একে তো রোগাপাতলা শরীরটা দিয়ে উইকেটের অর্ধেকও আড়াল হয় না, তায় ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার! গ্লাভস নেই, হেলমেট নেই, এমনকি অন্ধের যষ্টি একখানা ব্যাটও নেই---- ব্যাটিং ক্রিজে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল ভুতুম। একটা বল, যা হোক করে এই একটা বল পার করতে পারলেই আজকের মতো নিশ্চিন্দি!
ক্লাস নাইনের পল্টন পোদ্দার পাতলুনে বল ঘষতে ঘষতে একবার খুনে চোখে মেপে নিল ভুতুমকে। অর্থাৎ--- ‘দাঁড়াও বাছাধন, তোমার ব্যাটবল খেলার শখ জন্মের মতো ঘোচাচ্ছি।’ তা অমন হুমকি দেওয়া তার সাজে বইকি! হোক না টেনিস বলের খেলা, এরই মধ্যে তার আগুনে ফাস্ট বোলিংয়ে এইটথ ক্লাসের একজনের নাক ফেটেছে, জনা দুই বুক চেপে ধরে বসে পড়েছে মাটিতে। বি সেকশনের মন্টুর কপালটা কমলালেবুর মতো ফুলে উঠেছিল, খবরটা কেমন করে জানি চাউর হয়ে যাওয়ায়, তার বাবার আপিস থেকে আর্দালি শাসিয়ে গেছে গেমটিচার বংশীধরবাবুকে---- ছেলেকে আর মাঠে নামানো হলে মন্টুর বাবা স্যারকে হাজতবাস করিয়ে ছাড়বেন।
পল্টন পোদ্দার এক পা-দু’পা করে দৌড় শুরু করেছে, রক্তমাখা বলটা তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা। ভুতুমের বুকের ভেতরে কেউ দমাদ্দম হাতুড়ি পিটছে, হাঁটুদুটো অবশ হয়ে শরীরের ভার ছেড়ে দেব দেব, এমন সময় সেই ভূতটা ফিসফিস করে বলে উঠল:
-আরে, ঘাবড়াও মৎ! বলের লাইনটা লক্ষ্য করে জোরসে একখানা ঘুঁষি হাঁকাও দেখি!
ভুতুম তো অবাক! ঘুঁষি চালাবে? মানে? ওই কামানের গোলার মুখে হাত নিয়ে গেলে হাতটার আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে নাকি? লোকটা ভূত হলেও পাগল-টাগল নয়তো? আচ্ছা, মরে গেলে তো মাথার ঘিলু-টিলু সমেত গোটা শরীরটাই ফেলে যেতে হয়, তাহলে ভূত হয়েও পাগলামির লক্ষণ থাকে কী করে? টিফিন পিরিয়ডের মতো খানিকটা অলস সময় পাওয়া গেলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে আরেকটু তলিয়ে ভাবা যেত, কিন্তু খেলার মাঠে অত ভাবাভাবির অবকাশ কোথায়? চোখের পলক ফেলার আগেই পল্টনের রানআপ শেষ, তার খাটো করে ফেলা বল তখন পিচের ধুলো উড়িয়ে সটান ধেয়ে আসছে ভুতুমের বুক বরাবর। আতঙ্কিত ভুতুম ঝপ করে চোখ বুজে ফেলল--- ওই এলো, ওই বুঝি সেই কালান্তক বল ভেঙে চুরমার করে দিল তার পাঁজরার হাড় ক’খানা!
প্রথমে আঙুলের ডগা থেকে কাঁধ অবধি প্রবল একটা ঝনঝনানি, যেন খোদ ইন্দ্রের ঐরাবত তার হাতখানা শুঁড়ে পেঁচিয়ে খুব একচোট নাড়িয়ে-ঝাঁকিয়ে দেখছে--- ঝাঁকানোর চোটে হাড়মাস একেবারে খসে পড়ার যোগাড়! খুব ছেলেবেলায় একবার খোলা স্যুইচবোর্ডে হাত পড়ে গিয়েছিল, সেই থেকে বিদ্যুতের তারকে বেজায় ভয় পায় ভুতুম। কিন্তু এই ঝাঁকুনির সামনে ইলেকট্রিক শকও যেন তুচ্ছ! ভুতুম সবে ব্যথায় ককিয়ে উঠে ‘বাপরে’ বলে চেঁচাতে যাবে, একটা সমবেত গর্জনের শব্দে তার কানে তালা ধরে গেল।
নন-স্ট্রাইকার প্রান্তের ছেলেটার মুখে বুঝভুম্বুল হাসি। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে চোখ মেলে তাকাতেই ভুতুম টের পেল, তার ডানহাতটা তখনও মুঠো পাকিয়ে স্থির হয়ে আছে, আর বলটা সেই মুঠোয় জোরালো ঘাড়ধাক্কা খেয়ে পাঁইপাঁই দৌড় লাগিয়েছে স্কোয়্যার লেগ বাউন্ডারির দিকে।
তা যাক! বলের গতিবিধি নিয়ে ভুতুমের তেমন মাথাব্যথা নেই, তার মনে তখন অন্য চিন্তা--- হাতের আঙুল ক’খানার বুঝি জন্মের দায়ে দফারফা হয়ে গেল! নির্ঘাত ওই উল্কার মতো বলের সঙ্গে সংঘর্ষে মুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে--- এজীবনে আর হাতের মুঠো খুলতে হচ্ছে না! জগন্নাথ ভিখিরির দুটো হাতই কনুই থেকে কাটা, সেই কাটা হাত নিয়ে ইস্টিশানের প্ল্যাটফর্মে ভিক্ষা করার ফাঁকে ফাঁকে ভুতুমকে গানও শেখায়--- ‘কৃষ্ণ নামে কী আনন্দ ডুবলে জানা যায়।’ এহেন জগন্নাথদাকে কেউ তার সামনে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বললেই এতদিন রাগে ভুতুমের দুই ভুরুর মাঝখানটা চিড়িং মেরে উঠত। কিন্তু এরপর তো তাকেও সবাই ‘নুলো ভুতুম’ বলে ডাকবে!
ভাবনা-ঘুড়ির সুতোয় আরেকটু ঢিল দিতে পারলেই হয়তো ভুতুমের চোখে জল এসে যেত, কিন্তু ততখানি সুযোগ-সুবিধে কেউ তাকে দিলে তো! তার আগেই ক্লাস এইটের পুরো দলটা এসে তাকে ঘিরে ধরলে। তাদের ঘনঘন পিঠ চাপড়ানি আর ‘সাবাশ ভুতুম!’ শেষ হতে না হতেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন স্বয়ং গেমটিচার। বংশীধর বর্মন আবেগপ্রবণ মানুষ, ভুতুমের কাঁধদুটো ধরে বারকতক কষে ঝাঁকুনি দিয়ে ছলছল চোখে বললেন, “ব্রাভো মাই বয়, ব্রাভো! এমন চওড়া বুকের পাটা না থাকলে কি আর ক্রিকেট খেলা হয়? জাত ব্যাটসম্যান তো এমনধারাই হবে! চিত্ত ভয়শূন্য না হলে শির উঁচিয়ে বল দেখবে কেমন করে? কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান... বয়েজ, তোমরা তোমাদের এই সহযোদ্ধার সাহসকে টুপি খুলে কুর্নিশ জানাও, করতালি সহযোগে দু’মিনিট নীরবতা পালন করো...”
স্যার হড়বড় করে আরও একগাদা কথা বলে যাচ্ছিলেন, সব ভুতুমের ঠিক ঠিক কানে ঢুকল না। সে কেবল আড়চোখে দেখল, ভিড়টা থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে পল্টনদা খর চোখে সটান তারই দিকে তাকিয়ে আছে--- তার চোখের রঙ খ্যাপা ষাঁড়ের মতোই লাল।
ভুতুম ব্যাট, বল দুটোই টুকটাক করতে পারে বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্লাস এইটের টিমে সচরাচর তার জায়গা হয় না। ইন্টারক্লাস টুর্নামেন্টে তার ভূমিকা উৎসাহী ভলান্টিয়ারের--- জল-তোয়ালে বওয়া, বাউন্ডারির ধারে চোরকাঁটার ঝোপ থেকে বল কুড়িয়ে আনা, এমনকি মাঠে কুকুর-বেড়াল ঢুকে পড়লে তাড়ানোর কাজটাও তাকেই করতে হয়, তবুও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না! সে হিসেবে আজকের দিনটা ব্যতিক্রমী, আর সেই ব্যতিক্রম ঘটার একমাত্র কারণ ওই পল্টন পোদ্দার। মূলত তার ভয়েই ক্লাস এইটের অন্তত হাফ ডজন প্লেয়ার মাঠে নামতে অস্বীকার করায় ভুতুমদের মতো কয়েকজনের কপাল খুলে গেছে।
ক্লাস নাইনে পরপর দু’বার ফেল করার পরেও যে পল্টনকে ইস্কুল থেকে তাড়ানো হয়নি, তার কারণ ওই খুনে বোলিং। আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতায় সে যে একার হাতে এই ইস্কুলকে কত ম্যাচ জিতিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই! ইতিমধ্যেই স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে জেলায় তার নাম ভাসছে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কলকাতার ক্লাবগুলো থেকেও ডাক আসতে পারে--- এহেন পল্টনকে ছাড়া স্কুল টিমের বোলিং বিভাগ কানা, তাই খোদ বংশীস্যারও তাকে সমঝে চলেন। কিন্তু এইসব এলেবেলে গা-ঘামানোর ম্যাচে সে নাকি ইচ্ছে করেই একটু আস্তে বল করে! ম্যাচ শুরুর আগে বংশীধরবাবু সেই কথাটাই একটু স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়েছিলেন, “বাবা পল্টন, অপোনেন্টের প্লেয়াররা তো তোমার ছোটভায়ের মতো--- কচি কচি ছেলেগুলোর হাত-পা ভাঙাটা কি যুক্তিযুক্ত হবে?” জবাবে পল্টন স্যারকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, “ঘাবড়াবেন না স্যার, আজ মুডটা তেমন ভালো নেই, স্লো বলই দেব। কথা দিচ্ছি, জনা তিনেকের বেশি কাউকে মাটি ধরাব না।”
কিন্তু পল্টন পোদ্দার পুরোপুরি কথা রাখতে পারেনি! চোট পাওয়া ব্যাটসম্যানদের সংখ্যা তিন পেরোয়নি বটে, কিন্তু তার ওই ‘স্লো’ বলের ধাক্কা সামলাতে না পেরে দু-দুটো ব্যাট ভেঙেছে। দুটো ব্যাটই মান্ধাতা আমলের--- বোধহয় সেই ইস্কুল প্রতিষ্ঠার সময় কেনা, মাটিতে ঠুকলেই কেশো বুড়োর মতো করুণ আওয়াজ ছাড়ত। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আজকের এই উৎপীড়ন আর সইতে পারেনি। কিন্তু ডমরুধর স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের ওই দুটি বই আর ব্যাট নেই, তাই ক্লাস এইট বারো রানে পাঁচ উইকেট খোয়ানোর পরে দেখা দিল ঘোর সংকট। তাও উইকেটকিপার পিকলুর নিজের একখানা ব্যাট ছিল, সেটা দিয়েই হয়তো কোনওমতে কাজ চালিয়ে যাওয়া যেত, কিন্তু পল্টনের ওভারের পঞ্চম বল হতেই দেখা দিল নতুন বিপত্তি। বাড়িতে মাস্টারমশাই পড়াতে এসে অপেক্ষা করছেন, এদিকে পাঁচটা বেজে গেলেও ছেলের ফেরার নাম নেই দেখে পিকলুর মা তাদের ভোজপুরি দারোয়ান মুসিবত সিংকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ছেলেকে ধরে আনতে। বংশীধরবাবু তাকে বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন, ‘মেনস সানা এন করপোরে সানো,’ ‘গীতাপাঠের চেয়েও মহৎ’ ইত্যাদি, কিন্তু মুসিবতের সেই এক গোঁ! “দেখিয়ে মাস্টারবাবু, হামি আনপড় আদমি আছে, ইসব বাত হামার দিমাগে ঘুষে না। লেকিন মাঈজি অগর হামাকে বলেছেন খোঁকাবাবুকে ধরে লিয়ে যেতে, তো হামি বেঁধে লিয়ে যাবে। অউর এক বাত, ইখানে খোঁকাবাবুর কাম কী আছে? উইকিটকিপার, মতলব, উও তিনঠো ছোটা ছোটা উইকিট হি তো সামলাবে! হামি উসসে দশগুণা বড়া গেট সামলাই, যিসকো বোলতা হ্যায় গেটকিপার। লেকিন তংখা যা মিলে, তা’তে সোমসার চলে না। না মাস্টারবাবু, হামি আপনাকে খোঁকাবাবুর কোনও লুকসান করতে দেবে না।”
দলটার থেকে একটু আলাদা হয়ে পশ্চিমদিকের ভাঙা পাঁচিলটার ওপর বসে একমনে ঘাসের শিস চিবুচ্ছিল ভুতুম। হিসেবমতো এবার তার নিজেরই ব্যাটহাতে নামার কথা, কিন্তু মাথা না থাকলে যেমন মাথাব্যথাও পোহাতে হয় না, তেমনই ব্যাট ছাড়াও ব্যাটসম্যান হয় না! ভুতুমের অভিষেক তখনও ঝুলে--- পিকলু এবং সর্বোপরি পিকলুর ব্যাটের থাকা বা না-থাকার ওপর নির্ভরশীল। স্যারের সঙ্গে মুসিবতের সেই ব্যাট-বিবাদ যখন চরমে উঠেছে, ঠিক তখনই কানের কাছে একটা হুড়মুড়-দুমদাম আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হল।
শিরীষ গাছটার ডালপালা ভেঙে যে লোকটা এইমাত্র ভুতুমের পাঁচহাত দূরে ছিটকে পড়েছে, সে যে জলজ্যান্ত একখানা ভূত, সেকথা আর বলে দিতে হয় না! লোকটার চেহারাখানা প্রকাণ্ড হলে কী হবে, দেখে রক্তমাংসের বলে মনেই হয় না--- যেন একরাশ ধূসর ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে! অতখানি উচ্চতা থেকে আছড়ে পড়ায় তার মুণ্ডুটা খসে পড়ে গড়াতে গড়াতে এসে ঠেকেছিল ভুতুমের পায়ের কাছে, একনজর দেখেই ভুতুম বুঝল কেবল ওই অতিকায় শরীরটাই নয়, লোকটার মাটিতে লুটোপুটি দাড়ির বাহারও ধোঁয়াটে, এমনকি মাথার হলদে-লাল ডোরাকাটা টুপিটাও কেমন ছায়া-ছায়া! আর সবচেয়ে বড় কথা, যে গাছটা থেকে লোকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেই ন্যাড়া শিরীষ গাছটার একটিমাত্র ডাল, তাও মাটি থেকে এত উঁচুতে যে স্থূলশরীর নিয়ে সেখানে ওঠে কার সাধ্যি! সুতরাং ব্যাকরণের নিয়মেই এই লোকটা ভূত হতে বাধ্য--- বিটকেল দাড়িওয়ালা, গোলগাল, হৃষ্টপুষ্ট চেহারার একটি নিটোল বায়ুভূত।
আচমকা স্কন্ধকাটা হয়ে পড়ে লোকটা, থুড়ি, ভূতটাও কেমন ব্যোমভোলা মেরে গিয়েছিল। মাথাটা কুড়িয়ে নিয়ে হেলমেটের মতো পরে ফেলে, ভুতুমের দিকে তাকিয়ে একঝলক বোকাটে হাসি ছুঁড়ে দিল- হেহঃ হেহঃ! তারপর ঘাড় উঁচিয়ে গাছটার দিকে চেয়ে, অবাক গলায় বললে, “কেমন হল? হিসেব তো মিলছে না!”
