বন্ধ ঘরের ভেতর - বিভাবসু দে

অলংকরণ - পার্থ মুখার্জী
(১)

ঘরে ঢুকতে গিয়েই খিল-ভাঙা দরজাটার দিকে চোখ পড়েছিল ইনসপেক্টর খানের। কাঠের তৈরী সাদামাটা একটা দরজা, গায়ে খয়েরি রঙ করা। ঘরটাও খুব জমকালো নয়, তবে সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো। অজিতেশবাবু চিরকালই এমন পরিপাটি মানুষ।

ওঁর সঙ্গে খানের পরিচয় চাকরিজীবনের একেবারে শুরুতে। ইনসপেক্টর খান তখন সদ্য পুলিশে ঢুকেছেন আর অজিতেশ ব্যানার্জি সেই সময় পুলিশের নামকরা দুঁদে অফিসার। এককথায় বলতে গেলে ‘ডিপার্টমেন্টাল হিরো’। তাঁর রেকর্ডবুকে জাঁদরেল খুনি, গুন্ডাদের ধরা থেকে শুরু করে এনকাউন্টারে হিটলিস্টের মোস্ট-ওয়ান্টেড দুষ্কৃতী মারা, সবই ছিল। যেকোনও নতুন জয়েন করা অফিসারের কাছে অজিতেশ ব্যানার্জি ছিলেন আদর্শ। আর রশিদ খানও তার ব্যতিক্রম নন। এখনও মনে পড়ে, অজিতেশবাবুর সলভ করা প্রতিটা কেস সেই পুলিশ ট্রেনিং-এর দিন থেকে খানের নখদর্পণে ছিল।

ঘরটার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে যেন কুড়ি-একুশ বছর আগের সেই স্মৃতিগুলোই ভিড় করে আসছিল খানের চোখে। এমন একজন মানুষ হঠাৎ এই কাজ কেন করতে যাবেন? ডিপ্রেশন? আসলে খবরটা শোনার পর থেকেই প্রশ্নগুলো বারবার খচখচ করছিল ইনসপেক্টর খানের মাথায়। কোথায় যেন কী একটা হিসেব ঠিক মেলাতে পারছেন না কিছুতেই।

ঘরটা আরেকবার চোখে মেপে নিলেন খান। পুবের দেওয়াল ঘেঁষে একটা বিছানা—অজিতেশবাবুর নিথর রক্তাক্ত শরীরটা এখনও সেখানেই পড়ে আছে। ফরেনসিকের লোকেদের স্যাম্পল আর ছবি নেওয়া শেষ হলেই একটু পরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে পোস্টমর্টেমের জন্যে।

বিছানাটার ঠিক পাশে একটা জানালা, আরেকটা জানালা দক্ষিণের দেওয়ালে। আর দক্ষিণ-দেওয়ালেরই শেষ মাথায় সেই দরজাটা—এটাই ঘরের একমাত্র দরজা। উত্তর দিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটা স্টাডি টেবিল, তার ঠিক পাশে বইয়ের আলমারি আর দেওয়ালের ওপরদিকে একটা টিউব লাইট। পশ্চিম দিকের, মানে অজিতেশবাবুর বিছানার ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো এক-দুটো পারিবারিক ছবি, অজিতেশবাবুর বিভিন্ন সময়ে পাওয়া কিছু মানপত্র, পুরস্কার গ্রহণের ছবি আর একজোড়া বাঁশবেতের সোফাসেট, এই। আর হ্যাঁ, একদম ওপর দিকে একটা এসি, এখনও চলছে।

“অজিতেশবাবু কি রাতে এসি চালিয়ে শুতেন?”

“হ্যাঁ স্যার। আসলে দরজা-জানালা তো সবই বন্ধ রাখতেন।” কথাগুলো বলতে বলতেই খানের দিকে এগিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। বয়স আন্দাজ বত্রিশ কি তেত্রিশ হবে। মোটামুটি লম্বাই বলা চলে, গায়ে একটা সাধারণ টি-শার্ট আর ট্রাউজার। ভদ্রলোকের চেহারার আদলে যে অজিতেশবাবুর সঙ্গে বেশ মিল আছে, সেটা চোখ এড়াল না ইনসপেক্টর খানের।

“আপনি?”

“আমি অজিতেশ ব্যানার্জির ছেলে। অমিতেশ ব্যানার্জি।”

অমিতেশকে বেশ ভালো করে একবার দেখে নিয়ে খান জিগ্যেস করলেন, “আপনিই কি প্রথম ঢুকেছিলেন?”

“হ্যাঁ। তবে একা নই, সঙ্গে মৈত্রী, বসন্ত আর আমাদের দু’জন প্রতিবেশীও ছিলেন।”

“মৈত্রী আর বসন্ত কে?” ইনসপেক্টর খান ততক্ষণে প্রায় বিছানার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গে অমিতেশও।

“মৈত্রী আমার স্ত্রী। ডাঃ মৈত্রী ব্যানার্জি।” আঙুলের ইশারায় বাইরে দাঁড়ানো বছর তিরিশের এক ভদ্রমহিলাকে দেখালেন অমিতেশ। “আর বসন্ত আমাদের ড্রাইভার।”

মৈত্রীকে এক ঝলক দেখে নিয়ে খান আবার চোখ ফেরালেন অমিতেশের দিকে, আর তারপর সেই বিছানাটার দিকে।

বিছানার অনেকটা জুড়ে রক্তের দাগ। অজিতেশবাবুর গলার কাছটায় একটা গভীর চির; রক্ত জমাট বেঁধে কালচে হয়ে আছে। বামহাতটা বুকের কাছে ভাঁজ করা আর ডানহাতটা এলিয়ে আছে বিছানার ওপাশে। আর তার ঠিক পাশটায় একটা রক্ত-লাগা ছুরি।

“বাবা যে হঠাৎ কেন এমন করতে গেলেন, কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার।” গলাটা যেন ধরে এল অমিতেশের।

স্যাম্পল নেওয়ার কাজ তখন প্রায় শেষ, বডির পজিশনও মার্ক করে দেওয়া হয়েছে। ঘরের বাইরে থেকে ভেসে আসছে সাব-ইনসপেক্টর অরিন্দম দত্তের গলা, বোধহয় বাড়ির কারও বয়ান নিচ্ছেন।

“হ্যাঁ, আ...” কিছু একটা বলতে গিয়েও হঠাৎ যেন থমকে গেলেন খান। ভুল দেখছেন না তো? না, মোটেই না। খান বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়লেন অজিতেশবাবুর গলার কাছটায়। মাথার ভেতরটা যেন কেমন চিড়িক করে উঠল। সরু হয়ে উঠল তাঁর ধারালো চোখদুটো। যেন এটাই খুঁজছিলেন তিনি। নিজের অজান্তেই তাঁর ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা শিকারী হাসি। যদিও সেটা অমিতেশের চোখে পড়ল না।

“হ্যাঁ, বলুন কী যেন বলছিলেন।” অমিতেশের দিকে ফিরে দাঁড়ালেন খান।

“মানে, বাবা হঠাৎ এমনভাবে আত্মহত্যা করতে গেলেন কেন সেটাই আমাদের মাথায় ঢুকছে না।”

“হুম। ঠিকই বলেছেন। অজিতেশ ব্যানার্জির মতো অসাধারণ সাহসী অফিসার এভাবে নিজের গলায় কেন ছুরি দিতে যাবেন সেটা আমারও মাথায় ঢুকছে না!” খানের গলায় যে একটা হালকা ব্যঙ্গের সুর ছিল, বুঝতে মোটেই অসুবিধে হল না অমিতেশের। “আচ্ছা অমিতেশবাবু, পুরো ঘটনাটা একটু খুলে বলুন তো।”

অমিতেশ একবার ছোট্ট করে ঢোক গিলে নিয়ে শুরু করলেন, “আসলে বাবা রোজ ভোরেই হাঁটতে বেরোতেন। এই ধরুন মোটামুটি ছ’টা নাগাদ। কিন্তু আজ সাতটা বাজার পরেও যখন দেখলাম বাবার ঘরের দরজা বন্ধ তখন একটু চিন্তা হল। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো শরীর খারাপ, ঘুমোচ্ছেন। তাই ডাকিনি। কিন্তু যখন আটটা বেজে গেল তখন মৈত্রী ব্রেকফাস্টের জন্যে ডাকতে এল।

“কিন্তু অনেক ডাকাডাকির পরও বাবার কোনও সাড়াশব্দ নেই। আমিও ততক্ষণে মৈত্রীর গলা পেয়ে এসে পড়েছিলাম। বেশ জোরে জোরে আরও কয়েকবার ডাকলাম, দরজাও ধাক্কালাম, কিন্তু বাবা খুললেন না।

“আমাদের ডাকাডাকি শুনে বসন্তও বোধহয় এসে পড়েছিল ততক্ষণে। বাবার হার্টের প্রবলেম ছিল, তাই আমি আর বসন্ত দেরি না করে তখনই পাশের বাড়ির আরও দু’জনকে ডেকে এনে দরজা ভেঙে ফেলি। কিন্তু তখন কি জানতাম যে ভেতরে... বাবা এভাবে...”। শেষের কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা কেঁপে উঠল অমিতেশের।

“দরজা যে ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, আপনি শিওর?” অমিতেশের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে আরেকবার দরজার দিকে তাকালেন ইনসপেক্টর খান। দরজার ভেতরদিকে ঠিক মাঝখান বরাবর আড়াআড়িভাবে একটাই খিল, বেশ বড় সাইজের। যদিও আপাতত ভাঙা। খিলের হাতলটা ছিটকিনির মতোই, মানে ভেতর থেকে তালা দেওয়ার কোনও সুবিধে নেই। তবে ভেতর থেকে টেনে দিলে বাইরে থেকে খোলারও কোনও উপায় নেই।

“হ্যাঁ। বাবা দরজা-জানালা সব ভেতর থেকে বন্ধ করেই শুতেন। এসি চলত সারারাত।”

খানের মাথার ভেতর শিরাগুলো কেমন যেন দপদপ করে উঠল। লোহার গ্রিল লাগানো জানালাগুলো যে এখনও একইভাবে ছিটকিনি-আঁটা, সেটা ঘরে ঢুকেই চোখে পড়েছিল তাঁর। তাহলে কি...

“স্যার, মর্গের গাড়ি এসে পড়েছে। বডি পাঠিয়ে দেব?” সাব-ইনসপেক্টর দত্তের কথায় হঠাৎ যেন চমক ভাঙল খানের।

“হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।”

“স্যার, বাবাকে, মানে মর্গ থেকে কখন...” একটু নিচু গলায়ই জিগ্যেস করলেন অমিতেশ।

খান বললেন, “সন্ধে নাগাদ পেয়ে যাবেন হয়তো। আপনি বরং দত্তের কাছ থেকে একটু মর্গ ইনচার্জের মোবাইল নম্বরটা নিয়ে রাখুন।”

মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন অমিতেশ। এখন ঘরের ভেতর শুধু ইনসপেক্টর খান আর অজিতেশ ব্যানার্জির মৃতদেহ। বাইরে মর্গের লোকেদের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে, সঙ্গে দত্তের গলা। রামতনু দরজার বাইরে পুলিশের হলদে টেপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে—বডি নিয়ে গেলেই সিল করে দেওয়া হবে পুরো ঘরটা।

কিন্তু এই সবকিছুর বাইরে একগাদা প্রশ্ন যেন ঝোড়ো হাওয়ার মতো বারবার থেমে থেমে আছড়ে পড়ছে খানের মাথার ভেতর। তাঁর সরু চোখ দুটো শিকারী বাঘের মতো কিছু যেন খুঁজছে এদিক-ওদিক। কিছু একটা, কোনও একটা সূত্র—এমন কিছু যা হয়তো চোখে পড়ছে না কারও!

আর তখনই হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল অজিতেশবাবুর স্টাডি টেবিলের নিচটায়। কিছু যেন পড়ে আছে সেখানে। কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন খান। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন—দশ বারোটা আলপিন। কিন্তু পকেট থেকে ছোট একটা চিমটে বের করে একটা পিন তুলতে গিয়েই ধাক্কা খেলেন খান। সবগুলো পিন গায়ে গায়ে লেগে আছে! আরও ঝুঁকে পড়লেন পিনগুলোর কাছে—আর সঙ্গে সঙ্গে যেন মাথার ভেতর বিদ্যুৎ খেলে গেল! রক্ত, হ্যাঁ রক্তই। একটা পিনের মুখে খুব অল্প শুকনো রক্ত লেগে আছে।

খান যা ভাবছেন যদি তা-ই হয় তবে খুনি আর বেশি দূরে নেই!

পিনগুলো স্যাম্পল প্যাকে ভরে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন খান। “রামতনু...”

(২)

“সেদিন থেকে দেখছি, কী অত ভাবছেন স্যার? অজিতেশবাবুর সুইসাইড কেসটা নিয়ে?” খানের কেবিনে ঢুকতে ঢুকতেই প্রশ্নটা করলেন সাব-ইনসপেক্টর দত্ত।

ঘড়িতে এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। একটু আগেই ফরেনসিক রিপোর্টগুলো এসেছে। সেগুলোই নেড়েচেড়ে দেখছিলেন খান। তাঁর চওড়া কপাল জুড়ে চিন্তার রেখাগুলো বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল।

“সুইসাইড? বলছ?” দত্তের কথায় খানের ঠোঁটে বাঁকা হাসির একটা রেখা যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল।

দত্ত ততক্ষণে সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়েছেন। “তাহলে? বন্ধ ঘরের ভেতর অন্য কেউ কীভাবে ঢুকবে? এছাড়া স্যার, ছুরির হাতলে তো অজিতেশবাবুর আঙুলের ছাপও পাওয়া গেছে।”

খানের হাসিটা যেন আরেকটু বাঁকা হয়ে উঠল। “গলার চিরটা ভালো করে দেখেছিলে ভায়া?”

“হ্যাঁ, মানে দেখেছিলাম তো। কেন স্যার?”

“দাঁড়াও, বলছি।” টেবিলের দেরাজ ঘেঁটে একটা ছোট প্লাস্টিকের স্কেল বার করলেন ইনসপেক্টর খান। “নাও, ধরো। মনে করো এটা ছুরি, এবার চালাও দেখি গলায়।”

খানের কথামতো দত্ত স্কেলটা ডানহাতে নিয়ে নিজের গলায় বসিয়ে টান দিলেন, ঠিক যেভাবে কেউ গলায় ছুরি দেবার সময় করে।

“কী, কিছু বুঝলে?”

ঘাড় নাড়লেন দত্ত। “না স্যার।”

“বলছি। তুমি ডানহাতে ছুরি, মানে স্কেলটা ধরে গলায় চালালে, যেভাবে অজিতেশবাবু চালিয়েছিলেন। ঠিক?”

“একদম ঠিক।”

“গলার ওপর কোনদিক থেকে কোনদিকে টানটা দিয়েছিলে? আর কোনদিকে প্রেশার বেশি পড়েছিল?”

গলায় আরেকবার স্কেলটা ঠেকিয়ে একটু ভেবে নিয়ে দত্ত বললেন, “বাম থেকে ডানে টান দিলাম। আর স্বাভাবিকভাবেই প্রেশারটাও বামদিকেই বেশি পড়ল।”

“দারুণ! তাহলে গলার চিরটাও বামদিকেই বেশি গভীর হবে? আর যত ডানদিকে যাবে তত হালকা হয়ে আসবে?”

“হ্যাঁ। সেটাই তো হবার কথা।”

“বাহ্! বেশ!” খাম খুলে একটা ছবি দত্তের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে খান বললেন, “তাহলে এবার অজিতেশবাবুর গলার ছবিগুলো দেখো তো।”

একটা ছবি হাতে নিয়ে দেখতে দেখতেই হঠাৎ যেন চোখদুটো গোলগোল হয়ে উঠল সাব-ইনসপেক্টর দত্তের। “স্যার, এখানে তো...তার মানে...”

“হ্যাঁ দত্ত। তার মানে এটা মোটেই আত্মহত্যা নয়, খুন।” একটু থেমে খান আবার বললেন, “সেদিনই আমার চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। অজিতেশবাবুর গলার ডানদিকে চিরটা বেশি গভীর, আর সেটা বামদিকে যেতে যেতে ক্রমশ হালকা হয়ে এসেছে। অজিতেশবাবু যদি ডানহাতেই ছুরি ধরে থাকেন তাহলে সেটা কখনই সম্ভব নয়। এটা একমাত্র তখনই পসিবল যখন সামনে থেকে কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তি গলায় ছুরি বসায়।”

“মাই গড! আর তারপর ছুরিটা অজিতেশবাবুর হাতে একবার চেপে বসিয়ে দেওয়া হয় যাতে আঙুলের ছাপ পড়ে যায়। কিন্তু স্যার...”

দত্তকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে খান বললেন, “এটাই জিগ্যেস করবে তো যে দরজা-জানালা সব যদি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল তাহলে খুনি বেরোল কীভাবে? আর যদি দরজা দিয়েই বেরোয় তাহলে সেটা আবার ভেতর থেকে বন্ধ করল কে?”

“এগজেক্টলি স্যার। এটা তো তাহলে ‘লকড রুম পাজল’-কেস হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”

“হুম। লকড রুম পাজলই বটে! কিন্তু সেটা আমার চিন্তার কারণ নয়—ওটা তো সেখানে দাঁড়িয়েই সলভ করে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম খুনিও বুঝি হাতের মুঠোয়। কিন্তু এখন এই পোস্টমর্টেম রিপোর্টগুলো হাতে পেয়ে মনে হচ্ছে সব হিসেব যেন ওলোট-পালট হয়ে গেল।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিঠটা চেয়ারে আরেকটু এলিয়ে দিলেন ইনসপেক্টর খান।

টেবিলের ওপর বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়ে দত্ত জিগ্যেস করলেন, “অ্যাঁ! বলেন কী! আপনি সেই লকড রুম মিস্ট্রি সলভ করে ফেলেছেন? খুনি কে স্যার? আর লকড রুম বানালই বা কীভাবে?”

একটু হাসলেন ইনসপেক্টর খান। “দাঁড়াও হে, দাঁড়াও। এই কেস অত সোজা নয়। যে ব্যাটা এত মাথা ঘামিয়ে লকড রুম ক্রিয়েট করে গলায় ছুরি বসিয়েছিল, সে আসলে মরা মানুষের গলা কেটে এসেছে!”

“মানে?” দত্ত যে বেশ ভালো রকমই চমকে গেছেন, তাঁর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

“নাও, এই রিপোর্টটা দেখো।” স্টেপল করা কয়েকটা কাগজ দত্তের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে খান বললেন, “পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, অজিতেশবাবু মারা গেছেন হার্ট ফেইল্যুরে, রাত সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে। আর গলায় ছুরি দিয়ে চির দেওয়া হয়েছে একটার পরে। মানে তখন অজিতেশবাবু অলরেডি মৃত।” একটু থেমে খান আবার বললেন, “কিন্তু হার্টফেলটাও আসল কেস নয়।”

দত্ত রিপোর্টায় বেশ ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিগ্যেস করলেন, “এখানে তো লেখা আছে যে অজিতেশবাবুর শরীরে অ্যাকোনাইট পাওয়া গেছে। তাহলে কি...”

“হ্যাঁ। তাঁর হাতের তালুতেও অ্যাকোনাইটের ট্রেস পাওয়া গেছে। এটা খুব সাংঘাতিক একধরণের বিষ, দুই থেকে তিন মিলিগ্রামেই কাজ হয়। এতে মুখে কোনও গ্যাঁজলা ওঠে না, কিন্তু পেটে যাবার দুই থেকে ছয় ঘন্টার মধ্যে মানুষ হার্ট ফেইল্যুরে মারা যায়।”

“সর্বনাশ!”

“হুম। আমার ধারণা ভুল না হলে খুনি অজিতেশবাবুর স্টাডি টেবিলে রাখা বইয়ের পাতায় ওই বিষ মাখিয়ে রেখেছিল। রামতনুকে একটু আগেই পাঠিয়েছি বইগুলো ফরেনসিকে দেবার জন্যে।” একটু সময় কী যেন ভেবে খান আবার বলতে লাগলেন, “খুনি অজিতেশবাবুর খুব কাছেরই কেউ। বাড়ির লোক। সে জানত যে অজিতেশবাবু প্রতিদিন সন্ধেবেলা কিছুক্ষণ বই পড়েন, আর সে এটাও জানত যে তাঁর আঙুলে থুতু লাগিয়ে পাতা ওল্টাবার বদভ্যাস আছে। আর তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বিষটা লাগিয়েছিল বইয়ের পাতায়, যাতে সহজেই সেটা অজিতেশবাবুর মুখে পৌঁছে যায়।”

“কিন্তু স্যার, একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না, খুনি যদি বিষ দিয়েছিল তাহলে আবার ফিরে এসে পরে গলায় ছুরি বসাতে গেল কেন? ডেথ কনফার্ম করবার জন্যে?”

ঠোঁটে একটা ছোট্ট মুচকি হাসি টেনে উঠে দাঁড়ালেন ইনসপেক্টর খান। “না হে দত্ত, ভুল করছ। খুনি যে একজন সেটা তোমায় কে বলল?”

“মানে আপনি বলতে চাইছেন যে বিষ দিয়েছে সে ছুরি চালায়নি?”

“কেন চালাবে? একবার নিজেই ভেবে দেখো না, ছুরি না চালালে কেসটা কী দাঁড়াত। ন্যাচারাল ডেথ ডিউ টু কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। কারণ পেটে অ্যাকোনাইট আছে সেটা তো তখন ধরা পড়বে যখন পোস্টমর্টেম হবে। কিন্তু সাধারণ একটা হার্ট ফেইল্যুরের কেসে এসব কিছু হবার প্রশ্নই ওঠে না। ডাক্তার আসবে, খালি চোখে একটু বডি নেড়েচেড়ে হার্ট ফেইল্যুরে মৃত্যু বলে একখানা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে চলে যাবে। ব্যস, ল্যাটা চুকে যেত! চারজনে মিলে কাঁধে তুলে ‘বলো হরি, হরিবোল’ হাঁকতে হাঁকতে শ্মশানে নিয়ে ফুঁকে দিত। না থাকত লাশ, না কোনও প্রমাণ, না কোনও সন্দেহের কারণ। আস্ত একটা জলজ্যান্ত মার্ডার কেস ন্যাচারাল ডেথ হিসেবেই হাওয়ায় উড়ে যেত। পুলিশও আসত না আর পোস্টমর্টেমও হতো না।

“কিন্তু গলায় ছুরি দেওয়ায় পুরো কেসটাই কেঁচে গেল। যেটা ন্যাচারাল ডেথ হবার কথা ছিল সেটা হয়ে গেল সুইসাইড... পুলিশ এল, পোস্টমর্টেমও হল আর কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে অ্যানাকোন্ডা বেরিয়ে পড়ল।”

“আরিব্বাস!” মাথার পুলিশি টুপিটা খুলে বার দুয়েক মাথা চুলকে নিয়ে দত্ত বললেন, “মানে দুজন লোক একই দিনে অজিতেশবাবুকে খুন করার প্ল্যান করল, আলাদা আলাদাভাবে। কেউই কারও খবর জানত না! কিন্তু স্যার লকড রুমটা যে ছুরি-চালানো খুনিই বানিয়েছিল, সেটা কীভাবে বুঝলেন?”

“তোমার কী মনে হয়?” টেবিলের ভর দিয়ে দত্তের দিকে সামান্য ঝুঁকেই প্রশ্নটা করলেন খান।

“হুমমম, বুঝেছি। কারণ বিষ যে দিয়েছিল সে জানত অজিতেশবাবু ন্যাচারাল ডেথে মারা যাবেন, তাই লকড রুম তৈরির কোনও প্রয়োজনই তার ছিল না। কিন্তু যে ছুরি দিয়ে গলা কাটতে গিয়েছিল, সে চাইছিল ঘটনাটা সুইসাইড বলে প্রমাণিত হোক। আর তাই সে লকড রুম ক্রিয়েট করল।”

“একদম ঠিক বলেছ। আর মজার ব্যাপার কী জানো, ছুরিটা কে চালিয়েছে সেটা আমি জানি।”

“জানেন! কে? বাড়ির কেউ?” আপনা থেকেই যেন পিঠটা টানটান হয়ে গেল সাব-ইনসপেক্টর দত্তের। “চলুন, আজই অ্যারেস্ট করি ব্যাটাকে।”

“হ্যাঁ, বাড়ির লোকই।” পিঠটা সোজা করে বসলেন খান। “না, তবে এখনই ধরব না। আরেকটু খেলিয়ে নিই! ওর ওপর নজর রাখার জন্যে লোক লাগিয়ে রেখেছি, পরে সময় মতো দেখে নেব। কিন্তু আগে আসল খুনিকে ধরি, যে বিষ দিয়েছিল। ওটাকে পেলেই একসঙ্গে সব রহস্য খোলসা করে দেব। লকড রুম পাজলটাও।”

কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে দত্ত বললেন, “সে তো স্যার বিষের খোঁজ করলেই বিষধরকেও পাওয়া যাবে।”

“হুম। ঠিকই বলেছ। এই দায়িত্বটা তাহলে তোমাকেই দিলাম।”

মুখে একচিলতে হাসি টেনে উঠে দাঁড়ালেন সাব-ইনসপেক্টর দত্ত। “জো হুকুম স্যার। আমি এক্ষণই লেগে পড়ছি।”

(৩)

দিন তিনেক পর সকালবেলা হঠাৎ বেশ হন্তদন্ত হয়েই খানের কেবিনে এসে ঢুকলেন দত্ত। হাতে একটা পাতলা ফাইল।

“কী খবর দত্ত? মুখের জেল্লা দেখে মনে হচ্ছে কিছু জব্বর জিনিস পেয়েছ!”

“ঠিকই ধরেছেন স্যার।” একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে দত্ত বললেন, “আপনার ধারণা একদম ঠিক ছিল। বিষের পেছনে বাড়ির লোকই আছে।”

“তা গুণধরটি কে?”

“খুলেই বলছি স্যার।” হাতের ফাইলটা টেবিলে রেখে দত্ত আবার বলতে লাগলেন, “অ্যাকোনাইটের মেইন সোর্স হল মঙ্কসহুড নামে একধরণের বেগুনি-ফুল-ফোটা গাছ। মূলত পাহাড়ি অঞ্চলেই হয়। গ্রামে-গঞ্জে আদিবাসীরা এককালে শিকারের কাজে এই বিষ ব্যবহার করত, এখনও করে হয়তো। কিন্তু সরাসরি গাছের শেকড়-বাকড় থেকে গ্রাম্য পদ্ধতিতে এই বিষ তৈরি করলে তাতে কিছু ইমপিউরিটি থেকে যায়। কিন্তু ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে অজিতেশবাবুর পেটে যেই বিষ পাওয়া গেছে তা একদম পিওর, মানে কেমিক্যালি রিফাইনড।”

“ভেরি গুড! তার মানে যে বিষ দিয়েছে সে কোনও ল্যাব বা দোকান থেকেই এটা কিনেছে।”

“এগজেক্টলি স্যার। যদিও এই অ্যাকোনাইট কিছু কিছু হোমিওপ্যাথিক ওষুধে অল্প পরিমাণে ব্যবহার হয়, কিন্তু তাতে অন্যান্য কমপাউন্ড যেমন ইথানল, এসব মেশানো থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটাও ছিল না। বিষটা একদম পিওর ফর্মে ইউজ করা হয়েছে।”

“তাহলে সেটা পাওয়াও নিশ্চয়ই যথেষ্ট কঠিন হবে?”

“হ্যাঁ স্যার। আমাদের রাজ্যে এটা শুধুমাত্র স্টেট মেডিক্যাল কলেজের পয়জন কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট থেকেই পাওয়া সম্ভব।”

চোখদুটো সরু হয়ে উঠল খানের। “কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই এমনি এমনি যাকে-তাকে দিয়ে দেবে না?”

“রাইট স্যার। শুধুমাত্র কোনও সরকারি ডাক্তার যদি নিজের লেটারহেডে লিখিতভাবে ঠিক-ঠাক কারণ দেখিয়ে অ্যাপ্লাই করেন তাহলেই দেওয়া হয়।” শেষের কথাগুলো বলতে বলতেই ফাইল থেকে একটা কাগজ বের করে ইনসপেক্টর খানের দিকে এগিয়ে দিলেন দত্ত। “এই যে স্যার, এটাই সেই অ্যাপ্লিকেশন।”

“ডাঃ মৈত্রী ব্যানার্জি!” পুরো কাগজটায় আগাগোড়া একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন খান। “আচ্ছা দত্ত, এই মৈত্রীদেবী কি নিজেই গেছিলেন এই অ্যাপ্লিকেশন দিতে আর বিষ আনতে?”

“না স্যার। সুজিত সরকার নামে তাঁর একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট নাকি গেছিলেন, প্রায় তিন সপ্তাহ আগে। ১২-ই জানুয়ারি।”

খান কথাগুলো ঠিক শুনতে পেলেন কি-না বোঝা গেল না। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে, কপালের ভাঁজগুলো আরও গাঢ় হয়ে উঠল।

“কিছু ভাবছেন স্যার?” বেশ একটু নিচু গলায়ই বললেন দত্ত। “বললে মৈত্রী ব্যানার্জির নামে একটা ওয়ারেন্ট বের করে ফেলি?”

“হু... ম... না, এখনই নয়।”

“কিন্তু স্যার...”

“হিসেবটা মিলছে না দত্ত। একবার ভেবে দেখো তো যেই খুনি এত বুদ্ধি খাটিয়ে প্ল্যান করে একটা মার্ডারকে প্রায় ন্যাচারাল ডেথ বানিয়েই ফেলেছিল, সে কি এত বোকা হতে পারে যে নিজের নামের লেটারহেড দিয়ে লোক পাঠিয়ে বিষ আনাবে? তাও আবার মেডিক্যাল কলেজ থেকে! যেখানে কে বিষ নিয়েছে সেটা ডিটেক্ট করা অনেক অনেক সোজা। সেই তুলনায় খুনি যদি কোনও গ্রামটাম থেকে এই বিষ জোগাড় করে আনত তাহলে বাপের জন্মেও আমরা খুঁজে বের করতে পারতাম না।” একটু থামলেন খান। একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে আবার বললেন, “ভায়া হে, আমার সিক্সথ সেন্স বলছে মৈত্রী ব্যানার্জিকে কেউ ইচ্ছে করে ফাঁসাতে চাইছে, তাই এমন সুন্দরভাবে প্রমাণগুলো ছড়িয়ে রেখেছে।”

“হুম, কথাটা ভুল বলেননি স্যার।”

“আচ্ছা, মেডিক্যাল কলেজের ওই পয়জন সেকশনে সিসিটিভি আছে নিশ্চয়ই? সেই সুজিত সরকার নামক বস্তুটির চেহারা দেখা যাচ্ছে কি?”

“না স্যার, আমি ফুটেজ চেক করেছি। লোকটি এমনভাবে হুডি পরেছিল যে মুখ দেখা যাচ্ছে না।” একটু সময় চুপ করে থেকে দত্ত আবার বললেন, “কিন্তু স্যার লোকটার ডিটেইলস আছে। পয়জন সেকশনের রেজিস্টারে তার নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর আর আধার কার্ডের ফটোকপিও আছে।”

“খোঁজ নিয়ে দেখেছ? ভুঁয়ো নিশ্চয়ই?”

“না স্যার, সেটাই তো আশ্চর্যের। আমি লোক লাগিয়ে খোঁজ নিয়েছি, সেই ঠিকানায় সত্যিই সুজিত সরকার বলে একজন আছে। এমনকি আধার কার্ডটাও আসল!”

চোখদুটো হঠাৎ যেন চকচক করে উঠল খানের। “বলো কী হে! এত বছরের পুলিশ জীবনে এই প্রথম শুনলাম কোনও ঠিকানা ভুল নয়!”

“কিন্তু স্যার, লোকটা মোটেই মৈত্রী ব্যানার্জির কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট নয়, বরং একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে।”

“হুম! চলো তবে এই সুজিত ভায়ার সঙ্গে একটু মোলাকাতটা সেরেই আসা যাক, নইলে কেসটা যে বড্ড ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে।”

(৪)

“সুজিত সরকার, ১৭/২, রামনগর-৩ (প্রিয়া ভ্যারাইটিজের উল্টোদিকে)”—জিপ থেকে নামতে নামতে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই একবার ঠিকানাটা আউড়ে নিলেন ইনসপেক্টর খান। নীলচে মত একটা সাধারণ একতলা বাড়ি, বাইরে জংধরা ছোট লোহার গেট। রোদে-বানে অনেকদিন আগেই রং চটে গেছে।

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে একবার দু’পাশটা দেখে নিলেন খান। ডানদিকে ছোট্ট এক টুকরো জায়গা, কয়েকটা গাঁদাফুলের গাছ—এক দুটো ফুলও ফুটে আছে। একপাশে একটা তুলসীর বেদি আর তার উল্টোদিকে, মানে বামদিকে ঘরের দরজা।

কলিং বেল টিপতেই মিনিট দুয়েকের মধ্যে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে দাঁড়ালেন। চোখেমুখে বেশ একটা অপ্রস্তুত ভাব—হঠাৎ ঘরের দুয়ারে পুলিশ এসে দাঁড়ালে যেটা হয় আরকী!

“বলুন।”

“আপনি সুজিত সরকার?” একটু গম্ভীরভাবেই জিগ্যেস করলেন খান।

“হ্যাঁ। কেন স্যার? কিছু হয়েছে?”

“সে তো অনেক কিছুই হয়েছে। আপাতত আপনার সঙ্গে একটু কথা বলার ছিল।”

“আসুন।” ছোট্ট একটা ঢোক গিলেই বললেন ভদ্রলোক।

বসার ঘরটাও বাড়িটার মতোই সাধারণ। একটা নেঁতিয়ে-পড়া সোফাসেট আর মধ্যিখানে একটা চামড়া-ওঠা টেবিল।

হাতের রুল আর মাথার টুপিটা খুলে টেবিলে রাখতে রাখতে খান জিগ্যেস করলেন, “আচ্ছা আপনি ডাঃ মৈত্রী ব্যানার্জি নামে কাউকে চেনেন?”

“না স্যার।” মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক।

“দেখুন কোনও ধরণের মিথ্যে কথা কিন্তু বলবেন না, কারণ এটা খুনের কেস। মিথ্যে বললে নিজেই ফেঁসে যাবেন। তাই একটু ভেবেচিন্তেই বলবেন।”

“সত্যি বলছি স্যার, ওই নামে কাউকে চিনি না।” মুখটা আস্তে আস্তে শুকিয়ে আসছে ভদ্রলোকের।

“তাহলে মৈত্রী ব্যানার্জির লেটারহেড নিয়ে গত ১২-জানুয়ারি স্টেট মেডিক্যাল কলেজে কেন গেছিলেন? যাইনি বলবেন না যেন, আমরা সেখানে আপনার সাইন করা আধার কার্ডের ফটোকপি পেয়েছি!”

“আমি সত্যি বলছি স্যার, মা কালীর দিব্যি! আমি ১২-ই জানুয়ারি মেডিক্যাল কলেজে যাইনি। আমি তো সেদিন সারাদিন রামকৃষ্ণ মিশনে ছিলাম। স্বামীজীর জন্মদিনের উৎসবে। চাইলে আপনি সেখানকার মহারাজকে জিগ্যেস করে দেখতে পারেন।”

একমুহূর্তের জন্যে একটা ছোট্ট মুখ চাওয়াচাওয়ি হয়ে গেল খান আর দত্তের মধ্যে। এবার দত্ত বেশ একটু কড়া গলায় জিগ্যেস করলেন, “তাহলে আপনার সাইন করা আধার কার্ডের কপি সেখানে গেল কীভাবে? দেখুন তো” পকেট থেকে একটা কাগজ বের করতে করতে, “এটা আপনার সাইন নয়?”

কাগজটার দিকে দেখতে দেখতে মুখটা যেন আরও শুকিয়ে গেল ভদ্রলোকের। “হ্যাঁ...মানে... সাইনটা তো আমারই। কিন্তু আমি...”

“কী কিন্তু! দেখুন সত্যি কথা বের করার কিন্তু অনেক রাস্তা আছে পুলিশের হাতে।” শেষ কথাগুলো বেশ একটু জোরেই বললেন দত্ত।

“একটু দাঁড়াও দত্ত।” পকেট থেকে তিনটে পাসপোর্ট সাইজ ছবি করে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিলেন ইনসপেক্টর খান। “দেখুন তো এদের কাউকে চেনেন কি-না?”

মুহূর্তে চোখদুটো গোলগোল হয়ে উঠল তাঁর। উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠলেন ভদ্রলোক, “চিনি স্যার... এই... এই একেই তো...”

খানের ঠোঁটের কোণ ছুঁয়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠা বাঁকা হাসিটা চোখ এড়াল না দত্তের। এই হাসির একটাই মানে—‘কেস সলভড!’

(৫)

টিং-টং!

“আসছি।” সাত সকালে দরজা খুলতেই হঠাৎ ইনসপেক্টর খান আর সাব-ইনসপেক্টর দত্তকে দেখে বেশ ভালোই চমকে গেলেন মৈত্রী। “আপনারা!... আসুন।”

“হ্যাঁ। একটু বাড়ির সবাইকে ডাকবেন কাইন্ডলি?”

মৈত্রী ওদের বসতে বলে ঘরের ভেতর চলে গেলেন অমিতেশকে ডাকতে। একটু পরেই অমিতেশ বেরিয়ে এলেন আর বাইরের দিকের একটা ঘর থেকে বসন্তও এসে ঢুকল।

“আসুন, বসুন সবাই।”

“কিছু জরুরি দরকার ছিল কি?” সোফায় বসতে বসতে জিগ্যেস করলেন অমিতেশ।

“না। আজ আর কোনও দরকার নেই। আজ শুধু একটু গল্প শোনাতে এলাম।” খানের মুখে একটা হালকা হাসি।

“কিন্তু আমাকে যে বেরোতে হবে স্যার। আমার হাসপাতালের সময় হয়ে যাচ্ছে।” কথাটা বলতে বলতে প্রায় উঠেই পড়েছিলেন মৈত্রী, খান থামিয়ে দিয়ে বললেন, “সরি মেডাম, আজ যে একটু লেট্ হবে আপনার। কিছু করার নেই।”

“মানে?” ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল মৈত্রীর। “শুধু শুধু একটা সুইসাইড কেস নিয়ে আর কত জলঘোলা করবেন আপনারা? বাবা যেদিন মারা গেলেন সেদিন একবার আমাদের সবার আঙুলের ছাপ নিলেন, ব্লাড স্যাম্পল নিলেন, তারপর আবার একদিন এক হাবিলদারকে পাঠিয়ে বাবার ঘর থেকে সব বইপত্র তুলে নিয়ে গেলেন! আজ আবার বলছেন আমি হাসপাতালে যেতে পারব না! ডিসগাস্টিং!”

একটু সোজা হয়ে বসলেন খান। টিকালো নাকের ওপর বার দুয়েক আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, “সুইসাইড যে সেটা এত শিওর হলেন কীভাবে? অজিতেশবাবুর খুন হয়েছিল মেডাম।”

“খুন!” গলাটা হঠাৎ যেন কেমন নেঁতিয়ে গেল মৈত্রীর।

“আজ্ঞে, খুন। তাই দয়া করে একটু কোঅপারেট করুন—কথা দিচ্ছি আজকের পর আর জ্বালাতে আসব না।”

ডাঃ মৈত্রীর মুখ দিয়ে আর কোনও কথা সরল না। অমিতেশ টেবিলের ওপর বেশ খানিকটা ঝুঁকে উত্তেজিত গলায় বলে উঠলেন, “খুন! কিন্তু কীভাবে? কে করল?”

“সেই গল্পই তো বলতে এলাম স্যার!” ডানহাতটা সোফার হাতলে ছড়িয়ে দিয়ে বেশ একটু পিঠ এলিয়ে বসলেন ইনসপেক্টর খান। “তাহলে গল্প শুরু করা যাক? কী বলো দত্ত?”

“আলবৎ স্যার। আমি তো কবে থেকে মুখিয়ে আছি শোনাবার জন্যে।”

“বেশ! প্রথমেই বলে রাখি এই কেসে একটা দারুণ লকড রুম সিচুয়েশন আছে, যার জন্যে এটাকে সহসা খুন বলে ভাবাই যায় না। দরজা-জানালা সব ভেতর থেকে বন্ধ, বিছানায় গলা-কাটা অবস্থায় পড়ে আছেন অজিতেশবাবু। ডানহাতের পাশে রক্তাক্ত ছুরি। প্রথম দেখায় যে কেউ আত্মহত্যাই ভাববে। আমারও তাই মনে হয়েছিল, যদিও অজিতেশ ব্যানার্জিকে যদ্দূর চিনতাম তাতে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন। তাই একবার নিজে বডিটা খুঁটিয়ে দেখতে গেলাম, অমিতেশবাবুও তো সঙ্গে ছিলেন তখন।”

অমিতেশ ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন।

“আর তখনই হঠাৎ জিনিসটা চোখে পড়ে। গলার চিরটা ডানদিকে বেশি গভীর আর বামে ক্রমশ হালকা হয়ে গেছে। কিন্তু যেকোনও মানুষ ডানহাতে ছুরি ধরে গলায় চির দিতে গেলে হবার কথা উল্টো। মানে বামে বেশি গভীর আর ডানদিকে ক্রমশ হালকা। ব্যস, মাথার ভেতর পুলিশি পোকাগুলো একেবারে চাগাড় দিয়ে উঠল। বুঝতে পারছিলাম, খুনি খুব বুদ্ধি করে একেবারে গোয়েন্দা উপন্যাসের কায়দায় একটা লকড রুম ক্রিয়েট করেছে, যেটা ভাঙতে না পারলে কিছুতেই এগোনো যাবে না।

“সারাটা ঘরের আনাচে-কানাচে চোখ বুলাতে লাগলাম, যদি কিছু একটা ক্ল্যু, কিছু একটা লুপ-হোল চোখে পড়ে যায়! আর তখনই হঠাৎ চোখ গেল অজিতেশবাবুর স্টাডি টেবিলের নিচটায়। দশ-বারোটা আলপিন পড়ে আছে। কিন্তু তুলতে গিয়ে দেখি সেগুলো গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে, ঠিক যেমনভাবে চুম্বকের গায়ে লোহা লেগে থাকে। আর যায় কোথা! সঙ্গে সঙ্গে আমার টনক নড়ল, একেবারে জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল রাত্তিরবেলা কী ঘটেছে এই ঘরে।” দম নেওয়ার জন্যেই যেন একটু থামলেন খান। দত্ত প্রায় শ্বাস আটকে তাকিয়ে আছেন খানের দিকে, লকড রুমের পুরো ব্যাপারটা শোনার জন্যে।

খান আবার শুরু করলেন, “চুম্বক। খুব পাওয়ারফুল একটা চুম্বক ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা জোগাড় করা খুব কঠিন কিছু নয়, গাড়ির পার্টসে বা কলকারখানায় একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়। অজিতেশবাবুর দরজার খিলটা ছিল আড়াআড়িভাবে লাগানো, কিন্তু আলগোছেই খোলা যেত। মানে জংধরা গোছের টাইট নয়। এবার খুনি করল কী হাতে সুন্দরভাবে রবারের দস্তানা পরে নিয়ে চুম্বক হাতে এসে দাঁড়াল দরজার বাইরে। বাইরে থেকে আড়াআড়িভাবে খিল বরাবর চুম্বকটা লাগিয়ে টান দিল—ব্যস, খুলে গেল দরজা! এবার বাকি কাজ তো সোজা, ঘুমন্ত অজিতেশবাবুর গলায় ছুরি ধরে গলা কাটতে আর কতক্ষণ! কিন্তু গোলমালটা হল তারপরেই। খুনি ঘরে ঢুকে গলা কাটবার সময় চুম্বকটা অজিতেশবাবুর স্টাডি টেবিলে রাখল, কিন্তু সে জানত না যে সেখানে একপাশে কিছু আলপিনও রাখা আছে। ব্যস, আলপিনগুলো এসে লেগে গেল চুম্বকের গায়ে।

“কিন্তু অন্ধকারে সেটা খুনি দেখতে পেল না। বেরোবার সময় যখন চুম্বকটা তুলতে গেল, একটা আলপিন ফুটে গেল হাতে আর সঙ্গে সঙ্গে রিফ্ল্যাক্স অ্যাকশন হিসেবে চুম্বক হাত থেকে সোজা মাটিতে, আর আলপিনগুলো ছিটকে টেবিলের তলায়। কিন্তু স্কুলে সবাই পড়েছি যে লোহা খুব শক্তিশালী চুম্বকের কাছে এলে নিজেও চুম্বক হয়ে ওঠে, ম্যাগনেটাইজড হয়ে যায়। আর সেটাই হয়েছিল আলপিনগুলোর ক্ষেত্রেও। খুনির কপাল খারাপ যে সেটা পড়বি তো পড় আমার চোখেই পড়ল।

“আমার হাইপোথিসিসটা যে মোটেই ভুল ছিল না সেই প্রমাণও সঙ্গে সঙ্গেই পেয়েছিলাম। একটু খুঁটিয়ে দেখতেই একটা আলপিনের মুখে একটু শুকনো রক্ত চোখে পড়ে যায়। আর কী, হয়ে গেল কেল্লা ফতেহ! রামতনুকে ডেকে তখনই আপনাদের ব্লাড স্যাম্পল নিতে বললাম—যার সঙ্গে ম্যাচ করবে সে-ই খুনি।”

কথাগুলো শুনতে শুনতে যে একজনের মুখটা ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে, সেটা বেশ ভালোভাবেই লক্ষ করছিলেন খান।

“কিন্তু স্যার, খুনি কে?” অমিতেশ জিগ্যেস করলেন।

জবাবটা দিতেই যাচ্ছিলেন খান, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ দরজার দিকে দৌড়ে পালতে গেল বসন্ত—পারল না! রামতনু সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ঝাপটে পড়ে ধরে ফেলল তাকে।

“নিন অমিতেশবাবু, আপনার জবাব খুনি নিজেই দিয়ে দিল।”

“বসন্ত!” অবাক চোখে একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন অমিতেশ আর মৈত্রী। “কিন্তু কেন? তুমি হঠাৎ বাবাকে খুন করতে গেলে কেন?” প্রশ্নটা মৈত্রীই করলেন।

বসন্ত তখন প্রায় খাঁচায় আটকা পড়া কোনও জানোয়ারের মতো হাঁপাচ্ছে। চোখদুটো লাল। একটু সময় চুপ থেকে ফ্যাসফেসে গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “যা করেছি বেশ করেছি। একটা এগারো বছরের বাচ্চাকে যখন চোখের সামনে নিজের বাবার রক্তাক্ত লাশ দেখতে হয় তখন কেমন লাগে, বোঝেন আপনারা?”

হঠাৎ যেন পুরো ঘর জুড়ে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ ছেয়ে গেল। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে খানের দিকে তাকিয়ে থেকে বসন্ত আবার বলতে লাগল, “আমার তখন মাত্র এগারো। আপনজন বলতে কেবল বাবা—মা মারা গেছিল জন্মের সময়ই। এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে, খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন—ঘরের দুয়ার অবধি জল জমে গেছিল। বাড়িতেই ছিল বাবা। হঠাৎ বেশ রাতের দিকে একটা ফোন আসে, একটা বিজনেস ডিল ছিল বাবার। খুব জরুরি একটা ডিল—সেই বৃষ্টিতেই রেনকোট গায়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।” একটা দীর্ঘশ্বাস যেন পাঁজর ঠেলে বেরোতে গিয়েও আটকে গেল বসন্তের বুকেই। “পরদিন সন্ধেবেলা বাবা ফিরল, সাদা চাদরে জড়ানো রক্তভেজা লাশ হয়ে। বুকে-পেটে মোট সাতটে গুলি লেগেছিল।”

খান বেশ একটু নিচু স্বরেই বললেন, “বসন্ত, এটা ভুলো না যে তোমার বাবা একজন কুখ্যাত ড্র্যাগ ডিলার ছিলেন। বেশ কিছু খুনের চার্জও ছিল তার ওপর। সেদিন রাতে তোমার বাবাকে অ্যারেস্ট করতেই গেছিলেন অজিতেশবাবু, কিন্তু অপরপক্ষ আচমকা গুলি চালাতে শুরু করলে...”

বসন্ত যেন কিছুই শুনতে পেল না। তখনও আচ্ছন্নের মতো বলে চলেছে, “খবরের কাগজে ছবি দেখেছিলাম ওই শয়তান অজিতেশ ব্যানার্জির। আমার বাবার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে নিজের প্রোমোশনের রাস্তা সাফ করেছিল হারামজাদাটা! সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, একে না মেরে মরব না। বদলা আমি নেবই!”

এবার উঠে দাঁড়ালেন খান। বেশ একটু শ্লেষের সুরেই বলে উঠলেন, “পারোনি হে, পারোনি! তুমি যখন গিয়ে অজিতেশবাবুর গলা কেটেছিলে, তার প্রায় আধঘন্টা আগেই তিনি মারা গেছেন।”

বসন্ত যেন ঘায়েল বাঘের মতো চোখে তাকাল খানের দিকে। দৃষ্টিতে একটা স্পষ্ট অবিশ্বাসমাখা চাউনি।

খান একবার ধারালো চোখে মেপে নিলেন সবাইকে, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন। “এই কেসটা খুব মজার, বুঝলেন অমিতেশবাবু? একটা খুন, কিন্তু দু’জন খুনি! দু’জনেই আলাদা আলাদাভাবে একই দিনে অজিতেশবাবুকে খুন করবার প্ল্যান করল। অথচ কেউই অন্যজনের খবর জানত না!”

“দু’জন খুনি!” অমিতেশের চোখে বিস্ময়ের গাঢ় রেখা। “একজন তো বসন্ত, তাহলে আরেকজন কে?”

মুচকি হাসলেন খান। “বলছি বলছি, অত অধৈর্য হবেন না। বলতেই তো এসেছি। বসন্ত তো শুধু ডেডবডির গলায় ছুরি চালিয়েছে, মানে লজিক্যালি সে খুনিই নয়। যদিও ইনটেনশন অফ মার্ডারের জন্যে আই.পি.সি ৩০৭ মোতাবেক কিছুদিন জেল খাটতে হবে ওকেও। যাই হোক, এবার তবে আসল খুনির কথায় আসি।”

মৈত্রী যে বারবার ঢোক গিলছেন, সেটা চোখ এড়াল না খানের।

“অজিতেশবাবুর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তাঁর পেটে অ্যাকোনাইট নামে একধরণের বিষ পাওয়া গেছে।” খান আড়চোখে একবার তাকালেন অমিতেশের দিকে। “এই অ্যাকোনাইট বিষটা খুব হেব্বি জিনিস, বুঝলেন! মাত্র দুই থেকে তিন মিলিগ্রাম, মুখে কোনও গ্যাঁজলা ওঠে না। প্রথম প্রথম একটু ডাইরিয়া মতন হয়, মাথা ঘোরে, গা ব্যথা করে আর তারপর দুই থেকে ছয় ঘন্টার মধ্যে মানুষ হার্ট ফেইল্যুরে মারা যায়। কী সুন্দর ব্যাপার না! একবার ভেবেই দেখুন, এই ব্যাটা আহাম্মক বসন্তটা যদি অজিতেশবাবুর গলায় ছুরি না দিত তবে পুরো খুনটাই একটা ন্যাচারাল ডেথ হয়ে যেত। আর আপনিও ধরা পড়তেন না!”

“মানে! কী আবোল-তাবোল বকছেন?” উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন অমিতেশ ব্যানার্জি।

“চেল্লাবেন না অমিতেশবাবু।” বেশ কড়া গলায় একটু টেনে টেনেই কথাগুলো বললেন ইনসপেক্টর খান। “প্ল্যানটা দারুণ ছিল, কিন্তু ওই যে কপাল! কপালদোষে সব মাটি হয়ে গেল। আপনি ভাবতেই পারেননি যে ব্যাপারটা এমন মোড় নিতে পারে। ভেবেছিলেন সকালে দরজা ভেঙে ঢুকবেন, দেখবেন অজিতেশবাবু হার্টফেল করে মারা গেছেন—ব্যস একটা ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করিয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে খই ছিটোতে ছিটোতে শ্মশানে চলে যাবেন। কিন্তু সব এক্কেবারে কেঁচে গেল!”

দত্ত ততক্ষণে উঠে বেশ শক্ত করে চেপে ধরেছেন অমিতেশের হাতটা। থিরথির করে কাঁপতে কাঁপতে সোফায় বসে পড়লেন অমিতেশ। মৈত্রী যেন পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে।

খান আস্তে আস্তে গিয়ে সোফায় বসলেন। ঠিক অমিতেশের মুখোমুখি। “একটা কথা বলুন তো, নিজের স্ত্রীকে কেন ফাঁসাতে চাইছিলেন?”

মৈত্রীর লাল ছলছলে চোখদুটো একমুহূর্তে ফিরে গেল খানের দিকে। খান যেন তাঁর মনের প্রশ্নটা বুঝতে পেরে নিজে থেকেই বলতে লাগলেন, “মৈত্রীদেবী, আপনি যেহেতু একজন ডাক্তার তাই নিশ্চয়ই ভালোভাবেই জানেন যে কেমিক্যালি রিফাইনড অ্যাকোনাইট আমাদের রাজ্যে শুধু স্টেট মেডিক্যাল কলেজের পয়জন কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ইউনিটে পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা শুধু কোনও সরকারি ডাক্তারই পেতে পারেন, এবং তার জন্যে তাঁকে নিজের লেটারহেডে বা কোনও অথেন্টিক কাগজে লিখিত অ্যাপ্লিকেশন দিতে হয়। আপনার স্বামী, অমিতেশবাবু আপনার লেটারহেডে আপনার নামে ভুয়ো অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে যান সেই বিষ আনতে। পরিচয় দেন আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে। কিন্তু সেখানে একটা গোলমাল হয়ে যায়। রিসেপশনিস্ট অমিতেশবাবুর কাছে আই.ডি প্রুফ চেয়ে বসেন, যেটা মোটেই ওঁর প্ল্যানে ছিল না। কিন্তু তখনই অমিতেশবাবুর হঠাৎ মনে পড়ে যে পকেটে সুজিত সরকার বলে একজনের আধার কার্ডের সাইনড ফটোকপি পড়ে আছে—ব্যস, অমিতেশবাবু নিজের নাম সুজিত সরকার বলে সেই ফটোকপিটাই জমা দিয়ে আসেন। রিসেপশনিস্টও আর অত ছবিটবি খেয়াল না করেই কাগজটা জমা নিয়ে অমিতেশবাবুকে অ্যাকোনাইট দিয়ে দেন। তারপর আর কী, বিষটা এনে মাখিয়ে দিলেন অজিতেশবাবুর বইয়ের পাতায়, যাতে পাতা ওল্টাবার সময় আঙুল হয়ে সহজেই বিষ পেটে চলে যায়—খেল খতম!”

মৈত্রীর ভেজা চোখদুটো যেন আরও লাল হয়ে উঠল।

খান অমিতেশের দিকে ফিরে বললেন, “জানেন অমিতেশবাবু, অনেক সময় আউট অফ সিলেবাস প্রশ্ন এলে বাচ্চারা ভড়কে গিয়ে ভুলভাল উত্তর লিখে আসে, আপনিও ঠিক তেমনই আউট অফ প্ল্যান কিছু সিচুয়েশনের কারণে ধরা পড়ে গেলেন। প্রথমত বসন্তের ব্যাপারটা আপনার কাছে সম্পূর্ণ সারপ্রাইজ ছিল। আর দ্বিতীয়টা হল আধার কার্ডের ব্যাপারটা। রিসেপশনিস্টের সামনে হঠাৎ চাপ খেয়ে গিয়ে আপনি সুজিত সরকারের আধারকার্ডটা দিয়ে এলেন। আর সেটাই ফাঁসিয়ে দিল। সুজিত সরকার আপনার ছবি দেখামাত্রই চিনে ফেলেছিলেন। ভদ্রলোক সেদিন সকালেই আপনার অফিসে এসেছিলেন একটা ফ্ল্যাট বুক করবার জন্যে, আর তখন নিজের আই.ডি প্রুফের একটা কপি আপনাকে দিয়ে গেছিলেন। মেডিক্যাল কলেজে রিসেপশনিস্ট যখন প্রুফ চাইলেন, তাড়াহুড়োয় সেটাই বের করে ধরিয়ে দিলেন। কী, ভুল বলছি না তো?”

অমিতেশ তখনও একইভাবে মাথা নুইয়ে বসে আছেন। কোনও জবাব দিলেন না।

“আচ্ছা, নিজের স্ত্রীকে কেন ফাঁসাতে চাইছিলেন সেটা নাহয় না-ই বললেন—আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, আপনারা বুঝুন গে; কিন্তু অজিতেশবাবুকে কেন মারলেন সেটা যে বলতেই হবে। নইলে এই দত্তবাবুর কিন্তু আবার বেজায় মাথা গরম, কথায় কথায় রুল উঁচিয়ে পেটাতে শুরু করেন।” শেষের কথাগুলো বলতে বলতে একবার আড়চোখে দত্তের দিকে তাকিয়ে হাসলেন খান।

“প্রোমোটিং বিজনেসের জন্যে আমার অনেকগুলো টাকা দরকার ছিল স্যার।” অমিতেশের গলার কাঁপন এখনও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। “নতুন একটা অ্যাপার্টমেন্ট শুরু করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিছুই টাকা ছিল না হাতে। বাবাকে বলেওছিলাম যে ফ্ল্যাট বুকিং শুরু হলে কিছুদিনের মধ্যেই ফিরিয়ে দেব। অনেকবার বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু...”

“কিন্তু উনি দেননি আর তাই নিজের বাবার মুখেই বিষ ঢেলে দিলেন! ধন্যি সন্তান বটে!” পেছন ফিরে খান বললেন, “রামতনু, নিয়ে যাও এদের। ভ্যানে তোলো নিয়ে দুটোকেই।”

মৈত্রী তখনও পুতুলের মতো স্থির হয়ে বসে আছেন সোফায়। রামতনু বসন্ত আর অমিতেশকে নিয়ে দরজার দিকে এগোতে লাগল, সঙ্গে সাব-ইনসপেক্টর দত্তও।

“জানি না, আজ অজিতেশবাবু বেঁচে থাকলে তাঁর নিজের ছেলের ওপর ঘেন্নাটা বেশি হতো না আমাদের ওপর গর্বটা!” স্বগতোক্তির মতোই যেন দীর্ঘশ্বাস-মাখা কথাগুলো বেরিয়ে এল ইনসপেক্টর খানের গলা ঠেলে। শুধু দত্ত ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না।

( কৃতজ্ঞতা স্বীকার : ডাঃ স্বাগতা দত্ত, পাঞ্চালী পালিত )