অনাহূত - পৃথ্বীশ গজী

গল্প

“গুড মর্নিং পাপা, তুমি যে বলেছিলে এই দেশের ইতিহাস বলবে আমাকে।”

পামটপে সারা পৃথিবীর খবর ঘাঁটছিলাম। ঈশিতার কণ্ঠস্বর কানে আসতেই তাকালাম ওর দিকে। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ও। ওদের স্কুলে ফোর্থ স্ট্যাণ্ডার্ড থেকে পড়ানো শুরু হয় এই দেশের ইতিহাস। ঈশিতাও কিছুদিন আগে ফোর্থ স্টাণ্ডার্ডে উঠেছে। কিন্তু বাপের একমাত্র আদুরে মেয়ের আবদার ক্লাসে শুধু হিস্ট্রি স্যারের কাছে নয়, আমার কাছে শুনবে এই দেশের ইতিহাস।

প্রায় মাস দুয়েক আগে ঈশিতার আবদারেই বলেছিলাম এই দেশের ইতিহাসের পুরোটাই ওকে শোনাব। কিন্তু তারপর জীবককে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে আর সময় দিতে পারিনি নিজের মেয়েকে। কখন যে আমার কর্মস্থল ‘ন্যাশানাল অর্গানাশজেশন ফর সাইন্টিফিক রিসার্চ অ্যান্ড ইনভেনশন’ বা ‘নসরি’-র গোপন ল্যাবরেটরিতে যেতাম আর কখন যে বাড়ি ফিরতাম তার কোনও ঠিক ঠিকানা ছিল না এই ক’দিন। প্রতিদিন ভোরবেলায় যখন আমি বাড়ি থেকে বেরতাম তখন ঘুম ভাঙত না ঈশিতার। সারাদিনের গবেষণার কাজ শেষ করে ফিরে এসেও দেখতাম ও ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই।

এদিকে ওদের নতুন সেশনের ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে কিছুদিন আগেই। ঈশিতাকে কথা দিয়েও রাখতে না পারার জন্যে বড্ড খারাপ লাগছিল নিজের। কিন্তু বিগত কয়েকমাসের গতে বাঁধা রুটিনটার ব্যতিক্রম ঘটেছে আজ।

জীবকের কাজের ফাইনাল আপডেট আসা অবধি আর কোনও কাজ নেই আমার বা নাসেরের। এই দেখুন, এত কথা বলতে গিয়ে নিজের পরিচয়টা তো দেওয়াই হয়নি আপনাদের। আমার নাম ডঃ কৌশিক সিংহরায়।

গতকাল আমি যখন ‘নসরি’ থেকে ফিরি তখন ঘড়ির কাঁটা রাত দেড়টা পার করে ফেলেছে। ঈশিতা তখন ঘুমিয়ে কাদা। শুতে যাওয়ার আগে ওর মাকে বলেছিলাম যে আজ হয়তো কিছুটা হালকা থাকব আমি। মনে হয় ঘুম থেকে উঠে ওর মায়ের কাছে থেকে আমার বাড়িতে থাকার খবর পেয়েই ছুটে এসেছে ঈশিতা।

“গুড মর্নিং ডিয়ার।” পামটপ বন্ধ করে হাসলাম ঈশিতার দিকে তাকিয়ে, “হ্যাঁ, আজ বলব তোকে।”

বসেছিলাম ডাইনিং টেবিল সংলগ্ন একটা চেয়ারে। আমার কথা শুনে ঈশিতাও বসে পড়ল আমার সামনের চেয়ারটাতে, “পাপা শুরু কর। তুমি কত সুন্দর করে বল। স্কুলের বোরিং ইতিহাস ক্লাস মোটেও ভাল লাগে না আমার। বলা যায় না কখন আবার বেরিয়ে যাবে!”

ছোট্ট মেয়েটার মুখে অভিমান স্পষ্ট। জানি ও আমার মুখ থেকে গল্প শুনতে চাইছে। কিছুদিন আগে অবধিও নিয়মিত ওকে গল্প বলতাম। তবে সেসব নেহাত বাচ্চাদের ভোলানো গল্প নয়। সারা পৃথিবীর নানা খবর, ঘটনা সবই ওকে শোনাতাম ওর মত করে।

এরপর জীবকের কাজে হাত দেওয়ার পর আমার ব্যস্ততা এতটাই বেড়ে গেছে যে শুধু ঈশিতা নয়, ওর মা সায়ন্তিকার থেকেও কিছুটা দূরত্ব বেড়ে গেছে আমার। মা সেটা বুঝলেও ছোট্ট মেয়েটা তো তা বুঝবে না। সেটাই স্বাভাবিক। ওর অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠল আমার। মনে হল আজ সুযোগ এসেছে আপন সন্তানের সঙ্গে দূরত্বটা কিছুটা হলেও মিটিয়ে নেওয়ার। তাই খানিক জোর করেই হাসলাম ঈশিতার দিকে তাকিয়ে, “চল শুরু করা যাক।”

“বলো পাপা।” ঈশিতা উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, যেন আর তর সইছে না ওর। তাই শুরু করলাম আমিও, একটা ছোট্ট প্রশ্ন দিয়ে, “ঈশি তোর মনে আছে আমাদের দেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কবে?

“উউউ…” একটু ভাবল ঈশিতা, “দু’হাজার ছাব্বিশ।”

“ঠিক বলেছিস, কিন্তু কেন বলতো?”

“সুনামি। স্যার বলেছেন দু’হাজার পঁচিশ সালে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প আর সুনামি না হলে ইকোল্যাণ্ডের জন্মই হত হত না।”

“বাহ,” ঈশিতার শেষ হয়ে যাওয়া কথা থেকেই হাল ধরলাম আমি, “হ্যাঁ, সেই আর্থ কোয়েক আর সুনামির কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল দুনিয়াব্যাপী চলতে থাকা গ্লোবাল ওয়ার্মিং। তুই তো গোটা পৃথিবীর ম্যাপ দেখেছিস। কিন্তু তখন পৃথিবীর ম্যাপ ছিল অন্যরকম। ইকোল্যাণ্ডের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তার বদলে অনেকটাই বিস্তৃত ছিল অন্য মহাদেশগুলোর উপকূল। কিন্তু রিখটার স্কেলে দশ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর সবকটা কোস্টাল এরিয়া। প্রকৃতির সেই তাণ্ডব ছাড় দেয়নি আটলানটিক, প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরকেও। সুনামি হয়ে আছড়ে পড়েছিল পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশগুলোর উপকূলে। ভয়ংকর সেই তাণ্ডব থেমে যাওয়ার পর মানুষ আবিষ্কার করেছিল পৃথিবীর অধিকাংশ মহাদেশের উপকূল তলিয়ে গেছে জলের তলায়। সেই তালিকায় ছিল ছোট বড় অসংখ্য দ্বীপও। কিন্তু এরই বিপরীতে আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে জেগে উঠেছে এক স্থলভাগ যার আয়তন হারিয়ে যাওয়া স্থলভূমির থেকে কিছুটা কম হলেও খুব একটা কম নয়।”

আমি একটু থামতেই ঈশিতা বলল, “এটা তো জানি। স্যারও এই অবধি পড়িয়েছেন। উনিই আমাদের বুঝিয়েছেন গ্লোবাল ওয়ার্মিং কাকে বলে। আর রিখটার স্কেলই বা কী। কিন্তু পাপা, তারপর?”

ঈশিতার কথা শুনে মনে মনে খুশি হলাম। মুখে যতই বলুক বোরিং ক্লাস, ও কিন্তু ফলো করেছে স্যারের লেকচার। বললাম, “হ্যাঁ, এবার তারপরের কথায় আসি। ভয়ংকর সেই তাণ্ডবের মধ্যেও কিন্তু মারা যায়নি ওইসব জায়গার মানুষ। কেন বলতো? কারণ ওই ঘটনার তিন বছর আগে মানে দু’হাজার বাইশ সালে রাশিয়ার একদল বিজ্ঞানী আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন আর্থ কোয়েক ডিটেকটর। ইন্টারনেটে তুই নিশ্চয়ই দেখেছিস যে এটা এমন একটা যন্ত্র যা পূর্বাভাস দিতে পারে সুনামি এবং ভূমিকম্পের। সেই যন্ত্রই আভাস দিয়েছিল আগাম বিপর্যয়ের। ভূমিকম্পের আগেই তাই মানুষগুলোকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল উপকূল থেকে অনেক দূরে, অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায়। তুই তো জানিস আমরা আগে থাকতাম ইন্ডিয়াতে, কলকাতা নামের একটা শহরে। জায়গাটার দূরত্ব সমুদ্র থেকে খুব বেশি ছিল না। তোর গ্র্যান্ডপার মুখ থেকেই শুনেছি সেখান থেকে আমাদের মানে তোর গ্র্যান্ডপা আর গ্র্যান্ডমাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইন্ডিয়ার ক্যাপিটাল সিটি দিল্লীতে। শুধু তাই নয়, সেইসময় ইন্টারন্যাশানল বর্ডারের তোয়াক্কা না করেই বাংলাদেশ থেকেও কিছু লোককে এনে জায়গা দেওয়া হয়েছিল ইণ্ডিয়ার উত্তরদিকে। একইভাগে শ্রীলঙ্কার মানুষদেরও জায়গা দিয়েছিল ইন্ডিয়া। আসন্ন বিপর্যয়ের মোকাবিলায় সারা পৃথিবীতেই এক হয়েছিল সেই সময়। ইন্টারন্যাশাল বাউণ্ডারির সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে যে সব মানুষ থাকেন, তাঁদেরও সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল নিকটবর্তী নিরাপদ স্থলভাগে, তা সে যতই অন্য দেশের হোক না কেন। সেই সময় সম্ভাব্য মৃত্যু মিছিল এড়াতে এক হয়ে গিয়েছিল সারা পৃথিবী।”

ঈশিতা বড় বড় চোখ করে শুনছিল আমার কথা। একটু জল খাওয়ার জন্যে টেবিলে রাখা জলের জাগটার দিকে হাত বাড়াতেই সে বলল, “পাপা, পরে জল খাবে। আগে বলো।”