“কেন?”
“কেন কী হে? বেঁচে থাকতে আমার ওজন ছিল সতেরো স্টোন। তা ধরো,” ভূতটা খানিকক্ষণ বিড়বিড় করে আঙুলের কর গুনল, “না হোক একশো বছর আগেকার কথা! তখন এমন অঘটন ঘটলেও নাহয়... কিন্তু এখন তো আমি ভূত, মানে অতীত। হিসেবমতো শরীরটাও তো সূক্ষ্ম হওয়া উচিত! কিন্তু এই যে সূক্ষ্মশরীরেও আমি গাছের ডাল ভেঙে কুমড়োগড়ান গড়াচ্ছি, তুমিও দিব্যি আমায় দেখতে-শুনতে পাচ্ছ--- এসব কি ঠিক হচ্ছে? বলি, সবকিছুরই তো একটা নিয়মকানুন আছে, নাকি? এমনধারা চললে তো কোনদিন দেখব পুকুরের মাছগুলো সব ডাঙায় উঠে ডাঙ্গুলি খেলছে, লোকে নিমপাতার আইসক্রিম কিনছে লাইন দিয়ে আর মাঝদুপুরেই থইথই করছে জ্যোৎস্না!”
ভগবান একেকজন মানুষকে একেকটা ক্ষমতা একটু চেপে দেন। এই যেমন ভুতুমের ঠাকুমা নিস্তারিণীদেবী ধান শুনতে কান শোনেন। কাবুলিওয়ালা হাঁক পাড়লে হরিনাম সংকীর্তন ভেবে কেঁদে আকুল হন; আবার জ্যাঠামশাই যখন গায়ত্রী জপ করেন, তখন ডাকাত পড়েছে ভেবে বঁটি-হাতে দৌড়ে যান। ঠিক সেরকমই, ভূতের ভয়টা ভুতুমের বরাবরই একটু কম। যদিও আরশোলা, টিকটিকি বা বার্ষিক পরীক্ষার মতো আর পাঁচটা ভয়ঙ্কর জিনিসকে সেও ভয় পায়, কিন্তু ভূত সম্পর্কে তার মনের ভাবটা একটু নাকউঁচু ধরনের। তাই এই লোকটা নিজের মুখেই নিজেকে ভূত বলে পরিচয় দিলেও ভুতুমের তেমন ভাবান্তর হল না, বরং খুব বিজ্ঞের মতোই ভূতটার ভুল ধরিয়ে দিলে, “গেল বছর বাজ পড়ে ঝলসে গিয়েছিল, তারপর থেকেই গাছটার শরীর দুবলা--- স্থূল, সূক্ষ্ম কোনও দেহের ভারই বইতে পারে না।”
“ওহ্! তাই বলো, আমি ভাবলুম... হেহঃ হেহঃ...” ভূতটা নিজের অজ্ঞতায় নিজেই ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসল, “কিন্তু, এমন পুটুস পুটুস বল খেলতেই তোমরা যে একেবারে দাঁত ছিরকুটে ভিরমি যাচ্ছ! এর নাম নাকি ফাস্ট বোলিং! মরি মরি!”
যতই এখন বিপক্ষে থাক, পল্টন পোদ্দার তো এই স্কুলেরই রত্ন, তার জোরে বোলিংয়ের এহেন অপমানে ভুতুমের রাগই হল। “জানো, ফাস্ট বোলার হিসেবে গোটা জেলায় পল্টনদার জুড়ি নেই! আজ বাদে কাল কলকাতায় খেলবে, তারপর হয়তো দেশের হয়েও...”
“ফুঃ!” ভূতটা তার ধোঁয়াটে নাক কুঁচকে একটা বিচ্ছিরি অবজ্ঞার হাসি হাসল। “বাপু হে, ফাস্ট বোলার ছিল আমাদের সময়। স্যাম উডসের রোখ তো দেখোনি! আর ছিল কার্টরাইট! এখন তো সব কামানো গালের মতো পিচ দেখছ, আমরা খেলতুম চষা ক্ষেতে। আর সেই মাটিতে পড়ে কার্টরাইটের গুড লেংথ বলও সাঁইসাঁই বেরিয়ে যেত মাথার ওপর দিয়ে।”
স্যাম উডস, কার্টরাইট--- এই নামগুলো ভুতুম কস্মিনকালেও শোনেনি। সবে জিজ্ঞেস করতে যাবে, এরা কারা--- শুনতে পেল, মাঠের ভেতর থেকে বংশীধরবাবু চিৎকার করে তাকেই ডাকছেন:
“ওহে, কী নাম যেন তোমার... যাকগে, এদিকে এসো তো একবাট্টি!”
তর্কযুদ্ধে মুসিবত সিংয়ের হাতে শোচনীয় পরাজয় হয়েছে বংশীধরবাবুর, কাছে যেতেই প্রায় মিনতির স্বরে বললেন, “ব্যাট-ফ্যাট তো নেই, কিন্তু খালি হাতে অন্তত একটা বল টিকতে পারবে না? দেখো না চেষ্টা করে! এই ওভারটা ফুরোলেই আজকের মতো স্টাম্পস ডেকে দেব।”
স্যারের করুণ মুখখানা দেখে ভুতুমের মায়াই হল। ভয় যে তার করছিল না, তা নয়, কিন্তু বেকায়দায় পড়া স্যারকে নিরাশ করতেও মন চাইল না। কিন্তু বংশীধরবাবু নিজেই তার ভয়টা আরও উসকে দিলেন পরের কথাকটা বলে, “যাও ইয়ংম্যান, উইকেট গেলে যাক, কিন্তু শরীরটা অন্তত বাঁচানোর চেষ্টা করো!”
তার পরের গল্প তো আগেই বলেছি!
ডমরুধর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী যে একজন ভক্ত বৈষ্ণব, তা তাঁকে একঝলক দেখলেই বোঝা যায়। তিনি নাক থেকে শুরু করে কপালজুড়ে রসকলি আঁকেন, কণ্ঠি ধারন করেন, চেনা-অচেনা সবাইকেই অভিবাদন করেন ‘জয় নিতাই’ বলে। এছাড়াও ফি-সন্ধ্যা নিয়ম করে চৈতন্যচরিতামৃত পাঠ এবং জন্মাষ্টমীর দিন চৌধুরীবাবুদের বাড়ির কীর্তনের আসরে নামগানের সঙ্গে খোল-করতাল বাজানো, এসবই তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আর বাজনার হাতখানাও ভারী মিঠে! গোপাল গোঁসাইয়ের দশাসই বপুটি কিঞ্চিৎ ভয়োৎপাদক হলেও, তাঁর করতাল যখন ‘কাঁইনানা-কাঁইনানা-তুমকানানা’ বোল তোলে, তখন অতি বড় নাস্তিকেরও চোখে জল এসে যায়। তবে, খাঁটি বৈষ্ণবের আর সব গুণাবলী আয়ত্ত হলেও একটি জায়গায় তাঁর ভাগ্যে মস্ত বড় ঢ্যারা পড়ে গেছে। গোপালবাবুর স্বভাবে বৈষ্ণবীয় বিনয়ের ‘ব’টুকুও নেই--- বস্তুত, গর্জন না করে তিনি কথা কইতে পারেন না। আর তাঁর গলাখানাও দেহায়তনের সঙ্গে মানানসই, সে গর্জন শুনলে সুন্দরবনের কেঁদো বাঘেরাও বুঝি লজ্জা পায়! হেডমাস্টারমশাই কিঞ্চিৎ বদরাগীও বটে--- অল্পেতেই একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন; তারপর ভাঁটার মতো চোখ ঘুরিয়ে, চিৎকার-চেঁচামেচি আর ধমক-ধামক দিয়ে একেবারে পাড়া মাথায় করে তোলেন। তাই এত গুণের আধার হওয়া সত্ত্বেও যে গাঁয়ের লোকেরা আড়ালে তাঁকে ‘বাঘা বোষ্টম’ বলে ডাকে, সে নেহাৎ তাদের কুচুটে প্রবৃত্তির দোষ নয়!
হেডস্যার গোপালবাবু যদি উত্তর মেরু হন, তবে তাঁর ঠিক বিপরীতে আছেন অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টার ভবতারণ ভটচাজ। সবাই জানে, ভবতারণবাবু সে যুগের বিখ্যাত কালীসাধক কমলাকান্তের উত্তরপুরুষ। ভবতারণ নিজে অবশ্য সে বিষয়ে খোলাখুলি জাঁক করেন না, তবে মাতৃ আরাধনায় তিনিও কিছু কম যান না! তাঁর বাড়ির কালীপুজোয় কমপক্ষে দু’শো লোক পাত পেড়ে মায়ের প্রসাদ খেয়ে যায়, কলকাতার নামী গায়করা তাঁর স্বরচিত শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ড করতে চেয়ে মোটা টাকার বায়না দেন। ভবতারণবাবু ক্লাসে আসেন কপালে রক্তচন্দনের তিলক আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলিয়ে, রক্তাম্বরের বদলে ক্ষীণকায় মানুষটির পরনে থাকে আগুনরঙা শার্ট-প্যান্ট। মাঝেমধ্যে হাতের স্কেলটাকেও ত্রিশূলের মতো বাগিয়ে ধরেন বটে, কিন্তু সেই স্কেল আজ অবধি কারও পিঠে পড়েছে, এমন অপবাদ তাঁর শত্তুরেও দেবে না। এমনিতেই তাঁর ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ফার্স্ট বেঞ্চের ওপারে পৌঁছয় না, তায় ক্লাসঘরে কোনওদিন একটু বেশি সংখ্যায় মশা-মাছি ঢুকে পড়লে, তাদের ভনভনানিতে সেটুকুও চাপা পড়ে যায়। পেছনের বেঞ্চের ছেলেরা তাই তাঁর ক্লাসে মহানন্দে কাটাকুটি খেলে। কেবল তাদের বেয়াদপি যখন সপ্তমে পৌঁছয়, ভবতারণবাবু তখন ঈষদুষ্ণ হয়ে স্কেল দিয়ে টেবিলের ওপর সামান্য ঠুকঠুক করেন মাত্র! কিন্তু রেগে গিয়ে চেঁচামেচি বা মারধর করা তাঁর ধাতে নেই। জিজ্ঞেস করলে বলেন, “ক্রোধ হল চণ্ডাল--- একবার ধরলে আর রক্ষে নেই! কিন্তু স্বয়ং জগন্মাতা যার বর্ম, রিপু-রাক্ষস তাকে ছুঁতেও পারে না। মা, মাগো, তোমার অশেষ কৃপা, মা... জয়ক্কালী!”
তা, প্রকৃতির সহাবস্থানের নিয়ম মেনে ‘বাঘা বোষ্টম’ আর ‘শুঁটকো শাক্ত’ নির্ঝঞ্ঝাটে পাশাপাশি থাকতেই পারতেন, কিন্তু গোল বাঁধল অন্য জায়গায়। চুম্বকের দুই মেরুতে যেমন কখনও মিলমিশ হয় না, তেমনই ডমরুধর স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের এই দুই স্তম্ভেরও আজ পর্যন্ত কখনও মতের মিল হয়নি। অথচ তাঁরা কেবল সহকর্মীই নন, পরস্পরের দীর্ঘদিনের পড়শি এবং বাল্যবন্ধুও বটে! কিন্তু তাঁদের জীবনের সেই ঊষালগ্নেও দুজনের মতানৈক্য লেগেই থাকত। যে অঙ্কের প্রতি গোপালের দুর্বলতা বরাবরের, সেই অঙ্কই তাঁর বন্ধুর দু’চক্ষের বিষ--- অঙ্কের নতুন বই হাতে এলেই ভবতারণ তার পাতা কেটে কেটে কাগজের ফুল বানাতেন। আবার ভবতারণের ফুটবলপ্রীতি সুবিদিত, অথচ গোপালবাবু লাথালাথির খেলার নাম শুনলেও বিবমিষা বোধ করেন--- ছেলেবেলায় রেডিওতে ফুটবলের কমেন্ট্রি শুরু হলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বসে থাকতেন নদীর ধারে।
কিন্তু ছোটবেলায় যা ছিল নিছক খুনসুটি, দীর্ঘদিনের অভ্যাসে তাই একগুঁয়ে রেষারেষিতে পরিণত হয়েছে। এখন একজন যদি ডান দিকে যান, অন্যজন অবধারিত বাঁয়ে দৌড়বেন। ‘দি গ্রেট ইন্টারন্যাশনাল’ সেলুনটা নতুন খুলেছে, ভবতারণবাবু অনেকদিন ধরেই ভাবছিলেন একবার ঢুঁ মারবেন। কিন্তু যেদিন গোপালবাবুকে দেখলেন ওই সেলুন থেকে বেরিয়ে চকচকে গালে হাত বোলাতে, সেইদিন থেকে তাঁর শখ ঘুচে গেছে--- এখন ছগনলাল নাপিতকে ডেকে বাড়িতেই চুল-দাড়ি কাটান।
আবার একা তাঁর ঘাড়েও দোষ দেওয়া যায় না! ভবতারণের ইচ্ছে ছিল সরস্বতী পুজোর মেনুতে লুচি-আলুরদম রাখা হোক, প্রস্তাবটা হেডমাস্টারের টেবিলে যাওয়ামাত্র নাকচ হয়ে গিয়ে খিচুড়ি আর বাঁধাকপির চচ্চড়ির পক্ষে সিদ্ধান্ত পাশ হয়ে গেল। এমনিতে অবশ্য গোপালবাবু লুচি বলতে অজ্ঞান, কিন্তু প্রাণ থাকতে ওই ভটচাজের পোকে জিতে যেতে দেবেন, ডমরুধর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তেমন বান্দাই নন!
এমনি করেই দিন যাচ্ছিল। আজও হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ভবতারণবাবু ঘোষণা করলেন, “জয়ত্তারা! ছোটখোকার উপনয়নের জন্য কেষ্টনগরের ময়রাকে অর্ডারটা দিয়েই এলাম। সরভাজা আর সরপুরিয়া খাইয়ে সব্বাইকে একেবারে তাক লাগিয়ে দেব।”
কিন্তু তাঁর দুর্বল কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল গোপালবাবুর ব্যাঘ্রগর্জনে, “বড়খুকিটা দশে পড়ল। ভাবছি খুব ঘটা করে জন্মদিনটা পালন করব, চন্দননগরের জলভরা পাতে পড়লে গাঁ-সুদ্ধু লোকের চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। জয় গৌর, জয় নিতাই!”
