লটারি - পরাগ ভূঞ্যা

গল্প

নক্ষত্রখচিত আকাশ চেয়ে আছে আমার দিকে। রোজই চেয়ে থাকে। ওর কাছে আমিই ঈশ্বর। আমার ইশারায় আবার ভোরের ক্যানভাস হয়ে যায়। শিশু রৌদ্রের মৃদু আভা নেমে আসে। স্পিকারে বেজে ওঠে পাখিদের কলতান। এখন যদিও দুপুর তবুও রাতের আকাশ ভালো লাগে। আমার আর শ্রীপর্ণার ভালো লাগে। মাঝে মাঝেই ওর ভেন্টিলেশন্ মাস্ক খুলে ওকে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। লড়াই চলছে প্রতিনিয়ত, মৃত্যুর সঙ্গে শ্রীপর্ণার আর সময়ের সঙ্গে আমার।

শ্রীপর্ণার লাং ক্যান্সার ফাইনাল স্টেজে। আর্টিফিশিয়াল রিপ্লেসমেন্ট আমার সামর্থ্যের বাইরে। দিন গুনি রোজ। বিরক্ত লাগলে ভর দুপুরে শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুনি। কিন্তু কতদিন এইভাবে পালাবো। রাগে-ঘৃণায় খামচে ধরি রিমোট।

ভিডিও স্ক্রিন সরে গিয়ে রাতের আকাশ বদলে দেয়। স্বচ্ছ কাচের ওপারে দুর্ভেদ্য ধুলো আস্তরণ। ধীরে ধীরে স্বয়ংক্রিয় ওয়াইপার ধুলো পরিষ্কার করতে থাকে। অদূরে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উগরানো দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা চিমনিখানা নজরে আসে। ছোটবেলায় মুখপোড়া লাইটহাউস বলতাম। ওই মুখপোড়াটাই আমাদের পেটের ভাত জুগিয়ে এসেছে বাপের আমল থেকে। দৈত্যাকার চিমনির নিচ থেকে শুরু হয় চারকোনা লুডোর ছক্কার মতন লেবার কলোনি। যার একটার মধ্যে আমার গোটা জীবন কেটেছে।

গত মাস থেকে কাজটাও আর রইলো না। কোম্পানির অবস্থা ভালো নয়, অগত্যা ছাঁটাই। পি সি এস্ : দুনিয়ার তিন নম্বর প্লাস্টিক রিসাইকেল কোম্পানি। নোটিস দিয়েছিল চল্লিশ দিনের মধ্যে ঘর খালি করে দাও। আজ মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তিম দিন। খুব ইচ্ছে ছিল মুখপোড়া লাইটহাউসের চূড়ায় পৌঁছে জ্বলন্ত লেলিহান শিখায় গিয়ে ঝাঁপ দিই।

সেটাও আর সম্ভব নয়। স্লিপিং পিলস্ এখন আমাদের মুক্তির ঔষধ।

শ্রীপর্ণার কাশির শব্দে সম্বিৎ ফিরল। ওর কাশি একবার শুরু হলে অবিরাম চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে পারি না। ওকে ওইভাবেই ফেলে ঘরের এককোণায় এসে বেড়ালের মতন বসে থাকি। সব ঠিক হয়ে যাবে মনকে সান্ত্বনা দিই।

এক গ্লাস জল আর কিছু ঘুমের বড়ি হাতে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যাই পাশের ঘরে।

বিছানায় রাখা ফোনটা বেজে ওঠে।

***

প্রিয় শ্রী,

জানি না এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছবে কিনা। মান্ধাতা আমলের রুচি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেবে কিনা জানি না। প্লাস্টিক পোড়ানো এক মজদুরের নোংরা হাতে লেখা চিঠি। না জানি কত ভাইরাস লুকিয়ে আছে অক্ষরগুলোর মধ্যে। তবে আমার চোখে মনুষ্য জাতিই ভাইরাস। শুধু আকার আয়তনে দৈত্য এই যা।

