কনস্ট্যান্টস - অনিন্দ্য রাউৎ

হাসির গল্প

অলংকরণ - মিশন মন্ডল

বাজি ধরে কিছু করাটা ঠিক ভালো লাগে না আমার, কিন্তু আমার ভালো লাগে না বলেই বা শুনছেটা কে? আসলে আমি বা অনন্য যাই চাই তা কোনোদিন হয় না। সেই ছোট থেকেই এমনটা হয়ে আসছে দেখি, যখন খুব ভালো পরীক্ষা দিয়ে আসতাম, মন খুশি থাকতো, সেদিন মাঠে গিয়ে শূন্য রানে রান-আউট হতামই! মানে রানটা হয়তো নেওয়াই যেত, আমি ক্রিজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হয়তো চলেই গেছি, সেই সময়ই পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে যেতাম বা অন্য প্রান্তে থাকা শিবু বা বিশুর মনে হতো থাক রানটা নিয়ে লাভ নেই, তাই আমায় আবার পেছনে দৌড়তে হতো। বা যেদিন খুব ভালো একটা ইনিংস খেলতাম সেদিনই বাড়ি গিয়ে বুঝতাম লুকোচুরি খেলার জন্য লুকোতে হয় না, আমায় যে কেউ যখন তখন ধাপ্পা দিতে পারে। আমার মায়ের মামা চশমার ডাঁটিটা একটু নামিয়ে আমায় দেখে বলতেন, “এরকম ছেলেপিলে থাকলে আমি সন্ন্যাস নিতুম, কষ্ট করে তো বড় হতে হচ্ছে না, পড়াশোনা-খাটনির মর্ম এরা বুঝবে কী করে? পড়তো আমার পাল্লায়, রোজ এমন নাকখৎ দেওয়াতুম যে দুদিনে সিধে হয়ে যেত। তুই বড় সরল রে মিতু, তাই ছেলেকে কিছু বলিস না, তবে দেখিস হাতের বাইরে না চলে যায়।”

মামাদাদু কোনোদিন বিয়ে করেননি, তিনি সন্তানের জন্য সন্ন্যাস নেবেন কী করে? আর নিজে তো টেনেটুনে মেট্রিক পাশ করেছেন, তারপর ফেলের বহর দেখে মায়ের দাদু ভুসিমালের দোকানে বসিয়ে দিয়েছিলেন, আর তিনি পড়াশোনা নিয়ে এতকিছু ... আমি হাঁ হয়ে যেতাম। আমি খেলতে গেছি বলেই এত কথা? এরপর তো মা আমায় আস্ত রাখবে না! মামাদাদু তো কোনোদিন মায়ের হাতের বেলনের সরলতা দেখেনি, তাই এসব বলছেন। এত রাগ কেন মামাদাদুর! একবার মজা করে পেছনে পাড়ার নচ্ছার ভুলোকে লেলিয়ে দিয়েছিলাম বলে? সে তো পরে আমিই আমাদের এখানকার সেরা মিষ্টি দোকানের সেরা ছানার জিলিপি এনে দিয়েছিলাম। কৃতঘ্ন শব্দটা কি এইভাবেই একদিন এরকম লোককে দেখে হঠাৎ জন্ম নিয়েছিল?

মায়ের মারের হাত থেকে রেহাই পেতে না পেতেই সেই পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোত যেখানে আমরা দারুণ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। দাঁত বের করে রেজাল্ট নিতে গিয়ে দেখি হেডস্যার আমার দিকে লম্বা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এত ভালো করেছি? আমি কি পুরো ফাটিয়ে দিয়েছি? এত খুশি তো হেডস্যারকে কোনোদিন দেখিনি! এ হেন খুশির দিনে হেডস্যার আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে হয়তো নিজেকে ধন্য মনে করবেন বা একটা সরস অভিনন্দন জানিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে পাঠার মাংস খাওয়াবেন। এরকম সবে ভেবে আমিও কোনো দ্বিধা না রেখেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম আর হঠাৎই হেডস্যার নিমেষের মধ্যে আমার হাতটা ধরে এমন টান মারলেন যে আমি কোনোমতে নিজেকে পড়ে যাওয়ার থেকে বাঁচালাম। হাত ধরে এরকম প্যাঁচে ফেলে দেওয়া--- হেডস্যার নির্ঘাৎ জুডো প্র্যাকটিস করতেন কম বয়সে। পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে আটকেই বুঝেছিলাম কী ভুল হয়ে গিয়েছে। আমার মুখ হেডস্যারের হাঁটুর সামনে, আমার হাঁটু ভাঁজ হয়ে গিয়েছে, মাথা নামানো আর এই সবকিছুর মানে একটাই --- স্যারের হাতের সামনে আমার প্রশস্ত পিঠ, এরকম সুযোগ দিলে তালকানা বিট্টুও দশ গোল মারবে সেখানে তো পিঠে রদ্দা বসানোয় হেডস্যার হলো গিয়ে মেসি। মারলেন পাঁচ ছটা স্কুল কাঁপানো বোমা, ফাটলো শুধু আমার পিঠে। ঐভাবে নিচু হয়েই চোখে জল নিয়ে শুনলাম স্যার বলছেন, “পরীক্ষায় এরকম ইয়ার্কি যেন আর না দেখি, পেন্সিল দিয়ে লিখে পরীক্ষা দেওয়া! খাতায় খাতায় ঘষে গিয়ে সে লেখা প্রায় উঠেই গেছে, কিছুই পড়ার জো নেই।”