আবার হয়তো একচোট মন কষাকষি হয়ে যেত, বাধ সাধল ইস্কুলের পিওন পাঁচুগোপাল। পাঁচুর একটা বদভ্যাস আছে, কোনও কারণে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেই সে সাধুভাষায় কথা বলতে শুরু করে। ইস্কুলের ঘন্টা বাজানোর হাতুড়িটা ছিল তার হাতে, যুযুধান দুই শিক্ষক একযোগে ফিরে তাকাতেই পাঁচুগোপাল সেটা তুলে মাঠের দিকে ইশারা করে বললে, “স্যারদ্বয়, ক্রীড়াশিক্ষক শ্রীযুক্ত বংশীধরবাবু সকল শিক্ষকবর্গকে ক্রীড়াঙ্গনে আহ্বান করিয়াছেন। সেস্থলে নানাবিধ অলৌকিক ঘটনাবলী সংঘটিত হইতেছে। তাহাদের কেন্দ্রে রহিয়াছে ভুতুম নামক অষ্টম শ্রেণীর এক বিদ্যার্থী। আপনারা কালক্ষেপ করিবেন না, সত্ত্বর সেখানে উপস্থিত হইয়া উক্ত বালকটির কীর্তি চাক্ষুষ করিয়া আসুন!”
এমন ডাক কি উপেক্ষা করা যায়? জলভরা আর সরপুরিয়ার কুস্তি আপাতত মুলতুবি রইল, দু’জনে তড়িঘড়ি গিয়ে হাজির হলেন খেলার মাঠে। সেখানে তখন সত্যিই অলৌকিক ঘটনাবলী সংঘটিত হচ্ছে, গতকালের সেই বাউন্ডারিতেই শেষ নয়--- বরং কালকের সেই বিচিত্র মুখবন্ধের পর ভুতুম-ম্যাজিকের আসল শো হচ্ছে আজ। লাগাতার চার আর ছয়ের ফোয়ারা ছুটছে, আর ভুতুমের হাতে রকমারি স্ট্রোকের ফুলঝুরি দেখে বিস্ময়ে হতবাক বংশীবাবু যেন হাততালি দিতেও ভুলে গেছেন। ঘনঘন আনন্দাশ্রু মোছার চোটে শার্টের আস্তিনটা ইতিমধ্যেই ভিজে ন্যাতা, কিন্তু বংশীধর বর্মন এখন বেপরোয়া--- পাগলের মতো একবার হাসেন, একবার কাঁদেন আর বিড়বিড়িয়ে কীসব যেন আবৃত্তি করেন। খানিকক্ষণ কান পেতে শুনে গোপালবাবু বললেন, “বংশী রবি ঠাকুর রিসাইট করছে। হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে...”
“উঁহু, নজরুল।” মাথা নাড়লেন ভবতারণ, “বলছে, ওরে যাদু ওরে মাণিক, আঁধার ঘরের রতন-মণি...”
ক্লাস নাইনের বোলাররা সবাই কম-বেশি এই নিপীড়নের শিকার হচ্ছে বটে, তবে তাদের মধ্যে একজনের ওপর যেন ভুতুমের একটু বেশিই পক্ষপাত! সে আর কেউ নয়- চ্যাম্পিয়ন ফাস্ট বোলার পল্টন পোদ্দার। পল্টন বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, নীচু ক্লাসের একটা বাচ্চা ছেলে তাকে এতখানি হেনস্থা করবে! ভুতুমের প্রথম একশো রানের মধ্যে সত্তর এসেছে পল্টনের বলে। ব্যাটিংয়ের হেন মার নেই, যা বাদ পড়েছে--- ড্রাইভ, কাট, পুল, হুক; শেষটায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত পল্টন পরপর তিনটে ওয়াইড করায় ক্যাপ্টেন বাধ্য হয়েছে তাকে তুলে নিতে। বলগুলো দেখে বংশীবাবু অবধি স্বীকার করে নিয়েছেন--- “ওয়াইডেস্ট অফ ওয়াইডস!”
একশো থেকে মাত্র পনেরো বলে দেড়শো, সেখান থেকে চোখের পলকে একশো সত্তর... আশি... শেষটায় ভুতুম যখন একশো নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছল, তখন মাঠময় দেখা দিল চাপা উত্তেজনা। ইতিমধ্যে এই অদ্ভুতুড়ে ইনিংস দেখার জন্য ইস্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে, খবর রটে যাওয়ায় আশপাশের কয়েকটা গ্রাম থেকেও লোক আসতে শুরু করেছে ম্যাটাডোর বোঝাই করে। সবার মধ্যেই একটা কী হয়-কী হয় ভাব, এমনকি খোদ বংশীধরবাবুও টেনশনে দাঁতে নখ কাটছেন আর বলছেন, “ধীরে ভুতুম, ধীরে! এই দশটা রান পেতেই হবে, ডবল সেঞ্চুরি বলে কথা! দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার...”
কিন্তু ধীরেসুস্থে খেলবার কি জো আছে? ওদিকে সেই ভূতটা তখন নাগাড়ে কুমন্তর দিয়ে চলেছে ভুতুমের কানে--- “অত ঠুক ঠুক কেন হে? বলি, ঠুকে তো বড়জোর তিন রান পাবে, তার চেয়ে হাত খুলে চালাও দেখি... ওই যে, শর্ট বল আসছে, হাঁকাও পুল!”
তা, ভুতুমও হাঁকাল বটে, কিন্তু টাইমিং ঠিক না হওয়ায় বলটা রকেটের বেগে উঠে গেল আকাশে। ডিপ মিড উইকেটে ফিল্ডিং করছিল গিরীন্দ্রনারায়ণ ভড় তলাপাত্র। পিতৃদত্ত নামখানা যেমনই হোক, গিরীন্দ্রনারায়ণ চার ফুট তিন চেহারার ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু তার উচ্চতা আর ইঞ্চি দুয়েক বেশি হলেই হয়তো এ-যাত্রায় ভুতুমের ভাগ্যে ডবল সেঞ্চুরি অধরাই থেকে যেত। ভাগ্য ভালো, গিরীনদা অনেক লাফিয়ে-ঝাঁপিয়েও ক্যাচ লুফতে পারল না, বলটা বেড়া ডিঙিয়ে যাওয়ায় আম্পায়ার ওভার বাউন্ডারি দিয়ে দিলেন।
বল যখন সটান গিরীন্দ্রনারায়ণের বাড়ানো হাতের দিকে নেমে আসছে, ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল ভুতুম। বুকের ভেতর আবার হাতুড়ি পেটার শব্দ, ঝিঁঝির ডাকে কান কটকট... ভাগ্যের জোরে বেঁচে গিয়ে ভূতটার দিকে কটমটে চোখে তাকালো ভুতুম। কিন্তু ভূতেদের কি আর লজ্জা-শরম বলে কিছু আছে? সিলি পয়েন্টের কাছে হাওয়ার ওপরেই আধশোয়া হয়ে দিব্যি হেহঃ হেহঃ করে হাসতে লাগলো!
এরপর অবশ্য ভুতুম খুব হুঁশিয়ার হয়ে গেল। আর কোনও ভৌতিক প্ররোচনায় কান দেওয়া নয়, এখন মানে-মানে দু’শোর ঘরে পৌঁছতে পারলেই বাঁচোয়া! কিন্তু তার ব্যক্তিগত রান যখন একশো আটানব্বই, তখন অপ্রত্যাশিত একটা দুর্ঘটনায় আবার মাথায় হাত পড়ার জোগাড়!
মিডিয়াম পেসার রতনদা একটা দুধভাত ডেলিভারি রেখেছিল অফ স্টাম্পের বাইরে--- ভুতুম দ্রুত দু’পা সরে গিয়ে সেটাকে থার্ড ম্যানের দিকে ঠেলে দিল বটে, কিন্তু সেই চক্করে তার পায়ের আলতো ছোঁয়ায় স্টাম্পের ওপর থেকে বেলটা পড়ল খসে।
ভুতুম আউট! দ্বিশতরান থেকে আর মাত্র দু’ধাপ দূরে!
কিন্তু কেউ খেয়াল করেনি, কেউ না! উইকেটকিপার ছুটেছে বলের পেছন পেছন, তার এদিকে তাকানোর ফুরসত নেই। হতাশ রতনদা আগেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে গুটিগুটি হাঁটা দিয়েছে বোলিং মার্কের দিকে। আর মাঠভর্তি এত দর্শক--- তাদের মনোযোগ এখন অরক্ষিত থার্ড ম্যান বাউন্ডারির দিকে। অর্থাৎ সকলের চোখে ভুতুম এখনও নট আউট।
না, একজন সত্যিটা জানেন! তাঁর সতর্ক দৃষ্টিতে পুরো ঘটনাটাই ধরা পড়েছে বটে, কিন্তু তিনি ইতস্তত করছেন--- আর তার কারণটাও খুব পরিষ্কার! এই যে ইস্কুলের দুটো ক্লাসের মধ্যে অতি সাধারণ একটা লড়াই দেখতেও শয়েশয়ে লোক জড়ো হয়েছে, তার একমাত্র কারণ ভুতুমের ব্যাটিং তাণ্ডব। সমবেত সেই জনতার আকাঙ্খা এখন একটাই, তারা ভুতুমের ডবল সেঞ্চুরি দেখতে চায়। এইমুহূর্তে সত্যিটা সবার চোখের সামনে তুলে ধরলে, ফল ভালো নাও হতে পারে!
ইতিহাসের মাস্টারমশাই কালাচাঁদবাবু এমনিতেই নার্ভাস প্রকৃতির লোক, তার ওপর জীবনে প্রথমবার আম্পায়ারিং করতে নেমেই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দোনামনা করছেন। ভুতুম একবার চকিতে তাঁর মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়। ইস্! এই উভয় সংকটের ঠেলা সামলাতে না পেরে স্যার বেচারি ঘেমেনেয়ে একেবারে একসা হয়ে গেছেন!
আচ্ছা, যদি কপালজোরে ডবল সেঞ্চুরি হয়েও যায়, ভুতুমের সাদামাটা জীবনটা তাতে খুব বেশি বদলাবে কি? সন্ধ্যেবেলা হারাধনবাবু পড়াতে বসে কান ধরে তেমনই আহ্নিক প্যাঁচ লাগাবেন, অ্যালজেব্রায় ভুল হলেই গাঁট্টার ঘায়ে মাথার ঘিলুগুলো এক্কাদোক্কা খেলবে। ভুতুমের বাবা ব্যস্ত মানুষ, ছেলের জন্য তাঁর দৈনিক বরাদ্দ আড়াই মিনিটটাও বেড়ে সাড়ে তিন হবে না। ছোটবোনটা যেমন দুরন্ত, তেমনই থাকবে আর মা... সেই না-ফেরার দেশ থেকে মাও তো আর ফিরবে না!
দু’শো হোক বা নাহোক, ভুতুম মিত্তির যেমনটি ছিল, হুবহু তেমনটিই থাকবে।
কিন্তু ব্যাটের ঠিক মাঝখানে বল লাগার ওই ‘টক’ শব্দটা! মামার দেওয়া বিলিতি অ্যালার্ম ঘড়িটার আওয়াজও অত মিঠে নয়! আর ওই যে সবুজ ঘাসের বুক চিরে বলটার সরসর করে ছুটে যাওয়া- অমন মনোরম দৃশ্য ভুতুম তার চোদ্দ বছরের জীবনে একটিই দেখেছে, তাদের পোষা বেড়াল মার্জারিনের হাই তোলা। তারপর ফিল্ডারের বাড়ানো হাত এড়িয়ে বলটা যখন ছোট্ট লাফে বাউন্ডারি টপকে যায়, কিম্বা বোলারের ঝুলে যাওয়া কাঁধ আর ফ্যালফ্যালে চাহনি... নাহ্! এবার তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হচ্ছে!
নীচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধার ভঙ্গিতে আলগোছে বেলদুটো তুলে নিয়ে, স্টাম্পের ওপর আবার বসিয়ে দিতে দিতে কালাচাঁদস্যারের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল ভুতুম, “বড্ড হাওয়া, তাই না স্যার?”
“কী ভাবছ হে?”
কথা হচ্ছিল লাট্টুদের আমবাগানে বসে। ইদানীং ইস্কুল ছুটির পর ভুতুম হামেশাই এখানে হানা দেয়। আম পাড়তে নয়, বরং এই যে হরেকরকম আমগাছ, তাদের কিছু ভুতুমের পরিচিত--- যেমন পাঁচিলের লাগোয়া এই গাছটার নাম আম্রপালি, উত্তরদিকে ওই পরপর সারিবাঁধা গাছগুলো মধুগুলগুলি। আবার বেশ কিছু গাছের নাম সে কস্মিনকালেও শোনেনি। এই সেদিনই তো বাগানের মালি পান্তুদা একটা নতুন ধরনের গাছ দেখালে, একেকটা আম প্রায় একহাত লম্বা, কিন্তু রঙ কাঁচা গোলাপির সঙ্গে সবুজ মেশানো--- এর নাম নাকি আলতাপাটি! কে জানে, হবেও বা! কিন্তু চেনা বা অচেনা যাই হোক, এই পরস্পর ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর ছায়ায় এসে বসলে মনটা আপনা থেকেই ভালো হয়ে যায়। গাছগুলোও যেন ভুতুমের অপেক্ষায় থাকে, হিলহিলে হাওয়ায় তিরতির করে পাতা দুলিয়ে তাকে বাইরের রোদ-জলের ঝাপটা থেকে আড়াল করে খানিকক্ষণ। বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামার আগে, দিনের এই সময়টুকু একান্তই তার ব্যক্তিগত।
ইস্কুলের সেই ভূতটা তার পেছন পেছন এখানেও এসে জুটেছে! তা’তে অবশ্য ভুতুমের বিশেষ আপত্তি নেই- একবার প্রায় আউট করিয়ে দিচ্ছিল বটে, কিন্তু ভূতটা যে মোটের ওপর উপকারী, তা’তে সন্দেহ নেই। এরমধ্যে টুকটাক কথাও হয়েছে দু’জনের। কথা বলার সময় ভূতটার মুখ থেকে কেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরোয়, যেন হাজারে হাজারে ঝিঁঝিঁ একটা ছোট্ট জায়গায় জমা হয়ে একসুরে ডাকতে লেগেছে--- নিখিলবঙ্গ ঝিঁঝিঁ সমিতির বার্ষিক সম্মেলন বা ওই গোছের কিছু! কথাটা বলতেই ভূতটা ভারি খুশি হয়ে উঠল, “বেশ তো, তুমি তবে আমাকে ঝিঁঝিঁভূত বলেই ডেকো। কিন্তু অত ভুরু কুঁচকে ভাবছটা কী?”
আসলে ভুতুমের মনটা ঠিক গতে নেই! অথচ গেল হপ্তাতেই অষ্টম শ্রেণীর হয়ে অভিষেক ম্যাচে ভুতুম করেছে তিনশো চুয়াল্লিশ, ছাত্র-শিক্ষক সব মহলই ধন্য-ধন্য করছে তার ব্যাটিং দেখে। কিন্তু একটা কথা মনে পড়লেই ভুতুমের মনটা বেজায় খচখচ করছে--- অনেক আগেই সে আউট হয়ে গিয়েছিল! বন্ধুদের এই পিঠ চাপড়ানি, স্যারেদের এত প্রশংসা, এর কোনোটাই হয়তো তার পাওনা নয়! আচ্ছা, কালাচাঁদবাবু যদি সত্যিটা ফাঁস করে দেন? সবাই কি তাকে ঠগ, জোচ্চোর ভাববে? এত লোকের এত মুগ্ধতা কি নিমেষে ঘেন্নায় বদলে যাবে না?
