গোবিন্দগড়ের রাজামশাই - সুস্মিতা কুণ্ডু

হাসির গল্প

অলংকরণ : সুমিত রায়

রাজামশাইয়ের মন খারাপ। খারাপ মানে খুউউউব খারাপ, বেজায়রকমের খারাপ। যেরকম খারাপ হলে নলেন গুড়ের রসগোল্লাও মোটে ন‘টা খেয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে যেতে হয় কিংবা ধরো রানিমা পাতে পাঁঠার কালিয়ার বদলে মুর্গির ট্যালট্যালে ইস্টু না কী যেন দিলেও রাজমাতার কাছে গিয়ে নালিশ করতে ইচ্ছে করে না, ঠিক সেই রকম মন খারাপ রাজামশাইয়ের। আর হবে নাই বা কেন? রাজ্যের রাজার নাম যদি দোলগোবিন্দ হয় তাহলে একশবার মন খারাপ হওয়া উচিত! শুধু রাজা কেন রাজ্যশুদ্ধু প্রজার মন খারাপ হওয়া উচিত। রাজামশাইয়ের ইচ্ছে করে তক্ষুনিই রাজসভায় গিয়ে ঘোষণা করে দেন ‘গোবিন্দগড় রাষ্ট্রীয় শোকদিবস’ আগামী তিনদিন। নেহাতই মনটা বেজায় খারাপ তাই আবার কষ্ট করে ধড়াচূড়ো পরে মুকুট মাথায় দিয়ে বেরোতে আলিস্যি লাগছে। মন খারাপের সাথে গা ম্যাজম্যাজের একটা বেশ গূঢ় রকমের যোগসাজশ আছে নির্ঘাৎ। দু’জনেই একসাথে হামলা করে। এই ব্যাপারটা নিয়ে একবার মন্ত্রীমশাইয়ের সাথে আলোচনা করলে হয়।

মন্ত্রীমশাইয়ের নামটা মনে আসতেই ফের ফোঁসস করে এক ক্রোশ লম্বা দীর্ঘশ্বাস পড়ল রাজামশাইয়ের। যে রাজ্যের রাজার নাম দোলগোবিন্দ সেই দেশের মন্ত্রীর নাম কিনা রুদ্রপ্রতাপ। এর থেকে অশৈলী ব্যাপার দুনিয়ায় আর আছে! অ্যাঁ! গোটা গোবিন্দগড়ে আর কেউ আছে যার নামখানি রাজামশাইয়ের নামের মত এত হেলাচ্ছেদ্দার! ছ্যা ছ্যা! এমন রাজামশাইকে লোকে মাণ্যিগণ্যি করবে কক্ষণও! ওইজন্যই যখন কালকের বিচারসভায় ডাকাতসর্দার নরসিংহকুমারকে সাতদিনের ফাঁসির সাজা শোনালেন তখন সে ব্যাটা ভিরমি খাওয়ার বদলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসেই গড়িয়ে পড়ল। কী লজ্জার কাণ্ড! বন্দী ডাকাতের নাম নরসিংহকুমার আর বিচারক রাজামশাইয়ের নাম দোলগোবিন্দ! ডাকাতের আর দোষ কী! হাসবেই তো! এমনকি ব্যাটা সেপাইটা যে বেয়াদপ ডাকাতটার পিঠে বল্লমের খোঁচা দিচ্ছিল সে অব্দি মোম দিয়ে পাকানো সূচালো গোঁফের ডগা নাচিয়ে মুচকি হাসল। তারও নাম তো জংবাহাদুর সিং।

