হার-না-মানা মেইসেল - জয়িতা সাহা

প্রবন্ধ

ষাটের দশকের নিউইয়র্কে সন্ধেবেলার দিকে যদি গ‍্যাসলাইট পাবে যান, মিজের সাথে মোলাকাত হতে পারে। মিরিয়াম মিজ মেইসেল। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অঙ্কের অধ্যাপক এব্রাহাম আর ওকলোহমা প্রভিন্সের উত্তরাধিকারী, প‍্যারিসে শিল্পচর্চা শেখা রোজের একমাত্র কন‍্যা। মিজ তার জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাস প্ল্যান করে নিতে শিখেছে। সম্ভ্রান্ত জিউইশ পরিবারের আদবকায়দা পালনে তার জুড়ি মেলা ভার। পড়াশোনার পাট শুভস‍্যশীঘ্রম চুকিয়ে অভিজাত বংশের একমাত্র ওয়ারিশ পাত্রের সাথে প্রেম ও বিয়ে করতে মিজ দেরী করেনি। এক ছেলে ও এক মেয়ের মা হয়েও মিজ প্রত‍্যেকদিন নিজের কব্জি থেকে কনুই, পায়ের গোছ থেকে কোমর মাপের ফিতে দিয়ে (হ‍্যাঁ বাড়িয়ে বলছি না!) মেপে রাখে। মিজ জানে খাবারের ছবি দেখলেও মোটা হয়ে যাওয়া সম্ভব! গাড়ি চালাতে না জানলেও পোশাকের সাথে মানানসই ড্রাইভিং গ্লাভস সাথে করেই গাড়িতে চাপতে হয়! ব্রিস্কেট এবং জেলো মোল্ড বানিয়ে সকলের মন জয় করাটাই একজন আদর্শ গৃহবধূর একমাত্র লক্ষণ! এবং লাস্ট বাট নট দ‍্য লিস্ট নিজের মেকআপবিহীন মুখ কাউকে (হ‍্যাঁ ইনক্লুডিং স্বামী দেবতা) দেখাতে নেই!

কিন্তু মিজের এই মোর দ‍্যান পারফেক্ট ইউটোপিয়ান জীবন এক তুড়িতেই ধুলিস্মাৎ হয়ে যায় যখন ওর স্বামী জোয়েল কোনো কারণ ছাড়াই নিজের সেক্রেটারীকে ডেট করতে শুরু করে আর নিছক ঝোঁকের বশেই মিজকে ছেড়ে চলে যায়। প্রতিটি পা মেপে ফেলেও যে সবকিছু অকারণ ভুল হতে পারে এই উপলব্ধি হওয়ার প‍র মিজ নিজের চারপাশে নিজেরই গড়ে তোলা অচলায়তন স্বহস্তে ভাঙতে বসে। মনের আগল খুলে দিয়ে বলতে থাকে সারাজীবনের অবদমিত অভিমান। গ‍্যাসলাইট পাবে তখন অনেক রাত। একলা মেয়ে নিজের সংসার ভাঙার গল্প শোনাচ্ছে অথচ হাসির রোল পড়ে যাচ্ছে প্রায়ান্ধকার ঘরটায়। কথা বলতে জানে মেয়েটা। কথা বেচে খেতে পারবে কি? কয়লার খনিতে হীরে পাওয়ার মতো ওই রাতে মিজকে খুঁজে পায় সুজ়ি। সম্ভ্রান্ত বাড়ির গৃহবধূ থেকে মিরিয়ামের স্ট‍্যান্ড আপ কমিক হয়ে ওঠার এই গল্প নিয়েই আজ কথা বলবো।

 

