ভিড় গিজগিজে রাস্তায় কোনওদিন হেঁটে দেখেছেন? হাঁটেননি তো? খবরদার চেষ্টাও করবেন না। এর কনুই এর গুঁতো, ওর জুতোর খোঁচা খেতে খেতে আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে। এই যেমনটা এখন আমার সাথে হচ্ছে, ভিড় ভারাক্রান্ত অক্সফোর্ড রোডে দুলকি চালে হাঁটতে গিয়ে বিরক্তির একশেষ হচ্ছি। অথচ করার কিছুই নেই, থর্নডিক আমার হাতটা বগলের মধ্যে চেপে ধরে আছে, যেন বাগদত্তা রমণীর হাত ধরে প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়েছে!
কোন এক রাশিয়ান গ্রাণ্ড ডিউকের বিদায়ী সভা, তাও এই উইকএণ্ডের দিনে। স্বাভাবিক ভাবেই চিত্রবিচিত্র কোট, গাউনের উচ্ছ্বাসে গিল্ড হল অবধি রাস্তা একেবারে ঢেকে গেছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এক রাজপুত্রও আসছেন আজ তাকে বিদায় জানাতে, ফলে সময় যত গড়াচ্ছে ভিড়টা ক্রমশ জনসমুদ্রের আকার নিচ্ছে।
ঘণ্টার মতো দুলতে দুলতে কোনওমতে “রথবন প্লেসের” অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গাটায় এসে একটু হাঁফিয়ে নেব ভাবছি, তার আগেই হাতে রামচিমটি কাটল থর্নডিক। চমকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তার দৃষ্টি সামনের এক ভদ্রলোকের দিকে নিবদ্ধ। ধোপধুরস্থ ফারকোট পরা সেই ভদ্রলোক অলস ভঙ্গীতে চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়ছেন,যেন এই তামাম দুনিয়ার ভিড় তাকে স্পর্শ করার সাধ্য রাখে না।
এগিয়ে যেতে যেতে সেই ভদ্রলোকের উদ্দেশে বলল থর্নডিক, “কী হে... ব্যাডার, এখানে কী ব্যাপার, কাউকে খুঁজছ নাকি?” তারপর আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, “ওই যে থামটার পাশে দাঁড়ানো হালকা ধূসর ওভারকোটের লোকটাকে দেখছ, ওটাই আমাদের পুলিশবন্ধুর লক্ষ্য বুঝলে।”
এই বেলা বলি, ব্যাডার আমাদের পুরানো বন্ধু, পুলিশের বেশ উপর মহলের লোক।
এক গাল হেসে আমাদের দিকে সরে এল ব্যাডার, “হেঃ হেঃ, সেটাই তো বুঝতে চাইছি স্যার। আধঘন্টা ধরে ওই যে ওই লোকটা, ওকেই মাপছি। ব্যাটার হাবভাব সন্দেহজনক, মুখটাও বুঝলেন কিনা বেশ চেনা।” তারপর চোখ সরু করে বলল, “মাঝে মাঝে আবার দেখছেন ফোলা বুক পকেটটা কেমন হাতড়াচ্ছে। তাই বুঝলেন কিনা রিস্ক নিতে চাইছি না। অন্তত ডিউক না যাওয়া অবধি তো নয়ই।”
তারপর বিড় বিড় করে ম্লানস্বরে বলল, “তবু তো এই রাশিয়ানরা যদি দুঃখটা একটু বুঝতো, তা নয় খালি পায়ে পা বাধিয়ে ঝামেলা বাঁধায়।”
—“সেটাই, কিন্তু তুমি কি কিছু...”
—“ঠিক ধরেছেন স্যার, থর্নডিককে থামিয়ে বলে উঠল ব্যাডার, খবর সেরকমই আছে অবশ্য, আমি পুরো রাস্তাটাকেই সাদা পোশাকের পুলিশ দিয়ে ঘিরে দিয়েছি।”
—“মানে যদি কিছু অসুবিধা না থাকে..."
—“অসুবিধা কীসের স্যার, আপনি তো হলেন গিয়ে যাকে বলে আমাদের লোক। তারপরে ফিসফিস করে বলল – “বেশ কিছু বদমায়েশ প্রকৃতির লোক ডিউকের পেছন পেছন ইংল্যান্ডে এসে জুটেছে। ছদ্মবেশ ধরে মূল জনস্রোতে মিশেও আছে অনেকে। ফলে বুঝতেই পারছেন...”
এইসব কথার ফাঁকে আচমকাই সন্দেহভাজন ভদ্রলোক পাশ ঘুরলেন আর ঘুরেই চোখাচোখি হল ইন্সপেক্টরের সাথে, রীতিমতো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন যেন। তক্ষুনি লাফ দিলেন ভিড়ের মধ্যে। আচমকা এই তাড়াহুড়ায় হুলুস্থুলু পড়ে গেল। ভদ্রলোক সামনের এক ষণ্ডামার্কা ব্যক্তির সাথে খেলেন সজোরে ধাক্কা, টাল রাখতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন রাস্তায়।
সামনেই একজন মাউন্ট পুলিশ ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিৎকার, চেঁচামেচি হইহল্লাতে ঘোড়াটা বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে গা ঝাঁকানি দিল আর তাতেই পিছনের পা-খানা সজোরে এসে পড়ল পড়ে যাওয়া ভদ্রলোকের পিঠে। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলুম না।
ইন্সপেক্টর একজন কনস্টেবলকে হাত নেড়ে রাস্তা ফাঁকা করতে বলেই ছুট লাগালেন ভদ্রলোকের দিকে। আমরাও পিছু পিছু ছুটলাম, ততক্ষণে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছেন, থর থর করে কাঁপছে তার গোটা শরীর।
থর্নডিক উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি ঠিক আছেন তো?”
ভদ্রলোকে হাঁটুগেড়ে বসলেন, কোনওমতে ঘড়ঘড়ে স্বরে বলতে পারলেন –“আমি,আমি কেমন যেন... দমবন্ধ...,” তারপর বুকের ওপর কাঁপা কাঁপা ডান হাতটা রেখে এলিয়ে পড়লেন। থর্নডিক ভ্রূ কুঁচকে ভদ্রলোককে একবার দেখে নিয়েই ইন্সপেক্টরকে বলল,“ব্যাপারটা ভাল বুঝছি না। দ্রুত একটা অ্যাম্বুলেন্স বা গাড়ির ব্যবস্থা কর।”
ভাগ্য ভালো ঠিক সেই সময় পাশের গলি দিয়ে একখানা ক্যাব আসছিল। ভদ্রলোককে তাড়াতাড়ি তাতে ঢুকিয়ে আমি, ইন্সপেক্টর আর থর্নডিকও চড়ে বসলাম।
ভিড় রাস্তা ঠেলে এগোনো দুস্কর, এদিকে ভদ্রলোকের মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়ে আসছিল। বুকের ওঠাপড়াও যেন মৃদু হয়ে আসছিল ক্রমশ। বারে বারে তার দাঁত কপাটি লাগছিল। আমাদের সবার মনে তখন একটাই চিন্তা হাসপাতাল অবধি নিয়ে যেতে পারব তো?
গাড়িটা মূল রাস্তাতে পড়তেই, তিনি একবার হেঁচকি দিয়ে উঠে, স্থির হয়ে গেলেন। খোলা চোখের দৃষ্টিহীন তারা আর শরীরের ছেড়ে দেওয়া অবস্থা বুঝিয়ে দিচ্ছিল আমাদের আশঙ্কাটাই সত্যি হয়েছে।
প্রথম কথা বললেন ইন্সপেক্টর, “ভদ্রলোক..."
আমরা নীরবে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। মিনিট পাঁচেকে গাড়ি মিডলসেক্স হাসপাতাল চত্বরে প্রবেশ করল। একটা সাড় এল যেন আমাদের মধ্যে, ঝটপট নেমে ট্রলিতে বডিটা তুলে দিলাম। আড়চখে তাকিয়ে দেখি, থর্নডিকের মুখে স্বভাবসুলভ চাঞ্চল্য আবার ফিরে এসেছে।
ক্যাজুয়ালিটি রুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বেশ দৃঢ়ভাবেই বলল থর্নডিক –”আমাদের আগে ভদ্রলোকের অবস্থা জানা দরকার।” তার মন এখন আইনের কাটাছেড়ার বাইরে মৃত্যুরহস্যের ওপরে গিয়ে পড়েছে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
হাউস সার্জেন ভদ্রলোক মৃতদেহের অপর ঝুঁকে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন, আমাদের দেখে নিয়ে তারপর দুর্ঘটনার কথা শুনে বললেন, “হুম,ইন্টারনাল হেমারেজই তো মনে হচ্ছে, সাধারণত এইসব কেসে তাই-ই হয়ে থাকে।
তারপর জিভে টাসকি মেরে বেশ রহস্য করে বললেন, “ব্যাডার সাহেব,থর্নডিক সাহেব দুজনেই আছেন দেখছি। আপনাদের উপস্থিতি, এই মৃতদেহ কেসটা কী?”
—“ভিতরে আসব?’’
পিছনে তাকিয়ে দেখি, একজন পুলিশ সার্জেন্ট ঘরে ঢুকেই পড়েছেন প্রায়। একবার উপস্থিত জনতার দিকে তাকিয়ে নিয়েই (বোধহয় ব্যাডারের মৌন সম্মতি নিয়ে) চটপট মৃতদেহের পকেটে আগে হাত ঢোকালেন। হবে নাই বা কেন, ঢাউস পকেটখানাই যে আগে নজর টানছিল।
যেটা বেরোল সেটা একটা ব্রাউন পেপারের মোড়ক, টেপ দিয়ে বেশ যত্ন করে আঁটা।
“এতো একটা পর্কপাই! আহা রে, খাওয়াই হল না বেচারার।” একখানা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সার্জেনের গলা দিয়ে।
“আপনি বরং অন্য পকেটগুলো দেখুন একটু…”খোদ থর্নডিকের থেকে আদেশ পেয়ে অভিভূত হয়ে একটা তৈলাক্ত সম্ভ্রম ছুঁড়ে দিয়ে সার্জেন্ট ভদ্রলোক অন্য পকেটটায় হাত দিলেন। লাভের মধ্যে একখানা মুখবন্ধ চিঠি পাওয়া গেল, উপরে জঘন্য হাতে লেখা,
To,
Mr. Adolf Schonberg,
2/3 Greek Street, Soho.
