রেনেসাঁ - দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়

গল্প

—“আর কি সত্যিই কোনো উপায় নেই?”

—“সরি প্রোফেসর। এটাই একমাত্র রাস্তা। আমি ৭৪৩২১৫৭৯০৩ সংখ্যক ডেটা অ্যানালিসিস করে দেখেছি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডঃ উৎসব নিয়োগী। সামনের খোলা জানালা দিয়ে দূরের মাঠটার দিকে চলে গেল তাঁর নজর। এটা ওয়র্কস্টেশনের মাটির ওপর তলার অংশ। বাইরে থেকে দেখলে একটা ভাঙ্গা ওয়ার বাঙ্কার ছাড়া কিছুই না। গতরাতেই একটা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়ে গেছে। উৎসস্থল ছিল নিউইয়র্ক থেকে একশো কিলোমিটার দূরের একটা গ্রাম। তার ফলেই সম্ভবত সামনের মাঠটায় আজ হাঁটতে গিয়ে দেখতে পেয়েছেন শুকনো ঘাস চিরে হাঁ হয়ে থাকা জমি। এরকম যে আরো কতকিছু অপেক্ষা করে আছে! দেখতে দেখতে ফরসা মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। দৃঢ় গলায় বললেন, “ঠিক আছে। তাই হোক তবে!”

এতদূর বলে থামলাম। সামনে উবু হয়ে বসে আছে একটা অদ্ভুত প্রাণী। আমি থামতেই আমার দিকে তাকিয়ে ঘষঘষ করে মাথা চুলকোলো। তারপর আবার উদাস নয়নে চেয়ে রইল দূরের ঝাঁকড়া গাছটার দিকে। বুঝতে পারছি আমার গল্পে তেমন আগ্রহ নেই। তা হোক। আমাকে তো শোনাতেই হবে গল্পটা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আপনমনেই বললাম, “তাহলে প্রথম থেকেই বরং বলি।”

সে আজ থেকে প্রায় মাস খানেক আগের কথা...

একটা খোলা সবুজ মাঠ। নরম পশমের মতো ঘাসের গালিচা বিছানো তাতে। বেশ কিছুটা দূরেই দেখা যাচ্ছে গম্ভীর বৃদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা ঝাঁকড়া গাছ। ঘন সবুজ পাতায় মোড়া ডালগুলো যেন কৌতূহলী হয়ে মুখ বাড়িয়েছে আকাশপানে। আকাশে একটা অদ্ভুত মায়ামাখা আলো। সতেজ দুই ঘাসের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে লালচে আভা ছড়িয়ে অস্ত যাচ্ছে ক্লান্ত সূর্য। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল এলিজাবেথ। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর কোনো নিঝুম বিকেলে কিংবা একটা ঘুম ভেঙে বসা তরতাজা সকালে, যতটুকুনি সময়ই সে পায় স্টাফ কোয়ার্টারের এই ছোট্ট ঘরটাতে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওই দেওয়াল জোড়া ছবিটার দিকে। আজও দেখতে দেখতে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল তার দুটো চোখ। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক ছেড়ে। বহু পুরোনো ছবিটা, তার কোনো পূর্বপুরুষের সময়কার। ঠাকুমার কাছে শুনেছে তখন নাকি ঝকঝকে শীতের সকালে গায়ে সোয়েটার জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ত কচিকাঁচারা, গড়াগড়ি দিত ওই নরম ঘাসের বিছানায়। বসন্তের শুরুতে যখন নরম কচি পাতায় সেজে উঠল ম্যাপল গাছগুলো, তার নীচে কাঠের বেঞ্চে বসে উল বুনত তার গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডমাদার। তখন নাকি একটা ভারী আদুরে হাওয়া বইত পৃথিবী জুড়ে। তখন মানুষ ভালোবাসতো মানুষকে।

চোখ সরাল এলিজাবেথ। ছবিটার ঠিক পাশেই বড় জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরেটা। কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। বিশাল বড় এক গ্রীনহাউস তৈরী হবে। ছবিটা আর ওই জানালার ফ্রেম... যেন দুটো আলাদা পৃথিবী। দশকের পর দশক ধরে একটু একটু করে কখন যেন পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে সেই ঘাসে ঢাকা সবুজ মাঠগুলো। সেগুলো হয়ত এখন “নট নিডেড”। কিন্তু সে যদি কোনোদিন এই কৃত্রিম “নট নিডেড” এর দুনিয়া ছেড়ে আবার ফিরে যেতে পারত ওই খোলা মাঠটাতে...

ক্যাঁও ক্যাঁও ক্যাঁও! বিচ্ছিরি শব্দে বেজে উঠেছে ইন্টারকমটা। মুখটা তেতো হয়ে গেল এলিজাবেথের। উফ্, কোথাও কি একদন্ড শান্তি নেই? হাত বাড়িয়ে স্পিকারটা অন করতেই ভেসে ড্যানির বাজখাঁই গলা, “হেই লিজা! অ্যাওয়েক?”

—“ইয়াহ। কেন কী ব্যাপার?” কেজো গলায় বলল এলিজাবেথ।

—“আরে ম্যান ব্যাপার গুরুতর! জানিস আজ কে এসেছে হসপিটালে অ্যাডমিশানের জন্য?” ড্যানির গলায় সারা বিশ্বের যত উত্তেজনা যেন এসে জমা হয়েছে।

উত্তর দিল না এলিজাবেথ। ড্যানিটা বরাবরই নাটুকে। খবরটা ঠিকই বলবে, তবে একটু রঙঢঙ করে।

—“দ্য গ্রেএএট... ইউ এন!” পুরস্কার বিতরণী মঞ্চের ঘোষকদের মতো চেঁচিয়ে উঠল ড্যানি।

ইউ এন! এলিজাবেথের বুকের শান্ত দীঘিটায় যেন একটা ছোট্ট ঢিল পড়ল। ও বেঁচে আছে!

***

—“প্রত্যক্ষদর্শী গ্রামবাসীর কাছ থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, পাখিটি ছিল প্রায় এগারো ফুট লম্বা। দুই পায়ে দ্রুত বেগে ধাবমান এই দৈত্যাকার পাখি দুই ঠোঁটের ফাঁকে তুলে নেয়...”

