বিষানল - অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

মন্দার পর্বত ও সর্পরাজ বাসুকির সাহায্যে সমুদ্র মন্থন করে দেবতারা পেলেন অমৃত আর অসুরদের ভাগ্যে জুটল হলাহল। দেবতারা অমরত্ব লাভ করলেন। বিষ হাতে পেয়ে অসুরেরা নামল ধ্বংসযজ্ঞে।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থের এই কাহিনীর সাথে আমরা সকলেই বহু পরিচিত। কিন্তু বিষের উপর অধিকার কি শুধু নরকের বাসিন্দাদের? সে কি শুধুই শয়তানের হাতের অস্ত্র? হয়তো নয়। শাসকের হাতে সেই বিষ কেমন ভাবে মারণাত্মক হয়ে উঠতে পারে, পৃথিবীর প্রতিটি যুদ্ধ তার সাক্ষী। শাসক তো দেবতারই প্রতিনিধি। তাই অমৃত কিম্বা বিষ, সবেতেই তার একছত্র অধিকার।

মানব ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, রাজনীতিতে বিষ কীভাবে প্রবেশ করে একেবারে জাঁকিয়ে তার অধিকার দাবী করেছে। সম্পদের অধিকারভোগ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ঈর্ষা। ঈর্ষা জন্ম দিয়েছে সন্দেহ। সন্দেহের অজানা কানাগলিতে ওঁৎ পেতেছে মৃত্যু।

পরিমাণে কম হলে বিষ হয় জীবনদায়ী (অমৃত?)। আবার সেই অমৃতরূপী ওষুধ, পরিমাণের আধিক্যে হয়ে ওঠে বিষ। তাই বুঝি অমৃত ও বিষের তফাতটা অতি সামান্যই। দ্রব্য ব্যবহারের গুণে কখনো বিষ হয়ে ওঠে প্রাণদায়ী, আবার কখনো প্রাণহারী।

মানুষ ঠিক কবে থেকে বিষ প্রস্তুতির মশলা আয়ত্ত করল, ইতিহাস ঘেঁটে বার করা কষ্টসাধ্য। কারণ মানবসভ্যতার সব ইতিহাস তো লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়নি! এখনো পর্যন্ত মানুষের হাতে আসা সবচাইতে প্রাচীন পুঁথি প্যাপিরাসে বিষের ঔষধি গুণাবলী লেখা দেখতে পাওয়া গেছে, সেটি আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পুরনো। তবে অন্যান্য নিদর্শন, যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে পাওয়া মানুষের জীবাশ্ম পরীক্ষা করে পণ্ডিতেরা জানাচ্ছেন—বিষ তৈরির কৌশল আরও প্রাচীন। প্রায় ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাদ আগেও মানুষ বিষের ব্যবহার জানত।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে পন্টাসের রাজা মিথিরিডেটস–৬ প্রভূত বিষ আবিষ্কার করেন। তার এই আবিষ্কারের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর বিষপ্রয়োগের থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা। তিনি নিত্য নতুন বিষ আবিষ্কারই শুধু করতেন না, তার প্রতিষেধক খুঁজে তথ্যসমূহ লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। বিষ প্রয়োগে তাকে কেউ হত্যা করবে এই ভয়ে, রোজ একটু একটু করে নিজের শরীরে বিষ ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে সেই বিষের মাত্রা বাড়াতেন। এক কথায় তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক বিষ-পুরুষ। অবশ্য এমন এক বিষ-পুরুষের কামড়ে মানুষ মারা যেত কিনা, সে বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। মিথিরিডেটাসের শত্রু ছিলেন রোমের রাজা পম্পেই। রোমের সৈন্য পন্টাস আক্রমণ করে রাজা মিথিরিডেটসকে বন্দী করে। পম্পেইয়ের বিচারে মিথিরডেটাসের শাস্তি হয় মৃত্যু। শাস্তি এড়াতে রাজা মিথিরিডেটস মৃত্যু বরণ করবার উদ্দেশ্যে নিজেই নিজের শরীরে বিষ প্রয়োগ করেন। কিন্তু বিষ-পুরুষের শরীরে সেই বিষ কোনও কাজ করল না, আর মিথিরিডেটস মারা গেলেন না। অগত্যা রাজা পম্পেইয়ের নির্দেশে মিথিরিডেটসকে কেটে ফেলে হত্যা করা হয়।

৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়ায় সুমের সভ্যতার আরাধ্য বিষ দেবীর নাম - গুলা। বিষ প্রয়োগ করে রোগ নিরাময়ের জন্য মানুষ তার আরাধনা করতো। গুলা দেবীর আরাধনার যে সমস্ত নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা থেকে বিষ ব্যবহারে প্রাচীন মানুষেদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয়। গুলা শব্দের অর্থ – মহান। অর্থাৎ মহান ছিল গুলাদেবীর বিষ প্রয়োগের ক্ষমতা। গুলার মা ছিলেন অনু। তিনিও আরোগ্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। গুলার বাবা আবু ছিলেন কৃষিকার্যের দেবতা। বিশেষজ্ঞদের মতে — গুলা তার বাবা ও মায়ের কাছে শেখা ব্যবহারিক জ্ঞান থেকে ভেষজ বিষ বানাবার পদ্ধতি আয়ত্ব করেছিলেন। মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া গুলা দেবীর মন্দিরে অনেক কুকুরের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সাথে চিনে মাটির কুকুরের মূর্তিও পাওয়া গেছে। কুকুর যে নিজের গা চেটে রোগ নিরাময় করতে পারে, সেটি তখনকার দিনের মানুষের জানা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে পুরুষ দেবতাদের রমরমা শুরু হতে থাকে। কিন্তু গুলা দেবীর মহিমা বহুকাল পর্যন্ত সমাজে অটুট ছিল।

হিন্দুধর্মে সর্পদেবী হিসেবে মনসার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদে। পুরাণে তাঁকে ঋষি কাশ্যপ ও নাগ-জননী কদ্রুর কন্যা বলা হয়েছে। জনসমাজে প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, শিব বিষ পান করার পর মনসা তাঁকে রক্ষা করেন এবং তারপর থেকে ‘বিষহরা’ নামে পরিচিত হন। যদিও দেবীর কুলীন আসন তার কপালে কোনোদিনই জোটেনি।

গুহাবাসী শিকারি-সংগ্রহকারী জীবন থেকে নেওয়া পাঠে মানুষ একদিন হয়তো শিকার করা পশুর পিছনে ছুটে বেড়ানোর পরিশ্রম ও সময় সংক্ষেপের তাগিদেই লতাপাতা থেকে বিষ তৈরির কৌশল আয়ত্ত করে ফেলে। এমনটাই ধারণা পণ্ডিতদের। তিরের ফলায় বিষ মাখিয়ে শিকার করতে শুরু করে একদিন লড়াইতে মানুষ মারার কাজেও সেই বিষ মাখানো তির ব্যবহার করা শুরু হয়। মানুষই হয়ে ওঠে মানুষের শত্রু। রাজনীতি-ধর্মনীতি জন্ম দিল নতুন নতুন বিষ ও মারণাস্ত্রের। প্রাণদায়ী সুধা কখন যে প্রাণঘাতী হয়ে উঠল, মানব সমাজ জানতেই পারল না। প্রাকৃতিক সম্পদ একজায়গায় কিছু মানুষের হস্তগত হল, কিছু মানুষ হল বঞ্চিত। হিংসা বিদ্বেষ সম্পত্তির লোভ জন্মাল মানুষের মধ্যে। নিঃশব্দ ঘাতকের রূপ নিল মানুষের তৈরি বিষ।