আশা রাখি এতদিনে অপারেশন শেষ হয়েছে। আমি রাজনগর হাউজিং কমপ্লেক্সে একটি ফ্ল্যাট তোমার মৃত্যু পর্যন্ত লিজ নিতে পেরেছি। পুরনো বাসায় আর ফেরার দরকার নেই। তবে এইটুকুই সম্বল ছিল।

কী করে সম্ভব হলো? ভাবছ লটারি জিতেছি কিনা? সেই রকমই কিছু। আমার কোম্পানি পি সি এস্ ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের জন্য একটা ফিউচার প্ল্যান রেখেছে। যদিও আমি জানতাম না। সেদিন ওদের ফোন পেলাম। ওরা বিটা স্পেস অর্গানাইজেশন সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে। লটারির মাধ্যমে বেছে নিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে ছাঁটাই হওয়া আমার মতন কয়েকশ’ বেকারদের। আমরা পাড়ি দিচ্ছি অন্য এক পৃথিবীতে। তার বিনিময়ে তোমার অপারেশন ও ফ্ল্যাটের লিজ। আমি খুব বেশি সময় পাইনি একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই চিঠিটি লেখা। বাবা বলতো প্রেম জাহির করার জন্য চিঠির বিকল্প নেই। কতকিছু লিখবো ভেবেই জল্পনা-কল্পনার অন্ত রাখিনি। কিন্তু লিখতে গিয়ে এই কয়েকটি শব্দযোগ আমার দ্বারা সম্ভব হলো।

এই পর্যন্তই । ভালো থেকো। পারলে নতুন সঙ্গী খুঁজো। বিদায়।

ইতি,

তোমার সৌরভ

***

একটা বিশাল হলঘরে জমায়েত হয়েছি। শুধু আমি নয় রয়েছে কয়েকশ’ নারী পুরুষ। বসার স্থান ভর্তি। অধিকাংশ দাঁড়িয়ে আছে। হল জুড়ে সম্বলিত মানুষে চাপা কণ্ঠস্বর গমগম করছে। লটারি বিজেতাদের দল ভারি। সামনের সারিতে নিউজ রিপোর্টারদের ভিড়।

ডেস্কের ওপর উঠল একটি মাঝবয়সী লোক। ডজন খানিক ড্রোন ক্যামেরা ঘিরে রইল তাকে।

“লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান। নমস্কার। আমি রূপক দত্ত। পরবর্তীতে যে বিষয়গুলো আমরা আলোচনা করবো সেটা মন দিয়ে শুনুন। শুধু রিপোর্টার নয়, আমাদের মাঝে আজ রয়েছে অজস্র স্বেচ্ছাসেবী, যারা এই যুগান্তকারী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে চলেছে, আমার পরবর্তী শব্দগুলি কেবলমাত্র তাদের জন্য―আপনাদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা সমান নয়। ইনফ্যাক্ট অনেকেই স্কুলের গণ্ডি দেখেননি। তাই আমি চেষ্টা করবো সহজ ভাষায় বলার।

গোটা পৃথিবী জুড়ে বিপুল জনসংখ্যা আমাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা। সিঙ্গল্ চাইল্ড নিয়মের কড়াকড়িতে লাভ কিছু হয়নি। প্রতি মিনিটে পঁয়ত্রিশটি শিশু জন্মাচ্ছে। উপায় কী? উপায় আমাদের পৃথিবীর মতন আরও একটি গ্রহ খুঁজে সেখানে পুনর্বাসন। বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে প্রতিনিয়ত অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ আমরা খোঁজ পেয়েছি এরমই এক গ্রহ, যা সম্পূর্ণ হ্যাবিটেবল্ জোনের মধ্যে পড়ে অর্থাৎ পৃথিবীর মতনই বায়ুমণ্ডল, পাহাড়, সমুদ্র সবই আছে।”

লোকটা থামল। তারপর বাম হাত দিয়ে শূন্যে গোল আঁকল। প্রায় সেই মুহূর্তে ডেস্কের ওপর ফুটে উঠলো একটি গ্রহের থ্রি ডি হলোগ্রাফিক ছবি। নিজের কক্ষ বরাবর আবর্তিত হচ্ছে। লোকটি আবার বলে উঠল―

“তিনশ পঁচাশি দিন সময় নেয় মাতৃ-নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে একপাক ঘুরতে। ভূপৃষ্ঠের আয়তন পৃথিবীর চেয়ে ষাট শতাংশ বেশি। জলবায়ু মানুষের বসবাসের অনুকূল।

কিন্তু একটি সমস্যা― দূরত্ব। আলোর চেয়ে তীব্র গতি সম্পন্ন মহাকাশযান সৃষ্টি মানুষের দ্বারা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞান বলছে সুদূর ভবিষ্যতেও কোন আশার আলো নেই।

কীভাবে পৌঁছব আমরা?”