নিশ্চয়ই ভাবছেন হাস‍্যকৌতুক সংখ্যাতে কী সব আলোচনা ফেঁদেছি! ঠিক এই মুহূর্তে কমেডি টিভি এক মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লিনিকালি ডিপ্রেসড, সেক্স অ্যাডিক্ট ফ্লীব‍্যাগকে আমরা তিনখানা ‘এমি’ জিতিয়েছি এইবছর। স্ল‍্যাপস্টিক কমেডি বা পাঞ্চলাইন কিংবা ব‍্যাকগ্রাউন্ড লাফটার ট্র্যাকের উপর নির্ভরশীলতা আর নেই। হাস‍্যরসের রসদ এখন জীবন। আমরা আর বর্তমানে আমাদের চারপাশ এতোটাই নিষ্ফল আর অসহ‍্য তা একপ্রকার হাস‍্যকর। ট্র্যাজেডিতে কমেডির ধারা মেনেই তাই এখন স‍্যাটায়ার বা ব্ল‍্যাককমেডি কিংবা ননসেন্স হিউমারের রমরমা চারদিকে। অ্যামাজ়নের শো ‘মার্ভেলাস মিসেস মাইসেল’ আরেকটি নতুন বিভাগে আত্মপ্রকাশ করে কমেডি ড্রামা বা হাস‍্যনাটিকা কিংবা ড্রামেডি বা নাট‍্যকৌতুক। এমি শর্ম‍্যান প‍্যালাডিনোর সৃজনে এই সিরিজ ২০১৭ তে শুরু হয়েই চারদিকে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলো। এই ডিসেম্বরে তৃতীয় সিজ়ন এসেছে এবং আসা মাত্রই এক বাটি নতুন গুড়ের পায়েসের মতো সাবড়ে ফেলেছি। ড্রামার পরতে কমেডির অনবদ‍্য মিশেল, অদ্ভুত রঙিন সব চরিত্র আর অসাধারণ প্রোডাকশন ডিজাইন। কস্টিউম থেকে মিউজিক সমস্ত কিছুর নিখুঁত ডিটেইলিংয়ে ষাটের দশককে এই ভাবে ছোটপর্দায় দেখানো হয়েছে যা একপ্রকার অবিশ্বাস্য। মিজের ওয়ার্ড্রোবের সিকি ভাগ পাওয়ার জন্যে যেকোনো মহিলা দর্শক দিনে দুপুরে ডাকাতি করতেও রাজি হয়ে যাবেন নির্ঘাত! ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা থেকে বারবারা স্ট্রেইসেন্ড, পেগি লী কাকে ছেড়ে কাকে শুনবেন! সিরিজের সাউন্ডট্র্যাক রীতিমতো ঈর্ষণীয়। আরও একটা নতুন বিষয় আছে, অভিজাত জিউ কালচারের সাথে একদম কাছ থেকে পরিচয় করাবে এই সিরিজ। জিউইশ পরিবারের নিয়ম কানুন পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে চিরাচরিত ধর্মভীরুতা বর্জন করে ব‍্যঙ্গ আর হাস‍্যরসের মাধ্যমে, যেটি একটি অনবদ‍্য প্রচেষ্টা বলা যায়।

 

চরিত্র নির্মাণ এই শোয়ের এক প্রধান সম্পদ। আ্যব ওয়াইজম‍্যান অর্থাৎ মিজের বাবার চরিত্রটি টেক্সটবুক হিউমারের এক নম্বর নিদর্শন। কোনো কমিকাল ডায়লগ ছাড়াই কেবলমাত্র উনার হাবভাব দেখেই মনে হবে যেন জেরম কে জেরমের সৃষ্টি। সেই সঙ্গে টোনি শালুবের অসামান্য অভিনয়। মিজের শ্বশুর এবং শাশুড়ির চরিত্র একে অপরকে এইভাবে সঙ্গত করে যাচ্ছেন সব সময়! ভানু বন্দোপাধ্যায়ের সেই কর্তা বনাম গিন্নি মনে পড়তে বাধ‍্য। মিজের স্বামী, সহকর্মী এবং প্রেমিক এই তিনটি আপাত সাধারণ কিন্ত জটিল চরিত্র খুবই উপভোগ্য।

একেবারেই নারীবাদী নয় কিন্তু অবশ্যই নারী-প্রধান এই টিভি সিরিজের প্রত‍্যেকটি মহিলা চরিত্রই নিজ গুণে বিশেষ। মিজের মায়ের চরিত্রে আমরা পাই রোজ-কে যিনি মেয়ের এই কমেডিয়ান হওয়ার পথ বেছে নেওয়াকে ব‍্যক্তিগত আঘাত হিসেবে নেন এবং উনার চিরাচরিত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে উনি বলেন মিজ বারবণিতার পেশা অবলম্বন করলেও হয়তো উনার পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ হতো। মিজের স্বামী সংসার ছেড়ে নিজের জন‍্য বাঁচতে চাওয়াকে রোজ নিজের দেওয়া শিক্ষার অপমান মনে করে কিন্তু সেই রোজই নিজের পরিবারে সব ভাইদের থেকে যথাযথ সম্মান না পেলে সমস্ত সম্পত্তি ত‍্যাগ করে। স্বামীর খামখেয়ালীপনাকে শিক্ষা দিতে প‍্যারিসে নিজের কর্ম জীবনে ফিরে যেতে চায় আর এ সবই মিজের স্বাধীনচেতা স্বভাবের নিঃশব্দ অনুপ্রেরণায়। অন্যদিকে আছে মিজের ভাইয়ের বউ অ্যাস্ট্রিড যে কিনা বিয়ের পর ধর্মান্তরিত হয়েছে। তার জিউইশ আচরণ বিধি পালনের এক সে বড়কর এক কার্যকলাপ চূড়ান্ত হাস‍্যকর কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে স্বীকৃতি পাওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। মিজের কমেডি কেরিয়ারের এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী সোফির চরিত্র আমাদের শেখায় জীবনে ঝুঁকি নিতে না জানলে ঠকতেই হবে।

