শিবুর সন্ন্যাস - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

হাসির গল্প

অলংকরণ : সুমিত রায়

শিবুদের বাড়িটা একটা বিচিত্র জায়গা ছিল। সবসময় গিজগিজ করছে লোকজন। বাবারা আটভাই, মা কাকিমা আটজন, জ্যাঠতুতো খুড়তুতো মিলে একতিরিশজন ভাইবোন, তাদের বয়স একুশ থেকে সাড়ে আট মাস, দুই পিসি, দাদু-ঠাকুমা, তাছাড়া, দিনে গড়পড়তা দশজন অতিথ কুটুম, আর এই সমস্ত লোকজনের দেখভাল করবার জন্য বাঙালী, বিহারী, উড়ে মিলে বেশ ক’জন কাজের লোক। প্রায় দুবিঘে জমি নিয়ে বসত। তার একপাশে বিরাট একটা তিনতলা বাড়িতে ওরা সবাই মিলে থাকে। নিচের তলায় রান্নাঘর, ভাড়ার ঘর, ফুটবলমাঠের মত বড় খাবার ঘর, ঠাকুর চাকরের থাকবার ঘর, আর ওপরের দুটো তলা মিলে প্রায় তিরিশটা নানা মাপের ছোট বড় ঘর, ব্যালকনি, খোলা বারান্দা, ঘেরা বারান্দা জুড়ে বাড়ির বাকি লোকজনের আস্তানা।

তবে বাড়িতে দলে সবচেয়ে ভারী ছিল শিবুরা, মানে শিবুদের বয়েসের ভাইবোনেরা। দশ থেকে পনেরো বছরের ভাইবোন কুল্লে সতেরোটি। তেরোটি ভাই, চারটি বোন। মাসে একবার নাপিত এসে তেরো ভাইকে বাগানে সার বেঁধে বসিয়ে মাথা মুড়িয়ে দিয়ে যেত, আর নববর্ষে, পুজোয়, ষষ্ঠীতে তিনবার হরেন দর্জি বগলে বিরাট এক পোঁটলা করে ছিট কাপড়ের থান আর কডুরয়ের মোটা কাপড় নিয়ে এসে তেরোজনের মাপ নিয়ে একরকম জামা আর প্যান্ট বানিয়ে দিত সবার জন্য। পুজোর সময় ফুলহাতা জামা আর ফুলপ্যান্ট, বকি দুটো সময় হাফহাতা জামা আর হাফপ্যান্ট। মেজকাকা বলতেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম। এ বাড়িতে বরাবর নাকি এই নিয়ম চলে আসছে। দশ বছরে পড়লে তো ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ঢোকো, পনেরো পুরো হয়ে স্কুল ফাইনাল পাশ করলে তারপর আবার নিজের ইচ্ছেয় চুল কাটা আর জামাকাপড় পরা। কিন্তু এর মধ্যেকার সময়টা অতি ভয়ানক। শুধু যে একরকম জামাকাপড় পরতে আর গণহারে চুল ছাঁটতে হয় তা নয়, আরও বিপদ আছে। গুরুজনের তো আর অভাব নেই এ বাড়িতে! শিবু একবার গুনে দেখেছিল, সাকুল্যে পঁচিশজন। পঁচিশজোড়া নিশপিশ করা হাতের নাগালের মধ্যে মাত্র তেরোজোড়া কান। তার ওপরে, সবার একরকম চুলের ছাঁট আর পোশাকের কল্যাণে শাসনের উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে তো লেগেই থাকত। আবার, বাবা কাকাদের মধ্যে কেউ যদি বেশ কয়েকদিন বাইরে কোথাও ঘুরে আসতেন তাহলে ফেরবার পর এই শিশুপালের মধ্যে কোনটা যে কার সেটা বুঝে নিতে তার বেশ খানিক সময় লেগে যেত।

এই সমস্যাটা হত বিশেষ করে ফুলকাকাকে নিয়ে। কারণ বাবা-কাকাদের মধ্যে ফুলকাকার স্মৃতিশক্তিটাই একটু বিশেষরকম কম ছিলো। সেই নিয়ে সেবারে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল এ বাড়িতে। ব্যাপারটা এই রকম-- ফুলকাকা জরিপের আপিসে চাকরি করতেন। এ কাজে মাঝে মাঝেই লম্বা লম্বা টুরে যেতে হয়। যেতেন ফুলবাবুটি হয়ে, আর ফিরতেন, যেন কাঠির মাথায় আলুর দমটি। তারপর আবার কিছুদিন বাড়ির আট বউ-এর হাতে সরু মোটা, আমিষ নিরিমিষ খেয়ে, শিবুদের কানে পিঠে হাতের ব্যায়াম করে করে চেহারাটা যেই ফিরত ওমনি আবার রওনা দিতেন। তা সেবার পুজোর ঠিক পর পর ফুলকাকার ডাক পড়েছিল কুচবিহারের তুফানগঞ্জের কাছে বালাভুত বলে একটা জায়গায়। সে অনেক দূরের রাস্তা। যেতে আসতে চারপাঁচ দিন লেগে যায়। তার ওপরে, কাজও ছিল লম্বা। ফলে ফিরতে ফিরতে ফুলকাকার প্রায় পাঁচমাস কেটে গেল। ইতিমধ্যে, বালাভুত-এ থাকতেই চিঠিতে খবর পেয়েছেন, ওঁর ছেলে না অ্যানুয়াল পরীক্ষায় অংকে সাড়ে তিন পেয়েছে। খবরটা জানিয়ে একটা পোস্টকার্ড ছেড়েছিলেন ঠাকুর্দা। তার সঙ্গে আরও লিখেছিলেন--

“সুধীরের পুত্র পীতাম্বর তোমাদের বাল্যকালে অংক কষাইতো স্মরণে আছে নিশ্চয়! সে বর্তমানে ইশকুলের প্রধান শিক্ষক হইয়াছে। শ্রীমান নান্তুর পরীক্ষার ফল আমার হস্তে দিয়া তোমার কথা স্মরণ করিয়া সে বলিয়াছে, ‘হবে না? কার ছেলে, সেটা দেখতে হবে তো! এ যে সাড়ে তিন পেয়েছে সেটাই তো আশ্চর্য!’ অত্রস্থ বকি সকল কুশল। নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ যত্ন নিবে। ব্রাহ্মী শাকের রস প্রত্যহ খাইতেছ তো?

আশির্বাদক শ্রীশচন্দ্র ভট্টাচার্য

পু: জমির মাপজোকের অংকগুলি যাহা করিবে সেগুলি তোমার আমিন নফরচাঁদকে দিয়া সর্বদা সংশোধন করাইয়া লইবে। পীতাম্বর বহুদর্শী মানুষ। তাহার কথা নিতান্ত অবজ্ঞা করিবার নয়। এই আক্রার বাজারে সামান্য যোগবিয়োগে ত্রুটির কারণে চাকরিটি হারাইলে মর্মবেদনার অবধি থাকিবে না জানিবে।”

 

পোস্টকার্ডটা আবার নফরচাদই হাতে করে এনে দিয়েছিল ফুলকাকার কাছে। পড়েটড়েই দিয়েছিল নিশ্চয়। সব মিলিয়ে ফুলকাকার গোটা রাগটাই গিয়ে পড়ল বেচারা নান্তুর ওপরে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি যখন রাধাপুরে এসে পা দিলেন, শরীরের রক্ত তখন ফুটছে।

সেটা ছিল সরস্বতীপুজোর পরদিন। তখন সকাল আটটা মত হবে। শীত আছে বেশ। সকালে উঠেই ঘুমচোখে শিবুরা দোলাই, চাদর, হাতের কাছে যে যা পেয়েছে মুড়ি দিয়ে এসে পুজোর ঘরে বসেছে। ঠাকুমা আর শিবুর মা মিলে পেতলের বিরাট গামলায় দধিকর্মা মাখা চলেছে একপাশে, আর শিবুরা সব ভাইবোন মিলে ঠাকুরের সামনে দঙ্গল করে বসে বেলপাতায় একশো আটবার করে সরস্বতীর নাম লিখছে।

এই সময় দরজায় ফুলকাকার মুখটা দেখা দিল। কুলিতে ট্রাংক মাথায় করে এনে নামাচ্ছে বারান্দায়, আর নাকেমুখে ইঞ্জিনের মত শীতের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফুলকাকা এসে ঢুকেছেন পুজোর ঘরে।

শিবু, দুটো মার্বেলগুলি দান করে নান্তর লাল চেক চেক চাদরটা দু’দিনের জন্য ধার নিয়েছিল আগের দিন রাত্রে। সেইটে মুড়ি দিয়ে বসে মন দিয়ে লিখছে, এমন সময় ফুলকাকা এসে ঘরে ঢুকেই বাঘের মত থাবা দিয়ে তার চুলের মুঠিটা ধরে ঝুলিয়ে তুলে নিলেন। তারপর পিঠে বৃষ্টির মত কিল, আর সেইসঙ্গে ভয়ানক চিৎকার, “অংকে সাড়ে তিন পাওয়া! বাপ কা ব্যাটা হয়েছে। আজ তোরই একদিন কি----

শিবু যত বলে, “ও ফুলকাকা, আমি শিবু। আমি অংকে পঞ্চাশ পেয়েছি। আমি না না---”, ফুলকাকার রাগও ততই চড়ে। মারের বহরও বাড়ে। বলেন,“ বদমাশ, মিথ্যেবাদি! আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা! এই চদর আমি তোকে গতবার কিনে দিইনি? আমার ছেলে আমি চিনব না? তুই আলবাত নান্তু।”

ঘটনাটায় সবাই এতই অবাক হয়ে গিয়েছিল যে ভুলটা ভাঙাতে ভাঙাতে প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। ততক্ষণে ফুলকাকার স্টিম কমে গেছে। ফলে আসল নান্তুর কপালে মারটা আর জুটল না।

মার খেয়ে শিবুর ক্ষতিবৃদ্ধি বিশেষ কিছু হয়নি। কিন্তু তারপর সারাদিন ধরে নান্তুর মিটিমিটি হাসি দেখে মনে ব্যথা লেগেছিল আরও বেশি। আর, রাতে বাড়ি এসে সব ঘটনা শুনে বাবা যখন নান্তুকে পাল্টা মার দেবার কোন ফন্দি না করে শুধু ছাদ ফাটিয়ে হাসলেন, তখনই শিবু সিদ্ধান্ত নিল, এ বাড়িতে আর নয়। সংসার ত্যাগ করতেই হবে।

সংসার ত্যাগ ব্যাপারটা শিবু কিছু কিছু জানে। মাঝেমাঝেই মা’র মুখে শোনে কি না! মা রেগে গেলেই রাতে শিবুকে কাত করে বিছানায় শুইয়ে চাপড় দিতে দিতে আপনমনেই ফিস ফিস করে গজগজ করে, আর পারি না বাপু। এবারে কোনদিন সংসার ত্যাগ করে যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাব।

সেই থেকে শিবু বুঝেছে রাগ হলে লোকে সংসার ত্যাগ করে, মানে যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যায়। এ ব্যাপারটা শিবু এরপর দুয়েকদিন কাউকে না বলে চুপিচুপি চেষ্টা করে দেখল। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হল না। কারণ যতবারই চোখ দুটোকে যে দিকে খুশি তাকাতে দেয় ততবারই তারা পরেশের ফুলুরির দোকানের দিকেই চলে যায়। পকেটে রোজ রোজ অন্তত চার আনা পয়সা না থাকলে এ লাইনে সংসার ত্যাগ করাটা চলবে না। অতএব শিবু অন্য পথ ধরল।

মাস দুই পরের কথা। গরম তখনও তেমন চেপে পড়েনি। শিবুদের ইস্কুল শুরু হয়ে গেছে জোরকদমে। ফুলকাকার ততদিনে আবার বেরোবার সময় হয়ে এল। এবারে অবশ্য আগের মতন অমন ধ্যাধধেড়ে গোবিন্দপুর মার্কা জায়গা নয়। ডাক পড়েছে লালবাগে। বহরমপুর ইস্টিশান ছাড়িয়ে মুর্শিদাবাদ নামে ছোট্ট একটা স্টেশন আছে, সেখানে নেমে টাঙ্গায় করে যেতে হয়।

রাধাপুর থেকে বাসে চেপে কলকাতা। বাড়ির খানিক দূর দিয়ে লাল সুরকির সড়ক। সেখান থেকে সেদিন দুপুরে এসে বাস ধরলেন ফুলকাকা। দুপুরে ভালো খাওয়া দাওয়া হয়েছে। তাছাড়া, সঙ্গে পুঁটলীতে তেলতেলে লুচি আর মাংস দিয়ে দিয়েছে। রাতের খাওয়াটাও কাজেই নিশ্চিন্ত।

বাসে চেপে জুতসই একটা সিট দেখে বসে চোখ বুজলেন ফুলকাকা। তারপর, বাসটা যখন স্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, তখন বগলের বইয়ের ব্যাগটা মাটিতে রেখে, বাসের পেছনের সিড়ি বেয়ে আর একজনও চেপে বসল বাসের ছাতে। ওখানে ভাড়া অর্ধেক কিনা!

শেয়ালদা অব্দি পৌঁছুতে সেই ছাতের প্যাসেঞ্জারের অসুবিধে হল না। ভাড় ভেঙে পুরো দুটাকা জুটেছিল, ওতেই কুলিয়ে গেল। তারপর শেয়ালদা পৌঁছে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চেপে ফুলকাকা আর তার দলবল তো রওয়ানা হল। আর সবার চোখের আড়ালে সেই একজন সংসারত্যাগীও একই কামরার বাথরুমের ভেতর ঢুকে চেপে বসল। কেউ তাকে খেয়াল করেনি। ফুলকাকা তো নয়ই।

রানাঘাট পেরোবার পরে কামরার পেছন দিকে একটা হৈ চৈ উঠল। ফুলকাকা একটা বার্থে শুয়ে শুয়ে ঘুমোবার সাধনা করছিল; গণ্ডগোলে অস্থির হয়ে নফরচাঁদকে বলল “দেখে আয় তো নফর ব্যাপারটা কী? চোরটোর নয় তো?”

নফরচাঁদ খানিক পরে ঘুরে এসে রিপোর্ট দিল, ফুলকাকার অনুমান মিথ্যে না-ও হতে পারে। একটা বাচ্চা ছোকরা নাকি ধরা পড়েছে। এ কামরার চেকারসাহেব বেশ ঘুঘু মানুষ। গোটা কামরার টিকিট দেখে টেখে নিয়ে তারপর বাথরুমের দরজগুলো ঠেলে ঠেলে দেখছিলেন। আর তাতেই ধরা পড়েছে যে একটা দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সেই দরজা খোলাবার গণ্ডগোলই চলছিল এতক্ষণ। ছেলেটাকে নফর অবশ্য দেখতে পায়নি। বড্ড ভিড় ছিল।

শুনে ফুলকাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাবারের পোঁটলাটাকে একেবারে বুকের কাছটাতে টেনে নিয়ে ওপাশ ফিরে শুল। কে জানে বাবা, কোত্থেকে কী হয়!

ওদিকে দরজা খোলাবার পর ওইটুকু একটুকরো ছেলে দেখে লড়াকু জনগনের উৎসাহ কমে এসেছিল। একে গনধোলাই দিয়ে সুখ হবে না। অতএব খানিকক্ষণ এটা ওটা বলা কওয়া করে সবাই যে যার কাজে গেল। এইবারে চেকারসায়েব ছেলেটাকে নিয়ে পড়লেন।

“এই, তোর বাড়ি কোথায়?”

“রাধাপুরে”।

“সেটা আবার কোনদিকে?”

“পশ্চিমদিকে”।

“ও বাবা, বেশ মুখে মুখে জবাব দিচ্ছে দেখি!”

“তুমিই তো জিগেস করলে।”

“হ্যাঁ বাবা, ঘাট হয়েছে। এবারে দয়া করে বলবে, সেই রাধাপুর থেকে এই ট্রেনে এলে কী করে?”

“কেন, সবাই মিলে বাসে করে চলে এলাম। তারপর শেয়ালদা থেকে ট্রেন ধরেছি।”

“ও, দলবল তবে সঙ্গেই আছে। তা উঠেছিস কী ধান্দায়? সত্যি করে বল।”

“আমি সংসারত্যাগ করেছি।”

“অ্যাঁ? আর বাড়িই ফিরবি না?”

“কেন? ফিরব না কেন? সংসারত্যাগ তো হয়েই গেল। এবারে ফুলকাকা যখন ফিরবে তার সঙ্গে ফিরে যাব।”

“ফুলকাকাটা আবার কে?”

“ফুলকাকা মানে ফুলকাকা। ফ-য়ে হশ্যু, ল ----"

“থাক থাক, অনেক হয়েছে। তা ওই দলবল না কী বলছিস সেসব কি তোমার শিষ্যসামন্ত?”

