সাজেকের লোমশ আতঙ্ক ও এইট মেটাল ম্যান - শিমুল মন্ডল

হাসির গল্প

সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা চায়ের দোকানটার কাঠের ঝুল বারান্দায় বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভবাদা বলল, “ধ্যাত, এমন হবে জানলে তোদের সাথে আসতামই না।” ভবাদার কথাটার জবাবে যে কিছু বলব সে উপায় নেই, আসলে বেড়াতে এসে এভাবে ঘরে বসে থাকতে কারই বা ভালো লাগে, এমন হবে জানলে হয়ত এদিকে না এসে অন্য কোথাও যাওয়া যেত। আসল ব্যাপারটা হল দুইদিন আগে আমরা তিনজন, মানে আমি, বন্ধু ভুতো আর ভবাদা মিলে বেড়াতে এসেছি হিল টাউন সাজেকে। ঢাকা থেকে যেদিন রওয়ানা হয়েছি সেদিনও দেখে এসেছি ঝকঝকে আকাশে সাদা সাদা মেঘের দল সূর্যের আলো গায়ে লাগিয়ে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বাসে করে যতই দক্ষিণে আসতে লাগলাম ততই যেন মেঘের আনাগোনা বাড়তে লাগল, আর শেষ পর্যন্ত যখন সাজেকে এসে পৌঁছেছি তখন রীতিমত ঝড়ো বাতাস সহ বৃষ্টি হচ্ছে। সাজেক পাহাড়ি শহর, তাই বৃষ্টি এখানে প্রতিদিনই হয়। কিন্তু এই বৃষ্টি সেই ধরনের নয়, এর জাত আলাদা, তা এর ফোঁটার আকার আর বাতাসের বেগ দেখেই বোঝা যায়। আসার পথে চাঁদের গাড়ির রেডিও-তে শুনেছি বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ হয়েছে, সেই নিম্নচাপের প্রভাবেই এই দশা।

 

চাঁদের গাড়ি নামটা যাদের কাছে অচেনা তাদের জন্য বলে রাখি, চাঁদের গাড়ি হল পাহাড়ি জীপ গাড়ির স্থানীয় নাম। গাড়ির অবস্থা যেমনই হোক নামটা বেশ সুন্দর সেটা স্বীকার করতেই হয়। সাজেক শহরটাও অবশ্য ভীষণ সুন্দর, একদমই ছোট শহর, তাতে হাতেগোনা গুটিকয়েক হোটেল আর কটেজ, আর চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ, আর তার মাঝে সাদাকালো মেঘের ভেলা। আসলে কয়েক বছর আগেও সাজকের কথা তেমন একটা কেউ জানত না, বছর তিনেক আগে সরকারি উদ্যোগে এখানে আসা যাওয়ার জন্য পাকা সড়ক নির্মাণের পর থেকেই এদিকে পর্যটকের আনাগোনা বেড়ে গেছে। আর তাছাড়া দেশের দক্ষিণের এইসব দুর্গম অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপদ্রবও কমে এসেছে সেনাবাহিনীর কড়া পাহারার দরুন। আমি বা ভুতো আমরা কেউই এর আগে সাজেকে আসিনি, তাই এবারের বড়দিনের ছুটিতে সাজেকে বেড়াতে আসব সেটা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। ভবাদা আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে একদম শেষ মুহূর্তে, বলতে গেলে আমি আর ভুতোই জোর করে ধরে এনেছি তাকে।

 

ভবাদাকে যারা চেনেন না তাদের জন্য বলি, ভবাদা আমাদের পাড়ার বড় ভাই। ছোট বেলায় একই স্কুলে পড়েছি, তাই সম্পর্কে বড় হলেও ভবাদার সাথে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মত। যদিও ইদানিং ভবাদার দেখা সাক্ষাৎ পাওয়াটা কঠিন হয়ে উঠেছে, তার কারণ ভবাদাকে এখন মোটামুটি বিখ্যাত বা যাকে বলে পাবলিক ফিগার তা বলা যায়। যারা নিয়মিত পত্রিকা পড়েন তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গত বছর “পোনা মাছের পেটে করে সোনা পাচারকারী” একটি চক্রকে ধরেছিল পুলিশ, আর এই চক্রকে ধরিয়ে দিয়েছিল এইট মেটাল ম্যান নামের এক বাঙালি অতিমানব। এই বাঙালি অতিমানব “এইট মেটাল ম্যান” আসলে আর কেউ নয়, আমাদের আদি ও অকৃত্রিম ভবাদা।

 

ভবাদার যে রকম লিকলিকে শরীর আর বারোমাসি পেটের ব্যামো তাতে করে ভবাদাকে অতিমানব হিসাবে কল্পনা করাটা আসলে শুধু কঠিনই না বরং রীতিমত অসম্ভব বলা চলে। কিন্তু তারপরও এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে আমাদের দেশের পত্রিকাওয়ালারা। তাদের ভাষ্য অনুসারে ভবাদা অতিমানব, কারণ তার শারীরিক গড়ন যেমনই হোক না কেন, তার মগজ নাকি পাল্লা দিতে পারে পৃথিবীর যেকোন সুপারহিরোর সাথে। পত্রিকা পড়ে জেনেছি ভবাদার এই অদ্ভুদ অলৌকিক শক্তির উৎস নাকি তার বাম হাতের মধ্যমার শোভা বর্ধন করে থাকা অষ্টধাতুর আংটিটি, এই আংটি নাকি ভবাদার গুরু ভবাদাকে দিয়েছিলেন বারো বছরের কঠিন সাধনা শেষে। যদিও আমার এখনও মনে আছে বছর পাঁচেক আগে একবার সুন্দরবন বেড়াতে গিয়ে ফেরিতে করে পদ্মা নদী পাড়ি দেবার সময় আমার কাছ থেকে কুঁড়ি টাকা চেয়ে নিয়ে সেই টাকা দিয়ে এক কবিরাজের কাছ থেকে অষ্টধাতুর এই আংটিটি ভবাদা কিনেছিলেন কীসব গোপন রোগ সারাবার আশায়! কিন্তু সেকথা তো আর বাইরে বলা যায় না, তাই আমরাও কাউকে বলিনি।

