আয়ুমু - সৌরভ ঘোষ

গল্প

“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।”

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘প্রশ্ন’, পৌষ, ১৩৩৮)

সাল ২০৭৫ (মেনিস-১ বস্তি, পূর্ব-এশিয়ার একফালি ভূখন্ড)

এক অদ্ভুত নেশায় বুঁদ হয়ে আছে মানবসভ্যতা। এই নেশা মদ নয়, গাঁজা কিংবা কোনও সাইকাডেলিক ড্রাগ নয়। আফিমের থেকেও বিপজ্জনক এই নেশার উপাদান “অলীক বাস্তব”। কল্পনায় ডানা মেলার এই নেশা যুবক থেকে যুবতি, আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মধ্যে নানা রঙের রঙিন স্বপ্নের ঝড় তুলতে সক্ষম। ছোট্ট চালের দানা সদৃশ ক্যাসেট, শরীর সংলগ্ন স্নায়বিক সংযোগ স্থাপনকারী নিউরালিঙ্ক নামক চৌকো নক্সা করা যন্ত্রে পুরে দিতে হয়। অনেকটা হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ দিয়ে চামড়া ফুঁড়ে ড্রাগ নেওয়ার মত। তারপর দু-চোখে স্থাপন করতে হয় ডিজিটাইজড লেন্স আর দু-কানে মটর দানার মত ছোট দুটো ইয়ার প্লাগ। সে দুটোর মধ্যে দিয়ে এই ক্যাসেট নিয়ে যায় বহু আকাঙ্ক্ষিত আমাদের বাস্তবিক জগতের মতই ত্রিমাত্রিক এক অলীক স্বপ্নরাজ্যে, সব পেয়েছির দেশে। যেখানে সব স্বপ্নই সত্যি কিন্তু সে জগতের কিছুই মানুষ ছুঁতে পারে না। অলীকের সঙ্গে বাস্তবের এটাই একমাত্র ফারাক স্বপ্নের দেওয়াল পেরিয়ে আমরা অলীককে ছুঁতে পারি না।

ইতিকথা-১ (সাল ২০৪৫): বিশ্বব্যাপী জনবিস্ফোরণের ফলে পণ্য চাহিদার অতিমাত্রায় ক্রমান্বয়িক বৃদ্ধি ঘটে। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সমঝোতা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ অরণ্য। চেরনবিল অধ্যুষিত অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান বিকিরণ মাত্রা এবং প্রতি বছর ০.৮ শতাংশ হারে ওজোন স্তরের ক্রমান্বয়িক হ্রাস নিয়ে ধুঁকছে পৃথিবী। নদীখাত এবং ভূমধ্যস্থ পরিবেশের জলবায়ুতে বেড়ে উঠছে রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থের যান্ত্রিক রক্তবমি। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার পরিমার্জিত দূষণ সতর্কীকরণ বিধি না মেনেই সারা বিশ্বে পরিবেশ দূষণের (Air quality index PM 1.2-তে এসে ঠেকেছে) মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সবকটা দেশ একই দোষে দুষ্ট হলেও রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তি সম্মেলনে জি৭ (G7) রাষ্ট্রশক্তি আঙুল ওঠায় পূর্ব এশিয়ার দিকে। কারণ এরই কিছু আগে সারা বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী অতিমারির প্রকোপ সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠতে বিশ্বের সমস্ত দেশের প্রায় দুবছর সময় লেগেছিলো। তারওপর সমগ্র বিশ্বে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ে পলি পড়তে লেগেছে আরও সাতটা বছর। পূর্ব এশিয়া থেকে আগুনের ফুল্কির মত ছড়িয়ে পড়া এই মহামারীকে “চক্রান্ত” হিসেবে দাগিয়ে আমেরিকা এবং ইউরোপ রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিল। তাই পুরনো প্রতিহিংসার আগুনকে আরেকবার উসকে দিয়ে তারা হিটলারের অনুকরণে বলে, “Asians are undoubtedly a race. But they are not human.” জি৭ (G7) রাষ্ট্রশক্তির জোটে থাকা এশিয়ার প্রতিনিধি দেশ জাপান অবশ্য এই ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। রাজনীতির অন্য নাম যে “বিশ্বাসঘাতকতা” আর ক্ষমতার লোভ যে তার অনুষঙ্গ সেটা উপলব্ধি করতে জাপানের অনেকটা দেরী হয়ে গেছে তখন।

সময়ের চোরা স্রোতে এই নেশা ধাপে ধাপে অনেকখানি প্রসারিত হয়েছে এবং বর্তমানে সে আরও বেশী বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে মানুষের কাছে। প্রথম দিকে মানসিক ভারসাম্য স্থির রাখতে এই নেশার শরণাপন্ন হত যুদ্ধ ফেরত সীমান্তরক্ষীরা। তারা তাদের মনের রসনা, অতৃপ্ত চাহিদা খুঁজে পেত অলীক বাস্তবের অনুরতিতে।

ইতিকথা-২ (সাল ২০৫৫): এশিয়ার বেশ কিছু দেশের প্রযুক্তিগত ও দ্রুত বাণিজ্যিক উন্নতি রুখতে জি৭ (G7) রাষ্ট্রশক্তির হাজারো চেষ্টা বিফল হয়। এই বাণিজ্যিক অসন্তোষ ধীরে ধীরে ছাইচাপা আগুনের মত ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনার আভাস দিতে শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধের প্রাচীন ইতিহাসের মতই বন্ধু রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তির মাধ্যমে অক্ষশক্তি গঠনে সচেষ্ট হয়। ক্রমান্বয়িক জনবিস্ফোরণ এবং পৃথিবী জুড়ে ঘটতে থাকা অরণ্যের দাবানলে শুধু পশুপাখি নয়, গৃহহীন হয়ে পড়ে ভিন্ন উপজাতির প্রচুর আদিবাসী মানুষ। সাম্প্রদায়িকতা, দেশ-কালের মানচিত্র, ভাষাভাষী, বর্ণভেদ ভুলে সমস্তকিছু একাকার হয়ে যায় ধরিত্রী বক্ষে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তখন প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছে। ধনী হয়েছে আরও ধনী, প্রভাবশালী আর গরিব চির হতভাগ্য, কপর্দক শূন্য। পৃথিবীর বুক চিরে বেঁচে থাকা বাসভূমিগুলো ভাগ হয়েছে বড় বড় বস্তিতে। এক একটা দেশ গড়ে উঠেছে বেশ অনেকগুলো বিশালায়তন বস্তির সমষ্টিতে। আর সেই বস্তিগুলোর প্রত্যেকটা গড়ে উঠেছে ধনীদের বসবাস যোগ্য ‘রেসিডেন্স কাউন্সিল’ এবং তার চারপাশে তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গরিব, নিরীহ মানুষের আশ্রয়স্থল, একাধিক ত্রাণশিবিরে। সেই ত্রাণশিবিরে ভিড় করেছে সভ্য মানুষের পাশাপাশি অরণ্য থেকে উৎখাত হওয়া আশ্রয়হীন ভিন্ন উপজাতির বহু মানুষ। এরই মধ্যে প্রভাবশালী আমেরিকা ও ইউরোপ বিশ্বব্যাপী দূষণ প্রতিরোধে রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে “কোড গ্রীন” নামের নতুন এক সংগঠনের প্রস্তাব রাখে। রাষ্ট্রপুঞ্জ অনুমোদিত মোট ২০টি সচল সংস্থা (বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, বিশ্বশ্রম সংস্থা ইত্যাদি) এর সঙ্গে “কোড গ্রীন”কেও তালিকা ভুক্ত করা হয়। ’কোড গ্রীনের’ আর্থিক ও পরিকাঠামোগত সাহায্যের দায়ভার গ্রহণ করে জি৭ (G7) রাষ্ট্রশক্তি। ধাপে ধাপে শুরু হয় এশিয়ার ওপর কোড গ্রীনের শাসনতন্ত্র। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য দূষণ প্রতিরোধ হলেও এর আসল উদ্দেশ্য ধুঁকতে থাকা মানবসভ্যতা তার দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। মানুষের থেকে প্রথমে তারা কেড়ে নেয় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক অধিকার, তারপরে সামাজিক অধিকার এবং সব শেষে জীবন যুদ্ধের একমাত্র সম্বল “ভাষার অধিকার”, কথা বলার সাচ্ছন্দ্য। কড়া হাতে শুরু হয় তীক্ষ্ণ নজরদারি। সরকারি আইনি শাসনকর্তা ছাড়া সাধারণ মানুষের কথোপকথনে এল বিধি নিষেধ। উচ্চারিত কোনও শব্দ বা বাক্যে “সরকার” বা সরকার সম্বন্ধীয়, “বৈজ্ঞানিক গবেষণা” বা “কোড গ্রীন” অথবা “উন্নয়ন”, “বিপ্লব” সংক্রান্ত শব্দবন্ধের ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। বন্ধ করা হল বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক ভাবনা চিন্তার আদান প্রদান। শুরু হল একাকীত্বের দীর্ঘ নিঃশ্বাসে এক অন্ধকার সময়। মানুষে মানুষে পারস্পরিক কথোপকথনের প্রচলন বন্ধ করে সমস্ত ভাষা ও যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ে আসা হল অান্তর্জালের বিভিন্ন মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে যাতে সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাটাই কোড গ্রীনের নজরবন্দী থাকে। রাস্তাঘাট, শহর, বন্দর, স্কুল-কলেজ, অফিস সর্বত্র বসানো হল কোয়ান্টাম সেন্সর লাগানো ট্রান্সিভার অ্যান্টেনা। যা দূর দূরান্ত থেকে আসা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শব্দতরঙ্গকে বন্দী করে পৌঁছে দেবে কোড গ্রীনের বেতার তরঙ্গ গবেষণা কেন্দ্র ও আইনরক্ষক সংস্থার কাছে।

বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে যে সমস্ত তরতাজা শিরদাঁড়াগুলোকে কোড গ্রীনের প্রশাসন এতদিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে তাদেরই জীবনযুদ্ধে সস্তার জ্বালানি হিসেবে কাজ করে অলীক বাস্তবের এই ক্যাসেট। এরপর নেশার ঘোর কেটে স্বপ্ন দেখার পালা শেষ হলে নিউরালিঙ্ককে একবার ফ্লাশ করলেই ঠিক টেপরকর্ডারের ক্যাসেটের মত এই ক্যাসেটও যন্ত্র থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। যৌনতা থেকে সুখিগৃহকোণ, অলীক বাস্তবের এই ক্যাসেট বোবা মানুষের রাক্ষুসে মানসিক খিদেকে ক্রমশ বাড়িয়েই চলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

ভাষা এবং কথোপকথনে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সেনাবাহিনী বাহিত সেই নেশা ঢুকে পড়ল সাধারণ মানুষের গেরস্থালীতে। সস্তা নেশার মত এই ক্যাসেটের অত্যধিক ব্যবহারে মানুষ হারিয়ে ফেলতে লাগল তার মানসিক ভারসাম্য। বাস্তব এবং কল্পনার ফারাক করতে সে অপারগ হয়ে পড়ল। বাস্তবিক জীবনে বাস করেও সে যে তার অলীক বাস্তবকে আর ছুঁতে পারছে না সেই মৃত্যুব্যাধিই তাকে গ্রাস করল ক্রমশ। সেই আক্ষেপে অতর্কিতে তাই আত্মহত্যাকেই মানুষ নিজের জীবনের শেষ মাপদন্ড হিসেবে গ্রহণ করে নিতে লাগল। আত্মহনন প্রথমে শুরু হয়েছিল গোপনে, তারপর সংখ্যাবৃদ্ধিতে এখন শুরু হয়েছে প্রকাশ্যে। গণ আত্মহত্যার এই মৃত্যুমিছিল, অকাল মৃত্যুছায়া যে কোনো সভ্যতার কাছেই এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ।

মৃত্যুমুখী এই নেশাকে রোখার রাস্তা একটাই। মানুষের জন্মগত অধিকারকে ফিরিয়ে দেওয়া, ভাষার পুনঃপ্রচলন। মানুষের জীবনের গোপনীয়তার প্রয়োজন, মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশার প্রয়োজন এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রয়োজন—এই সবকিছুকে মাথায় রেখে সরকারি নজরদারি বন্ধ করা দরকার। কিন্তু তাতে কোড গ্রীনের স্বার্থ সিদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটবে, তাই সরকারও এ ব্যাপারে নীরব। এই পরিস্থিতি যে মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর তা নিশ্চিত। এরকম অন্ধকার সময়ে মূক সভ্যতার জন্য এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন যে সরকারের দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে বলবে—‘রাজা তুই সত্যিই উলঙ্গ’।

সাল ২০৭৫, কাউন্সিল অব জাস্টিস, মেনিস-১, পূর্ব-এশিয়া

—“ছোকরার কোনও খবর পেলে? নাকি এমনি এমনিই ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছ এখনও?” ক্ষুব্ধ স্বরে প্রশ্ন করেন কোড গ্রীনের স্বরাষ্ট্রসচিব জেনারাল অ্যাস্মোডিয়াস। বিগত ২০ বছর ধরে মেনিস-১ তাঁরই নেতৃত্বাধীন। কোড গ্রীনের ধীর পায়ে বেড়ে ওঠা স্বৈরাচারী শাসনতন্ত্রের একজন ধারক ও বাহক তিনি।

—“স্যার পুরোপুরি খবর না পেলেও একটা ক্লু আমরা পেয়েছি। সেই মত ফাঁদ আমাদের তৈরিই আছে। এবার শুধু শিকারের অপেক্ষায়। এর মধ্যেই আমরা বেশকিছু সন্দেহজনক চোরা ক্যাসেটের ক্যারাভান সিল করেছি...” দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে বছর পঁয়ত্রিশের যুবক, ইন্সপেক্টর লেভিড। লেভিড মেনিস-১ এর প্রধান আইনরক্ষক। সে একজন তেজিয়ান সরকারী চাকুরে। তার জোয়ান শরীরে বয়ে যাওয়া টাটকা, তাজা রক্ত জল হয়ে গেলেও প্রভুর প্রতি নেমকহারামি সেই রক্তবিন্দুতে নেই। বরং সরকার প্রদত্ত নেমকের হক আদায় এবং সুনিপুণ সরকারী চাটুকারিতা তাকে এত অল্প সময়েই এনে দিয়েছে প্রধান আইন রক্ষকের পদ।

—“আহাম্মক! তাতে হবেটা কি?” চেঁচিয়ে ওঠেন জেনেরাল অ্যাস্মোডিয়াস, “তুমি কি এখনও এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারছ না লেভিড? কোড গ্রীনের আইন রক্ষক অথরিটি আর ওপরতলার কাউন্সিলগুলোর থেকে চাপ আসছে। যেরকম করেই হোক ওই ছেলেটাকে আমাদের জ্যান্ত চাই। ওর বাপটার সঙ্গে ওকেও পিছমোড়া করে বেঁধে আনা হয়েছিল। তারপর সিকিউরিটির চোখে ধুলো দিয়ে ব্যাটা... যাকগে ধরা তো একদিন না একদিন পড়তেই হবে। পিঁপড়ের মত পিষে মারব তখন।” হাতের মুঠোটা শক্ত করে ইলেক্ট্রিক সিগারেটে একটা সুখ টান দেন অ্যাস্মোডিয়াস। রাগে মাথার চুলের ভেতর হাতের তেলোটা ঘষে নেন একবার। তারপর ঠোঁটের কোণে একটা বিকৃত হাঁসি টেনে বলেন, “ওর বাপের যা হাল করেছি তারপরেও শুয়োরটার শিক্ষা হয়নি। ‘বিপ্লব’... ‘বিপ্লব’! কী হবে বারবার একই তামাশা করে? সেই তো মশা-মাছির মত মরবে। তবুও কথা বলার অধিকার ওরা পাবে না... কখনই না।” এরপর কী এক আশঙ্কায় ভুরু দুটো একটু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেন, “শেষ এক সপ্তাহের কোয়ান্টাম সেন্সরের রিপোর্ট দেখে কী মনে হচ্ছে তোমার...? কোনও দলবাজি বা ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছ?”

—“স্যার আমরা সন্দেহ করছি কয়েকটা ক্যাসেটের ক্যারাভানে ছোকরার যাতায়াত ছিল। সেন্সর রিপোর্ট সেইরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই দেখুন, এটা বিগত এক সপ্তাহের সেন্সর রিপোর্টের সামারি।” গম্ভীর মুখে লেভিড তার হাতের লেজার পয়েন্টারটা শূন্যে ভাসমান একটা ডিজিটাল পর্দার ওপর ফেলে। সেটায় মেনিস-১ এর ভৌগোলিক মানচিত্রের স্থান বিশেষে সেন্সর ইউসেজ এবং তার পরিসংখ্যান চিহ্নিত করা আছে। লেভিড বলতে থাকে, “এই দেখুন বিগত এক সপ্তাহে আমরা প্রায় এগারো বার আন-ওয়ান্টেড সিগন্যাল পেয়েছি। যেগুলোয় কোনোরকম সিকিউরিটি সার্টিফিকেট নেই। যার ভেতর ছ’টা খুব জোরালো আর পাঁচটা মাঝারি ফ্রিকোয়েন্সির। যে ছ’টা জোরালো সিগন্যাল আমরা পেয়েছি তার মধ্যে চারটে এসেছে ‘রেসিডেন্স কাউন্সিল’ থেকে। গত সপ্তাহে আপনার আদেশে আমরা দুজন ধনী ব্যবসায়িকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় কথা বলার অনুমতি দিয়েছিলাম। তাই এই চারটে সিগন্যাল নিয়ম ভাঙলেও এদের ফ্রিকোয়েন্সি সোর্স আমাদের পরিচিত।”

—“ঠিক আছে... ঠিক আছে। আর বোঝাতে হবে না। আমি চিনি ওদের। ওরা হাইয়েস্ট কাউন্সিলের পরিচিত, আমার বন্ধু। বাকিগুলো বল,” উত্তেজিত হয়ে ওঠেন অ্যাস্মোডিয়াস।

—স্যার বাকিগুলোর প্রায় সবকটাই এসেছে “রেসিডেন্স কাউন্সিল”কে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ত্রাণ শিবির থেকে। এই সিগন্যালগুলোর প্রায় প্রতিটাই আমরা ডিকোড করে ভয়েস ম্যাচ করিয়েছি। রিপোর্ট বলছে ছোকরার গলার স্বরের সঙ্গে এর ৮০ শতাংশ মিল রয়েছে। এমনকি স্যাটেলাইট ট্র্যাকারে ট্র্যাক করে আরও গভীরে আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি এই সিগন্যাল সোর্সগুলোর মধ্যে একটা সাধারণ যোগসূত্রও আছে। প্রত্যেকটা সিগন্যালের কাছে-পিঠের এলাকায় একটা করে চোরা ক্যাসেটের ক্যারাভ্যান আছে। যেখান থেকে গোপনে ক্যাসেট বিক্রি হয়। তাই আমরা তাদের মধ্যে কয়েকটা ক্যারাভ্যান...” মুখের কথা শেষ হয় না লেভিডের।

—“গলার স্বরের মিল যে পাওয়া যাবে সেটা জানা কথা। ওই শুওরটা ছাড়া এত দুঃসাহস আর কার হবে?” রাগে হিসহিসিয়ে ওঠেন অ্যাস্মোডিয়াস। “আচ্ছা লেভিড... ক্যাসেট ফেরিওয়ালাগুলোকে প্রশ্ন করেছিলে?”