উফফফ নিকুচি করেছে এই রাজ্যের। মাঝে মাঝে রাজামশাইয়ের ইচ্ছে করে সন্নেস নিয়ে হিমালয়ে চলে যাবেন। সন্নেস নিলে নাকি গৃহী জীবনের নামধাম সব ত্যাগ করে নতুন নাম নিতে হয়। রাজামশাই মনে মনে একটা নাম ভেবেও রেখেছেন, উজ্জ্বলানন্দ পরমহংস। নতুন নাম হবে ভাবলেই রাজামশাইয়ের মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কিনা। কিন্তু সন্নেস নেওয়া বড় কষ্টের। ঠাণ্ডায় বরফে বসে শুধুমাত্র কৌপিণ পরে তপস্যা করতে হবে। এরকম শিমূলতুলোর লেপমুড়ি তো স্বপ্ন। তার ওপর আহার! ফল মূল বাকল এইসব। চারবেলা লুচি ঘি পোলাও মাংস মাছ ছ্যাঁচড়া ঘন্ট শুক্ত পোস্ত পায়েস দই মিষ্টি সাঁটানো রাজামশাইয়ের এই নধর চেহারাখানি আর মুখখানি শুকিয়ে আমসি হয়ে যাবে তাহলে। উজ্জ্বলানন্দ থেকে সটান তিমিরানন্দ হয়ে পড়বেন সোজা। নাহ্! সন্নেস নেওয়ার মতলবও বাতিল। যদিও তিমিরানন্দও দোলগোবিন্দর চেয়ে ঢের ভালো নাম কিন্তু ওই কৃচ্ছ্রসাধন রাজামশাইয়ের সুখী শরীরের সইবে না।

মাঝেমাঝে বিশ্বসংসারের ওপর এইসান রাগ ধরে রাজামশাইয়ের! সবথেকে বেশি রাগ হয় স্বর্গতঃ পিতৃদেবের ওপর। তাঁর মাথাতেই ভূত চেপেছিল রাজ্যের নাম গোবিন্দগড়ের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম গোবিন্দ রাখার। শুধু গোবিন্দ বা গোবিন্দলাল এসব কিছু রাখলেও নাহয় কিছুটা মুখরক্ষা হত কিন্তু সেটুকু সৌভাগ্যও কি আর রাজামশাইয়ের কপালে জুটল! বাবা যখন নাম ভাবছেন ঠিক তখনই পুচকে ফোকলাদেঁতো নেড়ুমুণ্ডু রাজামশাই দোলনায় শুয়ে দোল খেতে খেতে খিলখিলিয়ে হাসছিলেন। তাই দেখে ওমনি তাঁর বাবা নামের আগে টপাং করে একটা দোল লাগিয়ে রাজামশাইকে সম্ভাব্য বিজয়কুমার জয়বর্ধন ইত্যাদি প্রভৃতি থেকে সোওওজা দোলগোবিন্দ বানিয়ে দিলেন। গোবিন্দগড়ের হবু রাজা শ্রীমান দোলগোবিন্দ।

এই নিয়ে বিয়ের সময়ও কী কম ঝক্কি গেল! আশেপাশের কোনও রাজ্যের রাজারাই গোবিন্দগড়ের দোলগোবিন্দ রাজার সাথে নিজের বিয়ে দিতে চান না। রাজমাতার তো দিনে দশটা করে রাজকন্যের ঠিকুজি কুষ্ঠী পড়ে পড়ে চোখে চশমা নিতে হল। বাবা বেঁচে থাকলে দোলগোবিন্দ নির্ঘাৎ একটা রাজদ্রোহ দেশদ্রোহ জাতীয় কিছু করে ফেলতেন কিন্তু নিজের রাজ্যে নিজেই আর কার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন! রাজমাতা তো শেষমেষ রাজকন্যের আশা ছেড়ে মন্ত্রীকন্যে সেনাপতিকন্যে এমনকি যে কোনও ভালো ঘরের লেখাপড়া জানা কন্যে পেলেই বর্তে যান এমন অবস্থা। এমন সময় দূররাজ্যের রাজকন্যে মহামায়ার সম্বন্ধ এসে উপস্থিত হল গোবিন্দগড়ে। রাজমাতা তো হাতে স্বর্গ পেলেন। ঠিকুজি কুষ্ঠীর ঠেলায় না গিয়ে, রাজামশাইকে বগলদাবা করে সোজা রাজকন্যে মহামায়ার রাজ্যে গিয়ে কনেকে আশীর্বাদ আর বিয়ে একইদিনে সেরে বৌমা নিয়ে ঘরে ফিরলেন।

