পাশের সোফাটায় এসে বসতে বসতে বললেন, “তার মানে ইনি কি ওয়াটসন?”

বাবুদা একটু হেঁসে বলল, “অনেকটা সেরকমই বলতে।”

“বেশ... দীননাথ, এনাদের জন্য একটু জলযোগের ব্যবস্থা কর।”

প্রথমের সেই চাকর গোছের লোকটা দরজায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল। মনিবের আদেশ পালন করতে সে চলে গেল। প্রণববাবু, পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা বিদেশী চুরুট বের করে সেটা ধরালেন। তারপর একটু এগিয়ে বসে বললেন, “আমি আপনার নাম শুনি আমার বন্ধুর ছেলে শান্তনু রাহার কাছে। আপনার বেশ প্রশংসাই করেছে। তা আমি ভাবলাম, দেখি আপনি এই ব্যাপারে আমাকে কিছু সাহায্য করতে পারেন কি-না। তা আপনি যে এত ইয়ং সে ব্যাপারে আমার ধারণা ছিল না। শান্তনু শুধু নামটা আর পেশাটাই বলেছিল। তা আপনার বয়স কত হবে?”

বাবুদা বলল, “আজ্ঞে, সাতাশ।”

“ওয়েল, আমার পুলিশের উপর খুব একটা ভরসা নেই। একবার একটা ব্যাপারে ওদের সাহায্য নিয়ে বেশ ঠকেছিলাম। কিছু ক্ষেত্রে বুঝলেন, কাজের থেকে ওরা অকাজটাই করে বেশী। তা আমার ছেলে যদিও পুলিশে খবর দিয়েছে আর পুলিশের লোক এসে আমার সাথে কথাও বলে গেছে, তবুও আমি চাই আপনি এই কেসটা নিন। যদিও এটা এখনও কতটা কেস হয়ে উঠেছে তা জানি না।”

প্ৰণববাবু একটু থামলেন আর সেই সুযোগে বাবুদা গলা খাকরিয়ে বলল, “তা কী জন্য আমায় ডেকেছেন যদি...”

প্ৰণববাবু যেন শুনতেই পেলেন না কথাটা। বললেন, “জেনেটিক্স সম্বন্ধে আপনার কিছু আইডিয়া আছে?”

“সামান্য।”

“তাহলে নিশ্চয়ই বোঝেন এই জেনেটিক্সের একটা পেপারের মূল্য কত? আর সেই পেপার যদি এমন একটা বিষয়ের উপর হয় যা মানুষের খাদ্য সমস্যা অনেকটা নির্মূল করে দিতে পারে।”

প্ৰণববাবু থামলেন কারণ ওনার চুরুটটা নিভে গেছে। বার দুয়েকের চেষ্টায় আবার সেটাকে ধরিয়ে বলতে শুরু করলেন।

“গত দশ বছর ধরে আমি রিসার্চ করছি এমন একটি জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ারড ধানের যা যে কোন মাটিতে, যে কোন আবহাওয়ায় জন্মাতে পারে। এমনকি দেখা গেছে যে মাইনাস বারো ডিগ্রিতেও এই ধান জন্মেছে। তাহলে বুঝতেই পারছেন এই রকম একটা আবিষ্কারের ভ্যালু আজ কতটা? আর এই পেপারের পেটেন্ট থাকলে তার থেকে আয় কত হবে সেটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন?”

বাবুদা আর সোফায় হেলান দিয়ে বসে নেই, বরং এগিয়ে বসেছে, হাত দুটো হাঁটুর উপর রেখে মন দিয়ে শুনছে প্ৰণববাবুর কথা। আমার বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছি যে ভদ্রলোক এইবার আসল রহস্যের কথাটা বলবেন, কিন্তু এত কায়দা করে আস্তে আস্তে আসল কথাটায় যাচ্ছেন যে তাতে সাসপেন্স আরও বেড়ে যাচ্ছে।

ইতি মধ্যে দীননাথ চা আর চিকেন পকড়া রেখে গেছে সামনের শ্বেত পাথরের টেবিলটায়। প্ৰণববাবু বললেন, “আসুন, এটা খেতে খেতে কথা বলা যাক।”

বাবুদা একটা পকড়া মুখে দিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্ৰণববাবুর দিকে তাকাল। প্ৰণববাবু ওনার চায়ের কাপে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।

“আমার এই পেপার মোটামুটি কমপ্লিট হয়ে গেছে। বাকি আছে দুয়েকটা খুচরো ডিটেল। তা আরও মাস তিনেকের ব্যাপার। ল্যাবে পেপারটা বেহাত হয়ে যেতে পারে বলে আমি ওটাকে আমার বাড়িতেই রাখি। আমার শোবার ঘরের একটা সিন্দুকে। আপনি চা-টা খেয়ে নেন, আমি আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। গত সপ্তাহে আমার একটা ইন্টারভিউ বের হয় ‘সায়েন্স ক্যালকাটা’ নামক ম্যাগাজিনে। আর কিছুটা নিজের ভুলেই আমি ব্যাপারটা বলে ফেলি। তারপর থেকেই আমার একটা ভয় ধরে যায় এই পেপারটার সেফটি নিয়ে।”

বাবুদা ওনার কথা শেষ হতেই বলল, “একটা প্রশ্ন আছে?”

“করুন। “

“আপনি বললেন যে আপনার ল্যাব মানে ‘কাল্টিভাশন অফ সায়েন্স’-এর ল্যাব তো?’“

“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি গত বিশ বছর এখানেই আছি। জেনেটিক্সের উপর আমার গত তিনটে পেপার আমি এখান থেকেই পাবলিশ করেছি।”

“আচ্ছা, আর আপনার ল্যাবে ওটা সেফ নয় বলে মনে হওয়ার কারণ কি শুধুই বেহাত হওয়া?”

প্ৰণববাবু অল্প হাসলেন। বললেন, “না। গত মঙ্গলবার আমার ল্যাবে একটা এক্সিডেন্ট হয়। কী করে যেন আগুন ধরে যায় আর তাতে আমার ল্যাপটপ আর দেবাঙ্গনের কম্পিউটারটা নষ্ট হয়ে যায়। তার ফলে এই পেপার সম্পর্কিত যাবতীয় ডেটা নষ্ট হয়ে গেছে। কী ভাগ্য করে আমি যে তার আগের দিন পেপারটা বাড়ি নিয়ে এসেছিল, না হলে আমার দশ বছরের কাজ শেষ হয়ে যেত এক নিমেষে।”

বাবুদা বলল, “আগুনটা কী করে ধরল সেটা জানা গেছে?”

“না, আমাদের ল্যাবের ইলেক্ট্রিশিয়ান বলছে কোনভাবে সর্ট সার্কিট হয়ে গেছিল।”

“আই সি, তারপর বলুন।”

প্ৰণববাবু এক চুমুকে চা-টা শেষ করে বলতে লাগলেন, “আমি ওদের বারণ করা সত্ত্বেও ওরা পেপারটার কথাটা ছাপিয়ে দেয়। আর তারপর থেকে আমার কাছে প্রায় দশটা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে ফোন এসেছে পেপারটার পেটেন্ট বিক্রি করার জন্য।”

“আপনি কি রাজি হয়েছেন?”

“সার্টেনলি নট। ওরা হয়তো অনেক টাকা অফার করতে পারে কিন্তু আমি এটা টাকার জন্য করিনি মিঃ মিত্র। আমার বাড়িটা দেখে আপনি নিশ্চই বুঝতে পারছেন যে টাকার অভাব আমার নেই। গত দুটো পেপারের পেটেন্ট থেকে আমি যা রোজগার করেছি তাতে আমার আগামি তিন পুরুষ বসে খেতে পারবে। তা ছাড়া আমার ছেলেরও নিজস্ব ব্যবসা আছে আর তা বেশ ভালোই চলে। এই বাড়িটা যদিও আমার পিতামহের তৈরি। উনি ব্রিটিশ আমলে ব্যারিস্টার ছিলেন। তাছাড়া আমাদের জমিদারিও ছিল হাবড়ার ওদিকটার ইচ্ছাপুর গ্রামে। এই যে ছবিটা দেখছেন, ওটা পিতামহ শ্রী কালীকিঙ্কর রায় চৌধুরীর।” এই বলে প্ৰণববাবু আমাদের সোফার বাঁ দিকের দেওয়ালের সেই বিশাল ওয়েল পেন্টিং-এর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। তারপর আবার বলে চললেন, “আমি ভেবেছি এই পেপারটা আমি ইউনেস্কোকে দিয়ে দেব, ফ্রি অফ কস্ট। আমি চাই এই জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ার্ড ধান মানুষের হাতে পৌঁছক, তাতে দুর্ভিক্ষে কাউকে আর মরতে না হয়।”

“এ আপনার এক মহৎ প্রচেষ্টা,” বলল বাবুদা।

“কিন্তু আমার মনে হয় কেউ বা কারা আমার এই পেপার চুরি করতে চাইছে,” খুব শান্ত গলায় বললেন ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরী।

“চুরি? আপনার সন্দেহের কারণ?”

“গতকাল রাতে কেউ একজন আমার ঘরে ঢুকেছিল।”

“আই সি।”

“আমি সাধারণত ঘুমতে যাই রাত সাড়ে এগারটার মধ্যে। রাতে আবার একটু ড্রিঙ্ক করার অভ্যেস আছে। বেশি নয়, ওই দু পেগ স্কচ। কাল রাতেও তার অন্যথা হয়নি। ঘুম ভাঙল একটা আওয়াজে। চোখ খুলে দেখি আমার বিছানার মাথার দিকে কে যেন আমার সিন্দুকটা খোলার চেষ্টা করছে। আমি ‘কে’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে সে লোক চম্পট দেয়। অন্ধকারে তার চেহারা ঠাওর করতে পারিনি।”

“আপনার সিন্দুকের চাবি কোথায় থাকে?” বাবুদা প্রশ্ন করল।

“আমার বালিশের তলায়। কালও তাই ছিল। এই ব্যাপারের পর আমি আরও বেশি সাবধানী হয়ে গেছি। সকালে লোক ডাকিয়ে ঘরে সি সি টিভি ক্যামেরা লাগিয়েছি। তার ডাইরেক্ট লিঙ্ক আমার নতুন ল্যাপ্টপের সাথে। তবুও যেন ঠিক শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই আপনাকে ডাকা। আপনার পরামর্শের জন্য।”

বাবুদা বলল, “দেখুন চুরি যখন হয়নি, তখন আমার বিশেষ কিছু একটা করার আছে বলে মনে হয় না। তবুও আপনার শোবার ঘর আর সিন্দুকটা একবার দেখা গেলে...”

“নিশ্চয়ই। আমি চাই আপনি একবার দেখুন। তারপর না হয়...” এই বলে প্ৰণববাবু উঠে দাঁড়ালেন। উঠতে গিয়ে একটা হালকা ‘উফ’ বলে বাঁ পায়ের হাঁটুটার উপর হাত দিলেন। তারপর ‘আসুন’ বলে সেই ওয়েল পেন্টিংটার পাশের দরজা দিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। আমি আর বাবুদাও ওনাকে অনুসরণ করলাম।

বৈঠকখানা থেকে বেরিয়েই ডান দিকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে। প্ৰণববাবু সেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন রেলিংটায় ভর দিয়ে। বোঝাই যাচ্ছিল যে পায়ের ব্যাথা ওনাকে বেশ কাবু করেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দেখি পাশের দেওয়ালে বিভিন্ন ওয়েলপেন্টিং ঝোলানো আছে। আলো একটু কম বলে ছবির ডান দিকের নীচে লেখা আর্টিস্টের নাম ঠিক দেখতে পাচ্ছিলাম না। একটু ঝুকে পড়ে দেখছি দেখে প্ৰণববাবু বললেন, “এই ছবিগুলো আমার বাবার আঁকা। এক সময় ছবি এঁকে বেশ নাম করেছিলেন। বৈঠকখানায় আমার পিতামহের ছবিটাও ওনারই আঁকা।”

“তাপস রায় চৌধুরী?” বাবুদা বলল।

প্ৰণববাবু বেশ প্রসন্ন হাঁসি হেঁসে বললেন, “বাবা! আপনি আর্টেরও খবর রাখেন দেখছি!”

দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দা, আর তার গা দিয়ে সারি সারি ঘর। তিনটে তালা বন্ধ করা ঘর পেরিয়ে চতুর্থ ঘরটার সামনে গিয়ে প্ৰণববাবু বললেন, “এইটে হল আমার শোবার ঘর। কাজের ঘরও বলতে পারেন। ভিতরে আসুন।”

প্ৰণববাবুর ঘরটা বেশ বড়, প্রায় নিচের বৈঠকখানার সাইজের। দরজা যেদিকে তার উল্টো দিকে দুটো বড় বড় জানলা। ওই জানলায় যদি শিক না থাকত তাহলে অনায়াসে একজন মানুষ গলে যেতে পারে। জানলার পাশেই একটা পড়ার টেবিল আর দুটো বেতের চেয়ার। আমরা যে দরজা দিয়ে ঢুকেছি তার ডান দিকে একটা উঁচু খাট আর সেই খাটের মাথার কাছে একটা গোদ্রেজের সিন্দুক। তাছাড়া ঘরে একখানা গোদ্রেজের আলমারি আর গটা তিন বই বোঝাই কাচের আলমারি। আর দেখলাম, আলমারিটার মাথার উপরে একটা সি সি টিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। ওখান থেকে সোজাসুজি সিন্দুকটা দেখা যায়। জানুয়ারি মাস, তাই বড়দিন চলে যাওয়ায় প্রায় ছ’টা বাজলেও অল্প আলো এখনও আছে। প্ৰণববাবু ঘরে ঢুকেই আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।

বাবুদা ঘরের জিনিষগুলোর দিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সিন্দুকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হাঁটু মুড়ে বসে ভালো করে কী যেন দেখতে লাগল ও। তারপর ওর পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে তার আলোটা জ্বালিয়ে আবার দেখতে লাগল সিন্দুকটা। তারপর প্ৰণববাবুর উদ্দেশে বলল, “আপনার সিন্দুকের উপর কিঞ্চিৎ বল প্রয়োগ করা হয়েছে দেখছি। দরজাটা কেউ খুলতে চেষ্টা করেছিল। মনে হয় এটা কাল রাতের সেই ঘটনা থেকে। কারণ দাগগুলো বেশ নতুনই। আর ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে এই রকম দাগ পড়বে বলে তো মনে হয় না।”

বাবুদা উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি এতক্ষণ খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর প্ৰণববাবু বসেছিলেন একটা বেতের চেয়ারে। বাবুদাকে উঠতে দেখে উনিও উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “ক্যামেরা লাগিয়ে তাহলে ঠিকই করেছি?”

“নিশ্চয়ই। সাবধানের মার নেই। তবে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল।”

“বলুন? আরেক কাপ করে চা দিতে বলি?”

“না, না থাক। এই তো খেলাম। আপনি খেতে চাইলে খেতে পারেন।”

“ফাইন।”

“আমি আসার সময় দেখলাম যে আপনাদের বাড়ির গেটে কোন দারোয়ান নেই। আপনার বাড়িতে এত দামি একটা জিনিষ আছে। দারোয়ান না থাকার কারণটা জানতে পারি?”

“দারোয়ান ছিল একটা সুদীপ বলে। ব্যাটা ডিউটিতে ঘুমাত। তাই গত পরশু আমার ছেলে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। একটা সিকিউরিটি এজেন্সিতে আজ সকালেই খবর দিয়েছি। বলেছে দুদিনের মধ্যেই নতুন লোক পাঠিয়ে দেবে।”

“আপনি ওই সিকিউরিটি এজেন্সিতে ফোন করে বলুন যদি সম্ভব হয় তাহলে যেন আজ থেকেই নতুন দারয়ানের ব্যবস্থা করে। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, রাতে এই বাড়িতে আপনি ছাড়া আর কে কে থাকে?”

“আমি ছাড়া থাকে আমার ছেলে বিপ্লব, আমার ভাগ্নে অনিমেষ, আমার বন্ধুর ছেলে সৌম্যদীপ আর আমার চাকর দীননাথ।”

“আচ্ছা, আপনি ওনাদেরও বলবেন একটু সজাগ থাকতে। আর একটা কথা, দেখলাম আপনার টেবিলে একটা গ্লুকোজ ট্যাবলেটের শিশি, আপনার কি হাইপোগ্লাইসিমিয়া ধরনের কোন আসুখ আছে?”

প্ৰণববাবু মুখটা বেশ প্রসন্নতার হাসিতে ভরে উঠল। বললেন, “ধন্নি আপনার দৃষ্টি মিঃ মিত্র। ঠিক ধরেছেন আমার একিউট হাইপোগ্লাইসিমিয়া আছে। দিনে তিনটে গ্লুকোজের বড়ি না খেলে চলে না।”

“আই সি, তাহলে কোন রকম দারকার হলে আমায় জানাতে দ্বিধা করবেন না আর একটু সাবধানে থাকবেন। আমার তো মনে হয় পুলিশ প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করলে বেশি সেফ হত। আচ্ছা, আজ আসি তাহলে?” এই বলে বাবুদা আর আমি প্ৰণববাবুর থেকে বিদায় নিলাম।

বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। রাস্তায় ‘হাইপোগ্লাইসিমিয়া’ কী, জিজ্ঞেস করতে বাবুদা বলল, “রক্তে সুগার বেড়ে যাওয়া যেমন খারাপ, তেমন কমে যাওয়াও খারাপ। রক্তে এই সুগার লেভেল যদি সত্তর মিলিগ্রাম পার লিটারের থেকে কম হয় তাহলে সেটাকে হাইপোগ্লাইসিমিয়া বলে। সাধারণ মানুষের থাকে ১১০ থেকে ১২০ মিলিগ্রাম পার লিটার। এই ব্লাড সুগার লেভেল বাড়ানোর জন্য গ্লুকোজের ট্যাবলেট খেতে হয়, বুঝলি?”

বাড়ি ফেরার পথে বাবুদার সাথে প্ৰণববাবুর আর কোন কথা হয়নি। ও শুধু একবার নিজের থেকেই বলল, “আবিষ্কারের খবরটা পত্রিকায় বেরিয়ে ঠিক হয়নি রে মান্তে। এত বড় বৈজ্ঞানিক মুখ ফসকে বলে দিল?”

(৩)

আজ সকাল থেকে মনটা ভালো নেই। কোথায় ভেবেছিলাম বাবুদার নতুন তদন্তে ছুটিটা ভালো কাটবে কিন্তু যেখানে রহস্যই নেই, সেখানে আর তদন্ত হবে কী করে? আমি কখনই চাই না যে এত জরুরি একটা পেপার যেটা মানুষের ভালো করতে পারে তা চুরি হয়ে যাক, কিন্তু একটু রহস্য থাকলে যেন বেশি ভালো লাগত। তার উপরে আজ বাবুদার সাথে এসপ্ল্যানেডে যাওয়ার প্ল্যান ছিল, কিন্তু গত কাল রাত থেকে যে মুশল ধারে বৃষ্টি নেমেছে, তাতে মনে হয় না আজ আর বেরনো যাবে বলে। একটু আগে টিভিতেও দেখাচ্ছিল যে আগামি দুদিন প্রচণ্ড বর্ষণের আশঙ্কা, একেবারে বজ্র বিদ্যুৎ সহ। জানুয়ারি মাসে এই রকম বৃষ্টি খুব একটা দেখা যায় না।

বৈঠকখানায় গিয়ে দেখি বাবুদা সোফায় বসে ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরীর লেখা ‘জেনেটিক ইন্টেরপ্রিটেশন’ বইটা পড়ছে। আর মাঝে মাঝে কোলের উপর রাখা ল্যাপটপে কী সব লিখছে। আমাকে আসতে দেখে ও হেসে বলল, “আজ আর বেরনো হবে বলে মনে হয় না। যা বৃষ্টি হচ্ছে।”

আমি একটা ম্লান হাসি হেসে বাবুদার পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম, “ল্যাপটপে কী লিখছ?”

“জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং খুব কঠিন সাবজেক্ট। আর তার টার্মগুলোও বেশ শক্ত। তাই যেগুলো জানি না সেগুলো নেট-এ দেখে নিচ্ছি।”

আমি উঁকি মেরে দেখলাম ল্যাপটপে গুগুল খোলা। তাতে লেখা ‘মাইক্রো এঙ্ক্যাপসুলেশন টেকনিক’।

একটু পরে বাবুদা নিজে থেকেই বলল, “সকালে ফোন করেছিলাম প্ৰণববাবুকে। কাল রাতে কোন উৎপাত হয়নি। আজ থেকেই রাতে পাহারা বসবে। তোর ভাগ্যটাই খারাপ রে, মান্তে।”

আমি আর কী বলব, মনে মনে ভাবলাম এখনও তো মা-দের ফিরতে দশদিন দেরি আছে, দেখি কোন নতুন কেস আসে নাকি।

বাবুদা আর কিছুই বলছে না দেখে আমি বইয়ের আলমারি থেকে ফেলুদার ‘বাদশাহি আংটি’ বইটা বের পড়তে লাগলাম। আগেও পড়েছি বার তিনেক, আবার শুরু করলাম প্রথম থেকে। সারাদিন কেটে গেল এই ভাবেই। দুপুরে সুখেনকাকার রান্না কচি পাঠার ঝোল দিয়ে বাসুমতি চালের ভাত খেয়ে ঘরে গিয়ে বসলাম। আসার সময় দেখি বাবুদা আবার সেই চীনা ভাষার বইটা নিয়ে বসেছে। একে মন ভালো নেই, তার উপরে বৃষ্টি থামার নাম নেই। বিছানায় শুয়ে ‘বাদশাহি আংটি’ পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙল বাবুদার ডাকে। উঠে দেখি বাবুদা প্যান্ট সার্ট পড়ে রেডি। বিছানায় বসতেই ও বলল, “রেডি হয়ে নে, বেরতে হবে। দেবাঙ্গনবাবু ফোন করেছিল, পেপার চুরি গেছে।”

তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাইরে এসে দেখি বৃষ্টি ধরে গেছে, কিন্তু রাস্তার জল এখনও নামেনি। আকাশ মেঘে ঢেকে থাকার ফলে আজ অন্ধকারটা যেন খুব তাড়াতাড়ি নেমে এসেছে। ঘড়িতে দেখি সবে পাঁচটা দশ।

নবনালন্দা স্কুলের সামনে অবধি হাঁটার পর একটা ট্যাক্সি পেলাম। তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতে উঠে বাবুদা বলল, “রাজাবাজার চলো, জলদি।”

ট্যাক্সি চলতে লাগলো, বাবুদা আর আমি পিছনে বসে আছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে চুরি হল?”

