দ্য ওয়ে আপ টু হেভেন - রোয়াল্ড ডাল - লুৎফুল কায়সার

অনুবাদ গল্প

কোন জায়গাতে যাওয়ার সময় কিংবা ট্রেন, প্লেন, বাস ইত্যাদি ধরার সময়ে মিসেস. ফস্টারের সমস্যাটা শুরু হয়।

সারাটা জীবন উনার মধ্যে এক অদ্ভুত আতংক কাজ করে এসেছে, যে তিনি হয়ত জায়গাটাতে দেরী করে পৌছবেন কিংবা ট্রেন পা প্লেন ধরতে পারবেন না!

ব্যাপারটা শুধুমাত্র চিন্তাতেই সীমাবদ্ধ থাকলে তেমন কোন সমস্যা ছিল না, তবে এই সময়ে হুট করেই উনার শরীর কাঁপতে শুরু করে, বামচোখের কোণটা অদ্ভুতভাবে লাফাতে শুরু হয়! দূর থেকে দেখলে মনে হবে উনি যেন চোখ মারছেন!

ব্যাপারটা কমপক্ষে একঘন্টা চলতেই থাকে! আবার যদি ওই সময়ের মধ্যে তাকে ট্রেন বা বাসে উঠানো যায়, তবে ঠিক হয়ে যায়।

চিন্তা করে দেখুন, শুধু বাস বা ট্রেন ধরার জন্য এতো ভাবনা?

মিসেস. ফস্টার প্রতিবারই স্টেশনে ট্রেন আসার প্রায় আধাঘন্টা আগে(তা স্টেশন বাড়ির পাশে হলেও) জামা-কাপড় পরে ফেলেন। তারপর তিনি আর বসেন না, এ ঘর থেকে ওঘর পায়চারী শুরু করেন। উনার স্বামী মি. ফস্টার বেশ ভালো করেই নিজের স্ত্রীকে চেনেন। কিন্তু তারপরেও তাঁর মধ্যে কোনই সহানুভূতি নেই!

মাঝে মাঝেই তিনি ইচ্ছা করেই দেরী করেন! হ্যা, এটা ঠিক যে এরকম অদ্ভুত সমস্যার জন্য যেকোন মানুষই বিরক্ত হবে। কিন্তু তাই বলে শুধু এই কারণে দেরী করা যাতে করে নিজের স্ত্রীর কষ্ট হয়! খুব নিষ্ঠুর একটা ব্যাপার।

তবে ভদ্রলোকের মিষ্টি ব্যবহার দেখে কেউ এটা বুঝতেও পারবে না যে নিজের স্ত্রীকে এইভাবে কষ্ট দিয়ে উনি বেশ মজাই পান!

যতই কষ্ট হোক না কেন, স্বামীকে কখনোই তাড়াতাড়ি বের হতে বলতেন তা মিসেস. ফস্টার। এটারই ফায়দা নিতেন ভদ্রলোক। বিয়ের পর পর তো দুয়েকবার এতোটাই দেরী করেছিলেন তিনি, যে বেচারী মহিলার অবস্থা প্রায় মৃগী রোগীর মতো হয়ে গেছিলো।

এখনও আপনি মহিলার স্বামীর কোন দোষ খুঁজে পাচ্ছেন না? মানে এমন স্ত্রী হলে তো যেকোন পুরুষেরই মাথা গরম হবে, তাই না?

আচ্ছা শুনুন, স্ত্রী হিসাবে মিসেস. ফস্টার সবসময়ই অসাধারণ! ত্রিশ বছর ধরে উনি নিজের সংসার এতো সুন্দর করে সামলেছেন যেটা আজকালের মেয়েদের মধ্যে তেমন দেখাই যায় না! উনি এটা মন থেকে বিশ্বাসও করেন না যে উনার স্বামী উনাকে ইচ্ছা করে কষ্ট দেন!

এমন লক্ষ্মী একটা বউকে কষ্ট দেওয়া লোককে কী আর বলবেন?

