প্রজেক্ট সুপ্রিমো - শোভন কাপুড়িয়া

গল্প

সূচনা

আর্টিফিশিয়াল সুপার ইন্টেলিজেন্স চালিত এফভিডিস বা ফাস্ট ভিডিও ডিস্ট্রিবিউশন স্ক্রিনের মাধ্যমে কোনো এক ব্যক্তির একটা ভিডিও কল আসে তার কাছে... মুখে তার একটা তীর্যক হাসি ফুটে ওঠে। এই গোপন কনফারেন্সের জন্যই সে অপেক্ষা করছিলো।

—বলিয়ে হরকিষণ সাহাব, শুনা হ্যায় বহত দিনো সে আপ মুঝসে বাত করনা চাহতে থে!

—হান জি। আপকো মেরা মেসেজ তো মিল হি গ্যায়া হোগা। তো বোলিয়ে কব সে শুরু করনা হ্যায়।

—টার্গেট তো ফিক্সড হি হ্যায়। বস সহি মওকা কা ইন্তেজার কর রাহা হু।

—হা ও তো হ্যায়, লেকিন ম্যায় উন লোগোকো ওয়াদা কর চুকা হু। অউর প্যায়সা ভি আপকো মিল গ্যায়া হ্যায়।

—ও আপ মুঝপে ছোড়িয়ে। আপকা কাম হো যায়েগা অউর পতা ভি নেহি চলেগা লোগো কো কে কেয়া হুয়া। আপ বেফিকর রহিয়ে।

ভিডিও কল শেষ হলে সেই ব্যক্তি ঘরে উপস্থিত আরেকজনের উদ্দেশ্যে বললো, “মাসুদ, বিবেকের সঙ্গে সিকিওরড হলোগ্রাফিক ডিভাইসে যোগাযোগ করো!” হলোগ্রাফিক ডিভাইসে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি ছেলের চেহারা ফুটে উঠলো, ছেলেটির চেহারায় একটু ভয়ের ছাপ। সেই ব্যক্তি একবার হেসে কথা বলতে শুরু করলো,

—এনহ্যান্সমেন্ট কতদূর?

—হয়ে গেছে স্যার! ইটস রেডি।

—দ্যাটস গুড নিউজ! তাহলে তোমার মতে উই ক্যান ইম্প্লিমেন্ট নাও।

—সেটাই মনে হচ্ছে!

—হ্যাঁ কি না বিবেক! এই “হয়তো” বা “মনে হচ্ছে” এই সব শোনার জন্য তো তোমায় রিক্রুট করিনি তাই না?

—হ্যাঁ... ইট ক্যান বি ইম্প্লিমেন্টেড।

—ঠিক আছে তোমার সঙ্গে পরে আবার কথা বলবো।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহচরের দিকে দেখে সেই ব্যক্তি বললো, “ইম্প্লিমেন্ট করার জন্য টার্গেট আমরা যাকে করবো ভেবেছিলাম, তাঁর গতিবিধি নজরে রেখেছি আমি! ইনফ্যাক্ট সে জানেওনা যে আমি ঠিক কী করতে চলেছি তাঁর সঙ্গে।”

সহচরটি জবাব দিলো, “আপনি বললে কালকেই কিডন্যাপ করতে পারি।” হাত উঁচিয়ে থামার ভঙ্গিতে সে বললো, “না... এখনো সময় আসেনি। বাই দ্য ওয়ে... লেটস স্টার্ট উইথ দ্য ইম্প্লিমেন্টেশন, কিন্তু এমন ভাবে করবে যাতে আমাদের টার্গেট বুঝতে না পারে। পিপল স্যুড নট হ্যাভ এনি আইডিয়া হোয়াট দে আর গোয়িং টু ফেস ইন নিয়ার ফিউচার!”

কয়েকমাস পরের ঘটনা...

বাবার শরীরটা বেশ কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না, বাবার মাথার মেমব্রেন নাকি জলে ভরে যাচ্ছে... অন্তত ডাক্তারের এমনই বক্তব্য। জল ভরে যাওয়ায় মাথার স্নায়ুগুলো খুব একটা ভালো ভাবে কাজ করছে না, যার সোজা প্রভাব পড়ছে বাবার স্মৃতিশক্তি আর দৈনন্দিন কাজের ওপরে।

আট মাস আগে প্রথম এই রোগ ধরা পড়ে বাবার... কাজের চাপে অনেক সময় বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি, কিন্তু যে কয়বার ডাক্তারের কাছে গিয়েছি ততবার ওনার একটাই কথা... অপারেশন একমাত্র উপায়। সত্যি বলতে অপারেশনের কথা শুনলে একটা ভয় কাজ করে... মাকে তো এমনই এক অপারেশনের সময় হারিয়েছিলাম, তাই এ কথায় আমি সিঁদুরে মেঘ দেখতে পাচ্ছিলাম যেন।

কিন্তু বাবা ছাড়া তো আর কেউ নেই আমার, অপারেশন করে যদি বাবাকে সুস্থ করা যায় তবে আমি তাই-ই করবো আর সেই সূত্রেই আজ আবার বাইপাসের ধারের নামকরা হাসপাতালে বসে অপেক্ষা করছি নিউরোসার্জন ড: নীহারিকা সোমের জন্য। দিনটা শনিবার বলে একটু বেশিই ভীড় আজকে... তাও আজ দেখা না করে যাবো না, অপারেশনের পুরো ব্যাপারটা জানা দরকার আজ।

ঘড়ির কাঁটায় তখন বাজে পাঁচটা, নীহারিকা সোমের চেম্বারে ডাক পড়লো আমার। ভেতরে ঢুকতেই একটা কৃত্রিম হাসি হেসে বসতে বললেন আমাকে, হাতে একটা রিপোর্ট ধরা আছে ওনার। সেদিকেই আমার চোখ চলে গেছিলো, ডঃ সোম গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “বুঝলেন সুমন্তবাবু, আপনার বাবার মাথা থেকে জল বের করার জন্য অপারেশন দরকার... কিন্তু ওনার সুগারের যা অবস্থা, তাতে কিন্তু অপারেশন করতে গেলে ওনার মৃত্যু হতে পারে। এই রিপোর্ট অন্তত তাই বলছে!”

কথাটা শুনে আমার সমস্ত শরীরটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। “তবে কি বাবাকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই?” কুন্ঠা আর ভয় জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি ওনাকে। নীহারিকা কিছুক্ষন চিবুকে হাত বুলিয়ে বললেন “একটা উপায় হতে পারে... এই একটা উপায়েই আপনার বাবা কিছুটা স্বস্তি পেলেও পেতে পারেন! একটা ছোটো অপারেশন করতে হবে।” আমার মনে একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখা দিলো, বললাম, “সমস্ত রকমের উপায়েই আমি রাজি, আপনি শুধু পথ বলুন!”

হাইপারলুপ টিউবের শেষ স্টেশন দমদমে সবে নেমেছি, ঠিক এইসময় সোলার মোবাইলটা ভাইব্রেট‌ করতে শুরু করলো। দেখি বাড়ি থেকে ফোন এসেছে... বাবাকে দেখার জন্য যিনি আছেন তাঁর কাছ থেকে এইসময় তো অন্যদিন ফোন আসে না! তাহলে কি বাবার কিছু হলো!

—হ্যাঁ, উৎসাদি বলুন!

—হ্যালো!! হ্যাঁ, আপনার বাবা হঠাৎ কেমন যেন একটা করছেন!

—কেমন যেন করছেন মানে? কী করছেন?

—আবোলতাবোল কিছু বকছেন... ওনার কথাবার্তাগুলো কিছু বুঝতে পারছি না। কথাবার্তাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে... কেমন যেন স্ট্রোক হবে বলে মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসুন...

আমি আর সময় নষ্ট না করে বাড়ির দিকে তাড়াতাড়ি পা বাড়ালাম... মাথায় অজস্র দুশ্চিন্তারা ভিড় করে আসছে, মাথাটা যেন ফেটে যাওয়ার জোগাড়... যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখে পড়লো নীহারিকা সোম। প্রথমটায় ওনাকে ডেকে কথা বলার কথা ভাবলেও যখন দেখলাম যে উনি কোনো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্পে মশগুল, তখন সেই খেয়াল মন থেকে ঝেড়ে ফেললাম।

বাড়ি পৌঁছে দেখি বাবা ঘুমিয়ে রয়েছে। মুখমন্ডল জুড়ে একটা শান্তির ভাব বিরাজ করছে... উৎসাদি আমাদের রাতের খাবার বানানো শেষ করলো সবে। আর পাঁচটা দিনের সঙ্গে তেমন কোনো পার্থক্য কিন্তু আজকে নেই... একটু অবাক হয়েই উৎসাদিকে জিজ্ঞেস করলাম বাবার ব্যাপারে‌।

উৎসাদি একটু চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বললেন “ওনার যে হঠাৎ কী হয়েছিলো তা বলতে পারবো না। একদম কন্ট্রোলে রাখতেই পারছিলাম না... চোখমুখের এমন অবস্থা হয়েছিলো যে মনে হচ্ছিলো এই যায় কি সেই যায়। শুধু বলছিলেন মাথা নাকি ফেটে যাচ্ছে... কীসব দেখতে পাচ্ছেন নাকি, কিন্তু আপনাকে ফোন করার কিছুক্ষণ পরেই নিজে থেকেই সুস্থ হয়ে গেলেন। এই একটু আগেই শুয়েছেন। তবে আজ একটা কথা মনে হলো... আপনাকে আগে বলিনি।”

আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধড়াস করে উঠলো, বললাম “কী কথা?”