 

সেই চোরাচালানকারী দলটাকে ধরিয়ে দেবার পর থেকেই শুনছি ভবাদার নাকি একের পর এক ডাক আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে, রহস্য সমাধানের জন্য। তো এহেন সুপারহিরো খ্যাত ভবাদাকে যদি বেড়াতে এসে দুইদিন দুই রাত ঘরেই বসে থাকতে হয় তবে তার মেজাজটা যে একটু চড়ে যাবে সে আর আশ্চর্য কী। চা খাওয়া শেষ হতে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভবাদা বললেন, “এরচেয়ে যদি বেলজিয়ামের রহস্যটা সমাধান করতে যেতাম তবেও একটা কাজ খানিকটা এগোত।” আমাদের কথার মাঝেই চায়ের দোকানের ছেলেটা গরম গরম ভাজা পাকোড়া দিয়ে গিয়েছিল, বন্ধু ভুতো সেই পাকোড়ার একটায় সবে কামড় দেবে এমন সময় ভবাদার মুখে আচমকা বেলজিয়ামের কথা শুনে তার বিষম খাবার জোগাড় হল। “বেলজিয়াম এর কী রহস্য ভবাদা?” --- জিজ্ঞেস করলাম আমি।

“আর বলিস না, বেলজিয়ামের রানীর শখের বেলগাছে নাকি বেলের বদলে আম ধরেছে, তাই আমার ডাক পড়েছে।” এবারে আর ভুতোর বিষম খাওয়া আটকানো গেল না। পাছে বেমক্কা হেসে ফেলি আর ভবাদা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সেই ভয়ে আমি আর কথা না বাড়িয়ে পাকোড়া খাবার দিকে মন দিলাম। তখনো কিন্তু জানি না যে, এই সাজেকে বসেই আগামী কয়েক ঘন্টার মাঝেই ভবাদার আশ্চর্য বুদ্ধি আর সাহসের কেরামতি দেখার সৌভাগ্য আমাদের হবে।

রাতের বেলা খেতে গিয়ে একটা অনাকাঙ্খিত আর বিশ্রী ব্যাপারের মুখে পড়তে হল। ব্যাপার হল সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টির দাপট কিছুটা কমে আসায় আমরা ঠিক করলাম আজকে আর নিজেদের কটেজের ডাইনিং-এ না খেয়ে বরং অন্য কোথাও খেতে যাব। আমাদের কটেজ থেকে মাইল খানেক দূরে স্থানীয় লুসাই আদিবাসীদের একটা রেস্টুরেন্ট আছে, শুনেছিলাম সেখানে পাহাড়ি হাঁসের ভুনা আর খিচুড়ি পাওয়া যায়। আমাদের সাথে গাড়ি ছিল, গাড়ি মানে সেই চাঁদের গাড়ি। ড্রাইভারের সাথে কথা ছিল যে কদিন আমরা সাজেকে থাকব সে কদিন সে আমাদের সাথেই থাকবে, তাই সেই গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম পাহাড়ি হাঁসের ভুনা খেতে।

 

খেতে বসে কিন্তু এদের সুনাম এর কারণ বুঝতে পারলাম, পাহাড়ি ঠাণ্ডা আর বৃষ্টির মধ্যে হাঁসের মাংসের সাথে গরম গরম খিচুড়ি আর বেগুন ভাজি যেন অমৃত সমান। আমাদের মধ্যে ভুতো আবার বেশ ভোজন রসিক, সে একের পর এক তিন প্লেট খিচুড়ি শেষে যখন আবার আরেক প্লেটের অর্ডার করল তখন খানিকটা খোঁচা মেরে ভবাদা তাকে “পেট মোটা”, “হাভাতে”, “ভুক্ষার” অনেক কিছু বলল। ভবাদা সমানে এইসব বলছে আর সাথে খ্যাঁকখ্যাঁক করে তার ট্রেডমার্ক গা জ্বালানি হাসি হাসছে, এমন সময় আমাদের পিছনের টেবিল থেকে একটা লোক উঠে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। লোকটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, লোকটার বিশাল বপু আর বিরাট হাতের পাঞ্জা, গায়ের রঙ আবলুস কাঠের মত কালো, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল আর মুখভর্তি দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। লোকটা এসে কোন কথাবার্তা ছাড়াই ভবাদার কলার ধরে এক হ্যাচকায় ভবাদাকে চেয়ার থেকে খানিকটা উঁচু করে ফেলল, তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “খাওয়া আর মোটা নিয়ে যদি আর একটাও কথা বলেছিস শুটকো, তবে এক চাপে তোকে চিড়ে চ্যাপ্টা করে দেব।”

 

ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা একদম হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, সেই ভাব কাটতেই লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ভবাদাকে ছাড়ালাম। এরই মধ্যে রেস্টুরেন্ট এর মালিক আর একজন মহিলা ছুটে এসেছিল। তারা মিলে লোকটাকে সরিয়ে নিয়ে গেল, কিন্তু লোকটার রাগ পড়ল না, দেখলাম খাওয়া শেষ না করেই বিল দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে অবশ্য একটু সুযোগ পেয়ে সেই মহিলা আমাদের কাছে এসে দুঃখ প্রকাশ করে গেলেন। তখনই জানলাম লোকটা ভদ্রমহিলার স্বামী। ভদ্রমহিলা বললেন, “আমার স্বামী একটু হেলদি তো, আপনাদের কথা শুনে ভেবেছে আপনারা ওকে নিয়ে মজা করছেন, তাই রেগে গেছে, আপনারা প্লিজ কিছু মনে করবেন না। ওর হয়ে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।” আমরা ততক্ষণে নিজেদের ভুলটা বুঝতে পেরেছি, আসলে এভাবে পাবলিক প্লেসে কাউকে নিয়ে মজা করার আগে আমাদেরও লক্ষ করা উচিৎ ছিল যেন অন্য কেউ কষ্ট না পায়। তাই ভদ্রমহিলার কাছে আমরাও দুঃখ প্রকাশ করে ঝামেলা মিটিয়ে নিলাম।

 