“শিষ্য নেই, তবে একজন নফরচাঁদ সামন্ত আছে।”

“চোপ। আবার ফাজলমি হচ্ছে? এখন ঠিক করে বল মতলবটা কী?”

“মতলব আবার কী হবে? ঠিক করেছিলাম বাথরুমেই লুকিয়ে থাকব কিছুক্ষণ। ওদের লালবাগে কাজ আছে। রাতে মুর্শিদাবাদ ইস্টিশানে পৌঁছে ওরা যখন যন্তর টন্তর নিয়ে নাববে, তখন আমিও----”

“দাঁড়া, দাঁড়া, কী বললি? দলবল রাতে যন্তর টন্তর নিয়ে লালবাগে অপারেশন করতে যাবে?”

শিবুর চোখদুটো চকচক করে উঠলো, “ওই কথটাই এতক্ষণ পেটে আসছিল, মুখে আসছিল না। ফুলকাকার মুখে সেদিনই শুনছিলাম, ওর দলবলকে বোঝাচ্ছিল, কী যেন বলে, সেই অপারেশন বর্গমূল না কী----"

চেকারসাহেবের আর কোনও সন্দেহ নেই । ডাকাতের একটা বড় দল বন্দুক টন্দুক নিয়ে মুর্শিদাবাদে চলেছে। কোন গুপ্ত অভিযানে। তার কোডনাম বর্গমূল। কৃষ্ণনগর আসতে তখন আর বেশী দেরী নেই। ট্রেনটা থামলেই শুধু একটু দৌড়ে গিয়ে রেলপুলিশের ঘাঁটিতে খবর দেয়া-- তারপর পরমবীরচক্র, রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার, আপিসে দুটো ইনক্রিমেন্ট, খবরের কাগজে ফটো, ডি আর এম অপিসে চেয়ারে বসে বসে চাকরী--- উঃ, ভাবা যাচ্ছে না। শুধু পুলিশ আসবার আগে ডাকাতগুলো যেন টের না পায়, সেটুকু দেখতে হবে। ছেলেটার কাকা আর তার দলবল কোথায় বসেছে জেনে নিয়ে চেকার সাহেব একবার মুখগুলো দেখেও এলেন, আরেকবার টিকেট পরীক্ষার নাম করে।

***

কৃষ্ণনগর আসতে আসতে রাত আটটা হল। ঢোকার সময়ই গাড়ি দশ মিনিট লেট ছিল, তারপর প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেল--- গাড়ি আর নড়ে না। দেরী হচ্ছে দেখে নফরচাঁদ, চেনপিওন বনমালীকে ডেকে কুঁজোয় জল ভরে নিয়ে আসতে পাঠিয়েছিল। জল নিয়ে ফিরে এসে বনমালী বলল, কুঁজো হাতে দরজার কাছে আসতে, হঠাৎ অন্ধকার বাথরুমের সামনে থেকে নাকি একটা বাচ্চা ছেলের মুণ্ড বেরিয়ে এসে ওকে ফিসফিস করে বলেছে, "কাকাকে বলো বাঁচতে হলে যেন এক্ষুণি পালায়। পুলিশ আসছে।” কে কার কাকাকে কী বলবে আর কেনই বা বলতে যাবে এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বনমালী সবে ট্রেনের দরজা থেকে প্ল্যাটফর্মে পা দিয়েছে, ওমনি, কোথা থেকে দৌড়তে দৌড়তে চেকারবাবু এসে বলে, “আহা আপনি কষ্ট করবেন কেন স্যার, আমায় দিন। আপনি বরং ভেতরে গিয়ে বসুন।" এই বলে বনমালীকে আবার জোর করে ট্রেনের ভেতর পুরে দিয়ে কুঁজো হাতে গিয়ে জল ভরে এনে দিয়ে বলেছে,“আপনারা কি চা খাবেন স্যার? সীটে গিয়ে বসুন, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।” সব শুনে টুনে ফুলকাকা বলল, “সবই ভগবানের লীলা, বুঝলি বনমালী! নইলে, কে কোথায় শুনেছে, চেকারে জল এনে দেয়! তার ওপর আবার চা খাওয়াতে চাইছে! খাবারটা তবে একটু পরেই খাওয়া যাক, কী বলিস!”

আরও আধঘন্টা কেটে গেছে তারপর। চায়ের দেখা নেই। ফুলকাকার রক্ত সবে একটু গরম হয়ে উঠব উঠব করছে এমন সময় চেকার সাহেবের বিনীত মুখটা দেখা গেল। বললেন, “এই যে--”

ফুলকাকা বলল, “মশাই এতক্ষণে আপনার চা আনবার সময় হল? উঃ, এই চায়ের জন্য বসে থেকে থেকে----"

“চা খাওয়াচ্ছি তোমাদের! আসুন স্যার। এই যে, এখানে এদের পুরো গ্যাংটাকে প-প-প্রাণের মায়া না করে আটকে রেখেছি।” এই বলে চেকার সাহেব পেছন দিকে ঘুরে কাকে যেন ইশারা করলেন। অমনি, তার পাশ দিয়ে খাকি কাপড়ে ঢাকা বিরাট একটা ভুড়ি এসে ঢুকল কুপের ভেতরে। ভুড়ি ভেতরে এসে গর্জন করলেন, “ উইটনেস!” অমনি আর একটা পুলিশের হাত ধরে গম্ভীর মুখে শিবু এসে ভেতরে ঢুকল। তাকে দেখেই ফুলকাকা অবাক হয়ে বলল, “শিবু, তুই, ----”

মোটা পুলিশ গম্ভীর হয়ে বলল, “তাহলে বোঝা যাচ্ছে তোমরা এই ছেলেটাকে চেন।”

“চিনব না মানে? ওরকম হাড় বজজাত ছোকরা--”

ফুলকাকাকে থামিয়ে দিয়ে পুলিশ এবারে শিবুকে নিয়ে পড়ল-- “ তুই এদের সঙ্গে কতদিন আছিস?”

“কাকার সঙ্গে অনেকদিন”, শিবু ফুলকাকাকে আঙুল দিয়ে দেখাল, “আর বাকিদের সঙ্গে এই প্রথম।”

“হুম। এদের দলের পাণ্ডাটা কোনজন?”

শিবু আঙুল দিয়ে আবার ফুলকাকাকে দেখাল। ফুলকাকা কী যেন বলতে উঠছিল, ওমনি দুপাশ থেকে দুজন পুলিশ হাত মুচড়ে ধরে আবার বসিয়ে দিল। শিবু সেদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। এবারে ফুলকাকার রাগটাগ চলে গিয়ে বেজায় ভয় পেয়ে গেছে। শিবুকে ইশারায় ব্যাপারটা কী তাই জিজ্ঞেস করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু চেকারমশাইয়ের নজরে পড়ে যাওয়ায় সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় মুশকিল হচ্ছে যে তাকে কেউ মোটে কথা বলতে দিচ্ছে না। এই ফাঁকে বনমালী চুপি চুপি খাবারের পোঁটলাটা সরিয়ে ফেলবার মতলব করছিল, কিন্তু ভুড়িওয়ালা পুলিশের সেটা চোখে পড়ে যাওয়াতে “হল্ট” বলে এমন জোরে চেঁচাল যে বনমালীর পোঁটলা ধরা হাত আপনি মাথার ওপরে উঠে গেল। শিবু তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে পোঁটলাটা কেড়ে নিয়ে নিজের কাছে রাখল। পরে কাজে লাগবে। একটা ঝোলা গোপওয়ালা পুলিশ, মাংসের ঝোলের গন্ধ পেয়ে পোঁটলার দিকে লোভী লোভী চোখ করে চেয়ে ছিল, শিবু কটমট করে তাকাতে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। পুলিশ সায়েব শিবুর দিকে চেয়ে বললেন, “এরাই তোর সেই দলবল নাকি?”

“হ্যাঁ।”

ফুলকাকা এতক্ষণে ধাক্কাটা সামলে নিয়ে একটু একটু মুখ খুলছিল, “ মা-মানে আ-আমরা--”

তাকে থামিয়ে দিয়ে চেকারবাবু বললেন, “থাক, আর বলতে হবে না। আমরা সব জানি। তোরা লালবাগে যাচ্ছিলি, তাইতো?”

“হ্যাঁ।”

“সঙ্গে যন্ত্রপাতি আছে?”

“হ্যাঁ।”

ভুঁড়ো পুলিশ গোঁফ চুমড়ে বলল,“বাঃ, বাঃ, একেবারে বমাল সমেত গ্রেফতার! কোথায় রেখেছ সবকিছু বলতো বাপধন!”

