মায়াং-এর পুঁথি - প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

অলংকরণ - পার্থ মুখার্জী

সকালে বেড়াতে এসে, পাহাড়ের ঢালে গড়াতে গড়াতে এ সে কোথায় এলো? চারদিকে কুয়াশার চাদরে মোড়া পাহাড়শ্রেণী তাকে ঘিরে আছে। চুড়োয় চুড়োয় আটকে থাকা দলছুট কিছু মেঘ বেশির ভাগ জলকণা মাটিতে ফেলে দিয়ে তাদের কালো রঙ হারিয়ে, জোয়ান থেকে বৃদ্ধ অর্থাৎ সাদা হয়েছে। পাহাড়গুলোর চুড়ো থেকে জলপ্রপাতেরা প্রবল আওয়াজ তুলে ঝাঁপ দিচ্ছে উপত্যকার বুক চিরে এঁকে-বেঁকে বয়ে যাওয়া উপল-ব্যথিত পাহাড়ি নদীতে। কী অদ্ভুত জায়গা! একটু আগেই তো সকালের তরুণ রোদ মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে গাছের পাতায় পাতায় নাচছিল, দুপর না হয়ে বিকালটা নেমে আসে কী করে? নাকি সে এতটাই মুগ্ধ ছিল যে কখন দুপুর হয়েছে বুঝতেই পারেনি?

বিকেলের হাল্কা আলো চুপি চুপি সরে যেতে লাগলো। আকাশ আর পাহাড়ের চুড়োগুলো থেকে বোতল বোতল কালো কালি চারদিকে ছড়াতে ছড়াতে ভয়ঙ্কর দর্শন পাখিগুলো ট্যাঁ ট্যাঁ করে নেমে আসছিল সুমনের চারপাশে। চারদিকে কালো অন্ধকার যেন তাকে গিলে খেতে আসছে। পাহাড়ি নদীর স্রোতের সোঁ-সোঁ আওয়াজ আসছে। নিজেকে বাঁচাতে সে দৌড়াতে লাগলো সেই দিকে। কোথা থেকে যেন আবছা আলো আসছে। কাছে আসতেই সে দেখে নদীর ওপারে পাহাড়শ্রেণীর সবচাইতে উঁচু চুড়োতে এখন আলো জ্বলছে বেশ অনেকগুলো। একসাথে কেউ কি এতোগুলো উনুন জ্বালায়? তবে কি ওখানে কোনও তান্ত্রিকের সাধনা শুরু হয়েছে? এইরকম কিছু অনেক আগে সুমন পড়েছে তন্ত্রসাধনার কোনও বইতে। সবেমাত্র সে এই কথা ভাবছে, ঠিক সেই সময় যা সে দেখলো তাতে গা শিউরে উঠলো। তবে কি ওখানে কোনও তান্ত্রিকের সাধনা শুরু হয়েছে?

এমনসময় হঠাৎ যা ওর নজরে এল তাতে গা শিউরে উঠলো। দীপশিখার সারির ঠিক মাঝখানের দুটি দীপ একটু ওপরে উঠেই আনুভূমিকভাবে একে অন্যের বিপরীত দিকে সরে গেল। এর পর দুটি দীপই এক সাথে প্রায় সাত আট ফুট সিধা ওপরে উঠে আবার পরস্পরের দিকে এগিয়ে এসে খুব কাছাকাছি চলে এল। মনে হল যেন একটা সাত আট ফুটের মানুষ দুটো দীপ জমি থেকে দুই হাতে তুলে নিয়ে ওঠাল তার মাথার ওপর রাখবে বলে। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না।

বাকি দীপগুলোও ঠিক সেইরকম ভাবে উঠে এল তবে চার পাঁচ ফুটের মত। এই রকম প্রায় সাত জোড়া দীপ দেখা যাচ্ছে। সামনের দীপজোড়া সাত আট ফুট উঁচুতে। তার পিছের দীপজোড়াগুলো ক্রমান্বয়ে একটু একটু করে কম উচ্চতার। সব চাইতে পেছনের দীপজোড়া মাটি থেকে প্রায় তার উচ্চতায়।

সেই তন্ত্র-সাধনার বইতে যখন তান্ত্রিক তাঁর ক্রিয়া শুরু করেন তখন এই রকমেরই কিছু অনুষ্ঠানের কথা লেখা আছে বলে আবছা আবছা মনে পড়ছে তার। জ্বলন্ত চোদ্দ প্রদীপের নড়াচড়া দেখতে-দেখতে, সে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল তার মনে আনতে যে এর পর সেই বইটাতে আর কী লেখা ছিল। যদি ধরে নেওয়া যায় যে এগুলো তান্ত্রিকের ক্রিয়া তাহলে এরা দলে মোট সাতজন আর প্রতেকের মাথায় দুটি করে দীপ। সামনে সাত আট ফুট লম্বা কাপালিক আর তার পেছনে তার চেলারা। এক জন ছাড়া বাকিরা সবাই চার থেকে পাঁচফুটের। যারা চার পাঁচ ফুটের তারা হয়ত পূর্ণবয়স্ক। কিন্তু সবার শেষে যে আছে সে হয়ত তারই মতো কিশোর। হয়ত কোনও তান্ত্রিক ক্রিয়ার জন্যই তার বয়েসি ছেলেটি ওখানে আছে।

হঠাৎ সেই তন্ত্রসাধনার বইটার একটা পাতা যেন চোখের সামনে ভেসে এল। আর সেটা মনে হতেই গায়ের সব লোম শিউরে উঠলো। ব্যাপারটা এইরকমও হতে পারে--- ওই পাহাড়ে এক কাপালিক আর তার চেলা- চামুণ্ডারা তান্ত্রিক ক্রিয়া শুরু করবার বিধান অনুযায়ী মাথায় জোড়া দীপক নিয়ে একসারিতে দাঁড়িয়েছে। সেই সারিতে সবার শেষে আছে মাথায় দীপক নিয়ে তার বয়েসি এক কিশোর যাকে সম্মোহিত করে রাখা হয়েছে নরবলির জন্য। হ্যাঁ এইবার সে শতকরা একশো ভাগের বেশিই নিশ্চিত যে তন্ত্রসাধনার সেই বইটাতে তো এইরকমই কিছু লেখা ছিল। হঠাৎ ওইপার থেকে একপাল শেয়াল, কেঁদে ওঠার মত করে খুব জোরে উঁ উঁ উঁ করে, ডেকে উঠলো। সেই শুনে খাদের ধার থেকে কর্কশ আওয়াজে, “ট্যাঁ, ট্যাঁ ট্যাঁ” ডাক দিয়ে একটা বড় পাখি উড়ে গেল নদীর দিকে। এর আগে অনেকক্ষণ ধরে টুই টুই করে একটা রাতজাগা পাখি ডাকছিল। ভয় পেয়ে সেও এবার চুপ করে গেল। একটা কিছু যে নিষ্ঠুর কাণ্ড হতে যাচ্ছে তা এরাও টের পেয়েছে। এবার পাহাড়ের দিকে সে নজর ফেলতেই দেখে যে সেই কাপালিকের দল এবার কিশোরটিকে তাদের মাঝে রেখে, বেশ দ্রুত পদক্ষেপে একসারিতে পাহাড় থেকে নিচে নামছে। নিচে নামলেই তো খরস্রোতা নদী। তবে কি নদীতেই তাকে স্নান করিয়ে সেখানেই নরবলি দেওয়া হবে? এরপর মুণ্ডহীন বাকি ধড় ভাসিয়ে দেবে খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর জলে? মোটামুটি সবার আবছা অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু একী? এই কিশোরটি হুবহু তার মত দেখতে কেন? সে একবার নিজের গায়ে হাত বোলাতে গিয়ে দেখে এটা তো আসলে সে, সম্মোহিত থাকার জন্য সে ঠিক বুঝতে পারেনি। তাকে ঘিরে আছে ভীষণ দর্শন কাপালিকেরা আর তাদের একজনের হাতে একটা বেশ বড়ো বলির খাঁড়া আর একজনের হাতে একটা বিশাল আকারের হাড়িকাঠ। সে এইবার সত্যি ভয় পেয়ে, চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল বাবা আর মাকে। কিন্তু তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না কেন? সে আরো জোরে আওয়াজ করবার চেষ্টা করল কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এইজন্য হয়তো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। সে একটা প্রাণপণ শেষ চেষ্টায় তাকে ধরে রাখা কাপালিকটাকে মারল সজোরে এক কুংফু স্টাইলের লাথি। কিন্তু নিজে সামলাতে না পেরে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার সময় তার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। গাঢ় অন্ধকার রুম আর তার চারপাশ। চোখ ভাল করে কচলে সে দেখল যে সে হোটেল মেন্ডাবাড়িতে।

বিকেল থেকে বেতগুড়ির আকাশের মুখভার হয়ে আছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। এমনটা চলতে থাকলে যে কালকের রিম্বিক ঝর্ণাতে তাদের পিকনিকের প্রোগ্রাম বাতিল করতে হবে, সেটা মা বাবা দু’জনেই বলছিলেন। আগের থেকে মা বাবাকে অনেক টানা হেঁচড়া করেছে পাহাড় আর জঙ্গলঘেরা এই ডুয়ারসে আসবার জন্য। মাধ্যমিক পরীক্ষাটা শেষ করেই সেজন্য সে মা বাবার সাথে আসতে পেরেছে এই সুন্দর জায়গাটায়। বৃষ্টি যেন এই এই সুন্দর জায়গাটাকে মন ভরে দেখতে বাধ না সাধে। মা বাবা সুমনকে তার খামখেয়ালী সময়ের সাথে স্বাধীনভাবে চলতে দিয়ে পাশের রুমেই আছে। ভ্যাগিস স্বপ্ন দেখতে দেখতে শেষটায় সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠেনি। নইলে মা বাবা দুজনের ঘুম ভেঙ্গে যেত আর তারা এই ঘরের দরজায় নক করা শুরু করে দিতেন আর সব শুনে নিশ্চয় তার ট্যাবটা কেড়ে নিয়ে চলে যেতেন। আজ সন্ধ্যেতে সে একটা অন্যায় কাজ করেছে। মা বাবা রুমে ছিলেন না। বাবার খোলা ব্রিফকেসে একটা তালপাতার লম্বা পুঁথি সে না বলে নিয়ে এসেছে তবে উনি ফিরে আসার আগেই আবার যেখানে ছিল রেখে আসবে ভেবেছিল। সাধারণত পুঁথিতে পুজোর মন্ত্র থাকে। এই পুঁথি থেকে সেই মন্ত্র দেখে সে সুর লাগিয়ে প্রার্থনা করবে বৃষ্টিদেবতার কাছে যাতে কাল যেন বৃষ্টি না হয়। শব্দের মানে না বুঝেও সেগুলো কিছুক্ষণ পড়লে কে যেন তার থেকে সুর বার করিয়ে নেয়। পুঁথিটি বাংলা হরফে লেখা হলেও তার কথাগুলো বোঝবার উপায় নেই। একবার পড়েই সে ঠিক করেছিল একটু আগে গুম্ফাদাড়াতে গিয়ে গুম্ফার লামারা যে সুরে তাদের পুঁথি থেকে পড়ে পুজো করছিল ও সেই সুরেই এই পুঁথির মন্ত্রগুলো গাইবে। এরপর সে একটা হরর ফিল্ম দেখছিল আর সেটা দেখতে দেখতেই মনে হয় সে ঘুমিয়ে পড়েছিল যার ফলশ্রুতি এই ভয়াবহ স্বপ্ন।

