আবুলের দোকান - মোঃ শোআইব খান

হাসির গল্প

 

শেখ আবুল কাসেমকে আশেপাশের নানা লোক নানা নামে চেনে। প্রতিবেশীর কাছে তিনি আবুল ভাই আবার ক্ষমতাবলে বড়লোক বন্ধুর কাছে তিনি শুধুই আবুল। বাড়ির বাইরে রাস্তার হাঁটার সময় মাঝে মাঝে ছেলেপিলেদের কাসেম স্যার, কাসেম স্যার বলে সালাম দেওয়াটাও একেবারে পুরনো হয়ে গেছে আবুল সাহেবের কাছে। লোকজন এই ডাক শুনে মনে মনে যা অনুমান করে তা একদম মিথ্যা না। কিছুদিন আগেও শিক্ষক ছিলেন তিনি, মনিপুর হাই স্কুলের। অনেক বানরকে মানুষ করে অবশেষে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছেন।

আসলে নতুন একটা ইচ্ছে হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আবুল সাহেবের মধ্যে। ইচ্ছেটা অদ্ভুত বটে, তবে তার কাছে এটা অনেক বছর পরে নিজের অপ্রত্যাশিত স্বপ্ন পূরণের মতো।

ব্যাপারটা খুলেই বলি।

আবুল সাহেবের বয়স এই পঞ্চাশ-ষাটের কোঠায় হবে। অনেক বছর শিক্ষকতা করার পর একঘেয়েমি লাগা শুরু করেছে তার মধ্যে। শিক্ষকতা করে জনপ্রিয়তার দ্বারও পাননি। ছাত্রদের ঠিক পথে আনার জন্য যে হালকা শাসন করতেন তার জন্যও মাসে মাসে অভিবাবকদের কম অভিযোগ শুনতে হয়নি। শেষমেশ তো রাগে দুঃখে শিক্ষকতা পেশাটাই ছেড়ে দিলেন। বেশ কয়েক বছর ধরে বিপত্নীক তিনি। একমাত্র ছেলেটাও দেশের বাইরে । শিক্ষকটা করতে চাইলে বড়জোর আরো পাঁচ বছর করতে পারতেন। সে কথা বাদ। এমন অবস্থায় নিজের পাঁচতলা বাড়ির তিনতলায় বসে ভাবতে লাগলেন, কীভাবে কাটাবেন এই অবসর সময়টা। পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া একরাম ভাইয়ের কাছেও সাহায্য চাইলেন এব্যাপারে। মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া সত্তর বছরের এই ভদ্রলোককে দেখে আবুল কাসেমের কেন জানি মনে হয়, এই ভদ্রলোকের সিদ্ধান্তের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে।

‘ভাবছিলাম, এলাকায় বড়সড় একটা দোকান খুলে ফেলব,’ আবুল সাহেব একদিন হুট করে বলেই ফেললেন।

‘খুলুন।’ হাতের পত্রিকা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল একরাম সাহেব। তার মতে বাড়িওয়ালার সব কথাতে সায় দেওয়া উচিত, এতে হয়তো খুশি হয়ে বাড়িভাড়াটাও কিঞ্চিৎ কমে যেতে পারে। আসল কথা হলো, একরাম সাহেবের কাছে আবুল সাহেবের চিন্তাধারার কোনো দামই নেই।

‘কিন্তু সমস্যা তো অনেক। এলাকার বাড়িওয়ালা যদি হঠাৎ দোকান খুলে বসে ...বুঝতেই তো পারছেন, লোকে কী না কী বলবে। কিছু বলেন একরাম ভাই, বেশ ঝামেলায় পড়ছি।’

‘হুম।’ একরাম সাহেবের চোখ সরে গেল পত্রিকা থেকে। ‘লোকের কথা বাদ দেন তো। প্রয়োজন আর ইচ্ছেটাই বড় কথা। আপনার ইচ্ছেটা তো শুনলাম। কিন্তু দোকান খোলার প্রয়োজন পড়ল কেন হঠাৎ? বিশ্বভ্রমণের চিন্তাটাই একবার ভেবে দেখুন না! আপনার টাকার গাছটা তো কম বড় হলো না।’

