ইরাটোম্যানিয়া কিংবা স্মৃতি-খোঁড়ার গান - জুবায়ের রুমেল

গল্প

“...তারপর বলেন কী সমস্যা আপনার?” মৃদু হাসির সঙ্গে এক পেশাদারী কাঠিন্য ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে প্রৌঢ় ভদ্রলোকের ঠোঁটে। ঢাউশ সাইজের এক্সিকিউটিভ টেবিলটার পাশে বেমানান চেয়ারটায় বসা যুবকটা এবার ভাল করে তাকাল প্রশ্নকর্তার দিকে। এতক্ষণ তার চোখ ঘুরছিল ঘরময়। হাসিতে অবজ্ঞা না অভয় মিশে আছে বুঝতে পারল না। সে যে পেশায় আছে সেখানে হুট করে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ, চেয়ারটা টেনে আরেকটু কাছে নিল যুবক।

‘‘স্যার, আসলে কীভাবে যে বলি...”

“এই শাহানা...। চার নাম্বার প্যাশেন্টকে যে ‘অ্যাডাপেন’ লেখতে বলেছিলাম, লেখছেন?” যুবকের কথার মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে টেবিলের উল্টোদিকে দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকা সুন্দরী অ্যাসিস্ট্যান্টকে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

“স্যার, লেখতেছি। শেষ হলে আপনাকে দেখিয়ে নেব।” বলে উঠল সুন্দরী অ্যাসিস্ট্যান্ট।

“হুম, বলেন।” ডাক্তার ভদ্রলোক যেন এবার কিছুটা ফুসরৎ পেলেন সামনে বসা রোগীর দিকে তাকাবার।

‘‘স্যার, আমি প্রেমে পড়েছি। মানে একজনকে আমি খুব ভালবাসি, খুব পছন্দ করি...”

“প্রেমে পড়েছেন, এইটা তো ভালো কথা। এই নষ্ট সময়ে প্রেমে পড়ার সৌভাগ্য হয় কয়জনের! আর আপনার বয়সটা তো দেখি প্রেমে পড়ারই বয়স। এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই ইয়াংম্যান।” গোটা গোটা অক্ষরে প্যাডে নাম আর বয়স লিখতে শুরু করলেন ডাক্তার। অ্যাসিস্ট্যান্ট আগেই স্লিপ রেখে গেছে। অদ্ভুত এক প্যাঁচানো টানে সুন্দর করে আরএক্স লিখে আবার তাকাল যুবকের দিকে। কিছুটা মুগ্ধতা আর কিছুটা বিহ্বলতা নিয়ে প্যাডের লেখাটার দিকে তাকিয়ে আছে যুবক রোগী। ডাক্তারের কাছে এলেই তার জিজ্ঞেস করতে মন চায়—এই আরএক্স দিয়ে কী বোঝানো হয়। সংকোচ ভেঙ্গে কখনো আর জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠে না।

“স্যার, প্রতিদিন রাতেই স্বপ্ন দেখি। সে আসে ধীরে, প্রেম ও প্রত্যাশার সঙ্গে জড়িয়ে ধরে, গভীর আদরে বুকে টেনে নেয়...” যুবক শেষ করতে পারে না মুখের কথাটা, আবার বিঘ্ন ঘটে।

“তিন নাম্বার প্যাশেন্টকে সাত দিনের ‘প্রোজেক’ দিতে বলেছিলেন, স্যার। আগেরবার রোগীর নাকি এটাতে সমস্যা হইছে।” সুন্দরীর পেছনে বসা আর এক অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাক্তারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

“তাহলে ওটা চেঞ্জ করে ‘লেক্সাপ্রো’ দাও। আর কবে শিখবা তুমি, মোতালেব? কোনটার পরিবর্তে কোনটা দিবা এটা নিয়ে অনেকবার বলেছি তোমাকে। গ্যাসট্রিকের ওষুধ দিয়েছো? এদেশের সবাই এক একটা গ্যাসবোমা। ওটা লিখে দাও।”

মোতালেব নামের অ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে চকিতে বিরক্তির একটা ভ্রুকুটি দিয়ে যুবক আবার মনোযোগ দিল ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার সাহেব ততক্ষণে প্রেসক্রিপশন লিখতে শুরু করেছেন। গলা খাঁকারি দিল যুবক, “ইদানীং স্যার, ঘন ঘন স্বপ্নটা দেখছি। প্রচণ্ড পানির পিপাসা পায় তারপর...”

প্রেসক্রিপশন থেকে মাথা তুললেন ডাক্তার ভদ্রলোক, “ইয়াংম্যান, প্রেমে পড়া, বারবার প্রেমিকাকে স্বপ্নে দেখা—এসব কোনও সমস্যা না। এই বয়সে হরমোন ঘটিত একটু আধটু ইমব্যালেন্স হয়। ওসব কিচ্ছু না। ওষুধ লিখে দিচ্ছি, এক সপ্তাহ খাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।” আরও কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মাথা নিচু করে প্রেসক্রিপশনে মনোনিবেশ করলেন এখনও পর্যন্ত নিম্ন মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে থাকা ডাক্তার মুহিত মেহতাব। “এই শাহানা, প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে যাও, ডিটেইলস ইয়াংম্যানকে বুঝিয়ে দাও।”

এর মাঝেই টেবিলের ফোনটা বেজে উঠল। “না, না, এইটা সরকার আরও কম দামে আনতে পারে ভারত থেকে। কে শুনে কার কথা। গতকাল কথা হয়েছে আমাদের হারুনের সঙ্গে। আরে ওই যে আমাদের ব্যাচের হারুন, এখন তো ও স্বাস্থ্যসচিব। দেখি, আরেকবার বলে দেখবো।” ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ডাক্তার।

“নিজাম সাহেব এদিকে আসেন।” স্যারের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন এনে লেখা শুরু করেছে সুন্দরী অ্যাসিস্ট্যান্ট শাহানা ম্যাডাম। নিজাম মানে আমাদের যুবক রোগী এসে বসল শাহানা ম্যাডামের সামনে।

খানিক বাদে ক্লিনিক থেকে বের হয়ে এল নিজাম। মুখটা থমথমে, মেজাজ খিঁচড়ে আছে। কী ভেবে এসেছিল, গিয়ে কী দেখল। ডাক্তারের রোগীর সঙ্গে দু'দণ্ড কথা বলার সময় নেই। ছ’জন অ্যাসিস্ট্যান্ট বসিয়ে রেখেছে, ওরাই সামলাচ্ছে সব। কোনও কথাই ঠিকমত বলতে পারল না, তার আগেই প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ। টাকাগুলো জলে গেল এমন একটা অনুভূতি নিয়ে রাস্তায় নেমে এল। রিকশা খুঁজছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। রাতে ডিউটি আছে। রিকশায় বসে ভাবতে লাগল ডাক্তারের কথা। অবশ্য পরক্ষণে মনে হল এইটাইবা কম কী। এই ২০৭৫ সালে এসে একজন ডাক্তারের মুখোমুখি বসে কথা বলতে পারাই তো পরম সৌভাগ্য, যখন উচ্চবিত্তের ঘরে ঘরে চলে এসেছে নানা মূল্যের, নানা মডেলের ব্যক্তিগত মেডিকএইড। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল গলা চিরে। ধনী আর গরীবের বৈষম্য কখনো কমে না। ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর আর নির্মম সত্য।

