দলিলের খোঁজে - বিভাবসু দে

হাসির গল্প

অলংকরণ : সুমিত রায়

উফ! আরেকটু হলেই ট্রামের তলায় হুমড়ি খেয়ে আমার ‘জীবনানন্দ’ চিরজীবনের মতো ঘুঁচে যাচ্ছিল! জোর বাঁচান বেঁচে গেছি। আসলে ব্যাপারটাই এমন যে চোখে পড়লে যে-কোনও সুস্থ মানুষেরই স্থান-কাল জ্ঞান লোপ পাবে; তখন ট্রাম কেন ডাইনোসর তেড়ে এলেও হুঁশ থাকবার কথা নয়। মানে জীবনে ব্যবসা অনেক দেখেছি, তাই বলে এমন অভিনব উদ্যোগ! তাও আবার দিনেদুপুরে, মাঝরাস্তায়, একেবারে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে!

বেশ বুঝতে পারছি যে ভেতর ভেতর উত্তেজনার পারদটা একেবারে চড়চড় করে দেশের জনসংখ্যার মতো বেড়ে যাচ্ছে। না, এই জিনিসের গোড়ায় না গিয়ে ছাড়া যায় না!

মাঝরাস্তা থেকেই একলাফে গিয়ে দাঁড়ালাম ফুটপাত-ঘেঁষা দেয়ালটার সামনে--- মাঝারি সাইজের একটা কাগুজে পোস্টার সাঁটা, দেখে যা মনে হচ্ছে সদ্যই পড়েছে, হয়ত কাল রাতে কিংবা আজ ভোরেই। তার গায়ে লাল কালিতে বেশ গোটা গোটা করে ছাপা---

সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপায়ে একাত্তর কিংবা তারও আগের দলিল উদ্ধার করে দেওয়া হয়।
দলিল-প্রতি পারিশ্রমিক ২০০০ টাকা।
কোনও অগ্রিম নেওয়া হয় না।
সত্বর যোগাযোগ করুন:- +৯১-৯৯৯৮৮৮৫৫১১

কী সাংঘাতিক চমকপ্রদ বাণিজ্যিক চিন্তাধারা একবার ভাবুন দেখি! আজকাল এই আচ্ছেদিনের যুগে আর যাই হোক এসব ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পগুলোর সময়ে অসময়ে বেশ পোয়া-বারো হচ্ছে। সেই যে ওই ২০১৬ তে একবার সব কালো টাকা পাকড়াও করে ফেলা হয়েছিল, তখন দেখেছিলাম এমন রাস্তার এদিকে ওদিকে ছোটখাটো ব্যবসা বসে গেছিল--- না কী, পাঁচশো টাকার বাতিল নোট বদলে চারশো আশি টাকা বা সাড়ে চারশো টাকা নিয়ে যান, ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ছোট ছোট শিল্পোদ্যোগগুলো ছিল বলেই কিনা অতবড় একটা ধাক্কা সামলেও আজ আমাদের অম্বানিদা বিশ্বসভায় শ্রেষ্ঠদের মধ্যে একটা আসন করে নিতে পেরেছেন। সত্যিই প্রশংসনীয়।

যাই হোক, আপাতত এই ব্যাপারটা তো একটু স্বচক্ষে দেখতেই হচ্ছে। যদিও একাত্তর কেন, আমাদের বাড়িতে ইংরেজ আমলের দলিলও রয়েছে কিন্তু বৈজ্ঞানিক উপায়ে সেটা কীভাবে উদ্ধার করা হয়, তা না দেখলে যে মরেও শান্তি পাব না। তবে কে জানে, আজকাল তো আবার সবই বৈজ্ঞানিক--- সে ভূত হলে তাকে বলতে হয় তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আর গণেশ ঠাকুরের ঘাড়ে হাতির মাথা বসালে প্লাস্টিক সার্জারি।

না, আর দেরি না করে ফোনটা করেই ফেললাম। বারকয়েক রিং হবার পর ওপাশ থেকে দৈববাণীর মতো জলদগম্ভীর এক কণ্ঠ ভেসে এল---”হ্যালো...”

“ইয়ে মানে, আপনার একটা পোস্টার দেখে ফোন করলাম। একটা পুরোনো দলিল একটু...”

গদগদ হয়ে এল ওদিকের গলার স্বর--- “হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। যেকোনও দলিল খুঁজে দেওয়া যাবে। নির্দ্বিধায় চলে আসুন।”

বাহ্! লোকটার আত্মবিশ্বাস আছে--- ব্যবসা করতে গেলে ওই জিনিসটি থাকা বড় জরুরি। ঝটপট বললাম, “নিশ্চয়ই। ঠিকানাটা একটু যদি বলে দিতেন।”

“ওই তো বটতলা শ্মশান থেকে ডানদিকে মুড়ে ঘাড়কাটা কালীমন্দিরের পাশের গলিতে ঢুকলে যে প্রথম হলুদ দোতলা বাড়িটা দেখতে পাবেন সেটাই। সোজা ওপরে চলে আসবেন--- কেউ জিগ্যেস করলে আমার নামটা বলে দিলেই হবে। পুণ্ডরীক পুরকায়স্থ।”

“বেশ। আধঘন্টার মধ্যে আসছি তাহলে।”

বাড়ি থেকে যদিও অফিস যাব বলেই বেরিয়েছিলাম কিন্তু এমন একটা অনবদ্য ব্যাপার চাক্ষুষ করবার লোভ সামলাই কী করে বলুন! অগত্যা বসকে ‘গতকাল অতিরিক্ত ফুলকপির পকোড়া খেয়ে সকাল থেকেই ফুল ছড়াছড়ি কেস হয়ে গেছে’-গোছের একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে সোজা উঠে বসলাম বটতলার অটোতে। মিনিট দশেকের বেশি লাগল না বাজারের মুখে নামতে; সেখান থেকে একটা রিক্সা নিয়েই ছুটলাম পুণ্ডরীকবাবুর বলে দেওয়া ঠিকানায়।

গলিতে ঢুকতেই সেই হলুদ বাড়িটাও চোখে পড়ে গেল। কিন্তু এমনই সুপ্রসন্ন ভাগ্য যে কাউকে আর জিগ্যেস করতে হল না পুণ্ডরীক পুরকায়স্থর কথা, কারণ গেটের মুখে নামতেই এক দেড়েবুড়ো দুই লাফে সামনে এসে বলল, “নমস্কার, আমি পুণ্ডরীক পুরকায়স্থ। আসুন।”

উৎসাহে একেবারে টগবগ করছে লোকটা। এমন না হলে কি আর অন্ত্রেপ্রেনিওরশিপ হয়! প্রতি-নমস্কার জানিয়ে জিগ্যেস করলাম, “আমিই যে ফোন করেছিলাম বুঝলেন কী করে?”

লোকটা খুকখুক করে হেসে বলল, “মুখ দেখলেই বোঝা যায়।”

কী নিদারুণ উত্তর! বউ যদিও বরাবরই হুমদোমুখো বলে কিন্তু তাই বলে আমার মুখ দেখলেই যে কীভাবে দলিল-হীন জীব বলে বোঝা যায়, সেটা কিছুতেই ঠিক মাথায় ঢুকল না। লোকটা আগের মতোই উৎসাহী গলায় বলল, “আসুন আসুন। বাকি কথা ভেতরে গিয়ে...”

অতএব পুণ্ডরীক পুরকায়স্থর পেছন পেছন আমিও চললাম সেই হলুদ বাড়ির ভেতর যেখানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে একাত্তরের আগের দলিল উদ্ধার করে দেওয়া হয়। লোকটাকে দেখে যা মনে হল বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। একটু বেঁটে মতন, টেকোমাথা, বুকঝোলা দাড়ি আর গায়ে বেশ পুরোনো একটা রং-চটা খদ্দরের পাঞ্জাবি-পায়জামা। তবে গায়ের রংটা অদ্ভুতরকম ফ্যাকাশে--- নিঃসন্দেহে রক্তাল্পতার রোগী। অবশ্য আজকাল আবার অনেকে বিদেশসফর করতে করতেও দিনকেদিন ফর্সা হয়ে যাচ্ছেন। যাগ্গে, সে আলাদা ব্যাপার, এখন আসল কথা হল গিয়ে একাত্তরের আগের দলিল!