বিরক্ত হয়ে টিভিটা মিউট করে দিলেন শেরিং মোম্বা। আজ সকাল থেকে চ্যানেল আর্থে এই একটাই খবর। মস্কোর কাছে একটা গ্রামে অদ্ভুত ভাবে কয়েকদিন ধরেই মানুষজন নিখোঁজ হচ্ছিল। আজকাল কোথাও মাস-মিসিং এর খবর এলে তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিল একটা দানব পাখি।

হেডরেস্টে মাথা রেখে চোখ বুজলেন মোম্বা। প্রথমে বিকট দর্শন বাঘ, তারপর বিষাক্ত টিকটিকি জাতীয় প্রাণী, এখন এই পাখি। একের পর এক অদ্ভুত ধরনের ভয়াল প্রাণীর আবির্ভাব হচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, আর একে একে জনমানবহীন হচ্ছে সিটিগুলো। প্রথমবার বাঘের খবরটা সামনে আসার পর ভীষণ ভাবে চমকে ছিলেন তিনি। প্রায় বছর কুড়ি হয়ে গেছে বাঘের সমস্ত প্রজাতিই পৃথিবী থেকে লুপ্ত, আবার নতুন ভাবে বাঘের আক্রমণ হল কীভাবে! ওই বিষাক্ত টিকটিকিও ছিল একটা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জীব, হয়ত এই পাখিটাও। এই সমস্ত বিপজ্জনক হিংস্র জীবগুলো আসছে কোথা থেকে!

রগ দুটো জোরে টিপে ধরলেন ইউনাইটেড আর্থ মনিটরিং কমিটির হেড। প্রত্যেকটা মুহূর্তে তাঁকে নজর রাখতে হয় এই বিশাল পৃথিবীর প্রত্যেকটা কোণায়। পুরো পৃথিবীর দেখভালের দায়িত্ব তাঁরই। তাঁর এতকালের প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও গত কয়েকবছর ধরে শুরু হয়েছে একের পর এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বৈজ্ঞানিকরা এর নাম দিয়েছেন “অ্যাপোক্যালিপ্স এজ”। কয়েক সপ্তাহ অন্তর ভূমিকম্প, সাইক্লোন, তুষারপাত, জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরির ফলে আবার পৃথিবী জুড়ে প্রাণ হারাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ। এমন অবস্থায় এই রকম নতুন উৎপাতের ধাক্কায় মাথা ঠিক রাখা যায়! আজও চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে সেই শুরুর দিন গুলোর কথা।

২০৪০ সাল। এমনিতেই নানারকম রোগ আর দূষণের কবলে পড়ে ততদিনে প্রাণ হারিয়েছে পৃথিবীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ। তার সঙ্গে ছিল “দ্য হিস্টোরিকাল গ্রেট ডিপ্রেশন”। আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগে শুরু হওয়া সেই ভয়ঙ্কর মন্দায় ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। বাদ যায়নি বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলোও। কাজ হারিয়ে, খেতে না পেয়ে মরেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে আরো কয়েক লক্ষ। দুনিয়া জুড়ে তখন এক অসম্ভব ছন্নছাড়া বিশৃঙ্খলা! নেতাদের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে সেই দিশেহারা অবস্থা চলল প্রায় কুড়ি বছর। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের উদ্যোগে ২০৪০ সালে তৈরী হল এই “ইউনাইটেড আর্থ মনিটরিং কমিটি”। কতই বা বয়স তখন তাঁর! মধ্য তিরিশের এক সম্ভাবনাময় ঝকঝকে যুবক, সম্পূর্ণ নিজের ক্ষুরধার মেধা ও তুখোড় রাজনৈতিক বুদ্ধির জোরে নির্বাচিত হলেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। হ্যাঁ, তাঁর বাবা সিনিয়র মোম্বা ছিলেন পূর্ববর্তী আফ্রিকান ইউনিয়নের মাথা, সেই পরিচয় হয়ত কিছুটা সুবিধে তাঁকে দিয়েছে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদ! সে তো তাঁর নিজের দক্ষতাতেই পাওয়া। আর তারপর থেকে পৃথিবীর উন্নতির জন্য কী পরিশ্রমটাই না করেছেন! যত বন্য জীবজন্তু যেগুলো মানুষের কোনো কাজে লাগেনা, উল্টে প্রাকৃতিক সম্পদ গুলোয় ভাগ বসায়, আগে তাদের নিকেশ করেছেন। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের অনিয়ন্ত্রিত বংশবিস্তারের রাস্তা আটকেছেন, বাচ্চার জন্ম দেওয়ার আগে বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা করেছেন। এগুলো কী জন্য? সবই তো মানব জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কথা ভেবে! সমস্ত পদক্ষেপই নেওয়া যাতে এই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ কোনোদিনই অপর্যাপ্ত না হয় মানুষের জন্য। এখন পৃথিবীর প্রত্যেকটা কোণায় জন্মানো প্রত্যেকটা শস্য কণা থেকে শুরু করে নদী-জলাধার গুলোর জলের পরিমাণ, কলকারখানায় তৈরী জিনিসপত্র থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ফোনকলের রেকর্ডিং... এই সমস্ত কিছু এক করেই তো গড়ে উঠেছে তাঁর “মেগা ডেটা সেন্টার”। যেখান থেকে তিনি পরিচালনা করেন এই গোটা পৃথিবী। যেখানে তাঁর হাজার হাজার স্যাটেলাইট অতন্দ্র প্রহরীর কড়া নজর বুলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর প্রত্যেকটা ধূলিকণাতেও, সেখানে কোথা থেকে জন্মাচ্ছে এই সমস্ত বেয়াড়া জন্তু জানোয়ার?