***

“এ্যাই নিজাম? নিজাআআম? এ্যাই নিজাম? নিজাইম্মাআআআ...?” গলির মোড়ে মুদি দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুরুজ মিয়া। নিজামকে আসতে দেখেই চিৎকার করে উঠল বুড়ো। লেংটাকাল থেকে দেখে আসছে তাকে। কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই নিজামের। অস্থির হয়ে আছে মনটা। ডাক্তারের কাছ থেকে আসার সময় তার স্বপ্নের রাজকন্যাকে দেখেছে আজ। কাছে গিয়ে কথা বলতে পারেনি। প্রচণ্ড অভিমান জমে আছে গলায়। গোপনে ম্যাসেজ করে, সাংকেতিক ভাষায় এখানে ওখানে তার সম্পর্কে কথা বলে, বোঝাতে চায় তাকে অনেক ভালবাসে। কিন্তু সামনে দেখা হলে চিনেও না চেনার ভান করে। না, এমনটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এই বিরহ আর নেওয়া যাচ্ছে না। যে করেই হোক, দেখা করতে হবে; ভালবাসার কথা বলতে হবে।

অন্য সময় হলে সুরুজ মিয়ার সঙ্গে খুনসুটি করত। হয়ত রিকশা থামিয়ে এক কাপ চায়ের সঙ্গে জমিয়ে একটা জম্পেশ আড্ডাও দিয়ে ফেলত। কিন্তু আজকের অবস্থা ভিন্ন। আকাশের মতো অন্ধকার মুখে রিকশাওয়ালাকে জোরে প্যাডেল মারতে বলল। জায়গাটা দ্রুত পার হলেই যেন বাঁচে। রিকশা থেকে নেমে দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে ঢুকে গেল পাঁচতলা দালানটায়। সময়ের আবর্তনে এটা এখন ঝুপড়ি বস্তি। আশে পাশে পঞ্চাশ আর একশ তলা দালানের মাঝে নিতান্ত অসহায় একটা অবয়ব। এমন একটা পশ এলাকায় এমন ঝুপড়ি দালান বড্ড বেমানানও বটে।

রাত প্রায় একটা। সময়ের হিসাবে সকালের শুরু। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আশেপাশের কোনও বাড়ি থেকে ভেসে আসছে হারানো দিনের গান। উকিল মুন্সীর ভরা-বিচ্ছেদের অপার্থিব এক সুর...

...সোনা বন্ধুয়ারে

এত দুঃখ দিলি তুই আমারে

তোর কারণে লোকের নিন্দন,

করেছি অঙ্গের বসনরে।

কুমারিয়ার ঘটিবাটি,

কুমার করে পরিপাটি,

মাটি দিয়া লেপ দেয় উপরে।

ভিতরে আগুন দিয়া কুমার থাকে লুকাইয়া,

তেমনি দশা করলি তুই আমারে...

সুরের মাকড়সা যেন এক অদৃশ্য মায়াজালে বেঁধে ফেলতে চাইছে সমস্ত চরাচরকে। সকল অশুভ আর অশরীরী আত্মাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে প্রেমিক হৃদয়ে উথাল পাতাল ঢেউয়ের তুফান তুলতে চাইছে।

উত্তরায় এই পঁচাত্তর নম্বর সেক্টরটা নতুন হয়েছে। সর্বাধুনিক নাগরিক সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠা পশ এলাকাটা নামী দামী সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে সরকারের উপর মহলের এমপি, মন্ত্রী, আমলা আর ব্যবসায়ী রাঘব বোয়ালদের আবাস। এলাকায় টহল দেয় সার্ভিলেন্স ড্রোন, যা ঢাকার অন্য এলাকায় এখনো অকল্পনীয়।

এই এলাকার সবচেয়ে নতুন বিল্ডিংটার নাম ‘আকাশবাড়ি’। একশ তলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। একেবারে টপ ফ্লোরে থাকে এসময়ের হার্টথ্রব নায়িকা জারা আলি। গুণী এই অভিনেত্রী একাধারে যেমন নাচে-গানে পারদর্শী, তেমনি একজন সফল আন্তর্জাতিক মডেল। বাজারে জোর গুজব সে একাই ‘বি-পপ’ কালচারকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছে, দুনিয়াজোড়া এন্টারটেইনমেন্টের জগতে যার এখন আকাশচুম্বী চাহিদা। অবশ্য জারা আলি বেশ ক'বছর হল খ্যাতির মধ্যগগনে থাকতেই নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যুক্ত হয়েছে নানান জনহিতকর কাজকর্মে। চালু করেছে নিজের ফাউন্ডেশন, কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ তার এই ফাউন্ডেশনের উপকারভোগী। বিভিন্ন বক্তৃতা, সেমিনার আর আলাপচারিতায় জানিয়েছে কোটি কোটি মানুষের ভালবাসায় আপ্লুত হবার কথা।

নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে জারা, বৃষ্টির ফোঁটা টোকা দিচ্ছে কাচের জানালায়। আস্তে আস্তে তোড় বাড়ছে, সেই সঙ্গে অপার্থিব সুরে বেজে চলা গানটাও কেমন যেন আনমনা করে তুলছে। নিজে পপ জগতের রাণী হয়েও এই গানটা তার সবচেয়ে ভাল লাগে। অবশ্য গানটার সঙ্গে তার একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। গীতিকার, সুরকার আর গায়ক একই ব্যক্তি, তার উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ। অঝোর ধারার সঙ্গে সঙ্গে আবেগের ব্যারোমিটারটাও উঠানামা শুরু করেছে। রুমের লাইটিংটাও বারে বারে চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। এই হালকা বেগুনী তো এই হালকা নীল আবার পরক্ষণেই হালকা গোলাপী, মানসিক প্রশান্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে।

অ্যাপার্টমেন্টে ব্যবহার করা হয়েছে হালের স্মার্ট ফোন কেন্দ্রিক ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ প্রযুক্তি। বাড়িতে পুরোনো হয়ে যাওয়া ‘ওয়াই-ফাই’ প্রযুক্তির বদলে নতুন ‘লাই-ফাই’ প্রযুক্তি ব্যবহারের আইডিয়াটাও তার মাথা থেকেই বেরিয়েছে। স্বামীপ্রবর টেকবিজনেস টাইকুন হওয়ার সুবিধাটা মাঝে মাঝে ভালই কাজ দেয়। দেশে অ্যাভেইলেবল হওয়ার আগেই নিজে চেখে দেখার মজাই আলাদা; এক অন্যরকম আভিজাত্য, বিষয়টা খানিকটা উপভোগই করে সে। এই যেমন এই অ্যাপার্টমেন্টটা। দরজা বন্ধ হলে আপনাআপনি নিভে যায় ঘরের লাইট; রান্নাঘরে গেলে হোম সিস্টেম নিজেই মনের কথা পড়ে ফেলে, পরিবেশন করে সুস্বাদু কোনও রেসিপি, চা কিংবা কফি; সদর দরজায় কেউ কড়া নাড়লে বুঝে যায় কী করতে হবে—স্বয়ংক্রিয় আর সর্বেসর্বা এক অপারেটিং সিস্টেম।