ফুলকাকা নফরচাঁদের দিকে তাকাতেই সে আঙুল দিয়ে সীটের তলাটা দেখিয়ে দিল। দুটো রোগা পুলিশ উপুড় হয়ে শুয়ে সেখান থেকে সবকিছু টেনে টেনে বার করে এনে তারপর তাদের চেহারা দেখে বলে উঠল,“সার, এ তো ঠিক বন্দুক টন্দুক বলে --”

এইবারে ফাঁক পেয়ে ফুলকাকা কাতরে উঠল, “বন্দুক টন্দুক কোথায় পাব সার! ও তো জরিপের যন্ত্রপাতি!”

“মানে?”

“মানে, আমরা তো অপারেশান বর্গার জরিপের কাজ করতে যাচ্ছিলাম, লালবাগে। মধ্যে থেকে আপনারা হঠাৎ এসে---”

অমনি শিবু বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, কাকা তো ওই কাজই করে। সেই কথাই তো চেকারসাহেবকে বলেছিলাম, অপারেশন বর্গমূল করতে দলবল, যন্ত্রপাতি নিয়ে লালবাগে যাচ্ছে। তা উনি তাই শুনে আমায় আটকে রেখে পুলিশ ডেকে আনলেন।”

চেকারসাহেব একটা ক্ষীণ চেষ্টা করেছিলেন--“কিন্তু সরকারী কাজে যাবে তো সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে নিয়ে বাথরুমের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল কেন জিগেস করুন সার--”

তার উত্তরে শিবুই বলে দিল, “ আমি কাকার সঙ্গে আসিইনি। আমি তো সংসারত্যাগ করেছিলাম। কোনদিকে যাবো সে রাস্তাঘাট কিছু চিনি না বলে ফুলকাকা যখন বার হলো ওদের পিছু পিছু এসেছি।”

***

সব কিছু মিটে গিয়ে ট্রেন কৃষ্ণনগর ছাড়তে ছাড়তে রাত এগারোটা বাজল। ফুলকাকার এখন বাড়িতে ফিরে শিবুকে পৌঁছে দিয়ে আসবার উপায় নেই। সরকারের কাজ বাকি পড়ে আছে। কাজেই শিবু সঙ্গে চলেছে। লালবাগে পৌঁছে বাড়িতে খবর পাঠালে কেউ এসে নিয়ে যাবে। ফুলকাকা এবারে একটু ধাতস্থ হয়ে আরাম করে শিবুর কানদুটো মলতে মলতে জিজ্ঞাসা করল, এইবারে, মেরে হাড়গোড়গুলো গুড়িয়ে দেবার আগে বলে নে, বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিস কেন?”

শিবু বলল, “সেই যে আমায় মেরেছিলে, মনে নেই? সেই জন্য।”

“তাই বলে, তাই বলে---"

“ও ফুলকাকা,কানদুটো ছাড়ো না, বড্ড লাগছে--- উঃ! তাহলে কিন্তু আবার----"

ফুলকাকা তাড়াতাড়ি কানদুটো ছেড়ে দিয়ে দু’হাত দূরে সরে বসল। এ ছেলে সব পারে। আবার যদি ট্রেন ছেড়ে কোনদিকে রওনা দেয়, তবে কাজকর্ম সব মাথায় উঠবে। শিবু আড়চোখে ফুলকাকার মুখটা দেখছিল। ওষুধে কাজ হয়েছে মনে হয়। এবারে লুকিয়ে রাখা খাবারের পোঁটলাটা বার করে এনে মিচকি হেসে বলল, “ও ফুলকাকা, খিদে পেয়ে গেল যে । খাবে না?” ফুলকাকা যেন হাতে স্বর্গ পেল, “তুই এটা কোথায় পেলি?”

“হুঁ হুঁ, ভিড়ভাট্টায় পাছে হারিয়ে যায় তাই যত্ন করে কাছে রেখে দিয়েছিলাম তোমার জন্য।”

“সোনা ছেলে। চল তোকে কাল সকালেই লালবাগের কাটরা মসজিদ দেখাতে নিয়ে যাবো।”

সাতদিন পরে বাবার হাত ধরে শিবু বাড়ি ফিরে এল। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে বাড়ি ফেরার পর কোন গুরুজনই সেবার আর শিবুর কানদুটোর খোঁজ করতে আসেনি।