নব রবিকিরণে - রাকেশকুমার দাস

গল্প
এক

জলতরঙ্গের মতো ঝিলমিল সঙ্গীতের মূর্ছনায় আর মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল নূর সুমনের। চোখ না খুলেই হাত নাড়িয়ে অ্যালার্মটা বন্ধ করল, মোরগও থেমে গেল। ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই ঘরের উলটো দিকের দেওয়ালে মোরগটাকে দেখতে পেল নূর। খড় দিয়ে ছাওয়া একটা মাটির বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পাশে একটা গরু বিচুলি চিবিয়ে চলেছে।

হঠাৎ কী মনে পড়তেই ধড়াম করে বিছানায় উঠে বসল। বামদিক থেকে ডানদিক আড়াআড়ি হাত নাড়তেই দেওয়াল থেকে পুরনো দিনের গ্রামবাংলার ছবি উধাও হয়ে গেল। এবার সামনের তিনদিকের দেওয়াল জুড়ে একটাই রঙ ফুটে উঠলো, তাতে বিভিন্ন জায়গায় অনেক কিছু লেখা আর আইকন দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়া, পৃথিবীর খবর, শেয়ার মার্কেটের তথ্য, ছবি, কিছু মেসেজ—সব দেওয়ালেই দেখা যাচ্ছে।

নূর তাড়াহুড়ো করে মিটিং এর আইকনটার দিকে হাত দেখিয়ে ‘আয় আয়’ বলে ডাকার মতো হাতছানি দিল। সামনের দেওয়ালটা জানাল, আর দশ মিনিট পর একটা মিটিং শুরু হতে চলেছে। নূর সেটাকে আবার ‘কেটে পড়’ ভঙ্গিতে ইশারা করায় সেটা দেওয়াল থেকে চলে গেল।

নূর তারপর আবহাওয়ার খবরটা খুলল হাতছানি দিয়ে। দেওয়ালে এখন মেঘলা আকাশের খবর আর বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া একলাইন ভেসে উঠেছে, তার পেছনে সেই গ্রামবাংলার ছবিটি ভেসে উঠেছে আবছাভাবে, তবে সেখানে গরু বা মোরগ কোনটাকেই দেখা যাচ্ছে না, শুধু দেখা যাচ্ছে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে মাটির উঠান।

নূর চট করে পেছনের দেওয়ালে তাকাল, সাধারণ দেওয়াল, তাতে কোনও ছবি নেই। নূর হাত নাড়িয়ে বাইরের ক্যামেরার লাইভ-ফিড নিয়ে এল এই দেওয়ালে। তাতে সারি সারি বাক্সের মত বিশাল বিশাল বাড়ি দেখা যাচ্ছে শুধু। মেঘ করে আসা কালো আকাশের ব্যাকড্রপে সাদা দেওয়াল ও বাড়ির খোপে খোপে বেড়ে ওঠা সবুজ গাছপালা মেশানো বাড়িগুলো যেন বাচ্চাছেলেদের মতো বৃষ্টিতে ভেজার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। নূর মনে মনে ভাবল, যদি আজ বেরোতে হয় তাহলে স্লেটে চার্জ দিয়ে নিতে হবে। নূর তাড়াতাড়ি বাইরের ক্যামেরা বন্ধ করে চার্জিং পয়েন্টে স্লেটটা লাগিয়ে দিল।

নূর চট করে বাথরুমে গিয়ে দাঁতে ব্রাশ দিল। ব্রাশ বালতি বেসিন কমোড সবই অ্যালজি-প্লাসটিকের, রিসাইক্লেবল উপাদান। প্রাতঃকৃত্য করে গালে দুইদিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি যেটুকু ছিল পরিষ্কার করে কামিয়ে নিল। ওদিকে মিটিং শুরু হবার খবর দিয়ে দিয়েছে একটা গরু, বাথরুমের আয়নার এক কোণে আবির্ভাব হয়েছে তার।

নূর তাড়াতাড়ি ছুটে গেল। ঢুকেই হাত নেড়ে মিটিং শুরু করে দিল, জিজির মুখ দেখতে পেল দেওয়ালে। জিজির একরাশ কোঁকরানো চুলের জাদুতে নূর কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। জিজির ঠোঁটের নড়াচড়া দেখতে দেখতে বুঝলো, জিজির সাউন্ড মিউট করা আছে। সঙ্গে সঙ্গে ভলিউম বাড়িয়ে দিল, হাত দিয়ে কিছু তোলার ইশারায়।

“কী বললাম শুনেছিস? হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন?” জিজি রাগত স্বরে প্রশ্ন করল।

“না, মিউট করা ছিল। আবার বল। আজ কি অপারেশন হচ্ছে?” স্বভাবসিদ্ধ মেয়েলি ভঙ্গিতে বলল নূর।

“হ্যাঁ। আজকেই হচ্ছে। তুই এখনই বেরিয়ে পড়।”

“আমাদের মামনি আবার ঝোলাবেন না তো?”