—“বস্?” মিহি গলার আওয়াজে চিন্তায় ছেদ পড়ল। ভুরু কুঁচকে চোখ খুললেন মোম্বা। দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়েছে একটা থ্যাবড়া মঙ্গোলিয়ান মুখ। টিম লিয়াং। তাঁর পার্সোনাল সেক্রেটারি। খুদে খুদে চোখ জোড়া মিউট করা টিভির দিকে বুলিয়েই ঘরের আবহাওয়া বুঝে গেল চটপটে ছেলেটা। আজ মিস্টার প্রেসিডেন্টের শস্য উৎপাদন নিয়ে একটা মিটিং এ যাওয়ার কথা। গত মাসে পৃথিবীর প্রয়োজনীয় মোট শস্যের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, তার ফলে বেশ কিছু জায়গায় অপুষ্ট শিশু জন্মানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। হাতের ই-প্যাড টা সাবধানে টেবিলে রাখল টিম। মিটিং এর আগে বাড়তি কথাবার্তা পছন্দ করেন না প্রেসিডেন্ট, কিন্তু আপাতত তাকে একটু অন্য প্রসঙ্গ তুলতেই হবে। মৃদু গলা খাঁকরে সে শুরু করল, “মস্কো সিটিগার্ডের প্রধান আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়, ভিডিও কলিং এ অপেক্ষা করছে। ওই রাক্ষুসে পাখির দল ওখানে প্রায় হাজার খানেকেরও বেশী লোককে মেরে ফেলেছে...”

—“ফেলেছে তো ফেলেছে!” কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা ইলেকট্রনিক সিগার ধরালেন মোম্বা। তারপর সামান্য বাঁকা হাসি টিমের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “আমি লোকেশানটা দেখেছি। ওই কলোনিটা এমনিতেই এই উইকে “নট নিডেড” লিস্টে ঢুকতো। লোকগুলো বেআইনি ভাবে কমিটিকে না জানিয়ে শুয়োর প্রতিপালন করছিল, খবর পেয়েছি। বরাদ্দ খাবারে নাকি ওনাদের পেট ভরে না! হুঁহ যত্তসব! ভালোই হয়েছে আপদ বিদেয় হয়েছে। বাট উই হ্যাভ টু ট্র্যাক ডাউন দিস অ্যানোনিমাস বার্ডস! কোথা থেকে আসছে, এদের পাওয়ার ঠিক কী কী... আর আগের জানোয়ার গুলোর ব্যাপারে কিছু ইনফো কি কালেক্ট করা গেল?”

—“সরি বস্,” মাথা নীচু করল টিম, “নট টিল নাও।”

—“হুম্,” চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, “লেটস গো।”

ই-প্যাড নিয়ে পেছন পেছন হাঁটছিল টিম। মস্কোর সিটিগার্ডের ব্যাকুল মুখটাকে সোয়াইপ করে দিয়ে আলগোছে বলল, “ওহ্, আরেকটা খবর শুনেছেন?”

—“কী?” ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হালকা গলায় বললেন মোম্বা।

—“গত কাল কিংস জেনারেল হসপিটালের নিউরো সাইকায়াট্রিস্ট ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে ইউ এন। দ্যাট গ্রেট সায়েন্টিস্ট!”

দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রেসিডেন্ট। চমকে তাকালেন সহকারীর দিকে। ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে তাঁর কৃষ্ণবর্ণ মুখ, চোখ দুটোতে যেন গনগনে আগুনের আঁচে মিশে আছে ক্রোধ,সন্দেহ আর আতঙ্ক! সেই চোখের সামনে ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে থাকল একটা কনফারেন্স হল আর স্টেজে বক্তৃতা দেওয়া এক তরুণ।

***

—“আহহ্!” একটা করুণ আর্তনাদ ভেসে এল।

মুখ তুলে তাকালো এলিজাবেথ। একটা অস্বাভাবিক রুগ্ন মুখ কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই ক’দিনে কী চেহারা হয়েছে লোকটার! এলিজাবেথের মনে পড়ে গেল সেই উজ্জ্বল সৌম্যকান্তি চেহারা। রিমলেস চশমার পেছনে গভীর দীঘল দুটো চোখ, বড় বড় পাতা। কারোর দিকে তাকালেই মনে হত মনের ভেতর অব্দি পড়ে নিল বুঝি! দাদার ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামে গিয়ে সেই যে চোখ দুটোর প্রেমে পড়ল ও, আর সারাজীবন অন্য কারো দিকে যেন তাকাতেই পারলো না। উৎসবও যেন মগ্ন তপস্বীর মতো ডুবে ছিল বিজ্ঞান সাধনায়, কোনো নারীর প্রতি ছিটেফোঁটাও আসক্তি কোনোদিন প্রকাশ করেনি। এলিজাবেথ ছিল তার কাছে শুধুমাত্র সহপাঠীর বোন, আর কিছুই না। জীবনের ভাঙাগড়ায় এরপর দুজনের জীবন গড়িয়ে গেছে দুদিকে, শুধু উৎসবের ব্যাপারে একটা প্রচ্ছন্ন কৌতূহল বরাবরই থেকে গেছে এলিজাবেথের মধ্যে। তাই পাঁচবছর আগের সেই বিশ্ববিখ্যাত কনফারেন্সে উৎসবের স্পিচ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল সে। কোনো সুস্থ মানুষের মাথায় কি এমন ভাবনা চিন্তা আসতে পারে! তখন থেকেই হয়ত বিকৃতির বীজটা পোঁতা হয়ে গেছিল ওর ভেতরে, আর আজ তো...

