খেলা শেষ? - সায়নদীপা পলমল

উপন্যাস

পড়ন্ত বিকেলের লাল শামিয়ানাটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দিয়া। মাঝে মাঝে এক দুটো পাখি শামিয়ানা ভেদ করে ছুটে চলেছে বাড়ি ফেরার তাগিদে, দিয়া চিনতে পারে না ওদের, দূর থেকে সবাইকে কালো দেখায়। না চিনতে পারলেও দিয়া জানে ওরা ঠিক বাড়ি ফিরে যাবে আর কিছু পরেই, কিন্তু দিয়া!

বাড়ি বলতে ঠিক কী, দিয়া আজ অবধি সেই মানে বুঝতেই ব্যস্ত। বাবার ট্রান্সফারের চাকরি, ছোটবেলার থেকেই তাই ভবঘুরে জীবন দিয়ার। মাঝে মাঝে খুব লোভ হয় ওর, একটা বাড়ি থাকবে যার প্রতিটা কোণায় জড়িয়ে থাকবে ওর পাঁচ বছরের স্মৃতি, দশ বছরের স্মৃতি, বিশ বছরের… নাহ পাঁচ, দশ সব পিছলে গিয়েছে দিয়ার জীবন থেকে, এ কোয়ার্টার থেকে সে কোয়ার্টার কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পর কোনোটাই ওর বাড়ি না। দিয়ার এখন ক্লাস এইট চলছে, আর দু’বছর পরে মাধ্যমিক। দিয়া জানে খুব সম্ভবত এই স্কুলটা থেকেই তাকে মাধ্যমিক দিতে হবে যেই স্কুলটা তার একদম পছন্দ নয়।

আজ স্কুলের প্রথম দিন ছিলো। এতদিন গার্লস স্কুলেই পড়তে অভ্যস্ত দিয়া আচমকা কো-এড স্কুলে গিয়ে যেমন থতমত খেয়েছিল তেমনই একরাশ শূন্যতাও এসে ঘিরে ধরেছিলো, যখন টিফিনের সময় একলা বসে টিফিন খেতে হল। এতদিন দিয়া যে স্কুলেই গেছে সেই স্কুলেই কেউ না কেউ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল প্রথম দিনই, কিন্তু এই স্কুলটা ব্যতিক্রম। আসলে এই কুশারীগঞ্জ জায়গাটাই কেমন যেন, পুরোনো পুরোনো, স্যাঁতস্যাঁতে… দেখলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।

***

ছবি আঁকতে ভালোবাসে দিয়া। আজ বিকেলে ছাদে মাদুর পেতে খাতা কলম নিয়ে বসেছিলো তাই, কিন্তু মন খারাপের ছবি ছাড়া কিছুই ফুটতে চাইলো না পেন্সিলের ডগায়। নিচের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল কালচে সবুজ শ্যাওলার মেলা আর ওপর দিকে পড়ন্ত বিকেল, মন খারাপকে বাড়িয়ে দিতে আর কী চাই! বিরক্তিভরে আঁকার খাতাটা বন্ধ করলো দিয়া, আর তৎক্ষণাৎ ওর পাশেই খট করে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ হল। চমকে উঠল দিয়া, তাকিয়ে দেখলো ওর পাশে এসে পড়েছে একটা নীল রঙের ঘুড়ি। দিয়া জানে এই ঘুড়িটার নাম হল পেটকাটি, ওর আগের স্কুলের বন্ধু শ্রীজাতা চিনিয়েছিল ওকে। আস্তে আস্তে মাদুর ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে ঘুড়িটা হাতে তুলল দিয়া, তারপর মাথা তুলে আশেপাশের বাড়িগুলো দেখার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো কিছুটা দূরের একটা বাড়ির ছাদে একটা ছেলে যেন দ্রুত আড়ালে সরে দাঁড়ালো। অবাক হল দিয়া, তবে কি ওই ছেলেটারই ঘুড়ি? কিন্তু ও সেটা ফেরৎ না চেয়ে এভাবে পালালো কেন!

বুকের ভেতরটা কেমন যেন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে আকাশের। হাতের সামনে থাকা জ্যামিতি বক্সের কাঁটা কম্পাসটা নিয়ে সজোরে সে ফুটিয়ে দিল সাদা অঙ্ক খাতাটার ওপর, একটা খুব ক্ষীণ শব্দ করে কম্পাসের কাঁটাটা খাতার বুকটাকে বিদ্ধ করে নেমে গেল নিচে। কম্পাসটা আবার সজোরে টেনে বের করে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে আকাশ। একটা ধাতব শব্দ তৈরি হল, সেই শব্দ শুনে ঘরে ছুটে এলো তানি, “কী হয়েছে রে দাদাভাই?”

আকাশ উত্তর দিলো না, একটা অদ্ভুত শীতল দৃষ্টি নিয়ে তাকাল তানির দিকে, ভয়ে সিঁটিয়ে গেল মেয়েটা। আর কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে গেল সে। আকাশ এবার দু’হাতের তালু দিয়ে মুখটাকে আস্তে আস্তে ঢেকে ফেলল, ওর শরীরটা কাঁপতে শুরু করল তিরতির করে। মনে হল কিছুই কি তবে ওর হতে পারে না? এ জগতে ওর কি কিছুই নেই? একটা সামান্য ঘুড়িও ওর কাছ থেকে চলে গেলো! আকাশের বন্ধ চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে এলো সেই দিনটার ছবি যেদিন মা বাবা ওকে জানিয়েছিলেন সেই ভয়ঙ্কর সত্যিটা। আকাশ ওর মা বাবার সন্তান নয়! ওকে ওরা অনাথ আশ্রম থেকে এনেছিলেন! উফফ… কী ভয়ানক একটা কথা! ওই জন্যই মা বাবা তানিকে এতো বেশি আদর দেন, তানি হওয়ার পর থেকে শুধু তানি আর তানি। আকাশের স্পষ্ট মনে আছে তানি তখন কয়েকমাসের, স্কুলে খেলতে গিয়ে ভয়ঙ্কর চোট পেয়েছিল আকাশ। বাড়ি ফিরে মাকে সেই সবে বলতে যাবে কথাটা কিন্তু তানি কেঁদে উঠতেই মা এমন করে ছুটে গেলেন ওর কাছে যেন কোনো মস্ত বড় বিপদ হয়েছে। আকাশের কথাটা শুনলেনই না। বড্ড কষ্ট হয়েছিল সেদিন ওর, আর এখন তো স্পষ্ট বুঝতে পারছে কেন মা সেদিন ওর কথা শুনতে চাননি। এখনও তো কিছু হলেই ওরা তানিকেই ডিফেন্ড করেন, বলেন ছোটবোন তোমার। আকাশ কত বোকা ছিল, সত্যিটা বুঝতেই পারেনি। কিন্তু এখন যখন জেনেই গেল এবার কী করবে ও! কোথায় যাবে! কিচ্ছু মাথায় আসে না ওর। আবার দুই হাতের তালুতে মুখ ঢাকে।

কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেলটায় চাপ দিল স্যামুয়েল। ভেতরে সঙ্গে সঙ্গে একটি জনপ্রিয় হিন্দিগানের সুর বেজে উঠল, তার খানিকটা হাওয়ার সাথে ভেসে এসে লাগল স্যামুয়েলের কানেও। চমকে উঠল সে, এর আগে প্রায় দু তিনবার কলিং বেলটা টিপতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছিলো কিন্তু এবার তো বাজিয়েই ফেললো শেষমেষ। গলার কাছটা শুকিয়ে এলো ওর। আর তখনই শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে এলেন এক মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলা। স্যামুয়েলের দিকে দু দণ্ড নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন তিনি, তারপরেই তাঁর ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপতে শুরু করল। স্যামুয়েল কী বলবে কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মহিলার দিকে। ভেতর থেকে তখন ভদ্রমহিলার উদ্দেশ্যেই কেউ বলে উঠলেন, “কী গো কে এসেছে?”

ওই ডাকে সম্বিৎ ফিরল মহিলার, কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বলে উঠলেন, “পুকাই…”

“পিসিমণি।” ডেকে উঠল স্যামুয়েল। মহিলা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন ওকে। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন ওর কপাল। স্যামুয়েলের অস্বস্তি করলেও প্রতিবাদ জানাল না সে।

***

ঘরে ভেতর ঢুকে ব্যাগটা খাটে ছুঁড়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল স্যামুয়েল। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। আজ প্রায় বাইশ তেইশ বছর পর পিসিমণিকে দেখলো ও। সত্যি বলতে পিসিমণির মুখটা একেবারেই ঝাপসা হয়ে এসেছিলো ওর স্মৃতিতে কিন্তু সবাই বলে স্যামুয়েল নাকি হুবহু ওর বাবার প্রতিচ্ছবি। তাই তো পিসিমণি আজ এক ঝলক দেখেই ঠিক চিনে নিয়েছেন ওকে। একটা জোরে শ্বাস নিল স্যামুয়েল। যে কাজের জন্য এখানে আসা সেটা যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে ফেলতে হবে ওকে। পিসেমশাই মানুষটার চোখ দুটো ওর মোটেই ভালো লাগেনি, এতো বছর পর ওর এই আচমকা আবির্ভাব তাঁর মনে যে এক সন্দেহের উদ্রেক করেছে, সে বিষয়ে স্যামুয়েল নিশ্চিত। কিন্তু পিসিমণির সরল মন সম্পূর্ণভাবে ওর প্রতি স্নেহতে পরিপূর্ণ, সেখানে কোনো সন্দেহ দানা বাঁধার আগেই যা করার ওকে করে ফেলতে হবে।

“এক্সকিউজ মি।”

স্কুল যাওয়ার পথে অপরিচিত গলাটা কানে আসতেই মুখ তুলে তাকাল দিয়া। দেখল এক বছর সাতাশের যুবক দাঁড়িয়ে তার সামনে।

“হ্যাঁ বলুন।”

“বলছি এখানে অধীর বক্সির বাড়িটা কোথায় বলতে পারবে?”

“না। আমি জানি না।”

“কোনো গেস…”

“আসলে আমি এখানে নতুন এসেছি তাই কাউকেই চিনি না, সরি।”

“ওহ…”

এই বলে লোকটা হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল ওখান থেকে। দিয়া আবার হাঁটতে শুরু করল ধীর পায়ে। স্কুলে সময়ে পৌঁছাতে হবে কিন্তু তাও দিয়ার পায়ে যেন গতি আসতেই চায় না। ওই জায়গাটায় যেতে হবে ভাবলেই মনটা তেতো হয়ে যায় বারবার। হাত ঘড়িটা দেখলো দিয়া, দশটা বেজে দশ। দ্রুত পা চালাল সে, কুড়ির মধ্যে ঢুকতে না পারলে লেট লাইন নিশ্চিত। কিছুটা এগোতেই বাড়িটা নজরে পড়ল দিয়ার, এই ক’দিনে বেশ কয়েকবার দেখেছে বাড়িটাকে। পেল্লাই একটা বাড়ি কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার থেকে একটু ভেতরে। এতো বড় একটা বাড়ি অথচ সামনের বাগানটার কেউ যত্ন নেয় না, বড় বড় গাছ উঠেছে সেখানে। বাড়িটার দেওয়ালেও শ্যাওলা মোটা প্রলেপ। গেটের সামনে এমন আঁটোসাঁটো হয়ে আগাছা জন্মেছে যে ওই পথে বহুদিন কেউ পা রাখেনি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে গেটের পাশে নেমপ্লেটটা এখনও রয়ে গেছে। একটু এগিয়ে যায় দিয়া। যদিও সেটার নিচের দিকটা ক্ষয়ে গেছে খানিক, তাও নামটা পড়তে অসুবিধা হয়না— ‘অতুলচন্দ্র বক্সি’।

বক্সি…! পদবীটা পড়েই দিয়ার মনে পড়ে গেল একটু আগেই সেই লোকটা কে যেন এক বক্সির খোঁজ করছিল না! তবে সে নিশ্চয় অন্য কোনো বক্সি হবে। এই বাড়িতে যে কেউ বহুদিন থাকে না তা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

স্কুল থেকে ফেরার পথে মনটা বেশ ভারাক্রান্ত ছিল দিয়ার।

একটু আগেই দুঃসংবাদটা শুনেছে সে— ওদের বাড়ির থেকে কয়েকটা বাড়ি পরেই একটা বাড়ি আছে, সেই বাড়ির ছেলে আকাশ দিয়ারই ক্লাসমেট। কিন্তু ছেলেটাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুল যাবে বলে বেরিয়ে আর স্কুল আসেনি। কোথায় গেছে কে জানে! নানান জন নানান রকম কথাবার্তা বলছিল, সেই সব শুনে বেশ ভয় ভয়ই করছে দিয়ার। সে তাই দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছে।

ওই পোড়ো বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই আবারও থমকে গেল দিয়া। দেখল সকালের সেই লোকটা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে। লোকটা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। তার মানে লোকটা এই বাড়িটারই সন্ধানে ছিল! একটু অবাক হল দিয়া। তবে লোকের ব্যাপারে বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো। কথাটা ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল দিয়া, কিন্তু আবার বাড়িটার দিকে ঘুরতেই চমকে উঠল ও, দেখল লোকটা বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। কোথায় গেল লোকটা! লোকটাকে কোথাও যেতে হলে তো দিয়ার সামনে দিয়েই যেতে হবে। হতভম্বের মত কয়েক সেকেন্ড বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়া দেখতে পেল লোকটাকে। কিন্তু লোকটার পাশে যাকে দেখতে পেল তাকে দেখেই ওর হৃৎপিন্ডটা লাফিয়ে উঠল— আকাশ! যাকে সবাই মরিয়া হয়ে খুঁজছে সে এই পোড়ো বাড়িতে, কিন্তু কেন! দিয়া একবার ভাবল বাড়ি ফিরে সবাইকে জানায় ব্যাপারটা, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল সবাই আসতে আসতে যদি ও পালিয়ে যায় অন্য কোথাও! তারচেয়ে ও করছেটা কী সেটাই আগে দেখা যাক, এই ভেবে পা বাড়াল দিয়া। বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল প্রাচীরের গায়ে একটা বড়সড় ফাটল। তার মানে ওরা এটা দিয়েই ঢুকেছে ভেতরে! ব্যাগটা পিঠ থেকে খুলে নিয়ে একটু কসরৎ করতেই দিয়ার শরীরটাও অনায়াসে ঢুকে গেল সেই ফাটলের মধ্যে।

ঘরে ঢুকেই টেবিলটায় জোরে একটা চাপড় মারল রোমিত। ঘরে বসে থাকা বাকি মানুষগুলো বিরক্ত মুখে তাকাল তার দিকে। রোমিতের চোখে মুখে উত্তেজনা, “তোমরা কি এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে?”

“কী ব্যাপারে?” শ্লেষ মিশ্রিত গলায় জানতে চাইল সায়ক।

রোমিত একবার আড়চোখে পার্থকে দেখে নিয়ে এবার সরাসরি তাকাল তমসার দিকে, “স্যামকে নিয়ে কী ভাবছো? একটা ছেলে এরকম আচমকা উধাও হয়ে গেল সেটা তো হতে পারে না, কিছু একটা তো করতে হবে নাকি?”

“কী করার কথা বলছিস তুই?”

“আমি কী বলবো? ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেছিস তুই, তাই বলবিও তো তুই।” কথাগুলো বলতে বলতে রোমিতের ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠা হালকা শ্লেষটা নজর এড়ালো না তমসার। তবে তমসা কিছু বলার আগেই রোমিতের সমর্থনে এগিয়ে এলো রাত্রি, “তমসা ইউ হ্যাভ টু ডু সামথিং। স্যাম তোমার জন্য গিয়েছিল ওখানে। তুমি বলেছিলে বলে…”

“একমিনিট,” রাত্রিকে মাঝপথে থামিয়ে দিল তমসা, “আমার জন্য গিয়েছিল বোলো না, বলো ক্লাবের রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে গিয়েছিল।”

“সে যাই হোক কিন্তু তারপর থেকে ওর সাথে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।” উত্তেজিত গলায় বলল রোমিত।

সায়ক বলে উঠল, “করা যাচ্ছে না নাকি ও যোগাযোগ রাখতে চাইছে না!”

“তুমি চুপ করো সায়ক, শেষ মুহূর্তে ও আমার সাথে কথা বলছিল ফোনে। তোমরা শোনোনি কিন্তু আমি… আমি শুনেছি ওর সেই আর্তনাদ। ও অধীর বক্সির বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল কিন্তু তারপর…” কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই রোমিত তমসার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি আমাদের ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী স্যামকে খুঁজতে আমরা যেতে পারি না, কিন্তু এতো বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা রহস্যটাকেও তো আমরা আবার চাপা পড়ে যেতে দিতে পারি না। কিছু একটা করতেই হবে আমাদের।”

“কিন্তু স্যাম যদি ফোনে অভিনয় করে থাকে? যদি ও পুঁথিটার সন্ধান পেয়েও হাতিয়ে নিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি?” জানতে চাইল তমসা।

রোমিত এতক্ষণে টেবিলটার ওপর বসে পড়ল, “স্যামের একার পক্ষে এরকম একটা কাজ করা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। পুঁথিটা নিয়ে ও একলা করবেটা কী! আর তাছাড়া সেদিন ফোনে আমি স্যাম ছাড়াও আরও কারুর আর্তনাদ শুনেছিলাম।”

“মানে? কার হতে পারে? বক্সির?”

“জানি না, তবে আমার মনে হয়েছিল কোনো কম বয়সী কারুর গলা ছিল।”

“স্ট্রেঞ্জ!”

***

মূল ক্লাবঘর থেকে উঠে ভেতরের ঘরে এলো তমসা। এই ঘরটা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করতে পারে না। ঘরটার দেওয়াল জুড়ে থাকা বিরাট বিরাট আলমারীতে সাজানো হরেক রকম বই, ডায়েরী, কিছু প্রাচীন পুঁথি আরও অনেক কিছু। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তমসা যখন এই ক্লাবের সদস্য হয়ে আসে, তখন থেকেই এই ঘরটার প্রতি তার লোভ ভীষণ। কিন্তু তখন ঢোকার সুযোগ না পেলেও এখন পেয়েছে। কে জানতো মাত্র কয়েক বছর আগে ক্লাবে আসা এই মেয়েটাই একদিন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয়ে বসবে! সবই ভাগ্যের খেলা। তাই তো তমসার এই পদোন্নতি বহু পুরোনো সদস্যের ঈর্ষার কারণ। ভালোও লাগে এই ক্ষমতা, আবার মাঝেমাঝে ভয়ও হয়। এখানে সবাই ক্ষমতা চায়, ক্ষমতার জন্য এই ক্লাবে কী ঘটতে পারে তা তমসা নিজের চোখে দেখেছে।

ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা রোজালিণ্ড নাকি নিছকই বিভিন্ন অতিলৌকিক বিষয়ের রহস্যোদঘাটনের জন্য এই ক্লাব তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তারপর যা হয়… রোজালিন্ডের রহস্যজনক মৃত্যুর পর ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয় পার্থ স্যান্যাল। আর সেই সময় থেকেই ক্লাবের ভেতরে ক্ষমতার খেলাটা জমে ওঠে বেশি করে। ওই ক্ষমতার লোভেই পার্থও হারিয়ে যায় একদিন। তারপরেই ক্ষমতায় এসেছে তমসা। এই ক্লাবের প্রেসিডেন্টদের পরপর রহস্যজনক মৃত্যুর কথা মনে পড়লেই শিউরে ওঠে তমসা, বারবার অন্য কোনো সদস্যের প্রস্তাবে কোনো রহস্যের পেছনে গিয়েই তো হারিয়ে গেছে ওরা। তমসা এমন রহস্যজনক মৃত্যু চায় না, কিন্তু পদে থেকেও কোনো পদক্ষেপ না নিলে ক্ষমতাচ্যুত হতেও বা কতক্ষণ!

নির্দিষ্ট আলমারীর সামনে গিয়ে একটা বড় খাতা আর একটা ডায়েরী টেনে বের করে আনল তমসা। তারপর ঘরের মাঝখানে রাখা ছোট্ট টেবিলটার সামনে বসে পড়ল ধপ করে। বড় খাতাটার লাল মলাটের ওপর রুপোলি কালি দিয়ে মোটা করে লেখা দুটো শব্দ, ‘দ্য মিস্ট’।

এই খাতাটার মধ্যেই আছে সেই সব মানুষদের তথ্য যারা কোন না কোনো সময় ‘দ্য মিস্টে’র সদস্য হয়েছে। যারা হারিয়ে গেছে তাদের নামের পাশে লাল কালিতে ক্রশ করা। এই সদস্যদের বেশিরভাগই লেভেল থ্রি-এর সদস্য। ‘দ্য মিস্টে’ প্রথম যারা প্রবেশ করে তাদের কাছে এই ক্লাবের পরিচয় থাকে নিছক এক ভূত সন্ধানী ক্লাব হিসেবে। কিন্তু ক্লাবের মাথা যারা তারা এই নভিশদের কাজের মধ্যে থেকেই বেছে নেয় লেভেল টু-এর সদস্যদের। যদিও পুরো ব্যাপারটা নভিশদের কাছে একদম গোপন থাকে। মূলত সাহস, জ্ঞান আর দৃঢ়তাই হয় এই নির্বাচনের মাপকাঠি। লেভেল টু-এর সদস্যদের প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা হয় বড় বড় অভিযানের জন্য। আর লেভেল থ্রি’তে পৌঁছাতে লাগে অনেক অধ্যবসায়, অনেক সাধনা সহ আরও অনেক কিছু। তাই তো বর্তমানে ক্লাবের লেভেল থ্রি-এর সদস্য মাত্র পাঁচজন, নাকি চারজন…?

পাতা উল্টে স্যামুয়েলের পাতায় চলে গেল তমসা। ক্লাব ছেড়ে গেলে নামের পাশে নীল কালিতে outgoing arrow দেওয়ার নিয়ম, কিন্তু লেভেল ওয়ানের সদস্য ছাড়া তো কারুর ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার নিয়ম নেই। মৃত্যু বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে নামের পাশে লাল কালিতে ক্রশ দিতে হয়, আর কেউ যদি হঠাৎ করে উধাও হয়ে তখন… স্যামুয়েলের পাতাটা আঙুলে চেপে সামনের দিকে আরেকটা পাতায় চলে গেল তমসা। সেই পাতার সদস্যের নামের পাশে লাল কালিতে বিপদের চিহ্ন এঁকে একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন দেওয়া। এই লোকটাও এক সময় হঠাৎ করে উধাও হয়ে গিয়েছিল, আবার এর সন্ধানে গিয়েই উধাও হয়েছে স্যামুয়েলও। তাহলে স্যামুয়েলের নামের পাশে কী চিহ্ন বসবে?

“ওর নামের পাশে কী চিহ্ন বসবে সেটা জানতে হলে তো আমাদের ও যেখানে গেছে সেখানেই যেতে হবে।”

কথাগুলো শুনেই চমকে উঠল তমসা। দেখলো কখন যেন চুপিসাড়ে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট সায়ক। তমসা মুখে কিছু না বলে ডায়েরীটা তুলে নিল হাতে।

কুশরীগঞ্জ নেহাতই মফস্বল একটা শহর। অন্যান্য শহরের মত ঘন বসতি নেই এখানে, বেশ কয়েক হাত ছাড়া ছাড়া একতলা দোতলা বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় গাছের আধিক্য এখানে খুব। তবুও সব কিছু সত্ত্বেও শহরটাকে চারপাশ থেকে কেমন যেন একটা মন খারাপের মেঘ ঘিরে আছে সবসময়। কুশারীগঞ্জের নিস্তরঙ্গ জীবনটা হঠাৎ করে কয়েকদিন আগে থেকে উত্তাল হয়ে উঠেছে দু দুটো মানুষের আকস্মিক অন্তর্ধানে। একজন এখানকার স্থানীয় পোস্ট মাস্টার অলোকেন্দু রায়ের ছেলে আকাশ, আর একজন এই শহরের অতিথি। জনৈক প্রসূন মন্ডলের সম্বন্ধীর ছেলে যে কিনা পিসির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মন্ডলবাবুর স্ত্রী খ্রিস্ট ধর্মের মেয়ে হয়ে হিন্দু ধর্মে বিয়ে করায় বহু বছর বাপের বাড়ির সঙ্গে কোনোপ্রকার যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আচমকা কয়েকদিন আগে তার ভাইপো হঠাৎ পিসির বাড়ি বেড়াতে আসে। এ ঘটনা কুশরীগঞ্জের লোকের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। অনেকেরই ধারণা আকাশের অন্তর্ধানের সঙ্গে ওই স্যামুয়েল ছোকরার কোনো যোগ আছে। অবশ্য ব্যাপারখানা এখানেই শেষ নয় আকাশরা যেদিন নিরুদ্দেশ হয় সেদিন বিকেলে আকাশেরই এক সহপাঠিনিকে রাস্তার ধারে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। মেয়েটি স্থানীয় এক ব্যাংক কর্মীর মেয়ে, এই কিছুদিন হল ভাড়া এসেছে এখানে। সেই ঘটনার পর থেকে মেয়েটিও যেন বোবা কালা হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন খুব বড় শক পেয়ে মেয়েটির এই অবস্থা। চিকিৎসা চলছে তার।

“আপনাদের কাছে সব শুনে তো মনে হচ্ছে ওই স্যামুয়েল ব্যাটাই নাটের গুরু। আমরা ঠিক সন্দেহ করছিলাম।” পান চিবোতে চিবোতে কথাগুলো বললেন ধরণী সেন।

“আপনি এসব তথ্য দিয়ে আমাদের অনেক সাহায্য করলেন ধরণীবাবু”, বলল সায়ক, “কিন্তু এখানকার পুলিশ কী করছে?”

“পুলিশের কথা আর বলবেন না মশাই। ওই ছেলেটা মানে আকাশ ক’দিন ধরেই বাড়ি থেকে পালানোর তাল করছিল, ওর ডায়েরী নাকি সেরকমই বলছে। তাই পুলিশের মত বলে, আকাশ নিজেই পালিয়েছে। এদিকে মন্ডল বাবুর স্ত্রী তো তার বাপের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারছে না যে ওই স্যামুয়েলের খোঁজ নেবে। তবে আপনারা এসে ভালোই হল, আপনারা একবার এখানের পুলিশের সাথে দেখা করুন।”

“নিশ্চয়। পুলিশের কাছে তো যেতেই হবে আমাদের।” এই বলে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তমসা বলল, আচ্ছা, ধরণীবাবু ওই মেয়েটির কী অবস্থা? কিছু জানতে পারা গেছে ও কেন এরকম হয়ে গেল?”

“না না। হাসপাতালেই তো ছিল, এই কদিন হল বাড়ি ফিরেছে। বাড়িতে থাকলে যদি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।”

***

রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন নীলিমা দেবী। একটু আগেই রথীনবাবু বেরিয়ে গেছেন কাজে। এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ হল। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দরজাটা খুললেন নীলিমা দেবী। দেখলেন বাইরের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যান্ট শার্ট পরিহিত দু’জন তরুণ তরুণী। একটু অবাক হলেন নীলিমা দেবী, “আপনারা?”

“নমস্কার ম্যাডাম, আমরা একটি বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি।”

“বিশেষ প্রয়োজন?”

“হুমম। আপনি নিশ্চয় জানেন আপনাদের এই এলাকা থেকেই কিছুদিন আগে স্যামুয়েল মাইতি বলে একটি ছেলে নিখোঁজ হয়ে যায়। ওই ছেলেটি কলকাতায় এক কোম্পানিতে চাকরি করত, কিন্তু কোম্পানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি করে ও এখানে পালিয়ে আসে। তাই কোম্পানির তরফ থেকে আমদের এই কেসের তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।”

“সবই বুঝলাম কিন্তু এক্ষেত্রে আমি তো আপনাদের কোনো সাহায্য করতে পারব না।”

“ম্যাডাম আমরা শুনলাম স্যামুয়েল যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন আপনার মেয়েকে নাকি রাস্তার ধারে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। তাই আমাদের সন্দেহ এ হয়তো স্যামুয়েলের কাজ। আপনার মেয়ে হয়তো এমন কিছু দেখে নিয়েছিল যার জন্য স্যামুয়েল ওকে আঘাত করে পালায়।”

“আপনারা যা শুনেছেন তার পুরোটা ঠিক নয়, আমার মেয়েকে কেউ আঘাত করেনি। ও কিছু একটা দেখে… আমার মেয়ে কারুর সাথে কথা বলার অবস্থায় নেই। আপনারা আসুন।”

“এক মিনিট ম্যাডাম। আমরা আপনার মেয়ের অবস্থা সম্পর্কে শুনেছি। আমার এই সহকর্মীর গাইডেন্স অ্যাণ্ড কাউন্সেলিং-এর ওপর ডিপ্লোমা করা আছে। আপনি একটু যদি কো-অপারেট করেন তাহলে খুব ভালো হয়। কথা দিচ্ছি আপনার মেয়ের কোনো ক্ষতি হবে না।”

“ম্যাডাম এই নিন আমার কার্ড।”

মেয়েটির বাড়িয়ে দেওয়া কার্ডটা হাতে নিলেন নীলিমা দেবী। দেখলেন মেয়েটির নাম রাত্রি চক্রবর্তী। তার ডিপ্লোমার কথা কার্ডেও উল্লেখ করা আছে। আজকাল মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় রাতে ভালো করে ঘুমোতেও পারেন না। সবসময় মনে হয় কেউ যদি কোনোভাবে তাঁর মেয়েটাকে ঠিক করে দিতে পারত। হয়তো সেই কারণে এই মুহূর্তে আর বেশি কিছু ভাবতে পারলেন না, মাথাটাও যেন ঠিক কাজ করতে চাইল না তাঁর। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটোকে আশ্রয় করে বাঁচতে চায় তেমনই নীলিমা দেবীও এই মুহূর্তে মেয়েটাকে বাড়িতে আসতে দেবেন বলে স্থির করলেন, মনে কোথাও যেন ক্ষীণ আশা জেগে উঠল হয়তো মেয়েটা দিয়াকে ঠিক করে দিলেও দিতে পারে!

পোড়ো বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়েছিল ওরা চারজন। বাড়িটার জরাজীর্ণ গেটের পাশে ক্ষয়ে যাওয়া নেমপ্লেটটায় এখনও পড়া যাচ্ছিল একটা নাম— অলোকেন্দু বক্সি।

“যাই বলো মেয়েটা আঁকে কিন্তু খুব সুন্দর।” বলল রাত্রি।

তমসা ওর হাত থেকে একটা ছবি নিয়ে সামনের দিকে তুলে ধরল। নিঃসন্দেহে এই বাড়িটারই ছবি। ছবিটা ইঙ্গিত করছে একটু ডান দিকে সরে গেলেই প্রাচীরের গায়ে একটা গর্ত পাওয়া যাবে, সেটা দিয়ে একজন মানুষ গলে যেতে পারে অনায়াসে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সায়ক বলে উঠল, “আর বাকি ছবিগুলোর অর্থ কী?”

“জানি না। আমার মনে হল এগুলো হয়তো বাড়ির ভেতরটার ছবি তাই নিয়ে চলে এসেছি।” জবাব দিল রাত্রি। তমসা তাকে সায় দিয়ে বলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছে। এই ছবিগুলো দেখার পর তো আর কোনো সন্দেহ নেই যে মেয়েটা সেদিন স্যামুয়েল আর ওই বাচ্চা ছেলেটাকে দেখেছিল। প্রত্যেকটা ছবিতে খেয়াল করে দেখো দুজন মানুষের ছবি।”

“হুমম। তোমরা ভাগ্যিস বুদ্ধি করে আমাদের ওই মেয়েটার বাড়ি যেতে বলেছিলে নয়তো এই সূত্রগুলো পাওয়াই যেত না।” বলল রোমিত।

সায়ক প্রত্যুত্তরে বলল, “সূত্র তো পাওয়া গেছে কিন্তু এগুলোকে কাজে লাগাতে পারাটাই হচ্ছে আসল। সেদিন নিশ্চয় এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল যাতে করে মেয়েটা শক পেয়ে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু ওর অবচেতন মনে হয়তো ওই ঘটনাগুলো গেঁথে আছে বলেই এই ছবিগুলো আঁকতে পেরেছে। তোমরা শেষ ছবিটা খেয়াল করে দেখো। পেন্সিল স্কেচে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু মনে হচ্ছে ছবির দুজন ফিগার সামনে কোনো একটা আলমারী জাতীয় কিছু দেখছে একমনে।”

“হুমম। আর এই ছবির ধাঁধার সমাধান তখনই করা যাবে যখন আমরা ঘরটার ভেতরে ঢুকবো। তাই আর দেরী না করে চলো।”

ওদের চারজনেরই রোগা পাতলা শরীর হওয়ার কারণে প্রাচীরের ফুটোটা দিয়ে গলতে অসুবিধা হল না একটুও। প্রাচীরের ভেতর ঘন জঙ্গল। এখানে সাপখোপ থাকাও বিচিত্র নয়। তাই খুব সন্তর্পণে গাছপালার আড়াল ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল ওরা। বাড়ির সদর দরজাটা যেভাবে বন্ধ সেটা দেখলেই বোঝা যায় যে খোলা হয়নি বহুদিন। তাহলে স্যামুয়েলরা ঘরের ভেতর ঢুকেছিল কোনদিন দিয়ে! রোমিত প্রশ্নটা করার আগেই তমসা আঙ্গুল তুলে দেখালো কিছু। ওরা সবাই খেয়াল করে দেখল ঘরের দক্ষিণ দিকে একটা বড় জানালার পাল্লাগুলো আলগাভাবে বন্ধ করা রয়েছে। গুটিগুটি পায়ে জানালাটার কাছে এসে পাল্লা ধরে টান দিতেই সেগুলো খুলে গেল। দেখেই বোঝা যায় জানালাটায় গরাদ ছিল কোনোকালে কিন্তু ভেঙে পড়েছে সেগুলো।

“স্যামুয়েল তবে এ পথেই ঢুকেছিল।” বলল রোমিত, “কারণ ঘরটায় যখন ঢোকে ও তখন ওর আওয়াজ শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম ঢুকতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছিল ওকে।”

জানালাটার ফাঁক গলে অনেক কষ্টে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা চারজন। সবার শেষ ঢুকল রোমিত, গরাদের ভাঙা লোহায় লেগে তার হাত খানিকটা কেটে গেল। তবে এই মুহূর্তে এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। ভেতরে ঢুকেই জানালাটা বন্ধ করল ওরা। জানালাটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে নেমে এলো অন্ধকার। ওদের প্রত্যেকেই কাছেই টর্চ ছিল, সেগুলো জ্বালালো ওরা। ঘরটার আশেপাশে টর্চ ফেলতেই ওরা বুঝতে পারল এটা ডাইনিং স্পেস হিসেবে ব্যবহার হত কোনোকালে। একটা ভাঙা ডাইনিং টেবিল, কয়েকটা চেয়ার পড়ে আছে ঘরটায়। মেঝের একপ্রান্তে একটা মরচে পড়া কার্টলারি সেট, ভাঙা কাঁচের গ্লাস, জলের জগও পড়ে থাকতে দেখা গেল। মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ, দেওয়ালের ওপর মাকড়সার ফাঁদ জমেছে। তমসা এবার দিয়ার আঁকা একটা ছবির ওপর আলো ফেলল। পুরোপুরি নিখুঁত না হলেও মেয়েটা যে এই ঘরটারই ছবি আঁকার চেষ্টা করেছে তা আর বলে দিতে হয় না। হয়তো যেদিন ঢুকেছিল সেদিন ভালো করে ঘরটা খেয়াল করার সুযোগ পায়নি তাই নিজের কল্পনার রং মিশিয়েছে খানিকটা। তমসা ছবির একটা দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো, “ভালো করে দেখো। ঘরটার ডানদিকের প্যাসেজের মধ্যে একটা মানুষের ছায়া এঁকেছে মেয়েটা। তারমানে আমরা ধরে নিতে পারি স্যামকে হয়তো ওদিকেই যেতে দেখেছিল মেয়েটা।”

রাত্রি ঘরটার ডানদিকে টর্চ ফেলল। সত্যিই একটা প্যাসেজ দেখা যাচ্ছে সেখানে, প্যাসেজের দু’প্রান্তে দুটো ঘর। ওরা চারজন এগোলো। প্যাসেজ যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকেই শুরু হয়েছে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি।

“পরের ছবিতে এই সিঁড়িটারই উল্লেখ আছে নিশ্চয়।” বলল সায়ক। ওরা চারজন এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে, সবার পেছনে তমসা। সিঁড়িটাতে উঠতে গিয়েও খানিক থমকে গেল সে। একটা ব্যাপারে তার খটকা লাগছে বারবার, মেয়েটা তো বেশ পরপর ছবিগুলো এঁকেছে, তাহলে সেখানে কেন সিঁড়ি দিয়ে নামাকে ইঙ্গিত করছে, ওঠাকে কেন নয়!

“কী হল দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?” সিঁড়ির মাঝে দাঁড়িয়ে তমসার দিকে টর্চ ফেলে জিজ্ঞেস করল রোমিত। আর সেই টর্চের আলো নীচের দিকে খানিকটা ছড়িয়ে যেতেই চমকে উঠল তমসা। সিঁড়ির নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা কাঠের পাটাতন। চটজলদি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ির নীচের ওই জমাট বাঁধা অন্ধকারে আলো ফেলতেই তমসা দেখতে পেল গর্তটা। পাটাতনটা ওই গর্তেরই ঢাকনা। ওটা খোলা অবস্থায় আছে। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে গর্তের কিনারে দাঁড়িয়ে টর্চ ফেলতেই তমসা দেখতে পেল গর্ত থেকে সার বেঁধে নেমে যাওয়া সিঁড়িগুলো।

“তাকিয়ে দেখ এই পাটাতনটার ওপর ধুলো প্রায় নেই বললেই চলে। তারমানে বেশিদিন আগে খোলা হয়নি এটা।” মন্তব্য করল সায়ক। তমসাকে দেখে ওরা চারজনেই নেমে এসেছে।

রাত্রি বলল, “স্যাম কি তাহলে এই গর্তের নীচে আছে?”

“সেটা তো নীচে গেলেই বোঝা যাবে।” এই বলে ওই গর্ভগৃহের সিঁড়িতে প্রথম পা রাখল তমসা।

“ইয়েস… ইয়েস… এটাই। ওই দিয়া বলে মেয়েটার শেষ ছবিতে এই ঘরটাই আঁকা আছে। দেখো কত যন্ত্রপাতি এ ঘরে। ঠিক ছবিটার মত।” আনন্দে লাফিয়ে উঠল রাত্রি।

তমসা বিড়বিড় করল, “এই তাহলে অধীর বক্সির সাধন ক্ষেত্র তথা তার গবেষণাগার।”

“স্যাম এখান অবধি পৌঁছে গিয়েছিল আর তারপরেই…”

“হুমম। বি কেয়ারফুল গাইজ। স্যাম যদি এখান থেকেই উধাও হয়ে থাকে তাহলে আমাদের খুব সচেতন থাকতে হবে।” বলল তমসা। রাত্রি আশেপাশে তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা অধীর বক্সি তো বৈজ্ঞানিক ছিলেন তাহলে তিনি কেন আমাদের অকাল্ট ক্লাবে জয়েন করেছিলেন? মানে বৈজ্ঞানিকরা তো এসবকে গাঁজাখুরি বলে থাকে।”

রাত্রির কথায় চোখে চোখে কিছু যেন ইশারা হয়ে গেল তমসা আর সায়কের মধ্যে, তারপর সায়ক মৃদু হাসার চেষ্টা করে বলল, “কার কখন কিসে ইন্টারেস্ট থাকবে সেটা এভাবে জেনারেলাইজ করে বলা যায় না। এখন চলো কথা বলে সময় নষ্ট না করে আমরা ঘরটা দেখি ভালো করে।”

“হ্যাঁ, তবে একটা কথা, কেউ কিন্তু কোনো জিনিস বাকিদের না জানিয়ে টাচ করবে না। কখন কী থেকে বিপদ আসতে পারে আমরা কেউ জানি না।” এই বলে বাকিদের সাবধান করে দিল তমসা।

গোটা ঘরটা জুড়ে অসংখ্য যন্ত্রপাতি বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো রয়েছে, কোনটা সচল আর কোনটা অচল বলা মুশকিল। এছাড়া ঘরের কোণে রয়েছে একটা আলমারি। রাত্রি বলল, “এই আলমারিটার ছবিই কি এঁকেছিল মেয়েটা?”

“কে জানে! লোকটা যে পুঁথিটা চুরি করে এনেছিল হয়তো এটার মধ্যেই ভরে রেখেছে। কিন্তু ওটার গায়ে কোনো তালা দেখতে পাচ্ছি না তো!” বলল রোমিত। তারপর সে এগিয়ে গিয়ে আলমারিটার পাল্লা ধরে টানল কিন্তু খুলল না সেটা।

“যাহ বাবা!” রোমিতকে সরিয়ে দিয়ে আলমারির গায়ে টর্চ ফেলল সায়ক। টর্চের আলো পড়তেই খেয়াল করল আলমারির গায়ের সাথে মিশে থাকা একটা ছোট্ট বোতাম, “এটা কী! নাম্বার লক নাকি?”

“তাহলে নাম্বার ডিসপ্লে প্লেটটা কোথায়?” বলল রাত্রি।

সায়ক ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বোতামটা টিপেই দেখি না।” তমসা বাধা দিতে গেল সায়ককে কিন্তু তার আগেই সায়ক টিপে ফেলল বোতামটা। আর বোতামটা টেপার সঙ্গে সঙ্গে আলমারির ভেতরে বিপ বিপ করে অদ্ভুত একটা আওয়াজ হল। তারপর কয়েক সেকেন্ড পরেই নিঃশব্দে আলমারির দরজাটা দু’ফাঁক হয়ে খুলে গেল।

“আরে সাব্বাশ…” বলে সায়কের কাঁধ চাপড়ে রোমিত উঁকি দিল আলমারির ভেতরে, “আরে এ যে পুরো ফাঁকা!”

“কই দেখি?” সায়ক এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। তারপর কী যেন একটা দেখতে পেয়ে আলমারির মেঝেতে পা রাখল।

“কী হল কী দেখলে?” জিজ্ঞেস করল রাত্রি। সায়ক বলল, “মনে হল দেওয়ালে যেন কিছু একটা ফ্ল্যাশ করল।”

“কোথায়?” এই বলে রোমিত গিয়ে দাঁড়াল সায়কের পেছনে। রাত্রিও গেল ওদের কাছে।

“তমসা দেখে যাও এখানটা।” তমসাকেও ডাকল সায়ক। তমসার মনটা কেমন না জানি খচখচ করছিল তাও মুখে কিছু না বলে এগিয়ে গেল ও। আলমারীর দেওয়ালের একটা জায়গায় হাত বোলাতে বোলাতে সায়ক বলল, “এখানেই দেখেছিলাম ফ্ল্যাশ হতে।” বলতে বলতেই সায়কের মনে হল ওর হাতের চাপে দেওয়ালে কিছু যেন একটা টেপা হয়ে গেল। আর তৎক্ষণাৎ একদিকে সেখানে একটা সরু প্লেটের মধ্যে নীল আলো জ্বলে উঠল, আর অন্যদিকে তমসা আর রাত্রির মনে হল কিছু একটা চুম্বকের মত ওদের আকর্ষণ করে টেনে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল আলমারিটার মধ্যে। ওরা হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল ভেতরে। আর তার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে সশব্দে আলমারির পাল্লা দুটো জুড়ে গেল। এদিকে ওই ডিসপ্লে প্লেটটার ওপর বিভিন্ন ছোট ছোট সংখ্যা ফুটে উঠতে শুরু করেছে। অন্ধকার আলমারির মধ্যে ওরা দেখতে পেল নীল ডিসপ্লে প্লেটে আচমকা বড় বড় লাল হরফে ফুটে উঠল চারটে সংখ্যা— ২০৭৫…

দুর্গন্ধটা লাগতেই ভক করে বমি বেরিয়ে গেল রাত্রির, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলল সে। কিন্তু সামনের সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগল প্রথমে। কোথায় আছে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারল না।

“বলেছিলাম না এমনি গন্ধে হবে না একে দাওয়াই দে…” একটা নেশাতুর গলা কানে এসে লাগল রাত্রির। সেই সঙ্গে আরও কয়েকটা হাসির শব্দ। রাত্রি বুঝতে পারল ওর চোখেমুখে অ্যালকোহল ঢালা হয়েছে একটু আগে। আন্দাজে জামার কোণটা নিয়ে চোখ দুটো একটু মুছতেই এবার সব কিছু দেখতে পেল রাত্রি। একটা বড় হলঘরে এই মুহূর্তে রয়েছে সে। হলঘরটার চতুর্দিকে বিভিন্ন রকমের যন্ত্রাংশ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়ানো রয়েছে, ঘরটার এককোণে ডাঁই করে রাখা কিছু পেটি। ঘরটার মাঝে মাঝে সরু সরু পিলার উঠে গিয়ে ছাদকে ছুঁয়েছে। এরকমই একটা পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মেয়েটাকে। এক ঝলক ওকে দেখলে ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না, তবে ভালো করে তাকালে ওই বিকৃত সাজের মাঝেই মুখের লাবণ্যটা টের পাওয়া যায়। রাত্রি ভালো করে তাকাল মেয়েটার দিকে। মাথার চুলগুলো একদম ছোটো ছোটো করে ছাঁটা, কানের দু’পাশে অর্ধচন্দ্রাকারে সোনালী রং মাখানো। বাকি মাঝখানটায় সাদা রঙের ছিটে। এক কানের গোটা পাতাটা জুড়েই বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের দুল আটকানো, আরেকটা কানের লতিতে শুধু একটা দুল। মেয়েটার ডান গালে একটা ডেঞ্জার সাইন আঁকা ট্যাটু, থুতনিতে অসংখ্য কৃত্রিম তিল। গলা থেকে ঝুলছে একটা কালো রঙের চেন, চেনের সাথে আটকে একটা ড্রাগন লকেট। মেয়েটার পরনে একটা অদ্ভুত রকমের কাটা কাটা টপ, শরীরের সাথে সেটা চিপে বসে রয়েছে। ওই কাটা অংশ দিয়েই দেখা যাচ্ছে নাভির চারধারে ফুটো ফুটো করে গলানো খান কতক রিং। নীচের জিন্সটাও ততোধিক টাইট এবং যত্রতত্ৰ ছেঁড়া। মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে। ছেলেটার সাজ পোশাকও ভিন্ন কিছু নয়। রাত্রি ওদের দিকে দেখতে দেখতেই পাশের একটা দরজা ঠেলে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল আরও কিছু ছেলে মেয়ে। এদের প্রত্যেকেই একই রকম উদ্ভট সাজে সজ্জিত আর প্রত্যেকের গলায় ওই ড্রাগনের লকেট। ওদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে রাত্রির থুতনিটা ধরে নেড়ে বলল, “জ্ঞান ফিরল আন্টি?”

রাত্রির বিরক্তি লাগল, ছেলেমেয়েগুলো প্রায় ওর বয়সীই হবে সবাই, তাহলে ওকে আন্টি বলার মানেটা কী! রাত্রি কিছু বলার আগেই মেয়েটা ওর সঙ্গীদের মধ্যে কাউকে নির্দেশ দিল, “ওরে আংকেলকেও আন। দুজনের শুভ দৃষ্টি হোক।”

আংকেল… কার কথা বলছে ওরা! রাত্রি বেশি কিছু ভাবার আগেই দুটো ছেলে ঘাড় ধরে টানতে টানতে রোমিতকে নিয়ে এলো ঘরে। রোমিতকে দেখেই চমকে উঠল রাত্রি। ওর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা যথেষ্ট অত্যাচার করেছে ওর ওপর।

রোমিতকে যারা ধরে রেখেছিল তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, “কে, এই আংকেলের আঙুলগুলো কেটে নিতে ইচ্ছে করছে।”

ওর কথা শুনে শিউরে উঠল রাত্রি। সে দেখল পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা চিৎকার করে উঠল, “ইডিয়ট। সব সময় বলেছি না উত্তেজিত হয়ে আলফাল কথা বোলো না। আঙ্গুল কাটবে! আঙ্গুল কেটে দিলে ব়্যানসামটা কি তোর বাপ দেবে?”

“নাহ মানে…”

“শাট আপ। নে এবার আংকেল আন্টির কাছ থেকে সব খোল। দুটোরই জ্ঞান ফিরে গেছে যখন তখন আর দেরি করার মানে হয়না।”

“ক্ক… কী খুলবে?” ভয় মিশ্রিত গলায় জানতে চাইল রোমিত। একটা ছেলে মুখে চুকচুক শব্দ করে জবাব দিল, “চিন্তা নেই আংকেল তোমার ইজ্জত লুটবো না। শুধু এই গয়নাগাটিগুলো টুকটুক করে খুলে নেব।”

“সালা তোমরা তো হেব্বি মালদার পার্টি ভাই প্লাটিনাম আর গোল্ড পরে রাস্তায় ঘুরছিলে! আবার হাতে এতো জেমস! চুমু খাও…” বলে অদ্ভুত ভঙ্গি করল একটা মেয়ে। তারপর সে এগিয়ে এসে রাত্রির কান ধরে জোরে টানল। চিৎকার করে উঠল রাত্রি, “কী করছো কী! তোমরা কে? কেন এসব করছো?”

“ন্যাকা,” মুখ বিকৃত করল মেয়েটা, “শোনো আমরা বলে জ্ঞান ফিরতে নিচ্ছি সব। অন্য দলের হাতে পড়লে না অজ্ঞান অবস্থায় কুচকুচ করে কেটে নিতো এই কান।”

মেয়েটার কথা শুনে শিউরে উঠল রাত্রি। সে আমতা আমতা করে বলল, “দাঁড়াও। আমি নিজে খুলে দিচ্ছি।”

এই বলে কান থেকে প্রিয় প্লাটিনামের রিং দুটো খুলে মেয়েটার হাতে দিল রাত্রি। মেয়েটা ইশারা করল ওর হাতের আঙুলের দিকে। সোনা রূপো দিয়ে বাঁধানো মোট পাঁচটা রত্ন আছে আঙুলে, সেগুলোও খুলে দিল। মেয়েটা এবার ঘুরল রোমিতের দিকে। রোমিতের গলায় সোনার চেন, আঙুলে আংটি। সব খুলে দিতে হল ওদের। মেয়েটা সেগুলো নিয়ে গিয়ে ওই কে নামের মেয়েটার হাতে দিল। কে বেশ কিছুক্ষণ ভালো করে জিনিসগুলো দেখার পর বলল, “ওদের হাতে, পকেটে কিচ্ছু পেলি না?”

“কিচ্ছু না। পকেট খালি পুরো।” জবাব দিল একটা ছেলে। কে ভ্রু কুঁচকে বলল, “অদ্ভুত তো! যাইহোক, এই আঙ্কল আর আন্টি তোমাদের বাড়ির কারুর নম্বর বলো।”

“কেন?” জানতে চাইল রোমিত। একটা ছেলে মুখ বিকৃত করে জবাব দিল, “কেন আবার কী? তোমাদের মত মালদার পার্টিকে আমরা এতো সহজে ছেড়ে দেব।”

“দশ বলবি।” বলল কে।

ছেলেটা পাল্টা জিজ্ঞেস করল, “দশ দেবে!”

“দিলে কি তোর সমস্যা আছে! আর চাঁদ দশ বললে ওরা দরাদরি করবে। তখন যদি নামতে হয়…”

রাত্রি আর রোমিতের চোখাচোখি হল। দুজনেরই চোখে প্রশ্ন। কী হচ্ছে এসব, কেন হচ্ছে, কী করে হচ্ছে কিছুই মাথায় আসছে না ওদের। শেষ মনে পড়ছে অধীর বক্সির ল্যাব, একটা আলমারীর মধ্যে বন্দি হয়ে গিয়েছিল ওরা। কিন্তু তারপর…! আচ্ছা এটা কি হ্যালিউশন নাকি সেটা ছিল হ্যালিউশন! কী হচ্ছে এসব? রোমিত গলাটা একবার ঝেড়ে নিয়ে বলল, “ভাই একটু জল পাওয়া যাবে? মাথাটা কেমন করছে।”

রোমিতের কথা শুনে ছেলে মেয়েগুলো এমনভাবে তাকাল ওর দিকে যেন ও কোনো মহামূল্যবান রত্ন চেয়ে বসেছে।

একটা ছেলে রোমিতের মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলল, “আঙ্কলকে দেখার পর থেকেই মনে হচ্চিল ছিটাল, এবার তো শিওর হয়ে গেলাম। পোশাকের মতোই মগজটাও লটপটে।”

“এই আঙ্কল ভেজা ফ্রাই না করে বাড়ির কারুর নম্বর দাও দিকি।” হুঙ্কার দিল কে।

রোমিত একবার রাত্রির দিকে তাকাল করুণ চোখে। রোমিতের এখন নিজের বলতে কেউ নেই, কার নম্বর দেবে ও! রাত্রি বলল, “আমি বলছি। নোট করো।”

কে নিজের হাতে লাগানো ব্যান্ডটার ওপর কিছু যেন একটা টিপল। রাত্রি আর রোমিত অবাক হয়ে দেখল এতক্ষণ যেটাকে রাবারের ব্যান্ড মনে হচ্ছিল সেটা স্বচ্ছ হয়ে একটা ডিসপ্লে প্লেটের আকার ধারণ করল। সেখানে অনেক রকম ডিজিটও ফুটে উঠল।

“বলার জন্য আবার কি স্পেশ্যালি নেমন্তন্ন করতে হবে নাকি!” বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে উঠল কে। ওর চিৎকারে সম্বিৎ ফিরল রাত্রির। হতভম্ভ ভাবটাকে নিয়েই সে বলতে শুরু করল, “৯৮******০৩”।

রাত্রি দেখল ছেলেমেয়েগুলো ওর দিকে হতভম্বের মত তাকিয়ে আছে। তারপর আস্তে আস্তে কে এগিয়ে এলো রাত্রির কাছে, ওর চোখে চোখ রেখে আচমকা সজোরে একটা চড় মারল রাত্রির গালে। আঘাতের চোটে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল রাত্রি। কে হিসহিস করে বলে উঠল, “ইয়ার্কি হচ্ছে আমাদের সঙ্গে! কন্ট্যাক্ট আইডি নম্বর চেয়েছি পুরো অঙ্ক বই খুলে বসতে বলিনি। আমাদের কী ভেবেছিস কী!” কথাগুলো বলতে বলতেই কে-এর হাতে উঠে এলো একটা অদ্ভুত রকমের সূঁচালো যন্ত্র। কে সেটার কোথাও একটা চাপ দিতেই একটা সরু ফলা বেরিয়ে এলো বাইরের দিকে। কে সেটা রাত্রির দিকে তাক করে দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “তিন গুনব, তার মধ্যে নম্বরটা দিবি নয়তো… আমার কিন্তু একটা টার্গেটও মিস যায় না।”

রাত্রি দেখল কে-এর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একটা পৈশাচিক হাসি।

***

বুকের ওপর মৃদু একটা চাপ অনুভূত হচ্ছে, মনে হচ্ছে বুকের লোমগুলো ধরে কেউ যেন টানছে আলতো করে, তবুও একটুও যন্ত্রণা হচ্ছে না সায়কের, বরং ভালোই লাগছে এই অনুভূতিটা। অনেকক্ষণ থেকেই চোখ খুলতে চেয়েও খুলতে পারছিল না সায়ক, এবার কানের কাছে একটা গরম বাতাস এসে লাগতেই চোখ দুটো খুলে ফেলল সে। আর চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল ঠিক ওপরই দেখতে পেল এক অতল গিরিখাত । চমকে উঠল সায়ক। আর সঙ্গে সঙ্গে ওর সামনে থেকে দৃশ্যটা উধাও হল ওর সামনে থেকে। এবার সায়ক পরিষ্কার দেখতে পেল ওই অতল গিরিখাতের মালকিনকে। মেয়েটা ওর বুকের ওপর চড়ে বসেছিল এতক্ষণ!

“How are you feeling?” আমেরিকান টানে প্রশ্ন করল মেয়েটা। পুরো ব্যাপারখানায় এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সায়ক যে নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো তার, “ভালো। কিন্তু…”

“ব্রিদিং-এ প্রবলেম হচ্ছিল তোমার। তাই ম্যাসাজ করছিলাম।” এবার পরিষ্কার বাংলায় কথা বলল মেয়েটি। সায়ক ভালো করে তাকাল ওর দিকে। বয়েজ কাট চুল, তবে চুলের সামনের দিকটা কায়দা করে কেমন তীরের ফলার মত সূঁচালো করা। গোটা চুলটা ব্রাউন হলেও ওই সূঁচাল অংশটা উজ্জ্বল বেগুনী। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল সায়ক, মনে হল নাক চোখ মুখ যেন ছাঁচে তৈরি। অবশ্য শুধু মুখশ্রীটাই কেন গোটা শরীরটাই যেন ছাঁচে গড়া, যৌবনের আগুন ঝলসে পড়ছে শরীরের প্রতিটা ভাঁজ থেকে। হট প্যান্টের সঙ্গে বুকের অংশ টুকু বাদ দিলে ওপরের টপটা প্রায় ভেদ্য। মেয়েটার গড়ন, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা সব মিলিয়ে যে কোনো পুরুষের শরীর ওকে এক ঝলক দেখলেই শিহরিত হবে। মুহূর্তের জন্য সায়কের শরীরেও শিহরণ জাগলো, কিন্তু পর মুহূর্তেই একখানা প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই বিড়বিড় করে উঠল সে, “আমি এখানে এলাম কীভাবে?”

“জানি না। আমি মার্কেটিং করে ফিরছিলাম তখন হঠাৎ ওপাশের টিলাটার নীচে তোমাকে পড়ে থাকতে দেখি।”

“টিলা! এই শহরে?”

“হোয়াই নট? কোনোদিনও দেখোনি নাকি?”

সায়কের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। যতদূর মনে পড়ছে ওরা তো ছিল অধীর বক্সির ল্যাবে। সেই আলমারীতে ঢুকে পড়েছিল ওরা আর তারপর…

“আমার সাথে আর কেউ ছিল না?”

“না।”

“ওয়েট, কী টিলা কীসব বলছেন আপনি? আপনি কে?”

সায়কের প্রশ্নটা শুনে বোধহয় বেশ মজা পেল মেয়েটা। মুচকি হেসে সে জবাব দিল, “তুমি যা ভাববে আমি সেই…”

“কী!”

“আমার নাম রোজ।” কথাটা বলেই মেয়েটা আবার চড়ে বসলো সায়কের ওপর। চমকে গেল সায়ক। মেয়েটার শরীরের আকর্ষণে একদিকে যেমন উত্তেজিত হয়ে উঠছে তার শরীর, অন্যদিকে তেমনই একটা অজানা ভয়ও মনটাকে আচ্ছন্ন করে তুলছে তার। সায়ক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল মেয়েটাকে, কিন্তু তার আগেই মেয়েটা সায়কের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কামড়ে ধরল তার ঠোঁট।

***

ঘাড়ের কাছে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হতে চোখ খুলল তমসা। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য চোখের সামনে কিছুই যেন দেখতে পেল না সে। মনে হল সব কিছু ধোঁয়া ধোঁয়া। এই সময়ই কেউ একজন এসে হাত রাখল তার কাঁধে। তমসা দু’হাত দিয়ে চোখ দুটো ঘষে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, কানে লাগল বাধা দেওয়ার চিৎকার, “কী করছেন কী? আপনার হাতে কত জার্ম আছে কে জানে, সব তো চোখে চলে গেল!”

চোখ ঘষার পরও কয়েক সেকেন্ড চোখ দুটো বন্ধ রাখার পর আস্তে আস্তে সেগুলো খুলল তমসা। নাহ, এবার আর ধোঁয়া ধোঁয়া দেখালো না। সে স্পষ্ট দেখতে পেল সব কিছু। একটা বিছানার ওপর বসে আছে সে। বিছানার একপাশে একটা স্ট্যান্ড থেকে সেলাইনের নল বেরিয়ে আটকে আছে তার বাম হাতে, যদিও সেলাইনের বোতলটা এতো ছোটো যে বেশ অবাক লাগলো তমসার। আরেক দিকে একটা চাকা লাগানো টেবিলের ওপর রাখা কিছু ওষুধ। ছোট্ট রুমটায় আর বিশেষ কিছু নেই। তমসার পাশে যে দাঁড়িয়ে ছিল সে জানতে চাইল, “কেমন লাগছে আপনার?”

এতক্ষণে তমসা তাকাল মেয়েটার দিকে। মাথায় স্কার্ফ, গায়ে গোলাপি জামা পড়া মেয়েটাকে দেখে বলে দিতে হয় না যে সে একজন নার্স। তমসা তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার পর বিড়বিড় করে বলল, “ভালো। কিন্তু আমি এখানে এলাম কী করে? আর আমার সঙ্গীরাই বা কই?”

“আপনার সঙ্গী? আপনাকে তো একাই আনা হয়েছিল।”

“মানে?”

“রাস্তার ধারে আপনাকে কেউ অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেয়ে এখানে ভর্তি করে দিয়ে যায়।”

নার্সের কথা শুনে তমসার সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। দু’হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল সে। যতদূর মনে পড়ছে তারা অধীর বক্সির ল্যাবের সেই আলমারিটার মধ্যে ঢুকেছিল। তারপর সায়ক বোকামি করে কিছু একটা বোতাম টিপে দেয় যার ফলে দরজাটা বন্ধ হয়ে যায় এবং ভেতরে কোনও কারণে প্রচণ্ড তাপ উৎপন্ন হয় যার ফলে ও অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু তারপর! তারপর কী হয়েছিল? রাস্তা… হসপিটাল… আর বাকিরাই বা কোথায় গেল?

“আচ্ছা ম্যাডাম আপনি কি কোনো থিম পার্টিতে যাচ্ছিলেন?”

নার্সের প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরল তমসার। সে জিজ্ঞাসু চোখে নার্সের মুখের দিকে তাকাতে নার্স বলল, “আসলে আপনার পোশাকগুলো দেখে মনে হল আরকি।”

“আমার পোশাক!” বিড়বিড় করতে করতে নিজের শরীরের দিকে তাকাল তমসা, সবুজ রঙয়ের পেশেন্ট গাউন তার পরনে। এটা নিশ্চয় এই নার্সিংহোমে আসার পর পরানো হয়েছে তাকে। তমসাকে বিচলিত হতে দেখে নার্স হেসে বলল, “আসলে আপনি তো টোয়েন্টিজের ড্রেস পরেছিলেন তাই ভাবলাম হয়তো থিম পার্টিতে যাচ্ছিলেন।”

নার্সের কথাগুলো কানে লাগতেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল তমসার, টোয়েন্টিজের ড্রেস মানেটা কী! নার্সটা কী যা তা বকবক করছে, এখন কি ফিফটি না সিক্সটি যে তমসার ড্রেস টোয়েন্টিজের হবে! তমসা ঠিক বুঝতে পারছে না কিন্তু ভেতরে ভেতরে তীব্র একটা অস্বস্তি অনুভব করতে পারছে। নার্সিংহোমের এই রুমটার দিকে তাকালে সেই অস্বস্তিটা যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে। এই শহরে এমন আধুনিক নার্সিংহোম ছিল! আর এই নার্সটা…

তমসা বেশি কিছু ভাবার আগেই একটা চিৎকার, কোলাহলের শব্দ ভেসে এলো। তমসা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?” নার্সটা সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, “আপনি শুয়ে পড়ুন ম্যাডাম। আমার মনে হচ্ছে ওরা আজও এসেছে।”

“কারা?”

তমসাকে উত্তর না দিয়েই ছুটল নার্স। আর তখনই নার্সিংহোমের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে অজস্র আর্তনাদ ভেসে এলো তমসার কানে।

“রোমিত… কী হচ্ছে এসব?”

“আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না আর তোমাকে কী বলবো!”

“ওরা সব কোথায় গেল?”

“জানি না।”

“ওরা কে কিছু আন্দাজ করতে পারছো?”

“নাহ। ভীষণ অদ্ভুত একটা ফিলিং হচ্ছে। ওদের পোশাক আষাক, ব্যবহার সব কিছু কেমন যেন...”

“আর ওদের ওই যন্ত্রগুলো খেয়াল করেছো? এমন কোনো জিনিস এরকম গুন্ডা দলের কাছে থাকতে পারে বলেই আমার ধারণা ছিল না।”

“গুন্ডা দল কেন রাত্রি, কোনো বড় লোকের কাছেও থাকবে না। এমনি স্মার্ট ওয়াচ দেখেছি, কিন্তু ওদের হাতের ওই ব্যান্ডের মধ্যে… আর তারপর যে অস্ত্রটা দিয়ে তোমাকে আঘাত করতে গিয়েছিল সেটাও তো আশ্চর্যরকমের।”

“আমি পড়েছি আগেকার দিনে মানে সেই রাজা রাজড়াদের সময় গুপ্ত ঘাতকেরা এক ধরণের জিনিস ব্যবহার করত। একটা নলের মধ্যে বিষাক্ত সূঁচ রাখা থাকত, সঠিক তাক করে ফুঁ দিয়ে দিলেই সূঁচটা গিয়ে শিকারের গায়ে বিঁধে যেত। আমার বিশ্বাস ওই কে বলে মেয়েটার অস্ত্রটাও ওই রকম যন্ত্রেরই মডিফায়েড ভার্সন। তবে তুমি সেসময় বুদ্ধিটা না করলে এতক্ষণে আমি হয়তো…”

কথাটা বলতে বলতেই গলাটা কেঁপে উঠল রাত্রির। কিছুক্ষণ আগেই যখন কে বলে মেয়েটা ওই অস্ত্রটা তাক করেছিল রাত্রির দিকে তখন রোমিত বুদ্ধি করে বলে ওঠে, “আমার স্ত্রীর মাথাটা ঠিক নেই। আমরা ওরই ট্রিটমেন্টের জন্য যাচ্ছিলাম।”

কথাটা শুনে কে অবিশ্বাসের চোখে তাকালেও রোমিত ভয় না পেয়ে অম্লান বদনে বলে যায়, “আমাদের কোনো রিলেটিভ নেই যার সাথে যোগাযোগ করাতে পারি আপনাদের। আমরা দুজনে সম্পূর্ণ একা থাকি, তার ওপর আমার স্ত্রী অসুস্থ।”

“তাহলে তোদের ‌ব়্যানসামের টাকা কে দেবে?” জানতে চায় কে।

আরেকটা মেয়ে তখন বলে ওঠে, “ব্যাটার কথায় বিশ্বাস কোরো না কে। বউয়ের ট্রিটমেন্টের জন্য যাচ্ছিল, অথচ কার্ড, স্মার্ট ব্যান্ড কিচ্ছু না নিয়ে!”

“তোমরা আমাদের কোথায় খুঁজে পাও গো?” রোমিতের অভিনয়ের রেশ টেনে খানিক পাগলামির সুরে প্রশ্ন করে রাত্রি। একটা ছেলে কী ভেবে কে জানে খানিক নরম স্বরে বলে, “শহরের শেষ প্রান্তে ওই টিলার ওপরের জঙ্গলে।”

যদিও জায়গাটা কোথায় তার বিন্দু বিসর্গও কিছু বুঝতে পারে না রাত্রি বা রোমিত, তাও রোমিত ওই কথার রেশ টেনে বলে, “ঠিক কিছু মনে পড়ছে না, তবে আমাদের ওপর কেউ আক্রমণ করেছিল। আমাদের গাড়ি আর সঙ্গের সব জিনিস ছিনিয়ে নেয়।”

“কী! তুই গল্প ফাঁদছিস!” দ্বিধাগ্রস্ত গলায় জিজ্ঞেস করে কে। রোমিত বলে, “গল্প বলে কী লাভ বলো? তোমরা তো আর আমাদের ছেড়ে দেবে না।”

“ঠিক। তাই সত্যি কথা বল।”

এমন সময় কে-এর কানে কানে একটা ছেলে এসে বলে কিছু। সেটা শুনে হাতটা মুঠো করে পিলারের গায়ে জোরে ধাক্কা মারে কে। তারপর চিৎকার করে ওঠে, “স্কর্পিওন গ্যাং আমাদের বোকা বানালো এভাবে! মাংস খেয়ে নিয়ে শুধু হাড়টা ফেলে গেল আর তোরা তাকেই মাংস ভেবে তুলে আনলি!”

“সরি কে। এদের নিয়ে এবার কী করব বলো?”

“দাঁড়া, এসবই তো তোর অনুমান। আগে আমাদের কনফার্ম হতে হবে। আর সত্যিই যদি এদের থেকে আমাদের কিচ্ছু পাওয়ার না থাকে তাহলে রোজগারের একটা উপায় তো সবসময় খোলা আছেই।”

কথাগুলো বলে কে বেরিয়ে যায় ঘরটা থেকে। এরপর রাত্রি আর রোমিতকে বেঁধে ফেলে রেখে বেরিয়ে যায় বাকি ছেলেমেয়েগুলোও। আর সেই থেকে রাত্রি আর রোমিত এভাবে বন্দি হয়ে আছে।

“রোমিত তুমি কি জানো স্যামকে ঠিক কোন কাজে ওরা ওই কুশরীগঞ্জে পাঠিয়েছিল?” অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর আচমকাই প্রশ্নটা করে বসল রাত্রি।

“অধীর বক্সি নামে আমাদের ক্লাবের এক পুরোনো সদস্য ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন রোজালিণ্ডের লাইব্রেরী থেকে একখানা মূল্যবান প্রাচীন পুঁথি চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যায়। এতদিন এই খবর আর কেউ জানতো না, বা জানলেও ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝেনি। কিন্তু তমসা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর রোজালিণ্ডের এক ডায়েরী খুঁজে পায় যেখানে এই অধীর বক্সির উল্লেখ ছিল এবং বলা ছিল ওই দুষ্প্রাপ্য পুঁথিতে থাকা তথ্যগুলোকে কেউ যদি সঠিক ভাবে ডিকোড করতে পারে তাহলে…”

“তাহলে যুগ যুগ ধরে চাপা পড়ে থাকা এক রহস্যের অন্য দিগন্ত খুলে যাবে। তাই তো?”

“হুমম।”

“এই কথাগুলোই তোতাপাখির মত স্যাম আর সায়ক বলেছিল আমাদের। তমসার শেখানো বুলি আওড়ে গিয়েছিল দুজন। কিন্তু সেই রহস্যটা আদপে কী? কীসের সন্ধানে স্যামকে ওই অধীর বক্সিকে খুঁজতে পাঠিয়েছিল ওরা? আর তমসা কী করে জানলো যে অধীর বক্সি ওর বাড়িতেই থাকবে?”

“তমসা জানতো না। জাস্ট একটা ওয়াইল্ড গেস। লোকটার গতিবিধি জানতে স্যামকে পাঠিয়েছিল। আর দেখো আমাদের ক্লাবের নিয়মই তো আছে যে ওই লাইব্রেরীর কোনো ডকুমেন্ট প্রেসিডেন্ট আর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়া কেউ দেখতে পারে না।”

“রাখো তো তোমার নিয়ম। দেখতে না পারি, কিন্তু জানতে কী সমস্যা? তমসা ইচ্ছে করে করেছে এসব। হয়তো ওরা দুজনই চক্রান্ত করে ফাঁসিয়েছে আমাদের। স্যামকেও…”

কথাটা শেষ করার আগেই রাত্রি টের পেল ওর হাতে সুড়সুড়ি লাগছে কীসের, “রোমিত…”

“চুপ। আমার মনে হচ্ছে আমি খুলতে পারব। তুমি স্থির হয়ে থাকো।”

রোমিত আর রাত্রির হাত পা পিছমোড়া করে বেঁধে শয়তানগুলো ওদের পিঠোপিঠি বসিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘরটা থেকে। হাতের কব্জি বাঁধলেও আঙ্গুলগুলো তো খোলা, তাই রোমিত চেষ্টা করছিল যদি ওভাবে রাত্রির হাতের বাঁধনগুলো খুলতে পারে। তবে ব্যাপারটা যতটা সহজ হবে ভেবেছিল ততটা মোটেই না। এক ধরণের প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে বেঁধেছে ওরা। তাতে আঙুলের একটু চাপ দিলেই আঙ্গুলগুলো কেটে বসে যাচ্ছিল। তবুও অনেকক্ষণের চেষ্টার পর অবশেষে বাঁধনটা খুলতে সক্ষম হল রোমিত। নিজের হাতগুলো না দেখতে পেলেও টের পাচ্ছিল আঙুলগুলো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।

“এবার তুমি বাকিটা নিজে খোলার চেষ্টা করো। গিঁটটা তো খুলে গেছে।” রাত্রিকে বলল রোমিত। রাত্রি সায় দিয়ে এমনি দড়ি খোলার মত দুটো হাতের কব্জিকে পরস্পরের থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করল কিন্তু ফল হল উল্টো। দড়িটা আলগা হয়তো একটু হল কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে দুটো কব্জিতেই একদম কেটে গভীর হয়ে বসে গেল, রক্ত গড়িয়ে পড়ল ঝরঝর করে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল রাত্রি। আর ওর আওয়াজ শুনেই বোধহয় ওপাশের ঘরটা থেকে দুটো ছেলে বেরিয়ে এলো বাইরে। রাত্রিরা ভেবেছিল ওরা সদলবলে বাইরে চলে গেছে কিন্তু এরা দুজন যে ওই ঘরে চুপচাপ বসেছিল তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।

“ওরে স্লা বাঁধন খুলে ফেলেছে!” হুঙ্কার ছাড়ল একটা ছেলে। তার সঙ্গী দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “এটা নির্ঘাত এই ছোঁড়ার কাজ। বউয়ের হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছে। ভালোবাসা দেখাচ্ছে… থুঃ…” এই বলে ছেলেটা একদলা থুতু ফেলল মাটিতে। তারপর ছুটে এসে চড়ে বসল রোমিতের বুকে। মাটিতে পড়ে গেল রোমিত। হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল বলে কাঁধের কাছে প্রচণ্ড ব্যাথা লাগল, মনে হল যেন হাত দুটো যেন ছিঁড়ে যাবে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল সে। কিন্তু ছেলেটা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে এলোপাথাড়ি ঘুঁষি মারতে লাগল রোমিতের মুখে। রোমিতের ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো বাইরে…

“এই কী হচ্ছে এসব?” আচমকা একটা মেয়ের বাজখাঁই গলা শোনা গেল। রোমিত না দেখতে পেলেও বুঝতে পারল কে-রা ফিরে এসেছে। আরেকটা পাহারাদার ছেলে কে-কে বোঝানোর চেষ্টা করল, “আঙ্কল আন্টি পালাবে ভেবেছিল। দড়ির বাঁধনও খুলে ফেলেছিল।”

“কেমন বেঁধেছিলিস তোরা যে খুলে ফেলল!” কে-র গলার স্বর আচমকাই যেন অনেকটা নেমে গেল আবার, “যাইহোক, ছেড়ে দে ওদের। ওদের ব্যবস্থা করতে হবে।”

“মানে? কেন?” জিজ্ঞেস করল রোমিতকে মারতে থাকা ছেলেটা। কে তাকে নির্দেশ দিল, “তুই নেমে আয় ওর ওপর থেকে। এরা যা কিছু বলেছে সব গাঁজাখুরি গল্প। স্কর্পিওনরা কিছুই করেনি। তবে এপির কাছ থেকে জানলাম এদের মত আরও দুজনকে শহরে দেখা গেছে। কী আঙ্কল তোমাদের আরও সঙ্গী আছে, তাই না?”

শেষ প্রশ্নটা রোমিতের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কোনো জবাব দিল না রোমিত। ওর বুকের ওপর থেকে ছেলেটা নেমে বলল, “মিথ্যে বলেছিল তো ব্যাটাগুলোকে ধোলাই দিয়ে সত্যি কথা বলানোর চেষ্টা না করে তুমি ডাইরেক্ট ব্যবস্থা করার কথা কেন বলছো? এদের কাছে নিশ্চয় অনেক মাল আছে। অনেক বড়লোক এরা।”

“যা বুঝিস না তা নিয়ে কথা বলিস না। বেশি লোভ করতে গিয়ে ক্ষতি হতে দিতে পারি না আমি।”

এই বলে নিজের হাতের ব্যান্ডটায় আবার খুটখাট করে কয়েকটা সুইচ টিপল কে, তারপর কানে লাগানো ছোট্ট স্পিকারটা অন করে বলে উঠল, “কে ফ্রম ড্রাগন গ্যাং স্পিকিং…

দুটো স্যাম্পেল আছে…

দশ…

যে সে স্যাম্পেল নয়, দেখলেই বুঝতে পারবে…

ছ’কোটির কম নেভার…

ওক্কে আমি আসছি তারপর ডিল হবে।”

যন্ত্রটা অফ করে সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা ইশারা করল কে। কয়েকজন ওর পেছন পেছন বেরিয়ে গেল। রাত্রি আর রোমিত পরস্পরের দিকে হতভম্বের মত তাকাল। টাকার অঙ্কটা কী যেন বলল মেয়েটা ফোনে… ছ’কোটি! ওদের এতো দাম!

***

“হোয়াটস হ্যাপেনিং রোজ?”

দরজার পাশ থেকে একটা গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসতেই তড়িঘড়ি সায়ককে ছেড়ে নেমে দাঁড়াল রোজ। সায়কও কোনো মতে উঠে বসল সোফাটাতে। দেখল একটা সুটকেস হাতে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন এক বছর ষাট পঁয়ষট্টির বৃদ্ধ। এরকম বিবস্ত্র অবস্থায় বৃদ্ধকে দেখে খানিক লজ্জা পেল সায়ক। বৃদ্ধ রোজের দিকে তাকিয়ে আগের মতোই গম্ভীর গলায় বললেন, “রোজ তুমি কেন আমার অনুমতি ছাড়া একজনকে আমার বাড়িতে তুলে আনলে? আমি জানি তুমি…”

“প্রফেসর, তুমি যা ভাবছো তা নয়।” কথাগুলো বলতে বলতে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গেল রোজ। তারপর লাস্যময়ী ভঙ্গিতে বৃদ্ধের বুকে নিজের একটা লম্বা আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিয়ে মোহময়ী স্বরে বলল, “ওকে আমি অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। তাই তুলে এনেছি। তুমিই তো বলো উই শুড হেল্প আদার্স।”

“উফফ রোজ…”, বৃদ্ধ রোজের হাতটা খপ করে ধরে নিয়ে বললেন, “তোমার ওপর রাগতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারি না, কারণ জানি তোমাকে বলে কোনো লাভ নেই।”

বৃদ্ধের কথায় একটা রহস্যময় হাসি হাসল রোজ। বৃদ্ধ ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “ইউ নো হোয়াট আই ওয়ান্ট নাও।”

মাথাটা নেড়ে ঘরের ভেতরের দিকে চলে গেল রোজ। বৃদ্ধ এবার সোজা তাকালেন সায়কের দিকে। বৃদ্ধের দৃষ্টি মনে হল যেন সায়কের চামড়া ভেদ করে ভেতর অবধি চলে যাবে। একটা ঢোঁক গিলল সায়ক। বৃদ্ধকে দেখার থেকেই তার কেমন যেন অস্বস্তি করছিল। মেয়েটা বৃদ্ধকে প্রফেসর বলে ডাকল, কিন্তু এ কেমন প্রফেসর! বৃদ্ধের কাঁধ অবধি চুল খুব যত্ন করে বিনুনি করা, বিনুনির শেষপ্রান্তে বাদামী রং। বৃদ্ধের লম্বা দাড়ি বুক অবধি পৌঁছেছে, সেই দাড়িও আবার খুব যত্ন করে দুটো রিং দিয়ে একসাথে গোছা করে রাখা। বৃদ্ধের পরনে একটা খুব টাইট শার্ট, শার্টের আবার কলার নেই, ভি-শেপ গলা। শার্টের ওপর একটা লেদার জ্যাকেট। নীচের প্যান্টটা গোড়ালি থেকে ইঞ্চি ছয়েক উঠে আছে ওপরের দিকে। সব মিলিয়ে বেশ অদ্ভুত দেখাচ্ছে বৃদ্ধকে, খানিক হাস্যকরও বটে। কিন্তু এই মুহূর্তে বৃদ্ধকে দেখে হাসতেও ইচ্ছে করছে না সায়কের, এই বৃদ্ধেরই বাড়িতে বসে তাকে দেখে হাসাটা মোটেও সমীচীন নয়।

“হু আর ইউ?” কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ।

সায়ক ঢোঁক গিলে বলল, “দেখুন আমি কিছু জানি না, আমি ইচ্ছে করে আসিনি এখানে।”

“রোজ যা বলেছে তার বাইরের ইনফরমেশন কিছু দাও, কারণ রোজ মিথ্যে বলতে পারে না। নাম কী তোমার?”

“সায়ক ব্যানার্জী।”

“সায়ক! কোয়াইট ওল্ড ফ্যাশনড নেম। কে রেখেছে?”

বৃদ্ধের কথায় একটু অবাক লাগলো সায়কের, এই প্রথম কেউ ওর নামটাকে ওল্ড ফ্যাশন বলছে। এমনিতে সায়ক নামটা আনকমন না হলেও বৃদ্ধ যেভাবে ওল্ড ফ্যাশন বলছেন ততটাও নয়, বৃদ্ধের মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন পঞ্চাশ একশো বছরের পুরনো নাম। মনে মনে একটু ক্ষুণ্নই হল সায়ক। সে জবাব দিল, “আমার মা রেখেছিলেন।”

“তোমার মা নিশ্চয় অভিনেতা সায়ক দত্তর ফ্যান ছিলেন। তাই নামটা রেখেছেন!” হেসে বললেন বৃদ্ধ। সায়ক ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “ইনি আবার কোন অভিনেতা? আমি নামই শুনিনি কোনোদিনও।”

বৃদ্ধ সায়ককে কিছু বলতে গেলেন কিন্তু তার আগেই তাঁর নজর গেল সোফার হ্যান্ডেলের ওপর রাখা সায়কের টি শার্টটার ওপরে। তিনি খপ করে সেটাও তুলে মেলে ধরলেন সামনের দিকে, তারপর উত্তেজিত কন্ঠে বললেন, “এটা কার?”

“আ… আমার।”

“কোথায় পেলে এটা? রোজ দিয়েছে তোমাকে?”

“মানে?” মাথাটা গরম হয়ে গেল সায়কের, “রোজ কেন দিতে যাবে! এটা আমার টি শার্ট।”

“ডোন্ট লাই।”

“অদ্ভুত মানুষ তো আপনি। একটা পাতি টি শার্ট নিয়ে এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?”

“পাতি টি শার্ট! আর ইউ ম্যাড?”

“আমি তো ম্যাড নই কিন্তু মশাই বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনার বোধহয় মাথার সমস্যা হচ্ছে।”

“শাট আপ। জাস্ট শাট আপ। তুমি জানো এটা আমি অকশন থেকে কত টাকা দিয়ে কিনেছিলাম? সেভেন্টি ফাইভ থাউজ্যান্ড নাইন হান্ড্রেড নাইনটি নাইন।”

লোকটার কথা শুনে চোখ দুটো ছানা বড়া হয়ে গেল সায়কের, লোকটা বলে কী!

“আপনি ইয়ার্কি করছেন তাই না?” অবশ্য লোকটার কথাটা ইয়ার্কির মত মনে হলেও লোকটার চোখ মুখ কিন্তু অন্য কথা বলছে। লোকটা আগের মতোই উত্তেজিত গলাতে বলল, “ইয়ার্কি! তোমাদের মত অনলাইন গেমস খেলা ইয়ং জেনারেশনের কাছে এসব ইয়ার্কি মনে হতে পারে কিন্তু আমাদের কাছে এগুলো আমাদের ছোটবেলার নস্টালজিয়া। তোমরা জানো কি…”

বৃদ্ধ কথাটা শেষ করার আগেই সায়ক জিজ্ঞেস করল, “আপনার বয়েস কত?”

“এক্সাট ফিফটি ফোর।”

“ফিফটি ফোর! আপনাকে দেখে তো আরও বয়স্ক লাগে। সরি ডোন্ট মাইন্ড।”

“ইটস ওকে ইয়ং ম্যান। তোমরা যখন আমাদের বয়েসে পৌঁছাবে তখন তোমাদেরও বয়েসের তুলনায় আরও বেশি বৃদ্ধ লাগবে। এই পলিউশনে আমাদের শরীরের ভেতরের অর্গানগুলো সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জানো তো।”

বৃদ্ধ আরও কিছু বলছিলেন কিন্তু সেগুলো কানে ঢুকলো না সায়কের। সে একবার নিজের শার্টটার দিকে তাকাল। এটা আসলে ভাইয়ের টি শার্ট, সেদিন বেরোবার সময় তাড়াহুড়োতে এটা পরে এসেছিল সায়ক। একটা সাধারণ কালো রঙের টি শার্ট, যার ওপরে লেখা KKR এর বিখ্যাত স্লোগান, “করব লড়ব জিতবো রে”। কিন্তু এই বুড়োটা সেটাকে দেখে কীসব অকশন, ছোটবেলার নস্টালজিয়া বলছে কেন! বৃদ্ধের কি সত্যিই মাথার গণ্ডগোল আছে!

“মেসোমশাই বলছি যে আপনি এরকম টি শার্ট চাইলে আমি আপনাকে অনেক এনে দিতে পারি। বড় বাজারে প্রচুর বিক্রি হয়। আর আই.পি.এল চলাকালীন তো কথাই নেই। KKR এর জার্সি, আর এরকম স্লোগান লেখা টি শার্ট তো ঢালাও বিক্রি হয় চারিদিকে।

“কী বললে? আই পি এল, কেকেআর… তুমি এসব জানো? তুমি দেখেছো? এখন কি অনলাইনে খেলাগুলো দেখার ব্যবস্থা করেছে?”

“অনলাইনে কেন? আমার যদিও ক্রিকেট খুব একটা ভালো লাগে না তবুও ভাইয়ের জন্য দু’বার ইডেনে গিয়ে KKR এর খেলা দেখে এসেছি।”

“আরে ভাই ইডেনেও কি আর চোখের সামনে দেখো নাকি? সেই তো আসলে জায়েন্ট স্ক্রিনে অনলাইন স্ট্রিমিং হয়। তবে ওখানে এখন আই পি এল দেখাচ্ছে জানতাম না তো!”

“প্রফেসর আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।” একটা ট্রে’তে করে কফির কাপ আর কিছু স্ন্যাকস নিয়ে ঢুকল রোজ, “তোমাকে কিছু বলার আছে।”

“হুমম বলো।”

“আমি যখন এঁকে অজ্ঞান দেখতে পেয়ে তুলে আনি তখন দেখতে পেয়েছিলাম একদল ভ্যাংকার্স দুজনকে ওপরের জঙ্গল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। আর সেই দুজনের পোশাকও এর মতোই অদ্ভুত ছিল খানিকটা।”

“ইউ মিন এরকম স্লোগান লেখা শার্ট?”

“না। বাট এরকম ঢলঢলে পোশাক। মেয়েটা গ্রীন কালারের ড্রেস পরেছিল আর ছেলেটা পড়েছিল ব্রাউন।”

“রাত্রি! রোমিত!” উত্তেজনায় সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সায়ক। প্রোফেসর বললেন, “তুমি চেনো ওদের?”

“হ্যাঁ। ওরা তো আমার বন্ধু। কিন্তু… এসব কী হচ্ছে!” ধপ করে সোফায় আবার বসে পড়ল সায়ক। প্রোফেসর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “তুমি আসলে কে? ওই জঙ্গলে কী করছিলে?”

“আমার নাম তো আগেই বলেছি কিন্তু ওই জঙ্গল সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আমার। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কিছু মনে পড়ছে না আমার…” দু’হাতে নিজের চুল মুঠো করে ধরল সায়ক।

“তুমি আমাকে সব খুলে বলতে পারো। আমি হয়তো তোমায় কোনো সাহায্য করতে পারি।” নরম স্বরে বললেন প্রোফেসর। সায়ক আড়চোখে তাকাল লোকটার দিকে। কীভাবে বিশ্বাস করবে এই লোকটাকে! নাহ, ওদের গোপন কথা কিছুতেই এরকম বাইরের কারুর সাথে শেয়ার করা যায় না। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে সায়ক বলল, “আপনাকে বিব্রত হতে হবে না। আপনি শুধু আমাকে কাছের পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে দিন। আমি তারপর নিজেই বাকিটা সামলে নেব।”

সায়কের কথায় ভ্রু কুঁচকে গেল প্রোফেসরের। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই একটা বিপবিপ শব্দ শোনা গেল কোথাও থেকে। সায়কের কেন না জানি মনে হল শব্দটা আসছে রোজের কাছ থেকে। প্রফেসর উঠে গেলেন রোজের কাছে, “অনেক পরিশ্রম করে ফেলেছো আজ। বিশ্রাম নাও খানিক।” এই বলে তিনি রোজের পিঠে কিছু একটা করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে রোজ লুটিয়ে পড়ল তাঁর বুকে। প্রোফেসর তাকে শুইয়ে দিলেন একটা সোফার ওপর। সায়ক বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।

রোজকে শুইয়ে প্রফেসরের দৃষ্টি ফিরল সায়কের দিকে। তিনি বিরক্ত মুখে বললেন, “অমন হাঁ করে কী দেখছো?”

“ও… ওকে আপনি কী করলেন?” জড়িয়ে গেল সায়কের গলা।

প্রোফেসর অম্লান বদনে বললেন, “রেস্ট নিতে পাঠালাম। কাল ওভার চার্জ হয়ে গিয়েছিল বলে আজ অনেক কাজ দিয়ে ফেলেছিলাম। আসলে বাইরে থেকে যুবতী হলেও কী হবে বয়েস তো ওরও হচ্ছে, একটানা বেশি কাজ করলে আজকাল আর টানতে পারে না। একটুক্ষণ সুইচ অফ থাকলে আবার ঠিক হয়ে যায়।”

“চার্জ… সুইচ অফ… এসব কী বলছেন আপনি!”

প্রোফেসর কিছুক্ষণ অবাক হয়ে সায়কের দিকে তাকিয়ে থাকার পরেই কিছু একটা বুঝতে পেরেছেন এমন ভাব করে হো হো করে হেসে উঠল জোরে, “ওহ মাই গড। তুমি কি এতক্ষণ রোজকে মানুষ ভাবছিলে? আরে বাবা মানুষ হলে কী আর এই বুড়োর সাথে থাকতো সে? রোজ তো সেক্সরোব কাম মেইড।”

“কী!”

“আমার মত কাজ পাগল মানুষের পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না বুঝলে, সারাদিন তো প্রায় ল্যাবেই কেটে যায়। তবুও মানুষ তো, বায়োলজিক্যাল নিডগুলো কী করে অস্বীকার করব! তাই অর্ডার দিয়ে এই সেক্সরোবটা আনাই, তারপর কিছু টুকিটাকি চেঞ্জ করে এমন সেটিং করে দিই যাতে গৃহস্থালীর কাজকর্মও সামলাতে পারে। হেঁ হেঁ কেমন বুদ্ধি বলো? তবে ওভার চার্জড থাকলে মাঝে মাঝে যা তা কাণ্ড করে বসে।”

সায়ক কোনো জবাব না দিয়ে নিজের মাথাটা ধরে নিলো দু’হাত দিয়ে। তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

***

সমস্ত আর্তনাদ উপেক্ষা করে স্থির হয়ে শুয়ে থাকার চেষ্টা করছিল তমসা। এমনিতেই আজ সকাল থেকে অদ্ভুত সব জিনিসপত্র ঘটছে, তার ওপর এই নার্সিংহোমটা দেখলে ওর আরও অদ্ভুত লাগছে। এখানকার যা ইনফ্রাস্ট্রাকচার তাতে করে বলে দিতে হয় না যে নার্সিংহোমটা খুব কস্টলি। এতো কস্টলি নার্সিংহোমে ওকে কে ভর্তি করে দিলো কে জানে! তবে এতো কস্টলি নার্সিংহোম সেখানে এমন চিৎকার চেঁচামেচি মেনে নেওয়া যায় না। বিরক্তি লাগছিল তমসার, নার্সটা যে গেল তারও আর পাত্তা নেই। উফফ…

বিছানার উপর উঠে বসল তমসা। গায়ের যেখান সেখানে ছড়ে গিয়েছিল মনে হয়, ব্যান্ডেজ লাগানো আছে। ব্যথাও লাগছে অল্পস্বল্প। মাথাটা এদিক ওদিক ঘোরাতে গিয়েই তমসার নজর পড়ল বাম পাশের টেবিলের ওপর রাখা একটা পত্রিকার ওপর। ওখানে বেশ কয়েকটা পত্রিকা রাখা আছে, তার মধ্যে সবার ওপরের পত্রিকাটির কভারে একটি মেয়ের লাস্যময়ী ভঙ্গির ছবি, পাশেই বড় বড় হরফে লেখা--- “সায়নার মনের অলিগলি…”

এই মেয়েটার নাম সায়না! পত্রিকার কভার দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ বিখ্যাত কেউ হবে, কিন্তু তমসা তো এর নাম অবধি শোনেনি কখনও! কে এই মেয়েটা! তমসা পত্রিকাটা হাত বাড়িয়ে তুলতে গেল কিন্তু তার আগেই দক্ষিণ দিকের জানালার পাশে বীভৎস রকমের একটা শব্দ হল, মনে হল যেন ছাদ থেকে কিছু একটা ভেঙে পড়ে গেল। আর তমসার না জানি কেন মনে হল নার্সিংহোমের ভেতরের চিৎকারটাও বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তমসার গা’টা অজান্তেই শিরশির করে উঠল। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, যখনই আশেপাশে কোনো খারাপ কিছু ঘটে তখনই তমসার অজান্তেই ওর শরীরে এরকম শিরশিরানী অনুভূত হয়। হাতের আটকানো সেলাইনের চ্যানেলটার দিকে একবার তাকাল তমসা। সূঁচ তো দেখা যাচ্ছে না। একটা প্লাস্টিক বাক্সের মত জিনিস হাতের কিছুটা অংশে বসানো আছে, ওই বাক্সেই নলটা এসে ঢুকছে। ভ্রূ কুঁচকে চ্যানেলটা ধরে একটু নাড়াল সে। নাহ ব্যথা লাগছে না। ভালো করে তাকাতেই তমসা খেয়াল করল ওই সাদা বাক্সের দু’পাশে দুটো নব লাগানো। একটা নব ভেতর দিকে খানিকটা ঢুকে আছে, আর আরেকটা তুলনামূলক লম্বা হয়ে বেরিয়ে আছে বাইরে। তমসা কি মনে করে লম্বা নবটায় চাপ দিতেই সাদা বাক্সটা খুলে ওপর দিকে উঠে এলো। এবার তমসা দেখতে পেল খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ণ তিনটে সূঁচ গাঁথা হয়েছিল ওর হাতে কিন্তু ব্যথা হয়নি একদম। বাক্সটা তুলে বিছানায় রেখে দিল তমসা। তারপর ধীরে পায়ে বিছানা থেকে নেমে জানালাটার ধারে চলে এলো। কাঁচের সঙ্গে মুখ লাগতেই দেখতে পেল ওর কেবিন সংলগ্ন ব্যালকনিতে একটা বড় প্লেটের মত জিনিস ভেঙে পড়ে আছে। এটাই নিশ্চয় ছাদ থেকে পড়েছিল। কাঁচের এপাশ থেকে ওটা কীসের প্লেট ঠিক বুঝতে পারল না তমসা, তাই সে আস্তে করে জানালার ছিটকিনিটা খুলে ফেলে বাইরের দিকে মুখ বাড়াল। ওই ভাঙা প্লেটটা ছাড়া কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে না। বাইরেটা বরং অনেক শুনশান। তমসা মুখটা সরিয়ে নিয়ে জানালাটা লাগাতে গেল কিন্তু তখনই আবার ঝনঝন শব্দ করে ওর সামনে আরেকটা ভাঙা প্লেট ছাদ থেকে পড়ল নীচে। ঘটনার আকস্মিকতায় মৃদু চিৎকার করে উঠল তমসা। তারপরেই জানালা দিয়ে মুখ তুলে ছাদের দিকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু ভালো করে কিছু দেখার আগেই একটা নখর যুক্ত হাত ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে দিল তমসার মুখে। ভয় আর যন্ত্রণা দুয়ের মিশ্র অনুভূতিতে বীভৎস জোরে চিৎকার করে উঠে পিছিয়ে এলো তমসা। ও খেয়ালই করেনি কখন যেন ওর ঘরটার আলো নিভে গেছে। পিছিয়ে আসতে গিয়ে খাটে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল তমসা, তার চোখ গেল বাইরের দিকে। ঘরের মধ্যকার আলোটা নিভে গেলেও বাইরের আলোটা তখনও জ্বলছে টিমটিম করে, আর তাতেই জানালার ধারে তমসা দেখতে পেল তাকে…

দীর্ঘকায় একটা মূর্তি, কঙ্কালসার শরীরে পাতলা একটা চামড়ার আবরণ মাত্র, পেছনের প্রকান্ড লেজে তার অগ্নির স্ফুলিঙ্গ। শ্বদন্ত বেয়ে কষ গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। অনেকটা সরীসৃপের মত দেখতে কিন্তু ঠিক যেন সরীসৃপ নয়…

অজানা আতঙ্কে তমসার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল, হাত পাগুলো শিথিল হয়ে এলো। তমসার মনে হল সে এক্ষুণি বুঝি অজ্ঞান হয়ে পড়বে। কিন্তু তখনই একটা আর্তনাদ এসে লাগলো তার কানে, মনে হল যেন কারুর মৃত্যু আর্তনাদ। তমসা দেখলো প্রাণীটা এখনো ঘরের ভেতর চোখ চালিয়ে খুঁজে যাচ্ছে তাকে। হয়তো প্রাণীটা অন্ধকারে দেখতে পায় না তাই খুঁজে পাচ্ছে না তমসাকে। নাহ… তমসা তো এতো দুর্বল কোনোদিনও ছিল না। ‘দ্য মিস্টে’র হয়ে অনেক ভয়ঙ্কর অভিযানে গিয়েছে সে। এরকম করে ভয় পেলে চলবে না তার। একটা জোরে শ্বাস নিলো তমসা, তারপর মন আর শরীর দুয়ের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সে আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে এগোতে থাকলো। দরজার বাইরেও তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে কে জানে!

দরজা দিয়ে বেরোতেই তমসা দেখতে পেলো করিডোরে একটা লোক ঘাড় মুড়ে পড়ে আছে। দেখলেই বোঝা যায় লোকটার শরীর প্রাণ নেই। হয়তো একটু আগে এই লোকটারই আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল সে। রুম থেকে বেরিয়ে আসার ফলে নার্সিংহোমের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসা চিৎকারগুলো আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে, সঙ্গে ভেসে আসছে ভাঙচুরের আওয়াজ। আরেকটু এগোতেই তমসা দেখতে পেলো অনেক মানুষ উদ্ভ্রান্তের মত ছোটাছুটি করছে এদিক সেদিক, চারিদিকে ছড়িয়ে রক্ত। একজন নার্স ছুটতে গিয়ে রক্তের মধ্যে পা পিছলে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে সেই অদ্ভুত প্রাণীটা লাফ দিয়ে এসে পড়ে গেল তার ওপর। মুহূর্তের মধ্যে নার্সটার টুঁটি ছিঁড়ে নিল সে। দৃশ্যটা দেখে গা গুলিয়ে উঠল তমসার। সে যথা সম্ভব নিজেকে দেওয়ালের আড়ালে রেখে এগোবার চেষ্টা করল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তমসা দেখল সামনেই লিফট। লিফটটা এই ফ্লোরেই আটকে আছে। তমসা ছুটে গিয়ে লিফটের সুইচ টিপল। দরজাটাও খুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ভেতরে ঢুকতে গিয়েই গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল তার। ওরকমই একটা প্রাণী লিফটের মধ্যে বসে একজন রোগীর মাথাটা চিবিয়ে যাচ্ছে এক মনে। প্রাণীটা তমসাকে খেয়াল করার আগেই তমসা বাইরের সুইচ টিপে বন্ধ করল দরজাটা। তার বুকটা এখনও হাপরের মত ওঠা নামা করছে। ওই প্রাণী তারমানে একটা নয়, অসংখ্য! কিন্তু ওটা কী প্রাণী! কোথা থেকেই বা এলো! কাঁপা কাঁপা পায়ে আস্তে আস্তে এদিক সেদিক দেখেও কোথাও সিঁড়ি দেখতে পেলো না তমসা। তার হঠাৎ ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাথা করছে, প্রাণীটা যেভাবে আঁচড়ে দিয়েছিল মুখে সেই জায়গাটাও জ্বালা করছে, রক্ত বেরোচ্ছে এখনও। এখন কোনদিকে যাবে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না তমসা। কিন্তু সে বেশি কিছু ভাবার আগেই কাঁধের কাছে একটা গরম বাতাস এসে লাগতেই চমকে উঠে পেছন ফিরল সে। দেখল একটা প্রাণী ঠিক তার ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস নিচ্ছে। প্রাণীটা ওকে ধরতে যেতেই অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ছুট লাগাল তমসা। কিন্তু প্রাণীটার সাথে এঁটে ওঠা মুশকিল। বড় বড় পা ফেলে প্রাণীটা ধেয়ে এলো তার দিকে। একটু পরেই তমসা টের পেল দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তার। প্রাণীটা থাবা বাড়াল তার দিকে, তমসা শরীরটা কাত করে নিতেই থাবাটা গিয়ে লাগল পেছনের কাচের দেওয়ালে। ঝনঝন করে কাচ ভেঙে পড়ল, আর তমসার টাল সামলাতে না পেরে দশ তলা থেকে কাচের সঙ্গে হুড়মুড় করে পড়তে লাগলো নীচে…

১০

“স্যাম্পেলগুলো দেখছো? কত দেবে বলো?”

“আমি যা রেট বলেছি সেটাই। এদের মধ্যে বিশেষত্ব কিছুই নেই।”

“চালাকি কোরো না। তোমার চোখ মুখ কিন্তু অন্য কথা বলছে।”

“তাই বুঝি? এতো ধারণা শক্তি তোমাদের? তাহলে ঐ ধারণা শক্তিকে একটু ভালো কাজেও লাগাতে পারতে, তাহলে এমন করে গুন্ডামি করে জীবন কাটাতে হত না।”

“ডক্টর…” ঘুঁষি বাড়িয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল দলের একটা ছেলে। কে তাকে ইশারায় শান্ত হতে বলল। নেত্রীর নির্দেশে ঘুঁষিটা নামিয়ে নিলেও শান্ত হতে পারলো না ছেলেটি, ফুঁসতে লাগলো রাগে। কে মেয়েটার দিকে ঘুরে দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “আমাদের ব্যঙ্গ কোরো না ডক্টর। তোমাদের মতন সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না। আর মজার জিনিস দেখো না তোমাদেরও কিন্তু আমাদের মত গুন্ডার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন হয়।

যাইহোক, তোমার সঙ্গে ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। আমরা যা বলেছি তার থেকে এক চুলও নড়ব না। ছয় লাস্ট ডিল।”

“এদের জন্য ছয় কেন দেব বলতে পারো? এরা কে ভাই?”

“এরা কে জানি না তবে এদের মতো অদ্ভুত পোশাক পরা আরও দুজনকে আজ শহরে দেখা গিয়েছে। এরা মোট চারজন আছে। এই দুজনের কাছে কোনো আই কার্ড পাওয়া যায়নি, এরা কে কেন এখানে এসেছে কোনো সদুত্তর দিচ্ছে না। তাহলে ভেবে দেখো এরকম দুটো মানুষ গায়েব হলে সরকারের কিস্যু যাবে আসবে না।”

“বুঝলাম। কিন্তু এখন আমি পাঁচের বেশি দিতে পারব না। বাকি দুটোকেও যদি ধরে আনতে পারো তাহলে কথা দিচ্ছি মোট তেরো দেব।”

“কী বলছো কী! তাদেরকে এই গোটা শহর ঘুরে ধরে আনতে হবে আর তার জন্য মাত্র সাত! না না না। চারজনের মোট পনেরো, নয়তো থাক।”

কে আর ওই মেয়েটার কথোপকথন শুনে মাথাটা যেন বনবন করে ঘুরছিল রাত্রি আর রোমিতের। এরা কারা, কত পয়সা এদের যে এমন কোটি কোটি টাকা নিয়ে কারবার করে! যে মেয়েটাকে ওরা ডক্টর বলে ডাকছে মেয়েটার এক মাথা ঝাঁকড়া চুলের নীচের দিকে সোনালী রং করা, চোখে হলুদ রঙের লেন্স, পরনে একটা টাইট জিন্স আর সেরকমই টাইট শার্ট। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী বললেও অত্যুক্তি হয় না। এই মেয়েটার হাতে কে-এর মতো ব্যান্ড লাগানো। মেয়েটাকে ওরা ডক্টর বলে ডাকছে কিন্তু মেয়েটা আদপে কে কিছুই বুঝতে পারছে না রাত্রিরা।

“এ আমাদের এতো টাকা দিয়ে কিনছে কেন বলো তো রাত্রি?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রোমিত।

“কিনছে!” শব্দটা শুনেই গা’টা কেমন গুলিয়ে উঠল রাত্রির। মেয়েদের বেচাকেনা মানেই তো… আর রাত্রি শুনেছে আরবের দিকে নাকি এখনও গোপনে দাস পাচার হয় এভাবেই। রোমিতকে আশঙ্কার কথাটা বলতেই রোমিতের শিরদাঁড়াটা কেঁপে উঠল। ওর মনে পড়ে গেল সেদিন ক্লাব ঘরে স্যামকে খোঁজার দাবিটা ওই প্রথম জানিয়েছিল। আর সেই স্যামকে খুঁজতে গিয়েই আজ ওদের এই অবস্থা। একেই কি বলে নিজের কবর নিজে খোঁড়া! আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না রোমিত, চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল সে। কিন্তু কানে লাগল কে এর গলা, “ডিল। তোমার লোককে ডাকো। নিয়ে যাও ওদের।”

মেয়েটা কী বলল শোনা গেল না, তবে রোমিতের কানে এসে লাগল একটা বিপবিপ শব্দ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রোমিত বুঝতে পারল ঘরটায় কেউ ঢুকছে।

“স্যাম… তুমি!” রাত্রির চিৎকার শুনে চমকে উঠে চোখদুটো খুলল রোমিত। হতভম্ব হয়ে দেখল তাদের কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে স্যামুয়েল, যাকে খোঁজার জন্য এতো সব।

“স্যাম!” অস্ফুটে বলল রোমিত, দেখল স্যামের ঠোঁটের কোণে লেগে আছে একটা রহস্যময় হাসি।

***

“ইয়ং ম্যান বর্তমানে তোমার কাছে দুটো অপশন খোলা আছে— হয় আমাকে সব খুলে বলো আর নয়তো আমি টাউনের ইমারজেন্সি কন্ট্রোল টিমকে ডেকে তাদের হাতে তোমাকে তুলে দেবো, কারণ তোমাকে আমার ঠিক সুবিধের লাগছে না।”

“কিন্তু আমি…” সায়কের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একটা সুর বেজে উঠল কোথাও। প্রোফেসর ওকে ইশারায় চুপ করতে বলে নিজের হাতে লাগানো রাবার ব্যান্ডটাতে টাচ করলেন আর সায়ক অবাক হয়ে দেখল মুহূর্তের মধ্যে ওই অতি সাধারণ দেখতে রাবার ব্যান্ডটা স্বচ্ছ হয়ে অনেকটা ট্যাবের স্ক্রিনের মত দেখতে হয়ে গেল। প্রোফেসর আরেকটা জায়গায় টাচ করতেই ডিসপ্লেতে একজনের মুখ ভেসে উঠল।

“গুড এভিনিং মি. পল হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?” হাসি মুখে বললেন প্রোফেসর। ওপর প্রান্ত থেকে জবাব এলো, “এভিনিং ইজ নট এট অল গুড ফর মি প্রফেসর রয়।”

“হোয়াই?”

“আজ আবার টাউন হসপিটালে ওই দানবগুলো আক্রমণ করেছে। প্রচুর মানুষ মারা গেছে। আর…

যাইহোক এ কথা ছাড়ুন। আমাদের টাউনে আরও একটা বিশেষ ঘটনা ঘটেছে। চারজন অদ্ভুত পোশাক পরা ব্যক্তিকে কুশারীর জঙ্গলে আজ দেখা গিয়েছে। সূত্রের খবর ওদের মধ্যে দুজনকে ভ্যাংকার্সরা তুলে নিয়ে গেছে, আরেকজনকে টাউন হসপিটালে ভর্তি করেছিল কিছু লোক। কিন্তু খবরটা যতক্ষণে আমরা পাই ততক্ষণে দানবরা ওখানে আক্রমণ করে ফেলেছে তাই… বাট আরেকজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কি এ ব্যাপারে কিছু জানেন?”

প্রোফেসর একবার আড়চোখে সায়ককে দেখে নিয়ে মি. পলকে বললেন, “আমি কী করে এসব জানবো ফ্রেন্ড! আমি তো সকাল থেকে ল্যাবেই ছিলাম। এই ফিরলাম জাস্ট।”

মি. পল কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেলেন, তারপর তড়িঘড়ি বিদায় জানিয়ে কানেকশন কাট করে দিলেন। কথা বলতে বলতে প্রোফেসর সোফা ছেড়ে উঠে গিয়েছিলেন, তিনি আবার এসে বসলেন সোফায়।

“দেখলে তো ইমারজেন্সি কন্ট্রোল টিমের কাছে খবর চলে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আর আমি যদি খুব ভুল না করি আধ ঘন্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে ওরা এখানে এসে হাজির হয়ে যাবে।”

“কেন? আপনি যে ওদের না বললেন।”

“আমার মুখ দেখে কি যুধিষ্ঠির মনে হয় যে ওরা আমাকে বিশ্বাস করবে! ওরা নিশ্চয় রোজের সাথে তোমাকে দেখেছে। বাই দ্য ওয়ে যুধিষ্ঠির কে জানো তো?”

প্রোফেসরের প্রশ্নের শ্লেষটা দেখে গা জ্বলে গেল সায়কের। সে একটু ঝাঁঝিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, “আমার মুখটা দেখে কি অশিক্ষিত মনে হয় যে যুধিষ্ঠিরকে জানবো না!”

“রিয়েলি?” প্রোফেসর একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন নভেলের ক্যারেক্টার বলোতো?”

“নভেল? আপনি কি পাগল নাকি! এপিক আর নভেলের পার্থক্য জানেন না!”

“ব্রাভো!” নিজের উরুর ওপর আনন্দে তালি দিলেন প্রোফেসর, “এই জন্যই আমি চট করে তোমার নামটা ওদের বললাম না। ওদের আগে আমি জানতে চাই তুমি কে। তুমি আই পি এল জানো, KKR কে জানো, তুমি এপিক পড়েছো! আজকালকার ইয়ং জেনারেশন তো এসবের নামই শোনেনি বললে চলে!”

“একটা প্রশ্ন করব?”

“উফফ তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে যাচ্ছ তখন থেকে! আচ্ছা এটা লাস্ট চান্স, বলো কী প্রশ্ন করবে?”

“আপনার হাতের ওই জিনিসটা কী? ওটার সাহায্যে কীভাবে কথা বললেন ওই ভদ্রলোকের সাথে?”

“মানে? বুঝলাম না… তুমি এই স্মার্ট ব্যান্ডের কথা জিজ্ঞেস করছো?”

“স্মার্ট ব্যান্ড!”

“তুমি আগে কোনোদিনও দেখোনি?”

“না তো।”

“স্ট্রেঞ্জ! তুমি এবার খোলসা করে বলো তো তুমি কে ভাই? স্মার্ট ব্যান্ড আগে দেখোনি মানেটা কী! লোকের সঙ্গে তাহলে যোগাযোগ রাখতে কীভাবে? ডকুমেন্টস ক্যারি করতে কীভাবে?”

“আমি তো…” উত্তরটা দিতে গিয়েও থমকে গেল সায়ক, তার বুকের বামদিকটা এখন প্রচণ্ড জোরে কাঁপছে। কয়েকটা সূত্র সে অনেকক্ষণ থেকে জোড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, কিন্তু সূত্রগুলোয় ঠিক আবার বিশ্বাসও করতে পারছিল না তাই… কাঁপা কাঁপা গলায় সে জিজ্ঞেস করে উঠল, “এই জিনিসটা কবে আবিষ্কার হয়েছে?”

“আবিষ্কার…! উমম… প্রথম ২০৪১ এর দিকে আবিষ্কার হয়, তারপর ২০৪৫ নাগাদ জেনারেল পাবলিকের জন্য মার্কেটে চলে আসে। তোমার জন্মেরও আগে আবিষ্কৃত হওয়া একটা জিনিসের নামই শোনেনি তুমি!”

“২০৪১… ২০৪৫…” বিড়বিড় করল সায়ক। তার গোটা শরীরটা কাঁপছে এবার, “আর এটা কত সাল?”

সায়কের প্রশ্নে ওর মুখের দিকে খানিক অবাক হয়ে তাকালেন প্রোফেসর, হয়তো অনেক প্রশ্ন তার মনে জাগছিল, কিন্তু সেসব আর জিজ্ঞেস না করে সরাসরি বলে উঠলেন, “২০৭৫।”

“ইউ আর কিডিং, রাইট?” সায়ক জানে না কেন তার হঠাৎ কান্না কান্না পাচ্ছে। দুঃখ বা আনন্দ কোনোটাই নয়, একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ভেতরে। প্রোফেসর বেশি কথা না বলে হাতের ব্যান্ডটা অন করে সায়ককে দেখালেন। ঘড়ির নীচে সেখানে দেখা যাচ্ছে সময়, ১৫ই জুন, ২০৭৫।

একটা নিশ্বাস ছাড়ল সায়ক, তার চোখের সামনে ভেসে উঠল অধীর বক্সির ল্যাবের সেই আলমারির মধ্যে নীল ডিসপ্লে প্লেটে ফুটে ওঠা চারটে নম্বর।

“আমাকে একটু জল খাওয়াবেন?”

“জল? দাঁড়াও আসছি। কোথাও যেও না কিন্তু।”

প্রোফেসর ভেতরে চলে গেলেন, তারপর মিনিট খানেকের মধ্যে একটা কাঁচের গ্লাসে জল এনে সায়কের হাতে দিলেন। সায়ক গ্লাসটা নিয়ে কয়েকবার ঘুরিয়ে দেখল চোখের সামনে। এই সাইজের গ্লাসে তারা পাড়ার মোড়ে চা খেত।

“কী দেখছো ওভাবে?”

“এই ধরণের ছোটো গ্লাসে আমরা পাড়ার মোড়ে চা খেতাম।”

“পাড়ার মোড়! তুমি…”

“আপনার জন্ম কত সালে?”

“আমার জন্ম জিজ্ঞেস করছো! আমার তো তোমাকে নিজের থেকেও বুড়ো লাগছে। তুমি যা সব বলছো… যাইহোক, আমার জন্ম টোয়েন্টি ওয়ানে।”

“আন্দাজ করেছিলাম… আপনি ঠিকই বলেছেন প্রোফেসর, আমি আপনার চেয়েও বড়। আমার জন্ম ১৯৯১ সালে।”

“ইয়ং ম্যান…” প্রোফেসরের গলায় যেন বাক্যস্ফূর্তি হল না। তাঁর খুব ইচ্ছে করছিল এই ছোকরাকে এরকম ইয়ার্কি করার জন্য খুব কষে বকে দেয়, কিন্তু ছোকরার মুখ দেখে একটুও মনে হল না যে সে মিথ্যে বলছে। বরং উল্টোটা, ছেলেটাকে ভীষণ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে এই মুহূর্তে।

“প্রোফেসর আপনাদের এই সময় টাইম ট্রাভেল কি কমন ব্যাপার?”

“টাইম ট্রাভেল…! ওই নিয়ে কাজ হচ্ছে প্রচুর কিন্তু সাফল্য কেউ পেয়েছে বলে শুনিনি। তোমাকে যদি বিশ্বাস করি তাহলে প্রশ্ন উঠছে যে তোমাকে কি কেউ বলপূর্বক এখানে এনেছে? মানে কোনো বিজ্ঞানীর এক্সপেরিমেন্টের জন্য তুমি এসেছো?”

“প্রথমটার উত্তর না, আর দ্বিতীয়টা আংশিক ভাবে ঠিক।”

“যেমন?”

“আমি কোনো বিজ্ঞানীর এক্সপেরিমেন্টের কারণেই এখানে এসেছি তবে সেই বিজ্ঞানী আপনাদের সময়ের না। সে ঠিক কোন সময়ে কাজ শুরু করেছিল আমার জানা নেই, তবে আন্দাজ ২০০৮ সালের দিকে হবে। আর আমি আর আমার বন্ধুরা অজান্তেই ওই এক্সপেরিমেন্টের বলি হয়ে যাই ২০২০ সালে।”

“ওয়েট। এভাবে না বলে সবটা পরিষ্কার করে বলো। যে কোনো মুহূর্তে TAC Team পৌঁছে যাবে, তার আগে শেষ করার চেষ্টা করো।”

“ওকে। জানি না কতোটা গুছিয়ে বলতে পারব, তবে আপনাকে বলা ছাড়াও উপায় নেই আমার।”

একটু দম নিয়ে সায়ক বলতে শুরু করল তার গল্প।

***

“…দিয়ে ওই জায়গায় হঠাৎ করে প্রচণ্ড তাপ উৎপন্ন হতে শুরু করল। তারপর আমরা বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম আপনার বাড়িতে আছি।”

“আনবিলিভেবল… এমনটাও হয়! মানে আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে সেই সময়ও সায়েন্টিস্টরা এরকম সায়েন্সের সাথে পুরানো জাদু টোনার ব্যাপার স্যাপারকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করত!”

“তখন করত মানে! এখন…”

“ইয়েস, এখন এটা ভীষণ কমন ব্যাপার। সায়েন্টিস্টদের ওপেন সিক্রেট বলতে পারো। এখন সায়েন্সের সঙ্গে এসব ব্ল্যাক ম্যাজিক, অকাল্ট থিওরিজকে পাঞ্চ করে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করার ভীষণ বাতিক উঠেছে সায়েন্টিস্টদের মধ্যে। এখন নিষিদ্ধ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার প্রতি ঝোঁক খুব বেড়েছে।”

“নিষিদ্ধ যখন, তখন সরকার অনুমতি দেয় কেন?”

“সরকারকে কি আর বলে করে! ধরে নিতে পারো সরকারি সাহায্য নেওয়ার সময় মূল এক্সপেরিমেন্টের ওপর একটা মুখোশ চড়িয়ে ওরা শো করে, ওই মুখোশের আড়ালে নিষিদ্ধ কারবার চলে। আমরা জানি অনেক কিছুই, কিন্তু প্রমাণের অভাবে বা কিছু নীতি আমাদের সায়েন্টিস্টদের ফলো করতে হয়, যার জন্য আমরা অন্যের ব্যাপারে মাথা গলাই না।”

“আচ্ছা, সবই বুঝলাম। কিন্তু আপনি আমার বাড়ি যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন না? আর আমার ওই দুজন বন্ধুকে কারা জেনে ধরে নিয়েছে বলছিলেন…”

“ভ্যাংকার্স!”

“হ্যাঁ। ওরা কারা?”

“আমাদের মর্ডান সোসাইটির ডার্ক স্পটস। ভ্যাংকার্স মানে ভ্যাগাবন্ড প্লাস ড্রাঙকার্স। তোমাদের সময়ের সোসাইটির থেকে আমাদের সোসাইটি অনেক আলাদা। তোমাদের সময় চাকরি পাওয়া যেত মেরিটের ভিত্তিতে, এখন চাকরি ওঠে নিলামে। সুতরাং বুঝতেই পারছো চাকরি কারা পায়, কীভাবে পায়। বিজনেস খুলতে হলেও পারমিশন পেতে ওই নিলামের ব্যবস্থা। তাছাড়া এখন রোবটরা এতো বেশি কাজ করে দিচ্ছে যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মী মানুষের প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে। উচ্চশিক্ষার খরচও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। তাই দেশের ওই সব শিক্ষিত বেকারদের এখন নতুন নাম ভ্যাংকার্স। ওরা ভয়ংকর রকমের নিষ্ঠুর হয়, সমাজের প্রতি ওদের বিরূপ মনোভাবের কারণে ওরা কাউকে রেওয়াত করে না। নেশা করা, খুন জখম, কিডন্যাপ, মারামারি ওদের বেঁচে থাকার রসদ। বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই কুড়ি পেরোলেই এখন ভ্যাংকার্সদের সঙ্গে নাম লেখাচ্ছে। যার বাবা মা টাকা জোগাড় করে ফেলতে পারে তারা শুধু জীবনের মূল স্রোতে থেকে যায় আর নয়তো… এই ভ্যাংকার্সরা অত্যন্ত…”

“এতো প্রশংসা হচ্ছে আমাদের! আরও কিছু বলো কাকু আমিও শুনি।”

দরজার কাছে থেকে একটা মেয়ের গলা ভেসে আসতেই চমকে উঠলেন প্রোফেসর। তাঁর ঠোঁট দুটো আপনা থেকেই কেঁপে উঠল, “কে! তুই?”

“ভয় নেই কাকু, আজ তোমার কাছে ভিক্ষে চাইতে আসিনি।”

“কী চাই তোর? আর এই দলবল নিয়ে কেন এসেছিস? ডাকাতি করবি?”

থুঃ… ঘরের মেঝেতে এক দলা থুতু ফেলে কে বলল, “মরে গেলেও তোমার ঘরে ডাকাতি করব না। তোমার মতোই তোমার পয়সাকেও ঘেন্না করি আমি।”

“তাহলে?”

“তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। আমরা শুধু এই ছেলেটাকে নিতে এসেছি।”

“খবরদার! ওর গায়ে হাত দিবি না।”

“বাব্বা, যে লোকটা নিজের ভাইঝিকে মরতে ছেড়ে দিয়েছিল তার আজ একটা অচেনা ছেলের জন্য দরদ একেবারে উঠলে উঠছে! সত্যিই এই ছোকরা আর ওর সঙ্গীরা এই জন্য এতো দামী। এই লেগে পড়…”

কে নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে ওর দুই সঙ্গীর হাতে দুটো বন্ধুকের মত জিনিস উঠে এলো। প্রোফেসর বাধা দেওয়ার আগেই বন্দুক থেকে গুলি ছিটকে এসে বিঁধে গেল সায়ক আর প্রোফেসরের গায়ে…

***

বুকটা ধকধক করে উঠতেই ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল তমসা। দশ তলা থেকে নীচে পড়ে কোনো মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব না, যদি বা ক্ষীণ প্রাণের স্পন্দন রয়েও যায় তাহলেও শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ব্যথা তো লাগছে না সেভাবে! চোখটা খুলে উঠে বসার চেষ্টা করল তমসা। বসতে পারল, হাত পা ভাঙেনি। কিন্তু এটা কোথায় বসে আছে ও! তাকিয়েই প্রথমে আঁতকে উঠল তমসা। তারপর হড়হড় করে বমি করে ফেলল জায়গাটায়। জমাট বাঁধা মৃত মানুষের স্তূপের ওপর বসে একলা জীবিত মানুষ সে। এই মৃত মানুষগুলোর প্রত্যেকের শরীর বীভৎস ভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়ে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আছে, কারুর কারুর তো মাথাটাও নেই। হয়তো ওই জন্তুগুলোর যা খাওয়ার তা খেয়ে এদের ছুঁড়ে ফেলেছে এভাবে। হয়তো এদের জন্যই আজ তমসা প্রাণে বাঁচল, কিন্তু তাও একটা ভয় আর ঘেন্নার অনুভূতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল তাকে। ভীষণ কান্না পেয়ে গেল তমসার। কোথা থেকে কী হয়ে গেল এসব! কোনো মতে নিজের শরীরটাকে ওই মৃতের স্তূপ থেকে তুলে দাঁড় করালো সে। তার চুল, মুখ, পরনের নীল রঙের পেশেন্ট গাউন এখন বমি আর রক্তে মাখামাখি। কারুর শরীরের নালীও এসে লেপ্টে গেছে সঙ্গে। নিজের হাতগুলোর দিকে একবার তাকাল তমসা, ম্যানিকিওর করা হাত এখন চাপ চাপ রক্তের দাগে লাল, সবুজ নেলপলিশটার রং বোঝা দায়।

পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরীটা থেকে একটা হাড় হিম করা গর্জন ভেসে আসতেই চমকে উঠল তমসা। কোনো একটা জন্তু নিশ্চয় এদিকে আসছে। নাহ, এতো কষ্ট করে বেঁচে যাওয়া প্রাণটা এভাবে জন্তুটার হাতে তুলে দেওয়া যায় না। গায়ে হাত দিতে ঘেন্না লাগছিল, তাও সব ঘেন্না ভুলে দ্রুত হাতে গাউনটা হাঁটুর থেকে খানিক তুলে নিয়ে কোমরের কাছে বাঁধল তমসা। তারপর সামনের রাস্তার দিকে ছুট লাগাল সে। কোনো সময় পায়ে চোট লেগেছিল, ব্যথাটা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু তাও দাঁতে দাঁত চিপে ছুটতে থাকল সে। এতো বড় হসপিটাল চত্বর এই মুহূর্তে জনমানবহীন। হয়তো যারা পেরেছে আগেই পালিয়েছে, আর নয়তো তমসার মতো ভাগ্যের জোরে বিল্ডিংটা থেকে বেরোবার সুযোগ পায়নি তারা।

রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে হসপিটালের কম্পাউন্ড পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে এলো তমসা। কিন্তু বড় রাস্তায় পা রাখা মাত্রই হতভম্ব হয়ে গেল সে। ওই সাপের মত এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া ঝাঁ চকচকে রাস্তাটা তার ভীষণ অচেনা, শুধু তাই নয় রাস্তার ওপরের ওভার ব্রিজটা… যেন শূন্যে ঝুলে আছে। পাশাপাশি দুটো ভাগ, কী সুন্দর পরিপাটি করে গাড়িগুলো চলছে, কারুর সঙ্গে কারুর বিরোধ নেই, কোনো রেষারেষি নেই। এরকম সুন্দর রাস্তা কবে তৈরি হল আমাদের দেশে! ঠিক মনে পড়ল না তমসার। আবার গাড়িগুলোও কিন্তু চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মত, একদম স্লিম ছোট্ট সাইজ। কিছু বড় গাড়িও অবশ্য নজরে পড়ল। সেই হসপিটাল থেকে তমসার বারবার মনে হচ্ছে কিছু যেন একটা স্বাভাবিক নয়, জন্তুগুলোর দর্শন পাওয়া ছাড়াও কোথাও কিছু একটা যেন অন্যরকম কিন্তু কারণটা সে ঠিক ধরতে পারছিল না। রাস্তার ধারে ধপ করে বসে পড়ল তমসা। সে বোকাও নয়, অশিক্ষিতও নয়। রোজালিণ্ডের ডায়েরীর পাতার সেই লেখাগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল তমসার…

“…বক্সির ওপর সন্দেহটা অনেকদিন ধরেই হচ্ছিল, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া সরাসরি কোনো স্টেপ নেওয়ার কথা ভাবিনি। যখন আমার দলে মাত্র গুটিকয়েক সদস্য ছিল তখন থেকে বক্সি আমার সঙ্গী। আর তাছাড়া সেবার পুরুলিয়ার সেই পরিত্যক্ত বাড়ির রহস্য সন্ধান করতে গিয়ে কীভাবে ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল তাও ভুলি কী করে! কিন্তু বক্সির আসল উদ্দেশ্য যে এই ছিল তা কোনোদিনও ভাবিনি। দু দুটো মূল্যবান পুঁথি ও আমার আলমারি থেকে চুরি করে নিয়ে গেল! পুলিশকেও রিপোর্ট করতে পারছি না কারণ রিপোর্ট করলেই এত প্রাচীন পুঁথি আমার কাছে লুকিয়ে রাখার অপরাধে আমার উপরেই উল্টে কেস হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে এই জিনিস আমি পেলাম কোথায়! কিন্তু সে তথ্য তো আমি কাউকে বলতে পারব না।

বড্ড অস্থির লাগছে নিজেকে। আমি জানতাম বক্সি টাইম ট্রাভেল নিয়ে গবেষণা করছে। আর ওই পুঁথিতেও সেই বিষয়েই লেখা আছে অনেক কিছু। প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চা এত উন্নত ছিল যা হয়তো আমরা এখন কল্পনাও করতে পারি না। যে বা যিনি ওই পুঁথি লিখেছিলেন তিনি নিঃসন্দেহে প্রাচীন ভারতের একজন বড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন। দশাবতারের মিথকে তিনি নতুন আলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী নই, আমার বিষয় ইতিহাস ও দর্শন। তাই ওই পুঁথির অনেক অংশই আমার অধরা। যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবের জন্য ওই ভাষার সব সংকেতের পাঠোদ্ধার আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু বক্সি যেরকম মরিয়া তাতে ও যা খুশি করতে পারে। পুঁথি আমার কাছে বন্ধ হয়ে পড়েছিল, বক্সি যদি বিজ্ঞানের কাজে তাকে লাগায় তাহলে তারচেয়ে ভালো জিনিস হয় না। কিন্তু ইদানিং বক্সির চোখে লালসার যে আগুনটা আমি লক্ষ করেছিলাম তার জন্য ভীষণ ভয় করছে আমার। বক্সি যদি ঐ পুঁথির সংকেতকে খারাপ কাজে লাগায়! চিরটাকাল আমি অমীমাংসিত রহস্যের পেছনে ছুটেছি, রহস্যের প্রয়োজনে কালো জাদু, তন্ত্র এসব নিয়ে চর্চা করেছি; কিন্তু কোনোদিনও মানুষের ক্ষতি হবে এমন কোনো কাজ করিনি। আমার স্বপ্নের দল ‘দ্য মিস্টে’র শপথ হিসেবে তো এই প্রতিজ্ঞাই করতে হয়। কিন্তু বক্সি যদি সে শপথ ভেঙে পুঁথির তথ্যের অপব্যবহার করে তাহলে আমিও তো তার জন্য সমান দোষী হবো। সময়চক্রে পরিভ্রমণ কি আদৌ মানব সমাজের পক্ষে ভালো! আমার তো তা মনে হয় না। যা কিছু অতীতে চলে গেছে তা চলে যেতে দেওয়াই ভালো, যা কিছু আগামীতে আসছে তার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করাই ভালো… আমি তো এটুকুই বুঝি। সময়ের এই চক্রে হেরফের করলে যে অনেক বড় প্রলয় অবধি আসতে পারে। বক্সিকে কোথায় খুঁজবো জানি না। ওর কুশারীগঞ্জের বাড়িতে যোগাযোগ করেছিলাম, ও সেখানে যায়নি এখনও। তাহলে কোথায় গেল! কোথায় ও শুরু করতে চলেছে ওর এই গবেষণা!”

আলমারি… উত্তাপ… আলমারীর দেওয়ালে ফুটে ওঠা সেই চারটে সংখ্যা… উফফ…

দু’হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল তমসা। অধীর বক্সি কি তবে সত্যিই তার গবেষণায় সফল হয়েছিল! আর ওই আলমারিটাই… নাকি পুরোটাই একটা হ্যালুসিনেশন মাত্র!

“এই এত রক্ত মেখে বসে আছে কেন মেয়েটা?”

“ওকে তো আহত মনে হচ্ছে না! কাউকে খুন করল নাকি?”

“চল জলদি TECT কে খবর দিই।”

লোকদুটোর কথা কানে লাগতেই চমকে উঠল তমসা। পাশ ফিরতেই দেখতে পেল কিছুটা দূরেই লোকদুটো দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত দেখতে বাইক নিয়ে। ওদের মধ্যে একজন নিজের হাতে লাগানো একটা ব্যান্ডে সুইচ টেপার মত কীসব করল, আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যান্ডটার রংটা পাল্টে স্বচ্ছ হয়ে গেল। লোকদুটো কাকে খবর দেওয়ার কথা বলছে ঠিক বুঝতে পারল না তমসা, সে শুধু এটুকু বুঝলো তাকে এখন পালাতে হবে। কোনো মতে উঠে রাস্তার ধার বরাবর ছুট লাগল তমসা। কিন্তু লোকদুটো ওকে পালাতে দেখে বাইক স্টার্ট করে ওর পেছনে ধেয়ে এলো। তমসা বুঝলো এভাবে সোজা পথে পালাতে গেলে ধরা পড়ে যাবে। তাই সে এবার রাস্তায় উঠে রাস্তার মাঝ বরাবর এঁকে বেঁকে ছুট লাগাল। এতে কাজ হল, লোকদুটো বাইক নিয়ে এরকম রাস্তার মাঝামাঝি ছুটতে পারল না। কিন্তু রাস্তার অন্য গাড়িগুলো তমসাকে দেখে আচমকা ব্রেক কষতে বাধ্য হল, গালাগালি দিতে শুরু করল তারা। তবুও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই রাস্তার মাঝখান দিয়ে ছুটেছিল তমসা। কিন্তু আচমকা উল্টো দিক থেকে আসা একটা গাড়ি চটজলদি ব্রেক কষতে না পেরে ধাক্কা দিল তমসার গায়ে। ছিটকে পড়ল তমসা। ওর কানে এসে লাগল মানুষজনের চিৎকার…

“এ তো হসপিটালের ড্রেস পরে আছে। এভাবে ছুটছিল কেন?”

“কোনো ক্রাইম করেনি তো? এত রক্ত…”

“কী নোংরা! দেখেই ঘেন্না লাগছে।”

“এক্ষুণি TECT কে খবর দাও।”

“আমরা অলরেডি দিয়ে দিয়েছি। এ মেয়েটা মনে হয় কাউকে খুন করে পালাচ্ছিল।”

শেষ গলাটা চিনতে পারল তমসা, সেই লোকদুটোর একটা। তমসা বুঝলো এখান থেকে আর মুক্তি নেই, হাঁটাচলার শক্তি হারিয়েছে সে। কিন্তু আচমকাই একটা বাইক এসে দাঁড়াল তার কাছে, আর তমসা অর্ধ তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আশ্চর্য হয়ে দেখলো হেলমেট পরা বাইক আরোহী বাইকে বসা অবস্থাতেই এক হাতে তাকে প্রায় শূন্যে তুলে বসিয়ে দিল বাইকে।

১১

শিশুটার শরীরে পরম যত্নে হাত বোলাচ্ছিল লোকটা। প্রত্যেকবার শিশুটার শরীর স্পর্শ করার সময় লোকটার মুখটা অদ্ভুত মমতায় ভরে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন এ স্পর্শ শুধু শারীরিক স্পর্শ নয়, প্রত্যেক স্পর্শে ওই শিশুটির সঙ্গে লোকটার একটা আত্মিক সংযোগ ঘটেছিল…

“স্যার আসবো?”

“আসবে? এসো।” বিরস মুখে বলল লোকটা।

যে এসেছিল সে ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, “টাউন হসপিটাল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে স্যার। এর পরবর্তী ডেস্টিনেশন?”

“আপাতত পনেরো দিন ওরা বিশ্রাম নিক, আমার চিন্তা শুধু এই শিশুটিকে নিয়ে। ওর খাবার এনেছো?”

“হ্যাঁ স্যার। ডাইনিং টেবিলে রাখা আছে। ঘুম থেকে উঠলেই খাইয়ে দেব।”

“নাহ রবি, আজ ওকে আমি নিজের হাতে খাওয়াবো।”

“আচ্ছা, স্যার। স্যার, আরেকটা কথা ছিল।”

“বলো।”

“আমি আপনার অনুমতি ছাড়াই একটা কাজ করে ফেলেছি।”

“কী কাজ?”

“ওর জন্য ফ্রেশ হিউম্যান ব্লাডের ব্যবস্থা।”

“হোয়াট? কীভাবে?”

***

বিশেষ সংবাদ: দেশে আবার রহস্যজনক ভাবে চুরি। মাত্র কিছুক্ষণ আগেই খোদ ন্যাশনাল মিউজিয়াম থেকে একটি বহু মূল্যবান রুবি চুরি গেছে। চোরকে সনাক্ত করা যায়নি। মিউজিয়াম সূত্রের খবর চোরের UIC-এর কোনো ট্রেস পাওয়া যায়নি।

“হুইই! আবার এরকম চুরি! কী টেকনোলজি ব্যবহার করছে যে UIC অবধি মিলছে না! কীভাবে সম্ভব!” কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে নিজের কানের লতি ধরে টানল কে।

“আইন থাকলে আইনের ফাঁকও থাকবে, শুধু খুঁজে বের করলেই হল।” নিচু স্বরে কথাগুলো বললেন অর্শিয়া সেন। তারপর গলাটা একটু চড়িয়ে নিয়ে কে এর দিকে তাকিয়ে বলল, “কথা ছিল বাকি দুটোকে আনলে পুরো টাকা। কিন্তু এটা তো একটা।”

“সেটা তো হসপিটালে ছিল কিন্তু… মনে হয় মরে গেছে।”

“নাহ। তোমার কী হচ্ছে কে? আগে তো জানতাম শহরের অলিগলির সব খবর তোমার কাছে থাকে কিন্তু আজকাল তো সেরকমটা মনে হচ্ছে না।”

“কী বলতে চাইছেন কী? আপনি কি করে জানলেন সে বেঁচে আছে?”

“খোঁজ নিয়ে দেখো সে হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে আর তাকে পাবলিকের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে একটা বাইক। অনেক তথ্য দিয়ে দিলাম। বারো ঘন্টার মধ্যে খুঁজে আনো। আমার মেয়েটাকে চাই। যত বেশি স্যাম্পেল তত বেশি… যাও যাও সময় নষ্ট কোরো না।”

অর্শিয়া সেনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল কে।

কে বেরিয়ে যেতে না যেতেই একটা শব্দ শুনে পেছন ঘুরে তাকালেন অর্শিয়া সেন। দেখলেন ছেলেটা উল্টে পড়ল সোফায়। মুখ থেকে একটা হতাশাসূচক শব্দ বের করলেন অর্শিয়া। স্যামুয়েল, এই স্যাম্পেলটা স্পাইডি গ্যাং এর কাছ থেকে আমদানি করা। অর্শিয়া ভেবেছিলেন তাঁর এক্সপেরিমেন্ট প্রায় সফল, মানুষের ওপর প্রয়োগ করলে সাফল্য মিলবেই। কিন্তু কার ওপর প্রয়োগ করবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছিলেন না। সরকার তো এমন এক্সপেরিমেন্টের জন্য মানুষকে ব্যবহার করার অনুমতি দেবে না, তার ওপর তার পুরো গবেষনাটাই তো চলেছে গোপনে। এদিকে কাউকে যদি ধরে এক্সপেরিমেন্ট করেনও, কিছু গণ্ডগোল হলে সরকার ইউনিক আইডেন্টিটি কোডের মাধ্যমে লোকটাকে খোঁজা শুরু করলে মুশকিল হত। এমন সময় মুশকিল আসান হিসেবে ভ্যাংকার্স স্পাইডিরা এই ছেলেটাকে এনে দেয় যার কোনো ইউনিক আইডেন্টিটি কোড বা UIC-ই নেই। তার মানে এক্সপেরিমেন্ট সফল হোক বা ব্যর্থ সরকারের একে খোঁজার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ছেলেটার ওপর এক্সপেরিমেন্টটা সফল হয়নি পুরোপুরি, মাঝে মাঝে ওর ব্রেনের ফাংশান বন্ধ হয়ে যায়। ওকে দেখে আরও কিছু ইম্প্রুভমেন্ট করেছেন অর্শিয়া কিন্তু আবার টেস্ট করার লোক খুঁজছিলেন। পেয়েও গেলেন এই স্যামুয়েলের মতোই স্যাম্পেল তিনটে। আরেকটাকেও আশা করা যায় শিগগিরই পাওয়া যাবে। এই শহরে কে-এর অসাধ্য বলে কিছু নেই।

***

“ঘুম ভাঙলো প্রিটি লেডি?”

বিছানায় ধড়ফড় করে উঠে বসল তমসা। দেখল এক বৃদ্ধ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। বুকটা কেন না জানি অকারণেই ধক করে উঠল তমসার। কোনো জবাব দিতে পারল না সে। বৃদ্ধই আবার বললেন, “যাও তোমার ড্রেসটা চেঞ্জ করে নাও, এসব রক্ত টক্ত আমার ভালো লাগে না।”

“আ… আমি কোথায়?”

“আপাতত আমার বাড়িতে। আমার রোবট রবি তোমাকে এনেছে এখানে। যদিও এই রোবটদের নিজের বুদ্ধি খাটানো আমি পছন্দ করি না, তাও ঠিক আছে। মাঝেসাঝে মেনে নিতে হয় বৈকি। ওহ আমি একটু বেশিই বকছি তাই না? যাও যাও ড্রেসটা চেঞ্জ করে নাও, প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।”

নাক সিঁটিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে আঙুলের ইশারায় বিছানার একপাশে রাখা পোশাকগুলো দেখালেন বৃদ্ধ।

তমসা ওর ব্যথা শরীরটাকে নিয়ে উঠে গেল বাথরুমে। বাথরুমের স্ট্যান্ড থেকে একটা দুধ সাদা তোয়ালে ঝুলছিল লম্বা হয়ে। তমসা আস্তে আস্তে ওর শরীর থেকে রোগীর পোশাকটা খুলে তোয়ালেটা জড়িয়ে নিল গায়ে। আধুনিক ঝাঁ চকচকে বাথরুম। এত বড় বাথরুম তমসা আগে কখনও দেখেনি। তবে বাথরুমের কোথাও কোনো ট্যাপ দেখতে পেলো না তমসা, শুধু একপাশে একটা সাদা রঙের বেশ বড় বাথটাব দেখা যাচ্ছে। নিজের এই রক্ত, ধুলো কাদা মাখা শরীরটা নিয়ে অমন সুন্দর বাথটাবে যেতে ইচ্ছে করল না তার। আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে ভালো করে তাকাতেই নজর পড়ল জিনিসটা, অনেকটা সুইচ বোর্ডের মত দেখতে একটা বোর্ড লাগানো দেয়ালের গায়ে। সেই বোর্ডে বেশ কয়েকটা সুইচ। কোনোটার ওপর ট্যাপের ছবি আঁকা, কোনটায় শাওয়ার, কোনটায় আবার গরম বাষ্পের ছবি। অনেকগুলো সুইচের ওপর আঁকা চিহ্ন তো ঠিক করে বুঝতেও পারল না তমসা। সে তার কাঁপতে থাকা হাতটা তুলে শাওয়ারের চিহ্ন আঁকা সুইচটায় চাপ দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমের চার দেওয়াল থাকা অসংখ্য সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ম ছিদ্র থেকে ফোয়ারার মত জলের স্রোত এসে ভিজিয়ে দিতে লাগল তার সারা শরীর। অনেকক্ষণ পর জলের স্পর্শ পেয়ে শরীরে বেশ আরাম লাগল তমসার। দু’হাত দিয়ে শরীরের ওপর জমে থাকা সমস্ত নোংরা ধুয়ে ফেলতে চাইল সে। তমসার ইচ্ছে করছিল ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে এই ঠান্ডা জলের তলায়, কিন্তু সে সুযোগ আর হল না। মিনিট পাঁচেক কাটতে না কাটতেই আচমকা শাওয়ারের জলটা বন্ধ হয়ে গেল। চমকে উঠে তমসা সুইচটায় আবার চাপ দিল কিন্তু কোনো লাভ হল না। হতাশ হয়ে নতুন পোশাক পরে বাইরে বেরিয়ে এলো তমসা। এই টাইট পোশাকে অস্বস্তি হচ্ছিল তার। বাইরে বেরোতেই সে মুখোমুখি হল বৃদ্ধের। বৃদ্ধ হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “শাওয়ার নিয়ে ভালো লাগছে?”

তমসা একটা ঢোঁক গিলে জবাব দিল, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনার মনে হয় ট্যাঙ্কের জল শেষ।”

তমসার কথা শুনে খুকখুক করে হাসলেন বৃদ্ধ, “তোমাদের মত ইয়ং জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের জন্যই এই ব্যবস্থা। আমাদের সময় মানুষ যা ভুল করেছে তোমাদের সময়ও তাই করছে। আর সরকারও এই ব্যাপারে উদাসীন। আরে বাবা শুধু পানীয় জল নিয়ে ভাবলে চলবে নাকি, বাকি জলের সঞ্চয়ের দিকেও তো নজর রাখতে হবে তো নাকি! আহ আমি আবার অতিরিক্ত বকে ফেলছি তাই না? কিছু খাবে তুমি?”

“এক গ্লাস জল।”

“জল…! সরি লেডি, এক গ্লাস জল সম্ভব না, হাফ গ্লাস দিচ্ছি নাও। তোমার আজকের জলের কোটা কি নেওয়া হয় গেছে?”

“মানে? জলের কোটা বলতে?”

“দেখো ইয়ং লেডি আমি সাফ কথার মানুষ, আমার দু লিটার জলের পুরোটাই আমার লাগে তাই কাউকে শেয়ার দিতে পারব না আমি। যদি তোমার আজকের জল না নেওয়া হয় থাকে তাহলে রবিকে বলে অর্ডার দিয়ে আনিয়ে নাও।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল তমসা। উনিশ কুড়ি সাল থেকেই যেভাবে জলের সংকট দেখা যাচ্ছিল তাতে করে পঁচাত্তরে এসে যে যেভাবে সরকারকে মাথা পিছু জল নির্দিষ্ট করে দিতে হবে এ আর আশ্চর্যের কী!

“কী হল, কী ভাবছো? তোমার ব্যান্ড কোথায়?” তমসাকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ। তমসা অবাক হয়ে বলল, “ব্যান্ড!”

বৃদ্ধ ইশারায় নিজের কব্জির কাছটা দেখালেন। তমসা দেখল একটা কালো রঙের রাবার ব্যান্ডের মত জিনিস। এই জিনিসটার মহিমা সে আগেই দেখেছে। তার মানে এই সময় এই ব্যান্ডের মত জিনিসটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

“স্যার পিচকুর খিদে পেয়েছে।” বাইরে থেকে কেউ যেন ডাকল বৃদ্ধকে। আর ডাকটা শোনা মাত্রই বৃদ্ধ তড়িঘড়ি বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তমসা ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো তাঁর পেছন পেছন। বাইরে এসেই আঁতকে উঠল তমসা। দেখল বৃদ্ধের কোলে একটা প্রকান্ড সাইজের চড়ুই পাখি। হ্যাঁ, পাখিটা যে চড়ুই এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তার সাইজ প্রায় একটা হৃষ্টপুষ্ট বেড়ালের মত। কুতকুতে চোখে সে তাকিয়ে আছে তমসার দিকে। গলাটা যেন আরও বেশি করে শুকিয়ে এলো তমসার। চড়ুই পাখির মত একটা মিষ্টি পাখিরও যে এমন ভয়ংকর রূপ হতে পারে কে জানতো আগে!

বৃদ্ধ তমসার দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, “ভয় পেয়েছো?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলে উঠলেন, “শুনে খুব খুশি হলাম। এতদিন ওরা নিরীহ বলে ওদের ওপর যা নয় তাই করে অত্যাচার করেছো, ওদের অস্তিত্ব মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছো, এখন দেখো ওরাও চাইলে তোমাদের ভয় দেখাতে পারে।”

“ও… ওটা এতো বড় কেন?” কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইল তমসা। বৃদ্ধ মুখটা বিকৃত করে বললেন, “বড়! কী বলছো কী? ও তো এখনও শিশু। আমার পিচকু সোনা, আমার পরিবারের ক্ষুদে সদস্য।”

“এটা কি সত্যিই চড়ুই?”

“কোনো সন্দেহ আছে?”

“ওর চেহারা…”

“ছোটো হলে তোমাদের খুব ভালো হত না? কিন্তু সে ভালো যে আমি আর হতে দিতে পারি না। এখন ওদের ভালো হওয়ার সময়।”

“ম… মানে?”

“২০৫৭… জানো কী হয়েছিল? মনে রেখেছো আদৌ?”

“ক্ক… কী হয়েছিল?”

“দেখছো তো… একটা প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দিয়েও কোনো অনুশোচনা নেই তোমাদের। আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন আমার বাড়ির পাশে একটা তালগাছ ছিল, মস্ত বড়। কোনোদিনও দেখেছো তালগাছ? দেখোনি না? দেখলে জানতে পারতে তালগাছ থেকে যখন বাবুই পাখির বাসা ঝোলে কী অপূর্ব লাগতো দেখতে। কিন্তু এই তোমাদের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য ২০৫৭-তে বাবুই পাখি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

ছোটবেলায় আমার একটা খরগোশ ছিল, আমার খেলার সাথী। খরগোশের মত মিষ্টি একটা প্রাণীকেও কেউ বাঁচতে দিল না… ২০৭০… শেষ। বাঘ সিংহের নাম শুনেছো খুকি? জানো জঙ্গলের রাজা কাকে বলে? আচ্ছা জঙ্গল কাকে বলে সেটা জানা আছে তো? কী জবাব দেবে? ওই ন্যাড়া অ্যামাজনকে জঙ্গল বলবে! হাঃ হাঃ হাঃ…”

“২০১৯ সালের শেষের দিকে অ্যামাজনে আগুন লেগে অনেক ক্ষতি হয়েছিল। তারপরেও কি….”

“কী বললে আগুন? হাঃ হাঃ হাঃ গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো এখন জ্বলছে। অর্থের খুব অহংকার ছিল ওদের, ভাবত অর্থ দিয়ে সব কেনা যায়। দিনের পর দিন বিষাক্ত গ্যাসের চাষ করে গেছে। এখন দেখো কেমন লাগে…”

“স্যার পিচকুর খাবার।” বৃদ্ধের কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা লোক একটা বড় বাটি নিয়ে ঢুকল ঘরে। তমসার মনে হল লোকটার হাঁটা চলা কেমন যেন অন্যরকম।

বৃদ্ধ আর কথা না বাড়িয়ে তাঁর চড়ুইকে নিয়ে বসে পড়লেন একটা সোফায়। বৃদ্ধের ভৃত্য বাটিটা বাড়িয়ে ধরলেন তাঁর দিকে। তমসা দেখল বাটির মধ্যে একটা কালচে লাল রঙের তরল উঁকি দিচ্ছে, তরলটা থেকে একটা আঁশটে গন্ধ এসে ঝাপটা মারল তমসার নাকে। চমকে উঠল তমসা, “এটা কী জিনিস?”

“মুরগির রক্ত।” ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিল ভৃত্যটি।

“কী!”

“আঁতকে ওঠার কী আছে? ওকে সুস্থ থাকতে হলে রক্ত তো পান করতেই হবে। আমি এমনভাবে ওর শরীরের ভেতরের অর্গানগুলোকে জেনারেট করেছি যে যেকোনো প্রাণীর রক্তেই সমানভাবে উজ্জীবিত হবে তারা। কিন্তু আমার একদম ভালো লাগে না ওই নিরীহ প্রাণীগুলোকে হত্যা করা। তোমরা তো চিকেন খাওয়া ছাড়তে পারবে না, তাই দোকানগুলোর রমরমিয়ে ছাগল, মুরগি কাটা চলে। আর আমাকেও পিচকুর মুখ চেয়ে বাধ্য হয়ে রক্ত সংগ্রহ করতে হয় সেখান থেকে। অবশ্য পিচকু বড় হয়ে গেলে ও নিজেই নিজের খাবার সংগ্রহ করতে পারবে। তখন আর কোনো নিরীহ প্রাণীর রক্তের দরকার পড়বে না, পিচকু তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণীদের শিকার করবে। হাঃ হাঃ হাঃ…”

“সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী বলতে?” জানতে চাইল তমসা।

বৃদ্ধ সোজা তাকালেন ওর চোখে, তারপর অদ্ভুত স্বরে বললেন, “তোমার চেয়েও বিপজ্জনক কেউ আছে নাকি!”

গোটা শরীরটা কেঁপে উঠল তমসার। ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়ল সে।

১২

“এতো উত্তেজিত হচ্ছ কেন অর্শিয়া?”

“কেন হবো না বলতে পারো? ওই বুড়ো দানিশ রাও আমাকে…”

“কাম ডাউন, প্লিজ। ওই বুড়োর কথা ভেবে মাথা খারাপ করার কোনো মানেই হয় না। তোমার জন্য আমি কত ঝুঁকি নিয়ে রুবিটা উদ্ধার করে আনলাম বলোতো, এবার তুমি কাজ না শুরু করে ওই বুড়োটার ওপর রাগ দেখাচ্ছ!”

“কাজ শুরু করার জন্য স্যাম্পেল চাই।”

“চারটে তো আছেই। আর কটা চাই?”

“বাচ্চাটার কথা বাদ দাও, ওকে স্পেশ্যাল কেসে ব্যবহার করব। কিন্তু…”

“তুমি স্যাম্পেলের কথা ভাবছো আর আমাকে যে পুলিশ খুঁজছে, আমার কী হবে ভাবছো না তো একবারও।” আদুরে গলায় বলল লোকটা। অর্শিয়া আড় চোখে লোকটার দিকে তাকাল। তার থেকে প্রায় একশো বছরের বড় এই বুড়োটা তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। অর্শিয়া জানে সে সুন্দরী, মাত্র একঝলক তাকিয়েই বহুলোক তার প্রেমে পড়ে যায়, আর এই প্রেমিকদের নিজের সুবিধার জন্য পুরোদস্তুর ব্যবহার করতে জানে অর্শিয়া। এই লোকটাও ব্যতিক্রম নয়। যদিও এই সময়ে এসে ওর বয়েস বাড়েনি তবুও আদপে তো বুড়োই। অর্শিয়া এতো বছর ধরে লোকটাকে এমনি এমনি পুষছে না। লোকটা তাকে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে সাহায্য করছে। এক তো লোকটার এই সময়ে আদপে কোনো অস্তিত্ব নেই বলে গবেষণার প্রয়োজনে যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজে লোকটাকে ব্যবহার করা যায়, আর অন্যদিকে সবচেয়ে বড় ব্যাপার তো হল লোকটা টাইম ট্রাভেল করে এসেছে। লোকটার এক্সপেরিমেন্ট হয়তো সফল হয়েছিল কিন্তু অনেক কিছুই তখনও টেস্ট করা বাকি ছিল। অর্শিয়া এখন টাকা ঢালছে ওর পেছনে, লোকটার এক্সপেরিমেন্ট নতুন করে করার জন্যও সব ব্যবস্থা করেছে। একবার ওর গবেষণা সফল হলেও অর্শিয়া সময়ের চাকাকে উল্টো পথে ঘোরাবে। ঠিক করে দেবে অতীতের সব গন্ডগোল।

“কী হল কিছু বলছো না যে?” অর্শিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল অধীর বক্সি। অর্শিয়া মাথাটা নাড়ল শুধু। বক্সি এবার বিরক্ত হল, “কী?”

“আমার ওই স্যাম্পেলটা চাই, বাই হুক অর বাই ক্রুক।”

“কিন্তু…”

“ওই মেয়েটা যদি দানিশ রাও ছাড়া আর কারুর কাছে থাকত আমি ছেড়ে দিতাম কিন্তু দানিশ রাওয়ের কাছে আমি হেরে যেতে পারি না। কিছুতেই না…” উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বলল অর্শিয়া।

“তোমার ঐ দানিশ রাওয়ের ওপর এতো রাগ কেন?” কথাগুলো বলতে বলতে অর্শিয়ার কাঁধে হাত দিতে গেল বক্সি, কিন্তু অর্শিয়া সরে গেল। কোনো জবাব না দিয়েই নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল সজোরে।

***

“ভেতরে আসবো স্যার?”

আচমকা গলাটা শুনে মুখ তুলে তাকালেন দানিশ রাও। সামনেই একজন মধ্য তিরিশের যুবক দাঁড়িয়ে। একটু আগেই ন্যাশনাল সায়েন্স এসোসিয়েশনের বড় বড় কর্মকর্তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শেষ হয়েছে। দানিশ রাও-ও ছিলেন ওই মিটিং এ। এই মুহূর্তে তিনি মিটিং নিয়েই চিন্তা করছিলেন, তাই এই আগন্তুকের আগমনে যথেষ্ট বিরক্ত হলেন।

“কী ব্যাপার?”

“স্যার আমার এপয়েন্টমেন্ট ছিল।”

“কী নাম?”

“সৌনাভ সেন।”

দানিশ রাও একবার ঝুঁকে পড়ে নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরীটা চেক করে নিলেন। সত্যি কথা বলছে লোকটা।

“পাঁচ মিনিটে ফিনিশ করবেন।”

“কিন্তু স্যার আমার কথাটা পাঁচ মিনিটে বলতে গেলে ঠিকমতো…”

“আমি আমার টাইম বলে দিলাম, এর মধ্যে বলতে পারলে বলুন আর নয়তো চলে যান।”

“না না স্যার, আমি বলছি।”

একটা ঢোঁক গিলল লোকটা। একমুখ দাড়ির মাঝেও লোকটার নার্ভাসনেস দানিশ রাওয়ের নজর এড়ালো না। লোকটা একটু ইতস্তত করে সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়ল, “স্যার হিউম্যান ব্রেন হচ্ছে আমার গবেষণার ক্ষেত্র। আমদের মানব মস্তিষ্কে কোনো কারণে গোলযোগ দেখা দিলে আমরা যেমন অপারেশ করে সান বা অন্য কোনো যন্ত্র বসিয়ে মস্তিস্কের ফাংশন পুনরায় ঠিক করে দিই তেমনই আমি এমন একটা টেকনোলজি আবিষ্কারের চেষ্টা করছি যাতে করে জড় বুদ্ধি বা স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো বাচ্চা জন্ম নিলে তার ব্রেনের অপারেশন করে আমরা যাতে তাকে স্বাভাবিক বুদ্ধি সম্পন্ন করে তুলতে পারি। আর এই জন্য স্যার আপনার…”

“টাইমস আপ।” জোর গলায় হাঁকিয়ে দিলেন দানিশ রাও। থতমত খেয়ে গেল সামনে বসা লোকটা, “কিন্তু স্যার…”

“নাও ইউ ক্যান লিভ।”

***

সপ্তাহখানেক পরের কথা। দানিশ রাও আরাম করে রকিং চেয়ারে বসে নিজের প্রিয় পোষ্যকে নিয়ে মেতে ছিলেন। এমন সময় তাঁর পি.এ এসে জানালো একটি লোক তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থী। নাম বলেছে সৌনাভ সেন। নামটা শুনেই দানিশ রাওয়ের ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হল, নামটা শোনা শোনা ঠেকলেও কোথায় শুনেছেন ঠিক মনে করতে পারলেন না। উঠে এসে বৈঠকখানার সিসিটিভি ফুটেজটা দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল তাঁর, “আমার পারমিশন না নিয়ে যাকে তাকে ঘরের ভেতর ঢোকাস কোন সাহসে?” চিৎকার করে উঠলেন দানিশ রাও। এ বাড়িতে তাঁর মেজাজকে ভয় পায় না এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। পি.এ ছেলেটা আমতা আমতা করে বলল, “ও যে এসে আপনাদের এসোসিয়েশনের ভিজিটার্স কার্ড দেখালো!”

“হোয়াট!”

ভারী পায়ে বৈঠকখানার দরজায় এসে রুক্ষ গলায় দানিশ রাও বলে উঠলেন, “তুমি?”

গলা শুনে দরজার দিকে ঘুরে তাকাল সৌনাভ সেন, আগেরদিনের নার্ভাস ভাবটা আজ আর নেই। দানিশ রাওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে কর্মরদনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল সে। দানিশ রাও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই বললেন, “আমাদের এসোসিয়েশনের ভিজিটার্স কার্ড পেলে কোথায়?”

“আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে। উনি এসোসিয়েশনের একজন মেম্বার, নাম তড়িৎ সেন।”

“তড়িৎ সেন…!” বিড়বিড় করতে করতে দানিশ রাও জিজ্ঞেস করলেন, “রোবটিক্স নিয়ে কাজ করছে যে?”

“হ্যাঁ স্যার। চেনেন ওনাকে?”

“দেখেছি কয়েকবার। বাট তুমি এখানে কেন?”

“স্যার সেদিন আপনি ব্যস্ত ছিলেন বলে কথা হয়নি ঠিক করে, তাই আজ আপনার বাড়িতে এলাম।”

“আজ আমার অফ ডে।”

“জানি স্যার, তাও এলাম কারণ আমার বিশ্বাস আমার পুরো প্রস্তাবটা শুনলে আপনি আগ্রহী হবেন।”

“তাই নাকি?”

“একদম স্যার। আমরা কি বসে আলোচনা করতে পারি?”

অনিচ্ছুক পায়ে এগিয়ে এসে সামনের সোফায় বসলেন দানিশ রাও। সত্যি বলতে এই সৌনাভ সেন যে বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাইছে তাতে করে ওকে সাহায্য করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাঁর নেই। কিন্তু এসোসিয়েশনের একজন সদস্যের মাধ্যমে এসেছে যখন তখন কথা না বলে বিদায় করাটা ভালো দেখায় না তাই বসলেন দানিশ রাও। সৌনাভ প্রবল আগ্রহে বলতে শুরু করল, “স্যার আগেরদিন তো আমি আপনাকে বলেইছিলাম আমি কী নিয়ে কাজ করছি। এবার আমার প্রপোজাল হল আমার টেকনোলজিটা মেডিক্যাল সায়েন্সে ব্যবহার করে নাহয় একজন মানুষের মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটলাম। কিন্তু এর পর কী হবে? অর্থাৎ ওর নেক্সট জেনারেশনের মধ্যে যাতে আবার এই ত্রুটিটা না প্রকট হয়ে উঠতে পারে সেই বিষয়টা সুনিশ্চিত করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি বুদ্ধির ক্ষেত্রে একটা জেনেটিক ফ্যাক্টর কাজ করে, আমরা যদি এই জিনটার মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারি তাহলে স্যার পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধির নিরাপত্তাও সুনিশ্চিত হবে। আর এই জন্যই আমার আপনার সাহায্য চাই, আমরা যৌথ ভাবে…”

“বেনিফিট?”

“সরি স্যার?”

“মানুষের বুদ্ধি আরও উন্নত করে লাভটা কী?”

“না স্যার, ব্যাপারটা আরও উন্নত করার নয়। যারা জড় বুদ্ধিসম্পন্ন বা যাদের খুব কম বুদ্ধি তাদের ভালোর জন্য।”

“আমার তো মনে হয় যারা কম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তারাই বরং এই পরিবেশের জন্য নিরাপদ। তাদের বুদ্ধি বাড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি করার কোনো অর্থ হয় না।”

এই প্রৌঢ় বিজ্ঞানীর দিকে খানিক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল সৌনাভ। লোকটা বলতে কী চাইছে!

“স্যার ব্যাপারটা তো অন্যভাবেও ভাবা যেতে পারে। যার বুদ্ধি কম সে পরিবেশের ভালো মন্দ বুঝবে কী করে? পরিবেশ তো দূরের কথা সে তো নিজের ভালো মন্দই বুঝতে পারে না।”

“নিজের… নিজের… নিজের… তোমরা নিজেরটুকু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারো না তাই না? মানুষ হয়েছো বলে খুব অহংকার। মানুষের উন্নতি সাধনের চেষ্টা করছি...আহ কী মহান চিন্তা!” দানিশ রাওয়ের গলায় শ্লেষ, “মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে আর কারা বাস করে জানা আছে? কখনও ভেবে দেখেছো তাদের কথা?”

“স্যার আপনি এতো উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কেন? আমি তো শুধু…”

“গো টু হেল ইউ এন্ড ইয়োর রিসার্চ।”

“স্যার আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনি আমার প্রস্তাবে রাজি নন ঠিক আছে কিন্তু আপনি এরকম ব্যবহার কেন করছেন?” বরাবরের শান্ত সৌনাভ এবার উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

দানিশ রাও আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, “কী বললে, পারি না? আমি কী পারি আর না পারি তোমাকে দেখিয়ে ছাড়ব সেটা। নাও গেট লস্ট।”

***

ডায়েরীটা বন্ধ করে একটা জোরে নিশ্বাস ফেলল অর্শিয়া। এই শহরে রাফ এন্ড টাফ অর্শিয়া সেনের ইতিহাস কেউ জানেনা। অনেকেই তাকে উড়ে এসে জুড়ে বসা পাখি বলে আখ্যা দেয়, অনেক বলে বিউটি উইদাউট ব্রেন। অবশ্য তাদেরও দোষ নেই। জনসমক্ষে অর্শিয়া তার গবেষণায় কতটুকুই বা সাফল্য পেয়েছে, রোবটিক্সের ওপর এতো দিন কাজ করেও তার উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান নেই জনসমক্ষে। রোবটিক্স… এই বিষয়টাই তো অর্শিয়ার নিজের ছিল, বাবার সঙ্গে বাবার ল্যাবে কাজ করত সে। আর ‘হিউরোব’ নিয়ে এই শহরে বসে গবেষণা করত তো সেই লোকটা। অনেক স্বপ্ন দেখত লোকটা, বলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ওপর অধিক নির্ভরতা নাকি ভবিষ্যতে খুব বড় বিপদ ডেকে আনবে। তাই তো লোকটা চেয়েছিল মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে আধুনিক রোবটিক্সের কিছু ফর্মুলা ব্যবহার করে আরও উন্নততর মানুষ তৈরি করতে। শুধু তাই নয় তার স্বপ্ন ছিল পৃথিবীকে জড়বুদ্ধি মুক্ত করে তোলা। লোকটা সবসময় মানুষকে নিয়ে ভাবত। লোকটা বিজ্ঞানী হয়েও স্বপ্ন দেখত। নিজের গবেষণার কাজে সাহায্য নেওয়ার জন্য লোকটা গিয়েছিল জেনেটিক্স নিয়ে গবেষণারত বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক দানিশ রাওয়ের কাছে। কিন্তু ওই বুড়ো দানিশ রাও সাহায্যের বদলে কেন কে জানে কী এমন কলকাঠি নাড়ল যে ন্যাশনাল সায়েন্স এসোসিয়েশন লোকটার বিরুদ্ধে তেতে গেল। স্বপ্ন দেখা লোকটা মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে ফেলল একদিন। শেষ দিকে তো লোকটা ভালো করে কথা অবধি বলতো না অর্শিয়া বা অন্য কারুর সঙ্গে। অর্শিয়া কল করে অপেক্ষাই করে যেত। লোকটা নিজেকে শেষ করে দেওয়ার আগে অর্শিয়ার জন্য একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল, সেই মেসেজে লোকটা শুধু একটা শব্দই বলেছিল, ‘চক্রান্ত’।

অধীর বক্সির কাছ থেকে অর্শিয়া গল্প শুনেছে তাদের সময়ের, যখন মানুষ সংসার, পরিবার, ভালোবাসা এসবকে নিজের থেকেও বেশি মূল্য দিত। কিন্তু অর্শিয়াদের সময় তো এমনটা হয় না। সবাই তো নিজের নিজের ভালো থাকাটুকু খুঁজে নিতে ব্যস্ত থাকে। অর্শিয়ার বন্ধু বান্ধবীরা তো ঘনঘন পার্টনার পাল্টে ফেলে সুখের জন্য। তবুও অর্শিয়া কেন আজ অবধি পারল না অন্য কাউকে নিজের জীবনে ঠাঁই দিতে! কেন ওই লোকটা মরার পরেই অর্শিয়া বাবার ল্যাব, নিজের রিসার্চ সব ছেড়ে এই শহরে চলে এসেছিল ছুটে! রাতের পর রাত জেগে লোকটার সব খাতা পত্র, ডায়েরী সব পড়েছিল, তারপর লোকটার অসম্পূর্ণ রেখে যাওয়া কাজের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল! কিন্তু লোকটা তার গবেষণা চালিয়ে যেতে চেয়েছিল মানুষের কল্যাণের জন্য, কিন্তু বিনিময়ে কি পেল! অপমান, লাঞ্ছনা, মৃত্যু… অর্শিয়া তার এই ত্যাগ বিফলে যেতে দেবে না বলে স্থির করেছিল। তবে কি অর্শিয়া ওর সময়ের থেকে আজও পিছিয়ে! আজও সে অনুভূতি মুক্ত আত্মসুখের সন্ধানী হতে পারল না! অবশ্য এও তো এক আত্মসুখের সন্ধানই। লোকটার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়াই এখন অর্শিয়ার একমাত্র লক্ষ্য, ওর একমাত্র সুখ।

১৩

“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

“সে কৈফিয়ত কি তোমাকে দেব নাকি?”

“আলবাত দেবে, দিনের পর দিন তোমার এই স্বেচ্ছাচারিতা চলতে পারে না।”

“কেন? তুমি যা খুশি করতে পারো আর আমি পারি না?”

“বাবা বাবা দেখবে এসো না টুইস্টি কেমন করছে….!!!” রাও দম্পতির ঝগড়ার মাঝেই পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা তীক্ষ্ণ চিৎকার বাড়িটাকে আরও অশান্ত করে তুলল। দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন মি.রাও, “এই যে… এই যে আরেক ঝামেলা! মাঝেমাঝে সন্দেহ হয় যে এটা আদৌ আমার ছেলে তো নাকি তোমার পরকীয়ার ফসল!”

“ওহ প্লিজ তোমার ছেলে না হয়ে ও যাবে কোথায়? ওর ওই মোটা মাথাই তো প্রমাণ করে ও তোমার ছেলে।”

“ইউ…”

“বাবা মা তাড়াতাড়ি এসো।” পাশের ঘর থেকে আবার চিৎকার ভেসে এলো।

বিরক্ত মিসেস রাও হাঁক পাড়লেন গভর্নেসকে, “ন্যান্সি… ন্যান্সি হোয়ার আর ইউ?

উফফ আবার ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে।”

“বাবা মা…”

“উফফ অসহ্য!” গুমগুম করে পাশের ঘরে এলেন মি. রাও। দেখলেন তাঁদের একমাত্র সন্তান ডিংকো তার প্রিয় পোষ্য বেড়ালটিকে আগলাতে ব্যস্ত। বিড়ালটিকে দেখলেই বোঝা যায় তার শরীরে কিছু একটা অস্বস্তি হচ্ছে। রাও দম্পতিকে দেখে সাহায্যের আশায় বিড়ালটা কুঁইকুই করে উঠল। আর সহ্য হল না মি. রাওয়ের। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত হতাশা যেন একসঙ্গে ভীড় করে একটা দানবের রূপ নিল তাঁর মাথায়। নিজের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সজোরে একটা লাথি মারলেন বিড়ালটার শরীরে, পুঁচকে বিড়ালটা ছিটকে গিয়ে ধাক্কা খেল দূরের দেওয়ালে, ভক করে এক দলা রক্ত বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কেঁপে উঠে একদম স্থির হয়ে দেহটা। একটা প্রচণ্ড আর্তনাদ করে ডিংকো ছুটল তার পোষ্যের নিথর দেহটার দিকে।

***

“আপনি সেদিন খুব বড় ভুল করেছেন মি.রাও। আপনার একদম উচিৎ হয়নি এরকম করা। আপনি তো জানেন আপনার ছেলের মানসিক অবস্থা কীরকম ছিল, তার ওপর ওর প্রিয় পোষ্যকে…”

“বেড়ালটা এমনিতেই মরে যেত ডক্টর।”

“হতে পারে কিন্তু আপনার উচিৎ ছিল ছেলের প্রতি সহানুভূতি দেখানো। যাইহোক, এখন যা বললাম তাই করুন।”

ডাক্তার বেরিয়ে যাওয়ার পরেই অনেকক্ষণ পর আবার গলা তুললেন মিসেস রাও, “শুনলে? সহানুভূতি কাকে বলে জানো?”

“ওহ এখন তুমি আমাকে সহানুভূতি শেখাবে? আর তুমি নিজে সেদিন কী করছিলে?”

“শোনো… “

“এই খালি ফ্যাচফ্যাচ না করে তোমার ছেলের জন্য আবার কিছু একটা কিনে আনার ব্যবস্থা করো।”

“আমার ছেলে! আর তোমার?”

“ওরকম ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।”

“তোমার মতো বাবা থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। ওর জন্মের সময় যদি হাজির থাকতে তাহলে হয়তো ওর মাথায় এরকম হওয়াটা আটকানো যেত। তখনও তোমাকে পাওয়া যায়নি আর এখনও সবসময় দায় এড়িয়ে যাচ্ছ। আমি একলা কী করব বলো?”

“দায় এড়িয়ে যাচ্ছি! ওর ট্রিটমেন্টের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা কে খরচ করছে?”

“টাকা দিয়েই তো তুমি খালাস। আর সময়-শ্রম এগুলো?”

“এতোই যদি প্রবলেম তো ফেলে দাও তোমার ছেলেকে।”

***

“বুঝলে রবি মানুষের মতো খারাপ আর কেউ নেই। মানুষ নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব বলে দাবি করে অথচ ওরাই হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট। একটা পশুর কিন্তু তার অসুস্থ সন্তানের প্রতি মায়া থাকে কিন্তু মানুষের থাকে শুধু বিরক্তি। একটা পশু ভালোবাসা পেলে মানুষকে আপন করে নিতে পারে কিন্তু মানুষ পারে না।

জানো রবি জন্মের পর আমার মাথার ভেতরে একটা রস জমে আমার মাথাটা ফুলে গিয়েছিল আর বুদ্ধিসুদ্ধিও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল অনেক। এবং এটাই ছিল আমার মা বাবার বিরক্তির কারণ। ওরা সবসময় আমার থেকে মুক্তি চাইতেন, ঘরে অশান্তি লেগেই থাকতো, কথায় কথায় শুনতাম আমাকে ‘ফেলে’ দেওয়ার কথা।

আমার মাথার অদ্ভুত আকৃতির কারণে আমার সঙ্গে কেউ খেলতে চাইত না। আমার একমাত্র খেলার সঙ্গী ছিল টুইস্টি। আমার আকৃতি নিয়ে টুইস্টির কিছু যেত আসতো না, আমার সুখ দুঃখ সবকিছুর ভাগিদার হয়েছিল সে। কিন্তু আমার বাবা তাকেও মেরে ফেলল! জানো রবি আমার চোখের সামনে টুইস্টিকে তড়পে তড়পে মরতে দেখেছিলাম আমি। রাগে ঘেন্নায় তখন আমার মাথার শিরাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছিল যেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এর বদলা আমি নেবোই। এই ঘটনার পর আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি, তখন বাবাই একটা খরগোশ এনে দেয় আমাকে। আবার… আবার ওকে নিয়েই আমার নতুন জগৎ তৈরি হয়, আমি আবার নিজের মতো করে বাঁচতে শুরু করি। কিন্তু…

একদিন আমার খরগোশটা বাড়ির থেকে বেরিয়ে যায় খেলতে খেলতে। ওকে দেখে আমাদের সোসাইটির ছেলেরা গাজর খেতে দেয়। হ্যাঁ, আমাদের হাই সোসাইটির ছেলেরা ওকে বিষাক্ত গাজর খেতে দেয় শুধুমাত্র এটা দেখবে বলে যে একটা প্রাণী কেমন করে তড়পে তড়পে মরে। মজা… এতে নাকি মজা পায় ওরা।

সেদিন আমি বুঝেছিলাম রবি যে শুধু আমার মা বাবাই এমন নয়, গোটা মানুষ জাতিটাই এরকম। খবরে শুনেছিলাম ‘মানুষের কৃতকর্মের জন্য একটার পর একটা প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে’। কেন? পৃথিবী শুধু মানুষের একার নাকি? মানুষ নিজেকে ভাবেটা কী? ওরা আবার অন্য প্রাণীদের ‘ইতর’ বলে। সত্যিই? মানুষের চেয়েও ইতর আর কেউ হতে পারে নাকি?

আমি… আমি মনে মনে স্থির করে নিই মানুষকে তার কৃতকর্মের শাস্তি আমি দেবোই। দেখিয়ে দেব পশু পাখিরা কমজোর নয়। আমার বাবা একটা উপকার করেছিল। বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আমাকে সুস্থ করে তোলে। আর সেজন্যই আমি আজ এই মহান কর্মযজ্ঞে সামিল হতে পেরেছি। আর কিছুদিনের অপেক্ষামাত্র, মানুষের দম্ভ শেষ হল বলে। যাদের এতদিন অবজ্ঞা করে এসেছে মানুষ, এবার তাদের ভয়েই কাঁপবে ওরা। আর কয়েকটা দিন মাত্র…

আমি মানুষকে বিশ্বাস করি না, তাই তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমার এই কর্মকান্ডের সাক্ষী রাখিনি। আমার গবেষণার শেষ পর্যায়ে একটা অন্য বড় পরীক্ষা করব আমি, জানি না তারপর আমার কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট থাকবে কিনা। কিন্তু আমি চাই মানুষ কতটা ঘৃণ্য তা কখনও না ভুলতে তাই তোমার মধ্যে আমার সেই স্মৃতি দিয়ে রাখলাম রবি। জানি ওখানে সুরক্ষিত থাকবে।”

মাঝেমাঝেই রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে দানিশ রাওয়ের এই স্মৃতিচারণ শোনে রবি। আজ বেশ কয়েকটা বছর রবি কাজ করছে মানুষটার সঙ্গে। দেখেছে কী অসীম ধৈর্য নিয়ে একটার পর একটা প্রাণীর জিনের মধ্যে বিবর্তন ঘটিয়ে ওদের আকৃতি আর চরিত্রে পরিবর্তন এনেছেন মানুষটা। পরীক্ষা চলাকালীন কোনো প্রাণী মারা গেলে হাউহাউ করে কাঁদতেও দেখেছে মানুষটাকে, খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে বসে থাকতে দেখেছে মানুষটাকে। কত দিনের পরিশ্রমের পর ওঁর পোষ্যরা আজ মানুষের চেয়েও শক্তিশালী। একটার পর একটা জায়গায় গিয়ে ত্রাস ছড়িয়ে আসছে তারা। এদিকে রবির চাতুর্যে শহরের ECT মরিয়া হয়ে খুঁজেও ওদের হদিশ পায়নি এখন অবধি।

দানিশ রাওয়ের গবেষণার প্রতিমুহূর্তের সাক্ষী রবি, কিন্তু রবি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না গবেষণার শেষলগ্নে কোনো বড় পরীক্ষার কথা বলছেন উনি!

এখন রাত আড়াইটা বাজে, আর ঠিক দেড় ঘন্টা পর রবির বিশ্রাম নিতে যাওয়ার পালা। ওপাশের ঘরটায় মেয়েটাকে বেঁধে রাখা আছে। ছটফট করছে মেয়েটা, বিভিন্ন রকমের আওয়াজ করছে। আজ ওর হাত কেটে অল্প খানিকটা রক্ত পিচকুকে খাওয়ানো হয়েছে। প্রফেসার রাও দেখতে চান মানুষের রক্ত পেয়ে পিচকুর মধ্যে কতটা পরিবর্তন আসে। তিনি একটা নতুন সূত্র খুঁজে পেয়েছেন, তার জন্য এই এক্সপেরিমেন্টটা খুব কাজে দেবে।

ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতেই আচমকা রবির অনুভব হল একটা অদ্ভুত রকমের শব্দ হচ্ছে কোথাও, ক্ষীণ কিন্তু তীক্ষ্ণ। ওপাশের ঘরের মেয়েটা এত আওয়াজ করছে যে ভালো করে কিছু শোনা দায়। রবি ওর চোখের এক্স রে মোড এক্টিভেট করল। তারপর গোটা ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু নাহ, কোথাও অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ল না। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল রবি আর তাতেই অন্ধকারে দেখতে পেল দানিশ রাওয়ের বাংলোর বিশাল কম্পাউন্ডের মধ্যে দুটো ছায়া মূর্তি সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে এ বাড়ির দিকেই। অন্য মানুষ হলে হয়তো এই দৃশ্য দেখে চমকে উঠত কিন্তু রবির সিস্টেমে এমন কোনো ফাংশান নেই, তাই সে চমকালো না। এই বাংলোর বাউন্ডারি ওয়ালে হাই ভোল্টেজ দেওয়া আছে, যে কেউ সেটা স্পর্শ করলেই শক খেয়ে শরীর জ্বলে যাওয়া অবধারিত। তাহলে এই মানুষদুটো ঢুকলো কেমন করে! রবি চট করে একবার চেক করল, দেখল বাউন্ডারির ইলেকট্রিক সিস্টেম অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের তো এই সিস্টেমের ব্যাপারে জানার কথা নয়, তাহলে এই লোকদুটো নিশ্চয় বিশেষ কেউ। ওরা প্রোফেসর রাওয়ের সম্বন্ধে সব তথ্য জেনেই এসেছে। রবিও অন্ধকারেই টুক করে বাইরে বেরিয়ে এসে স্ক্যানার অন করতে টের পেল আগন্তুক দুজনের UIC নেই, সকালে আসা এই মেয়েটারও ছিল না। রবির সিস্টেমে এরকম মানুষ সম্পর্কে কোনো ইনফরমেশন নেই। সকালে মেয়েটা অজ্ঞান ছিল বলে ওকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি কিন্তু এই লোকদুটো তো সুস্থ সবল। এই মুহূর্তে কী করণীয় তা সিস্টেমে সার্চ করতে করতেই ওদের মধ্যে একজন রবিকে দেখতে পেয়ে গেল। ত্বরিত গতিতে সে এসে রবির বুকের ওপর একটা যন্ত্র রাখল। রবি টের পেল ওই যন্ত্র থেকে কোনোভাবে কারেন্ট জেনারেট হয়ে রবির বডির মধ্যে প্রবেশ করছে এবং তার ভোল্টেজ রবির সহ্য সীমার থেকে বেশ খানিকটা বেশি। রবি বাধা দেওয়ার আগেই ওর ভেতরের সিস্টেমে আগুন ধরে গেল নিমেষে।

১৪

অর্শিয়া তাকে অগ্রাহ্য করে ঘরে চলে যেতেই ঠোঁট কামড়াল অধীর বক্সি। মাঝেমাঝে মেয়েটার এই ঔদ্ধত্য অসহ্য লাগে তার কিন্তু করণীয় বলতে কিছুই থাকে না।

ভাবা যায়, এই মুহূর্তে এই সুবিশাল পৃথিবীর বুকে অধীর বক্সি বলে কারুর অস্তিত্বই নেই। আজ থেকে বেশ অনেকগুলো বছর আগের পৃথিবীতে তার নামটার অস্তিত্ব থাকলেও শরীরটার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই অস্তিত্বহীনতার অনেক সুবিধা থাকলেও মাঝেমাঝই তার বুকের ভেতরটা কেমন খাঁ খাঁ করে ওঠে, সবকিছু শূন্য মনে হয়, একটা স্বাভাবিক জীবনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। এতো কাছাকাছি থেকেও অর্শিয়া যেন তার ধরাছোঁয়ার বাইরে সবসময়।

দু’হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল অধীর বক্সি। দুর্বল চিন্তাগুলো মাথায় আসতে দিলে চলবে না। ছোট থেকেই তুখোড় বুদ্ধি ছিল তার, পড়াশুনাতে সবসময় এগিয়ে থাকতো। কিন্তু ক্লাস এইটে পড়াকালীন কাকতলীয় ভাবে এক তান্ত্রিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার। তন্ত্র সাধনার প্রতি অমোঘ আকর্ষণে ঘর ছাড়ে সে, প্রায় পাঁচমাস সেই তান্ত্রিকের সঙ্গে থেকে আশ্চর্য সব ক্রিয়া কলাপের সাক্ষী হয়। কিন্তু তারপর পুলিশ ঠিক তাকে উদ্ধার করে আবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। জীবনে হঠাৎ আসা এডভেঞ্চারের ইতি হয় ওই কয়েকমাসেই, কিন্তু মন থেকে ঘটনাগুলো পুরোপুরি মুছে যেতে পারেনি। অতিলৌকিক বিষয়ের প্রতি অমোঘ আকর্ষণই তাকে নিয়ে আসে দ্য মিস্ট ক্লাবে, যে ক্লাব তার জীবনটাই পাল্টে দেয়। ক্লাবের লাইব্রেরীর অজস্র বইয়ের পাতায় বুদ্ধিমান বক্সি খুঁজে পায় এক নতুন দিগন্ত--- তন্ত্র, ব্ল্যাকম্যাজিক আর বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। ক্লাবের সবাই যখন নতুন কোনো রহস্যের পেছনে ছুটে যেত, অধীর বক্সি তখন লাইব্রেরীতে বসে অনেকগুলো হিসেব মেলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত থাকত। আর এই অধ্যবসায়ের ফলেই সে পায় তার জীবনের জ্যাকপট। এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের চাবিকাঠি। সবার অলক্ষ্যে লাইব্রেরী থেকে প্রয়োজনীয় নথিগুলো নিয়ে গোপনে সে পৌঁছে যায় তার আদি বাড়িতে। সেখানেই গোপন কক্ষে শুরু হয় তার গবেষণা। বাবা অনেক সম্পত্তি রেখে গত হয়েছিলেন, বক্সি সেই অর্থে নিজের মফস্বলের ওই বাড়ির মধ্যেই তৈরি করে ফেলে তার গবেষণাগার। দিনরাত সেখানে অক্লান্ত পরিশ্রম, ক্রমাগত ব্যর্থতার মধ্যে সাফল্য চলে আসে আচমকাই যা অধীর বক্সি নিজেও টের পায়নি। আর এই টের না পাওয়াটুকুই ওলট পালট করে দেয় সবকিছু। বক্সি এসে সময়ের বেড়াজালে আটকে পড়ে। কিন্তু নাহ, বক্সি হারতে শেখেনি। এই সময়ের লোকের কাছে সে অস্তিত্বহীন হলেও নিজের কাছে তার অস্তিত্ব ভীষণভাবে প্রকট। আর অস্তিত্ব সে মুছে যেতে দেবে না কিছুতেই।

শিকার আর শিকারি… অর্শিয়া ভাবে অধীর বক্সিকে ব্যবহার করছে। সত্যিই? একটা মেয়ে অধীর বক্সিকে ব্যবহার করবে আর অধীর বক্সি পুতুলের মত নাচবে, এতোই সহজ!

আজও সেদিনের ঘটনাটা কিছুটা মনে পড়ে অধীর বক্সির। যন্ত্রটার খুব গরম হয়ে যাচ্ছিল বলে ভেতরে পরীক্ষা করতে ঢুকেছিল সে, তারপরেই কী যেন হয়ে গেল। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলো কয়েকটা অদ্ভুত পোশাক পরা গুণ্ডাদের হেফাজতে সে। আসল ব্যাপারটা বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছিল তার। আর গুণ্ডাগুলো সে ইচ্ছে করে বোকা সাজছে ভেবে তার ওপর অত্যাচার করেছিল খুব, তারপর বিক্রি করে দিয়েছিল অর্শিয়া সেনের কাছে। এরপরেই জীবনটা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল তার।

এই সময়ে প্রত্যেকটা মানুষের একটা ইউনিক আইডেন্টিটি কোড থাকে, যার সাহায্যে তার সমস্ত তথ্য সরকারের ঘরে জমা থাকে। এমনকি গুণ্ডা বদমায়েশদের ধরতেও এই কোড প্রশাসনের খুব কাজে লাগে। কিন্তু অন্য সময় থেকে হঠাৎ করে এসে পড়া অধীর বক্সির স্বভাবতই এই কোড ছিলনা, আর সেই ব্যাপারটাকেই কাজে লাগাতে চায় অর্শিয়া। বাইরের জগতের কাছে অর্শিয়া শুধুমাত্র রোবটিক্স নিয়ে গবেষণা করে, কিন্তু অধীর বক্সি ভেতরে ভেতরে অর্শিয়ার কাজ আরও কত মারাত্মক। আর সেই গোপন গবেষণা চালানোর জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। এবং সেই অর্থ আসেও নিষিদ্ধ মাধ্যমে। UIC বিহীন একটা মানুষকে অর্শিয়া এই জন্যই কিনে নিয়েছিল। অধীর বক্সির মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গা থেকে সম্পদ লুঠ করে সে, UIC না থাকায় প্রশাসন চোরের হদিশ পায় না। এছাড়াও গবেষণার প্রয়োজনে অর্শিয়ার হয়ে আরো অনেক নিষিদ্ধ কাজ বক্সিকে করতে হয়। অর্শিয়া বোধহয় বিশ্বাস করে কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়; তাইতো অধীর বক্সিকে পাওয়ার পর তার ট্রেনিং এর পেছনেও অনেকটা শ্রম আর অর্থ ব্যয় করেছিল সে। বক্সির তখন নতুন সময়ের গোলকধাঁধায় পড়ে বিধ্বস্ত অবস্থা, অর্শিয়ার আজ্ঞাবাহী দাসে পরিণত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার। কিন্তু সেই বিধ্বস্ত অবস্থা ছিল মাত্র কিছুদিনের জন্য, খুব শীঘ্রই নিজেকে সামলে নেয় বক্সি। সে এটুকু বুঝে যায় এই মুহূর্তে টিকে থাকতে গেলে অর্শিয়ার মতো একটা শক্ত খুঁটির খুব প্রয়োজন। অল্পদিনের মধ্যেই অর্শিয়ার বিশ্বাস অর্জন করে ফেলে বক্সি, অর্শিয়াকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এখানে নতুন করে শুরু করে বহু বছর আগের এক সময়ে অসমাপ্ত রেখে আসা তার গবেষণা। ‘৭৫ এর পৃথিবীর আধুনিক প্রযুক্তি যেমন তার সহায়ক হয়, তেমনই ওদের কাজ বুঝতে সময়ও লাগে খানিক। যাইহোক বক্সির বিশ্বাস তার কাজ প্রায় শেষের মুখে। এবার আর সে কোনো ভুল করবে না। একবার সম্পূর্ণ সাফল্য পেলে ইতিহাসটাই পাল্টে দেবে সে। অধীর বক্সির চোখদুটো চকচক করে ওঠে আনন্দে। কিন্তু পরমুহূর্তেই একটা চিন্তার স্রোত তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

মাত্র কিছুদিন আগের ঘটনা। ভ্যাংকার্স স্পাইডিরা যোগাযোগ করে অর্শিয়ার সঙ্গে, বলে ভালো একটা ডিল আছে। বেশিরভাগ সময়ই অর্শিয়ার হয়ে এইসব কাজে যেতে হয় অধীর বক্সিকে, এইবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্পাইডিদের ডেরায় গিয়েই চমকে যায় বক্সি, দেখে দুটো ছেলেকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় ফেলে রেখেছে স্পাইডিরা। পাশেই ওদের পড়ে থাকা পোশাক দেখেই চমকে ওঠে বক্সি, এইধরণের পোশাক তার খুব চেনা। বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে তার। এরা যদি ওই সময়ের মানুষ হয়ে থাকে তাহলে তারা এখানে পৌঁছালো কীভাবে! তাহলে কি ওই সময় অন্য কেউ ইতিমধ্যেই আবিষ্কার করে ফেলেছে সময় পরিভ্রমণের পদ্ধতি! নিজের মনের শঙ্কা স্পাইডিদের বুঝতে না দিয়ে ছেলেদুটোকে কিনে আনে বক্সি। ওরা একটু সুস্থ হতেই রহস্যের উন্মোচন হয়। আজ অনেকগুলো বছর পর অধীর বক্সি আবার শোনে সেই ক্লাবের নাম, যে ক্লাবে তার এই স্বপ্নটার জন্ম হয়েছিল। ছেলেদুটোর নাম স্যামুয়েল আর আকাশ। স্যামুয়েল নাকি দ্য মিস্টের হায়েস্ট লেভেল মেম্বার, বক্সিকে খুঁজতেই নাকি কুশারীগঞ্জে পৌঁছায় সে। আর আকাশ মা বাবার ওপর অভিমান করে বাড়ি পালিয়ে ভিড়ে যায় স্যামুয়েলের সঙ্গে। তারপর দুজনে বক্সির সন্ধান করতে করতে আসাবধানে বক্সির যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে পৌঁছে যায় এখানে। স্যামুয়েলের কাছে সব শুনে বুকটা কেমন যেন করে ওঠে বক্সির, এতোদিন পরেও তার যন্ত্রটা তারমানে ঠিক আছে! কিন্তু ওটার সাহায্যে এই সময়ে পৌঁছে গেলেও ওটার আর অস্তিত্ব নেই এই সময়ে। উফফ এ যে কী যন্ত্রণার তা বক্সি ছাড়া কেউ বুঝবে না।

ঘটনার অবশ্য শেষ নয় এখানে, আজ আবার চার চারজন এসেছে ওই সময় থেকে। বক্সির মনটা অস্থির লাগছে, এমন করে যদি সবাই তার ওই আবিষ্কারের হদিশ পেয়ে যায় তাহলে তো যে কেউ ওই আবিষ্কার নিজের নামে চালিয়ে দেবে। তখন এই অন্য সময়ে এসে বক্সির এতদিনের সাধনা বিফলে যাবে তো! আবার তার এই গবেষণার কথা এই সময়ে অন্য কেউ জেনে গেলেও তো মুশকিল। স্যামুয়েলের থেকে অবশ্য আর ভয় নেই। স্যামুয়েলের মস্তিষ্ক এখন অর্শিয়ার দখলে। সে এখন অর্শিয়ার মানুষরূপী রোবট। কিন্তু বাকি চারটে! ভাবা যায় দ্য মিস্ট থেকে এতো বছর পর তাকে খুঁজতে বেরিয়েছে ওরা! তিনজন তো এখন অর্শিয়ার বাড়িতে বন্দি কিন্তু সমস্যা তো আরেকজনকে নিয়ে। তাকে নাকি ধরে নিয়ে গেছে বুড়ো দানিশ রাও। ওই খিটকেল বুড়োটাকেই বক্সির ভয়, লোকটা সবসময় নিজেকে একটা রহস্যের মোড়কে আবৃত করে রাখে। ও কী কাজ করে না করে তা সাধারণ বিজ্ঞানীরা জানতেও পারে না। আবার অর্শিয়ার মুখে শুনেছে ওই বুড়ো নাকি চাইলেই একেকজনের কেরিয়ার শেষ করে দিতে পারে। বুড়োর বিরুদ্ধে একবার থিসিস চুরির অভিযোগে এনেছিল এক তরুণ, কিন্তু তারপর আশ্চর্যজনক ভাবে ছেলেটা উধাও হয়ে যায়। সুতরাং ওই দানিশ রাও লোকটা যে কী পরিমাণ বিপজ্জনক তা বলে দিতে হয় না। ওই অতীত থেকে আসা মেয়েটাকে ওর কাছে রাখা মোটেও নিরাপদ নয়।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বক্সি। অর্শিয়ার জন্য নয়, তার নিজের জন্যই মেয়েটাকে উদ্ধার করতে যেতে হবে। ওই বুড়োটার সঙ্গে লড়াই করার জন্য বক্সি একলাই যথেষ্ট।

***

“কোথায় যাচ্ছ?” পেছন থেকে ডাক আসতেই ঘুরে তাকাল অধীর বক্সি। অর্শিয়া দাঁড়িয়ে, চোখগুলো তার ফুলে লাল। কাঁদছিল নাকি! মনে প্রশ্নটা উঁকি দিলেও সেটাকে গোপন রেখে বক্সি বলল, “কোথাও না, এমনিই।”

“ওই মেয়েটাকে আমার চাই।”

“ক্ক কোন মেয়েটাকে?” জেনেও না জানার ভান করল বক্সি।

নাকটা টেনে অর্শিয়া বলল, “তুমি হয়তো ঠিকই বলেছিলে অতো ঝুঁকি নিয়ে মেয়েটাকে উদ্ধার করার কী দরকার, আমিও ভেবে দেখলাম হয়তো দরকার নেই। কিন্তু… মেয়েটাকে যদি ঐ দানিশ রাও না নিয়ে গিয়ে অন্য কেউ নিয়ে যেত তাহলে আমি হয়তো ছেড়ে দিতাম। কিন্তু লোকটা যখন দানিশ রাও, তখন আমি ছেড়ে দিতে পারি না।”

অধীর বক্সি একবার ভালো করে অর্শিয়ার মুখের দিকে তাকাল, ওর ফর্সা গালদুটো লাল হয়ে উঠেছে। বক্সি মনে মনে একবার হাসল। বাইরে সবাই বলে মেয়েটা নাকি ভীষণ কাঠখোট্টা, কিন্তু বক্সি জানে মেয়েটা বুদ্ধিমান হলেও আবেগই তাকে বেশি নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও এক্ষেত্রে তাকে বাধা দেওয়ার কোনো মানে হয় না।

“ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কোরোনা। বুড়োর জন্য আমি একলাই যথেষ্ট।”

“বুড়ো কিন্তু একলা নয়।”

“ওহ, ওর ওই রবিকে ভয় পাচ্ছ? আচ্ছা আমি তাহলে স্যামুয়েলকে নিয়ে যাচ্ছি।”

“নাহ।”

“মানে?”

“আমি বুড়োটাকে বিশ্বাস করি না….”

১৫

“দাদা, ওরা আমাদের কেন ধরে রেখেছে কিছু জানো?” জিজ্ঞেস করল আকাশ। আজ বহুদিন বাদে কথা বলার লোক পেয়েছে সে।

“নাহ। তুমি এখানে স্যামের সাথে এসেছিলে তাই না?” জানতে চাইল রোমিত। আকাশের চোখ দুটো চকচক করে উঠল, “তুমি কী করে জানলে স্যামুয়েল দাদা তোমাকে বলেছে?”

“নাহ। স্যাম তো... “

“পাল্টে গেছে তাই না?” বলল আকাশ। রাত্রি জানতে চাইল, “তুমি ওর এই পরিবর্তনের ব্যাপারে কিছু জানো?”

“নাহ। সেই বক্সি বাড়ির আলমারীতে ঢোকার পর যখন চোখ খুললাম দেখলাম এইখানে রয়েছি। একদিন পরেই স্যামুয়েল দাদাকে একটা লোক বের করে নিয়ে গেল। লোকটা নিজের নাম বলেছিল অধীর বক্সি।”

নামটা শুনেই ঘরে উপস্থিত বাকি তিনজন চমকে উঠল। সায়ক বলল, “তারপর?”

“তারপর বেশ কয়েকদিন স্যামুয়েল দাদাকে দেখতে পাইনি। দিয়ে যেদিন এলো সেদিন দেখলাম ওর মাথার একপাশে ব্যান্ডেজ বাঁধা, মাথার অপারেশন হলে যেমন করে বাঁধা থাকে তেমন করে। স্যামুয়েল দাদা আমার সঙ্গে কথা বলছিল ঠিকই কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন ও নিজের মধ্যে নেই।”

“তারপর থেকেই স্যাম এরকম?”

“হ্যাঁ।”

“আমি বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি কিছু।” বলে উঠল সায়ক। সবাই জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিয়ে তাকাতেই ও বলল, “আমাকে যে প্রোফেসর রায় উদ্ধার করেছিলেন, মানে ওনার ওই রোবট আরকি উদ্ধার করেছিল, সেই প্রোফেসর বলছিলেন যে এখন নাকি নিষিদ্ধ বৈজ্ঞানিক চর্চা খুব রমরমিয়ে চলছে।”

“নিষিদ্ধ বৈজ্ঞানিক চর্চা বলতে?” জানতে চাইল রাত্রি। সায়ক গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলল, “ডিটেলসে তো কথা হয়নি, তবুও যেটুকু বুঝলাম তাতে ধরো এমন কিছু রিসার্চ যা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর সেরকম জিনিস নিয়েও কাজ চলছে। যেমন মানুষের ক্লোনিং জিনিসটা তো নিষিদ্ধ, হয়তো সেটা নিয়েই কেউ বড় রকমের রিসার্চ করছে গোপনে। আর তাছাড়া…”

“তাছাড়া কি?”

“তাছাড়া এই ধরো ব্ল্যাক ম্যাজিক, তন্ত্র মন্ত্র এসব জিনিসের সাথে বিজ্ঞানকে মিলিয়ে দিয়েও নাকি অনেক রিসার্চ চলছে।”

“কী! এটা কি সম্ভব নাকি?” মুখ বাঁকিয়ে বলল রোমিত, “এগুলো তো দুই বিপরীত মেরুর জিনিস। বিজ্ঞান কোনোদিনও ব্ল্যাক ম্যাজিকের অস্তিত্ব স্বীকার করে না।”

“তুমি কি অস্বীকার করতে পারো? তোমার অভিজ্ঞতা কি বলে?” রোমিতের দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সায়ক, “প্রোফেসর রায় সন্দেহ করছেন অধীর বক্সি ওই পুঁথি চুরি করে এরকমই কোনো গবেষণায় নেমেছিলেন।”

“তার মানে তুমি বলতে চাও অধীর বক্সি টাইম ট্রাভেল করে এই সময়ে এসে দিব্যি আছে। শুধু তাই নয়, স্যামের মাথার অপারেশন করে কিছু একটা করে দিয়েছে স্যামকে!” রাত্রির গলায় অবিশ্বাসের ছোঁয়া।

“আমি যা জেনেছি বললাম এবার বিশ্বাস করা না করা তোমাদের ব্যাপার। তমসা কোথায় সেটাও আমরা জানি না।”

“কাম অন সায়ক, ওই বক্সি এখানে এসে রিসার্চ চালানোর মত রিসোর্স কোথার থেকে পাবে! সেও অন্য সময়ে আছে, আমরাও অন্য সময়ে পৌঁছে গেছি। পার্থক্য একটাই যে, সে জেনেশুনে এসেছে আর আমরাই বলো বা স্যামরাই বলো আনাড়ির মত ওর সেট করে যাওয়া সেটিংস থেকে পৌঁছে গেছি নিজেদের অজান্তেই। তাই বলছি লোকটা নিশ্চই সঙ্গে করে আনেনি এসব।”

“তোমরা কেন ভাবছো যে ওই বক্সি লোকটা একাই সব করছে? এখানে অনেক রোবট আছে, মানুষের মত দেখতে। আমার তো মনে হয় আরও কেউ আছে যে এদের সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করছে।”

ক্লাস এইটে পড়া একটা ছেলের মুখে এমন কথা শুনে চমকে উঠে আকাশের মুখের দিকে তাকাল সবাই। আকাশ ভাবলেশহীন গলায় বলল, “তোমরা এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা না করে ঝগড়াই করে যাচ্ছ!”

“উদ্ধার! কেমন করে? দরজা তো শিল করা।” বলল রাত্রি।

আকাশ বলল, “ওপরের দিকে তাকাও।”

আকাশের কথা শোনা মাত্রই ওরা তিনজন ওপরের দিকে তাকাল, দেখল দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া একটা ঘুলঘুলির মত দেখা যাচ্ছে, তার ওপর ফাইবারের আস্তরণ।

“আমার একার পক্ষে ওই অবধি পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। এবার তোমরা এসেছো যখন, তখন চেষ্টা করা যেতেই পারে।”

“অত উঁচুতে! তাছাড়া লাভ হবে কিছু?” সন্দিগ্ধ গলায় বলল রাত্রি।

সায়ক মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে উঠল, “চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?”

***

দানিশ রাওয়ের ঘুমটা বরাবরই ভীষণ পাতলা। আগে তাঁর বাড়িতে দুজন পাহারাদার, আর একজন চাকর ছিল, কিন্তু প্রোফেসর রাওয়ের মানুষের ওপর বিশ্বাস বড় কম। তাই ওদের ছাড়িয়ে দিয়ে রবিকে আনলেন তিনি। রবিই এখন সব দিক সামাল দিতে পারে। তবুও যাইহোক যন্ত্র তো, তাই কোনো সময়েই দানিশ রাও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন না। আজকের দিনটাও ব্যতিক্রম নয়। তার ওপর আজ যখন একটা আস্ত মেয়ে মানুষ রয়েছে ঘরে তখন তো নিশ্চিন্তে ঘুমোবার প্রশ্নই আসে না। নেহাত শরীর নামক যন্ত্রটারও কাজ করার জন্য বিশ্রাম প্রয়োজন তাই শুয়েছিলেন তিনি। আচমকা একটা খুট করে শব্দ হতেই ঘুমটা ভেঙে গেল তাঁর। রবির প্রত্যেকটা শব্দ তাঁর ভালো ভাবে চেনা, এটা রবির শব্দ নয়। নিজের লাইসেন্সড রিভলভারটা ড্রয়ার থেকে বের করলেন প্রোফেসর রাও। তারপর রিভলভারটা উঁচিয়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে এলেন নিজের রুম থেকে। বাইরের ঘরগুলো অন্ধকার। রবিকে ডাকতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন প্রোফেসর। পা টিপে টিপে ডাইনিং হলে আসতেই তাঁর মনে হল কে যেন সেখানে চেয়ারে বসে। রবি তো এভাবে বসে না, তাহলে কে! রিভলভারটা শক্ত করে ধরে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলেন প্রোফেসর। দেখলেন ডাইনিং টেবিলে চেয়ারে একজন অচেনা লোক বসে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। ভাবখানা এমন যেন প্রোফেসর যে আলোটা জ্বালবেন সেই অপেক্ষাতেই ছিল লোকটা।

“নাইস টু মিট ইউ প্রোফেসর। আমাদের একটা জিনিস আপনার কাছে চলে এসেছিল ভুল করে, সেটাই নিতে এসেছি।” শান্ত গলায় কথাগুলো বলে লোকটা একটা অদ্ভুত আওয়াজ করল। আর সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘর থেকে দুজন বেরিয়ে এলো, ওদের সঙ্গে হাত পা বাঁধা অবস্থাতে আজকের সেই মেয়েটা। প্রোফেসর ওই দুজনের একজনকে দেখে বুঝলেন ওটা একটা সাধারণ হিউম্যানয়েড, কিন্তু আরেকজনকে দেখে অদ্ভুত লাগল তাঁর। দেখে তো মনে হচ্ছে মানুষই কিন্তু তার আদব কায়দায় কোথাও যেন একটা যান্ত্রিক ভাব। প্রোফেসর বুঝলেন রবিকে এরা কিছু করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে তিনি সম্পূর্ণ একা, তাই এদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা মানে বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রোফেসর নিষ্ক্রিয় ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাল সকালে TECT-এর কাছে রিপোর্ট করবেন নাহয়, মেয়েটার কথা উল্লেখ করবেন না, শুধু রবির ব্যাপারে বলবেন। ওরা বেরিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটাকে নিয়ে, আর প্রোফেসর জরিপ করে দেখে নিচ্ছিলেন কী কী জিনিসে ওরা স্পর্শ করছে। কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছেও আচমকা লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। তারপর আগের মতোই হাসি হাসি গলায় বলল, “প্রোফেসর, আমাদের বস আপনাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছেন ফ্রি গিফট হিসেবে।”

এই বলে লোকটা একটা অস্ত্র তাক করল প্রোফেসর রাওয়ের দিকে। বেগতিক বুঝে ম্যাজিশিয়ানের মতো লোকদুটোর অলক্ষ্যে নিজে হাতে পরে থাকা ঘড়ির মত যন্ত্রটার একটা নির্দিষ্ট বোতামে চাপ দিলেন তিনি, তারপর আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গিতে বন্দুকটা নামিয়ে রাখলেন মাটিতে।

১৬

“তাড়াতাড়ি করো, আর ধরে রাখতে পারছি না।” যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সায়ক। এই মুহূর্তে আকাশ তার কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ওপরের ওই ফাইবারের পাল্লাটা খোলার চেষ্টা করছে। সবার নীচে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোমিত, তার অবস্থা কহতব্য নয়। এতদিন টিভির পর্দাতেই জিমন্যাস্টিকের এসব খেলা দেখেছিল, কোনোদিন ভাবেওনি নিজের জীবনেও এর প্রয়োগ করতে হতে পারে এভাবে।

“অনেকদিন খোলা না হয়ে ছিটকিনিটায় জং ধরে গেছে, তোমরা আরেকটু ধৈর্য ধরো।” বলল আকাশ। তারও পুরো শরীরটা কাঁপছে। ওই ছিটকিনিটুকু বাদ দিলে হাতের কাছে কোনো সাপোর্ট নেই। আচমকা একটা আর্তনাদ করে নড়ে উঠল রোমিত। রোমিতের নড়ে যাওয়াতে টলোমলো হয়ে যেতেই সায়কের কাঁধ থেকে আকাশের পা দুটো স্লিপ করে গেল। ওরা ভাবল আকাশ এই বুঝি সোজা মাটিতে পড়ল, কিন্তু সেরকম কিছু হওয়ার আগেই খুট করে ছিটকিনিটা খুলে গেল আর আকাশ পাল্লাটা ধরে ঝুলতে লাগল শূন্যে। সবার হতভম্ব ভাবটা কেটে উঠতেই সায়ক আবার ওর পা দুটো কোনোমতে নিজের কাঁধের ওপর রাখল। আর এদিকে রাত্রি রোমিতের পায়ের ওপর থেকে একখানা কাঠ পিঁপড়েকে ছাড়িয়ে আনল। এমন শক্ত করে চামড়াটা কামড়ে ধরেছিল যে ওটার মুখের সঙ্গে রোমিতের পায়ের চামড়ার খানিকটা উঠে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে সেখান দিয়ে।

“সময় পাল্টে গেল কিন্তু এদের স্বভাব পাল্টালো না।” মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করল রোমিত।

ওর কথাকে বিশেষ আমল না দিয়ে সায়ক আকাশের পা দুটো শক্ত করে ধরল। ঘুলঘুলির পাল্লাখানা সরিয়ে বাইরে হাত ছোঁয়াল আকাশ।

“স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারছিনা কিন্তু একটা ফ্ল্যাট সারফেস পাচ্ছি মনে হচ্ছে।”

“ঠিক আছে, দু’হাতের সাপোর্ট দিয়ে ওঠার চেষ্টা করো। পারবে তো?”

“একদম। এ আর এমন কি! স্কুলের জামগাছে চড়ার মত ভাবব আরকি।”

এই বলে আকাশ শরীরটাকে টানটান করে দুটো হাত দিয়ে ঘুলঘুলিটাকে ধরে ফেলল শক্ত করে। তারপর শরীরটাকে শূন্যে ঝুলিয়ে অনেক কসরৎ করে পায়ের পাতা দুটোকে দেওয়ালের ওপর লাগিয়ে দিল। তারপর মসৃণ দেওয়ালেই সিঁড়িতে ওঠার মত করে একটু একটু ওপরের দিকে শরীরটাকে নিয়ে যেতে থাকল। দু’বার পিছলে গেল পা, তবুও আকাশ দমল না। ও টের পাচ্ছিল ওর হাত দুটো চাপে ছড়ে যাচ্ছে, হয়তো আর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না; কিন্তু এটাই একমাত্র বেরোবার পথ। যদি ব্যর্থ হয় সে, তাহলে স্যামুয়েলের মত ওরও মাথায় কিছু করে দেবে এরা। নাহ, চেষ্টা করতেই হবে। দাঁতে দাঁত চিপে শরীরটাকে ঘষে ঘষে ওপরের দিকে তুলে নিয়ে যেতে লাগল সে। শুনতে পেল দিদিটা তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলে উঠল, “সাব্বাশ আকাশ, ইউ ক্যান ডু ইট।”

তৃতীয়বারের চেষ্টায় অবশেষে মাথাসহ অর্ধেকটা শরীর ঘুলঘুলির বাইরে বের করতে সক্ষম হল আকাশ।

“ওপারে কি আছে?” জানতে চাইল রোমিত।

আকাশ ক্লান্ত গলায় জবাব দিল, “মুক্তি…”

আকাশ ওপ্রান্তে চলে যেতেই সায়ক বলল, “আকাশ নিজের শরীরটা শক্ত রেখে তুমি তোমার হাতটা নীচের দিকে বাড়াও।”

এই বলে সায়ক নিজের একটা হাত ওপরে দিকে বাড়িয়ে ধরল। কিন্তু আকাশ হাত বাড়ানোর বদলে সরে গেল ওই ঘুলঘুলির মুখটা থেকে। চমকে গেল ওরা তিনজন।

“ছেলেটা তবে আমাদের ছেড়ে পালাল!” সোজা হতে হতে বলল রোমিত। সায়কও নেমে পড়েছে নীচে। কোনো জবাব না দিয়ে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু।

“ওইটুকু বাচ্চা ছেলে আমাদের এমন বোকা বানিয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।”

“রোমিত, আমি তো ভাবছি ছেলেটা ধরা পড়ে গেল না তো!” বলল রাত্রি। রোমিত কোনো একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তার কাঁধের কাছে সুড়সুড়ি লাগল। চমকে উঠে রোমিত দেখল ওই ঘুলঘুলিটার থেকে একটা তারের মত জিনিস নেমে আসছে নীচে।

“এটা কি!”

কেউ কোনো জবাব দেওয়ার আগেই ঘুলঘুলির মুখের কাছে আবার দেখা গেল আকাশের মুখ। সে বলল, “হঠাৎ এটা নজরে পড়ল, বেশ শক্তপোক্ত আছে। এর শেষপ্রান্তটা আমি একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছি। আমি ধরছি তোমরা এক এক করে উঠে এসো। সায়ক রোমিতকে ইশারা করতেই রোমিত অস্ফুটে বলল, “তুমি আগে যাও।” নিজের একটু আগে বলা কথাগুলোর কথা ভেবে তার খানিক লজ্জাই পাচ্ছিল।

***

ওই তারটার সাহায্যে ওরা এক এক করে উঠে এলো ওপরে। এখানে এসেই চমকে গেল, দেখল ঘুলঘুলিটার মুখ একদম বাড়িটার বাইরে।

“তার মানে আমরা আন্ডার গ্রাউন্ডের কোনো ঘরে ছিলাম!” বলল রাত্রি। সায়ক বলল, “সে তো বোঝাই যাচ্ছে কিন্তু এখন আমাদের পালাতে হবে এখান থেকে।”

ওরা আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বুঝতে পারল যে ওরা যেখানটা দিয়ে বেরিয়েছে সেটা বাড়িটার একটা সাইড, বাইরে বেরোনোর গেটটা দেখা যাচ্ছে বেশ খানিকটা দূরে। যদিও ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার খুব কাছেই বাউন্ডারি ওয়ালটা। এদিক দিয়েও টপকে পেরোনো যায়, কিন্তু উঁচু বাউন্ডারির মাথায় আবার কাঁটা তার লাগানো।

রোমিত বলল, “একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি? শরীরের বিভিন্ন জায়গা তো ছড়ে গেছে, আরেকটু নাহয় কাটাকাটি হবে।”

“আমার আপত্তি নেই। আমি শুধু এখান থেকে পালাতে চাই।” বলল আকাশ। রোমিত ওর মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ওই ঘরটার মধ্যে অত উঁচুতে থাকা ঘুলঘুলিটা অবধি যদি পৌঁছাতে পারি তাহলে এই প্রাচীরটা কোনো ব্যাপারই নয়। কি বলো?”

“একদম।”

সায়ক এতক্ষণ চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল। এবার সে মাটির থেকে একটা শুকনো ডাল কুড়িয়ে ছুঁড়ে দিল ওই কাঁটাতার লক্ষ্য করে। ডালটা তারে লাগার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে ছাই হয়ে গেল। আকাশ ভয় পেয়ে খামচে ধরল রোমিতের শার্ট।

সায়ক মাথাটা নেড়ে বলল, “দেখেই সন্দেহ হচ্ছিল! এবার বলো কীভাবে বেরোবে?”

“ওই গেটটা দিয়ে পেরোতে গেলেও হয়তো বাড়ির থেকে দেখতে পেয়ে যাবে।” বলল রাত্রি।

সায়ক তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তারচেয়েও বড় কথা গেটটা ভালো করে লক্ষ্য করো, ওটা কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে লক করা আছে, আমরা খুলতে পারব না। আর ডিঙিয়ে পেরোতে গেলে দুটো সম্ভাবনা- এক, কেউ দেখে ফেলতে পারে; আর দুই, ওটাতেই এরকম কারেন্ট দেওয়া আছে হয়তো। ওরা বেরোবার সময় প্রয়োজন মত সেটা বন্ধ করে দেয় হয়তো।”

“আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে মাত্র ২০৭৫ সালে পৃথিবী এতো উন্নত হয়ে গেল! মাত্র পঞ্চান্ন বছরে!” অদ্ভুত মুখভঙ্গি করল রোমিত। সায়ক হেসে বলল, “তোমার জন্মের সময় তোমার মা বাবাও কিন্তু ভাবতে পারত না হসপিটালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব আত্মীয় স্বজনকে তোমার জন্মের খবর দেওয়া যেতে পারে বলে। মাত্র ঊনত্রিশ বছর পর যদি তুমি টাচ স্ক্রিন ফোন, 4G data ব্যবহার করতে পারো তাহলে পঞ্চান্ন বছরে এসব আর এমন অসম্ভব কি!”

“আরে বাবা পঞ্চান্ন বছরে কী পরিবর্তন হয়েছে সে কথা ছাড়ো, আমার তো এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমরা ২০৭৫-এ পৌঁছে গেছি।” বলল রাত্রি। সায়ক ওকে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আকাশ ইশারা করে ওদের চুপ করতে বলল।

“কেউ একটা আসছে।”

ওরা রুদ্ধশ্বাসে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতেই দেখতে পেল একজন বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে। ওর হাঁটা চলা দেখলেই বোঝা যায় ওটা একটা রোবট। আকাশরা বেশ খানিকটা দূরে একটা ঝোপের আড়ালে ছিল বলে রোবটটা ওদের দেখতে পেল না। রোবটটা ওর হাতে কিছু একটা টিপতেই গেটটা খুলে গেল দু’ফাঁক হয়ে। আকাশ উত্তেজিত হয়ে বাকিদের দিকে তাকাতেই সায়ক ওকে চোখ টিপে চুপ করে থাকতে বলল। এবার ওরা দেখল রোবটটা মোটর বাইক টেনে আনল সামনে। যদিও আকৃতি অনেকটাই পাল্টেছে তবুও ওটাকে মোটর বাইক বলে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। রোবটটা বাইকটার মিটারের কাছে কিছু একটা সুইচ টিপতেই আওয়াজ করে উঠল সেটা। আর এদিকে সায়ক মুহূর্তের মধ্যে ওর কর্তব্য স্থির করে ফেলল। সে ইশারায় বাকিদের তার প্ল্যানটা বুঝিয়ে গুটি গুটি পায়ে ঝোপের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তারপর মাটি থেকে একটা পাথর তুলে সোজা টিপ করল রোবটটার মাথায়। যদিও টিপটা মিস হল কিন্তু পাথরটা রোবটটাকে ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে একটা আওয়াজ তৈরি করল। রোবটটা হিসেব মেনেই বাইক ছেড়ে সেই আওয়াজের উৎস সন্ধান করতে এগিয়ে গেল। এই সুযোগে আরেকটা পাথর তুলে বাঁকাবাঁকি ভাবে ছুঁড়ে দিল সায়ক। রোবটটা আরেকটু দূরে সরে গেল তাতে। এবার ক্ষিপ্র গতিতে সায়ক এসে চড়ে বসল বাইকটার ওপর। বাকিরাও ততক্ষণে এসে গাদাগাদি করে বসে পড়েছে পেছনে।

সায়ক দেখল এ বাইকে না আছে চাবি না ক্ল্যাচ, কিছুই নেই। সামনে একটা স্ক্রিনের ওপর রয়েছে কয়েকটা ট্যাব। এসব দেখে সায়কের মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ততক্ষণে রোবটটা এদিকে ঘুরছে তাই আর কাল বিলম্ব না করে start লেখা ট্যাবটায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে বাইকটা হুশ করে চলতে শুরু করে দিল। গতির কারণে ওরা সবাই হাওয়ার মত পেছন দিকে পিছিয়ে গেল, রোমিত বসেছিল সবার শেষে তার প্রায় পড়ে যাওয়ার জোগাড় হল। কোনোক্রমে দাঁতে দাঁত চিপে রোমিত বলল, “প্লিজ স্পিড কমাও।”

“কেমন করে কমাতে হবে কিছুই বুঝতে পারছি না!” চিৎকার করে বলল সায়ক। বাইক ছুটে চলেছে তার দুর্বার গতিতে। আকাশ কী যেন ভেবে বিড়বিড় করে বলল, “মপেড থেকে বাইক হয়েছে কিন্তু সব ফাংশান কি পাল্টেছে কি! তুমি চেষ্টা করো দাদা, নিশ্চয় কিছু না কিছু এক থাকবে।”

আরেকবার ওই স্ক্রিনটার দিকে তাকাল সায়ক, স্টার্ট ট্যাবটা ছাড়া বাকিগুলো সব ধোঁয়াশার মত থেকেছে। এবার সে হ্যান্ডেল দুটোর ওপর ভালো করে হাত বোলাতেই বাম দিকের হ্যান্ডেলটার শেষপ্রান্তে একটা উঁচু মতন কিছু অনুভব করল। মনে মনে একবার ঠাকুরের নাম স্মরণ করে সায়ক ওই উঁচু জায়গাটায় চাপ দিল আর সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা প্রায় থেমে গিয়ে ওরা সবাই হুড়মুড়িয়ে পড়ল সামনের দিকে।

“ইউরেকা! পেয়ে গেছি স্পিড কন্ট্রোলের সুইচ…” সায়ক বুঝতে পারল ওই সুইচটা ঠিক মতো প্রেস করার ওপর গাড়ির স্পিড নির্ভর করছে। সে হাতটা একটু আলগা করতেই গাড়িটার স্পিড আবার বাড়ল খানিক। রোমিত একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বলে উঠল, “যাহ বাবা এতক্ষণে আমার পেছনটা একটু শান্তি পেল।”

সায়ক মাথাটা একটু পেছন দিকে ঘুরিয়ে বলল, “কিন্তু আমার পিঠটা…”

“সায়ক দেখো…” রাত্রির চিৎকারে সামনের দিকে তাকাতেই সায়ক দেখল গাড়ির স্ক্রিনের ওপর ফুটে উঠছে একটা হুড খোলা গাড়ির ছবি। সেই গাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে একটা অস্ত্র তাক করছে সেই রোবটটা।” সম্ভবত এই বাইকটার পেছনে ক্যামেরা লাগানো আছে, আর তাতেই ধরা পড়ছে ওদের তাড়া করার দৃশ্য।

“ওহো, শান্তিতে বসা আমাদের ভাগ্যে নেই…” সায়ক সুইচটার ওপর থেকে আঙ্গুল সরিয়ে ফেলল। বাইকটা আবার দুর্বার গতিতে ছুটতে শুরু করল। এইবার ওরা শক্ত করে ধরেছিল বলে আর ততটা অসুবিধা হল না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রোবটটা গুলি চালাল। প্রথম গুলিটা প্রায় রোমিতের কানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। ভয়ে কেঁপে উঠল সে। সায়ক কোনোক্রমে বাইকের দিক পরিবর্তন করল কিন্তু তাতেও রোবট নাছোড়বান্দা, পরের পর গুলি চালিয়ে যেতে থাকল সে। গুলিগুলো প্রায় ওদের শরীর ঘেঁষে একটার পর একটা বেরিয়ে যাচ্ছিল কোনো মতে। এভাবে কোনদিকে কতক্ষণ ওরা চলছিল তার কোনো হিসেব নেই। এ যেন মনে হচ্ছিল হলিউডি সিনেমায় দেখা দৃশ্য, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলিউডি সিনেমার নায়কের মত সায়কের এই বাইকটা নিয়ে কসরৎ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আনাড়ীর মত এদিক সেদিক বাঁকিয়ে চালাচ্ছিল সে, অবশ্য বাইকটার যা স্পিড, তাতে করে চলছে না বলে উড়ছে বলাই বোধহয় বেশি যুক্তিযুক্ত। যেভাবে ওরা এগোচ্ছিল তাতে করে রাত্রির শুনশান রাস্তা বলেই হয়তো এভাবে এগোনো সম্ভব হচ্ছিল, নয়তো কখন অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সায়ক দেখল সামনেই দুটো মাতাল টলতে টলতে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। সায়ক প্রাণপণে চেষ্টা করল বাইকটা ঘুরিয়ে নেওয়ার কিন্তু গতির কারণে ঘোরাবার আগেই বাইকটা গিয়ে মাতালদুটোর মাঝামাঝি গিয়ে ধাক্কা মারল, লোকদুটো ছিটকে পড়ল রাস্তার দুপাশে। ওদের হাতের বোতল পড়ে গিয়ে খানখান করে শব্দ উঠল। কিন্তু সেই শব্দকেও ছাপিয়ে আরেকটা ফায়ারের শব্দ শোনা গেল, সাথে কিছু বাস্ট করার আওয়াজ।

“সা… সায়ক কী হল?” কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইল রাত্রি। কিন্তু সায়ককে জবাব দিতে হল না, তার আগেই বাইকটা উল্টে পড়ল মাটিতে। কিন্তু থেমে গেল না। ওদের নিয়ে ঘষা খেতে খেতে বাইকটা সামনের একটা বাড়ির কম্পাউন্ডে ঢুকে গেল সোজা। আকাশের শরীরটা ছিটকে গিয়ে লাগল লোহার গেটে। অজ্ঞান হওয়ার আগে আকাশ দেখতে পেল ওই রোবটসুদ্ধ গাড়িটাও ঢুকে পড়ল এই গেটের মধ্যে।

***

দানিশ রাও আর তমসাকে নিয়ে বাড়িটার বাইরে পা রাখা মাত্রই একটা অদ্ভুত রকমের গর্জন কানে এলো। অধীর বক্সি অবাক হয়ে তাকালেন স্যামুয়েলের দিকে, তারও চোখে প্রশ্ন। গর্জনটা আবার ভেসে আসতেই কেঁপে উঠল তমসা, “ওহ মাই গড!”

“কী হল?” জানতে চাইল অধীর বক্সি।

“আমি এই গর্জনটা চিনি। এটা তো সেই ভয়ানক জন্তুগুলোর গর্জন যারা হসপিটালে অ্যাটাক করেছিল।”

“মানে!”

“আমাদের পালাতে হবে এক্ষুণি।” বলল তমসা। সে জানেনা এই লোকগুলো আদপে কে, তবে যেই হোক এই বুড়োটার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক নিশ্চয় হবেনা, সুতরাং ওদের সহযোগিতা করবে বলে স্থির করল তমসা।

কিন্তু তার কথা শুনে হঠাৎ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন দানিশ রাও। এই রাতের নির্জনতায় সে হাসির সঙ্গে দানবের হাসির কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলনা তমসা।

“বুড়োটা হাসছে কেন?” ভ্রূ কুঁচকে বলল স্যামুয়েল।

“আমি… আমি জানি”, তমসা বলে উঠল, “এসব এই বুড়োটার কাজ। ও এই জন্তুগুলোকে তৈরি করেছে। শুধু চড়ুই পাখিটা নয়, তার মানে…” তমসা কথা শেষ করার আগেই কোথার থেকে সেই প্রকান্ড সাইজের চড়ুইটা উড়ে এসে অধীর বক্সির হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল। স্যামুয়েল ওটার দিকে গুলি করতে যেতেই ওটা ক্ষিপ্র গতিতে এমন ডানা ঝটপটিয়ে উঠল যে স্যামুয়েলের হাত থেকেও ছিটকে পড়ল পিস্তলটা। তবুও স্যামুয়েল না দমে হাতটা মুঠো করে পাখিটার উদ্দেশ্যে একটা ঘুঁষি ছুঁড়ে দিল, কিন্তু ঘুঁষিটা পাখিটার গায়ে লাগল না। দানিশ রাও আবার জোরে হেসে উঠলেন, “পিছলে গেল তো! এতদিন ওরা দুর্বল ছিল বলে তোমরা ওদের ওপর অত্যাচার করেছো। এবার দেখো ওদের কাছে তোমরা কতটা অসহায়।”

পাখিটা আবার ঘুরে আসছিল ওদের দিকে কিন্তু তার আগেই কোথা থেকে যেন একটা গুলি এসে লেগে গেল ওটার গায়ে। পাখিটা ডানা ঝটপটিয়ে পড়ে গেল নীচে। রাগে চিৎকার করে উঠলেন দানিশ রাও। দেখলেন কোথা থেকে যেন পাঁচটা রোবট এসে ঢুকে পড়েছে তার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে। ওদের গুলিতেই আহত হয়েছে পাখিটা। অধীর বক্সি এবার দানিশ রাওকে নকল করে হেসে বললেন, “অর্শিয়া আন্দাজ করেছিল এরকম কিছু হতে পারে, তাই তো এদের সঙ্গে পাঠিয়েছিল।”

“অর্শিয়া সেন…” বিড়বিড় করল দানিশ রাও, “সেই রোবটিক্স নিয়ে একটার পর একটা ফালতু এক্সপেরিমেন্ট করা মেয়েটা!”

“কতটা ফালতু সে তো দেখতেই পাচ্ছ, যদি বেঁচে থাকো আরও অনেক কিছু দেখবে। এখন চলো…” দানিশ রাওয়ের ঘাড়ের কাছে ধাক্কা মারল অধীর বক্সি। দানিশ রাও হুড়মুড়িয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেও নিজে থেকে নড়ল না এক পা।

“খেলা এখনও শেষ নয়।” এই বলে মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করল সে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই গর্জনের তীব্রতা অনেক বেড়ে গেল। তারপরেই বাড়ির বাম পাশটা প্রচণ্ড জোরে কাঁপতে শুরু করল।

তমসা ব্যাপারটা আন্দাজ করে চিৎকার করে উঠল, “পালাও…”

হতভম্ব অধীর বক্সি আর স্যামুয়েল পালাবার আগেই ওপাশ থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো প্রায় সাত আটটা অতিকায় জন্তু যাদের তমসা দেখেছিল সেই হসপিটালে। অধীর বক্সি এদের কথা আগে শুনলেও চাক্ষুষ করল এই প্রথম। আতঙ্কে সে দানিশ রাওয়ের জামার কলার ছেড়ে ছুটে পালাতে যেতেই একটা জন্তু এসে তার ঘাড় খামচে ধরে তাকে শূন্যে তুলে ফেলল। মৃত্যুভয়ে চিৎকার করে উঠল অধীর বক্সি। রোবটগুলো জন্তুটাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। কিন্তু সব গুলিই ওটার চামড়ায় লেগে ছিটকে বেরিয়ে যেতে থাকল। এই সুযোগে অন্য জন্তুগুলো ধেয়ে গেল রোবটগুলোর দিকে। দানিশ রাও আত্মতৃপ্তিতে চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু অন্যদিকে তমসা আর স্যামুয়েল ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল কিন্তু আচমকা একটা কিছু এসে সজোরে ধাক্কা মারল ওদের। ওরা হুড়মুড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল নীচে। উঠতে গিয়ে তমসা অবাক হয়ে দেখল সায়ক, রাত্রি আর রোমিত একটা বাইকের সঙ্গে ঘষা খেতে খেতে ঢুকে পড়েছে গেট দিয়ে, আর তমসারা ওদের সঙ্গেই ধাক্কা খেয়েছে। এতটা পথ ঘষা খাওয়ার ফলে ওদের শরীরের চামড়া ছেড়ে রক্ত বেরোচ্ছে গলগল করে। ওরা আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা গাড়ি এসে ঢুকল ভেতরে। স্যামুয়েল বিড়বিড় করে উঠল, “অর্শিয়া!”

“সেটা কে?” জানতে চাইল তমসা। জবাব দিল না স্যামুয়েল।

***

না-মানুষ আর যন্ত্র-মানুষের অদ্ভুত লড়াইতে এই মুহূর্তে কাঁপছে গোটা এলাকা। গেটের খুব কাছে বিক্ষিপ্ত হয়ে বসে রয়েছে ওরা পাঁচজন। শরীরগুলো আঘাতে আঘাতে এতটাই বিধ্বস্ত যে উঠে পালাবার শক্তি নেই কারুর। ওদের থেকে একটু দূরেই পড়ে রয়েছে অধীর বক্সির দেহটা। যে লোকটাকে খুঁজতে গিয়ে ওদের জীবনে এতো বড় বিপর্যয় নেমে এলো সেই লোকটা আজ ওদের কাছে থাকা সত্ত্বেও ওরা তার কাছে যাওয়ার আর কোনো তাগিদ অনুভব করছে না। লোকটা বেঁচে আছে না মারা গেছে সেটুকুও বোঝা যাচ্ছে না। অর্শিয়া কোনদিনও ভাবেনি দানিশ রাওয়ের সঙ্গে এমন সম্মুখ সমরে। সে চিরকাল বুদ্ধির লড়াইতে হারাতে চেয়েছে লোকটাকে কিন্তু আজ কাকতলীয় ভাবে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে। এতগুলো ভয়ঙ্কর জন্তু দাঁড়িয়ে তার সামনে, এরা প্রত্যেকে একসময় আমাদের অতি পরিচিত নিরীহ গৃহপালিত পশু ছিল আর আজ রাও এদেরকে দৈত্যে পরিণত করেছে। ভাবা যায় শহরের ওই ভয়ঙ্কর আক্রমণগুলো সব এই শয়তান বুড়োটার কীর্তি! জন্তুগুলোকে এতো শক্তিশালী করে তুলেছে সে যে অর্শিয়ার এতো উন্নত রোবটগুলো অবধি তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেনা ঠিক করে। গুলিতে কাজ না হতে অর্শিয়ার নির্দেশে রোবটগুলো এবার অন্য একখানা অস্ত্র দিয়ে আগুনের গোলা ছুঁড়ছে তাদের দিকে। কিন্তু তাতেও দমানো যাচ্ছেনা ওদের। জন্তুগুলোর এক একটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে লালা বেরিয়ে আসছে বাইরে তাতে করে রোবটগুলোও যেন দিশেহারা হয়ে পড়ছে। ঘরের মূল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দানিশ রাওয়ের মুখে লেগে আছে অদ্ভুত একটা হাসি, একটা তৃপ্তির হাসি। অর্শিয়া এক কোণে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল লোকটাকে, এবার সে সন্তর্পণে এগিয়ে গেল তার কাছে। দানিশ রাও চমকে উঠলেন। একটা বাঁকা হাসি হেসে অর্শিয়া ওর হাতের বন্দুকটা তাক করল দানিশ রাওয়ের দিকে, “ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে বোঝাপড়াটা অন্যভাবে করব। যে আবিষ্কারের জন্য আমার স্বামীকে তুমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে সেই আবিষ্কার দিয়েই তোমায় ঘায়েল করব। কিন্তু আজ পরিস্থিতি অন্যরকম, তাই এই নাও…” ট্রিগারে চাপ দিল অর্শিয়া। কিন্তু গুলিটা বেরিয়ে বৃদ্ধকে বিদ্ধ করার আগেই একটা জন্তু হাতের মুঠোয় তুলে নিল অর্শিয়াকে। গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাগল দানিশ রাওয়ের পায়ে, গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো। উল্টে পড়লেন দানিশ রাও। আর অন্যদিকে জন্তুটার হাতের চাপে ছটফট করতে লাগল অর্শিয়া। জন্তুটার অন্যমনস্কতার সুযোগে একটা রোবট এগিয়ে এসে জন্তুটার তল পেট লক্ষ্য করে আগুনের গোলা ছুঁড়ে দিল। নরম জায়গায় আঘাত লাগতেই ছটফট করে উঠে জন্তুটা অর্শিয়াকে ফেলে দিল মাটিতে, তারপর খপ করে রোবটটাকে ধরে তুলে নিল। রোবটটার হাতের অস্ত্রটা জন্তুটার লালা লেগে অকেজো হয়ে গেল। জন্তুটা এক টানে রোবটটার একটা হাত খুলে ছুঁড়ে ফেলল। মাটিতে পড়ে কাতরাতে কাতরাতেই অর্শিয়া বুঝলো রোবটগুলোর বাঁচার আর উপায় নেই। শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে এবার। রোবটটাও হয়তো বুঝতে পেরেছিল তার শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে, তাই সে নিজেকে প্রস্তুত করতে কয়েক সেকেন্ড নিল। আস্তে আস্তে রোবটটার শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করল। হতভম্ব জন্তুটা ব্যাপারটা টের পেতে পেতেই সশব্দে ব্লাস্ট করল রোবটটা। জলন্ত ধাতব যন্ত্রাংশের সঙ্গে সঙ্গে একটা জন্তুর শরীরও ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ল চতুর্দিকে। চোখ বন্ধ করে ফেলল অর্শিয়া। নিজের প্রিয় পোষ্যের পরিণতিতে পায়ের ক্ষতস্থান চেপেই বিলাপ করে উঠলেন দানিশ রাও। বাকি জন্তুগুলোও এই প্রচণ্ড শব্দে হতভম্ব হয়ে যেন লড়াই করতে ভুলে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু এসবের মাঝেই আচমকাই একটা রোবট এগিয়ে এসে আরেকটা জন্তুর তলপেট লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে দিয়েই পালাতে গেল, পারল না। জন্তুটা হাতের মুঠোয় ধরে নিল রোবটটাকে। এই রোবটটারও শরীরের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করল…

মাটিতে শোয়া অবস্থাতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্শিয়া। তার বানানো যন্ত্র মানবেরা তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। ওদের প্রোগ্রামিংয়ে এমনটাই তো নির্দেশ দেওয়া আছে--- যখন পরাজয় নিশ্চিত তখন শত্রুকে সঙ্গে নিয়ে নিজেকে শেষ করে দাও। আত্মঘাতী রোবট ওরা। এছাড়া ওই জন্তুগুলোর হাত থেকে বাঁচার আর উপায় নেই।

***

চারিদিকে ধিকধিকি করে আগুন জ্বলছে, ধাতু আর চামড়া পোড়ার গন্ধ একসাথে। পরপর এতগুলো ব্লাস্টে সবার শরীরে আঘাত লেগেছে বিভিন্নভাবে। এখনও একটা জন্তু রয়ে গেছে জীবিত, কিন্তু তার শরীরেও আঘাত লেগেছে। দানিশ রাও মুখ থেকে অদ্ভুত শব্দ করে জন্তুটাকে কিছু একটা নির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু জন্তুটাকে আর নির্দেশ পালন করতে হল না। তার আগেই সাইরেন বাজাতে বাজাতে কয়েকটা গাড়ি এসে দাঁড়াল গেটের সামনে। সেই গাড়ি থেকে দল বেঁধে ইউনিফর্ম পরা কিছু লোক অস্ত্র হাতে নেমে এলো। তাদের সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলেন প্রোফেসর রায়। সায়ক তাঁকে দেখেই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। প্রোফেসর এসে সায়ককে ধরে তুললেন মাটি থেকে। তারপর উর্দিধারী একজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “বলেছিলাম না মিস্টার পল এখানে কিছু গন্ডগোল আছে।”

“কিন্তু আপনি কী করে জানলেন আমরা এখানে বলে?” জিজ্ঞেস করল সায়ক।

প্রোফেসর রায় হেসে বললেন, “থ্যাংক্স টু রোজ। তোমাকে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় ও তোমার প্যান্টের পকেটে একটা জিপিএস ট্র্যাকার আটকে দিয়েছিল তোমার অজান্তেই। বাট প্রথমে ভ্যাংকার্সরা তোমাদের এমন কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল তখন তোমার কোনো ট্রেসই পাচ্ছিলাম না। তারপর জখম পেলাম তোমার লোকেশন বারবার চেঞ্জ হচ্ছিল জিগজ্যাগ ওয়েতে, দেন এই লোকেশনে স্থির হল।”

“থ্যাংক ইউ সো মাচ স্যার।”

“আরে ইটস ওকে। আর ভয় পেয়ে কাজ নেই। TECT পৌঁছে গেছে। তোমাদের জন্যই আজ এই সারা শহরে ত্রাস সৃষ্টি করা জন্তুগুলো ধরা পড়ল। ভাবতে পারছি না প্রোফেসর রাওয়ের মত একজন মানুষ এরকমটা করতে পারেন বলে। উনি তো জেনেটিক্স নিয়ে গবেষণা করছিলেন!”

“এই লোকটা একটা বদ্ধ পাগল”, বলে উঠল তমসা, “ও সম্ভবত এই সরীসৃপ প্রাণীগুলোর জিনে কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে আর কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে এই দানব আকৃতির করে তুলেছিলেন যাতে এরা মানুষের চেয়েও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে।”

সায়ক এক এক করে বাকি সবার সঙ্গে প্রোফেসর রায়ের পরিচয় করিয়ে দিল। ওই TECT এসে দানিশ রাও আর অর্শিয়াকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। জন্তুটাকেও নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল।

***

দানিশ রাও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য সেদিনই মারা গেছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা গিয়েছে লোকটা নাকি নিজের শরীর নিয়েও কিছু এক্সপেরিমেন্ট করছিল, ওর জিনে অদ্ভুত কিছু এলিমেন্ট পাওয়া গিয়েছে। অর্শিয়া রয়েছে পুলিশি হেফাজতে। এদিকে প্রোফেসর রায় কিভাবে যেন ওই ইমারজেন্সি কন্ট্রোল টিমকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ওদের ছয়জনকে নিজের কাছেই রেখেছেন। ওদের চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেছেন। । প্রোফেসরের কাছ থেকেই ওরা অর্শিয়া সেনের সম্পর্কে জানতে পারল। ওই মহিলার ব্যাপারে সবটুকু জেনে একই সঙ্গে ভালো আর খারাপ লাগছিল ওদের। প্রোফেসর বলেছেন স্যামুয়েলকেও ঠিক করার চেষ্টা করবেন।

“দানিশ রাও লোকটাকে আমাদের কারুরই ঠিক ভালো লাগত না ওর ব্যবহারের জন্য কিন্তু লোকটার যে এরকম মানসিক বিকৃতির শিকার তা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাইনি কোনোদিন।” আফসোসের সুরে বললেন প্রফেসর রায়। দানিশ রাও বা অর্শিয়া সেনকে নিয়ে রোমিতদের যত না আগ্রহ ছিল তারচেয়েও বেশি কৌতুহল হচ্ছিল অধীর বক্সিকে নিয়ে। ভাবা যায় অতীত থেকে এসে এখানে এমন সব কান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল লোকটা!

“একটা ব্যাপারে অদ্ভুত লাগছে না তোমাদের, এই অন্য সময়ে এসে আমাদের এত প্রবলেমে পড়তে হল আর ওই বক্সি কেমন বহাল তবিয়তে ছিল এখানে।” গোগ্রাসে কাপ নুডলস গিলতে গিলতে কথাগুলো বলল রোমিত। প্রোফেসর রায় হেসে বললেন, “বহাল তবিয়তে কি আদৌ ছিল!”

“কেন?”

“অর্শিয়া কোনোভাবে ওর সন্ধান পেয়ে ওকে ব্যবহার করছিল নিজের স্বার্থে। বেশ কয়েক বছর ধরে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে নামি দামি জিনিসপত্র চুরি যাচ্ছিল, অথচ চোরের কোনো ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন কোড ট্রেস করা যাচ্ছিল না। আসলে অর্শিয়া অধীর বক্সিকে দিয়ে এইসব চুরিগুলো করাতো। ও গোপনে যে গবেষণা করছিল তার জন্য তো কোনো সরকারি সাহায্য পেত না, অথচ এই ধরণের গবেষণা ভীষণ রকমের ব্যয়বহুল। তাই চুরি করে অর্থের সংকুলান করতে হচ্ছিল।” একটানা কথাগুলো বলে দম নিলেন প্রফেসর রায়।

“সে যাই করুক, আজ ওই লোকটার জন্য আমরা এমন অন্য সময়ে এসে ফেসে গেলাম!” দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাত্রি।

সায়ক ওর মাথা চুলকে প্রফেসর রায়কে বলল, “আচ্ছা আপনি যে বলছিলেন ব্ল্যাক ম্যাজিক আর সায়েন্স মিশিয়ে নাকি কিসব গবেষণা হচ্ছে সেরকম কিছু তো দেখলাম না!”

সায়কের প্রশ্নে মুচকি হাসলেন প্রোফেসর, তারপর বললেন, “এইটুকু সময়ের মধ্যে কতটুকুই বা কী দেখেছো তোমরা!”

“আমি আর দেখতেও চাই না”, বলে উঠল আকাশ, “আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।”

প্রোফেসর আকাশের মাথায় হাত রেখে বললেন, “চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে তোমাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করতে পারি।”

“কিন্তু যতদিন না ফিরতে পারছি ততদিন কি হবে আমাদের?” জানতে চাইল রাত্রি, তমসা সঙ্গে যোগ করল, “আমাদের তো আবার ওই UIC নেই। ধরা পড়ে যাই যদি।”

নিজের স্মার্ট ব্যান্ডের স্ক্রিনের দিকে তাকাতে তাকাতে প্রোফেসর রায় বললেন, “চিন্তা কী আমি তো আছি। কটা দিন নাহয় আমার সঙ্গেই কাটাও।”

রিস্ট ব্যান্ডের স্ক্রিনে তখন ফুটে উঠছে সেদিনের বিশেষ সংবাদ...

“UIC বিহীন কুখ্যাত চোর গুরুতর আহত অবস্থায় কিছুদিন আগেই ধরা পড়েছিল TECT এর হাতে, আজ তার মৃত্যু হয়েছে। জানা যাচ্ছে ওই ব্যক্তির নাম অধীর বক্সি, কিন্তু তিনি কিভাবে এলেন কোথার থেকে এলেন এই ব্যাপারে কোনো তথ্য জানা যায়নি…”

খবরটা পড়তে পড়তে প্রোফেসর রায় আড়চোখে দেখলেন অতীত থেকে আসা ছেলেমেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। ওদের দেখে মুহূর্তের জন্য একটা রহস্যময় হাসি তাঁর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল গোঁফ দাড়ির জঙ্গলে।