মি. ইউজিন ফস্টার, প্রায় সত্তর বছর বয়স্ক একজন লোক। নিউইয়র্কের পূর্ব সিক্সটি সেকেন্ড স্ট্রিটের একটি ছয়তলা বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। সবমিলিয়ে চারজন কাজের লোক রয়েছে তাদের বাড়িতে।

বাড়িটাকে বিষন্নতার প্রতিমূর্তিই বলা যায়, কারণ এখানে তেমন কেউই আসে না। এখানকার বাসিন্দারা একে অপরের সাথে তেমন কথাও বলে না।

কিন্তু জানুয়ারীর এক সকালে সবকিছু বদলে গেল! কেমন যেন প্রাণ ফিরে পেল বাড়িটা।

দুজন ঝি মিলে সেই সব ঘরগুলো পরিষ্কার করছে যেগুলোতে কেউ থাকে না(কোন কারণ ছাড়াই!)। খানসামা একের পর এক স্যুটকেস এনে রাখছে বসার ঘরে। বাবুর্চি বারবার রান্নাঘর থেকে নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছে তাকে।

মিসেস. ফস্টারও নিজের পুরনো একটা পশমের কোট আর কালো হ্যাট পরে এঘর থেকে ওঘর ঘুরে শুধুই এদের কাজ তদারক করে যাচ্ছেন। সত্য কথা বলতে কী, আসলে তিনি তদারক করার অভিনয় করছেন! তার মাথাতে শুধুই একটা চিন্তা কাজ করছে আর সেটা হলো, যদি উনার স্বামী খুব শীঘ্রই পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে না আসেন তবে উনি বিমান ধরতে পারবেন না!

“কটা বাজে ওয়াকার?” হাঁটতে হাঁটতে খানসামাকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। বেচারা একদম উনার সামনেই পড়ে গেছে।

“সোয়া নটার মতো ম্যাডাম,” ঘড়ি দেখে বলল লোকটা।

“গাড়ী এসেছে?”

“হ্যা! আমি আপনাদের জিনিসপত্রগুলো গাড়িতে তোলাও শুরু করে দিয়েছি।”

“আইডলওয়াইল্ডে গাড়িতে করে পৌছাতে এক ঘন্টার মতো লাগে, বিমান ছাড়বে এগারোটায়! ওখানে প্রায় আধাঘন্টা আগে পৌছতে হবে! নইলে দেরী হয়ে যাবে! মনে হয় দেরী হয়েই যাবে, কী বল?

“সমস্যা নেই ম্যাডাম, আমি মি. ফস্টারকে বলে দিয়েছি যে সোয়া নয়টার মধ্যেই বের হতে হবে! উনি তাই করবেন, আপনি চিন্তা করবেন না।”

 

“আমি জানি ওয়াকার! তারপরেও আমার ভয় করছে!”

“চিন্তা করবেন না ম্যাডাম।”

কিন্তু চিন্তা কমলো না মিসেস. ফস্টারের। এই বিমানটা হাতছাড়া হয়ে গেলে সম্ভবত উনি আর যেতেই পারবেন না! উনার স্বামীও আবার উনাকে বিমানবন্দরে রাখতে যাচ্ছেন, এখন যদি গিয়েও বিমান হাতছাড়া হয়, তবে উনিই বা কী ভাববেন?

“কটা বাজে ওয়াকার?” আবার বলে উঠলেন তিনি।

“নটা আঠারো, ম্যাডাম।”

“হায় ঈশ্বর প্লেনটা মনে হয় ধরতেই পারব না! এখনও উনি আসছেন না কেন?”

মিসেস. ফস্টার একাই ফ্রান্সে যাচ্ছেন। উনাদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে একজন ফরাসী ভদ্রলোকের সাথে। জামাইকে খুব একটা পছন্দ করেন না তিনি, কিন্তু মেয়েকে প্রাণের চাইতেও অধিক ভালোবাসেন। শুধু তাই নয়, নিজের তিন নাতি-নাতনীকে দেখার জন্যেও উনার মনটা কেমন যেন করছিল।

ওদের তিনজনের কাছে যাওয়ার আনন্দে আগের রাতে বলতে গেলে ঘুমাতেই পারেননি তিনি। ক্যামেরাতে তোলা ওদের ছবিগুলো মাঝে মাঝেই দেখেন তিনি। আহ! কত্ত সুন্দর বাচ্চাগুলো! ওদের কাছেই যদি তিনি থাকতে পারতেন! প্রতিদিন বিকালে ওদের পার্কে ঘুরতে নিয়ে যেতেন, তারপর সন্ধ্যার চকলেট কিনে বাড়ি ফিরতেন!