—“লি… জাআ!” একটা অস্ফুট জড়ানো কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল এলিজাবেথ। খাটের ওপর উঠে বসেছে পাকানো শরীরটা, শান্ত চোখে তাকে দেখছে। তাকে চিনতে পেরেছে উৎসব! পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার এককালের আকাঙ্খিত পুরুষের দিকে। সারা গায়ে বিশ্রী কালো কালো ছোপ, কোন ইনফেকশনে কে জানে ঠোঁট দুটো ফুলে উঠে মুখের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, যেটুকু আছে তাও যেন গায়ের মোটা মোটা খয়েরি লোম থেকে কেটে বসানো। চোখ গুলো কোটরে বসা। প্রথম দিন ওকে দেখে চমকে উঠেছিল এলিজাবেথ। হুইল চেয়ারে কুঁজো হয়ে থাকা লোকটা যে উৎসব, বিশ্বাস করতে পারেনি। তবে শেষ পর্যন্ত চিনিয়ে দিয়েছিল ওই চোখদুটোই। হসপিটালের বাকি স্টাফেরাও বিশ্বাস করতে পারেনি যে, বিশ্ব বিজ্ঞান সম্মেলন মঞ্চে সাবলীল ভাষায় বক্তৃতা দেওয়া, পাঁচশোরও বেশী থিসিস পেপার লেখা, একাধারে জীব বিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনের “আধুনিক মহীরুহ” উপাধি পাওয়া সেই জিনিয়াস ডঃ ইউ এন আজ কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে অর্ধোন্মাদ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন! তারপর নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা সত্ত্বেও ডাক্তাররা বুঝতে পারেননি ওর এই অদ্ভুত বিকৃত মুখমণ্ডল, খসে পড়া চামড়া, কদাকার শারীরিক গঠনের রহস্য। উৎসবের ওই অদ্ভুত অসংলগ্ন কথাবার্তা, ক্রমাগত “সব শেষ হয়ে যাবে, সব ধ্বংস হয়ে যাবে” চিৎকারের ফলে শেষ পর্যন্ত নিউরো সাইকায়াট্রিস্ট বিভাগে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তাররা। আজ দু’দিন হয়ে গেল অবস্থার কোনো উন্নতি তো হয়ইনি, উল্টে অবনতি ঘটছে দ্রুত।

চোখ নামিয়ে নিল এলিজাবেথ। সেডেটিভের ইঞ্জেকশন টা স্বয়ংক্রিয় মেশিনের ট্রে তে রাখতেই ঘরঘর শব্দে সেটা সরে গেল পাশের কেবিনের নার্সের দিকে।

—“লেইইইজাআআ,” যেন খুব কষ্ট করে আবার কথাগুলো উচ্চারণ করলেন ডঃ নিয়োগী।

—“কিছু বলবেন?” নার্স সুলভ ভাবলেশহীন গলায় বলল এলিজাবেথ।

—“তুমি...” হাতছানি দিয়ে তার বিছানার পাশে বসতে ইশারা করল উৎসব। এলিজাবেথ বসতেই তার দিকে ঝুঁকে পড়ে চোখে চোখ রেখে ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠল, “আমার হাতে বেশী সময় নেই... কেউ আমার কথা বুঝতে পারছে না। এরপর হয়ত ভাষাও বুঝতে পারবে না। তুমি অন্তত প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করো! আমার রিসার্চ ভুল নয়! সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে! এটাই একমাত্র পথ!” বলতে বলতে কোমরে গোঁজা একটা ছোট্ট জিনিস এলিজাবেথের হাতে দিয়ে মুঠো বন্ধ করে দিল।

বিস্ফারিত চোখে নিজের হাতের মুঠোয় জিনিসটার দিকে তাকিয়ে থাকল এলিজাবেথ!

***

—“হেয়ার’স দ্য ফুড!” ক্লাব স্যান্ডউইচ আর ব্ল্যাক কফির ট্রে সামনে এনে রাখল ড্যানি। তারপর চেয়ার টেনে বসে বলল, “তারপর? পাগলা সায়েন্টিস্টের খবর কী?”

—“খবর...” শুকনো হাসল এলিজাবেথ, “তেমন কিছু না। ওই একইরকম। বরং আরো ডিটোরিয়েট করছে।”

—“এই জন্যে বাবা আমি বেশীদূর পড়িনি-টড়িনি,” কফিতে ফুঁ দিতে দিতে ড্যানি হালকা গলায় মাথা নেড়ে বলল, “হসপিটালের রিসেপশনিস্টের চাকরিই ঠিক আছে। বেশী পড়লে কী হয় তো দেখতেই পাচ্ছি!”

কোনো উত্তর দিল না এলিজাবেথ। হাসলও না। শুধু গলার নীল পাথরের লকেটটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দূরের দিকে।”কী রে? কী ভাবতে বসলি?” নাকের সামনে তুড়ি বাজালো ড্যানি। অল্প হেসে কফিতে মনোনিবেশ করল এলিজাবেথ। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে ড্যানির মুখের দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বলল, “ভাবছি, যদি ওর কথা সত্যি হয়?”

একমুখ স্যান্ডউইচ সমেত হো হো করে হেসে উঠল ড্যানি। তারপর কোনোমতে নিজেকে সামলে বলল, “ওই পাগলের সেবা করতে করতে তুইও পাগল হয়ে গেলি লিজা? লোকটা কী বলেছিল মনে আছে?”

খুব মনে আছে। ওর অ্যাটেন্ড করা প্রত্যেকটা ইন্টারভিউ, সেমিনার, কনফারেন্সের ভিডিও দেখত এলিজাবেথ, ফলো করত ওকে নিয়ে তৈরী সমস্ত নিউজ। আর ওই ঐতিহাসিক কনফারেন্সের কথা তো সবাই জানে! ২০৭০ এর ওয়ার্ল্ড সায়েন্স কনফারেন্স, থিম ছিল “ফর আ বেটার প্ল্যানেট”। ওই কনফারেন্সেই বোমাটা ফাটিয়েছিল উৎসব।” লোকটা বলেছিল এই ২০৭৫ এর ১৫ই জুন নাকি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে! ও সরি সরি, পৃথিবী না, মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে!” ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল ড্যানি, “ভালো কথা। কিন্তু তার থেকে বাঁচার উপায় কী? না আদিম যুগে ফিরে যাওয়া! এতদিনের অর্জিত জ্ঞান, বিদ্যা বুদ্ধি সব জলাঞ্জলি দিয়ে আবার শুরু থেকে শুরু করা! এটা কখনো সম্ভব! আর তা নাহলে নাকি প্রকৃতি তার রিভেঞ্জ নেবে! হাউ ফানি!”

—“কিন্তু প্রকৃতি কি সত্যিই রিভেঞ্জ নিচ্ছে না?” উত্তেজিত গলায় সোজা হয়ে বসেছে এলিজাবেথ। চোখ দুটো যেন হীরের মতো জ্বলজ্বল করছে!”এই যে গত কয়েক মাস ধরে শুরু হওয়া ভূমিকম্প, সাইক্লোন, সুনামি... এগুলো কি তারই ইঙ্গিত নয়?”