আমি ভাবলাম ইসসস কী ভুল হয়ে গেছে! কিন্তু এরকম হলে কি একটু সহানুভূতি পাওয়ার কথা নয়? হাসি হাসি মুখ করে হাত বাড়িয়ে তারপর এরকম মার! অমরীশ পুরি তো পুরো ফেল।

এ তো গেল আমার কথা। ওপরে ছোট্ট করে আমার সঙ্গে একটা নাম লিখেছিলাম। অনন্য। অনন্যা নয়, অনন্য। যে সব নাম মেয়েদের নামে বেশি প্রচলিত এবং তার থেকে ‘আ’ কার বাদ দিলে যে ছেলেদের নাম পাওয়া যায়, সেরকম নাম কোনো ছেলের হলে চিরকালই তাকে টিটকিরি শুনতে হয়। অনন্যও তাই। তবে ও কারোর টিটকিরি, অসভ্যতামি গায়ে মাখতো না। আসলে ওর মতো ছেলে হয় না। অনন্য আর আমি ডাকটিকিট আর খাম, নন্টে আর ফন্টে, ইমরান হাশমি আর চুমু, আচার আর জিভে জল! না থাক, আর বেশি বলবো না; মোট কথা যাই হোক আমরা একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকি সেই ছোট থেকে। আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড আছি, ফিজিক্স স্যারের কথা মতো থাকবো ঠিক যতদিন না আবার মহাজাগতিক ধূলিকণায় পরিণত হচ্ছি আমরা, তত যুগ।

তো এই আমি যখন সিওর রান আউট হয়েই গেছি, উইকেটে বল হিট করার সময় আমার ব্যাট, পা, পুরো শরীর যখন লাইন থেকে দুই তিন গজ বাইরে, তখন মোটা পাওয়ারের চশমা পরে দাঁড়ানো আম্পায়ার অনন্য রায় দুদিকে জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বলতো কোনোমতেই আউট নয়। তারপর তো বোলিং টিম অনন্যকে এই মারে তো সেই মারে, আমি গিয়ে বাঁচাই আর কী …

বা আমায় যখন মামাদাদু প্যাঁচে প্রায় ফেলে দিয়েছে তখন অনন্য হঠাৎ করে বলতো, “আচ্ছা আপনাকে সেদিন পালবাবুর বাজারের পেছন দিকে দেখলাম, ‘আপনা সাপনা মানি মানি’ ক্লাব থেকে বেরোচ্ছেন, কী ব্যাপার? জুয়া খেলছিলেন নাকি? আমি তো ঐ রাস্তা দিয়ে পড়তে যাই, হঠাৎ করে চোখ পড়ে গেছিল।”

মামাদাদু ক্ষেপে পাগল হয়ে চিৎকার করে হয়তো আরো দুটো তিনটে বাজে কথা বলতেন, তবে বাড়ির দিকে আর কিছু মাস আসতেন না। কিন্তু মায়ের মামার অপমান, তাই আমার ওপর বেলনের ভালোবাসা আরো ডবল হয়ে যেত।

বা হেডস্যার আমার পিঠে রদ্দা বসিয়ে সবে হয়তো ভাবতেন আজকের মত হাতের ব্যায়াম হয়ে গিয়েছে, ঠিক তখনই আমার পেছন থেকে রোগা ভোলা ছেলেটা মাথা উঁচিয়ে বলতো, “স্যার, আসলে আমায় ও দেখাচ্ছিল, আমিই ওকে বলেছিলাম পেন্সিলে লিখে রাখ, পরে বাকিদের সঙ্গে মিলিয়ে পেন-এ লিখবো। “

ইতিহাসের টিচার হেডস্যারকে কেউ ‘আকবর হলো বাবরের বাবা’ বললেও এতটা অবাক হতেন না যতটা অনন্যর কথা শুনে হলেন, কোনোরকমে তুতলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ওটা প..প...পরীইই... পরীক্ষা চলছিল না অন্য কিছু? কে গার্ড দিচ্ছিল?”

অনন্য অম্লানবদনে তাকিয়ে বলেছিল, “ভজুবাবু।”

ভজুবাবু হয়তো তখন সবে নাক ডেকেছেন একটা, নামটা শুনেই চমকে উঠে বললেন, “ আমি, না তো আমি নই তো, আমি কেন? আমি কেন তোর টিফিন নেব? “

ভজুবাবু ঘুমাতে আর ছাত্রদের টিফিন খেতে খুব ভালোবাসতেন, স্কুলের সবাই জানে। যাইহোক, অনন্যর স্বীকারোক্তিতে আমাদের ডবল মার পড়েছিল। হেডস্যার আর ভজুবাবু দুজনেই বেশ হাতের সুখ করেছিলেন পরে সময় বুঝে।

আশেপাশের বন্ধুরা দেখে বলে, অনন্য আমায় বাঁচানোর থেকে বেশি কেসই খাওয়ায়, কিন্তু আমি ওসব ভাবি না, ও যে কতটা আমায় ভালোবাসে সেটা আমিই জানি।

সেই স্কুল লাইফের গণ্ডি ডিঙিয়ে আমরা এখন কলেজেও একসঙ্গে, এবং কলকাতায় একই মেসে থাকি। আর প্রায় সন্ধ্যায় মেসের কাছেই একটি ক্লাবে ক্যারম খেলতে যাই--- মোবাইল, ইন্টারনেটে আমাদের মন নেই, মানুষের সঙ্গে থাকায়, আড্ডায়, খেলায় আনন্দ। কিন্তু এই ক্যারম খেলতে গিয়েই জীবনের সবচেয়ে বড় কেসটা খাবো ভাবতেই পারিনি।