নারী শাসিত যৌথ জীবন থেকে পুরুষ শাসিত সমাজে রূপান্তরের কারণে বিষ প্রয়োগের কৌশলে নারীবাদের তকমা লেগে গেল। বিষ প্রয়োগ করা হয় অজান্তে নিঃসাড়ে। তাই বিষ প্রয়োগ নিছকই নারীজনোচিত কাজ বলে গণ্য হতে থাকল। পুরুষ কেন বিষ প্রয়োগ করবে? সে তো তার পেশীর শক্তি ব্যবহার করে, রক্তপাত ঘটিয়ে, যখন খুশি প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। বিষ প্রয়োগে হত্যা করা তাই পুরুষের উচিত কাজ বলে আর গণ্য হল না মানব সমাজে।

সেক্সপিয়ার তার লেখা বিখ্যাত নাটক ‘এন্টনি ও ক্লিয়পেট্রা’ তে দেখালেন—রোমান রানি ক্লিয়োপেট্রা, বিষ প্রয়োগে আত্মহত্যা করছেন। সুন্দরী রানির জীবনে একদিকে বৃদ্ধ সম্রাট জুলিয়াস সিজার, অন্যদিকে প্রেমিক রাজা এন্টনি। জীবনের প্রতি অনীহা আর নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে না পেয়ে, সেক্সপিয়ারের নাটকে অন্তিম দৃশ্যে তাই দেখা গেল—ক্লিয়োপেট্রা বিষধর সাপকে আহ্বান করে বলছে, “হে বিষধর, তোমার শ্বদন্তে আমার জীবনের শেষ গিঁট ছিঁড়ে দাও। এসো তোমার শরীরে ক্রোধ আনো, বিদায় জানাও।”

ক্লিয়োপেট্রা যে সত্যি সত্যি সাপের বিষে প্রাণ দিয়েছিল, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু সেক্সপিয়ারের নাটকে অনুপ্রাণিত হয়ে অসংখ্য চিত্রকর সাপের দংশনে ক্লিয়োপেট্রার মৃত্যুর চিত্র এঁকে গেছেন। বিজ্ঞেরা বলেছেন, সাপটা কিং-কোবরা না হয়ে যায় না। কারণ অন্য কোনও বিষে মারা যাবার পাত্রী ছিলেন না ক্লিয়োপেট্রা। তিনি বিষ নিয়ে গবেষণা করতেন। নিত্য নতুন বিষ বানিয়ে, পরিচারক পরিচারিকার উপর প্রয়োগ করে, ফল পরীক্ষাই শুধু করেননি—নিজেও রোজ অল্প অল্প করে বিষ পান করে ক্রমশ নিজেকে বিষকন্যা করে তুলেছিলেন।

ক্লিয়োপেট্রার আগে বিষ পান করে মারা গিয়েছিলেন বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস। তিনি দেবতার অস্তিত্ব বিনা প্রমাণে মেনে নিতে পারেননি। মানেননি ধর্মীয় প্রভুদের অনুশাসন। যুক্তির উপর দাঁড় করিয়ে জন্ম দিয়েছেন এক নতুন দর্শনের। ফল – মৃত্যুদণ্ড। শাসকের নির্দেশে ৫০০ বিচারকের বিচারের প্রহসনে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দিয়েছিল ২৮০ জন বিচারক। তবে সে যুগে তাঁর মতো প্রখ্যাত জ্ঞানী দার্শনিককে বেছে নিতে বলা হয়েছিল মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতি। তিনি হেমলক বিষ পান করে মৃত্যু বরণ করে নিতে চেয়েছিলেন। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো সক্রেটিসের মৃত্যু দৃশ্যের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। যদিও সক্রেটিসের এই শিষ্যটি তাঁর মৃত্যুর সময় উপস্থিত ছিলেন না। সক্রেটিসকে হেমলকের সাথে খানিকটা আফিম মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তিনি আচ্ছন্ন অবস্থায়, কম যন্ত্রণায় মারা যান। প্লেটোর বর্ণিত দৃশ্য এমন ছিল – সক্রেটিস তাঁর বন্ধু ক্রিটোর হাত থেকে বিষ পাত্র তুলে পান করলেন। ক্রিটো তাঁর পায়ের উপর চিমটি কেটে অনুভব করছেন, সক্রেটিসের শরীরে বিষ অঙ্গ অবশ করতে সক্ষম হয়েছে কিনা। সক্রেটিস জানাচ্ছেন – আস্তে আস্তে বিষ তার শরীরে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এবার হৃদয়ে উঠে এলেই সব শেষ হয়। তারপর ক্রিটো দেখছেন – সক্রেটিস অসাড় হয়ে গেছেন, তাঁর চোখ নিথর হয়ে গেছে। মারা গেছেন সক্রেটিস। বিষ পান করে মৃত্যুপথযাত্রী সক্রেটিসের অনেক ছবি এঁকে গেছেন অনেক বিখ্যাত চিত্রকর, যার মধ্যে ফরাসী চিত্রকর জ্যাকুইস লুই ডেভিসের ছবিটি সবচাইতে বেশি খ্যাতি লাভ করে।

ডেভিডের আঁকা সক্রেটিসের মৃত্যু দৃশ্য

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে এশিয়া মহাদেশ থেকে ঘরে ফেরার সময়ে ব্যাবিলনে দেহত্যাগ করেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা আলেকজান্ডার। তখন তার বয়স মাত্র ৩২। কেউ বলে ম্যালেরিয়ায় হয়ে বা নিয়মোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান আলেকজান্ডার। আবার কেউ বলে বিষপ্রয়োগে মৃত্যু হয় তাঁর। বিশেষজ্ঞদের বর্তমান মত হল—ম্যালেরিয়ার জীবাণু বাহক মশার অস্তিত্ব ব্যাবিলনের মরুভূমিতে পাওয়ার কথা নয়। নিউমোনিয়াও কেন শুধু তারই হল, মহামারীতে আর কেউ মারা যাওয়ার কথা কেন জানা যায় না। তাই তাঁদের মতে, পানীয়ে বিষ মিশিয়ে হয় তাকে হত্যা করা হয়েছিল, বা অসাবধানে কোনক্রমে পানীয়তে বিষ মিশে যাওয়ার ফলে অ্যালেক্সান্ডার মারা যান। পুঁথি বলছে প্রায় বারো দিন রোগে কষ্ট পেয়ে মারা যান রাজা। কী সেই বিষ, যার ফলে দীর্ঘায়ত হয়েছিল তাঁর মৃত্যু? সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, ভেরাটাম এ্যালবাম নামক একধরনের ভয়ঙ্কর বিষাক্ত গাছ আলেকজান্ডারের খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে থাকতে পারে। এই গাছের সাদা ফুল অতি সুন্দর। অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভেষজ ওষুধ হিসাবে এই গাছের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। জঙ্গলের পশুরা কিন্তু ভুলেও এই গাছের ধারে কাছে যায় না। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাতেও ভেরাটাম এ্যালবামের শিকড় থেকে তৈরি ওষুধ ব্যবহার করা হয় রক্তশূন্যতা, মৃগীরোগ, টাইফয়েড প্রভৃতি চিকিৎসায়।

বিষের প্রয়োগবিধি ও ধরণের উপর যে শাখায় গবেষণা করা হয় সেটি হল – টক্সিকোলজি, বা বিষবিদ্যা। জীবনবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, ঔষধবিদ্যার ব্যবহারিক দিক প্রয়োগ করে বিষ নিয়ে গবেষণা করাই এই শাখার কাজ। তবে বিষের উপর এমন পরীক্ষা নিরীক্ষার ইতিহাস অতি প্রাচীন। সভ্যতা যত উন্নত হচ্ছে বিজ্ঞানের এই শাখার কাজ ততই জটিল পথ ধারণ করছে নিঃসন্দেহে। রোমান সম্রাট নিরোর সভাবৈদ্য ডায়োস্করডিস সর্বপ্রথম গাছের বিষ ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস করেন। হেমলক সর্বাধিক ব্যবহৃত বিষ, যা হেমলক গাছ থেকে তৈরি করা হয়। এছাড়াও রিসিন একটি অত্যন্ত মারাত্মক বিষ। রিসিন গাছের বীজ থেকে ক্যাস্টর অয়েল বানানো হয়। কিন্তু এই বীজের খোসা প্রাণী শরীরে প্রবেশ করলে প্রোটিন সংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে। বহু রাজনৈতিক হত্যার পিছনে রিসিনের মারাত্মক বিষ প্রয়োগের কাহিনী লুকিয়ে আছে।

রিসিন
হেমলক
ভেরাটাম

প্রাচীন গ্রীক সাম্রাজ্যে হেমলক ছাড়াও আর একটি বিষের ব্যবহার বিষবিদ্যার গবেষকেরা খুঁজে পেয়েছেন। সেটি হল—একোনাইট। বাংলায় একে বলা হয় কুচিলা। নীল রঙের অতি সুন্দর বাহারি ফুল হয় এই গাছে। গ্রীকেরা তীরে বিষ মাখানোর জন্য একোনাইটের শিকড় ব্যবহার করত। এরপর সমাজের উন্নতির সাথে সাথে বদলে গেল বিষের ব্যবহারের উপকরণ। আর্সেনিক, পারদ, সীসা, সব ধাতুই প্রথমে ওষুধ হিসাবে প্রয়োগ করা হতো। ধীরে ধীরে এদের মারণাত্মক দিকটাও মানুষ আবিষ্কার করে ফেলল।

বিষ প্রয়োগ ও তার ব্যবহারের সাথে সাথে মধ্যযুগীয় রাজনীতিতে জমে উঠল পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে তার আমত্য চাণক্য রাজাকে নির্বিঘ্ন শাসনের পথ খুলে দিতে বিষকেই বেছে নিয়েছিলেন গোপন হত্যায়। বিষকন্যা নিযুক্ত করে উচ্চাসনে আসীন রাজপুরুষদের হত্যা করা সে যুগে খুবই স্বাভাবিক ছিল। বৌদ্ধ ও জৈন পুঁথিতে উল্লেখ করা আছে, চন্দ্রগুপ্তকে চাণক্য প্রতিদিন একটু একটু করে বিষ পান করাতেন, যাতে তার শরীর বিষরোধী হয়ে ওঠে। শত্রুর বিষপ্রয়োগের হাত থেকে মহারাজের প্রাণ বাঁচানোই ছিল তার উদ্দেশ্য। বিন্দুসারের জন্ম নিয়ে একটি কাহিনী বিভিন্ন বৌদ্ধ পুঁথিতে পাওয়া যায়। একদিন চন্দ্রগুপ্ত তার পত্নী দূর্ধারার সাথে প্রাতরাশ করবার সময়ে আপেলে কামড় দিয়ে সেই আপেলই মহিষীকে ভালবেসে খেতে দেন। ঠিক সেই মুহূর্তে চাণক্য প্রাতরাশের জায়গায় এসে পড়েন। দূর্ধারা সেই সময়ে গর্ভবতী ছিলেন। বিষ-পুরুষ চন্দ্রগুপ্তের কামড়ানো আপেল খেয়ে দূর্ধারার আসন্ন সন্তান মারা যাওয়ার আশংকায় চাণক্য তখুনি রানির পেট তরোয়াল দিয়ে কেটে তার পুত্র সন্তানকে বার করে আনেন। এক ফোঁটা রক্ত সদ্যজাতের মাথায় পড়ায় তার নাম হয় – বিন্দুসার। হয়তো আসল ঘটনার সাথে অনেকটাই কল্পনা ও কাহিনী মিশে থাকার সম্ভাবনা আছে। তবে চন্দ্রগুপ্ত স্বয়ং যে একজন বিষ-পুরুষ ছিলেন, এর উল্লেখ বহু লিপিবদ্ধ পুঁথিতেই পাওয়া যায়।

মোগল সাম্রাজ্যর ইতিহাস জুড়ে আছে সন্দেহ, অবিশ্বাস, গুপ্তহত্যা ও নীরবে বিষপ্রয়োগ করে হত্যার অসংখ্য নজির। বাদশারা এক বিশেষ কৌশলে প্রায়শই হত্যার কাজটি সুসম্পন্ন করতেন। সেই আমলে রত্ন মণিমাণিক্য খচিত মূল্যবান পোশাক উপহার দিয়ে অতিথিকে সম্মান জানাবার রীতি ছিল। এমন পোশাককে বলা হত – খিলাত। বশ্যতা স্বীকার করবার প্রমাণ হিসাবে বাদশার সামনেই এই পোশাক পরার রীতি ছিল। পোশাকের মধ্যে কলেরা, স্মল পক্স ও ম্যালেরিয়ার জীবাণু মিশিয়ে দেওয়া হত। ফলে পোশাক গায়ে দিয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেলে কোনও সন্দেহের অবকাশই থাকত না। তবে এইভাবে বিষ মাখানো পোশাক ব্যবহার করে মানুষ মেরে ফেলার চল অতি প্রাচীন। জানা যায় গ্রীক বীর হিরাক্‌লসকেও নাকি একই পদ্ধতিতে মারা হয়। মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেব তার প্রতিদ্বন্দ্বী পৃথ্বী সিংহকে একই উপায়ে স্মল পক্সের জীবাণু মেশানো পোশাক উপহার দিয়ে হত্যা করেন। আওরঙ্গজেবের পুত্র আকবর (দ্বিতীয়) তার পিতার বিরুদ্ধাচারণ করে বিরাগভাজন হন। আওরঙ্গজেব তার মসনদের কাঁটা সরাতে নাকি পুত্রকে বিষ মাখা পোশাক উপহার দেন। পিতার মতিগতিতে সন্দিহান হয়ে আকবর সেই পোশাক সে নিজে না পরে, এক ক্রীতদাসকে সেই পোশাক পরিয়ে দেয়। দুএকদিনের মধ্যেই দাসটি মারা যায়। দ্বিতীয় আকবরের সন্দেহ প্রমাণিত হয় এবং সে তার প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়।

১৭০০ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বিষবিদ্যার বিপ্লব ঘটে গেল। কারণ এই সময়ের মধ্যে হয়েছিল শিল্প বিপ্লব। উন্নতি হল ধাতুশিল্প, খনন কার্জ এবং রসায়ন শিল্পে। এক দল মানুষের হাতে নতুন ক্ষমতা এল। জন্ম নিল ঈর্ষার নতুন দিক, রাজনীতির মোড় ও গতি বদলে গেল। বিষ প্রয়োগের নতুন নতুন কলাকৌশলে মেতে উঠল বিষবিদ্যা। শুধু একজনের প্রতি বিষপ্রয়োগের জায়গা নিল বহু মানুষকে একসাথে মেরে ফেলবার জন্য রাসায়নিক ও জীববিজ্ঞানী মারণাস্ত্র। দুটি বিশ্বযুদ্ধ তার সাক্ষী।

তথ্য ঋণ -

1) The elements of murder, A history of Poison, John Emsley, Oxford University Press, 2003.

2) Historical milestone and discoveries that shaped the toxicological sciences, Antoinetee N. Hayes and Steven G. Gillbert, Research Gate. net publication, 2009.

3) Killer Khilats, “Legends of Poisoned Robes of Honour” in India, Michelle Maskiell and Adrienne Mayor, Routledge Journals; Taylor & Francis Ltd, 2001, pp. 23 – 45.

 

ছবি ঋণ – আন্তর্জাল