“খুব টেনশন হচ্ছে রে। রিনার জন্যই চিন্তা হচ্ছে, হয়তো ঝোলাবে না, কিন্তু ওর কেরিয়ার লাইফ দুটোই রিস্কে আছে।”

জিজির ছবিটাকে অর্ধেক করে দিয়ে আরেকজন দেওয়ালের বাকি অর্ধেকটা দখল করল, “হ্যালো নূর ডার্লিং!”

রাজেন্দর!

“নূর ডার্লিং, তোর সঙ্গে রিনার লোকেশন সিঙ্ক করিয়ে দেব ১০টার পর। তুই এখনই বেরিয়ে পড়। কই একটা হামি দে এবার।”

নূরের মাথা গরম হয়ে গেল।

“এই যা তো। মাথা ঠান্ডা রাখতে দে। সবসময়ে মজা ভাল লাগে না।” বলে হাতের ইশারায় মিটিং বন্ধ করে দিল।

নূর ঝটপট তৈরী হয়ে নিল। স্মার্টশার্টের কলারের খাঁজে স্লেটটা গুঁজে দিতেই শার্টের মধ্যে ওই প্রাচীনকালের গ্রামবাংলার ছবির একটা আভাস ভেসে উঠল। নূর দ্রুত স্লেটে হাত বুলিয়ে বন্ধ করে দিল। আপাতত রোকিনের গান যেটা থেমেছিল সেটা চালিয়ে দিল, জামাটা সাদা থেকে গাঢ় বেগুনি হয়ে গেল আর রোকিনের ঝাঁকড়া চুলভরা মাথা বারবার হেড-ব্যাংগিং করতে লাগল নূরের পেট জুড়ে। ঠোঁটে হাল্কা বেগুনিরঙের একটা পোঁচ দিয়ে অ্যামিবার মতো দেখতে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে যখন নূর দরজা লক করে বেরিয়ে গেল, তখন দেওয়ালে আবার বৃষ্টির পূর্বাভাস এসে দাঁড়িয়েছিল, কয়েকটা ব্যাঙ থপথপ করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল দেওয়াল জুড়ে।

দুই

রিনা সারিনেন আর-এন-টি-ফাইভ মেট্রো স্টেশনের টয়লেটের কমোডে বসেছিল প্যান্ট পরে। আসন্ন বিপদের ভয়ে তার স্লেট ধরা হাতটা কাঁপছিল। স্লেটে দেখাচ্ছিল স্থানীয় দু-তিনটি ভিডিও চ্যানেলে তার ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে, পুলিশ তাকে খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। অফিস বিল্ডিং ও রাস্তার ক্যামেরায় তার যে ছবি ধরা পড়েছে সেগুলোই পুলিশের পাবলিক চ্যানেল থেকে প্রকাশ করা হয়েছে, সেটাই কয়েকজন তাদের চ্যানেলে পুনরায় শেয়ার করেছে। সরকারের ভিডিও শেয়ার করলে পয়সা পাওয়া যায় কিছু। এত তাড়াতাড়ি যে তার খোঁজ পড়ে যাবে তা সে ভাবতেও পারেনি। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে চ্যানেল পালটাতে লাগল। আগেকার দিনের সিনেমা চলছিল একটা চ্যানেলে, এব্রাম খান তার চোখ নাচিয়ে ডায়লগ দিচ্ছিল, ‘কখনও কি তোমার মনে হয়েছে যে জীবনের কোনও এক স্বপ্ন পূরণ করতে তুমি তোমার প্রাণটাও দিয়ে দিতে পারো একটুও না ভেবে?’

রিনা স্লেটটাকে দুই হাতের তালুর মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে চেপে ধরল। দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছিল। অস্ফুটে বলে উঠলো, “হ্যাঁ। হ্যাঁ আমি পারি।”

***

দু-ঘন্টা আগেও এতটা ভয় ছিল না রিনার মনে। অফিসের জানলা দিয়ে গগনচুম্বী বাড়িগুলোর মাথায় বসানো সূর্যমুখী ফুলের মত সোলার প্যানেলগুলোর চালচলন দেখতে বেশ পছন্দ করে রিনা। সবসময়ে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে এরা। দুপুরে মুখ উঁচু করে থাকে, সূর্য যত পশ্চিমে ঢলতে থাকে এরাও মুখ নামাতে থাকে। যেন সূর্য কোনও বিখ্যাত অভিনেতা বা রাজনীতিক—আর প্যানেলগুলো তার কথাবার্তা, ইশারা সব ভিডিও রেকর্ড করে নেওয়ার জন্য মুখ তাক করে স্লেটের ক্যামেরা তাক করে আছে।

অভিনেতা বা রাজনৈতিক লোকেদের কথার গুরুত্ব তেমন না হলেও আজকের যুগে সূর্যকে ছাড়া গতি নেই। এই প্রতিটা গগনচুম্বী বাড়ির হাজারটা অফিসের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ওই সূর্য থেকেই আসে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে। S.E.T. এন্টারপ্রাইজ, যাদের অফিস পাশের বিল্ডিং-এ, তারাই এই শহরে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্টন করে। প্রতি বিল্ডিং-এ বসানো প্যানেল থেকে শক্তি যায় তাদের কেন্দ্রীয় শক্তিভান্ডারে, সেখান থেকে সমস্ত অঞ্চলে পুনরায় বন্টন করা হয়। সাতদিন সূর্য না উঠলেও তারা সঞ্চিত শক্তি থেকে সাতদিন চালিয়ে নিতে পারবে। সারি সারি সোলার প্যানেলে তাদের কমলারঙের গোল লোগোটা যেন হাজারটা চোখ রিনার দিকে তাকিয়ে আছে।