মনে হচ্ছে হাতে হাতেই ডেলিভারি করত। স্ট্যাম্প নেই তো। থর্নডিকের সামনে ব্যপারখানা ধরতে পেরে বেশ খুশি খুশি মুখ করে বললেন ইন্সপেক্টর।
“আমার মনে হয়, আমাদের ওখানেই যাওয়া উচিৎ; সার্জেন্ট এস। আপনারাও এবার আসুন নাকি।” বলেই টুক করে চিঠিটা পকেটে ফেলে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন আমাদের বন্ধু ইন্সপেক্টর, পাছে আমরা পিছু নিই। সার্জেন্ট বেচারা বাকি জিনিস পকেটে ভরতে ভরতে অনুসরণ করল।
ব্যাডারের এহেন অভব্য আচরণে আমার মেজাজ খিঁচড়ে গেছিল, তবুও থর্নডিকের জন্য পিছন পিছন আসতে হচ্ছিল। এদিকে থর্নডিকও মুখে কুলুপ এটে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিল।
বার্নার স্ট্রীটের মুখটায় এসে ব্যাডার একবার ইতস্তত করে বলল, “আমরা তাহলে এবার ডানদিক নেব...”
কিছু মাত্র না ঘাবড়ে থর্নডিক বলল, “আমরা তো একসাথেই যাচ্ছি। এই তো একটুখানি পথ, তাছাড়া একযাত্রায় পৃথক ফল করে লাভ কী?”
২/৩ নং গ্রীক স্ট্রীটের বাড়িখানা দেখলে এক ঝলকে পুরানো কোন চার্চের অংশ বলেই মনে হয়, রেনোভেট করে একটা অ্যাপার্টমেন্টের আকার দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো ঘর তিনটা তলা মিলিয়ে। মূল দরজার ফ্রেমের দু’পাশ থেকে পেতলের ঘন্টা ঝুলিয়ে বেশ একটা চমৎকার ভাব আনা হয়েছে। প্রত্যেক ঘন্টার পাশে ঘরের নম্বর দেখে বুঝলাম এগুলো আবার কলিংবেলের কাজও দেয়।
আমরা এদিক ওদিক দেখছিলাম, তার মধ্যেই সার্জেন্ট ব্যাটা ওস্তাদী মেরে দিলে ডানহাতের মাঝের নবটা টেনে। চোখের পলকে একতলার জানলাখানা খুলে একখানা মাথা স্যাৎ করে সরে গেল। আমরা কিছু ভাবনা চিন্তা করার আগেই,আবারও চমকে দিয়ে রাস্তার দিকে দরজাটা খুলে, একটি লালচুলো লোককে বেরোতে দেখা গেল। পাছে আবার দরজা বন্ধ করে দেয় তাই তড়িঘড়ি ইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন,“স্কনবার্গ, অ্যডলফ স্কনবার্গ থাকেন নাকি এখানে?”
“স্কনবার্গ—স্কনবার্গ…” নতুন ভদ্রলোক ভ্রূ কুঁচকে নামটা মুখের ভেতর জাবর কাটতে লাগলেন। এইবার ভালো করে দেখলাম ভদ্রলোককে। লালচুলো সাধারণ ইহুদী চেহারা। বিশেষত্বের মধ্যে কুতকুতে চোখের ওপর একজোড়া গোল সোনালী ফ্রেমের চশমা।
“হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ওই ছেলেটি, ওই তো তিনতলায় থাকে। একটু আগেই দেখলাম তো।” আঙুল দিয়ে একটা খোলা দরজার দিকে দেখালেন।
“আমাদের তাহলে উপরে গিয়েই দেখা উচিৎ নাকি,” বলেই দ্রুত সিড়ি ভাঙা শুরু করলেন ইন্সপেক্টর। অগত্যা আমরাও পিছু নিলাম।
খোলা দরজার ভিতর দিয়ে একটা বেডরুম নজরে পড়ছিল। ইন্সপেক্টর দুম করে ঢুকে পড়লেন, অবশ্য তিনি আইনের রক্ষক, সবই পারেন।
কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরের আরেকটা দরজা খুলে এক ষণ্ডামার্কা লোক মুঠি পাকিয়ে বেরিয়ে এলেন। বঙ্কিম ভ্রূ জোড়ায় বিরক্তি আর ক্রোধ মাখিয়ে গমগমে স্বরে প্রশ্ন করলেন,“কী ব্যাপার?”
ইন্সপেক্টর মিনমিন করে বললেন, “মিঃ অ্যডলফ স্কনবার্গ? কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে।”
এবারে আরও বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, “কী-ই-ই স্কনবার্গ? তো এখানে কেন? এটা তার ঘর নয়। নীচে একতলার প্রথম দরজায় কড়া নাড়ুন গিয়ে, যত্তসব!”
ভদ্রলোক দরজাটা বন্ধ করে দেবেন বুঝে থর্নডিক মোলায়েম স্বরে গ্যাটিস দিল, “মাফ করবেন স্যার যদি একটু বলে দেন মিঃ অ্যডলফ স্কনবার্গ দেখতে কেমন? তাতে করে আরকী...”
“দেখতে... একেবারে প্রস্ফুটিত পদ্মের মত ছ্যাতরানো মুখ, তার ওপর ভুট্টার রোঁয়ার মতো পাটকিলে চুল-দাড়ি আর বোতলের তলার মত গোল গোল কাচওয়ালা চশমা। এই হল স্কনবার্গ। এবারে আমাকে ক্ষমা দেন।” বলেই ধড়াম করে মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন ভদ্রলোক। ওপাশ থেকে চাবি ঘোরানোর কড়কড়ে আওয়াজও পেলাম।
আমরা হতভম্বের মতো নীচে নেমে এলুম। ভদ্রলোক যে স্কনবার্গের ওপর বিরক্ত তা বেশ বুঝলাম, আমাদের ওপর তো বটেই। আড়চোখে দেখলুম থর্নডিকের মুখে আষাঢ়ে মেঘ জমেছে।
সার্জেন্ট এক ছোকরাকে দেখতে পেয়েই জেরা করা শুরু করে দিল। সে ছোকরাও দেখি বিষম ধূর্ত। নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে পেন্সিল কাটতে কাটতে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। বগলে নোটবুক দেখে বুঝলাম প্রেস রিপোর্টার, ঠিক গন্ধ শুঁকে চলে এসেছে। ছোকরা নাকি ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামার সময়, সেই ভদ্রলোককে স্কোয়ারের দিকে যেতে দেখেছে।
এসব দেখে ইন্সপেক্টর যেন নিজের বল ফিরে পেয়েছেন, বেশ গম্ভীর স্বরে শুধোলেন, “সে কি তাড়াহুড়ো করছিল?”
“তাড়াহুড়ো মানে, আপনারা ভিতরে ঢুকতেই একেবারে তিরের বেগে ছুট লাগালো। এতক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে, আপনারা ধরতে পারলে হয়...”
তার দিকে হাসি হাসি মুখ করে থর্নডিক বলল, “আহা, কে বললে ধরতে চাইছি, মিস্টার...”
—“জেমস অল্টারোয়ার্থ, নিউ টাইমসের সাংবাদিক।”
—“ওহ, খুব ভালো লাগলো পরিচিত হয়ে।” তারপর ইনস্পেক্টরের কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “ওটাই স্কনবার্গ সে বিষয়ে আশা করি কারোর সন্দেহ নেই এবং আপাতত সে পালিয়েছে অতএব এর পিছনে যথেষ্ট রহস্য আছে, তারপর এই সাংবাদিক ছোকরাও জুটে গেছে। সুতরাং চিঠিটা খুলে ফেলাই সঙ্গত।”
ইন্সপেক্টর যেন মনে মনে এরকমই একটা কিছুর অপেক্ষাতে ছিল, বলামাত্র নিখুঁতভাবে মুখটা কেটে চিঠি বের করে আনলো। তারপরেই
“কী এটা! শর্টহ্যান্ড! বিদেশী ভাষা! কী জিনিষ!”
“দেখি দেখি” ইন্সপেক্টরের অভিব্যক্তি দেখে থর্নডিক তড়িঘড়ি তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে আলোর সামনে মেলে ধরে থাকলো কিছুক্ষণ। তার কোঁচকানো চোখ নরম হয়ে এল, থেমে থেমে বলল, "হাফশীট সাইজের পাতলা কাগজে লেখা। কালচে খয়েরি রঙের কালি। টানা লেখা কোন ছাড়, ফুলস্টপ ছাড়াই। আপাতদৃষ্টিতে বিদঘুটে কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং চেহারা...সম্ভবত কোন প্রাচীন লিপি কিম্বা পুঁথির হরফ।”
“মানে, কী করে বুঝছেন ডক্টর?” ইন্সপেক্টরের উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এল।
“আঃ, ওটা বড় ব্যাপার নয়। ভাল করে দেখুন; এই হরফগুলো নিশ্চিতভাবে সংকেত তবে ফিনিশিয় ভাষা মানে আদি সোমাটিক ভাষার সাথে মিল আছে। একইরকম ডান থেকে বামে পড়তে হয়। সম্ভবত বর্তমান হিব্রুর আদি রূপ কারণ গ্রীক হরফ বা শব্দ তো একটাও দেখলাম না। তবে তার সাথে মিল আছে এমন কিছু হিব্রু শব্দ পেয়েছি এই যেমন এইখানটা “বাদিম” অর্থাৎ মিথ্যা। আপনি বরং কোন এক্সপার্টকে এটা দেখান, সেটাই ভাল।”
“হুম, যদি হিব্রু হয় তাহলে অবশ্য একটা ব্যবস্থা হতে পারে,” ব্যাডার বললেন।
—“আপনি বরং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যান। ওখানকার ফিনিশিয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের বর্তমান প্রধান আমার চেনা। তাকেই বরং..."