রাজা দোলগোবিন্দর জীবনে যতকিছুই বাজে ঘটুক এই একটি কাজ বড় ভালো হল। রানি মহামায়া একদম অন্য ধাতের মানুষ। তিনি এইসব ছোটোখাটো নামবিভ্রাটকে মোটেই পাত্তা দেন না। উল্টে রাজামশাই মন খারাপ করলে বলেন,

-“আপনার নাম দোলগোবিন্দ না হয়ে বীরবর্মা বা বজ্রবাহু হলে কোন মহাভারতটা উল্টে যেত শুনি? নীল আকাশ লাল হত না নদী উল্টোপথে বইত? আজেবাজে জিনিসে মন না দিয়ে বরং এই বাদামের শরবতটুকু খেয়ে রাজসভায় যান দিকি শিগগির। মেলা কাজ পড়ে আছে।”

রানিমার বকুনি আর হাতের রান্না খেলে রাজামশাইয়ের মেজাজটা আবার শরীফ হয়ে যায়। মনে হয় যদি দোলগোবিন্দ না হয়ে অন্য নাম হত তাহলে রানি মহামায়ার সাথে বিয়েটা নাও হতে পারত। আগেই হয়ত আশেপাশের কোনও রাজকন্যের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যেত। হয়ত ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।

এমনিতে রানির হাতের রান্না খেয়ে মন ভালো হয়ে যায় বটে তবে এই বারটায় বড্ড বিগড়েছে মেজাজটা রাজামশাইয়ের। শেষে কিনা একটা ডাকুও অমনধারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে! নাহ্! মন্ত্রীকে ডাকতেই হচ্ছে এবার। একটা বিহিত দরকার। আরও কঠিন সাজা দিতে হবে নরসিংহ ডাকাতকে। মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢালতে হবে। আর গোঁফওয়ালা সেপাইটাকেও। দোলগোবিন্দরই খাবে দোলগোবিন্দরই পরবে দোলগোবিন্দর বল্লম দিয়েই সেপাইগিরি করবে, এদিকে গোঁফে তা দিয়ে মুচকি হাসা! দাঁড়াও মজা বার করছি। নাপিত ডেকে সেপাইটারই গোঁফ কেটে দিতে হবে। গলা ছেড়ে চ্যাঁচালেন দোলগোবিন্দ!

-“এইয়ো! কে কোথায় আছিস মন্ত্রীকে খবর দে।”

রাজামশাইয়ের তলব পাওয়ার কয়েক পল পরেই মন্ত্রী রুদ্রপ্রতাপ উর্দ্ধশ্বাসে পড়ি কি মরি করে কাছা সামলাতে সামলাতে এঁটো হাতেই ছুটে এলেন। সবে পুঁই মেটুলির ছ্যাঁচড়া দিয়ে একতাল পান্তা নিয়ে বসেছিলেন এমন সময় পেয়াদা এমন শমনের মত হাজির হল যে পরণের পোশাকটুকু বদলানোরও সময় মিলল না। কোনও মতে বাঁ হাতে করে পাগড়িটা মাথায় চাপিয়ে নিয়েই রওয়ানা দিয়েছেন। এহ্! এই ঘরে পরার ধুতিটায় খানকতক ছোপছাপও লেগে রয়েছে। আসলে মন্ত্রীমশাইয়ের পোষা হুলো বেড়াল ভোম্বলচন্দ্র বড্ড দুরন্ত যে। সারাক্ষণ বাগানে খেলছে মাটি খুঁড়ছে আর এসে ‘ম্যাঁয়াও ম্যাঁয়াও’ করে মন্ত্রীমশাইয়ের ধবধবে কাপড়চোপড়ে মুছচে।

যাই হোক! যেন তেন রূপেই এসে হাজির হলেন রাজা দোলগোবিন্দর শয়নকক্ষে। দরবারে তলব হলে তাও নাহয় একটা কথা ছিল। রাজামশাইকে সামলানোর জন্য সেনাপতি পাত্র মিত্র আর চাট্টি লোক ছিল। কিন্তু একা রাজামশাইয়ের সাথে দেখা করতে যাওয়া মানে একদল তরোয়ালওয়ালা সৈন্যর সামনে দাঁত খোঁচানোর খড়কে কাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া। কী যে দাবী তিনি জানাবেন তার নেই ঠিক। যত ফ্যাসাদে পড়বেন এই মন্ত্রীমশাই! কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

-“হ্যাঁ রাজামশাই, আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন?”