কিন্তু মি. ফস্টার বেঁচে থাকতে তো এসব সম্ভব নয়! আমেরিকাতে উনার ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, কিন্তু তারপরেও নিউইয়র্ক ছেড়ে প্যারিসে গিয়ে বসবাস করতেও তিনি কখনোই রাজী হবেন না।

এমনকি এখনও উনার বিশ্বাস হচ্ছে না যে উনার কড়া মেজাজের স্বামী উনাকে প্যারিসে যেতে দিচ্ছেন! তাও ছয় সপ্তাহের জন্য!

“ওয়াকার, কটা বাজে?”

“নটা বাইশ, ম্যাডাম...”

“হায় ঈশ্বর..আমি...”

উনার কথা শেষ হওয়ার আগেই পড়ার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মি. ফস্টার। তাঁর দৃষ্টিতে স্পষ্ট বিরক্তি। উনার শুশ্রমন্ডিত মুখটা দেখে অ্যান্ড্রু কার্নেগীর সেই পুরনো ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে যায়!

“হুম, তো এখন তো আমাদের বের হওয়া উচিত, কী বলো?” স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন তিনি।

“হ্যা! সবকিছু তৈরী! গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে,” প্রায় লাফিয়ে উঠলেন মিসেস. ফস্টার।

“আচ্ছা বেশ,” নিজের মাথাটা ডানদিকে ঘোরালেন মি. ফস্টার। উনার মাথা ঘোড়ানোর একটা বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে, একবারে ঘোরাতে পারেন না উনি, দুই-তিনবার ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তারপর মাথাটা ঘোরান। অনেকটা কাঠবিড়ালীদের মতো। নির্জন পার্কে দাঁড়িয়ে থাকা এক বুড়ো কাঠবেড়ালী!

“ওয়াকার তোমার কোট নিয়ে আসছে, পরে নাও,” বললেন মিসেস. ফস্টার।

“দাঁড়াও, দু’মিনিটের মধ্যে আসছি, হাতটা ধুয়ে আসি,” বলে আবার ঘরে ঢুকে পড়লেন মি. ফস্টার।

আবার অপেক্ষা!

“ওয়াকার, আমি মনে হয় বিমানটাতে আর উঠতে পারব না!” কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মিসেস. ফস্টারের মুখ।

“আরে না ম্যাডাম, উনি এখনই আসছেন,” হাসল ওয়াকার।

এলেন মি. ফস্টার। ওয়াকার গিয়ে তাকে কোটটা পরতে সাহায্য করলো। প্রায় দৌড়ে গাড়ির দিকে রওনা দিলেন মিসেস. ফস্টার। কিন্তু পিছে পিছে খুবই ধীর গতিতে এগোতে লাগলেন তাঁর স্বামী!

শীতের সকাল যেমন হয়, বেশ কুয়াশা বাইরে।

“এতো কুয়াশা,” গাড়ির দরজা খুললেন মি. ফস্টার, “সম্ভবত বিমানটা আজ যাবে না!”

“এইভাবে বলছ!” যেন ডুকরে কেঁদে উঠলেন মিসেস. ফস্টার।

গাড়ি লং আইল্যান্ডে পৌছানোর আগে তাঁরা আর কোন কথাই বললেন না।

“শোন, সব চাকর-বাকরদের আজ ছুটি দিয়ে দিলাম বুঝলে?” বলে উঠলেন মি. ফস্টার, “ওদেরকে ছয় সপ্তাহের বেতনও দিয়ে দিয়েছি। ওয়াকারকে এটাও বলেছি যে আমি যোগাযোগ না করা পর্যন্ত যেন ওরা না আসে।”

“হ্যা, ও কাল রাতে বলেছে আমাকে।”

“আজ রাতে ক্লাবে যাব, অনেকদিন যাই না, এই সুযোগে একটু ঘুরেই আসি।”

“বেশ বেশ, তোমাকে চিঠি লেখব আমি।”

“বাড়িতে এখন কম যাব, বাইরেই বেশী থাকব, মাঝে মাঝে চিঠিপত্র এসেছে কিনা সেটা দেখতে যাব অবশ্য!”

“ওয়াকারকে বাড়িতে রাখলে হতো না? ও সব দেখে রাখত?”

“ফালতু কথা! ওকে পুরো বেতন দিয়ে রাখব শুধু বাড়ি দেখার জন্য?”

“সেটাও কথা!”

“আবার ধর, আমি থাকছি না, ওয়ারকারকে রাখলাম! ও নিজের ফালতু বন্ধুদের নিয়ে এসে আমার বাড়িটা নষ্ট করল!”