কিন্তু আজ রুমের অত্যাধুনিক এই সব প্রযুক্তিও ঠিক পেরে উঠছে না তার মনের সঙ্গে। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র, বড়ই অদ্ভুত। প্রযুক্তির সাধ্য কী তাকে বশ মানায়।

উঠে বসল জারা, বৃষ্টিতে ভিজতে মন চাইছে। আহত হরিণীর মতো অজানা কারণে জল জমে উঠেছে চোখের কোণে। বিষাদের বিষে নীল হয়ে আছে সব। এক মন চাইছে স্রষ্টার এই রহমতের ফোঁটায় ভিজতে ভিজতে পবিত্র হয়ে যেতে, সুখী হয়ে যেতে, নতুন করে সব শুরু করতে। আবার অন্য মন বলছে, কী লাভ! চল হারিয়ে যাই অজানায়, অনেক তো হলো। আর কত! ভিতর বলে বাহির, বাহির বলে ভিতর।

***

ফোঁপানোর গমকটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। বৃষ্টির একটানা রিমঝিমের মাঝে বড় সকরুণ সে সুর। টেরেসের একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে আছে জারা। বৃষ্টির ফোঁটা যেন তীক্ষ্ণ সূঁচের মতো এসে বিঁধছে শরীরে। নিচে তাকলো, রাত জাগা শহরটা তার চেয়েও উজ্জ্বল আলোয় ঝিলমিল করে যেন হাতছানি দিচ্ছে।

মানুষ কত নিঃসঙ্গ! খ্যাতি, লোভ-লালসা, মোহ আর ঐশ্বর্যের এক মায়াজালে আটকে থাকে সারাটা দিন। রাতের তারায় নেমে আসে এক অদ্ভুত শূন্যতা। এক অদ্ভুত আঁধার।

নিজের জীবন সংগ্রামের কথা মনে পড়ে গেল। ছয় বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে পা রেখেছিল রুপোলী জগতে, ভর্তি হয়েছিল দেশের সবচেয়ে দামী বি-পপ একাডেমিতে। কঠোর অধ্যবসায় আর নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন শেষে খুলে গেল নতুন দুনিয়া। হয়ে উঠল এক রাজেশ্বরী। যশ, খ্যাতি একে একে এসে ধরা দিতে লাগল পদতলে। কিন্তু নিয়তির অদ্ভুত খেল, সুখ নামের সোনার হরিণটা ধরতে ধরতেও নাগাল পায়নি।

লম্বা করে শ্বাস নিল, আর্দ্র হয়ে উঠেছে হৃদয়। অপরূপ মমতায় পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা। টেরেসের মৃদু আলোয় উপভোগ করছে প্রকৃতির এই লাস্যময় আচরণ।

হঠাৎই বিনা নোটিশে ছন্দপতন। পুরো এলাকা জুড়ে টোটাল ব্ল্যাক আউট। চোখে বিরক্তির ছাপ। চিন্তার সূত্রটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, খেই হারিয়ে ফেলল। এ এক নতুন উপদ্রব, গত পাঁচ মাসে এই নিয়ে তিনবার হল এমন। লোকাল মিউনিসিপ্যালিটি আর পুলিশকে জানানো হলেও এখনো পর্যন্ত কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। না, এটা মানা যায় না। কিছু একটা করতে হবে।

চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির ওম নিচ্ছে, হাবিজাবি ভাবছে। এতই আনমনা, টেরই পেল না কখন এক নিঃশব্দ আততায়ী এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। বিষাদমাখা মুখে ক্রুর হাসির ঝিলিক, এ যেন এক ম্যানিয়াক।

বুঝে উঠার আগেই টের পেল শূন্যে ভাসছে। মুখ থেকে বেরিয়ে এল গগনবিদারী চিৎকার। এই একশতলা কংক্রিটের জঙ্গলে কে শোনে কার কথা, নিষ্ফল চিৎকার মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল বাতাসের গর্তে। আতঙ্ক এসে ভর করল, যুক্তিহীন এক ভয়। মায়ের মুখটা ভেসে উঠল, মনে পড়ল প্রিয় সব মুখ। নিজের অজান্তে বন্ধ হয়ে এল চোখ। আলো-আঁধারের এক তীব্র ঝলকানি। তারপর শুধুই এক মহাজাগতিক অন্ধকার। একসময় বৃষ্টির ফোঁটার মতো মিলিয়ে গেল নিচে ঝিলমিল করতে থাকা শহরের পানে। মৃত্যুর অতল গহ্বরে।

মধ্যবয়স্ক কিন্তু সুঠামদেহী এক লোক এসে হন্ডা থেকে নামল ঘটনাস্থলের সামনে। রাগে গজ গজ করতে করতে সামনে এগোল, হাতে জারভিস-এক্সআরএ মডেলের একটা হেলমেট। ভদ্রলোক রাশেদ হাসান। ‘সেলিব্রেটি ক্রাইম ইউনিট’ এর প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা, অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ। ‘সাইবার ক্রাইম ইউনিট’ এর দায়িত্বও তার হাতে।

“এই মাঝরাতে এমন একটা বুলশিট-এর জন্য বিছানা থেকে তুলে এনেছ?” বিরক্তিকর জিজ্ঞাসা চোখেমুখে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে হয়েছে। কাল রাতের ব্ল্যাক আউটের কারণ খুঁজে দেখতে বলা হয়েছে। এই জন্য মেজাজটা আরও বেশি খিঁচড়ে আছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কাজ, বলে কিনা আমায় করতে হবে!

লাশটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল নিজাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর। এই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। রাশেদের গলার আওয়াজ শুনে দৌড়ে গেল তার দিকে।

“লাশটা প্রথম কে দেখেছে?” পেশাদার গাম্ভীর্য চোখেমুখে।

“আমি, স্যার।” কাঁচুমাচু মুখে বলল নিজাম। থমথমে চেহারা। তড়িঘড়ি ঘুম থেকে উঠে আসার ছাপ স্পষ্ট। এই এলাকাতেই তার বাড়ি।

“কী কী মেজার নিয়েছ? স্পর্শকাতর বিষয় বুঝতেই পারছ।” ভিতরের বিরক্তিটা চেপে রেখেছে অনেক কষ্টে।

“এত উপর থেকে পড়েছে, চেহারা দেখে লাশ শনাক্ত করার কোনও উপায় ছিল না। ডিএনএ অ্যানালিসিসের জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে যা হয়, খানিকটা সময় লাগবে ওই রিপোর্ট পেতে। এর মাঝে ফরেনসিক টিম লাশ থেকে তার ব্যবহৃত ‘মেমোরেট’ টা বের করেছে।” কিছুটা আনমনা নিজাম।

“কী করেছ ওটা?” অধৈর্য্য রাশেদ।

“স্যার, মানে...। না...মানে...।”

“আরে কী এমন মানে মানে করছ? ঝেড়ে কাশ।”