কিন্তু আজ আর জানালাবিলাস করা হল না রিনার। এমনিতেই সকাল থেকে আকাশ মেঘলা, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে অনবরত। আর বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না। ঠিক ৪টে বাজে, ডেটাসেন্টার রুম থেকে অ্যাডমিন ছেলেটা এখনই বেরোয় চা খেতে। রিনা পা চালালো দ্রুত।

ওই তো ছেলেটা বেরিয়ে যাচ্ছে ওপরে, ক্যাফেটেরিয়ায়। রিনা অফিসের গাছ-গাছালি ভরা কাঁচঘেরা করিডোর দ্রুত পেরিয়ে ডেটাসেন্টারে ঢুকল। স্মার্টশার্টের খাঁজ থেকে একটা আইডি চিপ বের করল। সেটা দরজার সামনের প্লেটে ধরতেই দরজা খুলে গেল। আগে ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করার স্ক্রিনটায় গিয়ে কিছু কাজ করল, যাতে ক্যামেরা পরবর্তী ৩০ মিনিট কিচ্ছু রেকর্ড না করে। এবার আরো ভেতরে ঢুকে গেল রিনা।

গত সপ্তাহে একই রকম পদ্ধতিতে সে একটি ন্যানোডিস্ক বসানো ডিভাইস এখানে লাগিয়ে গেছিল। প্রথম দিন ব্যর্থ হয়েছিল যদিও, দ্বিতীয়দিনের চেষ্টায় সফল হয়। আজ আর সেটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হল না। ডিভাইসটা যেই তার থেকে বিচ্যুত করল রিনা, সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল।

রিনার মাথার আকাশ ভেঙে পড়ল, তার মানে তো ঘরে বন্দি! কলে পরা ইঁদুরের মতো থরথর করে কেঁপে উঠল।

লোডশেডিং? গত কয়েকবছরে কোনওদিন হয়েছে? রিনা মনে করতে পারল না। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই আবার আলো ফেরত এল। রিনারও ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। চট করে তারটা আরেকবার লাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল, ডিভাইসটা ততক্ষণে তার পকেটে চলে এসেছে।

অফিসের গাছ-গাছালি ভরা করিডোরটা আবার পেরোল রিনা। কাচের দেওয়াল বৃষ্টির জলের বিন্দুতে ভরে রয়েছে, তাতে পালা করে নীল রঙ লাল রঙ এসে বিমূর্ত কিছু আকার রঙ করে দিয়ে যাচ্ছে দশ সেকেন্ড অন্তর অন্তর। স্লেটটা বের করে সময়টা দেখল। কালো মেঘের সন্নিবেশে প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে অসময়ে।

অন্যমনষ্ক রিনার সম্বিৎ ফিরল দক্ষিণ ভারতীয় টানে ‘কাজ হয়ে গেল?’ শব্দে। চমকে তাকিয়ে দেখে শ্রীনিবাস রাজু, ডেটাসেন্টারের অ্যাডমিন। চমকে হাত থেকে স্লেটটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। কী বলবে ভেবে পেল না রিনা। ‘ওক্কে গুডনাইট রিনা’ বলে রাজু পাশ কাটিয়ে চলে গেল হাসতে হাসতে।

হাসল কেন? ও কি কিছু দেখেছে বা আঁচ করেছে?

লিফটের মধ্যেও বুঝতে পারল এখনও চমকে যাওয়ার রেশটা যায়নি। বুকটা এখনও ঢিপঢিপ করে যাচ্ছে। এখন যা করতে হবে তা হল মাথা ঠান্ডা রেখে ডিভাইসটা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে।

আগেকার মতো ইন্টারনেটে সুরক্ষিতভাবে বা নামধাম গোপন রেখে তথ্য পাঠানোর উপায় নেই। এখন ইন্টারনেট তিন ভাগে বিভক্ত—গভরনেট, এলিটনেট আর পাবলিকনেট। পাবলিকনেট থেকে অপর দুটি নেটওয়ার্কে বিচরণ করা তো যায়ই না, উলটে সরকার পাবলিকনেটের সমস্ত তথ্য চালাচালি পুরোপুরি নজরাধীন রাখে। তার থেকেও বড় কথা ঐ ন্যানোডিস্কটা লাগিয়ে তথ্য বের করার মতো কোনও অন্য যন্ত্রও নেই। স্লেট বা এইজাতীয় ব্যক্তিগত যন্ত্রে ও জিনিস লাগানো যায় না।

হঠাৎ আরো একটা শঙ্কা এল রিনার মাথায়। বেরনোর সময় গেটে চেকিং এ যন্ত্রটা ধরা পড়ে যাবে না তো?