প্রশ্নটা শুনেই রাজামশাইয়ের বিগড়োনো মেজাজ আরও খিঁচিয়ে উঠল। তেঁতো সুরে বললেন,

-“না আপনাকে কেন ডাকতে যাবো! ডাকছিলুম মোক্ষদাকে খানিকটা দেশের দশের আলোচনা করব বলে!”

মোক্ষদা রাজবাড়ির সবচেয়ে পুরনো বুড়ি দাসী। কানেও শোনে না চোখেও ভালো দেখে না। তবে কিনা রাজামশাই দোলগোবিন্দ ছোটোবেলায় এই মোক্ষদাসুন্দরীর হাতেই তেল মেখে চান করে সাবু বার্লি খেয়ে বড় হয়েছেন। এই দুদিন আগেই তো, রাতে রাজামশাইয়ের পেট ভুটভাট করছিল বলে মোক্ষদা ভোরবেলায় ইয়াবড় পেতলের গেলাসে থানকুনির পাতার রস নিয়ে ডাক দিয়েছিল,

-“অ দোলু! দোলু রে! অ গোবু! এই রসটুকুন খে’ নে’ বাবা। এটা খেয়ে বাহ্যে গেলে পরে পেট এক্কেরে খোলসা হয়ে যাবে।”

রাজমাতা তো বটেই এমনকি রানি মহামায়াও অব্দি মোক্ষদাদিদি বলতে অজ্ঞান। মোক্ষদাদিদির টোটকা নাকি রাজবদ্যিমশাইয়ের তেঁতো পাঁচনের থেকে ঢের কার্যকরী। অতএব রাজামশাইকে দোলু হয়ে থানকুনিপাতার রস গিলতে হয়েছে।

যাই হোক গে, মন্ত্রীমশাইয়ের ওপর মেজাজ দেখিয়েও গায়ের ঝালটা ঠিক মিটল না। বললেন,

-“শুনুন, মন্ত্রী হয়েছেন কী করতে? রাজার মনের কথা যদি বুঝতেই না পারলেন তবে বরং ইস্তফা দিয়ে দিন কাজে।”

মন্ত্রীমশাই বোঝেন এরকম অবস্থায় চুপ থাকাই ভালো। শাঁখের করাত, হ্যাঁ বললেও দাঁতখিঁচুনি, না বললেও মুখঝামটা। বিড়বিড় করেন খানিকটা পায়ের বুড়ো আঙুলের ভাঙা নখটার ডগার দিকে চেয়ে। নাগরা জুতোর পাশ দিয়ে উঁকি মারছে আঙুলটা। ইসস্! তাড়াহুড়োয়ে খেয়াল করেননি, পুরনোটাই পায়ে গলিয়ে চলে এসেছেন। ক’দিন আগেই পেয়ারের হুলো ভোম্বলচন্দ্র জুতোটা চিবিয়ে দিয়েছিল। একটু মনে হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, রাজামশাইয়ের বাজখাঁই গলায় চটকা ভাঙল।

-...বুঝলেন কী বললাম? নরসিংহকুমার আর জংবাহাদুর ওদের দুজনেরই কঠিন সাজা চাই। বলি কানে গেল কথাটা? নাকি ভূতের বেগার বকেই চলেছি?”

মন্ত্রীমশাই থতমত খেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললেন,

-“ক্ ক্ কিন্তু রাজামশাই নরসিংহ ডাকাতকে তো আপনি সাতদিনের ফাঁসির সাজা শুনিয়েই দিয়েছেন। আর জংবাহাদুর তো আমাদের দলেরই সেপাই। ওকে কেন খামোখা সাজা দিতে যাব শুনি? আপনার মাথাটাই গোলমাল হয়ে গেছে নির্ধাৎ।”