“তুমি যা ভালো বোঝ।”

“হুম!”

কিছুক্ষণের নীরবতা।

“আচ্ছা, তুমি আমাকে চিঠি লিখবে না?” ম্লান হাসি দিলেন মিসেস. ফস্টার।

“বলতে পারছি না। তুমি তো জানোই এমনি এমনি আমি কাউকে চিঠি লেখি না। কোন কথা থাকলে অবশ্যই লিখব।”

“সেটাই, দরকার না হলে লিখবে কেন?”

গাড়ি তখন কুইন্স বুলিভার্ডে, কুয়াশা আরও ঘন হয়ে এসেছে।

“বিমানে মনে হয় উঠতেই পারব না,” আবার বলে উঠলেন মিসেস. ফস্টার।

“আরেহ ধুর! এত কথা বলো না তো, এমনিতেই বিমান আজ উড়বে না! কুয়াশা দেখেছ কেমন?”

মি. ফস্টারের গলাতে কেমন যেন একটা পরিবর্তন এসে গেছে, সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলেন মিসেস. ফস্টার। এই লোকের মুখ দেখে আসলে কিছুই বোঝা যায় না, তিনি কী ভাবছেন না ভাবছেন তা বোঝার একমাত্র উপায় হলো তাঁর চোখ দেখা, কিন্তু এই মূহুর্তে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না!

“তোমার যাওয়াই উচিত না!” হুট করে বললেন মি. ফস্টার।

“ওমা! কেন?”

“কেমন কুয়াশা দেখছ না? আর আমরা এতো তাড়াতাড়ি যেতেও পারব না!”

কোন কথা বললেন না মিসেস. ফস্টার। কুয়াশার মধ্যেও সামনের লাইট জ্বালিয়ে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ড্রাইভার। বেশ কয়েকটা স্ট্রিটলাইট তখনও জ্বলছিল ফলে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না তার। কিন্তু এমন এক জায়গায় ওরা এসে পৌছল যেখানে আর কোন স্ট্রিটলাইট নেই!

গাড়িটা দাঁড় করাল ড্রাইভার।

“দেখলে?” হাসলেন মি. ফস্টার, “আমরা আটকে গেছি!”

“না স্যার,” দরজা খুলতে খুলতে বলল ড্রাইভার, “আমরা বিমানবন্দরে পৌছে গেছি!”

প্রায় লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন মিসেস. ফস্টার।

বেশ ভিড় এয়ারপোর্টে। কুয়াশার কারণে অনেক ফ্লাইটই সময়মতো যেতে পারেনি।

“ম্যাডাম আপনার ফ্লাইটের একটু দেরী হবে, কিন্তু চলে যাবেন না, কিছুক্ষণের মধ্যেই আবহাওয়া পরিষ্কার হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে,” বললেন এয়ারপোর্টের একজন কর্মকর্তা।

মি. ফস্টার একটা চেয়ারে বসে পড়েছেন ততক্ষণে।

“দেরী হবে বুঝলে, তুমি অপেক্ষা করো না, নাকি? তোমার তো কাজ আছে?” কাঁচুমাচু করলেন মিসেস. ফস্টার।

“হ্যা, ড্রাইভার তোমার ব্যাগপত্রগুলো সব দিয়ে গেলেই আমি চলে যাচ্ছি!”

“আচ্ছা!”

ড্রাইভার কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস. ফস্টার সব জিনিসপত্র দিয়ে গেলো।

ড্রাইভারকে নিয়ে চলে গেলেন মি. ফস্টার।

একাই রয়ে গেলেন মিসেস. ফস্টার।

বাকীটা দিন প্রায় দুঃস্বপ্নের মতোই গেলো উনার। ঘন্টার পর ঘন্টার উনি পায়চারি করে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু ফ্লাইটের সময় আর ঘোষণা হলো না। আধাঘন্টা পর পর বারবার উনি সেই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন যে বিমান কখন যাবে। প্রতিবারই তিনি একই উত্তর পেলেন, “অপেক্ষা করুন ম্যাডাম! এতো মানুষ অপেক্ষা করছে!”

