বাস্তবসম্মত - ধূপছায়া মজুমদার

হাসির গল্প

।।১।। (ধরে নাও এসব 'গৌরচন্দ্রিকা')

 

সরসতা নাকি ছড়িয়ে রয়েছে দশ দিকে, কেবল কুড়োতে জানলেই হলো। তা, সে জিনিস কুড়োনোর কি স্পেশাল কোনও যন্তর পাওয়া যায় বাজারে? নইলে সংসারের গোড়ায় সারবস্তু জুগিয়ে সংসারের চাকা সচল রাখতে রোজ ভোররাত থেকে মাঝরাত পর্যন্ত যে উস্তুমকুস্তুম লড়াইটা লড়ে যেতে হয় সত্যসাধন দত্তকে, তার মাঝে সরসতা দেখাই বা দেবে কখন, আর ধরাই বা দেবে কখন?

সারাদিন চোখের মাথা খেয়ে দুটো পাবলিশারের অফিসে প্রুফ দেখে আর সন্ধেবেলা দু'বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি ফিরে তাঁকে শুনতে হয় গিন্নির পান্তা ফুরোনোর রোজনামচা, রুটি আর সয়াবিনের বড়ির তরকারি খেতে খেতে বুঝতে হয় বড়মেয়ের বয়সের কমাবাড়ার জটিল হিসেবের অঙ্ক। হিসেবটাকে আরেকটু জটিল না করে তুললে মিনিমাম পণে মেয়ে পার করা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। ছোটটা এখনও কন্যাশ্রীর আওতায় আছে, যদ্দিন থাকে তদ্দিনই লাভ। নিজের মেয়েদের ব্যাপারে এমন ভাবা অন্যায়, তা সত্যসাধন নিজেও জানেন, তবুও ভেবে ফেলেন। কী করবেন, এই ক'টা টাকায় আর ক'দিন চলবে?

 

তবুও, রোজকার এই নানাবিধ ঝামেলার মধ্যেও একখানা গোপন ইচ্ছে সত্যসাধনের মনে ঘাই মারে নিরন্তর। সেই গোঁফ বেরনোর বয়েস থেকে মনের কোণে লালন করা সে ইচ্ছে। বছরকয়েক আগে একবার এক দুর্বল মুহূর্তে নিত্যদিনের ওঠবসের সঙ্গিনী ধর্মপত্নীকে বলে ফেলেছিলেন স্বপ্নটার কথা, শুনে সে মহিলা এমন চোখে তাকালেন, যেন তিনি ভিনগ্রহের কাউকে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখতে চাইছেন। চিন্তায় ঘুম হয়নি সারারাত, কী জানি, প্রলাপ বকার শাস্তি হিসেবে পরদিন থেকে হয়তো আলাদা ঘরে শোয়ার বন্দোবস্ত হবে! আর কিছু না, মাঝরাতে জলতেষ্টা পেলে এই বয়সে নিজে উঠে জল গড়িয়ে খাওয়ার বড় হ্যাপা। কনুইয়ের আওতায় পাশের মানুষটাকে পেলে একটা ঠেলাতেই কাজ হয়ে যায় তো, অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে তাই। যাইহোক, সেবারে জল অদ্দূর গড়ায়নি, তবে তিনি সাবধান হয়ে গেছেন। তাঁর নিজের নেশা, নিজের স্বপ্ন, নিজের কাছেই থাকুক, আর কারও জেনে কাজ নেই।

 