-ভুতুম মিটার, তোমাকে একটা গল্প বলি শোনো।
ঝিঁঝিঁভূত নিজেও এককালে ক্রিকেট খেলত। খেলুড়ে হিসেবে নাকি একশো-দেড়শো বছর আগেও খুব নামডাক ছিল তার। ঝিঁঝিঁভূতের খেলোয়াড় জীবনের কিছু কিছু গল্প ইতিমধ্যেই শুনে ফেলেছে ভুতুম। সেসব গল্প যেমন মজার, তেমনই রোমাঞ্চকর। তাই সে ধরেই নিল, ভূতটা এবারেও নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আরেকটা চমকপ্রদ গল্প শোনাবে।
“উঁহু! তুমি যা ভাবছ, তা নয়।” ভূতেরা পেটের কথাও টের পায়, ঝিঁঝিঁভূত তার দাড়ির জঙ্গলের ফাঁকে একটা দুষ্টু হাসি হেসে বলল, “এই গল্পের নায়ক আমার মেজদা।”
“তোমার দাদাও ক্রিকেটার ছিল নাকি?”--- এবার ভুতুমের গলায় বিস্ময়।
“হুঁ হুঁ বাবা, আমাদের বাড়িতে বাচ্চারা জন্মাতই ক্রিকেটার হয়ে। কেবল আমি আর মেজদাই নই, আমরা চার ভাইই একবার একসঙ্গে টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। আঠারোশো আশি সালের কথা বলছি, কিন্তু এই এত বছর পরেও সেই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি।”
“আইব্বাস!”
“মেজদা এডওয়ার্ডও আমার মতোই রগুড়ে মানুষ ছিল। একবার একটা ম্যাচ খেলতে নেমে বোলারের সঙ্গেই বাজি ধরে বসলে--- আউট করতে পারলেই টাকা দেব! তা, সারাদিন ধরে নটআউট থেকে মেজদা যখন প্রায় বাজি জিতব জিতব, তখন একটা বল হঠাৎ ব্যাটের কানায় লেগে উঠে গেল আকাশে--- তোমার ওই পুল শটের মতোই। দাদা একবার আড়চোখে দেখেই বুঝলে, আর নিস্তার নেই! লং অনের ফিল্ডার যেরকম খাপ পেতেছে, তা’তে নটে গাছটি মুড়োল বলে! কিন্তু আমারই তো মেজদা, সেই বা এত সহজে হার মানবে কেন? বল তখনও আকাশে, দাদা একটা গগনবিদারী হাঁক ছেড়ে বললে, ‘আমি ইনিংস ডিক্লেয়ার করছি!’ তা, দলের ক্যাপ্টেন যখন, যেকোনো মুহূর্তে ইনিংস ছেড়ে দেবার হক তো তার আছেই--- তাতে আইনে আটকায় না।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? দৌড়ে গিয়ে চেপে ধরলে স্কোরারকে, ‘আমাকে শিগগিরই নট আউট ঘোষণা করুন।’ “
মন খারাপের পারদ নেমে গিয়ে ভুতুম হো হো করে হেসে উঠল। তাই দেখে ঝিঁঝিঁভূতও খুব খুশি হয়ে বললে, “তা ভুতুমবাবু, ব্যাট হাঁকিয়ে তোমার প্রাপ্তিযোগ তো নেহাৎ কম হল না! এত হাততালি পেলে, এত লোকে তোমায় বাহবা দিল...”
“হেডস্যার গোপালবাবু একবাক্স চকলেট দিয়েছেন, আর অ্যাসিস্টেন্ট হেডস্যার দিয়েছেন মস্ত একটা কেক।”
“চৌধুরীদের বড়বাবুও তো শুনছি তোমাকে সোনার মেডেল দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন!”
“হুঁ।”
“এবার একটু ভেবে বলো তো দেখি, এই অ্যাত্ত পাওনাগণ্ডার মধ্যে কোন জিনিসটা তোমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে? যদি বলি, কেবলমাত্র সেই একটি জিনিস রেখে আর সবকিছু আমাকে দিয়ে দাও, তুমি কোনটা রাখবে? খুব ভেবেচিন্তে বলা চাই কিন্তু!”
ভুতুম গালে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ ভাবল। চকলেটগুলো দিব্যি খেতে, আবার কেকটাও নেহাৎ মন্দ নয়! ভুতুমের বাবা এককালে নামজাদা হাডুডু খেলোয়াড় ছিলেন, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে পাওয়া কাপ-মেডেলগুলোর ওপর তাঁর মমত্ব দেখবার মতো! কাঁচের শোকেসে সাজানো সেসব পুরস্কার ভুতুমরা চোখে দেখলেও কখনও হাতে নিয়ে দেখার অনুমতি পায়নি। চাইলেই বাবা বলবেন, “আগে ওসব জিনিসে হাত দেবার অধিকার অর্জন করো, তারপর।” ভুতুমের নিজস্ব একখানা মেডেল হলে সেও পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখতে পারবে, বাবা হাজার চাইলেও হাত দিতে দেবে না।
নানারকম জটিল হিসেব-নিকেশের গোলোকধাঁধায় পড়ে মাথাটা সবে ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করেছে, হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো একটা কথা মনে পড়ে যেতেই পিঠ টানটান করে সোজা হয়ে বসল ভুতুম। আড়চোখে ঝিঁঝিঁভূতের দিকে তাকাতেই মনে হল, ভূতটার মুখেও আবার সেই দুষ্টু-দুষ্টু হাসিটা ফিরে এসেছে।
ঘটনাটা ঘটেছিল ম্যাচের দ্বিতীয় দিন সকালে। প্রথম কয়েক ওভারে বেদম মার খেয়ে পল্টনদা তখন চটে লাল। লাগাতার শরীর লক্ষ্য করে বল ছুঁড়েও ভুতুমকে ভয় পাওয়ানো যায়নি, উপরন্তু চার-ছয়ের বন্যা বয়ে গেছে।
ভুতুম আন্দাজ করেছিল, পল্টন পোদ্দারের মতো ঝানু বোলার এবার নতুন ফন্দি আঁটবে। হলও ঠিক তাই! নতুন ওভারের প্রথম তিনটে বলই এল গরুর গাড়ির গতিতে, তাও শরীর থেকে অনেকখানি দূরে--- যেন হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেবার ভাব! কিন্তু চতুর্থ বলটার আগে যখন পল্টনদা বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়তি এক সেকেন্ড দম নিল, তখনই ভুতুমের মাথার মধ্যে কেউ যেন বলে দিলে--- এইবার ইয়র্কার আসছে!
আগাম অনুমান করেই ক্রিজ ছেড়ে দু’পা বেরিয়ে এসেছিল ভুতুম, ফলে পল্টনের বিষাক্ত ইয়র্কারটাই হয়ে গেল লোপ্পা ফুলটস। পরমুহূর্তেই ব্যাটের ঠিক মাঝখানে লাগার সেই ‘টক’ শব্দ, আর তারপর...
“বল গিয়ে লাগল জামরুল গাছটার মগডালে ভীমরুলের চাকে। তুমি তো বাপু ছক্কা মেরেই খুশ, এদিকে ভীমরুলের তাড়া খেয়ে মাঠসুদ্ধ লোকের তখন দফারফা! কনস্টেবল পাঁড়েজি মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিচ্ছিল; যেই না ভীমরুলের ঝাঁক গিয়ে ছেঁকে ধরেছে, ভয়ের চোটে খালি ডাক ছেড়ে কাঁদে আর চিৎকার করে হনুমান চালিশা আবৃত্তি করে--- জয় হনুমান জ্ঞানগুণসাগর... হেহঃ হেহঃ হেহঃ...” ঝিঁঝিঁভূত তার বর্ণনা থামিয়ে আবার ভুঁড়ি দুলিয়ে অট্টহাসি হাসতে শুরু করল।
সত্যিই, ওই মুহূর্তটা মনে পড়লে ভুতুমের এখনও চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছে! সেও একগাল হেসে ভূতের দিকে তাকালো।
“কী হে, ডিসিসন ফাইনাল তো?” ঝিঁঝিঁভূত একটুও অবাক হয়নি, যেন উত্তরটা তার জানাই ছিল। “দেখো ভুতুমবাবু, আমি সাতচল্লিশ বছর বয়সেও টেস্ট খেলেছি। ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছি নয় নয় করে একশো ছাব্বিশবার। কত হাজার হাজার রান আর উইকেট যে আমার নামের পাশে জমা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সংখ্যাগুলো সব ভুষিমাল হে, এখন জাবর কাটতে বসলে ওসব নিতান্তই ছিবড়ে ঠেকে। কিন্তু ওই যে টুকরো টুকরো আনন্দগুলো, ওগুলো জুড়ে জুড়েই তো আসলি জীবন।”
“কিন্তু...”
“জানি তুমি কী ভাবছ! আরে বাপু, সবসময় অত গেরামভারি চিন্তা করলেও চলে না! একটু বাড়তি মজার জন্য নাহয় অমন দু’একটা অন্যায়... না না, অন্যায় বলব না, নাহয় ওরকম খুচরো দুষ্টুমি একটু-আধটু করলেই, ওতে দোষের কিছু নেই!”
“তাই বলে...”
“শোনো ছোকরা, এককালে এই ঝিঁঝিঁভূত খেলার মাঠে যা সব দুষ্টুমি করেছে, তোমরা আজকালকার ছেলেপুলেরা সেসব কল্পনাও করতে পারবে না! হয়তো বলের গুঁতোয় তিনটে স্টাম্পই উপড়ে গেছে, তাও নট আউট বলে তর্ক জুড়েছি বোলারের সঙ্গে। আবার ফিরতি পথে হয়তো কোনও ফিচেল দর্শক টিপ্পনি কাটল, ক্ষেপে উঠে ব্যাটটাকে গদার মতো বাগিয়ে ধরে তাড়া করেছি তাকে। আমার সেসব কীর্তিকলাপের খ্যাতি এমনই যে, লোকের মুখে মুখে আমার নতুন একখানা ডাকনামই চালু হয়ে গিয়েছিল- ‘ওল্ড ডেভিল।’ কিন্তু কই, কখনও তো তার জন্য হাহুতাশ করিনি! কেন জানো? আরে বাবা, ওই মজাটাই তো আসল! ক্রিকেটের মাঠেই বলো বা জীবনের খাতায়, মজাটুকু বাদ দিলে কেবল সাজাই পড়ে থাকে--- তোমাদের বইয়ের ভাষায় যাকে বলে ‘জীবনধারণ।’ “
“হুঁ।”
“আর মজা কি একলা তোমার-আমার? তোমার ব্যাটিং দেখে কত লোক যে আনন্দ পেল, সেটা বুঝি কিছুই নয়? কেমন, এবার ঢুকল ঘটে?”
ভুতুম গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল, “আচ্ছা ঝিঁঝিঁভূত, ক্রিকেট খেলাটা অনেকটা জীবনের মতোই, তাই না?”
“নাহ্!” ভূত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “বরং জীবনটাই অনেকটা ক্রিকেট খেলার মতো।”
পরের খেলা এগারো ক্লাসের দাদাদের সঙ্গে। আগের ম্যাচে মনের খচখচানির জন্য ফুর্তিতে যেটুকু টান পড়েছিল, এই ম্যাচ থেকে তার পুরোটাই কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করে নিল ভুতুম। ব্যাট করতে নেমে সেঞ্চুরি তো করলই, কিন্তু আসল চমকটা দিল বোলার হিসেবে। মাত্র পাঁচ ওভার হাত ঘুরিয়ে বিপক্ষের সাত-সাতটা উইকেট নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়, কিন্তু দর্শক হেসে কুটিপাটি হল তার কাণ্ডকারখানা দেখে। দু’হাত ছড়িয়ে পাখির মতো উড়ে আসে ভুতুম, মুখের ভাবখানা যেন কাঁচা লোহা চিবিয়ে খায়! ওই রানআপ আর মুখভঙ্গি দেখেই তো ব্যাটসম্যানের আত্মারাম খাঁচাছাড়া! কিন্তু অমন মারমার-কাটকাট করে দৌড়ে আসার পর ডেলিভারি বেরোয় গড়ানে নাড়ুর মতো--- যেন পর্বতের মূষিক প্রসব! বেচারা ব্যাটসম্যান হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই তিনটে উইকেট ছিটকে পড়ে তিনদিকে।
মন্থর ব্যাটিংয়ের জন্য ইলেভেনের শান্ত সরখেলের সুনাম অথবা দুর্নাম দুইই আছে, একবার থানা গেড়ে বসলে তাকে ফেরায় কার সাধ্যি! ভুতুম প্রথমটায় তাকে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করল, কিন্তু শান্ত সেই ফাঁদে পা না দিয়ে দিব্যি ঠুক ঠুক করে আরও আধঘন্টা কাটিয়ে দিলে।
ষষ্ঠ ওভারের প্রথম বলটা করতে ভুতুম দৌড়ে এল দুলকি চালে। বলটা ছাড়তে যাবে যাবে, এমনসময় বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তেরচা চোখে চাইল আকাশের দিকে। তারপর বেশ খুশিয়াল গলায় বললে, “আইব্বাস! বকগুলো কী সুন্দর, তাই না শান্তদা?”
শান্ত এই গ্রামের পক্ষীপ্রেমী সমিতির সভ্য, বেচারি ভুতুমের দৃষ্টি অনুসরণ করে যেই না তাকিয়েছে, গনগনে সূর্যের আলো সোজাসুজি চোখে এসে পড়ায় চোখ গেল ধাঁধিয়ে! হতভাগ্য শান্ত সরখেল পরের বলটা ভালো করে দেখতেও পেলে না, স্লিপে খোঁচা দিয়ে গজগজ করতে করতে ফিরে গেল প্যাভিলিয়নে।
সব ঠিকঠাকই চলছিল, বিপত্তিটা ঘটল অষ্টম ওভারের মাথায়। মাত্র সাতাশ রানে নটা উইকেট খুইয়ে ক্লাস ইলেভেন তখন ধুঁকছে, খেল খতম করতে আবার ডাক পড়ল ভুতুমের। সেও নিশ্চিন্ত মনেই বল-হাতে দৌড় শুরু করেছিল। ক্রিজ থেকে দূরত্ব যখন আর হাত পাঁচেকের, আচমকাই পায়ের নীচে মাটি যেন দুলে উঠল! ভুতুমের চারপাশটা তখন বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে শুরু করেছে, মাথা ঝিমঝিম--- আর তারপরেই চোখের সামনে ঝুপ করে নেমে এল একটা কালো পর্দা।
ব্যস! তারপর আর কিচ্ছুটি মনে নেই!
-জিভ দেখি... ছাদের দিকে তাকাও... এ হে, তোমার শরীরে যে রক্ত বেজায় কম, ভুতুমবাবু! দাঁড়াও, চট করে একবার ভেতরটা দেখে আসি। বড় করে হাঁ করো তো দেখি!