“না, স্যার মানে...। আমি লাশের মেমোরি অ্যাকসেস করে দেখেছি। নিহত মহিলা বিখ্যাত অভিনেত্রী, মডেল ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব জারা আলি।” এক শ্বাসে শেষ করে থামল নিজাম। ভয়ে আছে স্যার কী বলে উঠে, অনুমতি ছাড়া মেমোরেট ডিকোড করার জন্য।

“দেখি দাও ওটা। ওদিকটা সামলাও।”

একটু পর।

“শুনো সবাই।” জোরে হাঁক দিল এএসপি রাশেদ। পুরো টিম একসঙ্গে জড় হলো।

“উপরের মহল থেকে কেসটা সমাধানের যথেষ্ট চাপ আসবে আমার উপর। বড় মাপের সেলিব্রেটি কোনও সন্দেহ নাই। খানিক বাদেই হামলে পড়বে শকুনের দল। হিংস্র জানোয়ার এক একটা সাংবাদিক। টিভি, প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বড় বড় দালালরা আসবে, টক শোতে ঝড় বয়ে যাবে। ফেসবুক, টুইটারে ফ্যানবয়রা ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু ঘটনাটা আমার কাছে এত জটিল মনে হচ্ছে না। মেমোরিটা আমিও দেখলাম, যদিও এটা কেবলই একটা প্রাথমিক অবজার্ভেশন। অভিজ্ঞতা বলছে নিশ্চিত আত্মহত্যা। আমাদেরকে শুধু নিয়ম মেনে কাজটা করে যেতে হবে।” এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল এএসপি রাশেদ।

হাঁফ ছাড়ল নিজাম, স্যার বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি।

“সেলিব্রেটি আর সাধারণ মানুষের মাঝে আমি কোনও তফাৎ দেখি না। আগেও এমন সেলিব্রেটি কেস আমরা সামলেছি, আর এটা তো স্রেফ একটা আত্মহত্যা। আত্মহত্যাকারীর প্রতি আমার কোনও মায়া নাই। সস্তা সেলিব্রেটির কোনও কদরও নাই আমার কাছে। যার যার কাজটা সবাই ঠিকভাবে করো তাহলেই হবে। যাও সবাই কাজে লেগে পড়ো। ক্রাইম সিন যেন নষ্ট না হয়!”

“না স্যার। আমি আপনার সঙ্গে একমত না। এটা খুন। পরিকল্পিত খুন।” মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে সাধ্যমতো। সবাই কাজে চলে গেলেও নিজাম রয়ে গিয়েছিল।

ভ্রু কুঁচকে তাকাল রাশেদ। প্রচণ্ড বিরক্ত। “নিজাম, থামো। আমি জানি, জারা আলির পাঁড় ভক্ত তুমি। ফেসবুকে তার সবচেয়ে বড় ফ্যানপেজের একজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটরও। কিন্তু পেশাদারিত্ব সবার আগে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করো, সাম্প্রতিক কয়েক বছরের রিক্রুটদের মধ্যে তোমার উপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করি আমি। প্রযুক্তির উপর তোমার দখল সবসময়ই বিভিন্ন তদন্তে ভাল কাজ দিয়েছে। তোমার উপর আস্থা আছে আমার। মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে তুমি অনেকদূর যাবে। যাও, এখন কাজ করো।” অভিভাবক সুলভ একটা চাহনি এএসপি রাশেদের চোখে, প্রশ্রয়ের হাসি ঠোঁটের কোণে।

তুখোড় মাথাওয়ালা পুলিশ অফিসার এএসপি রাশেদ হাসান। সব সহকর্মীর পছন্দের মানুষ। এটা একটা দুর্লভ গুণ। এক অফিসে সবার ভালবাসা পাওয়া চাট্টিখানি কথা না, তাও আবার আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর মতো এমন কঠোর, কঠিন একটা সংস্থায়। স্টেরিওটাইপ পুলিশ অফিসার- মদ্যপ, বাতের ব্যথায় ভোগে, পারিবারিক কলহের জেরে অশান্তিতে আছে, এমন নয় মোটেও। চৌকষ আর দক্ষ অফিসার বলতে যা বোঝায় তার এক পরিপূর্ণ প্যাকেজ। বর্তমান পুলিশ বাহিনীতে যে কজন অফিসার ক্ষেত্রবিশেষে নিউরন অগমেন্টেশন চিপ ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে সে তাদের মধ্যে একজন। বিশেষ এই ইলেকট্রনিক চিপের মাধ্যমে নিউরণের কর্মক্ষমতা বাড়ানো যায়। এটা ব্যবহারে অবশ্য উপরের মহলের বিশেষ অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

শান্তিনগর এলাকাটা ভালই লাগে রাশেদের। রাস্তার দুপাশে বড় বড় মেহগনি গাছ। ফরেনসিক ট্রেনিং ইন্সটিটিউট এর ভিতরেও অনেক গাছ। ছায়া সুনিবিড় একটা পরিবেশ। ফ্রেশারদের একটা কোর্সে ক্লাস নিতে এসেছে। ‘ডাটা এনালিটিকস্ টু ইমপ্রুভ ডিজিটাল পুলিশিং’ নিয়ে আলোচনাটা জমে উঠেছিল বেশ। নতুনদের সঙ্গে আলোচনায় সবসময়ই মজা পায় ও। যদিও আলোচনাটা শুরু হয়েছিল ডাটা অ্যানালিটিকস নিয়ে, শেষ পর্যন্ত সেখানে আর থেমে থাকেনি। সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে যাওয়া হ্যাকিং অপরাধ, ডার্ক ওয়েব বাণিজ্য, সাইবার গ্যাংস্টার, সর্বশেষ সংযোজন জারা আলি ইস্যু—কোনওটাই বাদ যায়নি।

‘মেমোরেট’ নিয়েই তরুণদের মাঝে আগ্রহটা ছিল বেশি। মিডিয়ার জোর গুজব, জারা আলি ছিলেন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রথম বাংলাদেশী। তাই আগ্রহের পারদ বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। রাশেদও ফিরে গিয়েছিল ফ্রেশার হিসেবে তার ট্রেনিংয়ের সেই দিনগুলিতে। শেষ করেছিল এই বলে, “হিউম্যান-মেশিন-আর্টিফিশিয়াল ইনটিলিজেন্স—এই তিনের যথাযথ মেলবন্ধন করাই হল বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনারাই অগ্রসেনানী। তাই বলব, সফল হতে হলে শুধু মেধা আর বুদ্ধি থাকলেই হবে না, থাকতে হবে একটা লক্ষ্য, একটা দর্শন—আমি কী করছি, কেন করছি, কাদের জন্য করছি। সর্বশেষে সফল হওয়ার টোটকা একটাই—কমিউনিটি এনগেজমেন্ট।”