৷৷ ২ ৷৷

ক্যারম খেলা একটা নেশার মতো। স্ট্রাইকার, ঘুঁটি, লক্ষ্য, স্মুদনেস, ফিনিশিং, ট্যালেন্ট, রানী, কভার, ক্রস, ইঞ্চি, বেস, অ্যাঙ্গেল, রিভার্স সবটাই এতটা আকর্ষণীয় যারা খেলেছে তারা জানে। তবে আমরা বড় ম্যাচবোর্ডে চারপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলি, দরকার হলে জোরে, আস্তে সবরকম শট মারি। ঐ বসে ছোট একটা বোর্ডে টুকটুক করে খেলা আমাদের পোষায় না, সে যতই বাইরে সবজায়গায় ওরকমভাবেই খেলা হোক। খেলার আগে হালকা পাউডার দিয়ে বোর্ডের সারফেসকে একটু স্মুদ করে স্ট্রাইকার, ঘুঁটি তিন চারবার বোর্ডের এদিক ওদিক করে মাঝখানে সাজিয়ে ব্রেক করি। তারপর কী করে যে খেলতে খেলতে, ঘুঁটি ফেলার নেশায়, ভালো খেলার নেশায় বা জেতার নেশায় কীভাবে যে দুই তিনঘন্টা কেটে যায় জানি না। আমি মোটামুটি খেলি, খুব দারুণ নয় আর খারাপও না। অ্যাঙ্গেল, ক্রস আর ইঞ্চি খেলতে ফাটাফাটি লাগে। ক্যারম খেলা তো শুধু ঘুঁটি ফেলা নয়, এটা ভীষণ স্ট্র্যাটেজিক খেলাও। বিপক্ষর সহজ ঘুঁটি ফেলার সুযোগকে কঠিন করে দেওয়া, এক সঙ্গে এক হিটে তিন চারটে ঘুঁটি ফেলা, একটা ঘুঁটি ফেলার সঙ্গে পরের দানে আরেকটা ঘুঁটি যাতে ফেলা যায় তার সুযোগ করে নেওয়া সবকিছুই হলো খেলার অংশ। সবমিলিয়ে ক্যারম ভীষণ ইন্টারেস্টিং আমাদের কাছে। আমি খেললেও অনন্য তত খেলে না। ও বেস টুকটাক ফেললেও ইঞ্চিতে তালকানা, সোজা মারতে গিয়ে এমন মারে যে অন্য সব ভালো ঘুঁটি ফেলার সুযোগও নষ্ট হয়ে যায়, আর যেটা একটু তেরচাভাবে মারতে হবে সেটা এমন সরলরেখায় মারে যে স্ট্রাইকার সোজা পকেটে। তবু আমি ওকে সবসময় পার্টনার করে খেলি, সহজে জেতার থেকে ওকে নিয়ে জেতা আমার কাছে চ্যালেঞ্জিংও আর অনেক বেশি স্যাটিসফাইংও।

কলেজ, ক্যারম বাদ দিয়ে আরেকটা ‘ক’-ও এখন আমার জীবনের অংশ। কলি। কলেজে গিয়ে কলিকে দেখে বুঝেছিলাম আমায় এখানেই সরকার গড়তে হবে, যাতে আরো পাঁচ বছর অন্তত থাকা যায়। তাই গ্র্যাজুয়েশন পাশের দোরগোড়ায় এসে ঠিক করেছি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করবো, তারপর না হয় ডক্টরেট, যতদিন কলি থাকবে কলেজে আমিও থাকবো। কথা হয় আমাদের, তবে ঐ ফ্রেশারদের ইন্ট্রো নেওয়ার পর আগে এগোয়নি। কলির সামনে অনেকে ইঁট পাতলেও আমি জানি ভালো কোয়ালিটির সিমেন্ট শুধু আমার কাছেই আছে, আমাদের দুজনের মজবুত বাড়িটা আমিই বানাবো। তবে খুব বেশি যে দেরি করাও চলবে না তা বুঝে একদিন কলেজ শেষে ফেরার পথে ডেকে বললাম নিজের মনের কথা।

“তোমায় ছাড়া জীবন চলছে না, হবে কি আমার জীবনসঙ্গিনী?”

ও জিজ্ঞেস করলো, “এতে আমার লাভ?”

বললাম, “আমি সবরকম কাজ পারি, তোমায় কোনো কষ্টই করতে হবে না।”

“তাহলে তো বাড়িতে একটা চাকর রাখলেই হয়।”

অপমান বোধটা আমার টনটনে হলেও সেটাকে মনের মধ্যেই মেরে ফেলার অভ্যেস ছোট থেকেই আছে, তাই বললাম, ‘ভালো রান্নাও পারি।”

“রাঁধুনি রাখবো তাহলে।”

গান, নাচ, কবিতা, আবৃত্তি, ক্রিকেট, ফুটবল কিছুই তেমন পারি না, নিজেকে ভীষণ ফালতু লাগলো, কী বলবো খুঁজে না পেয়ে বললাম, “আমার জীবনবীমা করা আছে, আমি মরে গেলে কোটিপতি হয়ে যাবে তুমি।”

হঠাৎ কলি খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসলে বড্ড বেশি সুন্দর দেখায়, উফফফফ! তাকিয়ে আছি মুগ্ধভাবে, কলি হাসি আটকে বললো, “তাহলে তোমায় মেরে ফেলতে হবে?”

আমি পরপর পাঁচ ম্যাচে শূন্য রানে আউট হয়েও এতটা হতাশ হইনি! বললাম, “তোমায় ভালোবাসি, তোমার সঙ্গে থাকতে চাই, আমার আর কিছুই নেই।”

দেখলাম, অট্টহাসি পাল্টে স্মিত হলো, চোখটা অল্প নামিয়ে বললো, “আমি এসবে এখন মন দিতে চাই না, তাছাড়া আমার বাবার যদি পছন্দ না হয় কাউকে, আমি তার সঙ্গে থাকতে পারবো না।”

বাবা? সিলেবাসের বাইরের প্রশ্ন পেয়ে একটু ঘাবড়ে গেলাম। তবু উত্তর দিতে হবে জেনেই বললাম, “তোমার বাবাকে পাবো কোথায়?”

৷৷ ৩ ৷৷

আসলে আমাদের জীবন কেমন হবে তা কোনো বিশেষ দিনগুলোতে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে। কলির সঙ্গে বিশেষ দেখা হয় না আমার আজকাল, আমায় দেখলেও এড়িয়েই যায় কেমন যেন। আমিও খুব সাহস করে এগিয়ে কথা বলতে পারি না। আজকের মত একদিন এরকম শীতকালের সন্ধেবেলা আমি মেস থেকে বেরিয়ে হাত দুটো ঘষতে ঘষতে ক্লাবের দিকে যাচ্ছি আর মনে মনে কলির কথা ভাবছি, প্রায়ই ভাবি, নিজের মনেই হেসে ফেলি। অনন্য আগে থেকেই ক্লাবে চলে গিয়েছে। চারিদিকে কুয়াশার ঘন আস্তরণ, আলোর নিচে কুয়াশা জমাট বেঁধে যেন মানুষের আকার নিয়েছে, টুপি পরা লম্বা চেহারা।

হঠাৎ কেউ যেন ডাকলো, “ঈশান, যাচ্ছিস কোথায়, শিগগিরই চল, অনন্য কেলেঙ্কারি করেছে ওদিকে।”

সত্যিই কখন যে বেখেয়ালে ক্লাব পেরিয়ে চলে গেছি বুঝতেও পারিনি, দেখি বিতান ডাকছে। অনন্য, অনন্য আবার কী করলো? ক্লাবে ঢুকেই দেখি অনন্য হাত পা ছুঁড়ে সামনে দাঁড়ানো একজন মাঝবয়সী লোকের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করছে। বিতান বললো উনি বিপিনবাবু।

“কী ভাবেন? আমি খেলতে পারি না? না হয় কয়েকটা শট মিস করেছি, তাই বলে মাঝপথে আমায় উঠে যেতে বলবেন? আপনি এমন কী ভালো খেলেন, একটাও ম্যাচ জিততে পারেন না আমায় নিয়ে। জঘন্য প্লেয়ার আপনি।”

“কয়েকটা শট? একটাও খেলতে পারোনি, উল্টে আমার দান নষ্ট করেছ। যখন আমি প্রায় ফিনিশ করে ফেলেছি তখন ফাইন করে ঘুঁটি বাড়িয়েছ! তোমাদের মতো ছেলেদের ক্লাবে ঢুকতে দেয় কে? এই বোর্ডে, স্ট্রাইকারে হাত দেওয়ার যোগ্য নও তুমি।”

“স্ট্রাইকার আমার, ময়দান থেকে কেনা। কেন হাত দেব না? বড্ড ঘ্যাম না আপনার, দাঁড়ান, দাঁড়ান, এই তো... এই তো… এই তো ঈশান।”

আমি ওকে থামাতে যাবো, উল্টে দেখি ও আমার হাত ধরে টেনে এনে সামনে দাঁড় করালো।

“ও আর আমি পার্টনার, আপনি যেখান থেকে যাকে পারেন তাকে নিয়ে আসুন, দরকার হলে প্রতাপ শাহর আত্মাকে নিয়ে আসুন। সিরিজ হবে। তিনটে গেমের। বেস্ট অফ থ্রি। যারা দুবার আগে ঊনত্রিশ পয়েন্টে পৌঁছবে তারা জিতবে। রাজি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ রাজি। তবে এমনি এমনি তো বাজি হয় না। তোমরা হারলে তোমরা দুজন এই ক্লাবে আর কোনোদিন খেলতে আসবে না।”

যাহ বাবা, আমি কেন ক্লাবে আসতে পারবো না? আমি তো ঝগড়াও করছি না আর বাজিও ধরছি না। কিন্তু কিছু বলার আগেই অনন্য বললো, “ওসব হারার কথা আপনারা ভাবুন, ওসব আমরা ভাবি না। আমরা জিতলে কী হবে বলুন?”

“কী হবে? কী হবে? হবেটা কী? যা খুশি, তোমাদের যা খুশি চাইতে পারো। আমি রাজি। “

অনন্য পাড়া কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। “ঠিক আছে, ঠিক আছে। ঈশান, আমার হেডস্যারের কথা মনে পড়ছে রে। কী যে হবে এই লোকটার!”