ভবাদার মুড অফ হয়ে গিয়েছিল, তাই খাওয়া শেষে ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে চা কফি খেয়ে ভবাদার মুড যখন কিছুটা ভাল হয়েছে তখন গাড়ি ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে সাজেকের রাস্তায় ঘুরতে বের হলাম। বাইরে বৃষ্টি ছিল না, কিন্তু আকাশের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছিল রাতেই আবার আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় পথ দেখে দেখে আমরা যখন আমাদের নিজেদের কটেজে ফিরে আসছি তখন হঠাৎ পথের মাঝে দাঁড়িয়ে পরল ভবাদা, তারপর রাস্তার বাঁদিকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা হোটেল এর দিকে তাকিয়ে বলল, “সোনা চোরাচালানকারী মুষকোটা তাহলে এই রিসোর্টে উঠেছে।”

তার কথা শুনে ভারি অবাক হয়ে হোটেলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দোতলার ডানদিকের একটা জানালায় সেই বিশাল বপুর লোকটা উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাত পা নাড়ানোর ধরনে মনে হল কারো সাথে কথা কাটাকাটি হচ্ছে।

“লোকটা যে সোনা চোরাচালানকারী সেটা কীভাবে বুঝলে ভবাদা?” --- প্রশ্ন করলাম আমি। একবার একটা সোনা চোরাচালানের দলকে ধরিয়ে দিয়েছে মানে যে দুনিয়াসুদ্ধ সবাই সোনা চোরাচালান করবে এটা ভবাদার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। “লোকটার হাতের আংটিগুলো তোরা বোধহয় খেয়াল করিসনি।”--- বলল ভবাদা। আমি আর ভুতো অবাক হয়েছি দেখে ভবাদা আবার বলল, “লোকটা যখন আমার কলার ধরল, তোরা কি ভেবেছিলি আমি ভয় পেয়ে চুপ মেরে গেছি? আসলে আমি তখন ওর হাতের পাঁচ আঙ্গুলে যে পাঁচটা আংটি আছে সেগুলো ভাল করে দেখে নিচ্ছিলাম।”

“তাই নাকি? তা আংটি দেখে কী বুঝলে?” --- এবারে ভুতো জিজ্ঞেস করল।

“এখনও তেমন কিছু বুঝতে পারিনি, তবে এত এত সোনা যার আঙ্গুলে শোভা পায় সে লোকটা যে কোন না কোন ভাবে সোনা চোরাচালানের সাথে যুক্ত সেটা যে কেউ বলে দিতে পারে।” --- বলল ভবাদা।

 

আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, তাই ভবাদার সাথে আর তর্কে না গিয়ে চুপচাপ কটেজে ফিরে এলাম। তারপর বিছানায় শুয়ে কটেজের টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। রাতে একবার মনে হল আমাদের কাঠের কটেজটা যেন একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে! আমি ঢাকা শহরের মানুষ, তাই একটুতেই ভুমিকম্পের ভয় লাগে। উঠে দৌড় দেব কিনা ভাবছি, সেই সময় পাশের বিছানা থেকে ভবাদার গলা পেলাম --- “এই জন্য এসব কাঠের কটেজে নব বিবাহিতদের ভাড়া দিতে নিষেধ করেছিলাম ম্যানেজারকে, সে ব্যাটা শুনল না।” অগত্যা হাসি চেপে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম, আর সেই ঘুম ভাঙল একদম সকালে, অনেক মানুষের সম্মিলিত কোলাহল আর কান্নাকাটির শব্দ শুনে।

ঘুম ভাঙতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ফোটেনি; পাশের বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভুতো আর ভবাদারও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। একটু ভাল করে কান পেতে শুনে বুঝলাম হৈচৈ আর কান্নাকাটির শব্দটা আসছে আমাদের কটেজের দক্ষিণ থেকে--- সাজেকের গাড়ির স্ট্যান্ড আর গির্জাটা সেদিকেই। ভবাদা দেখলাম সটান বিছানা থেকে উঠে পড়ে গায়ে একটা সোয়েটায় চড়িয়ে নিল, তাপর আমাকে বলল, “চল তো দেখে আসি কী ব্যাপার, কিছু একটা ঘটেছে মনে হচ্ছে।”

আমি আর ভুতোও উঠে পড়লাম। কটেজ থেকে বের হয়ে দেখলাম আরও অনেকেই সেই হল্লা শুনে সেদিকেই যাচ্ছে। কাল রাতে যে কটেজে ভবাদার কথিত সেই চোরাচালানকারিকে দেখেছিলাম, তার থেকে কিছুটা সামনে আসতেই দেখলাম রাস্তার বামে পাহাড়ের ঢালের একটা পেঁপে বাগানের গাছগুলো তছনছ হয়ে আছে। মনে হল যেন প্রবল আক্রোশে কেউ গাছগুলো কে উপড়ে ফেলেছে। পেঁপে বাগান থেকে খানিকটা সামনে একটা পাহাড়ি কলার বাগান ছিল, সেই বাগানেরও দেখলাম একই দশা। দেশের দক্ষিণের এই পার্বত্য অঞ্চলে এখনও কিছু বুনো হাতির দল টিকে আছে জানতাম--- সব দেখে শুনে মনে হল হয়ত তেমন কোন বুনো হাতির দল হামলা করেছে বাগানগুলোতে। ভবাদাকে সেকথা বলায় সে অবশ্য কোন জবাব দিল না।

 

আরেকটু সামনে এগিয়ে স্থানীয় গির্জার সামনে আসতেই দেখলাম লোকজনের ভিড় জমেছে গির্জার বারান্দার সামনে। সেই ভিড়ে দেশি বিদেশি পর্যটক, চাঁদের গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে স্থানীয় লুসাই আদিবাসী সব মিলে মিশে একাকার অবস্থা। লোকের ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখলাম বারান্দার গির্জার ফাদার, একজন আর্মি অফিসার আর কয়েকজন বৃদ্ধ লুসাই মহিলা বসে আছেন। তাদের পাশে এক লুসাই মেয়ে বসে বসে কান্নাকাটি করছে আর কান্নার মাঝে মাঝে কিছু একটা বলছে। লুসাই মেয়েটাকে দেখে চিনতে পারলাম, গির্জার থেকে একটু সামনে গেলে এই মেয়েটার একটা চা কফি আর জুসের দোকান আছে। তার দোকানে গতকাল সকালেও আমরা তাজা পেঁপের জুস খেয়েছি। সাজেকের আদিবাসী লুসাই পরিবারগুলো মাতৃতান্ত্রিক, চাষাবাদ থেকে শুরু করে সাজকের স্থানীয় দোকানগুলো তারাই চালায়। ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে তার কথা শুনে যেটা বুঝলাম সেটা হল, কাল রাতে কোন এক লোমশ দানব তার দোকানটার উপর হামলা করেছে।