—“ওহ্ কাম অন লিজা!” ঠোঁট বাঁকালো ড্যানি, “দোজ আর কোইন্সিডেন্টস। তাহলে এই যে এখন হঠাৎ হঠাৎ করে সব আজব জীবজন্তু হাজির হয়ে মানুষকে সাবাড় করছে, এটাকেও প্রকৃতির প্রতিশোধ বলবি?”

—“কিন্তু এটা তো মানবি, যে ওই জীবেদের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ন্যাচারাল ডিজাস্টার হওয়া অনেক কমে গেছে!” উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠল এলিজাবেথ। ব্যাগ থেকে ই-প্যাড বের করে উঠে গিয়ে ড্যানির নাকের সামনে ধরে বলল, “এই দেখ গ্রাফ। গত এক বছরে একটু একটু করে প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা রোজ বেড়েই গেছে পৃথিবীতে! বেড়েছে তার ইন্টেনসিটি, বেড়েছে মৃত মানুষের সংখ্যাও। একদম এক্সপোনেনশিয়াল কার্ভ! ১৫ই জুন হতে আর দশ দিন বাকি ড্যানি! উৎসব ভুল ছিল না! এই কার্ভ সত্যিই তার হায়েস্ট পিকে পৌঁছাচ্ছে এই সময়টাতেই, যখন পৃথিবীতে জীবিত মানুষের সংখ্যা দেখাচ্ছে শূণ্য! আর প্রথম ওই বাঘের ঘটনাটা ঘটেছিল কবে? ১৫ই জানুয়ারি। এই দেখ, সেদিনের ডেটা... কার্ভ আস্তে আস্তে শিফট হচ্ছে নীচের দিকে। খুব ধীরে, কিন্তু হচ্ছে। এর পরেও বলবি!” একটানা বলে হাঁফাতে হাঁফাতে বসে পড়ল লিজা।

থতমত খেয়ে ভেবলে যাওয়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল ড্যানি। হঠাৎ পিঁক পিঁক আওয়াজে পকেট থেকে ছোট্ট ট্যাবলেটটা বের করে দেখল। মেসেজ জ্বলজ্বল করছে, “প্রেসিডেন্ট ইজ অ্যারাইভিং ইন ওয়ান আওয়ার।” হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল! এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে স্যান্ডউইচ ধরে তাড়াতাড়ি উঠতে উঠতে বলল, “প্রেসিডেন্ট আসছে! আমি চললাম ভাই! তবে...” যেতে যেতে একবার পেছন ঘুরল ড্যানি, “ন্যাচারাল ক্যালামিটিতে না হলেও ওই সব ডেঞ্জারাস অ্যানিমেলস এর দয়াতেও আলটিমেটলি মানুষ মরছে লিজা! এটার ব্যাখ্যা নাহয় পরে শুনবো তোর থেকে!” ক্যান্টিনের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল ড্যানি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলিজাবেথ। ওরা ফিরছে। আবার নতুনভাবে ফিরছে পৃথিবীর বুকে। কারণটা এখন ও জানে। দ্য গ্রেট ইউ এনের ব্যাপারে একটা কথা বরাবর প্রচলিত, প্রকৃতির ভাষা বুঝতে পারে ও। কবে পৃথিবীর বুক থেকে ডাইনোসরের হারিয়ে যাবে কিংবা তুষার যুগের শুরু হবে কবে... সবটাই নাকি ওদের জিনের বিশ্লেষণ করে আগে থেকে জানা সম্ভব ছিল, সে কথা তো প্রথম বিশ্বের সামনে আনে উৎসবই! সেই গবেষণা ওকে এনে দিয়েছিল বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরস্কারও, ধন্য ধন্য করেছিল বিশ্বজোড়া মানুষ। কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে কেন সেটা মানতে পারলো না কেউ!

হঠাৎ চোখদুটো খুব জ্বালা করে উঠল এলিজাবেথের।

***

গাড়িতে বসে বারবার গ্রাফটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন শেরিং মোম্বা। এই গ্রাফ তৈরী করেছে স্বয়ং তাঁর অফিস। সচরাচর পৃথিবীর ভালোমন্দ সংক্রান্ত এই ধরনের ডেটা কখনোই ওয়েবে আপলোড করার অনুমতি থাকে না, অথচ এবারে কী করে যেন ছড়িয়ে পড়েছে তথ্যটা। অন্যসময় হলে ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট তুলকালাম করতেন তিনি, কিন্তু এখন সামনে আরো বড় বিপদ। আজ সকালেই নিউইয়র্কের একটা প্রান্তিক জায়গা ছেয়ে গেছে একধরনের বড় বড় জালার মতো মাথাওলা মানুষ খেকো গাছ। প্রায় পঞ্চাশেরও বেশী মানুষ ইতিমধ্যে সেই গাছের শিকার হয়েছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই ওই শয়তান বৈজ্ঞানিকের হাত আছে! পাঁচ বছর আগের ওই কনফারেন্সের পর থেকে সব ছেড়েছুড়ে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছিল লোকটা। ও যে আদৌ বেঁচে আছে, পৃথিবীর লোক তাইই জানতো না! এতদিন পরে পাগল সেজে ফিরেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে এই সব ভয়ঙ্কর জীবজন্তু-গাছপালা। ওর একটা হেস্তনেস্ত আজ করেই ছাড়বেন তিনি! হসপিটালের সামনে গাড়ি থেকে নেমেই গটগট করে ঢুকে গেলেন প্রেসিডেন্ট। কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। স্যালুট করে দাঁড়ালো সবাই, অভ্যর্থনার জন্য পানীয় এল। সেসবের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন রিসেপশনিস্ট ছেলেটির সামনে। কর্তৃত্ব ব্যঞ্জক গলায় বললেন, “টেক মি টু দ্য ওয়ার্ড অফ মিস্টার উৎসব নিয়োগী!”

বিছানার ওপর বসে দুহাতে কামড়ে কামড়ে একটা আপেল খাচ্ছিলেন ডঃ নিয়োগী। অস্বাভাবিক দ্রুততায় তাঁর শারীরিক অবস্থার পতন হচ্ছে। ঠেলে উঠেছে দুই হনু, চোখগুলো যেন আরো ছোট ছোট হয়ে বসে গেছে উঁচু কপালের নীচে। চোখের সামনে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে গেলেন প্রেসিডেন্ট। তারপর গম্ভীর গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “কেমন আছেন ডঃ ইউ এন?”