তবে স্বপ্নটা তিনি রোজ দেখেন। প্রকাশক আর খবরের কাগজের অফিসের লোক একহাঁড়ি মিষ্টি আর একখানা উত্তরীয় নিয়ে তাঁর বাড়ি আসছে সুখবরটা দিতে, সাহিত্যিক সত্যসাধন দত্ত এবারের সাহিত্যশিরোমণি পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁর প্রথম উপন্যাসের জন্য, তাঁর সাক্ষাৎকার দেখতে পাড়ার লোকে ভিড় করে এসেছে, গিন্নি একখানা জরিপাড় শাড়ি পরে তাঁর পাশে বসে আছেন আর পতিগরবে গরীয়সী হয়ে উঠছেন, এমন স্বপ্ন সত্যসাধনের শয়নে জাগরণে ফিরে ফিরে আসে। বলা যায় এই স্বপ্নটাই তাঁকে অহরহ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। নইলে বইপাড়ার কোন হেঁজিপেঁজি পাবলিশারের চুনোপুঁটি প্রুফরিডার সত্যসাধন দত্তের অবসর সময়টুকু ভবিষ্যতের কন্যাদায়ের চিন্তাতেই ঘেমেনেয়ে উঠতো। এই শখ আর স্বপ্নটুকু আছে বলেই তিনি নিশ্বাস নিতে পারেন।

 

রোজ রাতের খাওয়া ধোয়াপাকলার পর্ব চুকিয়ে ঘরে গিয়ে গিন্নি বালিশে মাথা রাখতেই ঘুমিয়ে পড়েন, ওঘরে দুই মেয়ের সাড়াশব্দও আস্তে আস্তে থেমে যায়। এরপরই সত্যসাধন তাঁর বালিশের খোলের ভেতর থেকে কাগজের তাড়া বের করে তুলো ঝেড়ে বসার ঘরে এসে বসেন। এইসময় যদি গিন্নি কোনওদিন তাঁকে দেখতে পেতেন, তবে তাঁর একটা জিজ্ঞাসা মিটতো। রোজ সকালে উঠে বিছানাবালিশ ঝাড়াঝুড়ির কাজটা সত্যসাধন অত্যন্ত যত্ন নিয়ে করে থাকেন, কাউকে হাত লাগাতে দেন না। এ নিয়ে গিন্নির অনেকদিনের কৌতূহল। তা যাকগে, কত লোকে তোষক বালিশের মধ্যে তাড়া তাড়া নোট পুষে রেখে বিখ্যাত হয়ে গেল, আর সত্যসাধন ক'দিস্তে গপ্প কোবতে লেখা কাগজ রাখতে পারবেন না? গান্ধীছাপ না থাকলেই কি কাগজ মান হারায় নাকি?

 

যা বলছিলাম, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, বসার ঘরের মেঝেতে বসে, কিংবা আধশোয়া হয়ে বুকের নিচে বালিশ রেখে শুরু হয় সত্যসাধনের সাহিত্যচর্চা। এই আধশোয়া হয়ে লেখালিখির ব্যাপারটাকে খুব একটা উঁচু নজরে দেখেন না তিনি, নিজেরই স্বভাব যদিও, তাও। সেই সত্যজিৎবাবুর চারুলতায় বোধহয় দেখেছিলেন চারু আধশোয়া হয়ে সাহিত্যচর্চা করতো। সেই থেকেই ধারণা হয়েছিল লেখাপড়ার এই ভঙ্গীটি কিঞ্চিৎ নারীসুলভ, বুকের নিচে বালিশ নিলে তো হয়েই গেল, রাঙা চরণযুগলের খুনসুটি আর নুপূরনিক্কণেরই যা অভাব কেবল! তবে ভঙ্গীখানা বড় আরামের, সারাদিন ঘাড় গুঁজে প্রুফ দেখার পর এইভাবে আধশোয়া হয়ে এক চোখে স্বপ্ন দেখা আর এক চোখে সাধনার মজাই আলাদা। কতদিন যে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি! তারপর শেষরাতে মশার কামড়ের চোটে ঘুম ভেঙে ঘরে গিয়ে শোন।

 