 

টানা বৃষ্টির কারণে এমনিতেই পর্যটক কম, তাই কাল রাতে দশটার দিকে দোকান বন্ধ করে মেয়েটা বাড়ি চলে গিয়েছিল। দোকানের একটু পাশেই তার বাড়ি, পাহাড়ের ঢাল আর গাছপালার কারণে দোকান থেকে বাড়িটা দেখা যায় না। বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর আনুমানিক রাত দুটোর দিকে দোকানের এদিক থেকে কুকুরের ডাক শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। লুসাই পরিবারের সবাই কুকুর পোষে, ফসলের ক্ষেত আর দোকান পাহারা দেবার জন্য এই সব কুকুরের কোন জুড়ি নেই। কুকুরের ডাক শুনে মেয়েটা বৃষ্টি মাথায় করে দেখতে আসে দোকানের সব ঠিক আছে কিনা। সাজেকে বিদ্যুৎ নেই, সন্ধ্যার পর জেনারেটর চলে, তবে দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলে সেই জেনারেটরও বন্ধ করে দেয়া হয়, তাই দোকানের এদিকটা বেশ অন্ধকার হয়ে ছিল। দোকানের কাছাকাছি আসতে বিদ্যুৎ চমকের আবছা আলোয় মেয়েটা দেখে কেউ একজন তার দোকানের বন্ধ ঝাঁপ টেনে খোলার চেষ্টা করছে। মেয়েটা প্রথমে মনে করেছিল কোন মানুষ, তাই চিৎকার করে তার দিকে তেড়ে যায়। কিন্তু কাছাকাছি যেতেই প্রাণীটা মেয়েটার দিকে ঘুরে তাকিয়ে দাঁত খিচিয়ে মেয়েটার দিকে তেড়ে আসে। ভয়ে মেয়েটা সেখানেই জ্ঞান হারায়, জ্ঞান ফিরলে সে দেখে প্রাণীটা অদৃশ্য হয়েছে, তখন সে বাড়ি ফিরে গিয়ে বাকিদের জানায়। আলোর অভাবে প্রাণীটাকে ভাল করে দেখতে না পারলেও মেয়েটা জোর দিয়ে বলল তার চেনা জানা কোন প্রাণী সেটা নয়, পাহাড়ি হাতি হবার তো প্রশ্নই আসে না। তার যেটুকু মনে আছে তাতে করে সে বলল প্রাণীটার লোমশ শরীর, কুচকুচে কালো রঙ, আর ঝকঝকে দাঁতের সারি সে দেখেছে। তার কথা শুনে আমার মনে হল প্রাণীটা হয়তো পাহাড়ি ভাল্লুক বা শিপাঞ্জি গোছের কিছু হবে, কিন্তু সাজেকের এদিকে ভাল্লুক বা শিম্পাঞ্জি আছে বলে কখনো শুনিনি।

 

ভবাদাকে বললাম কথাটা, সাথে করে এটাও বললাম যদি এই পাহাড়ি অঞ্চলে ভাল্লুক বা শিপাঞ্জি খুঁজে পাওয়া যায় তবে সেটা একটা জাতীয় খবর হবে। আমার কথা শুনে ভবাদার মাঝে কিন্তু কোন উৎসাহের লক্ষণ দেখা গেল না। তার বদলে একটা হাই ছেড়ে সে বলল, “ছ্যা! এসব ভাল্লুক শিপাঞ্জি ধরা কি আমার কাজ নাকি, যদি মানুষ খেকো বাঘ বা চিতা হত তাহলেও না হয় চেষ্টা করে দেখা যেত।” তারপর আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে ভবাদা বলল, “চল, চল, এইসব বাজে ব্যাপারে সময় নষ্ট না করে সকালের নাস্তাটা করি গিয়ে।” অগত্যা ভবাদার সাথে ফেরার জন্য যখন পা বাড়িয়েছি, ঠিক তখন দেখলাম আমাদের কটেজের দিক থেকে বেশ কয়েকজন লোক আর তাদের সাথে সেই কালকের দেখা সেই ভদ্রমহিলা ছুটে আসছেন গির্জার দিকে। মহিলার চোখ মুখ দেখে বোঝা গেল প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন। তারা এসে ভিড়টার ভিতর ঢুকতেই ভিড়টা যেন আবার প্রাণ ফিরে পেল আর সাথে সাথে জনতার কোলাহলও যেন এক নতুন মাত্রা পেল।

আমাদের আর নাশতা করতে যাওয়া হল না, আবার ফিরে এলাম ভদ্র মহিলার কথা শোনার জন্য। ভদ্র মহিলা এসে সরাসরি বারান্দার আর্মি অফিসারের কাছে চলে গেলেন, তারপর স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, “অফিসার, মাই হাসব্যান্ড ইজ মিসিং, আই সিক ফর ইয়োর হেল্প।” মহিলার ইংরেজি শুনে সকলেই একটু নড়েচড়ে বসল, যেন বুঝতে পারল হেলাফেলা করার মত মহিলা এ নয়। এরপর ঝড়ের মত বাংলায় মহিলা তার সমস্যাটা বলে গেল। তার কথা শুনে যেটা বুঝলাম, তিনি আর তার স্বামী দুজনেই বাঙালি হলেও বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। একমাসের ছুটিতে দেশে এসে ভেবেছিলেন নিজের দেশটা একটু ঘুরেফিরে দেখবেন। সেইমত দুদিন আগে সাজেক এসেছেন। রাতে ঘুমানোর আগে স্বামীর সাথে সামান্য একটু তর্ক বিতর্ক হয়ে ছিল তার। রাতের ডিনারে গিয়ে কয়েকজন পর্যটকের সাথে সামান্য ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তার স্বামী, সেই নিয়েই কথা কাটাকাটি। এপর্যন্ত শুনে বুঝলাম আমাদের কথাই হচ্ছে--- মনে মনে প্রমাদ গুনলাম! এখন যদি মহিলার স্বামী নিখোঁজের দোষ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে তবেই হয়েছে।