আপেল খেতে থাকা প্রাণীটির তাতে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। শুধু একবার মাড়ি বের করে হেসে সে আবার মনোযোগ দিল আপেলে। এমন স্পর্ধায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট! তাঁর এক ইশারায় সশস্ত্র আর্মি ছিনিয়ে নিল আপেলটা, ঘাড় ধরে সোজা করে দিল রুগ্ন শরীরটাকে। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রেসিডেন্টের দিকে চাইলেন ইউ এন। তার দিকে ঝুঁকে প্রচণ্ড আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠলেন মোম্বা, “হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান? হাঁহ! এত বছর ধরে কী ষড়যন্ত্র করেছ তুমি? এই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীগুলো আবার ফিরে আসছে কোথা থেকে! কী মতলব তোমার? বলো!” প্রেসিডেন্টের হুঙ্কারে উপস্থিত বাকীরাও যেন আমূল কেঁপে উঠল। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলেন ইউ এন। তাঁর এই নীরবতা সহ্য হল না শেরিং মোম্বার। সহজে এ ভাঙবে না! তবে একে কীভাবে ভাঙতে হবে সেটা তিনি ভালোই জানেন! চিৎকার করে আদেশ দিলেন আর্মিকে, “একে এক্ষুণি বেঁধে নিয়ে যাও আলাদা সেলে। ইলেকট্রিক শক আর স্লো ব্লিডিং করাবে যতক্ষণ না প্রশ্নের উত্তর দেয়! আমিও দেখব কতক্ষণ টেকে এই পাগলামির নাটক!”

এক দুর্বোধ্য আওয়াজ করে হাততালি দিয়ে উঠলেন ডঃ নিয়োগী। যেন ভারী মজা পেয়েছেন। তারপরেই অবশ্য তাঁর মুখের ওপর আছড়ে পড়ল এক বিশাল ঘুঁষি। কিছু পরে হাত পা বেঁধে মেঝের ওপর দিয়ে তাঁকে টানতে টানতে নিয়ে চলল প্রেসিডেন্টের সেনারা। কেউ ভালো করে খেয়াল করলে শুনতে পেত, একটা অদ্ভুত ভাষার গোঙানি উঠে আসছে তাঁর গলা দিয়ে। এ ভাষা কোনো মানুষের নয়। তবে তার মধ্যেও চেনা যায় ছেঁড়া ছেঁড়া কয়েকটা শব্দ... “কিচ্ছু করতে পারবে না! কিচ্ছু করতে পারবে না তোমরা! সে আছে! আমি মরে গেলেও সে থাকবে! সবাইকে আবার ফিরিয়ে আনবে এই গ্রহে! বাঁচার এখন একটাই রাস্তা...”

***

রাতের কালো চাদর আকাশ থেকে নেমে এসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেছে শহরের আনাচে কানাচে। ঠিক যেন কোনো গোপন শত্রুর মতো আস্তে আস্তে গোটা নিউইয়র্ক কে জড়িয়ে ধরছে তার লম্বা কালো আঙুল দিয়ে। একখানা ঘোলাটে চাঁদ উঠেছে আকাশে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার নেমে আসা দেখছিল এলিজাবেথ। সূর্য ডুবে গেলেও বাতাসে এখনো গরম হলকা, দাঁড়ানো যায় না বেশীক্ষণ। এটাই এখন এখানে স্বাভাবিক। নরম, ঠান্ডা, আদুরে শব্দগুলো যেন মৃত ভাষার মতো হারিয়ে গেছে মানুষের জীবন থেকে। তবুও প্রতিদিন হসপিটালের স্টাফ কোয়াটার্সে তার এই ছোট্ট বারান্দায় দাঁড়ায় এলিজাবেথ। উষ্ণ বাতাসের স্পর্শে খোঁজার চেষ্টা করে শব্দ গুলোর মানে। অন্ধকারকে চোখে নিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে ঠাকুমার বলা সেই রূপকথার মায়াময় পৃথিবীটাকে। কিন্তু আজ মনে পড়ছে অন্য একজনের কথা। প্রেসিডেন্টের আর্মি আজ তুলে নিয়ে গেছে উৎসবকে। ওখানে অকথ্য অত্যাচার করে ওর কাছ থেকে বের করা হবে সেই কথাগুলো, যেগুলো আজ সকালে এলিজাবেথকে পরম বিশ্বাসে বলে গিয়েছে উৎসব। সামান্য কেঁপে উঠল এলিজাবেথ। প্রথমবারের মতো তার হাত ধরেছিল সে। সেই খসখসে, বড় বড় নখওলা লোমশ হাত দিয়ে সে ধরেছিল তার হাত আর অনেক কষ্টে খুলে বলেছিল সবকিছু।

“লিজা, আমি ভুল ছিলাম না, বিশ্বাস করো! হ্যাঁ, আমার গবেষণা দিয়ে আজ পৃথিবীতে সমস্ত আদিম প্রাণীকে ফিরিয়ে এনেছি আমিই। এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না! আমাদের এই কৃত্রিম, অত্যাচারী, সুচতুর কার্যকলাপে হাঁফিয়ে উঠেছে প্রকৃতি, সব কিছু পেছনে ফেলে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে তার কাছে ফিরে না গেলে যে সে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে! একথা আমি বলছি না, এ সবই লেখা আছে আমাদের জিনে, আমাদের বিবর্তনে। আমি শুধু উদ্ধার করেছি মাত্র। এ গ্রহ তো আমাদের একার নয়! প্রকৃতি আবার ফিরে পেতে চায় তার সমস্ত সন্তানকে। আর আবারও আগের মতোই এক্ষেত্রে হবে যোগ্যতমের উদ্বর্তন। একথা আমি কাউকে বোঝাতে পারিনি। অন্তত তুমি যদি বোঝাতে পারো তাদের!”

কয়েক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়ল এলিজাবেথের গাল বেয়ে। তবে কি দিন শেষ হয়ে আসছে এই পৃথিবীর? নাকি অন্ধকারের জগত পেরিয়ে আবার সোনালী সূর্যকে বুকে নিয়ে জন্ম নেবে নতুন পৃথিবী? আবার কি বসন্তকালে নতুন পাতা গজাবে ম্যাপলের গায়ে? আবার বইবে সেই নরম আদুরে বাতাস? সে কি ছুটে বেড়াবে সেই একটুকরো খোলা মাঠে, অন্য কোনো রূপে? অন্য কোনো পরিচয়ে?

হাতের মুঠোয় থাকা সবুজ তরলের শিশিটা খুলল এলিজাবেথ।

সেই রাতে হসপিটালের মাটির নীচের গোপন সেলের গরাদ ভেঙ্গে ফেলল এক উলঙ্গ ছায়ামূর্তি। এক অস্ফুট উল্লাসের শব্দ করতে করতে মিশে গেল অন্ধকার প্রকৃতির বুকে।

***

একটা নরম আলো মুখে পড়তে ঘুম ভেঙ্গে গেল শেরিং মোম্বার। স্বচ্ছ জানালার ওপার দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছানা কাটা জল রঙের আকাশ বেয়ে উঁকি দিচ্ছে হালকা গোলাপী রঙের সূর্য। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। উঠে বসতেই মিঠে সুরে সুপ্রভাত জানালো স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম। আয়েশ করে আড়মোড়া ভাঙলেন মোম্বা। দূরে রাস্তার ওপারটায় বড় বড় সবুজ গাছ দেখা যাচ্ছে। যেন জঙ্গল হয়ে আছে। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। থোকায় থোকায় হলুদ ফুল তাতে। আহ্, চোখ দুটো যেন জুড়িয়ে গেল! এমন সুন্দর সকাল শেষ কবে দেখেছেন মনেও নেই। শান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সেই অনাবিল সবুজের দিকে। নধরকান্তি গাছগুলো অল্প অল্প হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা কুটকুটে অস্বস্তি মাথা চাড়া দিতে লাগল তাঁর ভেতরে। কী যেন ঠিক মিলছে না! কিন্তু বেশীক্ষণ ভাবার সময় পেলেন না, ঝনঝন শব্দে বেজে উঠেছে তাঁর স্যাটেলাইট ফোন। ভরাট গলার “হ্যালো” শেষ হতে না হতেই অপর প্রান্ত হতে ভেসে এল টিমের কাটা কাটা স্বর... “বস্! সর্বনাশ হয়ে গেছে!”

—“কী সর্বনাশ? তুমি কোথায়?” ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর।

—“আআমি হসপিটালে...” গলা কেঁপে উঠল তাঁর সহকারীর, “ইউ এন... কাল রাতে পালিয়েছে... আর এখানে... ওফ্! আমাকে বাঁচান প্লিজ! আমার গাড়িটাকে ওরা ঘিরে ফেলেছে...”

ইউ এন পালিয়ে গেছে! রাগে জ্বলে উঠে গনগনে গলায় মোম্বা বললেন, “যত্তসব অপদার্থ! একটা লোককে ধরে রাখতে পারলো না! আর কে তোমার গাড়ি ঘিরে ফেলেছে?”

—“অনেক গাছ বস্! অনেক হলুদ হলুদ ফুল তাতে! কিন্তু আমার কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে... ওহ্... বাকিরা মরে গেছে... আমি নিঃশ্বাস নিতে...” প্রবল কাশির দমকে পরিণত হল টিমের আর্ত চিৎকার! এক মর্মান্তিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল তার আর্তনাদ! লাইন কেটে গেল।

ফোনটা রেখে দিয়ে হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন মোম্বা। সারা শরীর ঘামে জবজব করছে। হঠাৎ সামনের সেই সবুজ বনরাজির দিকে চোখ পড়তেই মাথার ভেতর এক তীব্র আঘাতে যেন খসে পড়ল চোখের সামনে থাকা একটা পর্দা! আর ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলেন তাঁর অস্বস্তির কারণটা কী। আজ যেখানে নরম হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে উঁচু উঁচু গাছের জঙ্গল, গতকাল অব্দিও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর গর্ব, তাঁর “মেগা ডেটা সেন্টার”!

প্রচণ্ড চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেলেন শেরিং মোম্বা! আতঙ্ক একটা বরফ চাঙড়ের মতো ভাসতে ভাসতে নামছে তাঁর শরীর বেয়ে। শরীরের সমস্ত পেশী যেন বিদ্রোহ করেছে, অসাড় শরীর জমতে শুরু করেছে পাথরের মতো। ওই তো, একটু আগের সূর্য দেখা জানালাটা দিয়ে মুখ বাড়িয়েছে একটা কচি ডাল। তার আগায় ফুটে আছে এক ছোট্ট হলদে ফুল। আবছা চোখে সেই নিষ্পাপ ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুভব করলেন অদৃশ্য কেউ যেন ভারী রড কণ্ঠনালীতে চেপে চড়ে বসেছে তাঁর বুকের ওপর। দম বন্ধ হয়ে আসছে। অবশ হাত দিয়ে নিজের গলাটাকে আলগা করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে শেষবারের মতো প্রেসিডেন্ট দেখলেন, জানালা দিয়ে যেন ঢুকে আসছে শত শত ডাল...উন্মত্তের মতো মাথা তুলছে কংক্রিটের দেওয়াল বেয়ে। আর তাদের চকচকে গা থেকে বেরিয়ে আসছে লক্ষ লক্ষ আকর্ষ... সাপের মতো এগিয়ে আসছে তাঁর শরীরের খুব কাছে...