‘মেমোরেট’, পুরো নাম মেমোরি রোবট—নিউরোসায়েন্স, ইনফরমেশন টেকনোলজি, ডাটা সায়েন্স আর পিকোটেকনোলজির এক আশ্চর্য সমন্বয়। একটা বায়োচিপ, সূঁচের ডগার চেয়েও ছোট। ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে পুশ করা হয়, রক্তে বাহিত হয়ে পৌঁছে যায় মস্তিষ্কের টেমপোরাল লোবের মাঝে থাকা হিপ্পোক্যাম্পাসে। স্বাভাবিকভাবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু যখনই ব্রেনের কোনও বড় ধরণের অসংগতি ধরা পড়ে তখন নিজে নিজেই সক্রিয় হয়ে যায়, রেকর্ড করতে থাকে সব কিছু। জটিল রোগের চিকিৎসা, দুর্ঘটনা তদন্ত, বীমা দাবি, সর্বোপরি অপরাধ তদন্ত—মূলত এসব কাজের জন্যই এর ব্যবহার। কিন্তু হয়েছে ঠিক উল্টো। লাখ লাখ কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসা গড়ে উঠেছে ‘সংরক্ষিত স্মৃতি’ নামে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে স্মৃতি চিত্ত বিনোদন ক্লাব। এই হল মানুষ। কথায় আছে, আদমের পেট মাটি ছাড়া আর কিছু দিয়ে ভরে না।

***

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলছে রাশেদের গাড়িটা। গন্তব্য ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব, আশকোনা, দক্ষিণখান। কাকলীর কাছে আসতেই প্রচণ্ড জ্যামে আটকা পড়ল। দীর্ঘ এক ঘন্টা বসে থেকেও জ্যাম থেকে বেরোতে পারছে না, পুলিশের সাইরেন কোনও কাজে আসছে না। প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে, বেশি বিরক্ত লাগছে এদেশের অর্বাচীন আর আহাম্মক দেশ-নেতাদের উপর। ফ্লাইওভারে চালু করেছে ভিআইপি লেন, ২০২৫ সালে চালু হয়েছিল এই ফ্লাইওভার। দেশের কোনও সেক্টরে সুষম উন্নয়ন নেই। যা একটু এগিয়েছে তা হল একমাত্র তথ্যপ্রযুক্তি খাত, যার বেশিরভাগ সুবিধা ভোগ করে নির্দিষ্ট কিছু পশ এরিয়ায় বাস করা লোকজন। ঢাকা শহরের সবচেয়ে বেশি অপরাধও সংঘটিত হয় এই সব এলাকায়। উপরমহলে আলোচনা চলছে, এসব এলাকাগুলোকে ‘হট স্পট করিডোর’ হিসেবে চিহ্নিত করে সাইটেক্টিভ কার্যক্রম শুরু করার। ‘বেক্সিটেক’ নামে বাংলাদেশী এক টেক-জায়ান্ট এ বিষয়ে শলা-পরমর্শ দিচ্ছে সরকারকে। সেলুকাস! দেশে এখনও দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা মানুষের সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ পার্সেন্টের বেশি।

পিছন থেকে ক্রমাগত গাড়ির হর্নে চিন্তার সূত্র কেটে গেল, চোখ খুলল রাশেদ। গাড়িগুলো চলতে শুরু করেছে। ফোন দিল নিজামকে, ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে থাকার জন্য। ওর ডিউটি এখন ওদিকেই। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। বিকালে আবার মিটিং আছে, ওইদিনের ঘটে যাওয়া ব্ল্যাক আউট-কাণ্ড নিয়ে। এ বিষয়ে তদন্ত যতটুকু এগিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে এটা নিছক কোনও পাওয়ার ফেইলিউর না, পরিকল্পিতভাবে স্যাবোটাজ করা হয়েছে। পাওয়ার ফেইলিউর, সিকিউরিটি সিস্টেম শাট ডাউন, সার্ভিলেন্স ড্রোন অচল হয়ে যাওয়া—তিনটে একই সঙ্গে ঘটা কোনও কোইনসিডেন্স নয়। কিছু একটা অবশ্যই আছে। তার মনে হচ্ছে এই টিমে আরও দক্ষ লোক লাগবে, নাসিম ছেলেটা একা পেরে উঠছে না। ‘জারা আলি’ কেস শেষ হলে নিজামকে এখানে নিয়ে আসতে হবে, ছেলেটা কম্পিউটার বোঝে ভাল।

***

কাজ দ্রুত এগোনোর জন্য নিজাম আগে থেকেই জারা আলির মেমোরেট সিস্টেমে ইন্সটল করে রেখেছিল। রাশেদ এসেই দেরি করল না, কাজে বসে গেল। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি গিয়ারটা মাথায় পরার সঙ্গে সঙ্গেই জারা আলি যেন কোনও এক জাদুবলে আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল। রাশেদই জারা, জারাই রাশেদ—হয়ে উঠল।

...নিচে পড়তে পড়তে মনে হতে লাগল যেন বৃষ্টির ফোঁটায় মিলিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত আলো-আঁধারি খেলা করছে চোখের সামনে। মৃত্যুভয়। টুকরো টুকরো স্মৃতিরা ভেসে উঠতে লাগল।

পুরাণের গহন ভিতর থেকে বের হয়ে আসা এক ভয়, হতাশা আর ঘৃণার পুরো আস্তরণ টের পেতে থাকল, রাশেদ যতই স্মৃতির ভিতরে ঢুকতে লাগল।

...মদের গেলাস হাতে তার মাতাল বাবা, মায়ের অসহায়ত্ব, দারিদ্রতার দিনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, নিজের কান্নারত মুখ, অপূর্ব রূপ, সর্বস্ব বিক্রি করে মায়ের হাত ধরে বি-একাডেমিতে যাওয়ার প্রথম সেই দিন—বিচিত্র সব স্মৃতিরা আসতে লাগল বানের পানির মতো।

রাশেদ অনুভব করতে পারছে জারার উত্তুঙ্গ হৃৎস্পন্দন।

...প্রথম ছবি করার সেই দিন, অস্কার পাওয়া, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধুত্ব। তারপর প্রেমিক পুরুষের আগমন, তার কাছ থেকে প্রথম চিঠি পাওয়া, ধীরে ধীরে প্রেমে পড়া...

জারা আলি সম্পর্কে রাশেদের প্রাথমিক ধারণা ছিল আগে থেকেই। স্মৃতি খুঁড়তে গিয়ে, প্রেমিক পুরুষকে দেখা মাত্রই চিনতে পেরেছে। নাম তার আসিফ আনসারি, একাধারে টেকবিজনেস টাইকুন আর মিডিয়ামোঘল। রাশেদ বুঝতে পারছে এই ‘সংরক্ষিত স্মৃতি’ যদি বাজারে ছাড়া যায় তাহলে মুহূর্তে হয়ে উঠবে ‘টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’। শত শত কোটি টাকার ব্যবসা হবে এটা নিয়ে।

এখনো নিচে পড়ছে জারা আলি। স্মৃতির রিল যতই ঘুরছে ততই সেলিব্রেটি সম্পর্কিত রাশেদের তথাকথিত ধারণাও পরিবর্তিত হচ্ছে।