সিঁড়ি ভেঙে দুজনে এসে দাঁড়ালাম দোতলার একটা বন্ধ দরজার সামনে। পুণ্ডরীকবাবু তালা খুলতে খুলতে ইশারায় বললেন, “আসুন।”

আমিও ঢুকলাম। আর ঢুকেই তো একেবারে থ! এটা ঘর! মানে জীবনে অনেক বর্বর এবং উর্বর বস্তু দেখেছি বটে, কিন্তু তাই বলে সেই সবকিছুরই একই ঘরে এহেন সমাবেশ যে একেবারে কল্পনাতীত। আসলে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেটাকে ঘর না বলে অন্যকিছু বলা উচিত, কিন্তু সেটা ঠিক কী, তা জানি না।

ঘরের দক্ষিণে খান পাঁচেক বই-বোঝাই আলমারি, তার পাশে বিদঘুটে কীসব লাল-নীল বাতি-জ্বলা যন্ত্রপাতিতে ঠাসা বেশ ক’টা টেবিল, ওদিকের বন্ধ জানালাটার গায়ে ঝুলছে এক সহাস্য নরকঙ্কাল। তার পায়ের কাছে আবার একটা যজ্ঞকুণ্ডের মতো ধুনি জ্বলছে, আশেপাশে কতগুলো আজব আজব গাছও রয়েছে টবে পোঁতা! এইটুকু তবু হজম হয়, কিন্তু উল্টোদিকে চোখ পড়লে তো চক্ষু-চড়কগাছ হতে বাধ্য। কী নেই সেখানে! খাঁচায় ভরা গিনিপিগ, পাখি, দুটো বাঁদর আর... একটা জলজ্যান্ত গরু--- সানন্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে, মুখের সামনে এক গামলা কচি ঘাস মেশানো খড়-বিচোলি। কিন্তু সেটা ব্যাপার নয়, ব্যাপার হল সেই গরুর বাঁটে ফানেলের মতো একটা নল আঁটা, যার আরেক মুখ গিয়ে ঢুকেছে কী এক বিদঘুটে যন্ত্রের ভিতর। তার গায়ে সবুজ হলুদ আলো জ্বলছে আর নিভছে, আর অন্যদিক দিয়ে টপটপ করে কী একটা তরল পদার্থ কাচের বিকারে জমা হচ্ছে।

আমাকে ওই নধরকান্তি গাভীটির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে পুণ্ডরীকবাবু বললেন, “ওটা আমার সদ্য আবিষ্কৃত দুগ্ধারাস পাতন যন্ত্র।”

আরও অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, “কীসের রস?”

“রস নয়, রাস, দুগ্ধারাস। মানে দুগ্ধ যোগ অরাস, অর্থাৎ সোনা। দুধ থেকে সোনা নিষ্কাশন পদ্ধতি। ওই যে বিকারে তরল খাঁটি সোনা জমা হচ্ছে।”

“আরিব্বাস! বলেন কী!

একটা বিজ্ঞ হাসি হেসে পুণ্ডরীক পুরকায়স্থ বললেন, “এসব তো সামান্য জিনিস।”

আহঃ, কী বিনয়! দেখলেও প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। জিগ্যেস করলাম, “আপনি কি বিজ্ঞানী?”

“গবেষণাই সখ।”

“বাহ্! দারুণ ব্যাপার তো। জীবনে বিজ্ঞানী ঢের দেখছি কিন্তু গরুর দুধ থেকে সোনা--- এতবড় বিজ্ঞানী দেখিনি।”

পুণ্ডরীকবাবু একগাল হেসে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “সবাই কি আর নিজের ঢাক পিটিয়ে বেড়ায় বলুন!”

“তা তো বটেই, তা তো বটেই।”

“যাগ্গে, এবার কাজের কথায় আসা যাক। বলুন কোন সালের কী দলিল লাগবে?” একটা চেয়ার টেনে বসলেন ভদ্রলোক। আমিও মুখোমুখি বসে একটু ইতস্তত করেই বললাম, “মানে সেটাও কি এখানেই কোনওভাবে বানিয়ে দেবেন, নাকি... আসলে জাল দলিল হলে পরে যদি...”

কিছুক্ষণ ভূত-দেখা চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন পুণ্ডরীক পুরকায়স্থ। তারপর কেমন যেন খেক খেক করে খেঁকশেয়ালের মতো হাসতে হাসতে বললেন, “কী যে বলেন মশাই! আমাকে কি দলিল জাল করা ছিঁচকে জোচ্চোর পেয়েছেন নাকি? একেবারে আসল দলিল হাতে এনে দেব, শুধু আপনাকেও একটু সাহস করে সঙ্গে যেতে হবে, এই আরকী।”

“কোথায়?” একটু চমকেই উঠি। “মানে পুলিশের ঝামেলা-টামেলা হলে কিন্তু...”

“আগে বলুন তো কোন সালের দলিল চাই।”

একটু ভেবে নিয়ে বললাম, “১৯৪১। বাড়ির দলিল।”

“তখন তো দেশে পুলিশ বলতে ব্রিটিশ পুলিশ, ওরা স্বদেশী ঠেঙিয়েই কূল পায় না, আবার আমাদের কী ধরবে!”

“মানে?

“মানেটা জলবৎ সরলং! সোজা ১৯৪১-এ গিয়েই আপনার বাড়ির দলিল নিয়ে আসা হবে।”

অ্যাঁ! লোকটা বলে কী! তাও আবার এমন অমায়িক ভঙ্গিতে যেন মাছবাজার থেকে ইলিশ কেনার আলোচনা চলছে। থতমত খেয়ে জিগ্যেস করলাম, “১৯৪১-এ গিয়ে মানে?”

“গিয়ে মানে গিয়ে। টাইম ট্রেভেল শোনেননি?”

সাহিত্যে নাকি চোখ ছানাবড়া হওয়া বলে একটা অপার্থিব অবস্থার উল্লেখ আছে--- আমার এখন সেই দশাই। তবু কোনওক্রমে সামলে নিয়ে যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় জিগ্যেস করলাম, “আপনি বলতে চাইছেন যে আপনার এই ঘরে টাইম মেশিন আছে আর সেটা দিয়ে আমরা টাইম ট্রেভেল করে ১৯৪১-এ গিয়ে দলিল হাতিয়ে আবার এখানে, মানে ২০২০-তে ফিরে আসব!”

“আলবাত।” মুখে এমন একটা হাসি টানলেন পুণ্ডরীকবাবু যে সেটা ছাতির সমানুপাতে বাড়িয়ে দেখলে হয়ত অনায়াসে ছাপান্ন ইঞ্চি ছাড়িয়ে যেত।

আমি ঢোক গিলে বললাম, “মশাই, আপনি যেটা বলছেন সেটা যে আজকাল কল্পবিজ্ঞান গল্পেও কেউ লেখে না, জানেন?”

“কেউ বিশ্বাস করবে না সেটা আমি ভালোই জানি, তাই কোনও অগ্রিম নিই না। নিজে সঙ্গে যাবেন, কাজ হবে, তখন গিয়ে টাকার কথা।” তাঁর মুখে সেই নৈসর্গিক হাস্যরেখা তখনও একইভাবে ঝুলে আছে। “নিজে যাচাই করেই দেখুন না, বুজরুকি নাকি সত্যিকারের বিজ্ঞান।”

ভদ্রলোক পাগল কিনা, একবার সন্দেহ হল বটে, কিন্তু কথাবার্তায় তো তেমন কোনও লক্ষণ চোখে পড়ছে না। আর কথাটাও নেহাত মন্দ নয়। আদৌ কিছু হলে সে তো লাভের ঘরেই, খোওয়াবার তো কিছু নেই। কয়েক সেকেন্ড মনের ভেতর বাঙালি-মার্কা হিসেবনিকেশগুলো সেরে নিয়ে বুক চাপড়ে আমিও বলেই দিলাম, “ঠিক আছে। রাজি। দেখি সত্যিই ১৯৪১-এ নিয়ে যেতে পারেন কিনা!”