 

মহিলা অবশ্য সেদিকে না গিয়ে বলে চললেন। কথা কাটাকাটি হবার কারণে তিনি আর তার স্বামী আলাদা দুটো বিছানায় ঘুমিয়েছিলেন। আজকে সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখেন তার স্বামী বিছানায় নেই। প্রথমে ভেবেছিলেন সে হয়তো বাইরে বেরিয়েছে, যদিও এত সকালে তার স্বামী কখনো ঘুম থেকে ওঠেন না। কিন্তু ঘন্টা দুই হয়ে গেলেও যখন তার স্বামী ফিরে আসলেন না, তখন খোঁজ নিতে গিয়ে জানলেন হোটেলের কেউই তার স্বামীকে দেখেনি। এরপর শুনলেন রাতে সাজেকে এক বন্য প্রাণীর আক্রমণ হয়েছে, তাই এখন তিনি এখানে ছুটে এসেছেন।

 

ভদ্রমহিলার কথা শেষ হতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, ভাগ্যিস ভদ্রমহিলা দোষটা আমাদের উপরে দেননি। তবে কিছুই বলা যায় না, কিছুক্ষণ পর হয়তো দিতেও পারেন। সাজেক ছেড়ে আজকেই চলে যাব কিনা ভাবছি, এমন সময় পাশে তাকিয়ে দেখি ভবাদা নেই। আমি প্রামাদ গুনলাম, ভবাদা কি এর মধ্যেই ভেগে গেল নাকি? “অফিসার, আমাকে না চিনলেও আমার নাম নিশ্চয়ই আপনি শুনেছেন, আমি ভবাদা ওরফে এইট মেটাল ম্যান। কাল রাতে আমার সাথেই ওনার স্বামীর খানিকটা ঝামেলা হয়েছিল।” - গলা শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি কোন সময়ে জানি ভবাদা বারান্দার গিয়ে উঠেছে। মনে মনে ভবাদার সাহসের প্রসংসা না করে পারলাম না। ভবাদার পরিচয় পেয়ে আর্মি অফিসার সম্ভ্রম সহকারে উঠে দাঁড়িয়ে তার সাথে হাত মেলালেন, তারপর আরও দুটো চেয়ার এনে ভদ্রমহিলা আর ভবাদার বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। চেয়ারে বসে ভবাদা বললেন, “অফিসার আমাদের উচিৎ প্রথমেই ওনার স্বামীকে খুঁজে বের করা। তিনি কি নিজেই কোথাও গিয়েছেন, নাকি সেই মানুষখেকো লোমশ আতঙ্ক কি তাকে ধরে নিয়ে গেছে সেটা আগে যাচাই করা দরকার।” ভবাদার এই কথায় উপস্থিত ভিড়ের মাঝে যেন কবরের নীরবতা নেমে এল। আসলে লুসাই মেয়েটার সেই লোমশ দানবের গল্প এতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণের জন্য নিতান্তই এক বিনোদনের ব্যাপার ছিল, কিন্তু ভবাদার এই কথার সাথে সাথে যেন সবাই বিপদের মাত্রাটা অনুধাবন করতে পারল।

 

সাজেকের লোমশ আতঙ্ক, ভবাদা অবশ্য নামটা দারুণ দিয়েছে। কিন্তু কলা আর পেঁপে বাগানে হামলা করা দানব যে কীভাবে মানুষখেকো হয়ে গেল সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। এদিকে ভবাদার কথা শুনে ভদ্রমহিলা হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন; কোন রকমে তাকে থামিয়ে সেই আর্মি অফিসারকে উদ্দেশ্য করে ভবাদা বললেন, “চলুন সবাই মিলে আশে পাশে খুঁজে দেখি, লোকটাকে যদি সেই দানব ধরেই নিয়ে যায় তবে কোথাও না কোথাও তার প্রমাণ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।”

ভবাদার কথার জবাবে সেই আর্মি অফিসার জানালেন, পাহাড়ি ভারি বৃষ্টিতে দীঘিনালায় সাজেকে আসার পথে পাহাড় ধ্বস হয়েছে, আর্মির এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য সেখানে রাস্তা মেরামতের কাজ করছে। এমন অবস্থায় সার্চ পার্টি করার মত এত সৈন্য সাজেকে মজুদ নেই। আর্মি অফিসারের কথায় কিন্তু ভবাদা দমে গেল না, বরং এমন একটা ভাব করল যেন এটা কোন ব্যাপারই না। ঝটপট বুদ্ধি খাটিয়ে ভবাদা বলল, “দেখুন ওনাদের হোটেলটাকে যদি বেস পয়েন্ট ধরি, তবে তার উত্তরদিকটাতে কোন বাগানে বা কারো উপর হামলা হয়েছে এমনটা শুনিনি, তাই ছোট্ট একটা দল সেদিকে গেলেই হবে। বাকি আমরা যারা আছি তারা রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিকটাতে খুঁজতে শুরু করি। খুব বেশি লোক তো এতে লাগবে না।” এই বলে ভবাদা সাহায্যের আশায় সমবেত জনতার দিকে তাকালেন। একটু আগেও মজা নেবার আশায় অনেক লোকের ভিড় জমেছিল, কিন্তু মানুষখেকো দানবের কথা শুনে তাদের বেশির ভাগ ইতিমধ্যেই যার যার মত কেটে পড়েছে। এইবেলা মানুষখেকোর সন্ধানে যেতে হবে শুনে বাকিরাও কেটে পড়ল। পাহাড়ি লুসাইরা খুব সাহসি হয়, তারা এগিয়ে এল, এটা তাদের সুনামের ব্যাপার। ভবাদার কথামত সেই আর্মি অফিসার তখন দ্রুত লুসাইদের একটা ছোট দলকে উত্তরের দিকে পাঠিয়ে দিলেন, তারপর আমরা বাকিরা মিলে দুটো জিপে করে দক্ষিণের দিকে গেলাম খুঁজতে। বেশিদূর অবশ্য খুঁজতে হল না, আধামাইল যেতেই রাস্তার পাশে একটা কাটা ঝোপের উপর একটা চকলেট রঙের তোয়ালে পড়ে থাকতে দেখে আমরা গাড়ি থামালাম। সেই ভদ্রমহিলা আমাদের সাথেই ছিলেন, তোয়ালেটা দেখেই তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।