...প্রেম পরিণতিতে গড়াবার কিছুদিন পর স্বাভাবিক নিয়মে জারা মা হলো। হঠাৎ একদিন ছন্দপতন, অন্য মেয়ের সঙ্গে দেখা গেল আসিফ আনসারিকে। রাশেদ টের পাচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, মারামারি-হাতাহাতি। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ধাক্কা খেয়ে জারার পড়ে যাওয়া, অতঃপর গর্ভপাত। আসিফ আনসারি বেরিয়ে গেলো।

রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল রাশেদ। ব্যাটাকে কাছে পেলে আস্ত চিবিয়ে খেতাম।

...বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলো। বিভিন্ন ট্যাবলয়েড আর মিডিয়াতে প্রকাশিত হতে লাগল জারা আলির নামে কুরুচিপূর্ণ, মিথ্যা আর বানোয়াট সংবাদ। বেনামী উৎস হতে উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ ছবি প্রকাশ হতে থাকল বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। শহরের সবচেয়ে বড় বেশ্যা, অভিজাত পাড়ায় নিত্য যাতায়াত—কানাঘুষো চলতে লাগল। আস্তে আস্তে হাসি-তামাশার পাত্রে পরিণত হতে লাগল জারা আলি। সমগ্র জগৎ সংকুচিত হয়ে আসতে লাগলো। একে এক সব চুক্তি বাতিল করতে লাগল স্পন্সর, ডিরেক্টররা। সবকিছুর পিছনেই আসিফ আনসারির হাত তা বুঝতে পেরেছিল জারা। কিন্তু কিছুই করল না সে। না কোনওরকম প্রতিবাদ, না কোনওরকম প্রতিরোধ। কেমন যেন মিইয়ে গেল। যশ, খ্যাতি, সম্মান-সব কিছু দখল করে নিল আসিফ আনসারি।

...নিচে শক্ত কংক্রিট দেখতে পাচ্ছে জারা। ক্ষণিকের বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা হিমশীতল ভয় ঝিলিক দিয়ে উঠল চোখে। তারপর এক শাশ্বত আঁধার। স্মৃতিরা হারিয়ে গেল এক কালো গহ্বরে।

গিয়ারটা খুলে লম্বা একটা শ্বাস নিল রাশেদ। বুঝতে পারল নিজাম কেন ওই দিন এত উত্তেজিত ছিল। ‘মেমোরেট’ এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো— অতি সূক্ষ্ম আর উন্নত প্রযুক্তি। যে কেউ এর সঙ্গে কানেক্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই ওই মৃত ব্যক্তি হয়ে উঠে; সব কিছু দেখে, শোনে, ভাবে মৃত ব্যক্তির মতোই।

“হায়রে সেলিব্রেটি জীবন!” বিষণ্ণ মুখে তাকাল নিজামের দিকে। “সব দোষ ওই হারামীর, আসিফ আনসারি নামের ওই বজ্জাতটার। ওর কারণেই জারা আলির এমন করুণ মৃত্যু।’’ চোখমুখ কঠিন নিজামের।

‘জারা আলি মৃত্যু’ একটি আত্মহত্যা, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পুলিশের খুব বেশি বেগ পেতে হল না। দেশীয় মিডিয়ার চেয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় নিউজটা কাভারেজ পেল বেশি। তার ব্যবহৃত মেমোরেট নিলামে তোলা হলো, একটা আন্তর্জাতিক মেগাকর্পোরেশন পৌনে দুইশ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নিল। সপ্তাহখানেকের মধ্যে অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে চলে এল ভিডিওটা। ‘ট্রিবিউট টু দ্যা মেমোরি অব জারা আলি।’ বুড়ো থেকে জোয়ান, পাজি থেকে হাজি—সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল জারা আলির মৃত্যু পূর্ব অভিজ্ঞতা চেখে দেখতে। প্রথম দিনেই কোম্পানীর আয় হল দুইশ কোটি টাকা। জারা ক্যাপ, জারা কফি—কী হল না! ব্যক্তি জারা হারিয়ে গেল, তিক্ত স্মৃতি হয়ে উঠল বাণিজ্যিক পণ্য।

জীবিত মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠল এক ‘সংরক্ষিত স্মৃতি’। আম জনতার রোষের বলি হল আসিফ আনসারি। জারা আলির প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতির নিচে চাপা পড়ে গেল সে। টিভি, টক শো, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া বাদ গেল না কোনটাই। ফেসবুকে জনমত গড়ে উঠল তার ফাঁসির দাবীতে। বলা বাহুল্য ‘জারা’স ফ্যান’ পেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নিজাম বেশ ভাল ভূমিকা রাখল জনমত গঠনে। কোম্পানী ব্যবসা হারাতে লাগলো, চুক্তি বাতিল হতে লাগল একের পর এক; বন্ধুরা দূরে সরে গেলো। মৃত্যুর হুমকি আসতে লাগল প্রতিনিয়ত। বলতে গেলে একেবারে ঘরবন্দী হয়ে গেল বেচারা। মিডিয়া ট্রায়ালে প্রতিদিন তার বিচার হতে লাগলো।

***

প্রায় ছয় মাস পার হয়েছে। উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত।

এভাবে আর কতদিন! না বাহির, না ঘর। একদিন সাহস করে বাড়ি থেকে বের হল আসিফ আনসারি। সামনে একটা কফি শপে গেলো। আধঘন্টা ভালই কাটল। উঠে আসতে যাবে এমন সময় কোত্থেকে একটা ছেলে আচমকা দৌঁড়ে এসে একটা ছুরি বসিয়ে দিল ঠিক বুক বরাবর। হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা গেল আনসারি। অবশ্য পরে ছেলেটাকে ধরা হল, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল তার। কিন্তু জনমতে কোনও পরিবর্তন এল না। এমনকী কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল সাজা প্রাপ্ত ছেলেটা ঠিক কাজই করেছে।

এভাবে বছর ঘনিয়ে আসতে লাগল।

আজ জারা আলি’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। জারা’স ফ্যান পেজের আয়োজনে সকালে ছোট্ট একটা প্রেগ্রাম করা হয় ‘জারা আলি’ মিউজিয়ামে। আকাশবাড়ির ওই অ্যাপার্টমেন্ট এখন মিউজিয়াম। আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলে নিজাম দরজা খুলে টেরেসে গিয়ে দাঁড়ালো। টবে লাগানো গাছগুলোতে শিশির। নিজেকে হঠাৎ তার আধো-ভৌতিক কোনও অন্ধকারের জীব মনে হতে থাকে। মনে হতে থাকে তার ভালবাসার কথা, তার স্বপ্নের কথা। কাছে আসতে গিয়েও না আসতে পারার ব্যথা। চোখে টলটলে জল, হৃদয় গলে গলে পড়ছে যেন।

হঠাৎই নিজামের চোখে পড়ে দূরে অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় একটা আবছায়া মূর্তি। হতবিহ্বল নিজাম চিৎকার করে উঠতে গিয়েও থেমে যায়। বলা ভালো, নিজের পুলিশি সত্তাটা থামিয়ে দেয়। ভাল করে তাকায়, চেহারাটা পরিষ্কার হয়ে উঠে। এএসপি রাশেদ হাসান দাঁড়িয়ে আছে।

“আপনি এখানে কী করছেন, স্যার? আপনিও কি এখান থেকে লাফ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করবেন?” হাসছে নিজাম।