“সাবাশ!” তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন পুণ্ডরীকবাবু। “এই না হলে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি। তাহলে ঝটপট যেই বাড়ির দলিল জোগাড় করতে হবে সেই বাড়ির ঠিকানাটা বলে ফেলুন।”

“বাড়ি এই শহরেই। ১৮-এ প্যারীবাবু লেনের ২৬ নম্বর বাড়ি। রায়বাড়ি বললেই সবাই চেনে।” জিগ্যেস করলাম, “তা আপনার টাইম মেশিনখানা কোনটা? এই ঘরেই আছে?”

“আছে। তবে ওই পাতি সিনেমা-টিনেমায় যেমন ঢাউস চেম্বারের মতো দেখায় তেমন কিছু নয়, হাতঘড়ির মতো দেখতে। পরে নিলেই হল।” বলতে বলতে ঘড়ির মতোই দুটো কী যেন দেরাজ খুলে বেরও করে ফেললেন ভদ্রলোক। একটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “পরে ফেলুন। আমারটার সঙ্গে সিংক্রোনাইজ করা আছে, আপনাকে কিছু টিপতে হবে না।”

হ্যাঁ, টেপাটেপি ভারী ঝক্কির কাজ। একবার মোবাইলে বউয়ের নম্বর টিপতে গিয়ে শালীর নম্বর টিপে বিস্তর প্রেম নিবেদন-টন করে বসেছিলাম, তারপর বাকিটা ইতিহাস!

তা এবারও অবশ্য, এই পুণ্ডরীক পুরকায়স্থর কথা যদি আদৌ সত্য হয়, তবে ইতিহাসেই যাচ্ছি, কিন্তু নিজে ইতিহাস না হয়ে গেলেই হল। তাই মা কালী, মা দুর্গা, শিবঠাকুর, গণেশ ঠাকুর, রবি ঠাকুর সবাইকে মনে মনে পেন্নাম করে নিয়ে ঘড়ি মানে ওই তথাকথিত টাইম মেশিনখানা হাতে বেঁধেই নিলাম। পুণ্ডরীকবাবু জিগ্যেস করলেন, “তৈরি?”

আমিও সদর্পে ঘাড় কাত করে বললাম, “তৈরি।”

ব্যস, উনি টিপলেন ঘড়ির বোতাম আর. . . ধপাস! কী যে হল কিছুই বুঝলাম না, শুধু মনে হল একঝাঁক আলোর ফোয়ারা ঠেলে কোথাও যেন একটা এসে আছড়ে পড়েছি এবং সেখানকার মাটিটা বেজায় উল্লাসে থরথরিয়ে লাফাচ্ছে। কিন্তু চোখ খোলসা হতেই তো ভয়ে একেবারে যাকে বলে আমার ইয়ে ইয়েতে উঠে যাবার অবস্থা! কোথায় সেই বিদঘুটে ঘর, এ যে খোলা মাঠ আর আমি... এক জাঁদরেল ভুষকালো মোষের পিঠে--- ব্যাটা উর্দ্ধশ্বাসে উঠছে। কে জানে হয়ত যমের দুয়ারে গিয়েই থামবে!

কিন্তু পুণ্ডরীকবাবু?

কথাটা মাথায় আসতেই একটা বিটকেল গোঙানি কানে এল--- সভয়ে খানিকটা পেছন ফিরে দেখি ভদ্রলোক মোষটার ল্যাজ ধরে প্রায় ঝুলতে ঝুলতে আর হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে চলেছেন। এখনও যে মরেননি এটুকুই ভরসা--- ২০২০ তে ফিরতে গেলে কোথায় কী টিপতে হবে সেটা তো উনিই জানেন। কিন্তু এই যমের ক্ষ্যাপা বাহানটা যদি এভাবেই ম্যারাথন চালিয়ে যায় তবে বুড়ো আর বেশিক্ষণ টিকবে বলে মনে হচ্ছে না। অতএব তাড়াতাড়িই কিছু একটা করতে হবে।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সিনেমায় দেখেছি, ঘোড়ার লাগাম ধরে কষে টান দিলে ঘোড়া থেমে যায়; কিন্তু এখানে তো আর লাগাম-টাগামের বালাই নেই, অগত্যা ব্যাটার শিং দুটোই সজোরে টেনে ধরলাম--- এবং আশ্চর্য, কাজও হল! কিছুক্ষণ রাগে গোঁ গোঁ করে শেষমেশ থামল সেই গোঁয়ার মোষ। আমিও তার পিঠ থেকে একলাফে নেমে পুণ্ডরীকবাবুকে গিয়ে টেনেটুনে তুললাম। কাদায় মাটিতে কাপড়চোপড় একসা--- দাড়ির ফাঁকে ফাঁকে সবুজের সমারোহ!

“মশাই, আছেন? না...”

মিনিট দুয়েক কেমন যেন ঝিম মেরে রইলেন ভদ্রলোক। মনে হল জীবন্মুক্ত হবার প্রাক-অবস্থা এখনও কাটেনি! তবে বেশি সময় অবশ্য লাগল না ধাতস্থ হতে--- বিজ্ঞানী মানুষ বলে কথা। রামদেবের প্রাণায়ামের স্টাইলে ফোঁসফাঁস করে বারদুয়েক শ্বাসটাস টেনে একগাল হেসে বললেন, “ওসব কিছু না। সায়েন্টিফিক হ্যাজার্ডস।”

“বটেই তো! স্কুলজীবনে বিজ্ঞানের স্বার্থে কত হাজারে বিজারে ব্যাঙ কাটলাম আর একটা মানবজনম এমন কী বস্তু! তা আমরা কি সত্যিই এখন ১৯৪১-এ?”

“নিঃসন্দেহে।”

“কীভাবে নিঃসন্দেহ হলেন?”

“পেছনে তাকিয়ে দেখুন, এটাই আপনার সেই বাড়ি কিনা?”

ঘাড় ঘোরাতেই চমকে উঠলাম। দেখে তো সত্যিই আমাদের বাড়ি বলেই মনে হচ্ছে, মানে আদলটা প্রায় সেই, শুধু মাস ছয়েক আগে নতুন-করা রংটা কীভাবে যেন ভোজবাজির মতো বদলে গিয়ে পুরনো সাদাটে চুনকাম হয়ে গেছে।

মাঠের সামনে একটা সরু রাস্তা, চারপাশে সব কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। হাতে গোনা কয়েকটা শুধু পাকাবাড়ি, তাও বেশ দূরে দূরে। অথচ এমন কোনও জায়গা আমার চেনা শহরের বুকে আছে বলে তো মনে পড়ছে না--- যদি না সেই চেনা শহরটাকে সত্যি সত্যিই ১৯৪১-এ নিয়ে আসা হয়!

“সত্যি বলছেন?” অবাক গলায় জিগ্যেস করলাম।

“মশাই, এই পুণ্ডরীক পুরকায়স্থ ঢপবাজির ব্যবসা করে না। বিশ্বাস না হলে ওই লোকটাকে ডাকুন দেখি... জিগ্যেস করুন এখন কত সাল।”

রাস্তা দিয়ে একটা ধুতি-ফতুয়া পরা প্যাকটিমার্কা লোক যাচ্ছিল--- হাঁক পাড়লাম। লোকটা থমকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে, তারপর যে কী হল কে জানে, পাগলের মতো কোথায় যেন চোঁচা দৌড় লাগাল। হয়ত আমার জিন্স-পরা দিব্যকান্তি দেখেই একটু ভড়কে গেছে! কিন্তু তাই বলে এতটা!

সে যাই হোক, আমি পুণ্ডরীকবাবুর দিকে ফিরে বললাম, “নিন, আপনার সাক্ষী তো পালাল!”

“সে চুলোয় যাক।” মুখ বেঁকিয়ে বললেন পুণ্ডরীকবাবু। “এসব সাক্ষীসাবুদ ছেড়ে বরং সোজা আপনার বাড়িতেই যাই, দেখি যদি কায়দা করে কোনওভাবে দলিলটা হাতানো যায়।”

“বেশ! কিন্তু তার আগে একটা কথা বলুন তো, টাইম মেশিনে শুধু সময় এগোনো পিছোনো যায় বলেই দেখেছি সিনেমায়, জায়গা পাল্টালেন কীভাবে? মানে আপনার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি, যদি এটা সত্যিই আমার বাড়ি হয়, তবে এখান অবধি এলাম কী করে?”