অবশেষে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে কর্তৃপক্ষ জানালো যে পরের দিন সকাল এগারোটা পর্যন্ত ফ্লাইটটি স্থগিত করা হয়েছে।

মানসিক চাপ আর ক্রমাগত দুঃশ্চিন্তার ফলে ক্লান্ত মিসেস. ফস্টার প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে রইলেন। তিনি বুঝে পাচ্ছিলেন যে কী করা উচিত এখন তাঁর! বাড়িতে ফিরে গেলে যদি মি. ফস্টার উনাকে আর প্যারিসে যেতে না দেন? উনি নিজেও উনার স্বামীর মুখটা আর দেখতে চাচ্ছিলেন না। একবার ভাবলেন, পরদিন পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকবেন! কিন্তু তিনি এতোটাই ক্লান্ত যে বাড়ি না ফিরলে আর হচ্ছিলও না!

অবশেষে ফোনবুথের ফোন থেকে বাড়িতে ফোন করলেন।

মি. ফস্টার ফোনটা ধরলেন। উনার গলা শুনেই মিসেস. ফস্টার বুঝতে পারলেন যে ক্লাবে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তিনি। উনাকে সব খুলে বললেন তিনি।

“কী আর করবে? বাড়ি এসো!” বিরক্ত কণ্ঠে বললেন মি. ফস্টার।

“চাকর-বাকরেরা আছে তো?”

“নাহ! ওরা চলে গেছে!”

“তাহলে আর কী, তুমি ক্লাবে যাও, আমি এখানকার কোন হোটেলে থাকছি!”

“এতো ঢং কেন করো? এই শহরে তোমার এত বড় একটা বাড়ি আছে! আর তুমি হোটেলে থাকবে?”

“কিন্তু ওখানে যে কেউ নেই।”

“আমি থাকছি তোমার সাথে।”

“কিন্তু বাড়িতে তো সম্ভবত কোন খাবারও নেই।”

“আসার আগে খেয়ে এসো কোথাও থেকে। এতো চিন্তা কর কেন তুমি?”

“আচ্ছা, আমি তাহলে কোন দোকান থেকে একটা স্যান্ডউইচ খেয়ে বাড়ি আসছি, আমি দুঃখিত!” ফোনটা রাখলেন মিসেস. ফস্টার।

রাতের বেলা খাওয়ার তেমন কিছুই পেলেন না মিসেস. ফস্টার। একটা ট্যাক্সি ধরলেন তিনি।

কুয়াশা সকালের চেয়ে কম ছিল, তবে এতটাও কম না যে গাড়ি তাড়াতাড়ি চালান যায়! বেশ অনেকটা দেরী করেই বাড়ি পৌছলেন তিনি।

“তো কেমন দেখলে প্যারিস?” দরজা খুলে ব্যাঙ্গের হাসি হাসলেন মি. ফস্টার।

“কাল সকাল এগারোটায় রওনা হচ্ছে বিমান!”

“যদি কুয়াশা না থাকে তবে!”

“পরিষ্কার হয়ে যাবে, বাতাস উঠেছে বাইরে।”

“তোমাকে তো বেশ ক্লান্ত লাগছে, অনেক পায়চারি করেছ নাকি?”

“ঘুমাতে যাওয়া উচিত আমার।”

“সকাল নটায় একটা ট্যাক্সিকে আসতে বলেছি আমি!”

“আহা! তুমি আমার কত খেয়ার রাখ! ধন্যবাদ, কিন্তু কাল তোমার আর আমাকে বিমানবন্দরে রাখতে যাওয়ার দরকার নেই।”

“সেটা তো যাচ্ছিই না! তুমিই বরং আমাকে বিমানবন্দর যাওয়ার পথে একটু ক্লাবে নামিয়ে দিয়ে যেও।”

ভ্রু কুঁচকে স্বামীর দিকে তাকালেন মিসেস. ফস্টার। সামনে দাঁড়ান লোকটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কুচক্রি মানুষ মনে হচ্ছে উনার কাছে এই মূহুর্তে!

“কিন্তু ক্লাব তো বিমানবন্দরের রাস্তাতে না!” ঢোক গিলে বললেন তিনি।

“তা তো বটেই! আমাকে ক্লাবে নামিয়ে দিয়ে তারপর যাকে ওখানে! এজন্যই তো নটাতে গাড়ি ডাকলাম। নাকি আমাকে সাথে নিতে চাও না?”

“না না তা কেন হবে।”

“ঠিক আছে, তাহলে সকাল নটায় দেখা হচ্ছে!”

