এমব্রায়ো - জাকিউল অন্তু

গল্প

আবার! সেই একই ঘটনা। তন্ময় যেন অনন্ত যাত্রায় আছে। আশেপাশে মানুষ যে একেবারে নেই তা নয়, কিন্তু বেশ তফাতে। সবাই হাঁটছে। প্রথমে মনে হলো একটা প্রশস্ত রাস্তা। পরে টের পেলো রাস্তাটা মূলত একটা ব্রীজ। একটু সাবধানে দু’পাশে উঁকি না দিলে দু’দিকের জলাধার চোখে পড়ে না। সাবধানে বলছি কারণ সে হেঁটে চলেছে একটা অদৃশ্য নির্দিষ্ট পথ ধরে। ওর ইচ্ছাশক্তির কোনও মূল্য নেই এখানে। অনেকটা রেললাইনের মতন সোজা পথ। শুরুতে মনে হয়েছিলো ওর পাশে মানুষ আছে।

কিন্তু তারাও যার যার মতন পথচক্রে আটকে আছে। ওর যেমন তাদের কাছে যাবার উপায় নেই, তেমনি তাদেরও ওর কাছে আসবার উপায় নেই। কারো মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। তবে পরিচিত মনে হয়। সবার হাঁটার মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা। খানিকটা ক্লান্তিও আছে বোধহয়। অন্তত ওর ক্লান্তি লাগছে৷

মনে হচ্ছে তন্ময় আসলে নিজেকে বহন করে চলেছে। অনেকটা বিমানের মতন৷ ককপিটে বসে আছে ওর আত্মা। চোখদুটো সামনের আকাশ দেখে কন্ট্রোল হুইল ঘোরাচ্ছে৷ তাতে ঘুরে যাচ্ছে পা৷ কিন্তু গণ্ডির ভেতর!

***

সাম্প্রতিক কোনও কিছু ভুলে গেলে যেখানে ঘটনার সূত্রপাত সেখানে ফেরত যাওয়া রাফিদের স্বভাব৷ টেকনিকটা খুব কাজের৷ ভুলে যাওয়া জিনিস সহজে খুঁজে পাওয়া যায় তাতে৷

ধরা যাক, একটা চটপটে স্বভাবের কোনও মানুষ কাজ করার জন্য এক রুম থেকে অন্য রুমে ঢুকলো৷ কিন্তু কী কাজ সেটা রুম বদলের সময় ভুলে গেলো৷ তখন সে আগের রুমে তৎক্ষণাৎ ফিরে গেলেই তার পরবর্তী রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্য মনে করতে পারবে৷

তাহলে কি আমাদের কথাবার্তা সব বাতাসে ভাসমান? শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে আমরা একজন আরেকজনের কথা শুনতে পাই ঠিকই, কিন্তু সেই শব্দ যখন কান নামক শব্দগ্রাহক অঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে না, তখন কি সেটা আজীবন বাতাসে ভেসেই থাকে?

শব্দেরা কি কারোর জন্য অপেক্ষা করে? রাফিদের মনে প্রশ্ন জাগে৷

***

বাচ্চা মেয়ে পারিজা৷ এখনো ঠিকমতো কলম ধরতেই শেখেনি৷ ওর বাবা ওকে কিনে দিয়েছে ডিজিটাল স্কেচপ্যাড। আঁকিবুঁকি করার জন্য৷ কিন্তু একদিন ওর মা দেখলেন তার কন্যা বাতাসে কান পেতে কী যেন শুনছে আর সামনে রাখা আঁকার স্কেচপ্যাডে আঁকছে। সেই ড্রয়িং দেখে পারিজার মা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন৷ মাত্র চার বছরের বাচ্চা যা এঁকেছে তা কোনও ভালো আঁকিয়েও এত সহজে পারবেন না৷ কিন্তু এ কীসের ছবি আঁকলো পারিজা! ওর বাতাসে কান পাতার উদ্দেশ্য কী?

***

চাইনিজ এমব্রায়োলজিস্ট লি. উই এই প্রথম তার কাজের সফলতায় খুশি হবার বদলে ঘাবড়ে গেছেন৷ প্রচণ্ড ভয় কাজ করছে তার মনে৷ চাইলেই এই এক্সপেরিমেন্ট থেকে সরে আসা যেতো কিন্তু তিনি কৌতূহলের ফাঁদে পড়ে শেষমেশ আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি৷ এখন উপায় একটাই৷ নিজেকে শেষ করে দিতে হবে৷ এটাই হয়তো সবাইকে বাঁচাবার একটা শেষ উপায়!

***

মানুষ গাছের মতন৷ সূর্যালোকে বাড়ে… আলো বাতাস ছাড়া বাঁচে না৷

পৃথিবী দিবসে পৃথিবীর আদিম সভ্যতার ধারক ও বাহক মানুষকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে বসেছে বিজ্ঞানী তন্ময় কিবরিয়া। মানুষ সম্পর্কে ইতিবাচক একটা প্রবন্ধ লেখার ভার দেওয়া হয়েছে তাকে৷ কিন্তু গোটাকতক ছেলেমানুষী লেখার বাইরে কিছুই আসছে না৷ মনে হচ্ছে কিশোর ছেলে কবিতা লেখার চেষ্টা করছে৷

সে ভাবছিল আসলেই মানুষকে নিয়ে বলার মতন কিছু কি অবশিষ্ট আছে?