এই শুনে তো রাজামশাই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।

-“কী? আমার সাথে মস্করা! আমার নামটা এমনধারা বলে ডাকাত সেপাই এমনকি নিজের মন্ত্রী অব্দি ঘরশত্রু বিভীষণের মত কথা কইবে! কভি নেহি! আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না। আগে আপনাকে সাজা দেব। আপনি পালের গোদা! যে দেশের রাজার নাম দোলগোবিন্দ সে দেশের মন্ত্রীর নাম রুদ্রপ্রতাপ! ইয়ার্কি পায়া হায়? আজ থেকেই না না তিনদিন পর থেকেই আপনার চাকরি নট। এই তিনদিনের ভেতর আমি নতুন মন্ত্রী খুঁজে নেব। কে আছিস শিগগ্গির দিকে দিকে ঢ্যাঁড়া দে। মন্ত্রীর পদ খালি। যারা মন্ত্রী হতে চায় এসে যেন খাতায় নাম লিখিয়ে যায়। সবথেকে অদ্ভুত কিম্ভুত আজব বিটকেল নাম যার সেই হবে মন্ত্রী! ব্যস!”

কারোর আর কোনও কথা কানে নিলেন না রাজামশাই। এতক্ষণে গায়ের ঝালটা একটু পড়েছে মনে হচ্ছে। গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে বাগানে হাওয়া খেতে চলে গেলেন। এদিকে মন্ত্রীমশাই তাঁর এঁটো হাতখানা দিয়েই কপাল চাপড়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লেন। সর্বনাশ!

অগত্যা দিকে দিকে সাজো সাজো রব। মন্ত্রী হওয়ার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে নাকি। জ্ঞান বুদ্ধি কিছুই লাগবে নাকো, শুধু নামটা বিটকেল হলেই নাকি চলবে, দৌড়বে। দিক দিক থেকে দলে দলে লোক এসে রাজ দরবারের বাইরে রাখা লাল শালুমোড়া খাতায় খাগের কলম কালিতে ডুবিয়ে নাম লিখিয়ে যাচ্ছে। এমনকি যারা নাম লিখতে পারে না তারাও পাঠশালে পড়া ছেলেনাতিপুতি যাকে পারছে সঙ্গে নিয়ে এসে তাদের দিয়ে নাম লেখাচ্ছে। হেবো, কচাই, ভোঁদড়, লবঙ্গলতিকা, হিংচে, পটলা... নামের বাহার দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। এই সব গোলযোগে সবাই নরসিংহডাকাতের সাতদিনের ফাঁসি আর জংবাহাদুরের সাজার কথা ভুলে গেল।

এদিকে অন্দরমহলে রাজমাতাও বেজায় চিন্তায় পড়েছেন। কী যে ভূত চাপলো ছেলেটার মাথায়! তখন পইপই করে কর্তামশাইকে বারণ করেছিলেন দোলগোবিন্দ নামটা রাখতে, কিন্তু তিনি শুনলে তো। যা জেদী আর একগুঁয়ে ছিলেন। ছেলেটাও পেয়েছে বাবারই গোঁ। এখন একমাত্র রানিমা মহামায়াই পারেন এই বিপদ সামলাতে। মন্ত্রীমশাই তো সেই কোন ভোর থেকে এসে হত্যে গিয়ে পড়ে আছেন রাজমাতার কাছে। আহা রে! বেচারা বুড়োমানুষটাকে কী জ্বালাতনই না করে দোলগোবিন্দটা। কর্তার আমল থেকেই মন্ত্রীমশাই বহাল আছেন, সুষ্ঠুভাবে রাজ্যও সামলে চলেছেন আর তাঁর কপালেই কিনা এমন হেনস্থা লেখা ছিল। বৌমাকে ডেকে রাজমাতা বললেন,

-“কিছু একটা ব্যবস্থা করো বৌমা। দোলুটার এবার মাথাটাই বিগড়েছে দেখছি।”

রানি মহামায়া একগাল হেসে হাতে বরাভয় মুদ্রা করেন। রাজমাতা আর মন্ত্রীমশাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।

 