ও একটা সিগারেট ধরিয়ে পোড়া দেশলাই কাঠিটা আবার বাক্সের মধ্যে রেখে বলল, “ডিটেলে কিছু বলল না। বিকেলে ল্যাব থেকে ফিরে প্ৰণববাবু দেখেন সিন্দুক খোলা, ভিতরে পেপারের ফাইলটা নেই।”

“পুলিশে খবর দেয়নি?”

“দিতে তো বললাম।” সংক্ষেপে উত্তর দিল বাবুদা।

গাড়িতে আর কথা হয়নি। বৃষ্টির ফলে রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। তাই গাড়ির স্পিড চল্লিশের বেশি উঠছিল না। তার উপরে সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের বিরাট জ্যাম কাটিয়ে রাজাবাজার পৌঁছতে সোয়া ছ’টা বেজে গেল।

গিয়ে দেখি পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। ফটকের সামনে দুজন উর্দি পরা কন্সটেবেল দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ঢুকতে দেখে হাত দেখাল, “কাকে চাই?”

বাবুদা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে একজন লম্বা মত ইনস্পেক্টর বেরিয়ে এসে বলল। “আসতে দাও।”

বাবুদা দেখি হাসি মুখে ওনার দিকে এগিয়ে গেল। উনিও হেসে হাত মেলালেন, বললেন, “কী মিঃ মিত্র, গন্ধে গন্ধে চলে এসেছেন?”

আমি দেখলাম ওনার বুকের উপর ডান দিক কালো ব্যাজের উপর সোনালি দিয়ে লেখা দেবব্রত দাস।

বাবুদাও হেসে বলল “কী করব বলুন ইনস্পেক্টর দাস, আপনার মত আমাকে তো আর সরকার মাইনে দেয় না। তাই মাঝে সাঝে উড়ে এসে জুড়ে বসতে হয় আর কী?”

“ভালো, ভালো। ডাঃ রায় চৌধুরী আপনার কথা বলছিলেন।”

“তা চুরিটা কখন হয়েছে মনে হয়?”

“ডাঃ রায় চৌধুরী তো বলছেন দুপুরের দিকে। সেই সময় বাড়িতে কেউ ছিল না ওদের চাকরটা ছাড়া। আমি তো মোটামুটি কথা বলেছি সবার সাথে, আপনিও দেখুন। যান, ডাঃ রায় চৌধুরী বৈঠকখানায় আছেন।”

আমরা বাড়ির ভীতরে ঢুকলাম। একতলার বৈঠকখানায় প্ৰণববাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। দেবাঙ্গনবাবু সোফার পাশটায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আরও দুজনকে দেখলাম বইয়ের আলমারিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। প্ৰণববাবুর পাশে আরও একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন, গলায় স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে।

বাবুদা প্ৰণববাবুকে বললেন, “ঘটনাটা একটু বলবেন?”

“কী আর বলব বলুন মিঃ মিত্র, আমার দশ বছরের গবেষণা জলে চলে গেল।”

“না মানে, আপনি কখন দেখলেন যে সিন্দুকে পেপার নেই?” বাবুদা বেশ গম্ভীর।

“আমি সকালে যখন কাজে যাই তখন দেখে গেছি সিন্দুকে পেপারটা ছিল। বিকেলে বাড়ি ফিরে এখানে বসেই চা খাচ্ছিলাম। দীননাথকে বলি আমার ঘরে আমার ব্যাগটা রেখে আসার জন্য। তারপর উপরে গিয়ে সিন্দুক খুলে একটা কাগজ বের করতে গিয়ে দেখি পেপারের ফাইলটা নেই। আমি আবার সিন্দুক বন্ধ করে দিয়ে আপনাকে ফোন করতে বলি”, কোন রকমে বলে প্ৰণববাবু দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢুকে ফেললেন।

বাবুদা জিজ্ঞেস করল, “আপনার সিন্দুকে পেপার ছাড়া আর কী ছিল?”

“টাকা ছিল বেশ কিছু, তাও প্রায় হাজার বিশেক। বাড়ির দলিল ছিল, আরও কিছু কাগজপত্র।”

“সেগুলো ঠিক আছে?”

“সব আছে মিঃ মিত্র, সব আছে। শুধু ওই পেপারের ফাইলটাই নেই।”

“আপনার ঘরটা আরেকবার দেখা যায়?”

“নিশ্চয়ই। দেবাঙ্গন, ওনাদের আমার ঘরে নিয়ে যাও,” প্ৰণববাবু ওনার সহকারীর উদ্দেশে বললেন।

বাবুদা বলল, “আমি আপনার ঘরটা দেখে আসি, তারপর আপনার সাথে আরও একটু কথা বলার ছিল।”

প্ৰণববাবু মাথা নিচু করেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন।

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে দেবাঙ্গনবাবু বললেন, “কী বিশ্রী ব্যাপার বলুন তো? আমি স্যারকে বলেছিলাম যে পেপারটা যদি ল্যাবে না রাখেন তো ব্যাঙ্কে রাখুন। শুনলেন না। বললেন ‘কখন কী দরকার হয়, আর যেখানে পেপারের কাজ এখনও চলছে, সেখানে আমি কি রোজ রোজ ব্যাঙ্কে গিয়ে কাজ করব?’ একদিক দিয়ে কথাটা ঠিক কিন্তু ব্যাঙ্কে থাকলে এই চুরি কি হত? বলুন?”

বাবুদা কোন উত্তর দিল না। বরং উলটে প্রশ্ন করল, “পেপারের আর কপি আছে? আপানর কাছে?”

“না মিঃ মিত্র, পেপারের একটাই কপি আর সেটা এইটা মানে যেটা চুরি গেছে। আমাদের ফিল্ডে পেপারের একটা করেই কপি রাখা হয়, না হলে জাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যত শিক্ষিত মানুষ, তার তত কুটিল মন।”

সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমরা প্ৰণববাবুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। ঘরের সামনে একজন কন্সটেবেল দাঁড়িয়ে আছে। দেবাঙ্গনবাবু বললেন, “আপনারা ভিতরে গিয়ে দেখুন, আমি এখানে আছি। দরকার হলে ডাকবেন।”

আমাদের ঘরে ঢুকতে দেখে কন্সটেবেলটা কিছু বলল না দেখে বুঝলাম যে ইন্সপেক্টর দাস তাকে ইতিমধ্যে খবর দিয়ে দিয়েছে। আমরা দুজন ঘরে ঢুকে দেখি কালকের থেকে আজকে কোন তফাত নেই। বাবুদা সোজা চলে গেল সিন্দুকটার সামনে, তারপর হাঁটু গেঁড়ে বসে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে সেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ইন্সপেক্টর দাসের থেকে সিন্দুকের চাবিটা উপরে আসার আগেই বাবুদা নিয়ে নিয়েছিল। সেই দিয়ে এবার সিন্দুকটা খুলল ও। সিন্দুকের ভিতরে দুটো তাক। উপরেরটাতে কিছু কাগজপত্র রাখা আছে আর নীচের তাকটায় একশো টাকার নোটের বাণ্ডিল। তারপর পকেট থেকে একটা ছোট্ট কালো রঙয়ের ডাইরি বের করে তাতে কীসব লিখতে লিখল। আমিও বাবুদার কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে দেখলাম সিন্দুকটা। স্পেশাল কিছুই দেখলাম না। মিনিট পাঁচেক পর বাবুদা উঠে গিয়ে দাঁড়াল আলমারির উপর সেই সি সি টিভি ক্যামেরাটার সামনে। তারপর বলল, “চল, নীচে যাওয়া যাক।”

আমি ফিসফিস করে বাবুদার কানের কাছে গিয়ে বললাম, “কিছু পেলে?”

ও কিছু বলল না দেখে আমিও চুপ মেরে গেলাম।

নীচে গিয়ে দেখি প্ৰণববাবু একটু নর্মাল হয়েছেন। পাশের সেই ডাক্তারও আর নেই। বাবুদা ওনার উল্টো দিকের একটা চেয়ারে বসে বলল, “আপনাকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল ডাঃ রায় চৌধুরী।”

“বলুন, তবে তার আগে আমি একটা কথা বলতে চাই,” সোজা হয়ে বসে বললেন ভদ্রলোক, “এই কেসটা আপনি সমাধান করে দিন। খুঁজে দিন আমার অমূল্য গবেষণা। আপনার ফি নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না। দেবাঙ্গন, ওনাকে দিয়ে দাও।”

বলা মাত্রই দেবাঙ্গনবাবু জামার পকেট থেকে একটা খাম বের করে বাবুদার হাতে দিল।

“এতে কুড়ি হাজার টাকার চেক আছে। আপনার পুরো ফি। আপনি যে করেই হোক আমার পেপারটা খুঁজে বের করুন।”

বাবুদা খামটা পকেটে রেখে বলল, “ধন্যবাদ। তবে আপনার সাথে একটু একা কথা বলতে পারলে ভালো হত।”

“আচ্ছা বেশ, আসুন”, এই বলে প্ৰণববাবু উঠে ভিতরে একটা ছোট ঘরে গিয়ে বসলেন। এই ঘরটা বেশ ছোট। আর আসবাব বলতেও একটা টেবিল আর তিন চারটে চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। দেওয়ালে একটা ব্ল্যাক বোর্ড টাঙানো।

“এখানে আপনি পড়াতেন বুঝি?” বাবুদা প্রশ্ন করল।

মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন প্ৰণববাবু।

টেবিলের এক দিকে বসলাম আমি আর বাবুদা, আর উল্টো দিকে বসলেন প্ৰণববাবু।

বাবুদা বলতে শুরু করল, “ইন্সপেক্টর দাসের কাছে শুনলাম যে সেই সময় বাড়িতে আপনার চাকর ছাড়া আর কেউ ছিল না। তা আপনার এই চাকরটি বিশ্বাসী তো?”

“দীননাথ আমার বাড়ি কাজ করছে প্রায় বছর দশেক। ওর মত বিশ্বাসী লোক আমি দুটো দেখিনি। কতদিন টেবিলে দুশো পাঁচশো টাকা পড়ে থাকে, কোনদিন এক পয়সায় ও হাত দেয়নি।”

“এই পেপারটা যে আপনি বাড়িতে রেখেছিলেন, এই খবরটা কে কে জানে?”

“বাড়ির সবাই মোটামুটি জানে। আমি আসলে সবাইকে জানাতে চাইনি। যেদিন পেপারটা আনি, তার পরের দিন কথা প্রসঙ্গে দেবাঙ্গন বলে ফেলে, আর তাই থেকেই সবার জানা। কিন্তু এক সৌম্য ছাড়া আর কেউ ইন্টারেস্ট দেখায়নি ওটার উপর। সৌম্যই একবার জিজ্ঞেস করেছিল কীসের পেপার, বাড়িতে কেন রাখলাম ইত্যাদি।”

“আচ্ছা, যে সময় চুরিটা হয়, আপনি ল্যাবে ছিলেন?”

“হ্যাঁ, রোজ সকাল ন’টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটে অবধি আমি ওখানেই থাকি। আজও তাই ছিলাম।”

“আর দেবাঙ্গনবাবু?”

“সেও ছিল আমার সাথে, কিন্তু বাড়িতে ওর মেয়ের শরীর খারাপ হওয়ায় ও দুটো নাগাদ বাড়ি চলে যায়। তারপর চুরির ব্যাপারটা বলতে ও এখানে চলে আসে।”

“পেপারের খবরটা ছাপার পর সেটা কেনার জন্য অনেকেই আপনাকে ফোন করেছে এটা আপনিই বলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কাউকে কি মনে হয়েছে যে পেপারটা পাওয়ার জন্য বিশেষ নাছোড়বান্দা?” বাবুদা প্রশ্ন করছে আর ওই কালো খাতাটায় খসখস করে কীসব লিখছে।

“ভালো কথা মনে করিয়েছেন মিঃ মিত্র। ওই ব্যাপারটা তো ভুলেই গেছিলাম। সবাই একবার করেই ফোন করেছিল এক মিঃ কেডিয়া ছাড়া।”

“মিঃ কেডিয়া, মানে রমাকান্ত কেডিয়া?”

“ইয়েস, রমাকান্ত কেডিয়া, কেডিয়া কেমিক্যালস-এর মালিক। সে প্রায় বার পাঁচেক ফোন করেছে। আমি প্রতিবারই না করে দিই। আমার ল্যাবেও এসেছিল একদিন। আমি ছিলাম না বলে দেখা হয়নি।”

“শেষ কবে ফোন করেছিলেন?”

“গতকাল রাতে। আপনারা চলে যাওয়ার পর, এই সাড়ে সাতটা নাগাদ। বললেন, ‘পেপারটা পাওয়ার অন্য উপায়ও আছে ডাঃ রায় চৌধুরী। আর তাতে কিন্তু আপনার কোন প্রফিট হবে না। ভেবে দেখুন কী করবেন। এক সপ্তাহ পর আবার ফোন করব।’ তিন কোটি অফার করেছিল।”

তিন কোটি টাকা!শুনে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। আর যে পেপারের দাম তিন কোটি টাকা, সেটা উনি মানুষের স্বার্থে বিনা পয়সায় দিয়ে দেবেন এটা ভেবে প্ৰণববাবুর প্রতি সম্মানটা এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গেল।

“আই সি, তা ওনার অফিসের ঠিকানাটা পাওয়া যাবে? কার্ড দিয়েছিলেন নিশ্চয়ই?” বাবুদা গম্ভীর।

“হ্যাঁ, ওটা দেবাঙ্গনের কাছে আছে। আপনাকে দিতে বলে দেব।”

“এই দেবাঙ্গনবাবু সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?”

“না, না, ও এসবের মধ্যে নেই। আপনি ওকেও সন্দেহ করছেন নাকি?” একটু উদ্বিঘ্ন হয়ে বললেন প্ৰণববাবু।

“সন্দেহ করাই তো আমার কাজ মিঃ রায় চৌধুরী। তা কী মনে হয় ওনার সম্বন্ধে?”

“দেখুন মিঃ মিত্র, দেবাঙ্গন আমার ছেলের মত। গত দশ বছর ও আমার সাথে আছে, আমার কাছে পি এচ ডি করে আমার সহকারীর কাজ করছে। আর ওর যদি পেপারটা হাত করতে হত তাহলে ওর সুযোগ অনেক ছিল। সিন্দুক ভেঙে চুরি ওকে করতে হত না।”

“আচ্ছা, আর বাড়ির বাকিদের সম্পর্কে?”

“আর বাকি বলতে আমার ছেলে বিপ্লব, আমার ভাগ্নে অনিমেষ আর সৌম্য। ওদের কাউকে সন্দেহ করার মত আমার কাছে কিছু নেই।”

“তা আমি যদি ওনাদের সাথে একটু কথা বলি এই চুরির ব্যাপারে তাহলে আপনার কোন আপত্তি নেই নিশ্চয়ই?”

“একদম না।”

“ওকে, আর একটা কথা, আপনার সি সি টিভি ক্যামেরায় চোরের ছবি উঠেছে নিশ্চয়ই?”

প্ৰণববাবু কীরকম একটু মূর্ছিত হয়ে পড়লেন, বললেন, “ভেবেছিলাম ওই যন্ত্রটা লাগিয়ে কিছুটা লাভ হবে, কিন্তু কিছুই হল না।”

“মানে ক্যামেরায় চোরের ছবি নেই?” খুব শান্ত হয়ে প্রশ্ন করল বাবুদা এমন যেন ছবি থাকবে না ও আগে থেকেই জানত। পরে ওকে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, “যদি ক্যামেরায় চোরের ছবিই থাকত তাহলে কি আর আমার ডাক পড়ে?”

“না মিঃ মিত্র, কিচ্ছু নেই। ঘর যেমন তেমনই আছে। চোরের টিকিটিও দেখা যায়নি।”

“আমি একবার টেপটা দেখতে চাই। পাওয়া যাবে তো?”

“কিন্তু ওটা তো পুলিশের জিম্মায়। আপনাকে ইনস্পেক্টর দাসের সাথে কথা বলে দেখতে হবে। কিন্তু আমি বারবার দেখেছি, ওখানে চোরের কোন চিহ্নই নেই।”

প্ৰণববাবুকে দেখে মনে হচ্ছিল উনি ঠিক সুস্থবোধ করছেন না। কীরকম যেন একটু ঢুলছেন। বাবুদা বলল, “আপনার উপর দিয়ে আজ অনেক ধকল গেছে। আপনি একটু বিশ্রাম করুন। আর দেবাঙ্গনবাবুকে দয়া করে একটু বলে দিন যে মিঃ কেডিয়ার কার্ডটা যেন আমায় একটু দিয়ে দেয়। আর বাকিদের সাথে আমি একটু কথা বলব, সেটাও যদি আপনি একটু বলে দেন, তাহলে খুব ভালো হয়।”

প্ৰণববাবু “আচ্ছা” বলে উঠে গিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট তিনেক পড়ে দেবাঙ্গনবাবু এসে মিঃ কেডিয়ার কার্ডটা বাবুদাকে দিয়ে বললেন, “মিঃ মিত্র, আগে সৌম্যদীপবাবুকে আসতে বলি? উনি আবার একটু বেরবেন বলছিলেন।”

“আচ্ছা, ওনাকেই ডাকুন,” সংক্ষেপে উত্তর দিল বাবুদা।

দেবাঙ্গনবাবু চলে যেতে দীননাথ এসে চা আর বিস্কুট দিয়ে গেল। বাবুদা চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “বুঝলি মান্তে, ভেরি ইন্টারেস্টিং!”

এই বলে বাবুদা পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে একটা ফোন করল। আমি উঁকি মেরে দেখলাম এল সি ডি স্ক্রিনে লেখা ইনস্পেক্টর দেবব্রত দাস। আমি একদিকের কথাই শুনেছিলাম কিন্তু তা থেকে ওপাশের কথা কী হতে পারে তা আন্দাজ করে লিখছি।

“হ্যালো, দাসবাবু?”

“বলুন মিঃ মিত্র।”

“আপনার একটু হেল্প চাই। পাওয়া যাবে কি?”

“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। বলুন?”

“ডাঃ রায় চৌধুরীর ঘরের সি সি টিভি ক্যামেরার ফুটেজটা চাই।”

“শুধু কাল দুপুরেরটা তো?”

“না, ওখানে তো আছেই দুদিনের। আমার পুরোটাই চাই।”

“আচ্ছা, আজ রাতের মধ্যে ওটার একটা কপি আমি কন্সটেবেলকে দিয়ে আপনার বাড়ি পাঠিয়ে দেব। আর কিছু?”

“এতেই হবে। ধন্যবাদ।”

“আর হ্যাঁ”

“বলুন”

“আমি কোন খবর পেলে আপনাকে জানাব, আশা করি কোন ক্লু পেলে আপনিও আমায় জানাবেন?”

“সে আর বলতে? আপনাকে ছাড়া তো চলবে না মশাই। কেস যদি সল্ভ হয়, তাহলে আপনিই তো শেষ সিনের হিরো।”

বাবুদা ফোন রেখে আমার দিকে ফিরে বলল, “মান্তে, আজ রাতে ঘুম বন্ধ।”

(৪)

বাবুদা চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে পকেট একটা সিগারেট ধরালো। এমন সময় একজন ভদ্রলোক দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আসতে পারি?”

বাবুদা গম্ভীর গলায় বলল, “আসুন।”

ভদ্রলোক এসে আমাদের সামনের চেয়ারটায় বসলেন। আমরা যখন আসি, ইনি সামনের ঘরে ছিলেন না। ভদ্রলোকের চেহারাটা চোখে পড়ার মত। লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। চেহারা মাঝারি, গায়ের রঙ ফর্সা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কানে ছোট্ট একটা দুল, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। ওনার চোখের মনির রঙ হালকা, চশমা পরেন না। যদিও ওনার সার্টের বুক পকেট থেকে একটা রে ব্যানের সানগ্লাসের অংশ উঁকি দিচ্ছে। আরও একটা ব্যাপার আমার চোখে পড়ল। ওনার কপালের ডান দিকে একটা ছোট্ট কাঁটা দাগ। উনি বসতে বসতে বললেন, “দেখুন মিঃ মিত্র, আমার একটু কাজ আছে, বেরোতে হবে। যা জিজ্ঞেস করার তা একটু তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয়।”

টেবিলের উপরে রাখা অ্যাস্ট্রেতে সিগারেটটা ফেলে বাবুদা বলল, “আমার কিছু প্রশ্ন আছে আপনার কাছে, আপনি যত তাড়াতাড়ি তার জবাব দেবেন, তত তাড়াতাড়ি আপনার ছুটি।”

“ওকে। বলুন।”

“আপনার নাম?”

“সৌম্যদীপ দত্ত।”

“আপনি কতদিন এই বাড়িতে আছেন?”

“এই ধরুন বছর দশেক।”

“কেন জানতে পারি কি? মানে আপনার যদি অসুবিধে না থাকে।”

“না, না, অসুবিধে থাকবে কেন? জ্যেঠু মানে প্ৰণবজ্যেঠু আমার জন্য যা করেছেন, সেটা আপন কেউও করে না। আমার বাবা আর জ্যেঠু একসাথে স্কুলে পড়তেন। মাকে আমি জন্মের সময়ই হারিয়েছি। বছর দশেক আগে টি বি রোগে আমি বাবাকে হারাই। বাজারে অনেক দেনাও ছিল বাবার। তাই ওনার মৃত্যুর পর আমাদের বাড়িটা বিক্রি করে সেই ধার মেটাই। তারপর একদিন সকাল হঠাৎ করে আমার কলেজের মেসে জ্যেঠু এসে হাজির। নিয়ে এলেন এখানে। তারপর থেকে এখানেই আছি।”

“আই সি, তা কী নিয়ে পড়াশুনা করেছেন আপনি?”

“কমার্স। এম কম।”

“চাকরি করেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, ডালহৌসিতে গাঙ্গুলি অ্যান্ড সন্স-এ, চিফ একাউন্টেন্ট।”

“আজ যখন চুরিটা হয়, আপনি তখন কোথায় ছিলেন?”

“অফিসে। যদিও মাঝখানে এই ধরুন দুপুর আড়াইটে নাগাদ একবার বেরিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে।”

“এই বৃষ্টির মধ্যে? তা বন্ধুর নাম?”

“আপনি তাকেও জেরা করবেন নাকি?” একটু উদ্বিঘ্ন হয়ে বলে উঠলেন সৌম্যদীপবাবু।

বাবুদা হেসে বলল, “দরকার পড়লে করতে হবে বৈকি।”

সৌম্যদীপবাবু একটু দমে গেলেন যেন। গলাটা একটু নামিয়ে বললেন, “আসলে কী জানেন মিঃ মিত্র, জ্যেঠু চায় আমি ওনার ভাইজির সাথে বিয়ে করি। উনি মোটামুটি কথাও নাকি বলে রেখেছেন। কিন্তু...”

“কিন্তু কী মিঃ দত্ত?”

“আমি একজনকে ভালোবাসি। আমার অফিসেই কাজ করে ও। নাম দেবস্মিতা গাঙ্গুলি। আজ আমি ওর সাথেই একটু বেরিয়েছিলাম। এটা দয়া করে জ্যেঠুকে জানাবেন না। উনি খুব কষ্ট পাবেন। আমিই ওনাকে বলব ভাবছিলাম দিন দুয়েকের মধ্যে কিন্তু কাল যা হল, তারপর...”

“আচ্ছা তাই, বলব না। তা নতুন সংসার করতে গেলে টাকার তো দরকার হয় মিঃ দত্ত।”

“আপনি কি বলতে চাইছেন আমি চুরি করেছি?” বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন সৌম্যদীপবাবু।

“আমি কিছুই বলতে চাইছি না। তা এই চুরি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?”

“ধারণা মানে?”

“মানে আপনার কি কারুর উপর সন্দেহ হয়?”

“দেখুন মিঃ মিত্র, আমি এই বাড়িতে একজন আশ্রিত মাত্র। আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই এই সব পেপার টেপারের ব্যাপারে। বুঝিও না জেনেটিক্স কী। আর যদি টাকার কথাই বলেন তো এ বাড়িতে আরও অনেকেই আছেন যাদের টাকার প্রয়োজন আমার থেকে অনেক বেশি।”

“যেমন?” বাবুদা আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছে।

“এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না মিঃ মিত্র। আমায় ক্ষমা করবেন।”

“দেবাঙ্গনবাবুর সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?”

“ওনার সাথে আমার খুব একটা কথা হয় না। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে আমার আটটা বেজে যায়। ততক্ষণে দেবাঙ্গনদা বাড়ি চলে যায়।”

“আই সি, আর একটা কথা, মিস গাঙ্গুলি সম্পর্কে এই বাড়ির আর কেউ কিছু জানেন?”

“পাগল হয়েছেন। কেউ জানলেই তো সেটা জ্যেঠুর কানে গিয়ে উঠবে। আমাকে এখানে অনেকেই ঠিক পছন্দ করে না। সেটা আসা করি বুঝতে পেরেছেন।”

“আচ্ছা, আপনি এবার আসতে পারেন। দরকার পড়লে আবার কথা হবে।”

“নিশ্চয়ই, আই এম অলঅয়েজ রেডি টু হেল্প।” এই বলে সৌম্যদীপবাবু উঠে গেলেন। উনি দরজার কাছে পৌঁছতে বাবুদা বলল, “আর একটা কথা মিঃ দত্ত, আপনার ঘরটা আমি একবার দেখতে চাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তো?”

“এখন? আচ্ছা, আসুন।”

আমি আর বাবুদা সৌম্যদীপবাবুর পিছন পিছন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। আজ দোতলা ছাড়িয়ে উঠলাম তিন তলায়। দোতলার বারান্দাটার থেকে এখানের বারান্দাটা একটু ছোট। ঘরের সংখ্যাও কম। দরজা এখানে মাত্র চারটে, তার মধ্যে তিনটে ঘর আর শেষের দরজাটা ছাদে যাওয়ার। বাবুদা সৌম্যদীপবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “এই ফ্লোরে আপনি ছাড়া আর কে থাকে?”

“এই যে প্রথম দরজাটা দেখছেন, এটা দীননাথের ঘর। আর ওই কোণার ঘরটা আমার। মাঝের ঘরটা খালিই থাকে।”

“আই সি।”

সৌম্যদীপবাবুর ঘরটা মাঝারি সাইজের আর আসবাব বলতে একটা সিঙ্গেল খাট, একটা কাঠের আলমারি, একটা বেতের সোফা আর ঘরের কোণায় একটা টেবিলের উপর ওনার ল্যাপটপ। খাটের পাশে একটা চেয়ারে একজোড়া জামা প্যান্ট রাখা। প্যান্টের পায়ের কাছে কাদার ছিটে আমিও লক্ষ করলাম, মনে হয় এটা পরেই উনি অফিস গেছিলেন।

বাবুদা ঘুরে ঘুরে সারা ঘরটা ভালো করে দেখল। তারপর বলল, “খাটের তলার এই ট্রাঙ্কটায় কী আছে, মিঃ দত্ত?”

“আমার কিছু পুরানো জামা কাপড় আর কাগজপত্র। পুলিশের লোক একবার খুলে দেখে গেছে। আপনি দেখবেন?”

বাবুদা একবার জানলার পাশে গিয়ে নিচের দিকে কী যেন দেখল, তারপর ফিরে এসে বলল, “চলুন, একবার ছাদটা ঘুরে নীচে চলে যাব।”

“ছাদে যাবেন? দাঁড়ান, চাবিটা নিয়ে আসি।” এই বলে সৌম্যদীপবাবু নীচে চলে গেলেন চাবি আনতে। সেই ফাঁকে আমি বাবুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি মনে হচ্ছে যে বাড়ির কেউই এই চুরিটার সাথে যুক্ত? বাইরের লোকও তো হতে পারে?”

বাবুদা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, “পেপারটা যে সিন্দুকে আছে সেটা বাইরের লোকের পক্ষে জানা সম্ভব নয় যদি না বাড়ির কেউ সেটা তাকে বলে না দেয়। আর বাইরের লোক এলে সে সারা ঘর খুঁজবে পেপারটা। শুধু সিন্দুক থেকে ওটা বের করে নিয়ে যাবে না।”

আমার আরও কিছু প্রশ্ন ছিল, কিন্তু সেটা করার আগেই সৌম্যদীপবাবু ছাদের চাবি নিয়ে হাজির। সুন্দর সাজানো ছাদ, ধারের রেলিঙের উপর ছোট ছোট টবে নানা রকম ফুল গাছ। বাবুদা এগিয়ে গিয়ে একটা গোলাপ গাছকে খুব মন দিয়ে দেখছে দেখে সৌম্যদীপবাবু বললেন, “এই গুলো জ্যেঠুই নিজে দেখেন। ওনার খুব ফুল গাছের শখ।”

আমদের নীচে নেমে আসতে দেখে দেবাঙ্গনবাবু বললেন, “সৌম্যদীপবাবুর সাথে কথা হয়ে গেলে বিপ্লববাবুকে ডেকে দিই?”

বাবুদা বলল, “না ডাকার দরকার নেই, ওনাকে বলুন আমরা ওনার ঘরে গিয়েই কথা বলব, সে ফাঁকে ওনার ঘরটাও একেবারে দেখা হয়ে যাবে।”

মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতেই বিপ্লববাবু এসে হাজির। এনাকে আগেই দেখেছি, আমরা যখন আসি তখন বৈঠকখানার বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে ইনি একজন ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছিলেন। সেই ভদ্রলোক মনে হয় প্ৰণববাবুর ভাগ্নে, অনিমেষ রায়।

বিপ্লববাবুর চেহারার সাথে প্ৰণববাবুর চেহারার বিশেষ মিল নেই, একমাত্র চোখ দুটো ছাড়া। স্পেশাল কিছু নেই, তবে চোখ দুটো যেন বাবার চোখ বসানো। ইনি কিন্তু বাবার মত লম্বা নন, হাইট খুব বেশি হলে পাঁচ ফুট পাঁচ। চেহারা বেশ ভালোই। চশমা একটা পড়েন ঠিকই তবে তাতে পাওয়ার নেহাতি কম। সোনালি ডাঁটিওয়ালা রিমলেস চশমা। মাথার চুল বেশ লম্বা, প্রায় কাঁধ ছুঁয়ে গেছে। নাকের নীচে বেশ যত্ন করে ছাঁটা একখানা সরু গোঁফ। পরনে পাজামা আর কুর্তা। উনি বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন, “আসুন।”

আমরা আবার সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। প্ৰণববাবুর পাশের ঘরটাই বিপ্লববাবুর। উনি দরজা খুলে আমাদের ভিতরে আসতে বললেন। ঘরটা বেশ বড়, প্রায় প্ৰণববাবুর ঘরের মতই তবে একটু অগোছালো। দরজার বাঁ দিকে একটা বড় খাট আর তার পাশে একটা গোদ্রেজের আলমারি। আলমারিটার পাশে একটা এল ই ডি টিভি লাগানো আছে। খাটের উল্টো দিকে দুটো বড় বড় জানলা আর সেই জানলা দুটোর মাঝে দুটো ছবি লাগানো আছে। একটা মনে হল ওনার মায়ের, কারণ ছবিটার গলায় একটা শুকনো মালা ঝুলছে। আর একটা ছবিতে প্রাইজ পাওয়া কাপ হাতে বাচ্চা ছেলে। বাবুদা ছবিটার সামনে গিয়ে বলল, “জুনিয়ার বেঙ্গল কাপ। কোন ইয়ার?”

“দু হাজার পাঁচ। ম্যান অফ দ্য সিরিজ,” বেশ গর্বের সাথেই বললেন বিপ্লব রায় চৌধুরী।

বাবুদা বলল, “আমিও, দুহাজার তিনে। কালীঘাট ক্লাব।”

বিপ্লববাবু মাথা নাড়ালেন।

খাটের পাশে রাখা দুটো বেতের বেশ কারুকার্য করা চেয়ারে আমাদের বসতে বলে উনি খাটের উপর গিয়ে বসলেন। তারপর বললেন, “বলুন।”

বাবুদা বলল, “আপনার বাবার কাছে শুনলাম যে আপনার নিজস্ব ব্যবসা আছে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার একটা ফ্লাক্স বানানো কারখানা আছে। ব্রেস ব্রিজে।”

“বজবজ লাইনের ব্রেস ব্রিজ?”

“হ্যাঁ। আমার কম্পানি ভারতের বিভিন্ন ষ্টীল প্ল্যান্টে ফ্লাক্স সাপ্লাই করে।”

ফ্লাক্স জিনিষটা কী ? এটা ফেরার সময় বাবুদাকে জিজ্ঞেস করতে ও বলল, “স্টিল বানানোর জন্য অনেক কেমিক্যালের প্রয়োজন হয়। ষ্টীল থেকে ইম্পিউরিটি আলাদা করার জন্য এই ফ্লাক্স দেওয়া হয়। এগোল ইম্পিউরিটির সাথে রি-একশন করে স্ল্যেগ তৈরি করে।” তারপর একটু থেমে বলল, “তোর আপাতত এইটুকু জানলেই হবে।”

বিপ্লববাবু ওর জামার পকেট থেকে একটা গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেট বের করে বাবুদাকে অফার করলেন। তারপর নিজে একটা ধরালেন।

বাবুদা একটা লম্বা টান মেরে জিজ্ঞেস করল, “আপনার কোম্পানি কেমন চলে?”

“মাঝে মার্কেট একটু ডাউন ছিল। কিন্তু এখন অর্ডার খুব ভালো আছে।”

“কোম্পানিটার নাম কী?”

“রেজিনা ফ্লাক্সেস।”

“আই সি, তা আপনার বাবা যে বাড়িতে এত দামি একটা জিনিষ রাখছেন, আপনি তাতে আপত্তি করেননি?”

“আমার আপত্তি যদি বাবা শুনতেন তাহলে তো অনেক সমস্যাই মিটে যেত।”

“কেন, আপনার বাবার সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো নেই?”

“তা থাকবে না কেন? বাবা একটু জেদি প্রকৃতির মানুষ। উনি যেটা ঠিক করবেন সেটাই হবে। আর কারুর মতামতের কোন ভ্যালু নেই।”

“যেমন?”

“যেমন ধরুন এই সৌম্যদীপের ব্যাপারটা। কতবার বলেছিলাম, এখন তো ও চাকরি করছে, ওকে বল অন্য কোন অ্যাকমোডেশন দেখে নিতে, কিন্তু না। উনি যা বলবেন তাই। থেকে গেল এই বাড়িতে”, বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন বিপ্লববাবু।

“সৌম্যদীপবাবুকে আপনার অপচ্ছন্দ করার বিশেষ কোন কারণ আছে কি?”

“নিশ্চয়ই আছে। এমনি এমনি কাউকে অপচ্ছন্দ করার লোক আমি নই মিঃ মিত্র। যে লোক অকারণে মিথ্যে কথা বলে তাকে আমার পচ্ছন্দ হয় না।”

“কী মিথ্যে বলেছে সেটা জানতে পারলে ভালো হত,” বাবুদা বেশ গম্ভীর।

“আমার এক দুঃসম্পর্কের বোনের সাথে বাবা ওর বিয়ে ঠিক করেছেন। তখন একটা কথাও বলেনি। কিন্তু ও যে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে সেটা আমার অজানা নয় মিঃ মিত্র। যে মানুষটা ওর জন্য এত করল, তাকে এই ভাবে ঠকাতে ওর একটুও দ্বিধা হল না?”

“উনি যে লুকিয়ে প্রেম করছেন সেটা আপনি আপনার বাবাকে বলেছেন?”

“নিশ্চয়ই বলেছি। আর বলব নাই বা কেন? বাবারও তো জানা দরকার যাকে উনি এত স্নেহ করেন সে ওনার পিছনে কী করে বেড়াচ্ছে?” বেশ রেগে গিয়েই বললেন বিপ্লববাবু।

“তাতে আপনার বাবার কী মনভাব?”

“খুশি যে হননি, সেটা বলাই বাহুল্য। গত কাল রাতে তো রাগারাগিই হল দুজনের মধ্যে। বাবাও ওকে সাফ বলে দিয়েছেন যে এক সপ্তাহের মধ্যে অন্য অ্যাকমোডেশন দেখে নিতে।”

“আই সি। আর অনিমেষবাবু?”

“অনিমেষের মত ছেলে আমি খুব একটা দেখিনি। নিজের মত থাকে। বাইরে খুব একটা বেশি মেশে না। নিজের মতই থাকে। বাড়িতেও যতক্ষণ থেকে নিজের ঘরে বই নিয়ে। বৈঠকখানার পাশে একটা ঘরে ও থাকে। সারাদিনে শুধু রাতে খাওয়ার সময় ওর দেখা পাওয়া যায়।”

“আজ যখন চুরি হয়, তখন আপানি কোথায় ছিলেন?”

“আপনি আমাকেও সন্দেহ করছেন মিঃ মিত্র?” বিপ্লববাবু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

বাবুদা কোন উত্তর না দেওয়ায় উনি নিজে থেকেই বললেন, “অয়েল, আমি আজ দুপুর দেড়টা অবধি আমার কারখানায় ছিলাম। তারপর একটা মিটিং ছিল কাস্টমারের কাছে। সেখানে গেছিলাম। বাড়ি ফিরেছি পাঁচটা নাগাদ। আপনি আমার পি.এ-কে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

“আপনার মিটিং কোথায় ছিল?”

“এসপ্ল্যানেডের বারিস্তায়।”

“আপনার ক্লায়েন্টের নাম?”

“মিঃ জগদিস সিং, কেডিয়া স্টিল, উড়িষ্যায়।”

“কেডিয়া স্টিল ? রমাকান্ত কেডিয়ার?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“আমার শেষ প্রশ্ন। এই চুরির ব্যাপারে আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?”

“এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না।”

বিপ্লববাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা নীচে চলে এলাম। আসার আগে বিপ্লববাবুকে বলে এল যে দরকার হলে ও আবার আসবে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাবুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আবার কেডিয়া? এনার কথাই প্ৰণববাবু বলেছিলেন না?”

বাবুদা শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল, মুখে কিছু বলল না।

আমি বললাম, “এবার তাহলে মিঃ অনিমেষ দত্ত?”

বাবুদা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দত্ত নয়, রায়। অনিমেষ রায়। দত্ত হল সৌম্যদীপ। নামগুলো মনে রাখার চেষ্টা কর।”

নীচে এসে দেবাঙ্গনবাবুর সাথে রওনা হলাম মিঃ অনিমেষ রায়ের ঘরের উদ্দেশে। যেতে যেতে দেবাঙ্গনবাবু জিজ্ঞেস করল, “আর এক কাপ চা বলি?”

(৫)

অনিমেষবাবুর ঘরটা বৈঠকখানার ঠিক পাশেই। মাঝারি সাইজের ঘর আর আসবাব খুব কম। একটা খাট, একটা আলমারি, একটা টেবিল আর একজোড়া বেতের চেয়ার ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। আর যা আছে সারা ঘরটায়, সেটা হল ওই টেবিল আর খাটের উপর ডাই করা বইয়ের স্তূপ। কী বই নেই সেখানে ! ইংরেজি গল্পের বই, ইতিহাসের বই, কম্পিউটারের বই। এই বইয়ের স্তূপ ছাড়া ঘরটা এমনি বেশ পরিচ্ছন্ন। খাটের উপর একটা কালো প্যান্ট আর হলদে রঙের ফুলহাতা শার্ট পরে বসে আছেন অনিমেষ রায়, হাতে একটা বই নিয়ে। কাছে যেতে দেখেছিলাম ওটা ড্যান ব্রাউনের লেখা ‘ইনফারনো’। এনার গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। বসে আছেন বলে কতটা লম্বা সেটা বুঝতে পারিনি। খুবই রোগা, হাতের শিরা দেখা যায়। মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল আর মুখে দিন তিনেকের না কাঁটা দাড়ি। দরজায় একটা টোকা দিয়ে বাবুদা বলল, “আসতে পারি?”

বাবুদার গলা পেয়ে উনি আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “আসুন।”

এইবার খেয়াল করলাম যে ওনার গলাটা অত্যন্ত মিহি। আর একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি ঘরে ঢুকেই। সেটা হল একটা কড়া সেন্টের গন্ধ। কোন পুরুষ মানুষ যে এত সেন্ট মাখতে পারে সেটা এনাকে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। পরে বাবুদা বলেছিল, “সৌখিন লোক হতে পারেন এই অনিমেষ রায় কিন্তু হয়তো পয়সার অভাবে দামি সেন্ট ব্যবহার করতে পারেন না। এই সেন্টগুলো এসপ্ল্যানেডের ফুটে বিক্রি হয়, একশো টাকায় তিনটে।”

আমরা ঘরে প্রবেশ করতে উনি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। এইবার দেখলাম যে ভদ্রলোক শুধু রোগাই নন, বেশ বেঁটেও। ওনার মাথা প্রায় বাবুদার বুকের কাছে হবে। বাবুদার হাইট আমি জানি যে পুরো ছ’ফুট। তার মানে ইনি খুব বেশি হলে পাঁচ পাঁচ।

বাবুদাও প্রতি নমস্কার করে বলল, “কিছু প্রশ্ন করার ছিল আপনাকে? প্ৰণববাবু নিশ্চই বলেছেন?”

“হ্যাঁ, মামা বলছিলেন যে গোয়েন্দা ডেকেছে। আপনি আসতে আপনার চেহারাটা বেশ ইম্প্রেসিভই লাগল। বলুন কী জিজ্ঞেস করবেন, পুলিশ তো এক পত্তন জেরা করে গেছে। তার বেশি তো আমার আর কিছুই বলার নেই।”

“জানি, তবে পুলিশ আপনাকে কী জেরা করেছে, সেটা আমি জনি না। আমি আমার মত কিছু প্রশ্ন করব।”

“আচ্ছা, করুন,” এই বলে উনি আবার খাটে গিয়ে বসলেন আর বাবুদা একটা বেতের চেয়ার টেনে তাতে বসল। আমি বাবুদার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বাবুদা বলল, “আপনি কতদিন আছেন এখানে? মানে এই বাড়িতে?”

“তা বছর তিনেক হয়ে গেল। আসলে কলকাতায় চাকরি করে রোজ বর্ধমান থেকে যাতায়াত পোষাচ্ছিল না, তাই মামা এখানে আসার কথা বলতে রাজি হয়ে গেলাম।”

“বর্ধমানে কোথায়?”

“বীরহাটায়।”

“বিগ বাজারের আশেপাশে কি ?”

“না, অন্যদিকে, দত্ত পাড়ায়।”

“বাড়িতে কে কে আছেন?”

“মা আছেন, এক বোন আছে। ওখানেই স্কুলে পড়ে। ক্লাস ইলেভেন। বছর দুই হল বাবা মারা গেছেন।”

“আপনার মা তো প্ৰণববাবুর আপন বোন?”

“হ্যাঁ, বিয়ের পর বাবার বদলির জন্য মাকে বর্ধমানে চলে যেতে হয়।”

ভদ্রলোক পকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করে একটা ধরাল। ইনি কিন্তু বাবুদাকে অফার করলেন না।

বাবুদা বলল, “দিনে ক’প্যাকেট হয়?”

“আজ্ঞে?”

“বলছি দিনে ক’প্যাকেট সিগারেট খান?”

“ওই তিন প্যাকেট হয়ে যায় আর কী,” একটু হেসে বললেন অনিমেষবাবু।

“সিগারেট যে বেশি খাওয়া হয় সেটা আপনার ডান হাতের আঙুল থেকেই বোঝা যায়”, মুচকি হেসে বলল বাবুদা।

কথাটা শুনে ভদ্রলোক নিজের ডান হাতটা তুলে আঙুলগুলো দেখল তারপর হো হো করে হেসে বললেন, “আপনার শুধু চেহারাটাই ইম্প্রেসিভ নয়, চোখটাও বেশ ইম্প্রেসিভ।”

আমি খুব মন দিয়ে অনিমেষবাবুর আঙুলগুলো দেখলাম। ডান হাতের আঙুলের নখগুলোয় হলদে ছোপ বর্তমান। বাবুদাকে জিজ্ঞেস করতে ও বলেছিল যে ওই হলদে ছোপগুলো আসলে নিকটিনের অধঃক্ষেপ।

বাবুদা হাল্কা হেসে বলল, “কোথায় চাকরি করেন?”

“রোহটাক সলিউশনস, মহত্মা গান্ধী মেট্রো স্টেশনের কাছে। বাইকে মিনিট পনেরো লাগে”, শান্ত গলায় বললেন অনিমেষবাবু।

“চাকরি করছেন কত বছর?”

“তাও প্রায় চার বছর হতে চলল।”

“এই যে আপনার মামা ঘরে একটা এত দামি জিনিষ রাখছেন, আপনি আপত্তি করেননি?”