হেডস্যার? নাকখৎ দেওয়াবে নাকি? না মাথা নিচু করিয়ে পিঠে …? এরকম বয়স্ক লোকের সঙ্গে এরকম? অনন্যটা কি আজ পুরো পাগল হয়ে গেল! ক্লাবে এসে চুপচাপ খেলে চলে যাওয়া ছেলেটার আজ হলো কী সেটাই বুঝতে পারছি না। তায় বিপিনবাবুর সঙ্গে এরকম চ্যালেঞ্জ? বিপিনবাবু নাকি এই ক্লাবের বেস্ট প্লেয়ার--- বেশিরভাগ দিনে সকালেই আসেন, তাই এই সন্ধেতে বিশেষ দেখা হয় না। অনন্য নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমারও ক্লাবে আসাটা বন্ধ করলো মনে হয়।

৷৷ ৪ ৷৷

অনন্য তো এখন বেসটাই ঠিক করে খেলতে পারছে না। ও সিরিজ জেতার স্বপ্ন দেখে কীভাবে? প্র্যাকটিসও করছে না ঠিক করে, অথচ আর দুদিন পর এই রবিবারই ম্যাচ। কিছু বললেই বলছে, “ তুই ভালো করে প্র্যাকটিস কর, তুই ভালো করলেই আমার ভালো হয়ে যাবে। সেই ছোট থেকে দেখেই আসছিস। স্টেজে আমি পারফর্ম করি। এটা তোর জীবন মরণের ম্যাচ। জেনে রাখিস। “

সালা চ্যালেঞ্জটা নিলি তুই, আর জীবন মরণ আমার! স্টেজে পারফর্ম করবি? এটা কি পরীক্ষার খাতা নাকি যে দেখালে পাশ করে যাবি? ক্লাবে আমি থাকতে চাই, ক্যারাম খেলতে চাই, তাই বলে আমার জীবন মরণ আর তোর কিছু না? তুই ঢিলে দিবি? ক্লাব থেকে বেরোতে হলে তোকে এমন ক্যালাবো যে তোর জীবন মরণ হয়ে যাবে!

মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে কিছু বললাম না। এদিকে আমাদের কনফিডেন্স চুরমার করতে বিপিনবাবু এখন বিকেলে এসে রোজ দুই ঘন্টা খেলে যান আর প্রায়ই হোয়াইট স্ল্যাম বা ব্ল্যাক স্ল্যাম দিয়ে যান। আমি তাকিয়ে দেখতে থাকি শুধু, কী স্কিল! কেন যে আমি কোনো প্রতিবাদ করলাম না, বাজি ধরার সময়! অনন্যও পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে আর মুচকি মুচকি হাসে। বুঝতে পারি পুরো মাথাটাই গেছে ছেলেটার।

৷৷ ৫ ৷৷

রবিবার এলো। সকালে লুচি আর দুপুরে পাঠার মাংস খেয়ে ঘুমাবো কোথায়, না আমি ক্লাবে যাচ্ছি দুটো টোস্ট মুখে গুঁজে। ক্লাবে ঢুকে দেখি ক্যারম বোর্ডের চারপাশে জনা কুড়ি লোক দাঁড়িয়ে--- এদেরই যেন বেশি আগ্রহ, সবাই আমার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা হাসছে, যেন বলতে চাইছে এই তো ক্লাবে শেষ দিন, এরপর কোথায় মুখ লোকাবে? দুই একটা চাপা গুঞ্জন শুনলাম, “এরা নাকি বিপিনের সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছে! মনে আছে তো বিপিন একবার হিমালয়ে গিয়ে ওখানকার যোগীদের ক্যারমে হারিয়ে এসেছিল, তাও খালি গায়ে খেলতে হয়েছিল ঐ বরফঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে। দেখে সাধুরা এতই তৃপ্ত হন যে আশীর্বাদ দেন বিপিন যে বোর্ড ছোঁবে সেটাই সোনা।”

সোনা? হিমালয়? সাধু? ক্যারম? ইনি কে মশাই? কার বিপক্ষে খেলতে নামছি?

“আরে ও তো কিছুই না, একবার ও এক পা… না না না দুই পা শূন্যে তুলে ক্যারম খেলেছিল। তাও জিতে যায়।”

অন্য আরেকজন আমার মতই কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করে বসলো, “দুই পা শূন্যে তুলে? উনি কি উড়তে পারেন?”

“এই জন্যেই আমি মূর্খদের সামনে কিছু বলি না। বিপিনের পা দুটোকে দড়ির সাহায্যে গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ও তাও জিতলো।”

এরকমভাবে কে খেলে? গাছের ডালের সঙ্গে পা বেঁধে ? গিনেস বুকে নাম তোলার চেষ্টা?

“আর সেইবারটা মনে আছে? সেই কন্যাকুমারীতে গিয়ে ভারত মহাসাগরের সামনে?”

“আরে কোনটা বলো তো? সেই যে ও জলের ওপর হাঁটতে হাঁটতে খেললো, না আকাশে সেই ...?”

“আরে না ওগুলো তো ঠিক আছে, তবে সেই যে শীর্ষাসন করে পা দিয়ে খেললো, সেইটা?”

“আরে হ্যাঁ তো। ওটা অভাবনীয় ছিল, পা দিয়ে খেলে ও দেশের সেরা প্লেয়ারদের হারিয়ে দিয়েছে কতবার।”

আমি হাসবো না কাঁদবো না পালাবো বুঝছিলাম না, এরা সব কারা? বলছেটা কী? এ কোন যুগাবতার? এখানে কেন? আজও কি দুই পা শূন্যে তুলে বা শীর্ষাসন করে খেলবে? কান আর মাথা যখন ঝাঁ ঝাঁ করছে তখন আমি ভিড় থেকে একটু দূরে সরে এসে বোর্ডটা দেখতে লাগলাম। এই বোর্ডটাই সব। রোজ পড়াশোনার চাপ, কলির আমায় নিয়ে উদাসীনতা, বাড়ির, মেসের নানা ঝামেলা নিয়ে এই বোর্ডের সামনে যখন দাঁড়াই, সবটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়--- সামনে থাকে শুধু ১৯টা ঘুঁটি, স্ট্রাইকার আর বোর্ড। সমস্ত ফ্রাস্ট্রেশন, কষ্ট এখানে হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে স্ট্রাইকারের শটে ঘুঁটিতে লেগে ঘুঁটিকে নিয়ে পকেটে হারিয়ে যায়। শুধু এই বোর্ডের জন্যই, আমার খেলার জন্যই আমায় আজ জিততে হবে।

চারজন দাঁড়ালাম। অনন্য আর আমি, বিপিনবাবু আর একজন মুশকো লোক। খেলা শুরু হলো। টসে জিতে বিপিনবাবু ব্রেক নিলেন। আর শুরুই করলেন হোয়াইট স্ল্যাম দিয়ে। আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। অনন্য উল্টোদিকে সেই হাসছে। আমি ওর থেকে সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েছি, যতটা করার আমাকেই করতে হবে। ওকে কিছু বলবোও না। কী করে ও, দেখবো। বিপিনবাবুর ডানদিকে আমি--- আমার ব্রেক এবার। চোদ্দ পয়েন্টকে কাউন্টার করতে গেলে আমার এই ব্রেকে যতটা সম্ভব পয়েন্ট তুলতে হবে। পকেট থেকে কালো রঙের ছোট কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো স্ট্রাইকারটা বের করলাম। হিট, হিটেই পাঁচটা গুটি পকেটে গেল, বেশ ভালো হিট, পাঁচটার বেশি ফেলিওনি কোনোদিন ফার্স্ট হিটে। হোয়াইট স্ল্যামের চেষ্টা করতে হবে--- রানী প্রায় পকেটে ঝুলছিল। অন্য একটা ঘুঁটিকে মেরে লালটাকে ফেললাম, কভারও করলাম। ক্রসে দুটো আর বেসে একটা ফেলে আমারও হোয়াইট স্ল্যাম। ভাবতে পারিনি এতটা ভালো হতে পারে, কালো ঘুঁটিগুলো পকেটের ধারে-কাছে নেই। দেখি বিপিনবাবুর চোখ জ্বলজ্বল করছে, রেগে গেলেন না খুশি হলেন? কে জানে! তবে অনন্য হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, বেমক্কা বলে বসলো, “কীইইই, নাম তুলে নেবেন নাকি?”

বিপিনবাবুর মুখ নিমেষে পাল্টে গেল, রাগে গরগর করতে লাগলেন। মুশকো লোকের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন, “অমিত, দেখতে পাচ্ছিস তো কেমন বেয়াদপ? এদের না ক্লাব থেকে তাড়িয়েছি, তো আমার নামও বিপিন নয়।”

আমি ভাবছি এর আজ কী হয়েছে, কেমন অদ্ভুত হয়ে আছে অনন্য। এত তাতাচ্ছে কেন?

অমিতবাবু হিট করলেন, স্ল্যাম না হলেও পাঁচটা ফেললেন, ভালোই খেলেন। তবে আমিও একটু নিশ্চিত হলাম, এর মানে এঁদের মধ্যে বিপিনবাবুই বেস্ট। অজানা এই অমিতবাবু নন। অনন্যর দান এবার। অনন্য দেখি হাতের দুটো বেস ছেড়ে ইঞ্চি মারতে যাচ্ছে। আমার দিকে তাকাচ্ছেও না। আমিও ডাকবো না ঠিক করলাম, নিজেই খেলুক। ইঞ্চি মারলো, শটে কালো ঘুঁটি না পড়ে পাশে থাকা সাদা ঘুঁটি পড়লো। অনন্য চট করে একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বিপিনবাবুকে বললো, “নিন, নিজে তো তেমন ফেলতে পারবেন না, আমিই ফেলে দিলাম।”

বিপিনবাবু চোখ দিয়ে অনন্যকে ভস্ম করে দিয়ে নিজের ঐ দানেই বোর্ড শেষ করে দিলেন। মানে সেই চোদ্দ, ওদের আঠাশ আর আমাদের চোদ্দ। বুঝতে পারছি এভাবে জেতার আশা নেই। একা আমি কী করবো তাও জানি না। না, শেষ অব্দি খেলে যেতে হবে। অনন্যর ব্রেক, স্ট্রাইকার সপাটে মারলো ঘুঁটিতে, কিন্তু আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম--- দেখি সাদা ঘুঁটিগুলো পকেটের কাছেই পৌঁছলো না, উল্টে কালোগুলো টপাটপ পড়ছে। ও কি চক্রান্ত করেছে আমায় ক্লাব থেকে বের করবে বলে? আমি তাকাতেই হাতজোড় করে বললো, “খুব ভুল হয়ে গেছে মাইরি, ক্ষমা করে দে। নেক্সটটায় দেখে নিস এরা নাচবে।”

সেই আমার অব্দি দান আর পৌঁছলো না, তার আগেই বিপিনবাবু শেষ করে দিলেন। নিজের ব্রেক ছাড়া আর কোনোবার সুযোগই পেলাম না। আমি বোর্ড ছেড়ে বেরিয়ে বাইরে এলাম। মাথা কাজ করছে না, এভাবে হারতে হচ্ছে? খেলা বন্ধ হয়ে যাবে আমার? অনন্যর সামনে যেতেই ইচ্ছে করছে না। ওর যদি আমাকে তাড়ানোরই ইচ্ছে হয়, তাহলে তাই। তবে আমিও লড়ে যাব।

৷৷ ৬ ৷৷

কিন্তু খেলা যে এভাবে ঘুরে যাবে আমি ভাবতেও পারিনি। দ্বিতীয় গেমের শুরু থেকেই দেখছি বিপিনবাবু কেমন উশখুশ করছেন, ডানহাতটায় স্ট্রাইকার ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছেন না। আর অন্যদিকে অমিতবাবুও ঝিমোচ্ছেন। অমিতবাবু মারতে যাবেন, এমন সময় বিপিনবাবু চিৎকার করে উঠলেন, “আমার এমন হচ্ছে কেন?”