“গুড কোশ্চেন!” বেশ মাস্টারি ভঙ্গিতে আমার পিঠে একটা হালকা চাপড় মারলেন পুণ্ডরীকবাবু। “আমার এই যন্ত্রে শুধু টেম্পোরাল ট্রান্সলেশন মানে কালগত সরণই ঘটে না, চাইলে স্থানিক সরণও ঘটানো সম্ভব। ওই যে আপনার ঠিকানাটা জিগ্যেস করেছিলাম, একারণেই তো।” দাড়ি চুমড়ে ছোট্ট করে একবার হাসলেন তিনি। “আসলে এই ব্যাপারটা যন্ত্রে আগে ছিল না; তা একবার হয়েছে কী ভারি সাধ হল পৌরাণিক যুগে আসলে কী হত তা স্বচক্ষে গিয়ে দেখে আসব। সেই মতো সময়-টময় সেট করে যেই বোতাম টিপেছি, দেখি সব ফাঁকা! কোথায় কী, আমি দাঁড়িয়ে আছি ঘুটঘুটে এক জঙ্গলের ভেতর। চারপাশ থেকে বাঘ শেয়ালে সমবেত কেত্তন করছে। তখনই বুঝলাম সমস্যাটা কোথায়--- পৌরাণিক যুগের প্রায় সবকিছুই তো ওই উত্তরভারত জুড়ে, আর আমি দাঁড়িয়ে আছি পূর্বভারতে, মানে যেই স্থানে পঞ্চ সহস্র বৎসর পশ্চাৎ আমার বাড়িখানা গজাইবে সেই স্থানে--- সেটা তখন ঘন বন।”

“তারপর কী করলেন?”

“সে-যাত্রা ব্যর্থ হয়েই ফিরে এসেছিলাম। তারপরই আবার নিয়ে বসলাম আমার যন্ত্রটাকে--- ছয়মাস টানা কাজ করবার পর এতে শেষপর্যন্ত এই ব্যবস্থা করা গেল যে যেখানে যেতে চাই ঠিক সেই জায়গাতেই নিয়ে নামাবে।”

“বাহ্! তা তারপর গেছিলেন পৌরাণিক যুগে?”

“নিশ্চয়ই। সেজন্যেই তো এত কাণ্ড! সোজা গিয়ে নেমেছিলাম পাঁচ হাজার বছর আগের অযোধ্যায়।”

“উরিব্বাস! কী দেখলেন?”

“ওই যেখানে এখন মন্দির হচ্ছে সেখানেই ছিল রাজা দশরথের প্রাসাদ। আর দেখলাম তার বাগানে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র। আহা! কী অপূর্ব দৃশ্য, একেবারে নবদুর্বাদলশ্যাম মূর্তি।”

আমিও ভক্তি-গদগদ ভঙ্গিতে কপালে হাত ঠেকালাম একবার--- নইলে কে আবার কখন দেশদ্রোহী ভেবে বসে, বলা তো যায় না!

পুণ্ডরীকবাবু সেই দিব্য সুখস্মৃতি থেকে আস্তে আস্তে আবার নেমে এলেন এই পাপসমাকীর্ণ ধরাধামে, বললেন, “চলুন, এগোনো যাক। আর দেরি করে লাভ নেই।”

“হ্যাঁ চলুন।”

কিন্তু চলা আর হল না! যেই দুজনে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি, অমনি ঘটে গেল এক কাণ্ড! মানে কাণ্ড বলতে যে-সে কাণ্ড নয়, একেবারে যাকে বলে ভয়ংকর অভাবনীয় রোমহর্ষক কাণ্ড--- বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে যে একপাল লোক হইহই করে ছুটে এল কিছুই বুঝতে পারলাম না। আর শুধু কি এল, এসেই পুণ্ডরীকবাবুকে “দাদু গো, এতদিন কোথায় ছিলে! দিদিমা যে তোমার জন্যে...”, ইত্যাদি বলতে বলতে প্রায় জাপটে ধরে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে চলে যেতে লাগল। সঙ্গে সেই পালিয়ে যাওয়া প্যাকটিমার্কা লোকটাও--- বুঝলাম, ব্যাটা তখন এদের খবর দেবার জন্যেই ছুটেছিল! কিন্তু ব্যাপারটা কী হল? পুণ্ডরীকবাবু তো ২০২০ সালের বুড়ো, তিনি এই ১৯৪১-এর একদঙ্গল জোয়ান ছোঁড়ার দাদু হলেন কীভাবে! আবার নাকি একটি দিদিমাও রয়েছেন! এ আবার কী কেস রে বাবা! ওরা কি তাহলে পুণ্ডরীকবাবুকে নিজেদের দাদুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে, নাকি... মানে, হতেই তো পারে যে ভদ্রলোক ওই টাইম ট্রাভেলিং ঘড়ির জোরে এই যুগ সেই যুগ ঘুরে ঘুরে দিদিমা পটিয়ে বেড়াচ্ছেন, আর হরেদরে যুগযুগান্তরব্যাপী নাতিকুল উৎপন্ন করে চলেছেন! আসলে সব এমন ঝড়ের বেগে ঘটে গেল যে কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। পুণ্ডরীকবাবু অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি কিন্তু এই দেশে তো অন্যের বক্তব্য শোনবার রেওয়াজ কোনওকালেই নেই, তাই তিনিও কিছু বলবার বা হাতের ঘড়িতে বোতাম টিপবার তেমন সুযোগ-টুয়োগ পেলেন না--- নাতিরা দাদুকে নিয়ে সানন্দে সদর্পে ড্যাঙডেঙিয়ে চলে গেল।

আর আমি? ব্যাপারটা যে বেশ উত্তেজক, আমি শুরুতেই আঁচ করে ফেলেছিলাম, তাই ভিড়কে আর বেশি উত্তেজিত না করে সেটাই করলাম যেটা এমন পরিস্থিতিতে যেকোনও কর্তব্যপরায়ণ সৎ এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তির করা উচিত, মানে চট করে গিয়ে বটগাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়া! আসলে কী জানেন তো, ভিড় জিনিসটা হল ভূতের মতন--- কখন আর কেন যে কার ঘাড়ে আছড়ে পড়ে ঘাড় মটকে দেয় বলা যায় না; সে আসে, মারে এবং হাওয়ায় মিলিয়ে যায়--- ভূত কিংবা ভিড়ের জন্যে আইনে কোনও ধারা নেই কিনা!

সে যাই হোক, এখন বিচার্য বিষয়টা হল বাড়ি ফিরব কীভাবে? মানে, পুণ্ডরীক পুরকায়স্থকে স-ঘড়ি উদ্ধার না করতে পারলে তো আমাকেও এই ১৯৪১-এই আবার সংসার পাততে হবে! সেটা যদিও খুব একটা মন্দ আইডিয়া নয়, কিন্তু আপাতত মুলতুবি রাখাই শ্রেয়। তার চেয়ে বরং যাই, যেদিকে লোকগুলো গেল সেদিকে এগিয়ে দেখি পুণ্ডরীকবাবুকে দিদিমা আর তাঁর নাতিদের হাত থেকে বাঁচানো যায় কিনা--- মিনিট দুয়েকের জন্যে হাতছাড়া করাতে পারলেই তো কাজ হাশিল, বোতাম টিপে সোজা নিজের যুগে।

“ও দাদা, শুনছেন?”

গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে সবে দু’পা এগিয়েছিলাম, হঠাৎ দেখি বছর পনেরোর এক ছোকরা ওই বাড়ির দিক থেকে বেশ ত্রস্ত ভঙ্গিতে আমার দিকে ছুটে আসছে--- হাতে একটা কাগজ। আমার জিন্স-টিশার্ট পরা চেহারার দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, “একটা উপকার করতে পারবেন?”

এও আবার আমাকে বাবা কিংবা কাকা বলে ধরে যাবে না তো! একটু শঙ্কিত সুরেই জিগ্যেস করলাম, “কী?”

“এই চিঠিটা,” হাতের খামবন্ধ কাগজটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। “এই রাস্তা দিয়েই তো যাচ্ছেন, যদি দয়া করে একটু মিত্রবাড়ির পুবের আমগাছটার পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে দিয়ে আসেন তো বড় উপকার হয়। আসলে বাড়িতে এখন বাবা আছেন তো... আমি ঠিক বেরোতে...”