অশরীরীর গল্প এবং সেই নিয়ে তার আগ্রহ প্রবল। এই আগ্রহের দরুন, সে আর তার কিছু বন্ধু মাঝে মাঝে প্ল্যানচেটের আসর বসায় এবং সে খুব ভাল মিডিয়াম বলে বন্ধুরা স্বীকার করে। রাত এখন নিশ্চয় বেশ গভীর। তার রুমের চারপাশে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। সহজাত আন্দাজে মনে হল, তার এই রুমে কেউ আছে। সে এখন পুরোপুরি সজাগ, ব্যাপারটা কী দেখতে হচ্ছে। বেড সুইচ কোনদিকে হতে পারে সেই আন্দাজে হাত চালাতে গিয়ে, সে স্পষ্ট শুনতে পেল কেউ তার খুব কাছে থেকে এসে তার নাম ধরে ডেকে আবার দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। তার সহজাত তীক্ষ্ণ অনুভূতিপরায়ণ মন বলতে থাকলো এ কোনো চোর-ছ্যাঁচড় নয়। তাহলে কি কোনও অশরীরী? সে কি তাকে কিছু বলতে চায়? এইরকম কিছু হলে বেশ হয়। সে জানে অশরীরীরা কোনো ক্ষতি করে না বরং তার থেকে বাঁচিয়ে তো দেয়ই, সাথে সাথে অনেক অজানা কিছুও জানা যায়। মনে সাহস এনে সে জিগ্যেস করলে “কে তুমি? কিছু বলতে চাও আমাকে?” মিহি বালিকাকণ্ঠে জবাব এল, “বাঃ তুমি আমাকে কী সুন্দর নিখুঁত সুরেলা আহবান করে ডেকে আনলে আর এখন জানতে চাইছ আমার পরিচয়?” সুমন অবাক হল, “আমি তোমায় আহবান করলাম? কখন?” বালিকা কণ্ঠে জবাব এলো, “মনে করার চেষ্টা কর। আজ বিকেলে তোমার পাশের ঘরে একটা খোলা বাক্স থেকে তুমি একটা পুঁথি নিয়ে এলে আর তারপর প্রথমে ওম, তারপর হ্রিং এবং শেষে ক্রিং এই তিনটি বীজমন্ত্র কী সুন্দর সুর করে গাইলে আর তাতেই তো আমি কতকাল বাদে আবার জাগ্রতা হলাম। এইসাথে তোমার আজ্ঞাচক্রের কিছু অংশ জাগ্রত হয়েছে, অবশ্য সেটা আমার ইচ্ছাধীন। যে কারণে একমাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে দেখতে পারবে না “

হঠাৎ তার নজরে আসে যে ঘরের দেওয়াল-আলমারির দরজার পাল্লা খোলা আর সেখানে তার বয়েসি একটি কিশোরী বসে আছে। সে সেইখান থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকল, “তুমি যাবে আমার সঙ্গে, আমার দেশে? সেখানে পাহাড়, বনজঙ্গল, ঝর্ণা, মেঘ আর পাখীর গান সব আছে। আমি অনেকদিন কারো সাথে গল্প করিনি। কিছু সময় আমার সাথে আমার দেশে থেকে তারপর আবার ফিরে এস তোমার মা বাবার কাছে। তার বেশী চিন্তা করবেন না।” আচ্ছন্নের স্বরে সুমন বলে, “বেশ চল তাহলে। ঘুরতে বেড়াতেই তো এসেছি এইখানে।”

রুমের বাইরে সিসি টিভির চোখ এইটুকু দেখতে পেল যে সুমন করিডোরের প্রান্তে চলে যাচ্ছে, হোটেলের পেছনের দিকে। এমন কী পেছনের বাগানে গেটের কাছে দু’জন সিকিউরিটির লোকও তাকে দেখতে পায়নি গেট পার হতে। গেটের বাইরে আসতেই তার পেছন থেকে কে যেন তার নাকের সামনে একটা মিষ্টি গন্ধের রুমাল আনে। এরপর তার যখন ঘুম ভাঙল সেটা বেতগুড়ি থেকে অনেক দূরে। বিকেল বিদায় নিচ্ছে তখন। ঘুপচি নোনা ওঠা দেওয়ালের একমাত্র জানালার গরাদগুলো থেকে ঘরের রোদ লাফিয়ে লাফিয়ে বিদায় নিচ্ছে। এমন সময় সেই চেনা মিষ্টি সুরে বেতগুড়ির হোটেলে সে রাত্রের দেখা কিশোরী তাকে ডাকল, “চল সুমন পাহাড়ে মেঘের আনাগোনা, ঝর্ণা আর পাখীদের গান শুনবে তো চলো আমার সাথে। এতদিন আমাকে দিয়ে কিছু লোক অনেক শয়তানি করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আজ যখন তুমি এসেছ, আমি এইবার জেগে উঠেছি। ওই বদমাশ কালো তান্ত্রিকটা আমাকে না পারবে ওই ভয়ানক কালো পুতুলটার মধ্যে বন্দী করতে, না পারবে আমাকে দিয়ে আর কোনো খারাপ কাজ করাতে।”

ডিএসপি সোহম, তাঁর চেম্বারের সরকারী ঘড়ির দিকে চেয়ে একটু অস্থির আর বেশ বিরক্ত হচ্ছিলেন বেতগুড়ি সদর থানার আইসি সোনাম ওয়াংদি আর তাঁর ইনফরমারের গ্যাং লিডার বিজয় হাজারীর ওপর। নিজের চেয়ার থেকে উঠে একবার পায়চারী করে আবার ফিরে যেতে যেতে দেখলেন সিটি ট্রাফিক ওয়াচ মনিটরের দিকে। চ্যানেল ৮ মানে বেতগুড়ির কপালেশ্বরী চৌমাথাতে লাগানো সিসিটিভির ক্যামেরা। দেখা যাচ্ছে যে দু’জন কনেস্টেবল মোড়ের ঠিক দক্ষিণদিকের রাস্তার লাগোয়া হোটেল মেন্ডাবাড়ি ইন্টারন্যাশনালের গেটের সামনে আছে আর সাদা পোশাকের লোকেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই হোটেলের চারপাশে। হোটেলের পাশের রাস্তায় নেপালি ভিখারির মেকআপ নিয়ে গুরুং আর তেজবাহাদুর তাদের হাতের লম্বা চোঙ দিয়ে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকাবার বাহানায় আসলে নজর রেখেছে বিশেষ কিছু রুমের জানালা আর ব্যাল্কনির দিকে।

একদিন আগে, মেন্ডাবাড়ি হোটেলের এই রুমগুলোর একটা থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে, কলকাতা থেকে আসা চা ব্যবসায়ী দীপক এবং বিদিশার একমাত্র সন্তান সুমন। সুমন সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেছে। তার জেদাজেদিতেই বহুদিন পর সপরিবারে উত্তরবঙ্গের এই পাহাড়ি অঞ্চলে বেড়াতে এসে, এই হোটেলে পাশাপাশি দুটো রুম নিয়েছিলেন। একটা তাঁদের জন্য এবং অন্যটা খামখেয়ালী সময়ে চলা পুত্রের জন্য। প্রথম দিন তাঁরা বেতগুড়ির আশেপাশের চা বাগানগুলো ঘুরলেন। পরদিন তাঁদের রিম্বিক ঝর্ণাতে পিকনিকে যাবার কথা ছিল। সকালে তাঁরা নিজেদের রুমের বাইরে এসে দেখেন যে সুমন তার মোবাইল বিছানার ওপর ফেলে রেখে, কাউকে কিছু না বলেই কোথাও গিয়েছে। প্রথমে তারা ভেবেছিলেন যে সে রোজকার মত মনিং ওয়াকে দূরের পাহাড়ের দিকে বেড়াতে গেছে। বিকেল পর্যন্ত সে না ফেরায়, হোটেল কতৃপক্ষ পুলিস ডাকে। প্রাথমিক তদন্তে করিডোরে লাগানো সিসি টিভির হার্ড ডিস্ক খুঁজে দেখা যায় যে শেষ রাতের দিকে সুমন তার রুম ছেড়ে, কেমন যেন আচ্ছন্ন অবস্থায় হোটেলের পিছনের বাগানের দিকে যাচ্ছে। সুমনের নিখোঁজ হবার শোকে, তার মা বিদিশা এতটা আঘাত পান যে তাঁকে সেডেটিভে আচ্ছন্ন করে রাখতে হয়। পরের দিন মাঝরাতে দীপকবাবুকে হোটেলের লকার রুমের প্যাসেজে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। বেতগুড়ি এমনিতে শান্ত জায়গা, আইনশৃঙ্খলা সেখানে কোনো সমস্যাই নয়। সেখানে একই হোটেলে, রাজনৈতিক মহলে সুপরিচিত এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ী দীপকবাবুর পরিবারের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীতে পুলিস থেকে গৃহমন্ত্রকের উচ্চপদস্থেরাও বেশ উদবিগ্ন হয়ে পড়লেও মহাকুমার সদ্য চার্জ নেয়া তরুণ ডিএসপি, এতটুকুও না ঘাবড়ে পেশাদারী কায়দায় এই রহস্যময় ঘটনার তদন্তে, তার পুরো দল নিয়ে নেমে পড়েছে।

কনস্টেবল-বডিগার্ড, দরজায় নক করে ঢুকে সোহমকে স্যালুট দিয়ে, মোবাইল তাঁর হাতে দিয়ে বলে, “স্যার, সদরথানা আইসি সাহেব আর একটা অজানা নাম্বার।” অজানা নম্বরটা দেখেই সোহম বুঝতে পারে সেই লাল মারুতিভ্যানের কোনো খবর এনেছে তার শিলিগুড়ির সোর্স হাজারী। সুমনের অপহরণের রাতে, কপালেশ্বরী চৌমাথার কাছে এই লাল মারুতি ভ্যানটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ভ্যানটার নম্বর প্লেটটা ফেক, তাই একে ট্রেস করবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি কোথাও। নিজের চেম্বারের লাগোয়া ওয়াশরুমের নিরিবিলিতে গিয়ে কল করতেই কলকলিয়ে ওঠে হাজারীর গলা। “ছ্যার, আপনি জেঠন(যেমন) বলঠিলেন কার্য সবঠা করেঠি। সেই জালি নম্বর প্লেঠের লাল মারুঠি ভ্যান’ঠা এস এন টি বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে থাকার পর এনজেপি স্টেশনের পারকিং লটে আসে।”

“গুড। মারুতি ভ্যানে কে, কে ছিল?”

“সার জি, এরা কেউ গ্যাংটক- রংপো বা শিলিগুড়ির কিডন্যাপার বা রাউডি নয়। আসামের কোনো মালদার পার্টি। এনজেপি স্টেশনের পার্কিং লটে এরা নেমেছিল, সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকা একটা অল্পবয়েসি ছেলে। এই ছেলেটির স্কেচ আপনি পাঠিয়েছিলেন। ছেলেটাকে দেখে বেশ রহিস ঘরের লোক বলেই মনে হল, তবে অসুস্থ হতে পারে। লোকদুজন গাড়ি থেকে নেমে দুপাশ থেকে ছেলেটাকে ধরে, ওই ঘুমন্ত অবস্থাতেই স্টেশনের আপার ক্লাসের ওয়েটিং রুমের দিকে চলে গেল। ওদের মধ্যে যে বেশ খাটো আর স্বাস্থ্যবান, তাকে আমাদের একজন লোক প্লাটফরমে একজন টিটির সাথে কথা বলতে দেখেছে। ওর কানে এসেছে যে আসামের দিকে কোনো এক জায়গায় যেখানে ট্রেন অল্পসময় থামে, সেখানে বেশি সময় থামাবার জন্য টি টি মারফত গার্ডের সাথে কিছু লেন-দেনের কথা। আমাদের লোকগুলো অন্য আর এক ধান্দায় ছিল, তারা এর বেশি দেখেনি। আপনি স্যার চাপ নেবেন না। গুয়াহাটি স্টেশন আর তার আগে-পিছে সব জায়গায় আমাদের সেটিং আছে। ছেলেটাকে নিয়ে উড়ে তো যাবে না। যে গাড়িতেই যাক আমার কাছে খবর আসবেই। আপনাকে আর একটু পরেই ওদের খবর দিচ্ছি।”

বললেন, “আমাকে আপডেট করতে থাকবে। আই সি-র ফোন আসছে বোধহয় তুমি ছাড় এখন।”

হাজারী বলে, “স্যার, আইসি সাহেব সব জানেন। আরপিএফ-কে বলেছেন উনি নজর রাখতে।”

আই সি সদর, ইনস্পেক্টর সোনাম ওয়াংদিকে কড়া ধমক লাগালেন সোহম, “আরপিএফ-কে নজর রাখতে বলে তুমি হাত ধুয়ে বসে আছ? গুয়াহাটি ডিআইজি অফিসে লাইটনিং কল কেন দাওনি? গুয়াহাটি না গিয়ে ওরা আর অন্য কোনো ট্রেনেও যেতে পারে। এখনি আমার হয়ে রেডিও মেসেজ পাঠাও গুয়াহাটির আশেপাশের সব থানাতে আর সেই সাথে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ সুমনের ফটো আর ডিটেলস দাও।”