আমাদের ম্যাড়ম্যাড়ে বিবর্ণ সাজেক ভ্রমন যে আচমকা এমন আতঙ্ক আর উত্তেজনার দিকে মোড় নেবে সেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি। তোয়ালেটা দেখে ভদ্রমহিলা বললেন সেটা তার স্বামীর তোয়ালে, বিদেশ থেকে কেনা। তোয়ালেটা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন তিনি, তার কান্না শুনে মনে হল স্বামীকে ফিরে পাবার আশা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। ভবাদা আর সেই আর্মি অফিসার গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে পাহাড়ের ঢাল ধরে কিছু একটা খুঁজে ফিরছিলেন, হয়তো ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন বা রক্তের দাগ। এমন সময় সেই আর্মি অফিসার কিছু একটা দেখে হাতের ইশারায় আমাদের সেদিকে ডাকলেন। কাছে গিয়ে দেখি তোয়ালেটা যেখানে পাওয়া গেছে তার থেকে হাত পনেরো সামনে পাহাড়ের ঢালের লতা গুল্মের ঝোপ দুমড়ে মুচড়ে গেছে, দেখে মনে হয় ভারি কোন কিছু সেখান দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি ভাল করে তাকিয়ে আশেপাশের মাটিতে পায়ের ছাপ খোঁজার চেষ্টা করছি দেখে ভবাদা আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “পায়ের দাগ বা রক্তের দাগ খোঁজার চেষ্টা করিস নে, রাতের বৃষ্টিতে সেসব ধুয়ে গেছে।”

আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম - “তুমি এমন ফিসফিস করে কথা বলছ কেন ভবাদা?”

জবাবে দূরে গাড়িতে বসে থাকা ভদ্রমহিলার দিকে চোখের ইঙ্গিত করে ভবাদা বলল - “ওনাকে এখনই জানানো চলবে না যে তার স্বামী আর বেঁচে নেই, আর তাছাড়া কে জানে হয়তো সেই প্রাণীটা আশেপাশেও থাকতে পারে।” ভবাদার ফিসফিসিয়ে কথা বলার ধরনে কিছু একটা ছিল যাতে করে ভয়ের একটা শিহরণ বয়ে গেল আমার শরীর জুড়ে। সবাই মিলে আবার গাড়িতে উঠে ফিরে চললাম গির্জার দিকে, পরবর্তী সিদ্ধান্ত সেখানে বসেই নিতে হবে।

 

গির্জায় ফিরে দুজন লুসাই মেয়েকে দিয়ে ভদ্রমহিলাকে তার হোটেলে ফেরত পাঠানো হল--- তার কান্না তখনো থামেনি। এদিকে তোয়ালে খুঁজে পাবার কথাটা কীভাবে যেন চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। যারা এতক্ষণ ইতস্তত ঘোরাফেরা করছিল তারাও মানুষখেকো দানবের ভয়ে তড়িঘড়ি করে যার যার ঘরে ফিরে গেল। বেশ বুঝতে পারলাম আতঙ্কের একটা চাদর যেন আচমকা কেউ বিছিয়ে দিয়েছে পুরো সাজেকের উপর, সাধারণ শহুরে পর্যটকের দল থেকে শুরু করে লুসাইরা পর্যন্ত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। রাস্তা সম্পূর্ণ ফাঁকা, এর মাঝে আবার টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এদিকে গির্জার ভিতরে আমরা সবাই মিলে একটা আলোচনায় বসলাম। গম্ভীর মুখে ভবাদা বলল, “যে করেই হোক ওই পাহাড়ের ঢাল ধরে নেমে দেখতে হবে প্রাণীটা লোকটাকে কোথায় ধরে নিয়ে গেছে।” আর্মি অফিসার ভবাদার কথার প্রতিবাদ করল, তার ভাষ্যমতে পর্যাপ্ত অস্ত্র আর সৈন্য ছাড়া ওই ঢাল বেয়ে নামা আর মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাওয়া নাকি একই কথা হবে। তিনি আমাদের বললেন, “আপনারা যে যার কটেজে ফিরে যান, আমি এরই মধ্যে ক্যাম্পে খবর দিয়েছি, আমাদের সৈন্যদের একটা দল দীঘিনালার রাস্তা ঠিক হলেই এখানে এসে পৌঁছাবে। তারা এসে পৌঁছানো মাত্র, সবাই মিলে ঢাল বেয়ে দানবটাকে খুঁজতে যাব।” আমার মন কিন্তু তার কথায় সায় দিচ্ছিল না, দীঘিনালার রাস্তার কথা যা শুনেছি তাতে আগামী দশঘন্টার আগে মনে হয় না কেউ সেদিক দিয়ে সাজেকে আসতে পারবে। ততক্ষণ দেরি করলে লোকটাকে বাঁচানোর কোন আশাই থাকবে না, যদিও লোকটা আর বেঁচে আছে কিনা সেটাও জানি না। ভবাদা সকল আশা ছেড়ে দিলেও আমার মন বলছিল তেমন খারাপ কিছু হয়তো লোকটার ভাগ্যে ঘটেনি।

 