—“হ্যাঁ স্যার!” বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নাড়ে ইন্সপেক্টর লেভিড। বলে, “ওদের বেশির ভাগই রুগ্ন, দুর্বল। সাত চরেও রা কাটে না। সবকটা ওই আশেপাশের ধুঁকতে থাকা ত্রাণ শিবিরের বাসিন্দা। আগে কারখানার শ্রমিক ছিল। দূষণ রুখতে বহুদিন আগে ত্রাণ শিবিরগুলোর অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ক্যারাভানে করে চোরাগোপ্তা এই ক্যাসেট বেচেই এরা সংসার চালাচ্ছে। ওরা জানায় ইদানীং কোনও জটলা বা দলবাজি ওদের চোখে পড়েনি। এমনকি কারুর কথা বলার কোনও বিশেষ জোরালো শব্দও তাদের কানে আসেনি। তবে ছোকরার ব্যাপারে কেউ কিছুই বলতে পারেনি তখন।”

—“তাহলে তুমি সন্দেহ করছ কিভাবে? পরের দিকে ছেলেটার ছবি দেখিয়েছিলে ওদের?” গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেন অ্যাস্মোডিয়াস।

—“হ্যাঁ! কিন্তু লাভ হয়নি। আমার মনে হয় ভয়... ভয় পেয়ে ওরা কেউই ঠিক...। এমনকি ওদের সবার ক্যারাভানের ড্রাইভিং সিটের সামনে, অক্সিজেন অ্যান্ড্রয়েডেও ওই ছোকরার ছবি আর মাথার দাম আমি ব্রডকাস্ট করে দিয়েছি। যদি পরে কখনও...” জেনেরালের দিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসে লেভিড, “কিন্তু এসবের মধ্যেও একটা ভালো খবর আছে স্যার। যার জন্য আমাদের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে। সেই একই কারণে ইনভেস্টিগেশনে আমরা একটা নতুন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। ফেরিওয়ালাগুলোর মধ্যে ‘আলি’ নামের একজন নিজে থেকেই এগিয়ে এসে গোপনে আমাদের সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছে। ওর সমস্ত বয়ান কোড গ্রীনের কাউন্সিল অব জাস্টিসের ওয়েবসাইটে রেকর্ড করা আছে। আলি এরই মধ্যে বছর আঠাশের একটা ছেলেকে শনাক্তও করেছে। যার সঙ্গে এই ছোকরার বেশ কিছু শারীরিক বর্ণনা মিলে যায়, যেমন- বলিষ্ঠ শরীর, বাঁ হাতের কব্জির প্রতিবন্ধকতা। সদ্য চোরা ব্যাবসায় নামা আলিকে ছেলেটা ক্যাসেটের কাঁচা মাল, প্রোগ্রামিং চিপ সরবরাহ করছে। আরও কয়েকটা ক্যারাভ্যানেও ওর যাতায়াত আছে, তবে আলির সঙ্গেই বেশী ইয়ে...।

—“বটে?!” চোখে একটা আলোর ঝিলিক খেলে যায় অ্যাস্মোডিয়াসের। মুখটাকে আরও গম্ভীর করে সে প্রশ্ন করে, “কিন্তু এত শিওর হচ্ছ কি করে? ছোকরার নাম কিছু বলেছে আলি?”

মাথাটা নিচু করে জিভ দিয়ে মুখ থেকে একটা চুক চুক শব্দে আওয়াজ করে লেভিড।

—“খুব ভুল হয়ে গেছে স্যার। তাড়াহুড়োতে নামটাই... তবে ছোকরার ঠিকানা সঠিকভাবে না জানলেও আলি কিন্তু ওকে কয়েকবার ত্রাণশিবির উনোর দিক থেকে আসতে দেখেছে। তাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে ওই ছোকরাই হল...”

আশার আলো দেখতে পেয়ে অ্যাস্মোডিয়াসের চোখেমুখে তীব্র হাসির একটা আভা ফুটে ওঠে। সে আরও উত্তেজিত হয়ে একটু দ্বিধান্বিতভাবে বলে, “কিন্তু আলি হঠাৎ তার নিজের ব্যবসার ক্ষতি করে আমাদের দিকে ঘেঁষে এল কেন? ভালো করে খোঁজ নাও লেভিড। জানো তো সাবধানের মার নেই...?”

—“ক্ষতি!...” একটা কুৎসিত হাসি হাঁসে ইন্সপেক্টর লেভিড। “স্যার আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন ছোকরার মাথার দাম এক হাজার ক্রিপ্টো স্টার কয়েন। সেটা ষাট বছরের বুড়ো-হাবড়া আলির জন্য কম কিছু নয়। ওর সাতকুলে কেউ নেই। বাকি জীবনটা ফুর্তিতেই কাটবে। শুনেছি নাকি লালবাতি থেকে ঘুরে এলে বুড়ো তার মরা শরীরে জান ফিরে পায়...” অ্যাস্মোডিয়াসের দিকে চেয়ে চোখ টিপে মুচকি হাঁসে লেভিড।

—“বেশ... বেশ,” অনেকদিন পর শিকারকে বাগে পাওয়ার আনন্দে বিভোর হয়ে যান অ্যাস্মোডিয়াস।

—“কিন্তু স্যার আলি যে শুধু টাকার জন্য এই কাজ করছে তা নয়।”

—“তবে?” হাসির রেখা মিলিয়ে গিয়ে ভুরু দুটো আবার কুঁচকে যায় অ্যাস্মোডিয়াসের।

—“ইদানীং নাকি ছোকরার খুব দেমাক বেড়েছে স্যার। ক্যাসেটের জন্য ওর দেওয়া প্রোগ্রামিং চিপ কাজ করছে না। এই কারণে ক্যাসেটের বাজারে হঠাৎ মন্দা দেখা দেওয়ায় কয়েকটা ক্যারাভ্যানের মালিকের সঙ্গেও ঝামেলা করেছে সে। এই ব্যাপারে আলি প্রতিবাদ করায় আলির সঙ্গেও শেষ কয়েকদিন ভীষণ মুখ-খারাপ, হাতাহাতিও হয়েছে। সেন্সরের ওই আন-ওয়ান্টেড সিগনালে ধরাও পড়েছে সেসব। তাই প্রতিশোধ নিতে আলি...”

—“আই সি...” ইলেক্ট্রিক সিগারেটে আরও একটা টান দেন অ্যাস্মোডিয়াস।” আচ্ছা লেভিড, তুমি ওই অকেজো ক্যাসেটগুলো পরীক্ষা করেছিলে?”

—“হ্যাঁ স্যার। আমাদের টেকনিক্যাল এক্সপার্টকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। ইন্টারোগেশনের সময় আলিই আমাকে দু-তিনটে ক্যাসেট দিয়েছিল দেখতে। কোনওটাই কাজ করছে না। ক্যাসেটগুলো চালানোর পর শুধুই কালো অন্ধকার। আর একটা অদ্ভুত খট-খট খট-খট শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। ক্যাসেটগুলোর চিপেরই গণ্ডগোল। তবে স্যার ওই ক্যাসেটগুলো যে কাগজের টুকরোয় মোড়া ছিল সেটায় লেখা একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়েছে যার কোনও মাথামুণ্ডুই নেই...”

—“তাই নাকি? কী রকম?” অবাক চোখে তাকান অ্যাস্মোডিয়াস।

—“এই যে স্যার। দেখুন...” কাগজের টুকরোটা এগিয়ে দেয় লেভিড।

কোঁচকানো কাগজটার একটা দিক ফাঁকা। পেছনের দিকের ছোটো ছোটো হরফে লেখাটার ওপর ধীর গতিতে চোখ বোলাতে থাকেন অ্যাস্মোডিয়াস। সেটাকে লেখা না বলে সাধারণ একটা বর্ণমালা বলাই ভালো। দেখতে অনেকটা এইরকম—

—“তোমার কী মনে হচ্ছে লেভিড? লেখাটার মানে কী হতে পারে?”

—স্যার আমার মনে হয় না এই লেখাটার আদৌ কোনও মানে দাঁড়াচ্ছে। এটা কোনও বাচ্চার পড়ার বইয়ের ছেঁড়া পাতা হবে। ত্রাণ শিবিরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বহুদিন আগে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বইয়ের চাহিদা আর নেই। অন্যদিকে প্লাস্টিকের যোগানও সেই কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এখন কাগজের ঠোঙা বা ব্যাগ বানাতে ছাপা খানার মজুত রাখা কাগজই ব্যাবহার হচ্ছে।

—“হুমম... কিন্তু বর্ণমালাটা সম্পূর্ণ নয়।” জোরে নিঃশ্বাস ফেলেন অ্যাস্মোডিয়াস। কাঁচাপাকা, অভিজ্ঞ ভুরু দুটোর মাঝখান থেকে চিন্তার ভাঁজ কিছুতেই সরাতে পারেন না। “তুমি তো বললে তুমি সিগনালগুলো সব ডিকোড করেছো তাই না?”

—“হ্যাঁ স্যার।” দৃঢ় স্বরে বলে ইন্সপেক্টর লেভিড।

—“বেশ। ডিকোড করা সিগনালের শেষ কথাটা কার ছিল মনে আছে তোমার?” লেভিডের দিকে তাকান জেনেরাল অ্যাস্মোডিয়াস।

—“অবশ্যই স্যার! শেষ কথাটা ছিল ওই ছোকরার।”

—“গুড! শেষ কথাটা কি সেটাও নিশ্চয়ই মনে আছে?”