আই সি সদর ওয়াংদির কাছে, মহকুমায় সদ্য জয়েন করা তরুণ ডিএসপি সোহমের থেকে আরও ধমক থেকে বাঁচবার জন্য তার নিজের সোর্সদের পাওয়া কিছু খবর ছিল। অবিচলিত স্বরে সে বলে, “স্যার গুয়াহাটি থেকে আমার শিলিগুড়ির সোর্সেরা কিছু জরুরি খবর পেয়েছে। আপনাকে সেগুলো এখনি বলা দরকার।”

ওয়াংদির কথার সুর বুঝে সোহম বলল, “এখন কেউ নেই আমার চেম্বারে, বলে যাও।”

ওয়াংদি গলার স্বর কমিয়ে বলে, “স্যার, শিলিগুড়ির সোর্সদের মধ্যে শইকিয়ার বাড়ি গুয়াহাটিতে। সে কিছুদিন আগে বিয়েবাড়ির নেমতন্ন রাখতে বাইকে করে গিয়েছিল একটা গ্রামের দিকে। ফেরবার সময় গুয়াহাটি-মারিগাও হাইওয়েতে একটা কালো রঙের স্করপিও তার আগে আগে চলছিল। পথে মায়াং যাবার ক্রসিঙে ট্রাফিক সিগন্যালে থামবার সময় সে ওই স্করপিওটার একদম পিছনেই ছিল। তখন তাঁর নজরে আসে যে স্করপিওটার সাদা রঙের নম্বরপ্লেট, সেটা শুধু অসমিয়াতে লেখা হলেও কিন্তু তার নম্বর বেঙ্গলের। তাতে পেছনের সিটে ঘুমন্ত অবস্থায় একটা অসুস্থ কিশোরকে ধরে রেখেছিল কালো সানগ্লাস পরা বড়োলোক ঘরের একজন ম্যাডাম। গাড়িটা চালাচ্ছিল যে তাকে দেখে গাড়ির মালিক বলেই মনে হচ্ছিল।”

সোহম বিরক্ত গলায় বলে “গাড়িটা কোনদিকে গেল সেটা নিয়ে কোনো খবর দিতে পারলো?”

ওয়াংদি বলে, “স্যার, এরপরে শুনুন। সিগন্যাল সবুজ হতেই, গাড়িটা মায়াং যাবার রাস্তাতে বাঁক নিয়েও হঠাৎ আবার হাইওয়েতে ফিরে আসে। গাড়ির ড্রাইভার তখন তার মুখটা বার করে একবার পেছনে সইকিয়ার দিকে আর একবার হাইওয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। সইকিয়া অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও আর তার বাইকটা ড্যামেজ হয়। সে ডেমারেজ আদায়ের জন্য, স্করপিওটাকে ফলো করতে শুরু করে কিন্তু শেষ অবধি স্করপিওর স্পীডের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। এরপর শইকিয়া পুরো গৌহাটি এবং মারিগাওতে অনেক গ্যারাজ আর হাইওয়ের ধাবাগুলোতে জিগ্যেস করে জেনেছে বেঙ্গলের নাম্বারের কোনো গাড়ি শুধু অসমীয়াতে তারা আজ অবধি দেখেনি।”

সোহম একমনে সব শুনে ওয়াংদিকে বলল, “তাহলে এটা এখন আপাতত ধরে নেওয়া যেতে পারে যে নাম্বারটা ফেক। তবুও তুমি একবার আর টি ও অফিসে খোঁজ লাগাও, গুয়াহাটি, শিলিগুড়ি আর মারিগাওতে। সইকিয়াকে বল এই স্করপিওটা না পেলেও এর ড্রাইভার আর পেছনে যে ম্যাডাম ছিল তাদের খুঁজতে।”

আই সি ওয়াংদি বলে, “স্যার, আমরা শইকিয়াকে আর বিজয় হাজারীর লোকদের শিলিগুড়ি থেকে এখানে আনিয়েছিলাম। শইকিয়া স্করপিওটার ড্রাইভার আর ঘোমটা দেওয়া সেই ম্যাডামকে যতটুকু দেখেছে, সেই বর্ণনা শুনে শুনে আমাদের পুলিস আর্টিস্ট ওদের ছবি এঁকেছে। এছাড়া স্যার, সইকিয়ার লোকের বর্ণনা শুনে, সে এন জে পি স্টেশনে সেই দু’জন লোক যারা সেই ঘুমন্ত ছেলেটাকে নিয়ে প্ল্যাটফরমের ভেতর যাচ্ছিল তাদের সবার স্কেচ করেছে।”

“গুড জব ওয়াংদি। ছবিটা পাঠিয়ে দাও আমাদের সাইবার সেলের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট এস আই শ্রেয়া মজুমদারকে। দেখি ও যদি কোন লিড দিতে পারে।”

ওয়াংদি এরপর যা বলল তাতে সোহমের মনে হল ভাগ্যিস সে একটু আগে কফিটা শেষ করেছে। সেটা না করলে এটা শোনবার পর কফি মাগ তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে যেত। এই অবস্থায় থেকে সে ওয়াংদিকে বলল, “ওয়াংদি তুমি যা বললে আর একবার সেটা রিপিট করো।”

“শইকিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী আর্টিস্ট যে ছবি এঁকেছে দু’জনের, তাতে স্করপিও ড্রাইভার আর দীপকবাবু যেমন অনেকটা মিলে যাচ্ছেন তেমনি মাথার ঘোমটা বাদ দিলে সেই ম্যাডামের স্কেচটা দাঁড়াচ্ছে ওনার স্ত্রী বিদিশার। আমি আর একজন আর্টিস্ট লাগিয়েছিলাম। দুই আর্টিস্টের ছবির তেমন কোনো ফারাক নেই। ঠিক তেমনি ঘুমন্ত যে ছেলেটিকে দুজনে দু’পাশ থেকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, যাকে শিলিগুড়ি স্টেশন আর গুয়াহাটি দু’জায়গাতেই দেখা গেছে সেই ছেলেটির স্কেচ আর হোটেল মেন্ডাবাড়ি থেকে নিখোঁজ দীপকবাবুদের ছেলে সুমন দু’জনেই একই বলে মনে হচ্ছে।”

সোহম বলে,”কিন্তু দীপকবাবু পরশু রাত থেকেই দারুণ চোট নিয়ে নার্সিং হোমে আর বিদিশা ম্যাডাম সেই দুদিন আগে তাঁদের নিখোঁজ ছেলের শোকে এখনো সেডেটিভের আশ্রয়ে আছেন। তাহলে সুমনের সাথে এরা সব কারা?”

ওয়াংদি বলে “স্যার, ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো-প্যাঁচালো। কলকাতা আর টি ও অফিস থেকে মেসেজ এসেছে যে নম্বর প্লেট এবং গাড়ির মেক মানে এই স্করপিও গাড়িটা এই দুটোই দীপকবাবুর কালো স্করপিওর সাথে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু স্যার আমরা সোর্স মারফত খুব ভালো করে জানি যে দীপকবাবুর ওই কালো স্করপিও গাড়ির ইঞ্জিন আর গিয়ার বক্সের কাজ চলছে শিলিগুড়িতে কোম্পানির কারখানায়। যে দু’জন লোক ঘুমন্ত সুমনকে দু’পাশ থেকে ধরে ধরে গাড়ি থেকে ওঠনামা করাচ্ছিল, তাদের একজনের মুখের দাড়ি বাদ দিয়ে দিতেই চেনা গেল। সে হচ্ছে একজন কুখ্যাত ক্রিমিনাল বুলাকি। কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে একটু আগে খবর এসেছে যে বুলাকিরামের ছিন্নভিন্ন দেহ রেললাইনের ওপর পাওয়া গেছে। শিলিগুড়ি টিম প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর কিছু লিড পেয়েছে। তাতে তারা মনে করছে যে বুলাকিরামকে অন্য কোথাও মার্ডার করে তার ডেডবডি যাতে চেনার অযোগ্য হয়ে পড়ে, সেই মতলবে রেললাইনের ওপর ছেড়ে গেছে। বুলাকিরামের মা আর ভাই এই বেতগুড়ির পাহাড়তলীর নেপালী বস্তিতে থাকত। তারা বাড়ি-বাড়ি এবং অনুষ্ঠানে বড়ো রান্নার কাজ করে। ওদের বস্তিতে গিয়ে আমাদের লোকেরা জেনেছে যে ওর মা আর ভাই দু-তিন দিন আগে বাইরের কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে রান্না করতে গেছে। বেতগুড়ির অঞ্চলপ্রধানের মেয়ের বিয়ে কালকে। সেজন্য তাদের আজ বা কালের মধ্যে ফিরে আসবার কথা। স্যার এই কেসের এখনো অবধি সব আপডেট দিয়ে আমি একটা রিপোর্ট বানিয়ে সেটা পেন ড্রাইভে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। দীপকবাবু, বিদিশা ম্যাডামের এবং হোটেল মেন্ডাবাড়ীর সব ফোন আমরা ট্যাপ করে রেখেছি। আমাদের দুজন এ এস আই আর মোবাইল ভ্যান সব সময় সেইদিকে নজর রাখছে। স্যার, ওদের ছেলে সুমনের নিখোঁজের আজ দু’দিন কেটে গেলেও র‍্যানসাম চেয়ে এখনো কোনো কল আসেনি। ।”

সোহম বলে, “সে রকম কিছু এলেই আমাদের অ্যাকসন প্ল্যান তৈরিই আছে। সেই অনুযায়ী কাজ হতে যেন একটুও দেরি না হয়।”

ওয়াংদি বলে, “একদম নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার। ফুলবডি স্ক্যান অনুযায়ী দীপকবাবুর চোট শুধু পিঠে লেগেছে এবং সেটা তেমন কিছু সিরিয়াস নয়, একটু রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে বলে নার্সিংহোম তাঁকে আর একটু পরে ছেড়ে দেবে বলছে। তাহলে স্যার ওনার সাথে আমরা আর একটু পরে...”

সোহম বিরক্ত হয়ে বলে, “ওয়াংদি, ওনাকে সকালটা হোটেলেই আরাম করতে দাও। বিকেলের দিকে যদি সম্ভব হয় তবে ওনাকে সসম্মানে নিয়ে আসবে আমার বাংলোতে। তবে দরকারে আমরা ওনাকে হয়তো একটু কড়া গ্রিলিং করতে পারি। তুমি ভিডিও টিমকেও সঙ্গে আনবে। যদি দরকার হয় তবে উনি যা বলবেন তার ভিডিও রেকর্ডিংও আমরা ডকুমেন্টেশনের জন্য রাখতে পারি। ওই মহিলা এবং তাঁর দলবলের আপডেট পেলেই বিন্দুমাত্র দেরি না করে আমাকে দেবে।”

ওয়াংদি একটু বিব্রত সুরে বলে, “স্যার মারিগাও আসামে। সেইজন্য সেখান থেকে সোর্স মারফত কিছু খবর পেতে গেলে, আমাদের কন্টিজেন্সি ফান্ড তেমন নেই। আর আসাম পুলিস তো জানেনই স্যার, শুধু আমাদের কাছ থেকে খবর নেবে। কিন্তু দেবে না কিছু।”

সোহমের কপালে এবার সত্যি বেশ বড়ো ভাঁজ পড়ে যায়। হঠাৎ করে একটা দিশা সে পেয়ে যায়, “গুড হেভেন্স! এস পি মারিগাও, পুজেশ্বর সইকিয়া আমাকে খুব ভালো করে চেনে। পুলিস একাডেমিতে আমার থেকে দু বছরের সিনিয়র ব্যাচ। ওনাকে আমার নামে একটা লাইটনিং কল দাও আর কানেক্ট করবার অল আউট এফোর্ট লাগাও।” ওয়াংদি বলে, “স্যার আমার একটা ব্রেনওয়েভ এসেছে। মারিগাও এর কাছেই হচ্ছে তন্ত্রমন্ত্র আর জাদুবিদ্যার পিঠস্থান মায়াং।”

ক্রুদ্ধ সোহম বলে, “তুমি কি চাও ডিপার্টমেন্ট এবার ইনভেস্টিগেশন ছেড়ে দীপকবাবুর ছেলে সুমনের অপহরণ কেসে তান্ত্রিক আর জাদুকরদের শরণাপন্ন হবে? তোমার পিএ, এ এস আই বড়গোহাই এর সাথে-সাথে তোমার এগেন্সটেও ডিপারটমেন্টাল তদন্ত চালু হোক, সেই চাও?”