ভবাদাকে বললাম কথাটা, খানিকটা দোনমনা করে শেষপর্যন্ত আমার সাথে ভবাদাও একমত হল। আর্মি অফিসারকে উদ্দেশ্য করে ভবাদা বলল, “আমরা এদিকে আপনার লোকের আশায় বসে থাকব, আর মানুষখেকোটা ওদিকে আরাম করে মোটা লোকটার গোশত খাবে সে আমি হতে দেব না। আমরা যে করেই হোক সে দানবের খোঁজে যাব।” ভবাদার মুখে আমি-র বদলে আমরা শুনে আমাদের মত আর্মি অফিসারও অবাক। তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ভবাদা আমার আর ভুতোর দিকে ইশারা করে বলল, “ওরা আমার পাড়ার ছেলে, ওদের সাহসও আমার চেয়ে কোন অংশে কম নয়, আপনারা না গেলে আমরা তিনজন যাব লোকটাকে খুঁজতে।” ভবাদার আবেগঘন বক্তব্য শুনে ভুতো বেচারা বেমক্কা কাশতে শুরু করল। কিন্তু ভবাদার তার দিকে কটমট করে তাকাতেই সে বেচারা কাশি থামিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল। কয়েকজন লুসাই মেয়েও আমাদের সাথে এগিয়ে এল, তারাও যাবে আমাদের সাথে। অবস্থা বেগতিক দেখে আর্মি অফিসার ভবাদার কথা মেনে নিলেন। আর্মি অফিসারের সাথে দুজন সৈনিক ছিল রাইফেল হাতে, তারাও এগিয়ে এল। শেষ পর্যন্ত মোটামুটি বারো জনের একটা দল নিয়ে আমরা আবার রওয়ানা হলাম সেই ঢালের দিকে।

সবাই মিলে আবার যখন ঢালের কাছে এসে পৌঁছালাম তখন ভাগ্যক্রমে বৃষ্টি একদম থেমে গেছে, তবে আকাশে কালো কালো জলভরা মেঘের দলের আনাগোনা বুঝিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি আপাতত থামলেও যেকোন মুহূর্তে আবার শুরু হবে। সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক হল, সবার আগে থাকবে ভবাদা, তার পিছনেই থাকবে অস্ত্রসহ সিপাহী দুজন, আর আমরা বাকিরা পিছনে। ভবাদা আমার আর ভুতোর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওরা দুজন আমার সাথেই থাকবে, ওদের কোন বিপদ হোক সেটা আমি চাই না।” অগত্যা আমি আর ভুতো ভবাদার পিছনে পিছনে গেলাম; ভবাদা তার বাম হাতের অষ্টধাতুর আংটিটায় একটা চুমো খেয়ে সামনে পা বাড়াল। পাহাড়ের ঢালের লতা পাতার ঝোপের মধ্য দিয়ে লোকটাকে যেখান দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে সেদিক দিয়ে একটা সরু পথ মত হয়ে গিয়েছিল। সেই চিহ্ন ধরে ধরে পা টিপেটিপে আমরা এগোতে লাগলাম। মুখে কোন শব্দ না করলেও বুঝতে পারছিলাম বাকি সকলেরও আমার মতই দশা, উত্তেজনায় হৃদপিণ্ড এত দ্রুত চলছে যে মনে হচ্ছে অন্যরাও সেই শব্দ শুনতে পাবে। চারিদিকে অখণ্ড নীরবতা, এর মাঝে সেই ঝোপ ঝাড় ঠেলে একশো মিটার মত নিচে নেমে এলাম আমরা, আর ঠিক তখনই হাতের ইশারা করে ভবাদা আমাদের থামতে বলল।

 

ভবাদার দৃষ্টি লক্ষ করে তাকিয়ে দেখলাম সামনে বিশ পঁচিশ হাত দূরে পাহাড়ের ঢালটা কিছুটা সমান হয়ে এসেছে, অনেকটা একটা তাকের মত জায়গা। সেখানে রাশি রাশি কলা আর বুনো কচুগাছের ঝোপ। ভাল করে সেদিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে আর একটু হলেই আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম আর কী, ভাগ্যিস ভবাদা আমার মুখে একটা হাত চাপা দিয়ে থামাল। আমাদের থামতে দেখে বাকিরাও আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। সবাই মিলে সামনে তাকিয়ে দেখলাম সেই কলা আর কচুগাছের ঝোপের মাঝে কালো লোমশ কোন একটা প্রাণী শুয়ে আছে, তার পিঠের সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছে গাছের ফাঁকা দিয়ে। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে ভবাদার দিকে তাকিয়ে আছি পরবর্তী নির্দেশের জন্য, ঠিক এমন সময় ঘটনাটা ঘটল। সেই বিরাট বিশাল প্রাণীটা একটু গড়ান দিয়ে আমাদের দিকে পাশ ফিরল। প্রাণীটার বিশাল বপুর চাপে দুটো কলাগাছ শব্দ করে হেলে পড়ল, কোথা থেকে একটা ভুষুন্ডি-কাক কর্কশ স্বরে কা কা করে উড়ে পালাল। আর সেই সাথে আমাদের সাহসী বীর পুরুষ, অতিমানব খ্যাত, ভবাদা “ওরে মাগো বাবাগো” বলে চিৎকার করে এক দৌড়ে সেই পাহাড়ি ঢাল বেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। মুহূর্তের হতচকিত ভাব কাটিয়ে উঠে ভবাদার পিছনে পিছনে দৌড় দেব ভাবছি এমন সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই কালো প্রাণীটা ডেকে বলল, “ভাই আমাকে বাঁচান, আমি নড়তে পারছি না।”

 

আমরা সাথে সাথে দৌড়ে লোকটার কাছে গেলাম; গিয়ে দেখি ওমা, এতো সেই মোটা লোকটা, যাকে ভবাদা প্রথমে সোনা চোরাচালানকারী আর পরে দানবের খাদ্য বলে ঘোষণা করেছিল। আমরা সবাই মিলে সেই দশাসই লোকটাকে টেনে উপরে তুলে আনলাম, তারপর গাড়িতে করে ফিরে চললাম গির্জার দিকে। আমাদের ফিরে আসার খবর শুনে আবার দলে দলে লোক জমায়েত হল গির্জার সামনে। সবার মুখে তখন একটাই প্রশ্ন --- কী হয়েছিল কাল রাতে?

মোটা লোকটার কাছ থেকে অবশ্য শুরুতে কিছুই জানা গেল না, তার সম্ভবত খুব খিদে পেয়েছিল। পরপর গোটা দশেক ডিমের ওমলেট আর পরোটা খেয়ে তারপর এক ছড়া পাহাড়ি কলা নিয়ে সেখান থেকে একের পর এক কলা সাবাড় করতে লাগল লোকটা। আমিই তখন সাহস করে সামনে এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছিল কাল রাতে। সেই প্রশ্নের জবাবে লোকটার কথা শুনে যা বুঝলাম তা হল--- কাল রাতে খেতে গিয়ে প্রথমে ভবাদার সাথে ঝামেলা হয়, পরে আবার হোটেলে ফিরে স্ত্রীর সাথে তর্ক। এতে করে তার মেজাজ বিগড়ে যায়, বিছানায় শুয়ে এমনিতেই ঘুম আসছিল না, এরমধ্যে রাত দুটোর দিকে প্রচণ্ড খিদের জ্বালায় তার পক্ষে আর শুয়ে থাকাও সম্ভব হল না। তিনি তার পশমি নাইট গাউন গায়ে দিয়ে তোয়ালেটা দিয়ে মাথা ঢেকে হোটেলের বাইরে বের হলেন খাবারের আশায়। কিন্তু সব খাবার দোকান ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি তখন হোটেলের সামনে একটা পেঁপে বাগান পেয়ে পাকা পেঁপের আশায় কয়েকটা গাছের পেঁপে পেড়ে খাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেখানে সুবিধা না হওয়ায় তার থেকে আরেকটু সামনে গিয়ে একটা কলাবাগান পেয়ে সেই বাগানের কয়েকটা কলাগাছ থেকে কলা পেড়ে খেলেন। এতেও খিদে না মেটায় সামনে এগিয়ে একটা দোকান দেখে সেটার ঝাঁপ ধরে টানাটানি করছেন, ঠিক এমন সময় এক পাহাড়ি তরুণী ছুটে এসে তার উদ্দেশে কিছু একটা বলে অজ্ঞান হয়ে যায়। সাহায্য করার জন্য তরুণীর দিকে আগাতেই কয়েকটা পাহাড়ি কুকুর মিলে তাকে ধাওয়া করে। সেই কুকুরের ধাওয়া খেয়ে আধা মাইল দৌড়ে গিয়ে ভুল করে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যান তিনি। ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ে তার পা মচকে গিয়েছিল আর কোমরেও আঘাত লেগেছিল। নড়াচড়া করতে পারছেন না দেখে তিনি তখন বৃষ্টি থেকে বাঁচার আশায় গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে কচু ঝোপের মাঝে আশ্রয় নেন।

 

লোকটার কথা শুনে সবকিছু জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল আমাদের কাছে--- ইনিই তবে ভবাদার কথিত সেই সাজেকের লোমশ আতঙ্ক। কিন্তু ভবাদা গেল কোথায়, এই সব ঘটনা শুনে সে কী বলে সেটা জানা দরকার। আশেপাশে তাকিয়ে যখন ভবাদাকে খুঁজছি এমন সময় আর্মি অফিসার সেই মোটা লোকটাকে বলল, “এভাবে রাতে বের হওয়া আপনার উচিৎ হয়নি, আজকে আমি না থাকলে আপনার কী দশাটা হত সেটা ভেবেছেন!” আর্মি অফিসারের কথা শুনে আমি আর ভুতো সাথে সাথে প্রতিবাদ করে উঠলাম, বললাম - “সত্য কথাটা বলুন, আপনি না বরং আমাদের ভবাদাই আজকের নায়ক। ভবাদা ছিল বলেই আজকে উনি বেঁচে ফিরলেন।” সমবেত জনতা আমাদের কথায় সায় দিয়ে হইহই করে উঠল। এমন সময় সেই ভিড়ের মধ্য থেকে ভবাদার গলা শোনা গেল - “শাব্বাস, এই না হলে আমার পাড়ার ছেলে।” ভবাদা যে কখন ভিড়ের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা আমরা কেউই লক্ষ করিনি, এইবারে তাকে পেয়ে লোকজন তাকে কাঁধে করে নিয়ে মিছিল শুরু করল। মিছিল শেষে ভবাদার কদর দেখে কে--- পর্যটকের দল এসে তার সাথে ছবি তুলতে লাগল, কেউ কেউ তার অটোগ্রাফ নিল। ভবাদাও দেখলাম লোকজনের কাছে নানা রকম ভাবে আমাদের এই অভিযানের কথা বর্ণনা করে চলেছে, যদিও অভিযানের শেষ বেলায় সে যে দৌড়ে পালিয়েছিল সেটা বেমালুম চেপে গেল।

 

আমাদের অফিসের ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই পরদিনই আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। আমাদের বিদায় দেবার জন্য যেন পুরো সাজেক একসাথে জড়ো হল গির্জার সামনে। তাদের থেকে বিদায় নিয়ে, আবার আসব কথা দিয়ে যখন ফিরে আসছি, তখন চাঁদের গাড়িতে বসে ভবাদা বলল, “সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, তোদের মত দুটো অকাট মূর্খের সাথে আর কোথাও বেড়াতে যাব না।” তার কথা শুনে তো আমরা অবাক, বললাম, “সেকী কথা ভবাদা, আমরা আবার কী করলাম?”

জবাবে ভবাদা বলল, “সেই যে তখন গির্জার ভিতর কটমট করে তোদের দিকে তাকিয়ে চোখের ভাষায় তোদের নিষেধ করলাম, সে তো তোরা শুনলিনে। তার বদলে মূর্খের মত বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে গেলি। একবার ভেবেছিস যদি আসলেই ওটা মানুষ না হয়ে মানুষখেকো হতো তবে বাড়ি ফিরে তোদের বাবা মায়ের কাছে কী জবাব দিতাম!” এতক্ষণে ভবাদার দৌড়ে পালানোর রহস্যটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হল, আর সেই সাথে আমি আর ভুতো হো হো করে হেসে উঠলাম। আমাদের হাসির শব্দ মিলিয়ে গেল বাইরের বৃষ্টির শব্দের সাথে, সেই শব্দের মধ্য দিয়ে আমাদের চাঁদের গাড়ি ছুটে চলল পাহাড়ি রাস্তা ধরে ঢাকার দিকে।