চলে যাওয়ার আগে, রানিমা মন্ত্রীমশাইকে বলেন,

-“মন্ত্রীমশাই ভোম্বলটাকে মোক্ষদাদিদির হাতে একটু পাঠিয়ে দেবেন তো। কোমলি গাইয়ের দুধের সর তুলে রেখেছি। বড় খেতে ভালোবাসে দুষ্টুটা।”

মন্ত্রীমশাই এমন সঙ্কটের সময় রানিমা হুলোকে সর খাওয়ানোর চিন্তা করছেন দেখে একটু অবাক হলেও হ্যাঁসূচক ঘাড় নাড়লেন। রানিমা ভোম্বলকে বড় ভালোবাসেন কিনা, রাজবাড়িতে তার অবারিত দ্বার।

 

নতুন মন্ত্রীর নাম ঘোষণার আগের দিন রাতে সব সেপাই যখন ঢুলছে তখন রানিমা চুপিচুপি কম্বলমুড়ি দিয়ে দরবারের লাল শালুর খাতাটায় যেটায় সবার নাম লেখা আছে, তাইতে কিছু একটা লিখে আবার চুপিচুপি ফিরে এলেন।

পরের দিন সকালে বিশাল শিঙাটিঙা ফুঁকে ঘোষণা হল,

-“রাজাধিরাজ, মহারাজ, রাজামশাই শ্রী দোলগোবিন্দ রাজসভায় পধার রেহে হ্যায়... ইয়ে মানে আসিতেছেন আর কী!”

ঘোষণা শুনেই রাজামশাইয়ের গা জ্বলে যায়, বলেন,

-“আমি সিংহাসনে বসে পড়েছি, এতক্ষণে উজবুকগুলোর শিঙে বাজানোর কথা মনে পড়ল!”

ঘোষক তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,

-“এক্ষুনি আমাদের নতুন মন্ত্রীমশাই নির্বাচন হবে, লাল শালুর খাতা থেকে।”

রাজামশাই খাতার পাতা উল্টে উল্টে নামগুলো পড়তে থাকেন আর ঘাড় নাড়াতে থাকেন। ওদিকে চেয়ারে বসে মন্ত্রী রুদ্রপ্রতাপের বুক দুরুদুরু করতে থাকে।

রাজামশাই পাতা ওল্টান আর ঘাড় নাড়েন এপাশওপাশ। কোনও নামই পছন্দ হয় না। রুদ্রপ্রতাপ নামটা চলবে না ঠিক আছে তাই বলে হেবো পটলা এইসব নামেরও তো মন্ত্রী হতে পারেন না রাজা দোলগোবিন্দর গোবিন্দগড় রাজ্যে। মাথা নাড়তে নাড়তে এক্কেবারে শেষপাতায় পৌঁছে গিয়ে রাজামশাই ‘ইউরেকা!’ বলে এমন বিকট চিৎকার করে ওঠেন যে মন্ত্রীমশাই চেয়ার থেকেই গড়িয়ে পড়েন খানিকটা।

রাজামশাই ফের সোল্লাসে চেঁচান!

-“এইত্তো! পেয়েছি গোবিন্দগড়ের জন্য একদম ঠিকঠাক মন্ত্রী! রাজা দোলগোবিন্দর মন্ত্রী ঢোলগোবিন্দ।”

মন্ত্রীমশাই রাজামশাইয়ের কোলের ওপর রাখা নাম লেখা খাতাটায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেখেন সব্বার শেষে লাল কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে নাম লেখা ‘ঢোলগোবিন্দ’। কপালটা শেষমেষ পুড়লই মন্ত্রীমশাইয়ের।

ঘোষক ফের শিঙে ফুঁকল,

-“নতুন মন্ত্রী ঢোলগোবিন্দ হাজির হো!”