মিরিয়াম মিজ মাইসেলের চরিত্রে র‍্যাচেল ব্রসনান এই শোয়ের চালিকাশক্তি বলা যেতে পারে। উনার স্ক্রিন প্রেসেন্স এবং এনার্জি রীতিমতো সংক্রামক! মিজকে পর্দায় দেখতে দেখতে আপনারও ইচ্ছে করবে নিজের চেনা গণ্ডির বাইরে বেরোতে। ছক ভেঙে নতুন করে নিজের মতো বাঁচতে। মিজ দশভূজা। সংসার থেকে কেরিয়ার, পরিবার, বান্ধবী, ডিভোর্সড স্বামী থেকে নতুন প্রেমিক সমস্ত কিছুতেই ওর প্রবল উপস্থিতি। চারদিক সামলাতে না পারলেও সবকিছুর দায়িত্ব নিয়ে ফেলা ওর স্বভাব আর কারো জীবনেই কম গুরুত্বপূর্ণ হতে সে নারাজ তাই সর্বক্ষণ এক চড়কিবাজির মতো দুনিয়ার অদৃশ্য নাগরদোলায় সে ঘুরছে। গিন্নি নাম্বার ওয়ান থেকে নামকরা কমিক হয়ে ওঠার এই দুর্গম যাত্রা পথে ‘একলা চলো’-ই মিজের চরৈবতি। মিজের এই যাত্রার ছায়াসঙ্গী সুজ়ি। দুই চরিত্রের বন্ধুত্ব এবং রসায়ন একটি বড় পাওনা। সমাজের দুই বিপরীতমুখী শ্রেণীর থেকে আসা প্রায় সমস্ত কিছুতে অমিল থাকা এই দুই মেয়ের মেলামেশা যেমন হাস‍্যরস নিয়ে আসে সেইরকম ওদের সম্পর্কের পরিণতি আমাদের ভাবায় মেয়েদের হয়ে উঠতে হবে পরস্পরের শক্তি কিন্তু এত শত সহস্র বছর বাদেও তা আমরা পেরে উঠলাম কই?

টিভি সিরিজের আঙিনা পেরিয়ে মিজ কখন আমাদের জীবনের সাথে একাত্ম হয়ে যায় তা টের পাওয়া মুশকিল। একটি স্টেজ পারফরম্যান্স চলাকালীন মিজ বলে, "They (And by they I mean the men) say we have to wear white to march for Vote or we can’t ride horses because we get cramps or we will elect Kennedy as President as we think he is cute! Why it have to be either or! Why it can’t it be both! It’s 1960! Change is coming. And I believe that someday a next generation suffragette will wear pink and ride horses, and an unmarried woman will take the birth control pills so she can have as much as sex she wants and not get pregnant and a married woman will just have a headache and call it a night." মজার ছলে বলা এই কঠিন কথাগুলোর মতোই আমাদের জীবন আজও এক চোখে হাসি, অন্য চোখে জল। পছন্দের পেশা থেকে পোশাক, শখ থেকে প‍্যাশন এমনকি অধিকাংশ জায়গায় বেসিক শিক্ষা ও সুরক্ষা সব কিছুতেই আজও সমঝোতা আর ত‍্যাগস্বীকার। কম্প্রোমাইজ ও স‍্যক্রিফাইজ। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আজও মেয়েদের যে জীবনসংগ্রাম তার রসদে হাস‍্যরসের কোনো কমতি নেই। সারা পৃথিবীর দর্শকের অবিরাম বিনোদনের জন‍্য যথেষ্ট। মিরিয়াম মিজ মেইসেল তাই আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, কথা বলতে শেখায় । আশ্চর্যের বিষয় ষাটের দশকের এক মহিলার উত্থান কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক ও সমকালীন। আজও যদি কোনো নারী তথাকথিত গণ্ডির বাইরে বের হতে চায় তাকে ঘিরে ধরে অজস্র প্রশ্ন। নিজের পরিচয় তৈরী করতে চাইলে মেয়ে হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে বা মা হিসেবে বাঁচার অধিকার হারায় সে। আসলে সময় পাল্টালেও মেয়েদের জীবন আজও এক সুপরিকল্পিত সার্কাস এই উপলব্ধি উপহার দিয়েছে এই শো প্রায় প্রতিটি মুহূর্তে এক আশ্চর্য অবলীলায়। এক মার্ভেলাস মিজ লুকিয়ে আছে আমাদের সবার মধ‍্যে, শুধু মঞ্চে উঠে মাইক ধরার অপেক্ষা।