সালটা ২০৭০৷ আরো কয়েক শতক আগের মানুষের জার্নাল ঘাঁটলে পাওয়া যেতো বৈচিত্র্যময় শিল্প, নানান সভ্যতার চমৎকার সব নিদর্শন। মিউজিক আর আর্ট ছিলো মানুষের আত্মার খোরাক। ওদের বিভিন্ন লেখায় একটা ভয়ের কথা প্রায়ই লেখা থাকতো। একসময় মানুষ হয়ে উঠবে আবেগহীন। অনেকটা রোবটের মতন। যন্ত্রবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। অবশ্য তা যে ঘটেছে সীমিত পরিসরে। বিকলাঙ্গ মানুষদের শরীরে প্রস্থেটিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে দেওয়ার কাজটা অনেক আগের। কিন্তু এখন তা আরো অনেক বেশি উন্নত। বিকলাঙ্গ মানুষগুলোকে এখন সেমি-রোবট বললেও ভুল হবে না।

সেকালে চীন-জাপানের দিকে যান্ত্রিকতা বেড়ে গিয়েছিলো লাগামহীনভাবে। ওরা সুযোগ পেলেই যেকোনও নামকরা যন্ত্রের রেপ্লিকা তৈরী করে ফেলতে পারতো। সেই যন্ত্রগুলো আসল যন্ত্রের চাইতেও ভালো কাজ করতো মাঝেমধ্যে। আবার কখনো কখনো ঠিকমতো চলতোই না৷ চীনারা কাজের অকাজের প্রচুর জিনিস বানিয়েছে সেসময়।

জনশক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বের অর্থনীতিতে এদের অবদান ছিলো অনেক। কিন্তু সবচেয়ে লক্ষনীয় ছিলো ওদের খাদ্যাভ্যাস। বায়োহ্যাজার্ডের উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিলো ওরা। আর্থ্রোপোডা থেকে শুরু করে ম্যামাল সব ধরনের প্রাণীই ওদের পেটে গেছে। শুধু তাই নয় ট্রনটিউবে সার্চ দিলে এখনো আর্কাইভে কিছু এ.এস. এম আর ভিডিও পাওয়া যাবে জীবন্ত মাছ, ব্যাঙ আর অক্টোপাস খাবার।

গা ঘিনঘিন করে ওসব দেখলে।

প্রাণীহত্যার একদম বিপরীতে যেতে পারবে না তন্ময়। কিন্তু ও জানে জীবন্ত অবস্থায় কাউকে কামড়ে খেয়ে ফেললে কেমন অসহ্য যন্ত্রণা হতে পারে। অতীতের লোমহর্ষক ঘটনাটা মনে পড়ে ওর। জঙ্গলে ক্যাম্পিং করতে গিয়েছিলো ওরা দুই বন্ধু। অ্যাডভেঞ্চারের শখের কারণে সেদিন সব ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বন্ধ করে রেখেছিলো। ভেবেছিলো আদিম মানুষরাও তো জঙ্গলে থেকেছে এককালে। ওরা কি সার্ভাইব করেনি!

কিন্তু দুই বন্ধু যে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে সেটা কি কেউ জানতো?

ক্যাম্প খাটিয়ে বনফায়ারের সামনে খাওয়াদাওয়া আর ফূর্তি সেরে ওরা যখন শুতে যাবে তখন ওদের মনে হলো আশেপাশে ভারী দেহের কিছু একটা আছে। ওদের ক্যাম্প ঘিরে থপ থপ শব্দে মাটি কাঁপিয়ে চক্কর দিচ্ছে। একটা আশঁটে গন্ধ বাতাসে।

বনফায়ার থেকে একটা জলন্ত কাঠের টুকরো ওপরের দিকে তুলে ধরেছিলো তন্ময়ের বন্ধু ও সহকর্মী বিজ্ঞানী প্রীতম শীল।

তন্ময় কিছুক্ষণ পর বেরিয়েছিলো। কিন্তু বের হয়েই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছে। তার সামনে পড়ে আছে তার বন্ধুর আধখাওয়া মৃতদেহ। ওটার গলা থেকে নীচে পেট পর্যন্ত ফেড়ে ফেলা হয়েছে ধারালো নখ দিয়ে।

সেই নখ আর কারোর নয়। বিলুপ্ত হওয়া প্রাণী গ্রিজলীট্রনের। আধা ভাল্লুক-আধা রোবট। বিজ্ঞানের খামখেয়ালিপনার এক বিকট নিদর্শন। পৃথিবীতে খাবারের অভাব হওয়ায় এদের অল্প খাদ্য আর চার্জের ব্যাটারীতে চলার মতন একটা অবস্থা তৈরী করা হয়েছিলো।

এবং সায়েন্টিস্ট উইংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এরা কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সবাইকে ক্রাশারে ফেলে পিষে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এখন তো একটাকে দেখা যাচ্ছে তার ভয়ানক চেহারা নিয়ে আক্রমণ করতে।

তন্ময় সব দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ভাল্লুকটা প্রীতমকে খাওয়ার ফাঁকে মাথা তুলে তাকাতেই তন্ময়কে দেখতে পায় আর তৎক্ষণাৎ হুঙ্কার ছাড়ে। স্পষ্ট হামলার প্রস্তুতি। উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তন্ময় একটা জলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে প্রাণপণে ছুট লাগায় জঙ্গলের বাইরের হাইওয়ের দিকে। পর্যাপ্ত আলো না থাকায় চলতে অসুবিধা হচ্ছিলো। হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছে ও। পায়ের পাতা ছিলে গেছে। কিন্তু বাঁচার জন্য দৌড়াতেই হবে। ওদিকে গ্রিজলীর গর্জন শোনা যাচ্ছে। তন্ময়কে রাস্তা বদল করতে হলো। পাথুরে একটা উপত্যকা আছে কাছেই। ওদিকে পাথরের আড়ালে লুকোনো যেতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ৷ কিন্তু ঢালু অংশটা বেয়ে উপরে উঠতে গিয়েই পিছলে পড়ে গেলো সে।