উৎসাদি বললেন, “উনি গত কয়েকদিন ধরেই বলছেন যে ওনার ভিসনে কিছু একটা অসুবিধা হচ্ছে আর তার সঙ্গে মাথায় নাকি মাঝেমধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। যেহেতু ব্যাপারটা খুব বেশী সময় ধরে হতো না তাই উনি আপনাকে জানাতে বারণ করেছিলেন যাতে আপনি চিন্তা না করেন।”

বাবার অপারেশন হয়ে এক দেড় সপ্তাহ মতো হয়েছে, আর এর মধ্যেই বাবার আবার অসুবিধা হচ্ছে! ভিসন আর মাথার ব্যথার ব্যাপারটাতো কোনোদিন ছিলো না বাবার! তবে কি অপারেশন ঠিক হয়নি নাকি বাবার শরীরে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। দুশ্চিন্তাগুলো এবার যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো।

ফ্ল্যাট বাড়িটার নীচে দাঁড়িয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বৃদ্ধের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইন্সপেক্টর রজতাভ পালিত। মাথা থেতলে বেরোনো রক্ত এখন জমাট বেঁধেছে। তিন তলার যে বারান্দা থেকে পড়ে ওনার মৃত্যু হয়েছে সেই বারান্দাও একবার দেখে নিলেন রজতাভ। কিছুক্ষণ পরে পাশে এসে দাঁড়ালো রজতাভর সহকারী রেমো ডিসুজা, বললো, “আবার একটা সুইসাইডের কেস, দুই নম্বর হলো এই নিয়ে! এনাকে তো আবার বাড়ির লোক ঝাঁপ দিতে দেখেছেন... যদিও চেষ্টা করেও ব্যাপারটা আটকাতে পারেনি কেউ।”

রজতাভ তীর্যক দৃষ্টিতে একবার রেমোর দিকে দেখে বললেন “তিন তিনটে এক ধরণের আত্মহত্যা, অদ্ভুত ব্যাপার। আগের দুই ক্ষেত্রে তো আত্মহত্যার কারণ ছিলোই না... এনার ক্ষেত্রেও কী ব্যাপারটা একরকম? চলো একবার কথা বলে আসি ওনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।”

“উনি বেশ কয়েকদিন ধরেই বলছিলেন যে ওনার মাথায় নাকি অদ্ভুত কিছু হচ্ছে।” কাঁপা কাঁপা কান্না ভেজা গলায় বললেন সাবিত্রী, মৃত হরিপদবাবুর স্ত্রী। পাশে বসে ছিলো ওনার মেয়ে জয়িতা। কথাবার্তা শুরু হয় রজতাভ আর জয়িতার।

—মাথায় কিছু অদ্ভুত হয়েছিলো বলতে?

—উনি পরিষ্কার করে কোনোদিন কিছু বলেননি, তাই ঠিক...

—তুমি কি বাবা মায়ের এক সন্তান?

—দাদা কাজের সূত্রে বাইরে থাকে, আজ রাতে এসে পৌঁছবে।

—আচ্ছা। হরিপদবাবু যে এই মাথার ব্যাপারটা বলা শুরু করেছিলেন, সেটা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিলো?

—এই তো দুই সপ্তাহ আগে ওনার অপারেশন হয়েছিলো, তার মোটামুটি এক সপ্তাহ পর থেকেই উনি অমন বলতে শুরু করেন।

—কী অপারেশন?

—অ্যালজাইমারস রোগের জন্য একটা ছোটো অপারেশন হয়েছিলো। একটা ছোটো ইলেকট্রনিক চিপের মতো দেখতে পিকোবট বসানো হয়েছিলো, এমন এক পিকোবট যা অ্যালজাইমারস রোগীদের মাথায় অতিরিক্ত জলের চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।

—আই সি! তো অপারেশনের পরে আপনার বাবা কেমন ছিলেন?

—খুব একটা যে উন্নতি হয়েছিলো তা বলা যায় না... তা‌ না হলেও বাবা বেঁচে তো ছিলেন!

—ডাক্তার কি বলেছিলেন যে একদম সুস্থ হয়ে যাবেন?

—হ্যাঁ সেরকমই বলেছিলেন। কেন স্যার? কী হলো!

—হরিপদবাবুর আগেও আরো দুইজন ঠিক এমন ভাবেই আত্মহত্যা করেছেন এবং ওনাদের ক্ষেত্রেও মাথার অপারেশন হয়েছিলো মৃত্যুর দেড় দুই সপ্তাহ আগে।

—সে কী?

—সেটাই তো ব্যাপার! বাই দ্য ওয়ে, কোন ডাক্তার অপারেশন করেছিলেন?

—ডঃ নীহারিকা সোম, বাইপাসের ধারের নিউরোলজি হাসপাতালে বসেন।

—ধন্যবাদ জয়িতা! রেমো... এই নীহারিকা সোম কিন্তু আগের দুটো অপারেশনও করেছিলেন। কিছু একটা ব্যাপার তো আছেই, ওনার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করো। প্রথম দুটো আত্মহত্যার ক্ষেত্রে তেমন গা করিনি, কিন্তু তিনজন বৃদ্ধের একই রকমের আত্মহত্যার ব্যাপারটা কেন জানি না ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না।

ঠিক এইসময় রজতাভর স্মার্ট সোলার ওয়াচে একটা ট্রান্সমিশন এলো... “হ্যাঁ বলো... আবার একটা আত্মহত্যা! কাল রাতে হয়েছে? ডিটেইলস পাঠাও!!”

বাবার নিথর শরীরটা কিছুক্ষণ আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে, হাসপাতালের অটোমেশন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেলে বাবার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারটা আপলোড করেছিলাম... বাবা যে হঠাৎ আত্মহত্যা কেন করলো সেটা এখনো ঠিক পরিষ্কার নয় আমার কাছে। আত্মহত্যার ব্যাপারে জেনেই হয়তো পুলিশের আগমন হয়েছে আমার বাড়িতে। হলঘরের সোফাতে মাথা নীচু করে বসেছিলাম, বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে ইন্সপেক্টর এসে ঢুকলো হলঘরে।

—আমার নাম রজতাভ পালিত, আপনার বাবার আত্মহত্যার ব্যাপারটা আমি দেখছি। আর সেই ব্যাপারেই কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার আছে আপনার কাছে।

—আপনি জিজ্ঞেস করার আগেই আমি বলছি যে, হ্যাঁ... আমার বাবার অপারেশন হয়েছিলো এই এক দেড় সপ্তাহ আগে ডঃ নীহারিকা সোমের হাতে। আপনি আগের খবর দুটো দেখেছি... বাবার আত্মহত্যার সঙ্গে মিল আছে হয়তো কিছুটা।

—আচ্ছা, কিন্তু আপনার বাবা কেন আত্মহত্যা করলেন তার কোনো ব্যাখ্যা আপনার কাছে আছে? কারণ আগের দুই ক্ষেত্রেও কোনো সঠিক কারণ আমরা খুঁজে পাইনি।

—দেখুন কারণ যে কী, সেটা আমিও বলতে পারবো না। তবে যতদূর মনে হয়, মৃত্যুর আগে বাবা কিছু একটা লিখে গেছেন।

—সুইসাইড নোট?

—সুইসাইড নোট হলে ব্যাপারটা সহজ হতো, কিন্তু উনি যা লিখেছেন সেটার সঙ্গে যে কীসের যোগ আছে... সেটাই বুঝতে পারছি না। দেখাচ্ছি আপনাকে।

বাবার মৃতদেহ যে বিছানাটায় পড়েছিলো তার পাশেই রাখা ছোটো টেবিলটার কাছে নিয়ে গেলাম ইন্সপেক্টর পালিতকে। বিছানাটা একবার দেখে নিলাম... গলার কাছে একটা ভারী দলা অনুভব করলেও নিজেকে সামলে নিতে বাধ্য হলাম। টেবিলের ওপরে রাখা আছে একটা সাদা কাগজ, কাগজে লেখা আছে কতকগুলো সংখ্যা। সংখ্যা বলতে কতকগুলো ১ আর ০, এবং সেগুলো বিভিন্ন কম্বিনেশনে লেখা আছে। পালিত কাগজটা একবার দেখে নিয়ে একটু বিস্মিত হলেন, বললেন, “এগুলো আপনার বাবা লিখে গেছেন?”

—হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস যে উনি ঘুমের ওষুধগুলো খাওয়ার আগেই এগুলো লিখে রেখেছিলেন।

—সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু মানে কী এগুলোর!

—কোনো কোড বলে মনে হচ্ছে।

—এতগুলো ১ আর ০ দেখে মনে তো হচ্ছে বাইনারি কোড। তবে আত্মহত্যার আগে এসব লেখার কী মানে... সেটা ঠিক...