এপর্যন্ত চলছিলো ভালোই, চেনাপরিচিতদের মধ্যে ছোটখাটো পত্রিকায় লেখা পাঠাচ্ছিলেন, একটা দুটো করে গল্প ছাপাও হচ্ছিলো, সমস্যা শুরু হয়েছে ইদানীং। ইস্কুলে তাঁদের জুনিয়র ছিল দেবাশিস অধিকারী, তার খুড়তুতো ভাই শিবাশিস একটি পত্রিকা চালায়। চেয়েচিন্তে আর নিজের গাঁটের কড়ি খরচা করে পত্রিকা ছাপিয়েই চালাতে হয়, কেনে না কেউই বিশেষ, যারা লেখা পাঠায় তারাও সৌজন্য সংখ্যা ছাড়া আর একটা কপিও নেওয়ার আগ্রহ দেখায় না। ছাপার অক্ষরে নাম বেরিয়েছে, ব্যস, ফ্রিতে পেলে একরকম, বাড়ির শোকেসে রাখা যায়, কিন্তু তার বেশি খরচা করতে সবাই চান না। যাকগে, সে যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখন কথা হলো, সেই শিবাশিস তার পত্রিকার প্রচার বাড়ানোর জন্য ভেবেছে পরের সংখ্যাটা হাসির গল্প স্পেশাল বের করবে। 'হাসতে থাকুন, সুস্থ থাকুন' ক্যাম্পেন আজকাল বেশ ইন, কিন্তু হাসির বিষয়বস্তুর নাকি বড় অভাব, তাই গপ্পেটপ্পে যদি হাসির কিছু পায় মানুষ, টি আর পি, থুড়ি বিক্রি একটু বাড়তেও পারে, এইই আশা সম্পাদকের। সত্যসাধন মোটামুটি তার চেনা গণ্ডির মানুষ, তাই তার সনির্বন্ধ অনুরোধ, একটা নির্মল হাস্যরসাত্মক গল্প তাঁকে লিখে দিতেই হবে পরের সংখ্যার জন্য।

 

সত্যসাধন পড়েছেন মহা মুশকিলে। এমনিতে হয়তো এদিক সেদিক খামচে নিংড়ে একশিশি হাস্যরস জোগাড় করে ফেলতে পারতেন, কিন্তু ওই সনির্বন্ধ অনুরোধের ঠেলাটাই ঝামেলায় ফেলেছে। যা সহজলভ্য, না চাইতেই এসে ধরা দেয় সৃষ্টির আপন খেয়ালে, তাকে মন দিয়ে চাইতে গেলে সে যে এমনধারা লুকোচুরি খেলতে শুরু করবে, তা ঠিক আগে বোঝা যায়নি। বাজার করার বেলায় দেখেছেন এমনটা হয়। গিন্নি যেদিন ফর্দে মোচা নারকেল লিখবেন, সেদিনই বাজার থেকে নারকেল হাওয়া হয়ে যাবে, ভেটকি কিনলে সেদিন আর ফুলকপি পাওয়া যাবে না, পুঁইডাঁটা কিনে ফেলে কুমড়োর দেখা মেলা দুষ্কর হয়ে উঠবে। ঠিক সেই ফর্মূলাতেই, যখন হাস্যরসের অতীব চাহিদা দেখা দিয়েছে, অমনি পরিবেশ থেকে হাস্যরস এক্কেবারে উধাও হয়ে গেল। রোজকার খবরের কাগজে অবিশ্যি হাস্যরসের কমতি নেই, কেন্দ্র বলুন বা রাজ্য, রথীমহারথীদের মুখনিঃসৃত 'সিগনেচার' বাণীরাই বোধহয় ইদানীং হাস্যরসের মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, আম আদমির বেছে নেওয়া রথীমহারথীদের বাণী নিয়ে হাসির গপ্প লেখা তো আর আম আদমির এক্তিয়ারে পড়ে না! সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে চালকশক্তির রোষে পড়তে রাজি নন দুই মেয়ের বাবা সত্যসাধন। তাই হাসির গপ্প লিখতে বসে বারেবারে তিনি হোঁচট খাচ্ছেন, হতাশায় ঘুমিয়ে পড়ছেন, আর ঘুম ভেঙে অপরাধবোধে ভুগছেন।

 

।।২।। (এই আমাদের গপ্প হলো শুরু)

 

“সত্য, ও বাবা সত্য? আরও ঘুমোবি?”

“উঁ? আর একটু।”

“দ্যাখো ছেলের কাণ্ড! এ নাকি নবেল লিখবে, গলায় উড়নি ঝুলিয়ে স্টেজে উঠবে পেরাইজ নিতে! দুটো ঘণ্টা চোখ খুলে রাখতে পারে না, বড় বড় স্বপ্ন দ্যাখে! হ্যাঃ!”

এক ঝটকায় ঘুমটা কেটে গেল। কে ডাকল? কে বলল কথাগুলো? কথা বলার ধরনটা খুব চেনা, অনেকদিন আগে কে যেন এরকম করে বকতো তাঁকে। মনে করতে পারছিলেন না সত্যসাধন। ঘড়িতে চোখ পড়ল, পৌনে দুটো। লজ্জা করল নিজেরই, সত্যিই, দুটো ঘণ্টাও চোখ খুলে রাখতে পারেননি। এভাবে তিনি কীভাবে লেখা নিয়ে স্বপ্ন দেখা পথে হাঁটবেন? লেখা বলতেই মনে পড়ল, ধ্যাত্তেরি, হাসির গল্পের কী যে হবে! পেন আর কাগজ নাড়াচাড়া করতে করতে জোর করে দু'লাইন লিখলেন, কাতুকুতু বুড়োর কবিতার মতো লাগল পড়ে। আরও দু'লাইন এগোতে না এগোতেই চোখ বুজে এল আবার, খুলতে চেয়েও পারলেন না। কানে ভেসে এল একটু আগের সেই চেনা গলাটা,

“সতে, তোর আক্কেল বলে এই বয়সেও কিস্যু হলো না, না?”

“অ্যাঁ? কী হয়েছে টা কী? একটু ঘুমোতেও দেবে না?”

“ঘুমো। আর ওই ছেলেটা যে বসে আছে, গপ্প দিবি বলে আশা দিয়ে রেখেছিস, তার কী হবে?”

“আশাই তো দিয়েছি, টাকা তো নিইনি, বলে দেব পারিনি লিখতে।”

“চেষ্টা করেছিস লেখার? রোজ বসিস আর ভাবিস, হচ্ছে না, পারছি না! এই তো ঢংয়ের চেষ্টা! এতেই এত গুমোর! আশা দেওয়া আর টাকা নেওয়াকে একাক্কার করে ফেললি! এমন শিক্ষে আমি দিয়েছি বলে তো মনে পড়ে না।”

“এই তুমি কে বলো তো? তখন থেকে বাতেলা ঝেড়ে কানের পোকা নড়িয়ে দিচ্ছ!”

“কানের নয় রে ছোঁড়া, মাথার। কানে তুই কিস্যু শুনতে পাচ্ছিস না। অত ঘুমোলে এরপরে জেগেও কিছু শুনতে পাবি না আর। নমিতার গলা সাধা মাঠে মারা যাবে!”

এই সময়টায় ঘুমের ঘোরটা কাটে সত্যসাধনের। সত্যিই তো! ঘুমের মধ্যে তো কানে তেমন পষ্ট শোনা যায় না। তাহলে কথাগুলো কি স্বপ্নে শুনছিলেন? তখন থেকে কে রে বাবা এই মহিলা তাঁর নাড়িনক্ষত্রের খোঁজ রাখছেন আর ঘুম এলেই টিকিতে টান মেরে ডেকে দিচ্ছেন? শিবাশিস কাউকে ফিট করল নাকি গপ্প আদায়ের জন্য? মহা ধড়িবাজ ছোকরা তো!

 

ঘুমের ঘোরে সত্যসাধন ভাবতে ভুলে যান শিবাশিস তার পকেট ভেঙে চালানো পত্রিকার লেখা আদায়ের জন্য কাউকে ফিট করার মতো বড়সড় হ্যাপা কেন নেবে, আর নিলেও সেই ভাড়াটে স্পাই সত্যসাধনের স্বপ্নের মধ্যে কেমন করে ঢুকে পড়বে!