টলতে টলতে লিফটে উঠে তিনতলাতে নিজের ঘরটাতে গেলেন মিসেস. ফস্টার, আর বিছানাতে ওঠামাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন তিনি। উনাদের লিফটে একটু সমস্যা আছে! মাঝে মাঝেই ওটা নষ্ট হয়ে যায়!

পরের দিন বেশ সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে নিলেন তিনি। আর সাড়ে আটটার মধ্যে নিচে নেমে গেলেন।

নটার বাজার পাঁচমিনিট পর মি. ফস্টার এলেন সেখানে।

“তুমি কফিটফি বানাওনি?” কটমট করে স্ত্রীর দিকে চাইলেন তিনি।

“নাহ গো, আমি ভাবলাম তুমি ক্লাবেই নাস্তা করবে! আমি দুঃখিত!”

বিরক্ত হয়ে জানালার দিকে চাইলেন মি. ফস্টার।

খুব অবাক লাগছে মিসেস. ফস্টারের। আজকাল তাদের দুজনের শুধুমাত্র হলঘরটাতেই দেখা হয়! কী এক অদ্ভুত ব্যাপার।

“তোমার বাক্স-পাতি সব কই?” জিজ্ঞাসা করলেন মি. ফস্টার।

“বিমানবন্দরে জমা দিয়ে এসেছি। কালরাতে আর ওসব তুলে আনিনি, ওরাও বলেছে যে খেয়াল রাখবে।”

“অহ! আচ্ছা। ক্লাবে তো নামিয়ে দেবে আমাকে, তাই না? চলো তাড়াতাড়ি বের হই!”

“অবশ্যই!” প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মিসেস. ফস্টার।

“হুম দাঁড়াও একটা দুটো সিগার ফুঁকে আসি, তুমি গাড়িয়ে ওঠো গিয়ে, আমি আসছি!”

গাড়িতে গিয়ে উঠলেন মিসেস. ফস্টার। বেশ আন্তরিকভাবেই দরজা খুলে দিলো ড্রাইভার।

“কটা বাজে?” জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

“সোয়া নটা, ম্যাডাম!”

পাঁচ মিনিট পর দরজাতে মি. ফস্টারের মুখ দেখা গেলো। খুবই আস্তে হেঁটে গাড়ির দিকে আসছিলেন তিনি। একটা ছোট বাচ্চাও সম্ভবত উনার চেয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারবে!

আজকেও বেশ কুয়াশা, তবে সূর্যের আলো একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে।

“আহ, আজ মনে হয় তোমার বিমান প্যারিসে পৌছেই যাবে,” গাড়িতে উঠে হাসলেন মি. ফস্টার।

“হুম, চলো যাই!”

ড্রাইভারও গাড়ি চালু করল।

“এই ড্রাইভার থাম!” বলে উঠলেন মি. ফস্টার।

“কোন সমস্যা?” কাঁদো কাঁদো গলাতে বললেন মিসেস. ফস্টার।

“এলেনের জন্য একটা উপহার কিনেছিলাম আমি! তোমার হাতে দেওয়ার জন্য ওটা নিয়ে ঘর থেকে বেরও হয়েছিলাম! কিন্তু এখন আর ওটা আমার হাতে দেখছি না!”

“তোমার হাতে তো কিছু দেখিনি! যখন বেরিয়ে এলে তখনও না! কী উপহার?”

“একটা ছোট বাক্স, সাদা কাগজ গিয়ে মোড়ানো! কাল তোমাকে দিতে ভুলে গেছিলাম। আজ আর ভুলতে চাই না!”

“আমি তো কালও তোমার হাতে কোন বাক্স দেখিনি!”

“এতো বকো কেন? কাল ভুলে গেছিলাম! বললাম না!”

“আচ্ছা!”

কোটের পকেট হাতড়াতে লাগলেন মি. ফস্টার। এমন ভাব করতে লাগলেন যেন পৃথিবীর সেরা হীরাটা উনি নিজের মেয়ের জন্য পাঠাচ্ছিলেন আর সেটা হারিয়ে গেছে!

“আহহা, নেই এখানে! সম্ভবত আমার শোবার ঘরে রেখে এসেছি, দাঁড়াও নিয়ে আসি,” বলে গাড়ি থেকে নামতে গেলেন মি. ফস্টার।

“ওহ! যেও না! আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে! কী আর পাঠাচ্ছ মেয়ের কাছে? ওইসব ফালতু চিরুনীগুলো?” উনার হাত ধরে ফেললেন মিসেস. ফস্টার।

“তা চিরুনীতে সমস্যা কী?” রেগে গেলেন মি. ফস্টার।

“সমস্যা নেই..কিন্তু...”