ডিএসপি সাহেবের কথাতে ওয়াংদি কিন্তু একটু হেসে বলে, “স্যার বড়গোহাই এর শ্বশুরবাড়ি কিন্তু ওই মায়ংয়ে। ওখানে লোকে যে শুধু তন্ত্রমন্ত্র শিখতে যায় তা নয়, মন্দ উদ্দেশ্যেও অনেক ক্রিমিনাল গ্যাঙ্গের আনাগোনা চলতেই থাকে। বড়্গোহাইএর শালা ওখানে হোটেল থেকে আরম্ভ করে, বিভিন্ন ঠেকের লোকদের সাথে ওঠাবসা আছে। তাকে যদি এই মহিলা বা সুমনের স্কেচ দেখিয়ে কোনো হদিস পাওয়া গেলেও যেতে পারে। স্যার এই মায়ংয়ের অনেক জায়গা আছে যেখানে পুলিসও যেতে চায় না। ।”

সোহম একটু ভেবে বলে, “ঠিক আছে। পুলিসের এই দুর্বলতার সুযোগ যে সুমনের অপহরণকারীরা নেবে না এমন সম্ভাবনা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। তুমি এক কাজ কর। গুরুঙ্গের গ্যারাজ থেকে আমার নাম করে একটা জাইলো গাড়ি নিয়ে এখনই বড়গোহাইকে সপরিবার রওয়ানা করিয়ে দাও মায়ংয়ে। ওকে বলে দাও ওর এগেন্সটে যে এনকোয়েরি চলছে তাতে আমি নিজে রেকমেন্ড করবো কম সাজার, যদি এই কেসে ও কোনো পজিটিভ লিড আনতে পারে।”

ওয়াংদির সাথে কথা বলার সময়ে সোহমের নজর আটকে ছিল ট্রাফিক মনিটর চ্যানেল এইটের দিকে অর্থাৎ বেতগুড়ির কপালেশ্বরী চৌমাথাতে লাগানো সিসি টিভির ক্যামেরা যাতে এখন আর একটা ক্যামেরা লাগানো হয়েছে হোটেল মেন্ডাবাড়ির দিকে। এই ছাড়া আর একটা ক্যামেরা যুক্ত আছে চ্যনেল এইটের সাবচ্যানেলে যেটা লাগানো হয়েছে হোটেলের পেছনের বাগানের দিকে।

হোটেলের পেছনের বাগানে একজন হিপিচুলের বিদেশী আর তার সাথে একজন সিটকে রোগা লম্বা লোককে দেখে সোহম চমকে ওঠে। একবার নিশ্চিত হবার জন্য তার ডেস্ককে বলে হোটেলের রিসেপসন- ইন- চার্জ গোমেজ যেন এখুনি কথা বলে। প্রায় সাথে সাথে গোমেজের গলা ভেসে আসে। “গুড মর্নিং স্যার। কী হুকুম বলুন”

সোহম বলে, “গোমেজ, বিদেশী কোনো গেস্ট এখন আছে?”

গেস্ট রেজিস্টারের পেজগুলো তার মুখস্থ। তবু একবার দেখে নিয়ে বলে, “না স্যার, এই মাসে কোনো গেস্ট আসেনি, তবে তিনদিন পর এক আমেরিকান কাপলের বুকিং আছে।”

“ওকে গোমেজ, কিপ টাচ।”

গোমেজের সাথে কথা শেষ না হতেই কপালেশ্বরী মোড় থেকে কনস্টেবল গুরুং অয়ারলেসে মেসেজ পাঠায়, “সাহেব, হোটেলের পেছনের গেট দিয়ে একজন সাহেব আর তার সঙ্গী বেরিয়ে এসে চকবাজারের দিকে গেল। এদের চলাফেরা দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। হোটেলের রিসেপসন এদের সম্বন্ধে কিছু বলতে তো পারলো না, উপরন্তু বলে যে হটেলে এখন কোনও বিদেশী গেস্ট নেই। স্যার আমি চকবাজারে টহলদারি মোবাইল ভ্যানকে এদের সম্পর্কে জানিয়েছি।”

সোহম নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে, “গুড জব ডান গুরুঙ্গ। আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

সোহম নিজের ডেস্ক কম্পিউটারের “মাই ফোটোজ” এ ক্লিক করে তার প্রবেশন পিরিয়ডের সময় নিজের গুরুর ছবি আর একবার দেখে নেয় আর মৃদু হাসতে থাকে। এই কেসে এখনো পর্যন্ত সে বা তার টিম তেমন কোনো লীড পায়নি। দু’দিন পর শিলিগুড়িতে ডিআইজির ক্রাইম কনফারেন্স আছে। সেইসময় অবধি যদি এই অপহরণ কেসে উল্লেখযোগ্য কোনও প্রগ্রেস না হয় তবে বেশ কড়া কথা শুনতে হবে, বিশেষ করে যখন দীপকবাবুর শাসকদলে বেশ ওঠাবসা আছে। প্রবেশনের সময় তার এই গুরু বারবার বলেছিলেন যে কেসের লিড পাচ্ছিস না, তাতে ইনফরমারদের দেওয়া খবরগুলোর রেকর্ডিং বারবার শুনবি। দেখবি এর মধ্যেই আছে লিড আর সেখানে হিট করলেই বাজি মাত।

হিপিচুলে বিদেশীর বেশ ধরে সেই রহস্যময় লোক আর তার সঙ্গী চকবাজারে গেলে নিশ্চয় যাবে অ্যান্টিক দোকানগুলোতে। বেশীর ভাগ বিদেশী এইসব জায়গাতেই যায়। ট্রাফিক চ্যানেল টু আর থ্রি অর্থাৎ চকবাজার সাউথ আর নর্থ যেখানে বেশীরভাগ অ্যান্টিকের দোকানগুলো আছে, তার বাইরে বড়ো লাইটপোস্টে লুকিয়ে রাখা সি সি ক্যামেরার ছবি নিজের মনিটরে ফোকাসে রেখে, সোহম নিজের গুরুর উপদেশ মতো ইনফরমারদের সাথে হওয়া কথাগুলোর রেকর্ডিং শুনছিল। হঠাৎই তার মনে হল এই নকলি ভেকধারী বিদেশী আর তার স্যাঙ্গাত এইসব দোকানে আসবে কেন? এরা তো টুরিস্ট নয়। এরা যে এসেছে অন্যকিছুর খোঁজে সেটা তো সে একটু আগেই বুঝতে পেরেছে। কথাটা ভাবতে না ভাবতেই সে ট্রাফিক মনিটরে স্পষ্ট দেখল যে গুরু চেলা দু’জনেই ঢুকছে ভুটিয়া অ্যান্ড লিম্বুর দোকানে। এখানে অ্যান্টিকের সাথে সাথে সিকিমিদের ট্র্যাডিশনাল পোশাক, চমরী গরুর শিং, আর নানারকম মুখোশ বিক্রি হয়। গুরু-চেলা সোহমের আন্দাজের সামান্য এদিক ওদিক করেছে এবং সেটার পেছনেও নিশ্চয় এই গুরুর কোনও প্ল্যান নিশ্চয় আছে। সোহমের জানা উচিত সেটা। এর সাথে এই প্যাঁচালো কেসের লিঙ্ক তো আছেই। ওয়্যারলেস চ্যানেল টু’তে সোজা পাওয়া যাবে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা মোবাইল ইউনিট থার্ড’কে। সোহম ওয়্যারলেসে কল দিলো। “কাপ্রোজিনে কলিং মোবাইল থ্রি, আর্জেন্ট। ওভার”

“রজার। মোবাইল থ্রি অনলাইন স্যার। সাব ইন্সপেক্টর গুরুং বলছি স্যার। অ্যালারট ফর অর্ডার স্যার। ওভার।” (রজার মানে অন্যপ্রান্তের কথা এই প্রান্তে সবটা শোনা এবং বোঝা গেছে)

“রজার। গুরুং এখন তোমাদের টার্গেট ওয়াচ ওয়ান অ্যান্ড টু সম্পর্কে বলছি। এই দুজনে এখনই ঢুকেছে ভুটিয়া অ্যান্ড লিম্বুতে। তোমার ভ্যানের প্লেন ক্লোদস’এর কাউকে পাঠিয়ে কভার করো দোকানের ভেতরে আর দেখ ওই দু’জন ওই দোকানে কী করছে বা কী চাইছে? আমাকে সোজা রিপোর্ট ব্যাক করো। ওভার।”

“রজার। স্যার আমি প্লেন ক্লোদসের লেডি কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার। ওভার।”

“রজার, ওভার।”

গুরু চেলা দুজনেরই মুখের কথার চাইতে দৃষ্টি বিনিময় আর হাতের আঙুলের ইশারাতে কথা বেশী হয়। একজন বিদেশী আর একজন এদেশির মধ্যে তাই স্বাভাবিক। ভুটিয়া অ্যান্ড লিম্বুতে ঢুকে দুজনে কিছুক্ষণ এটা ওটা দেখবার পর, বিদেশী তাঁর এস্কর্টকে ইশারা করলেন মুখোশের কথা। সেলসের মেয়েটি ওপরের তাক আর মাঝখানের কিছু জায়গা থেকে বেশ কিছু বাক্স থেকে একের পর এক মুখোশ বার করে দেখাচ্ছিল। সাহেব সেসব দেখে হাসিমুখে ভেরিগুড ভেরিগুড বললেও প্যাক করতে মানা করল। হতাস সেলস গার্ল মুখোশের প্যাকগুলো ফেরত পাঠাচ্ছিল আর তখন সাহেব তার গাইডকে কিছু একটা ইশারা করছিল। সেলস গার্ল’কে গাইড লোকটি নেপালিতে বললে, “দেখ সাহেব এইসব জীব জন্তুর, বা দৈত্য দানবের ভয়ঙ্কর মুখোশের প্রশংসা করলেও, উনি চাইছেন এমন মুখোশ যা পরলে তাঁকে অন্য মানুষের মতো দেখাবে।”

মেয়েটি একবার দুজনের দিকে তাকিয়ে একটু নিচু গলায় বললে, “স্যার আপনারা ওপরে শপ ম্যানেজারের কিউবিকিলে যেতে পারেন। আমার কাছে এই ধরনের কিছু নেই।” সিনেমার সুপরিচিত ভিলেন ড্যানী ডিঙ্গোপার মতো দেখতে শপ ম্যানেজার তাঁর কুতকুতে চোখ মেলে শাঁসালো ফরেনার কাস্টমারকে দেখে খুব সহাস্যে এবং সবিনয়ে অভ্যর্থনা করে বসতে বলে ড্রিঙ্কস আর সিগারেট অফার করলেন। সেসব সবিনয়ে প্রতাখ্যান করে তিনি তার গাইডকে ইশারা করলেন, সে শপম্যানেজারকে বলল, “এই সাহেব অনেক জায়গাতে শুনেছে যে তোমার দোকানে সেরা মুখোশ কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু নিচে তোমদের কাউন্টারে যা দেখালো সাহেব তা চাইছেন না। উনি চাইছেন সেইরকম মুখোশ যা একইরকম আদলের মুখের লোক যদি পরে তবে দূর থেকে তাকে হুবহু অন্য কেউ বলে মনে হবে।”

ম্যানেজার ওদের কথা শুনছিল আর তাঁর কুতকুতে চোখদুটো দিয়ে তাঁর উল্টোদিকে বসা লোকদুটিকে বুঝে নেবার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ব্যাপারটা তার কাছে সুবিধেজনক মনে হচ্ছিল না। একটু ভেবে নিয়ে সে বলে, “স্যারেরা, আমরা সচরাচর এইরকম মুখোশ বিক্রি করি না। কিন্তু কোনো শিল্পী এসে খুব পীড়াপীড়ি করলে কিছু দিন রাখি যদি এই বিক্রি থেকে সে ক’টা পয়সা পেয়ে যায়। কিছুদিন আগে এইরকম একটি লোক এসেছিল, সেগুলি বিক্রি হয়ে গেছে। বেশ অনেকদিন সেই লোকটি আসেনি। আপনারা আপনাদের ফোন নম্বর রেখে যান। লোকটা এলে আমি আপনাদেরকে খবর দেব।” বিদেশী লোকটি এবার তাঁর গাইডকে কিছু ইশারা করল, সে তার ওয়ালেট বার করে দুটো পাঁচশো টাকার নোট ডেস্কে রেখে একটু শাসনের সুরে বলল, “এই টাকাগুলো তোমার হতে পারে যদি তুমি সেই লোকটির নাম আর সে কোথায় থাকে আমাদেরকে বলে দাও।” টাকাগুলো ডেস্ক থেকে নিজের হাতে নিতে নিতে সে বলে, “বুলাকি নামের এই লোকটাকে পাহাড়তলির নেপালি বস্তিতে আমার লোকেরা কয়েকবার দেখেছে। ওখানে খোঁজ করলে তোমরা পেয়ে যেতে পার।” তিনবার বিপ বিপ করে একটা আওয়াজ ম্যানেজারের ঘরে হতেই সে বলল “দোকানে পুলিসের টিকটিকি এসেছে। তোমাদেরকে কিছু জিগ্যেস করলে মুস্কিলে পড়তে পারো। এই কিউবিকলের পেছনের দরজা খুলে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে গিয়ে, সামনের পাহাড়ি ঢালে পায়েচলা পাহাড়ি পাকদন্ডী রাস্তা ধরে নেমে গেলেই নেপালি বস্তি পাবে।”

পাহাড়ি ঢালের রাস্তাটা খারাপ নয়। নিচে নামতে নামতে মেকআপ খুলে, লিকুইড জেল আর টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে নিয়েছে এস এস পি ( সি আই ডি) শেখর সোম আর তাঁর বডিগার্ড সঞ্জয়। একদম পাহাড়তলির কাছে একটা মাঠে যে ছেলেটা গরু চরাচ্ছিল সে তার হাতের ছড়ি দিয়ে দেখিয়ে দিলে বুলাকির বাড়ি। মাঠেরই এককোণায় একটা জীর্ণ দশার বাড়ি, তার মাটির পাঁচিলও জায়গায় জায়গায় ভাঙ্গা। সেই ভাঙ্গা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা লোক বাড়ির দাওয়ায় বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে আর তার মা ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে “ছিদ্দন, এ ছিদ্দন” বলে ডেকে গেলও ছিদ্দনের তাতে তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। বুলাকির নাম ধরে ডাকতেই ছিদ্দন বেরিয়ে এসে বলে “দাদা একহপ্তা হল বাড়ি আসেনি। তোমরা কে?”

শেখর সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, “বুলাকি নেই? তার ভাই ছিদ্দন বাড়ি আছে কি? তাকেই ডেকে দাও।”

ছিদ্দন বলে, “আমিই ছিদ্দন। তোমাদের কে পাঠিয়েছে? কেন এসেছ তোমরা?”

এই প্রশ্নের উত্তরে শেখর একটা চাল দিলেন, লাগে যদি তাহলে বাজি মাত, না লাগলেও অন্য উপায়ের কথা ভেবেই রেখেছেন, “ম্যাডাম পাঠালেন। কিছু দিন আগে বুলাকি, ম্যাডামকে কিছু জিনিষের স্যাম্পল দিয়েছিল। ম্যাডামের পছন্দ হয়ে যাওয়াতে সেই স্যাম্পেলর পুরো দুটো কার্টনই চেয়েছিলেন। সেই কার্টন দুটো যদি এনেছ তাহলে সেগুলো দাও। সেজন্য ম্যাডাম হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। বুলাকি না থাকলে তোমাকেই দিতে বলেছেন।”

ছিদ্দন যেন আকাশ থেকে পড়ে, বলে, “দুটো কোথায়? ভইয়া তো একটাই এনেছে হপ্তাভর পহেলে। তারপরে তো ভইয়া আর আসেনি।” এই সময় তার মায়ের গলার আওয়াজ আসে, “এ ছিদ্দনোয়া, আরে শুন তো ইহা।” ছিদ্দন ঘরের ভেতর যেতেই সঞ্জয় ফিসফিসিয়ে বলে, “স্যার এ লোকটার তো নেপালি কাটিঙের মুখ। কিন্তু এর মা হিন্দি বলছে বিহারীদের টানে।”

শেখর বলেন, “এখানে অনেকে বিহার থেকে আসে, চা বাগানের শ্রমিকের কাজ করতে। তারা অনেকেই স্থানীয়দের বিয়ে শাদী করে এইখানেই পাকাপাকি রয়ে যায়। এদেরই কেউ কেউ দুটো বেশি পয়সার লোভে অন্ধকার জগতে চলে যায় যেমন এই বুলাকি। পুরো ব্যাপারটা আমাদের কাছে ধীরে-ধীরে পরিস্কার হচ্ছে। এখন আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লাম মাত্র। দেখা যাক এখন ছিদ্দন কী আনে আর কী বলে।” ছিদ্দন আসছে আন্দাজ করে দুজনেই চুপ হয়ে যায়। ছিদ্দন দুটো মাঝারী সাইজের কার্টন এনে ওদের হাতে দিয়ে বলে, “ভইয়া আর একটা ডিব্বা এনে মায়ের কাছে রেখে দিয়েছিল। ম্যাডামজীকে বলবেন যে আমরা খুব তখলিফের মধ্যে গুজারা করছি। আমি চা ফেক্টারির বয়লারের কাজও জানি। গারডেনে এখন নোতোন লোক লিবার অসুবিধা থাকলে হাম চা ফেকটারিমে ভি কাম করতে পারি।”

প্যাকেট দুটো নিয়ে পাহাড়ি পাকদন্ডী রাস্তায় এসে, রাস্তায় একটা পায়ের ছাপ আর দূরে বাঁকের কাছে একটা সরকারী মারুতি জিপ দেখে উনি একবার নিজে মনেমনে হাসলেন। একটু নিচু গলায় সঞ্জয়কে বললেন, “তুমি এই প্যাকেট দুটো নিয়ে জীপে ওঠো আর ডিএসপি সাহেবকে বলবে যে উনি যেন গাড়ির ইঞ্জিন চালু না করে, পার্কিং ব্রেক আর ক্লাচ ছেড়ে, ঢালু গড়ানে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে একটা বাঁক পেরিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করেন। আমি এইখান থেকে জিপে উঠছি সেটা ছিদ্দন দেখলে গড়বড় হয়ে যেতে পারে।”

সঞ্জয়ের হাতে স্টিয়ারিং ছেড়ে দুজনে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসে চলেছেন মাজিটঁড়ে, বৌদ্ধতন্ত্রের প্রফেসর এমেরিটাস ডঃ দেবু সেনের বাড়ি। সোহম ওয়্যারলেসে বেতগুড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে যে ছিদ্দন আর তার মা’কে একটা গাড়িতে শিলিগুড়ি মর্গে পৌঁছে দিতে এবং অন্ত্যেষ্টির পর তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনাবার ব্যবস্থা করতে। পুলিস লাইনের মেসে দু’জন রাঁধুনির কথা মেস ম্যানেজার সবাইকে বলছিল। যদি সম্ভব হয় তবে ছিদ্দন আর তার মাকে সেই কাজে নিতে বলল সোহম।

রাস্তায় এগোতে এগোতে ছিদ্দনের দেওয়া দুটো প্যাকেটের মধ্যে একটায় পাওয়া গেল মানুষের চামড়ার স্বাভাবিক রঙের সাথে মিলে যাওয়া মুখের বিভিন্ন আকৃতির সাথে মেল খাইয়ে একাধিক মুখোশ। মুখের আদল মিলে গেলে সেই মুখোশ পরে থাকতে যেমন কষ্ট হচ্ছে না তেমনি রাস্তায় পড়া তিস্তা বাজারের ট্রাফিক পুলিস সোহমকে চিনতে না পেরে স্যালুট তো দিলোই না, স্টিয়ারিঙে বসা সঞ্জয়কে তাকে বলতে হল যে ডিএসপি সাহেবের বাড়ির লোক এনারা, কলকাতা থেকে এসেছেন। অন্য প্যাকেটটা খুলতেই প্রথমেই পাওয়া গেল একটা পুঁথি আর তার তলায় কলাপাতার ওপর তুলোর মোড়কে ঢাকা একটা প্যাকেট থেকে কুচকুচে কালো রঙের একটি ভয়ানক দর্শন হিংস্র মুখ উঁকি দিচ্ছে। দ্বিতীয় প্যাকেটটা দেখে শেখর বললেন, “এই পুঁথি আর মূর্তির ব্যাপারে আমাদেরকে আলোকিত করবেন ডঃ সেন। ওনার সাথে এই নিয়ে আলোচনা আমাদেরকে এই কেসের ব্যাপারে অনেক সাহায্য করবে।”

সোহম বলে, “স্যার, আমি আর একটা পুঁথি পেয়েছি। ওর প্যাকেটটা আমার সিটের নিচে রেখেছি। আপনাকে আর সঞ্জয়কে ভুটিয়া এন্ড লিম্বুতে দেখে আমি আন্দাজ করতে পারি যে আপনারা ওখানে কীসের সন্ধানে যাচ্ছেন। ডিপার্টমেন্ট এই কেসের ব্যাপারে যুক্ত সবার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে ফাইল বানিয়ে ফেলেছে। সে ফাইলটাই আমি সেইসময় দেখে নিচ্ছিলাম। দীপকবাবুর ফাইলটা পড়তে-পড়তে আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। আমি মেন্ডাবাড়ি হোটেলের লকার রুমে দীপকবাবুর লকারের আশেপাশের যেসব লকার খালি থাকার কথা, সেগুলো হোটেলকে দিয়ে খোলাই। এর মধ্যে একটাতে আমি এই পুঁথিটি পেয়ে যাই। হোটেল আমাকে জানায় যে এটি দীপকবাবু শুরুতে নিলেও একদিনের মধ্যে খালি করে দেন। হতে পারে দীপকবাবু এটি খালি করবার সময় এই পুঁথিটি ফেলে যান এবং হোটেল সেরকম কিছু চেক না করেই এতে চাবি লাগিয়ে দেয়। হতে পারে এই পুঁথির ব্যাপারে দীপকবাবুকে জেরা করলে, এই কেসের ব্যাপারে কিছু লিড হয়তো পাওয়া যেতে পারে। আমি তাই এটি রেখে নিয়েছি।”

শেখর বলেন, “সোহম, আমরা এই দুটি পুঁথি ডঃ সেনকে দেখাব। দেখি উনি কী বলেন আর এই পুঁথি আমাদের কতটা সাহায্য করতে পারে।”

পথচলতি লাঞ্চের জন্য, সিংটাম চকবাজারে গাড়ি রাস্তার ধারে থামিয়ে সঞ্জয় এনে দিয়েছিল চিকেন রোস্ট আর রুমালি রুটি। সিংটাম ব্রিজ পেরিয়ে, তিতিলঝোরার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তিনজনে লাঞ্চ সেরে নিলেন। ঝোরার জল চোখে মুখে ছিটিয়ে শেখর বললেন, “এই কেসের উল্লেখযোগ্য কী-পয়েন্ট হচ্ছে অপহরণকারী দলটা মুখোশের সাহায্যে সবাইকে ধোঁকা দেবার সফল চেষ্টা করেছে। অপহরণটাও বেশ রহস্যজনকভাবে করেছে। মুক্তিপণ চেয়ে যখন কোনো কল এখনো আসেনি তখন ধরে নেয়া যেতে পারে যে এই কাজের মূল কুচক্রি অর্থের কারণে এই কাজ করেনি এবং সেক্ষেত্রে কেসটা বেশ জটিল হলেও একদিকে ভেবে দেখলে আমাদের এখন প্রধান টাস্ক হল এই অপহরণের মোটিভটা কী, তা জানা। সেটা ঠিকমত বার করে ফেললে অপরাধীকে ধরা আর অপহৃতকে তাড়াতাড়ি ফিরে পেতে সময় লাগবে না। যাই হোক এরা কিছু ভুল করেছে যেটা আমরা কাজে লাগাব। বুলাকিকে মেরে ফেলে এরা আমাদের হাতে অনেকটা লিড দিয়ে দিয়েছে। বুলাকি ভুটিয়া এন্ড লিম্বু ছাড়া আর কোন কোন অ্যান্টিক অপারেটরকে সাপ্লাই দিত সেটার খোঁজ করলে কিছু জরুরি লিড আমারা পেয়ে যাব। মাজিটাড় পৌঁছাতে পৌঁছাতে, তুমি আমাকে এই দীপকবাবু যার ছেলে সুমনকে অপহরণ করা হয়েছে তার এবং এই কেসের সাথে যারা কানেক্টেড তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড, তোমরা যা জোগাড় করেছ আমাকে বল।”

সোহম বলে, “আমার কাছে সেই ফাইলটা এই ট্যাবে আছে। আপনাকে পড়ে শোনাচ্ছি--- ডুয়ারসের সামসিং অঞ্চলে দীপকবাবুর ঠাকুরদার অনেকগুলো বড়ো বড়ো টি এস্টেট ছিল। দীপকবাবুর বাবা এইখানে এইগুলো দেখাশোনার সাথে সাথে জুয়ার নেশাও ছিল। জুয়াতে বড়ো রকমের ধন দৌলত পাবার আশায় এক তান্ত্রিক গুরুর কবলে পড়েন। প্রথমে বেশ কিছু সাফল্য পেলেও পরে এই জুয়া আর তান্ত্রিক আচারের পেছনে অনেক অর্থ খরচ হবার ফলে বিশাল দেনাতে জড়িয়ে পড়েন যার কারণে এই সব এস্টেটগুলি একে একে বেচে দেন। পাছে দেউলিয়া হয়ে যান, সেইজন্য তিনি নিজের চা বাগানের বিক্রির টাকার সিংহভাগ গুরুর পরামর্শে সোনা-জহরত কিনে আসামের কোনো এক জায়গায় গুপ্তধন করে লুকিয়ে রাখেন। সেই গুপ্তধনের ঠিকানা তাঁর গুরুদেব আর তিনি ছাড়া আর কেউ জানতেন না। কিন্তু গুরু-চ্যালা দু’জনেরই কলকাতার কাছেই তাঁদের এক বাগানবাড়িতে কোনো তান্ত্রিক ক্রিয়া চলবার সময় রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়। সেই সময়কার ইনভেস্টিগেশন এবং কেস ডায়েরি থেকে পাওয়া গেছে যে বাগানবাড়ির সেই মন্দিরের ভেতর কোনো তান্ত্রিক ক্রিয়া চলবার সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। মৃত্যুর সময় দুটো মৃতদেহেই আতঙ্কের ছাপ এবং অজানা প্রাণীর দংশনের দাগ আছে। দীপকবাবু ওই বাগানবাড়ি বিক্রি করে বিভিন্ন বাগান থেকে চা এনে প্যকেজিং এবং পরে চা রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। বছর পাঁচেক আগে দীপকবাবু এই ব্যবসার সাথে সাথে বিদেশের বিভিন্ন চা আমদানি কোম্পানির হয়ে টি অকসন এজেন্টের কাজ করতে থাকেন। এই কাজে তিনি শিলিগুড়ি এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন টি এস্টেটে প্রায়ই আসতেন। এইসময় তিনি অ্যান্টিকের বিজনেসেও নেমে পড়েন। শিলিগুড়ি এবং কলকাতা দু’জায়গাতেই প্রাইম লোকেসনে তাঁর বেশ বড়ো দোকান আছে। আমাদের নিজস্ব ইনভেস্টিগেশন সোর্স জানাচ্ছে যে বেতগুড়িতে তিনি প্রায়ই আসেন। প্রথমে তিনি মেন্ডাবাড়ি হোটেলে উঠতেন। পরে এই তল্লাটের সবচাইতে বড়ো চা বাগান যাদের বাগানের সাথে সাথে বিশাল টি প্রসেসিং প্লান্টও আছে সেই বেড়াবাড়ি টি এস্টেটে যাওয়া আসা এবং বাগানের ভেতর তাঁদের গেস্ট হাউসেও থাকতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে তাঁদের সোল সেলিং এজেন্ট হয়ে যান। এরপরই দীপকবাবুর আর্থিক অবস্থা এতটাই ভাল হয়ে যায় যে তাঁর পুরানো বাগানবাড়িটি আবার কিনে নিতে সক্ষম হন। এই বাগানের মালিক বর্তমানে বিপাশা দেবী যিনি তাঁর স্বামী নরেন্দ্র সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর সব সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী হয়ে এই বাগানের বর্তমান মালিক হন। বিপাশা দেবী খুব কম বেতগুড়িতে নিজের চা বাগানে আসেন। টি অকশনের সময় দীপকবাবুর সাথে শিলিগুড়িতে টি অকশন হাউসে তাঁকে দেখা গেছে।”

শেখর, সোহমকে থামতে ইশারা করে বললেন, “এক্সেলেন্ট জব ডান বাই টিম। আমি যা বুঝলাম তাতে আমার মনে হয় তোমরা দীপকবাবুর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মানে তাঁর নাইট লাইফ, ড্যান্স বারে বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি, এইসব নিয়ে কোনো খবর নিয়েছ?”

সোহম মাথা নেড়ে বলে, “স্যার আমরা এই ব্যাপারে একটা রুটিন সার্চ করেছি। উনি নিজের ব্যবসা এবং তাঁর অবসরে নিজের পরিবারের সঙ্গেই সময় কাটান। শৈশব থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে বড়ো হয়েছেন দীপকবাবু এবং সেই ভাবধারাতেই এখনো চলেন। বেশির ভাগ ছুটির দিন এবং প্রতিটি উৎসবের দিন উনি সপরিবারে বেলুড় মঠে চলে যান। ওনার স্ত্রী বিদিশাও বিয়ের আগেই দীক্ষা নিয়েছিলেন।”

শেখর জিগ্যেস করলেন, “বিদিশাকে উনি সামজিক বিয়ে করেন না লাভ ম্যারেজ?”

“স্যার, সেটা বলা যাচ্ছে না। তবে যে বছর উনি বিয়ে করেন তার পাঁচ-ছ’বছর আগে এবং এখনো অবধি কোনো রেকর্ডে তাঁর বিয়ের রেজিস্ট্রি হয়নি। তবে ওনার স্ত্রীর মা বাবা অল্প বয়েসেই মারা যান। তাঁর কাকা-কাকিমা যাদের নাম উনি বলেছেন, সেই দু’জনেই সদ্য প্রয়াত।”

ট্যাব থেকে একটা ফাইলে ক্লিক করে সোহম বলে, “স্যার, সুমন মাঝারি মাপের ছাত্র। তার প্রধান আকর্ষণ কবিতা ও গান লেখা এবং তাতে সুর দেওয়া। প্রকৃতি সে খুব ভালোবাসে। তবে এই ধরনের কিশোরদের যে হৃদয়গত কিছু ব্যাপার থাকে তা কিন্তু এর নেই বলে জানা গেছে। আধিভৌতিক, পারলৌকিক ভূত-প্রেত, হরর এইসব তার খুব পছন্দের। বেশ কয়েকবার ও বন্ধুদের সাথে প্ল্যানচেটে মিডিয়ম হতে গিয়ে বিপদে পড়লেও এই নেশা তার আছে। মা বাবার কড়া বকুনি সত্ত্বেও সে এটি এইখানে বেড়াবার কিছুদিন আগেও করেছে। সুমনের ঘর তল্লাস করে এবং কলকাতা পুলিসের তদন্তে তার কোনো রকম নেশা বা ড্রাগের খবর জানা যায়নি।”

শেখর বললেন, “সোহম, বেড়াবাড়ি টি এস্টেটের মালকিন বিপাশা দেবীর ব্যাকগ্রাউন্ড অনুসন্ধান তোমরা করেছ কি?”

সোহম বলে “স্যার উনি এই কেসে কোনোভাবে জড়িত নন বলে আমরা মনে করছি। সেইজন্য এইসময় আমরা ওনার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করিনি। কিন্তু আমি জয়েন করবার পর ওনার স্বামী নরেন্দ্র তার শোবার ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় হার্ট ফেল করে মারা যান। বিপাশা তার সব সম্পত্তির একছত্র অধিকারিণী হওয়ায় আমরা ওনার সম্বন্ধে অনুসন্ধান শুরু করি। বিপাশা দেবীর সম্বন্ধে প্রথমে বেশী কিছু জানতে পারিনি। উনি বেশ সুন্দরী এবং শিক্ষিতা তা সত্ত্বেও নিজের বয়েসের চাইতে প্রায় ডবল বয়েসি লোককে কেন বিয়ে করলেন আর ওনার বাপের বাড়ি কোথায় এই খবরগুলো পেতে বেশ সময় লেগে যায়। বিভিন্ন পুলিস ফাইলস থেকে জানা যায় যে একদম শৈশবে উনি নিরুদ্দেশ হয়ে নিউ দিল্লি স্টেশন প্লাটফর্মে ঘুরতেন। পুলিস ওনাকে একটি মিশনারির হাতে তুলে দেয়। এরপর ভাগ্য সহায় হয়। মিশনারিদের স্কুলে ইংরাজি মাধ্যমে স্কুলের পড়া শেষ করে, বিশেষ স্কলারশিপ এবং অনুদান পেয়ে হোটেল ম্যনাজমেন্টে ডিগ্রি পান। দিল্লি ও কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে ফ্রন্ট অফিসে কাজ করার সময়, শিল্পপতি নরেন্দ্রর সাথে আলাপ ও সামাজিক বিয়ে। বিয়ের প্রায় পরেই নরেন্দ্র তাঁর সব সম্পত্তির একছত্র উত্তরাধিকার বিপাশাকে দিয়ে যান। শুরু থেকেই, বেড়াবাড়ি টি এস্টেটে বিপাশা খুবই কম থাকেন। তাঁদের উইন্ডমিল, সৌর বিদ্যুত, এছাড়া এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের বিজনেস ছড়ানো আছে দেশে ও বিদেশে। উনি সেইগুলো দেখবার কাজে ব্যস্ত থাকেন।”

প্রফেসর দেবু সেনের বাংলো বাড়ির আউটহাউসে দু’ঘন্টা বিশ্রাম নেবার পর তাঁর বিশাল লাইব্রেরি রুমে ডাক পড়ল। এককোণে একটি টেবিলে দুটি বড় থারমোসে চা, কফি আর হটপট ভরতি গরম সামোসা রাখা আছে। যেমন ইচ্ছে খাও, কোনো ফর্মালিটি নেই। ওরা দু’জন এইখানে পৌঁছাবার সময়ই, পুঁথি দুটি স্টাডি করবার জন্য ডঃ সেন তাঁদের কাছ থেকে নিয়েছেন। ওরা এইসাথে সেই মুখোশের প্যাকেটটিও তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সিকিম- বাংলা এই দুই রাজ্যের প্রায় সীমান্তে এই গ্রাম মাজিটাড়। সারাটি দিন একটু গরম ছিল, তাই সন্ধ্যে হতেই অঝোরে বৃষ্টির সাথে সাথে অন্ধকার আকাশ জুড়ে মাঝে মাঝেই দেখা দিচ্ছে বিদ্যুতের আলপনা। চা পানের পর্বেই প্রফেসর তাঁদের অনুরোধ জানালেন যে বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি রাস্তায় ফিরে না গিয়ে রাতটা তাঁর এইখানেই কাটিয়ে যেতে। শেখর বললেন, “স্যার, আপনার সাথে যতটা সময় কাটানো যায় ততই নিজের অন্ধকার কাটে।” বিপত্নীক প্রফেসর সেন তাঁর পরিচারককে বললেন, “রাত্রে আজ দম বিরিয়ানি আর বুরহানি বানাবার ব্যবস্থা করে ফেল। দেখি আজ তোমার হাতের কেরামতি আর এনারা কী বলেন সেটাও শুনি।”

“আপনাদের কাছ থেকে আমি মোট চারটে জিনিস পেয়েছি। দুটো পুঁথি, একটি ধ্যানমূর্তি এবং মুখোসের একটা প্যাকেট। চারটে জিনিসই কিন্তু একে অন্যের সঙ্গে এক যোগসূত্রে বাঁধা। আমি প্রথমে মুখোশের কথায় আসছি কেননা পুঁথিদুটোর স্তোত্রতে এই মুখোশকে ব্যবহার করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের পাহাড়তলিতে সেনসা নামে এক আদিম জনজাতি সম্প্রদায় বাস করত যারা জীবিকার জন্য চাষবাসের কাজ করতে বাধ্য হলেও তারা আদতে ছিল উঁচুমানের শিল্পী। দ্বিমাত্রিক কোনো চিত্র থেকে ত্রিমাত্রিক রূপ এবং বিমূর্ত প্রতীক চিত্র ইত্যাদি তৈরি করতে পারত। এদের একটি অংশ কোনো কারণে তিব্বতে এবং নেপালে গিয়ে পৌঁছায় যেখানে স্তোত্রপাঠের অর্থ বুঝিয়ে দিলে তারা তান্ত্রিক দেবদেবী এবং অপদেবতাদের মুখোশ বানিয়ে ফেলতে পারত। বৌদ্ধতন্ত্রে একটি উপাসনার পদ্ধতি ছিল যেখানে সাধক এইসব মুখোশ পরে সাধনার মধ্যে নিজের আত্মার মধ্যে সেই দেবদেবী বা অপদেবতাকে আহ্বান করত। কিছুসময় পরে এদের এক বড়ো অংশ আসামে বসবাস করতে শুরু করে এবং এদের এই প্রতিভাকে আসামের তান্ত্রিকেরাও কাজে লাগান। সবস্থানেই ভাল এবং দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা থাকে। কিছু তান্ত্রিক, কারো ক্ষতি সাধনের জন্য এদের দিয়ে যার ক্ষতি করতে হবে তার মুখের চিত্র এদেরকে দেখিয়ে সেই মুখের হুবহু প্রতিরূপ তৈরি করাতেন। এরপর পুঁথিতে লেখা মন্ত্রোচারণ করে সেই মুখে নানারকম সুচ ফুটিয়ে আসল ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে হত্যা করতেন। এই তান্ত্রিকদের একটা বড় অংশ মায়াং-এ বসবাস করতে শুরু করে। মায়ং-এ তন্ত্রের ভালো এবং মন্দ দুদিকেরই সাধনা হতে থাকে। এই সময় অনেক মন্ত্র যা মুখে মুখে ছিল তা পুঁথির আকারে লেখা শুরু হয়। এই পুঁথির শুরুতে, শেষে এবং মধ্যে এই পুঁথির লেখক নাগধর বেজ বলে লেখা আছে। আমি এই নামে একজনকে জানি যিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত এবং তন্ত্রাচার্য এবং এনার নাম বিনয় হাজারিকা বলে সরকারী কাগজপত্রে লেখা থাকলেও পুরো মায়াং এ লোকে ওনাকে নাগধর বেজ বলেই জানে। এই অঞ্চলে যারা তন্ত্রাচার্য এবং কুলগুরু হন তাঁরা বংশ পরম্পরায় একই নাম রাখেন যাতে তাঁদের শিষ্যরাও সেই বংশ পরম্পরা মেনে চলেন। এই পুঁথির যে অংশটি সোহম পেয়েছেন তাতে শুধু বীজমন্ত্র আছে, পরেরটিতে উপাসনা এবং স্তবস্তুতি ও প্রার্থনা আছে। দুটি পুঁথিই মায়াং নিবাসী নাগধর বেজের লেখা। এগুলি নিঃসন্দেহে মায়াং এর পুঁথি।”

শেখর বললেন, “আপনার কথার মাঝখানে বলার জন্য মাফ করবেন স্যার। বীজমন্ত্র আর উপাসনা একটু যদি বুঝিয়ে বলেন। এই অপহরণ কেসে হয়ত এই পুঁথির লিঙ্ক থাকতে পারে।”

ডঃ সেন বোঝাতে গিয়ে বললেন, “একটু সরল করলে, মায়াং থেকে আনা ছোট পুঁথিটি হচ্ছে ঘরে ঢোকবার চাবি আর দ্বিতীয় পুঁথিটি হচ্ছে ঘর। বীজমন্ত্রে শরীরের মধ্যে নানা চক্রের মধ্যে যেটি দরকার সেইটিকে জাগ্রত করা হয়। যেমন এই পুঁথিতে অনান্য চক্রের সাথে জোর দেয়া হয়েছে ভ্রু র মাঝখানে আজ্ঞাচক্রকে জাগ্রত করাতে যাতে আবাহিত শক্তিকে অথবা কোনো অপশক্তি, অশরীরী ইত্যাদি দর্শন করা যায় এবং পরের পুঁথিটি পাঠ করে সেই দেবী বা অপদেবীকে উপাসনা করে তাঁকে ধ্যানমূর্তিতে আবদ্ধ করে পরে তাঁকে দিয়েই নিজের দুরভিসন্ধি সাধন করা, যেমন যার ক্ষতি করতে হবে তাঁর পুতুল বানিয়ে, একের পর এক সুচবিদ্ধ করে হঠাৎ করে অজানা রোগে মেরে ফেলা। আপনারা পুঁথির সাথে যে ভীষণদর্শনা কালো রঙের মূর্তি আমাকে দিয়েছেন এটি সেইরকম এক ধ্যানমূর্তি।”

ডঃ সেনের সাথে মিটিং-এর সাথে সাথে ইটিং অর্থাৎ রাতের ডিনারও চলছিল। তবু সব শেষ হতে প্রায় মাঝরাত পেরিয়ে গেল তারা দু’জন গেস্টরুমে যখন বিশ্রাম নিতে এলেন। রুমে আসতেই এস এসপি শেখরের মোবাইলে রিং হতে লাগলো। শেখর, সোহমকে বললেন, “দিল্লি এসবি’র ফোন। দারুণ অ্যাকটিভ এরা, সত্যিকারের পেশাদার।” ফোন তুলে উনি বলেন, “বোল বলবীরা, মিলা কুছ?” এরপর দিল্লী পুলিশের কাছ থেকে কিছু খবর শুনে বসে পড়লেন নিজের শয্যায়। সব শুনে বললেন, “সচ মে বলবীরা? ওহ মারভেলাস। তোমরা দুটো ছবি মিলিয়ে নিয়েছ টেকনিক্যাল এক্সপার্ট দিয়ে? রিয়েল গুড জব বাই ইয়োর টিম, থ্যাংকস টু অল অফ দেম।” ফোন সুইচ অফ করে তিনি সোহমকে জড়িয়ে ধরেন, “তোমার ব্রেন ওয়েভ দারুণ কাজ করেছে। আমরা এখন অপরাধীর খুব কাছে। সে অপহরণ ছাড়া কমপক্ষে দু’ দুটি অপ্রমাণিত হত্যার সাথেও জড়িত। কিন্তু আমাদের ঘরের ছেলেরা কী করছে এতক্ষণ ধরে? দুটো সামান্য কাজ, তা করতে এতো সময় কেন নিচ্ছে?”

সোহম বলে, “স্যার, ওরা অনেক আগেই সে কাজ করে ফেলেছে। আমরা তখন ডঃ সেনের সাথে আলোচনা আর ডিনারে ব্যস্ত ছিলাম।”

“আমি কল করছি” এই বলে শেখর মাথা নেড়ে বলেন, “নাঃ বেটার ইউ কল দেম।” সোহম কল করতেই ইনস্পেকটর, সি আই ডি অরিজিৎ বোস বললেন, “হ্যাঁ স্যার, আমরা ওই বছরের ম্যারেজ রেজিস্ট্রেসনের রেকর্ড পেয়ে গেছি। স্যার, এস এস পি সাহেব কি ওইখানে আছেন? ওনার সাথে একটু কথা বলে নিতে চাই।”

শেখর বললেন, “ভেরি গুড অ্যান্ড কুইক জব বাই টিম। ওই অ্যাকশন প্ল্যানের ব্যাপারে বলবে তো?”

“হ্যাঁ স্যার। আপনি যা অনুমান করেছিলেন আমরা আজ স্পটে গিয়ে তাই দেখতে পাই। এই বাড়ির মেরামতির কাজের আর সিকিউরিটির ঠিকাদার আমার চেনা লোক। আমার কথামত সে বাড়ির মন্দিরের কাছে জঙ্গল সামান্য পায়ে চলার মতো রাস্তা বানিয়ে বন্ধ করে, লোকদের এইখানেই অন্য কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। বাড়ির মালকিন যদি ফোন করেন তবে তাকে কী বলতে হবে শিখিয়ে দিয়েছি। টাস্ক ফোর্সের কম্যান্ডোরাও আমাদের সাথে ছিল। তাদের অফিসারকে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝিয়ে অনসাইট দেখিয়ে দিয়েছি এবং তারাও ঠিক করে নিয়েছে রেস্কিউ অপারেশনে কোথায় কোথায় পজিশন নিয়ে থাকবে। পুরো বাড়িটায় আর বাগানে অনেকগুলো সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়ে গেছে। আমাদের এস টি এফের লোকেরাই সিকিউরিটি সেজে থাকবে। আমি প্রত্যেক প্রধান লোকদের সাথে আলাদা আলাদা করে মিটিং করে বুঝিয়ে দিয়েছি যে ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে সোজা মনে হলেও সামান্য ভুলচুক হলেই একটি কিশোর ছেলের প্রাণ যেতে পারে, ব্যাপারটা নিয়ে মিডিয়া ঝড় তুলতে পারে।”

শেখর বললেন, “আমি নিজেও কাল পৌঁছচ্ছি, যদিও তুমি যেখানে আছ সেখানে আমার দেখার কিছু নেই। ওকে সো লং দেন।”

শেখর মোবাইলের দিকে চেয়ে বলেন, “আমি এই গাড়িটা নিয়ে বাগডোগরা এগোচ্ছি। ফ্লাইটে’ই একটু রেস্ট নিয়ে নেব। এস পি মারিগাও পুজেশ্বরের টিম মায়াং থেকে গাড়িটা বেরোতেই শিলিগুড়ি অবধি গাড়িটাকে কভার করবে। সব চেকপোস্টকে বলে দেওয়া আছে যে গাড়িতে ভি আই পির পরিবার আছে, কেউ যেন চেকিং না করে। শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা রুটের ব্যপারটা তুমি অরগানাইজ করো। একদম তৈরি থেকো। ওই গাড়ি শিলিগুড়ি পেরবার পর দীপকবাবু আর তার স্ত্রীকে নিয়ে তুমি নিয়ে চলে আসবে কলকাতায়। কোনোভাবেই তারা যেন কলকাতার কোথায় আর কেন যাচ্ছ সেটা বলবে না, বলবে একদম শেষের দিকে। অবশ্য তখন ওরা নিজেরাই বুঝে নেবেন।”

দমদমের পোড়ো বাড়িটার মন্দিরের রাস্তা বেশ ভালোভাবে তার চেনা। শ্বশুর- শাশুড়ি তাকে প্রথমে মেনে না নিলেও পরে এই বাড়িতেই একটা ছোটো অনুষ্ঠান করে বরণ করে নেন। বিরক্ত হচ্ছিলেন তিনি, পয়সা অঢেল দিলেও ঠিকাদার কাজ কিছু করেনি। তার সঙ্গে থাকা এই পরিবারের কুলগুরু নাগধর’ও বিরক্ত হচ্ছিলেন। আগাছা আর ঝোপের ভেতর দিয়ে যেতে আর অচেতন সুমনকে তাঁকেই সামলাতে হচ্ছিল। কোনোমতে সেইখানে পৌঁছে তিনি বললেন, “আমি প্রস্তুত হচ্ছি, বেশী সময় নেব না। আমি পুজোতে বসলেই তুমি ছেলেটাকে সামলাবে। এ এই বংশের উত্তরপুরুষ এবং মায়াং-এও দেখেছি এর ওপর ভর হতে বেশী সময় লাগে না। ভর শুরু হতেই আমি অন্য পুঁথিটি থেকে পাঠ শুরু করে তোমাকে ইশারা করব। তুমি এই কৃপাণ ছেলেটির বাম বাহুর ওপরের মোটা শিরাতে সামান্য চাপ দিলেই যে রক্তপ্রবাহ বেরোবে তা এই প্রদীপে সংগ্রহ করবে। দেবীকে সেই রক্ত নিবেদনে তুষ্ট করে তবেই জানা যাবে মায়াং থেকে সাতটি রূপার ঘড়া ভর্তি সোনার গিনি দীপকের বাবা কোথায় রেখেছে। ঘড়াগুলো পেয়ে গেলেই, আমি কুলগুরুর পাওনা নিয়ে সরে যাবো। এই ছেলেটিকে যা করার তা তুমি স্থির করবে।”

সুমনের শরীরে কম্পন শুরু হতেই নাগধর সুরেলা কণ্ঠে দ্রুত শ্লোকপাঠ করে জিজ্ঞাসা করলেন, “দেবী প্রসিদং, প্রসন্নে ভবঃ ইয়হ তিষ্ঠঃ।” সুমন হেসে ওঠে উচ্চস্বরে, “দেবী আসেননি পাপিষ্ঠ, আমি দীপকের বাবা শমীন্দ্রনাথ এসেছি। তোর বাপ আমার গুরু ছিল আর সে ছিল সত্যিকারের সাধক, তোর মত লোভী, বদমাশ নয়।” নাগধর কুটিল হেসে বলে, “সেই সুযোগ নিয়ে এই মন্দিরেই তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে তার পাওনা না মিটিয়ে তোর পোষা প্রেত দিয়ে শেষ করিয়েছিলি। কিন্তু বাবার আর এক দেহরক্ষী অপদেবতা পরে এই ঘরেই তোকে আঁচড়ে, আঁচড়ে শেষ করেছিল। এবার বল সেই গিনি সোনা ভর্তি সাত ঘড়া কোথায় রেখেছিস?”