ডান পা-টা সোজা গ্রিজলীর গলার কাছে ধাক্কা খেলো। গ্রিজলী কামড়ে ছিলে নিলো ওর পা। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো ও। ভেবেছিলো এই তার শেষ চিৎকার। কিন্তু হাসপাতালে যখন ওর জ্ঞান হলো ও অবাক হয়ে খেয়াল করলো ওর ডান পা আগের মতই আছে। শুধু শরীরে দুর্বলতা আছে। যেন গ্রিজলীট্রনের পুরো ব্যাপারটাই একটা দুঃস্বপ্ন।

অন্য কোন মামুলি রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে সে। শোয়া থেকে উঠে বসতেই চমক ভাঙ্গলো ওর। সব ঠিক আছে, কিন্তু ওর ডান পা সেখানে এসে কোমরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেখানে লেখা আছে একটা শর্ট ইউজার ম্যানুয়েল।

“প্রস্থেটিক লেগ, চার্জ অ্যাট লিস্ট ফিফটিন মিনিট ফর আ ব্রিস্ক ওয়াক, থার্টি মিনিটস ফর রানিং এন্ড ওয়ান আওয়ার ফর জেটপ্যাক। ওয়াটারপ্রুফ ম্যাটেরিয়াল।”

অনুভূতিতে কোন কমতি রাখে না এই নকল পা। এমনকী এই পায়ে লাগানো জেটপ্যাক দিয়ে সে শূন্যে ভাসতেও পারবে কিছুক্ষণ। কিন্তু তন্ময়ের মনে হলো ওর রক্তমাংসের পা সারাজীবনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গ্রিজলীট্রনের তীক্ষ্ণ দাঁত বিধিয়ে ছিড়ে নিয়ে গলাধঃকরণ করেছে ঐ অংশটা। মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই ট্রমা ওর মাথা থেকে যাবে না৷

মাঝেমধ্যেই দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করলো তন্ময়। প্রীতমের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে ও। শুধু ওর মুখমণ্ডল জীবিত। ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে।

প্রীতমের মুখ থেকে একটা বাক্যই বের হচ্ছে।

“দোষটা আমাদেরই!”

তারপরেই তন্ময়কে আক্রমণ করে বসে গ্রীজলীট্রন। আর ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে সে।

এইসব সমস্যার কারণে ওকে লবোটমি করার পরামর্শ দিয়েছিলো ডাক্তার এড্রিক বেকার।

কিন্তু লবোটমি আসলে একধরনের শাস্তি ব্যতিত আর কিছুই নয়। মস্তিষ্কের প্রি ফ্রন্টাল লোবে একটা ধারালো সূচ ঢুকিয়ে সব ধরণের স্মৃতি নষ্ট করে ফেলা হয়। শুধু যে ঐ ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথাই ওর মনে আছে তা তো নয়। ওর পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে আরো কত লক্ষ স্মৃতি ওর মস্তিষ্কে জমা আছে সেটা শুধু ও নিজে জানে।

প্রবন্ধটা লিখতে গিয়ে বারবার আদিম মানুষদের জার্নালের কথা মনে পড়ে যায় ওর। নকল যে কখনো আসলকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না সেটা ওদের ধারণা ছিলো। আজ সে ধারণা সত্যি হয়েছে।

মানুষের আরেকটা ধারণা ছিলো মানুষের মঙ্গল গ্রহে বসতি। সেটা আজ ডালভাতের মত সহজ। মঙ্গলে বসবাস উপযোগী পরিবেশ তৈরী করে কলোনির পর কলোনি তৈরী করা হয়েছে। যদিও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করিয়ে এখানে মূলত রাখা হয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ আসামীদের। আদি কালের বনবাস প্রথার মতন।

তাছাড়া মানুষ নিজেদের বসবাসের জন্য সপ্তাশ্চর্যগুলোর ডিজাইন বেছে নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে পিরামিডের আদলে গড়া বিশাল সব ভাসমান দালান।

ডাল ভাতের কথা থেকে তন্ময়ের মনে পড়ে গেলো সেকালের সতেজ খাবার আর ফলমূলের কথা। ও শুনেছে তখন মানুষ আসল ফল খেতে পারতো, ফসলের মাঠ থেকে নতুন ফসল ঘরে তুলতো। এখনকার মতন সিনথেটিক খাবারদাবার ছিলো না তখন। আপেল খেতে চাইলে সরাসরি আপেল খাওয়া যেতো, আপেলের ফ্লেভারের গুঁড়ো নয়।

যেটা জলে মিশিয়ে খেয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হবে। শুধু মনে করতে হবে অমুক ফলের স্বাদ এককালে এমন ছিলো। প্যাকেটে লেখা থাকে, “আর্টিফিশিয়ালি ফ্লেভার্ড। নো এডেড সুগার।”

পছন্দের সবজিও বড় বড় গ্রীন হাউজ ছাড়া ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। পৃথিবীর বাইরে একসময় ওজোন নামে একটা আচ্ছাদন ছিলো। সরাসরি সুর্যের আলোর অতিবেগুনী রশ্মি পৃথিবীতে ঢুকতে পারতো না। ওজোন লেয়ার ছাকনির মতন ছেঁকে নিতো ক্ষতিকর পদার্থগুলো।

সেই লেয়ার বহুকাল আগেই ছিদ্র হয়ে গেছে। মানুষের চর্মরোগ বেড়ে গেছে তাই। গত কয়েক শতকে স্কিন ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য এককালে শুধু ক্যামেরায় ফিল্টার ব্যবহার করা হত। তারপর এলো প্লাস্টিক সার্জারী। কিন্তু ইদানীং তৈরি হয়েছে অগমেন্টেড স্যুট। যার ব্যবহারে একটা সুইচ চাপলেই চরম অগোছালো চেহারা আর বেশভূষা বদলে যায় ফিটফাট পোশাক আর চেহারায়। এমনকি শরীরের দুর্গন্ধ পর্যন্ত দূর হয়ে যাবে বিশেষ পারফিউমের মাধ্যমে। ফলে প্রকৃত ভালো থাকার বা গোছানো জীবনযাপন করা হচ্ছে না। এতে অবেসিটি বা স্থুলতা বেড়ে গেছে।