—এই ব্যাপারটাই আমি বুঝিনি। আমার বাবা কিন্তু কোনোদিন টেকনিক্যাল কোনো বিষয়ে পড়াশোনা বা কাজ করেননি।

—খুব অদ্ভুত ব্যাপার! দেশে পিকোবট টেকনোলজি ব্যবহার করে নিউরোসার্জারির টেকনোলজি এলো... নীহারিকা সোম এই শহরের তিনজন বৃদ্ধের ওপর এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপারেশন করলেন... আর মৃত্যু বরণ করার আগে আপনার বাবা বাইনারি কোড কম্বিনেশন লিখে গেলেন। যোগসূত্র কি আছে! কিন্তু যোগসূত্র থাকলেও বুঝতে পারছি না যে সেটা কী? নীহারিকা সোমের সঙ্গে দেখা করা খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

হাতঘড়িতে একবার সময় দেখে নেন ডঃ নীহারিকা সোম। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই... রোগীদের আনাগোনার চাপে দুপুরের খাওয়াটাই হয়নি। অগত্যা হাসপাতালের ক্যান্টিনের থেকে একটা স্যান্ডউইচ কিনে খেতে খেতে বড়ো কাচের জানালাটার সামনে দিয়ে দাঁড়ালেন... রাস্তার দিকে চেয়ে রইলেন একভাবে। রাস্তার বেশ খানিকটা ওপর দিয়ে একটা আইডেন্টিফায়িং ড্রোন অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হয়তো সামনের সপ্তাহের বড়ো মিছিলের জন্য কোলকাতা পুলিশ প্রস্তুতি নিচ্ছে... ভাবেন নীহারিকা। তাঁর মনটা একটু ভারাক্রান্ত আছে কোনো কারণে... যদিও নিজেকে সামলে নেওয়ার মতো দৃঢ়চিত্তের অধিকারী তিনি।

হাসপাতালের সামনেই হাইপারলুপ বাস স্টেশন অবস্থিত, সেদিকে তাকিয়ে লোকের আনাগোনা দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। হঠাৎ সোলার মোবাইলটা বেজে উঠলো নীহারিকার। ফোনটা তুলতেই এক ঝলক হাসি খেলে গেলো নীহারিকার মুখে, ভাবটা এমন যেন কোনো মন ভালো করা খবর শুনেছেন তিনি... তিনি শুধু বললেন, “তুমি ওখানেই দাঁড়াও, আমি আসছি!”

বাবার শেষ কাজ করা হয়েছে দুই দিন হয়ে গেলো, অফিস যাওয়া এখনো শুরু করিনি। বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে আজকাল... খাওয়া দাওয়ার জন্য হোম ডেলিভারি বলা আছে, তাই অতটা চিন্তা আর করি না। সকালের বানানো চায়ে সবে চুমুক দিয়েছি, সোলার মোবাইলটা বেজে উঠলো। বায়োওয়্যার সলিউশনসের হেড সুকোমল ব্যানার্জির ফোন... এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে আমি বায়োওয়্যার সলিউশনসের সিকিউরিটি ডিভাইস ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন বিভাগের এক ডেভলপার আর সুকোমল ব্যানার্জির সঙ্গে আমায় অনেক কাজ-ই করতে হয়। ফোনটা রিসিভ করলাম,

—সুমন্ত, তুমি কি একবার অফিসে আসতে পারবে?

—আমায় কি আজ থেকে জয়েন করতে হবে?

—জয়েনিং এর ব্যাপার না। তবে আরো বেশী দরকারী কিছু!

—কী ব্যাপার বলুন তো সুকোমলদা?

—তুমি অফিসে এসো... কথা হবে, ইটস আটমোস্ট আর্জেন্ট।

সুকোমলদার কাচে ঘেরা কেবিনে বসে আছি... আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট চালিত স্বয়ংক্রিয় চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছি আমি। উল্টোদিকে হলোগ্রাফিক ডিভাইসটা ইনস্টলড রয়েছে, নীচে একটা ছোটো সবুজ আলো জ্বলছে... বুঝতে অসুবিধা হয় না অন্য কোনো রিজিয়নের সঙ্গে কানেকশন সেট আপ করা হয়েছে, শুধুমাত্র হলোগ্রাফিক কনফারেন্স আইডি এসটাবলিশ করা বাকি আছে। তবে আমি যত দূর জানি এই ধরণের হলোগ্রাফিক কলের কোনো লগ থাকে না, অর্থাৎ এই ধরণের কনফারেন্সগুলো সম্পূর্ণ গোপনীয় থাকে... এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে এই কলগুলো যেগুলো সম্পর্কে কোনোরকম তথ্য কোথাও সংগৃহীত থাকে না। তাহলে কি কোনো গুরুতর ব্যাপার! এইসময়ে সুকোমল ব্যানার্জী ঘরে ঢুকলেন...

“কী ব্যাপার সুকোমলদা!” আমি জানতে চাইলাম যদিও সোজা কোনো উত্তর পেলাম না।

সুকোমলদা বললেন, “এইসময়ে তোমায় ডাকার জন্য সরি... বাট সামথিং সিরিয়াস হ্যাজ কাম আপ। যিনি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান, তাঁর সঙ্গে কলটা শুরু করি দাঁড়াও।”

মিটিং আইডি টা ইউআই স্ক্রিনে পাঞ্চ করতেই হলোগ্রাফিক ডিভাইসের সূক্ষ্ম স্ক্রিনের ওপরে একটা ছবি ফুটে উঠলো... মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। কস্মিনকালেও এই ভদ্রলোককে আমি দেখিনি... অথচ এনার আমার সঙ্গে ঠিক কী কথা থাকতে পারে সেটা আমার বোধগম্য হলো না। সুকোমলদা আমার সঙ্গে ওনার আলাপ করালেন, জানতে পারলাম ওনার নাম বিক্রম যোশী... র-এর টেকনোলজিক্যাল এক্সপার্টাইজ ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র কর্তা। একটু ঘাবড়ে গেলাম... হঠাৎ র-এর একজন অফিসার আমার সঙ্গে কেন কথা বলতে চাইছেন। কথাবার্তা শুরু হলো ওনার সঙ্গে...

—হ্যালো সুমন্ত, নার্ভাস হয়ো না। তোমার সঙ্গে কয়েকটা ইনফরমেশন আমি কনফার্ম করতে চাই। দ্যাটস অল! বাই দ্য ওয়ে... তোমাকে “তুমি” করেই বলছি!

—শিওর স্যার। কিন্তু... আমি একজন সাধারণ কোড ডেভলপার, আমার কাছ থেকে কী এমন ইনফরমেশন চাই ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার।

—(এবার একটা ছবি পপ আপ হয়ে স্ক্রিনের কোণায় হাইলাইট হলো) তুমি এই লোকটাকে নিশ্চয় চেনো?

—হ্যাঁ, বিবেক শর্মা। বায়োওয়্যার সলিউশনসেই কাজ করতো। গত বছর কোম্পানি ছেড়ে দেয়।

—রাইট! এবার একটা কথা বলো... তুমি দেড় বছর আগে একটা সফটওয়্যার বানিয়েছিলে ইন্ডিয়ান আর্মির ইন্টেলিজেন্সের জন্য... যদিও সেটা এখনো গভর্নমেন্ট অ্যাপ্রুভ করেনি। সফটওয়্যারটা নিয়ে যদি কিছু বলো।

—সফটওয়্যার না বলে প্রোটোটাইপ বলতে পারেন স্যার। প্রোটোটাইপ টার‌ নাম ছিলো “মেমোক্লিয়ার”, আর্মি ইন্টেলিজেন্স থেকে রিকোয়্যারমেন্ট এসেছিলো যে এমন একটা সফটওয়্যার বানাতে হবে যেটা ব্রেইন চিপের সঙ্গে কম্প্যাটিবেল হবে এবং সেই চিপ ধরা পড়া কোনো জঙ্গীর মাথায় প্লেস করলে তাঁর সমস্ত মেমোরি যে কোনো ফর্ম্যাটে সংগ্রহ করে রাখা যাবে আর সেই ব্যক্তির মাথা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে যাবে।

—ওকে! এবার ধরো... যদি মেমোরি রিট্রিভ করার পরে মস্তিষ্ক থেকে মেমোরি মুছে দিয়ে ব্রেইনের মধ্যে কতকগুলো আজেবাজে সংখ্যার কম্বিনেশন বসিয়ে দেওয়া হয়! যেমন... দেখতে আবোলতাবোল ১ আর ০ এর বিভিন্ন কম্বিনেশন বা বাইনারি কোড। তোমার কোডে কী সেটা সম্ভব?

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাবার লিখে যাওয়া সেই সংখ্যাগুলোর কথা মনে পড়লো, দেখতে আবোলতাবোল বাইনারি কোড কম্বিনেশনগুলো মনে পড়লো। বললাম,

—আমার বাবা মৃত্যুর আগে তো এমনই কিছু লিখে গিয়েছিলেন... আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বলুন তো!

—ধীরে ধীরে... সব বলবো। তোমার সেই কলিগ বিবেক বায়োওয়্যার থেকে পদত্যাগ করার আগেই তোমার বানানো সফটওয়্যারের একটা ক্লোন তৈরী করে। তারপরে কোনো সিকিওরড এবং এনক্রিপটেড ক্লাউড এফটিপি প্রোটোকলের মাধ্যমে সেই কোড পাচার করে বাইরের কারোর কাছে।

—এফটিপির মাধ্যমে পাঠালে তো সিস্টেমে লগ পাওয়া উচিত।

—সুকোমল লগ পেয়েছিলো, কিন্তু কোনোভাবে টার্গেট আইপি আর ইউজার আইডি এমনভাবে এনক্রিপট করা হয়েছিলো যে ধরা সম্ভব হয়নি যে কে এই কাজ করেছিলো।

—বেশ! কিন্তু একটা ডরম্যান্ট সফটওয়্যার নিয়ে বিবেক কী করবে?

—জানিয়ে রাখি যে কিছুদিন আগে বিবেকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।

—সে কী? আমার না সব গুলিয়ে যাচ্ছে... বিবেকের সঙ্গে বাবার মৃত্যুর যোগাযোগ আছে বলছেন আপনি? তাছাড়া আমার কোডে তো বাইনারি কম্বিনেশন জেনারেট করার কোনো সাবরুটিন ছিলো না।

—বিবেকের সঙ্গে শুধু তোমার বাবার না... বাকি দুই বৃদ্ধের মৃত্যুরও যোগসূত্র রয়েছে। তোমার সফটওয়্যারটা এনহ্যান্স করেছে বিবেক... মেমোরি রিপ্লেসিং টেকনোলজি ইনস্টল করা হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এই সফটওয়্যারকে পিকোবট নিউরো চিপের কম্প্যাটিবল তৈরী করা হয়েছে।

—দাঁড়ান দাঁড়ান! বাবার মাথায় তো এই পিকোবট নিউরো চিপই অপারেট করে বসিয়েছিলেন নীহারিকা সোম... তো আপনি কি বলছেন যে বাবার মাথায় এই চিপ বসানোর পরেই বাবার মেমোরি হ্যাক হয়ে যায় আর মেমোরি রিপ্লেস করে বাইনারি কোড কম্বিনেশনগুলো?

—একদম তাই। দেশে এখন একমাত্র নীহারিকা সোম আছেন যিনি পিকোবট নিউরো চিপ অপারেট করে বসাতে পারেন... আর তাঁর অপারেশন করা তিনজন পেশেন্টের সঙ্গেই এমন হলো। যার ফলে ঐ নিউরো চিপ এখন আর সাধারণ চিপ না... বরং মেমোরি হ্যাকিং ডিভাইসে পরিণত হয়েছে।

—আপনি বললেন বিবেক কোনো একজনের হয়ে এই কাজগুলো করছেন... তিনি কে? আর বাবার সঙ্গে তাঁর কীসের শত্রুতা?

—আমাদের সন্দেহ যে বিবেক দুইজনের সঙ্গে কাজ করছিলো....একজন হতে পারেন নীহারিকা সোম নিজে আর আরেকজন... রণবীর যাদব। নীহারিকা সোমের চেম্বার গত তিনদিন ধরে বন্ধ, কোথায় গেছেন কেউ জানে না।

—অদ্ভুত ব্যাপার তো! আর এই রণবীর যাদব কে?

সুকোমলদা অার যোশীকে দেখলাম একবার দৃষ্টি আদান প্রদান করে নিতে, ওঁরা কি কিছু লুকোতে চাইছেন আমার থেকে!

আমি আবার বললাম, “হঠাৎ উনি এমন একটা আইনত অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়লেন কেন? বাবার সঙ্গে ওনার শত্রুতাই বা কীসের!”

যোশী বললেন, “এটাই ঠিক বুঝতে পারছি না। হঠাৎ এই যাদব তিনজন বৃদ্ধের সঙ্গে এমন করলো কেন? নীহারিকা সোমের সঙ্গে কি কোনো যোগাযোগ আগের থেকেই ছিলো? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা। আর এখানেই আমাদের তোমায় দরকার!”

আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম, বললাম “আমার মতো একজন ডেভলপার আপনাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারে এই ব্যাপারে?”

যোশী কিছুক্ষণ ভেবে বললেন “বিবেকের কাজের জায়গা ছিলো ওর বাড়ি। আমাদের কিছু এজেন্ট বাড়িটার ওপরে নজর রেখেছিলো যদি যাদবের লোকেরা বাড়িটার ওপরে আক্রমণ করে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেরকম কোনো আক্রমণ হয়নি। এটাই আমায় বেশী চিন্তায় ফেলেছে যে বিবেককে খুন করার পরেও ওরা কিন্তু ওর কাজের প্রমাণগুলো নষ্ট করতে উদ্যত নয়। কিন্তু কেন? সেই সন্দেহের বশেই আমাদের টেকনিক্যাল টিম বিবেকের সিস্টেমের আইপি এড্রেস জোগাড় করেছে। আমি চাই এই আইপি এড্রেস ব্যবহার করে বিবেকের সিস্টেমস, ফাইলস, অনলাইন লগ, প্রোগ্রাম মডেল, কোডিং প্যাটার্ন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিকোড করার চেষ্টা করো। যেহেতু তুমিই এই মেমোরি হ্যাকিং সফটওয়্যারের বেস ডেভলপার তাই আমার বিশ্বাস তুমি তাড়াতাড়ি ধরতে পারবে যে তোমার সিস্টেমের ডিজাইনটা কোথায় পরিবর্তিত করা হয়েছে। আমাদের জানতেই হবে যে যাদব বিবেককে দিয়ে ঠিক কী করাচ্ছিলো... যাদব হ্যাজ প্লানড সামথিং বিগ! শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী যাদবকে বহিষ্কৃত সুরক্ষা মন্ত্রী হরকিষণের সঙ্গে দেখা গিয়েছে। আর হরকিষণের সঙ্গে এখনকার সবচেয়ে বিপজ্জনক জঙ্গী গোষ্ঠীর ভালোমতো যোগাযোগ রয়েছে। ভয় একটাই যে হরকিষণ এবং যাদব কিছু করে না বসে আমারা কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই।”

নীহারিকা সোমের যখন জ্ঞান ফিরলো, মাথায় একটা অসহ্য ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। চোখের দৃষ্টি একটু ঘোলাটে হয়ে রয়েছে, স্বল্প আলোকিত ঘরের পারিপার্শ্বিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি...না, ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না কিছু। মাথার পেছন দিকটায় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলেন নীহারিকা। মাথার যেখানটায় ব্যথা অনুভূত হচ্ছে, সেখানটায় হাত দিতেই তিনি চমকে উঠলেন... ছোটো একটা চিপের মতো কিছু তাঁর মাথার সঙ্গে আটকানো রয়েছে যেন। টেনে খুলতে গেলে প্রচণ্ড ব্যথা মাথা থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। হালকা হালকা কিছু মনে পড়ছে তাঁর... সেদিন হাসপাতাল থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে হাইপারলুপ বাস স্টেশনে পৌঁছে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিন মাসের পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে, আর তারপর... নীহারিকার ভাবনা মাথাতেই রয়ে গেলো তাঁর।

অন্ধকার ঘরের স্বয়ংক্রিয় আলোগুলো জ্বলে উঠলো এবং “কেমন ঘুম হলো?” একটা ভারী কন্ঠে কথাটা শুনতে পেলেন নীহারিকা। এই কন্ঠ খুব পরিচিত তাঁর... বক্তার দিকে ফিরতেই একটা বিস্ময়, ভয় এবং রাগের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো নীহারিকার। সেই ব্যক্তি তাঁর থেকে খুব বেশী দূরে দাঁড়িয়ে নেই... আগন্তুক ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো।

—আমি কোথায়? কোথায় নিয়ে এসেছো তুমি আমায় দিলীপ!

—রিল্যাক্স নীহারিকা, রিল্যাক্স। তুমি আমার নিজস্ব কমিউনিকেশন সেন্টারে আছো। আর... আরেকটা কথা। আমার নাম... মানে আসল নাম রণবীর যাদব।

—মানে? তুমি কি তাহলে শুধু নাটক করছিলে এতদিন!

—বলতে পারো। তোমার বিশ্বাস জেতাটা একটু দরকার ছিলো।

—লেট মি গো! ছেড়ে দাও আমায়! হোয়াই অ্যাম আই হিয়ার?

রণবীর যাদবের হাতে ধরা ছিলো একটা রিমোট, রিমোটের মাধ্যমে একটা ট্রান্সপ্যারেন্ট স্ক্রিনে পয়েন্ট করতেই একটা ছবি ফুটে উঠলো। নীহারিকা ছবিটা দেখে চিনতে পারলেন, একটু বিস্মিত হয়ে রণবীরের দিকে দেখলেন।

—বুঝলে নীহারিকা, ইনি কিছুদিন পরেই কোলকাতায় আসছেন একটা মাল্টি মিলিয়ন ডলারের বিজনেস ডিল সাইন করতে। আর এখানেই আমার সুযোগ। তবে এসবের আগেই ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে... সো স্যাড।

—হোয়াট? আর ইউ ম্যাড!

—আমি পাগল কিনা সেটা না হয় পরে ভেবো। নাও, আই ওয়ান্ট ইউ টু প্ল্যান্ট দ্যাট পিকোবট চিপ ইনসাইড হিজ হেড হোয়েন হি উইল বি আনকনশাস।

—হঠাৎ আমিই কেন?