“আমাকে মামা এই বাড়িতে যে থাকতে দিয়েছেন সেই অনেক। এই বাড়ির কোন ব্যাপারে নাক গলাতে আমার ভালো লাগে না।”

“আই সি, তা যে সময় চুরিটা হয়, মানে আজ দুপুর দুটো থেকে চারটের মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?”

“আমি অফিসে ছিলাম। যদিও দেড়টা থেকে আড়াইতে অবধি আমাদের লাঞ্চ হয়। সেই সময় আমি বেইরে ছিলাম, রবিদার দোকানে।”

“এই দোকানটা কোথায়?”

“এই মহত্মা গান্ধী মেট্রো স্টেশনের সামনে গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে।”

“সেই সময় আপনার সাথে কেউ ছিল? মানে কোন কলিগ বা বন্ধু?”

“না, আমি একাই যাই ওখানে খেতে। বাকিরা ক্যান্টিনে খায়।”

“এই যে চুরি হল, এই নিয়ে আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”

“দেখুন জিনিষটার দাম খুব বেশি। মামার মুখেই শুনেছি এই দাম কোটিতে। আর এই বাড়িতে অনেকেই আছেন যাদের টাকার খুব প্রয়োজন। তাই সন্দেহ তো সবাইকেই করতে হয় মিঃ মিত্র।”

“যেমন?”

“আপনি দেখুন। আমায় ক্ষমা করবেন মিঃ মিত্র আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”

“আর একটা কথা, আপনি কোন লাইব্রেরী থেকে বই নেন?”

“লাইব্রেবি থেকে নিতে যাব কেন? বাইরে দেখলেন না, তিন আলমারি বোঝাই বই।”

আবার আসতে হতে পারে বলে আমরা বেরিয়ে অনিমেষবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বেরোনোর সময় দরজার সামনে দাঁড়াল বাবুদা। তারপর ফিরে অনিমেষবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশুনা করেছেন?”

“কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং।”

বৈঠকখানায় এসে দেখলাম প্ৰণববাবু সেখানে নেই। দেবাঙ্গনবাবু সোফায় বসে মোবাইলে কী যেন দেখছেন। আমাদের আসতে দেখে উনি উঠে বললেন, “এবার কে মিঃ মিত্র?”

বাবুদা বলল, “চলুন, আগে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল, তারপর চাকরের সাথে একটু কথা বলব।”

“আচ্ছা চলুন। এখানে বসবেন না ওই ঘরটায়?”

আমরা ওই ভিতরের ঘরটায় গিয়েই বসলাম। বাবুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “আপনাদের তো খুব ক্ষতি হয়ে গেল?”

“তা হয়ে গেল। আর ল্যাবের আগুনে সব ডাটা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে পেপারটা রিট্রিভ করারও কোন উপায় নেই,” বলে দেবাঙ্গনবাবু বার দুয়েক মুখ দিয়ে ছিক ছিক আওয়াজ করল। তারপর বললেন, “আর স্যারের শরীরের যা অবস্থা তাতে আবার এই পেপারটা বানানো হয়তো সম্ভব হবে না।”

“তা পেপারটা যখন বাড়িতে এনে রাখলেন আপনি আপত্তি করেননি?”

“করেছিলাম, কিন্তু স্যার শুনলেন না। বললেন, এখান থেকে আমার বাড়িতে অনেক বেশি সেফ থাকবে এটা।”

“আই সি, এই পেপারের মূল্য কত হতে পারে বলে আপনার ধারণা ?”

“এই ব্যাপারে আমার বিশেষ আইডিয়া নেই, তবে কোটির উপরে সেটা আন্দাজ করতে পারি।”

“তা আপনি তো পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন প্ৰণববাবুর সাথে, এই পেপারে আপনার অবদানও নিশ্চয়ই আছে?”

“তা তো আছেই, আমার থিসিস পেপারের একটা অংশ আছে এখানে। তাছাড়া যাবতীয় এক্সপেরিমেন্ট তো আমিই করেছি”, বেশ উত্তেজিত লাগল ওনাকে।

“তা পেপারে প্ৰণববাবু যে আপনার নাম দেয়নি সেটা দেখে আপনার দুঃখ হয়নি?”

দেবাঙ্গনবাবু ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। বললেন, “সেটা আপনি কী করে...”

“যদি পেপারে আপনার নামও থাকত তাহলে আপনার অবস্থাও প্ৰণববাবুর মতই হত। আমিও একজন ডক্টরেট মিঃ ঘোষাল, কষ্ট করে লেখা পেপারের মূল্য আমি বুঝি।”

“উনি আমাকে বাদ দিয়েছেন ঠিকই আর এঁর জন্য আমি খুব কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু তার জন্য ওনার উপর আমার কোন আক্রোশ নেই। আমি তো শুধু মেকানিক্যাল কাজগুলোই করেছিলাম, আসল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক তো স্যারই।”

“আচ্ছা, তা প্ৰণববাবুর থেকে পেপারটা কেনার জন্য যে বেশ কজন ওনাকে অফার দিয়েছিলেন সেটা কি আপনি জানেন?”

“আজ্ঞে, জানি। তাদের মধ্যে মিঃ কেডিয়া একবার ল্যাবেও এসেছিলেন। সেদিন স্যার ছিলেন না, তাই স্যারের সাথে দেখা হয়নি।”

“আপনার সাথে কথা হয়েছিল?”

“না, উনি যে এসেছিলেন সেটা আমি শুনি আমাদের রিসেপশন থেকে”, বললেন দেবাঙ্গনবাবু।

“ল্যাবের কাজ ছাড়া প্ৰণববাবুর আর কী কাজ করেন আপনি?”

“এই বিভিন্ন চিঠি লেখা, পেপার টাইপ করা, মেল করা ইত্যাদি। আর এখন ওনার নতুন বইটার কাজ চলছে বলে বইয়ের প্রুফ দেখায় বেশ অনেকটা সময় দিতে হয়।”

“এই পেপার চুরি নিয়ে আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?”

“সন্দেহ মানে, এই বাইরের লোকেদের কথা বলছেন তো?”

“শুধু বাইরের লোকেদের কথা কেন? আপনার কি এই বাড়ির কাউকেও সন্দেহ হয় নাকি?”

“দেখুন মিঃ মিত্র, দুপুরে বাড়িতে কেউ ছিল না, সবাই নিজের অফিসে ছিল তাই আমার তো মনে হয় না যে বাড়ির কেউ এর সাথে জড়িত আছে বলে। কিন্তু একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল, যেদিন প্ৰণববাবু পেপারটা বাড়িতে নিয়ে আসে, সেদিন এক সৌম্যদীপবাবুই অনেক প্রশ্ন করছিল পেপারটা নিয়ে।”

“যে সময় চুরি হয়, সেই সময় আপনিও তো ল্যাবে ছিলেন না?”

“আজ্ঞে না, ছিলাম না। আমার মেয়ের একটু ডাইরিয়া মত হয়েছে। সকালের দিকে বার দুয়েক বমিও করেছে। তাই আমি বাড়ি চলে যাই। আপনি চাইলে আমার স্ত্রীয়ের থেকে কনফার্ম করতে পারেন।”

“পেপারটা যে সিন্দুকে থাকত সেটা আপনি জানতেন?”

“জানব না কেন, আমিই তো কতবার সেটা বের করে এনে দিয়েছি।”

“তার মানে সিন্দুকের চাবিটা কোন না কোন সময় আপনার হাতে এসেছিল?”

“আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো মিঃ মিত্র?” একটু রেগেই প্রশ্ন করল মিঃ ঘোষাল।

“আমি কিছুই বলছি না মিঃ ঘোষাল। শুধু কটা প্রশ্ন করছি।”

“আচ্ছা, বেশ। হ্যাঁ, কোন না কোন সময় সিন্দুকের চাবিটা আমার হাতে ছিল। আর শুধু আমার হাতে কেন? কোন না কোন সময় এটা তো বাড়ির সবার হাতেই আসতে পারে। প্ৰণববাবু হয়তো আপনাকে বলতে ভুলে গেছেন যে উনি বাড়িতে থাকলে চাবিটা কিন্তু ওনার পকেটে সবসময় থাকে না। ওটা থাকে ওনার টেবিলের ড্রয়ারে।”

“আই সি। তার মানে বাড়ির যে কেউই সেটা হাতে পেতে পারে?”

“নিশ্চয়ই, আর আমার পেপারটা সিন্দুক খুলে চুরি করার কী দরকার মিঃ মিত্র, এতদিন তো ওটা ল্যাবেই ছিল। আমি তো চাইলেই ওটার একটা কপি বানিয়ে রাখতে পারতাম।”

বাবুদা কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে বসে তারপর উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “আপনার ছুটি। শুধু একবার চলুন দীননাথের সাথে একবার কথা বলে চলে যাব।”

দেবাঙ্গনবাবু বলল, “আপনারা এখানেই বসুন। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।”

ওনাকে বেরোতে দেখে বাবুদা বলল, “আর একটা কথা মিঃ ঘোষাল...”

দেবাঙ্গনবাবু থমকে দাঁড়ালেন।

“আপনাদের বাড়িতে আগে যে দারোয়ান কাজ করত তার নাম আর ঠিকানাটা আপনার কাছে আছে নিশ্চই?”

“হ্যাঁ, আপনার লাগবে?”

“হ্যাঁ, পেলে ভালোই হত।”

“ঠিক আছে, আমি আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি,” বলে উনি বেরিয়ে গেলেন।

দেবাঙ্গনবাবু বেরিয়ে গেলে বাবুদা একটা সিগারেট ধরাল। তারপর দুটো লম্বা টান দিয়ে বলল, “যে যা বলছে মন দিয়ে শুনছিস তো?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেই দেখ না?”

“বেশ, তাহলে বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা হবে।”

মিনিট তিনেকের মধ্যেই দীননাথ এসে হাজির। বাবুদাকে হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল, “পেন্নাম বাবু।”

বাবুদা বলল, “বস এখানে।”

সে না বসে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “হামি কিছু করিনি বাবু। হামি কিছু জানি না।”

“তুমি কিছু করনি সেটা আমি জানি। তবে আমি কতগুলো প্রশ্ন করব, সেগুলোর ঠিক ঠিক জবাব দেবে। কেমন?”

দীননাথ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

বাবুদা বলল, “কদিন কাজ করছ এখানে?”

“তা বাবু দশ সাল হয়ে গেল।”

“বাড়ি কোথায়?”

“এজ্ঞে বাবু, বিহারের দ্বারভাঙ্গায়।”

“দুপুরে তুমি কী করছিলে?”

“রোজ দুপুরে খানা খেয়ে আমার একটু নিন্দ এসে যায় বাবু। আজও তাই তিন তলায় আমার ঘরে গিয়ে থোড়া শোয়া থা। তারপর বিকেলে বাবু ছাদ থেকে কাপড় তুলে নীচে আসি। সামনের ঘরটা সাফা করতে করতে বাবু এসে যায়। তারপর ওনাকে খানা দিয়ে উনি উপরে গেলে আমি ভেবেছিলাম বাকি ঘরগুলো সাফা করব। কিন্তু তারপর তো...”

“আচ্ছা, দুপুরে যখন ঘুমচ্ছিলে তখন কোন শব্দ পাওনি?”

“না বাবু, হামার ঘুম খুব হালকা। একটু শব্দ হলেই ভেঙে যায়। কিন্তু দুপুরে তো কিছুই শুনিনি।”

“এই কদিনের মধ্যে প্ৰণববাবুর সাথে কেউ দেখা করতে এসেছিলেন?”

“না বাবু, অচেনা কেউ আসেনি। ডাক্তারবাবু এসেছিলেন বেশ কয়েকবার।”

“কেন? প্ৰণববাবুর কি শরীর খুব খারাপ?”

“হাঁ বাবু, আগে এত খারাপ ছিল না। এই হপ্তা দুয়েক হল খুব কষ্ট পাচ্ছেন।”

“আচ্ছা, তুমি যেতে পার। আর কিছু যদি মনে পড়ে তাহলে আমায় জানিও। আমি তো আসব মাঝেমাঝেই।”

দীননাথ ‘জি বাবু’ বলে চলে গেল। আমরাও উঠে পড়লাম। বেরনোর সাময় দেবাঙ্গনবাবুর থেকে থেকে মিঃ কেডিয়ার কার্ডটা নিতে গিয়ে দেখলাম সেই ডাক্তারবাবু আবার ঢুকছেন। বাবুদা দেবাঙ্গনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “ডাঃ রায় চৌধুরীর শরীর কি খুব খারাপ?”

“না, আসলে একটা শক পেয়েছেন তো। তাই আর কী”, চিন্তিত স্বরে বললেন দেবাঙ্গনবাবু। তারপর ডাক্তারবাবুর পিছন পিছন উপরে যেতে যেতে বললেন, “আমি একটু উপরে যাচ্ছি।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

আমরা বেরিয়ে গেলাম। রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম ঘড়িতে পৌনে ন’টা বাজে। বাবুদা বলল, “চল, একটু হেঁটে যাই। তারপর মেট্রো ধরব।”

আমরা যেদিক দিয়ে এসেছিলাম, বাবুদা তার উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। মিনিট দুয়েক হাঁটার পর একটা পেট্রোল পাম্পের পাশ দিয়ে বাঁদিকে একটা গলিতে ঢুকে গেল। আরও মিনিট পনেরো হাঁটার পর আমরা পৌঁছলাম এম জি রোড মেট্রো স্টেশনের কাছে। রাস্তায় ওর সাথে এই বিষয়ে আর কোন কথা হয়নি। শুধু গলিটায় ঢুকে একটা বিশাল বাড়ি দেখিয়ে বলেছিল, “এটা আমাদের কলেজের হোস্টেল।”

বাবুদাকে দেখলাম ষ্টেশনে না গিয়ে সামনের বড় রাস্তাটা পেরিয়ে উল্টো ফুটে চলে গেল। আমি বাবুদাকে জিজ্ঞেস করতে যাব যে কোথায় চললে, এমন সময় একটা পানের দোকানে দাঁড়িয়ে বাবুদা বলল, “দাদা, এখানে রবিদার খাবারের দোকান কোনটা?”

পানের দোকানের ভদ্রলোক বাবুদাকে একটু ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, “ওই যে সামনের গলিটায় ঢুকে দু তিনটে দোকান ছেড়ে। কিন্তু এখন তো বন্ধ হয়ে গেছে।”

“এমা, বন্ধ হয়ে গেছে? যাহ্‌! বিকেলে কি খোলে না?” বাবুদা এমন করে বলল যে দোকানটা বন্ধ থাকায় ও খুব দুঃখ পেয়েছে।

“না, বাবু। শুধু সকালে খোলে। আপনি বরং একটু এগিয়ে যান, ওখানে নিউ ইন্ডিয়া নামে একটা রেস্তরা আছে। ওটা বেশ ভালো।”

বাবুদা সেই ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে আমায় বলল, “চ, বাড়ি যাওয়া যাক।”

(৬)

মেট্রো আর তারপর বাসে করে বাড়ি ফিরতে পৌনে দশটা বেজে গেল। এতক্ষণ লাগতো না যদি না টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে বেশ বড় একটা জ্যামে আটকাতাম। ঘরে ঢুকতেই সুখেনকাকা “একটা পুলিশ এসে এটা দিয়ে গেল”, বলে ব্রাউন রঙের একটা খাম বাবুদার হাতে দিল। বাবুদা খামটা একটু ফাঁক করে সেটা সামনের টেবিলের উপর রাখল। আমিও এই ফাঁকে খামটা তুলে নিয়ে দেখলাম, ওর ভিতরে একটা সিডি কেস।

বাবুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইনস্পেক্টর দাস পাঠিয়েছেন নিশ্চয়ই?”

বাবুদা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারপর পকেট থেকে ওর সনি এক্সপিরিয়া এম ফোনটা বের করে ডায়াল করল। আমি একদিকের কথাই শুনলাম।

মোটামুটি তিরিশ সেকেন্ড চপ করে ফোনটা কনে ধরে থাকার পর, বাবুদা বলল, “হ্যালো। ইনস্পেক্টর দাস?”

...“ওটা পেয়ে গেছি।”

...“অনেক ধন্যবাদ।”

...“হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে আর বলতে।”

...“রাখি তাহলে?”

...“ওকে। গুড নাইট।”

বাবুদা ফোন রেখে দিল। তারপর বলল, “মন্তে, সুখেনকাকাকে বল ভাত দিয়ে দিতে। আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি।”

বাবুদা ওর ঘরে চলে যাওয়ার পর আমি সোফাটায় গিয়ে বসলাম। এতদিন শুধু বাবুদার কাছে ‘জেরা’ কথাটা শুনেছিলাম, আজ নিজের চোখে দেখে এলাম। যদিও কে কী বলেছিল তা পুরোটা আমার মনে নেই তবে বাবুদার যে সব কথাই মনে থাকবে সেটা বলাই বাহুল্য। আমিও উঠে গিয়ে হাত মুখে ধুয়ে এলাম। এসে দেখি বাবুদা সোফাটায় বসে টেবিলের উপর পা-টা লম্বা করে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আমি গিয়ে ওর পাশে বসে বললাম, “সুখেনকাকা বলল মিনিট পনেরো পরে দিচ্ছে।”

বাবুদা চোখ বন্ধ অবস্থায়ই ‘হুঁ’ বলল।

আমি টেবিল থেকে ওই সিডি কেসটা তুলে নিয়ে বললাম, “চুরি তো কাল দুপুরে হয়েছিল, তাহলে তুমি পুরো দুদিনের ফুটেজ চাইলে কেন?”

“হঠাৎ করে শুধু এই দু ঘণ্টার ফুটেজ দেখলে কিছুই বোঝা যাবে না রে মান্তে। সেটাই মনে হবে কমোন।”

“আচ্ছা, আর দারয়ানের ঠিকানা চাইলে কেন? সে ওই পেপার নিয়ে কী করবে?”

এই কথাটার বাবুদা কোন উত্তর দিল না। উলটে বলল, “একবার প্ৰণববাবুর ড্রাইভারের সাথে কথা বলা দরকার ছিল রে, দেখি কাল একবার যদি যাওয়া যায়।”

তারপর বলল, “যা, এই ঘরের টেবিলে দেখ একটা খাতা আছে। ওটা নিয়ে আয়। তোর পরীক্ষাটা হয়েই যাক।”

আমি উঠে গিয়ে খাতাটা নিয়ে এলাম, বড় রুল টানা খাতা। তারপর টেবিলের উপর থেকে একখানা পেন নিয়ে বললাম, “বল।”

বাবুদা বলল, “আমি প্রশ্ন করছি, তুই উত্তরগুলো বল আর ওই খাতাটায় লিখে ফেল।”

আমি মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে বাবুদা বলল, “ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরী কোথায় কাজ করেন?”

“কাল্টিভাশন অফ সায়েন্স, যাদবপুর।”

“ওনার সহকারীর নাম?”

“দেবাঙ্গন ঘোষাল।”

“কত বছর ওনার সাথে কাজ করছেন?”

“দশ। প্রথমে পাঁচ বছর পি এচ ডি, তারপর উনার সহকারি।”

বাবুদা বলল, “গুড। এবার বল, দেবাঙ্গনবাবু কোথায় থাকেন?”

“এই রে, বেহালা মনে আছে, কিন্তু...” আমি জিভ কেটে বললাম।

“পর্ণশ্রী।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। পর্ণশ্রী”

“আচ্ছা, প্ৰণববাবুর ছেলের নাম?”

“বিপ্লব রায় চৌধুরী।”

“কী করেন?”

“ফ্লাক্সের ব্যবসা। ব্রেস ব্রিজের ওখানে কারখানা।”

“নাম?”

“রেজিনা ফ্লাক্সেস।”

“প্ৰণববাবুর ভাগ্নের নাম?”

“অনিমেষ রায়।”

“কী করেন?”

“চাকরি। রোহটাক সলিউশনস, মহত্মা গান্ধী মেট্রো স্টেশনের কাছে।”

“বাঃ, ভালোই মনে আছে দেখছি। এবার বল, উনি কোথায় লাঞ্চ করেন?”

“রবিদার দোকানে,” তারপর বাবুদার পরের প্রশ্ন করার আগেই বললাম, “তুমি একটা কথা বল, ফেরার সময় হঠাৎ রবিদার দোকানের খোঁজ করলে কেন?”

“অ্যালিবাই চেক করার জন্য।”

অ্যালিবাই শব্দটা আমি আগে শুনেছি কিন্তু তার সঠিক মানে জানতাম না। বাবুদাকে জিজ্ঞেস করতে ও বলল, “বইয়ের আলমারি থেকে বাংলা অভিধানটা নিয়ে দেখে নে।”

কী আর করি, উঠে গিয়ে ডিক্সেনারি বের করলাম। তারপর বললাম, “অ্যালিবাই বানানটা কী গো?”

“এ এল আই বি আই।”

খুঁজে দেখি ওখানে লেখা আছে ‘বিশেষত অপরাধমূলক ঘটনা ঘটার সময় অন্যত্র থাকার অজুহাত।’

আমি ডিক্সেনারিটা বন্ধ করতে ও বলল, “বুঝলি?”

আমি মাথা নাড়লাম।

“আচ্ছা, তাহলে বল প্ৰণববাবুর বন্ধুর ছেলের নাম কী ?”

“সৌম্যদীপ দত্ত।”

“কী করেন?”

“একাউন্টেন্ট। কোম্পানির নাম ভুলে গেছি।”

বাবুদা বলল, “ডালহৌসিতে গাঙ্গুলি অ্যান্ড সন্স। আর ওই বাড়ির চাকরের নাম?”

“দীননাথ।”

“করেক্ট।”

ইতি মধ্য সুখেনকাক এসে বলে গেল যে নীচে ডিনার দিয়ে দিয়েছে। তাই আমার পরীক্ষা আপাতত বন্ধ। বাবুদার সাথে নীচে গিয়ে রুটি আর ফুলকপির তরকারি দিয়ে ডিনার সারলাম। খাবার টেবিলে বাবুদার সাথে কোন কথা হয়নি। ও বলে, “খাবার সময় কথা বললে মনটা কথার দিকেই থাকে আর তাতে খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায় না।”

খাওয়া শেষ হলে হাত ধুয়ে উপরে যেতে যেতে বাবুদা বলল, “আমি এখন ওই সিডিটা দেখব। তুই দেখবি?”