রূপক দত্তর হাতের ইশারায় এবার ফুটে উঠলো একটি মহাকাশযানের হলোগ্রাফিক ইমেজ।

“বিটা স্পেস অর্গানাইজেশনের ড্রিম প্রোজেক্ট ফাইন্ডিং অ্যানাদার আর্থ এর অন্যতম কারিগর এক্সেলসিয়ার মহাকাশযান। আমরা সাতানব্বইটি এক্সেলসিয়ার প্রস্তুত করার সংকল্প নিয়েছি যার মাধ্যমে প্রায় আধলক্ষ স্বেচ্ছাসেবী আমরা পাঠাতে সক্ষম হব। ইতিমধ্যে এক্সেলসিয়ার-১ প্রস্তুত এবং তিনশ পঁচাশি জন আগামী সপ্তাহে পাড়ি দিচ্ছে নতুন পৃথিবীতে।” বলেই রূপক দত্ত তর্জনী এগিয়ে দেয় আমাদের দিকে।

সারা হলঘর জুড়ে হাততালি ফেটে পড়ে।

―“স্যার আমার কিছু কোয়ারি ছিল।” ক্রমশ শান্ত হওয়া করতালির শব্দের মাঝে একজন রিপোর্টার দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো।

―“মাই প্লেজার। বলুন।” রূপকের গলায় বিনয়ের সুর।

―“নতুন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ প্রায় দ্বিগুণ। মানুষ কি সত্যিই এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে?”

―“পারবে। তবে এরা কেউ সশরীরে পৌঁছতে পারবে না। পৌঁছবে এদের বংশধররা। এক্সেলসিয়ার-১ একটি জেনেরশন শিপ। কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ, ম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ড সব কিছুর ব্যবস্থা রয়েছে। সময়ের সঙ্গে এদের উত্তরসূরিরা অভিযোজনের মাধ্যমে এই অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হবে।”

―“নতুন পৃথিবী চোদ্দ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। নাসার হিলিয়াস সেভেনের সমতুল্য গতি বজায় রেখে চললে পৌঁছতে দু কোটি বছর লাগবে। বিটা স্পেস অর্গানাইজেশন কী এমন প্রযুক্তি নিয়ে এলো যার দ্বারা মাত্র কয়েক হাজার বছরে এই দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব?”

―“এর উত্তর আমার কাছেও নেই। জেনে থাকলেও বলতাম না। জনস্বার্থে কিছু বিষয় গোপন থাকাই শ্রেয়। নেক্সট।”

―“আকাশগঙ্গা আনন্দ থেকে আমি শ্রীময়ী। বিটা স্পেস অর্গানাইজেশন গত পঁচিশ বছর ধরে পারমাণবিক অস্ত্রের বিরোধিতা করে এসেছে। কিন্তু হালফিলের একটি কন্সপিরেসি থিওরি অনুসারে আপনারা উন্নত মানের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরিতে বিপুল পরিমাণে টাকা ঢালছেন। সম্প্রতি হাই টেক লেজার গান প্রচারের আলোয় এসেছে। এই বিষয়ে যদি আলোকপাত করেন।”

―“অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে কথা বলতে আসিনি। ক্ষমা করবেন। নেক্সট!” রূপক দত্ত বেশ বিরক্ত হলেন।

―“সমাজের অকর্মণ্যের দলকে এই বৈপ্লবিক মহাকাশযাত্রায় কেন সামিল করছেন? যোগ্য লোকের কি অভাব ছিল?” প্ৰথম প্ৰশ্নকর্তা ফিরে এলো।

―“কে যাবে? আপনি? এটা তো স্বেচ্ছামৃত্যুর সমতুল্য। পৃথিবীর মোহ-মায়া, পরিবার ছেড়ে কে যেতে চাইবে? কেউ না। রঙ্গমঞ্চে তামাশা দেখে সমালোচনা করা লোকের অভাব নেই। অভাব অভিনেতার!”

―“ওয়ান্স ইন এ মিলিয়ন! নিন্দুকরা বলছে এটাই সাফল্যের হার। কেবলমাত্র সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে জলের মতন এত টাকা নষ্ট করবে বিটা স্পেস অর্গানাইজেশন! এটাই কি বিকল্প রাস্তা? মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ?”

―“উপায় তাহলে আপনারাই বাতলে দিন... ক্ষমা করবেন আজ এই পর্যন্তই। নমস্কার।”

রূপক দত্ত ডেস্ক ছেড়ে নেমে এলেন। রিপোর্টার আর ড্রোন ক্যামেরার দল তাঁকে অনুসরণ করলো। আমরা কৃতজ্ঞ হয়ে আমাদের পরিত্রাণকর্তার চলে যাওয়ার পথে চেয়ে রইলাম।

***

প্রিয় শ্রী,

এই চিঠিটি লেখার কোনও অর্থবহ কারণ নেই। লটারি জেতার মূল্যের বিনিময়ে অনেকগুলি শর্ত পূরণের মধ্যে একটি পরিবারের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা। যদি কোনও সহৃদয় ব্যক্তি তোমার কাছে পৌঁছে দেয় সেই আশায় চিঠিটি লেখা।

আমি ভালো আছি। সহযাত্রীদের অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন হয়েছে। মাঝে আমাদের একটি বিশেষ পোশাকের সঙ্গে পরিচয় করানো হলো। ন্যানো ফাইবার দিয়ে তৈরি। দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম। স্পাইডারম্যানের সিম্বিয়ান ব্ল্যাক সুটের মতন। নিজের ইচ্ছেমত রং ও টেক্সচার পরিবর্তন করে নেয়। আমরা অনেকেই ঠিক করে রেখেছি মহাকাশযানে এই পোশাক পরে নিজেদের মত রং পাল্টে কসপ্লে খেলবো। বেশ মজার ব্যাপার হবে। খবরের চ্যানেলগুলিতে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্ৰথম পোশাকটি নিলামে দাম উঠেছে কয়েক কোটি টাকা। তবে আরও একটি খবর দাবানলের মতন ছড়াচ্ছে― ফাস্ট স্পেস কাপল্।

‘এক্সেলসিয়ার-১’-এ সঙ্গী নির্বাচনের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে জ্যাসমিনের আমাকে মনে ধরেছে। সে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে পৃথিবীতে থাকাকালীন তার প্রস্তাব পূরণ করা হোক। কর্তৃপক্ষও এই নাটুকে প্রস্তাব লুফে নিয়েছে। একপ্রকার জোর করেই আমার সম্মতি নেওয়া হয়েছে। ট্রেনিং ক্যাম্পের বাইরে নজর গেলেই শহর জুড়ে আমার আর জ্যাসমিনের পোস্টার। জ্যাসমিন আহামরি সুন্দরী নয়, বরং উচ্চতায় আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। ওর সঙ্গে কথা বলেছি। তোমার কথাও ওকে বলেছি। তবে মেয়েটির মন বড় সরল। আর কৈফিয়তের গান গাইবো না। কাল আমরা শ্রীলঙ্কা পাড়ি দিচ্ছি। সেখান থেকে স্পেস এলিভেটরের মাধ্যমে পৌঁছে যাবো মহাশূন্যে, যেখানে অপেক্ষা করে আছে এক্সেলসিয়ার-১।