নিস্পলক দৃষ্টিতে জেনেরাল অ্যাস্মোডিয়াসের দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ ভাবে লেভিড। কথাগুলো একে একে মনে করার চেষ্টা করে সে।

—“মনে পড়েছে স্যার। ছোকরার শেষ কথাটা ছিল, ‘সময় হয়েছে জাগার...’। তারপর সে দুবার কিছু একটায় টোকা দেয়। ‘খট-খট’ আওয়াজ হয়, অনেকটা ওই ক্যাসেটের মত।”

সাল ২০৭৫, ত্রাণ শিবির ‘উনো’, মেনিস-১

ইতিকথা-৩ (সাল ২০৭০): এরই মধ্যে “কোড গ্রীন” এগিয়ে গেছে অনেক দূর। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আঁতাত এবং নির্বাচন ব্যবস্থার কারচুপি বিশ্ব রাজনীতিতে তাকে রাজসিংহাসন দিতে না পারলেও এনে দিয়েছে সেই সিংহাসনে বসার ক্ষমতা। তাদের গোপন পন্থা একটাই—এশিয়ার প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোকে দাবিয়ে রাখা। যারা আমেরিকা ও ইউরোপকে দ্রুত বিশ্বায়নে এক লহমায় নীচে নামিয়ে দিতে পারে। একটু একটু করে এশিয়ার সেই বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোর দম্ভ ভেঙে চুরমার করে সামাজিক মানচিত্র থেকে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। যাতে তারা ভাঙা শিরদাঁড়া নিয়ে বিশ্বের দরবারে আর উঠে দাঁড়াতে না পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই তো চির সত্য—‘মানুষ আজীবন মেরেছে মানুষ, মানুষ হওয়ার তরে’। এই কাজে অবশ্য তারা আংশিকভাবে সফলও হয়েছে। বেআইনি জৈবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র সংরক্ষণ এবং গুপ্ত গবেষণার দায় বদনাম দিয়ে তারা পূর্ব এশিয়ার বহু দেশের বাণিজ্যিক লাইসেন্স বাতিল করেছে। সেই অভ্যন্তরীণ ঝঞ্ঝায় জড়িয়ে পড়ে জাপান নিজেও। না, জি৭ রাষ্ট্রশক্তি তাকে রক্ষা করেনি এবারে। কারণ জাপানকে এতদিন ব্যবহার করে “কোড গ্রীন” এর মাধ্যমে এশিয়াকে দমিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখেছিল জি৭। তাই জাপানেই গড়ে তোলা হয়েছে কোড গ্রীনের মুখ্য শাসনকেন্দ্র “হাইয়েস্ট কাউন্সিল”। “কোড গ্রীন” নামের মধ্যে সচলতা, স্নিগ্ধতার বার্তা থাকলেও তার পরিকাঠামোর পরতে পরতে ছিল হিংস্র, লোলুপ রক্ততৃষ্ণা। কোড গ্রীন বিশ্ব সভ্যতার কাছে ক্রমশ একটা গভীর এবং বিপজ্জনক অসুখের নজির হয়ে উঠছিল। তখনও এই সভ্যতা ভাবতে পারেনি এই অসুখ মহামারীর আকার ধারণ করার আগেই বিশ্বরাজনীতির পঙ্কিল হ্রদে জন্ম হবে এক শ্বেতশুভ্র পঙ্কজের... আগ্নেয়গিরির মত দুঃসাহসী এক ভাষা বিপ্লবীর...

ভাষা আমার জন্মগত অধিকার। সেই অধিকার কেড়ে নিতে মৃত্যুকেও আমি ভয় করি না। আস্তিক অথবা নাস্তিক, ধনী কিংবা দরিদ্র মৃত্যুর কাছে আমরা সবাই সমান। সৃষ্টির সেই শিশুসময় থেকে মৃত্যুর একটাই লক্ষ্য। এই বিশ্ব-চরাচরে চরম সত্য হয়ে সে জীবনকে জয় করতে চায়। আমি আয়ুমু, “মেনিস-১” বস্তির সর্ববৃহৎ ত্রাণ শিবির “উনো”এর আশ্রিত। জাপানি ভাষায় আয়ুমু শব্দের অর্থ ‘পদক্ষেপ’। বাবা হেসে বলতেন, “জানিস আয়ু? বিপ্লবের অন্য নাম হল ‘পদক্ষেপ’!” বাবার মত একজন দেশপ্রেমী সৈনিকের আমৃত্যু প্রেম ছিল তাঁর মাতৃভাষা, তাঁর নিজের জন্মভূমি।

ত্রাণশিবির “উনো” এতটাই বড় যে হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে গোটাটাই যেন একটা দেশ। তার ঠিক পাশ দিয়ে নীল নদের মত বয়ে গেছে একটা নর্দমা। নর্দমাটা এমন সব জিনিসে বুজে আছে যে দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না। কয়েকটা মোটা বই নর্দমায় ডুবে আছে। ভাষার অধিকারকে যখন থেকে খুন করা হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাও তখন থেকেই ক্রমশ অন্ধকারের দিকে এগিয়েছে। অনেকের সন্দেহ নর্দমায় বোধহয় মৃত মানুষও রয়েছে, কেননা আবছা হলেও বোঝা যাচ্ছে মানুষের একটা হাত বেরিয়ে আছে। হয়তো অলীককে ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সে...। হাসপাতালের দুটো বেড কোলকুঁজো হয়ে পড়ে আছে নর্দমার পাশের বিষাক্ত রাবিশে। সেই বেডের সঙ্গে বেছানো খড়ের জাজিমের দুটোতেই শুয়ে আছে দুটো উলঙ্গ নারী শরীর। যার একটায় তীব্র প্রসব যন্ত্রণাকে উপশম করার জন্য উলঙ্গ এক মহিলা মরিয়া হয়ে মুচড়ে নিচ্ছেন তাঁর সর্বাঙ্গ। স্বামী হয়ত সীমান্তরক্ষার কাজে ব্রতী অথবা অলীক বাস্তবের স্বপ্নসুখ কেড়ে নিয়েছে তার নিষ্পাপ প্রাণ। আর অন্যটায় ধর্ষিত, ক্ষতবিক্ষত শরীরে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে আরেকজন উলঙ্গ যুবতি। তার দুপায়ের ফাঁক থেকে বিশ্বে দূষণের মত নর্দমায় চুঁইয়ে পড়ছে থকথকে লাল রক্ত। নারী-পুরুষ মিলিয়ে বেশ কিছু মানুষ ভিড় করে আছে সেখানে। কথা বলার অধিকার বা সাহস কোনোটাই তাদের নেই। এই সভ্যতা তাদের মূক যন্ত্রণায় নিঃসঙ্গ মৃত্যু দেখছে। বাস্তব মানুষকে উন্মাদ করে তোলে আর অলীক বাস্তব হিংস্র। কোনও একজন লেখক বহু বছর আগে লিখেছিলেন সমস্ত মানুষের মৃত্যুর দেবদূত কিন্তু যৌনতা হতে পারে না। কামনার মায়াজাল ভেদ করে আমরা যদি আত্মনিয়ন্ত্রক হতে পারি তাহলে হয়ত একদিন মনুষ্যত্বকে জিতিয়ে দিয়ে ছুঁয়ে যাব সুন্দর একটা ভবিষ্যতকে।

বোবা ত্রাণশিবির বুকের ভেতরে একরাশ বোকামি আর বাঁচার আর্তি নিয়ে ঘুমিয়ে আছে কুয়াশা ঢাকা মরণঘুমে। একজন সদ্যজাত যেভাবে তার পুরো হাতটা দিয়ে কোনও নিকট আত্মীয়ের, বয়োজ্যেষ্ঠের একটা আঙুল আঁকড়ে ধরে। ঠিক সেরকম এই বোবা ত্রানশিবির বাঁচতে চাইছে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, তার ভাষার স্বাধীনতাকে আঁকড়ে ধরে। তবু মাঝে মাঝে এই মৃত্যু উপত্যকায় যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের পদধ্বনি দিয়ে যায় এক পশলা শব্দসুখ। আমি কান পেতে শুনি সেই শব্দঘড়ির নিবিড় প্রতিধ্বনি—

“মৃত্যুভয় মৃত্যুর থেকেও ভারী, তার থেকেও ভারী কার্তুজ”।

অশ্রু-স্বেদ, রক্তস্নাত সৈনিকদের দলটার এটাই হল একমাত্র শ্লোগান। কী এক অজানা নেশায় ঝিমিয়ে থাকে তারা। তাদের ফ্যাকাশে মুখ, রক্তশূন্য শরীর, নিস্পলক দৃষ্টিতে সারাক্ষণ কিসের যেন উত্তর খোঁজার চেষ্টা। আমি অবশ্য আমার বুড়ো বাবাকে দেখেছি। এই শ্লোগান তুলে কোড গ্রীন গবেষণা কেন্দ্রের উন্মাদাগারের গরাদ দুটো চেপে ধরে বহুবার খিঁচিয়ে উঠতে। এই একটা মাত্র শ্লোগান কড়া ঘুমের ওষুধে ঝিমিয়ে পড়া বাবার আধ-মরা শরীরটায় লাগামহীন জীবনীশক্তির সঞ্চার করত। বাইরে থেকে আসা শ্লোগানের প্রতিধ্বনির সঙ্গে তাল রেখে বাবা কী এক উদ্যমে হাতদুটো শূন্যে মেলে ধরতেন। তারপর বন্দীঘরের কোনও অন্ধকার কোণ থেকে দামাল শিশুর মত গরাদের দিকে ছুটে আসতেন। তাঁর ঘোলাটে চোখ দুটো ঠিকরে বার করে এক পাশের যান্ত্রিক আর অন্য পাশের মাংসল হাত দুটো গরাদের বাইরে রেখে, হাতড়ে হাতড়ে কী একটা খোঁজার চেষ্টা করতেন। যুদ্ধ প্রস্তুতির তৎপরতায় বন্দুক উঠিয়ে নেওয়ার অভ্যেস তাঁর স্মৃতি থেকে তখনও মুছে যায়নি। শুধুমাত্র সেইটুকু সময় বাবার বিকলাঙ্গ মানবিক সত্ত্বা তাঁর সচল-যান্ত্রিক সত্ত্বাকে অনেকটা অতিক্রম করে যেত। বাবার শরীরে লাগানো যান্ত্রিক হাতটা ছিল কোড গ্রীনের গবেষণা ত্রুটি। মানব দেহ কাটা-ছেঁড়া করে বিকৃত বায়োনিক গবেষণার ফসল ছিল সেটা। কোড গ্রীনের অত্যাচারের এক অন্যতম অন্ধকার দিক এই গবেষণা।

বাবা ছিলেন কোড গ্রীনের সেই বিশেষ গবেষণাকেন্দ্রের একজন বায়োনিক সাবজেক্ট। শেষ জীবনে বাবার এই বিদায় সম্বর্ধনা প্রাপ্য ছিল না। হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক সচল হলেও বাবার ভেতরে যে অসুখটা দানা বেঁধেছিল তার নাম “বিপ্লব”, ভাষার জন্য বিপ্লব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বাবাকে করে তুলেছিল একরোখা, জেদি। সেই অসুখেরই অন্তিম চিকিৎসা চলেছিল কোড গ্রীনের গবেষণা কেন্দ্রে। তারা জানত এই অসুখ দীর্ঘদিন স্থায়ী থাকলে তা ছারখার করে দেবে কোড গ্রীনের স্বপ্নের সাম্রাজ্যকে। সম্পূর্ণরূপে পরিণত একজন পদচারি শব ছাড়া বাবার আধমরা দেহটায় একটুও মনুষ্যত্ব অবশিষ্ট ছিল না। বাবা ছিলেন অন্তর্মুখী স্বভাবের। অল্প বয়সে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগদান করার সময় থেকে শুরু করে শেষ অবধি তাঁর অস্থি-মজ্জা, রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছিল অ্যানার্কিস্ট বিপ্লবের মুক্তি-চেতনা। তাঁর প্রিয় রঙ ছিল ‘লাল’। গোলাপের থেকেও তীব্র, রক্তের মত গাঢ় ‘লাল’। তাই আজও তারায় ভরা নীল আকাশের দিকে চেয়ে হঠাৎ কোনও রক্তিম বর্ণের উল্কাপিন্ডকে ছুটে যেতে দেখলে বাবার কথা বড্ড মনে পড়ে। মনে হয় পৃথিবী মানেই তো সেই জীবনযুদ্ধে “ভিনি, ভিডি, ভিসি”—আসা, দেখা আর জয় করে নেওয়ার গল্প। কিন্তু ছুটন্ত উল্কাপিন্ডটা বলে যায় অন্য রূপকথা। সে বলে আসল লড়াইটা ভালোবাসার... আসল লড়াইটা “ভিনি, ভিডি, আমিভি”—আসা, দেখা আর ভালোবাসা। ভালোবেসে আপন করে নেওয়া। যেমনভাবে বাবারা যুদ্ধে যাওয়ার আগে তাঁর সন্তানকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর স্নেহ চুম্বন দিয়ে বলে যান ছেলে ভুলোনো মিথ্যে কথা। ঠিক সেরকম বুক ভরা মায়া নিয়ে উল্কাপিন্ডটা যেন বলে যায় “আবার আসব, আবার দেখব, আবার ভালোবাসব”।

কোড গ্রীনের সমাজতন্ত্র মানুষকে বাঁচতে শেখায় না। বরং পরিবেশ দূষণের অহেতুক দোহাই দেখিয়ে মানুষের প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নেয়, কেড়ে নেওয়া হয় মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা। কয়েক বছর অন্তর একবার করে ত্রাণ শিবিরগুলোকে অনুমতি দেওয়া হয় কোড গ্রীনের লোভী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে কোনও একজনকে নির্বাচিত করার জন্য। যে কিনা ত্রাণ শিবিরগুলোর প্রতিনিধি হয়ে ত্রাণ শিবিরগুলোকেই নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে শোষণ করবে। জেনেরাল অ্যাস্মোডিয়াস মেনিস-১ এর সেরকমই এক নেতৃত্বের নাম।

মনে পড়ে যায় সে বছর যখন আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য কারখানার চাকরিটা জুটল না। তখন পারিবারের আর্থিক সংস্থানে বেশ ভালোই টানাটানি চলছে। যুদ্ধে একটা হাত আর একটা পা খোয়ানোয় সেনা বিভাগ থেকে বাবাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতা-পিয়াসী স্বরাষ্ট্র-মন্ত্রক এবং তার রক্তের লোভ বড়ো সাংঘাতিক। বড় সাংঘাতিক সেই যুদ্ধের নেশা। একজন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সৈন্যের জীবনের দামের থেকে সে নেশার দাম বহুগুণ বেশী। আর তার পরিবার? ...সেটার দায়িত্ব? সেসবে কানপাতার সময় এই বধির সরকারের নেই...। আমাদের পরিবার বলতে আমি, বাবা আর বোন। মা আমাদের সঙ্গে নেই। তাঁর দীর্ঘ যুদ্ধজীবনের মেয়াদ বোধহয় এখনও শেষ হয়নি। ছোটবেলায় আমি আর বোন যখন রাতের নীল আকাশের চাঁদোয়ার নীচে শুয়ে একমনে তারা গুনতাম, তখন কিছুদুরের টিলার ওপরে দাঁড়ানো কবরখানার দিকে আপনা থেকেই চোখ চলে যেত। সেটার মাথায় সবুজ চোখ মেলে চেয়ে থাকা অজানা এক নক্ষত্র আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকত। যেন কিছু একটা তাকে বলতে হবে, কিন্তু কী বলতে হবে সেটা হারিয়ে গেছে তার স্মৃতি থেকে। অজানা কোনও এক মেরুজ্যোতির রাতে সেদিকে তাকিয়ে বাবাকে মায়ের কথা বলতে শুনেছি। বাবা বলতেন, মায়েরা হলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। তাঁদের অবসর কোথায়? কখনও সময় পেলে হয়ত এরকমই কোনও এক মেরুজ্যোতির রাতে তিনি নেমে আসবেন মাটিতে। আমাদের বেহুঁশ জ্বরে কপালে হাত ছুঁইয়েই আবার ফিরে যাবেন। কারণ মায়েরা এভাবেই আসেন. নিঃশব্দে। নাড়ির টান যে পৃথিবীর অভিকর্ষের চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী।

সেদিন মাঝরাতে যখন জীবিকার চিন্তা খিদেয় জ্বলতে থাকা পেটটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে, আমার কপালে হঠাৎ দৃঢ় হাতের স্নেহস্পর্শ পেলাম। শক্ত হাত, স্নেহ আর ভালোবাসা মিশে নরম হয়ে গেছে। বাবার এই হাত আমার চেনা। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বাবা ফিসফিস করে বলছিলেন, “বিপ্লব মানেই যে সবসময় রক্ত ঝড়াতে হবে তা নয়। ‘বিপ্লব’ মানে খুব তাড়াতাড়ি আমুল পরিবর্তন। ওরা আমায় ডেকেছে জানিস? যেতে হবে...” চমকে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিলাম একবার। এই সময় সতর্ক থাকা ভীষণ প্রয়োজন। বাবা ঘরের জানলা আর দরজায় পুরু ভিনাইল এবং ফোম দিয়ে বানানো শাটার আগে থেকেই টেনে দিয়েছিলেন, যাতে সেগুলো শব্দ শুষে নেয়। সিলিং থেকে মাটি অবধি দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো ভিনাইলের পুরু চটগুলো আমি ফাঁক-ফোকরে টেনে দিয়ে বললাম, “ওরা মানে... কারা? কারখানা থেকে?”

—“নাহ।”

—“তবে?”

—“কোড গ্রীনের কাউন্সিল অব জাস্টিস”।

—“সে কী? হঠাৎ...?”

খানিকক্ষণ সব নিস্তব্ধ। রাত বেড়ে চলে বোবা মানুষগুলোর রুগ্ন, ক্লান্ত শরীরের মধ্যে দিয়ে। বাবা আমার হাতদুটো চেপে ধরেন অসহায়ভাবে। মাথা নিচু করে ভাঙা গলায় ভেসে আসে, “জানিস ওরা ‘আই’কে...” বাবার কণ্ঠনালী বুজে যায় অজানা শব্দস্রোতে। ‘আই’ ফুলের মত নিষ্পাপ, আমার হতভাগিনী বোন। কতই বা বয়েস ছিল তখন ওর কুড়ি কি একুশ। ‘আই’ মানে ভালবাসা। বাবা বলেছিলেন মায়ের এই নামটা বড় পছন্দের। তাই তাঁদের দুজনের শেষ স্মৃতি হিসেবে মা এই নামটা রেখেছিলেন। আই আজন্ম বোবা। ঠিক বাবা-মায়ের ভালোবাসার মতন। সে কথা বলতে পারে না তাই তার জন্য আলাদা সরকারি নির্দেশিকার প্রয়োজন নেই। সেই ভাবে প্রতিবাদও সে একেবারেই করতে পারে না। ওর উপস্থিতি জানানোর দরকার হলে গলা দিয়ে নয়, ও হাতের কাছের কোনও জিনিসে টোকা দিয়ে জানায়। ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছিলেন।

“আইকে কী করেছে... কী করেছে ওরা?” বাবার কাঁধটা আমি শক্ত করে ধরি। বাবার গালের দুপাশ দিয়ে জলের ফোঁটা চিকচিক করে ওঠে।

—“ওরা বারণ করেছিল জানিস? ওরা সতর্ক করে দিয়েছিল... তবুও...”

—“কারা?”

—“উনোর আইন রক্ষক সমিতির দালালরা... কাঁচা বয়েসে ডানা গজানো কিছু বেয়াদব ছোকরা। সেদিন উনোর ডান দিকের কোণায়, রাস্তার ধারের বাড়িগুলোর ফাটা দেওয়াল যখন ভাষা বিপ্লবের পোস্টার দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলাম তখন...। হঠাৎ যমদূতের মত ওরা জনাতিনেক এসে আমায় ঘিরে ধরল।”

—“পুলিশ?”

—“না... তবে ওদেরই পোষা। ওদের ভেতর একজন ষণ্ডামার্কা বলল, ‘বিপ্লবের চুস্কি এখনও নামেনি দেখছি তোর?’ পাশ থেকে আরেকজন বলল, ‘কারখানার শ্রমিকদের আর ভাষার অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার নিয়ে ভড়কানো যাবে না।’ সেদিন কারখানার আলি আমার সঙ্গে না থাকলে ওরা হয়তো আমাকেই...। যা অন্যায় তার সামনে আমি কখনও মাথা ঝোঁকাইনি। এই মৃত্যুমিছিল, এই মরণ নেশা, শিথিল জীবন... সব... সব সত্যি।”

—“কারুর নাম জানতে পারোনি?”

—“ওই ষণ্ডামার্কা ছেলেটা বলেছিল ওদের দলের নেতার নাম ‘লেভিড’।”

নিশ্চুপ আঁধারে দৃষ্টি, কণ্ঠস্বর দুইই ঝাপসা হয়ে আসে বাবার। আমি আলতো করে আবার কাঁধে হাত রাখি। জানতে চাই, “তারপর?”

—“আজ সকাল থেকেই আইকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বোবা, মা-মরা আমার মেয়েটা সারাদিন বাড়িতে থেকে বাড়ির কাজ করে। কিন্তু আজ কী যে হল... আমি আর আলি যখন অনেক খুঁজেও কোনও চিহ্ন পেলাম না, চিন্তায় দিশেহারা লাগছিল। বুঝতে পারিনি যে তখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। আমার সৈনিক ভাইয়েরা অনেকে আমার সঙ্গেই সেনা থেকে বরখাস্ত হয়ে কারখানায় কাজ নিয়েছিল। তাদেরই কয়েকজন আইয়ের কাটা ছেঁড়া, খোবলানো শরীরটা বাড়িতে দিয়ে গেল। ইশারা করে বলল, তারা আইকে এই অবস্থায় কারখানার পাশের ভাঙা স্কুল বাড়িটা থেকে পেয়েছে।”

—“আই এখন কোথায় বাবা?”

উত্তর আসে না। রাত কানা অন্ধকার যেন নিস্তব্ধ ঘরের কোণাগুলোর গলা টিপে ধরে। আমি পাগলের মত ছুটে যাই পাশের ঘরে। “আই...?” বাড়ির বাইরে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠি, “... আইই...?” নিকষ কালো রঙে যেন চুপসে গেছে গোটা পৃথিবী। কয়েকটা রাস্তার ঘেয়ো কুকুর বোধহয় ডুকরে কেঁদে ওঠে। সহমর্মিতা দেখাতে তাদের চেয়ে ভালো আর কেউ পারে না।

—“বাবা আই কোথায়? ...আই কোথায় বাবা...?” বুকের ভেতর কি এক অজানা আকুতি দলা পাকিয়ে উঠছিল।

—“সে আর ফিরবে না। ওকে আমি খালের জলে...”

—“বাবা আই সাঁতার জানে না... ও মরে যাবে...”

—“ওর আর সাঁতার জানার প্রয়োজন হবে না... দেখিস ও বহুদুর ভেসে যাবে... নিঃশব্দে। উনোর আইন রক্ষক সমিতি কাউন্সিল অব জাস্টিসকে জানিয়েছে আমিই আইকে খুন করেছি। গলা টিপে... তারপর ওর লাশটা খালের জলে... এই দেখ এই দুটো হাত দিয়ে... দেখ...”

কী এক আক্রোশে প্রতিবন্ধকতা ভুলে গিয়ে আমার জামার কলার দুটো চেপে ধরার চেষ্টা করেন বাবা। তারপর সরল শিশুর মত হেঁসে ওঠেন। সে হাসিতে সারল্যের চেয়ে বিকৃতিই বেশী। বিকৃত, করুণ সেই হাসি যেন সমাজের গালে একটা নৈতিক থাপ্পড়। সেই হাসি বুঝিয়ে দেয় মাতৃত্বের মমতার চেয়েও কন্যা শোকার্ত পিতৃত্ব বড় কঠিন। কারণ এই বিশ্বে বাবারা বড্ড মিথ্যে কথা বলেন।

আমার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেন বাবা।

—“অনেক দেরী হয়ে গেছে আমাদের। আলি সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছে। চল আমরা অন্য বস্তিতে পালিয়ে যাই...”

—“না! এর শেষ না দেখে কখনোই নয়!”

ভাঙা কাঠের ক্র্যাচে ভর করে, বাঁ দিকের কুনুই অবশিষ্ট হাতটা দিয়ে বাবা আমার মুখে, কপালে হাত বোলাতে থাকেন।

—“ওদের এটা চক্রান্ত। এখনও বুঝতে পারছিস না...? ওরা এখুনি এসে পড়বে। কোড গ্রীন তার শত্রুদের বাঁচিয়ে রাখে না। আমাদের বাঁচতে হবে... বাঁচাতে হবে... এত মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের আলো পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সম্মুখসমরের দাম শুধু রক্তেই মিটবে... ওরা ক্ষমতাশালী। এতে কোনও গণতন্ত্র নেই।”

—“না বাবা। এত তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাব না। লড়াইটা সামনে থেকে লড়ে যাব। সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ ষোল আনা গণতান্ত্রিক।”

একরোখা, এক অদম্য জেদ চেপে বসে আমার মধ্যে। আমি জানি অন্যায় সহ্য করতে করতে আমাদের বাঁকা শিরদাঁড়াটা একদিন শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ একবারও না করলে আগামীর অভিধান থেকে ‘প্রতিবাদ’ শব্দটাই হয়ত একদিন মুছে যাবে। থেকে যাবে শুধু অন্যায়ের প্রতিশব্দ...

ভাঙা স্কুলবাড়ি, ত্রাণ শিবির ‘উনো’, মেনিস-১

সময় জীবনের মতই স্রোতস্বিনী। কেটে গেছে বেশ কিছু মাস। সন্ধ্যের মেঘাচ্ছন্ন ধোঁয়াটে আকাশে কালশিটে পড়া শুকনো চাঁদটাকে আজ বড্ড বেশি উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। পেঁজা মেঘের পাতলা আস্তরণ ছিঁড়ে সে যেন উন্মাদের মত ছুটে চলেছে নিরুদ্দেশের দিকে। সোজা করে দাঁড় করানো গোছা করা প্যান ফ্লুটের মত কারখানার ফার্নেসগুলো মাথা উঁচিয়ে সেই দিকেই নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তারা নিরব, অচল। কালো ধোঁয়া ছেড়ে প্রতিবাদ করার মত ক্ষমতা আজ আর তাদের নেই। সে অবশ্য “কোড গ্রীন” এরই দূষণ প্রতিরোধ পরিকল্পনার বদান্যতা। ফার্নেসগুলোর দেওয়ালে এখন “গ্রীন ওয়ালের” সবজেটে ছোপ ধরেছে। “উল্লম্ব উদ্যান” প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতার একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তার নোনা ধরা, ছাই লেপা ঘুলঘুলিতে এখন পায়রাদের বাস। শুধু কারখানার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নিস্তরঙ্গ খালের জলে পড়ে আছে অজস্র পচে যাওয়া, ফুলে ওঠা ভুখা পেট। জলের স্রোত ছাপিয়ে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্রের আওয়াজ ছাপিয়ে ওদের হাহাকার যেন থেমে গেছে কত শতাব্দী আগে।

কবর দেওয়ার জন্য বাবার পুরো শরীরটা উদ্ধার হলেও মাথাটা কোনও ভাবেই আর ফিরে পাওয়া যায়নি। শেষ সময়ে কোড গ্রীন গবেষণা কেন্দ্রের উচ্চ মাত্রার ইলেক্ট্রিক ভোল্ট সদ্য সন্তানহারা পিতার ক্ষুদ্র জৈবিক মস্তিষ্ক সহ্য করতে পারেনি। থেঁতলানো তরমুজের মত ঘিলু সমেত সেটা ছিটকে নাক দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। বাবার শরীরে অ্যাড্রেনালিনের দৌড় প্রতিযোগিতায় একটুর জন্যে কৃত্রিম, যান্ত্রিক সাইন্যাপ্সগুলো জিতে গেছিল বোধহয়। তাই শরীরটা নিথর হয়ে যাওয়ার পরেও তার ডানদিকের সেই যান্ত্রিক হাত মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। কী একটা খুঁজতে চাইছিল সেটা... বোধহয় যুদ্ধ তৎপরতায় বন্দুক ওঠানোর অভ্যেস!

কোনও মহাযুদ্ধের পরে ভিজে মাটির সঙ্গে যেভাবে রক্ত আর পোড়া বারুদের গন্ধ মিশে থাকে, উনোর প্রতিটা অলি-গলি, রাস্তার প্রতিটা মোড়ে সেই একই সোঁদা গন্ধ মিশে আছে। এই গন্ধে বমি আসে না। আজন্ম যারা এই গন্ধ তাদের শরীরে মেখে বেড়ে উঠেছে, তাদের এই গন্ধ মায়ের শুকনো, ছেঁড়া-আঁচলের কথাই বেশী করে মনে করায়।

সবুজাভ কারখানার পাশে ভাঙা স্কুল বাড়িটা যেন ক্রমশ অন্ধকারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আজ থেকে একশ বছর পরে নতুন প্রজন্ম হয়ত এর জীবাশ্মটুকুও খুঁজে পাবে না। মগজ ধোলাইয়ের খবরদারীতে শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমি অবশ্য সংসারের টানে স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারিনি। কোড গ্রীনের সমাজতন্ত্রও আমাকে সেই সুযোগ করে দেয়নি। সেই স্কুল আজ মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসস্তূপ। মন্দিরের মত তার থামগুলো, গির্জার মত কারুকাজ করা ভাঙা দেওয়ালগুলো আর মসজিদের মত ছাদের আধখাওয়া গম্বুজটা দীর্ঘ অপেক্ষায় রয়েছে ভবিষ্যতের সূর্যোদয় দেখবে বলে। আইয়ের মত কত অজস্র যুবতির আর্তনাদ, চামড়া ফাটা রক্তের দাগে ঝুল ধরে গেছে ফাঁকা ব্ল্যাক বোর্ডের দেওয়াল। কষ্ট করে দু-ক্লাস ইংরিজি শিখতে পেরেছিলাম আমি। A-B-C-D আর সেই অ্যালফাবেটগুলো দিয়ে কীভাবে বাক্য গঠন করা যায় শুধু সেইটুকুই। সেইটুকু এই ত্রাণ শিবিরের প্রায় সবাই জানে। বাঁচার ন্যূনতম লড়াইয়ে অতটুকু জানা জরুরি। রেসিডেন্স কাউন্সিল সহ অন্যান্য উঁচুস্তরের কাউন্সিলগুলোর সরকারি স্কুলে শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও সচল আছে। সেখানে অন্য বিভাগের সরকারি পদস্থ কর্মচারীদেরকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। যাতে আগামীর ইতিহাসে বাঁচার সংগ্রাম, প্রতিবাদের ভাষাকে মুছে দিয়ে শুধু থেকে যায় ওই অন্ধকার শাসন ব্যাবস্থার জয়ধ্বনি।

বাবার উন্মাদাগারের গরাদটা ছিল আমার কয়েদখানার গরাদের ঠিক সমান্তরালে। একপাশে আমি আর অন্যপাশে বাবা। সেখানে কথোপকথন নিষিদ্ধ। মাঝে মাঝে ওয়াচ টাওয়ারের এলোপাথারি আলোর ফলা ছিঁড়েখুঁড়ে দিত হাজতখানার দুর্ভেদ্য অন্ধকার। সেই আলোতেই ঝলসে উঠত ছেঁড়া পোশাকে বাবার ক্ষতবিক্ষত দেহটা। সব সময়ই প্রায় নিস্তেজ হয়ে ঝিমিয়ে থাকত সেটা। আবার কখনও কখনও একমনে ছেঁড়া জামার খুঁটে আঁকিবুঁকি কেটে কিছু লেখার চেষ্টা করতেন তিনি। কী লিখতেন কেউ জানে না। সে জিনিস গারদের রক্ষিদেরও বোধগম্য হত না।

সেদিন হঠাৎ একটা আওয়াজে আমার তন্দ্রাচ্ছন্নভাবটা কেটে গেল। দিন কি রাত বোঝার উপায় নেই। ওয়াচ টাওয়ারের আলো ঘুলঘুলি বেয়ে মাঝে মাঝে গড়িয়ে আসছে ভেতরে। বাবার গরাদের ভেতরটাও আবছা বোঝা যাচ্ছে যেন। দৃষ্টি একটু স্পষ্ট হতেই দেখলাম বাবাকে। ওয়াচ টাওয়ারের আলোর ফলার ভেল্কি খেলে যাচ্ছে ওঁর মুখের ওপর দিয়ে। গবেষণাগারের যান্ত্রিক অত্যাচারে ওঁর আধ-পোড়া শরীর আর গুঁড়িয়ে যাওয়া হাড়ের প্রায় সবই অস্পষ্ট। কিন্তু লালা আর রক্ত মিশে দাঁতগুলো চকচক করছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে আমার দিকে চেয়ে উনি হাসছেন আর একনাগাড়ে তাঁর অন্যপাশের তোবড়ানো, যান্ত্রিক হাতটা দিয়ে দেওয়ালে একটা নির্দিষ্ট লয়ে আঘাত করে চলেছেন। খট-খট আওয়াজটা সেদিক থেকেই আসছে। এই ভঙ্গিমা আমার ভীষণ পরিচিত, এটা আইয়ের ভঙ্গিমা। এই সাংকেতিক ভাষা আইয়ের ভাষা। তবে কি আবার নতুন কোনও পরিকল্পনা...? আমি এবারে আমার কয়েদখানার গরাদের আরও কাছে এসে বাবাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। বাবার ডান হাতে কি একটা মুঠো করে ধরা আছে, যেন এক খাবলা হৃৎপিণ্ড। হাতটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। এবারে সেটা মুঠো করেই বাবা গরাদের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। এক টুকরো কাপড়, বাবার জামার খুঁট থেকে ছেঁড়া। ঘুলঘুলি বেয়ে চুঁইয়ে আসা ওয়াচ টাওয়ারের আলো কয়েকবার ছিটকে এল সেটার ওপরে। এর ওপরে লেখা সংকেত আমি জানি। বাবা তাহলে এতদিন ক্ষতবিক্ষত শরীরের রক্ত ছেঁচে এই সংকেতই লেখার চেষ্টা করছিলেন...?

ছোটবেলায় আমাকে আর আইকে শেখানো বাবার এই সংকেত এখনও ভুলিনি। ইংরিজি বর্ণমালার ২৬টা অক্ষর থেকে ২৫টা বর্ণকে নেওয়া হয়েছে। তাকে ৫টা বর্গে ভাগ করা হয়েছে। শেষ অক্ষর ‘z’ বাদ কারণ সেটা ঈশারায় বোঝানো সোজা। হাতের কাছের যে কোনও জিনিসে টোকা দিয়ে এই ৫টা বর্গ থেকে বর্ণ নিয়ে শব্দ গঠন সম্ভব। “বর্গ” বোঝাতে পরপর দুটো টোকা দরকার আর “ঘর” বোঝাতে একটা টোকা। অর্থাৎ যদি আমি আই (AI) এর নাম বোঝাতে চাই। তাহলে প্রথম বর্ণ ‘A’ বোঝাতে একবার দুটো টোকা আর ঘর বোঝাতে ৫ সেকেন্ড পর একটা মৃদু টোকা (বর্গ - ১, ঘর - ১)। ঠিক একইভাবে ‘I’ বোঝাতে প্রথমে দুবার দুটো টোকা (বর্গ-২) ৫ সেকেন্ড পর চারবার মৃদু টোকা (ঘর-৪)। ছোটো ছোটো শব্দে কথা বললে এই ভাষা বোঝার সাধ্য কোডগ্রীনের রক্ষীদের বুদ্ধিমত্তায় কুলোবে না।

বাবার দিকে তাকালাম এবার। অকথ্য অত্যাচারে বেশ কিছুদিন আগেই বাবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন সেই সঙ্গে মানুষ চেনার ক্ষমতাও। কিন্তু এখন বাবার ঘোলাটে চোখ দুটোয় যেন দৃষ্টি ফিরে এসেছে হঠাৎ। বাবা দেওয়ালে একটা মৃদু ঘুসি মারলেন। এর মানে উনি কিছু বলতে চান। আমি ইশারায় ঘাড় নাড়লাম। উনি বোধহয় একবার হাসলেন। মুখের থেকে কষ বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ল নীচে, রক্তও হতে পারে। তারপরে দুবার দুটো টোকা ও চারবার মৃদু টোকা এবং ১০ সেকেন্ড পর চারবার দুটো টোকা সঙ্গে ৫ বার মৃদু টোকা। অর্থাৎ ‘It’। এই ভাবে নির্দিষ্ট লয়ে বাবা টোকা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে যা বললেন তা দাঁড়াল - “It’s time. Meet Ali. Urgent.” এটাই উপযুক্ত সময় আলির সঙ্গে দেখা করার। জলদি। এত কড়া নিরাপত্তার চোখে ধুলো দিয়ে আমাকে পালাতে হবে। কিছু মানুষের কন্ঠস্বর ভেসে এল কানে সঙ্গে কিছু যান্ত্রিক আওয়াজ। বাবাকে নিয়ে যেতে এসেছে ওরা। কিন্তু এবারে যেন বাবা যেতে চাইলেন না। বরং গরাদ দুটো চেপে ধরে রক্ষীদের গায়ে থুতু দিতে লাগলেন।

ফিরিয়ে দেওয়া, ত্রাণ শিবির ‘উনো’, মেনিস-১

ভাঙা স্কুলবাড়ির ধ্বংসাবশেষের অন্ধকারে গভীর চিন্তায় চোখ দুটো জ্বলছিল আয়ুমুর। এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হবে আজ। এই রাত শুধু প্রতিশোধের রাত নয়। এই রাত আগামীর ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় রাত হয়ে থেকে যাবে। সব কিছু যদি পরিকল্পনা মাফিক হয় তবে এক পাল মানুষের মধ্যে এতদিনে নিশ্চয়ই সে আগুনের ফুল্কি ছড়িয়ে দাবানল সৃষ্টি করতে পেরেছে। বিপ্লবের আগুন। উত্তর অবশ্য সময় দেবে। সময়ই সর্ব শক্তিমান।

সশস্ত্র আয়োজনেই যা একটু সময় লেগে গেল তার। আলি চাচা না থাকলে এসব কিছুই সম্ভব ছিল না। অন্ধকারে চকচক করে ওঠা ইল মাছের মত ডান হাতের কালো ঘোড়াটার দিকে সে একবার নজর বুলিয়ে নেয়। a.22 ক্যালিবারের শর্টগান। তারপর বাঁহাতের হাতঘড়ির আর এফ আইডি কিই দিয়ে সেটা চালু করে। শেষবারের মত নেড়েচেড়ে দেখে নেওয়া দরকার। রিয়াল টাইম ডিসপ্লেতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে। ম্যাগ্নেটিক এনার্জি লেভেল ৯৫ শতাংশ; রেঞ্জ অ্যাক্টিভেটেড; অ্যাঙ্গেল অ্যাকিউরেট। সব কিছু ঠিকঠাক কাজ করছে। একদিনের জন্য গুনে গুনে ৫০ ক্রিপ্টো সেন্টস নিয়েছিল উনোর আইন রক্ষক সমিতির পাহারাদারটা। ছাপাখানার ৭ দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির মজদুরির সঙ্গে ক্যাসেটের কাঁচা মালের প্রাপ্য টাকা সব মিলিয়েই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বন্দুকে থাকা ন্যানো কয়েলে তৈরি শক্তিশালী তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্রই এই ধাতব মারণাস্ত্রের একমাত্র চালিকাশক্তি।

—“তুই ঠিক জানিস? এই স্কুল বাড়িটাই তো?” গম্ভীর গলায় খেঁকিয়ে ওঠে লেভিড। পুরোনো স্মৃতি। যেন আকাশ থেকে পড়েছে সে।

—“হ্যাঁ স্যার ঠিকই ধরেছেন।” আলির শান্ত, শীতল কন্ঠস্বর ভেসে আসে। সে চেয়ে থাকে অন্ধ, বোবা ভাঙা বাড়িটার দিকে। কত স্মৃতি ভিড় করে আসে তার চোখের তারায়। আয়েশার মতই ফুটফুটে মেয়ে ছিল আই। বড় স্নেহের। কী দোষ করেছিল তারা? ভাষার জন্য প্রতিবাদ...? সে একবার ভালো করে দেখে নেয় লেভিড সহ তিন-চারজনের পুলিশের দলটাকে। প্রত্যেকের হাতে আর্মাটিক্সের কালো ঘোড়া। স্মার্ট বুলেটে লোডেড। প্রতি মিনিটে দু হাজার রাউন্ড। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এই বুলেট লক্ষ্যভেদ করতে হাওয়াতেও বাঁক খেতে পারে। অজানা পিতৃত্ব ভর করে আলির মনে। ছেলেটা একা পারবে তো? অনাথ আয়ুমু আলি চাচারও যে বড্ড স্নেহের।

অন্ধকার ক্লাসরুমের তোবড়ানো দরজাটায় একটা মৃদু ঘুসির শব্দ হয়। সজাগ হয়ে ওঠে আয়ুমু। তারপর দুবার টোকা আর একবার মৃদু টোকা। তার মানে ‘A’। বাকিটা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না আয়ুমুর। আলি চাচা এসেছেন। দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। তারপর দুটো ছপাৎ ছপাৎ শব্দে একটু থমকে দাঁড়ায়। তার হাত আর কাঁধের পাশ দুটো যেন অবশ হয়ে এসেছে হঠাৎ। দুটো ক্ষতস্থান। সেখান থেকে পেঁজা পেঁজা গরম তরল ওটা কী বেরিয়ে আসছে? রক্ত...? দরজা ভেঙে ততক্ষণে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে লেভিড আর তার দল। শিকারের মরসুমে যেন শিকারিদের উল্লাস। মরণঘুমে চোখ বুজে আসে আয়ুমুর। আলি চাচা কি তবে...? লেভিডের বুটটা গলার থেকে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে সে। ঝাপসা চোখে উঁকি দেয় বাইরের দিকে। আলি চাচার রক্তাক্ত সাদা ফেজ টুপি আর সাদা পাঞ্জাবিটা দেখা যাচ্ছে অন্ধকারে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে সেটা। নাহ সে যা ভেবেছিল তা নয়। আলি চাচা তাঁর পরিকল্পনা, প্রতিজ্ঞায় অবিচল ছিলেন। লেভিডের আবছা কন্ঠস্বর ভেসে আসে কানে। সে আরও জোরে বুট দিয়ে চেপে ধরেছে আয়ুমুর গলার কাছটা। আয়ুমুর হাতের পাশেই ছিটকে পড়ে আছে শর্ট গানটা। সেটাও বোধহয় কেউ একজন পা দিয়ে চেপে ধরেছে। ম্যাগনেটিক এনার্জি ৮৫ শতাংশ। দুবার আলোটা দপ দপ করে ওঠে।

—“এতদিনে বাছাধনকে বুটের নীচে পেয়েছি। তুই কি ভেবেছিলিস তুই একাই চালাক?” লেভিডের চোখে মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে, “তোর বাপটা তোর থেকে বেশি চালাক ছিল। পরিণতিটা তো নিজের চোখেই দেখেছিলিস শেষ অবধি...?”

বুটের চাপে মুখের কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে আসে আয়ুমুর। লেভিড এবারে ঝুঁকে পড়ে আয়ুমুর মুখের ওপর। চুলের মুঠিটা চেপে ধরে সজোরে। তারপর চোখের সঙ্গে চোখ মিলিয়ে বলে, “জেনেরাল অ্যাস্মোডিয়াসের চোখে ফাঁকি দেওয়া এত সোজা না... ভাষার অধিকার নয়, বুটের তলাই তোদের আসল জায়গা।” মুখের সামনেটা একবার জিভ দিয়ে চেটে নিয়ে সে আবার বলতে থাকে, “ডান পাশের ভাঙা বেঞ্চটা দেখতে পাচ্ছিস? এরকমই একটা বেঞ্চে শুয়ে তোর বোনটা ছটফট করছিল। হাতজোড় করছিল। উফ কী নরম মাংস। এরকম আর বহুদিন... প্রথমে ফ্রকটা, তারপর নীচে...” কথা শেষ হয় না। আয়ুমুর থুতু ছিটকে আসে লেভিডের চোখেমুখে।

লেভিড যেন আরও ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। তার মুখে সেই একই হাসি। “এত সহজে তোকে আমি মারব না...। বোনের থেকেও তোর খারাপ অবস্থা করব যাতে উনোর কারুর আর এতটা সাহস না হয়।” এলো পাথারি ঘুসিতে দৃষ্টি বুজে আসে আয়ুমুর। কিন্তু মুখ থেকে তার প্রশান্ত হাসি তখনও মিলিয়ে যায়নি।

—“স্যার! পেছনে দেখুন। ওগুলো কীসের আলো...?” ভাঙা গলায় কে যেন একটা বলে ওঠে পাশ থেকে। খানিকক্ষণ থেমে যায় ঘুসির শব্দ। আলোগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে কালো ছায়ার সংখ্যা।

‘যাক! মানুষগুলো বুঝেছে তাহলে’, চোখের পাশ দিয়ে একটা ফোঁটা চিকচিক করে ওঠে আয়ুমুর। মুখের কষ বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া রক্ত বাঁহাতের প্রতিবন্ধক কব্জিটা দিয়ে মুছে ফেলে সে। উঠে বসার চেষ্টা করে একবার। চলে যাওয়ার আগে এই পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে দিয়ে যাবে সে। এটাই তো তার স্বপ্ন, বাবার স্বপ্ন। এই প্রাগৈতিহাসিক স্কুল উনোকে আবার শিক্ষার আলোয় আলোকিত করবে। এই তো তার জীবনের শেষ অঙ্গীকার।

—“শুয়োর কোথাকার! আবার কী চাল চেলেছিস?” আচমকা ঘুষিতে নাক বেয়ে দু ফোঁটা রক্ত ঝরে পরে আয়ুমুর।

তার হাসি পায়। সে নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে লেভিডের দিকে।

—“সামনের সারির লোকগুলোকে চিনতে পারছেন স্যার...?” কোনও এক পুলিস রক্ষী বলে ওঠে।

—“সেই চোরা ক্যাসেটের ক্যারাভ্যানের লোকগুলো না...?” বিস্ফারিত চোখে এগিয়ে আসা আবিবর্তিত মানুষগুলোর দিকে চেয়ে থাকে লেভিড। বোবা মানুষগুলো যে এতটা আদিম, এতটা হিংস্র আগে কখনও বুঝতে পারেনি সে। তাদের স্নায়ু থেকে স্নিগ্ধ আগুন ছিটকে আসছে। উনোর এই বিস্তীর্ণ জন সমাগমের সামনে তাদের হাই-টেক অস্ত্র নস্যি। একসঙ্গে কত মানুষ মারবে লেভিড আর তার রক্ষীরা? ছ-হাজার সাত হাজার? তারা আজ প্রস্তুত নয়। সে জানে জনবিপ্লবের কাছে বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী অস্ত্রই চিরকাল লজ্জা পেয়েছে।

—“তুই আমায় যতটা কাঁচা খেলোয়াড় ভেবেছিলিস, ততটা কাঁচা আমি নই, তাই না...? তুই আর তোর প্রভু ভেবেছিলিস ক্যাসেটগুলোর সংকেত উনোর অশিক্ষিত মানুষ বুঝতে পারবে না। কিন্তু সেই দায়িত্ব এতদিন ক্যারাভ্যানের মালিকরা যে সযত্নে পালন করে আসছে সেটা বুঝতে পারিসনি। তোদের ওই সেন্সরের মত শখের খেলনাতে সেসব ধরাও পড়েনি... মানুষের মন শব্দ তরঙ্গের থেকেও বেশি শক্তিশালী, বেশি তীব্র।”

লেভিডের গুলিতে আয়ুমুর বুক আর হাত আরও দুবার কেঁপে ওঠে। চোখ বুজে আসে ঘুমে। চারদিকে অজস্র আলো জ্বলে উঠেছে। পাশে মাটিতে ওটা কে? বাবা...? যে বন্দুক নিয়ে উনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সে বন্দুকের নলের সামনে একটা কেঁচো বাসা বেঁধেছে বোধহয়। মাটি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে নলের গর্ত। এক নুইয়ে পরা সবুজ লতা নিকট আত্মীয়ের মত জড়িয়ে ধরেছে সেই বন্দুকের নল। পেঁচিয়ে বেড়ে উঠেছে তারই সঙ্গে। বুদ্ধ বলেছিলেন বন্দুকটা নিজের দিকে ফেরাও, হিটলার বলেছিলেন উল্টোদিকে। আর আয়ুমুর ভেতরের সেই অচেনা বিপ্লবী... সে কী বলেছিল?

জ্ঞান ফেরে আয়ুমুর একটা শব্দে। কে যেন বলছে—

“স্যার ওরা অনেকটা এগিয়ে এসেছে। এখানে থাকা ঠিক হবে না আর...” বাইরে থেকে আবছা হলেও কোলাহল ভেসে আসছে। মাথার পাশের শর্ট গানটা দপদপিয়ে জ্বলে উঠল একবার। ম্যাগনেটিক এনার্জি ৪৫ শতাংশ। এই শেষ সুযোগ। কেউ নেই সেখানে। কাঁপা হাতে বন্দুকের হাতলটা চেপে ধরে আয়ুমু। লেভিডের হুঁশ এখনও এদিকে ফেরেনি। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আয়ুমু বুকের কাছে নিয়ে আসে পিস্তলটা। রেঞ্জ অ্যাক্টিভেটেড; অ্যাঙ্গেল অ্যাকিউরেট। একটা খুব সূক্ষ্ম হাওয়া কেটে যাওয়ার শব্দ, আরও একবার। লেভিডের শরীরটা এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেছে। লাশটা আয়ুমুর পাশেই লুটিয়ে পড়েছে এতক্ষণে।

আকাশের এক কোণে জ্বলছে ধ্রুবতারা; তার পাশেই ওটা বোধহয় লুব্ধক। আয়ুমুর মনে পড়ে যায় বাবা বলেছিলেন মায়েরা এভাবেই আসেন, নিঃশব্দে। তার কানে ভেসে আসে আইয়ের আর্ত চিৎকার, বাবার ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে আসা রক্তাক্ত হাসি। সে আজ বিজয়ী। পৃথিবী এখন শান্ত, তার নিজের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সেটাও যে কতদিন শোনেনি সে। উনোর সেই সোঁদা গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। যুদ্ধ জয়ের পোড়া গন্ধ এক অদ্ভুত মায়া দিয়ে যায় সৈনিকদের। সক্রেটিস জানতেন হেমলকই দিতে পারে সমাজকে যুক্তিবোধের জ্ঞান। তাই হেমলক পান করেও সক্রেটিসরা নীলকণ্ঠ। তাঁরা মৃত্যুঞ্জয়। আর আয়ুমুরা? তারা সংক্রমণের মত বাড়ে। এক থেকে একশ, একশ থেকে হাজার, হাজার থেকে লাখ। তারা অবিনশ্বর।

লেখকের কথা: গল্পের চরিত্র অ্যাস্মোডিয়াস। জন মিল্টনের লস্ট প্যারাডাইস থেকে অনুপ্রাণিত। অ্যাস্মোডিয়াসের অর্থ লোভ। আর ডেভিল-কে করা হয়েছে লেভিড। এই গল্প রূপকধর্মী। এই গল্প লিখতে যারা অনুপ্রাণিত করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বেন ওকরি, চে এবং ভারতীয় বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ও আরও অনেকে এবং তাঁদের জীবন দর্শন। মানুষের অমরত্ব থেকে যায় তাদের চিন্তায়।