আমি রাজি হয়ে গেলাম। বাবুদা ওর ল্যাপটপে সিডিটা লাগিয়ে খাটের উপর গিয়ে কোলবালিশটা কোলে নিয়ে বসল। আমিও ওর পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। ল্যাপটপটা খাটের উপর রেখে বাবুদা চালিয়ে দিল।

ক্যামেরায় প্ৰণববাবুর ঘরের অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। খাট আর খাটের পিছনের সিন্দুকটা স্পষ্ট। ঘরের মেঝেটাও কিছুটা দেখা গেল। উপরে দেখলাম লেখা আছে ৭-ই জানুয়ারি, ১২.০০ এ এম। বাবুদা সাউন্ডটা একটু জোরে দিতে বুঝলাম বাইরের আওয়াজ বিশেষ শোনা না গেলেও গাড়ির হর্নগুলো হালকা শোনা যাচ্ছে। ফাঁকা ঘর আর কতক্ষণ দেখা যায়। মিনিট পনেরো পরে আমি কাত হয়ে শুয়ে দেখতে লাগলাম। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল বলে কম্বলটা গায়ের উপর টেনে নিলাম। দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি সকাল হয়ে গেছে। পাশ ফিরে দেখি বাবুদা নেই। উঠে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে বৈঠকখানায় এসে দেখি বাবুদা খবরের কাগজ পড়ছে। আমার আসতে দেখে বলল, “ঘুম ভাঙল?”

আমি বোকা বোকা হেসে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কাল তুমি ক’টায় শুলে?”।

ও বলল, “কাল নয়, আজ। এই ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ।”

“কিছু পেলে ওই সিডিটায়?”

বাবুদা মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ।”

আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কী ?”

“যথা সময়ে জানতে পারবি,” বলে আবার খবরের কাগজে ডুবে গেল। আমি আর কী করি টেবিল থেকে টেলিগ্রাফটা তুলে নিয়ে সিনেমার পাতাটা উলটে পালটে দেখতে লাগলাম। মিনিট পনেরো পর বাবুদা বলল, “আজ একটু বেরোতে হবে বুঝলি? এই ব্রেকফাস্ট করে বেরোব।”

“কোথায় যাবে? রবিদার হটেলে?”

“না, ওটা পরে হবে। একবার থানায় যেতে হবে ইন্সপেক্টার দাসের সাথে কথা বলার জন্য। আর একবার টালিগঞ্জ।”

“টালিগঞ্জ কেন?”

বাবুদা ওর জামার পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে আমার হাতে দিল। তাতে লেখা আছে সুদীপ কর্মকার, দুর্গাপুর ব্রিজের কাছে পুলিশ কোয়াটারের পিছনে। ১৭/সি গোপাল কলোনি।

“এটা কি সেই পুরানো দারোয়ানের ঠিকানা?”

“ইয়েস।”

“গোপাল কলোনি? ওখানে আমার এক মাসির বাড়ি আছে, জানো তো? কিন্তু গোপাল কলোনি তো দেখিনি?”

“ওই পুলিশ কোয়াটারের পিছনে একটা ছোট্ট বস্তি আছে, ওটার নাম গোপাল কলোনি।”

ইতি মধ্যের দেখি কখন সুখেনকাকা এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। বাবুদা ফিরে বলল, “বলো?”

সুখেনকাকা বলল, “একজন পুলিশের লোক এসেছেন। আপনাকে খুঁজছেন। উপর আসতে বলি?”

“কে ইন্সপেক্টার দাস?”

“তা তো জিজ্ঞেস করিনি দাদাবাবু।”

“আচ্ছা, ওনাকে নিয়ে এস।”

মিনিট তিনেকের মধ্যেই ইনস্পেক্টর দেবব্রত দাস হাসি মুখে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, “কী গোয়েন্দা সাহেব, কিছু পেলেন?”

বাবুদাও হালকা হেঁসে বলল, “না, আপনি?” প্রশ্নটা করে ও সুখেনকাকাকে বলল, “তিন কাপ চা দিয়ে যাও না।”

ইন্সপেক্টার দাস বাবুদার উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসে বললেন, “সেই জন্যেই তো আসা।”

“সে কী ? এর মধ্যে?”

“ইয়েস স্যার। আপনাকে সুখবরটা নিজেই দিতে এলাম। কেস মোটামুটি সল্ভড।”

“বাঃ, কাল্প্রিট কে?”

“ওই সৌম্যদীপ দত্ত নামের ভদ্রলোক। সবার অ্যালিবাই আছে, শুধু ওনার ছাড়া। উনি বলেছেন যে উনি সেই সময় বাইরে ছিলেন অফিসের কাজে। কিন্তু আজ সকালেই আমি খবর নিয়ে দেখেছি যে অফিসের কোন কাজে উনি বাইরে যাননি। দেড়টার পর উনি কোথায় ছিলেন সেটা কেউ জানে না। যদিও উনি এখানে একা নন। ওনার অ্যাকমপ্লিস ও আছে একজন।”

“কে? দীননাথ?” হালকা হেসে বাবুদা বলল।

“ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আপনি কী করে...” একটু অবাকই হল ইন্সপেক্টার দাস।

ওনার প্রশ্নটা বাবুদা যেন শুনতেই পেল না। ও উল্টে প্রশ্ন করল, “আপনি কি অ্যারেস্ট করার কথা ভাবছেন নাকি?”

“ভাবছিলাম একবার থানায় ডেকে আরেকটু জিজ্ঞাসাবাদ করব। একটু কড়কালেই সব বলে দেবে।”

“আচ্ছা, দেখুন।”

সুখেনকাকা চা আর এক প্লেট চানাচুর দিয়ে গেল। ইন্সপেক্টার দাস একটা কাপ তুলে নিয়ে বলল, “আপনার আর মাথা খাটানো হল না মিঃ মিত্র।”

বাবুদা হেসে বলল, “কী আর করা যাবে দাসবাবু। কিন্তু সি সি টিভিতে কিছু এল না কেন?”

ইন্সপেক্টার দাস একটু দমে গেলেন, বললেন, “এই ব্যাপারটাই ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু ব্যাটাকে কড়কালেই সুড়সুড় করে সব বলে দেবে।”

বাবুদা হেসে বলল, “দেখুন তাহলে, কিন্তু একটা রিকোয়েস্ট যে ফস করে গ্রেপ্তার করে ফেলবেন না। তা কবে ডাকছেন সৌম্যবাবুকে?”

“আজই একবার ডাকব ভাবছি, দুপুরের দিকে। তা আপনি আসতে চাইলে আসতে পারেন কিন্তু।”

“না থাক, আপনিই দেখুন। কী হল শুধু জানাবেন।”

“নো প্রবলেম স্যার,” বলে দাসবাবু উঠে গেলেন।

দাসবাবু বেরিয়ে গেলে আমি একটু মনমরা হয়ে বাবুদাকে বললাম, “কেস তো পুলিশই সল্ভ করে দিল। তোমার তো কিছুই করার থাকলো না।”

বাবুদা বলল, “এত সহজ না রে মান্তে, দিল্লি এখনও অনেক দূর। দাঁড়া একটা ফোন করে নিই।”

এই বলে বাবুদা পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে একটা ফোন লাগাল। আর টেবিলের উপর রাখা ওর মানিব্যাগ থেকে দেবাঙ্গনবাবুর দেওয়া মিঃ কেডিয়ার সেই কার্ডটা বের করে নম্বর টিপে ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে দিল। বার তিনেক রিং হওয়ার পর ওপার থেকে একটা নারী কণ্ঠে উত্তর এল, “হ্যালো, মিঃ কেডিয়ার অফিস।”

“নমস্কার, আমার নাম জৈত্র মিত্র। মিঃ কেডিয়ার সাথে আমার একটু দরকার ছিল, আজ কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাবে?”

“একটু অপেক্ষা করুন।”

তারপর প্রায় এক মিনিট পর আবার শোনা গেল। “সরি স্যার, আজ ওনার সাথে কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাবে না। কাল পেতে পারেন সকাল সাড়ে ন’টায়।”

“ওকে, সেটাই ভালো। থ্যাঙ্ক ইউ।”

“হ্যাভ এ গুড ডে, স্যার।”

ফোনটা রেখে দিয়ে বাবুদা বলল, “আজ তাহলে শুধুই টালিগঞ্জ। আর বিকেলে একবার প্ৰণববাবুর সাথে দেখা করতে যাব। কাল ভদ্রলোকের শরীর ভালো ছিল না, তাই ভাবছি একবার দেখে আসব। সেই ফাঁকে সৌম্যবাবুর সাথেও ওনার জেরার কথাটা হয়ে যাবে।”

দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বেরোতে বেরোতে প্রায় দেড়টা বেজে গেল। বাড়ির সামনের থেকেই আজ ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। আজ আকাশ মেঘলা থাকলেও বৃষ্টি হয়নি। যদিও রাস্তায় এখনও একটু আধটু জল জমে আছে কোথাও কোথাও। রাসবিহারি মড়ের জ্যাম এড়াতে বাবুদা ট্যাক্সি চালককে টালিগঞ্জ ফাঁড়ি দিয়ে নিয়ে যেতে বলে। মহাবীর তলার মোড়ে পৌঁছতেই দেখি আবার ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল। বাবুদা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটা চিক করে বিরক্তিসূচক শব্দ করে জানলার কাঁচটা তুলে দিল।

আমি বললাম, “আমরা যে যাচ্ছি, কিন্তু সেই দারোয়ান মহাশয় যদি বাড়িতে না থাকে, তাহলে?”

ও বলল, “কালকেই তো শুনলি যে এই সুদীপ কর্মকার কোন সিকিউরিটি এজেন্সির লোক নয়। তাই দু তিন দিনের মধ্যে এই বাজারে নতুন চাকরি জোগাড় করা সহজ ব্যাপার নয়। আর যদি নাও থাকে তাহলে জানা তো যাবে যে কখন এলে ওকে পাওয়া যাবে?”

আমাদের গাড়ি যখন দুর্গাপুর ব্রিজে উঠছে, তখন দেখি সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা প্রায় থেমে এসেছে। ব্রিজ থেকে নেমে বাবুদা ড্রাইভারকে বলল, “ডাইনে চল।”

আমাদের ট্যাক্সিটা ব্রিজের একদম গা ঘেঁষে ব্রিজের সাথে একটা সমান্তরাল রাস্তা দিয়ে এগোতে লাগল। তারপর আরও একটা ডানদিক আর দুটো বাঁদিক ঘুরে একটা বস্তির সামনে এসে দাঁড়াল। বস্তিটার ঠিক পিছনে কিছু বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট দেখা যাচ্ছে। বাবুদা বলল, “ওইগুলো পুলিশ কোয়াটার, তোর মাসির বাড়িও এখানেই।”

ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে আমরা বস্তিটার ভিতরে ঢুকলাম। ছোটছোট টালির চালওয়ালা একতলা বাড়ি আর দুটো বাড়ির মাঝখানে সরু রাস্তা। বাড়িগুলোর গায়ে লাল কালিতে একটা করে নম্বর লেখা আছে। বারো/ এ নম্বর বাড়ির সামনে পৌঁছে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে সে দেখিয়ে দিল কীভাবে গেলে সতেরো/ সি তে পৌঁছনো যাবে। সরু গলির পাশের নোংরার ঢিবি পেরিয়ে আমরা সুদীপ কর্মকারের বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। বাড়ির বারান্দায় একজন মোটা গোছের টাক মাথা লোক বসে বিড়ি টানছে। আমাদের দাঁড়াতে দেখে প্রশ্ন করল, “কাকে চাই?”

বাবুদা বলল, “এটা সুদীপ কর্মকারের বাড়ি?”

“হ্যাঁ, আমিই সুদীপ কর্মকার। কী দরকার বলুন?”

“আমার নাম রজনীকান্ত সেন, আমি সলিড সিকিউরিটি নামে একটা কোম্পানিতে কাজ করি। আমার মালিকের বন্ধু আপনার নাম সাজেস্ট করেছিলেন। কিন্তু বারবার আপনাকে ফোনে না পেয়ে শেষমেশ আপনার বাড়িতেই আসতে হল।”

সুদীপবাবু হাত থেকে বিড়িটা ফেলে ওটা পায়ের চাপে নিভিয়ে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে “আসেন স্যার, বসেন,” বলে একটা ময়লা হ্যান্ডেল ভাঙা চেয়ার এগিয়ে দিল।

বাবুদা বসল আর আমি ওর পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। সুদীপবাবু বললেন, “চা খাবেন, স্যার?”

বাবুদা বলল, “না, মানে আমার একটু তাড়া আছে। ক’টা প্রশ্ন করেই বেরিয়ে যাব।”

“আচ্ছা, স্যার। বলুন?”

“আপনি তো আগে ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরীর বাড়িতে চাকরি করতেন?”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“তা ওখান থেকে আপনাকে বের করে দেওয়া হল কেন?”

সুদীপবাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “ইয়ে, মানে একদিন রাতে একটু চোখ লেগে গেছিল। আসলে কী হয়েছিল, স্যার, আমার না সারাদিন খুব জ্বর ছিল। ছুটি চেয়েছিলাম একদিনের কিন্তু ওনারা দিলেন না।”

“ওনারা মানে, ডাঃ রায় চৌধুরী?”

“না, স্যার। ওনাকে বললে উনি হয়তো দিতেন, কিন্তু ওনার সহকারীবাবু দিলেন না। তারপর রাতে একটু চোখ লেগে এসেছিল, ঘুমাইনি স্যার, শুধু চোখ লেগে এসেছিল। সেটা দেখে অনিমেষবাবু খুব বকাবকি করলেন। আর পরেরদিন সকালে ছোটবাবু আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিলেন। কতবার বললাম যে শরীরটা ভালো নেই, তাই এট্টু... আর কোনদিন এমনটি হবে না। কিন্তু কিছুতেই শুনলেন না। তাড়িয়ে দিলেন।”

“ছোটবাবু মানে, ডাঃ রায় চৌধুরীর ছেলে?”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“আই সি, তা তোমাকে এখন কোন নম্বরে ফোন করলে পাওয়া যাবে?”

সুদীপবাবু ঘর থেকে একটা খবরের কাগজের টুকরোতে ওনার মোবাইল নম্বরটা লিখে বাবুদার হাতে দিলেন।

বাবুদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে, আজ উঠি। কোন প্রগ্রেস হলে আপনাকে ফোন করে দেব।”

“একটু দেখবেন,স্যার। খুব কষ্টে আছি। চাকরিটা আমার খুবই দরকার, স্যার,” প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন সুদীপবাবু।

বাবুদা ওনার কাঁধে হাত রেখে ‘দেখব’ বলে চলে এল। ফেরার পথে আমি বাবুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি মিথ্যে নাম বললে কেন?”

ও হেসে বলল, “গোয়েন্দা বললে কি আর এত সহজে সব কথা জানা যেত?”

* * *

দুর্গাপুর ব্রিজের তলা থেকে অটো করে কালীঘাট মেট্রো আর সেখান থেকে মেট্রোতে করে এম জি রোড। তারপর অটো করে ‘অশ্বিনী ভবন’ -এ পৌঁছতে প্রায় চারটে বেজে গেল। গতকাল দেবাঙ্গনবাবুকে ফোন করে জানা গিয়েছিল যে এক সপ্তাহ প্ৰণববাবু ল্যাবে যাবেন না কারণ ওনার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। ফাটক দিয়ে ঢোকার সময় একজন বন্দুকধারী ষণ্ডামার্কা দারোয়ান আমাদের পথ আটকাল। বাবুদার নাম শুনে ভিতরে একটা ফোন করল। তারপর বলল, “আপ যা সাকতে হ্যায়।”

বাবুদা ফিসফিস করে আমায় বলল, “ইস, যদি একদিন আগেও এই দারোয়ান বাবাজি থাকত, তাহলে হয়তো পেপারটা হাত ছাড়া হত না।”

আমরা বাড়ির সদর দরজা অবধি পৌঁছে দেখি মিঃ ঘোষাল বেরিয়ে এসেছেন। বললেন, “দারোয়ানকে বলা ছিল যে আপনাকে আসতে দেওয়ার জন্য, ব্যাটা মনে হয় আপনার নামটা ভুলে মেরে দিয়েছে।”

বাবুদা হালকা হেসে বলল, “ডাঃ রায় চৌধুরীর শরীর এখন কেমন আছে?”

“খুব একটা ভালো নেই, তবে কালকের থেকে বেটার। আপনারা যান না, উপরে ওনার ঘরেই আছেন। আমি একটু ডাঃ সান্যালের থেকে ওষুধটা নিয়ে আসি। এই মিনিট দশেক লাগবে।”

এই বলে দেবাঙ্গনবাবু বেরিয়ে গেলেন। বেরোনোর সময় দারোয়ানকে কিছু একটা বলে গেলেন। আমরা দোতলায় উঠে প্ৰণববাবুর ঘরের সামনে এসে দেখলাম ভদ্রলোক জানলার ধারে একটা চেয়ারে বসে আছেন। পরশু দিনের প্ৰণববাবু আর আজকের প্ৰণববাবুর চেহারার মধ্যে আকাশ পালাতের তফাৎ। চোখের কোণে কালি, মুখটাও বেশ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, মাথার চুল উসকো খুসকো। পরনে একটা ছাই রঙের ড্রেসিং গাউন। দরজার সামনে এসে বাবুদা বলল, “আসতে পারি?”

প্ৰণববাবুর যেন পিছন ফিরে তাকাতেও বেশ কষ্ট হল। একটা শুকনো হাসি হেসে বললেন, “আসুন মিঃ মিত্র। কোন প্রগ্রেস?”

বাবুদা মাথা নেড়ে বলল, “এখনও কিছু না।”

“আচ্ছা, দেখুন,” বলে উনি আবার জানলার দিকে মুখ করে বসলেন।

“এই দারোয়ানটি কি আজ এল?”

“হ্যাঁ, আজ সকালে অনিমেষ গিয়ে খুব চেঁচামিচি করেছে ওদের অফিসে। বলেছে কেস করবে। তাই মনে হয় আধ ঘণ্টার মধ্যে পাঠিয়ে দিল,” তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব আস্তে আস্তে বললেন, “এখন এসেই বা কী হবে মিঃ মিত্র। সব শেষ হয়ে গেছে। আসলে কী জানেন মিঃ মিত্র, পেপারটা বাড়িতে রাখার কারণ ছিল যে এক্সপেরিমেন্ট তো সাবাই করতে পারে, কিন্তু ইনফারেন্স লেখাটাই আসল। ওটা লিখে ফেলার পর পেপারটা আর ল্যাবে রাখতে ভরসা হল না।”

“একটা কথা বলছি ডাঃ রায় চৌধুরী, আপনার শরীর কিন্তু কালকের থেকে অনেক বেশি খারাপ লাগছে। ডাক্তার কী বলল?”

“ডাঃ সান্যাল তো গতকালই ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে কই?”

এর মধ্যে কখন দীননাথ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা লক্ষ করিনি। হাতে একটা জলের গ্লাস। প্ৰণববাবু ওকে দেখে বলল, “জলটা ওখানে রেখে যাও। দেবাঙ্গন ওষুধটা নিয়ে আসুক।”

দীননাথ জলের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে যাচ্ছিল এমন সময় প্ৰণববাবু বললেন, “এই দীননাথ, একবার এই ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটটা একটু পরিষ্কার করে দাও না, একটা ইঁদুর মরেছে।”

বাবুদা বলল, “আপনি স্টকে ওষুধ রাখেন না?”

“রাখি যে, আসলে একটা ফাইল যে দিন শেষ হয়, সেদিনই ডাঃ সান্যালকে বললে উনি আরেকটা পাঠিয়ে দেন কিন্তু আজ খেতে গিয়ে একটা বড়ি পড়ে গেছে। আর পড়েই একেবারে খাটের তলায়। অগত্যা, পাঠালাম দেবাঙ্গনকে।”

ইতিমধ্যে দেবাঙ্গনবাবু ঘরে ঢুকে বললেন, “এই নিন স্যার ওষুধ।”

আমরা প্ৰণববাবুকে আর বিরক্ত করলাম না। ‘পরে আসব’ বলে বাবুদা বেরিয়ে গেল। রাস্তায় বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরাল ও তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এই সিকিউরিটি এজেন্সির নামটা কী ছিল?”

এটা আমার মনে ছিল, আমি বললাম, “সলিড সিকিউরিটি।”

একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “গুড।”

(৭)

সেদিন আর বলার মত কিছু হয়নি। বাড়ি ফিরে বাবুদা একবার ইন্সপেক্টার দাসকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল যে সৌম্যদীপবাবু তার কড়কানিতে কিছু স্বীকার করেছেন কি-না। তারপর বাবুদার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে বুঝলাম ওপাশ থেকে ইন্সপেক্টার দাস কী উত্তর দিয়েছেন।

পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙল বাবুদার ডাকে। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতে ও বলল, “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আটটা বাজে। কেডিয়ার অফিস যেতে হবে সাড়ে ন’টার মধ্যে।”

রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাবুদা বলল, “এখন ব্রেকফাস্ট করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে, কেডিয়ার অফিস পার্ক স্ট্রিটে। ওখানেই কিছু খেয়ে নেব।”

ট্যাক্সি নিয়ে পার্ক স্ট্রীট পৌঁছতে প্রায় ন’টা বেজে গেল। পার্ক হোটেলের সামনে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে বাবুদা বলল, “নেট-এ যা দেখলাম, এখান থেকে কাছাকাছি। চল রলেক্সের পাসের দোকানটা থেকে কিছু খেয়ে নিই। তারপর যাওয়া যাবে।”

রলেক্সের পাশের দোকানটা ঠিক বাকি পার্ক স্ট্রিটের সাথে মানানসই নয়। একটা গুমটির মত ছোট্ট একটা দোকান। সামনের পাতা বেঞ্চটায় বসে বাবুদা দুটো চা আর দু প্লেট ডিম টোস্টের অর্ডার দিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে খাবার চলে এল। দোকানটা দেখতে যেমনই হোক না কেন, ডিম টোস্টটা কিন্তু দারুণ বানিয়েছিল। খাওয়া শেষ করে পয়সা মিটিয়ে আমরা ওই গলি দিয়ে সোজা এগিয়ে গেলাম। মিনিট পনেরো হাঁটার পর একটা বিশাল উঁচু বাড়ির সামনে পৌঁছে বাবুদা বলল, “এর সাত তলায় রেজিনা ক্যামিকালের অফিস।”

ভিতরে ঢুকে লিফট চেপে আমরা সাত তলায় উঠে গেলাম। লিফট থেকে নেমে যা দেখলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে গেল। ভরাট একটা কাঁচের ঘর আর তাতে ছোট ছোট সব কাঠের কিউবিকেল করা। সব কটা কিউবিকেলেই একটা করে কম্পিউটার। আমি গুনে দেখলাম ওই ঘরটায় প্রায় একশোটার উপর কিউবিকেল আছে। তাছাড়া ঘরটার দেওয়াল ঘেঁষে সারি সারি দরজা। বাবুদা বলল যে ওই ঘরগুলো অফিসের বড়বাবুদের জন্য। ঘরটায় প্রবেশ করার জন্য একটা কাঁচের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই আপনিই সেটা খুলে গেল। এই রকম দরজা আমি ইংরেজি সিনেমায় দেখেছি, আর দেখেছিলাম আমাদের দমদম এয়ারপোর্টে।

ঘরে ঢুকেই বাঁদিকের একটা টেবিলে একজন সুশ্রী মহিলা বসে আছেন। টেবিলের উপর লেখা আছে, রিসেপশন। বাবুদা সেই দিকেই এগিয়ে গেল। বাবুদাকে আসতে দেখে ভদ্রমহিলা বললেন, “হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ, স্যার?”

বাবুদাও ইংরেজিতে বলল, “আমার নাম জৈত্র মিত্র। কাল ফোন করেছিলাম। মিঃ কেডিয়ার সাথে সাড়ে ন’টার সময় অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।”

ভদ্রমহিলা হাসি মুখে বললেন, “প্লিজ, অয়েট ফর এ মমেন্ট, স্যার।” এই বলে উনি কম্পিউটারে কী যেন দেখলেন, তারপর বললেন, “স্যার একটু ব্যস্ত আছেন, দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এই সোফাটায় গিয়ে বসুন। মিঃ কেডিয়া ফ্রি হলে আপনাকে ডেকে নেব।”

ও বলল, “আমি আসল রোহটাক সলিউশনস থেকে আসছিলাম”, তারপর পকেট হাতড়ে কিছু খুঁজে বলল, “এমা, কার্ডটা আনতে ভুলে গেছি।”

রিসেপশনে বসা ভদ্রমহিলা বললেন, “হ্যাঁ, আপানদের ওখান থেকে একজন ফোন করেছিলেন, একটু আগে। কিন্তু নাম বললেন না। আপনিই কি?”

“না আমি না, মনে হয় আমার বস ফোন করেছিলেন। গলাটা খুব ভারি তো?”

বাবুদা এই প্রশ্নটা কেন করল সেটা বুঝতে আমার বেশি সময় লাগলো না।

ভদ্রমহিলা বললেন, “না, না। ভারি কোথায়? বেশ নরম মানে মিহি টাইপের।”

“ও আচ্ছা, তাহলে হয়তো অন্য কেউ...” বলে বাবুদা আমার পাশে এসে বসে পড়ল।

পাক্কা কুড়ি মিনিট বসার পর ওই ভদ্রমহিলা বললেন, “আপনারা এবার ভিতরে যেতে পারেন। ওই যে সোজা গিয়ে তিন নম্বর ঘরটা।”

“গুড মর্নিং, মিঃ কেডিয়া।”

“গুড মর্নিং”, বেশ ভারি গলায় উত্তর এল।

বাবুদা এগিয়ে গিয়ে মিঃ কেডিয়ার বিপরীতে একটা চেয়ারে বসল। আমিও বসলাম ওর পাশের চেয়ারটায়। আমাদের মাঝখানে একটা প্রশস্ত আধুনিক ডেস্ক। অফিস ঘরটা শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত আর চারিদিক থেকে বন্ধ। তাই বাইরের কোন শব্দই আর ভিতরে এসে পৌঁছয় না। টেবিলের উপর কিছু ফাইল রাখা আর একটা ইলেকট্রনিক ঘড়ি।

টেবিলের উল্টো দিকে যিনি বসে আছেন তাঁর চেহারাও সেই ঘরের সাথে মানানসই। হাইট বেশি না হলেও চেহারাটা বেশ ভালোই। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশের উপরে। মাথায় পরিপাটি করে আঁচড়ানো সাদা ধবধবে চুল, আর নাকের নীচে খুব যত্ন করে কাটা একটা মোটা কালো গোঁফ। পরনে কালো সুট, হাতের কব্জিতে দামি রলেক্সের ঘড়ি।

আমরা বসতে উনি জিজ্ঞেস করলেন, “বালুন কী ব্যাপার?”

“আমার কতগুলো ইনফরমেশন দারকার ছিল, মিঃ কেডিয়া”, শান্ত গলায় বলল বাবুদা।

উনি একটু ভ্রু কুঁচকে বাবুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বালুন, যদি পসেবেল হয় তাহলে দিব।”

ভদ্রলোক বাংলাটা ভালোই বলেন যদিও একটা হালকা হিন্দির টান আছে কথায়।

“আপনি রিসেন্টলি ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরীর কাছে একটা পেপার কেনার ব্যাপারে গিয়েছিলন। তাই না?”

“ইয়েস।”

“উনি বিক্রি করতে রাজি হননি?”

“নো।”

“আপনি পেপারটার ব্যাপারে কী করে জানলেন?”

“হামি জানিনি, হামার এক কর্মচারী হামায় আর্টিকেলটা দেখায়। যদিও এখন ওই পেপার নিয়ে হামার কোন ইন্টারেস্ট নেই মিঃ মিত্তর।”

“কেন জানতে পারি কি?”

“কারণ হামার চেন্নাইয়ের ল্যাবে হামার এক সায়েন্টিস্ট এই একই বিষয়ে রিসার্চ করছেন। আর সেও প্রায় শেষের দিকে।”

বাবুদা একটু গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন করল, “পেপারটা বিক্রি করার জন্য তো আরও একজন এসেছিলেন আপনার কাছে?”

প্রশ্নটা শুনে ভদ্রলোক যেন একটু আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। ভাবটা এমন যে বাবুদা যেন একটু বাড়াবাড়িই করছে আর উত্তর দেওয়া বা না দেওয়া ওনার মর্জি। তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর উনি বললেন, “আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে হামি বাধ্য নয়, মিঃ মিত্তর। আপনি এখন আসতে পারেন। হামার একটা মিটিং আছে। গুড বাই মিঃ জৈত্র মিত্র।”

শেষ কথাটা মিঃ কেডিয়া এমন করে বললেন যেন বাবুদার নাম ও পেশার সাথে উনি বিশেষভাবে পরিচিত।

ওখান থেকে বেরিয়ে বাবুদা বলল, “সবে তো সাড়ে দশটা, এখন আর লাঞ্চ কি করবি? চল বরং যাদবপুরে গিয়েই একেবারে লাঞ্চ সেরে নিবি।”

আমি বললাম, “যাদবপুরে? কী করতে যাবে?”

“তোর আর বুদ্ধি হবে না রে মান্তে, এক বার কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে যাব। প্ৰণববাবুর কাজের ঘরটা একবার দেখার খুব ইচ্ছে আছে”, এই বলে ও একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে থামাল।

ট্যাক্সিতে উঠে আমি বললাম, “পেপার তো আর ল্যাব থেকে চুরি যায়নি, গেছে বাড়ি থেকে। তা ওখানে কী দেখবে?”

বাবুদা গম্ভীর গলায় বলল, “যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।”

* * *

যাদবপুরে পৌঁছতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল। আমি বাবুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা যে যাচ্ছি, তা দেবাঙ্গনবাবু যদি না থাকে? তাহলে?”

বাবুদা বলল, “না থাকলে আর কী? টু বি বাস স্ট্যান্ডের সামনের ‘সাহি কাবাব’ রেস্টুরেন্টটা থেকে লাঞ্চ করে বাড়ি চলে যাব। ওরা রেশমি কাবাবটা ফাটাফাটি বানায়।”

কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের গেটের সামনে ট্যাক্সিটা ছেড়ে আমারা ভিতরে ঢুকলাম। রিসেপশনের সামনে দাঁড়িয়ে জেনেটিক্স ডিপার্টমেন্ট কোথায় জিজ্ঞেস করতেই সেখানে বসা ভদ্রমহিলা বললেন, “কার সাথে দেখা করতে যাবেন?”

বাবুদা বলল, “ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরীর সহকারী, ডাঃ দেবাঙ্গন ঘোষালের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

“একটু অপেক্ষা করুন”, বলে উনি সামনের ডেস্কের উপর রাখা কালো রঙের টেলিফোন তিনটে নম্বর ডায়াল করলেন। তারপর কয়েক সেকেন্ড কথা বলে পাশে বসা বেয়ারাকে বললেন, “এনাদের ডাঃ দেবাঙ্গন ঘোষালের অফিসে নিয়ে যাও।”

বেয়ারাটা ‘আসুন’ বলে রিসেপশনের পাশের একটা করিডোর দিয়ে এগিয়ে গেল। আমি আর বাবুদা ওর পিছনে। মিনিট সাতেক ওই করিডোর দিয়ে ডান দিক, বাঁ দিক ঘুরে একটা বেশ বড় দরজার সামনে এসে বলল, “এইটা ডাঃ রায় চৌধুরীর ল্যাব। ডাঃ ঘোষালও এখানেই বসেন। “

দরজায় নক করতেই দেবাঙ্গনবাবু বেরিয়ে এলেন। তারপর বেশ অবাক হয়েই বললেন, “একী, মিঃ মিত্র। আপনি?”

“আপনার সাথে একটু কথা ছিল। তাই ভাবলাম সেই ফাঁকে একবার কাল্টিভেশনের ল্যাবটাও দেখে যাই,” তারপর একটু থেমে বলল, “ব্যস্ত ছিলেন নাকি?”

অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে দেবাঙ্গনবাবু বললেন, “ও আচ্ছা, আসুন।”

ল্যাবে ঢুকে দেখি বড় ছোট মিলিয়ে কম করে কুড়িটা বিভিন্ন প্রকারের মেসিন। তার সঙ্গে আছে কেমিক্যাল রাখা অনেক পাত্র। আমি দেখালাম একটা বেশ বড় ব্রাউন রঙের জারের গায়ে লেখা সালফিউরিক এসিড, ৩২ (এন)। আবার আর একটাতে লেখা হাইড্রফ্লুরিক এসিড। তাছাড়া টেবিলের উপর রাখা আছে প্রচুর টেস্ট টিউব, বিকার আর ছোট ছোট স্বচ্ছ কাঁচের প্লেট। বাবুদা বলল যে ওগুলোকে অয়াচ গ্লাস বলে। একটা বেশ বড় মেসিনের সামনে এসে দেবাঙ্গনবাবু বললেন, “এটা হল ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ।” বাবুদা দেখি কাছে গিয়ে ভালো করে মেশিনটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর বলল, “আচ্ছা দেবাঙ্গনবাবু, আগুনটা ঠিক কোন জায়গায় ধরেছিল?”

“আগুনটা? এই যে ওই ঘরে। আসুন দেখাচ্ছি।”

এই বলে উনি পাশের একটা মাঝারি সাইজের ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানেও একটা বিশাল মেসিন। বাবুদা বলল, “এটা এক্স আর ডি মেসিন না?”

“হ্যাঁ, আর ওই যে ওটা হল প্রেসটা”, বলে আঙুল দিয়ে একটা ছোট্ট মেসিনের দিকে দেখালেন। তারপর বললেন, “এটা একদম আপডেটেড ভারসান। এটাতে কিন্তু পাউডার দিলে কাজ হয় না, এই প্রেসটায় পাউডারটা প্রেস করে এই রকম টাইপের সেল বানাতে হয়।” এই বলে উনি একটা ট্যাবলেটের মত জিনিষ আমার হাতে দিলেন। আমার দেখা হয়ে গেলে, বাবুদা সেটা আমার হাত থেকে নিয়ে ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে বলল, “আমাদের কলেজে কিন্তু পুরানো মেশিনটাই দেখেছি। এই মেশিনটার এরার ফ্যাক্টার কত?”

দেবাঙ্গনবাবু বললেন, “পয়েন্ট জিরো জিরো টু।”

“বাবা! আমরা তো কাজ করেছি পয়েন্ট জিরো জিরো নাইনে।”

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। পয়েন্ট জিরো জিরো টু আর পয়েন্ট জিরো জিরো নাইনের মধ্যে যে কী এমন ডিফারেন্স কি জানি। যাই হোক, এই বিষয়ে আলোচনা চলল আরও মিনিট দশেক। তারপর বাবুদা মেসিনের উল্টো দিকটা দেখিয়ে বলল, “ওইখানেই আগুনটা লেগেছিল?”

দেবাঙ্গনবাবু অবাক হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কী করে...”

বাবুদা ওর একপেশে হাসিটা হেসে বলল, “কিছুই না, ওখানে একটা ইলেকট্রিক বোর্ড আছে আর তার নিচের দেওয়ালের অংশটার রঙ বাকি দেওয়ালের চেয়ে আলাদা। মানে পুড়ে যাওয়ার দাগটা ঢাকতে আবার রঙ করা হয়েছে।”

দেবাঙ্গনবাবু একটু বোকা বোকা হাসি হেসে বললেন, “ঠিক, ঠিক।”

বাবুদা দেওয়ালটার কাছে গিয়ে ভালো করে কী যেন দেখল, তারপর বলল, “চলুন, একবার আপনাদের কাজের ঘরটা দেখে নিই।”

ওই ঘরটা থেকে বেরিয়ে আরও দুটো দরজা ছেড়ে একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। আগের ঘরটার মতই মাঝারি সাইজের ঘর। এটাতেও বেশ কিছু কেমিক্যালের বোতল রাখা। আর আছে দুখানা টেবিল। একটা বেশ বড় আর একাটা মাঝারি সাইজের। দেবাঙ্গনবাবু বললেন যে ওই বড় টেবিলটা প্ৰণববাবুর আর ছোটটা ওনার।

তারপর প্রায় পনেরো মিনিট ধরে বাবুদা সারা ঘরটা ভালো করে দেখল। একটা দুটো ফাইল খুলেও কী যেন পড়ল। তারপর দেবাঙ্গনবাবুকে বলল, “ল্যাবে পেপারটা কোথায় থাকত?”

ডাঃ রায় চৌধুরীর টেবিলটার একটা ড্রয়ার দেখিয়ে দেবাঙ্গনবাবু বললেন, “এইটায়। চাবি দেওয়া থাকত।”

“পেপারটা যে উনি এখান থেকে বাড়ি নিয়ে গেছেন, সেটা কি এখানের কেউ জানত?”

“আমি যতদূর জানি, এখনও কেউ জানে না। পেপারটা যে চুরি গেছে সেই খবরটা তো প্রেসের কাছে লিক করা হয়নি।”

“আচ্ছা, তা এই ল্যাবে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মধ্যে কেউ কি হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? মানে ধরুন এই একই সাব্জেক্টের উপর কাজ করছে এমন কেউ।”

একটু চিন্তা করে দেবাঙ্গনবাবু বললেন, “উঁহু, আমি তো সেরকম কাউকে জানি না।”

“আই সি, ঠিক আছে মিঃ ঘোষাল, আমি আজ তাহলে চলি। এখন প্ৰণববাবুর শরীর কেমন আছে?”

“ওই একই রকম। কোন উন্নতি নেই।”

আমরা দেবাঙ্গনবাবুর থেকে বিদায় নিয়ে কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর সেই ‘সাহি কাবাব’-এ লাঞ্চ করে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন সবে দেড়টা বাজে।

“যা একটু গড়িয়ে নে”, বলে বাবুদা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর কার সাথে যেন ফোনে কথা বলল বেশ কিচ্ছুক্ষণ। দরজার বাইরে থেকে আমি বিশেষ কিছুই শুনতে পেলাম না। কী আর করব ঘরে গিয়ে স্নান করে খাটে শুতেই ঘুম এসে গেল।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখি সাড়ে ছটা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে চোখমুখ ধুয়ে বৈঠকখানায় এলাম। বাবুদার ঘরের সামনে এসে দেখলাম দরজা খোলা। ভিতরে উঁকি মেরে দেখলাম বাবুদা নেই। সুখেনকাকাকে জিজ্ঞেস করতে ও বলল বাবুদা নাকি ঘণ্টা দুয়েক আগে কোথায় বেরিয়ে গেছে। আমার এই জিনিষটা একদম ভালো লাগল না। তদন্তের পুরোটা না দেখলে তো কিছুই বুঝব না, আর বাবুদাকে একটু হেল্পও করতে পারব না। যদিও এটা জানি যে আমার হেল্পের দরকার ওর নেই, তবুও।

‘বাদশাহি আংটি’-র অর্ধেকটা বাকি ছিল, তাই সেটা খুলেই সোফায় গিয়ে বসলাম। খানিকক্ষণ পড়ার পর দেখলাম ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে। এমন সময় বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি থামার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি বারান্দায় গিয়ে দেখি বাবুদা নামছে ট্যাক্সিটা থেকে।

ও উপরে এলে আমি বললাম, “এটা কিন্তু ঠিক হল না। তুমি আমায় না নিয়ে একা একাই চলে গেলে কেন?”

“একটা ক্ষীণ আলোর আশা দেখতে পাচ্ছিলাম, তাই বেরিয়েছিলাম আরকী !” হেসে বলল বাবুদা।

“তাহলে কেস সল্ভড?” আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম।

“না রে মান্তে, সল্ভড আর কোথায়? একটা গন্ধ শুধু ভাবাচ্ছে রে।”

“গন্ধ? কীসের গন্ধ?”

বাবুদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু এমন সময় ওর মোবাইলটা বেজে উঠল। ওটা কানে দিয়ে ‘হ্যালো’ বলল ও। তারপর একবার ‘তাই নাকি? কী করে?’ আর বার তিনেক ‘হু’ বলে ও ফোনটা পকেটে রেখে দিল।

আমি ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করার আগেই বাবুদা বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, “ঝটপট রেডি হয়ে নে। রাজাবাজার যেতে হবে। এই মিনিট পনেরো আগে প্ৰণববাবু মারা গেছেন। হার্ট অ্যাটাক।”

(৮)

আজ আর মেট্রো ধরল না বাবুদা, প্রথম দিনের মত ট্যাক্সিতে চেপে রাজাবাজার পৌঁছতে লাগলো মিনিট পঁয়তাল্লিশ। সাড়ে আটটা নাগাদ ‘অশ্বিনী ভবন’-এ পৌঁছে দেখি প্রায় সবাই সেখানে উপস্থিত আছেন। আমাদের আসতে দেখে দেবাঙ্গনবাবু এগিয়ে আসতে বাবুদা জিজ্ঞেস করল, “ডাক্তার এসেছিলেন?”

“হ্যাঁ, ডাঃ সান্যাল। এই মিনিট দশেক আগে গেলেন। আবার আসবেন চার ঘণ্টা পর, ডেথ সার্টিফিকেট দিতে।”

“বডি কোথায়?”

“ওনার শোবার ঘরে। আসুন।”

আমরা বৈঠকখানা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপর উঠতে শুরু করেছি। উঠতে উঠতে বাবুদা বলল, “বডিটা কে দেখল প্রথম?”

“চাকর দীননাথ। চা দিতে গিয়ে দেখে স্যারের অচৈতন্য দেহ।”

আমরা উপরে গিয়ে দেখি সাদা কাপড়ে ঢাকা প্ৰণববাবুর দেহটা খাটে শোয়ানো আছে। পাশে একটা চেয়ারে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন বিপ্লববাবু। ওনার কাঁধে হাত রেখে বেশ ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে আছেন অনিমেষ রায়। আর জানলার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে সৌম্যদীপ দত্ত। চাকর দীননাথ প্ৰণববাবুর পায়ের দিকটায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

আমাদের ঢুকতে দেখে বিপ্লববাবু উঠে দাঁড়ালেন, “আসুন মিঃ মিত্র। কী থেকে কী হয়ে গেল।” ওনার গলাটা বেশ ভারি হয়ে এল। বাবুদা গম্ভীর গলায় বলল, “ভেরি সরি ফর ইওর লস, মিঃ রায় চৌধুরী।” তারপর দীননাথের দিকে ফিরে বলল, “তুমি প্রথম দেখেছ ?”

দীননাথের চোখে জল এসে গেল। সে গামছা দিয়ে চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, “বাবু আমায় উপরে ডেকে এক কাপ চা দিতে বললেন। তারপর বাবুর একটা ফোন এল। আমি চা নিয়ে উপরে গিয়ে দেখি বাবুর যেন হুঁশই নেই। বার দুয়েক ‘বাবু, বাবু’ করে দেখে যখন কোন সাড়া পেলাম না, তখন নীচে গিয়ে এই বাবুকে ডাকি”, বলে দেবাঙ্গনবাবুর দিকে আঙুল দেখিয়ে দিল।

দেবাঙ্গনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “আমি তাড়াতাড়ি উপরে এসে দেখি স্যারের পালস নেই। তাই দীননাথকে বলি বিপ্লববাবুকে ডাকতে। আর তক্ষুনি আমি ডাক্তার সান্যালকে ফোন করে দিই।”

বাবুদা এগিয়ে গিয়ে প্ৰণববাবুর দেহটা ভালো করে দেখল। তারপর বলল, “ডাঃ সান্যাল কী বললেন?”

বিপ্লববাবু বললেন, “ব্লাড সুগার লেভেল খুব লো হয়ে যাওয়ার জন্য নাকি এই হার্ট অ্যাটাক।”

বাবুদা ভ্রু কুঁচকে বলল, “উনি কি সময় মত ওষুধ খেতেন না?”

দীননাথ বলল, “হ্যাঁ, বাবু। হামি রোজ ওনাকে ওষুধ খাওয়ার কথা বলে দিতাম। বাবু বলতেন, ‘তোকে ছাড়া আমার কী করে চলবে রে দীন...’ আর আজ বাবুই...” আবার কাঁদতে লাগল দীননাথ।

বিপ্লববাবু বললেন, “দিনুদা, এনাদের একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।”

দীননাথ নীচে চলে গেলে বাবুদা দেবাঙ্গনবাবুকে বলল, “আপনি কি নীচে ছিলেন তখন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। স্যার একটা নতুন বই লিখছিলেন, সেটার ফাইনল প্রুফ চেক করছিলাম। ওই আগের দিন যে ঘরে আপনি বসেছিলেন, ওই ঘরটায়।”

“আই সি। তা আমার মনে হয়, আপনি একবার পুলিশকে খবরটা জানিয়ে দিন।”

অনিমেষবাবু এবার বলে উঠলেন, “কিন্তু মিঃ মিত্র, এ তো নর্মাল ডেথ, এতে কি পুলিশকে জড়ানোর কোন দরকার আছে?”

“তা নেই, তবে ওনাদের খবরটা জানিয়ে দিতে বলছি।”

আমরা নীচে চলে এলাম। বৈঠকখানায় বসে সৌম্যদীপবাবু বললেন, “ওই পেপার ব্যাপারে আপনি কত দূর অগ্রসর হলেন মিঃ মিত্র?”