বিদায়।

ইতি,

সৌরভ

***

নীল সমুদ্র। তার ওপর ভাসমান মোবাইল প্লাটফর্ম ছেড়ে ধীরে ধীরে স্পেস এলিভেটর আমাদের নিয়ে মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে। দূরে সমুদ্র সৈকতে অজস্র মানুষের ভিড় ক্রমশ ক্ষুদ্রতর হয়ে আসছে। স্বচ্ছ কাচের ওপর ধীরে ধীরে কালো আবরণ ঢেকে যায়। বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণ জনিত তাপ থেকে সুরক্ষার জন্য, নইলে জ্বলে পুড়ে শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগতো না।

মোট পাঁচ দফায় আমাদের এক্সেলসিয়ার-১ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরাই অন্তিম দল। লটারি বিজেতাদের জল্পনা-কল্পনা চাপা কলরব হয়ে শ্মশানসম নিস্তব্ধতায় ছেদ টানছে। হঠাৎ মাথার ওপরে কিছু দূরে অবস্থিত বড় বড় স্ক্রিনগুলি জীবন্ত হয়ে উঠলো।

নিউজ চ্যানেলগুলোতে আমাদের রমরমা। গোটা পৃথিবী জুড়ে উৎসবের আমেজ। বিপরীতে কেউ কেউ আবার প্রতিবাদী দাঙ্গায় নেমেছে। অনেকের দাবি পরবর্তী অভিযানে তাদের নিয়ে যাওয়া হোক। উল্টোদিকে, ইতিমধ্যে স্পেস স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া আমার সহযাত্রীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া আলাদাই মাত্রা যোগ করেছে।

নিশ্চুপ হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকি সিটে। বন্ধ চোখের আড়ালে প্রথমে বাবার মুখ ভেসে আসে। বাবা ছোটবেলায় পারগাটোরির গল্প শোনাত। রোমান ক্যাথলিক ধর্মে একধরনের শুদ্ধিস্থান, যেখানে স্বর্গে যাওয়ায় আগে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। এই লিফট আমার কাছে সেই শুদ্ধিস্থান। একে একে মানসপটে ফুটে ওঠে মুখপোড়া লাইটহাউস, লটারি জেতার ফোন আর শ্রীপর্ণার লাবণ্য ভরা মুখখানি। স্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে শ্রী এগিয়ে আসে আমার দিকে। মুখে ভেন্টিলেশন্ মাস্ক, চুলগুলি বাতাসে ভেসে বেড়ায় এলোমেলো হয়ে। তার চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও তাকে থামাতে পারেনি, সে হাঁটতে থাকে।

কয়েকঘন্টা পর লিফট থেমে যায়। অভিযাত্রীদের মধ্যে শোরগোল পড়ে যায়। ভাবলাম গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। কিন্তু পরক্ষণে স্ক্রিনে যা ফুটে উঠল তাতে বিস্ময়ের অন্ত রইল না।

‘মহাকাশের প্রথম দম্পতি সৌরভ ও জ্যাসমিন পৌঁছে গেছে স্পেস স্টেশনে। তাদের চুম্বন বিনিময়ের বিরল দৃশ্য। ভিডিও সৌজন্যে বিটা স্পেস অর্গানাইজেশন।’

সব মিথ্যে, একটা বড় মিথ্যে! এরা নিয়ন্ত্রণহীন মারণভাইরাসের বিকল্প রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। সমাজের অদরকারী মানুষদের ছেঁটে ফেলবে আর কেউ প্ৰশ্নও করবে না!

আমরা সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে দেওয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে অজস্র লেজার গান!

লটারি বিজেতারা একে একে বাষ্পীভূত হতে থাকে।

লেখকের কথা: শার্লি জ্যাকসনের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘লটারি’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গল্পটি লিখি। ২০৭৫ সালে আমার কল্পনায় কিছু সম্ভাব্য ঘটমান বিষয়, যেমন—প্রথম সক্রিয় স্পেস এলিভেটর, লাঙ ক্যান্সারে ১০০% মৃত্যুর হার, রং-রূপ পরিবর্তনে সক্ষম ন্যানোফাইবার পোশাক, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নির্মম কায়দা ইত্যাদি গল্পে ব্যবহার করেছি । গল্পটি আমার মস্তিষ্কপ্রসূত, অন্য কিছুর সঙ্গে মিল থাকলে তা সম্পূর্ণ কাকতালীয় ঘটনা।