“না, না। এমন কিছু না। তোমার বাসায় গিয়েছিলাম পেলাম না, গলির মোড়ে সুরুজ আলি বলল প্রোগামের কথা। ভাবলাম এখানে পাব, তাই চলে আসলাম। মনে হল তোমার সঙ্গে আমিও যোগ দেই।”

“একবছর হয়ে গেছে। ওপারে শান্তিতে আছে জারা ম্যাডাম। আসিফ আনসারি তার প্রাপ্যটাই পেয়েছে।” মুখের সবগুলো পেশি স্থির হয়ে আছে নিজামের।

“অসংখ্যবার আমি জারা আলি’র মৃত্যু পূর্ব সংরক্ষিত স্মৃতির রেকর্ডটা প্লে করে দেখেছি। যতবারই দেখি ততবারই মনে হয় যেন আমি নিজেই পড়ছি। এক ধরণের বিভ্রান্তি, বিষণ্ণতা আর গ্লানি বোধ হয়।” চোখে মুখে একরাশ নির্লিপ্ততা আঁকা রাশেদ হাসানের।

“স্যার, আপনি যে এত আবেগী তা তো জানতাম না।” নিজামের শুকনো গলা। কিছু একটা হয়েছে, ঠিক ঠাহর করতে পারছে না।

“খুনের তদন্ত করতে হলে যেমন সম্ভাব্য খুনীর মনস্তত্ত্ব বুঝতে হয় ঠিক তেমনি যে খুন হয়েছে তাকেও ঠিকভাবে পড়তে হয়। না হলে কোনও রহস্যই সমাধান করা যায় না। যেমন এইটা!”

“এটা তো স্রেফ একটা আত্মহত্যা। খুনের কথা আসলো কোত্থেকে!” অবাক বিস্ময় নিজামের চোখে মুখে।

“মনে আছে, তুমি বলেছিলে এটা একটা খুন। ভালো করে মনে করে দেখো।”

“হ্যাঁ, এটা তো খুনই। আনসারির কারণে জারা আলি আত্মহত্যা করে। পরোক্ষভাবে সেই জারা’র খুনী।”

“ঠিক বলেছ এটা একটা খুন। না, কেবল খুন না; ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত খুন। আর খুনটা করেছো তুমি নিজে। তুমি একটা বদ্ধ উম্মাদ, মানসিক বিকারগ্রস্ত এক ইরাটোম্যানিয়াক।” দম নিল রাশেদ হাসান।

“এ কেমন তামাশা, স্যার। আমি কেন খুন করতে যাব জারা আলিকে? আমার মতো লোকের তো জারা আলির ধারে কাছে ঘেঁষার কোনও সুযোগ নাই। কোথাও ভুল হচ্ছে, স্যার।” নিজামের নিরুত্তাপ উত্তর।

“প্রথম প্রথম আমিও তেমনই ভেবেছিলাম, এটা স্রেফ একটা আত্মহত্যা। কিন্তু যখন ওই ব্ল্যাক আউটের বিষয়টা খতিয়ে দেখা শুরু করি তখন ধারণা পাল্টে যেতে থাকে। বার বার রেকডর্টা প্লে করে দেখি। তখনই সূক্ষ্ম পার্থক্যটা ধরা পড়ে। স্পষ্ট টেম্পারিংয়ের আলামত দেখতে পাই। বুঝতে পারি, শেষের কিছু অংশ ডিলিট করা হয়েছে, কিছু স্মৃতি এডিট করা হয়েছে।”

“এটা তো যে কেউই করতে পারে। আমি কেন?” কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ নিজাম।

“ঘটনার দিন তুমি ওখানে সবার আগে পৌঁছুলে কী করে?” রাশেদ হাসানের জিজ্ঞাসা।

“ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সার্ভিলেন্স ড্রোন প্রথম আমাকে রিপোর্ট করে।” নিজামের ঝটতি জবাব।

“হ্যাঁ, এটুকু ঠিক আছে। মেমোরেট প্রথম রিড করেছ তুমি। একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে তুমি এটা করতে পারো। সবাই জানে তুমি জারা আলি’র পাঁড় ভক্ত, অতি উত্তেজনা আর আবেগের বশে তুমি এমনটা করেছ ধরে নিয়ে তখন তেমন মাথা ঘামাইনি। কিন্তু ব্ল্যাক আউট কান্ডে কেচোঁ খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসে।”

“ব্ল্যাক আউট কান্ডের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?”

“সম্পর্ক আছে কিনা জানতেই তো তোমার কাছে আসা। তুমিই ভাল বলতে পারবে। তোমার মনে আছে, মাস দুয়েক আগে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন সাইবার ডিটেক্টিভ নিয়োগ দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে তাকে হটস্পট করিডোরগুলোতে সাইবার অপরাধ দমনের দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পুরোপুরি দায়িত্ব নেয়ার আগে আমিই তাকে পরীক্ষামূলকভাবে ব্ল্যাক আউট কান্ডে চোখ বুলাতে বলি। গত এক মাস ধরে তদন্ত করে সে সন্দেহজনক অনেক কিছুই জানতে পেরেছে।” আবারও দম নিল রাশেদ হাসান।

“আমাকে এসব শুনিয়ে আপনি বেহুদা সময় নষ্ট করছেন, স্যার।” কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত নিজাম।

“আমার হাতে আজ অনেক সময়। একটু না হয় বেহুদা গল্পই শুনো। দায়িত্ব পেয়েই সে তদন্ত শুরু করে। তার প্রথম কাজ ছিল সিকিউরিটি প্রোটোকল ব্রীচ হওয়ার ঘটনাটা খুঁজে দেখা। ওটা করতে গিয়েই সে দেখে পাওয়ার ফেইলিউর, সিকিউরিটি প্রোটোকল শাটডাউন, সার্ভিলেন্স ড্রোন অচল—এসবই করা হয়েছে একটা নির্দিষ্ট আইপি অ্যাড্রেস থেকে। অ্যাড্রেসটা চালায় ‘ডেভিল’স আইভি’ নামে এক হ্যাকার, যাকে ডার্ক ওয়েবে কেউ কেউ ‘অ্যানিহিলেটরবিডি৭১’ বলে ডাকে।” রাশেদ হাসান তাকায় নিজামের দিকে। তাকে পড়ার চেষ্টা করে।

নিরুত্তর নিজাম।

আবার শুরু করে রাশেদ হাসান। “আরও একটা জিনিস পায় আমাদের সাইটেক্টিভ। মনে আছে, সাইবার-ডিটেক্টিভ নামটাকে সংক্ষিপ্ত করে সাইটেক্টিভ বলার আইডিয়াটা তোমারই দেয়া। ‘ক্র্যাংকি সেইন্ট’ নামে হাঙ্গেরিয়ান এক হ্যাকারের সঙ্গে আমাদের কথিত হ্যাকার ‘অ্যানিহিলেটরবিডি৭১’-এর একটি কথোপকথন যেখানে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ প্রোটোকল ডিক্রিপশনের সর্বশেষ প্রযুক্তি ‘স্কুইডক্রাসার’ কেনা-বেচা নিয়ে কথা হয়। ব্ল্যাক আউট কান্ড আর জারা আলি মৃত্যু যেহেতু একই সময়ের ঘটনা তাই কোনও যোগসূত্র আছে কিনা খুঁজে দেখতে বলি। আপাত কোনও যোগসূত্র গতমাস পর্যন্তও তার কাছে পরিষ্কার ছিল না। শুধু এটুকুই জানতে পারে, ওই ব্ল্যাক আউটের দশ মিনিটের মধ্যেই জারা আলি’র খুনের ঘটনাটা ঘটে। খুনী কে? কী উদ্দেশ্যে খুন করতে পারে? এসবই ছিল ধোঁয়াশা। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। গত মাসে একটা অদ্ভুতুড়ে কান্ড ঘটে। জারা আলির ফেসবুক আইডি থেকে একটা পোস্ট করা হয়। মৃত মানুষ তো ফেসবুক চালায় না, কিছু একটা গড়বড় হয়েছে নিশ্চিত। শুরু হল নতুন অ্যাঙ্গেলে অনুসন্ধান। বের হয়ে আসে জারা আলির অব্যবহৃত আইডিতে অযাচিতভাবে কেউ অনুপ্রবেশ করেছে। তার অ্যাক্টিভিটি লগের সকল ডাটা নিয়ে অ্যালগোরিদমিক প্যাটার্ন অ্যানালিসিস করা হলো। কেউ একজন অ্যাপার্টমেন্টের সকল ইন্টারনেট অব থিংস টেকনোলজি নিয়ন্ত্রণ করছে তার মৃত্যুর আগে থেকেই। তার প্রত্যেকটা কর্মকান্ড দেখছে এক অদৃশ্য ঈশ্বরের মতো। শুরু হল হ্যাকারকে খোঁজার কাজ, ডার্ক ওয়েবে নজরদারি বাড়ানো হলো। অবশেষে পাওয়া গেল একটা নাম ‘অ্যানিহিলেটরবিডি৭১’। চেক করা হল ব্ল্যাক আউটের সময় জারা আলির অ্যাপার্টমেন্টের টেকনিক্যাল ইনফরমেশনগুলো, দেখা গেলো ওই সময়টাতে পুরো সিস্টেমটার নিয়ন্ত্রণ ছিল ‘অ্যানিহিলেটরবিডি৭১’ নামে ওই হ্যাকারের হাতে।” উত্তেজিত রাশেদ হাসান।

“এই অ্যানিহিলেটরবিডি৭১ যে আমি তার প্রমাণ কী?” দুর্বল জিজ্ঞাসা নিজামের।

“প্রমাণ! পুলিশ প্রমাণ ছাড়া কিছু করে না। যখনই নিশ্চিত হলাম ব্ল্যাক আউট কান্ড আর জারা আলি খুনের প্রাইম সাসপেক্ট এই ‘অ্যানিহিলেটরবিডি৭১’ তখনই শুরু হল তার খোঁজ। কথোপকথনের সূত্র ধরে মানি ট্রানজেকশনের সম্ভাব্য সকল রেকর্ড ট্রেস করা হলো। পেমেন্ট করা হয়েছে বিটকয়েনের মাধ্যমে। ব্যবহার করা হয়েছে ব্ল্যাকচেইন টেকনোলজি। পেমেন্ট আইডি খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে আসে একটি নাম।”

চমকে উঠল নিজাম, নিজের ভিতর গুটিয়ে যেতে চাইল। এই শীত সকালের অনুত্তেজনাহীন হালকা কুয়াশায় বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে, কী বলবে। মুহূর্ত সময় মাত্র। মগজের লেলিহান শিখাটা দপ দপ করে জ্বলতে শুরু করল আবার। হঠাৎই প্রজ্বলিত আগুনের জিহ্বা বেরিয়ে এল যেন। “হ্যাঁ, আমি...। আমিই করেছি। কোনও কিছুর তোয়াক্কা করি না আর আমি। জারা আমার ভালবাসা। আমি ছাড়া আর কেউ তাকে পেতে পারে না। আমি ছাড়া আর কেউ তার সঙ্গে হেসে কথা বলতে পারে না। জারা আমার। আমি জারাকে অনেক ভালবাসি, জারাও আমাকে অনেক ভালবাসে। ওই শয়তান আসিফ আনসারির জন্য কিছু করতে পারছিল না সে।”

মানসিক বিকারগ্রস্থরা যে কত তুচ্ছ কারণে খুন করতে পারে তা জানা আছে রাশেদ হাসানের। নিজামের ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে তার। ইরাটোম্যানিয়া, ডাক্তারি ভাষায় বললে, ‘ক্লেরামবোল্ট সিনড্রোম’ নামে এক মানসিক রোগে ভুগছে নিজাম। এই রোগ যার হয় সে গোপনে ভালবাসতে থাকে কোন নামকরা সেলিব্রেটিকে, তার প্রতি একধরণের অবসেশন তৈরি হয় তার মাঝে। দর্শকের উদ্দেশ্যে সেলিব্রেটির সাধারণ হাত নাড়াকেও তার গোপনে কোনও ম্যাসেজ মনে হয়। এমনকী, সংবাদে কিংবা সাক্ষাৎকারে তাকে দেখে তার মনে হতে পারে ওই সেলিব্রেটি তাকে ভালবাসার কথা জানাচ্ছে। ডাক্তারের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর থেকে নিজামের মানসিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে, শেষমেষ থেরাপিও নিতে হয়। বোঝাই যাচ্ছে কোনও কাজে আসেনি এসব।

“মেমোরি ট্যাম্পারিং করে সব দায় তুমি আসিফ আনসারির ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছ। প্রাথমিকভাবে তুমি সফলও হয়েছ। কিন্তু যখনই আমি আনসারির মেমোরি দেখি তখনই বুঝতে পারি ঘাপলা আছে কোথাও। তারপরই জারা’র মেমোরি রেকর্ড আবার চেক করি। সূক্ষ্ম পার্থক্যটা ধরা পড়ে। তারপর একে একে সব পরিষ্কার হতে থাকে। কিছু বলার আছে তোমার?” কঠিন চোখে তাকায় রাশেদ হাসান।

পুলিশের গাড়িতে নিজাম। চুপচাপ বসে আছে। মিইয়ে আছে নিজের মাঝে। ভালবাসার জন্য আকুলিবিকুলি করেছে সারাটা জীবন। নিজে পুড়ে অন্যকে পুড়িয়েছে। অস্ফুটে বিড়বিড় করে কী যেন আওড়ায়। মনে মনে বিশ্বাস করে, আশা করে জারা...। একটা রহস্যময় হাসি ঝিলিক মেরে উঠে তার ঠোঁটে।

আধঘন্টার মধ্যে দেশের সবগুলো টিভি চ্যানেল, পত্রিকা অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিদেশি সংবাদমাধ্যম উঠে পড়ে লাগে। যেন জলের দরে সোনা কেনাবেচা হচ্ছে। সবাই জানতে চায়, সবাই শুনতে চায়। কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর আগেই শুরু হয়ে যায় নিজামের মিডিয়া ট্রায়াল। চলতেই থাকে।