তন্ময় লেখাটা লিখছিলো একটা ডিজিটাল প্যাডে। চাইলেই এখন আর কোনও ধরনের কাগজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকৃতিতে উদ্ভিদের সংখ্যা কমে গেছে অনেক। ফলে যেসব গাছ থেকে কাগজ হতো, বিশেষ করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজাতির ঘাস বাঁশও আর জন্মায় না। পান্ডা নামক এক প্রাণীর বিলুপ্তির কারণ এই বাঁশের বিলুপ্তি। পান্ডার প্রধান খাদ্য ছিলো বাঁশ।

নোটপ্যাড এখন শুধু স্ক্রিনেই। কাগজের অনুপস্থিতি মানেই সবার চোখে চশমা। কাগজ থেকে তো আর চোখের জন্য ক্ষতিকর ব্লু লাইট এমিট করতো না।

একটা সময় পৃথিবীতে ধর্ম নামে একটা ব্যাপার ছিলো। অনেকটা কাউন্সিলের মতন। এখন পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে কাউন্সিলররা। তাদের মতামত অনুযায়ী চলতে হয় সবাইকে। এককালের চারটে বড় ধর্মের মত এখন চারটে বড় কাউন্সিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা বিশ্বে।

সায়েন্টিস্ট উইং, কমান্ডো উইং, ইকোনমি উইং এবং কালচার উইং।

সায়েন্টিস্ট উইং এর কাজ সারা বিশ্বের সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মানুষের টিকে থাকার সরঞ্জাম বানানো আর চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা। এই নতুন সভ্যতা টিকিয়ে রেখেছে এরাই।

কমান্ডো উইং এর কাজ হলো যুদ্ধের বিনিময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। ব্যাপারটা তাদের উদ্দেশ্যের মতই হাস্যকর।

ইকোনমি উইং এর কাজ বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা এবং সেটা শুধু নিজেদের স্বার্থেই। এরা মূলত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একটা বড় গোষ্ঠী।

সবচেয়ে দুর্বল হচ্ছে কালচারাল উইং। এরা ভবঘুরে, কোনও খাবার বা বাসস্থানের ঠিক ঠিকানা নেই। এদের হাতে গিটার থাকে, গল্প-কবিতার বই থাকে, স্বরচিত লেখার নোটপ্যাড থাকে। ঝোলায় সিগারেট বা মারিজুয়ানা থাকে, চোখে স্বপ্ন আর ফাঁকা পকেটে এরা পথ চলে। বেশীরভাগ মারা যায় বিনা চিকিৎসায়। কারণ সায়েন্টিস্ট উইং এ তাদের সচরাচর ঢুকতেই দেওয়া হয় না।

তন্ময় ঠিক করেছে প্রবন্ধটা লিখেই সে তার বহুল আকাঙ্ক্ষিত অভিযানে যোগ দেবে। তার অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। টাইম ট্রাভেলের পেটেন্ট করিয়েছে সে। একদম নিজের নামে। এরপর থেকে কেউ টাইম ট্রাভেল করতে চাইলে তার তৈরি টাইম মেশিনে করে যেতে হবে। সায়েন্টিস্ট উইং তৈরি হবার অনেক আগে থেকেই টাইম ট্রাভেল নিয়ে গবেষণা চলেছে। আজ সেই ধারণা সত্যি হচ্ছে।

তন্ময়ের বানানো টাইম মেশিনের একটা বিশেষত্ব হলো এটা ব্রিফকেসের মতন দেখতে। ডালাটা খুললেই হলোগ্রাফিক চেম্বার উন্মুক্ত হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে সময় আর গন্তব্য ইনপুট করতে হয়।

এই যন্ত্র ওজনে হালকা তাই সহজে বহনযোগ্য। টাইম ট্রাভেলের পরেও একটা হলোগ্রাফিক আলো ট্রাভেলারকে খুঁজে নেবে। অর্থাৎ ট্রাভেল শেষে টাইম মেশিন হারাবার কোনও ভয় নেই। শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যাচ্ছে তন্ময়ের। এটা কি শুধুই উত্তেজনা?

টেস্ট ট্রাভেলের প্রস্তুতি নেয়ার আগেই তন্ময়ের স্ত্রী তিলোত্তমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো তার ঘরে। তাদের একমাত্র শিশুকন্যা পারিজা তার আঁকার স্কেচপ্যাডে কী যেন এঁকেছে। তিলোত্তমার চিন্তিত মুখ দেখে তন্ময় ছুটলো তার পিছুপিছু।

পারিজার স্কেচপ্যাডের দিকে তাকিয়ে তাকেও হতবাক হয়ে যেতে হলো। তার মেয়ে স্কেচ পেন দিয়ে তাকেই এঁকেছে।

কিন্তু এ কোন তন্ময়? কোমরের ওপরের দিকে স্বাভাবিক থাকলেও তার নীচ থেকে বের হয়েছে গাছের শিকড় জাতীয় কোন বস্তু! যেন ওর কোমরের নীচের অংশটা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে কোন গাছের গুড়ি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। যার শিকড় কিলবিল করছে শুঁড়ের মত। মাথার ওপরে একটা ডিজিটাল ক্লক। তাতে তারিখটাও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ২২ এপ্রিল, ২০৭৫!

অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর পরের ঘটনা। কিন্তু পারিজার ছোট্ট হাতে এত স্পষ্ট আঁকা হলো কীভাবে?

বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী তন্ময় কিবরিয়া খানিকটা আন্দাজ করলেন ব্যাপারটা। তার মানে তিনি এর আগেও টাইম ট্রাভেল করেছেন!