আর এটা বলেই হাত পা ছুঁড়ে নাচতে লাগলেন। পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, “দেখ, দেখ, বলেছিলাম না, আজ নাচতে নাচতে বিপিন বোর্ড শেষ করবে।”

সত্যি এও সম্ভব? বিপিনবাবু হাত পা ছুঁড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে নেচেই চলেছেন। আশেপাশে অস্থিরতা বাড়ছে।

“খেলবে কখন? এ তো নেচেই যাচ্ছে।”

“হেরে যাওয়ার ভয় নাকি? অপোনেন্টে থাকা বাচ্চা ছেলেটা যা খেললো, ওতেই ভিরমি খেয়েছে।”

“আরে না, উনি এরকম নাচতে নাচতেই দুম করে মেরে দেবেন। উনি তো একবার খেলতে খেলতে ভরত নাট্যমের পুরো কোর্সও কমপ্লিট করে ফেলেছিলেন। নাচের মাস্টার ক্লাবে ক্যারম খেলার সময় আসতেন আর তালিম দিয়ে চলে যেতেন।”

এদিকে সবাই যখন বিপিনবাবুর এই তিড়িং বিড়িং নাচ দেখতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ধপাস করে মাটি কাঁপিয়ে একটা আওয়াজ হলো। সবাই রে রে করে উঠে পেছনে তাকালো। ঘুরে দেখি, অমিতবাবু মাটিতে পড়ে গিয়ে বেশ জোরে জোরে নাক ডাকতে শুরু করেছেন।

এসব হচ্ছে কী? আমি অমিতবাবুকে তুলে ক্লাবের সোফায় শুইয়ে দিলাম। অন্যদিকে বিপিনবাবু বেশ হাঁপিয়ে উঠেছেন, কিন্তু নাচের বিরাম নেই। আমি এবার ভালো করে লক্ষ্য করলাম, বিপিনবাবুর মুখটা লাল হয়ে ফুলে গেছে, হাত দিয়ে সারা গায়ে ঘষছেন, বিপিনবাবু আসলে নাচছেন না, চুলকাচ্ছেন।

অনন্য এবার এগিয়ে গেলো, “বিপিনবাবু আপনার বন্ধু তো ঘুমোচ্ছেন আর আপনিও এদিকে খেলা ছেড়ে কীসব শুরু করলেন। খেলবেন কি আর?”

একটা চিঁ করে আওয়াজ বেরোলো। “খেলবেঁএএএএএএএএ”।

“আচ্ছা খেলুন।”

হাত পা ঘষতে ঘষতে কোনোরকমে বোর্ডের কাছে এসে স্ট্রাইকার দিয়ে ব্রেক করলেন, কিন্তু ঘুঁটি ব্রেক হলো না, ব্রেক হলো নাক। স্ট্রাইকারটা বিপিনবাবুর আঙুলের জোর টোকা খেয়ে বোর্ড থেকে উড়ে গিয়ে সজোরে লাগলো একজন দর্শকের নাকে। নাক ধরে তিনি বসে পড়লেন।

“না পারছি না। আমি বাড়ি যাবো। আমায় ছেড়ে দাও। আমায় ছেড়ে দাও।”

ধরে কেউ অবশ্য ছিল না। সবাই সরে দাঁড়ালো। আর বিপিনবাবুও হাত তুলে দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন।

গত সাত মিনিটে কী যে হয়ে গেল আমার মাথায় ঢুকলো না। হঠাৎ কেন এত চুলকানি? অমিতবাবুই বা কেন ঘুমিয়ে পড়লেন?

আমি ভাবছি কী হতে পারে, এমন সময় অনন্য এসে পিঠে চাপড় মেরে বললো, “চল, মেসে যাই। আমরা ক্লাবে থাকছি।”

৷৷ ৭ ৷৷

“ঈশান, ঈশান…”

আমি থমকে দাঁড়ালাম। গলাটা ভীষণ চেনা। আমি খুব খুশি হয়ে ঘুরে তাকালাম। কলি আসছে দৌড়ে দৌড়ে।

“ঈশান, চলো, বাড়ি চলো।”

চমকে গেলাম। গত চার পাঁচ মাসে ঠিকভাবে কথা বলেনি কলি। আর আজ ছুটে এসে আমায় বাড়ি যেতে বলছে।

“বাড়ি? কেন?”

“বাবা তোমায় ডেকেছে। “

“মানে? তুমি রাজি? তুমি বাবাকে আমার কথা বলেছ?”

আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারলাম না।। মানুষ যখন সব আশা ছেড়ে দেয়, তখন হঠাৎ করে সব ভালো হয়ে যেতে পারে? তবু হঠাৎ এরকম বলায় আমার কেমন একটা সংকোচ হলো। “এরকম হঠাৎ? মানে কী হলো? কীরকম একটা …? এই জামাকাপড়ে? “

“লজ্জা পাচ্ছ? আজই আমাদের পাকা দেখা হচ্ছে না। চিন্তা নেই, খুব একটা অসভ্য দেখতে লাগছে না। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি বাবা কীভাবে নিজে থেকে আমায় তোমার কথা বললো। তুমি কিছু করেছিলে?”