‘আসলে,’ আবুল সাহেব বাঁহাতের কব্জির দিকে তাকালেন, ‘আসলে, আমার একটু কাজ আছে বিদ্যুৎ বিলের অফিসে, আপনার সাথে পরে কথা হবে এই ব্যাপারে, কেমন? এখন আসি।’

একরাম ভাইয়ের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে আবুল সাহেব অফিসে যাওয়ার ভান করে হাঁটতে লাগলেন, ভয় পেয়ে গেছেন। প্রয়োজনটা বলা সম্ভব না তার পক্ষে। তার নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে চিন্তাটাকে ঘিরে। দোকান খোলার প্রয়োজনটা খুব অদ্ভুত আর পাগলামির পর্যায়ে পড়ে। সত্যি বলতে, আবুল সাহেব নিজেকে জনপ্রিয় করতে চান। ছোটবেলায় তিনি দেখেছেন, এলাকার সাধারণ এক দোকানের নামে সেই এলাকার কোনো রাস্তা, সেই দোকানের নামানুসারে হয়ে যায় । কখনো তো আবার পুরো এলাকার নামটাই পালটে যায় সেই দোকানের জন্য। সাধারণ মানুষ দোকানের নামটাকে ঠিকানা হিসেবে ব্যাবহার করে । আবুল সাহেবেরও অনেক দিনের ইচ্ছে তার সাথে এমনটা হয়। জনপ্রিয় হওয়ার জন্য আরও অনেক কিছু করা যায় তবে দোকান খোলাটাকে বেশি সহজ মনে হলো আবুল কাসেমের। লোকজনের মুখে মুখে তার নামটা সর্বত্র ঘুরে বেড়াবে, মানুষ তাকে নিয়ে ভাববে। আবুলের দোকান থেকে আবুলের রাস্তা কিংবা আবুলপুর হয়ে যেতেও তখন খুব একটা সময় লাগবে না। ভাবতে ভাবতে আবুল সাহেবের বুকটা দু-ইঞ্চি ফুলে যায়। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেন তিনি।

হুম...দোকান তাকে খুলতেই হবে।

দোকান দিতে বেশিদিন লাগল না। ফোনে কয়েকটা টেপাটেপি আর দু-চারটা কল করে দু-তিনদিনের ভিতর এলাকার ভিতরেই একটা দোকানভাড়ার ব্যবস্থা করে ফেললেন। বাকি কয়েকদিনে লোক লাগিয়ে মালামাল এনে শুধু দোকান ফিটফাট করা। জায়গাটা নিজ বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। আবুল সাহেবের মনের মতো একটা জায়গায় যেন গেড়ে বসে আছে দোকানটা! আশা ছিল পুরো দোকানটাই কিনে ফেলবেন। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? মালিকের মত না থাকায় কিনতে পারলেন না। মনে মনে এখন শুধু ভয় উঁকি মারে, এলাকার নামটাই না আবার ফজর পাড়া হয়ে যায়। মালিকের নাম ফজর আলী আলাউদ্দীন কিনা!

এসব ছোটখাটো দুশ্চিন্তা বাদে দোকানের সব কাজ ভালো মতোই এগোচ্ছে। আবুল কাসেম দোকানের একটা নামও ঠিক করে ফেলেছেন। ‘‘আবুলের দোকান’’ নামের সাইনবোর্ড লাগানোটাও এই শেষ হয়ে এল। লোকে এই অদ্ভুত সাইনবোর্ডটা দেখে হাসলে হাসুক, তাতে কিচ্ছুটি যায় আসে না আবুল সাহেবের।

দোকান খোলার চতুর্থ দিনে আবুল সাহেব দোকানের ছেলে ছোকরাকে কাজের ফরমাশ দিচ্ছিলেন। আশেপাশে আচমকা শোরগোল শোনা গেল। বড় নেতারা এলাকায় আসলে যেমনটা হয় আরকি। গুঞ্জনটা দোকানের কাছাকাছি এলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সেদিকে নজর দিলেন আবুল সাহেব।

মোটাসোটা টাকমাথার এক লোক দুই পাশে দুই হোৎকা মার্কা মাস্তান টাইপের লোক নিয়ে হেঁটে আসছে। এই দিকে আসতে দেখে আবুল সাহেব আন্দাজ করে নিলেন, টাক মাথা ফজর আলী ছাড়া আর কেউ না। আচার-আচরণ দেখে বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছে না এই ভদ্রলোককে।

বেপরোয়া ভঙ্গিতে দোকানে ঢুকে পড়ল তিনজন। ‘এই হানে আবুল ক্যাডা?’ চেঁচিয়ে বলল এক মাস্তান। অথচ ভালো করেই জানে আবুল কে।

ভীষণ চটে গেছেন আবুল সাহেব। গাধাটা জানে না এলাকার কতবড় বাড়িওয়ালা তিনি। গাধা তিনটাকে একসাথে পুতে তার উপর আরেকটা বাড়ি এখন সহজেই বানাতে পারেন তিনি।

আবুল সাহেব তবু ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন, ‘হ্যা, আমি। কেন? কোন সমস্যা?’

‘হুম, সমইস্যা একখান হইছে বটে,’ বললেন ফজর আলী। ‘আমার শালার ফুফাতো ভাইয়ে এই দোকানখান ভাড়া চাইছে। আপনের কথা হ্যারে কইছিলাম,’ একটু থেমে ফিচকা হাসি দিল টাকমাথা। ‘আর হ্যায় কইছে আপনার থাইকা ভাড়া বেশি দিবো। আপনে যেহেতু আইসা পড়ছেন, থাহেন। তয় দুই মাস পর ফুইটা যাইবেন, বুঝছেন?’

‘দুই মাস!’ আবুল সাহেবের মাথায় যেন বাজ পড়ল। কোনোমতে তাল সামলালেন তিনি।

‘হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত কেন? আগে বললে ত পারতেন। এইভাবে ভড়ং বাজি করলেন কেন ভাই আমার সাথে?’ আবুল সাহেবের গলা ধরে এল। মাথা বনবন করতে লাগল। এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল।

‘বাদ দেন,’ ফরজ আলীর কাঠখোট্টা গলা, ‘আপনে দুইমাস পর চইলা যাইবেন। এইডা আমার সাফকথা। আর একখান কথা, দোকানখান সাফছতুর রাখা লাগবো। উল্টাপাল্টা কিছু হইলে কিন্তু...’ দুই চেলার দিকে ইঙ্গিত করলেন ফজর আলী, ‘ডান হাত, বাম হাত কিন্তু রেডি আছে। হে হে...এই চল পীরেরবাগে যাই। আউয়াল পোলাডারে ঝাড়া মাইরা আহি।’

ধুপধাপ শব্দ করে ফজর আলী তার সাঙ্গপাঙ্গসহ বিদেয় নিল । আর আবুল সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। প্রচণ্ড রাগে আর কষ্টে পাথর হয়ে গেলেন। ফজর আলীর হুমকির থোরাই পরোয়া করেন তিনি। কিন্তু দুই মাসে তো দোকানের পাবলিসিটি হওয়া অসম্ভব! কোথায় তিনি ভেবেছিলেন নিজের নাম দিয়ে দোকান খুলে একটু পার্ট নেবেন। হলো না। হাস্যকর ইচ্ছেটা হাস্যকরই থেকে গেল। চুল ছিঁড়ে টাক্কু হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আবুল সাহেবের। রাগে কাই হয়ে ভাবতে লাগলেন কী করা যায়। তারপর কী মনে করে যেন উঠে দাঁড়ালেন। মহা গাধা টাইপের ছাত্রকে যদি একমাসে মানুষ বানাতে পারেন, তাহলে দোকানটা জনপ্রিয় করতে কেন দুই মাস লাগবে? দুনিয়া উল্টে যাক! আকাশ বেগুনী হয়ে হোক! আবুল সাহেব জেদ ধরলেন দোকানটাকে উরাধুরাভাবে জনপ্রিয় করবেন এক মাসের মধ্যে! নাহলে, কুকুরের পিঠে চড়ে পুরো এলাকা চক্কর দেবেন। কী ভয়ঙ্কর!