সোজাভাবে বলতে গেলে ভবিষ্যতের তন্ময় এসেছে বর্তমানের তন্ময়ের সঙ্গে দেখা করতে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে সতর্ক করতে এসেছে ভবিষ্যতের কোনও বিভীষিকার ব্যাপারে। তিলোত্তমা বলেছিলো ও যখন পারিজাকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখছিলো তখন মনে হচ্ছিলো মেয়েটা বাতাসে কান পেতে কী যেন শুনছিলো।

সেটা কি তন্ময়ের ভবিষ্যৎ সত্তা! কিন্তু সে সরাসরি তন্ময়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলো না কেন?

পরক্ষণেই মনে হলো ইন্টেন্স নেগেটিভ এনার্জির কথা। দুটো সত্তা কাছাকাছি থাকলে টাইমলাইনে বিরাট বিস্ফোরণ হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তন্ময় সময়ের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে।

পারিজার স্কেচপ্যাডের ড্রয়িংটা নির্দেশ করছে আগামী পাঁচ বছর পরের কোন ঘটনা। যেখানে তন্ময় আধা মানব আধা বৃক্ষে পরিণত হয়েছে।

নাকি এটা পারিজার ইন্টারনেটে দেখা কোনও অ্যানিমেশনের প্রতিফলন! নাকি বাবাকে নিছক কল্পনায় ভেবে এঁকেছে সে?

এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় রাফিদের ফোন এলো। রাফিদ ওর সহকারী বিজ্ঞানী। একই ফ্লোটিং ফ্ল্যাটে থাকে ওরা। এনার্জি ফিলড জোনে বেশ তৎপর।

এই ফ্লোটিং বিল্ডিং বা ভাসমান দালানকে ওর এনার্জি ফিল্ড থিওরীই ভাসিয়ে রেখেছে।

কারণ মাটি এখন দূষিত। দালানের সঙ্গে সরাসরি ভূমির সংযোগ থাকলে পুরো দালান দূষিত হবে। তাই ভূমি থেকে নিরাপদ দূরত্বে কম্প্রেসড ফোর্স দিয়ে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে বিল্ডিংটা। একটা বিশেষ উপায়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অর্থাৎ গ্রাভিটেশনাল ফোর্স কমিয়ে আনা হয়েছে।

ভূমিতে কয়েকশো একর জমিতে শুধু নিম্নবিত্ত মানুষের বসবাস। নিতান্তই ছা-পোষা তাদের জীবন। ভূমি দূষণে মৃত্যুহার সবচেয়ে এদের বেশি।

ওদের কোনও নির্দিষ্ট দেশ নেই। দেওয়ার মতন পরিচয়ও নেই। ওরা ইউনিনেশন এর বাসিন্দা। এটাই ওদের পরিচয়।

রাফিদ জানালো, কিছুক্ষণ আগে ওর এনার্জি রিসিভারে একটা আচমকা স্পার্ক হয়েছে। কিন্তু শব্দটা কেন জানি এই ডাইমেনশনের নয়। বাইরের কোনও ডাইমেনশনের। ওর ভয় হচ্ছে কোনও এলিয়েন ওর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে কিনা?

তন্ময় রাফিদকে তেমন কিছু না জানিয়ে শুধু জানালো সে ব্যাপারটা দেখবে।

এবার আর তন্ময়ের মনে কোন সন্দেহ রইলো না। ঐ আকস্মিক স্পার্ক সত্যিই অন্য ডাইমেনশন থেকে এসেছে।

ভবিষ্যৎ তন্ময়ের আগমনী বার্তা। সে কি এসেই আবার চলে গেছে? ২০৭০ এর পৃথিবীতে সে টিকে থাকার আশা রাখবে না নিশ্চয়।

রাতের দিকে আরো একটা খারাপ খবর এলো। খুব শিগগির দানা বেঁধে উঠবে যুদ্ধ। চীন ইকোনমি উইং এর দখল নিয়ে নেবে শিগগির। ওদের একটা বড় উদ্দেশ্য আছে। খাদ্যের অভাব মেটাতে এক বিকৃত সমাধান নিয়ে এসেছে ওরা।

পৃথিবীতে এখন মোট জনসংখ্যার হিসাব অনুযায়ী খাদ্য অপ্রতুল। কিন্তু তাই বলে চীনের সমাধান মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এই প্রথম ইকোনমি আর কমান্ডো উইং একসঙ্গে কাজ করছে। সত্যি বলতে গেলে ইকোনমিই চালাচ্ছে কমান্ডো উইং-কে।

চীন তৈরি করছে অদ্ভুত এমালগামেশন। এরা অনেক আগে থেকেই অখাদ্য সব প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে আসছে। তেলাপোকা, বাদুড়, সাপ, ব্যাঙ, শামুক সব ওদের পেটে গেছে। শুধু তাই নয়, যেসব প্রাণীকে তারা খেত তাদের মারতো খুব কষ্ট দিয়ে। ঠিকমতো মৃত্যু নিশ্চিত না করেই সরাসরি গরম তেলে ভেজে ফেলতো। অনেকসময় ডিশ সার্ভ করার পরেও দেখা যেতো কই জাতীয় মাছ তখনো জীবিত আছে।

ফলে প্রতি শতবর্ষ পরে একবার হলেও মহামারীর দেখা মিলতো। শুরুটা হত চীনে আর শেষ হত সারা বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ বধের মাধ্যমে। মূলত এইজন্যই চীন পরাশক্তির আধার দেশগুলোর সবার আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দুতে পড়েছিলো। গত একশো বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়েছে। চীনের জনশক্তি আর বুদ্ধিমত্তাকে ছাপিয়ে গিয়েছিলো অনেক দেশ। কিন্তু বায়ো-ওয়েপন বানানোর ক্ষেত্রে চীনাদের কেউ টপকাতে পেরেছে কি?