“আমি? না তো! আমি তো তোমার বাবাকে চিনিও না।”

“আরে, এসো, এসো ঈশান। ঈশান তো?”

কলির বাড়ির ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি বিপিনবাবু ক্যারম বোর্ডে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন।

আমার মুখের হাঁ বন্ধ হয়নি।

“হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? আমিই কলির বাবা।”

বুঝলাম সব শেষ। সেদিন ঐ হারের বদলা আমার ওপর দিয়ে নেবে বলে ডেকেছেন। কী যে করবেন? খুব অপমান করবেন? মারধোর করতে পারেন কি?

আমি ধীরে ধীরে বোর্ডের দিকে এগোলাম।

“খেলবে?”

ট্রিক নাকি? আমি মাথা নাড়লাম।

“তা কলিকে ভালোবাসো?”

আমি আবার মাথা নাড়লাম।

“ভালো, ভালো। ভালো না বাসলে তোমাদের দুজনকে ঘুড়ির মতো করে আকাশে উড়িয়ে দিতাম। তবে তোমরা সেখানেও কিছু ফন্দি ফিকির করে বেরিয়ে যেতে। যা ভয়ানক তোমরা।”

“দুজন …? তোমরা? কারা?”

“তুমি আর তোমার বন্ধু। অবশ্য তোমার বন্ধু বলছিল তুমি কিছু জানো না। তবে ক্যারমটা বেশ ভালো খেলো। জমবে ভালো আমার সঙ্গে। “

“আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না।”

বিপিনবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন। “তোমার বন্ধু তোমার ভালোবাসার কথা জেনেই আমার সঙ্গে বাজি লড়েছিলো। প্ল্যান ছিল, আমাদের হারিয়ে আমার থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়ে নেবে যে আমি যেন কলিকে তোমার হাতে তুলে দিই। কিন্তু ও ভাবতে পারেনি আমি এতটা ভালো খেলি।”

আমি অবাক হয়ে শুনতে লাগলাম। “কিন্তু সেদিন… সেদিন কী থেকে কী হলো?”

“হাহাহাহাহা, এটাও তোমার বন্ধুর কারসাজি। আমায় রাগিয়ে দিয়ে এমন উত্তেজিত করে তুলেছিল যে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার ডিমে অ্যালার্জি। কিন্তু ও ঠিক কোনোভাবে জেনে গিয়েছিল। আর প্রথম গেম জেতার পর আমি এতই এক্সাইটেড ছিলাম যে আমার জন্য কে একটা ডিমের চপ আনলো, আমি খেয়েও নিলাম। ব্যাস আর যাই কোথায়, নাচতে লাগলাম চুলকানির চোটে। অমিতকেও চা দিয়েছিল। আর তার সঙ্গে ঘুমের ওষুধ। সেও ঘুমিয়ে পড়লো। খেলা গেল চুলোয়। হাহাহাহাহা। “

ঘুম থেকে উঠে যদি দেখতাম আমি ব্যাঙ হয়ে গেছি তাও এত অবাক হতাম না।

“পরের দিন যখন ঠিক হয়ে গেছি, ভোরবেলা জগিংয়ে বেরোবো, দেখি তোমার বন্ধু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। মুখটা কাঁচুমাচু করে সরল মনে সবটা বলে দিল। শুনতে শুনতে রাগ হলেও যখন বুঝলাম তোমার ভালোবাসার জন্য ও নিজে এতটা ঝুঁকি নিয়েছে, তখন আর রেগে থাকতে পারলাম না, আর ওর কথা রাখবো বললাম। শুধু তুমি সত্যিই আমার মেয়েকে ভালোবাসো কিনা আর আমার মেয়েও তোমায় পছন্দ করে কিনা যাচাই করতে চেয়েছিলাম। সেটাও আজ কলিকে জিজ্ঞেস করতে বললো, ওর জন্য তুমি নাকি ডাঙায় ওঠা মাছের মতো করছ। হাহাহাহাহা, ইয়াং বয়, আমার কলেজের দিনগুলো মনে পড়ে গেল। তাই আজ তোমায় ডেকে পাঠালাম। তোমায় বেশিদিন কষ্ট দেওয়া যায় না।”

***

আসলে কী থেকে কী হয়, আমরা কেউ জানি না। বলেছিলাম না অনন্য যে কী তা শুধু আমিই জানি। বন্ধু এরকমই হয়।

অনন্য যে আমায় এভাবে বক করবে ভাবিইনি কোনোদিন, তাও আমার জন্য, শুধু আমার ভালোবাসা, ইচ্ছের জন্য। অনেককিছু পাল্টে গেলেও কিছু জিনিস, ভালো লাগা, ভালোবাসা পাল্টায় না। এখনো বিপিনবাবুর সঙ্গে জিততে হলে আমি মাঝে মাঝে অমলেটের প্লেট রেখে দিই সামনে, তবে উনি আর ভুল করেন না, হেসে ওঠেন। এখনো আমি কলির পেছনে ঘুরি, তবে ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য নয়--- ওর জন্য নোটস দিতে, আনতে, ওর শপিং ব্যাগ ধরে রাস্তায় হাঁটার জন্য। এখনো আমি আর অনন্য ছোটবেলার পাড়ায় যাই, মাঠে যাই, স্কুলে যাই, আমরা যে এখনো সেই আমরাই আছি, মাটি থেকে আলাদা হয়ে যাইনি তা বোঝার জন্য।

জীবনের কনস্ট্যান্টগুলো ঠিক থাকলে সব ঠিকই থাকে।