পরেরদিন সকালেই শিবাশিসকে ফোন করে আচ্ছাটি করে ঝাড়তে হবে, ওসব লেখাফেখা দিতে পারবেন না জানিয়ে দেবেন, দুটো পয়সাও তো ঠেকাবে না! এদের জন্য খেটে হবেটা কী? এসব ভেবে রাগটা একটু কমলো। চোখ জুড়ে এল আবার, আর সেইসঙ্গে ফিরে এল সেই হস্টেল সুপারের মতো মহিলাকণ্ঠও।

“বা বা বা! সরস্বতীর বরপুত্র হওয়ার মতোই চিন্তাভাবনার গতি বাছা তোমার! এমন চিন্তাধারা নিয়ে এগোলে নোবেল পেয়ে যেতে পারো!”

“আবার এসছেন মাসীমা! প্রব্লেমটা কী বলুন তো আপনার?”

“আগে তুই বল তোর কি টাকার খুব দরকার? নইলে দু'পাতা লিখে দেওয়ার জন্য টাকার কথা অত ভাবছিস কেন?”

“টাকার তো দরকার সবসময় থাকে মাসীমা, দরকার মতো জুগিয়ে দিচ্ছে কে বলো তো? আর দু'পাতা লিখতেও তো মাথা ঘামাতে হয়, সে ঘামের দাম চাওয়া কি খুব অন্যায়?”

“তা অন্যায় নয়, তবে সে ছেলেও তো শুনলাম ব্যাঙ্কের খাতা ভাঙিয়ে বই ছাপায়, তোর কত অখদ্যে লেখাও নাকি ছেপেছে! এখন তার দিকটা তোরা না দেখলে কে দেখবে? তোরা না সাহিত্যসেবী! সরস্বতীর ছাত্তর সব?”

 

“অখদ্যে লেখার কথা কে বলল তোমায়?”

এতক্ষণ স্বপ্নে শুনছেন ভেবে ঘুমের ঘোরে বকে যাচ্ছিলেন সত্যসাধন, টনক নড়ল আরেকবার। বারদুয়েক নিজেরই বেশ অপছন্দের লেখা পাঠিয়েছেন শিবাশিসকে, কাজটা ঠিক হয়নি ভেবে কুণ্ঠিতও হয়েছেন, কিন্তু যথাসময়ে দেখেছেন পত্রিকায় লেখাগুলো ঠিকই ছেপে বেরিয়েছে। সত্যি বলতে কী, একমাত্র শিবাশিসই তাঁর কোনও লেখা কখনও ফেরত পাঠায় না। কিন্তু সেসব কথা ইনি জানলেন কেমন করে?

 

“খুলে বলুন তো মাসীমা, আপনি কে? স্বপ্নের ভেক ধরে অনবরত মাথার মধ্যে নড়ে চলেছেন, বিবেকটিবেক নাকি?”

 

অখদ্যে লেখার ব্যাপারটা মাসীমা বলে দেওয়ার পর থেকেই বিবেকের কনসেপ্টটা মনে পড়েছে সত্যসাধনের।

 

“না রে মুখপোড়া, বিবেক কেন হতে যাব? সে ছোঁড়াকে আজকাল আর দেখা যায় নাকি? গাঁয়ের যাত্রাপালাতেও আজকাল আর সে আসে না, দেশান্তরী হয়েছে নিশ্চিত।”

“তবে তুমি কে?”

“আমি বীণাপাণি সরস্বতী।”

“ক্কেঃ?” নিজের কথা গলায় জড়িয়েই বিষম খেলেন সত্যসাধন। যদিও বিষমটাও স্বপ্নে খেলেন, নাকি বাস্তবে, বুঝে উঠতে পারলেন না।

“ক্যান রা? আমি সরস্বতী হতে পারি না?”

“না, মানে, একটু স্নিগ্ধ কিছু ইয়ে থাকলে তাও...”

কথা শেষ করতে দিলেন না সেই মহিলাকণ্ঠ,

“হ্যাত্তেরি তোর স্নিগ্ধ! সরু কোমর, ফিনফিনে শাড়ি, দুধসাদা গায়ের রঙ, মোমের আঙুলে কায়দা করে বীণা ধরে আছে, মুখ খুললে মধু ঝরে, এমন কিছু না হলে তোদের মন ওঠে না, না রে? আবলুশকাঠ গায়ের রঙ, চিনির বস্তার মতো কোমর, পাড়ছেঁড়া ন্যাতানো শাড়ি, ফাটা কাঁসরের মতো গলার আওয়াজ, আমি এমনটা হলে আমায় আর পুজো করতে পারবি না, না?”