—দেশে একমাত্র তুমিই তো আছো যে এই কাজ করতে পারে! আর তাছাড়া ওঁর শরীরের ওপরে একটা সিক্রেট অপারেশন তো তুমিই করেছিলে তাই না... সব খবর নিয়েছি আমি।

—পিকোবট বসিয়ে কী হবে তারপরে?

—তারপরে কী হবে সেটা না হয় আমার ওপরেই ছেড়ে দিলে!

—আমি যদি না করতে চাই!

—গ্ল্যাড ইউ আস্কড। তোমার মাথায় একটা ব্যথা হচ্ছে না? আসলে ওটা একটা চিপ, “থট ট্র্যাকার” সফটওয়্যার ওটার মধ্যে আপলোড করা আছে। আমরা তোমার কাছ থেকে ঠিক কী আশা করছি সেই এক্সপেক্টেশনগুলো এই থট ট্র্যাকারে কমান্ড হিসেবে আপলোড করা আছে। তুমি অন্য কিছু করার চেষ্টা করলেই তোমার মস্তিষ্কে থট বা চিন্তা তৈরী হবে আর সেই চিন্তা যদি আমার কমান্ডের সঙ্গে না মেলে, তখন আমি যে কোনো সময় চাইলেই চিপটা তোমার মাথার মধ্যে ছোট্ট করে ব্লাস্ট করে দেবো। তাই অন্য কিছু করার চিন্তা মাথাতেও আনবে না।

সিকিওরড ডাটা কিউয়ের মাধ্যমে রিমোট ন্যানোসিস্টেম কানেকশন স্থাপন করলাম বিবেকের সিস্টেম আইপি-এর সঙ্গে। মুহূর্তের মধ্যে বিবেকের সিস্টেমের সম্পূর্ণ অ্যাক্সেস আমার হলোগ্রাম সিস্টেমে চলে এলো, হলগ্রামিক সিস্টেমের ওপরে দেখাচ্ছে... “ফরেইন আননোন লগ ইন-১”।

সময় নষ্ট না করে প্রথমেই চলে গেলাম কোডিং প্যাটার্ন অ্যাক্সেস পোর্টালে এবং অ্যালডোন কোড স্ক্যানারের মাধ্যমে বিবেকের বানানো কোডটার একটা কপি করলাম। তারপরে সেই কপির সঙ্গে আমার বানানো সফটওয়্যারের কোডের সোর্স দুটো মেলানোর জন্য হলোগ্রামিক নিউরো সোর্স কম্পারিজন ইউটিলিটি ব্যবহার করলাম। খুব বেশীক্ষণ সময় লাগলো না... পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে ঠিক কোথায় বিবেক আমার কোডে পরিবর্তন করেছিলো। মনে মনে নিজেই বললাম যে এই কোডকে পুরোনো অবস্থায় নিয়ে যেতে খুব বেশী সময় লাগবে না, একটা বিজয়ের ভাব অনুভব করলাম বটে।

এবার দেখলাম যে এক্সপেরিমেন্টাল আউটপুট ট্র্যাশ নামে ক্লাউড ফোল্ডারে কিছু তথ্য রয়েছে, ফোল্ডারটা খুলতেই দেখলাম অজস্র ভিডিও ফাইল রয়েছে সেখানে। কয়েকটা ভিডিও ফাইল এলোমেলো দেখার পরে একটা নির্দিষ্ট ফাইলে আমার নজর আটকে গেলো। সেখানে দেখলাম একজোড়া হাতের ওপরে ছোটো একটা বাচ্চা দোল খাচ্ছে এবং একটি পুরুষালি গলা তাঁকে গান শোনাচ্ছে, আমি হতচকিত হয়ে গেলাম কারণ ঐ বাচ্চাটি আর কেউ নয়... স্বয়ং আমি!

আমি আবার সমস্ত ভিডিওগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম... বুঝতে পারলাম এই ভিডিওগুলো আসলে ঐ তিনজন বৃদ্ধের সমস্ত স্মৃতি। এই মেমোরিগুলোকে মেমোক্লিয়ার সফটওয়্যারের মাধ্যমে হ্যাক করে ডাউনলোড করে রাখা হয়েছে, কিন্তু একটা খটকা লাগলো আমার যে এগুলো এক্সপেরিমেন্টাল আউটপুট ট্র্যাশ ফোল্ডারে কেন রাখা আছে? এখানে তো আমার প্রোগ্রাম সেই ফাইলগুলোই রাখবে যেগুলো শুধুমাত্র পরীক্ষামূলকভাবে বা ট্রায়ালের মাধ্যমে তৈরী হয়েছে! তবে কি... বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা জিনিস মনে হলো।

আমি আবার নিউরো সোর্স কম্পারিজন ইউটিলিটির আউটপুট খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম এবং একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে গেলো আমার। দেখলাম এই কোডটাকে আরো একটু মডিফাই করা হয়েছে শুধুমাত্র একজন নির্দিষ্ট টার্গেটের মেমোরির জন্য এবং তাঁর মেমোরির আউটপুট কিন্তু ট্র্যাশে পয়েন্ট করা নেই, পয়েন্ট করা আছে কোনো একটি আইপির উদ্দেশ্যে। আমি চটজলদি সেই আইপিটা ট্রেস করতে লাগলাম এবং বুঝলাম যে, এই আইপি‌ একটি ডরম্যান্ট আইপি বা এমন কোনো আইপি যা অনেকদিন ব্যবহৃত হয় না, তবে সেই আইপি-এর একটা নির্দিষ্ট কোঅরডিনেট খুঁজে নিলাম। হঠাৎ মনে হল যে বিবেকের আইপিতে অন্য কেউও লগ ইন করতে চলেছে, কারণ সফটওয়্যারে লগ ইন প্রসেসের প্রোগ্রাম ট্রিগার হয়েছে। আমি নিজের লগ ইনকে ইনভিজিবল মোডে নিয়ে এলাম। দেখে বুঝলাম যে এই আইডি রণবীর যাদবের, এবং সে টার্গেটের সমস্ত ডিটেইলস ইনপুট করছে। আমার বিস্ময়ের অবকাশ রইলো না... যত জলদি সম্ভব যোশীকে জানাতেই হবে! জানাতেই হবে যে এখনো অবধি যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে তা শুধুমাত্র একটা ট্রায়াল ছিল...আসল লক্ষ্য তারা ছিলেন না। রণবীর যাদবের আসল লক্ষ্য তো অন্য কেউ!

আমি যা কোনোদিন ভাবিনি তাই হলো, আমার সোলার মোবাইল প্যানেলে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসছে। একবার হলোগ্রাম স্ক্রিনে দেখলাম আর একবার সোলার মোবাইলের স্ক্রিনে দেখলাম... একটু কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করলাম।

—হ্যালো!

—সুমন্ত দত্ত, এটাই তো নাম তোমার তাই না!

—ক-কে আপনি, হঠাৎ এই প্রশ্ন...

—বোকার মতো কথা বলো না সুমন্ত। “মেমোক্লিয়ার” সফ্টওয়্যারের ব্যাকএন্ডে একটা এনক্রিপশন প্রোগ্রাম চলে, আমার ডিজাইন করা। এই প্রোগ্রাম সমস্ত ইনভিজিবল ফরেইন লগইনকে ডিক্রিপ্ট করতে পারে। যেটা তুমি জানতে না, জানার কথাও নয়। কেননা এই ডিক্রিপশন স্টিল্থ মোডে হয়, তাই হ্যাকাররাও এই ব্যাপারটা ধরতে পারবে না। সেখান থেকেই তোমার আইপি, কনট্যাক্ট সব এখন আমার হাতে। বিবেককে খুন করতে হয়েছিল কারণ ও বাকি কাজটা করতে চাইছিলো না, আমায় ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে। কিন্তু এবার তুমি শেষ করবে বিবেকের না করা কাজ।

—কী কাজ?

—ডরম্যান্ট আইপির মেশিনটাকে তোমায় রিভাইভ করতে হবে ঐ মেশিনের লোকেশনে গিয়ে।

—আর যদি না করি!

—তুমিও মরবে বিবেকের মতো!

—আপনি ঠিক কী করতে চাইছেন?

—আমার গড়ে তোলা কোম্পানি, আমার তৈরী করা বায়োওয়্যার সলিউশনস থেকে আমাকেই বের করে দিয়েছিল! বলেছিল আমি নাকি পাগল! আমার পাগলামির নমুনা এবার ধীরে ধীরে পুরো শহর, পুরো দেশ দেখবে... কাল থেকেই শুরু হবে আমার লক্ষ্য পূরণ। দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবো আমি! আমার টার্গেট কালকের ডিল সাইন করার আগেই ওঁকে কিডন্যাপ করবো আর তারপরে... যাই হোক, কালকে সঠিক সময় চলে আসবে আমার লোক তোমায় নিতে এবং তুমি কোনো চালাকি না করে ওঁর সঙ্গে চুপচাপ চলে যাবে ডরম্যান্ট আইপির লোকেশনে। কাউকে কিছু জানানোর চেষ্টা করো না, তোমার সোলার মোবাইলের সম্পূর্ণ অ্যাক্সেস কিন্তু আমার কাছে। রাখলাম!

সুকোমলদা আমার সঙ্গে এতক্ষণ বসেছিলেন, একদম চুপ করে ছিলেন তিনি। ঘটনার ঘনঘটায় তিনিও হতচকিত হয়ে পড়েছেন, ব্যাপারটা যে এমনভাবে একটা মোড় নিতে পারে আমরা কেউই ভাবিনি।

—সুকোমলদা, আপনি জানতেন রণবীর যাদব আর বায়োওয়্যার সলিউশনসের এই ব্যাপারটা!

—হুমম, জানতাম... মানে শুনেছিলাম। ঐ লোকটা জিনিয়াস কিন্তু পাগল, ওঁর একটা বিদঘুটে আবিষ্কার এবং সেটার প্রয়োগের কারণেই নাকি ওকে বের করে দেওয়া হয়। সেই আবিষ্কার সম্পূর্ণ রূপ পেলে ধ্বংসাত্মক হতে পারতো, তাই নাকি ওকে বহিষ্কার করা হয়।

—এখন আমার কী করা উচিত।

—তুমি যাবে ওখানে, যেতে হবেই।

—সে না হয় হলো, কিন্তু আমি যে প্রাণে বাঁচবোই তার কোনো নিশ্চয়তা দেখছি না। দেখলেন তো ওঁর আসল টার্গেট কে।

—সেটাই বিষয়। ঠিক আছে, আমি এখনই যোশীকে জানিয়ে দিচ্ছি যে রণবীর যাদব বায়োওয়্যার সলিউশনসের বর্তমান কর্ণধার সুনীল বসুর দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মেমোরি হ্যাক করার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু তারপরে যে কী করবে... ব্যক্তিগত আক্রোশের থেকেই করছে হয়তো, কিন্তু সুনীল বসুর মেমোরিই কেন চাই ওর!

—আমার বিশ্বাস ঐ ডরম্যান্ট আইপির মেশিন রিভাইভ করাটাই হলো যাদবের পরিকল্পনার শেষ পর্যায়। আমি কাল ওদের সঙ্গে গেলেই বাকিটা বুঝতে পারবো, আপনি যোশীকে ফোন করে সব বলুন। সঠিক পরিকল্পনা না করতে পারলে আমি তো মরবোই। বুঝতে পারছেন তো! যদি কোনোভাবে রণবীর এই লোকটার মেমোরির অ্যাক্সেস পেয়ে যায় তবে কিন্তু সব ওলটপালট হয়ে যাবে, কারণ বায়োওয়্যার সলিউশনস এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সমস্ত সিকিউরিটি রিলেটেড বিষয়কে সাপোর্ট দেয়।

—সে না হয় হলো। কিন্তু যোশী তো নিজের টিম নিয়ে না হয় সুনীল বসুর দিকটায় ব্যস্ত থাকবেন... তোমায় ওখান থেকে বের করতে তো কারোর প্রয়োজন আছে!

—আমি জানি একজনকে যে সাহায্য করতে পারবে, ওর সঙ্গে আজই যোগাযোগ করুন!

ড্রোন সিমুলেটরের থেকে ট্রান্সমিটেড ভিডিওতে কিছু একটা খুঁটিয়ে দেখছে রেমো ডিসুজা। গত কয়েকদিনে রেমো ডিসুজা এবং রজতাভ পালিত বারবার নীহারিকা সোমের চেম্বারে গেছে, অনেকের কাছে তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো ফল হয়নি... কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এরমধ্যেই একটি খবর আসে যে একটি ট্রান্সমিশন ভিডিওতে নীহারিকা সোমকে দেখা গিয়েছে এবং যেদিন দেখা গিয়েছে সেদিন‌ থেকেই সে নিখোঁজ।

রেমোর ডাকে সাড়া দিয়ে রজতাভ পালিত দেখে সেই ড্রোন সিমুলেটর ট্রান্সমিশন ভিডিওটি, বলেন, “নীহারিকা সোম এই তারিখের পর থেকেই কিন্তু নিখোঁজ। এই সঙ্গে থাকা লোকটা কে? এই রেমো... এই ফ্রেমটা বড় করে হলোগ্রাফিক সিমুলেটরে ফেলো তো!”

রজতাভর কথা মতো রেমো সেটাই করে। ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে নীহারিকার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ব্যক্তির চেহারা, রজতাভর মুখে একটা সন্দেহের ভাব ফুটে ওঠে।

তিনি বলেন, “এ তো রণবীর যাদব! বায়োওয়্যার সলিউশনসের প্রাক্তন মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা। অনেক দিন যাবত এনার কোনো খোঁজ কেউ পায়নি, কোথায় ছিলেন কেউ জানে না। হঠাৎ করে ফিরে আসার কী কারণ!”

রেমো সব শুনে বলল, “সুমন্তও তো এই কোম্পানিতেই কাজ করে তাই না!”

রজতাভ কিছু একটা হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছেন, গভীর কোনো চিন্তায় থাকার ভঙ্গিতে বললেন “সেটাই তো ভাবছি। তিনজন বৃদ্ধের অপারেশন করলেন নীহারিকা, ওদের মৃত্যু হয়, তারপরেই নীহারিকার সঙ্গে রণবীর যাদবকে দেখা যায় এবং ঠিক তারপর থেকেই নীহারিকার খোঁজ নেই। রণবীর যাদবের তো নিজের ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয়, ওনার সঙ্গে নীহারিকা কী করছেন সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

ঠিক এইসময় থানায় একজন ব্যক্তির আগমন হল, এই আগন্তুক কে রজতাভ বা রেমো কেউই চেনেন না।

—বলুন, কী দরকার?

—ইন্সপেক্টর রজতাভ পালিতের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

—আমিই রজতাভ। বলুন কী দরকার?

—ও আচ্ছা। নমস্কার, আমি সুকোমল। আমায় সুমন্ত পাঠিয়েছে।

—কেন? সুমন্ত নিজে আসলো না কেন?

এরপরে সুকোমল ইন্সপেক্টর রজতাভ পালিতকে রণবীর যাদবের সঙ্গে হওয়া সমস্ত কথোপকথনের ব্যাপারে জানায়। সবকিছু শুনে রজতাভ বেশ অবাক হয়ে বললেন, “সে কী! এত বড় পরিকল্পনা? সুনীল বোসের মেমোরি হ্যাক করে তাহলে বায়োওয়্যার সলিউশনসের গোপন তথ্যগুলো বের করতে চাইছে ও।”

সুকোমল বললেন, “সেরকমই তো আপাতত মনে হচ্ছে। হি ওয়ান্টস টু ক্রিয়েট অ্যা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইস্যু।” সঙ্গে তিনি জানিয়ে রাখলেন যে সিবিআইয়ের কর্মকর্তারা এই দুর্ঘটনা রুখতে তৎপরতার সঙ্গে কাজ করছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রজতাভ বললেন, “ঠিক আছে, আমরা কয়েকজনের টিম নিয়ে সুমন্তর বাড়ির আশেপাশে থাকবো এবং ওকে ট্র্যাক করবো। নিঃশব্দে আমরা ওর পিছু নেব যাতে ব্যাপারটা বোধগম্য না হয়।”

“জেন্টলম্যান, দিস ক্যান বি অ্যা হিউজ অ্যাটাক। রণবীর যাদব যে কিছু বড় একটা পরিকল্পনা করছে সেটা বুঝতে পারছিলাম কিন্তু সে যে এমন ভাবে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইস্যু তৈরী করার চেষ্টা করবে তা ঠিক প্রত্যাশিত ছিল না। যাই হোক, আমাদের একটাই লক্ষ্য হবে—সুনীল বসুর কিডন্যাপিং যেকোনোভাবে আটকানো। লেটস গেট টু ওয়ার্ক।” কথাগুলো বলা শেষ করে সিবিআইয়ের কর্মকর্তা যোশী কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন একটু ঠাণ্ডা বাতাসের আশায়।

সময় সকাল নয়টা। দমদম বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন ব্যক্তি, বায়োওয়্যার সলিউশনসের কর্ণধার সুনীল বসু। একটি গাড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছিল, গাড়িতে উঠে তিনি দেখলেন চারজন বসে আছে সেখানে... তিনজন লোক এবং একজন মহিলা। মহিলাকে একবার দেখে তার একটা সন্দেহ হল, তিনি বললেন, “আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি বলে মনে হচ্ছে?”

মহিলা একটু থতমত খেয়ে যায়। সুনীল বসু একটু ভেবে আবার বলেন, “আপনি ডক্টর নীহারিকা সোম তাই না?” সুনীলের একটু সন্দেহ হলেও মুখে কিছু বললেন না।

সন্দেহটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে ড্রাইভার সিটের পাশে বসে থাকা ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বললেন, “বায়োওয়্যার চিফ সিকিউরিটি অফিসার মাসুদ, কী খবর আপনার! কাজকর্ম কেমন চলছে?”