কথাটা আর শেষ করল না সে, মাঝপথেই থেমে গিয়ে যেভাবে ভয়ে ভয়ে এসেছিল, সেভাবেই ছুট লাগাল বাড়ির ভেতর--- কিছু বলার সুযোগই পেলাম না।

কী জ্বালা দেখুন তো! এখন পুণ্ডরীক পুরকায়স্থকে ছেড়ে কোন মিত্রবাড়ির আমগাছের পেছনে কে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে গিয়ে খুঁজে মরি আরকী! আপদ! কিন্তু কী এমন চিঠি যে বাবা বাড়িতে থাকলে নিজে গিয়ে দেওয়া যায় না? রাস্তা বরাবর পা বাড়াতে গিয়েও একটু থমকে গেলাম--- এই ছোকরা স্বদেশী-টদেশী করে না তো? এই চিঠি যদি তেমন কোনও গোপনবার্তা হয় আর বরাতজোরে এই চিঠিসহ আমি গিয়ে পড়ি ব্রিটিশ পুলিশের খপ্পরে তাহলেই তো চিত্তির! বিনা সংগ্রামেই স্বাধীনতাসংগ্রামী হয়ে যাব!

নাহ, এখানে একটু আগে পুণ্ডরীকবাবুর সঙ্গে যা ঘটল তারপর আর ভদ্রতার তোয়াক্কা করে এতবড় ঝুঁকি নিতে পারব না--- চিঠিটা আগে একবার পড়ে দেখতেই হবে। তাড়াতাড়ি খাম-টাম খুলে জিনিসটা বের করলাম। করলাম তো বটে, কিন্তু দু’ছত্র পড়তে গিয়েই তো আমার যাকে বলে একেবারে ‘পুলকিত তনু-মন শিহরে পরাণ’--- ও হরি, এ যে ভয়ানক জিনিস! মানে বলতে গেলে একেবারে ভয়ঙ্কররকম ভয়ানক জিনিস--- ছোঁড়া প্রেমপত্তর লিখেছে! তার মানে আমগাছের পেছনে নিঃসন্দেহে প্রেমিকাটিই অপেক্ষা করছেন আর ইনি বাপের ভয়ে আমাকে মেঘদূত বানিয়ে নিজে গিয়ে ঘরে সেঁধিয়েছেন। বেশ মজার ব্যাপার তো--- এ লাভ স্টোরি অফ 1941! তাও আবার যে-সে প্রেম নয়, কাব্যিক প্রেম! ছোঁড়া লিখেছে---

সজনী সজনী তোমার লাগাইয়া রজনী বহিয়া যায়,

তোমার মধুর দরশ মাগিয়া হৃদি মোর কাতরায়।

জানি জানি প্রিয়ে, আছ পথ চেয়ে আম্রকুঞ্জপাশে,

আমারও পরাণ আকুলিবিকুলি তোমারি প্রেমের আশে।

তবু কী যে করি, সব পথ ঘেরি রয়েছে শমন ঘরে,

আজ যে শুধুই বিরহের বেলা কাটাইব তব তরে।

রাখো বিশ্বাস, ছাড়িও না আশ, আসিবে মিলনবেলা,

কল্য বিকালে নদীর ওপারে করিব দু’জনে খেলা।

ইতি,

তোমার কুঞ্জ

সবই ঠিক ছিল কিন্তু চিঠির শেষটায় এসে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল, আমার ঠাকুরদার বলা একটি মহান উক্তি কিংবা সাবধানবাণী--- “প্রেম একধরণের মনস্তাত্ত্বিক বিকার।” সারাজীবন তাঁর জীবনদর্শনের এই গভীরতম আপ্তবাক্যটি শুনিয়ে শুনিয়ে একেবারে আমার কানের পোকা নাড়িয়ে তবে তিনি স্বগ্গে গেছিলেন। এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেই বুড়োর নামটিও ছিল কুঞ্জ--- কুঞ্জবিহারী রায়।

না, আর এসব ভেবে লাভ নেই, বরং চিঠিখানা গিয়ে সেই কুঞ্জহৃদয়বিহারিনীকে দিয়ে তারপর পুণ্ডরীকবাবুকে খুঁজতে বেরোই। একটা দলিল খুঁজতে এসে দু-দুটো মানুষ যদি এভাবে নিখোঁজ হয়ে যায় তবে অনুপ্রবেশকারীর হিসেবটা মিলবে কীভাবে!

রাস্তাটা মোটামুটি সোজাই এগিয়েছে, অতএব আমিও সোজাই এগোলাম। কিন্তু লোকজন বড্ড কম--- সব পড়ে পড়ে ভাতঘুম দিচ্ছে নাকি ১৯৪১-এ জনসংখ্যাটাই এত কম ছিল, কে জানে। তবে বেশিদূর যেতে হল না, মিনিট দশেক পদযাত্রার পরই একটা ছোট্ট মুদিদোকান চোখে পড়ল। ভেতরে এক নড়বড়ে বুড়ো বসে ঢুলছেন আর মাঝে মাঝে গামছা নেড়ে মাছি তাড়াচ্ছেন। লিকলিকে গতর, ময়লাটে ধুতি, একমাথা টাক আর গলায় একগাছা তেলচিটচিটে পৈতে। জিগ্যেস করলাম, “আচ্ছা, মিত্র...”

“মিত্র! কীসের মিত্র? আমি নির্লিপ্ত আত্মা, কারও মিত্রও নই কারও শত্রুও নই।” মিত্রবাড়ি আর বলার সুযোগ হল না, তার আগেই একেবারে ব্রহ্মতেজে পৈতে নেড়ে দপ করে যেন জ্বলে উঠলেন ভদ্রলোক। পিঠ টান করে আবার বলতে লাগলেন, “গীতা পড়েছ? পড়নি! সে তো তোমার এই ম্লেচ্ছ পোশাক আর অমার্জিত মুখমণ্ডল দেখেই বুঝতে পারছি...”

মা-কালীর দিব্যি বলছি, সকাল সকাল ব্রাশ করে স্নান সেরে ভালো ছেলের মতো ঠোঁটে বোরোলিন মেখে তবেই বেরিয়েছিলাম অফিস যাব বলে, তাও যে কী করে আমার মুখমণ্ডলখানা এঁর কাছে অমার্জিত বলে মনে হল খোদায় মালুম! সেই ব্যক্তি তখনও একনাগাড়ে বক্তৃতার মতো করে বলে চলেছেন, “অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে নিজের মিত্র ভাবতেন, কিন্তু সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়ে শ্রীভগবান তাঁকে দেখিয়েছিলেন যে সব তিনিই। কেউ মিত্র নয়, শত্রু নয়, শুধুই এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম। আমি নিজে...”

“আরে মশাই, বলছি মিত্রবাড়িটা কোনদিকে?” এবার একটু গলা চড়িয়েই বললাম, নইলে ইনি যেই গতিতে এগোচ্ছেন, এখানে বসেই হয়ত পঞ্চম বেদ রচনা করে ফেলবেন!

“মিত্রবাড়ি?” কেমন যেন থতমত খেয়ে ভদ্রলোক তাকালেন আমার দিকে। কিন্তু ব্রহ্মতেজ আর পেঁয়াজের দাম, অত সহজে কি দমে! কয়েক সেকেন্ডেই আবার স্বকীয় ভঙ্গিতে ফিরে গেলেন--- “বলি তোমাদের কি কাজকম্ম নেই বাপু? মিত্রবাড়ি খুঁজছ আগে বললেই পারতে! এতক্ষণ মেলা বাকিয়ে এখন বলছেন মিত্রবাড়ি কোনদিকে... যত্তসব! শাস্ত্রে ঠিকই বলে, অপাত্রে জ্ঞানদান মহাপাপ। জানো, হিমালয়, কাশী থেকে কত বড় বড় বিদ্বান সন্ন্যাসী পণ্ডিতরা আমার কাছে আসেন শাস্ত্রালোচনা করতে? বললে লোকে বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু বছর পঁয়তাল্লিশ আগে যখন জোয়ান ছিলাম তখন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ অবধি আসতেন আমার এই দোকানে বেদান্তচর্চা করতে--- ওই, ওই ওখানটায় বসে কত মুড়ি-বাতাসা খেয়েছেন; বেলুড়মঠের, আমেরিকার গপ্প করেছেন... ওহ, সেসব কী দিনই না ছিল, আর তোমরা...”

“মিত্রবাড়িটা যদি একটু...”

আমার এই ভীষণ অভদ্রতায়(!) ভদ্রলোক এমনভাবে তাকালেন যেন সত্য কি ত্রেতাযুগ হলে এখনই ভস্ম করে দিতেন--- ভাগ্যিস, সরকার থেকে রামচন্দ্রের আমলের দলিল চায়নি! তবে যাই হোক, রেগেমেগেও শেষ অবধি বললেন, “সোজা চলে যাও। দক্ষিণের গলির প্রথম বাড়িটা।”

“অসংখ্য ধন্যবাদ।” ব্যস, আর দাঁড়াইনি, এটুকু বলেই উর্দ্ধশ্বাসে সোজা পা চালালাম। যদিও পেছন থেকে ছোট্ট একটা শব্দ কানে ভেসে এল--- “অর্বাচীন!

স্বামী বিবেকানন্দ আসতেন কিনা সে তিনিই জানেন, কিন্তু বুড়ো ঠিকানাটা ভুল বলেনি--- সোজা আরও বেশ কিছুটা গিয়ে দক্ষিণের গলিতে ঢুকতেই বাড়িটা চোখে পড়ল; গেটের পাশে পাথরে খোদাই করে লেখা রয়েছে ‘মিত্রভিলা’। এবং পুবদিকে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে খানকতক গাছগাছালিও আছে বটে।

নিঝুম দুপুর, বাড়ির ভেতরে বাইরেও তেমন কোনও জনমনুষ্যি চোখে পড়ল না, মানে মোদ্দা কথা, অবস্থা অনুকূল! তাই আমিও ঝটপট এদিক ওদিক একটু নজর বুলিয়ে ঢুকে পড়লাম বাগানের ভেতর। এবার কুঞ্জবাবুর সেই ‘প্রিয়তমা’-টিকে খুঁজতে হবে। কিন্তু না, খুঁজতে আর হল না--- এইমুহূর্তে ভাগ্যদেবী বোধহয় আমার প্রতি একটু বেশিই সুপ্রসন্না কিংবা আমার আপাতত আম্বানিযোগ চলছে! ব্যাপারটা আর কিছুই না, আমগাছখানার দিকে দু’কদম এগোতেই একটি বছর বারোর মেয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল--- অবশ্যই আমার ভয়ে! চাপা গলায় সঙ্গে সঙ্গে হাঁক পাড়লাম, “এই মেয়ে, শোনো, আমাকে কুঞ্জ পাঠিয়েছে।”

ওষুধের মতো কাজ হল--- প্রেমিকপ্রবরের নাম শুনেই থমকে দাঁড়াল মেয়েটি, যদিও দু’চোখে তখনও বিস্তর ভয় আর সন্দিগ্ধ চাউনি। দূর থেকেই আশ্বস্ত করে বললাম, “ভয় নেই। তোমার চিঠি আছে। কুঞ্জ দিয়েছে।”

এবার গুটিগুটি পায়ে এগোলো সে। কড়া চোখে আমাকে একবার মেপে নিয়ে জিগ্যেস করল, “সে এল না কেন?”

চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “ওর বাবা বোধহয় আজ বাড়িতে আছেন, পড়া ধরছেন ওকে। এই চিঠিতে লিখেছে হয়ত, নিজেই পড়ে নাও।”

“আপনাকে তো ওদের বাড়িতে দেখিনি কখনও? আপনি বিলেতে থাকেন?”

শেষের প্রশ্নটা যে অবশ্যই আমার সাজপোশাক দেখে, সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। অমায়িকভাবেই বললাম, “হ্যাঁ। আমি কুঞ্জদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় হই।”

তবে দূরত্বটা যে ‘সাময়িক’, সেটা আপাতত উহ্য থাকাই ভালো। মেয়েটি বেশ মন দিয়ে চিঠিটা পড়ছিল--- ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। জিগ্যেস করলাম, “তা তোমার নাম কী?”

সে একটু ভুরু কুঁচকে জবাব দিল, “মৃন্ময়ী।”

“বাহ্! খাসা নাম।”

যদিও মৃন্ময়ী নামে আমার কোনও ঠাকুমা যে কস্মিনকালেও ছিলেন না, এটুকু আমি নিশ্চিত। যাগ্গে, এখন দ্বিতীয় আর আসল কাজটা উদ্ধার করতে হবে, মানে পুণ্ডরীক-উদ্ধার। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ভদ্রলোককে যে কোথায় নিয়ে গেছে, সেটাই তো জানি না! দেখি এই মেয়েটি কিছু বলতে পারে কিনা। গলাটা খানিক নরম করে বললাম, “তোমার চিঠিটা তোমায় পৌঁছে দিলাম, এবার তুমিও আমার একটা ছোট্ট উপকার করে দাও তো বাছা।”

পাকাবুড়ির মতো ভুরু দুটো আরেকটু বাঁকিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আবার তাকাল সে। বললাম, “বেশি কিছু না। এই তল্লাটে এমন কোনও বাড়ি জানো কি যেখানে একজন দিদিমা আছেন, তার একপাল নাতি আছে আর দাদুটি অনেকদিন ধরে নিরুদ্দেশ? এবং আজ হঠাৎ তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেছে!” প্রশ্নটা করে নিজেকেই যেন বেশ একটা গোয়েন্দা গোয়েন্দা মনে হচ্ছিল!

মেয়েটি কিছুক্ষণ ভাবল। বার দুয়েক মাথাও চুলকোল, তারপর বেণী দুলিয়ে বলল, “অতকিছু তো জানি না, তবে এখানে আসবার পথে শুনতে পেলাম ভুতনদের বাড়িতে বেজায় হইহল্লা হচ্ছে।”

বাহ্! একটা অন্তত আশার আলো দেখা গেল--- যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার পুণ্ডরীক-দরশন! বললাম, “আমায় চট করে একটু সেই ভুতনদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে? খুব জরুরি দরকার।”

মেয়েটি ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, পারব না কেন! চলুন, এই তো এদিক দিয়ে সামান্য এগোলেই...”

কুঞ্জবাবুর প্রেমিকা চললেন আগে আগে, আমি তার পেছন পেছন। কিন্তু নীরব-পথচলা বড় বিরক্তিকর জিনিস। আচ্ছেদিন দেখতে যখন এত কাঠখড় পুড়িয়ে ৪১ সালে আসা, তখন ভালোভাবেই দেখেশুনে যাওয়া যাক! মেয়েটিকে জিগ্যেস করলাম, “তুমি স্কুলে পড়?”

“হ্যাঁ।”

“কুঞ্জও তোমার স্কুলেই পড়ে?”

সে এমনভাবে তাকাল যেন আমি খুব বোকার মতো একটা কথা বলে ফেলেছি। বলল, “তা কখনও হয়! ও তো ছেলে--- বয়েজ স্কুলে পড়ে।”

বুঝলাম, সত্যিই বোকার মতো কথাই বলে ফেলেছি বটে--- ১৯৪১-এও আর যাই হোক কোয়েড স্কুল ব্যাপারটা অত সাধারণ ছিল না। “তা কুঞ্জর সঙ্গে পরিচয় হল কীভাবে?”

“খেলতে গিয়ে। জানেন, ও খুব ভালো। রোজ আমাকে লজেঞ্জুস এনে দেয়।”

মুখে বললাম, “বাহ্, দারুণ ছেলে তো!” কিন্তু মনের কোণে আবার আমার সেই বৃদ্ধ ঠাকুরদার কথা চাগাড় দিয়ে উঠল, যিনি বলতেন, “চকলেট খেলেই দাঁতে পোকা ধরে।” আমি আরও কিছুটা একটা জিগ্যেস করতেই যাচ্ছিলাম মেয়েটিকে, কিন্তু তখনই হঠাৎ এক পিলে-চমকানো শাঁখের আওয়াজ! মেয়েটি মুচকি হেসে বলল, “ওই যে! শুনছেন তো? এটাই ভুতনদের বাড়ি। কী হয়েছে জানি না, তবে খুব হৈহৈরৈরৈ পড়েছে আজ।”

তাকিয়ে দেখলাম, পেল্লাই বাড়ি বটে একখানা। ভেতর থেকে রণনাদের মতো থেকে থেকে গর্জে ওঠা মঙ্গলধ্বনি শুনে আমার আশার পালে আরেকটু হাওয়া লাগল। মেয়েটিকে জিগ্যেস করলাম, “ভুতনের কোনও দিদিমা বা ঠাকুমা আছেন এই বাড়িতে?”

“হ্যাঁ, আছে তো। তবে আপনি যে-বাড়ি খুঁজছেন, এটাই সেটা কিনা জানি না।”

“সে আমি ঠিক খবর করে নেব। তুমি ভারী উপকার করলে বাছা, এবার বাড়ি চলে যাও, আর বিরক্ত করব না।” মেয়েটি ছোট্ট করে হেসে বলল, “হুম, বেশি এদিক-সেদিক ঘুরলে কুঞ্জ খুব রাগ করে।”

আহাহাহা! শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল গো... আমার বৌটিও যদি এমন বুদ্ধিমতী হত! যাই হোক, প্রেমিকা কিংবা পত্নী-ভাগ্য যখন উত্তরাধিকারসূত্রে মেলে না, তখন আর খামোখা আপশোস করে লাভ কী! যার যার কপাল।

অতঃপর মেয়েটি মনের সুখে হেলতে-দুলতে নিজের পথে পা বাড়াল, আর আমি আমার পথে--- মানে ওই বাড়ির দিকে। কিন্তু ব্যাপারটা হল, ঢুকব কী পরিচয়ে? প্রথমে ভাবলাম বুক ঠুকে সোজা ঢুকেই পড়ি, যা হবে দেখা যাবে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল পুণ্ডরীকবাবুর সেই তথাকথিত নাতির পালের কথা। মানে হাতির পাল তবু সামলানো যায় কিন্তু নাতির পাল কীভাবে সামলায়, সে-বিধান তো শাস্ত্রে নেই! আসলে পাল জিনিসটা বরাবরই গোলমেলে--- আজকাল গরুর পাল মনের সুখে পালে হাওয়া লাগিয়ে গোটা দেশটাই চিবিয়ে খেয়ে গোবর করে দিচ্ছে, লোকে ধরতেও পারছে না; তার ওপর এ হল গে নাতির পাল! সঙ্গে আবার পালের গোদা হিসেবে নাকি স্বয়ং এক দিদিমাও আছেন!

“ও মশাই, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছেন?”

পেছন থেকে হঠাৎ ধেয়ে আসা এমন অতর্কিত প্রশ্নে বেশ একটু চমকে গিয়েই পেছন ফিরলাম--- আর... একেবারে চোয়াল ঝুলে যাওয়া অবস্থা যাকে বলে, আমার তাই হল। এ যে খোদ পুণ্ডরীক পুরকায়স্থ দাঁড়িয়ে! গা-মাথা চাদরে মোড়া, তবু মুখটুকু দেখা যাচ্ছে। আমার হাঁ বুজতে বুজতে খানদুয়েক ডেঙ্গুর মশা হয়ত উদরস্থ হয়ে গেছে ততক্ষণে(এর জন্যে সরকার থেকে ডেঙ্গুশ্রী পুরস্কার দেওয়া হবে কিনা জানি না!)--- আসলে আচমকা এমন অভাবনীয় আনন্দে মুখ দিয়ে যে কথাও বলা যায় সেটাই ভুলে গেছিলাম। তবে পুণ্ডরীকবাবু আর বেশিক্ষণ আমার কথা বলার অপেক্ষা করলেন না, টানতে টানতে নিয়ে গেলেন ওপাশের একটা মোটা অশ্বত্থ গাছের আড়ালে, নিজেই বললেন, “কী আক্কেল বলুন তো আপনার? আপনাকে গোটা পাড়ায় খুঁজে বেড়াচ্ছি আর আপনি কিনা এখানে এসে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন! সে তো নেহাত আপনার হাতে বাঁধা ওই সময়যন্ত্রে বিশেষ ধরনের ট্রেকার লাগানো আছে, তাই খুঁজে পেলাম, নইলে...”

“আপনি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মানে? আপনাকে তো ওরা দাদু দাদু বলে তুলে নিয়ে গেল... কত কষ্টে খুঁজেপেতে এই বাড়ি অবধি এলাম আপনাকে উদ্ধার করব বলে আর আপনি কিনা এদিকে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন!”

“তা অবশ্য ঠিক,” এবার যেন গলাটা একটু নরম হল ভদ্রলোকের। মাথার ওপর থেকে চাদরখানা সরিয়ে বললেন, “আসলে আপনিও যে আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়বেন সেটা মাথায় আসেনি। ভেবেছিলাম আপনি হয়ত সেখানেই অপেক্ষা করছেন, তাই সোজা চলে গেলাম আপনাদের বাড়ির সামনে, কিন্তু গিয়ে দেখি আপনি বেপাত্তা!”

বুঝুন ঠ্যালা! এই না হলে বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি! জিগ্যেস করলাম, “তা আপনাকে এই বাড়িতেই এনেছিল? আর আনার কারণটাই বা কী?”

“হ্যাঁ, এই বাড়িই। তাই তো আপনাকে তড়িঘড়ি ওখান থেকে সরিয়ে এখানে আনলাম, কেউ দেখতে পেলে আবার কেলো হয়ে যেত।” টেকো মাথায় বারদুয়েক হাত বুলিয়ে নিলেন পুণ্ডরীকবাবু। “চলুন, বাকি কথাটা হাঁটতে হাঁটতে হবে। আপনার বাড়ির দিকেই এগোনো যাক।”

যদিও বাড়ির দিকে যে উদ্দেশ্যে যাওয়া, সেটা অন্তত আমার ক্ষেত্রে তেমন জরুরি নয়(মানে সত্যি সত্যি তো আর এখানে দলিল-ফলিল নিতে আসিনি), তাও আপত্তি করলাম না। এই গাছের আড়ালে এভাবে দাঁড়িয়ে গুজগুজ করার চেয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা ঢের ভালো--- পারতপক্ষে কেউ চোর ভেবে প্যাঁদাতে তো আসবে না।

“বুঝলেন মশাই, কারণটা হল জেনেটিক।” কয়েক কদম এগিয়ে ভদ্রলোক নিজে থেকেই বললেন, “বছর দশেক আগে এই বাড়ির বুড়ো, মানে ওই ছোঁড়াগুলোর দাদু, কোথাও একটা নিখোঁজ হয়ে যান। অবশ্য যা এক ‘দিদিমা’ দেখে এলাম, দাদুর নিখোঁজ হওয়াটাই স্বাভাবিক! তা হয়েছে কী, সেই দাদুর সঙ্গে আমার চেহারার ব্যাপক মিল, অতএব এরা ঠাওরে বসল আমিই সেই নিরুদ্দেশ ব্যক্তি আর বাকিটা তো আপনি স্বচক্ষে দেখেইছেন।”

“সে তো বুঝলাম, কিন্তু মাঝখানে আবার জিন-টিন কোথা থেকে এল?”

“সেটাই তো মিরাকেল অফ সায়েন্স! ওরা কাঁধে তুলে এই বাড়িতে যখন নিয়ে এল তখন বেশ ঘাবড়ে গেছিলাম, কিন্তু ভেতরে ঢুকে সেই দাদুটির মাঝবয়সের একটি ছবি চোখে পড়তেই সব একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। সে ব্যাটা আমারই এক দুঃসম্পর্কের জ্ঞাতি--- চোখে দেখিনি কিন্তু ছোটবেলা শুনেছিলাম বুড়োবয়সে নাকি ঘর ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। বুঝে গেলাম, এ সেই ব্যক্তি না হয়ে যায় না--- তাঁর বাড়ি যে এ-তল্লাটে সেটাও শুনেছিলাম একসময়। মানে একেবারে খাপে খাপ হিসেব মিলে যাচ্ছিল।”

“আরিব্বাস! তা পালালেন কীভাবে?”

মুচকি হাসলেন পুণ্ডরীকবাবু। “সেটাই তো মজা--- জেনেটিক্সে যে সমস্যার সৃষ্টি, তার নিবারণ করে দিলাম ফিজিক্স লাগিয়ে।”

ভদ্রলোকের বৈজ্ঞানিক পাণ্ডিত্যের প্রগাঢ়তার প্রতি মুহুর্মুহু শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছিল। সবিস্ময়ে জিগ্যেস করলাম, “কীরকম?”