মেয়ের আদুরে আবদার! অগত্যা শুকনো গলাতেই শুরু করতে হল ফের, “কিন্তু বহু মানুষের মৃত্যু এড়ানো গেলেও গণ্ডগোল বাঁধল অন্য জায়গায়। ভূমিকম্পের ফলে এমনিতেই জলের তলায় চলে গিয়েছে পৃথিবীর স্থলভাগের একটা বড় অংশ! যেটা বেঁচে আছে সেটাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনেকটা। এমন অবস্থায় এতগুলো সহায়সম্বলহীন মানুষকে স্থায়ীভাবে থাকতে দেওয়া অথবা তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে চায়নি পৃথিবীর কোনও দেশই।

“কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবের পরেই এই মানুষগুলো যেন পর হয়ে গিয়েছিল বাকি পৃথিবীর কাছে।

“কিছুদিন আলাপ আলোচনার পর পৃথিবীর সবকটা দেশই বিশেষ জাহাজে করে সেই বিপর্যয় কবলিত, নিঃস্ব, সহায়সম্বলহীন মানুষগুলোকে থাকা আর খাওয়ার অল্পকিছু রসদসহ পৌঁছে দিয়েছিল আমাদের এই দেশে।

“সেই মানুষগুলোর মধ্যে ছিল তোর গ্র্যান্ডপা আর গ্র্যান্ডমাও। আমার তো জন্ম হয়েছিল এই দেশেই। কিন্তু তোর গ্র্যান্ডপা আর গ্র্যান্ডমা যখন এই দেশে আসে তখন এত সুন্দর ছিল না ইকোল্যাণ্ড। চারিদিকে কেবল খাঁ খাঁ করছে বিরাট একখণ্ড স্থলভূমি। সেইসময় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইট বালি সিমেন্ট দিয়েই এদেশের মানুষরা তৈরি করেছিল নিজের বাড়ি। তখন সেই বাড়িগুলো ছিল ছোট্ট; এক কামরার। ঘরে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। সমুদ্রে ঘেরা এই আইসল্যান্ডে পানীয় জলের কষ্ট ছিল চোখে পড়ার মত। জলের উৎস বলতে ছিল দেশের পূর্ব উপকূলে তৈরি হওয়া একখানা একখানা ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট। তুই তো জানিস এই প্ল্যান্টে সমুদ্রের নোনা জলকে পিউরিফাই করে ড্রিঙ্কিং ওয়াটার তৈরি করা হয়। পৃথিবীর বাকি দেশগুলোর সহায়তায় এই প্ল্যান্ট গড়ে উঠলেও সমুদ্রের জলকে পরিশুদ্ধ করে সেখানে যে পরিমাণ পানীয় জল তৈরি হত তাতে মিটত না এই দেশের মানুষের তৃষ্ণা। খাবারের জন্যে এগ্রিকালচার শুরু হলেও সেইসময় তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। তাই দেশের কারুরই দু’বেলা খাবারও জুটত না ঠিকমত। আর খাবার আর জল ঠিকমত পাওয়া যেত না বলেই তখন ইকোল্যাণ্ডের বেশিরভাগ মানুষই শিকার হত ম্যালনিউট্রিশান আর ডিহাইড্রেশনের। যার ফলে মানুষদের শরীরে বাসা বাঁধত নানা রকমের রোগ। কিন্তু সেই সময় দেশে ডাক্তার থাকলেও ওষুধের জন্যে আমাদের ভরসা করতে হত বাইরের পৃথিবীর উপর। তারা মানবতার খাতিরে বিনামূল্যে আমাদের ওষুধ সাপ্লাই করলেও বলা বাহুল্য সেই ওষুধের অধিকাংশই ছিল এত নিম্নমানের যে তাতে রোগ সারত না বেশিরভাগ সময়েই।

“ঈশি জানিস, সে সময় কত মানুষ যে কত মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে তার কোনও হিসাব ইকোল্যাণ্ড সেইসময় রাখতে পারেনি।”

আমার কথা শুনতে শুনতে বিস্ময়ে বড় হয়ে গিয়েছিল ঈশিতার চোখগুলো। যেন কোনও রূপকথার গল্প শুনছে সে। দুই প্রজন্ম পার করে ঈশিতা এখন পৃথিবীর এক অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের বাসিন্দা। এইসব দিন আমরা দেখলেও স্বপ্নেও কল্পনা তা করতে পারেনা ঈশিতা এবং তার প্রজন্ম। আমাদের তথা ওর মায়ের পূর্বপুরুষদের সেই লড়াইয়ের ইতিহাস আমরা এর আগে কখনও ওকে বলিনি। কিন্তু আজ মনে হল সবটুকু জানা উচিত ওরও। তাই বললাম, “ঈশিতা তুই জানিস আমরা এখানে আসার আগে ইণ্ডিয়ার সিটিজেন ছিলাম। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস যদি পড়িস দেখবি সেই দেশটাও দুটো একশো তিপ্পান্ন বছর আগে সেই বিশাল দেশটাও ইণ্ডিয়া আর পাকিস্তান নামের দুটো দেশে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। আমার পাপা মানে তোর গ্র্যান্ডপার মুখে শুনেছিলাম আমাদের পূর্বপুরুষরা ওই সময় একবার নিজের বাড়িঘর ছেড়ে বাধ্য হয়েছিলেন কলকাতায় আসতে। কারণ ওদের বাড়ি ছিল ইস্ট পাকিস্তানে, যে দেশটার এখন নাম বাংলাদেশ। সেই সময়েও কলকাতা ছিল ভারতবর্ষের অন্যতম বড় শহর। তবে শহরটা বড় হলেও কেউ তাঁদের সেখানে অভ্যর্থনা জানায়নি। বরং ওদের অবস্থা হয়েছিল আমার পাপা আর মমের মতই। সেই দিনগুলো যাতে আর তাঁদের উত্তরপুরুষদের দেখতে না হয়, সেইজন্যে ওরা কম কষ্ট করেননি। দেশভাগের ক্ষত নাকি কখনও স্পর্শ করতে পারেনি আমার পাপাকেও। জন্ম থেকে দুহাজার পঁচিশ সালের সেই ভূমিকম্পের আগে অবধিও তাঁর বাসস্থান ছিল দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরের একটা দোতলা বাড়ি, যেটা বানিয়েছিলেন আমার পাপার গ্র্যান্ডপা।

“ঈশি, সেখানেই তো বড় হয়ে ওঠার কথা ছিল আমারও! হয়তো তোরও। কিন্তু হয়নি। তার বদলে জন্ম থেকেই আমরা সবাই সামিল হয়েছিলাম একটা নতুন দেশ গড়ার কাজে। এই দেশের নাম ইকোল্যাণ্ড রেখেছিল এখানকার প্রথম মন্ত্রীসভা। তখন আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে সূর্যের আলো ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই আমাদের দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন তিনজন মানুষ। সুদীপ দত্ত, অ্যালেন লি আর ইউসুফ আনসারি। সেই তিনজন ইকোল্যাণ্ডের বিজ্ঞান গবেষণার দায়িত্ব দিয়েছিলেন পরিবেশবিদ ডঃ দ্যানিয়েল গার্সিয়ার হাতে। তাঁদের বক্তব্য ছিল খুব পরিষ্কার। এই দেশে উপলব্ধ কোনও প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করেই তৈরি করতে হবে কোনও বিকল্প শক্তির, যা চালিত করবে ইকোল্যাণ্ড নামের নতুন সভ্যতাটিকে।”

ঈশিতা বড় বড় চোখ করে শুনছিল আমার কথা। বাইরের পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে ওর কতটা আগ্রহ সেটা আমার জানা না থাকলেও ইকোল্যাণ্ডের ইতিহাস নিয়ে যে ওর বেশ আগ্রহ আছে তা বুঝতে পারছিলাম ওর মুখ দেখেই।

এই দেশের অগ্রগতি তথা উন্নতির পিছনে যে মানুষটার সবথেকে বেশি অবদান আছে তাঁর নাম ডঃ দ্যানিয়েল গার্সিয়া। আমরা যারা বিজ্ঞান তথা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত সবাই নিজেদের ডঃ গার্সিয়ার উত্তরসূরি বলেই মনে করি। ওনার জীবন এই দেশের সমস্ত ছাত্রছাত্রীর অবশ্যপাঠ্য। জীবনের প্রথমভাগটা স্পেনে কাটালেও ইকোল্যাণ্ডের ন্যাশানাল হিরো হয়ে উঠেছিলেন তিনিই। ঈশিতাও শুনেছে ওর নাম। তবুও ডঃ গার্সিয়াকে নিয়ে ঈশিতাকে বিস্তারিত বলার সুযোগ এসে যাওয়ায় মনে মনে বেশ খুশিই হলাম আমি। পূর্বপুরুষদের কথা বলা সময় বিষণ্ণতার চাদর তাই কিছুক্ষণের জন্যে আমাকে মুড়ে ফেললেও ফের শুরু করলাম নতুন উদ্যমে, “তো তখন সদ্য সমুদ্রের বুক থেকে জেগে ওঠা এই স্থলভূমিতে না হয় সেভাবে কোনও কৃষিকাজ, না পাওয়া যায় কোনও খনিজ। এইরকম একটা পান্ডববর্জিত জায়গায় বিকল্প শক্তির উৎস খুঁজে পাওয়া মোটেও সহজ ছিল না ডঃ গার্সিয়ার পক্ষে। তিনজন রাষ্ট্রনেতা তাঁকে ভরসা করলেও, প্রথম প্রথম দেশের মানুষরা খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি একমুখ দাড়িওলা সেই খামখেয়ালী মানুষটাকে। আপনভোলা লোকটা সবসময় কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছেন এই দেশের মাটিতে! কিন্তু তাঁর চিন্তা যে কতদূর প্রসারিত তা ইকোল্যাণ্ডবাসী বুঝতে পেরেছিল কয়েকবছর পরে। কয়েক বছর ধরে বিস্তর অনুসন্ধানের পর দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে সমুদ্রের উপকূল বরারবর ডঃ গার্সিয়া সন্ধান পেয়েছিলেন এমন এক মাইক্রোসস্কোপিক জীবের, যার কথা তার আগে কখনও জানতে পারেনি বাকি পৃথিবী।