“থাক এখানে, আমি যাচ্ছি!”

“আচ্ছা, একটু তাড়াতাড়ি এস!”

চলে গেলেন মি. ফস্টার। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন মিসেস. ফস্টার। প্রচন্ড স্নায়ুচাপে চোখে অন্ধকার দেখছিলেন তিনি!

“ড্রাইভার কটা বাজে?” কোনমতে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

“সাড়ে নটা ম্যাডাম।”

“এক ঘন্টাতে পৌছাতে পারব আমরা বিমানবন্দরে?”

“সম্ভবত পারব ম্যাডাম।”

ঠিক তখনই মিসেস. ফস্টারের নজর পড়লো বামপাশের কোণাতে, যেখানে উনার স্বামী বসেছিলেন। একটা সাদা বাক্স!

“হায় ঈশ্বর! আমি পেয়েছি! এখন আমরা যেতে পারি!” প্রায় কেঁদে ফেললেন তিনি, “ড্রাইভার তুমি কি একটু গাড়ি থেকে নেমে ওকে ডাকবে? আমিই নামতাম কিন্তু, আমার হাত-পা কাঁপছে!”

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দরজার কাছে গেল ড্রাইভার। তারপর আবার ফিরে এলো।

“ম্যাডাম, দরজাটা বন্ধ, আপনার কাছে কি চাবি আছে?” মিসেস. ফস্টারকে প্রশ্ন করল সে।

“হ্যা আছে, দাঁড়াও,” ব্যাগ হাতড়ে চাবিটা বের করলেন তিনি, “আচ্ছা, দাঁড়াও, আমিই যাই!”

চাবিটা ঢুকালেন তিনি, তারপর ঘুরালেন!

এক..দুই..তিন..দশসেকেন্ডের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। উনার মনে হতে লাগল কেমন যেন হাওয়াতে ভাসছেন উনি! দরজার ওপাশে কিছুই নেই! শুধুই শূন্যতা।

আরও কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। তারপরে ভিতর থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ পেলেন তিনি, ক্যাচক্যাচ একটা শব্দ! লিফটটা....

“ড্রাইভার! আমি আর ওর জন্য অপেক্ষা করব না! চল এয়ারপোর্টে!” এই বলে কাঁদতে কাঁদতে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন তিনি।

ড্রাইভার বেশ ভালো করে ভদ্রমহিলার মুখটা খেয়ার করছিল। কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সেটা, তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, একটু আগেও ওই মুখে হতাশা আর প্রচন্ড স্নায়ুচাপের একটা চিহ্ন ছিল, যেখানে বর্তমানে বিরাজ করছে চরম কঠোরতা!

“তাড়াতাড়ি চল ড্রাইভার,” উনার কণ্ঠেও কেমন যেন পরিবর্তন এসে গেছে।

“ম্যাডাম, আপনার স্বামী কি আপনার সাথে বেড়াতে যাচ্ছেন না?”

“আরে না! ওরে শুধু ক্লাবে নামিয়ে দিতাম। তাড়াতাড়ি চল! ও নেমে গাড়ি ধরে নেবে। আমাকে বিমান ধরে প্যারিসে যেতে হবে!”

ড্রাইভার উনার কথামতো বেশ জোরে গাড়ি চালাতে লাগল। পনের মিনিট আগেই প্লেন ধরে ফেললেন মিসেস. ফস্টার। আটলান্টিকের ওপর দিয়ে উড়তে উড়টে সাগরের নিঃসীম জলরাশির মধ্যে নিজের জীবনটাকে কল্পনা করলেন উনি।

প্যারিস! প্যারিসের সেই পুরনো শৈল্পিক রূপ! কেমন যেন একটা অপার্থিব শান্তি গ্রাস করলো উনাকে।

নিজের নাতি-নাতনীর সাথে খুব তাড়াতাড়ি দেখা হয়ে গেল উনার। ছবিতে যেমন দেখেছিলেন তার চাইতেও অনেক বেশী সুন্দর ওরা!

ওদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটতে লাগল তাঁর। ওদের নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরলেন, চকলেট আর নানান খেলনা কিনে দিলেন, ওদের পার্কে নিয়ে গেলেন! সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছিল উনার কাছে।

প্রতি মঙ্গলবারে নিজের স্বামীকে একটা করে চিঠি লিখতেন তিনি, যেগুলো শেষ কথা সবসময় হত এমন, “নিজের খেয়াল রেখ, সময়মতো দুপুরের আর রাতের খাবার খেও! আমার কেন যেন মনে হয় এগুলো ব্যাপারে তুমি খুব উদাসীন!”

ছয়টা সপ্তাহ খুব তাড়াতাড়িই কেটে গেল। উনার মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনী সবার মন খুব খারাপ হয়ে গেল, কারণ উনি চলে যাবেন! তবে উনার মন খুব একটা খারাপ হয়নি।

শেষ পর্যন্ত এসে গেল মিসেস. ফস্টারের আমেরিকা ফেরার দিন। উনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন এবং উনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল যে খুব তাড়াতাড়িই উনি আবার প্যারিসে বেড়াতে আসবেন।

একজন ভালো স্ত্রীর মতো উনি স্বামীকে দেওয়া কথা রাখলেন এবং ছয় সপ্তাহ পর আমেরিকা ফিরে এলেন।

আইডলওয়াইল্ডে কোন গাড়ি কিন্তু মিসেস. ফস্টারকে নিতে আসলো না! ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত না? কিন্তু মিসেস. ফস্টার মোটেও অবাক হলেন না! ঠান্ডা মেজাজেই একটা ট্যাক্সি ডেকে ওতে নিজের জিনিসপত্রগুলো উঠালেন উনি।

নিউইয়র্কে প্যারিসের চাইতে অনেক বেশী ঠান্ডা। পূর্ব সিক্সটি সেকেন্ড স্ট্রিটের বাড়ির সামনে ট্যাক্সিটা দাঁড়ানোর পর ড্রাইভার সিড়ি পর্যন্ত পৌছে দিয়ে ব্যাগপত্তরগুলো।

ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বেশ কয়েকবার দরজার বেল বাজালেন মিসেস. ফস্টার। কিন্তু কেউ খুলতে এল না! তিনি প্রায় পনের মিনিটের মতো অপেক্ষা করলেন, তারপরেও কেউ এল না।

অবশেষে নিজের ব্যাগে থাকা চাবিটা দিয়ে দরজাটা খুললেন তিনি।

হলঘরের মেঝেতে বেশ কয়েকটা চিঠি পড়ে আছে। এটাই উনাদের লেটার বক্সের নিয়ম, যদি বেশী চিঠি জমে যায় তবে কিছু চিঠি পিছনের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে মেঝেতে এসে পড়ে। মিসেস. ফস্টার নিজের পাঠানো দুটো চিঠিও মেঝেতে দেখতে পেলেন।

ধীরে ধীরে এগিয়ে লিফটের দরজার সামনে গেলেন তিনি। হ্যা! যা ভেবেছিলেন তাই!

কেমন যেন একটা আত্মতৃপ্তি ফুটে উঠল তাঁর চেহারাতে।

ধীরে-সুস্থে মি. ফস্টারের বসার ঘরে গেলেন তিনি, তারপর সেই মোটা বইটা খুঁজে বের করলেন যেখানে শহরের সব গুরত্বপূর্ণ জায়গার ফোন নম্বর রয়েছে।

অবশেষে নম্বরটা পেয়ে গেলেন তিনি।

বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কেউ ফোনটা ধরল।

“হ্যা আমি পূর্ব সিক্সটি সেভেন স্ট্রিট থেকে বলছি,” বললেন মিসেস. ফস্টার, “ হ্যা..লিফটেই সমস্যা.. ইনডিকেটরে দেখাচ্ছে যে ওটা তিনতলা আর চারতলার মাঝখানে আটকে আছে! কাউকে পাঠান দয়া করে। আজই বিদেশ থেকে ফিরলাম তো, পায়ে একটু ব্যাথা। তাই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে পারছি না। আমার স্বামীও ক্লাবে আছেন সম্ভবত, এখনও উনার সাথে যোগাযোগ হয়নি! কাউকে একটু পাঠান করে...হ্যা, ধন্যবাদ!”

অপেক্ষা করছেন মিসেস. ফস্টার, কোন তাড়াহুড়া নেই উনার। সম্ভবত আধাঘন্টার মধ্যেই লিফট ঠিক করার লোকেরা চলে আসবে।