মাটি আকাশের মাঝখানে - পার্থ দে

গল্প

ওয়্যারহাউসের জানলা দিয়ে ছেলেটা আকাশটার দিকে তাকাল। অনুজ্জ্বল, কালচে আকাশ। আবার ম্লান আলো আর নৈঃশব্দে ভরা একটা কর্মব্যস্ত দিন শুরু হতে চলেছে। ইদানীং তার মনে হয় চতুর্দিকে একটা বিষণ্ণতার আস্তরণ তাকে জড়িয়ে রেখেছে। ওয়্যারহাউসের এই হ্যাঙ্গার, প্যান্ট্রি, শৌচালয়, বসার চেয়ার, টেবিল, সামনে রাখা কন্ট্রোল প্যানেল কিচ্ছু তার ভাল লাগে না। কতদিন ছেলেটা একটা নদী দেখেনি। মৃদুমন্দ বাতাস এসে তার চুল এলোমেলো করে দেয়নি। অথচ এই মহার্ঘ চাকরিটার জন্য সে আজীবন স্বপ্ন দেখেছিল। প্রায় চার বছর আগের সেই দিনটা তার আজও মনে পড়ে। চাকরিটা পাওয়ার পর সে আনন্দে বিভোর হয়ে একটা অডিও মেসেজ পোস্ট করেছিল তার ডিভাইসের মাইক্লাউডে। অডিওটা ছিল অনেকটা এইরকমের—

সাইন ইন মাইক্লাউড, ২০.৩৪ ঘন্টা, ২১ মার্চ, ২০৭৫

হাই, আমি প্রীতশয়ান মুখোপাধ্যায়

ইউ ক্যান কল মী প্রীত।

আজ আমার ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ ছিল!

সিক্সথ সেমেস্টার পর্যন্ত আমার সিজিপিএ ৯.৪ ছিল। সেভেন্থ সেমেস্টারের রেজাল্ট বেরোবে হপ্তাখানেক বাদে। আমি জানি আমার সিজিপিএ ড্রপ করবে না। আমি ইলেক্ট্রনিক্স, রোবোটিকস এন্ড বট ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার ছাত্র, আমার রেজাল্ট যাকে বলে, কুল! আজ প্রথম দিনেই সেরা কোম্পানিগুলো এসেছিল। ভারতের সাহিল আম্বানির রিলায়েবল এনার্জি এন্ড মাইনিং (REM), সান্ড্রা বেজোসের ব্লু হরাইজন কর্প (BHE Corp), জেসন গেটসের ম্যাক্রোসফট এনার্জি এন্ড মাইনিং কর্প (MEM Corp) সহ আটটা কোম্পানি এসেছিল। অবশ্য আইআইটির ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ নিতে সেরা কোম্পানিরাই আসে।

আমার ইচ্ছে ছিল ব্লু হরাইজনেই যাতে চাকরিটা পাই। আধঘন্টার ইন্টারভিউতে প্রযুক্তি সংক্রান্ত সব প্রশ্নই ঝটপট উত্তর দিয়েছি। তবে শেষে যখন বোর্ডের একজন প্রশ্ন করল ‘মিস্টার মুখার্জি, ডু ইউ লাইক ব্লু হরাইজন?’ মুহূর্তের জন্য আমি একটু থমকে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, ব্লু হরাইজন খুব বড় আর পছন্দের বহুজাতিক সংস্থা বলেই তো ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে এসেছি। প্রশ্নকর্তা একজন মধ্যবয়সী ব্যুরোক্র্যাট, আমার দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসল। আমি তখনই কিউটা ধরে নিলাম, বুঝলাম প্রশ্নটা আসলে ক্রিকেটের গুগলি।

ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, “নীল আকাশ কার না ভাল লাগে। আমার অবশ্য আকাশের সব রঙই পছন্দের। সূর্যোদয়ের লালচে আর সূর্যাস্তের লাইল্যাক রঙটা যখন আকাশে ছড়িয়ে পড়ে তখনও। তখনও আকাশ আমার খুব ভাল লাগে।

ভদ্রলোক বললেন, “কিন্তু আকাশ যদি বেশিরভাগ সময় কালো হয়? ঘোর কৃষ্ণবর্ণ? তবে?”