কেউ সাড়া দিল না।

ঘোষক ফের চেঁচাল। কয়েকটা পায়রা দরবারের ওপরে ঘুলঘুলি থেকে উড়ে গেল, সবাই এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল কিন্তু কোনও ঢোলগোবিন্দ এলো না। অতঃপর রাজামশাই হাঁক ছাড়লেন মোলায়েম করে,

-“ও ঢোলগোবিন্দবাবু! ভয় কীসের? বেরিয়ে আসুন। পুরনো মন্ত্রীমশাই পাগড়ি পরিয়ে বরণ করে নেবেন আপনাকে।”

নাহ্! কোত্থাও কারোর সাড়া নেই। সবাই তো ঘোর চিন্তায়। ওদিকে মোক্ষদা দাসী পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ‘নতুন মন্ত্রী’ দেখছিল, হঠাৎই তার কোল থেকে ভোম্বল চন্দ্র ঝপাস করে দরবারের মাঝখানটিতে লাফিয়ে পড়ল। তার মুখে একটা লাল রেশমের কাপড়ের টুকরোর মত কী যেন। রাজামশাই চেঁচালেন,

-“ও মোক্ষদাদিদি! ভোম্বলটাকে ধরো না! নির্ঘাৎ আমার নতুন রুমালখানা চিবিয়ে ফর্দাফাঁই করছে।”

মোক্ষদা ভোম্বলকে বাগিয়ে ধরে, ওর মুখ থেকে কাপড়ের টুকরোটা হাতে নিয়ে চমকে উঠে বলল,

-“অ দোলু! এতে তো দেখি কীসব যেন লেখা আছে। কোনও দরকারি জিনিস নাকি কে জানে। আমি বাপু পড়তে-টড়তে পারিনে...”

এমন সময় রানিমাও দরবারে হাজির রাজমাতাকে সঙ্গে নিয়ে। বললেন,

-“কই দেখি, কী জিনিস ওটা!”

মোক্ষদা কাপড়ের টুকরোটা রানিমার হাতে দিতেই, রানিমা সেটা পড়ে চোখ বড়বড় করে ফেললেন। তারপর দিলেন রাজমাতার হাতে। রাজমাতারও নাক থেকে চশমাটা খসে পড়ল ওটা পড়ে। তিনি কাপড়ের টুকরোটা দিলেন রাজামশাইয়ের হাতে। চোখের কোণের জলটা মুছে, কাঁপা গলায় বললেন,

-“বাবা দোলগোবিন্দ! এ তো তোমার বাবার সীলমোহর লাগানো আদেশনামা। এদ্দিন বোধহয় ওঁর পুরনো জিনিসপত্রের ডাঁইয়ের ভেতর পড়েছিল। ভোম্বল আজ চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে ওগুলো টানাটানি করে খেলতে গিয়ে এইটে বার করে এনেছে।”

রাজামশাইয়ের তো উত্তেজনায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কোনওমতে কাপড়ের টুকরোটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

‘এতদ্বারা জানানো হইতেছে যে, আমার পুত্র শ্রীমান দোলগোবিন্দ যেই দিন হইতে গোবিন্দগড় রাজ্যের সিংহাসনে উপবিষ্ট হইবে সেইদিন হইতে মন্ত্রীমহাশয় রুদ্রপ্রতাপ তাঁহার পূর্বনাম ত্যাগ করিয়া নূতনরূপে ঢোলগোবিন্দ নামে পরিচিত হইবেন। ইহাই আমার ইচ্ছা, ইহাই আমার আদেশ। আমার স্বপ্নের গোবিন্দগড় রাজ্যের শাসনভার রাজা দোলগোবিন্দ এবং তস্য মন্ত্রী ঢোলগোবিন্দর উপর ন্যস্ত হইবে।”

রাজামশাইয়ের পড়া শেষ হতে, রাজমাতা চোখে আঁচল চাপা দিলেন আর রানিমা মুখে। মোক্ষদাদাসী নিবিষ্টমনে ভোম্বলের পিঠের লোম আঙুলে করে আঁচড়াতে থাকল। সভাসদদের সবার চক্ষু বিস্ফারিত। মন্ত্রী পদপ্রার্থীরা হতাশ। রাজামশাই বাক্যরহিত। আর মন্ত্রীমশাই মনে মনে প্রাণপণে ইষ্টনাম জপ করতে থাকলেন আর সেই সঙ্গে ভোম্বলকে রোজ এক সের দুধ আর কাতলা মাছের মুড়ো খেতে দেবেন প্রতিজ্ঞা করলেন।

 

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কাটার পর রাজামশাই গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন,

-“বেশ! এই যখন বাবার শেষ ইচ্ছে তবে তাই হোক। পুরনো মন্ত্রী রুদ্রপ্রতাপ নতুন রূপে মন্ত্রী ঢোলগোবিন্দ হয়েই বহাল থাকুন। কিন্তু একটা জিনিস বড় খটকা লাগছে, এই আদেশনামার কথা তো কেউই জানত না, এমনকি মন্ত্রীমশাইও না। তাহলে খাতায় ঢোলগোবিন্দ নামটা কে লিখল?”