ভুতুম খুব বাধ্য ছেলের মতো হাঁ করল। ঝিঁঝিঁভূত প্রথমে সেই হাঁ-মুখের ভেতর সিঁধেল চোরের মতো মুণ্ডু গলিয়ে দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কীসব যেন দেখলে। তারপর তার পেল্লায় শরীরটাকে গুটলি পাকাতে পাকাতে একটা হজমিগুলির মতো ছোট্ট করে এনে, খপ করে ঢুকে পড়ল ভুতুমের অন্দরমহলে।
শরীরের সবকটা কলকব্জা যদি নাগাড়ে টুংটাং, খুটখাট, ধুপধাপ প্রভৃতি ভয়ানক শব্দ করে, তবে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক--- ভুতুমও পাচ্ছিল। ভূতটার ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না! তার ওপর তার মগজখানা যেন মিচকেমির আড়ত--- মশকরা করতে গিয়ে ভেতরে বড়সড় কোনও গোলমাল পাকিয়ে না বসে! শেষকালে হয়তো তাকে নাকের বদলে কান দিয়ে গন্ধ শুঁকতে হবে, বুদ্ধিসুদ্ধি সব গিয়ে জমা হবে হাঁটুতে, আর খাবার-দাবার চাখতে হবে চোখ দিয়ে!
কিন্তু সেসবের কিছুই হল না! পাক্কা আধঘন্টা পর ভুতুমের নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এসে ঝিঁঝিঁভূতটা বেশ হাসি হাসি মুখেই বলল, “নাহ্! এক অ্যানিমিয়া ছাড়া তেমন কোনও কুলক্ষণ তো দেখলুম না! ভেতরে সামান্য ঝুল জমেছিল ঠিকই, কিন্তু সেসব আমি ঝেড়েপুঁছে একেবারে সাফসুতরো করে দিয়ে এসেছি। এখন রক্তে একটু আয়রন পড়লেই সব যন্ত্রপাতি আবার পাঁইপাঁই করে দৌড়বে।”
অ্যানিমিয়া! ভুতুমের মনে পড়ল, হেডস্যার গোপালবাবুও তেমনই কিছু একটা সন্দেহ করেছিলেন বটে। অ্যাসিস্টেন্ট হেডস্যার অবশ্য ক্ষীণকণ্ঠে একটু আপত্তি তুলেছিলেন, তাঁর মতে ভুতুমের পিত্তরোগ হবার সম্ভাবনাই বেশি--- কিন্তু গোপালবাবুর বাঘা ধমকের সামনে তাঁর সে মত ধোপে টেকেনি।
অজ্ঞান হবার পর ভুতুমকে শোওয়ানো হয়েছিল টিচার্স রুমের একটা বেঞ্চিতে। বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছিল, ব্যবসার কাজ ফেলে রেখে বাবাও পত্রপাঠ চলে এসেছিলেন। ভুতুমের বাবা বলদর্পী মিত্তির অল্প কথার মানুষ। সব শুনেটুনে তিনি কেবল মাথা নেড়ে বলেছিলেন, “না মাস্টারমশাই, আপনারা যতই শারীরিক ব্যামোর কথা বলুন, আমি গোটা ব্যাপারটার মধ্যে একটা অশৈলী কিছুর গন্ধ টের পাচ্ছি। ঠিক আছে, আপনাদের উদ্বিগ্ন হতে হবে না, যা করার আমিই করব।”
গেমটিচার বংশীধরবাবু কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন এককোণে, বাবা স্যারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, “এই অবস্থায় বেশি দৌড়ঝাঁপ না করাই ভালো--- কী বলেন, মাস্টারমশাই? ভুতুমের ব্যাটবল খেলা আপাতত বন্ধই থাক, আমি অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত ওকে আর মাঠে নামতে দেবেন না।”
বাবার কথা সত্যি হলে ভূতের পাল্লায় পড়েই ভুতুমের এত ভোগান্তি! সে কথাটা হালকা করে পাড়তেই ঝিঁঝিঁভূত একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল:
“রাবিশ! যতসব ফালতু কুসংস্কার! শোনো ভুতুম সর্দার, আমার ডাক্তারি করে করে পেকে যাওয়া চোখ; রোগলক্ষণ দেখেই অ্যানিমিয়া বলে সন্দেহ হয়েছিল, এখন নেড়েঘেঁটে দেখে আমি একেবারে একশো শতাংশ নিশ্চিত, তোমার রক্তাল্পতা না হয়ে যায় না!”
“ঝিঁঝিঁভূত, তুমি ডাক্তারিও করতে নাকি?”
“করতাম মানে? দস্তুরমতো এমআরসিএস, এলআরসিপি। সারারাত জেগে কল অ্যাটেন্ড করেও পরেরদিন ম্যাচ জিতিয়েছি এমসিসিকে। আরেকবার তো ম্যাচের মধ্যেই ছুঁচ-সুতো হাতে সেলাই করতে বসতে হয়েছিল।”
“কেন, কেন?” ভুতুমের গলায় কৌতুহল।
“অপোনেন্টের উইকেটকিপার ছিল বুড়ো পামার। বেকায়দায় একটা বল লেগে তার চোখের কাছটা গেসল কেটে, অগত্যা... কিন্তু অকৃতজ্ঞ পামার তার কী প্রতিদান দিলে জানো? পরের বলটাই স্টেপ আউট করে মারতে গিয়ে যেই না ফসকেছি, খুটুস করে স্টাম্প করে দিলে!”
ঝিঁঝিঁভূতের বলার ধরণে না হেসে পারল না ভুতুম। ভূতটাও তাতে খুশি হয়ে বললে, “আরেকটা গল্প বলি, শোনো। একবার এক পেশেন্ট এসেছে ফিট সার্টিফিকেট নিতে। তা ফিট লিখব কী, চেহারাখানা যা দেখলুম, ঘোরতর আনফিট! উপরন্তু মাঝেমধ্যেই ফিট হয়ে পড়ে যায়।”
“তারপর?”
“বললাম, ‘বাপু হে, একটু দৌড়ঝাঁপ করলেও তো পারো! ধরো, একটু শারীরিক কসরত বা নিদেনপক্ষে খেলার মাঠে একটু যাতায়াত!’ তাতে ছোকরা একগাল হেসে বললে, ‘আজ্ঞে, আমি নিজে খেলাধুলোয় তেমন দড় নই বটে, কিন্তু আপনাকে ব্যাট করতে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।’ সবে ভাবছি, ব্যাটা নির্ঘাত আমার ভক্ত, এখনই হয়তো ফস করে অটোগ্রাফ চেয়ে বসবে--- ও হরি! ব্যাটাচ্ছেলে বলে কী, ‘কিন্তু যতবারই খেলা দেখতে গেছি, আপনি প্রত্যেকবারই শূন্য রানে আউট হয়েছেন।’ “
“তারপর, তারপর?”
“খুব গম্ভীর মুখে প্যাড টেনে নিয়ে লিখলাম, ‘মতিভ্রম--- পত্রপাঠ পাগলাগারদে ভরে দিতে সুপারিশ করা হচ্ছে।’ “
ঝাড়া পাঁচ মিনিট ছাদের কড়িবরগা কাঁপিয়ে হাসার পর ভুতুম যখন থামল, ভূতের চোখে তখন গভীর ভ্রূকুটি। “কিন্তু ভুতুমবাবু, তোমার বাবা যে ওঝা ডেকে ভূত ঝাড়ানোর মতলব করছেন!”
কথাটা আগেই ভুতুমের কানে এসেছিল, এখন মনে পড়তেই হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবার যোগাড়!
“কী হবে, ঝিঁঝিঁভূত?”
“উঁ... কী হবে?” ঝিঁঝিঁভূত হাতের ধোঁয়াটে আঙুলগুলো মটকাতে মটকাতে খানিকক্ষণ কী যেন ভাবল, “কী আবার হবে? ম্যাচ বাঁচাতে এই বুড়ো ডাক্তারকেই আবার মাঠে নামতে হবে!” তারপর একটু ফিক করে হেসে বলল, “ঘাবড়াও মৎ! তুমি কেবল উইকেটের একটা দিক ধরে থেকো, বোর্ডে রান তুলে দেবার দায়িত্ব আমার।”
পঞ্চমুণ্ডীর আসনে যেদিকে মুখ করে বসার কথা, সাধনায় হাতেখড়ির দিনে বগলাচরণ বসেছিলেন তার উল্টোমুখে। দোষ হিসেবে খুব গুরুতর কিছু নিশ্চয়ই বলা চলে না, কিন্তু বগলা তান্ত্রিকের পোড়া কপালে এই লঘু পাপেই গুরুদণ্ডের সাজা লেখা হয়ে গেল--- সেই যে একবার ‘উল্টো সিদ্ধাই’-এর তকমা লেগে গেল তাঁর গায়ে, সে ছাপ আর জীবনভর উঠল না! ব্যাপারটা কীরকম, একটু বুঝিয়ে বলা দরকার।
ল্যাংচাহাটির দামোদর পুরকায়স্থ বিগত তিনদিন ধরে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন বগলাবাবার থানে। দামোদরবাবুর সুপুত্র বিদ্যেধর এইবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার রেকর্ড করবে, পরীক্ষাকারার লৌহকপাটে সে এর আগেও ন’বার আঘাত হেনেছে, কিন্তু কুচক্রী এগজামিনারদের ষড়যন্ত্রে প্রতিবারই ফিরতে হয়েছে ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে। এদিকে দামোদরবাবুর বৃদ্ধ পিতা গুণধর পুরকায়স্থ সেই দশ বছর আগেই ঘোষণা করেছিলেন, বংশের প্রথম পুরুষ হিসেবে বিদ্যেধরকে মাধ্যমিকের বেড়া ডিঙোতে না দেখলে, তিনি মরেও শান্তি পাবেন না। কিন্তু নাতির সাফল্যের আশায় পুরো একটি দশক ধৈর্য ধরে থাকার পরেও যখন তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ হল না, তখন নব্বই বছরের পুরোনো শরীরখানা বিদ্রোহ করে বসলে। ডাক্তার-কবিরাজ সকলেই জবাব দিয়েছেন, গুণধরবাবুর মেয়াদ বড়জোর আর একটি সপ্তাহ। ওদিকে পরশুই বিদ্যেধরের রেজাল্ট, দশবারের বারও সে কৃতকার্য হতে না পারলে, গুণধরবাবুর অতৃপ্ত আত্মা চিরটাকাল বাড়ির আশেপাশেই ঘুরপাক খাবে। চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করে তাই দামোদরবাবু বগলা তান্ত্রিকের শরণ নিয়েছেন।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর একটি নাতিদীর্ঘ দিবানিদ্রা না পেলেই বগলাচরণের কান কটকট করে, আজ দামোদর পুরকায়স্থর অত্যাচারে সেই সুখটি হাতছাড়া হয়েছে। ডানহাতের কড়ে আঙুল দিয়ে কানের ভেতরটা খোঁচাতে খোঁচাতে বলছিলেন, “ওরে, মায়ার বাঁধন কাটাতে না পারলে জীবাত্মা আর পরমাত্মায় মিলন হবে কী করে? পরীক্ষা, রেজাল্ট--- এসবই তো মায়া রে, অবোধ! সেই এক ব্রহ্মই তো নানারূপে বিরাজ করছেন--- তুইও যা, আমিও তা। পাশও যা, ফেলও তা। সবই মহামায়ার মায়া, বুঝলি?”
দামোদরবাবু কাঁদোকাঁদো স্বরে বললেন, “কিন্তু বাবা, বিদ্যে পাশ না করলে আমার বুড়ো বাপটার কী গতি হবে? বাবার জীবাত্মাটা তো দেহত্যাগের পরেও পরমাত্মার সঙ্গে ভাবসাব জমিয়ে উঠতে পারবে না! দোহাই বাবা, ছেলেটাকে ওই বাইরের বটতলায় বসিয়ে রেখে এসেছি--- আপনি তাক করে একটি বাণ ছেড়ে দিন, তাহলেই আর ভাবনা থাকে না।”
বগলাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ওরে বদ্ধজীব, তোর ছেলের অবস্থান কি আর আমার জানতে বাকি আছে রে? আমার তৃতীয় নয়ন দিয়ে কবেই দেখে ফেলেছি! আচ্ছা যা, ওই প্রণামীর বাক্সে পাঁচশোটা টাকা ফেলে যা! অ্যায়সা বাণ মারব, তোর ছেলে একেবারে ফার্স্ট ডিভিশনে তরিয়ে যাবে। যা যাঃ!”
দামোদরবাবু প্রায় নাচতে নাচতে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন মামলাবাজ বিধানচন্দ্র গুঁই। বাবার শ্রীচরণে রসগোল্লার হাঁড়ি আর একশো টাকার দশখানা নোটের বাণ্ডিল নামিয়ে রেখে বললেন, “হেঁ হেঁ, উকিলের মুখে শুনলুম, আসছে মাসেই শ্রীহরিপুরের জমিটার একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। খবর পেয়েই আপনার কাছে দৌড়ে এসেছি, এককাপ চা অবধি এখনও পেটে পড়েনি! বাবার আশীর্বাদ... এই না না, মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে... মানে, আপনার অভিশাপের হাতটা যদি এইবেলা একটু গরীবের মাথায় পড়ত, হেঁ হেঁ...”
বগলাচরণ আড়চোখে রসগোল্লার হাঁড়িটা একবার মেপে নিয়ে তাঁর সেবক শিবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হ্যাঁ রে শিবু, অভিশাপের দরটা কি হঠাৎ পড়ে গেছে?”
“তাই তো দেখছি, প্রভু! মোটে হাজারটা টাকা আর জনার্দন ময়রার বাসি রসগোল্লা- নাহ্! গঞ্জের বাজারে যার তিন তিনখানা দোকান, দুটো চালকল, একটা তেলের পাম্প, তার পক্ষে দরটা নেহাতই কম বলতে হবে। বিধানবাবুর কপাল ভালো, প্রভুকে দয়ার অবতার পেয়ে অভিশাপটা একরকম ফ্রিতেই বাগিয়ে নিলেন।”
“হ্যাঁ রে শিবু, পালংপোঁতার খগেন সমাদ্দার যেন অভিশাপপিছু কত করে দিতে চাইছিল?”
“আজ্ঞে প্রভু, নগদ দশ হাজার টাকা আর বড় একধামা বাটপাড়িরামের শোনপাপড়ি।”
বিধানচন্দ্র আঁতকে উঠলেন, খগেন এই মামলায় তাঁর বিরোধী পক্ষ। বগলাবাবার তৃতীয় নয়নের অগ্নিবর্ষণ যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পালংপোঁতায় গিয়ে পড়ে, তাহলে আর...
“অপরাধ নেবেন না, বাবা! এই যে আরও তিনটি হাজার টাকা রেখে যাচ্ছি। এর বেশি সঙ্গে নেই, কিন্তু দিব্যি গেলে বলছি--- মামলা জিতলে পুরো দশে দশ করে দেব।”
শিবু মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু! দশ নয়, বারো।”
“বাহাআআআরো!” আতঙ্কে গলাটা কেঁপে গেল বিধানবাবুর।
“বারো। বাকি দুইটা লেট ফাইন।”
বিধানচন্দ্র বলির পাঁঠার মতো করুণ চোখে তাকালেন বগলাচরণের দিকে। “প্রভু করুণাসাগর, গরীবের ওপর একটু কৃপাদৃষ্টি দিন, বাবা! বাজারে মন্দা চলছে, ব্যবসাপত্তরের হাল বেহাল--- এখন বারো হাজার টাকা বের করতে হলে ধনেপ্রাণে মারা পড়ব যে!”