“বেশ কিছুটা।”

“না মানে, আমি নতুন বাড়ি দেখে নিয়েছি, কিন্তু পুলিশের মতে কেস সল্ভ হওয়া পর্যন্ত কেউ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম আর কী।”

“ধৈর্য ধরুন মিঃ দত্ত।”

“কী ধৈর্য ধরব বলুন। আপনি হয়তো জানেন যে গতকাল আমায় থানায় ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন ইন্সপেক্টার দাস। তারপর শুরু হয় জেরা। প্রায় দু ঘণ্টা পড়ে ছাড়া পাই। আমার এইসব আর ভালো লাগছে না মিঃ মিত্র।”

বাবুদা শুধু মাথা নাড়ল, মুখে কিছু বলল না।

ইতিমধ্যে দীননাথ চা নিয়ে এসেছে। চা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বাবুদা ওকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “এই দীননাথ, তোমার ডান হাতে একটু অসুবিধে আছে না?”

দীননাথ বলল, “হ্যাঁ বাবু। বছর দুই আগে এক তলার বারান্দায় কাপড় মেলতে গিয়ে হামি নীচে পড়ে যাই। বিশেষ কিছু না হলেও এই হাতটা বেশ অকেজো হয়ে গেছে। জোর পাই না একদম।”

বাবুদা মাথা নাড়ল, বলল, “আচ্ছা, তুমি যাও।”

বিপ্লববাবু বললেন, “বাবাই ওর চিকিৎসা করান। হাতের হাড় চার জায়গায় ভেঙেছিল। তিন মাস প্লাস্টার বেঁধে ঘুরেছে।”

তারপর বাবুদা বিপ্লববাবুকে বলল, “আপনাদের এই বইয়ের আলমারিতে যে এত বই, সেগুলো কি শুধু আপনার বাবাই পড়তেন?”

“হ্যাঁ, তবে অনিমেষও পড়ে মাঝে মাঝে। আমার বইয়ের ব্যাপারে কোন ইন্টারেস্ট নেই। আর সৌম্যরও তাই। বাবা যদিও শুধু সায়েন্সের বইগুলোই পড়তেন। কেন বলুন তো?”

বাবুদা বলল, “না, এমনি।”

ওখান থেকে বেরনোর সময় বাবুদা দেবাঙ্গনবাবুর থেকে ডাঃ সান্যালের ফোন নম্বরটা নিয়ে এল। বেরনোর সময় একটা পুলিশের জিপ আসতে দেখে বাবুদা দাঁড়িয়ে গেল। ফটক দিয়ে ঢুকে জিপটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ইন্সপেক্টার দাস নেমে এসে বললেন, “সে কী মশায়, কী করে হল?”

বাবুদা সংক্ষেপে খবরটা দিতে ইন্সপেক্টার দাস ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটা চুক করে শব্দ করে বলল, “ইস, ভেরি স্যাড। তা মনে হচ্ছে তো নর্মাল ডেথ। আমার কি কিছু করার আছে এখানে?”

বাবুদা বলল, “শুধু একটা হেল্প করতে হবে।”

“বলুন।”

“বডিটা নিয়ে গেলে আপনি ঘরটা ক্রাইম সিন বলে সিল করে দিন। চুরিটা তো ওই ঘর থেকেই হয়েছিল।”

“ওকে। আপনি তাহলে কবে আসবেন সার্চ করতে?” হেসে বললেন ইন্সপেক্টার দাস।

“কালকে। ওই বিকেলের দিকে। আপনাকে ফোন করে নেব।”

ইন্সপেক্টার দাসকে বিদায় জানিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। বাবুদা খুব গম্ভীর। সারা রাস্তায় কোন কথা বলেনি। শুধু একবার বলেছিল, “গন্ধটা খুব সন্দেহজনক।”

* * *

পরের দিন সকালে উঠে দেখি বাবুদা সোফায় বসে আছে ওর সেই কালো খাতাটা নিয়ে। আমি কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম একটা সাদা পাতায় তিনটে প্রশ্ন লেখা আছে।

চোর কে?

ধুলো কেন?

গন্ধটা কীসের?

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না প্রথম প্রশ্নটা ছাড়া। আমি ওর পাশে এসে বসে বললাম, “চুরিটা তো বাইরের লোকও করতে পারে, তাই না?”

ও বলল, “সেক্ষেত্রে যদিও আমার বিশেষ কিছু করার নেই। আর বাইরের লোক যদি করে তবে সে কি আর তিরিশ হাজার টাকা দেখেও সেটা রেখে যেত?”

তাও ঠিক। যদি চোরই আসে, তাহলে পেপারের সাথে ফ্রিতে আরও তিরিশ হাজার টাকা পাওয়ার লোভ সে সামলাবে কেন?

বাবুদা এবার উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করেছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আমি বললাম, “তাহলে তুমি বলছ, চোর ওই বাড়িতেই আছে?”

“নিশ্চয়ই। হয় সে নিজে করেছে, নয় বা বাইরের কাউকে দিয়ে। আসল চোর ওই অশ্বিনী ভবনেই আছে।”

“তাহলে আমার মনে হয়, ওই সৌম্যদীপ দত্তই কালপ্রিট।”

“কেন?”

“দেখলে না, কেমন তোমায় একটা কথা বলল আর পুলিশকে একটা। আর বাড়ি থেকে পালানোর ধান্দাতেও আছে।”

“হু। আর দেবাঙ্গনবাবু?”

“ওনাকে দেখে মনে হয় না যে উনি চুরি করবেন।”

“কেন? ওনারও তো একই রকম সুযোগ ছিল?”

“তা ছিল। কিন্তু ওনাকে দেখে ঠিক...” আমি কোন যুক্তি দেখাতে না পেরে বললাম।

“আর বাকি দুজন?”

“ওদেরও সুযোগ ছিল।” আমি আর ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাই চুপ করে গেলাম। কিছুক্ষণ সব চুপ। তারপর বাবুদা বলল, “আজ একবার বেরোব।”

“ডাঃ সান্যালের কাছে?”

“গুড। তোর মাথাটাও আস্তে আস্তে খুলছে, রে মান্তে।”

সেই সময় প্রচণ্ড শব্দ করে একটা মোটর বাইক চলে গেল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “উফ! এই রোজ সকালে একবার করে যাবে। কান মাথা ধরে যায়।”

হঠাৎ বাবুদা পায়চারী বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, “কী হল?”

“ধন্যবাদ রে মান্তে, তুই ছাড়া এই ব্যাপারটা ক্লিয়ারই হত না। ধন্যবাদ।”

আমার কিছু বোঝার আগে বাবুদা প্রায় দৌড়ে ওর ঘরে চলে গেল। আর তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।

কী হল রে বাবা! কী এমন বললাম কি জানি।

বাবুদা ঘর থেকে বেরল প্রায় দেড় ঘণ্টা পর। এর মধ্যে বার তিনেক ফোনে কথা বলার শব্দ পেয়েছি ওর ঘর থেকে। তারপর ও যখন ঘর থেকে বেরল, তখন দেখি ও জামা প্যান্ট পরে রেডি। আমায় বলল, “চল, একবার ডাঃ সান্যালের সাথে দেখা করে আসি। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিয়েছি।”

ডাঃ পবিত্র সান্যালের বাড়ি শ্যামবাজারে। বাড়ির নীচেই চেম্বার। গিয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের পশার বেশ ভালোই। আমাদের সময় দেওয়া ছিল সাড়ে এগারোটায়। তার আগে আরও জনা বারো লোকের নাম লেখা আছে। প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ বসার পর আমাদের ডাক এল। চেম্বারে ঢুকে দেখলাম ঘরটা বেশ সুসজ্জিত। ঘরের মাঝখানে একটা বেশ বড় টেবিল। তার তিন দিকে চেয়ার দেওয়া। চতুর্থ দিকে একটা বেশ বড় রকমের রিভলভিং চেয়ারে ডাঃ সান্যাল বসে আছেন। ঘরের একটা কোণে একটা পর্দা টাঙানো। আর পর্দার অপর পারেও একটা ছোট ঘর মত করা। বাবুদাকে ঢুকতে দেখে উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আপনাকে সে দিন প্ৰণবের বাড়িতে দেখলাম না?”

বাবুদা হেসে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নাম জৈত্র মিত্র। পেশায় গোয়েন্দা।” এই বলে ও পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ডাঃ সান্যালের হাতে দিল।

ডাঃ সান্যাল কার্ডটা চোখের খুব কাছে এনে দেখে বললেন, “তা গোয়েন্দা মশায়ের আমার কাছে কী দরকার?”

বাবুদা বলল, “আমার কিছু প্রশ্ন করার ছিল।”

“বলুন। যদি উত্তর জানা থাকে তাহলে দেব।”

“ডাঃ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর কারণ?”

“হাইপোগ্লাইসিমিয়া ইন্ডিউসড হার্ট অ্যাটাক।”

“একটু বিস্তারিত ভাবে বললে সুবিধে হত।”

“আচ্ছা। যে কোন দৈহিক কাজ করলে আমাদের যে এনার্জি লাগে, সেটা সাপ্লাই করে গ্লুকোজ। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গেলে, সেই এনার্জিতে ঘাটতি দেখা যায়। আর সেই গ্লুকোজ যদি অনেক কমে যায়, তাহলে শরীরের বিভিন্ন দরকারি ফাংশান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রণবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ওর শরীরে ব্লাড গ্লুকজের লেভেল এতটাই কমে গিয়েছিল যে ওর হার্ট ঠিক মত কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তার ফল স্বরূপ এই হার্ট অ্যাটাক। বুঝলেন?”

“আজ্ঞে। তা উনি তো ওষুধ নিয়মিত খেতেন বলেই শুনেছি।”

“তা খেত। শারীরিক ব্যাপারে প্ৰণব কোনদিন গাফিলতি করেনি।”

“কিন্তু তাও কেন...”

বাবুদার কথা শেষ করতে না দিয়ে বেশ চিন্তিত গলায় ডাঃ সান্যাল বললেন, “আমিও সেটাই ভাবছি মিঃ মিত্র। আসলে এই কদিন এত টেনশনে ভুগছিলেন। সেটাও কিছুটা দায়ি এর জন্য।”

“উনি কী ওষুধ খেতেন?”

“গ্লুকোজ থার্টিন বলে একটা গ্লুকজের ট্যাবলেট। আমিই পাঠাতাম।”

“আই সি।”

“আসলে আমি প্রণবের শুধু ডাক্তারই ছিলাম না। আমরা ছেলেবেলা থেকেই খুব ভাল বন্ধু ছিলাম। এই গ্লুকোজ থার্টিন ওষুধ আমি অনেক পাই, ডক্টর’স স্যাম্পেল হিসাবে। সেগুলই পাঠাতাম ওকে। দেবাঙ্গন এসে নিয়ে যেত।”

“কিন্তু আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে, যে রোজ যদি কেউ গ্লুকোজ ট্যাবলেট খায়, তাহলেও কি তাঁর হার্ট অ্যাটাক হতে পারে?”

ডাঃ সান্যাল ভ্রু কুঁচকে বাবুদার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটু চাপা গলায় বলল, “আপনি কি অন্য কিছু সন্দেহ করছেন মশাই?”

বাবুদা হেসে বলল, “আরে না, না। আসলে এই চুরির ব্যাপারটা কতটা এই মৃত্যুর পিছনে দায়ী সেইটে জানার জন্য, আর কী। কারণ চোর ধরা পড়লে তাঁর উপর পুলিশ সেই ভাবে মামলাটা করবে।”

ডাঃ সান্যাল যেন একটু নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন, “ও আমি ভাবছিলাম আপনি হয়ত... যাই হোক, দেখুন মিঃ মিত্র, গত দুসপ্তাহ আগের কথা বলি, প্ৰণব কিন্তু বেশ সুস্থ হয়েই উঠছিল। ব্লাড সুগারও কন্ট্রোলে চলে এসেছিল। তখন ওর সুগার ছিল প্রায় আশির কাছে। কিন্তু তারপর থেকেই আস্তে আস্তে ডিটরিয়েট করতে শুরু করল। গত সপ্তাহে তো নেমে গেছিল পঞ্চাশে। আমি ডোজ ডবল করে দিই। গতকাল দুপুরে তো আমি ভাবলাম হয়তো অন্য কিছু হয়েছে। আমি ব্লাড টেস্ট করার জন্য ব্লাডও নিয়ে আসি। কিন্তু টেস্ট আর করা হল কই। কাল বিকেলেই তো খবর পেলাম...”

উনি মাথা নিচু করে বসে আছেন দেখে বাবুদা বলল, “আমরা আজকে উঠি ডাঃ সান্যাল।”

ডাঃ সান্যালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাবুদা বলল, “পেপার যদি খুঁজে বেরও করি, তবে প্ৰণববাবুর ইচ্ছা মনে হয় আর পূর্ণ হবে না।”

আমি বললাম, “কেন?”

ও বলল, “আমার তো মনে হয় না যে পেপারটা পেয়ে ওর ছেলে সেটাকে বিক্রি না করে থাকবে বলে।”

পকেট থেকে মোবাইল বের করে বাবুদা একটা নম্বর ডায়াল করল। তারপর বলল, “হ্যালো, ইন্সপেক্টার দাস?”

...“এই ধরুন চারটে নাগাদ।”

...“না, আর থানায় গিয়ে কী হবে। আপনি বরং রাজাবাজারেই চলে আসুন।”

...“আচ্ছা। ঠিক আছে। গুড বাই।”

ফোন রেখে ও বলল, “তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। চারটের সময় আবার অশ্বিনী ভবন।”

(৯)

মেট্রো রেলের লাইনে কী একটা গণ্ডগোল থাকার ফলে রাজাবাজারে পৌঁছতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। অশ্বিনী ভবনের সামনে গিয়ে দেখি ইন্সপেক্টার দাস সেখানে অপেক্ষা করছেন। আমাদের আসতে দেখে এগিয়ে এলেন। বাবুদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আপনারও লেট হয়?”

বাবুদা ওর একপেশে হাসিটা হেসে বলল, “সরি, আপনি কি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন?”

“না, না। এই মিনিট দশেক। চলুন।”

আমরা বৈঠকখানা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে সোজা প্ৰণববাবুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজাটা বন্ধ। সামনে একটা বড় সাইজের তালা ঝুলছে। তাতে একটা সাদা রঙের কাপড় জড়ানো আর সেই কাপড়ের উপর একটা লাল রঙের শিল। ইন্সপেক্টার দাস পকেট থেকে একটা ছোট্ট ছুরি বের করে সেই সিল সমেত কাপড়টাকে কেটে ফেললেন। তারপর জামার বুক পকেট থেকে একটা চাবি বের করে তালাটা খুলে ফেললেন। আমরা তিনজন ঘরে প্রবেশ করলাম। কালকে ঘরটা যে রকম দেখে গেছিলাম, আজও ঠিক সেই রকম।

ইন্সপেক্টার দাস বললেন, “ঘরের কোন জিনিসে কেউ হাত দেয়নি। এবার দেখুন, কী দেখবেন।”

বাবুদা ‘থ্যাঙ্কস’ বলে সিন্দুকটার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর মোবাইলের টর্চ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কী দেখল। তারপর বলল, “হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। তাই তো?”

প্রশ্নটা ছিল ইন্সপেক্টার দাসের উদ্দেশে, তাই উনি মাথা নেড়ে উত্তর দিলেন, “উঁহু। মনে হয় গ্লাভস পরে সিন্দুকটা খুলেছে।”

“আর রক্তের ছাপ?”

“কী? রক্তের ছাপ?”

“হ্যাঁ, সেটাও তো পাননি।”

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মিঃ মিত্র। কোথায় রক্তের ছাপ?” এই বলে ইন্সপেক্টার দাস বাবুদার দিকে এগিয়ে এল।

আমিও গেলাম।

বাবুদা ‘এই দেখুন’ বলে ঠিক সিন্দুকটার নীচে একটা ছোট্ট লোহার আঙটা দেখাল। আসলে কোন কারণে ধাক্কা লাগার ফলে সিন্দুকটার পায়ার কাছে একটা ছোট্ট লোহার আংটা মত বেরিয়ে আছে।

ইন্সপেক্টার দাস ওটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “এতে রক্ত থাকবে কেন মিঃ মিত্র?”

বাবুদা বলল, “ভালো করে দেখুন, সিন্দুকের অন্য জায়গা আর এই জায়গাটার তফাৎ। এখানটা দেখে কি মনে হচ্ছে না যে এটা কিছু দিয়ে মোছা হয়েছে?”

আমি খুব ভালো করে দেখলাম, তারপর বলে উঠলাম, “একটা কীসের রোঁয়া লেগে আছে না?”

“গুড মান্তে।”

ইন্সপেক্টার দাসও খুব কাছে গিয়ে ওনার বাই ফোকাল চশমাটা পরে দেখল। বলল, “ঠিক তো। কিন্তু রক্ত কোথায়?”

বাবুদা বলল, “আপনি এখুনি ফরেন্সিক ডিপার্টমেন্টে ফোন করে একটা ইনফ্রা রেড রে লাইট নিয়ে আসতে বলুন। আর একটা টেস্ট টিউব আর স্কারপেল।”

ইন্সপেক্টার দাস বাবুদার আদেশ পালন করলেন। ফোন রেখে বললেন, “ওদের আসতে আরও মিনিট ত্রিশেক লাগবে।”

“ঠিক আছে,” বলে বাবুদা ঘরের অন্যান্য জিনিষগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে অনেকক্ষণ কী যেন দেখল তারপর সেটাকে আবার যথাস্থানে রেখে দিল।

ঘরের প্রতিটা জিনিষ এই ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বাবুদা মাটিতে কী যেন একটা খুঁজতে লাগল। তারপর মাটিতে শুয়ে পরে খাটের নীচে মোবাইলের আলো দিয়ে দেখে তারপর আমায় বলল, “খাটটা সরাতে একটু হেল্প কর তো।”

আমি, বাবুদা আর ইন্সপেক্টার দাস মিলে ধরাধরি করে খাটটা একটু সরালাম। পুরানো দিনের বক্স খাট। বেশ ভারি। বাবুদা খাটের পাশে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখল তারপর বলল, “আই সি।”

আমি ওর কানের কাছে মুখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কী দেখলে?”

ও বলল, “ব্রহ্মাস্ত্র।”

বাবুদার এই খোঁজাখুঁজি চলল আরও মিনিট বিশেক। তার মধ্যে প্ৰণববাবুর ওষুধের বাক্স, জামা কাপড়ের আলমারি, সায়েন্স ম্যাগাজিন কিছুই বাদ গেল না।

ইতিমধ্যে একজন বেশ লম্বা, রোগা মত ভদ্রলোক এসে ইন্সপেক্টার দাসকে বললেন, “স্যার, আমি ফরেন্সিক থেকে আসছি। কী করতে হবে?”

ইন্সপেক্টার দাস বাবুদার দিকে তাকাতে বাবুদা বলল, “আসুন। এই যে লোহার আংটাটা দেখছেন, এখানে ইনফ্রা রেড রে দিয়ে দেখুন তো কোন ব্লাড স্যাম্পেল আছে কি-না?”

সেই ভদ্রলোক তাঁর ব্যাগ থেকে একটা বন্দুকের মত জিনিষ বের করে তার উপরের প্যানেল বোর্ডে কীসব যেন টেপাটিপি করলেন। তারপর একটা লালচে আলো ফেললেন ওই আঙটাটার উপর। কিছুই বোঝা গেল না। বাবুদা ফিসফিস করে বলল, “ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ান।”

উনি আবার কীসব টেপাটিপি করলেন। তারপর আবার আলোটা ফেললেন। এবারে আলোর রঙ একটু হালকা নীলচে।

বাবুদা চাপা গলায় বলে উঠল, “ইউরেকা।”

আমিও দেখতে পাচ্ছি যে ওই নীলচে আলো পড়ার ফলে আংটাটার মাথার দিকটায় একটা লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। সেই ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে একটা স্ক্যাল্পেল বের করে সেই লাল রঙের জিনিষটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একটা টেস্ট টিউবের ভিতরে ভরল। তারপর ইন্সপেক্টার দাসের দিকে ফিরে বললেন, “কী চেক করব স্যার।”

এবারের উত্তরটাও বাবুদাই দিল, “আপাতত ব্লাড গ্রুপটা চেক করলেই হবে। যদিও একটা ডি এন এ টেস্টও দরকার হতে পারে।”

ভদ্রলোক মাথা নাড়িয়ে ইন্সপেক্টার দাসকে একটা স্যালুট ঠুকে বেরিয়ে গেলেন। ইন্সপেক্টার দাস বলল, “আমার আর কী করনীয়, মিঃ মিত্র?”

বাবুদা বলল, “আপাতত কিচ্ছু না। আপনি ঘরটা আবার সিল করে দিন।”

রাস্তায় বেরিয়ে বাবুদা বলল, “ইন্সপেক্টার দাস, আর একটু হেল্প করতে হবে।”

“বলুন।”

“আমায় এই ভাইটিকে একটু আমার বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে।”

আমি বললাম, “মানে? তুমি যাবে না?”

“না। আমার একটু কাজ আছে। আলোর যে বিন্দুটা দেখতে পাচ্ছিলাম, সেটা একটু জোরালো হয়েছে। তুই বাড়ি যা। আমি আসছি একটু পর।”

ইন্সপেক্টার দাস বললেন, “আপনাকেও রাজাবাজার মোড় অবধি ছেড়ে দিই ?”

বাবুদা রাজি হয়ে গেল। ওকে রাজাবাজার মোড়ে নামিয়ে ইন্সপেক্টার দাস আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল।

* * *

বাড়িতে এসে বাবুদার উপর আমার বেশ একটু রাগই হল, আমাকে না নিয়ে চলে গেল বলে। কী এমন কাজ যে আমার সাথে নিলে ওর অসুবিধে হত? যাই হোক সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। ঘরে গিয়ে বিছানায় শুতেই ঘুম এসে গেল। ঘুম যখন ভাঙল, তখন দেখি সাড়ে সাতটা বাজে। বৈঠকখানায় এসে দেখলাম বাবুদা এখনও ফেরেনি। ভাবলাম একবার ফোন করে দেখব? তারপর ঠিক করলাম না, থাক। নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছে।

কী আর করি, টিভি চালিয়ে বসে গেলাম। দেখার মত কিছুই হচ্ছিল না আর আমার মনটাও পড়ে আছে বাবুদার দিকে তাই চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সময় কাটাচ্ছিলাম। প্রায় রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ বাবুদা এল। এসেই ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। তারপর টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে একটা সিগারেট টানতে লাগল।

আমি বললাম, “কোথায় ছিলে এতক্ষণ ?”