‘এই তোরা দোকানটাকে এই রকমভাবে সাজাবি, যাতে দেখলেই চোখ ট্যারা হয়ে যায়। আর মালপত্তর যত লাগে জোগাড় কর,’ দোকানের ছেলে ছোকরাকে ডেকে বললেন তিনি, ‘আর বাকি সব আমি দেখতাছি’। গটগট করে দোকান ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন আবুল সাহেব।

সেদিন একগাদা পোস্টার-স্টিকার নিয়ে ফিরেছিলেন তিনি। মাঝেমাঝে এখনও কাস্টমারশূন্য দোকানটার দিকে তাকিয়ে থাকেন আর ভাবেন, ‘এখানে বাকি দেওয়া হয়’, ‘একটা কিনলে দেড়টা ফ্রি’ এমন সব দারুণ দারুণ পোস্টার থাকা সত্ত্বেও কাস্টমার কেন এত কম আসে!

***

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, আবুল কাসেমের দোকানে কত চুরি হয়, লসের মুখ দেখে কত লোক দোকানের কাজ ছেড়ে দিল, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দোকানের উঠোনটাও সমানভাবে ক্ষয় হলো--- কাস্টমার আসে, তবুও সেটা খুব একটা মনের মতো না। এভাবে যদি চলতে থাকে তো, দোকানের নামটা শুধু সাইনবোর্ডেই থেকে যাবে, কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। অলরেডি একটা মাস চলেই গেল। বাকি এক মাসে, প্রতিদিন যদি দু’শ কাস্টমার দোকানে না আসে, তাহলে আবুল সাহেবকে নির্ঘাৎ শক্তপোক্ত কুকুর খোঁজা শুরু করতে হবে।

হিল্লোল নামে আবুল কাসেমের এক অ্যাসিস্টেন্ট ছিল। তার পেটে সব কুবুদ্ধির বান্ডিল আর মাথাটা পুরাই খালি। সে পরামর্শ দিল কয়েকটা সাংবাদিক টাংবাদিক এনে কিছু করবে কিনা। দরকার পড়লে লোক ভাড়া করে দোকান নিয়ে মাইকিং করে কীর্তন গাওয়ার বুদ্ধিটাও কাজে লাগানো যাবে । সবশেষে তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘বুঝছেন, কাসেম আংকেল, এই সব হইলো আমার বাম হাতের কাইজ। আপনে কুনু পেরেশান নিয়েন না। আমারে খালি অর্ডার দেন। পটাপট বাঁহাতের খেল দেখায়া দিমু।’

সব শুনে আবুল সাহেব শুধু গোমড়া মুখে মাথাটা ডান বাম করেছেন। ব্যাপারটা কেন জানি মেকি মেকি লাগছে তার কাছে।

দোকান খোলার শুরুর দিকে আবুল সাহেব ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গুপ্তচর লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ‘আবুলের দোকান’ সম্পর্কে ভালো কিছু শুনলেই খবর দেওয়ার কথা ছিল তাদের। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনো খবরই এল না। অগত্যা আবুল সাহেব নিজেই নেমে পড়লেন নিজের নাম ঠিকানা স্বীকৃত হয়েছে কিনা দেখার আশায়। সাধারণত কোনো দোকান এলাকায় বেশ নাম যশ করলে সেটা লোকেমুখে ছড়িয়ে পড়তে বেশি দেরি হয় না। এই ভেবে আবুল সাহেব উঁকি দিলেন সিএন জি স্টেশনে, চক্কর দিলেন ঘিঞ্জি অলিগলিতে, চায়ের দোকানে নানা রকম ছদ্মবেশে । ঐ শুধুমাত্র আবুলের দোকান নিয়ে কেউ কিছু বলছে কিনা দেখার আশায়, কিছুই হলো না। একদিন তো লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শোনায়, পাগল ভেবে পাবলিকের পিটুনীও খেলেন।

আবুল কাসেম তার মাথার ব্যান্ডেজটায় হাত দিয়ে বুঝতে পারলেন, তিনি আসলে একটা বদ্ধ পাগল। নয়তো এমন একটা অদ্ভুত ইচ্ছে হঠাৎ মনে জাগবে কেন? দোকান খোলা, এলাকায় আবুলের দোকান নিয়ে মাতামাতি, তার পেছনে এত এত পয়সা ঢালা, সবকিছু নিশ্চিত এসেছে এই বিকৃত মস্তিষ্ক থেকে। না, না কোনো মানে ছিল না এসবের। আজ থেকে দোকান টোকান সবকিছু বাদ, এর থেকে বাসায় গিয়ে একরাম সাহেবের সাথে সাপলুডু খেলাও অতি উত্তম। ভাবলেন আবুল সাহেব। তবে তার আগে অবশ্য একজায়গায় নিজ পায়ের ধুলো না ফেললেই নয়।

মোটা খরচে মেন্টাল ডাক্তারের গাদা গাদা পরামর্শ শুনে আবুল কাসেম হসপিটাল থেকে বের হলেন। রিকশা খুঁজছেন বাসায় ফেরার জন্য।

‘যাক, বাবা ভালোমতো পাগল হওয়ার আগে হসপিটালে এসেছিলাম। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। আর এমুখো নয়। বাসায় গিয়ে সোজা...হিক!’

আচমকা একটা ব্যাপার মাথায় এল তার।

রিকশাওয়ালাকে তো একবারও জিজ্ঞেস করে হয়নি। দোকানটা যদি সত্যিকার অর্থে জনপ্রিয় হয়েই যায়, তাহলে তো বহু মানুষ অনেক আগেই আবুলের দোকানকে ঠিকানা হিসেবে বানিয়ে ফেলেছে। সেই ক্ষেত্রে রিকশাওয়ালাদেরও অজানা থাকার কথা নয়। পরীক্ষা করে একবার দেখাই যাক না।

‘ঐ খালি! আবুলের দোকান যাবা?’

যত খালি ছিল সব আবুল সাহেবের দিকে তাকাল। আবুল কাসেমের মাথা থেকে হাটু পর্যন্ত একবার করুণার নজর দিয়ে যে যার রাস্তায় চলে গেল মুহূর্তের মধ্যে।

একইভাবে চতুর্থবার চেষ্টার পর আবুল সাহেব যখন কাঁদো কাঁদো গলায় মিরপুর-২ এ যাবার ঠিকানা বলতে যাবেন, হুট করে পেছন থেকে এক রিকশাওয়ালা বলে উঠল, ‘চাচা, কই যাবেন? আবুলের দোকান? দোকানের সামনে না রাস্তার মোড়ে? উইঠা পড়েন।’

আবুল সাহেব তো তাজ্জব! সরেজমিনে দেখতে হয় তো ব্যাপারটা।

সেকেন্ডের অর্ধেকও দেরি না করে, নাচতে নাচতে উঠে পড়লেন রিকশায়।

রিকশা চলমান। আবুল সাহেবের চিন্তার সুতো ঘুরছে। আনন্দ হচ্ছে বটে তবুও মনের ভিতর খচখচানি যেন থামছে না। রিকশাওয়ালার চোখে অশুভ কী যেন আছে। যদি তাকে পাগল ভেবে মশকরা করে। এই যেমন, একটা মানসিক হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দিয়ে বলে ‘এই যে মিস্টার, আবুলের দোকান আইসা পড়ছি। এবার মিয়া ফুটেন! যত্তসব।’

‘দূর! কী ছাই ভাবছি। দেখাই যাক না কপালে কী লেখা আছে।’ বিড়বিড় করলেন তিনি।

ধারণাটা ভুল হলো অবশ্য। রিকশা আবুল কাসেমের চিরচেনা অলিগলিতে এঁকেবেঁকে ছুটছে। তিনি এখন শতভাগ নিশ্চিত ব্যাটা রিকশাওয়ালা এখন তার দোকানেই যাচ্ছে। আগাগোড়া পুরো ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে আরাম করে উপভোগ করতে লাগলেন রিকশাযাত্রাটা। এটা তার দোকান, আবুলের দোকান। জনপ্রিয় না হয়ে আর যাবে কোথায়? সবে মাত্র শুরু হলো। দোকানটা একদিন এমন নাম ছড়াবে যে, বিদেশী বাবুরা এসে তার কাছ থেকে মালপত্তর নিয়ে যাবে। আবুল কাসেমের চিন্তাগুলো আকাশ পাতাল বরাবর ডালপালা ছড়াচ্ছে--- তার নামে ব্রিজ হবে, রাস্তা হবে, স্কুলও হবে।

কী দারুণ একটা ব্যাপার।

‘চাচা দেহি ঘুমাই পড়ছেন। বুঝবার লাহবো তো রিকশাওয়ালা ক্যাডা। ও, চাচা। উইঠা পড়েন দেহি, আবুলের দোকান আইসা পড়ছি।’ ঢুলু ঢুলু চোখে চারপাশটা তাকালেন আবুল সাহেব। তাড়াহুড়ো নেই। জানেনই তো, চোখ খুললে নিজের দোকানটাই দেখতে পাবেন। আড়মোড়া ভেঙ্গে তাই ঘাড়খানা কয়েক ডিগ্রি উপরে তুললেন। সাইনবোর্ডটা নজরে পড়ল। দোকানটা একনজর দেখে পটাং করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

***

আবুল কাসেমের যখন হুশ ফিরল, দোকানটার ভিতর আবিষ্কার করলেন নিজেকে। দোকানের সামনে এমন একটা অঘটন হওয়ার পরও কাস্টমারদের যাতায়াত কমেনি। কয়েকজন ছোকরা সেদিকটা সামলাচ্ছে। আর মাথার পেছনে কে যেন দাঁড়িয়ে ক্ষণে ক্ষণে কাসেম স্যার, কাসেম স্যার বলে চেঁচাচ্ছে।

যা বুঝার বুঝে নিলেন আবুল সাহেব। মনে মনে ছেলেটার কানে দু ঘা বসিয়ে দেওয়ার বাসনা জাগছে। কিন্তু তিনি যে আর শিক্ষক নন।

‘ননসেন্স কোথাকার! আর নাম পেলি না?’ আবুল সাহেবের ধমক দুর্বল শোনাল, ‘দোকানের নাম ‘আবুল’ রাখতে গেলি কেন? গাধা ছাগল কিছু একটা দিয়ে দিতি। আর....দোকান খুলতে হলো কেন তোর? অ, বুঝেছি। সব ঐ ঠিকমতো পড়ালেখা না করার ফল।’

ছেলেটা যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে গেল। ‘স্যার,আমি পটল। আপনি যে এই এলাকায় থাকেন, তা একদম জানা ছিল না। কয়েকমাস আগে আপনাকে মনে করেই আপনার নামে দোকানটা দিয়েছি। বেয়াদবি মাপ করবেন স্যার। বাপদাদার পেশা কী করে ছাড়ি বলুন? রেগে যাবেন না স্যার! নয়তো আবার অজ্ঞান হয়ে যাবেন।’

আবুল সাহেব যেন বিষম খেলেন। চারপাশে কাস্টমারের গিজগিজে ভিড়। নিজের দোকান যখন কিছুই করতে পারল না, সেখানে নিজের পুরনো ছাত্র পটলের ‘আবুলের দোকান’ নিঃসন্দেহে বাজিমাত করে দিয়েছে। ক্রেডিটটা কার? আবুল সাহেবের নাকি পটলের?

ওসব নিয়ে অবশ্য ভাবছেন না আবুল সাহেব। তার ছাত্র যে একটা কজের কাজ করেছে, এটাই অনেক। তার নামে দোকান না খুললেও আবুল সাহেব কোনো কষ্ট পেতেন না।

ক্লান্তিতে আবুল সাহেবের চোখ আবার বন্ধ হয়ে আসছে। মনের মাঝে খেলা করছে অদ্ভুত আনন্দ।

শেষ কথা

আবুল সাহেব এখন একদম অন্যরকম হয়ে গিয়েছেন। বলা ভালো, নিজের ভুলটা বঝতে পেরেছেন। দোকান খুলে, ঢোল পিটিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার মাঝে কোনো মানে নেই। পটলের কথা ভেবেও খুব ভালো লাগে আবুল সাহেবের। মাঝে মাঝে পটলের দোকানের সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। দূর থেকে ছেলেটার কাজকারবার দেখে শান্তি পান। ভাবনা আসে, তার কত পুরনো ছাত্রই না আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে। নিজের পেশায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নানা জায়গায়। তারা তাদের কাসেম স্যারকে হয়তো মনে রাখেনি। তাতে কী? তারা তো মানুষ হয়েছে। সেটাই আবুল সাহেবের কাছে অনেক বড় পাওয়া।

দুমাস পেরিয়ে গেছে, তাই আবুল সাহেবের দোকানটাও আর নেই। তাহলে কী করেন সারাদিন? ওহ হো! ভুলেই গিয়েছিলাম। আবুল কাসেম না সেই আগের মতো মনিপুর স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। সারাদিন মানুষ গড়ার কাজ করেন আর রাতে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখেন। মজার না?