“আহ্ মাসীমা, সেসব নয়, ওর'ম তুলনা করছি না। সে তো কত মেয়েই আছে, দেখতে শুনতে অতি সাধারণ, কিন্তু লেখাপড়ায় কাজেকর্মে দিগ্বিজয়ী। চেহারা দিয়ে কি সবটা বিচার করা যায়? কিন্তু মা সরস্বতী কি মানুষের ঘুমের মধ্যে মাথার ভেতরে থানা গেড়ে বসেন? নাকি এমনভাবে প্রতিটি কাজের খুঁত ধরে চলেন?”

এবার হেসে উঠলেন মাসীমা, কিংবা দেবী সরস্বতী।

“খুঁত ধরব না তো কী রে মুখপোড়া? এই তো সব কাজের ছিরি! একটা ছেলে ভক্তিভরে আমার আরাধনা করে চলেছে, তাকে তোরা দুটো লেখা দিয়ে উবগার করতে পারছিস না! সবেতে অত টাকা টাকা করে কী হবে রে বাপ, সঙ্গে নিয়ে তো যাবি না!”

 

“নিয়ে যাব না মাসীমা, ইয়ে, মা, কিন্তু মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য তো টাকাপয়সা দরকার। এভাবে ঘাড় গুঁজে শরীর পাত করে ক'টা টাকা আসে বলো তো?”

“সে সব বিধাতা লিখে রেখেছেন রে পাগলা! কত আসবে, কত যাবে, কত জমবে, সব হিসেব তার খাতায় কষে রাখা আছে। এতটুকু বাড়তি নিতে পারবি না, হাত গলে জল বেরিয়ে যাবে।”

 

“মা গো, একটু প্রশ্ন ছিল।”

“করে ফ্যালো।”

“এই যে, বিদ্যা বিনয় দেয়, বিদ্যার পূজারী হলে ধনকামনা না করলেও চলবে, বিদ্যাই শ্রেষ্ঠ ধন, এইসব থিওরিগুলো কি তোমার ইস্কুলের সিলেবাসে ছিল? তারপর ধরো, আমাদের সাহিত্যিকদের এমন হাঁড়ির হাল কেন বরাবর? তাবড় তাবড় লেখকদের নুন আনতে পান্তা ফুরনো নিয়ে কম গল্প চালু আছে নাকি!”

 

“বিদ্যা বিনয় দেয়, বিনয়ে পাপোশ ব'নে যেতে বলে না। বিদ্যা বিবেচনাশক্তিও দেয়, সেই শক্তি বুঝে নেয় ঠিক কতটা ধনকামনা করা সঙ্গত। আর হাঁড়ির হাল বলছিস? সে কার দোষ? মাথা ঘামিয়ে লিখবি, আঁকবি তোরা, তার ন্যায্য দাম বুঝে নেওয়ার জন্য ঠিক জায়গায় মুখ খুলতে পারবি না! তখন বিনয়ের পাপোশ এসে মুখে চেপে বসবে! পাপোশ পেলে তো লোকে পা মুছবেই, গপ্পের বই দিয়ে ঠোঙা হবেই।”

 

“যাকগে, মা, এসব ছাড়ো, এসেছোই যখন, এই অবোধকে একটুকু দয়া করো মা গো! কলমে একটু ধার দাও, ভাববার শক্তি একটু বাড়িয়ে দাও।”

বলতে বলতে গলা ধরে এল সত্যাসাধনের, চোখের কোণে একফোঁটা জলও চলে আসছিল, পুরুষমানুষ বলে সামলে নিলেন।

“ব্যস, শুরু হয়ে গেল। ঘোড়া দেখলেই খোঁড়া হয় এরা সব! অ্যাদ্দিন বেশ চলছিল ভোঁতা কলম আর শক্তিহীন ভাবনা নিয়ে, যেই আমায় দেখল, অমনি চামচে করে গিলিয়ে দেওয়ার আব্দার! আমার ধার দেওয়া কলম দিয়ে বই লিখলে আমার নাম দিবি তাতে?”