রাজমাতা খসে পড়া চশমাটা নাকের ডগায় এঁটে বললেন,

-“কই খাতাটা দেখি?”

খাতাটা দেখেই ফের ডুকরে কেঁদে উঠলেন রাজমাতা।

-“ও খোকা! ও দোলু! এখনও চিনতে পারলিনে? এ তো তাঁরই হাতের লেখা। দেখ না, এই রেশমি কাপড়ে লেখা আদেশনামা আর এই খাতার লেখা দুটোই তো এক। তোর বাবার হাতের লেখা চিনতে পারলিনে বাছা?”

রাজামশাই থতমত থেয়ে বললেন,

-“হ্যাঁ মা! তাই তো বটে!”

অতঃপর!

গোবিন্দগড় রাজ্যে ভারি শান্তি এখন। রাজামশাইয়ের মনেও আর খচখচানি নেই। রাত্রে বেশটি করে রানি মহামায়ার হাতের পঞ্চব্যঞ্জন খেয়ে আরামে ঘুমোতে গেলেন। শুধু একটি কথাই মনে হচ্ছিল। কী ভালই না হত যদি ব্যাটা ভোম্বল হুলো চিলেকোঠা ঢুঁড়ে হাটকে এমন একটা আদেশনামা বার করে আনতে পারত যেখানে লেখা থাকত,

মন্ত্রী রুদ্রপ্রতাপের নামের সাথে মিলিয়ে গোবিন্দগড়ের নাম হল প্রতাপগড় আর রাজামশাই দোলগোবিন্দের নাম বদলে হল জয়প্রতাপ বা মহাপ্রতাপ অথবা রাণা প্রতাপ কিংবা নিদেনপক্ষে শুধু প্রতাপ।

একবার ভাবেন, ভোম্বলকে আরেকবার চিলেকোঠার ঘরে পাঠালে কেমন হয়? কিন্তু গেল হপ্তায় আবার ভোম্বলের নাম করে মহামায়া যে পায়েসটা তুলে রেখেছিল সেটা

রাজামশাই খেয়ে নেওয়ার পর থেকে, ভোম্বলের সাথে রাজামশাইয়ের আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক হয়ে গেছে। যদি মহামায়া একটু সাহায্য করেন ভোম্বলের মান ভাঙাতে এই ভেবে রানিকে ডাকতে গিয়ে দেখেন তিনি অকাতরে ঘুমোচ্ছেন। হাজার ডেকেও সাড়া মেলে না। রাজা দোলগোবিন্দর কপালটা নেহাতই মন্দ, কী আর উপায়।

অবিশ্যি রানিমার অঘোরে ঘুমের কারণ রাজামশাই না জানলেও রাজমাতা আর মোক্ষদা দিব্যি জানে। কাল সারারাত ধরে রাজমাতার বার করে দেওয়া পুরনো সীলমোহর আর কাগজপত্র দেখে বারবার অভ্যেস করে তবেই না স্বর্গতঃ শ্বশুরমশাইয়ের হাতের লেখাটা নকল করতে পেরেছেন। মনটা যদিও খচখচ করছিল পাপ হল ভেবে কিন্তু স্বয়ং রাজমাতাই তো আশ্বাস দিয়েছেন, ভালো কাজে দু’টো মিছে কথা কইলে কোনও পাপ নেই।

 

(শুকতারার পুজোসংখ্যায় শ্রী শৈলেন ঘোষের লেখা রাজা কাক্কাবোক্কা আর তাঁর মন্ত্রীর নানা কীর্তিকলাপের গপ্পো পড়তে খুউউব ভালো লাগত। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই গল্পটা লেখার চেষ্টা করেছি।)