এবার ওরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে খাদ্য সমস্যার কিছু নিরসন করবে। কিন্তু পাশাপাশি আত্মহননের পথ পরিষ্কার করবে।

চীনাদের খাদ্য নিরসনের পদ্ধতিটা ঠিক এরকম,

প্রথমে ওরা প্রাণীদের বসবাসের জায়গা উজাড় করে ফেললো। তারপর প্রাণীদের খাদ্য সমস্যা দূর করতে তৈরি হলো ব্যাটারীচালিত প্রাণীর। যেন প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব হলেই ওদের মস্তিষ্ক ব্যাটারী থেকে শক্তি সংগ্রহ করে টিকে থাকতে পারে। মানুষ পারলে সব প্রাণীকে এমনিতেই খতম করে দিতে পারতো কিন্তু তাতে বাস্তুতন্ত্র অর্থাৎ ইকোসিস্টেমে ধ্বস নামবে বলে সম্ভব হয়নি।

এখন প্রাণীদের সংখ্যা খুব নগণ্য। বিড়াল প্রজাতির ফ্লাফিট্রন, কুকুর আর রোবটের সংকর ডগোট্রন, পাখির জাত বার্ডিট্রন সহ আরো পঞ্চাশটা প্রজাতির প্রাণীকে কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু প্রাণীকে ক্রিষ্টালে বন্দি করে রাখা হয়েছে মমির মতন। যাদের অর্ধেক শরীর মেটালে তৈরি।

জীবন্ত লাশের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ এরা।

শুধু পোকামাকড় বা কীটপতঙ্গের একটা বিশাল শ্রেণি এখনো দিব্যি বেঁচে আছে কোনওরকম জেনেটিক মিউটেশন ছাড়াই।

পঙ্গপাল বা ঘাসফড়িঙ জাতের পতঙ্গ একসময় মানুষের খাবার খেয়ে সাবাড় করে দিতো কিন্তু এবার চীনারা ঠিক করেছে পঙ্গপালকেই সবার খাবার বানাবে। বিশ্বের খাদ্যসমস্যা দূর করবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আবার রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে। আরো নতুন ধরণের মহামারী ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে। তাই এবার ওরা পরীক্ষা চালাবে সরাসরি মানুষের ওপর।

না, মানুষকে রোবটের সঙ্গে যুক্ত করবে না তারা। এমনকি কোনও প্রাণীর সঙ্গেও যুক্ত করবে না যেমনটা এককালে চেষ্টা করেছিলো, খানিকটা সফলও হয়েছিলো।

যেহেতু বেশিরভাগ সময় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হতো ইঁদুর বা গিনিপিগের ওপর, সেবারও তাই করা হয়েছিল। গর্ভাবস্থায় মানুষের জিনের সঙ্গে যুক্ত করা হলো রোডেন্ট বা ইঁদুরের মডিফায়েড জিন। জন্ম নিলো অতিদুর্বল ইঁদুরমুখো এক শিশু। সেই শিশু বড় হবার পর একদিন তার পরিবারের ওপর হামলা করে বসলো। প্রত্যেকের পেটে গভীর গর্ত।

মধ্যযুগে আসামীদের বর্বর শাস্তির বিধান ছিলো। আসামীকে বেঁধে শুইয়ে দিয়ে পেটের ওপর শস্য ছিটিয়ে দিয়ে তার ওপর ক্ষুধার্ত ইঁদুর ছেড়ে দেওয়া হত। ইঁদুরগুলো খাবার খেতে খেতে আসামির পেট চিঁড়ে ঢুকে পড়তো ভেতরে। তারপর নাড়ীভুঁড়ি চিবোতে থাকতো ওরা। ধীর অসহ্য মৃত্যু।

এই ইঁদুর মানবও তার পরিবারের সদস্যদের একই হাল করেছিলো। এরপর সম্ভবত ওকে নিউট্রালাইজ করে রেখে দেওয়া হয়েছে কোন গোপন ল্যাবে।

কাজেই মানুষের সঙ্গে কোন প্রাণীকে জুড়ে দেওয়া সম্ভব হলেও তার ক্ষতিকর দিক অনেক।

তাই চীনারা ঠিক করেছে এবার মানুষের সঙ্গে গাছের এমালগামেশন করবে। এবং সেই গাছ হবে নেপেন্থিস গোত্রের। সরাসরি বলতে গেলে নেপেন্থিস লার্ভায়ী গোত্রের। এই গাছগুলোকে বলা হয় পোকাখেকো গাছ। ইংরেজীতে এদের পিচার প্ল্যান্টও বলা হয়। কলসের মতন ফাঁদ পেতে এরা মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়।

সেই গন্ধে পোকামাকড় কলসে কিনারে এসে বসে। আর সঙ্গে সঙ্গে কলসের ওপরের ঢাকনার মতন অংশটা বন্ধ হয়ে যায়। তখুনি কলসের ভেতরে এনজাইম জমতে জমতে পোকাটাকে ডুবিয়ে দেয় আর পোকাটা ধীরে ধীরে হজম হয়ে মিশে যেতে থাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর ঢাকনাটা আবার উন্মুক্ত হয়ে যায় নতুন শিকারের অপেক্ষায়।

ইকোনমি উইং দাবী করছে আগামী পাঁচবছরের মধ্যে তীব্র খাদ্যসঙ্কট আর দুর্ভিক্ষ তৈরি হবে। তখন প্রোটিনের উৎসের জন্য পোকামাকড় বা রোডেন্ট খাওয়া ছাড়া কোন গতি থাকবে না নিশ্চয়ই। ইতিমধ্যে পঙ্গপাল ধরার জন্য বড় জালের ব্যবস্থা করার জন্য তারা সায়েন্টিস্ট উইং এর মতামত জানতে চেয়েছে।

তন্ময়কে করেছে টিমের প্রধান।

তন্ময় আপত্তি করে বলেছিলো প্রোটিন ছাড়াও মানুষ বাঁচে কিন্তু কেউ তার কথা কানেই তোলেনি।

তন্ময়ের মনে হতে থাকে পুরাতন আমলের একজন বিজ্ঞানী এলিস সিলভারের কথা। তিনি বলেছিলেন,

“মানুষ আজীবন ভেবে এসেছে ভীনগ্রহবাসী বা এলিয়েনের কথা। তারা হুট করে পৃথিবী আক্রমণ করে বসলে কী হবে সে কথা। কিন্তু এমনও তো হতে পারে আসলে পৃথিবীতে মানুষই ভীনগ্রহবাসী৷ যখন উল্কাপিণ্ড এসে পৃথিবীকে আঘাত হানে তখন বিলুপ্ত হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থলজ প্রাণী ডায়নোসর। মানুষ তো তার আগে থেকেই আছে। কিন্তু একমাত্র মানুষকেই পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম করতে হয়। অন্যান্য প্রাণীদের মতন রোদ, বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না তাদের চামড়া। প্রকৃতি থেকে খাবার সংগ্রহ করাটাও মানুষের জন্য অত্যন্ত ঝামেলার। মনে হয় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনও গ্রহ থেকে আশ্রয়প্রার্থী মানুষ পৃথিবীকে ধীরে ধীরে দখল করে পৃথিবীর আদি বাসিন্দাদের ওপরই খবরদারি করে চলেছে।

এখন তারা নিজেরা বাঁচার জন্য গাছের সাহায্য নেবে। জেনে রাখা ভালো গাছের শরীরে কোনও নার্ভ নেই, নেই কোনও নার্ভাস সিস্টেম বা মস্তিষ্ক। তাছাড়া কোনও পেইন রিসেপ্টরও নেই এদের ত্বকে। ফলে গাছ অন্যান্য প্রাণীর মতন ব্যথা পায় না।

যদি নেপেন্থিস গাছের সঙ্গে এমালগামেশন সফল হয় তাহলে মানুষের মধ্যেও এই গুণ আসার সম্ভাবনা আছে। কমান্ডো উইং ভাবছে এতে যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধা হবে। কোনওরকম ব্যথা থাকবে না শরীরে।

তন্ময় মনেমনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। মাথামোটা কমান্ডোরা এটা বুঝতেই পারছে না মাংসাশী গাছ শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত করাটা কতটা ক্ষতিকর হতে পারে। এরা ভাবে একসময় যুদ্ধ দিয়েই যুদ্ধ শেষ হবে। অথচ প্লেটো বলে গিয়েছিলো “একমাত্র মৃতরাই যুদ্ধের শেষ দেখেছে, কখনো জীবিতরা নয়।”

তন্ময় বুঝতে পারলো যে ওর ওপর আপাতত পুরো বিশ্বের ভালো থাকা দায়ী। ও ভাবছে টাইম মেশিনে কি সত্যিই ভবিষ্যৎটা দেখে আসবে। আসলে টিকে থাকার লোভে লোভী মানুষগুলো কতটা বোকামি করতে পারে! আর তন্ময়ের ভবিষ্যত সত্তার ঐ বীভৎস শরীর কি এই পরীক্ষার সফলতার নিদর্শন?

তারমানে তন্ময়কেও কি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে? কিন্তু সে ইচ্ছা তো তার নেই। সত্যি বলতে নিজের একটা পা যেদিন থেকে হারিয়েছে সেদিন থেকেই ও বুঝেছে নকল কিছু দিয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকার চেষ্টা করাটাই বোকামী। পৃথিবী আর কদিন পর এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে। সৃষ্টিকর্তা মানুষের বসবাস করার মতন আর কোন গ্রহ তৈরী করেছেন কি না জানা নেই। নিজেকে মডিফাই করে বাঁচার মধ্যে কোনও আনন্দ থাকতে পারে না৷ অন্তত যার মধ্যে স্বাভাবিক আবেগটুকু আছে তার নয়। এ যেন একশো বছরের বৃদ্ধের বেঁচে থাকার মতন। অথর্ব, মৃত্যুর জন্য সদা অপেক্ষমান মন।

তন্ময় ঠিক করেছে ও ভবিষ্যতে যাবে। মানবের সঙ্গে নেপেন্থিসের সংযোগের পেছনে যে চৈনিক বিজ্ঞানী আছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে কাজ শেষ করার ঠিক আগমুহূর্তে থামাতে হবে। বর্তমানে সেটা সম্ভব না। কারণ ইকোনমি বা কমান্ডো উইং এখন জেনে গেলে থামিয়ে দেবে তন্ময়কে৷ মেরেও ফেলতে পারে।

তন্ময় ঠিক করলো সে ভবিষ্যতে যাবে এবং সেটা এখনি। তবে সুদূর নয়, অদূর ভবিষ্যতে। অর্থাৎ ২০৭৫ এর বদলে ২০৭৩ সাল। মানব শরীর ও উদ্ভিদের মেলবন্ধনের এই প্রজেক্টের নাম দেয়া হয়েছিলো, “প্রজেক্ট পিচার-ম্যান”।

যার মেয়াদ তিন বছর। তার মানে ২০৭৩ এর মধ্যে এই অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্ট প্রথমে চালানো হবে টেস্ট সাবজেক্টের ওপর। তারপর ধীরে ধীরে সবার ওপর। মানুষকে বহু কায়দায় সেমি-রোবট হতে দেখেছে তন্ময়। কিন্তু আর না। সে চায় বাকি জীবনটা মানুষ মানবের মতন জীবনযাপন করুক।

একদম স্বাভাবিক জীবন।

টাইম মেশিনে সময় ও গন্তব্যের কমান্ড ইনপুট করে তন্ময় প্রস্তুত হলো। হলোগ্রাফিক আলো ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে। ও অনন্ত যাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে! কিন্তু কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে নিশ্চয়ই। মনে হলো ওর সামনে একটা অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে স্কেচপ্যাডে কিছু একটা লিখছে একজন সাদা এপ্রোন পরিহিত বিজ্ঞানী। চেহারায় চৈনিক ভাব প্রবল। বুকের কাছে নেমপ্লেটে লেখা লি. উই, এমব্রায়োলজিস্ট।

তন্ময় এগিয়ে গেলো ওনার কাছে। উনি একদমই টের পেলেন না। লেখা চলতে থাকলো। লেখা শেষ হলো মিনিট পাঁচেক পর। লোকটার চোখে জল। হাতে একটা রিভলবার। কিছু বোঝার আগেই সেটা মাথায় ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে দিলেন তিনি। মগজ আর মাংসের দলা পাকিয়ে ছিটকে পড়লো মেঝেতে। রক্তে ধুয়ে গেলো আশপাশ। তন্ময়ের কিছু করার নেই। কারণ ও নিজের অস্তিত্ব আন্দাজ করতে পারছে না।

ওর চোখ চলে গেলো স্কেচপ্যাডের দিকে। সেখানে লেখা।

“দুটো ভ্রুণের ওপর পরীক্ষা চালিয়েছি আমরা। আমি আর সায়েন্টিস্ট উইং এর প্রতিভাবান বিজ্ঞানী তন্ময় কিবরিয়া।

নেপেন্থিস উদ্ভিদের সঙ্গে মানব ভ্রুণের এই সংযোগ নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব আবিষ্কার। এমনকী শুধু ভ্রুণ নয়। যেকোনও বয়সী মানুষের সঙ্গে নেপেন্থিসের সংযোগ ঘটানো সম্ভব এখন। শুধু একটা সিরাম ইনজেক্ট করতে হবে শরীরে। এখন মানুষের খাদ্যাভাব হলে তারা পঙ্গপাল বা ইতরশ্রেণীর প্রাণীকে অনায়াসে খেয়ে প্রোটিনের অভাব মেটাতে পারবে। অথচ মহামারীর কোনও ভয় থাকবে না।

মানুষের কাছে পোকামাকড় খাওয়াটা জঘন্য একটা ব্যাপার, কিন্তু যেভাবে খাদ্যের অভাব দেখা দিতে শুরু করেছে তাতে কদিন পর না খেয়ে মরতে হবে। অন্তত না খেয়ে মরার চাইতে পোকামাকড় ভালো। আমি নিজে চীনা বিজ্ঞানী, আজেবাজে জিনিস চেখে দেখার লোভ আমাদের বহুকাল আগের। প্রজেক্ট পিচারম্যানের অংশ হতে পেরে আমারও ভালো লাগছে।

কিন্তু এর পেছনে যে কী ভয়াবহ উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে সেটা আজ জেনেছি। সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার মহা ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

সব খাবার শেষ হবার আগেই কৃত্রিম খাদ্যসঙ্কট তৈরি করে তাদেরকে পিচারম্যান প্রজেক্টের অংশ বানানো হবে। তারা যেন পোকামাকড় ধরে খেতে পারে।

কিন্তু তারপরেই ঘটবে আসল ঘটনা। যখন এই মানুষগুলো ঘুমিয়ে থাকবে তখন জাগ্রত হবে নেপেন্থিস উদ্ভিদ! তারপর এনজাইম ছড়িয়ে দেবে শিরা উপশিরায়। শরীরের ভেতর থেকেই হজম হতে থাকবে শরীর। মহামারীর মতই, কিন্তু মহামারী নয়৷ মানুষ মরলে যার শরীর, দায় শুধু তার ওপরেই থাকবে। কেউ জানবেও না ভেতরে ভেতরে এতবড় জঘন্য রাজনীতি হয়েছে। কারণ একসময় এদের লাশও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

শুধু টিকে থাকবে এলিট বা তথাকথিত উচ্চবিত্ত একটা শ্রেণী। তারা মজুতকৃত খাবার নিয়ে আরো অনেকদিন বাঁচবে। টিকে থাকার লোভ তো শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু আমি এটা হতে দেবো না। আমি পিচারম্যান প্রজেক্টের ফর্মুলা কোথাও কোনও জার্নালে লিখিনি। পুরোটা ছিলো আমার মস্তিষ্কে। কাজেই আমার মস্তিষ্ক শেষ হয়ে গেলেই আর এই প্রজেক্ট চলবে না। বিজ্ঞানী তন্ময়কে তার নিজের তৈরী টাইম মেশিনে করে পাঠিয়ে দিয়েছি অতীতে। তার সঙ্গেও একটা রিভলবার আছে। কোনও ঝামেলা হলে সেও বলির পাঁঠা হবে স্বেচ্ছায়। কারণ আমি ছাড়া শুধুমাত্র ঐ একজন ব্যক্তিই জানে পুরো পিচারম্যান প্রজেক্টের সম্পূর্ণ ফর্মুলা!”

তন্ময় সবটা পড়ে পাগলের মতন হয়ে গেলো। যদি এইমাত্র ২০৭৩ সালের তন্ময় ২০৭০ সালে চলে যায় তাহলে টাইম ডাইলেশনের ফলে কেউই আর নিজের আসল অবস্থায় ফিরতে পারবে না। সবাই যাত্রী হবে অনন্তকালের! যার কোনও শেষ নেই! একটা অসীম চক্রে পড়ে একই পথে ঘুরতে থাকবে সবাই!

(আবার শুরু থেকে পড়ুন)