বিধানের মুখখানা দেখে একটু একটু মায়া হচ্ছিল বগলাচরণের, সবে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে যাবেন, শিবু ঝাঁপিয়ে পড়ে বাধা দিল:
“বলি, বিধানকত্তার কি বুদ্ধিনাশ হল নাকি? স্বয়ং কল্কি অবতারের সঙ্গে দরাদরি করলে ধর্মে সইবে তো? বাবা যদি মুখ ফস্কে একটিবার আশীর্বাণী উচ্চারণ করে ফেলেন, আপনার যে দুর্গতির শেষ থাকবে না! চালকলে ধর্মঘট তো হবেই, এমনকি তেলের পাম্পে ডাকাত পড়তেই বা কতক্ষণ? তারপর ধরুন, দুষ্টু লোকে বলে, বাজারের শাড়ির দোকানটায় সিদ্ধিদাতা গণেশের আসনের নীচে নাকি আপনার কাঁড়ি কাঁড়ি কালো টাকা পচছে, দারোগাবাবুর কানে সে খবরটা পৌঁছলে কি আর রক্ষে থাকবে?”
ভীত, সন্ত্রস্ত বিধানবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, “ওরে বাবারে... ওরে বাবারে...”
“বেশি দরদাম করিসনে বিধান!” বগলাবাবার নাক থেকে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, “টাকাকটা রেখে মানে-মানে কেটে পড়। আমার মনটা আবার সকাল থেকেই প্রফুল্ল হয়ে আছে, কোন সময় ফস করে আশীর্বাদ করে বসব!”
টাকা রেখে বিধানচন্দ্র বিদায় হতেই শিবু একেবারে গাঁ গাঁ করে উঠল, “দিনকে দিন আপনার নজর খুব ছোট হয়ে যাচ্ছে, প্রভু! কোথায় কিপটের জাসুটাকে রগড়ে আখেরটা আরেকটু গুছিয়ে নেবেন, তা নয়--- এ যে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করা! বাতাসা খেয়েই অম্বল! আচার চুরির দায়ে জেল খাটা!”
“দেখ শিবু, লোভের ওপরেও একটা লাগাম রাখা ভালো, বুঝলি? তোর কেবল খাইখাই--- ওরে, একটু রয়েসয়ে না খেললে যে শিকার ভড়কে যাবে!”
কিন্তু শিবুর দুঃখ গেল না, “ইদানীং যে আমদানিতে ঢিল পড়েছে, সে খবর রাখেন? তার ওপর জাফরডাঙার বাঁটুল বোসের সেই কেলেঙ্কারিটার পর থেকে বাজারে আপনার একটু বদনামও রটেছে--- নাহ্! এরপর তো বোষ্টমদের মতো ভিখ মেঙেই পেট চালাতে হবে দেখছি!”
জাফরডাঙার কথা উঠলেই বগলা তান্ত্রিকের কানদুটো টকটকে লাল হয়ে ওঠে। বাঁটুল বোস তার দুঃসম্পর্কের খুড়োর দীর্ঘায়ু কামনা করে আশীর্বাদ চেয়েছিল। খুড়ো বেজায় পয়সাওলা, তিনি চোখ বুজলে সব সম্পত্তি বাঁটুলের নামেই অর্শাবে। তা, বগলাচরণ নগদ পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে খুড়োকে শতায়ু হবার আশীর্বাদ দেবার তিন দিনের মধ্যেই সেই খুড়োর চিঠি এসে হাজির--- কিন্তু চিঠি পড়ে তো বাঁটুলের মাথায় হাত! খুড়োমশায়ের শরীর গতিক সম্প্রতি খুব ভালো যাচ্ছে, উপরন্তু মাস ছয়েক আগে তিনি একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জনক হয়েছেন, এ তারই অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণপত্র। বাঁটুল যেন সপরিবারে হাজির হয়ে তার খুড়তুতো ভাইটিকে আশীর্বাদ করে, ইত্যাদি।
বাঁটুল বোস সেই পাঁচ হাজার টাকা তো ফেরত নিয়েছিলই, উপরন্তু তার মুখ বন্ধ রাখার জন্য আরও হাজার পাঁচেক বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শিবুর কথা শুনেই মালুম হয়, এত করেও লোকসান পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি। বগলাচরণ একটু লজ্জিত মুখে বললেন, “দেখ, ব্যবসায় ওঠা-পড়া তো লেগেই থাকে, কিন্তু তাই বলে কি হাল ছাড়লে চলে? মরণপণ করে লেগে থাকলে মা লক্ষ্মী নিশ্চয়ই আবার মুখ তুলে তাকাবেন!”
“থামুন মশাই!” ক্ষুব্ধ শিবু গুরুর মুখের ওপরেই ঝাঁঝিয়ে উঠল, “কত আশা ছিল, বেনেপাড়ার বাবু পালের মতো একটা মোটরবাইক কিনে গাঁয়ের লোককে তাক লাগিয়ে দেব। কিন্তু আপনার কাছে পড়ে থাকলে দেখছি সেসব শখ-সাধের কিছুই পূর্ণ হবার নয়। ইস! গেল মাসে বিশ্বেশ্বরবাবার ঠেকে ভর্তি হবার জন্য যে অ্যাডমিশন টেস্ট দিলুম, তাড়াহুড়োয় খান তিনেক এমসিকিউ ভুল করে না এলে অ্যাদ্দিনে আমিও ভটভটি চেপে ফাঁট মেরে বেড়াই! ধুর ধুর!”
“কে? কার নাম করলি?”
“আজ্ঞে, বাবা বিশ্বেশ্বরানন্দ।” শিবু হাতজোড় করে কপালে ঠেকায়, “মধুপুকুরের বিশ্বেশ্বর সিদ্ধাই। পিশাচসিদ্ধ সাধক, বুঝেছেন মশাই! সাক্ষাৎ শিবের অবতার, বাবা ভূতনাথের সঙ্গে নিত্যি ওঠাবসা তেনার।”
“বিশ্বেশ্বর? মানে, আমাদের বিশে? সেও এখন সিদ্ধাই হয়েছে?”
“হ্যাঁ। কেন, চেনেন নাকি?”
বিশ্বেশ্বর ওরফে বিশে সম্পর্কে বগলাচরণ তান্ত্রিকের মাসতুতো ভাই। ছোকরা বয়সেই বাপের সিন্দুক ভাঙার অপরাধে বাপ তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন--- বিশের অধঃপতনের সেই শুরু। তারপর ছোটখাটো চুরি-ছিনতাই, সিনেমা হলে টিকিট ব্ল্যাকের মতো কাজ দিয়ে হাত পাকিয়েই বিশে ধীরে ধীরে এ লাইনের ওস্তাদ হয়ে ওঠে। মাঝে বছর দুয়েক জেলও খেটেছে, জেল থেকে বেরিয়েই একবার কয়েকমাসের জন্য ঠাঁই নিয়েছিল বগলাচরণের কাছে। মারণ-উচাটন, ভূত ছাড়ানো ইত্যাদি শেখায় তার উৎসাহ ছিল প্রবল, কিন্তু বগলাচরণ জানেন অনধিকারীর কাছে তন্ত্রসাধনার গূঢ় তত্ত্ব ফাঁস করতে নেই--- মাসতুতো ভাইটির আবদারে তিনি কর্ণপাতও করেননি। উপরোধে বরফ গলছে না দেখে বিশেও ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল, একদিন বগলাচরণের খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাঁর ক্যাশবাক্সটি সমেত নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
সেই বিশেই এখন সিদ্ধাই সেজে বসেছে! ভাবতেই বগলাচরণের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। “শিবু, অনেকদিন রয়েছিস বলে তোর ওপর একটা মায়া পড়ে গেছে, তাই বলছি, বিশেটা পয়লা নম্বরের জোচ্চোর। যদি ভালো চাস, খবরদার ওর ধারেকাছে ঘেঁসিসনি!”
“রাখুন তো! আপনি কেবল লোকের কুচ্ছো গাইতেই ওস্তাদ। ওদিকে বিশেশ্বর ঠাকুর যে কত বড় দাঁও মেরেছে, সে খবর রাখেন?” শিবু গলাটা খাটো করে ফিসফিসিয়ে বলল, “বাজারে জোর খবর--- মিত্তির বাড়ির ছোঁড়াটাকে নাকি ভূতে ধরেছে, রক্ত চুষে চুষে একেবারে ছিবড়ে করে দিচ্ছে ছোঁড়াটাকে! বিশ্বেশ্বরবাবা তাই সক্কাল সক্কাল বাড়ি বয়ে গিয়ে মিত্তিরকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এয়েচেন, বলেছেন, উপযুক্ত সেলামি পেলে তিনি ভূত নামানোর দায়িত্ব নিতে রাজি। লোকমুখে শুনলাম, বিস্তর দরাদরির পর নাকি পঞ্চাশ হাজারে রফা হয়েছে। পঞ্চাআআআশ হাজার! আজ সন্ধ্যেতেই মিত্তিরের পোর ভূত ছাড়ানো হবে।”
শিবুর কথাকটা শেষ হতেই ধড়মড় করে আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন বগলা তান্ত্রিক। ত্রিশূল আর কমণ্ডলুটা হাতে নিতে নিতে গম্ভীর গলায় বললেন, “তোকে একটা কথা বলি শিবু, লোকের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে এই শর্মাও খায় বটে, তার জন্য যে শাস্তি আমার পাওনা, তা নিশ্চয়ই চিত্রগুপ্তের খাতায় লেখাও হচ্ছে, কিন্তু প্রেতাত্মা নিয়ে ছেলেখেলা চলে না! এমনিতে তেনারা কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না, কিন্তু অকারণে উত্যক্ত করলে ক্ষেপে উঠে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দিতে পারেন। বিশে নিজের অজান্তেই সাপের ল্যাজে পা দিচ্ছে, বাঁচতে চাস তো ও ধার মাড়াসনে!”
মিত্তিরদের ছেলেটার কথা ভাবতেই চোখে জল এল বগলা তান্ত্রিকের। ভুতুম নামটা যেমন মিষ্টি, ছেলেটাও তেমনই মিষ্টি স্বভাবের। সংসারের প্রায় সব আসক্তিই বগলাচরণ একে একে জয় করেছেন, কেবল আমসত্ত্বের ওপর তাঁর অনুরাগ এখনও পুরোপুরি যায়নি। ভুতুম মাঝেমধ্যেই ঠাকুমার ভাঁড়ার ঘর থেকে আমসত্ত্ব চুরি করে তাঁকে এনে দেয়।
নাহ্! বগলাচরণের দেহে প্রাণ থাকতে এমন সোনার টুকরো ছেলের কোনও অনিষ্ট তিনি হতে দেবেন না!
সেদিনের মতো ইস্কুলের পাট শেষ। ছাত্র-শিক্ষক সকলেই যখন বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছেন, তখন হঠাৎই ভগ্নদূতের মতো এসে হাজির হলেন বগলা তান্ত্রিক। তাঁর মুখে ভুতুমের আশু বিপদের কথা শুনে ডমরুধর হাইস্কুলের তিন মাস্টারমশায়ের প্রতিক্রিয়া হল তিনরকম। হেডস্যার গোপালবাবু চিৎকার করে ‘হা কৃষ্ণ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে সামনের টেবিলে এমন একখানা ঘুঁষি মারলেন যে, পুরোনো আমলের উইধরা টেবিলটা মড়মড় শব্দে আর্তনাদ করে উঠল। অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টার ভবতারণবাবু কপাল চাপড়ে, “হে মা কালী, এই ছিল তোর মনে!” বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন, আর গেমটিচার বংশীধর বর্মন “বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ ঘোর দুর্যোগের ঘনঘটা...” আবৃত্তি করতে করতে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন ঘরময়।
শেষটায় বগলাচরণ যখন বললেন, “মাস্টারমশাইরা অপরাধ নেবেন না, আমি মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ, কিন্তু আমার মনে হয়, হাহুতাশ না করে, সময় থাকতে আমরা একটু উদ্যোগ নিলে হয়তো ছেলেটাকে প্রাণে বাঁচানো যেত।”
এই পরামর্শেও তিনজন শিক্ষক আলাদা আলাদা ভাবে সাড়া দিলেন। ভবতারণবাবুর দুর্বল কণ্ঠে “তাহলে কি মানবাধিকার কমিশন...” ভেসে গেল গোপালবাবুর “খবরদার না, আগে পুলিশ” গর্জনের সামনে। বংশীধরবাবু ফের একবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বগলাচরণের মিনতিপূর্ণ চোখের দিকে তাকাতেই দ্রুত তাঁর সম্বিৎ ফিরে এল।
অবশ্য তাতেও বিশেষ লাভ হল না! থানায় ফোন করে জানা গেল, মধ্যাহ্নভোজনে হাঁসের ডিমের ডালনা খেয়ে দারোগাবাবুর পেট আইঢাই করছে, এই অসময়ে কোথাও দৌড়োদৌড়ি করতে পারবেন না। ইস্কুলের তরফ থেকে অভিযোগ দায়ের করা হলে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে, কিন্তু কাল সকালের আগে কোনও অ্যাকশন নেওয়া সম্ভব নয়। হতাশ গোপালবাবু আবার টেবিলে ঘুঁষি মারতে যাচ্ছিলেন, পাশ থেকে ভবতারণবাবু আক্ষেপের স্বরে জানালেন, মানবাধিকার কমিশনের ফোন ডেড, শত চেষ্টাতেও লাইন পাওয়া যাচ্ছে না!
“স্যারেরা দয়া করে রাগ করবেন না--- আমার জ্ঞানগম্যি বিশেষ নেই, কিন্তু তাও বলি,” মাস্টারমশাইদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়তে দেখে বলে উঠলেন বগলাচরণ, “পরনির্ভরতায় কোনও ফল হবার নয়। তার চেয়ে বরং আমরা নিজেরাই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই, চারজনের বুদ্ধি যোগ করলে একটা না একটা রাস্তা ঠিকই বেরিয়ে আসবে।”
অগত্যা সদলবলে মিত্তিরদের বাড়ি চড়াও হওয়াটাই সাব্যস্ত হল। কিন্তু খালি হাতে রণাঙ্গনে যাওয়াটা সৈনিকের পক্ষে ঠিক শোভনীয় নয়- বগলাচরণের ত্রিশূলখানা তাঁর সঙ্গেই ছিল, অবশিষ্ট তিনজনের মধ্যে বংশীবাবু নিলেন ক্রিকেটের একটা উইকেট আর দলপতি গোপালবাবু নিলেন ইস্কুলের ঘন্টা বাজানোর হাতুড়িটা। কেবল মাতৃসাধক ভবতারণবাবুই অস্ত্র ছুঁতে আপত্তি করলেন, ওতে নাকি পাশবিক প্রবৃত্তি জাগ্রত হয়! “আরে বাবা, স্বয়ং মা কালী তাঁর খাঁড়াটি হাতে করে নাচতে নাচতে আমার সঙ্গে চলেছেন, আমার আবার অস্তরের কী প্রয়োজন?”
মিত্তিরবাড়ির মস্ত উঠোনে কাঠের তক্তা সাজিয়ে যাত্রার স্টেজের মতো অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি হয়েছে--- সেই তক্তার ওপর বাঘছালের আসনে বসে বিশ্বেশ্বর সিদ্ধাই তখন তাঁর প্রেত বিতাড়ণ যজ্ঞের প্রাথমিক তোড়জোড় করছিলেন। মাথায় জটাজুট, সর্বাঙ্গে ছাইয়ের প্রলেপ--- ঝিমিঝিমি সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে বিশ্বেশ্বরের রক্তবর্ণ চোখদুটো যেন হিংস্র জন্তুর মতো ধকধক করে জ্বলছে। “ওঁ হ্রীং ক্রীং... জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং... ওঁ খর্বং স্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং... পিনাকহস্তায় বজ্রহস্তায় বৈ নমঃ... শঙ্খং গদাং পঙ্কজং চক্রং... ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা...”--- মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞাগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে খাঁটি গব্যঘৃত, আর সেই ঘিয়ের উসকানিতে আগুনের লকলকে তলোয়ার যেন ঝুঁঝকো আঁধারের পেট চিড়ে ফালাফালা করে ফেলছে।
কাঠের বেদি থেকে হাত কয়েক তফাতে বসে সিদ্ধাইয়ের কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করছিল ভুতুম। বিশ্বেশ্বরের দুই ষণ্ডা চেহারার চ্যালা হুমদো আর মামদো দু’দিক থেকে তাকে ঘিরে রেখেছে, তার দুটো হাত সেই দানবদের থাবার মধ্যে বন্দী। ভুতুমের অবস্থা অনেকটা পাটিসাপটার ভেতরে সন্দেশের পুরের মতো--- হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে যে টেনে দৌড় দেবে, তারও জো নেই! অবশ্য ভুতুমের মুখ দেখে মনে হয় না তার চম্পট দেবার বিশেষ ইচ্ছে আছে, এমনকি এই ঘোর বিপদেও তার সদা চঞ্চল চোখদুটোতে ভয়ের কোনও চিহ্নই নেই, বরং তার সন্ধানী দৃষ্টি যেন সর্বদাই কাউকে খুঁজে চলেছে।
বাড়ির প্রায় প্রতিটি সদস্যই এইমুহূর্তে উঠোন বা তার আশেপাশে উপস্থিত। ভুতুমের বাবা বলদর্পীবাবু তার ঠিক পেছনেই তুলসীমঞ্চের পাশটায় চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে আছেন। পান্তি ঝির কৌতূহলী মুণ্ডুটা একেকবার ঘরের ভেতর থেকে উঁকি মেরেই আবার সুট করে মিলিয়ে যাচ্ছে। জ্যাঠামশাইকেও দেখতে পাচ্ছে ভুতুম--- বিশ্বেশ্বরবাবার পেছনে ঘাপটি মেরে বসে সমানে রামনাম জপ করে চলেছেন। ঠাকুমা বাইরে না এলেও তাঁর খ্যানখ্যানে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে দোতলা থেকে, বিশ্বেশ্বর সিদ্ধাইয়ের মন্ত্রোচ্চারণকে তিনি নির্বাচনী প্রচারের বক্তৃতা ঠাউরে বসেছেন--- “এই তো সেদিন ভোট দিয়ে এলাম! এখনও আঙুলের কালি শুকোতে পেল না, এর মধ্যেই আবার ভোটাভুটি কেন রে বাপু?”
একমাত্র ভুতুমের ছোটবোন ভেবলিই আজকের আসরে অনুপস্থিত--- পাছে সে কান্নাকাটি করে সব পণ্ড করে, সেই ভয়ে আগেভাগেই তাকে মামারবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ছিঁচকাঁদুনে বোনটা নয়, ভুতুমের সার্চলাইটের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টির লক্ষ্য এইমুহূর্তে অন্য কেউ।
খুব বেশি তল্লাশির অবশ্য প্রয়োজন হল না, যাকে দেখার জন্য ভুতুম এতক্ষণ ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল, সে এইবার তার বাঁ কানের লতিতে কুটুস করে একটা চিমটি দিয়ে বুঝিয়ে দিলে, বান্দা হাজির হ্যায়!
বাপরে, যেন কাঠপিঁপড়ের কামড়! ভুতুম ব্যথার চোটে ‘চ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁ’ করে চ্যাঁচাতে গিয়েও সামলে নিলে, বেশি ছটফট করলে রাক্ষসদুটোর সন্দেহ হবে! বদলে ফিসফিস করে বলল, “এতক্ষণে বাবুর আসার সময় হল! এদিকে দুশ্চিন্তায় আমার ধাত ছেড়ে যাবার জোগাড়!”
“হেহঃ হেহঃ! কেমন ভড়কি দিলুম?” ঝিঁঝিঁভূত নিজের কৃতিত্বে নিজেই হেসে কুটিপাটি, “কিন্তু জোচ্চোরটার আক্কেল দেখেছ? ওই জগাখিচুড়ি মন্তর আবার কোন দেওতার?”
তা, ভূতের অমন মন্তব্য করার কারণ আছে বইকি! তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে একধার থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিশ্বেশ্বর ঠাকুর ততক্ষণে অন্য লাইন ধরেছেন--- “ওঁ হ্রীং ক্রীং পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধং দেহি, বিশালাক্ষী, কমললোচনে বুফো মেলানোস্টিক্টাসৈঃ নমঃ... ওঁ গঙ্গা নদীর উৎস গোমুখে প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ায়ৈঃ নমঃ...”
“ঠগ! বাটপাড়! জালিয়াত! হোঁদলকুতকুত!”--- ঝিঁঝিঁভূত যে দাড়ির ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আরও কত গালাগালি দিলে, তার ইয়ত্তা নেই! তারপর বললে, “তুমি চুপটি করে বোসো, ব্যাটাচ্ছেলে বিশের মাথাটা ফাটিয়ে ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়ে না দিয়েছি তো...”
“উঁ... ঝিঁঝিঁভূত! আমি ভাবছিলাম...”
“ভাবছিলে! বলি, এই কি তোমার ভাবাভাবির সময়? এদিকে মর্কটগুলোকে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর জন্য আমার হাত সুড়সুড় করছে, আর বাবু গ্যাঁটসে বসে ভাবনাচিন্তা জুড়েছেন!”
“আহা, গা গরম করার সুযোগ তো পরেও পাওয়া যাবে!” ভুতুম তার বিদেহী বন্ধুকে আশ্বস্ত করল, “কিন্তু তার আগে একটু... বুঝেছ?”
ভুতুমের কথায় কীসের ইঙ্গিত ছিল কে জানে--- খানিকক্ষণ কুতকুতে চোখে তার দিকে চেয়ে থেকেই, ঝিঁঝিঁভূতের মুখখানা আবার সেই দুষ্টু হাসিতে ভরে উঠল। তারপর ভুতুমের উদ্দেশে একটিবার আলতো করে চোখ টিপে বললে, “বুঝেছি।”
প্রাথমিক ক্রিয়াকলাপ শেষ করেই বিশ্বেশ্বরবাবা হুকুম দিলেন, “বাচ্চেকো বাঁধকে লে আও।” বাবার মুখে আচমকা হিন্দি বোল শুনে জ্যাঠামশাই আঁতকে উঠেছিলেন, বিশ্বেশ্বর তাঁর দিকে ফিরে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “ভয় পাবেন না, মিত্তিরমশাই! এককালে দুর্গম সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে সাধন-ভজন করতাম কিনা! যেমন ধরুন, একবেলা যদি এভারেস্টের চুড়োয় কাটে, তো অন্যবেলা অবধারিত অতলান্তিকের অতলে; আজ আমাজনের জঙ্গলে রাত্রিযাপন করলাম, কাল সকালেই হয়তো ছুটতে হল ধু ধু মরুভূমির দেশ কালাহারিতে--- ওসব জায়গায় আবার বাংলাটা তেমন চলে না, ভাবের আদানপ্রদান হতো মূলত হিন্দির মাধ্যমেই। সেই থেকেই এমন অভ্যেস হয়ে গেল... তারপর একদিন যখন আমার কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হলেন, দেখি তিনিও আমার সঙ্গে ওই রাষ্ট্রভাষাতেই শলাপরামর্শ করছেন।” জ্যাঠামশাই কী বুঝলেন কে জানে, বাবার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে ঢিপ ঢিপ করে গণ্ডাকতক পেন্নাম ঠুকে ফেললেন।
যেমন কথা, তেমনি কাজ--- হুমদো আর মামদো ওমনি গোয়াল থেকে সবচেয়ে মোটা দড়িখানা এনে ভুতুমকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে লেগে গেল। কিন্তু যতবারই বাঁধতে যায়, ততবারই সেই বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেরো গলে ভুতুম কেমন করে যেন বেরিয়ে পড়ে! বার দশেক পণ্ডশ্রমের পর দুই ষণ্ডাই হাল ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে শুরু করল, কিন্তু ভুতুম দড়ির বাঁধনে ধরা পড়তে নারাজ।
চ্যালাদের হয়রানি দেখে বোধহয় বিশ্বেশ্বর ঠাকুরেরও টনক নড়ল, তিনি খুব গম্ভীরভাবে মাথা দুলিয়ে বললেন, “হুম... লগ রহা হ্যায় বহুত তাগড়া পিরেত হ্যায়! ওরে, দড়িদড়া রেখে তোরা বরং ছোঁড়াটাকে চ্যাংদোলা করে তুলে আন!”
কিন্তু কে কাকে তোলে? হুমদো-মামদো যেই না ভুতুমকে কষে ধরতে যাবে, একজোড়া অদৃশ্য হাত যেন তাদের মাথাদুটো পরস্পরের সঙ্গে ঠুকে দিল। ঠাঁই ঠকাস! ভুতুম রইল পড়ে, দুই রাক্ষুসে স্যাঙাত তখন কপালের সদ্য গজিয়ে ওঠা ঢিবিদুটোয় হাত বোলায় আর “বাপরে! মা রে! গেছি রে!” বলে তিড়িং বিড়িং নাচে।
শেষমেশ ভুতুম নিজেই গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গিয়ে বসল বিশ্বেশ্বরবাবার সামনে। অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি হেনে ভুতুমকে প্রায় ভস্মীভূত করে দিয়ে বাবা আদেশ করলেন, “বিলকুল চালাকি নেহি, চুপচাপ যজ্ঞের আগুনে হাত রাখ।”
ভুতুমকে দেখলে মনে হবে, তার মতো সুবোধ বালক বুঝি সংসারে দুটি হয় না--- সে বিনা বাক্যব্যয়ে আগুনে হাত ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! হাত পুড়ে যাওয়া তো দূরস্থান, ভুতুমের হাতের স্পর্শ পাওয়ামাত্র ফুসমন্তরের মতো আগুন নিভে গেল!
“বটে!” রাগে বিশ্বেশ্বরের মুখটা বিকৃত হয়ে গেলেও একটা ধূর্ত হাসির আড়ালে সেটাকে সামলে নিলেন, “ভেবেছিস ভেলকি দেখিয়ে আমায় ঘাবড়ে দিবি! আচ্ছা, মেরা নাম ভি বিশ্বেশ্বর সিদ্ধাই! ব্যাটাচ্ছেলে জিন, তুম মিলিটারি তো হম ভি মিলিটারি! দেখি, আমার মিরচাই মার কেমন সইতে পারিস! এই নে-” বলেই একখাবলা লঙ্কাগুঁড়ো ছুঁড়ে মারলেন ভুতুমের মুখে।
রাজস্থানি লাল লঙ্কার গুঁড়ো, তার এককণাও চোখে ঢুকলে ভুতুমের অন্ধ হয়ে যাবার কথা, কিন্তু আবার আরেকদফা বিস্ময়! হঠাৎ দমকা হাওয়ায় লঙ্কার গুঁড়োর গতিপথ পাল্টে গিয়ে কতক পড়ল সিদ্ধাইয়ের চোখে, কতক ঢুকল জ্যাঠামশায়ের নাকে। এমনকি নিরাপদ দূরত্বে থাকা বলদর্পীবাবু বা বিশ্বেশ্বরের দুই চ্যালাও রেহাই পেলেন না। তারপর পাক্কা দশ মিনিট ধরে উঠোনজুড়ে কেবল হাঁচি, কাশি আর ক্রমাগত চোখ রগড়াতে রগড়াতে ‘বাবা গো! গেলুম গো!’ ‘ওরে দাদা রে, প্রাণটা গেল রে!’ ইত্যাদি আর্তনাদের মিছিল লেগে গেল। আর সেই লঙ্কাকাণ্ডের মধ্যে স্থির, অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একলা ভুতুম।
কিন্তু বিশ্বেশ্বরও এককালের দাগী আসামী, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চটজলদি সামলে ওঠার ক্ষমতা তাঁর সহজাত। টকটকে লাল চোখজোড়া থেকে তখনও অবিশ্রান্ত ধারায় জল ঝড়ছে, সেই অবস্থাতেই আচমকা ভুতুমের চুলের মুঠি চেপে ধরে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “এইবার? বড় বাড় বেড়েছিলি, তাই না? দেখ তবে, মুড়ো ঝ্যাঁটার বাড়ি গায়ে পড়লে কেমন লাগে!”
এই প্রথম ভুতুমের পা দু’টো একটু কেঁপে উঠল। সে প্রাণপণে গা ঝাড়া দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলে, কিন্তু সিদ্ধাইয়ের মুঠোর জোর কামঠের কামড়ের মতো! এতক্ষণ ধরে চোর-পুলিশ খেলার পর অবশেষে শিকারকে বাগে পাওয়া গেছে--- বিশ্বেশ্বরের মুখে ফের সেই ক্রূর হাসির ঝিলিক, ঝাঁটাসমেত হাতটা ধীরে ধীরে উঠে আসছে কাঁধের ওপর--- ভুতুম আর পারল না, চোখ বুজে ফেলল ভয়ে।
সপাং! সপাং! সপাং!
কেমন হল? একের পর এক ঝাঁটার বাড়ি আছড়ে পড়ার শব্দ হচ্ছে, কিন্তু ভুতুমের একটুও ব্যথা লাগছে না কেন? উঁহু, নিশ্চয়ই লাগছে! নইলে খামোখা ওরকম ‘বাবা গো’ ‘মা গো’ বলে চেঁচাতে যাবে কোন দুঃখে? কিন্তু... কিন্তু... তার গম্ভীর, অথচ সুরেলা গলার স্বরটা হঠাৎ অমন বকরাক্ষসের মতো হেঁড়ে হয়ে গেল কী করে?
চোখ খুলতেই যে দৃশ্যটা তার চোখে পড়ল, তাতে চোখজোড়া কপালে ওঠার জোগাড়! ঝাঁটার মার এলোপাথাড়ি পড়ছে ঠিকই, কিন্তু পড়ছে বিশে সিদ্ধাই আর তাঁর দুই শাকরেদের পিঠে। মার এড়াতে তাঁরা দু’হাতে মাথা ঢেকে উঠোনময় দৌড়োদৌড়ি করছেন, তিনজনের মিলিত কণ্ঠের “মিত্তিরমশাই গো! মেরে ফেললে গো!” প্রভৃতি আর্ত চিৎকারে কান পাতা দায়। কিন্তু ঝাঁটাঘাতের হাত থেকে কারও নিস্তার নেই! মারের চোটে হুমদো ফুটবলের মতো গড়াতে গড়াতে সদর দরজার বাইরে বেরিয়ে গেল, মামদো কোনওমতে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালালে, কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন পালের গোদা বিশ্বেশ্বর। শূন্য থেকে একটা হাত এসে তাঁর টিকিটা চেপে ধরলে, আর তারপরেই শুরু হল বেধড়ক মারের সঙ্গে অবিশ্রাম গালিবর্ষণ:
“তবে রে, বিটলে বদমাইশ! কচি ছেলেটার গায়ে ঝাঁটা তোলা হচ্ছে? ব্যাটা বেয়াক্কেলে বোম্বেটে, পাজির পাঝাড়া! ভুতুমের ভূত ছাড়াতে এসেছ তুমি? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!”
এই হুলুস্থূলের মধ্যেই আবার দোতলার ঘর থেকে ঠাকুমার গলা পাওয়া গেল, “এই অসময়ে আবার মহালয়া কেন রে? এ যে অকালে অকালবোধন! কালে কালে কত কীই যে দেখব!”
ওদিকে মার ঠেকাতে বিশ্বেশ্বর যদি মাথা আগলান, ঝাঁটা এসে পড়ে তাঁর পিঠে। হাত দিয়ে পিঠ আড়াল করতে গেলে মার খেতে হয় পেটে--- ঠ্যাঙানির চোটে পিশাচসিদ্ধ সাধকের মুখ দিয়ে তখন গ্যাঁজলা গড়াচ্ছে, কিন্তু গালমন্দ আর বন্ধ হয় না:
“ওরে উড়নচণ্ডী উগ্রপন্থী! ওরে গাম্বাট গোভূত! প্রেতসিদ্ধ সাধু--- অ্যাঁ! শিবের অবতার! চালাকি হচ্ছে আমার সঙ্গে? হতচ্ছাড়া মিটমিটে ভাম, আজ পিটিয়ে তোমাকে পাটিসাপটা না করেছি তো...”
ভুতুমের ভয় হচ্ছিল, অশরীরীর হাতে এরকম কম্বলধোলাই খেয়ে বেচারি বিশ্বেশ্বর অক্কা না পান, হঠাৎ কোথা থেকে একটা লোক ছুটে এসে তাঁকে আড়াল করে দাঁড়াল। অন্ধকারের দরুন প্রথমটায় ঠিক ঠাহর করতে পারেনি, কিন্তু লোকটা যখন হাতজোড় করে বলল, “দোহাই বাবা ভুতুম, তোমার সূক্ষ্মদেহধারী বন্ধুটিকে একটু শান্ত হতে বলো। বিশেটা ঘোর পাপী, কিন্তু ওর মতো একটা ছুঁচোকে মেরে উনি কেন হাত ময়লা করবেন?” তখন আর সন্দেহ রইল না--- আরে, এ তো তান্ত্রিক বগলাচরণ!
মিত্তিরদের উঠোনে যখন এই বিশ্বেশ্বরবধ পালা চলছে, তখন সবার অলক্ষ্যে সদর দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন চারমূর্তি। ভেতরের হালচাল দেখে অনেকক্ষণ কারও মুখেই কথা সরেনি, তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে হেডস্যার গোপালবাবুই প্রথম মন্তব্য করেছিলেন--- “ম্যাজিক হচ্ছে, অদ্ভুত ইন্দ্রজাল! পি সি সরকার, হুডিনি, ব্ল্যাকস্টোন...” বলা বাহুল্য, ভবতারণবাবু তাঁর বন্ধুর সঙ্গে একমত হতে পারেননি, তাঁর মতে সবই মহামায়ার মায়া! “প্রেতলোক আর জীবলোকের মধ্যে বাস সার্ভিস চালু হয়ে গেছে হে, তেনারা ঘরে ফেরার আনন্দে একটু মোচ্ছব করছেন।” আর গেমটিচার বংশীধরবাবু যেন পুরো ব্যাপারটা সঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি, কেবলই মাথা নাড়েন আর বলেন, “এ কী অভূতপূর্ব শোভা, এ কী অভাবনীয় লাবণ্য... কী হেরিলাম এ কি সত্য, কী শুনিলাম এ কি মিথ্যা!”
“ভুতুম, দয়া করো বাবা!” বগলাচরণ পুনরায় মিনতি করলেন, “বিশে হতভাগাটা আমার আপন মাসতুতো ভাই; আমি কথা দিচ্ছি, ও আর কক্ষণও এমন গোখ্খুরির কাজ করবে না। এমনকি ফের যদি তোমার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে চেষ্টা করে, আমি নিজে ওর ঠ্যাঙ ভেঙে দেব--- কিন্তু এইবারটার মতো অপোগণ্ডটাকে মাফ করে দাও!”
বগলাজেঠুকে অনেকে চিটিংবাজ বলে বটে, কিন্তু ভুতুমের সঙ্গে তাঁর বেজায় খাতির। জেঠুকে এমন কাতরভাবে অনুরোধ করতে দেখে তার চোখে জল এল, জড়ানো গলায় ডাক দিল বন্ধুর উদ্দেশে:
“ঝিঁঝিঁভূত, জেঠু যখন বলছেন... এবারের মতো নাহয় ছেড়েই দাও।”
“দিতে পারি, কিন্তু একটা শর্তে! এই দণ্ডে অলম্বুষটাকে কান ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।”
আর বলতে হল না, বিশ্বেশ্বর তৎক্ষণাৎ দু’হাতে নিজের কান পাকড়ে উঠোনজুড়ে নাকখত দিতে শুরু করল।
“আর আপনাকেও বলিহারি, বলদবাবু!” ঝিঁঝিঁভূতের রাগ এইবার গিয়ে পড়ল ভুতুমের বাবার ওপর, “মা-মরা ছেলেটার খাওয়াদাওয়ার দিকে কেউ ঠিকঠাক লক্ষ্য রাখে না, শরীরে আয়রনের অভাবে বেচারি অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। আপনি কোথায় তার চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করবেন, তা নয়, কতগুলো অন্ধ কুসংস্কারের বশে নিজের ছেলেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছিলেন... ওয়েল, এদেশে এখনও আমাদের শাসন চললে আপনাকে আমি জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়তাম!”
“ভুল হয়ে গেছে স্যার, মস্ত বড় ভুল!” ভূতুড়ে ধমকের মুখে কাঁদোকাঁদো হয়ে পড়েন ভুতুমের বাবা, “কিন্তু আর কক্ষণও এমন হবে না, কথা দিচ্ছি।”
“কিন্তু শুধু কথায় তো চিঁড়ে ভিজবে না, বলদবাবু।” ভূতের মুখে আবার মিচকে হাসি, “একটা শাস্তি আপনার পাওনা। ওহে ভুতুম, তোমার মাস্টারমশাইরাও এসে হাজির হয়েছেন দেখছি! বেশ বেশ! শুনুন স্যারেরা, এবার থেকে রোজ ইস্কুল ছুটির পর ভুতুম আমার কাছে ক্রিকেটের কোচিং নেবে। এখনও ড্রাইভ মারার সময় ওর শরীর বলের লাইনে যাচ্ছে না, ডেলিভারির ফলো থ্রুতে পায়ের ব্যালান্স বিগড়ে যাচ্ছে। তাছাড়াও কিছু খুচরো মেরামতির দরকার, তাই আর দেরি না করে কাল থেকেই শুরু করতে চাই। গোপালবাবু এবং ভবতারণবাবুর কাছে অনুরোধ, স্কুলের মাঠটা সাফসুতরো করিয়ে রেডি রাখবেন। আর আপনার নাম তো বংশীধর?”
বংশীধর বর্মন বোধহয় এমন ভৌতিক সম্ভাষণের জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না। আমতা আমতা করে বললেন, “আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস...”
“আর আমি কে বলুন তো? কুইন ভিক্টোরিয়া!” ঝিঁঝিঁভূত তার চোখদুটো সরু করে, নাক-মুখ কুঁচকে একটা ভীষণ ভেঙচি কাটলে, “তা বেদুইনবাবু, আপনাকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে।”
“বলুন।”
“নিজে পছন্দ করে ইস্কুলের জন্য কয়েক সেট ক্রিকেটের সরঞ্জাম কিনে আনবেন। বেস্ট কোয়ালিটি হওয়া চাই কিন্তু! খরচের কথা ভেবে আপোষ করবেন না--- খরচাপাতি যা লাগে, সব এই বলদবাবুই দেবেন।”
“যথা আজ্ঞা!”
ফেরার পথে তিন শিক্ষকই অনেকক্ষণ গুম মেরে ছিলেন। চোখের সামনে এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ঘটতে দেখলে বাক্যস্ফূর্তি না হওয়াই স্বাভাবিক, তার ওপর তিনজনের ঘাড়েই এখন গুরু দায়িত্ব! শেষটায় নীরবতা ভেঙে ভবতারণ ভটচাজই প্রথম কথা বললেন, “মাঠ পরিষ্কারের জন্য জনা দশেক লোক লাগিয়ে দিলেই চলবে, কী বলো? মা তারার আশীর্বাদে তাতেই কাজ হয়ে যাওয়া উচিত।”
“উঁহু! অন্তত বিশ জনের কমে হবে না।” মাথা নেড়ে দ্বিমত প্রকাশ করলেন গোপাল গোঁসাই, “কাল ভোরের আলো ফুটলেই লোক খুঁজতে বেরিয়ে পড়ব। তারপর… সকলই শ্রীহরির ইচ্ছা! কী হে বংশী, তুমি কিছু বলছ না যে!”
বংশীধরবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, “স্যার, আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।”
“কী অনুরোধ হে?”
“কাল যখন ওই ‘উনি’ ভুতুমকে কোচিং দেবেন, আমি মাঠে উপস্থিত থেকে একটিবার চাক্ষুষ করতে চাই। আমার অনুরোধ, আপনারাও আমার সঙ্গে থাকুন।”
“কেন বাপু, একা যেতে বুঝি সাহসে কুলোচ্ছে না?”
“না, ঠিক তা নয়।” বংশীবাবু যেন পরের কথাগুলো মনে মনে একটু গুছিয়ে নিলেন, “দেখুন স্যার, ক্রিকেট খেলার ইতিহাস সম্পর্কে আমার অল্পবিস্তর পড়াশোনা আছে। ক্রিকেটের ব্যাকরণ সম্পর্কে ওঁর যা জ্ঞান দেখলাম, উনি যে খুব বড় খেলোয়াড় ছিলেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাছাড়া, ওরকম অতিকায় চেহারা, জঙ্গুলে দাড়ি-গোঁফ; আবার চিকিৎসাশাস্ত্রে মজবুত দখল... নাহ্! আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, ভুতুমের ঝিঁঝিঁভূতের আসল পরিচয় আমি জানি।”
“ব্যাপার কী বলো তো? কিছু আন্দাজ করেছ নাকি?”
“করেছি। কিন্তু এখনই বলতে চাই না, বলব কাল, ভুতুমের প্র্যাকটিস দেখার পর।”
পরেরদিন বিকেলের কথা। ঘড়ির কাঁটায় প্রায় পৌনে ছটা, অর্থাৎ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দিনের আলো মুছে গিয়ে সন্ধ্যার আকাশে তারা ফুটে উঠবে। ইতিমধ্যেই পাটে বসতে চলা সূয্যিঠাকুরের নাক বরাবর গুড়ের পাটালির মতো গোল একটা চাঁদ দেখা দিয়েছে, সেই ফুরিয়ে আসা আলোয় ভুতুমের বিচিত্র ক্রিকেটশিক্ষার সাক্ষী থাকতে হাজির হয়েছিলেন ডমরুধর হাইস্কুলের তিন মাস্টারমশাই--- ভক্ত বৈষ্ণব গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী, শক্তিপূজক ভবতারণ ভটচাজ এবং গেমটিচার বংশীধর বর্মন।
ছোটখাটো জলহস্তীর মতো প্রকাণ্ড একটা শরীর, অথচ রক্তমাংসের বদলে যেন আপাদমস্তক ছায়া দিয়ে গড়া। পরণে দুধসাদা ক্রিকেটের পোশাক, মাথায় হলদে-লাল ডোরাকাটা টুপি। দাড়িগোঁফের আড়ালে দুষ্টুমিমাখা হাসি নিয়ে সেই ছায়ামানুষ স্টান্স নিয়েছে।
বল হাতে দৌড়ে এল ভুতুম। সবে ডেলিভারি ছাড়তে যাবে, অকস্মাৎ সেই বিদেহী ব্যাটসম্যান গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠলে- “অ্যায়ো, খবরদার!”
চমকে উঠেছিল ভুতুম, আর হঠাৎ ঘাবড়ে যাওয়ায় বলটাও হয়ে গেল লোভনীয় হাফভলি--- ছায়ামানুষ মহানন্দে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে, বলটা পাঁচিল ডিঙিয়ে গিয়ে পড়ল মাঠের একেবারে বাইরে।
“হেহঃ হেহঃ হেহঃ!”
নিখুঁত শটটা দেখে অভিভূত গোপালবাবু বললেন--- “ব্র্যাডম্যান, নির্ঘাত ব্র্যাডম্যান।”
“না না, ইনি স্বয়ং মহারাজা রণজিৎ সিংজি।”--- ভবতারণবাবু কপালে হাত ছোঁয়ালেন।
বংশীধরবাবুর হাতে একটা ছেঁড়াখোঁড়া, পোকায় কাটা ক্রিকেটের ম্যাগাজিন। অনেকক্ষণ ধরে সেটার পাতায় চোখ রেখে কীসব খুঁজছিলেন, এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আপনারা বরং এই ছবিগুলো একবার দেখুন। এটা উইজডেন পত্রিকার একটা বিশেষ সংখ্যা, পুরোনো ট্রাঙ্ক ঘেঁটে অনেক কষ্টে খুঁজে পেলাম। দেখুন তো, চিনতে পারেন কিনা?”
দুই বন্ধু তৎক্ষণাৎ বংশীস্যারের হাতের বইটার ওপর ঝুঁকে পড়লেন। পাতাজুড়ে তখন পরপর অনেকগুলো ছবি। কোনোটায় গোলগাল, দাড়িওয়ালা এক ব্যাটসম্যান বোলার ঠ্যাঙাচ্ছেন, কোনোটায় আবার তিনিই পাখির মতো হাত ছড়িয়ে ছুটে আসছেন বল করতে। কিন্তু প্রত্যেকটা ছবিই যে আদতে ভুতুমের ঝিঁঝিঁভূতের, তা এই আবছা আলোতেও বুঝতে অসুবিধা হয় না।
একেবারে শেষ ছবিটায় পৌঁছে দু’জনেই খানিকক্ষণ থমকে রইলেন। তারপর মুখ তুলে, সম্ভবত এই প্রথমবার ঐকমত্যে পৌঁছে বললেন--- “হুম।”
উইজডেন পত্রিকার সেই ছবিটা ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মাঠ লর্ডসের একটা তোরণের, যার ওপরে ইংরিজিতে খোদাই করা---
“To the memory of
WILLIAM GILBERT GRACE
THE GREAT CRICKETER.”