ও কোন উত্তর দিল না।

আমি আবার বললাম, “বল না কোথায় গিয়েছিলে?”

ও বলল, “সি জি সি আর আই।”

“অ্যাঁ, সেটা কী?”

“সেরামিক এন্ড গ্লাস রিসার্চ ইন্সটিটিউট, যাদবপুরে।”

“কেন?”

ও যেন আমার কথাটা শুনতেই পারল না। বলল, “আরও কতগুলো জায়গায় যেতে হল। ডাঃ সান্যাল, কাল্টিভেশন ইতাদি ইতাদি।”

“ওই রক্তটা কার সেটা জানা গেল?”

“উঁহু।”

“ইন্সপেক্টার দাস এখনও ফোন করেননি?”

“করবেন, করবেন। অত উতলা হয় না বৎস।”

আমি বুঝলাম ওর থেকে কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। আর ওর যা মুড দেখলাম তাতে মনে হল কেসটা ও সল্ভ করে ফেলেছে। তবুও শেষ চেষ্টা করলাম, “তুমি ধরে ফেলেছ?”

“কী ধরব?”

“বল না, চোর কে?”

“যথা সময়ে জানতে পারবি। এখন শুধু অপেক্ষা একটা ফোনের।”

বাবুদা চোখ বুজে শুয়ে গুন গুন করে একটা হিন্দি ছবির গান গাইছে। হাতের সিগারেটটায় এত বড় একটা ছাই জমে আছে। আমি ওর পাশে বসে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছি। আমিও মনে মনে অপেক্ষা করছি সেই ফোনটার।

যদিও বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট পনেরোর মধ্যেই বাবুদার মোবাইলটা বেজে উঠল। ওটা কানে দিয়ে ও বলল, “হ্যালো, বলুন ইন্সপেক্টার দাস।”

...“আচ্ছা।”

...“বেশ। তাহলে একটা কাজ করুন। কাল বিকেলে ঠিক পাঁচটায় সবাইকে নিয়ে অশ্বিনী ভবনে চলে আসুন। হ্যাঁ, সবাই মানে বিপ্লববাবু, দেবাঙ্গনবাবু, সৌম্যদীপবাবু, অনিমেষবাবু আর দীননাথ।”

তারপর একটু থেমে বলল, “হ্যাঁ, ডাঃ সান্যালকেও আসতে বলবেন। আর আপনার জনা তিনেক অনুচরেরও খুব দরকার।”

...“ধৈর্য ধরুন ইন্সপেক্টার দাস, কালকেই জেনে যাবেন, চোর কে?”

...“ওকে। গুড নাইট। তাহলে কাল ঠিক পাঁচটায়।”

(১০)

ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে পৌনে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম অশ্বিনী ভবনে। ইস্পেক্টার দাসও এসে পড়লেন পাঁচটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগে, সঙ্গে তিনজন কন্সটেবেল। বাবুদার কাছে এসে সামান্য হেসে বললেন, “আপনি রেডি তো?”

বাবুদাও ওর একপেশে হাসিটা হেসে বলল, “আপনি রেডি তো?”

পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাই এসে পড়ল। সবাই বলতে – বিপ্লববাবু, সৌম্যদীপবাবু, অনিমেষবাবু, দেবাঙ্গনবাবু, ডাঃ সান্যাল আর দীননাথ। এই মিনিট পাঁচেক দেরী হল ডাঃ সান্যালের জন্য। উনি ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “আসলে একটা সিরিয়াস পেসেন্ট এসে যাওয়ায়...”

অশ্বিনী ভবনের প্রশস্ত বৈঠকখানায় সবাই চেয়ার ও সোফাতে ছড়িয়ে বসলেন। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলায় ঘরের মধ্যে একটা হালকা গুনগুন শব্দ হচ্ছিল।

ইন্সপেক্টার দাস বললেন, “পেপারটা কি পাওয়া গেছে মিঃ মিত্র?”

“যথা সময়ে তার উত্তর পাবেন,” বলল বাবুদা। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সকলের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, “রহস্যের সমাধান হয়েছে। আর এটা বলাই বাহুল্য যে পুলিশের সাহায্য ছাড়া এটা হত না। আমি আপনাদের এখন ঘটনাটা বলতে চাই। আশা করি আপনাদের মনে যে সমস্ত প্রশ্ন আছে তার উত্তরও আমার কথায় পেয়ে যাবেন।”

“আই হোপ সো। তবে খুব বেশি সময় নেবেন না মিঃ মিত্র,” বললেন ডাঃ সান্যাল, “আমার আবার একটা কলে যেতে হবে।”

“যতটুকু দরকার, তার চাইতে এক সেকেন্ডও বেশি নেব না”, বলল বাবুদা।

সবাই চুপ।

“তা হলে এবার শুরু করি?”

“করুন,” বললেন দেবাঙ্গনবাবু।

“এই তদন্তের ব্যাপারে আমি সকলকেই জেরা করি। তার মধ্যে সকলেই যে সব সময় সত্যি কথা বলেছেন তা নয়। তাদের মিথ্যে কিছু ধরা পড়েছে অন্যের জেরাতে। কেউ কেউ আবার কিছু জিনিষ লুকিয়েছেন, আবার কেউ কেউ আমার কথার জবাব দিতে চাননি। আচ্ছা, এবার আসি চুরির ব্যাপারে। এই ব্যাপারে অনেকেই সন্দেহ করা যায়। যেমন মিঃ বিপ্লব রায় চৌধুরী, উনি বলেছেন ওনার ফ্যাক্টরি ভালো চলছে, কিন্তু আমি খবর নিয়ে দেখেছি যে গত মাসে ভাইজাগ স্টিল প্ল্যান্টে ওনার একটা লট ফেল করায় প্রায় এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। আর ওনার কোম্পানিও ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যায়। তারপর আরও একজনকে সন্দেহ করা যায়, মিঃ সৌম্যদীপ দত্ত। পরের আশ্রিত, ওনাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলা হয়। উনি নতুন সংসার করার জন্য আর এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চুরিটা করতে পারেন। তা ছাড়া আছেন মিঃ দেবাঙ্গন ঘোষাল। পেপারের জন্য অনেক কাজ করার পরেও ডাঃ রায় চৌধুরী পেপার থেকে ওনার নাম বাদ দিয়ে দেন। এই একটা পেপারে ওনার নাম থাকলে বৈজ্ঞানিক জগতে ওনার স্থান অনেক উপরে হবে। আর তা ছাড়া ডাঃ রায় চৌধুরী তখন পেপারটা ফ্রিতে আর ইউনেসকো-কে দিতে পারতেন না। কারণ তখন পেপারের মালিকানা দুজনের। আর একজনের উপর সন্দেহ করার কোন কারণই ছিল না, সেটা হলেন মিঃ অনিমেষ রায়। উনি ভালো ফার্মে চাকরি করেন, ভালো মাইনে, নিজের মত থাকেন। কিন্তু আমি খবর নিয়ে জানতে পারি যে কোম্পানি থেকে ওনাকে পিঙ্ক স্লিপ দেওয়া হয়েছে, মানে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার আগে এক মাসের নোটিস। তবে তার থেকে কিছু প্রমাণ হয় না।”

“আর একটা কথা, এখানে চুরির চেষ্টা হয়েছিল দুবার। প্রথমটা অসফল, আর দ্বিতীয়টা সফল। আমার অনুমান, প্রথম চুরির চেষ্টাটা করেছিলেন মিঃ দেবাঙ্গন ঘোষাল, বাইরের লোক দিয়ে। যদিও তখন চাবিটা হাতে না পাওয়ার ফলে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।”

“আমি চুরি কেন করতে যাব মিঃ মিত্র। আমি তো আগেই বলেছি, আমার চুরি করার হলে ল্যাবে সে সুযোগ আমার ছিল। বাড়িতে লোক ঢুকিয়ে চুরি কেন করব?” খুব শান্ত গলায় বললেন দেবাঙ্গনবাবু।

“আপনি তো পেপারটার একটা কপি করেছিলেন মিঃ ঘোষাল, আর সেটা মিঃ কেডিয়ার কাছে বিক্রি করতেও গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেও আপনি অসফল। ইনফারেন্স ছাড়া একটা পেপারের যে কোন মূল্য নেই মিঃ ঘোষাল। প্ৰণববাবুর পেপারটা বাড়িতে আনার কারণই ছিল ওটার ইনফারেন্স লেখা। ইনফারেন্স লেখা হলেই পেপারের মূল্য, নইলে শুধু এক্সপেরিমেন্টের জন্য তিন কোটি টাকা কেন দেবেন মিঃ কেডিয়া?”

দেবাঙ্গনবাবু চুপ। তারপর সেই একই রকম শান্ত গলায় বললেন, “আপনার কাছে কোন প্রমাণ নেই মিঃ মিত্র।”

“তা নেই, আর সেটা নিয়ে আমি অত চিন্তাও করিনি কারণ এটা শুধুই চুরির চেষ্টা। চুরি হয় দ্বিতীয় বার।”

“এবার আসি আমার দ্বিতীয় তথ্যে অর্থাৎ মিঃ কেডিয়ার কথায়। উনি ডাঃ রায় চৌধুরীকে তিন কোটি টাকা অফার করেন পেপারটা কেনার জন্য। কিন্তু উনি সেটা বিক্রি করতে চাননি। আমি যখন মিঃ কেডিয়াকে জিজ্ঞেস করি তখন উনি বলেন যে ওনার ল্যাবের একজন বৈজ্ঞানিক নাকি একই বিষয়ে অনেকটা কাজ করে ফেলেছেন আর পেপারটা ওনার আর দরকার নেই। মিঃ কেডিয়া এই কথাটা আমাকে বলেন প্ৰণববাবুকে ফোন করার তিনদিন পর। যদি সত্যিই কেউ কাজটা করছিলেন ওনার ল্যাবে, তাহলে উনি নিশ্চয়ই তিন কোটি টাকা দিয়ে পেপারটা কিনতে চাইতেন না। এখন যে কাজটা ডাঃ রায় চৌধুরী দশ বছর ধরে করছেন, সেটা কেউ তিন দিনে করে ফেলবেন সেটাও ঠিক বিশ্বাস যোগ্য নয়। এবার কথা হল, এই ঘরের একজন আছেন যিনি মিঃ কেডিয়ার থেকে তিন লাখ টাকা ধার নিয়েছিলেন দুমাসের মধ্যে সুদ সমেত ফেরত দেবেন বলে, কিন্তু দেননি। অনেক বলার পরও যখন তিনি টাকাটা ফেরত দেননি, তখন একটা পত্রিকায় ডাঃ রায় চৌধুরীর পেপারটার কথা প্রকাশ পেয়ে যায় আর মিঃ কেডিয়া তিন কোটি টাকা অফার করেও সেটা কিনতে ব্যর্থ হন। আমার অনুমান, তখন মিঃ কেডিয়া সেই ব্যক্তিকে বলেন পেপারটা ওনাকে দিলে উনি তার ধার মাফ করে দেবেন আর এক্সট্রা টাকাও দেবেন। সেই ব্যক্তির নাম হল মিঃ অনিমেষ রায়। তা হঠাৎ আপনার এত টাকার প্রয়োজন কেন হল মিঃ রায়?”

সকলে অবাক হয়ে দেখল অনিমেষ রায়ের দিকে। উনি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, “কী যাতা বলছেন মিঃ মিত্র?”

“আমি বলি। আপনাকে পিঙ্ক স্লিপ দেওয়া হয় কারণ আপনার বসের ধারণা হয় যে আপনি কোম্পানির তথ্য অন্য কোম্পানিকে বিক্রি করছেন। আর রোজগারের জন্য আপনি নিজস্ব একটা ব্যবসা খুলতে আগ্রহী ছিলেন। আপনি পারমিটের জন্য এপিলও করেছিলেন, সেই তথ্য আমার কাছে আছে।”

“তার থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না মিঃ মিত্র।”

“অপেক্ষা করুন। আপনি যে পেপারটা চুরি করেছেন সেটা আমার প্রথম সন্দেহ হয় আপনার সাথে যেদিন প্রথম কথা বলি। আপনার মনে আছে আপনি কী বই পড়ছিলেন?”

অনিমেষবাবু চুপ।

বাবুদা বলে চলল, “আপনি সেদিন ডান ব্রাউনের ‘ইনফারনো’ পড়ছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করায় আপনি বলেছেন যে আপনি কোন লাইব্রেরী থেকে বই নেন না, সব বাড়ি থেকেই নিয়ে পড়েন। তাহলে একজনের বাড়িতে একই বই দুটো কেন থাকবে মিঃ রায়? আমি সেদিন আপনার ঘরে যাওয়ার আগেই বইয়ের আলমারিতে দেখে গেছি ‘ইনফারনো’ বইটা সাজানো আছে। আমার অনুমান আপনি পেপারটা ওই ওই বইয়ের মধ্যে রেখে লুকিয়ে রাখেন। আর দ্বিতীয়ত, আপনার ঘরের ডাস্টবিনে একটা ব্যন্ডএডের কাগজ আর সিন্দুকের নিচের দিকে একটা বেরিয়ে থাকা আংটা। আমি পরীক্ষা করিয়ে দেখেছি যে ওখানে আপনার রক্ত লেগে আছে মিঃ রায়। আর আপনি বললে আমরা ডি এন এ টেস্ট করেও প্রমাণ করতে পারি মিঃ রায়। আর আপনার দুটো জিনিষ আপনাকে ধরতে সাহায্য করেছিল মিঃ রায়। এক হল আপনার সেন্টের গন্ধ, সেটা আমি প্রথম দিনই সিন্দুকের মধ্যে পেয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়ত আপনার গলা। যেটা মিঃ কেডিয়ার সেক্রেটারির কাছে জানতে পারি।”

অনিমেষবাবু দু হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলেছেন। আর ইন্সপেক্টার দাসের দুজন অনুচর ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, “কিন্তু পেপার তো নেই মিঃ মিত্র। ইনফারনো তো খালি। পেপার কই?”

বাবুদা গম্ভীর ভাবে বলল, “এখানে চুরি যে আরও একবার হয়েছিল মিঃ রায়, আর সেটা করেছিলেন মিঃ সৌম্যদীপ দত্ত, অফকোর্স আমার কথায়। আমি চুরির পরের দিন যখন দেখি যে আগের দিনের দেখা বই আর সেদিনের দেখা বইয়ের মধ্যে তফাৎ আছে তখন আমি মিঃ দত্তকে বলি বইটা পাল্টে দেওয়ার জন্য। আর পুলিশের জেরায় উনার যা অবস্থা ছিল, উনিও একবারে রাজি হয়ে গেলেন। এখন পেপারটা আছে ইন্সপেক্টার দাসের জিম্মায়। উনি কাল সেটা বিপ্লববাবুকে দিয়ে দেবেন।”

“কিন্তু ওই সি সি টিভি?” প্রশ্ন করল সৌম্যদীপবাবু।

“ওটা খুব সোজা মিঃ দত্ত। অনিমেষবাবু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ওনার কাছে একটা সি সি টিভি ক্যামেরা লুপ করা কোন ব্যাপার না। কিন্তু মুশকিল হল সি সি টিভিতে শুধু একদিনের ফুটেজ ছিল, তাই উনি সেটাই কপি করে দিলেন। আমার প্রথম সন্দেহ হয় সিন্দুকের পাশে চেয়ারের ছায়া দেখে। আপনাদের নিশ্চই মনে আছে যে তার আগের দিন সারা দিন ভীষণ বৃষ্টি হয়েছিল আর সারাদিন একটুও রোদ ওঠেনি। তাহলে ছায়া এল কোথা থেকে? আর আগের দিন এই পাড়ায় একজনের শরীর খারাপ হওয়ায় একটা এ্যাম্বুলেন্স এসেছিল। সেটার শব্দও ছিল দ্বিতীয় দিনের ফুটেজে।”

ডাঃ সান্যাল উঠতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বাবুদা বলল, “কোথায় যাচ্ছেন ডাঃ সান্যাল, আমার কথা তো শেষ হয়নি। এবার আসি দ্বিতীয় রহস্যে, আর সেটা হল ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরীর খুন।”

ঘরের মধ্যে আবার একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছে।

ইন্সপেক্টার দাস বললেন, “খুন?”

“হ্যাঁ, ইন্সপেক্টার দাস, খুন।”

“কিন্তু উনি তো হার্ট অ্যাটাকে...” ডাঃ সান্যালের কথা শেষ হল না।

বাবুদা বলে চলল, “আমি দেবাঙ্গনবাবুকে দুটো প্রশ্ন করতে চাই। এক, জেনেটিক্সে সোডিয়াম সায়ানাইড কী করতে লাগে মিঃ ঘোষাল?”

দেবাঙ্গনবাবু কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ঘর নিস্তব্ধ। আর তার মধ্যে বাবুদা বলে চলল, “আমি কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিলাম মিঃ ঘোষাল। আর আমি খবর নিয়ে জেনেছি যে জেনেটিক্সে সোডিয়াম সায়ানাইড লাগে না। ওটা লাগে ডি গ্লুকোজ থেকে এল গ্লুকোজ করতে।”

“সেটা আবার কী?” প্রশ্নটা এক ইন্সপেক্টার দাসের থেকে।

“গ্লুকোজ দু রকম হয় ইন্সপেক্টার দাস। এক হল ডি গ্লুকোজ যেটা প্রেস্ক্রাইব করেছিলেন ডাঃ সান্যাল আর ওটাই পাঠাতেন দেবাঙ্গনবাবুর হাত দিয়ে। আর দুই নম্বরটা হল, এল গ্লুকোজ, সেটা প্রাকৃতিক নিয়মে তৈরি হয় না, ওটা আর্টিফিশিয়ালি তৈরি করতে হয় ল্যাবে। যদিও ডি গ্লুকোজের বড়ি আর এল গ্লুকোজের বড়ি দেখতে ও টেস্টে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু কোন হাইপার গ্লাইসিমিয়ার পেসেন্ট যদি ডি গ্লুকোজের জায়গায় এল গ্লুকোজ খায় তাহলে তার কাছে সেটা স্লো পয়জন।”

বাবুদা থামল। সবাই চুপ। তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করল, “আমি কাল্টিভেসনে খবর নিয়ে দেখেছি যে মিঃ ঘোষাল গত দুই মাস দু সপ্তাহ ধরে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট থেকে সোডিয়াম সায়ানাইড নিচ্ছেন। আর সেটা দিয়ে নিজের ল্যাবে ডি গ্লুকোজকে কনভার্ট করছেন এল গ্লুকোজে। তারপর সেটা প্রেস করছেন ওনার এক্স আর ডি মেসিনের প্রেসে।”

“কিন্তু ডাঃ রায় চৌধুরীর ওষুধের কৌটোয় তো ডি গ্লুকোজই ছিল। আপনার কথায় সেটা আমি পরীক্ষা করে দেখেছি?” অবাক হয়ে বললেন ইন্সপেক্টার দাস।

“সেটাও মিঃ ঘোষাল পাল্টে দিয়েছিলেন। কিন্তু গণ্ডগোল হল প্ৰণববাবুর হাত থেকে একটা ওষুধ পড়ে খাটের তলায় ঢুকে যাওয়ায়। আমি সেটা বের করে টেস্ট করি। আর সেটা হল এল গ্লুকোজের ট্যাবলেট। আর অজান্তে দীননাথও ওনাকে কিছুটা সাহায্য করেন। দীননাথের ডান হাতটা অকেজো হওয়ার ফলে ওষুধের কৌটো দেবাঙ্গনবাবুই খুলে দিতেন। তারপর মনে পড়ে যে প্ৰণববাবু মারা যাওয়ার আগের দিন আমি যখন দেখি মিঃ ঘোষাল খোলা কৌটো এনে দিচ্ছেন দীননাথের হাতে। তখন পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। আরও প্রমাণ পাই ডাঃ সান্যালের কাছে থাকা প্ৰণববাবুর ব্লাড সাম্পেল থাকায়। সেটাকেও টেস্ট করে ওনার ব্লাডে এল গ্লুকোজের ট্রেস পাওয়া যায়। আর হ্যাঁ, ইন্সপেক্টার দাস, এই যাবতীয় টেস্ট রিপোর্ট আমি আপনাকে দিয়ে দেব। কোর্টে কাজে লাগবে। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে মিঃ ঘোষাল, ডাঃ রায় চৌধুরীকে মারার কী প্রয়োজন ছিল?”

ইন্সপেক্টার দাস আর ওনার তৃতীয় অনুচর দেবাঙ্গনবাবুর পাশে এসে দাঁড়ালেন। উনি ধীরে ধীরে উঠে বললেন, “এই পেপারে যেমন ওনার দশ বছরের পরিশ্রম ছিল, সেরকম আমারও ছিল। কিন্তু উনি আমার নাম বাদ দিয়ে দিলেন।”

“আর আপনি ভাবলেন যে উনি মারা গেলে পেপারটা আপনি কমপ্লিট করবেন মিঃ কেডিয়ার ল্যাবে। কিন্তু বাধ সাধল অনিমেষবাবু। উনি তার আগেই পেপারটা সিন্দুক থেকে সরিয়ে ফেলেন।”

ইস্পেক্টার দাস অনিমেষ রায় আর দেবাঙ্গন ঘোষালকে নিয়ে যাওয়ার পর বাবুদা বিপ্লববাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বললেন, “প্ৰণববাবু মারা যাওয়ার পর ওনার যাবতীয় সম্পত্তির সাথে এই পেপারের মালিকানাও আপনার। তাই সেটা নিয়ে আপনি কী করবেন সেটাও আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আপনার বাবা কিন্তু পেপারটা বিক্রি করতে চাননি। উনি কিন্তু চেয়েছিলেন যাতে এই আবিষ্কারের ফলে মানুষের উপকার হয়। দেখুন, আপনি কী করবেন।”

* * *

এই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর সকালে আনন্দবাজার পত্রিকা খুলে খবরটা চোখে পড়ল। তাড়াতাড়ি গিয়ে বাবুদাকে দেখাতে ও বলল, “আমি দেখেছি, তুই দেখ।”

ওখানে লেখা ছিল যে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডাঃ প্ৰণব রায় চৌধুরীর ছেলে বিপ্লব রায় চৌধুরী ওনার পিতার তৈরি জেনেটিক্সের উপর একটা অমূল্য পেপার ইউনেসকোর হাতে তুলে দিয়েছে। উনি বলেছেন যে এটাই নাকি ওনার পিতার শেষ ইচ্ছে ছিল।