লিফ্‌ট একদম গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে ঠেকতেই রিনা চট করে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। মেয়েদের টয়লেটে কখনও ক্যামেরা থাকে না। রিনা টয়লেটে ঢুকে ডিভাইস থেকে ন্যানোডিস্কটা সন্তর্পণে বার করে আনল। তারপর বাকি ডিভাইসটা ফ্ল্যাশ করে দিল। আর ন্যানোডিস্কটা মাথার চুলের ক্লিপের মধ্যে চুল সমেত আটকে নিল। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা রিনার মাথা স্ক্যানিং পর্দায় আসে না, আর আজ পর্যন্ত কেউ মাথা নিচু করে স্ক্যান করানোর জন্য জোর করেনি।

অফিস থেকে বেরিয়েই রিনার ভয় অনেকটা কেটে গেল। নতুন শহরের ধুলো-ধোঁয়া-দূষণমুক্ত বাতাস, তার মধ্যে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ছোটবেলার ধুলো-ধোঁয়া ভরা পরিবেশ তার এখনও মনে পড়ে।

ধীরে ধীরে সৌরশক্তি দিয়ে সবকিছু চালানোর ব্যবস্থা আসতেই দূষণ বিদায় নিয়েছে। তবে পুরনো শহরে বেশীর ভাগ জায়গাই আগের মতো রয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকালো রিনা। সবুজ ছোপ-ছোপ ওয়ালা সাদা বাড়িগুলো যেন কালো মেঘ অবধি চলে গেছে। মেঘ না থাকলে ওই উত্তর কোণটায় একটা সবুজ তারা দেখা যায়। আসলে তারা নয়, স্যাটেলাইট তথা স্পেস-স্টেশন। নাম অমর্ত্য।

রিনার বহুদিনের ইচ্ছা অন্তত কিছুদিনের জন্যে হলেও অমর্ত্যে গিয়ে কাজ করার। অমর্ত্যে একটা বিশাল সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে। ওখানে সূর্যরশ্মি থেকে ব্যবহারযোগ্য শক্তি তৈরি করে মাইক্রোওয়েভে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিনা মাথা নামালো। চাপা উৎকন্ঠাটা আবার চেপে ধরেছে।

রাস্তা দিয়ে দ্রুত হাঁটছিল রিনা। রাস্তার দোকানগুলো আর তাদের হলোগ্রাম-বিজ্ঞাপনগুলো অন্ধকার পেয়ে একটু আগেই চালু হয়ে গেছে। এক শাড়িপরা যৌবনবতী মহিলার হলোগ্রাম ‘নমস্কার রিনা’ বলে এক হাত দিয়ে আঁচলটা মেলে ধরে নাচের ভঙ্গিমায় দাঁড়াল পথ রোধ করে। রিনা তাকে ভেদ করে চলে গেল। আরও দ্রুত হাঁটতে লাগল।

পাশে উত্তর-মেরুর বিশাল হোটেলগুলোর বিজ্ঞাপন হয়ে চলছিল, অন্য দিন রিনা সেটা তারিয়ে তারিয়ে দেখে। আজ সেই সময় নেই। আজ সোলারবাইকটা সে অন্য জায়গায় রেখে এসেছে। পারলে সে সোলারকার ব্যবহার করতে পারে, তার একটা খুব দামী মডেলের সোলারকার আছে। কিন্তু তাতে বড্ড বেশী আভিজাত্যের ছোঁয়া। সোলারবাইকটা ব্যবহার করতে সে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ। চট করে আলোকোজ্জ্বল রাস্তা থেকে সরে গেল রিনা। বিল্ডিংগুলোর ভিতরের গলির মতো রাস্তা দিয়ে রীতিমতো ছুটতে লাগল এম-বি-টু মেট্রো স্টেশনের দিকে।

মেট্রো স্টেশনে আসতেই রিনা বুঝতে পারল অন্য দিনের থেকে আজ মেট্রো স্টেশনটা আলাদা লাগছে, কারণ বড্ড বেশি পুলিশ বাইরে ও ভেতরে। রিনা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল, স্লেট ঠেকিয়ে গেট খুলে প্ল্যাটফর্মে নেমে গেল। কী সৌভাগ্য, নামতে না নামতেই ট্রেন। রিনা সামনের প্রিমিয়াম কোচে উঠে পড়ল।

রাজেন্দরের মুখটা মনে পড়ল। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই রিনার জগতে একটা বড় হেলদোল পড়ে যায়। আগে আর পাঁচটা চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়েসী ছেলেমেয়ের মতোই ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে উদাসীন, সম্পূর্ণরূপে মনোরঞ্জনে নিমগ্ন এক মেয়ে ছিল। এই রাজেন্দরের সঙ্গেই অ্যাপ-ডেট করার পর থেকে ছেলেটার জগৎটা ধীরে ধীরে রিনার সামনে আসে।

রাজেন্দারের চেহারার থেকেও আকর্ষণীয় লাগে রাজেন্দরের পাণ্ডিত্য আর বুদ্ধিমত্তা। রাজেন্দার যা যা জানে, যা পড়ে তার একটা ভগ্নাংশ জানতে পেরেও রিনা অবাক হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ওদের বন্ধুবান্ধবদের গ্রুপের অংশ হয়ে পড়ে রিনা। রাজেন্দর, কৃষ্ণেন্দু, জিজি, নূর—আরও অনেকে আছে ওদের গ্রুপে। আপাতত তার উদ্দেশ্য হল, ন্যানোডিস্কটা আর-এন-টি-ফাইভ স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের কাউকে হস্তান্তর করে দেওয়া।

না। আর-এন-টি-ফাইভ থেকে বেরানো হয়নি রিনার। ট্রেনের মধ্যেই টের পায় তাকেই খুঁজছে সমস্ত পুলিশ। কামরার ভিতরের স্ক্রিনেও দেখা যায় তার ভিডিও দেখিয়ে পুলিশ তাকে ধরিয়ে দেওয়ার আবেদন রাখছে। আর-এন-টি-ফাইভে নেমেই রিনা বুঝতে পারল বেরনোর সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে পুলিশ চেকিং করছে। ইতিমধ্যে এও টের পেল অনেকেই আড়চোখে তাকে দেখছে, কারণ বর্ণনা আর ভিডিওর সঙ্গে রিনা পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে।

আর কোনও রাস্তা না পেয়ে রিনা স্টেশনের টয়লেটে ঢুকে লেডিস সেকশনে ঢুকে পড়েছিল।

তিন

রিনার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। টয়লেটের বাইরেই যে তার জন্য পুলিশ অপেক্ষা করছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। ছুটে পালানো যাবে না। পুলিশ বেরনোর সমস্ত গেট বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আবার আরেকটা ইঁদুরকলে পড়ে গেছে রিনা।

ঘাড়ে মুখে একটু জল দিয়ে বেরাল রিনা। টয়লেটের একদম বাইরের দরজা খুলেই দ্রুত হাঁটতে লাগল। টের পেল চারপাশ থেকে কয়েকজন ধীরে ধীরে তাকে একটি বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ করছে।

হঠাৎ একজন এসে ‘এক্সকিউজ মি, আপনি মিস রিনা সারিনেন?’ বলে পুলিশের চেহারায় সামনে উদয় হল।

“হ্যাঁ, কী ব্যাপার?” বলে রিনা লক্ষ করল দুজন মহিলা পুলিশও পেছনে এসে দাঁড়াল।

“কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে আসতে হবে। একটা অভিযোগের ভিত্তিতে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলার ছিল।” বলে অফিসারটি হ্যান্ড-জ্যাপারটা নাচালেন। অর্থাৎ বেগড়বাঁই করলে তারা জনসমক্ষে বন্দী করে নিয়ে যেতে পিছপা নয়। রিনা টের পেল ইতিমধ্যেই পনেরো-কুড়িজন লোক স্লেট উঁচিয়ে ভিডিও রেকর্ড করা শুরু করে দিয়েছে। এমন রসালো ভিডিও তাদের চ্যানেলে দিলে ভাল টাকা আসবে।

রিনা বলল, “দেখুন আপনারা বলছেন যখন আমার আপনাদের সঙ্গে যেতে আপত্তি নেই। তবে আপনাদের নিশ্চই কোনও ভুল হয়েছে।”

অফিসার বলল, “সেটা আপনি প্রমাণ করার অনেক সময় পাবেন, আপাতত আমাদের সঙ্গে চলুন।”

“দয়া করে আমাকে ঘিরে রাখবেন না, আমি আপনাদের সঙ্গেই যাচ্ছি। আমি চাই না আমার ভিডিও কাল সবার চ্যানেলে দেখতে।”

“ঠিক আছে, তবে মনে রাখবেন, পেছন থেকে কিন্তু সশস্ত্র অফিসার আপনাকে ফলো করছে। চালাকি করবেন না দয়া করে।”

অফিসার তার নিজের গোলাপি স্লেট বার করে কী যেন বললেন। রিনার মনে হল তার ধরা পড়ে যাওয়ার খবরটাই পাঠাল।

পুলিশদের সঙ্গে মেট্রোর গেটে এল রিনা। গেটটা পুলিশ আবার স্বাভাবিক করে দিয়েছে, লোকজন দ্রুত বেরোতে পারছে। তাকে একটু জনান্তরে এনে একজন অফিসার তাকে নাম বলতে বলল, আর আইডি দেখাতে বলল।

রিনা যখন সেগুলো করল, আরেকজন অফিসার তার ভিডিও তুলে নিল। গেটের বাইরে গিয়ে দেখা গেল পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চেকিং লাইনে একজন করে বেরনোর ফলে রিনার পেছনে সেই অফিসার ছাড়া আর কেউ ছিল না। রিনার মাথায় হঠাৎ কে যেন জানিয়ে দিল, এই সুযোগ।

রিনা ছিটকে অফিসারের আয়ত্ত থেকে বেরিয়ে দৌড় মারল। সঙ্গে সঙ্গে একদল পুলিশও হইহই করে তার পেছনে দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু এই অঞ্চলটা রিনা হাতের তালুর মত চেনে। দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। জেকবদের এখানে একটা খাবার দোকান আছে গলির ভেতরে, যদি মেট্রো করে কোথাও যায়, সেখানেই রাখা থাকে রিনার সোলারবাইকটা। কিছুদূর দৌড়াতেই রিনা তার সোলারবাইকটা পেয়ে গেল।

এই অঞ্চলটা অনেক পুরনো, অন্ধকার ঘুপচি গলি আছে অনেক। সৌরশক্তির বহুল ব্যবহার এই অঞ্চলে অত বেশি নেই। নিস্তেজ হলুদ আলোয়ে আলোকিত গলিগুলো পেরোতে লাগল রিনা ফুল স্পিডে। গলি থেকে বড় রাস্তায়, তারপর আবার গলিতে।

বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা তার দৃষ্টি ঝাপসা করে দিচ্ছিল মাঝে মাঝে। রাস্তায় বসে থাকা উদ্বাস্তু আর খাবার স্টলগুলিকে সামলে রিনা চলছিল আরও ভেতরের দিকে, যেদিকটা পুলিশের কব্জায় আসতে অন্তত কিছুটা সময় লাগবে।

কিছুক্ষণ পরেই পুরনো কারখানা আর গুদামঘরের জায়গাটায় চলে এল। পাশেই জাঙ্ক-ইয়ার্ড। পুরনো আমলের পেট্রল বা ডিজেল ইঞ্জিনের জং-ধরা বাতিল গাড়ি শয়ে শয়ে ডাঁই করে রাখা। আজকাল তেলে বা গ্যাসে চলা গাড়ি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। এই জায়গাটায় রিনা ছোটবেলায় আসত, রিনার বাড়িও কাছাকাছি।

তবে যাই হোক, আজ আর বাড়িতে যাওয়া যাবে না। রিনা বাইকটাকে আস্তে করে স্লেটটা দিয়ে খুলল। রাজেন্দর স্লেটের সফট্‌ওয়্যারে কিছু কারিকুরি করে দিয়েছে যা দিয়ে লোকেশন বন্ধ করে দেওয়া যায়। রিনা আগে লোকেশন বন্ধ করল।

হঠাৎ আরেকটি বাইকের আওয়াজ পেল রিনা, সঙ্গে সঙ্গে আবার স্পিড বাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করল। পেছন থেকে আওয়াজ এল, ‘বাইক থামান, নয়ত গুলি করব’ । রিনা আরো জোরে চালানোর চেষ্টা করল, গাড়ির স্তূপের মধ্য দিয়ে সরু জায়গা দিয়ে আরও ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইল। পেছন থেকে ঠং ঠং আওয়াজ পেল, অর্থাৎ পেছনের পুলিশটি গুলি চালাতে শুরু করেছে।

হঠাৎ রিনা খেয়াল করল বাইক ক্রমশ আস্তে হয়ে যাচ্ছে। তার মানে তার বাইকে গুলি লেগেছে। তারপরেই সে বাম নিতম্বে গরম কিছুর অস্তিত্ব টের পেল। কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পারল গুলি লেগেছে। বাইক সমেত রিনা পিছলে পড়ল মাটিতে, গাড়ির এক স্তূপে রিনার দেহটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল।

রিনা দেখতে পেল, একজন বিজনেস স্যুট পরা লোক বাইক থেকে নেমে আসল, হাতে ডিজিটাল স্ক্রিনওয়ালা একটা বন্দুক। রিনার হঠাৎ বমি পেল। টের পেল কোমরের নিচ থেকে কিছু আর নাড়াতে পারছে না, এখানে পড়ে থাকা ছাড়া কোনও গতি নেই। তাই লোকটা এসে যখন তার শরীরে হাত বুলিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল, সে লাথি মারার চেষ্টা করেও পারেনি।

“কোথায় আছে জিনিসটা, দিন রিনা।”

রিনা এবার লোকটার মুখটা খেয়াল করল, মুখটা চেনা চেনা লাগল। অফিসে বার কয়েক দেখেছে। এ লোক পুলিশ নয় সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই।

“আপনি কে? আমার কাছে কোনও জিনিস নেই।”

“কী বলছেন রিনা মেমসায়েব, ক্যামেরায় দেখা গেল আপনি চ্যানেল-স্নিফারটা পকেটে ঢোকালেন—আর এর মধ্যে ভুলে গেলেন? ও আপনি বোধহয় ক্যামেরায় কিছু কারসাজি করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় একটা পাওয়ার সার্জ হওয়ায় ক্যামেরা কন্ট্রোল আবার রিসেট হয়ে গেছিল। আর আমাকে আপনার বাবা ভালো করে চেনেন। আমি S.E.T. এন্টারপ্রাইজের এজেন্ট।”

রিনার মুখ থেকে বিদ্রূপাত্মক হাসি বেরাল শুধু, “হোয়াট অ্যান আয়রনি, আপনার কোম্পানি পাওয়ার সার্জ থেকেও লাভবান হচ্ছে দেখছি।”

লোকটা রিনার কথায় আমল না দিয়ে বলে চলল, “আপনি সোলারিসের ডেটা চুরি করছেন ভাল কথা, কিন্তু আমাদের একটি প্রজেক্ট এই মুহূর্তে আপনাদের সোলারিস সলিউশনের সঙ্গে কোলাবোরেশনে চলছে। আমরা তো মোটেই ডেটাকে বাইরে বেরতে দিতে পারি না।”

“হ্যাঁ, মানুষ মেরে ক্ষমতা দখলের প্রজেক্ট তো? তা ভালই তো প্ল্যান আপনাদের। আপনাদের টাকা খাওয়া লোক অমর্ত্য স্যাটেলাইটে গোলমাল করিয়ে সেটাকে আছড়ে ফেলবে আমাদের এই পুরনো শহরে। সরকার এখানকার যে সমস্ত গরীব মানুষ আর দেশ-বিদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেই সব মানুষ অনেকেই মারা যাবে এতে। সরকার এটাকে স্রেফ সন্ত্রাসবাদী হামলা বলে চালাবে আর শহর পুনর্নির্মাণের উপযুক্ত টাকা নেই বলে জানালে আপনারা টাকা নিয়ে এগিয়ে আসবেন, অর্থাৎ তারপর থেকে সরকার চালাবেন কার্যত আপনারাই।”

এজেন্ট লোকটার মুখ সাদা হয়ে গেল। বলল, “এতে আপনারাও সামিল সেটা মনে আছে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনাদের ইঞ্জিনিয়াররা অত ভাল অঙ্ক করতে পারে না বলেই, স্যাটেলাইটটাকে ঠিক কোথায় ফেলতে হবে তারজন্য হিসেব-নিকেশ এর জন্য আমাদের ওপর ভার দিয়েছেন। অমর্ত্য-র কিছু প্রোজেক্ট আমরা এখনও চালাই সেটা অনেকেই জানে। আমাদের কোম্পানির পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করছি এটা ভেবে নিন।”

এজেন্ট উবু হয়ে বসে রিনাকে উলটে দিয়ে একবার গুলি লাগা স্থানটি দেখল। তারপর আবার চিৎ করে দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে স্লেট বের করে কোথাও ফোন করল। চাপা স্বরে কিছু কথা বলেই স্লেট ঢুকিয়ে রিনার উদ্দেশে বলল, “কিন্তু এর জন্যে আপনার প্রাণটা কেন দেবেন ম্যাডাম। আধ ঘন্টার মধ্যে আপনার চিকিৎসা শুরু না হলে আপনি খুব বেশিক্ষণ টিকবেন না ইহজগতে। দরকার পড়লে হসপিটাল বেড থেকেও আমরা ঐ ডিস্ক বের করে নিতে পারব যদি আপনি দেহের ভিতরে লুকিয়ে রাখার প্ল্যান করেন।”

“কিন্তু সে জিনিস তো আমার কাছে নেই। সে জিনিস যেখানে পৌঁছানোর কথা এতক্ষণে পৌঁছে গেছে। আপনারা আমার পেছনে এতক্ষণ সময় ব্যয় করলেন বলেই তো সে জিনিসটা নিয়ে সহজে বেরোতে পারল পুলিশের ঘেরাটোপ পেরিয়ে।”

এজেন্ট থতমত খেয়ে গেল, “কী বলছেন আপনি, কে নিয়ে গেল?”

“এমন একজন যে আর-এন-টি-ফাইভের লেডিস টয়লেটে ঢুকেছিল মেয়ে সেজে আর বেরিয়েছিল ছেলে সেজে। আপনার ছেলেদের ওপর কোনও নজর রাখেননি তাই না?”

এজেন্টটি অশ্রাব্য একটা কথা বলে মাটিতে পা ঠুকলো।

“এরা কারা? সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী কোনও? আপনি পুরোটা বলে ফেলুন। আমাদের পার্টনার সোলারিস এবং তার ডাইরেক্টর মিস্টার সারিনেন অর্থাৎ আপনার বাবার সম্মানের কথা মাথায় রেখে একথাগুলো আমরা গোপন রাখব। পুলিশকে আসতে বারণ করে দিয়েছি, আর অ্যাম্বুলেন্স কল করে দিয়েছি। আপনি এবার বলুন তো কাদের তথ্য পাচার করলেন।”

“সন্ত্রাসবাদী হলেন আপনারা, এরা নন। এরা সেই লোক যারা ক্ষমতালোভী সরকার আর তার বন্ধু কর্পোরেট গোষ্ঠীর আঁতাত বন্ধ করতে চায়। আপনারা সৌরশক্তি উৎপাদন আর বন্টনের দায়িত্ব কুক্ষিগত করে অর্থনৈতিকভাবে আর তারপরে রাজনৈতিকভাবে দেশটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন—সেটা এরা হতে দেবে না। এদের স্বপ্ন এক বিকল্প এক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে প্রশাসক আর ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সমন্বয় হাত ধরে চলবে।

প্রশাসনে যেমন ভোটে হেরে যাওয়া দলের লোকেরাও বিশেষ দায়িত্ব পাবে, তেমন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সমন্বয়তে ছোটবড় সমস্ত প্রতিষ্ঠান থাকবে, এবং তাদের বার্ষিক লাভের উপর হিসেব করে তাদের থেকে সহায়তা নেওয়া হবে ও অন্যান্য সরকারী বরাত দেওয়া হবে—যার বিশদ তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য থাকবে। ইন্টারনেট আবার আগের মতো মুক্ত হবে। আমিও এদের একজন। সারা দেশে এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আজ নয় কাল এরা নতুন দল গড়ে নেবে।”

রিনা প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছিল। এত কথা রিনা কোনদিন বলেনি। শেষ কয়েকটা কথা বলার সময়ে চোখটা বন্ধ হয়ে এসেছিল। খুব স্তিমিত কিন্তু তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ পেল অ্যাম্বুলেন্সের। এজেন্ট লোকটা রাগের মাথায় আরেকটা গুলি করতে যাচ্ছিল সেটা রিনা চোখ না খুলেও বেশ টের পেল। তারপর ধড়াম একটা আওয়াজ পেল।

শেষ বারের মতো পৃথিবীটাকে দেখে নিতে চাইল রিনা, কিন্তু চোখ খুলে দেখল এজেন্ট ভদ্রলোক পাশে চোখ বের করে পড়ে আছে, একটা পুরনো গাড়ির কঙ্কাল তার ওপর পড়েছে। রিনা মাথা উঁচু করে ওপরে তাকাতে গিয়েই জ্ঞান হারালো।

শেষ যেটা দেখেছিল গাড়ির স্তূপের ওপর জনপ্রিয় গায়ক রোকিনের একটা চুলঢাকা মাথা তার দিকে মুখ করে আছে।

অজ্ঞান হয়ে থাকা রিনার স্মার্টশার্টটা লাল হয়ে গিয়ে হেল্‌থ অ্যালার্ট দিচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সের তীক্ষ্ণ সাইরেনটার আওয়াজ আস্তে আস্তে বাড়ছিল।

চার

গত তিনদিন রাজেন্দরের মুখে কেউ হাসি দেখেনি, যে কিনা সারাক্ষণ মজা করে যায় সবার সঙ্গে। রিনার সঙ্গে বছর তিনেক আগে আলাপ। কিন্তু তারপর বন্ধুত্ব বেড়েছে, সে ওদের দলের আরেকজন হয়ে উঠেছিল। রিনাই আকস্মিকভাবে এই ষড়যন্ত্রটি আবিষ্কার করে ওর বাবার ফোন থেকে। কিন্তু তারপর রাজেন্দর তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার প্ল্যানটি করে।

যেহেতু কর্পোরেট হাউস এলিটনেট ব্যবহার করে, পাবলিকনেট থেকে তাতে ঢোকার কোনও উপায় নেই। তাই তথ্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আদানপ্রধান করার যন্ত্রপাতির মধ্যে একটি আড়িপাতার যন্ত্র বসিয়ে আসা হয়। সেটা ব্যবহার করে রাজেন্দর সমস্ত দরকারি তথ্য একটি ন্যানোডিস্কে জড় করে। সেই ন্যানোডিস্ক রিনার থেকে নূর উদ্ধার করে আনে।

বর্তমানে সেই তথ্য সম্বলিত একটি ভিডিও হাজার হাজার ব্যক্তির ভিডিও চ্যানেলে শোভা পাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে অমর্ত্যকে মর্ত্যে আছাড় মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রটি আটকানো সম্ভব হবে। পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ডেরায় হানা দেবে, পাবলিকনেটে ওদের ঠিকানা বের করা কঠিন নয় কিছু। সমস্ত কম্পিউটার ও স্টোরেজ সোলার-ওভেনে ঢুকিয়ে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। রিনার কোন খোঁজ নেই। খবরের কাগজেও কোনও খবর নেই।

জিজি এসে বলল, “কী রে ঘর থেকে বেরিয়ে আয় রাজেন। আর মনখারাপ করিস না। রিনা নির্ঘাত বেঁচে আছে। আমাদের এখনই বেরোতে হবে সোনা।” বলে জিজি একটা চুমু খেল রাজেন্দরের মাথায়।

অস্ফুটস্বরে রাজেন্দর বলল, “আমরা কোথায় যাব?” বোঝাই গেল গত তিন দিনের প্ল্যানগুলো কিছুই মাথায় ঢোকেনি।

নূর আর কৃষ্ণেন্দু এবার ঘরে ঢুকলো। নূর এসে বলল, “কেন? আমার ফ্ল্যাটে! তবে বলে রাখি আমার ফ্ল্যাটে জানলা নেই কিন্তু। টাকার অভাবে রাস্তার ধারের ফ্ল্যাট নিতে পারিনি। আর হ্যাঁ, রিনাকে যে অ্যাম্বুলেন্সটা নিয়ে গেছিল সেটার নম্বর দিয়ে খুঁজে খুঁজে আজ সেটার সন্ধান পেয়েছি, কিছু একটা খবর নিশ্চই পাব।”

রাজেন্দর ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদের মধ্যে পা রাখতেই সোলার-প্যানেলগুলোর থেকে প্রতিফলিত রোদ্দুরে চোখ ঝলসে গেল তার। মনে মনে বলল, “অনেক কাজ বাকি এখনও”।

(গ্যাব্রিয়েল কান্তারিরা’র ‘এসকেপ’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে)