বাঁশ - দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়

হাসির গল্প

অলংকরণ - পিয়াল চক্রবর্তী

-মশাই, ও মশাই, শুনছেন?

-উঁ?

-আরে মোলো যা! আরে ওওও দাদা, বলছি আপনি কি ডেডবডি নাকি?

-আরে কী জ্বালাতন! খামখা ডেডবডি হতে যাব কেন?

-না মানে, যেভাবে কেতরে পড়ে আছেন, এদেশের অর্থনীতি আর শ্মশান বাদে তেমন খুব একটা দেখা যায় না কিনা! তাই ভাবলাম...

-তা এই ঘুটঘুটে মাঝরাতে মানুষ আর কী করতে পারে বলে মনে হয়? আপনার বাবা কি প্যাঁচা ছিলেন নাকি?

-আহাহা চটেন কেন? আসলে একটা বিপদে পড়েই আপনাকে এই অবেলায় ডাকা। নাহলে কি আর...

-সে তো বুঝতেই পেরেছি। বিপদে না পড়লে এই অধমকে আর কেই বা মনে করে। একটা সিগারেট দেখি।

-সেটা আবার কী?

-আপনি কে মশাই? বোম্বাগড়ের রাজা নাকি বিশ্বনাথের গাঁজা? সিগারেট চেনেন না, ওই রকম হাঁড়ির মত মাথা, তাতে আবার দুখানা টিকি, পিপের মত শরীর! জন্মের পর পোলিওর বদলে গোমূত্র খেয়েছিলেন নাকি? কেমনধারা মানুষ আপনি?

-এহ, এভাবে আবার লজ্জা দিচ্ছেন কেন দাদা! আসলে আমাদের পাড়াতে সবাই এরকমই দেখতে কিনা।

-আপনি কোথাকার মাল বলুন তো? চন্দননগরের নাকি? শুনেছি সেখানে নাকি শেষ যে উন্নয়নের সুনামিটা এসেছিল তার সাথে ভেসে ভেসে অনেক নতুন লোকের আমদানি হয়েছে।

-আপনি কিন্তু ভীষণ বুদ্ধিমান দাদা। প্রায় ধরেই ফেলেছেন...তবে কিনা, আরেকটু দূরে গেলে আমার বাড়িটা ঠিকঠাক পাওয়া যেত আরকী!

-দাঁড়ান দাঁড়ান! আপনাকে কেমন যেন.... আচ্ছা, আপনি সেই লাখ দশেকের জামা পরে সবসময় বিদেশে ঘুরে বেড়ান না? ছোটবেলায় চায়ের ব্যবসা ছিল?

-উফফ, মোক্ষম ধরেছেন দাদা। সাধে কি বলে,ওই বুদ্ধি যস্য না কি যেন! তবে কিনা, আরেকটু এগোতে পারলে বড় ভালো হতো।

-আপনার তো প্রচুর দাবি মশাই! ঝেড়ে কাশুন তো! কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন? উগান্ডা না উলুবেড়িয়া?

-এই তো ভারী লজ্জায় ফেলে দিলেন দাদা! আসলে আমি যেখান থেকে এসেছি সেটা পৃথিবীর একটু বাইরে আরকী!

-খেয়েছে! আপনার তাহলে গান্ধী বাড়ির বৌয়ের মতো কেস। ইমপোর্টেড।

-আপনি নমস্য ব্যাক্তি মশাই। ফেরার সময় এক প্যাকেট পায়ের ধুলো নিয়ে যাব কিন্তু।

-সে না হয় হল। কিন্তু আপনার নামটাই তো এখনও জানালেন না!

-আজ্ঞে, আমি ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং!

-কার ঠ্যাং? কীসের ঠ্যাং?

-আজ্ঞে ঠ্যাং নয়, ওটা অ্যাং। স্ট্রেট আউট অফ পঞ্চা ঘোষের বাঁশ বাগান।

-অ। তা এই পোড়া দেশে হঠাৎ আমদানি হলেন কেন?

-সে দুঃখের কথা আর জিজ্ঞেস করবেন না দাদা। একদিন সকালে উঠে চাড্ডি মুড়ি দিয়ে একটু মার্কারির সরবত খেয়ে স্পেসশিপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলুম আশেপাশে একটু চক্কর কাটতে। এমনই কপাল দিকনির্দেশক ডুগডুগিটার দুটো সুতো এক নেংটি এলিয়েন কোথা থেকে জানি এসে কুট করে দিল কেটে। ব্যস্! পাক্কা ৩৪ দিন ধরে মহাকাশে ঘুরপাক খেলুম। শেষে তার-টার জোড়া শেষ হলে দেখি এসে পড়েছি এক ঘুটঘুটে জঙ্গলের ভেতর!

-ওখানেই তো মস্ত বড় গণ্ডগোল করে ফেলেছেন দাদা!

-কোথায়?

-কোথায় আবার! ওই ৩৪ সংখ্যাটা অ্যাং ব্যাং মাওয়ের ঠ্যাং কারোর জন্যই খুব একটা শুভ নয়...বাম ডান গুলিয়ে যেতে বাধ্য। যাহোক, তারপর?

-তার আর পর কী! ভালো করে লক্ষ করে দেখলুম যেখানে নেমেছি সেটা একটা বাঁশ বাগান। আবার যেই ডুগডুগিটা গ্রহের দিকে ছেড়েছি,অমনি স্পেসশিপের পেছনে খেলুম বাঁশগাছের এক খোঁচা! ব্যস্! গোঁত্তা খেয়ে এসে পড়লুম এখানে। এখন কিছুতেই ঠাহর করতে পারছি না এটা কোন জায়গা।

-আপনার কি ঝামেলা লগ্নে জন্ম মশাই? জানেন একের পর এক কেমন বিপদের দিকে ছুটে চলেছেন আপনি?

-আবার কী করলুম?

-ওই যে বাঁশ ঝাড়ে ধাক্কা খেলেন, জানেন তার ইমপ্যাক্ট কী হতে পারত? এদেশ যে আজ জাপানীদের হাতে চলে যায়নি, সে কেবল ওই বাঁশঝাড়ের জন্য। আর জানেন তো, জাপানীরা কেমন দুর্ধর্ষ জাতি? ব্যাং থেকে ল্যাং অব্দি সবকিছু নির্বিবাদে হজম করে ফেলে...আর আপনি তো মশাই কোথাকার কোন অ্যাং!

-এ তো ভারি সব্বোনেশে কাণ্ড! তবে যদি আরেকটু খোলতাই করে বলেন...আসলে আমি একজন কচি এলিয়েন আর কী, মাথার অ্যান্টেনাগুলো ছোট ছোট। আপনার কথাগুলো তাদের ফুট দুয়েক ওপর দিয়ে হাওয়ায় ফুটফুট করে ভেসে যাচ্ছে। ব্যাটাদের ঠিক কব্জা করে উঠতে পারছি না।

-আচ্ছা। তবে বলছি শুনুন।

তখন আমি অরুণাচল প্রদেশের জঙ্গলে জঙ্গলে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু হলে কি হবে, চারদিকে বিস্তর ঝামেলা। সবথেকে বড় সমস্যা হল রোগ জ্বালা। হাম থেকে হুপিং কাশি... যাই হোক তাতেই পিলপিল করে মানুষ টপকে যাচ্ছে। ভাবখানা এই যেন কোনো রোগই ছোটো নয়, সবাইকে তার যোগ্য সম্মান দেওয়া হউক। ঈশ্বর আল্লাহ গড কেউই খুব একটা এঁটে উঠতে পারছেন না।

এই অবস্থায় একটি গোপন মিশনের সব দায়িত্ব এসে পড়েছিল এই অধমের কাঁধে। সেটা আর কিছুই নয়, একটা গাছ খুঁজে বের করা। কিন্তু সে আবার যে সে গাছ নয়, সাক্ষাৎ বিশল্যকরণী! হনুমান থেকে হ্যানিম্যান সব্বাই শয়নে স্বপনে জাগরণে সেই গাছের বীজ খুঁজে বেড়িয়েছেন। একজন তো আবার পর্বত-টর্বত তুলে একশা, শেষে একজন কবি গানই লিখে ফেললেন... “কিচ্ছু চাইনি আমি, আজীবন... “ যাগ্গে সেসব বাজে কথা থাক। তো সমস্যা হচ্ছে সেই বীজ এমন জায়গায় থাকে যেখানে রোদ-জল লাগার কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি রোদ বা জল লেগে যায় তাহলেই এক্কেবারে কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড ঘটে যাবে! তাই সেই বীজ একমাত্র পাওয়া যায় পাহাড়ের গভীর খাদের ভেতরের কোনো খাঁজে। তাতে যদিও আমার কোনো সমস্যা ছিল না। রোজ সকালে গুরুদেবের দেওয়া মন্ত্রপূত বেগুনি বারমুডা আর মেরুন মাফলার জড়িয়ে বেরিয়ে পড়তাম, কোনোদিনই সন্ধ্যেবেলা খালি হাতে ফিরতাম না।

সেরকমই একদিন বিকেলে খুশি মনে ট্রা লা লা লা গান গাইতে গাইতে ফিরছি। মনে হেব্বি ফুর্তি। এমন সময় হঠাৎ মাথার ওপর... ছপাৎ! ওপরে তাকিয়ে দেখি এক হলদে হাঁড়িচাচা বেশ গম্ভীর গম্ভীর মুখে গাছের ডালে নিজের পেছনটা ঘষে নিয়ে পুবদিকে উড়ে গেল। বেশ চিন্তিত মনে মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম... হ্যাঁ, যা ভেবেছি ঠিক তাই। আর তো দেরি করা যাবে না, সামনে বড়সড় বিপদ! সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম সোজা পশ্চিমমুখো হয়ে। একদম নাক বরাবর তিন দিন তিন রাত্তিরের পথ পেরিয়ে এক ভাঙাচোরা বাংলোর বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঠকঠক করে তিনবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে ভারী গলা ভেসে এল, “ওরাংওটাং ভাঙবে ঠ্যাং... “ গম্ভীর মুখে জবাব দিলাম, “সিন্ধুঘোটক মারবে ল্যাং।” ব্যস্! দরজা খুলে এসে জহরদা আমাকে জড়িয়ে ধরল। “যাক, তুই এসেছিস শেষ পর্যন্ত! আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম যে তুই বুঝতে পারবি কিনা সঙ্কেতের মানে।” মুচকি হেসে বললাম, “পুবমুখো হলদে হাঁড়িচাচার হাগুর সঙ্কেত তুমি-আমি ছাড়া আর কে জানে দাদা! যাগ্গে, বলো কেন ডেকে আনলে?”

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জহরদা বলল, “দেশের বড় বিপদ রে সামনে! চট করে আমায় প্রধানমন্ত্রী করে বসিয়ে তো দিল, এখন বুঝতে পারছি না দেশটাকে আর ক’দিন টিকিয়ে রাখতে পারবো... তুই জেনারেল কচিশসা কে চিনিস তো?”

আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। সে তো ভয়ঙ্কর লোক! জাপানের গুপ্তঘাতক বাহিনী ‘দেখেনিলে কচুকাটা’-র সর্বাধিনায়ক! ছদ্মবেশ নিতে ওস্তাদ এরা, ডাকাত থেকে ডাইনোসর সব কিছুই সাজতে পারে! কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম সারা পৃথিবী জুড়ে ঘেঁটুফুলের চাষ বাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে এরা। ওদের জেনারেল ওই ফুল দিয়েই নাকি তার প্রেমিকা মিশিমাখা শিখিপাখা কে প্রেম নিবেদন করেছিল, তাই।”

বিরস বদনে জহরদা বলল, “আরে সেটাই তো হচ্ছে বিপদ! সেই কতদিন আগে যখন নেতাজী কয়েকজন জাপানীকে নিয়ে ভারতকে স্বাধীন করার জন্য আক্রমণ করেন, তখন সেই দলে নাকি এদেরও কয়েকজন ভিড়ে গেছিল। তারা এদেশে এসে নাকি দেখেছে যে এখানে জঙ্গলে জঙ্গলে অনেক ঘেঁটুফুল ফুটে আছে, সেসব আবার ওদের ওখানকার ফুলের চেয়ে অনেক বেশি বাহারি। ব্যস্, আর যায় কোথা! সেটা জেনেই কচিশসা প্রতিজ্ঞা করেছে সে এদেশ দখল করে ঘেঁটুফুলের ফার্মিং করেই ছাড়বে!”

নাকের ডগাটা সুড়সুড় করছিল। বুঝলাম এটা হচ্ছে বিপদের ইঙ্গিত। আর যদি জহরদার কথা সত্যি হয় তাহলে এটা ঠিক যে ব্যাপার বেশ গোলমেলে। জেনারেল কচিশসার সঙ্গে এর আগেও মোলাকাত হয়েছে। পাঁচ ফুট লম্বা বেঁটেখাটো হাসিখুশি লোক, মুখ দেখলে মনে হবে ভাজা মাছ সোজা বা উল্টো কোনোভাবেই খেতে জানে না। কিন্তু ভীষণ জেদি! মগজে যতরকম উদ্ভট দুষ্টু বুদ্ধি ভুসভুস করে গ্যাস বেলুনের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। সেবার আফ্রিকার জঙ্গলে বুনিপ সেজে দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কিলিমাঞ্জারোর চূড়াতে কালো রঙ করবে বলে। তাতে নাকি চাঁদের আলো আরো বেশি বেশি করে জাপানে গিয়ে পড়বে! শেষে এক বাংলা সিনেমার তোতলা হিরো সেজে ব্যাটাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছিল। কিন্তু বারবার তো আর একইরকম ফন্দি খাটবে না! কী করা যায় এবার?

পাশ থেকে জহরদা উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়েছিল। চোখাচোখি হতেই ব্যাকুল গলায় বলে উঠল, “কিছু কর ভাই। এখন তুইই শেষ ভরসা। মনে রাখিস সারা দেশের যতো ছেলে মেয়ে পিতা মাতা জামাতা ডান বাম বুদ্ধিজীবী বুদ্ধুজীবী সবাই এখন তোর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে।”

একবার গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললাম, “চিন্তা কোরো না। তুমি যখন বলেছ ওই কচিশসার স্যালাড আমি বানিয়েই ছাড়ব! একটা সিগারেট হবে? “

দিন তিনেক পর এক সকালে জাপানীদের ক্যাম্পে ভয়ানক গোলমাল বেঁধে গেল। সবাই যখন ক্যাম্পের ভেতরে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর মুখে আলোচনা চালাচ্ছে তখন হঠাৎ তাবুর বাইরে থেকে জোর হাঁই মাঁই কাঁই কাঁই চিৎকার শোনা গেল! প্রথমে তো সবাই ভারতীয় সেনা আক্রমণ করেছে ভেবে পজিশন নিয়ে নিল। কেউ ক্যাম্পখাটের তলায়, কেউ উনুনের পেছনে, সাথে যে যা পেরেছে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে... ঝাঁটা-জুতো-হাতা-খুন্তি! কিন্তু কিছুক্ষণ চিৎকার চলার পরেও কোনো গোলা গুলি গুলতি কিছুই ছুটে আসছে না দেখে একজন সাহস করে মাথা বের করে দেখল এক উড়ে বামুন ক্যাম্পের সামনে বসে হাতে এক পুঁটলি নিয়ে টিকি নাড়িয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করে চলেছে। সব জাপানী তো এই দেখে ক্ষেপে লাল! কচিশসা ততক্ষণে প্রায় পাকা টমেটো হয়ে গেছে! এসব কী বাপু? যদি ধর্ণাই দিবি তো দিল্লি যা, কলকাতা যা, নিদেনপক্ষে মেডিক্যাল কলেজে যা, তা নয় এসে বসলি কিনা জঙ্গলে জাপানী তাঁবুর সামনে!

এখন সমস্যা হল ব্যাটা এসেছে কী মতলবে সেটাই তো ঠিক বুঝে উঠে পারছে না কেউ! জাপানীরা যতই পরিজামি-ওরিগামি-ফুজিয়াবি-হাবিজাবি বলে চেঁচায়, সেই উড়ে তার থেকে দু ডিগ্রি উঁচুতে গলা তুলে “আই বাপঅ গো! একদম মরিজিবা গো! “ বলে বিলাপ শুরু করে। সে এক গোলমেলেঞ্জারাস কাণ্ড! শেষ ভারত দখলের স্বপ্ন যখন টাইটানিকের মতো ডুবতে বসেছে তখন অনেক খুঁজে এক জাপানীকে পাওয়া গেল যে একটু আধটু উড়িয়া বুঝতে পারে। তার বাবার বড় শালার ছোটো পিসেমশাই নাকি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সামনে গজা বিক্রি করত। সে এসে অনেকক্ষণ চোখ নাক কুঁচকে সব শুনেটুনে যা বুঝল তা হল এই যে এই উড়ে জাপানীদের কাছে এসেছে আশ্রয়ের আশায়। তার ভারতের লোকজনের ওপর খুব রাগ। সে নাকি আগে এই এলাকার গোবর মার্চেন্ট ছিল, গোবর থেকে ঘুঁটে তৈরীর একচেটিয়া ব্যবসা ছিল তার। তার বানানো বিভিন্ন ফ্লেভারের ঘুঁটে দেশে বিদেশে রপ্তানিও হত। বিশেষ করে তার গোলাপগন্ধী ঘুঁটে তো প্রায় কিংবদন্তি। স্বয়ং লাদেন নাকি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল হোয়াইট হাউস দখল করে সেখানে ঐ ঘুঁটের কারখানা বানানোর জন্য। আজকাল অন্য দেশের পেছনে কাঠি করা ছাড়া সেখানে আর কোন কাজ হচ্ছে না তো, তাই। কিন্তু হঠাৎ কদিন আগে কী হল কে জানে, কিছু লোক এসে তাকে বলল, “এইও, তুম এখানকার লোক নেহি হ্যায়, তুম বিদেশী হ্যায়। এক্ষুনি পালাও, নয়ত এনআরসি ছুঁড়ে মারেগা!” সে বেচারা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, গোমাতার গোবরের কসমও খেয়েছিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু লাভ হল না। উল্টে তার এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ঘুঁটেতে জল মিশিয়ে আবার তাকে গোবর বানিয়ে দিয়ে তারা চলে গেল! সেই থেকে সে তার পুঁটলি বেঁধে বেরিয়ে পড়েছে। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছে আর প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে। শেষে সে যখনি শুনেছে জাপানীদের কথা, ছুটে এসেছে। তার কাছে নাকি এক অব্যর্থ টোটকা আছে, যা নিয়ে গেলে যেকোনো যুদ্ধে জয় একেবারে নিশ্চিত! সে চায় এগুলো জাপানী সেনাদের দিয়ে যেতে... যাতে তারা যুদ্ধে জেতে, আর তার হাড় জুড়োয়।

কচিশসা নামে কচি হলেও বুদ্ধিতে কিন্তু বেশ পাকা। কোথা থেকে আসা এক উড়ে বামুন কিনা তাদের সাহায্য করবে বলে বসে আছে, এটা সে বিশ্বাস করবে? এ ব্যাটা নির্ঘাত শত্রুপক্ষের চর! সঙ্গে সঙ্গে সে হুকুম দিল,”বাঁধো ব্যাটাকে উল্টো করে গাছের ডালের সঙ্গে, আর সব্বাই মিলে আচ্ছাসে কাতুকুতু দাও... যতক্ষণ না ঠিক করে বলে ওর মতলব কী! “ ব্যস্! যেমন বলা তেমন কাজ। সারাদিন ধরে জাপানীর দল যতরকম উৎকট জিনিস দিয়ে ব্যাটাকে তেড়ে কাতুকুতু দিল... কাকের পালক, গিরগিটির ল্যাজ কি নেই তাতে! কিন্তু সব চেষ্টাই বেকার। উড়ে খালি হাঁই মাঁই করে চেঁচিয়েই গেল, কিন্তু অন্য কোনো কথা তার থেকে বের করা গেল না। শেষে সন্ধ্যেবেলায় জাপানীরা ক্লান্ত হয়ে তাঁবুতে ঢুকে দোর তুলে দিল ঘুম। উড়ে ব্যাটাও দিব্যি ঝুলতে ঝুলতেই ফুরফুর করে নাক ডাকতে লাগল।

তখন গভীর রাত। হঠাৎ আবার হাঁই মাঁই কাঁই কাঁই চিৎকারে জাপানীর দল বিছানায় উঠে বসল। নির্ঘাত ওই ব্যাটা আবার কোনো ঝামেলা পাকিয়েছে! কিন্তু লাঠিসোটা নিয়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়েই যা দেখল তাতে তাদের চক্ষুস্থির! কোথা থেকে দুই মুশকো রামছাগল, তাদের এই বড় বড় শিং, এই মাঝরাতে হাজির হয়ে তাদের নেতা কচিশসার বাহারী টুপিটা মনের সুখে কুড়কুড় করে চেবাচ্ছে! আরামে তাদের চোখগুলো অর্ধেক বুজে এসেছে, তুরুক তুরুক করে নাচছে লেজগুলো।

এখন জাপানীদের কাছে টুপি জিনিসটা ভীষণ সম্মানের। তারা কিডনি চাইলে দিলেও দিতে পারে, কিন্তু টুপি? কভি নেহি! ফলে যা হবার তাই হল। দু’শ জাপানীর সাথে দুই রামছাগলের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলল রাতভর! শেষে আঠাশ জনের পেছনে শিং ফুটিয়ে অত্যন্ত বিরক্ত মুখে দুই রামছাগল রণে ভঙ্গ দিল।

এতক্ষণে কচিশসার চোখ পড়ল সেই উড়ে বামুনের দিকে। সাথে সাথে ফুজিয়ামা ফুজিয়ামা বলতে বলতে ছুটে গিয়ে সে তাকে জড়িয়ে ধরল বুকে! আজ এর জন্যই তার সাধের টুপিটা আস্ত আছে। ভাগ্যিস ছাগল দেখে ঠিক সময়ে হাঁই মাঁই করে সিগন্যাল দিয়েছিল!

পরদিন সকালেই জাপানী শিবিরে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। ভোরবেলায় স্নান করে লাল সিল্কের লুঙ্গি পরে সেই বামুন বসে পড়েছে মা ক্যালানিদেবীর পুজোয়। তিনি নাকি তাদের যুদ্ধের দেবী, হেব্বি জাগ্রত। সবকটা জাপানী তার পেছনে মাথার সিঁদুর লেপে হাত জোড় করে ভক্তিভরে বসে আছে। পুজো শেষ করে তাদের সবার গলায় সে ঝুলিয়ে দিল তার ঝোলায় রাখা মন্ত্রপূত ঘুটঘুটেশ্বর মাদুলী, তার ওপর ছিটিয়ে দিল পুজোর শান্তি জল। সব জাপানী একসাথে আনন্দে হিচিমিচি কিচিকিচি করে চেঁচিয়ে উঠল। এবার তাদের জয় নিশ্চিত! জেনারেল কচিশসা হুকুম দিলেন, “এবার সবাই বিশ্রাম করো। আজ সন্ধ্যেয় আমরা আমাদের অভিযান শুরু করব। জয় পা-চাঁটি-ফানুসের জয়! ব্যস্! কাম খতম!”

-কাম খতম মানে? তারপর কী হল?

-তারপর আর কী? কচি কচি বাঁশ গাছে ভরে গেল সেই জায়গাটা। দেশটা বেঁচে গেল সে যাত্রা।

-সে আবার কী?... মানে কী করে?... মানে ক্যাইসে?

-খাইসে! কিছু বুঝলেন না নাকি? ওই যে মাদুলি ঝোলালাম ওদের গলায়!

-মা-মাদুলি? আর ঝোলালাম মানে... আপনি?

-আজ্ঞে হ্যাঁ। এই অধমই আপনার সেই উড়ে বামুন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, শেষে পোষা দুই রামছাগল ঘাসপাতা আর ব্যাঙেরছাতা কে কাজে লাগিয়ে ব্যাটাদের মন জয় করতে হয়েছিল। তবে গিয়ে না ব্যাটাদের গলায় মাদুলি ঝোলাতে পারলাম!

-কিন্তু... মাদুলি দিয়ে কী করে...?

-ওফ্! মশাই আপনিও না...! আরে ওই মাদুলির মধ্যেই তো ছিল ব্রহ্মাস্ত্র!

-অ্যাঁ!

-আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই অব্যর্থ বাঁশ গাছের বীজ, ব্যাম্বুসা ফুসফুসা... একটু জল পেলেই দু’ঘন্টায় বিশ হাত গজিয়ে ওঠে। সেদিনও তাই হয়েছিল। সবকটা জাপানী ব্যাটা এখনো বুকে বাঁশঝাড় নিয়ে মাটির তলায় শুয়ে আছে। বিশ্বাস না হলে দেখে আসুন গে!

-না না মশাই, খুব বিশ্বাস হয়েছে, ভীষণ বিশ্বাস হয়েছে... এই দেখুন না এখনো বুকটা ধড়ফড় করছে! উফ্! কী সব্বোনেশে কাণ্ড! খুব বাঁচা বেঁচে গেছি এ যাত্রা!

-তবে আর বলছি কী! পঞ্চা ঘোষের বাগান থেকে ওরকম দু একটা বীজ আপনার স্পেসশিপে পড়লে আর দেখতে হত না! অ্যাং এতক্ষণে বাঁশ গাছে হ্যাং হয়ে যেত!

-বাপরে বাপ! এ তো বড় ভয়ঙ্কর জায়গা! এক্ষুণি পালাতে হবে এখান থেকে! দোহাই দাদা, এই ভিনগ্রহী ভাইটাকে একটু সাহায্য করুন!

-আবার কী হল?

-আজ্ঞে এই জায়গাটা কোন জায়গা যদি একটু বলেন, আমার দিকনির্দেশক ডুগডুগিটাকে তাহলে ঠিক মতো নিজের গ্রহের দিকে তাক করে ছেড়ে দিতে পারি। পিলিজ দাদা!

-অ, এইকথা? এইটুকুর জন্য আপনি এতক্ষণ বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিলেন! সত্যি! এই যে আপনি এই রাস্তাটার পাশে এই বাড়িটার ছাদে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছেন, এই রাস্তাটার নাম বনমালী নস্কর লেন। আর বাড়িটা বাহাত্তর নম্বর।

-অনেক ধন্যবাদ দাদা। আপনার সঙ্গে এই সাক্ষাৎ আমি সারাজীবন ভুলবো না। তা... ইয়ে, মানে... দাদা আপনার নামটা...?

-আমার নাম দাস। ঘনশ্যাম দাস।