“এমনভাবে বোলো না মা, কৃতজ্ঞতা স্বীকারের কলামে তোমার নাম থাকবে। আচ্ছা বেশ, উৎসর্গের পাতাতেও তোমার নাম দেবো, দাও না মা গো একটুখানি আশীর্বাদ!”

 

“এ কি তোদের বিগবাজারের দিওয়ালি অফার নাকি রে ছোঁড়া? নাকি আমায় ঘুষ দেখাচ্ছিস? ওই উৎসর্গের পাতায় নামটুকুর লোভেই তো আদ্যিকাল থেকে এত হ্যাপা সামলাচ্ছি, তাই না? দু'দিনের ছেলে, নাক টিপলে দুধ বেরোয়, উৎসর্গের উৎকোচ দিতে এলে বাপ? আস্পদ্দা কম নয়!”

 

বাবা রে বাবা! এ কেমন দেবী সরস্বতী? চিরকাল জেনে এসেছেন মা সরস্বতী জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, যথেষ্ট ব্যক্তিত্বময়ী, অথচ স্নিগ্ধ, নম্র। এই মাসীমার ব্যক্তিত্বে তো মধ্যাহ্নের খরতাপ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই! তবে আর বেশি কিছু ভাবা উচিত হবে না, মাথার মধ্যেই তো বাসা বেঁধেছেন ভদ্রমহিলা, মনের কথা বুঝতে পারবেন নিশ্চয়ই। ভাবতে না ভাবতেই খুক খুক করে হাসির আওয়াজ পেলেন সত্যসাধন।

“থাক বাপ, আর ভেবে কাজ নেই। আশা করে আছিস, হাত জোড় করে বোস, বরটর দিয়ে বাড়ি যাই, তুইও ঘুমো, রাত হলো অনেক। সকালে তো আবার সেই ঘাড় গুঁজতে বেরুনো। এদের মায়ায় জড়িয়েই আমার দিন গেল রে! জ্বালা যত!”

 

।।৩।। (নটেগাছটি মুড়োক তবে)

 

ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে সত্যসাধন আরও একবার হতাশ হলেন, যেমন রোজ হন। কালকেও একটা পাতাও লেখা শেষ না করে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কাল কোনও স্বপ্ন দেখছিলেন কি? আবছা মনে পড়তে লাগল। গুপীবাঘার সেই ভূতের রাজার বরের মতো কিছু দেখেছেন বোধহয় স্বপ্নে, মা সরস্বতী এসেছিলেন না কী যেন বেশ। স্পষ্ট করে কিছু মনে পড়ে না তাঁর। স্বপ্ন ভেবে নষ্ট করার মতো সময়ও অবিশ্যি তাঁর হাতে নেই। দ্রুতহাতে খাতা কাগজের তাড়া বালিশের খোলে ভরতে শুরু করেন। আরেকটা দিন শুরু হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি।

 

বন্ধুরা, প্রশ্ন জাগছে কি মনে? ভাবছেন কি, আমাদের গল্পের নায়ককে মা সরস্বতী সত্যিই কোনও বর দিলেন কি না? পুরাণের গপ্পের বাইরে আজও এসব বরদানের ঘটনা ঘটে কি না? এত তাড়াতাড়ি সেরকমভাবে কোনও বরলাভের এফেক্ট বোঝা যায় না যদিও, তবে আপনারা লক্ষ রাখবেন নিয়মিত। নামটা তো জানেনই, সত্যসাধন দত্ত, হাতের কাছে চেনা অচেনা কম চেনা সবরকম পত্রপত্রিকা পেলেই একটু কিনে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখবেন এমন নাম চোখে পড়ে কি না, এমন নামকে ঘিরে কোনও মিরাকল চোখে পড়ে কি না। বরলাভের সৌভাগ্য কখন যে কার কপালে লেখা হয়ে যায় কে তা বলতে পারে!