“আমার কষ্টার্জিত অর্থ, তোর বাপের বুদ্ধিতে ডুবতে বসেছিল। আমি নিয়ে এসেছি। তা তোর হাতে দেব কেন? যা, যা পালা। আমি দেখতে পাচ্ছি তোর দুর্দিন সামনে।”

নাগধর বলে, “তুই তাহলে কালনাগিনীকে ভুলে গেছিস। দেখ, দেখ তোর সামনেই তৈরি আছে। ছেড়ে দি ওকে তোর কাছে। কামড়ের জ্বলুনিতে ছটপট করবি।”

“না, না তুমি আমার নাতি সুমনের ক্ষতি করো না। সবকটা ঘড়া আছে মন্দিরের গর্ভগৃহে, দেবীর পঞ্চমুণ্ডী আসনের তলায়। তোর ক্ষমতা আছে তো যা নিয়ে আয়।”

নাগধর বলে, “সেই কাজ তুই কর। তোর আরাধ্য দেবীর কাছে, তুই নিয়ে আয়। দেরি করলে কালনাগিনীকে...”

সুমন কাঁপতে কাঁপতে বলে, “চল দেবীর কাছে। আমি পঞ্চমুণ্ডীর আসনে পাতা দেবীর ঘট সরিয়ে এক এক করে সাতটা ঘড়া নিয়ে আসব। তুই তোর প্রাপ্য পেয়ে যাবি। কিন্তু সুমনের কোনও ক্ষতি যদি করিস তাহলে তুই কুলগুরুর বংশধর হলেও আমি ছেড়ে কথা বলবো না।”

মন্দিরের গর্ভগৃহে তিনজনে প্রবেশ করতেই এক প্রচণ্ড ধাক্কায় নাগধর ছিটকে পড়েন, দু পাশ থেকে দু জন কমান্ডো চেপে ধরে তাকে। দু’জন মেয়ে কম্যান্ডো সামনে পেছনে এগিয়ে যাচ্ছিল বিপাশার দিকে। কিন্তু বিপাশা তাদের চাইতে ক্ষিপ্রগতিতে গর্ভগৃহের প্রবেশ পথের কাছে সরে এসে,সুমনের গলায় কাছে একটু আগে নাগধরের দেওয়া কৃপাণ ধরে চিৎকার করে বলে, “কেউ এগিয়ে এলে সুমনের গলার কাছে ধরা কৃপাণটা তার কাজ করে নেবে।” পর মুহূর্তেই পেছন থেকে একজন তার কাঁধে এক প্রচণ্ড আঘাত করতেই বিপাশা ছিটকে পড়ে। নিজের হাতের কৃপাণ হারিয়ে সে তার জিনস এর পকেটে হাত বাড়াতে যাবার আগেই তার কব্জিতে নিজের রেসিং শু র স্পাইক দিয়ে আঘাত করে চেপে ধরে নিজের নাইন এম এম তার দিকে তাক করে সোহম বলে “মেঝেতে যেমন আছেন তেমনি শুয়ে থাকুন। স্মার্ট হবার সামান্য চেষ্টা করলেই আমার দেরি হবে না এটা চালাতে।” সোহমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে নারী কম্যান্ডোরা তাকে জাল বিছিয়ে বেঁধে ফেলে।

ভাঙ্গাচোরা বাড়িটার গাড়িবারান্দায় শেখরের দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুমনের সাথে তার মা- বাবা। হাতকড়া পরানো বিপাশা আর নাগধরকে, সোহম এবং এস টি এফের কম্যান্ডোদের সাথে আসতে দেখেই তিনি দীপককে বললেন, “রেজিস্ট্রি করে আইনসম্মত ভাবে এখনও প্রথমা স্ত্রী বিপাশা যিনি বিদিশা ম্যাডামের দিদি তাঁর সাথে বা আপনার কুলগুরু নাগধরের সাথে আপনার পরিচয়ের দরকার নেই। আপনার প্রথম যৌবনে যখন আপনার বাবা একের পর এক চা বাগান বিক্রি করছেন দেনার দায় থেকে বাঁচবার জন্য তখন ইনি আপনার ঘর ছেড়ে আরো কোনো উজ্বল ভবিষ্যতের আশায় ঘর ছাড়েন যা আপনি লোকলজ্জার ভয়ে লুকিয়ে রাখেন। ভাগ্যদেবী যখন আবার আপনার সহায় হন তখন এক টি অকশন মিটে আপনি আপনার প্রথম প্রেমকে আবার খুঁজে পান। ততদিনে উনি বেড়াবাড়ী টি এস্টেট এবং আরো অনেক ব্যবসার মালিক … সামাজিক বিয়ে করে ফেলেছেন। পুরাতন প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষণে তখন উনি তাঁর পথের কাঁটা … সরিয়ে ফেলেন খুব সম্ভবত তাঁর সুপরিচিত গুরু নাগধরের সহায়তায় কোনো তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আগেরবার আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও আপনাদের পরিবারের গোপন কথাটির খবর উনি জানতেন। আপনার সাথে ওনার পুরানো প্রেম জেগে ওঠবার সাথে সাথে বিপাশা আপনার বাবার গুপ্তধন পুনরুদ্ধারের উপায়টিও মাথায় রাখেন। আপনার মন জয় করবার জন্যই দমদমের বিশাল বাড়িটি কেনবার জন্য আপনাকে ব্যাঙ্কের ঋণভার থেকে উনি মুক্ত করেন তবে মালিকানাটি নিজের নামে করে নেন। গুপ্তধন পাবার জন্য মায়াং এ উনি নাগধর বেজকে নানা প্রলোভন দেখান। নাগধর আর বিপাশা, দু’জনেরই ধারণা ছিল যে এই গুপ্তধন মায়াং এর কোনো তন্ত্রস্থানে লুকিয়ে রাখা আছে। নাগধর মায়াবিদ্যার সবরকম উপায় কাজে লাগিয়েও এর কোনো কিনারা করতে পারেননি। অবশেষে তাঁর মাথায় আসে যে আপনাদের বংশের কিশোর বংশধর অর্থাৎ সুমন’কে এই কাজে লাগালে তবেই গুপ্তধনের কিনারা পাওয়া যাবে। সুমন কিন্তু ওনাদের কাজ অনেক সুগম আর সোজা করে দেয়।” সোহম আর আর শেখর দু’জনেই লক্ষ করেন যে বিদিশার তাঁর স্বামীর এই নতুন পরিচয় শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। শেখর, সোহম বলেন, “সোহম, অ্যারেস্ট ওয়ারান্ট আসতে আর কতো দেরি হতে পারে?”

সোহম বলে, “স্যার আর মিনিট দশেক লাগতে পারে।”

বিদিশা বলেন, “শেখর স্যার আপনি থামলেন কেন? আমার আর সুমনের সব জানা উচিত।”

শেখর বললেন, “বেশ চলছিল দীপকবাবুর টি বিজনেস কিন্তু উনি এর সাথে অ্যান্টিকের বিজনেস শুরু করে অনেক কিছুতে জড়িয়ে পড়লেন, অন্ধকার জগতের অনেকের সাথে ওনার চলা শুরু হল। এর মধ্যে ওনার হাতে এলো মায়ং থেকে আসা একটা পুঁথি। এই পুঁথির খুব ডিম্যান্ড দেখে উনি আরো দাম পাবার জন্য এই হোটেলের লকার রুমে লুকিয়ে রেখে শাঁসালো বিদেশী খদ্দের খোঁজা শুরু করলেন। এই সময় কিছু খদ্দের পেয়ে সেটি লকার রুম থেকে উনি নিজের ঘরে আনেন। এই সময় এটি সুমনের হাতে পড়ে যায় এবং ঘটনা চক্রে এই পুঁথি পাঠ করে দীপকবাবুর ছেলের সাথে একটা অলৌকিক কিছু ব্যাপার হয় যা অপহরণকারীদের, যারা সুমনের মর্নিং ওয়াকের অপেক্ষা করছিল, কাজটা অনেকটা সোজা করে দেয়। এদিকে উনি ছেলে আর মহামূল্যবান পুঁথি দুটোই হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। পুঁথি হয়ত লকার রুমেই রেখেছেন এই ভেবে সেদিকে যাবার পথে কারো আক্রমণে আহত হন। দীপকবাবু আপনি কি তাঁকে দেখতে পেয়েছিলেন?”

বিব্রত হয়ে দীপকবাবু বলেন, “দেখেছিলাম আর চিনেওছিলাম কিন্তু সেকথা…”

সোহম বলে, “আপনি পুলিসকে কিছুই বলেননি তখন। কেন?”

“আমি নিজেই আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি।”

শেখর বলেন, “কেননা আপনি দেখেছিলেন যে আপনার স্ত্রী আপনাকে পেছন থেকে আঘাত করছেন। অথচ তাঁর কিছু আগে আপনি দেখেছেন যে কড়া ডোজের সেডেটিভ নিয়ে তিনি এখন আচ্ছন্ন হয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন। আপনি আপনার এই কথা তখন আমাদের জানালে আমরা তদন্তের কাজে অনেক এগিয়ে থাকতাম। তবে বিপাশা দেবী আপনি দীপকবাবুর কাছে খবর পেয়ে, ছিদ্দনের দাদাকে কাজে লাগিয়ে কিছু মুখোশ পেয়ে যান। আপনার আর আপনার বোনের মুখের একই আকৃতির সুবিধাটা কাজে লাগিয়ে যথাযথ মুখোশটা পরে বিদিশা দেবী হয়ে গিয়ে আমাদেরকে খুব ভাল ধোকা যেমন দিয়েছেন তেমনি এই মুখোশের সূত্র ধরে আমরা তদন্তের কাজে ভালো লিডও পেয়ে যাই। আমরা বুঝে যাই যে মুখোশের আড়ালে সম্ভাব্য অপরাধীদের মধ্যে আপনি একজন। এর সাথে বুলাকিকে মেরে ফেলার ব্যপারে সুপারি যে আপনি দিয়েছেন সেটা জানতে পেরে আমাদের কাছে ব্যাপারটা অনেক পরিস্কার হয়ে আসে। আপনি এবং আপনার গুরু মুখোশ পরে আমাদেরকে ধোঁয়াশায় ফেললেও অনান্য সব সূত্র ধরে বিশেষত দীপকবাবুর ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজে আমরা বুঝে যাই আপনাদের মোটিভ, এবং এটা জানতে দেরি হয়নি যে সুমনকে আসলে হিপ্নোসিস করে তার ভেতরে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনার সূত্র ধরে আপনারা বুঝে যান যে গুপ্তধন মায়ং-এর কোথাও নয় বরং সেটা সরিয়ে নিয়ে দমদমের বাড়িতেই রাখা আছে। সুমনের সাথে এই অলৌকিক ব্যাপারটা না হলে আপনাদেরকে মায়ং-এ এই রকম হাতেনাতে ধরবার সুযোগ পেতাম না।”

সোহম বলে “স্যার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট এসে গেছে। চলুন গুরু আর চেলা দুজন। আজ রাতটা আমাদের আতিথ্যে কাটান, তারপর দেখি কোর্ট কী বলে পুলিস কাস্টডি না এই দমদমের জেল কোনটাতে আপনারা থাকবেন।”

সবাই চলে গেলে সোহম শেখরকে বলে “আপনার কাছে আমার এখনও অনেক শেখা বাকী আছে স্যার। কিন্তু স্যার সুমন বলছে ওর ওপর সেই মেয়েটির ভর হওয়া বা কোনো মানুষের পুতুল বানিয়ে মায়াং-এ যে অলৌকিক শক্তির কথা শুনি তার কি সত্যতা আছে?”

নিজের হাভানা চুরুটে আগুন লাগিয়ে শেখর বলেন, “আমরা পুলিস--- অপরাধীর,অপরাধের সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করে আইনের হাতে তুলে দিতে পারি কিন্তু সব দরজা চেষ্টা করেও খোলা যায় না। এগুলোও তাই বলে ধরে নিতে হবে।”