—“সেটা আমরা দেখে নেব” বলে টুক করে থর্নডিকের হাত থেকে চিঠিখানা থুড়ি কাগজখানা নিয়ে নিজের নোটবুকে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর মিচকে হাসি দিয়ে “ধন্যবাদ” সেরে ফেলল। এরপর রাস্তা মাপা ছাড়া আর কোন কথা চলে না। জেমস ছোকরাও যে ধন্যবাদের আওতায় পড়ে তা বেশ বুঝলাম কারণ সে ততক্ষণে হাঁটা লাগিয়েছে উল্টোদিকে।
আমরা বাড়ির পথ ধরলাম, থর্নডিকের মুখেও দেখি মেঘ কেটে গেছে, শিস দিচ্ছিল, থামিয়ে বলল, “এই জেমসকে ধরতে হবে বুঝলে। হাসপাতাল থেকে আমাদের পিছু নিয়েছে, এই ব্যাটা সাংবাদিকরা বিশদে খবর না নিয়ে এতদূর আসে না।”
“আচ্ছা ওই চিঠিটা কি...”
—“হুম ও দেখেছে। অন্তত একঝলক তো বটেই। ব্যাডারের হাতের ফাঁক দিয়েই দেখেছে।”
পাছে আবার গম্ভীর হয়ে যায় তাই তাড়াতাড়ি বললাম, "তোমার মতে কী বলে?”
—“এটা বুঝলে কোন লিপি? আদি সেমেটিকে লেখা, আর সেজন্যই আদি গ্রীক হরফের সাথে এতটা মিল।”
—“আর ডানদিক থেকে বামদিক?”
—“হুম সব কটাই। ফিনিশিয়, হিব্রু, আদি মোয়াবাইট বল বা আদি গ্রীক(এখনকার নয় ) বল সবার ওই একই ট্রেন্ড। পাতাটাও খুব সাধারণ লেইড পেপার, কালিটাও সাধারণ বড়ির কালি। চায়নীজ কালি সম্ভবত, ওদের ড্রাফটম্যানরাই এগুলো ব্যবহার করে।”
—“আচ্ছা!”
—“আর আচ্ছা নয় বন্ধু আমার, এই টুকুই। হাতে নিয়ে যতটুকু দেখেছি, তাতে এই টুকুই।”
—“বুঝলাম কিন্তু থর্নডিক এটাতো সাধারণ হিব্রু টেক্সট হতে পারে, তোমার সাংকেতিক লিপিই বা মনে হচ্ছে কেন?”
—“কারণ আছে জারভিস, কারণ আছে। দেখো আজকাল সব শিক্ষিত ইহুদিরাই হিব্রু কমবেশি লিখতে পড়তে জানে। তাদের যে কারুর হাতে পড়লেই এর খেল খতম, তাহলে...”
—“তাহলে কি?”
—“তাহলে বন্ধু আমার, বাই এনি চান্স অন্যকারোর হাতে পড়ে গেলে সে এটার পাঠোদ্ধার করে ফেলবে আর তাতে জগাখিচুড়ি মার্কা অর্থহীন কিছু বাক্যসমষ্টি পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।”
—“তুমি তাহলে...”
—“হুম আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ ওই সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে বুঝলে। ব্যস, আর কিচ্ছু না। তোমায় আমি এতগুলো তথ্য দিলুম, এবার এগুলোই নাড়াঘাটা করো গে। দয়া করে আমার মাথাটি আর খেও না, বলে তুম্বো মুখে আবার শিস দিতে শুরু করে দিলো।”
জানি এখন আর মাথা কুটে মরলেও থর্নডিকের মুখ থেকে টুঁ শব্দটিও বেরোবে না।
সকালে কাগজটা খুলেই দেখি, জেমস ছোকরার পাতা জোড়া প্রতিবেদন,
“অজ্ঞাত পরিচয় সন্ত্রাসবাদীর মৃতদেহ, হাতে লেখা সাংকেতিক লিপি উদ্ধার ইত্যাদি ইত্যাদি...”
থর্নডিক ঠিকই বলেছিল এই পত্রকাররা বেশ গুছিয়ে খোঁজখবর নিয়েই পথে নামে। তবে প্রতিবেদনের শেষ লাইনটা বেশ তৃপ্তি দিল আমায়, “পুলিশ এই কাজে বিখ্যাত ডিটেকটিভ ও সাংকেতিক লিপির পাঠোদ্ধারে বিশেষ পারদর্শী ডঃ জন থর্নডিকের সাহায্য প্রার্থনা করেছে কাজেই আশা করা যায় অচিরেই রহস্যের সমাধান হবে।”
এমন সময় থর্নডিক ঘরে প্রবেশ করল। আমি তাকে পুরো প্রতিবেদনটা শোনাতে যাচ্ছিলাম, পাত্তা না দিয়ে, মুখের ওপর একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল, “লন্ডন ব্রিজের সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের সাথে দেখা হল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ‘লিপি’-খানা নিয়ে হুলুস্থুলু পড়ে গেছে হে।”
—“স্বাভাবিক।”
—“ব্রিটিশ মিউজিয়ামে নিয়ে গেছিল কাগজটাকে, মিউজিয়াম আবার প্রাচীন লিপি বিশারদ প্রফেসর পপেলবামকে দেখিয়ে দিয়েছে।”
—“তাহলে তোমার কথাই রইল।”
—“স্বাভাবিক।” আমাকে ব্যঙ্গ করে বলে উঠল। তারপর গলা ঝেড়ে বলল, “প্রফেসর পপেলবামও একই কথা বললেন, মানে সেই কয়েকটা মাত্র হিব্রু আর তার সাথে মেশানো কিছু অর্থহীন অক্ষরমালা। একটা আক্ষরিক অনুবাদ করে দিয়েছেন অবশ্য। সেগুলো এখন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড় বড় ডেস্ক গুলোয় পোস্টমর্টেম হচ্ছে।”
একটা নীরব হাসি দিয়ে থর্নডিক বলল, “শব্দবন্ধ থুড়ি শব্দভাবনা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা লেগে গেছে এতক্ষণে। আমাকেও সুপার সাহেব একটা করে ফটোকপি (দুটোরই) গছিয়ে দিলেন।”
“তাহলে তুমি ও…”
এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, “তুমি আমায় এদ্দিনে এই চিনলে জারভিস?” তারপর হাসি থামিয়ে বলল আমি থাকব নীরব দর্শক হয়ে; কৌতূহলী নীরব দর্শক। আর আমার খাড়া করা যুক্তি ঠিক সময়ে আমি পরখ করে নেব।
তবে তুমি যদি এই খেলায় যোগ দিতে চাও, এই নাও সেই কাগজ।” আমি পড়তে শুরু করলাম, আড়চোখে দেখলাম একখানা আমুদে হাসি ঝুলে আছে তার ঠোঁটে।
—“কী এটা, সত্যিই তো মাথামুণ্ডুহীন।”
“হুম” প্রফেসরের মতেও এই শব্দ আর অক্ষরগুলি খাপছাড়া, মানে কোথাও একটা ফাঁক আছে সেই খাপে অক্ষর বসালেই খাপে খাপ।”
—“অ্যাঁ!"
—“হাঃ হাঃ, শোনো ওসব বাদ দাও। ভালো করে দেখ, এটার মধ্যে আহামরি কিছু নেই বন্ধু আমার; শব্দগুলো শুধুমুদু বসানো হতে পারে, বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, কেবলমাত্র অক্ষরগুলোই জীবিত। তারাই অর্থবহ, অথবা সম্পূর্ণ অন্য কিছু।”
বিকালবেলা দুজনে সোফায় বসে চা পান করছিলুম এমন সময় দরজায় একটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম। বিড়বিড় করে থর্ন্ডিক বলল, “মরিস, ৮৯৭ মডেল, নতুন গাড়ি।”
—“ঠিক তাই, জানালা দিয়ে আমাদের চেম্বারের নীচে যেটা থামল সেটা মরিসই বটে। পরমুহূর্তেই একজোড়া দ্রুত পায়ের শব্দ আর টোকার আওয়াজ পেলাম দরজায়।”
খুলেই মুখোমুখি হলাম এক সুবেশ ভদ্রলোকের। আমাকে একঝলক দেখে নিয়ে আমার কাঁধের ওপর থেকে ঘরের ভিতর উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন। তারপর বেশ উৎফুল্ল স্বরেই বলে উঠলেন – “বাঁচলাম, আপনারা দুজনেই ঘরে আছেন। আমার আপনাদের দুজনকেই দরকার, আমার নাম..."
এবারে থর্নডিক বলল, “আপনি ভিতরে এসে বসুন, দরকারি কথা ভিতরে বসেই বলা উচিৎ।”
—“হ্যাঁ যেটা বলছিলাম আমি বার্টন। আপনারা আমায় চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাদের কথা অনেক শুনেছি, অনেক পড়েছি।” তারপরেই গলার স্বর বদলে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, "আমার ভাইটাকে বাঁচান আপনারা। স্যার, অন্তত একবার আমার বাড়িতে আসুন, আমার ভাইটাকে দেখে যান স্যার।”
থর্নডিক স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য নিয়েই বলল, “মশাই সেটা নির্ভর করছে ঘটনার ওপর, কী ঘটেছে তার ওপর। আপনি প্লিজ শান্ত হয়ে বসে ঘটনাটা বলুন।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একগ্লাস জলের ইঙ্গিত দিল।
চেয়ারে বসে এক নিঃশ্বাসে জলের গ্লাসটা শেষ করে মিঃ বার্টন বলতে শুরু করলেন, “ঘটনার সূত্রপাত আমার ভাইয়ের বিয়ের থেকে। মানে এটা ভাইয়ের দ্বিতীয় বিয়ে। ভাই এর এখন ৫৫, ভ্রাতৃবধূর বয়স অনেকটাই কম, ২৬ এর কাছাকাছি, কিন্তু বিয়েটা ঠিকঠাক। মানে তাদের প্রেম বিবাহ। তো যাই হোক, বিয়ের পর সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল।
“গোল বাঁধল দুই সপ্তাহ পর। একদিন সকালে হঠাৎ করেই ভাই এর পেটের যন্ত্রণা শুরু হল। সে যন্ত্রণার তীব্রতা এমনই যে ভাই অজ্ঞান হয়ে গেল। ডাক্তার এলেন কিন্তু কিছুই রোগ ধরতে পারলেন না। তারপর আজ অবধি বহু ডাক্তার বদ্যি করলাম, কিন্তু হায়!" তার দীর্ঘশ্বাস বলে দিচ্ছিল যে শেষের আর খুব বেশি বাকি নেই।
থমথমে পরিবেশটাকে নাড়িয়ে থর্নডিক বলল, “ব্যাথাটা কি শুধু খাওয়ার পরেই উঠছে?”
—“হ্যাঁ তাই-ই, আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন, মানে আমিও সেটাই সন্দেহ করছি। বহুবার চেষ্টা করেছি জানেন খাবার স্যাম্পল জোগাড় করার...”
“পারেননি?” তুম্বো মুখে বলল থর্নডিক।
“না পেরেছি, আজ সকালে অবশেষে,” বলে কাগজের মোড়ক থেকে একটি চওড়া কন্টেনার বার করে টেবিলে রাখলেন। "সকালে দেখি ভাই এরারুট খাচ্ছিল, ব্যাজার মুখে জিজ্ঞাসা করতে বলে ধুস, এই বালি কাঁকরের গুঁড়ো আবার খায় নাকি। আসলে ভাই আমার খেতে ভালবাসত খুব।” উদাস মুখে বলল বার্টন।
তো যাইহোক, আমার ভ্রাতৃবধূ তখন আশেপাশে ছিল না। সেই সুযোগে আমি খানিকটা এরারুট স্যাম্পল তুলে এনেছি। এখন আপনি দয়া করে পরীক্ষা করে দেখুন না কী আছে এতে।” বলে বোতলটা থর্নডিকের দিকে ঠেলে দিলেন।
থর্নডিক একখানা কাচদন্ডের আগায় খানিকটা স্যাম্পল তুলে প্রথমে লেন্সের সামনে নেড়েচেড়ে দেখল তারপর খানিক শুঁকে দেখল। অবশেষে একখানা স্লাইডে ফেলে মাইক্রোস্কোপের তলায় নিয়ে গেল।
সেখান থেকে মুখ না তুলেই বলল—“কিছু কিছু দানা দানা জিনিষ আছে, সম্ভবত আর্সেনিক জাতীয় কোন ক্রিষ্টাল।”
“হায়! শেষমেশ আমার আশঙ্কাটাই, আরেকবার খুঁটিয়ে দেখুন না মিষ্টার থর্নডিক।” প্রায় কঁকিয়ে উঠলেন বার্টন।
“না এখনো আমি নিশ্চিত নই। তবে করে দিচ্ছি,” বলে টুং করে ল্যাবরেটরির ঘন্টাটা বাজাল। ল্যাবরেটরি থেকে অ্যসিস্ট্যান্ট ছোকরা মুখ বাড়াতেই থর্নডিক বলল, “পল্টন, একটা মাশ এপারেটস রেডি করো তো।” ছোকরা ততটাই দ্রুত উত্তর দিল, “দুটো রেডি করা আছে স্যার।”
—“বাহ, তাহলে একটাতে অ্যাসিড ঢেলে, একটা পোর্সেলিন টালি দিয়ে নিয়ে এস।” পল্টন ছোকরা ভিতরে যেতেই, থর্নডিক গম্ভীর ভাবে বলল, “মিঃ বার্টন, ধরুন যদি আর্সেনিকই মেশানো হয়ে থাকে খাবারে, তাহলে আপনি আমাদের কী করতে বলেন?”
“আপনারা আমার ভাইকে দেখতে আসবেন, তাকে বাঁচান ডক্টর।” প্রায় কেঁদেই ফেলল বার্টন।”
“এতো ডাক্তারের কাজ মশাই, আপনি আমার থেকে নোট নিয়ে ডাক্তারবাবুকে দেখান।”
“না না, কেউ পারবে না। আপনারাই একমাত্র পারবেন এই সর্বনাশের থেকে আমার ভাইকে বাঁচাতে। প্লিজ ডক্টর, না করবেন না, ভাইটা আমার মরে যাবে। এর থেকে ওকে বাঁচান প্লিজ।” একেবারে ভেঙে পড়লেন ভদ্রলোক।
“আহা, ঠিক আছে ঠিক আছে। আগে রিপোর্টটা তো দেখ যাক।”
এই সময় পল্টন ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল, প্রথমে রাখল ক্যালশিয়াম পারক্লোরাইডের লেবেল মারা একটি ফ্লাস্ক। ভিতরের তরল টগবগ করে ফুটছে, যেন জীবন্ত! হাত থেকে পোর্সেলিন টালিটা নামিয়ে রেখে পল্টন কাজ শুরু করল।
ফ্লাস্কের মুখে একটা কাপ লাগানো ছিল। এখন সেটা দিয়ে একখানা সরু কাচদণ্ড প্রবেশ করিয়ে কাচদণ্ডের মুখে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ধরতে হাল্কা বেগুনী রঙের একটা শিখা জ্বলে উঠল।
এবার থর্নডিক উঠে টালিটা হাতে নিল, তারপর ওই শিখার ওপর কিছুক্ষণ ধরে রইল। সাদা টালিতে ধীরে ধীরে বেগুনী একখানা বাষ্প বলয় ফুটে উঠল।
পল্টন এতক্ষণ ডিসটিলড ওয়াটারের বিকারে খানিকটা এরারুট ঢেলে নাড়ছিল। এখন দেখলাম পুরো এরারুটটাই দ্রবীভূত হয়ে গেছে।
এবার এই মিশ্র তরলের খানিকটা ওই কাপ দিয়ে ঢেলে দিল থর্নডিক। ঘন তরল ধীরে গড়িয়ে নামল নীচে। মূল তরলের মানে ওই ক্যালশিয়াম হাইপোক্লোরাইডের সাথে মিশতেই দেখি কাচদণ্ডের ওপরের শিখার রঙ মুহূর্তে হালকা নীলে পরিণত হয়ে গেল। নীল শিখার উপর সাদাটে ধোঁয়ার আস্তরণ দেখেই, থর্নডিক চটপট টালিটা তার ওপর ধরল। চকচকে কালো দাগ ফুটে উঠল ঝকঝকে সাদা টালির গায়ে।
“কী হল?” উদ্বেগ নিয়ে মিঃ বার্টন বলে উঠল।
"হুম, হয়েছে। তবে আর এক সেকেন্ড নেব।” এবার রিএজেন্টের বোতল থেকে কয়েকফোঁটা হাইপোক্লোরাইড টালির কালো দাগের ওপর দিতেই দেখি দাগ উধাও।
আমাদের দিকে মুখ তুলে নাক দিয়ে ফোঁৎ ফোঁৎ করে পরিচিত আওয়াজ ছেড়ে বলল—“হুম, আর্সেনিক আছে বেশ ভাল পরিমাণেই।”
“তাহলে?” উত্তেজনায় চেয়ার থেকে উঠে পড়েছিল বার্টন। আবার অনুনয় বিনয়ের পালা শুরু হবে বুঝে থর্নডিক বলল, একটু দেখে নিতে দিন আমাদের হাতে কী কী কাজ আছে। বুঝতেই পারছেন...” বলে কটমট করে তাকাল আমার দিকে, তারপর অফিসের ভিতরে ঢুকে গেল।
আমিও থতমত খেয়ে, "একটু বসুন, আসছি,” বলে অফিসের দিকে হাঁটা দিলাম।
“আরে ব্যাপার কী? আমদের হাতে তো কোন কাজ...” শসস; অফিসের দরজাটা বন্ধ করতে করতে থর্নডিক বলল,“জারভিস! মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি বুদ্ধিশুদ্ধি ট্যাঁকে গুঁজে রাখ। থাকগে যাক, এখন কী করবে সেটা বলো তো।”
“মানেটা কী! তুমি কি বার্টনকেও সন্দেহ করছ?”
—“না তা নয়, যথেষ্ট আর্সেনিক আছে এরারুটে। কিন্তু শুধুমুদু কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো, এছাড়া এতে রিস্কও আছে।”
—“তা বলে আমরা যাব না?” একটু খচেমচে বলে উঠলুম। "সে রিস্ক যাই থাক, আমাদের যাওয়াই উচিৎ।”
“বেশ।” মুচকি হেসে বলল থর্নডিক, "আমরা দুজনেই যাব তবে, যা হবে দেখা যাবে।”
আবার বসার ঘরে ঢুকলাম দুজনে, বার্টনকে বলামাত্র সে যে যারপরনাই খুশি হয়ে বারে বারে হাত ঝাঁকাতে লাগল।
"ভাই থাকে রেক্সফোর্ডে, এসেক্সের বাইরে একটু গ্রাম্য এলাকাটা তবে লিভারপুল স্ট্রীট থেকে ৭১৫ নং ট্রেন ধরলে দেড় ঘন্টায় পোঁছে যাওয়া যায়। এখন গেলে আজই ফিরে আসা সম্ভব।
“বেশ তাহলে ২ মিনিট দিন,” বলেই থর্নডিক ট্রে শুদ্ধ এপারেটাসগুলো ভিতরে রেখে ওভারকোট, টুপি পরে বেরিয়ে এল।
ভদ্রলোকের গাড়িটা নিচেই দাঁড়িয়েছিল, আমরা যেতেই ছেড়ে দিল। হেঁটে দৌড়ে যখন ট্রেনে উঠলাম, ট্রেন ছাড়তে মিনিট কয় বাকি। আমাদের নিঃশ্বাস আর ট্রেনের হুইসেল একসাথে পড়ল।
ট্রেন ছাড়তে দেখি আমাদের ক্লায়েন্ট দিব্যি ফুরফুরে হয়ে গেছে। বাস্কেট থেকে কাটলেট বের করে আমাদের পরিবেশন করে, নিজেও নিলেন। যে ঠান্ডা কাটলেট খেতে আমাদের গলা বুজে আসছিল, তাই কিনা ভদ্রলোক এমনভাবে চেটেপুটে খাচ্ছিলেন যেন অমৃতের স্বাদ নিচ্ছেন। মনে মনে বললুম, শুধু ভাই নয়, এ মক্কেলও খাওয়ায় কম যায় না।
এদিকে যত সময় গড়ায় ভদ্রলোক দেখি তত অস্থির হয়ে পড়ে, ঘনঘন ঘড়ি দেখে।
থর্নডিক এতক্ষণ ফুরফরে মেজাজে শিস দিচ্ছিল, এখন বললে, “দু পাঁচ মিনিটের হেরফের বড় কথা নয়, আপনি একটু স্থির হয়ে বসুন।”
“তা নয়, তবে এই যে এসে পড়েছি।”
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিয়েই, চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ মারল বার্টন। আমাদের বারণ-টারন কানেই তুলল না, প্ল্যাটফর্মে তখনো অ্যলার্ম বেল বাজছে। বার্টন তাড়াহুড়ো করে আমাদের বাইরের ফাঁকা বুকিং অফিসটায় নিয়ে গেল। ভদ্রলোকের কীসের যে এতো তাড়া তা বুঝলাম না!
—“এহে, মুস্কিল হয়ে গেল বুকিং অফিস যে ফাঁকা দেখি, আমার গাড়ি এখনো পৌছায়নি।” তারপর একটু হাত কচলে বলল—“মাফ করবেন, একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাদের এখানে। আমি দেখি যদি একটা গাড়ি জোগাড় করা যায়।” বলেই হুড়মুড় করে এগিয়ে গেল, ততক্ষণে একখানা আপট্রেন তীব্র বেগে হুইসেল বাজিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে একইসাথে আমাদের ট্রেনখানা ও বেরিয়ে যাবার আওয়াজ পেলাম।
এবারে থর্নডিক তিরের বেগে বেরিয়ে এল বুকিং অফিস থেকে। "জারভিস, জলদি, ওই যে ওই দেখ, ফুটব্রিজের ওপর দিয়ে পালাচ্ছে।” হ্যাঁ, তাই তো বার্টন তিরের বেগে দৌড়াচ্ছে, যেন আপট্রেন ধরাটাই তার লক্ষ্য!
"জারভিস, চলো ব্যাটাকে এই বেলা ধরতেই হবে, না হলে আর ধরা যাবে না।” বলতে বলতে থর্নডিক প্ল্যাটফর্ম থেকে লাফ মারল নীচে।
আমিও পা মেলালাম তার সাথে, থর্নডিকের হাতে দেখি তার সুইস নাইফখানা উঠে এসেছে। সর্বনাশ! কী করতে চায় ও!
লাইন পার হয়ে ছুট ছুট,ততক্ষণে ট্রেন ও হুইসেল দিয়ে দিয়েছে। আপট্রেনের একটা ফার্স্টক্লাস কামরার পাদানিতে পা দিতেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। এবারে দেখলুম সুইস নাইফ দিয়ে পেঁচিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল থর্নডিক, আচ্ছা তাহলে এই সুইস নাইফখানা চাবির ও কাজ করে। আমি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, "কিন্তু বার্টন?”
“সে সামনের কামরাতেই আছে।”
হঃ হঃ, হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম "এবার বলবে কি তুমি, এসবের মানে কী?”
“মানে কিছুই নয় জারভিস। জেমস ছোকরাই এর জন্য দায়ী, মনে আছে সে কাগজে ওই সাংকেতিক লিপি নিয়ে আমার সম্মন্ধে বড় বড় কথা লিখেছিল, তারই ফল এটা। কাগজে জেমসের রিপোর্ট পড়েই বুঝেছিলাম, এটা উদ্ধারের একটা চেষ্টা তো হবেই। হলোও তাই। তবে এত দ্রুত যে হবে তা ভাবিনি।”
—“মানে?”
—“আচ্ছা বল তো, বার্টন তার কোন পরিচয় দিয়েছে?”
—“না!”
—“হুম এতেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। সেটা আরও বাড়ল যখন সে আমাদের দুজনকেই চাইল। সেই সন্দেহটা জমাট বাঁধল যখন টেস্ট করলাম। খাবারে প্রচুর আর্সেনিক ছিল। অত পরিমাণ আর্সেনিক দেওয়া খাবার খেলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হবে। তাই আমি তৈরী হবার নাম করে ভিতরে গিয়ে টাইমটেবিলটা চেক করছিলাম, যথারীতি রেক্সফোর্ডে থেকে ফিরে আসার লাস্ট ট্রেন দেখার জন্য, দেখলাম একেবারে গায়ে গায়ে সময় দুটির, ক্রসিং বলা যায়। তখনই বুঝে গেছি সব। আসলে ও আমাদের বের করে, সেই সুযোগে ওর লোকজন দিয়ে ঘরটা তল্লাশ চালাতে চাইছিল ওই সাংকেতিক লিপিটা উদ্ধারের জন্য। আমরা ও বুকিংরুমে ওয়েট করতে করতে লাস্ট ট্রেন বেরিয়ে যেত, আর ফিরতে পারতাম না ফলে অনেক সময় পেত ওরা।”
—“আচ্ছা, এই জন্যেই তাহলে এই উদ্বেগ আর অস্থিরতা, কিন্তু বন্ধু তুমি যদি সবই বুঝতে পেরেছিলে, তাহলে এলে কেন?”
—“আহা,এই যে অ্যাডভেঞ্চারটা হল এটা বা কম কীসে?”
—“এর চক্করে আমাদের ল্যাবরেটরিটার যে সর্বনাশ হল!" আমি বিরক্ত মুখে বললাম।
—“আহা চট কেন? তার জন্য আপাতকালীন ব্যবস্থা করা আছে। তাছাড়া তারা তো এখনও অপেক্ষা করছে বার্টনের ফেরার জন্য... হয় তো আমাদের জন্যও।”
লাস্ট ট্রেন যে কি পরিমাণ ঝোলায় তা যারা যায়, তারাই জানে। দ্বিগুণ সময় নিল লিভারপুলে আসতে। থর্নডিক ও আমি ধীরেসুস্থে নেমে বার্টনের পিছু নিলাম। সে নিশ্চিত ছিল আমরা এখনো সেই বুকিং অফিসে মাছি মারছি, তাই গদাইলস্করি চালে সিগার ধরিয়ে ফুঁকতে ফুঁকতে, ব্রড স্ট্রীটের দিকে মোড় নিল।
থর্নডিক সহসা আমাকে ঠেসে একটি ট্যাক্সির মধ্যে ঢুকিয়ে ট্যাক্সিওলাকে বলল—“ক্লিফোর্ড ইন প্যাসেজ।” তারপর আমার দিকে ফিরে বলল আরামসে বস।
এই ক্লিফোর্ড ইন প্যাসেজ আমাদের অফিসের কোণাকুণি রাস্তা, যাই হোক ট্যাক্সি থেকে নেমে আমরা একটা অন্ধকার, সরুগলিতে গিয়ে ঢুকলাম। সেখান থেকে “ইনার টেম্পেল লেনের (আমার বাড়ি কাম অফিস বিল্ডিং) গেট অবধি সব পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে হাপিত্যেশ করার পর আমরা বাঁদিক দিয়ে তাকে আসতে দেখলাম। ব্যাটাচ্ছেলে খানিকক্ষণ আমাদের গেটে দাঁড়াল, তারপর টুক টুক করে মৃদু টোকা দিল। ভিতর থেকে নাইট শিফটের ছোকরা বেরিয়ে এলে, তার সঙ্গে কিছু কথা বলে ভিতরে চলে গেল।
আমরা পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে, রাস্তা পার করে এসে চেম্বারের সামনে এলাম, নাইট শিফটের ছোকরা বেরিয়ে এসে বললে “স্যার, আপনার চেম্বারে একজন এসেছেন। বললেন আপনার সাথে অ্যাপয়েনমেন্ট আছে।”
“ওহো, চলে এসেছে!” মেকী ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল থর্নডিক।
আমরা ভিতরে ঢুকে সোজা পথে না গিয়ে এ করিডর সে করিডর, অন্ধকার টেরাস পেরিয়ে আমাদের চেম্বারের ঠিক নীচে আরেকটা চেম্বারের দরজায় এসে উপস্থিত হলাম। এই চেম্বারের মালিক অ্যানস্টেও আমাদের পরিচিত।
আমি অবাক বিস্ময়ে অস্থির হয়ে বললুম—“আরে, কর কী! এখানে এলে কেন?” উত্তর না দিয়ে থর্নডিক সোজাসুজি অ্যানস্টের চেম্বারের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করল, প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন চেম্বারের ভিতর অ্যানস্টে স্বয়ং দুজন ঊর্দিধারী কনস্টেবলকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সাথে দুজন সাদা পোশাকের অফিসারও আছে মনে হল।
“কোন সিগন্যাল পাইনি স্যার এখনো অবধি,” সাদা পোশাকের ভদ্রলোক কথা বলে উঠতেই চিনতে পারলাম। এই ভদ্রলোক তো আমাদের এলাকার ডিটেক্টিভ সার্জেন্ট, থর্নডিক তাহলে...!
“তবে তিনি এসেছেন, আমাদের মিনিট পাঁচেক আগেই ঢুকেছেন।”
“তাহলে, এইবার পর্দা উন্মোচিত হোক বন্ধুরা, আমি যে আর...”
শসস...অ্যানস্টের এই নাটকীয় ডায়লগ থামিয়ে দিলেন সার্জেন্ট ভদ্রলোক, "কেউ ওপরে উঠছে মনে হচ্ছে!”
আমরা জানালায় ঘাপটি মেরে রইলাম,অন্ধকারে গা মিশিয়ে একজন পা টিপে টিপে উঠছে সিঁড়ি বেয়ে, তার পিছনে আরেকজন, তার পিছনে সবশেষে আমাদের ধুরন্ধর ক্লায়েন্ট। তার মানে এরা এতক্ষণ চুপচাপ পুরো দলের জন্য অপেক্ষা করছিল।
থর্নডিক ফিসফিস করে বলল, “বন্ধুগন এইবার...”
বলার সাথে সাথেই ঘন্টাঘরের ঘড়ি মধ্যরাত্রি ঘোষণা করে দিল। আর তার সাথে সাথেই আমাদের মাথার ঠিক উপরে কর্কশ ধাতব সংঘাতের আওয়াজ শোনা গেল।
সাথে সাথে সবাই নড়েচড়ে বসল।
সার্জেন্ট ঘুরে দাঁড়িয়ে উর্দি পরিহিত কন্সটেবলদ্বয়কে আগে যাওয়ার নির্দেশ দিলে তারা নিঃশব্দে বিড়ালের মতো বেরিয়ে গেল। আমরা পিছে পিছে ছুটে গেলাম থর্নডিকের চেম্বারের দিকে, ওপরে তখন কাঠের প্ল্যাটফর্মখানা মচমচ শব্দে সচকিত হয়ে উঠেছে। উপরে উঠে সামনের সার্জেন্টটি ফিসফিস করে বলল, “স্যার, ওরা কাজ শুরু করে দিয়েছে। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে তার কাচঢাকা লণ্ঠনের মৃদু আলোয় দেখলুম, সামনেরজন লোহার চাপবাড়ি হাতে আমাদের বসার ঘরের লোহার দরজাটা খোলার চেষ্টা করছে।
কন্সটেবল দুজনকে সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ দাঁড় করিয়ে আমরা উপরে উঠে এলাম। যত উপরে উঠলাম ততই আমাদের ঘর থেকে ভেসে আসা আওয়াজ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। দোতলায় আমরা একটি লোকের দেখা পেলাম, টুপিতে মাথা ঢেকে দাঁড়িয়েছিল তবে তার পোশাক বলে দিচ্ছিল সে আর কেউ নয় আমাদের ক্লায়েন্ট বার্টন।
আমাদের দেখেই বার্টন প্রায় ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। চকিতে অফিসার দুজনকে ধাক্কা মেরে নীচে নামতে লাগল। আমরা তাড়াহুড়ো করলাম না কারণ নীচে কনস্টেবলরা বার্টনের জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমার একবার খুব ইচ্ছা করছিল ব্যাটার মুখখানা দেখতে কিন্তু হল না কারণ ততক্ষণে আমরা মোড় ঘুরে আমাদের চেম্বারের সামনে চলে এসেছি। সেখানে একই ছবি, বার্টনের সঙ্গীদ্বয় খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করে, হাল ছেড়ে করুন মুখে তখন দাঁড়িয়ে রইল। এবার সার্জেন্ট মুখে আলোটা ফেলে পুলিশি ঢঙে বলে উঠলেন,“আরে মোয়াকে যে, এই যে টম হ্যারিস তুমিও আছ!"
“স্যার, যা হবার হয়ে গেছে এবার যেতে দিন। আমরা ভুল বাড়িতে চলে এসেছিলাম। ছেড়ে দিন চলে যাচ্ছি।” সার্জেন্টের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে করতে বলল মোয়াকে।
“হুম, তাই বটে, চল তোকে ঠিক ঘরে নিয়ে যাচ্ছি, আর ভুল হবে না আশা করি।” বলে কলারটাকে চেপে ধরে লাগিয়ে দিলেন একরদ্দা।
বেচারারা আর ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই করলো না, চুপচাপ আমাদের সঙ্গে নীচে নেমে এল দুজনে। নীচে নেমে দেখি আমাদের তথাকথিত ক্লায়েন্ট ব্যাজার মুখে হাতকড়া পরে দাঁড়িয়ে আছে।
সার্জেন্ট আমাদের দিকে ঘুরে বললেন, “আজ রাতটা ভালোভাবে ঘুমিয়ে নিন স্যার, অনেক ধকল গেছে। এসব পুরানো পাপী, অনেকদিনের পর দেখা হল, একটু দলাইমালাই করে নিই, যা হবার সব কালকে সকালে হবে, শুভরাত্রি”। তারপর তার দলটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
অপসৃয়মান দলটার দিকে তাকিয়ে থর্নডিক বলল, “বুঝলে জারভিস, এই বার্টনের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ব্যাটা কটা আকাট গাম্বাটের সঙ্গে মিশে মিশে নিজের দফারফা করেছে। পুলিশ কতদূর কী বুঝবে সেইই জানে।”
আমি শুধু একটা শ্বাস ছাড়লাম।
পরদিন সকালে উঠে দেখি খোদ পুলিশকর্তা মিলার এসে উপস্থিত। বুঝলাম ব্যাপারটা তাদের বেশ নাড়িয়ে থুড়ি ঝাঁকিয়ে দিয়েছে।
ঘ্যোঁত ঘ্যোঁত করে বললেন সুপার মিলার সাহেব, “ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন মিঃ থর্নডিক। মানে আপনার বাড়িতে ডাকাতির চেষ্টা, তাও আবার কিনা স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের অফিসের ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে, এই ইনার টেম্পলের মতো সম্ভ্রান্ত জায়গায়। ঠিক করে বলুন তো কী আছে আপনার কাছে!”
“আপনারা যেমন ভাবছেন, তেমন কিছুই নেই।” থর্নডিক বলল।
“অদ্ভুত তো! প্রথমে আপনার নোট পেয়ে ভেবেছিলাম বুঝি সেই সন্ত্রাসবাদী হতচ্ছাড়ার দল। সকালে কাগজে আপনার সাথে এই কেসের তদন্তে জড়িত থাকার খবর পেয়েছে আর সেই জন্যই বোধহয় এই আক্রমণ। এতো দেখি সাধারণ ছিঁচকে চোরের দল। যাই বলুন স্যার, বড় মাছের গন্ধ শুঁকে এসে যদি ছোট চুনো মাছ ধরা পড়ে, বড্ড বিরক্ত লাগে।” সত্যিই, ভদ্রলোকের মুখচোখ দিয়ে স্পষ্টতই বিরক্তি ঝরে পড়ছিল।
—“তা তো বুঝলাম কিন্তু সেই সাংকেতিক লিপিটার কী হল?”
—“ধুত্তোর! তাহলে কি আর এতো কথা বলতুম? কিছু মনে করবেন না স্যার এই যে আপনাদের প্রফেসর ভদ্রলোক মিঃ পপেলবাম শিক্ষিত হতে পারেন কিন্তু এখনো অবধি সামান্য এই লিপিটার মর্মোদ্ধারটুকু করে উঠতে পারেননি। তিনি প্রথমে নিজেই বললেন সাংকেতিক লিপির ভাষা হিব্রুতে। কোন সমস্যাই নয় অথচ যা অনুবাদ করেছেন তার চেয়ে বোধহয় মূল লিপিটাই ভালো ছিল।” বলে বিরক্তমুখে পকেট থেকে একতাড়া কাগজ আর ফোটো বের করে থর্নডিকের সামনের টেবিলে ফেলে দিলেন।
“এই লিপিটা নাকি কোন এক রাজা মেশার। তো সেই মেশা ছিলেন মোয়াব মানে অধুনা জর্ডনের রাজা, আনুমানিক ৮২৪ খৃঃ পূর্বাব্দে তিনি রাজত্ব করে গেছেন। তারপর স্বগতোক্তির মতো বললেন, “আমি এসব জন্মেও শুনিনি। তো যাই হোক এই রাজা মেশার আমলের যে সব লিপিটিপি পাওয়া গেছে তার সঙ্গে তার এই লেখার নাকি বহুলাংশে মিল আছে। যেমন অক্ষরগুলি আদি হিব্রু বা ফিনিশিয়। শব্দগুলি কিছু অক্ষরসমষ্টির আল দিয়ে পৃথক করা। আপাত দৃষ্টিতে সবগুলি অর্থহীন, কিন্তু এটা আসলে দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই লেখা।
"তার মতে শব্দগুলি একা অর্থবহ নয়, কিন্তু কিছু শব্দকে পাশাপাশি রেখে পূর্ণাঙ্গ বাক্য পাওয়া যায়। অর্থ হয়তো উদ্ভট কিন্তু দ্যর্থক। তার মতে এর ভিতরে আরও অন্যকোনও কাব্যিক সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকতে পারে।
"মর্মোদ্ধারের প্রক্রিয়াটা এই যে এই কাগজে দেখানো আছে। তবে প্রফেসরের মতে যে লিখেছে সে হিব্রুতে নভিশ, প্রচুর ভুল আছে। যাই হোক ডক্টর, এই সব দিলাম প্রফেসরের রিপোর্ট, দস্তাবেজ যাবতীয় যা কিছু আছে। এবার আপনি দেখুন।” থর্নডিক কাগজটা মুখের সামনে মেলে ধরল, "যাই বলুন একটা ছন্দ আছে কিন্তু।”
—“সে মশাই আপনি বুঝুন। আমি বলে দিলাম এটা একটা প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।”
তারপর ভয়ানক লাল মুখ করে টেবিলে একখানা চড় মেরে বললেন, "আমি বলছি মশাই, প্রফেসরের এই তথাকথিত অনুবাদ আপনার মাথার চুল ফাঁকা করে দেবে। পাগলা হয়ে যাবেন, পাগলা।”
এতকিছুর মাঝে থর্নডিক কিন্তু দিব্যি চুপচাপ নিজের কাজ করে যাচ্ছিল। আমি আড়চোখে দেখলাম আলতো হাসি খেলা করে যাচ্ছে তার কপালের ভাঁজে, ঠোঁটের কোণে।
থর্নডিক বলল, "মানেটা অদ্ভুত, হয়তো আপাত দৃষ্টিতে প্রলাপই বটে কিন্তু প্রফেসরের বির্নিমাণ মার্ভেলাস! এতো ভালো কাজ সম্ভবত আর কেউ করতে পারত না। আমার আসল ক্রিপটোগ্রাম থেকেই শব্দগুলো তুলে এনে শূন্যস্থান ভরেছেন ভদ্রলোক! চমৎকার!"
"জারভিস দেখো একবার,” উজ্জ্বলমুখে আমার দিকে কাগজগুলোবাড়িয়ে দিল থর্নডিক।
“দুঃখ শহর মিথ্যা লুণ্ঠন শিকার
গোলমাল চাবুক প্রাণবন্ত চাকা ঘোড়া
রথ দিন অন্ধকার বিষন্নতা
মেঘ অন্ধকার সকাল পর্বত
লোকজন শক্তিশালী আগুন তাহার শিখা।”
দ্বিতীয় পাতাটায় প্রফেসরের কথা পুনর্বিনিমান –
“রক্তাক্ত শহর আমার তোর জন্য দুঃখ তোলা থাক। লুণ্ঠনে, মিথ্যায়, শিকারের আর্তনাদে তুই আপনাকে ভরিয়ে রাখ। চাবুকের সপাং, ঘোড়ার খুরের চাঁট আর রথের চাকার ঘর্ঘরে ডুবে থাকুক তোর সত্ত্বা। চললাম আমি চললাম তোকে ছেড়ে।
বিষণ্ণতা কিংবা মনখারাপের দিন, আদতে সবই তো সেই অন্ধকার। চাপচাপ জমাটবাঁধা কালির মতো অন্ধকার। দিন যায়, বেলা বাড়ে, অভিজ্ঞতা বাড়ে, পাহাড় ডিঙোতে ডিঙোতে অন্ধকার ও বুঝি ফিকে হয়ে আসে।
সামনেই আগুনের শিখার সামনে আছে শক্তির প্রদর্শন অথবা জয়ের উল্লাস। আর পিছনে শুধুই শিখা।”
এইভাবেই পাতাটা শেষ হল। আমি পাতাটা টেবিলে নামিয়ে দিলাম, থর্নডিক কৌতুহলী মুখে চেয়েছিল তখনও আমার দিকে। “দারুণ কাজ বটে, মূল অনুবাদে প্রফেসর প্রায় ৭৫ শতাংশ শব্দ জুড়ে নিয়েছেন।”
“সেটাই, সেটাই তো সমস্যা” হাঁ হাঁ করে উঠলেন সুপারিন্টেডন্টে সাহেব, “এটার সবটাই প্রায় প্রফেসর, ক্রিপটোগ্রামটা ছাই চাপা পড়ে গেছে ওনার কারিকুরিতে।”
—“হোক, তবু আমি বলব প্রফেসরের ধরাটা ঠিকই আছে, মনে হয়।” থর্নডিক আপত্তির সুরে বলল।
—“মানেটা কী! আপনি কি বলতে চান এইসব প্রলাপের কোন অন্তর্নিহিত অর্থ আপনি...
—“না, আমি একেবারেই ঠিক সে কথা বলছি না। কিন্তু যতদূর মনে হচ্ছে বেরোলে এটার থেকেই সমাধান বেরোবে।”
—“স্যার, আপনাকে যে ফটোগ্রাফ দিয়েছিলাম; দেখেছিলেন?” মিলার কৌতূহলী মুখ করে বলল।
—“হুম, আমি দেখেছি তবে মূল কপিটা যদি আপনার সাথে থাকে তাহলে আমি ওটা একবার দেখতে চাই।”
—“হ্যাঁ আছে, প্রফেসর সাহেব সমাধান পত্রের সাথে মূলটাও ফিরত দিয়েছেন। যদিও এটা আমি আপনার কাছে রেখে যেতে পারব না, তবুও দেখে নিন। এই যে।”
পকেটবুক থেকে কাগজখানা বার করে থর্নডিকের হাতে দিতেই সে আতসকাচ নিয়ে জানালার কাছে চলে গেল। তারপর ভিতরের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। আমি বুঝলুম এখন সে পাইপ আর কাগজটা নিয়ে ঘন্টা দুয়েক মজে থাকবে। কাজেই মিলার সাহেবের সাথে ব্যস্ত হবার চেষ্টা করলাম।
—“কী বুঝছেন তাহলে?”
—“আরে ধুর, যেমন সব উটপটাং নৈরাজ্যবাদী, সন্ত্রাসবাদী বদমাইশের দল, তেমন তাদের সংকেত, কিসসু বেরোবে না এই আমি বলে দিলুম।” বলে আরেকবার টেবিলে ঘুষি মারলেন ভদ্রলোক।
—“আহা, হয়তো আমাদের কাছে নেই। কিন্তু এই প্রলাপের ছত্রে ছত্রে হয়তো সত্যিই কিছু লুকিয়ে আছে। হয়তো শব্দের ভাঁজে লুকিয়ে আছে মারাত্মক কিছু...”
—“বলছিলাম তো সেকথা প্রফেসরকে, ঠিক এই কথাটাই বলেছিলাম। কানে তুললে হয়, বলে ওগুলো সাজানো কেবল বিভ্রান্তির জন্য। এর জন্য আরো আরো ভাবতে লাগবে।”
—“হুম, দেখা যাক আমার বন্ধু কী বলে?”
—“কী আবার বলবে, মাইক্রোস্কোপের তলায় কাগজখানা দিয়ে গুচ্ছের পরীক্ষা করবে তারপর বলবে অমুক কোম্পানীর কাগজ, তমুকের কালি। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হবে কি?” তুম্বো মুখে বলল সুপারিন্টেনডেন্ট।
অগত্যা আমরা দুজনে চুপচাপ বসে পেয়ালার পর পেয়ালা চা পান করতে লাগলাম, আর অপেক্ষা করতে লাগলাম কতক্ষণে থর্নডিক আসে।
থর্নডিক এসে সোফায় বসতে বসতে প্রথমেই বলল,“সুপারিন্টেনডেন্ট সাহেব, আগে একটা কথা পরিষ্কার করুন এটা কি অফিশিয়াল কনসালটেশন?”
“অবশ্যই। আরে মশাই আমি খোদ অথরিটি, আপনার ফিজের ব্যাপার থেকে সব আমার দায়িত্ব, তাছাড়া আপনার কাজ হয়নি আপনি মূলটা আপনার সাথে কদিন রাখতে চান এই তো। তাহলে সে ব্যবস্থাও..."
—“না না তার দরকার হবে না, আমার কাজ শেষ, যা বেরিয়েছে তাতেই হয়ে যাবে।”
—“বলছেন কী!... আপনি তো..."
—“হয়েছে, এই যে নিন, পড়ুন।” বলে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল, থর্নডিক।
খানিকক্ষণ পড়ার পর মিলার সাহেব বললেন – “কী মশাই মস্করা করছেন? কী এটা? কোথা থেকে পেলেন এসব?”
“এটাই ওই ক্রিপটোগ্রামের সমাধান, পড়ুন ভালো করে পড়ুন। আরেকবার পড়তে পড়তে অস্থির ভাবে পা নাড়তে লাগলেন বুড়ো ডিটেকটিভ। শেষমেশ অস্থির গলায় বললেন, "কী মশাই, কেন মস্করা করছেন?”
“উহু, এটাই সমাধান। একমাত্র সঠিক সমাধান।”
“কী বলেন, মিঃ জারভিস একবার দেখুন এটা নাকি সমাধান!,” গলায় অবিশ্বাস ঝরে পড়ল সুপারিন্টেনডেন্টের।
আমি তার হাত দিয়ে কাগজটা নিয়ে দেখলাম। বুঝলাম তার এই উত্তেজনার কারণ কী। কিছুই না বড় হাতের কিছু লেখা। যেটা আরো বড় হেঁয়ালি,
চার এক ছয় খর বেগে বায়ু বয়,
দোতালায় ভাঙে কাচ ঝনঝন,
ওয়ার্ডার স্ট্রীটে লুণ্ঠন।
সিদ্ধি লাভে কিছু নিয়মকানুন প্রয়োজন,
আত্মশুদ্ধির আগে পূর্ণ অবগাহন।
রাজার নয়নসুখে বড় ভয়,
হাজার জোড়া চোখ তার, কেবল চেয়ে রয়,
জয়ের উল্লাস যেন আগুনেই ছাই হয়।
—“তাহলে, এই লোক কোন নৈরাজ্যবাদী ছিল না, একজন পাগল কবি ছিল?”
—“হতে পারে তবে সে ছিল মোয়াকের দলের লোক অথবা মোয়াকে তার দলের লোক। আমরা ভেবেছিলাম মোয়াকে যুক্ত আদতে, কিন্তু কীসে সেটা বুঝিনি। এটা সেটা।”
মিলার সাহেবের মুখ দেখে বুঝলুম ভদ্রলোকের মুখে বিস্ময়, রাগ, হতাশা, বিরক্তির এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যেন এখনি ঝড় উঠবে। ভদ্রলোককে আরো চমকে থর্নডিক বলল, "মিলার সাহেব চলুন আমাদের যেতে হবে। এখনো ওয়ার্ডার স্ট্রীটে পৌঁছতে পারলে ডাকাতিটা আটকানো যেতে পারে। জারভিস ব্যাগটা দাও তো আমায়।”
মিলার সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে বলা ভাল নিজের মাথার ওপর চাপ না বাড়িয়ে আমাদের টেলিফোনটা ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে নিলেন কেবল।
কোট পরতে পরতে থর্নডিক বলতে থাকল, “ভাবছি, ডাকাতির জায়গাটা আদৌ ওরা খুঁজে পাবে কিনা। অবশ্য যদি গ্যাং এর একাধিক লোক ঠিকানাটা জানে তাহলে অন্য কথা। কেসটা ভারী অদ্ভুত যাই বলো। এই বার্টন আর স্কনবার্গই আসল ওরাই মাথা খাটিয়ে এই লিপির ধুঁয়োটা উসকেছে।”
“তুমি একটু খুলে বলবে কি? এত তাড়াতাড়ি কী করে সমাধানটা বের করলে, আর কীই বা হচ্ছে?” আমি বললাম।
“আ, এটাতে এমন কিছুই ছিল না জারভিস, যার জন্য আমায় মাথা কুড়তে হবে। দুদিন যখন অপেক্ষা করেই নিলে আজকের রাত্তিরটাও করে নাও। কাল সকালে সব বলব।”
সকালে দুজনে পাইপ খেতে খেতে কথা বলছিলাম, “কালকের ব্যাপারটা তাহলে ভালোই মিটল কী বল। মিলার একেবারে বামাল সমেত গ্রেপ্তার করল সব।”
টকটক...মৃদু টোকা পড়ল দরজায়।
উম, কোন সম্ভ্রান্ত লোক, জোরে আওয়াজ করা পছন্দ করেন না, তবে এই মূহূর্তে কোন কারণে একটু অস্থির। দরজা খুলে দেখি একজন সৌম্যদর্শন প্রৌঢ়, দেখলেই বোঝা যায় যথেষ্ট অভিজাত। আমাকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন—“আমি প্রফেসর পপেলবাম..."