“ডঃ গার্সিয়ার মতে এদের আদি বাসস্থান ছিল সমুদ্রের অতি গভীরে। বিপর্যয়ের ফলে ডাঙায় উঠে এলেও, শরীরে একপ্রকার জটিল অভিযোজন ঘটিয়ে টিঁকিয়ে রেখেছে নিজেদের অস্তিত্ব। ঈশি তোকে এখানে বলে রাখি অভিযোজন কথাটার মানে। খুব সহজে বলতে গেলে নিজেদের কোষে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল এই মাইক্রোঅর্গানিজমগুলো। এমনিতে আমরা জানি জলজ জীবেরা খুব বেশিক্ষণ ডাঙায় উঠে বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু এরা পেরেছিল। এদের এই ক্ষমতাটাই তাই নতুন আশা জুগিয়েছিল ডঃ গার্সিয়ার মনে। তিনি ওদের নাম রেখেছিলেন গার্সিয়ান ইকোল্যাণ্ডিয়া। সমস্ত উদ্যম আর অধ্যাবসায় নিয়ে লেগে পড়েছিলেন ওদের পিছনে।

“বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন গার্সিয়ান ইকোল্যাণ্ডিয়ার আর একটা ক্ষমতা। শুধু নিজেদের শরীরে নয়, সঠিক মাত্রায় অন্যের শরীরে প্রবেশ করলে এরা অভিযোজন ঘটাতে সক্ষম সেইসব প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদের শরীরেও। জীববিজ্ঞানের দিগন্তে তখন উন্মোচিত হচ্ছে এক নতুন দিগন্ত। কয়েক বছর পরেই ডঃ গার্সিয়া করে ফেলেছিলেন আরও একটা আবিষ্কার, যা আমূল বদলে দিয়েছিল ইকোল্যাণ্ডের অর্থনীতিকে।

“ওই সময়ে সমুদ্রের ধারে বনাঞ্চল গড়ে তোলার জন্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে আসত ম্যানগ্রোভ, নারকেল, ইউক্যালিপটাস, এমনকি ওকের বিভিন্ন প্রজাতির চারা। এছাড়াও ততদিনে প্রকৃতির নিয়মেই সারা দেশ জুড়ে জন্মাতে শুরু করেছিল অসংখ্য গুল্মজাতীয় গাছও। ডঃ গার্সিয়ার একটা ভীষণ পছন্দের জায়গা ছিল বটানি। নিয়মিত তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেন এইসব গাছপালার উপর। ইকোল্যাণ্ডের লবণাক্ত জমিতে বনভূমিকে বাড়িয়ে তুলতে সারাজীবন চেষ্টা করে গিয়েছেন তিনি। বাইরে থেকে যেসব গাছের চারা এখানে আসত, তাদের প্রত্যেকটির একটা করে স্যাম্পেল চলে যেত ডঃ গার্সিয়ার ল্যাবরোটরিতে। এদের মধ্যে হঠাৎ এভারগ্রিন ওকের একটি চারাকেই পরীক্ষা করার জন্যে মনে ধরেছিল ডঃ গার্সিয়ার। সেটার মধ্যে তিনি ইঞ্জেক্ট করে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন নির্দিষ্ট মাত্রার গার্সিয়ান ইকোল্যাণ্ডিয়াকে।

“তাঁর এই ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনা যে জীববিদ্যার জগতে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে সেটা বোঝা গিয়েছিল আরও কয়েক বছর পর। সেই চারা তখন সবে গাছ হয়ে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে ডঃ গার্সিয়ার ল্যাবরোটরির পাশে। জায়গাটা সংরক্ষিত বলে সবার ঢোকার অনুমতি ছিল না সেখানে। কিন্তু আধখেপা সেই বিজ্ঞানী তখন নতুন কিছু আবিষ্কারের আশায় তাঁর কয়েকজন তরুণ সহকর্মীকে নিয়ে দিন রাত এক করে বসে আছেন সেখানে। একদিন তাঁদের ধরা পড়েছিল পরিবর্তনটা। গোধূলি নামতেই নিজের ছোট্ট দেহ থেকেই আলো বিকিরণ করতে শুরু করেছিল সেই ছোট্ট গাছটি। অবাক হয়ে ওরা দেখেছিলেন যে সেই আলো তথাকথিত বৈদ্যুতিক আলোর থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল।

“এই ঘটনার কয়েকদিন পর ডঃ গার্সিয়া এই ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে এসেছিলেন আমাদের সামনে— গার্সিয়ান ইকোল্যাণ্ডিয়াই ছিল এই অদ্ভুত ঘটনার মূল কাণ্ডারি। ওকের শরীরে তারা ঘটিয়ে ফেলেছে এক ব্যতিক্রমী অভিযোজন, যার ফলে দিনের বেলায় নিজের দেহে সূর্যের আলোকে সঞ্চয় করে রাখে ওই গাছ।

“রাত্রে সেই আলোই বিকিরিত হয় তাদের দেহ থেকে।

“ডঃ গার্সিয়ার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পরেও ট্রেন অথবা সমস্ত ইণ্ড্রাস্টি, ফ্যান, এসি গিজার চালাতে বিদ্যুৎ শক্তির দরকার পড়লেও আলো জ্বালাবার জন্যে বিদ্যুৎ খরচ না হওয়ায়, সারা পৃথিবীতে যেমন কমে গিয়েছিল বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, তেমনই ব্যাপক হারে ওকের বনসাই চাষ করার ফলে কমেছিল পৃথিবীর দূষণ, যা বর্তমানে গ্লোবাল ওয়ার্মিঙের প্রভাব কিছুটা হলেও কমিয়ে নতুন করে আলোর দিশা দেখাচ্ছে সারা পৃথিবীকে।

“এখন সারা পৃথিবীতে প্রতিটি বাড়ি, অফিস, হাসপাতাল সর্বত্রই রয়েছে একাধিক ওকের বনসাই। শখে নয়, প্রয়োজনেই মানুষকে রাখতে হয় এই গাছ। আর এই গাছের রুক্ষণাবেক্ষণের খরচও সারা বছর ইলেকট্রিসিটি পুড়িয়ে লাইট জ্বালানোর থেকে অনেক কম। তাই বাড়িতে বা কর্মক্ষেত্রে আলো ছাড়া অন্যান্য ইলেকট্রিকাল গ্যাজেট ব্যবহার করার জন্যে দৈনিক কিছুটা বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার হলেও, ইলেট্রিসিটির খরচ কিন্তু সারা পৃথিবীর জন্যেই কমে এসেছিল অনেকটাই। ইলেকট্রিসিটি তৈরি করার খরচ তো বাড়ছিল দিনদিন। এই বাড়তে থাকা খরচের সামনে দাঁড়িয়ে ডঃ গার্সিয়ার এই আবিষ্কার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দিয়েছিল সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পৃথিবীর অসংখ্য নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মানুষকে।

“তাঁর এই ব্যতিক্রমী কাজকে সম্মানিত করা হয়েছিল হয়েছিল নোবেল দিয়ে। তাছাড়া নিজের ফরমুলার পেটেন্ট বিক্রি করেও আয় করেছিলেন বিস্তর।

“সেই অর্থ তিনি নিজের জন্যে নয়, ব্যয় করেছিলেন বিজ্ঞানের চর্চায় আর দেশের উন্নতিতে।

“ডঃ গার্সিয়ার ফর্মূলা এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লেও গার্সিয়ান ইকোল্যাণ্ডিয়া এখনও একমাত্র পাওয়া যায় ইকোল্যাণ্ডেই। আমাদের লবণাক্ত মাটিতেই একমাত্র বংশবিস্তার করতে পারে তারা। তাছাড়া একবার গার্সিয়ান ইকোল্যাণ্ডিয়া ইনজেক্ট করে অভিযোজন ঘটানো যায় একটি ওকের শরীরের। সেই গাছটি বহুবছর বেঁচে থাকলেও, ওই গাছের চারা থেকে যে নতুন গাছেরা জন্মায় তার শরীরে এই ক্ষমতা থাকে না। তাই আলো জ্বালাবার জন্যেই সারা পৃথিবীর বাজারে গার্সিয়া ইকোল্যান্ডিয়ার চাহিদা এখন তুঙ্গে। পৃথিবীর বাকি দেশগুলো অনেক চেষ্টা করেও যেমন কিন্তু সংরক্ষণ করতে পারেনি এই অনুজীবটিকে। তৈরিও করতে পারেনি আর্টিফিশিয়ালি। যে দেশের হাতে এমন এক সম্পদ আছে, তারা তো সেটা অন্য দেশকে বিক্রি করে টাকা রোজগার করবেই। সেই টাকার পুরোটাই খরচ হয়েছে দেশের উন্নতির জন্যে। ঈশি, জানিস একটা দেশের গড়ে উঠতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু আমরা ইকোল্যাণ্ডিয়া গার্সিয়া অন্য দেশগুলোকে বিক্রি করে যা টাকা পয়সা আয় করেছি, তা দিয়েই মাত্র উনপঞ্চাশ বছরেই তৈরি করে নিয়েছি এই দেশটাকে। আর তুই তো জানিস, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ এখন জায়গা নিয়ে নিয়েছ ইকোল্যাণ্ড। এখন এখানকার ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, সুউচ্চ অট্টালিকা, আর দেশের উপকূল বরারবর তৈরি হওয়া অনেকগুলো অত্যধুনিক ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট দেখে কেউ বলবেই না কয়েক বছর আগেও সারা পৃথিবী আমাদের রিফিউজি কলোনি হিসাবে চিহ্নিত করত!

“এখন ইকোল্যাণ্ডে বিজ্ঞানচর্চা তথা গবেষণাকে শ্রেষ্ঠ পেশা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সব পেশার মানুষ এদেশে থাকলেও বিজ্ঞানীদের সম্মান এখানে সবথেকে বেশি। বিগত পঞ্চাশ বছরে এই দেশ ডঃ গার্সিয়া ছাড়া অন্যান্য বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার দ্বারাও সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ডঃ গার্সিয়ার ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনাই ছিল এই দেশ বদলের প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ। তাই ডঃ গার্সিয়াকেই মানা হয় এই দেশের ‘ফাদার অফ দ্য নেশন’ হিসাবে।

“তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও দেশের রাজধানী গ্রিন সিটির ঠিক মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর আবক্ষ প্রতিকৃতি, যাকে দেখে বারবার শ্রদ্ধায় আনত হন সমস্ত ইকোল্যাণ্ডবাসি।”

আমার বলা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঈশির চোখগুলো বড় বড় হয়ে আছে তখনও। হয়তো ও কিছু বলত, কিন্তু তার আগেই টের পেলাম কাঁপতে শুরু করেছে আমার পাজামার পকেটে রাখা মোবাইলটা।

এই মোবাইলটা থেকে কেবল ‘নসরি’ থেকেই অ্যালার্ট আসে। পকেট থেকে সেটা বার করে অন করতেই স্ক্রিনে ফুটে উঠল একটা গোপন কোড। এই কোড আমি, নাসের আর বেঞ্জামিন ছাড়া আর কেউ জানে না।

কোডটা দেখে চঞ্চল হয়ে উঠলাম আমি।

ফোন লাগালাম নাসেরকে!

ইকোল্যাণ্ডের ঝাঁ চকচকে রাস্তার বুক চিরে আমাদের চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় ছোট্ট গাড়িটা ছুটে যাচ্ছিল ঝড়ের গতিতে। ভিতরে যাত্রী বলতে আমি আর নাসের। দুজনেই বসেছিলাম চুপচাপ। মুখে কিছু না বললেও বুকের ভিতরে একনাগাড়ে হয়ে চলা হালকা ধুকপুকানিটাকে অনুভব করতে পারছিলাম বেশ ভাল করেই। নাসেরের অবস্থাও যে আমার মত সেটা বলে দিচ্ছিল ওর চোখ মুখই। আর তা হবে নাই বা কেন? কত আশা নিয়ে আমরা বানিয়েছিলাম জীবককে। সেই জীবক আজ ডঃ দ্যানিয়েল গার্সিয়ার অসমাপ্ত গবেষণাটির প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ করেছে নিজের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।

আর কিছুক্ষণ পরেই সে তার ফলাফল জানাবে আমাদের।

এখানে বলে রাখা ভাল যে কিছুক্ষণ আগে আমার মোবাইলে যে গোপন কোডটা এসেছিল, সেটার প্রেরক জীবক। যেহেতু এই গবেষণার হেড আমি, তাই জীবক আমাকেই পাঠিয়েছিল মেসেজটা। আমাদের গন্তব্য এখন নসরির গোপন ল্যাবরেটরি, যেখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে জীবক। জীবক আমার এবং নাসেরের অক্লান্ত পরিশ্রম তথা প্রচেষ্টার ফল। নতুন নতুন তথা যুক্তিযুক্ত চিন্তাভাবনাগুলো সবসময় কদর পায় ইকোল্যান্ডের বিজ্ঞানী মহলের কাছে। আর ঠিক সেই কারণেই বয়সে নবীন হলেও পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশগুলোকে পিছনে ফেলে ইকোল্যাণ্ড এখন বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে এখন পথ দেখাচ্ছে সারা বিশ্বকে।

পেশার দিক থেকে দেখতে গেলে আমি ডঃ গার্সিয়ার উত্তরসূরি। আসলে ইকোল্যাণ্ডে যেসব মানুষ বিজ্ঞানের সাধনা করেন, সে যে শাখারই হোক না কেন, সবাই নিজেকে পরিচয় দেন ডঃ গার্সিয়ার উত্তরসূরি হিসাবেই। বিজ্ঞানী হলেও আমি ডঃ গার্সিয়ার মত পরিবেশবিদ নই। আমি বিষয় হিউম্যান ফিজিওলজি। সঙ্গে পড়াশুনা করেছি এ আই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স নিয়েও। তবে আমি প্রধানত কাজ করি মানুষের শরীরের নানারকম জটিল প্রক্রিয়া নিয়ে। স্কুল জীবনের শেষ দিকে গবেষণার প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম ডঃ গার্সিয়াকে দেখেই। জীবদ্দশায় তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তারপর দশ বছর আগে আমার কেরিয়ারের প্রথম দিককার এক সকালবেলায় পেয়েছিলাম সেই মর্মান্তিক খবরটা।

গতকাল রাতে হঠাৎ একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক কেড়ে নিয়েছে ডঃ গার্সিয়ার প্রাণ!

প্রবাদপ্রতিম সেই মানুষটা শেষ করে যেতে পারেননি তাঁর গবেষণা!

ডঃ গার্সিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর পর থমকে গিয়েছিল তাঁর গবেষণা। সেই সময় একটা নতুন চিন্তা পেয়ে বসেছিল আমায়। আমরা তো কতকিছু সংরক্ষণ করি। বাধ্য হয়েই তো মানুষ এখন উঠেপড়ে লেগেছে বনভূমি সংরক্ষণ করার জন্যে। ঠিক এইভাবেই যদি মৃত্যুর পরেও সংরক্ষণ করে রাখা যায় কোনও মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং তাঁর গবেষণালব্ধ স্মৃতিকে!

তখন সেই বুদ্ধিমত্তা মানুষটির অনুপস্থিতিতেও অনায়াসে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে তার ফেলে যাওয়া গবেষণাটিকে।

ডঃ গার্সিয়া বা তাঁর সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা যদি একথা ভাবতেন তাহলে মৃত্যুর পর থমকে যেত না তাঁর অসম্পূর্ণ গবেষণা!

মানুষের মস্তিষ্ক সবসময়েই ছিল আমার আগ্রহের জায়গা। তার উপর এ. আই. নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেছিলাম কয়েকদিন আগে। নিজের চিন্তাভাবনাগুলোকে যতটা সম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে গবেষণার একটা সম্ভাব্য রূপরেখা আমি মেইল করেছিলাম ‘ন্যাশানাল অর্গানশজেশন ফর সাইন্টিফিক রিসার্চ অ্যান্ড ইনভেনশন’ বা ‘নসরি’-এর চিফ ডঃ বেঞ্জামিনের কাছে। বলা বাহুল্য আমার চিন্তাভাবনাগুলোকে ট্রাশ বলে মনে করেননি ডঃ গার্সিয়ার যোগ্য শিষ্যটি। বরং আমাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্যে।

দেশেজুড়ে চলা সমস্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলোকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার জন্যে দু’হাজার পঞ্চাশ সালে ‘ন্যাশানাল অর্গানাশজেশন ফর সাইন্টিফিক রিসার্চ অ্যান্ড ইনভেনশন’-এর গোড়াপত্তন করেছিলেন ডঃ গার্সিয়া। সেখান ডাক পাওয়া ছিল আমার কাছে স্বপ্নের মত। নটা-পাঁচটার কলেজে পড়ানোর একঘেয়ে বিরক্তিকর কাজটা ছেড়ে যোগ দিয়েছিলাম নতুন চাকরিতে। বছরখানেক পরেই বুঝতে পেরেছিলাম একদম সঠিক রাস্তায় এগোচ্ছে আমার কাজ। ততদিনে আমি তৈরি করে ফেলেছি জীবকের মস্তিষ্কের প্রাথমিক খসড়া।

আমার কাজ পরিচিত বিজ্ঞানী মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ইকোল্যাণ্ডের সব বিজ্ঞানীরা একটা ব্যাপার ভীষণভাবে মেনে চলেন। যতদিন না তাঁদের গবেষণা সফলতার মুখ দেখছে, ততদিন তাঁরা সেটাকে নিয়ে আসেন না বাইরের পৃথিবীর সামনে। ইকোল্যাণ্ডের প্রতিটি বিজ্ঞানী তথা মন্ত্রীসভা বিশ্বাস করেন এই গোপনীয়তায়। আমরা কখনই চাই না আমাদের কষ্টার্জিত গবেষণার ফল অসৎ উপায়ে ভোগ করুক বাকি পৃথিবী।

দেশের এই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে বাইরের পৃথিবী প্রকাশ্যে কিছু জানতে বা বলতে পারে না। কিন্তু ইউরোপ এবং আমেরিকার যুগ্ম উদ্যোগে তৈরি গোপন ইন্টালিজেন্স সংস্থা ‘ইউরোপিয়ান আমেরিকান সিক্রেট ইন্টালিজেন্স ব্যুরো’ বা ‘ইএএসআইবি’, যা প্রধানত বিশ্ব জুড়ে চলা জঙ্গী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ চালায়, তারা যে গোপনে আমাদের সমস্ত গবেষণার উপর নজরদারি করার চেষ্টা করে, তা অজানা নয় এই দেশের বিজ্ঞানী তথা মন্ত্রীদের। তবে জন্মলগ্ন থেকে গত কুড়ি বছর ক্রমাগত চেষ্টা করলেও আজ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি তারা। এর জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য এই দেশের সাইবার বিজ্ঞানীদের। সাইবার নিরাপত্তাকে তাঁরা এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে হাজার চেষ্টা করেও ‘ইএএসআইবি’ ক্র্যাক করতে পারেনি আমাদের গোপন কোডগুলো।

খুব গোপনেই এগোচ্ছিল আমার কাজ। আর এই কাজে আমার সহযোদ্ধা হিসাবে পেয়েছিলাম আমারই জুনিয়র নাসের আহমেদকে। তাছাড়াও আমাদের কাজে সাহায্য করার জন্যে ‘নসরি’-র পক্ষ থেকে পেয়েছিলাম দু’জন অ্যান্ড্রয়েডকে, যাদের নাম আমরা দিয়েছিলাম অরুন্ধতী আর সৌহার্দ্য।

তবে শুধু নাসের আর ওই দু’জন যন্ত্রমানব নয়, আমাদের কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশের সমস্ত তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরাও। এদের মধ্যে ছিলেন ডঃ ব্যাঙ্কো সোয়াইঙ্কা, তেমনই বিশিষ্ট পদার্থবিদ ডঃ জিমি আর্থার, বাঙালি উদ্ভিদবিদ ডঃ সুমন্ত সাঁতরা সহ আরও অনেকে যারা এই কাজ করে চলেছেন কোনও নতুন কোনও কিছু আবিষ্কারের জন্যে। আসলে আমরা জীবককে বানাতে চেয়েছিলাম দেশের সেরা বিজ্ঞানীদের বুদ্ধিমত্তা তথা মেধার আধার হিসাবে, যাতে তাঁদের কারুর অকস্মাৎ মৃত্যু হলে বা কর্মক্ষমতা হারিয়ে গেলেও থেমে না যায় গবেষণার কাজ।

আর সেইজন্যেই তাঁদের আইকিউ তথা গবেষণালব্ধ স্মৃতিকে ছেঁকে তুলে এনে বন্দি করেছিলাম ‘দ্য ব্রেইন অফ জীবক’ নামক একটি হার্ডডিস্কে।

তবে শুধু বর্তমানকেই নয়, অতীতে ইকোল্যাণ্ডে হওয়া সমস্ত গবেষণার কাজকেও আমরা রেখে দিয়েছি জীবকের মস্তিষ্কে, যার মধ্যে রয়েছে ডঃ গার্সিয়ার অসমাপ্ত কাজটাও। যদি কোনওদিন প্রয়োজন পড়ে, জীবকের কৃত্রিম আইকিউকে কাজে লাগিয়ে আমরা কিছু পরিবর্তন করতে পারব সেইসব গবেষণায়। বলা তো যায় না সেখান থেকেই হয়তো উঠে আসবে নতুন কোনও আবিষ্কার।

এই কাজ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের দেওয়া একটা চুক্তিপত্রে সই করতে হয়েছিল আমাকে আর নাসেরকে। সবার গবেষণার তথ্য আমাদের হাতে এলেও আমরা যেমন তার কোনও অপব্যবহার করতে পারব না, তেমনই সেগুলোকে কখনও তুলে দিতে পারব না কোনও বিদেশী শক্তির হাতে। এই চুক্তি ভঙ্গ করলে আমাদের দাঁড়াতে হবে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি। সেনাবাহিনীর অ্যান্ড্রয়েড অথবা সেনারাই তাদের অত্যধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে আমাদের শরীর। তার পাশাপাশি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হবে আমার এই গবেষণার কাজ এবং নষ্ট করে দেওয়া হবে গবেষণা সংক্রান্ত সমস্ত নথি।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে পৃথিবীর সমস্ত গোপন ডেটাবেসের উপর নজরদারি করার জন্যে কিন্তু ‘নসরি’-র হাতে আছে এক গোপন সফটওয়্যার। দেশের নিরাপত্তার জন্যেই ডঃ হাডসনের তৈরি এই সফটওয়্যারটাকে কখনও গবেষণাগারের বাইরে নিয়ে আসেনি ‘নসরি’।

ঘ্যাচ করে ব্রেক মেরে আমাদের গাড়িটা নিজে থেকেই দাঁড়িয়ে গেল ‘নসরি’-র গেটের সামনে। গ্রিনসিটির পশ্চিম দিকে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে গড়ে উঠেছে এই গবেষণাগার। লম্বায় প্রায় পাঁচশো মিটার দোতলা এই গবেষণাগারটির চতুর্দিক দিক লেসার দ্বারা সুরক্ষিত। লেসারের প্রাচীর টপকে ভিতরে ঢুকতে গেলে মৃত্যু অবধারিত। গবেষণাগারের পিছন দিকে রয়েছে সমুদ্র। ‘নসরি’-র নিরাপত্তার ভার দেওয়া আছে ইকোল্যাণ্ডের সেনাবাহিনীর হাতে। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সেই বাহিনী জল, স্থল বা আকাশ যে পথেই আক্রমণ হোক না কেন রক্ষা করতে সক্ষম দেশের এই প্রাণকেন্দ্রটিকে।

নসরির মূল ফটকের সামনে পাহারা দিচ্ছিল জেনিফার। খালি চোখে দেখে তাকে হলিউড ফিল্মের হিরোইন বলে মনে হলেও, সে আসলে সেনাবাহিনীর জন্যে নির্মিত এক অ্যান্ড্রয়েড। মুখে সবসময় মিষ্টি হাসি লেগে থাকলেও, সমস্ত যুদ্ধবিদ্যায় সে অত্যন্ত পারদর্শী। যে কোনওরকম আক্রমণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তুত সব সময়। যে কোনও আপদকালীন পরিস্থিতিতে তার পেট থেকে বেরিয়ে আসবে অত্যাধুনিক মেশিনগান যা ঝাঁঝরা করে দিতে সক্ষম সামনে থাকা যে কোনও কিছুকেই।

আমাদের গাড়িটা দেখে আরও একটু চওড়া হল জেনিফারের মুখের হাসিটা। তার আঙুলের আলতো ছোঁয়াতেই খুলে গেল ‘নসরি’-র গেট। গাড়িটা আমাদের নিয়ে নসরির মূল ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢুকতে সময় নিল আরও কয়েক সেকেণ্ড। তারপর ‘নসরি’-র বিল্ডিঙয়ের সামনে আমাদের নামিয়ে দিয়ে নিজেই চলে গেল আণ্ডারগ্রাউণ্ড পার্কিঙের দিকে।

মূল গবেষণাগারের সামনেই রয়েছে একটা বুলেটপ্রুফ কাঁচের স্বয়ংক্রিয় দরজা। দরজাটায় সেন্সর লাগানো। বাইরে থেকে দেখা না গেলেও নসরির বিজ্ঞানীদের শরীরেও, মানে বাম হাতে কনুইয়ের একটু নিচে ইমপ্ল্যান্ট করা রয়েছে আর এক ধরণের সেন্সর। ‘নসরি’-তে জয়েন করার পর লোকাল অ্যানেস্থসিয়ার সাহায্যে চামড়ায় ছোট্ট একটা ফুটো করে মাংসপেশীর উপর বসিয়ে দেওয়া হয় সেন্সরটাকে। কোনওভাবে নসরির চাকরি ছাড়লে আবার খুলে দিয়ে যেতে হয় এই সেন্সরকে। কেউ অবশ্য খুলে না দিলেও যে খুব একটা ক্ষতি হবে তা নয়। ‘নসরি’র বাউন্ডারির বাইরে কোনওভাবেই কাজ করে না এই সেন্সর। তার উপর কেউ যদি সাতদিন একটানা এখানে না আসে তাহলে নিজে থেকেই অকেজো হয়ে যায় যন্ত্রটা। তারপর আবার ভিতরে ঢুকতে গেলে নতুন করে রিঅ্যাকটিভেট করতে হয় তাকে। তাছাড়া খুলে না নিলেও হাতে বসানো সেন্সরটি আবার চলে যতক্ষণ আমাদের হৃদপিণ্ডটি সচল থাকে ততক্ষণই। প্রতিটি সেন্সর ডিজাইন করা হয় আলাদা আলাদাভাবে। একজন বিজ্ঞানী কর্মরত অবস্থাতে মারা গেলেও নিজে থেকেই কাজ করা বন্ধ করে দেয় ওই সেন্সর।

বিল্ডিঙয়ের দরজায় লাগানো সেন্সর হাতের সেনরটাকে সেন্স করতে পারলেই সবুজ হয়ে যায় দরজার মাথায় লাগানো লাল রঙের আলোটা। তারপর স্লাইডিং দরজাটা নিজে থেকেই সরে যায় একপাশে। প্রতিদিনের মত দরজাটা একপাশে সরে যাওয়ার পরেই আমাদের কানে এল পরিচিত যান্ত্রিক নারী কন্ঠস্বর, “গুড মর্নিং। ওয়েলকাম টু নসরি।”

‘নসরি’-র কাজ বন্ধ হয় না দিনের কোনও সময়েই। একমাত্র রবিবার এবং ন্যাশনাল হলিডে, মানে ডঃ গার্সিয়ার জন্মদিন তেইশে জানুয়ারী ছাড়া বাকি সবদিন চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ চলে এই গবেষণাগারে। ধর্মীয় উৎসবগুলোতে সংশ্লিষ্ট ধর্মের মানুষদের ইচ্ছাতে বিশেষ ছুটি অনুমোদন করা হলেও কিন্তু থেমে থাকে না ‘নসরি’-র কর্মযজ্ঞ। বিশাল এই কর্মকাণ্ডের ভার মানুষের পাশাপাশি তুলে দেওয়া হয়েছে অরুন্ধতি বা সৌহার্দ্যর মত অসংখ্য অ্যান্ড্রয়েডদের হাতেও। মানুষের কাজে সাহায্য করলেও তাদের সংখ্যা কিন্তু ‘নসরি’-তে কর্মরত মানুষের কয়েকগুণ। তবে সারাদিন অক্লান্তভাবে কাজ চললেও ‘নসরি’-র ভিতরে বিরাজ করে পিন পতন নিস্তব্ধতা। ‘নসরি’ তথা ইকোল্যাণ্ডে এটাই পরিচিত ছবি। মনের অনিয়ন্ত্রিত আবেগকে মুঠোবন্দি করতে আমরা শিখে গিয়েছিলাম অনেক আগেই।

আর হ্যাঁ, এই অ্যান্ড্রয়েডোদেরও কিন্তু আমরা তৈরি করেছিলাম আবেগবিহীন যন্ত্রমানব হিসাবেই।

যাই হোক, ভিতর ঢোকার পর আমি আর নাসের সোজা এসে হাজির হলাম আমাদের জন্যে নির্দিষ্ট রুমে। রুমটা বিল্ডিঙয়ের একতলায়। সমুদ্রের দিকে মুখ করে। রুমের একটা দেওয়াল জুড়ে আছে এক বিশাল স্ক্রিন যা হার মানাবে মাল্টিপ্লেক্সের স্ক্রিনকেও। গবেষণা সংক্রান্ত যে কোনও ডিজিটাল ডিসপ্লে ফুটে ওঠে ওই সাদা রঙের স্ক্রিনে। জীবকের ভারচুয়াল মস্তিষ্কটি তৈরি করার সময় আমি আর নাসের দু’জনেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতাম এই স্ক্রীনের সামনে বসে।

ইকোল্যাণ্ডের বাকি বৈজ্ঞানিক গবেষণার মত আমাদের গবেষণাও অত্যন্ত গোপনে হলেও ঘরটায় কিন্তু রয়েছে দুটো বিশাল জানলা। ঘরে ঢুকেই আমি খুলে দিলাম সেই জানলাদুটোকে। জানলার ওপারেই রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের। রুমের ভিতর থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় পাড়ের কাছে এসে ভেঙে পড়া ঢেউগুলোকে। বিশাল সমুদ্র যা একদিন ধ্বংস করে দিয়েছিল আমাদের পৈতৃক বাসভিটে, সেই যেন এখানে বাধ্য ছেলের মত ধুইয়ে দিচ্ছে তার আপন সন্তানেরই চরণ। কাজ করতে করতে যখন মাথা ব্লক হয়ে যেত তখন আমি আর নাসের সোজা তাকিয়ে থাকতাম বাইরের দিকে। সমুদ্রের বিশালতা আর তার নিরবিচ্ছিন গর্জনের সামনে বসে শান্ত হয়ে আসত আমাদের মন। নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে অসুবিধা হত না কোনও।

তবে শুধু সমুদ্র দেখার জন্যে নয়, প্রতিদিন রুমে এসে আমরা আমাদের জানলা খোলার একটা অন্য উদ্দেশও আছে। ঘরের মধ্যে থাকা ওকের দুটো বনসাইকে বাইরের আলো খাওয়ানো, যাতে রাতে কাজ করতে কোনও সমস্যা না হয় আমাদের। জীবককে তৈরি করতে গিয়ে আমরা দু’জন যে কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।

জানলাগুলো খুলে দিয়ে আমরা দু’জন বসে পড়লাম ঘরের সেই জায়ান্ট স্ক্রীনের সামনে রাখা আমাদের জন্যে নির্দিষ্ট রিভলভিং চেয়ারে। চেয়ার দুটোর সামনে রয়েছে দুটো টেবিল। সেই দুটো টেবিলে আবার রাখা আছে দুটো কি বোর্ড, যারা সক্রিয় হয় শুধুমাত্র আমার আর নাসেরের আঙুলের ছোঁয়া পেলেই। এও সেই সেন্সরেরই খেল। দুপুরে বড় কাজ থাকলেও এই মুহূর্তে আর কোনও প্রয়োজন নেই বলেই আমরা বিশ্রাম দিয়েছিলাম আমাদের দুই অ্যান্ড্রয়েড সহযোগী অরুন্ধতী আর সৌহার্দ্যকে। আমার জন্যে নির্দিষ্ট কিবোর্ডে একটা চার সংখ্যার পিন এন্টার করতেই আস্তে আস্তে কালো হয়ে গেল স্ক্রীনটা। কিন্তু তারপরেই ধীরে ধীরে হালকা সবুজ হতে থাকল সেটা।

অন্য অ্যান্ড্রয়েডদের মত এখনও জীবকের কোনও শরীর বানাইনি আমরা। চাইলেই সেটা বানানো যাবে। কিন্তু জীবকের মধ্যে আমরা অর্পিত করেছি আর একটা ক্ষমতা। গবেষণার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সে চিন্তা করতে পারে। কর্মরত মানুষ বা অ্যান্ড্রয়েডটিকে দিতে পারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ।

জীবককে অপারেট করার জন্যে যে শুধু পাসওয়ার্ডেরই দরকার তাই শুধু নয়, জীবকের মস্তিষ্কে বসানো আছে আরও একটা সেন্সর যা সেন্স করে আমাদের বামহাতে বসানো সেন্সরটিকেও। এছাড়াও রয়েছে ফেস রিকগনেশনের ব্যবস্থাও। এই ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা পার করতে পারলেই তবে অপারেট করা যায় জীবককে।

এতটা পড়ে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে জীবককে ঠিক কতটা নিরাপত্তায় মুড়ে দিয়েছি আমরা। বাইরের কোনও মানুষের সামনে সে পড়ে থাকবে কোনও খেলনার মতই। সবথেকে বড় কথা ‘নসরি’-র গোপন ডেটাবেসে লুকিয়ে থাকা জীবকের সফটওয়্যারের হদিশই পাবে না বাইরের পৃথিবীর হ্যাকাররা। প্রযুক্তির দিক থেকে বাইরের পৃথিবীর হ্যাকারদের থেকে যে ইকোল্যাণ্ডের বিজ্ঞানীরা অনেকটাই এগিয়ে, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আগেই বলেছি যে দেশের সমস্ত বিজ্ঞানীদের আইকিউ তথা গবেষণার স্মৃতি ধরা আছে জীবকের জায়ান্ট ব্রেনে। অপারেটরের নির্দেশ অনুসারে সেগুলো সে ডেমন্সট্রেট করবে সমস্ত প্রয়োজনীয় ডেটা। শুধু বর্তমান নয়, এদেশে অতীতে হওয়া সমস্ত গবেষণার ডিটেলও আমরা দিয়ে রেখেছি জীবককে, যার মধ্যে আছে ডঃ গার্সিয়ার অসমাপ্ত গবেষণাটিও। জীবককে নিয়ে প্রথম যে পরীক্ষামূলক কাজে আমরা হাত দিয়েছি সেটা হল ডঃ গার্সিয়ার অসমাপ্ত গবেষণাটাকে সমাপ্ত করা। এই কাজ করতে গিয়ে জীবকের আইকিউ সেট করতে হয়েছে একশো পঁয়তাল্লিশে, যা হল ডঃ গারসিয়ার সমান।

এখানে বলে রাখা ভাল যে ডঃ গার্সিয়া তাঁর শেষ গবেষণাটির প্রথম ধাপের একটা প্রাথমিক খসড়া ছাড়া আর কিছুই তৈরি করে যেতে পারেননি। তাই তাঁর এই কাজটিকে সেভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি অন্য কেউই। কিন্তু আমাদের পথ দেখিয়েছিল জীবকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মাস তিনেক সময় নিয়ে জীবক শেষ করেছে ডঃ গার্সিয়ার গবেষণার প্রথম ধাপ। এই তিনমাস সময়ে আমি, নাসের এবং আমাদের দুই অ্যান্ড্রয়েড সৌহার্দ্য এবং অরুন্ধুতি কাজ করে গিয়েছি জীবকের নির্দেশ অনুসারে। এই কাজে ব্যবহৃত হয়েছে গার্সিয়ান ইকোল্যাণ্ডিয়ার জেনেটিক কোডও। সেখানে ডঃ গার্সিয়ার প্রাথমিক চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে জীবকের নির্দেশে ঘটানো হয়েছে নতুন ধরণের অভিযোজনও। কিন্তু এতকিছুর পরেও আজ জীবক এখনও অবধি আমাদের যা দিয়েছে তাকে গবেষণালব্ধ ফলাফল বলা চলে না কিছুতেই। অভিযোজনের মূল কাজটা শেষ হয়ে গেলেও আসল গবেষণা বাকি আছে এখনও। জীবক আমাদের জানিয়েছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দেওয়ার জন্যে গার্সিয়ান ইকোল্যাণ্ডিয়ার এই অভিযোজিত প্রজাতিটিকে প্রথমে প্রবেশ করাতে হবে একটি পুরুষ এবং একটি নারী শিম্পাঞ্জীর শরীরে। সেখানে সফল হলেই তা প্রবেশ করানো হবে মানুষের শরীরে।

আজ জীবক আমাদের জানাবে কিভাবে কতটা মাত্রায় গার্সিয়ান ইকোল্যাণ্ডিয়ার এই নতুন প্রজাতিটিকে প্রবেশ করাতে হবে শিম্পাঞ্জী তথা মানুষের শরীরে।

সেই তথ্য হাতে পেলেই এদেশের বিশিষ্ট জুলজিস্ট ডঃ নরেশ মাহাতোকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ইকোল্যাণ্ডিয়া গার্সিয়ার এই নতুন প্রজাতিটিকে প্রবেশ করাবো আমাদের দেশের মধ্যভাগের বনাঞ্চল থেকে অতি সঙ্গোপনে আটক করে আনা দুই প্রবীণ শিম্পাঞ্জির শরীরে, যারা বন্দী আছে ‘নসরি’-রই এক গোপন কক্ষে। সে ঘরে সূর্যের আলো প্রবেশ করলেও কোনও মানুষের প্রবেশ নিষেধ। ওদের পাহারা দেয় চারজন অ্যান্ড্রয়েড।

সবুজ হয়ে গেছে পুরো স্ক্রীনটা। কি বোর্ডে আরও একটা পাসওয়ার্ড টাইপ করতেই এবার স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠল আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই ফলাফল। সেটা পড়তে যাব, এমন সময় কেউ বাইরে থেকে নক করল আমাদের দরজায়।

“এখন কে এল?”— একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ল নাসেরের কণ্ঠস্বরে। সত্যিই তো এই সময়ে এখানে আসার কথা নয় কারুর। অবাক হয়েছিলাম আমিও। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে এল আমাদেরই পরিচিত এক কণ্ঠস্বর, “কৌশিক, ওপেন দ্য ডোর। বেঞ্জামিন হিয়ার।”

ডঃ বেঞ্জামিন। ‘নসরি’-র অধিকর্তা। এখানে হয়ে চলা সমস্ত গবেষণার আপডেট নিয়মিত আমাদের জমা দিয়ে হয় ওকে। আমরা দু’জন আর নরেশ মাহাতো ছাড়া একমাত্র উনিই জানেন ঠিক কী কাজ আজ করতে চলেছি আমরা। ভদ্রলোকের গলা শুনে আশ্বস্ত হলেও অবাক ভাবটা কাটছিল না আমাদের। এই সময়ে এখানে আসা তো ‘নসরি’-র প্রটোকলের মধ্য পড়ে না! কিন্তু অধিকর্তা বলে কথা। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম আমি।

“আমিও দেখতে চাই জীবক আজ কী দেখাচ্ছে?” আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলেন বেঞ্জামিন। দেখলাম পিছনে দাঁড়িয়ে ওর দুই অ্যান্ড্রয়েড মার্কো আর এলিনা। ওরাও হাসল আমার দিকে তাকিয়ে হাসল ওরা। প্রত্যুত্তরে একটা হালকা হাসি আমি ‍ফিরিয়ে দিলাম ওদের দিকে, “প্লিজ কাম ইনসাইড।”

ওরা ঘরে ঢোকার পর দরজাটা বন্ধ করে দিলাম আমি। ঘরের মধ্যে রয়েছে একটি অতিরিক্ত রিভলভিং চেয়ার। বেঞ্জামিনের উদ্দেশে সেটা এগিয়ে দিল এলিনা। বেঞ্জামিন চেয়ারটায় বসার পর আমরা তিনজন তাকালাম জীবকের জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে। এক এক করে সব প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে জীবক। ছবির মত আমাদের সামনে ফুটে উঠছে ঠিক কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের কাজকে।

প্রচণ্ড গর্বে ক্রমশ চওড়া হচ্ছিল আমার বুকের ছাতি। আমরা যদি সফল হই, তাহলে পৃথিবীর বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম সেরা আবিষ্কার হিসাবে লেখা থাকবে ডঃ গার্সিয়ার এই অসমাপ্ত গবেষণাটি। সঙ্গে সারা পৃথিবীর কাছে মান্যতা পাবে আমাদের এই নতুন আবিষ্কার জীবক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে তো এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে চলে গেছি আমরাই।

ডঃ বেঞ্জামিনও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন জীবকের স্ক্রিনের দিকে। তাঁর চোখ মুখে বিস্ময় আর মুগ্ধতা। কিন্তু জীবকে ডেমন্ট্রেশন শেষ হওয়ার পরেই কোনও ভণিতা না করেই একটা একটা অদ্ভুত কথা বলে উঠলেন তিনি, “আই ওয়ান্ট দিস চিপ কৌশিক। বাকি রিসার্চটা আমি শেষ করব।”

চমকে উঠলাম বেঞ্জামিনের কথা শুনে। এ আবার কী কথা বলছেন বেঞ্জামিন! এ কথা তো ‘নসরি’-র প্রটোকলে নেই। অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা না ‍হারিয়ে ফেললে, গবেষণারত বিজ্ঞানীর মৃত্যু না হলে অথবা তিনি বড় কোনও অন্যায় না করে ফেললে গবেষণার হাতবদল তো এই দেশের নীতির বিরুদ্ধে!

“এটা আপনি কী বলছেন ডঃ বেঞ্জামিন?”— এবার মুখ খুলল নাসের। ওর কথা শুনে সামান্য হাসলেন ডঃ বেঞ্জামিন, “ইয়েস নাসের, আমি ঠিকই বলছি। এই যে আমরা এত পরিশ্রম করে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তার বিনিময়ে কী পাই? সামান্য কটা টাকা। আর ইউরোপ, এশিয়া, আমেরিকাতে কিছু লোক শুধু ব্যবসা করেই কোটি কোটি ডলারের মালিক হয়ে গেছে। আর আমরা, যারা তাদের জন্যে টেকনোলজি বানাচ্ছি, তারাই হলাম গিয়ে ভিখারি।”

মুখে একটা বিকৃত ভঙ্গি করলেন ডঃ বেঞ্জামিন। ইকোল্যাণ্ডের সবথেকে সম্মানীয় ব্যক্তিটির মুখে এই কথা শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি। ডঃ বেঞ্জামিন বললেন, “কৌশিক আর নাসের, মন দিয়ে শোন। যা বলছি সেটা শুনলে তোমরা এক নিমেষে কোটিপতি হয়ে যাবে। সেই টাকায় শুধু তুমি কেন, তোমার বংশধরেরাও বসে বসে খেয়ে যেতে পারবে কয়েক প্রজন্ম জুড়ে। পৃথিবীর সব সুখ ধরা দেবে তোমাদের হাতে। কিন্তু তার জন্যে আমার কথা শুনতে হবে তোমাদের।”

“কী বলছেন ডঃ বেঞ্জামিন?”— আমার মুখ ফুটে কোনও কথা না বেরলেও মুখ খুলল নাসের।

“ঠিকই বলছি নাসের। খুব মন দিয়ে তুমি আর কৌশিক আমার কথা শোন। এদেশের কেউ জানে না, কিন্তু মার্কো আর এলিনাকে নিয়ে একটা খুব গোপন প্রজেক্টে হাত দিয়েছিলাম আমি। তোমরা তো দূর অস্ত, দেশের সরকারও জানে না এই প্রজেক্টের কথা। আমি কৃত্রিমভাবে তৈরি করে ফেলেছি ইকোল্যাণ্ডিয়াকে। আর সেই ফর্মুলা গোপনে এদেশের চিফ সাইবার বিজ্ঞানী আকিওর সাহায্যে বিক্রি করে দিয়েছি ‘ইএএসআইবি’-এর কাছে। ইউরোপে আমার আর আকিওর দুটো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত আছে সেই টাকা।”

‘ইএএসআইবি’— মানে ইউরোপ আর আমেরিকার যৌথ ইন্টালিজেন্স ব্যুরো! আকাশ ভেঙে পড়ছিল আমার মাথার উপর। শুধু বেঞ্জামিন নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আকিও-ও। কিন্তু বেঞ্জামিন নির্বিকার, “এখন চয়েস আছে তোমাদের হাতে। আমি চাই এই আবিষ্কারটাকেও গোপনে ‘ইএএসআইবি’-এর হাতে তুলে দিতে। এখন পর্যন্ত জীবক যে ডেটা দিয়েছে সেটাকে আমরা শিম্পাঞ্জিদের উপর প্রয়োগ করে দেখে নেব সফল হল কিনা? যদি হয়, তাহলে ইকোল্যাণ্ডের নিয়ম মেনেই সেন্ট্রাল জেলে বন্দি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনও দুজন নারী-পুরুষকে আমরা তুলে নেব গবেষণার স্বার্থে। কিন্তু সেই গবেষণা দেশের বাকি গবেষণার মতই হবে অত্যন্ত গোপনে। ওদের শরীরে প্রয়োগ করার পর যদি দেখা যায় আমাদের ট্রায়াল সফল তাহলে, আর একবার আকিওর সাহায্য নিয়ে আমরা এই ফর্মুলাটাকেও তুলে দেব ‘ইএএসআইবি’-এর হাতে। অন্যদিকে মার্কো নিজের হাতেই মেরে ফেলবে ওই দুজন মানুষকে। আর আমরা রটিয়ে দেব ব্যর্থ হয়েছে আমাদের গবেষণা। ইকোল্যাণ্ডিয়ার এই প্রজাতি মানব শরীরের উপযুক্ত নয়। আর দু’জন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট নিয়ে যে দেশের সরকার তথা জনগণের কোনও মাথাব্যথা নেই তা তো তোমরা জান। আকিও তো আগেই হাত মিলিয়েছিল, তোমাদেরকে বলে রাখি দেশের চিফ ফরেনসিক স্পেশালিস্ট ডঃ ঈশিয়াস খানও রয়েছে আমাদের সঙ্গেই। কাজেই আমাদের কাজে খুব একটা অসুবিধা হবে না কখনই। এছাড়াও নরেশও রয়েছে আমারদের সঙ্গে। কাজটার জন্যে ‘ইএএসআইবি’ আমাদের যে টাকা দেবে সেটাই হয়ে জমা পড়বে ইউরোপের একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। সেই টাকার পরিমাণটা শুনে রাখ। হ্যান্ড্রেড বিলিয়ন মার্কিন ডলার! প্রত্যেকের! সাথে ইউরোপ আর আমেরিকার নাগরিত্ব। যখন খুশি চাইবে, চলে যেতে পারবে সেখানে। সেখানকার সমস্ত দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক মর্যাদা পাবে। আর তোমরা তো জানোই, ইকোল্যাণ্ডের বাসিন্দা হলেও ডুয়েল সিটিজেনশিপ তো অনায়াসে পেতে পারি আমরা।”

“এসব আপনি কী বলছেন ডঃ বেঞ্জামিন? যে দেশটা এতদিন আমাদের থাকতে দিল, পড়তে দিল, এত সম্মান দিল তার সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করব?” আরও একবার মুখ খুলল নাসের, “টাকার জন্যে এই হীন কাজটা আমি অন্তত করতে পারব না। আমার বিশ্বাস কৌশিকও পারবেন না।”

“আমিও পারব না।”— নাসের থামতেই চিৎকার করে উঠলাম আমি, “এটা কিছুতেই হতে দেব না।”

“দেখ কৌশিক,” ফের বলে উঠল বেঞ্জামিন, “তোমাদের এই কাজ করতেই হবে। কারণ তোমরা অলরেডি ফাঁদে পড়ে গেছ। এখানে ঢোকার সময়েই তো তোমরা জ্যামারের আওতায় পড়ে গেছ। যতই চেষ্টা কর কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারবে না কারুর সঙ্গে। আমার কথা না মানলে তোমাদের শরীরে ইনজেক্ট করা হবে মিসিকিউলিয়াম। আর তোমরা তো জানোই গোপনীয়তার স্বার্থে আমরা রুমের ভিতরে সিসিটিভি ব্যবহার করি না। কাজেই তোমাদের সঙ্গে কী হয়েছিল জানবে না কেউই। মার্কো আর এলিনাকে নিয়ে শুধু তোমাদের রুমেই নয়, বহুবার আমি বহু লোকের রুমে গেছি। কাজেই…”

“মিসিকিউলিয়াম!” চিৎকার করে উঠলাম আমি আর নাসের একসঙ্গে। এই দেশে মার্সি কিলিঙয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় এই ড্রাগ। পৃথিবীর অনেক ওষুধই পেইনলেস ডেথ ঘটাতে সক্ষম হলেও, এই ওষুধটা ইউনিক। রোগীর শরীরে ইনজেক্ট করার পর রোগীর স্মৃতি আস্তে আস্তে লুপ্ত হতে শুরু করে। কয়েকদিন বাদে যখন মৃত্যু এসে গ্রাস করে তাকে, তখন সে ভুলেই গেছে সে কে? এবং সে মারা যেতে চলেছে কিছুক্ষণ বা কিছুদিন পরেই।

বিছানায় শুয়ে থাকা অসুস্থ যে মানুষের জীবনের বহু বছর কেটেছে, তার জন্যে এই ওষুধ অমৃত হলেও মিসিকিউলিয়ামের নাম শুনে সরে গেল আমাদের পায়ের তলার মাটি। দেখলাম এলিনা তার ট্রাউজার্সের পকেট থেকে বার করে ফেলেছে দুটো সিরিঞ্জ। বেঞ্জামিন বলে উঠল, “ভেবে নাও তোমরা। ডলারের পরিমাণটা চাইলে আমরা দরাদরি করে বাড়াতেই পারি। আর মনে রেখ তোমরা মরে গেলে আমার কিন্তু কিচ্ছু হবে না। এমনিতেই শরীরটা খারাপ হওয়ার পর কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর মারা যাবে তোমরা। আর পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলবে ম্যাসিভ মায়োকার্ডিয়াল ইনফাকশন। হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্যেই মৃত্যু হয়েছে তোমাদের। ‘ইএএসআইবি’-এর হাত যার পাশে আছে তাকে ইকোল্যাণ্ড কিছুই করতে পারবে না।”

কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছিল আমাদের। দেখলাম এলিনা হাসিমুখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। পাশে মার্কো। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। হঠাৎ আমার কানের কাছে নাসের ফিসফিস করে বলে উঠল “কোড নাইনটি নাইন। ওটিএ।”

জীবককে বাঁচাতে এই গুপ্ত কোড নাসেরেরই তৈরি। কখনও যদি জীবকের ইন্টালিজেন্সের উপর অ্যাটাক হয়, তাহলে তার তথ্যকে এর মাধ্যমে পাচার করে দেওয়া যায় অন্যত্র, যাতে শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পায় সেই ডেটা। কিন্তু কোথায় সেই ডেটা ট্রান্সফার করা হবে তা নির্ভর করে অপারেটারের উপর।

বেশি কিছু ভাবার সময় ছিল না হাতে। এই বিপদের মধ্যেও নাসেরের প্রস্তাবটা যেন সবথেকে যুক্তিযুক্ত মনে হল আমার। আমি ঘাড় নাড়তেই কি বোর্ডের উপর ঝড়ের বেগে চলতে শুরু করে দিল নাসেরের আঙুলগুলো। সময় লাগল না এক সেকেণ্ডও। পুরনো সব লেখা মুছে গিয়ে জীবকের জায়ান্ট স্ক্রিনে ফুটে উঠল কোড নাইন্টি নাইন। নীচে ভেসে উঠল আর একটা লেখা, “ওপেন টু অল।”

এই গোপন কোডের কথা আমরা জানতে দিইনি বেঞ্জামিনকেও। ডঃ গার্সিয়ার গবেষণাকে বাঁচানোর শেষ অস্ত্রটা আমরা রেখে দিয়েছিলাম আমাদের জন্যে। কিন্তু সেটা যে এত দ্রুত ব্যবহার করতে হবে ভাবতে পারিনি কখনও। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে বেঞ্জামিনও বুঝতে পারল না কি হয়েছে। সে এখনও হাঁ করে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে। হিসহিস করে উঠল নাসের, “স্কাউন্ড্রেল এই তোমাদের লোভের শেষ। এই গবেষণার ফল এখন জেনে গেছে গোটা পৃথিবী। তারা এখন নিজের মত করেই শেষ করে নিতে পারবে এই গবেষণা। তুমি আর আটকাতে পারবে না কিছুতেই। আর তুমি তো জানো পৃথিবীর সব দেশই এখন প্রচুর পরিমাণে ইকোল্যাণ্ডিয়া মজুত করে রেখেছে।”

প্রথমে দু’চোখে প্রচণ্ড বিস্ময় থাকলেও ব্যাপারটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না চতুর বেঞ্জামিনের। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল সে। কিন্তু তারপরেই প্রচণ্ড আক্রোশে চিৎকার করে উঠল সে, “ইউ ইডিয়ট। মার্কো, এলিনা। অ্যাটাক দেম।”

হৃদস্পন্দনের গতি তখন বেড়ে গিয়েছে আমারও। বেঞ্জামিনের নির্দেশ পেতেই প্রায় ঝড়ের বেগে এসে আমাকের জাপটে ধরল মার্কো। ওই লৌহকঠিন বাহুবন্ধ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারলাম না আমরা। এলিনা এসে সিরিঞ্জটা ঢুকিয়ে দিল নাসেরের শরীরে। তারপর অন্য একটা সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে এল আমার দিকে…

২০ শে জানুয়ারী, ২০৮৫

ডঃ গার্সিয়ার রুমটা পরিষ্কার করার কাজ চলছিল কয়েকদিন ধরেই। এখানে ন্যাশানাল সাইন্টফিক মিউজিয়াম বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই দেশের সরকার। ডঃ গার্সিয়ার অসমাপ্ত গবেষণাটি বেহাত হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরেই মারা গিয়েছেলেন ডঃ কৌশিক সিংহরায় এবং ডঃ নাসের আহমেদ। বেঞ্জামিন ও তার দলের বাকি লোকেরা বিদেশে পালিয়ে গেলেও রেহাই পায়নি। এদেশের ইন্টালিজেন্স ব্যুরো সেখান থেকে খুঁজে তাদের ফিরিয়ে এনে জেরায় বার করে এনেছিল আসল কথাটা। গতবছরই তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ইকোল্যাণ্ডের সর্বোচ্চ আদালত।

কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম কলঙ্কিত হওয়ার পরেও এদেশের বাকি বিজ্ঞানীরা আবার নতুন করে উঠে পড়ে লেগেছেন তাঁদের হারিয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি আরও একবার গড়ে তুলতে। সেই উদ্দেশেই নতুন করে ডঃ গার্সিয়ার বাড়িটাকে বানানো হচ্ছে মিউজিয়াম হিসাবে, যাতে তাঁর জীবন ও কর্মকাণ্ড দেখে এই দেশের নতুন প্রজন্ম সদ্য ঘটে যাওয়া কেলংকারি ভুলে নতুন করে উৎসাহী হয় বিজ্ঞান চর্চার জন্যে।

মিউজিয়াম তৈরির দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে এই দেশের অন্যতম সেরা প্রযুক্তিবিদ ডঃ ব্যাঙ্কো সোইঙ্কার উপর। তাঁরই তত্ত্বাবধানে কয়েকজন অ্যান্ড্রয়েড কাজ করে চলেছে বাড়িটিকে নতুন করে সাজানোর জন্যে। সকালবেলায় তিনি ঘুরে দেখছিলেন তাদের কাজ। এরই মধ্যে জুবিন নামের এক এন্ড্রয়েড হঠাৎ একটা ডায়েরি ধরিয়ে দিয়ে গেল তাঁর হাতে, “স্যার, পাওয়া গেছে ডঃ গার্সিয়ার বেসমেন্টের পার্সোনাল লকার থেকে।”

ডায়রিটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখার পর খুলে ফেললেন ব্যাঙ্কো সোইঙ্কা। কিন্তু ডাইরি প্রথম পাতাটা খুলেই চমকে উঠলেন তিনি। হাতের লেখা তাঁর অচেনা নয়। এই কয়েকদিন ডঃ গার্সিয়াকে নিয়ে ঘাটতে ঘাটতে ডঃ গার্সিয়ার হাতের লেখাটা বেশ ভাল করেই চেনেন তিনি। কিন্তু তিনি অবাক হলেন অন্য একটা বিষয় দেখে। ডাইরির প্রথম পাতায় লেখা তারিখ। ১৭ই মে দু’হাজার ষাট। এর ঠিক এক দিন পরেই মৃত্যু হয়েছিল এই বিজ্ঞানীর।

মৃত্যুর ঠিক একদিন আগেই লিখেছিলেন ডঃ গার্সিয়া। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই লেখাটা পড়তে শুরু করলেন ব্যাঙ্কো। কিন্তু ডঃ গার্সিয়ার লিখে যাওয়া শেষ লাইনগুলো একটা ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দিল ব্যাঙ্কোর শিরদাঁড়া বেয়ে—

‘আমার আশঙ্কা যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে মানুষের শরীরে বাড়তে থাকবে অক্সিজেনের পরিমাণ। মানুষ শিকার হবে অক্সিজেন টক্সিসিটির। অন্যদিকে এই অবস্থা সামাল দিতে না পারলে পরবর্তী প্রজন্ম মুখোমুখি হবে সিভিয়ার এনভায়রনমেন্টাল অক্সিজেন ডেফিসিয়েন্সির।

‘হা ঈশ্বর! এই গবেষণা বন্ধ করে দেব আমি।’

ডঃ গার্সিয়ার এই গবেষণা বেহাত হলেও বন্ধ হয়নি কিন্তু। পাঁচ বছর আগে ইউএস এর একদল বিজ্ঞানীর হাত ধরে ইকোল্যান্ডিয়ার ওই অভিযোজিত প্রজাতিটি ছড়িয়ে পড়েছিল ক্রমশ। মানুষের উপর দেদার অ্যাপ্লাই করা হয়েছে তাদের। আর তার ফলে খাদ্য গ্রহণের জন্যে আর পৃথিবীর উপর নির্ভর করতে হয় না মানুষকে। একটি অভিযোজিত জিনের সাহায্যে নিজেরাই নিজের দেহে তৈরি করে নিতে পারে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান।

কিন্তু কয়েকমাস আগে এই প্রক্রিয়ার একটা কুফল দেখতে শুরু করেছে গোটা মানবজাতি। এখন আগের তুলনায় বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে তাদের।

এভাবে চলতে থাকলে তো…

প্রাণ নিয়ে গবেষণা করেন না ব্যাঙ্কো। তবুও ডঃ গার্সিয়ার করা ভবিষ্যৎবাণীর মর্ম বুঝতে সময় লাগল না।

ব্যাঙ্কো অনুভব করলেন সরতে শুরু করেছে তাঁর পায়ের তলার মাটি।

এক অনাহূত ভবিষ্যতের আশঙ্কায়…