“ওরা তো সেই দিদিমাটির সঙ্গে আমার আবার বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছিল মশাই--- পুরুত ডেকে আয়োজন শুরু করে দিয়েছিল রীতিমত। পরিস্থিতি যা বুঝতে পারছিলাম, সামনাসামনি বিরোধিতা করে কোনও লাভ হবে না, কেউ শুনবেও না। অতএব আমিও জুমলাদর্শনের পথই বেছে নিলাম--- বললাম, আমার সব মনে পড়ে গেছে। পুরুত ডাকো, আমি আবার আমার পুরোনো স্ত্রীকে বিয়ে করব, পাড়া জুড়ে মোচ্ছব হবে। ব্যস, বাড়িসুদ্ধ লোক খুশি হয়ে গেল। বুঝলাম, এদের বিশ্বাস পাওয়া গেছে, এবার আসল খেল খেলতে হবে। সুযোগ বুঝে বললাম, আমাকে একখানা নতুন কাপড় আর চাদর দাও তো, শুভ কাজের আগে বেশ করে একটু স্নান সেরে আসি। সেই ‘দিদিমা’ নিজেই সব সাজিয়ে গুছিয়ে বের করে দিয়ে লজ্জা-লজ্জা মুখে বললেন, ‘নাও, সেজে এস। আমিও নতুন শাড়ি পরে তৈরি হই।’ “

“তারপর?”

“তারপর বাকিটা খাঁটি বিজ্ঞান। ধুতি পাঞ্জাবি আর এই চাদর নিয়ে গিয়ে ঢুকলাম স্নানঘরে, আর টিপে দিলাম সময়যন্তর। আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম, এটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানগত সরণও ঘটাতে পারে, তা এক্ষেত্রে সেটাই মোক্ষম কাজ দিল। টাইম কোর্ডিনেট না ছুঁয়ে শুধু স্পেস কোর্ডিনেটে একটা লং জাম্প দিলাম--- সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম আবার আপনার বাড়ির সামনে।”

“মানে অনেকটা ওই গুপি-বাঘা যেমন হাতে তালি দিয়ে যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারত, তেমন?”

“একদম তাই।”

“ওদিকে ওই বাড়িতে তো নিশ্চয়ই এতক্ষণে হুলুস্থূল পড়ে গেছে?”

একবার সময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কী যেন একটু হিসেব করে নিলেন পুণ্ডরীকবাবু। “হ্যাঁ, এই আর দুই মিনিট সাড়ে বত্রিশ সেকেন্ড পরেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে যে দাদু স্নানঘর থেকে উধাও আর তারপরেই শুরু হবে আসল হইচই। তাই বলছি, আর দেরি না করে সোজা আপনার বাড়িতে ঢুকে দলিল নিয়ে কেটে পড়ি।”

আমরা ততক্ষণে আবার আমার বাড়ির সামনে এসে পড়েছি। নাহ, শুধু শুধু ভদ্রলোককে আর দলিলের পেছনে ফালতু ছুটিয়ে লাভ নেই, নইলে পরে লোকে ‘মোটাভাই’ বলে গাল দেবে! এবার সত্যটা বলে দেওয়াই উচিৎ। একটু কেশে নিয়ে সাফাইয়ের সুরে বললাম, “ইয়ে মানে, পুণ্ডরীকবাবু, দলিল আমার কাছেই আছে। আসলে আপনাকে একটু বাজিয়ে দেখার লোভেই এতকিছু আরকী। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার পুরো ফিজ আমি দিয়ে দেব, এখন চলুন নিজের যুগে ফেরা যাক।”

ভেবেছিলাম এমন একটা ফাজলামোর জন্যে ভদ্রলোক একেবারে রাগে ফেটে পড়বেন, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না--- কেমন একটা যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন পুণ্ডরীক পুরকায়স্থ। তারপর আস্তে আস্তে একটা ছোট্ট হাসির রেখা ভেসে উঠল তাঁর গোঁফদাড়ির ফাঁকে। এবং, হঠাৎ একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে গদগদ স্বরে বললেন, “আপনি জিনিয়াস! দারুণ একটা আইডিয়া দিলেন তো মশাই--- আপনাকে একটি টাকাও দিতে হবে না। দলিল খোঁজার ব্যবসা বন্ধ করে এবার থেকে টাইম ট্রাভেলিং এজেন্সি খুলব--- যুগযুগান্তরে ঘোরার ট্যুর প্যাকেজ থাকবে, ঘন্টা হিসেবে টাকা নেওয়া হবে। উফ, দারুণ ব্যাপার!”

আমি যে জিনিয়াস সেটা কেউ কোনওদিন বিশ্বাস না করলেও আমি ছোটবেলা থেকেই জানতাম। আসলে রতনে রতন চেনে তো, এমন একজন বিজ্ঞানী বলেই কিনা আমার কদর বুঝলেন। আহা, এই ঘটনাটা যদি রেকর্ড করে একবার বৌকে শোনাতে পারতাম!

“তৈরি?” খানিক পরে পুণ্ডরীকবাবুর কথায় চমক ভাঙল হঠাৎ। বললেন, “আর দেরি নয় মশাই, এবার ফিরেই আমাকে নতুন পোস্টার ছাপাতে হবে।”

“হ্যাঁ, অবশ্যই। অভিনব ব্যবসায়িক উদ্যোগ বটে। চলুন তাহলে, আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সময়ই তো মূলধন!”

শেষবারের মতো আমাদের ১৯৪১ এর বাড়িটাকে দেখে নিলাম--- যার ভেতর বসে বসে সময়ের স্রোতে প্রেমিক কুঞ্জ একদিন প্রেমকে মনস্তাত্ত্বিক বিকার বলা কুঞ্জবিহারী রায় হয়ে উঠবেন! মৃন্ময়ী হারিয়ে যাবে স্মৃতির অতলে। দেশভাগ হবে, রক্ত বইবে আর আশি বছর পরে আবার মানুষকে অতীত হাতড়ে দলিল খুঁজতে হবে নিজের অস্তিত্বের তাগিদে--- দেশ জ্বলবে।

পুণ্ডরীকবাবু ঘড়ির বোতাম টিপলেন--- আলোর ঝলকানিতে ভরে উঠল সবকিছু, আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগল সেই মাঠ, সেই রাস্তা, সেই বাড়ি আর সেই সময়। আমরা আবার ধপাস করে কোথাও একটা এসে আছড়ে পড়লাম। কোথায়? কোথায় আবার, পুণ্ডরীকবাবুর সেই বিদঘুটে ঘরে। এবং শুধু ঘরেই নয়, ঘরের একেবারে পবিত্রতম স্থানে--- চোখ রগড়ে দেখলাম আমি এসে পড়েছি সেই স্বর্ণিম দুগ্ধদায়ী গাভীর খড়বিচোলি রাখা গামলায়, একেবারে তেনার মুখের সামনে আর পুণ্ডরীকবাবু পেছনে, গোবরের গামলায়। জৈব গ্যাস উৎপাদনের জন্যে রেখেছিলেন হয়ত, কিন্তু আপাতত তাঁর নিজেরই জৈব-অবস্থা শোচনীয়! কোনওক্রমে গামলা থেকে তুলতে তুলতে ভদ্রলোককে জিগ্যেস করলাম, “আচ্ছা, আপনার এই যন্ত্রটির গো-প্রজাতির প্রতি এত আসক্তি কেন? একবার নিয়ে ফেলল মোষের পিঠে আর এখন এনে নামাল গরুর গুয়ে!”

পুণ্ডরীকবাবু দাড়ি আর টাক থেকে গোমাতার আশীর্বাদ মুছতে মুছতে একগাল হেসে বললেন, “আসলে ঘড়ির ভেতরের কিছু পার্টস নাগপুর থেকে আনিয়েছিলাম কিনা!”

আমি প্রত্যুত্তরে আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই স্বয়ং মা জননী সম্মতি জানিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “হাম্বাআআআ...!”

অতএব আর কী, গল্প শেষ। মায়ের ওপর তো আর কথা বলা যায় না!