মাসুদ একটু কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করল, “স্যার, আপনার প্রোটেকশনের জন্য সিবিআই থেকে দুইজন অফিসার রয়েছেন। আপনাকে অপহরণের একটা চেষ্টা হতে পারে তাই।” বলে গাড়িতে বসে থাকা বাকি দুই ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল... গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল।

তাঁকে অপহরণের চেষ্টা যে রণবীর করবে তেমনই একটা খবর তিনি আগেই শুনেছিলেন র-এর টেকনোলজিক্যাল এক্সপার্টাইজ ডিপার্টমেন্টের প্রধান যোশীর কাছে, মানসিকভাবে প্রস্তুত আছেন তিনি... শুধু একটাই খটকা তাঁর মনে, নীহারিকা সোম এখানে কী করছেন।

গাড়িটা কিছুদূরে একটু ফাঁকা রাস্তায় যেতে না যেতেই মাসুদ একটা পিস্তল বের করে তাক করল একজন সিবিআই অফিসারের দিকে। কোনোকিছু না ভেবে সোজা গুলি চালিয়ে দিল মাসুদ। ঘটনার আকস্মিকতায় নীহারিকা, সুনীল এবং অবশিষ্ট একজন সিবিআই অফিসার হকচকিয়ে গেলেন। মাসুদ এবার গাড়ির চালকের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, “নিয়ে চল সুপ্রিমোর লোকেশনে!”

বেশ কিছুক্ষণ হলো সামনের গাড়িটাকে অনুসরণ করছেন রজতাভ পালিত এবং তার একটি টিম। ঐ গাড়িতেই আপাতত রয়েছে সুমন্ত, তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোনো গোপন আস্তানায়। শহরের রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা বাইরে চলে এসেছে তারা, রাস্তায় লোকের আনাগোনা কম... রজতাভ পালিত তাদের প্রতিটা পদক্ষেপ যোশীকে জানাচ্ছেন যাতে যোশী নিজেদের একটা মোবাইল টিমকে রজতাভর সাহায্যের জন্য পাঠাতে পারেন সেই পথ ধরে। রজতাভর সঙ্গে কথা বলে যোশী এই পরিকল্পনা আগের থেকেই করে রেখেছিলেন।

গাড়িটি আমায় নিয়ে বেরিয়েছে বেশ অনেকক্ষণ হলো। এ গলি ও গলি রাজপথ ধরে এখন শহরের অনেকটাই বাইরে এসে পড়েছি আমরা। কাল পুরোটা দিন মনের মধ্যে এক অজানা ভয় এবং উৎকন্ঠা‌ নিয়ে কাটিয়েছি আমি, বাবার আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে এমন এক বিরাট ষড়যন্ত্রের খোঁজ পাব এবং সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে যাব এ যেন আমার কল্পনার অতীত।

তবে আজ আমার জীবনের হয়তো শেষ দিন হতে পারে, কেননা কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে যে রণবীর যাদব আর আমাকে জীবিত রাখবে না... সে আমি ভালোভাবেই জানি। শুধু যদি আমার পরিকল্পনা মাফিক সব কিছু হয় তবে আর চিন্তা নেই, নিজে না বাঁচতে পারি কিন্তু রণবীরকে আটকানো অন্তত যাবে।

গাড়িটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতেই আমার সম্বিত ফিরল। দেখলাম একটা বিশাল বড় টিনের শেড দেওয়া গোডাউনের সামনে এসেছি, আশেপাশে জঙ্গুলে এলাকা ছাড়া আর কিছু নেই। ঘরবাড়ির কোনো অস্তিত্ব নেই এখানে... সে দৃশ্য দেখতে দেখতেই একজন লোকের কাছে ধমক খেয়ে নামতে হলো গাড়ি থেকে। প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আমায়, ঠিক সেইসময় অন্য একটি বড় গাড়ী অপেক্ষারত অবস্থায় দেখতে পেলাম আমি, ভেতর থেকে কথা কাটাকাটির শব্দ শুনতে পেলাম আমি। মনে মনে শুধু একটাই প্রার্থনা করছি যেন রজতাভ পালিত এবং সিবিআইয়ের টিম সময়ের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারে এখানে।

গোডাউন বাইরে থেকে পুরোনো এবং ভাঙাচোরা মনে হলেও ভেতরটা কিন্তু যথেষ্ট ঝাঁ চকচকে, বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এবং মেশিনের সম্ভারে একটা বড়সড় ইলেকট্রনিক গোলকধাঁধার মতো মনে হল আমার। আরেকটু ভেতরে যেতেই আমায় দেখে একজন কর্পোরেট গোছের লোক বলে উঠলেন, “সুমন্ত... তাই না! ওয়েলকাম।” আমি সেকথার কোন উত্তর না দিয়ে একবার চারপাশে নজর বুলিয়ে নিলাম। দেখে অবাক হলাম যে সুনীল বসু, নীহারিকা সোম সমেত গোটা পাঁচেক লোক মনে হল রণবীরের দলের কাছে বন্দী।

একটা পুরোনো ভাঙাচোরা রোবটিক যন্ত্রাংশের দিকে দেখিয়ে রণবীর বললেন, “সুমন্ত, তোমার কাজ হল এই রোবটিক সুপার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট মেশিনটাকে রিভাইভ করা। “মেমোক্লিয়ার” এর প্রোগ্রাম যে ডরম্যান্ট আইপি তে পয়েন্ট করা আছে সেটা এই সুপার আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্ট মেশিনের আইপি।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হবে এটা দিয়ে?” রণবীর যাদব আমার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে সুনীল বসুর দিকে দেখলেন। বললেন, “কী সুনীল? এটা দিয়ে কী হবে?” সুনীল বসুর চোখ মুখ থমথমে, কোনো উত্তর দিলেন না।

রণবীর হিংস্র একটা হাসি দিয়ে বললেন, “বেশ আমিই বলি! ২০৫৫ থেকে ২০৬০ সালের মধ্যে তৈরী হয়েছিল সুপ্রিমো। হ্যাঁ, এই স্ট্রাকচারের নাম আমরা দিয়েছিলাম সুপ্রিমো বা প্রজেক্ট সুপ্রিমো। এই সুপার ইন্টেলিজেন্ট রোবটকে এমন ভাবে প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত করা হয়েছিল যাতে সুপ্রিমো অন্যের মন পড়তে পারে এবং সেই মনের থেকে চিন্তা চুরি করতে পারে। কিন্তু শুধু তাই নয়, এই রোবটের যে কোর মেমোরি/থট হ্যাকিং প্রোগ্রাম আছে সেই প্রোগ্রাম হল পোর্টেবল... অর্থাৎ ইট ক্যান বি প্লেসড এনিহোয়্যার। এই মেশিন কোনোদিন পূর্ণ মাত্রা পেলে বিশ্বের সকলের মনের এবং মাথার দখল নেওয়ার ক্ষমতা রাখতে পারবে, শুধু তাই নয়, মনের চিন্তাগুলোকে ভয়ানক রূপদানের ক্ষমতাও রাখবে... যার মাধ্যমে সকলের ব্রেনে থট ইনফেকশন ঘটানো যাবে, অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবী এবং সবার চিন্তার দখল আমাদের হাতে চলে অাসবে। ইউ ক্যান মেক এনিওয়ান ডু এনিথিং।

“তবুও এই আবিষ্কার সবার কাছে মনে হয়েছিল বিদঘুটে। বলে রাখি যে এই পরিকল্পনা তোমাদের সুনীল বসু এবং আমার ছিল, একা আমার ছিল না। কিন্তু সুনীলের নজর ছিল বায়োওয়্যারে আমার জায়গায়, তাই সময় আসতেই সমস্ত ব্যাপারটার দায় আমার ওপরে দিয়ে দেয়। আমি বরখাস্ত হই। সুপ্রিমোও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে ২০৬০ সাল থেকে। যাই হোক, এই মেশিনের না হয় মনের দখল নেওয়ার ক্ষমতা আর নেই, কিন্তু পিকোবট চিপের মধ্যে মেমোক্লিয়ার সফ্টওয়্যার ইন্সটল হয়ে গিয়েছে, তাই ব্রেনের থট ইনফেকশনের কাজটা তো হয়েই রয়েছে। যাই হোক, গেট টু ওয়ার্ক সুমন্ত! আর নীহারিকা... সুনীল বসুর মাথায় পিকোবট চিপ বসানোর কাজ শুরু করো।”

রণবীর যাদবের কথাগুলো শুনলেও আমার মনে অন্য জিনিস চলছে। এখানকার অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে চলেছে, যদি আমাদের প্রাণে বাঁচতে হয় তবে সুপ্রিমোর রিভাইভ হওয়া খুব দরকার। কারণ তাহলেই তো আমার পরিকল্পনা সফল হবে... আর বেশী কিছু ভাবতে পারলাম না। রণবীর যাদবের আরো একটা ধমকে আমি ধীরে ধীরে নিজের কাজ শুরু করতে উদ্যোগী হলাম। সুনীল ততক্ষণে রণবীরের হাতের পুতুল হয়ে পড়েছে এবং একরকম জোর করে অজ্ঞান করেই তার মাথায় পিকোবট চিপ বসানোর কাজ শুরু করা হল।

১০

আমার সঙ্গে নীহারিকার দৃষ্টি বিনিময় হল, সেই দৃষ্টিতে হালকা কোনো ইঙ্গিত দেওয়ার একটা চেষ্টা করলাম আমি। নীহারিকা রণবীরের কথা অনুযায়ী নিজের কাজ করতে লাগলেন, অন্যদিকে আমি সুপ্রিমোর সার্ভার রিভাইভ করার জন্য মেমোক্লিয়ারের ইনিশিয়ালাইজেশন মডিউল ট্রিগার করে দিয়েছি। এই ট্রিগারিং প্রসেস শেষ না হওয়া অবধি যেন রণবীর কিছু বুঝতে না পারে সেই প্রার্থনাই মনে মনে করে চলেছি।

বেশ কিছুটা সময় কাটল চরম উৎকণ্ঠায়। ট্রিগারিং প্রসেস শেষ হতেই সুপ্রিমোর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অপারেটিং সিস্টেমে মেমোক্লিয়ারের বাকি মডিউল এবং প্যাকেজগুলো ইনস্টল করার সময় এসেছে। এই প্রসেসও ইনিশিয়েট করলাম আমি, ব্যাকএন্ড স্টেজিং সার্ভার দেখার সময় নেই। ওপরওয়ালার ওপরে ভরসা করতেই হবে আমায়।

“আমার কাজ হয়ে গেছে! এবার আমায় ছেড়ে দাও...যেতে দাও আমায়।” প্রায় কাকুতি মিনতি করে নীহারিকা।

রণবীর হাসলেন, নীহারিকার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন “তোমার কাজ শেষ হয়েছে বটে! কিন্তু তোমার মাথায় থট ট্র্যাকার যে এখনোও রয়েছে নীহারিকা, তাই তোমাকেও...” কথাটা শেষ না করেই রণবীর ছোটো একটা রিমোট মতো টিপলেন। মাথায় হাত দিয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে নীহারিকা, দেখে মনে হল তার মাথা যেন ফেটে যেতে পারে যেকোনো সময়।

ঠিক এইসময় বাইরের দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম আমি, তার সঙ্গে যে প্রচণ্ড হাতাহাতিও বেঁধে গেছে সেটাও বেশ বুঝতে পারলাম। “পুলিশ কীভাবে এলো এখানে?” নিজের মনেই প্রশ্নটা করলেন রণবীর যাদব।

সুপ্রিমোর ইনিশিয়ালাইজেশন এখনো হচ্ছে না দেখে রণবীরের মনে হয়তো সন্দেহ দানা বাঁধল, তিনি বারবার সুপ্রিমোর বাকি যন্ত্রাংশগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন... মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে এখন নিশ্চয়ই সুপ্রিমো নিজের স্বমূর্তি ধারণ করবে এবং তিনি সুপ্রিমোর মেমোরি কন্ট্রোলিং এর মাধ্যমে সকলের মেমোরি ইনফেকশন ঘটাতে পারবেন।

কিন্তু আরো কিছুটা সময় কাটাবার পরেও যখন‌ সুপ্রিমো ইনিশিয়ালাইজেশন পয়েন্টে এসে পৌঁছলো না, তখন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আমার কলার ধরে টেবিলের সঙ্গে প্রায় মিশিয়ে দিয়ে বললেন, “সুপ্রিমো স্টার্ট কেন হচ্ছে না? হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান?” আমার ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠল।

রজতাভ পালিতের টিম এবং যোশীর টিম গুলি যুদ্ধে পরাস্ত করতে লাগল রণবীর যাদবের বন্দুক বাহিনীকে‌। রণবীর যাদব ধীরে ধীরে একা হয়ে পড়ছেন। সেই ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে না পেরে একটি পিস্তল আমার কপালে তাক করলেন তিনি। সেই অবস্থাতেও নিজেকে অবিচল রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকলাম, চোয়াল শক্ত করে রণবীর বললেন, “সুমন্ত, তোমায় এমনিই মারব আমি। তার আগে বলে যাও যে তুমি ঠিক কী করেছ সুপ্রিমোর সঙ্গে।”

বাবার মৃত্যুর পেছনে এই লোকটার হাত ছিল, বাবার কী দোষ ছিল? ওঁর দোষ কী এটাই যে উনি বাঁচতে চেয়েছিলেন! সাধারণ একটা পিকোবট চিপে ম্যালফাংশান করে বাবার মৃত্যু ঘটানো কি অপরাধ নয়! বাবার হাসি মুখটা মনে পড়ল, বললাম, “আপনি ঠিক পিকোবট চিপ গুলোতে যা যা করেছিলেন। এখানে আমিও ঠিক তাই করেছি।”

একটু যেন অবাক হলেন রণবীর, আর সেখানেই আমার মনে সাহস এলো। রণবীর ততক্ষণে বন্দুকের সেফটি ক্যাপ খুলে ফেলেছেন, বললেন, “হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান!” রণবীর যাদব যে একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন সেটা ভালোই বুঝলাম, কেননা চারিদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে রজতাভ পালিত এবং সিবিআইয়ের টিম। সুপ্রিমো আর জেগে উঠল না, সেই ভয়ঙ্কর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের রোবট এখন নিষ্ক্রিয়। আমি ঘায়েল এবং পরাজিত রণবীরের দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখে চোখ রেখে হাসলাম, বলতে শুরু করলাম, “আপনি হয়তো জানেন না স্যার যে আমি শুধুমাত্র একজন কোড ডেভলপার নই, তার সঙ্গে একজন এথিক্যাল হ্যাকারও বটে। সেদিন যখন আপনার সঙ্গে কল শেষ হয় আমার, সেদিন একটা জিনিস আমার মাথায় আসে। মেমোক্লিয়ার সফটওয়্যারের মধ্যে আপনার যে বাইনারি নম্বর ম্যালফাংশানের প্রসেস ইনস্টল করা ছিল, সেটাকে কিন্তু কোনোভাবেই ট্রেস করা যাচ্ছিল না‌। আমার হ্যাকিং এর নলেজ ব্যবহার করে ইনভিজিবল প্রসেসটার সোর্স আর অবজেক্ট খুঁজে বের করি। এই সোর্স আর অবজেক্টকে সুপ্রিমোর ডরম্যান্ট আইপি-র সার্ভারে স্টেজ করে রাখি। আমার শুধু একটাই ভয় ছিল, এত পুরোনো একটা আইপি... যদি সেই আইপি-কে রিভাইভ করা না যায়। কিন্তু আইপি-টা রিভাইভ হল এবং আমার প্ল্যান কাজে এলো। আপনার সুপ্রিমো যেহেতু সুপার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের একটা রোবট, তাই সার্ভারে অ্যাভেইলেবল যেকোনো প্রোগ্রামকেই ও সেল্ফ ইনস্টল করতে পারে। তাই এই রোবট রিভাইভ হলেও কতটা আপনার কন্ট্রোলে থাকত তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, আর এই একটা জিনিসই ছিল আপনার ক্রিয়েশনের বাগ... যা আমি খুঁজে বের করেছি এবং এই বাগটাকে নিজের মতো কাজে লাগিয়েছি। আপনার মেমোরি কন্ট্রোলিং প্রসেসের প্রোগ্রামটা সার্ভারে স্টেজ করার আগে একটা ছোটো বাগ আমিও প্লেস করি, এমন একটা বাগ যা ইনস্টলিং ডিভাইসকে ইনফাইনাইট লুপে ফেলতে পারে। আপনার প্রজেক্ট সুপ্রিমোর সঙ্গে সেটাই হয়েছে, প্রোগ্রামটা এতক্ষণে ইনফাইনাইট লুপে ঘুরছে তাই ইনিশিয়ালাইজেশন মডিউল অবধি আসছে না‌। আসবেও না... আর আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন ইনফাইনাইট লুপে চলতে চলতে একটা সার্ভার ক্র্যাশ করে যায়, আপনার সুপ্রিমোর সঙ্গে সেটাই হবে। তাই এবারের মতো আপনার আর ভগবানের জায়গা নেওয়া হলো না।”

আমার মনে হল রণবীর যাদব যেন হার্টফেল করবে, আমায় আরো কিছু বলার আগে পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে চলে যায়। নীহারিকা সোম বেশ আহত হয়েছেন, তাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা হলো।

বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে। সুকোমলদার অফিসে বসে হলোগ্রাফিক ডিসপ্লে ডিভাইসে যোশীর সঙ্গে কল হচ্ছে আমাদের।

—ওয়েল ডান সুমন্ত। তোমার কাজে আমি অত্যন্ত খুশী।

—ধন্যবাদ স্যার‌। তবে একটা জিনিস কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছে।

—কী?

—এত বড় একটা কাজ রণবীর তো একা করবে না। ফিনান্সিয়াল ব্যাকিং না থাকলে এমন ভয়ানক একটা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। এসবের পেছনে বড়ো কেউ রয়েছে হয়তো।

—সেটাই। রণবীর এখনও অবধি মুখ খোলেনি, মুখ তো খোলাতেই হবে। যাই হোক, দরকার পড়লে কিন্ত আবার তোমায় ডাকব সুমন্ত।

—এনিটাইম স্যার।

সিঙ্গাপুরের বেডক মলে একটা পিৎজায় কামড় বসালো লোকটা। হঠাৎ তার কাছে ফোনটা এলো।

—বলুন হরকিষণ জি!

—রণবীর হ্যাজ ফেইলড বিগ টাইম।

—রণবীরকে ছাড়ুন। আমার টার্গেট এখন অন্য।

—কে?

—দ্যাট হ্যাকার। হি উইল বি আওয়ার গাই। দ্য ব্ল্যাক অর্ডার উইল ইমার্জ, দ্যাট হ্যাকার উইল হেল্প আস অ্যান্ড হোল হিউম্যানিটি উইল বো ডাউন টু দ্য ব্ল্যাক অর্ডার। টাইম উইল টেল...