“তাহলেও ভাল লাগে,” আমি ওকে বললাম। “রাতের আকাশ তো কালোই। আর নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত। আর কী রহস্যময়!”

লোকটা হাসল। বলল, “গুড। এনি কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ?”

আমি বললাম, “গান জানি। রবীন্দ্রনাথ।”

লোকটা বলল, “গাও একখানা।”

“আকাশ আমায় ভরল আলোয়

আকাশ আমি ভরব গানে।

সুরের আবীর হানবো হাওয়ায়

নাচের আবীর হাওয়ায় হানে।”

গান শেষ হতেই লোকটা তালি দিয়ে উঠল, “বাহ, খুব সুন্দর গেয়েছ। টেগোর রকস। তোমার গলাটিও মেলিফ্লুয়াস। নাউ হিয়ার ইজ ইয়োর জব অফার। ভারতীয় মুদ্রায় এখন বছরে সিটিসি পাবে ছত্রিশ কোটি। প্রতি বছর ইনসেন্টিভ হিসেবে এক কিলো প্লাটিনাম আর দু কিলো গোল্ড। আনলিমিটেড হেলথ ইনশিওরেন্স আর অন্যান্য পার্কস থাকবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল তিনশো কোটি টাকার একটা ফ্রি জীবন বীমা পলিসি পাবে। সঙ্গে কোম্পানির শেয়ার কেনার অপশন। প্রথম ছ’মাস অ্যান্টার্কটিকায় ট্রেনিং, পরের ছ’মাস মেরিল্যান্ডে ট্রেনিং হবে। দ্বিতীয় বছরে পোস্টিং পাবে। এগারো বছরের কন্ট্রাক্ট। তবে প্রথম দশ বছর অনসাইটে থাকতে হবে, বাড়ি ফেরার ছুটি নেই। ইলেভেন্থ ইয়ারের গোটাটাই পেইড লিভ। তোমার কাজ ভাল হলে টুয়েলভথ ইয়ার থেকে ফের এগারো বছরের কন্ট্রাক্ট রিনিউ করবে কোম্পানি।”

আহা, আইআইটিতে ঢোকার সময় আমি এরকম একটা কেরিয়ারের স্বপ্নই তো দেখেছিলাম। আমি এখন বাইশ, দশ বছর পর বত্রিশ হব। তখন বিয়ে করে সংসারী হব। আমার পছন্দমতো যে কোনো দেশে তখন রিলোকেট করতে পারব। ভূমধ্যসাগরের তীরে কোনো স্পেনীয় ভিলা… নীল জল… দ্রাক্ষা আর অলিভের বন… আমার দুটি সন্তান… সোনালী বেলাভূমিতে ছুটোছুটি করছে… মধুবর্ণ রোদ গায়ে মেখে আমার প্রিয়তমা এগিয়ে আসছে আমারই দিকে… আহা সুখ, আহা জীবন…

আকাশ আমায় ভরলো আলোয়

আকাশ আমি ভরব গানে…

সাইন আউট মাইক্লাউড।

মাইক্লাউডে পোস্ট করা ছেলেটার সেই অডিও মেসেজটা অনেকেই শুনেছিল। রেটিংও করেছিল অনেকেই। কেউ ৩ দিয়েছিল, কেউ ৩.৫, কেউ আবার ৩.৮ দিয়েছিল। মোটের ওপর ছেলেটার অডিও একটা গড়পড়তা ৩.৪ রেটিং পেয়েছিল। কারণ অনেকেই তখন মনে করেছিল বহুজাতিক এনার্জি এন্ড মাইনিং কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার হিড়িকটা সময়ের হুজুগ ছাড়া কিছু নয়। জাস্ট আ জাইটগাইস্ট অফ ইয়ার টু থাউজেন্ড সেভেন্টি ফাইভ!

তিন মাসের বেশি কোনো অডিও বা ভিডিও মাইক্লাউডে থাকে না। তবে কেউ তার অডিও বা ভিডিও আরও বেশিদিন ধরে মাইক্লাউডে রেখে বিজ্ঞাপিত করতে চাইলে তাকে রেন্টাল দিতে হয়। তবে চাইলে কেউ অন্যের মাইক্লাউডে সাবস্ক্রাইব করে ডকিং করতে পারে। অডিও বা ভিডিও ক্লিপ অর্থের বিনিময়ে রেইনডাউন করতেই পারে। একটিমাত্র মেয়ে ছেলেটার সেই অডিওটা অর্থমূল্য দিয়ে কিনে নিয়েছিল। তারপর একটা অডিও মেয়েটি সরাসরি পার্সোনালাইজড স্নিপেট মেসেজ করে ছেলেটাকে পাঠিয়েছিল।

অডিওটা তখন শুনতে শুনতে প্রীতশয়ানের ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠেছিল।

সাইন ইন মাইক্লাউড, ১৭.৫১ ঘন্টা, ৪ এপ্রিল, ২০৭৫

হাই, আমি মনপ্লাবী বসু।

ইউ ক্যান কল মী প্যাল।

প্রীত, আমি গত সপ্তাহে তোমার অডিওটা শুনলাম। প্রথমেই বলি, তুমি খুব ভাল গাও। জানো, তোমার মতো আমিও আকাশ খুব ভালবাসি। ছোটবেলা থেকেই আকাশ আমাকে ভীষণ টানে। মনে মনে কতবার যে পাখি হয়ে উড়ে বেড়িয়েছি কত জায়গা! তাই তো আমি ক্যালিফোর্নিয়ার গ্লেনডেল কমিউনিটি কলেজে পড়তে এসেছি। গতমাসেই আমি Mach 5 সার্টিফিকেট পাস করেছি। এখন আমি যে কোনো হাইপারসনিক এয়ারক্রাফটে ফ্লাইট এটেন্ড্যান্টের চাকরি পাব। তবে মজার কথা কী জানো, আজকে আমারও জবের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ ছিল, আর আমিও ব্লু হরাইজন এয়ারলাইন্সে চাকরিটা পেয়েছি। অনেকগুলো এয়ারলাইন্স এসেছিল, কিন্তু ব্লু হরাইজনের মতো হাইপারসনিক প্লেন সার্ভিস আর কারও আছে, বলো? সানফ্রান্সিসকো থেকে কলকাতা দেড় ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। রাজারহাটে আমার প্রপিতামহরা থাকতেন। আমার প্রপিতামহ ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে এসেছিলেন। আমার ঠাকুরদা বারকয়েক সে দেশে গিয়েছিলেন, তবে আমার বাবা কোনোদিনও যাননি। আমার খুব ইচ্ছে একবার রাজারহাটে গিয়ে আমাদের ভিটেটা দেখে আসার। শুনেছি রাজারহাট জায়গাটা খুব পুরোনো, কে জানে খুঁজে পাব কিনা! জানো, ব্লু হরাইজনের সিটিসি বেশ ভাল। বারো কোটি দিচ্ছে। ভালই বলতে হবে, তাই না? আমি তো খুশি। কী মজা! তুমি আর আমি দুজনেই একই কোম্পানিতে জব পেয়েছি! শুধু তুমি এনার্জি এন্ড মাইনিং-এ আর আমি এয়ারলাইন্সে। তুমি জানিয়েছিলে ছ’মাসের ট্রেনিংয়ে মেরিল্যান্ডে থাকবে। আচ্ছা প্রীত, তখন কি আমাদের দেখা হতে পারে? অন্তত একটা দিন? তোমার কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর। দেখা হলে তুমি কি আমাকে একটা টেগোরের গান শোনাবে?

সাইন আউট মাইক্লাউড।

ছেলেটা ফের বিষণ্ণ চোখে জানলার বাইরে তাকাল। ম্রিয়মাণ আকাশটা তার দিকে ম্লান দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আকাশের ওই ম্লান আলোটুকুও বেশিক্ষণ থাকে না, তাকে এক্ষুণি কাজে বেরোতে হবে। তার চীনা বন্ধুটি আজ সারাদিন হ্যাঙ্গারেই কাটাবে, আজ তার ছুটি। অবশ্য ছুটি বলা যাবে না, এই ওয়্যারহাউসেই সারাদিন তার কাজ। ক্ষতিগ্রস্ত বট আর রোভারগুলোকে সে সারাদিন বসে বসে সারাবে। কালকের মধ্যেই সারাতে হবে, কারণ শিগগিরই রিপ্লেসমেন্ট আসার কোনো চান্স নেই। আর কোম্পানিও টানা দুদিন ফিল্ডওয়ার্ক থেকে ছুটি নিয়ে ওয়্যারহাউসে বসে থাকাটা মেনে নেবে না। ছেলেটা তার হ্যাঙ্গার-মেট বন্ধুটির থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিজের কাজে মন দিল।

আজকাল মেয়েটাকে খুব মনে পড়ে ছেলেটার। সেই অডিও মেসেজ পেয়ে মেয়েটার সঙ্গে প্রথমবার আলাপের পর প্রায় চারবছর কেটে গেছে। বহুদিন সে মেয়েটাকে দেখেনি, ক্রমেই তাকে একটা হতাশা যেন গ্রাস করে নিচ্ছে।

প্রথম বছরটা তারা অডিও আর ভিডিও মেসেজ চালাচালি করে কাটিয়েছিল। কখনও মেয়েটি সকাল আটটায় জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টের ছবি পাঠালে দু’ঘন্টা পর ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ছবি পাঠাত। বেশ মজা পেত ছেলেটা। কথা অবশ্য বেশি হত না। হাইপারসোনিক বিমানের ডিউটি করলে নাকি খুব জেটল্যাগ হয়, মেয়েটি বলত। একবার মেয়েটি মেরিল্যান্ডে গিয়েছিল ছেলেটার সঙ্গে দেখা করার জন্য, কিন্তু তখন ছেলেটা মন্টানায় গিয়েছিল প্ল্যাটিনামের খনিতে ট্রেনিং নিতে। ওদের সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু ছেলেটা ট্রেনিং পিরিয়ডে থাকাকালীন ওদের মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হত। ওরা ভিডিও চ্যাটও করত। মেয়েটি বাচ্চাদের মতো চোখ বড় বড় করে বলত, “তোমার কাজটা কী ভীষণ এক্সাইটিং! ইস, আমি যদি তোমার মতো রোবোটিক্স নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারীং পড়তাম কী ভাল হত!”

মেয়েটার কথা শুনে ছেলেটা হাসত। মেয়েটা বলত, “তোমার এই হাসিটা বড় সুন্দর। খুব ইনফেকশাস।” বলেই মেয়েটা হেসে ফেলত। ছেলেটা ফের হেসে বলত, “তোমার চোখের মণিদুটোও খুব সুন্দর। হেজেল ব্রাউন।”

প্রায় তিন বছর হতে চলল দুজনের মধ্যে দেখা নেই। না, ভার্চুয়াল আলাপ থাকলেও পাকেচক্রে ওদের মুখোমুখি সাক্ষাৎ কোনোদিন ঘটেনি। মেরিল্যান্ডের এক বছরের ট্রেনিংয়ের শেষে ছেলেটা পোস্টিং পেয়েছিল। কিন্তু আসার আগেও একবারের জন্যেও মেয়েটার সঙ্গে দেখা হল না। এখনও সে মেয়েটাকে অডিও বা ভিডিও বার্তা পাঠায়। সে বার্তা রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে প্রথমে মঙ্গলের চারদিকে ঘূর্ণনশীল কৃত্রিম উপগ্রহের মধ্যে দিয়ে রিলে হয়ে পৃথিবীর স্যাটেলাইট হয়ে নাসা যায়। ব্লু হরাইজন সেখান থেকে ডেটা সংগ্রহ করে। ডেটা ট্রান্সমিশনে প্রায় পনেরো মিনিট লাগে।

ছেলেটার আজকাল খুব নিঃসঙ্গ বোধ হয়। সে মাইনার ক্যাপসুল থেকে জানলার বাইরে তাকাল। এই জায়গাটা সিরিস-এর ওয়্যারহাউস থেকে উত্তর মেরুর দিকে ২৪০ কিলোমিটার দূরত্বে। ব্লু হরাইজনের সিরিস ওয়্যারহাউসটা নিরক্ষীয় অঞ্চলে। সেখান থেকে মাইনার ক্যাপসুলটা নিয়ে এসে ঠিক ওই ড্রিলিং সাইটটার ওপর নিয়ে যেতে হবে।

বছর দশেক আগে ছেলেটা যখন কলকাতার একটা নামী ইন্টারন্যাশনাল বোর্ডের স্কুলের একাদশ শ্রেণীতে পড়ত, তখন ছেলেটার ইঞ্জিনিয়ার বাবা বলেছিলেন, “প্রীত, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে, তুমি ইলেক্ট্রনিক্স, রোবোটিক্স এন্ড বট টেকনোলজি নিয়ে পড়বে। মনে রেখো, স্কাই ইজ দ্য লিমিট। আর এই আকাশের কোনো সীমা নেই। এখন পৃথিবীর সবচেয়ে মহার্ঘ চাকরি হল অ্যাস্টেরয়েড মাইনিং। ব্লু হরাইজন এনার্জি এন্ড মাইনিং কর্প, রিলায়েবল এনার্জি এন্ড মাইনিংয়ের মতো কোম্পানিগুলো অ্যাস্টেরয়েড বেল্টে পৌঁছে গেছে। প্রীত, তুমি বোধহয় জানো না, সিরিস, ভেস্টা, পালাস, হাইজিয়ার মতো গ্রহাণুসহ অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের হাজার হাজার গ্রহানু মিলে অন্তত ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজসম্পদ রয়েছে। দিজ কোম্পানিজ আর অফারিং দ্য বেস্ট পে প্যাকেজেস টু দ্য ব্রাইট কিডস লাইক ইউ।”

তখন থেকে ছেলেটার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল। তারপর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ পেরিয়ে যখন মেরিল্যান্ডে নাসা-ব্লু হরাইজনের জয়েন্ট ট্রেনিং শুরু হল তখনও সে অজানাকে জানার উত্তেজনায় কেঁপে উঠত। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার সময় বারবার উচ্ছাসে ফেটে পড়ত। বছরতিনেক আগে ওর মতো কুড়িজন অনসাইট প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে নিউ হরাইজনের মাইনার-৮ স্পেসক্রাফটে ওরা পৃথিবী থেকে রওনা দিয়েছিল। ২২০ দিন পর ওরা মার্সের হেডকোর্টারে এসে পৌঁছেছিল। ব্লু হরাইজনের ধাতু নিষ্কাশনের প্লান্ট, রিফাইনারি আর লজিস্টিক সাপোর্টের কাজ সবই মঙ্গলেই হয়। ব্লু হরাইজনের প্রায় ১০০ জন কর্মী মার্সেই কর্মরত। অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের গ্রহাণুগুলোয় খনিজ উত্তোলনের সময় যে জল পাওয়া যায় সেখান থেকে তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন পায় ওরা। অক্সিজেন যেমন ওদের বেঁচে থাকার জন্য লাগে তেমনই হাইড্রোজেন লাগে সিরিস থেকে মার্স ০.৬ AU দূরত্ব অতিক্রম করার জ্বালানী হিসেবে। মহাকাশের মূল জ্বালানি এখন হাইড্রোজেন।

ছেলেটা নতুন ড্রিলিং সাইটের ওপর তার মাইনার ক্যাপসুলটা নিয়ে চলে এসেছে। জায়গাটা একটা ৩০০ মিটার গভীর এবং ৪ কিলোমিটার চওড়া ক্রেটারের কাছে। ৫০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে। ধীরে ধীরে ক্রেটারটার কাছেই ছেলেটা মাইনার ক্যাপসুলটা ল্যান্ড করল। এবার একঘেয়ে কাজগুলো শুরু হবে, ছেলেটা ভাবল। তিনটে রোভার— ডোয়েন, নিকোল আর বিবার— এবার কাজ শুরু করবে। ওদের একে একে ক্যাপসুল থেকে নামিয়ে দিতে হবে। দুটো রোভারের নাম ডোয়েন আর নিকোল রাখা হয়েছে প্রয়াত কিংবদন্তীসম দুই হলিউড তারকার নামে। তৃতীয় রোভারটির নাম বৃদ্ধ কিংবদন্তী গায়ক জাস্টিন বিবারের নামে।

ক্যাপসুল থেকে ছেলেটা নজর রাখছিল। সিরিসে দিন খুব ছোট, ঘন্টা পাঁচেক বড়জোর, এর মধ্যেই চারঘন্টার ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হয়। রাতও ওই পাঁচঘন্টার। ছেলেটা সিরিসে এসেছে প্রায় দুবছর। তবুও পৃথিবীর চব্বিশ ঘন্টায় অভ্যস্ত শরীরটা এখনও দশ ঘন্টার দিনরাতের চক্রে অভ্যস্ত হতে পারেনি। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম হয় না, এক একদিন সকালে ঘুম ভাঙতে চায় না, অবসন্ন শরীর যেন ভেঙে পড়তে চায়।

নিকোল রোভারটা প্রথমে ক্রেটারের ধারে একটা পঞ্চাশ হাজার বর্গমিটারের মতো জায়গায় ফ্লুরোসিন লিক্যুইড স্প্রে করল, তারপর গোটা জায়গাটা চষে ফেলে আল্ট্রাভায়োলেট ল্যাম্প দিয়ে সবুজ রঙ ফুটে ওঠা দেখতে শুরু করল। সহজেই প্যালাডিয়াম আর প্ল্যাটিনাম আকরিকের জায়গাগুলো চিহ্নিত হয়ে গেল। জিওলজিক্যাল সার্ভে রিপোর্ট বা ব্লু ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট রিপোর্ট ছাড়াও ছেলেটা এই ব্যাপারে সাবেক আমলের কোইডের রঙ সনাক্তকরণ পদ্ধতিটা পছন্দ করে। এখানে রোডিয়াম, প্ল্যাটিনাম বা প্যালাডিয়াম ধাতু যত গুরুত্বপূর্ণ ততটাই গুরুত্বপূর্ণ জল। অবশ্য সিরিসের -১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই গোটা অ্যাস্টেরয়েড বেল্টে যত সাবসারফেস জলের বরফ জমে আছে তা সব মিলিয়ে পৃথিবীর জলের অনেকগুণ বেশি। শুধু তাই নয়, সিরিসের ২৫-৩০ কিলোমিটার ভূগর্ভের তলায় এক বহমান সমুদ্রও থাকার ইঙ্গিত মিলেছে।

এবার শক্তপোক্ত চেহারার ডোয়েন রোভারটা তার কাজ শুরু করে দিল। তার শক্তিশালী রোবোটিক হাতগুলো দিয়ে পঞ্চাশ বর্গমিটারের মধ্যে দুটো জায়গা বেছে নিয়ে ড্রিল করা শুরু করে দিল। এটা একটা প্ল্যাটিনামের ওপেন কাস্ট মাইন হতে চলেছে। ভূগর্ভের সামান্য নিচেই অনেকখানি প্ল্যাটিনাম পাওয়ার সম্ভাবনা। ড্রিল করার সময় যে সাবসারফেসের বরফ পাওয়া যাবে সেগুলোকে বিবার রোভার জ’ ক্রাশার দিয়ে গুঁড়ো করে ক্যাপসুলে তুলে দেবে। তারপর খনিজ প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, রোডিয়াম যা পাওয়া যাবে তা তুলে ফেলতে হবে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণের ধাতব আকরিক তুলে ফেলতে হয়। ছেলেটার গত বছরের টার্গেট ছিল ৮০ মেট্রিক টন প্ল্যাটিনাম। তার এ বছরের টার্গেট ১২০ মেট্রিক টন প্ল্যাটিনাম। সিরিস ওয়্যারহাউসে ছেলেটার মতো আরো চারজন প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার আর আশিটা রোভার আছে যারা সিরিসেরই বিভিন্ন সাইট থেকে প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, রোডিয়াম উত্তোলন করছে। তাদের সকলের সম্মিলিত প্রোডাকশন টার্গেট বার্ষিক ৬০০ মেট্রিক টন, যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্ল্যাটিনাম উৎপাদক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার বার্ষিক উৎপাদনের চারগুণ। ব্লু হরাইজন আপাতত অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের দশটি গ্রহাণুতে তাদের অপারেশনস শুরু করেছে। ধীরে ধীরে ওরা ব্যবসা বাড়িয়ে অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের অন্য গ্রহাণুগুলোর দিকে হাত বাড়াচ্ছে। অ্যাস্টেরয়েড বেল্টে ৩-৪ মিটারের খুব ছোট অ্যাস্টেরয়েড থেকে শুরু করে সিরিস বা ভেস্টার মতো বিশাল গ্রহাণুর আকারের অ্যাস্টেরয়েডের সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ। ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ লুকিয়ে আছে এখানে।