থর্নডিক ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে গিয়ে তাকে অভিবাদন জানিয়ে ভিতরে আনল, চেয়ারে বসতে বসতে ভদ্রলোক বললেন—“গতকাল দুপুরে আমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন করেছিলাম, জানলাম, আপনি সমাধান করে ফেলেছেন। এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও খুশি। আমি কী বলব, মানে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ইয়ার্ডে গিয়ে আবার চেয়ে এনেছিলাম ক্রিপটোগ্রামটা। কিন্তু মশাই সারা রাত মাথা খাটিয়েও কিছু বার করতে পারিনি। আর থাকতে পারিনি, সকাল হতেই ছুটে এসেছি আপনার কাছে।”
“আছে, ক্রিপটোগ্রামটা আপনার সাথে?”
“হ্যাঁ, এই যে,” বলে পকেটবুক থেকে ক্রিপটোগ্রামটা বের করে দিলেন প্রফেসর।
কাগজটায় আঙুল বোলাতে বোলাতে থর্নডিক বলল, “প্রফেসর সাহেব একটা জিনিস দেখেছেন কি পাতাটা সাধারণ লেইড পেপার মানে দুতিনটে স্তরের পাতলা কাগজ দিয়ে তৈরী আর কালিটাও চায়নীজ বড়ির কালি, যে কালি ছবি আঁকায় ব্যবহৃত হয়। পাতায় কোনও জলছাপও নেই?”
“হুঁ দেখেছি বটে, কিন্তু এদের সাথে এই লিপির সম্পর্ক কী?” অধৈর্য্যভাবে বলে উঠলেন প্রফেসর।
—“স্বাভাবিক। তবে আমার খটকা লাগে এই কালিতেই, আর সেটা প্রথম দেখাতেই লেগেছিল। দুইদিন খোঁচাখুঁচি করে ফটোগ্রাফ দেখেও কিছু বুঝতে পারিনি কিন্তু মনটা খচখচ করছিল।”
—“আরে কালিতে কী আসে যায়!”
“আছে মিঃ পপেলবাম আছে।” বলে প্রফেসরকে হাত তুলে থামিয়ে নাটকীয়ভঙ্গীতে বলা শুরু করল থর্নডিক, “চায়নীজ কালির কিন্তু বেশ দাম, আর এটার ব্যবহার আঁকার কাজে। তাহলে কেউ এটাকে এইরকম কাগজে লেখার জন্য ব্যবহার করল কেন? তখন মনে পড়ল এই কালির সুবিধার কথা, সেটা হল কাগজ যদি কোনওভাবে ভিজেও যায়, তাহলেও এই কালি নষ্ট হয় না। অর্থাৎ ইহা পার্মানেন্ট ইঙ্ক। তাহলে কি এটাকে ভেজানোর দরকার ছিলো?” বলেই জল ভর্তি পট টেনে সামনে আনল।
“আরে করছ কী?” আমি বললুম।
“কাল যেটা করেছিলাম, সেটাই করছি আবার,” বলেই কাগজটাকে রোল করে টুপ করে জলে ফেলে দিল থর্নডিক। আমরা হাঁ হাঁ করে উঠতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখলাম এক নতুন ধূসর রঙের অক্ষরমালা ফুটে উঠেছে কাগজের ওপর। থর্নডিক ঝটপট কাগজটা তুলে আলোয় মেলে ধরতেই জলছাপের মতো পরিস্কার রোমান হরফে টাইপ করা এই সম্পূর্ণ ভিন্ন লেখা গুলি ফুটে উঠল।
প্রফেসর গোঁজ হয়ে বসে কিছুক্ষন বসে রইলেন, তারপর বললেন "কিন্তু এটা যে ঠিক তা কী করে বুঝলেন?”
"জারভিস কে বোঝানোর জন্য একটা স্যাম্পল সেট তৈরী করাই আছে। আসুন আপনারা।”
আমরা সবাই মিলে অফিসে ঢুকলাম। দেখলাম টেবিলের ওপর কাঁচের একটা মোটা স্লাইড রাখা পাশে একটা ফটোগ্রাফিক ডিশের ওপর ভিজে চুপচুপে একটা কাগজ।
স্লাইডের ওপর কাগজটা রাখতে রাখতে থর্নডিক বলল, "এটাতে এই লেইড কাগজটা সারা রাত ভেজানো ছিল। এখন দলা পাকিয়ে মন্ড হয়ে আছে, ঠিক তো?”
আমরা কৌতূহলী মুখে শুধু ঘাড় নাড়লাম।
—“এবার, একটা শুকনো কাগজ বিছিয়ে দিলাম। তারপর উলটে দিয়ে পিছনে পেন্সিল দিয়ে চেপে চেপে লিখল,
হাতাহাতি নাচানাচি
গড়াগড়িচচ্চড়ি
প্রফেসরের মুখ দেখি রীতিমতো লালবর্ণ ধারণ করেছে। এবার ওপরের কাগজটা তুলে নিতেই দেখলাম ধূসর বর্ণের লেখা চেপে বসেছে ভিজে কাগজের ওপর। আলোয় ধরতে দেখলাম, স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে লেখাগুলো, যেন তেল রঙের লেখা।
“যখন শুকোবে, দেখবেন এই লেখাগুলো সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু জারভিস, প্রফেসর পপেলবাম যখনই এই কাগজ ভেজানো হবে এইসব লেখাগুলো আবার ফুটে উঠবে। তখনই এটা সংকেত, আপাতত নিরীহ মোয়াবাইট।”
প্রফেসর, নিম পাতা খাওয়া মুখ করে ঘাড় নাড়লেন কেবল।
“দুর্দান্ত সন্দেহ নেই কিন্তু একজন অশিক্ষিত, ছেনো মস্তান কী করে লিখল এই মোয়াবাইট লিপি?”
“না, প্রফেসর, এই ক্রিপটোগ্রামটা লিখেছে ওদের সর্দার। আমার মনে হয় লোকটা জানে এসব, তারপর দলের সবার কাছে এই জিনিষ ছড়িয়ে দিয়েছে। আসলে এই মোয়াবাইট লেখাটা শুধু বিভ্রান্তির জন্য লেখা। যাতে কাগজটা ভুল হাতে বা পুলিশের হাতে পড়লেও...আর তার হিন্ট ও মোয়াবাইটেই দেওয়া আছে। এই যে
“রক্তাক্ত শহর আমার তোর জন্য দুঃখ তোলা থাক। লুণ্ঠনে, মিথ্যায়, শিকারের আর্তনাদে তুই আপনাকে ভরিয়ে রাখ। চাবুকের সপাং, ঘোড়ার খুরের চাঁট আর রথের চাকার ঘর্ঘরে ডুবে থাকুক তোর সত্ত্বা। চললাম আমি চললাম তোকে ছেড়ে।
বিষণ্ণতা কিংবা মনখারাপের দিন, আদতে সবই তো সেই অন্ধকার। চাপচাপ জমাটবাঁধা কালির মতো অন্ধকার, খেলা শুধুই মেঘ বৃষ্টির। দিন যায়, বেলা বাড়ে, অভিজ্ঞতা বাড়ে, পাহাড় ডিঙোতে ডিঙোতে অন্ধকারও বুঝি ফিকে হয়ে আসে।
সামনেই আগুনের শিখা তবে তাতে মিশে আছে জয়ের উল্লাস। আর পিছনে শুধুই মরা আলোর হলদে শিখা।
কিছু শব্দ যেমন লুণ্ঠন, মেঘবৃষ্টি আর আগুনের শিখা ওভার রাইটীং হয়েছে, এগুলো সম্ভবত ইচ্ছা করেই। যেমন – লুণ্ঠন মানে ডাকাতির ইঙ্গিত
মেঘ আর বৃষ্টি ভেজানোর ইঙ্গিত পক্ষান্তরে স্নানের
কাজ শেষে আগুনে পুড়িয়ে ফেল।
এরপর ভিজিয়ে ফেললেই রোমান হরফে আসল ইঙ্গিত। যার তর্জমা,
চার এক ছয় খর বেগে বায়ু বয়,
দোতালায় ভাঙে কাঁচ ঝনঝন,
ওয়ার্ডার স্ট্রীটে লুণ্ঠন।
সিদ্ধি লাভে কিছু নিয়মকানুন প্রয়োজন,
আত্মশুদ্ধির আগে পূর্ণ অবগাহন।
রাজার নয়নসুখে বড় ভয়,
হাজার জোড়া চোখ তার, কেবল চেয়ে রয়,
জয়ের উল্লাস যেন আগুনেই ছাই হয়।
অর্থাৎ ৪১৬ ওয়ার্ডার স্ট্রীটের দোতালার ফ্ল্যাটে ডাকাতি। কাগজ ভিজিয়ে সব ইঙ্গিত এবনহ ছক পড়ে ফেলার নির্দেশ। কাজ শেষে পুলিশ ও প্রশাসনের নজর এড়াতে যার যার কাগজগুলি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ।
দুটো মিলিয়েই রহস্য উদঘাটন।”
“ব্রিলিয়ান্ট! আপনি মশাই তো জিনিয়াস! কিন্তু আমি পুলিশ নই, আপনার মতো ডিটেকটিভও নয়, শুধুই একজন প্রফেসর।” বলেই ঝড়ের মতো “বাঃ বাঃ” করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। আমরা ডেকেও সাড়া পেলুম না।
থর্নডিক মুচকি হেসে বলল, “এসব লোক একটু খামখেয়ালিই হয় তার চেয়ে চলো জারভিস আরেকপ্রস্থ চা খেয়ে আমাদের বুদ্ধিমান বন্ধু বার্টনকে দেখে আসা যাক।”