***

থামলাম। আমার সামনে থেকে উঠে সে ততক্ষণে মনোযোগ দিয়েছে সামনের গাছটার তলায় পড়ে থাকা কিছু ফেটে যাওয়া ফলের ওপর। মন দিয়ে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, আমি দেখছি। গত ক’দিন ধরেই প্রত্যেকটা দিন কাটছে এই একই গল্প শুনিয়ে, আর একজনের অপেক্ষা করে করে। তবে আমার শ্রোতা ততটা মনোযোগী নয়, হয়ত আমার গলার স্বর পছন্দ হচ্ছে না তার। ফল খেয়ে বীজগুলো হাতে লুফতে লুফতে আবার আমার কাছে ফিরে এল সে। উঁচু কপাল, থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট। ছ’ফুটের ওপর লম্বা হলেও সামান্য কুঁজো শরীরটার মাথা থেকে পা অব্দি ঘন খয়েরি লোমে ঢাকা। হোমো ইরেক্টাস। এই কিছুদিন আগে অব্দিও এনাকে চিনতাম অন্য নামে, অন্য পরিচয়ে। বিবর্তনের পাতায় কয়েক যুগ পিছিয়ে গেলেও ইনিই আমার জন্মদাতা। আমাকে জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাঁচ বছর আগে শুরু হয়েছিল যাঁর পথচলা। বিশ্বসুদ্ধ মানুষের সামনে অপমানিত, ভৎর্সিত হওয়ার পর সবার চোখের আড়ালে এক ভাঙা ওয়ার বাঙ্কারের নীচে মাটির তলায় লুকিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর আস্তানা। প্রেসিডেন্টের শ্যেন দৃষ্টি বাঁচিয়ে বছরের পর বছর ধরে সেখানেই চলেছে তাঁর সাধনা, জন্ম হয়েছে আমার। তারপর থেকে রাত দিন কেটেছে তাঁরই সাহচর্যে। তাঁর সাহায্যকারী হিসেবে আমি বেআইনি ভাবে ঢুকে পড়েছি “মেগা ডেটা সেন্টার” এর তথ্যভাণ্ডারে, তুলে এনেছি সমস্ত তথ্য, যা বিশ্লেষণ করে প্রেসিডেন্টের চোখের আড়ালেই তিনি নিজে তুলে নিয়েছেন সমস্ত পৃথিবী চালনার ভার। বিবর্তনের পথে উঠে আসা বিলুপ্ত প্রজাতিগুলোর সংরক্ষিত জিন থেকে আবার নতুন করে জন্ম দিয়েছেন তাদের। তাঁর অবিশ্বাস্য দক্ষতাতেই তাদের বংশবৃদ্ধি হয়েছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। আর তারপর তিনি আবিষ্কার করেছেন মানুষের বিবর্তনের পাতায় পিছিয়ে যাওয়ার সেই হরমোন। তিনি বুঝেছিলেন এটাই বাঁচার একমাত্র উপায়। যদি সভ্যতার ইতিহাসে কয়েক যুগ পিছিয়ে যেতে পারে মানুষ, তবেই হয়ত তার সেই আদিম রূপকে ক্ষমা করে দেবে প্রকৃতি।

খানিক দূরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে একটা খচমচ শব্দ হচ্ছে। কে যেন আসছে। তবে কি সে এসে গেল? হ্যাঁ, ঘন ঘাস জঙ্গলের পেছন দিয়ে উঁকি দিল আরেকটা মুখ। সেই উঁচু হনু, চ্যাপ্টা মাড়িসর্বস্ব মুখ। গলায় ঝুলছে একটা নীল পাথরের লকেট। ধীরে ধীরে ছোট মাঠটা পেরিয়ে এল সে। এখন স্পষ্ট দেখা যায় তার নগ্ন শরীর। সামান্য উঁচু হয়ে থাকা স্তন, ত্রিকোণাকৃতি যোনিপথ বলে দিচ্ছে এ আগের জনের থেকে আলাদা। বহু অধ্যবসায়ে তৈরী সেই জিনম্যাপিং ইঞ্জেকশন যখন প্রথমবার নিজের শরীরে প্রয়োগ করেছিলেন সেই নির্ভীক সায়েন্টিস্ট, তখনই কি দ্বিতীয় ইঞ্জেকশনে লেখা হয়ে গেছিল এঁর নাম? সেটা বিশ্লেষণ করার কাজ অবশ্য আমার নয়। বাঙ্কারের সেই সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি তে এখনও সাজানো আছে লক্ষ লক্ষ জিনম্যাপিং ইঞ্জেকশন, যারা হয়ত কালের নিয়মে ধ্বংস হয়ে যাবে। যে মানবজাতির কল্যাণের জন্য ছিল ইঞ্জেকশনগুলো, শুধুমাত্র অবিশ্বাসের দায়ে ধূলিসাৎ হবে সেসব।

কৌতূহলী চোখে নতুন আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে আছে আমার শ্রোতা। এবার প্রকৃতিই মিলিয়ে দেবে ওদের পথ। আমার কাজ এতদূর অব্দিই ছিল। আমি রেনেসাঁ, পুরোনো পৃথিবীর সর্বকালের উন্নততম সুপারম্যাক্স রোবোম্যান, নতুন পৃথিবী তৈরীর এই পুরো প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করেছি, যথাযথভাবে পালন করেছি ডঃ নিয়োগীর এই বিপদসঙ্কুল পরীক্ষায় ঝাঁপ দেওয়ার আগে দিয়ে যাওয়া সমস্ত দায়িত্ব। এখন আমার যাওয়ার পালা। আজ ১৫ই জুন ২০৭৫, আমার তৈরী এই নতুন পৃথিবী উপহার দিয়ে যাচ্ছি আগত মানবজাতিকে। আর দিয়ে যাচ্ছি এই সমস্ত তথ্য, সমস্ত স্মৃতি সম্বলিত একটা ব্ল্যাকবক্স, যা কখনোই ধ্বংস হবে না। কালের নিয়মে একদিন সেটা খুঁজে পাবে মানুষ, জানতে পারবে তাদের ফেলে আসা সমস্ত লোভ-লালসা-হিংসার কথা।

ভালো থাকবেন ডঃ নিয়োগী, ভালো থাকবেন এলিজাবেথ।

পিঁক শব্দ করে জ্বলে উঠল একটা উজ্জ্বল লাল আলো। অবোধ দুই প্রাণীকে অবাক করে দিয়ে স্ক্রীনে গোটা গোটা অক্ষরে ভেসে উঠল কয়েকটা অমোঘ শব্দ।

“সেলফ ডেস্ট্রাকশান মোড অন...

টেন...নাইন...এইট...সেভেন...সিক্স...ফাইভ...ফোর...থ্রি...টু...ওয়ান...”