ছেলেটা হঠাৎ চমকে তাকাল। তার অন্যমনস্কতায় কখন যেন বিবার রোভারটা একেবারে ক্রেটারটার ধারে চলে গেছে। ঠিক ওই দিকটাতেই ক্রেটারের খাদটা খাড়াভাবে তিনশ মিটার নিচে নেমে গেছে। ক্রেটারের অন্যদিকটা এতটা খাড়াই নয়। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে বিবারকে নির্দেশ পাঠাল, “হেই বিবার, তুমি একেবারে ক্রেটারের বিপজ্জনক দিকটায় দাঁড়িয়ে আছো। ওখান থেকে সরে এসো না হলে বিপদ…”

‘বিপদ’ শব্দের উচ্চারণটা শেষ হওয়ার আগেই বিবার ক্রেটারের তিনশ মিটার উচ্চতা থেকে হুড়মুড় করে সটান নিচে পড়ে গেল। ছেলেটা একটা হতাশাব্যাঞ্জক শব্দ করে দুহাতে মুখ ঢাকল। তার মানে আজকের মতো কাজ স্তব্ধ! এত উঁচু থেকে পড়ে নিশ্চয়ই বিবার আস্ত থাকবে না। এখন ডোয়েন আর নিকোলের কাজ থামিয়ে ওদের দিয়ে বিবারকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর ওয়্যারহাউসে ফিরে হয়ত গোটা রাত জেগেই বিবারকে মেরামত করতে হবে। রাত ছাড়া যে আর মেরামতির কাজের সময় নেই। প্রতি ছ’দিন কাজ করার পর একদিন ছুটি পাওয়া যায় কিন্তু সেই গোটা দশঘন্টার দিনটা ছেলেটা ঘুমিয়ে ক্লান্তি দূর করে।

ছেলেটা হতাশায় ভেঙে পড়ল। যে আকাশ সে একদিন ভালবাসত, সেই আকাশ আজ এক প্রকান্ড দানব হয়ে তাকে গিলে নিচ্ছে। একটা ধূসর রিক্ত গ্রহাণুর মধ্যে সে সবার অলক্ষ্যে একটু একটু করে এইভাবে শেষ হয়ে যাবে। তার বাবা জানবে না, মা জানবে না। আর সেই মেয়েটি? যে মেয়েটিও উড়তে ভালবাসে, সে কি আর মনে রাখবে তাকে?

কোনো একদিন এই মাইনার ক্যাপসুলটার ভিতর সে মরে যাবে। আর তার শবদেহ বয়ে নিয়ে এই ছোট মহাকাশতরীটা ভাসতে ভাসতে চলে যাবে বৃহস্পতি ছাড়িয়ে, শনি, টাইটান, ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো, চ্যারন, সেডনা ছাড়িয়ে, কাইপার বেল্ট ছাড়িয়ে আরও আরও দূরে উর্ট ক্লাউডস ছাড়িয়ে, এ সৌরজগত ছাড়িয়ে, আলফা সেন্টোরি ছাড়িয়ে আরও দূরের কোনো নক্ষত্রের জগতে…

তখনও… তখনও কি মেয়েটা মনে রাখবে তাকে… আকাশের দিকে চেয়ে খুঁজে নেবে তার নিঃসঙ্গ মহাকাশতরী…

“হাই!”

ছেলেটা ঘুমের মধ্যে একটু নড়ে উঠল। সে কি মেয়েটার কন্ঠস্বর শুনতে পেল? ঘুম ভেঙে সে চমকে উঠল। চোখ কচলে তাকাল। বাইরে এখনও অন্ধকার। তবে কি সে ভুল শুনল! নাহ, হ্যাঙ্গারের কন্ট্রোল প্যানেলের সামনেটা যেন আলোকিত হয়ে উঠেছে। টেবিলটার ওপর একটা ৭-ডি হলোগ্রাম ফুটে উঠেছে। অবিকল মেয়েটার মতোই দেখতে। হলোগ্রামের মাধ্যমে বার্তা দেওয়ার ফেসিলিটিটা ছেলেটা আগেই পেয়েছিল, কিন্তু কোনোদিন সে সেটা ব্যবহার করেনি। আজ মেয়েটা বিশেষ কোনো হলোগ্রাফিক মেসেজ নিয়ে এসেছে। ঘুমচোখে ছেলেটা টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল।

“হাই প্রীত, হ্যাপি বার্থডে,” মেয়েটার হলোগ্রাম বলে উঠল। “আজ তোমার জন্মদিনের শুভেচ্ছার সঙ্গে আরেকটা আনন্দ সংবাদ দেব।”

“কী?”

“আমাদের দেখা হবে। খুব শিগগিরই। এভাবে নয়, সামনাসামনি। তোমাকে দেখতে পারব ছুঁতে পারব,” মেয়েটা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল।

“কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?” ছেলেটা অবিশ্বাসী গলায় বলল।

“সম্ভব, খুব সম্ভব,” মেয়েটা কৌতুকের সুরে বলল। “জানো, আমার প্রমোশন হয়েছে। সিটিসি বেড়ে বিশ কোটি হয়ে গেছে। আমি হাইপারসোনিক ফ্লাইট এটেন্ড্যান্ট (HFA) থেকে স্পেস ফ্লাইট এটেন্ড্যান্ট (SCA) হয়েছি। খুব শিগগিরই আমি মার্স ট্যুরিস্টার-৪ এ ফ্লাইট এটেন্ড্যান্ট হয়ে যাত্রা শুরু করব। মঙ্গল গ্রহ ভ্রমণকালে পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তবান বিশজন পর্যটকের দেখাশোনার সমস্ত দায়িত্ব আমার। তখন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। হ্যাঁ, প্রীত, দেখা আমাদের হবেই।”

“কিন্তু এভাবে দেখা হয়ে কী লাভ, বলো প্লাবী? এইটুকু ক্ষণিকের দেখা… তারপর তুমি ফিরে যাবে পৃথিবীতে আর আমি আরও পাঁচবছর এখানে পড়ে থাকব। আমাকে যে থাকতেই হবে, আমি যে ব্লু হরাইজনের চাকরির বন্ড সই করেছি। আমি এখানেই পড়ে থাকব, প্লাবী, আর একটু একটু করে এভাবেই শেষ হয়ে যাব।”

“ও কথা বোলো না, প্রীত। অমন কথা বললে আমি কষ্ট পাই,” মেয়েটির হলোগ্রাম কাতরস্বরে বলে ওঠে।

রেডিও ওয়েভবার্তার বিলম্বিত ট্রান্সমিশনের কারণে দুজনের কথোপকথনের মধ্যে যতিচিহ্নের মতো নীরবতা নেমে আসে।

ছেলেটা ফের বলে, “জানো প্লাবী, আমার আর আকাশ ভাল লাগে না। গভীরে এলে বোঝা যায় আকাশ বড় নির্মম, আকাশ বড় কর্কশ। এখানে একটা নদী নেই, সবুজের চিহ্ন নেই। আজকাল আমাকে মাটি বড় টানে। উর্বরা শস্যশ্যামলা পৃথিবীর মাটি। আমি মাটিতে ফিরতে চাই, প্লাবী। মাটিতে ফিরতে চাই,” বলতে বলতে ছেলেটা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

মেয়েটার হলোগ্রাম অকস্মাৎ আবেগে কেঁপে ওঠে। সে গাঢ় স্বরে বলে ওঠে, “প্রীত, আমার প্রীত। তোমার জন্য আমি মাটি হব। তুমি কি আমাকে বীজ দেবে, বলো প্রীত, বলো?”

ছেলেটা মুখ তুলে চায়। কোন এক সঞ্জীবনী সুধা যেন তার রক্তে ফের প্রাণ ভরে দিয়ে যায়। ছেলেটি অধীর হয়ে ওঠে, তার আবেগদীপ্ত আঙুলগুলি দিয়ে সে ছুঁতে চায় মেয়েটির হলোগ্রাম। স্পর্শ করা মাত্র হলোগ্রাম ভেঙে তার আঙুলে লেগে যায় আলোর কণিকা।

২.২৭ AU দূরে পৃথিবীতে তখন মেয়েটি হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে।