নতুন স্বর্গ - সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

গল্প

রেডিওতে শুনেছিলাম রাতের বেলা নাকি ঝড় আসতে পারে, সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। কিন্তু কমরেডদের এসব তুচ্ছ জিনিস কবেই বা দমাতে পেরেছে। মেসবাড়িতে একা থাকি। লুকিয়ে নকশাল করতাম। ধরা পড়ার ভয়ে মুখে কংগ্রেসী বুলি আওড়ালেও মনে মনে আমি কিন্তু সাচ্চা কমিউনিস্ট থুড়ি সোস্যালিস্ট।

সেদিন বিকেল থেকেই শুরু হয়েছিল পার্টি অধিবেশন। আজকাল আর গোপনে ঝটিকা মিটিং করতে হয় না। পার্টি ক্ষমতায়—কমরেডরা সবাই একটু রিল্যাক্সড মুডে। তাই অধিবেশনে সামান্য খানাপিনার আয়োজনও করা হবে বলে শুনেছিলাম।

অসাধারণ একটা সন্ধ্যা কাটালাম বটে। “জাতীয় সাম্যবাদী পার্টি”-এর কিছু আধুনিকমনষ্ক কমরেডদের সঙ্গে একটা পুরো সন্ধ্যে কাটানো মোটেই হেলাফেলার নয়। উপরি পাওনা হিসাবে খাওয়াদাওয়ার মধ্যে হাঁসের তুলতুলে নরম মাংসের সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা দামী তুলাইপঞ্জি চালের মাটন বিরিয়ানি—কী সোয়াদ—যেন কবিতা! এরপর কয়েকগ্লাস উপাদেয় চিভাস টুয়েনটি ফাইভ ইয়ার্স নাহলে কি আর…

হেঁ হেঁ—বুঝতেই পারছেন, অমূল্য এক সন্ধ্যের জন্য এটুকু দুর্মূল্য বিনোদনের হিসাব কষা নেহাতই রসভঙ্গকারী ব্যাপার!

যাগগে, খাওয়া দাওয়ার পর চমৎকার কিছু হাভানা চুরুট ধরিয়ে (মানতেই হবে, পার্টির লোকজনের আভিজাত্য আছে) আমরা গভীর আলোচনাতে মনোনিবেশ করলাম। মূলধনের জাতীয়করণ এবং দুনিয়ার মানুষের সাম্য ব্যাপারটা আমাদের যারপরনাই চিন্তিত করে তুলেছে।

যদিও এত গুরুগম্ভীর আলোচনাতে আমি খুব একটা যোগ দিতে পারছিলাম না। ছোটবেলা থেকেই নিজের সংস্থান নিজেকে করতে হয়েছিল বলেই হয়ত, এসব দরকারী বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবুও আমি বেশ মনোযোগ সহকারে আলোচনাটা শুনছিলাম। আমার বন্ধু সজল আমাকে ব্যাখ্যা করে দিচ্ছিল আলোচনার দুরূহ বিষয়গুলি। জানলাম, সুপ্রাচীন কাল থেকেই দুনিয়াটা নাকি পুরো ভুল রাস্তায় চলেছে। তবে আর বছর কয়েকের মধ্যে পার্টি একে একদম সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য বদ্ধপরিকর।

সাম্য—সাম্যই হবে তাদের একমাত্র হাতিয়ার। সব কিছুতে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে—নিরবিচ্ছিন্ন এবং অবাধ সাম্য। অধিকারের সাম্য থেকে শুরু করে পদাধিকারের সাম্য। কর্তব্যে সাম্য, কর্তৃত্বে সাম্য—চতুর্দিকে সাম্যের সামগান গাইতে হবে। তবেই না মানুষের মনে পরিতোষ আসবে—সন্তুষ্টির আবহে ভেসে স্বর্গসুখ লাভ করবে অধুনা দুখী মানবসমাজ।

এই দুনিয়া সবার—এখানে সবার সম-অধিকার। মানুষের শ্রম শুধু তার নিজের কুক্ষিগত নয়। শ্রমের ওপর যেমন তার নিজের অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাষ্ট্রের ও সমাজের। যে রাষ্ট্র তাকে অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করে দিয়েছে, তাকে উপেক্ষা করে সে কেবল নিজের প্রয়োজনে তার শ্রমকে ব্যবহার করতে পারে না। তার শ্রমের ফল কেবল তারই আত্মোন্নতিতে লাগবে এ যেন না হয়, দেশ ও দশের জন্য উৎসর্গীকৃত হবে প্রতিটি মানুষের শ্রমজাত উৎপাদন।

এতদিন দেখা গিয়েছিল, ধন সম্পদ কেবল কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের হাতেই থাকে কুক্ষিগত। এই ধনিকশ্রেণি অধিকাংশ নির্ধন মানুষকে বেঁধে রাখে ষড়ৈশ্বর্যের প্রভাবে সৃষ্ট এক সামাজিক অধিকারের নিগড়ে। একটা ছোট ডাকাতদল যেমন কেবল আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ভয় দেখিয়ে বহু মানুষকে নিজেদের বশে রাখতে পারে—অনেকটা সেরকমই। আমাদের সেই আগ্নেয়াস্ত্র কেড়ে নিতে হবে। ধনের সাম্য প্রতিষ্ঠা করাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক অসাম্য, যা মনুষ্যত্ব বিকাশের পথে কাঁটাবিশেষ, তাকেও নির্মূল করতে হবে। মানুষকে তার ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে (সে ভবিষ্যত যাই হোক না কেন)। আজ মানুষকে তার জন্ম দিয়ে বিচার করা হচ্ছে—ব্রাহ্মণ, চাঁড়াল হিসাবে শ্রেণিবিভাজন চলছে। মনুষ্যত্বের সম্মুখে আজ এক অসমান মুক্তিমার্গ—যেখানে সুবিধাজনক শ্রেণির জন্য বিছানো রয়েছে নরম ঘাসের কার্পেট আর অন্তেবাসীর জন্য বরাদ্দ আছে খড়খড়ে খোয়া বিছানো পথ। কিন্তু যদি শ্রেণীবিন্যাস ভুলে আমরা একদল সৈনিকের মতন দৃপ্ত পদক্ষেপে মার্চ করে এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে এই বন্ধুর পন্থাও মসৃণভাবে পার হয়ে যাওয়া যায়।

পৃথিবী আমাদের মা—আর মায়ের কাছে কে আপন কে পর! তাই পৃথিবীর সম্পদে সব মানুষের সমান অধিকার। কেউ অভুক্ত থাকবে না, কেউ বেশি খাবে না। শক্তিমান দুর্বলের ওপর কর্তৃত্ব দেখাবে না, ছল করে কেউ অন্যের থেকে বেশি সম্পদ কেড়ে নেবে না। পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ মানুষের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হবে।

অসাম্যের ফলে আসে দুঃখ বেদনা। মানুষ হয়ে ওঠে অপরাধী, পাপী, আত্মকেন্দ্রিক, গোঁয়ার ও সুবিধেবাদী। কিন্তু সাম্যের পৃথিবীতে শয়তানের স্থান নেই। মানুষ লড়বে কী উদ্দেশ্যে? তখন তো রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও তো সে ধনই থাকবে। তখন কুটিল হলাহলের কটু গন্ধ অতিক্রম করে মনুষ্যত্বের অমৃতগন্ধে ম-ম করবে চতুর্দিক।

বিশ্বজুড়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা হলে এই ধরিত্রী হয়ে উঠবে স্বর্গ। তখন ভগবানের আর দরকার হবে না।

আমরা দামী গ্লাসে আরও দামী মদ তুলে সাম্যের নামে পান করলাম। তারপর আরও দুটো বোতল বের করা গেল আলমারি থেকে, সঙ্গে বেশ কয়েকটা হাভানা চুরুট।

মেসে ফিরে ব্যাপারগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলাম। এদের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো দুনিয়াটাই বদলে যাবে। এখন কথায় কথায় হাতাহাতি, গুঁতোগুঁতি, খেয়োখেয়ি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব—আর কিছুই থাকবে না এসব। দারিদ্র নেই, হিংসা নেই—অসাধারণ। রাষ্ট্র তার নাগরিকের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুর দায়িত্ব নিয়ে নেবে। আঁতুড়ের কাঁথা থেকে শ্রাদ্ধের ছাতা সবকিছু ভার রাষ্ট্রের ওপর। হাড়ভাঙা খাটুনির ইতি। হিসেব কষে দেখা গেছে, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ যদি দিনে মাত্র তিনঘণ্টা কাজ করে, তাহলেই যথেষ্ট। ভাবা যায়? মাত্র তিনঘন্টা!! এর বেশি কাজ করার কোনও প্রয়োজনই নেই। দুঃখ নেই, ভাবনা নেই—কেউ নজর নীচু করবে না, কাউকে নীচু নজরে দেখা হবে না। এভাবেই সুখসাগরে ভাসতে ভাসতে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে মানবসমাজ (সে ভবিষ্যত যাই হোক না কেন)!

বাইরে গুমোট গরমের জন্য ঘুম আসছিল না একদম। বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও সারাদিন কিচ্ছুটি হয়নি। শুয়ে শুয়ে বিছানায় এ’পাশ ও’পাশ করতে লাগলাম।

হঠাৎ বাইরে শনশন হাওয়ার শব্দ টের পেলাম। ঝড় উঠেছে—এতক্ষণে!! জানলার পাল্লাটা খটাখট করে নড়ে উঠল। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পাল্লাটা টানতেই বিপুল ঝড়ের প্রকোপে দড়াম করে জানলাটা হাট হয়ে খুলে গেল, আর হু হু করে ঢুকে এল একঝলক ঠান্ডা সোঁদা বাতাস। প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল। জমিয়ে একটা ঘুমের তোড়জোড় করতে লাগলাম। বাইরে ততক্ষণে ঝড়ের সঙ্গে শুরু হয়েছে আকাশভাঙা বৃষ্টি।

জলের ঝাট আসাতে জানলাটা ভেজানোর জন্য হাত বাড়ালাম। আচমকা একটা হলদেটে আলোয় চোখ যেন ঝলসে গেল। চারপাশে কেমন যেন একটা পোড়া গন্ধ। কড়-কড়াৎ করে বাজের ভয়ানক আওয়াজ শুনতে পেলাম—যেন ঠিক কানের কাছটায় বাজ পড়ল। তারপর আর কিছু মনে নেই।

***

ঘুম ভাঙার পর মাথাটা কেমন করে উঠল। ঠাওর করে বুঝলাম, চারপাশ থেকে প্রচুর আলো আসছে। সকাল হয়ে গেছে নিশ্চই। কিন্তু মেসের ঘরে তো এত আলো ঢোকে না। এ আমি আছি কোথায়!! ঘাড় ঘুরিয়ে বুঝলাম আমি একটা কাচের আধারের মধ্যে শুয়ে রয়েছি, যার ঠিক ওপরে বাংলায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে এই কথাগুলোঃ

মহান নক্সাল আন্দোলনে হাজার শহীদের তাজা রক্তস্নাত বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে ১৯৭৭ সালের জুন মাসে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরেই এই ব্যক্তিটি মহানিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ব্যক্তিটির বাড়িওয়ালার বক্তব্য অনুসারে, তিনি এঁকে ঘুম থেকে তুলতে ভুলে যান, এবং বাড়িওয়ালার যখন খেয়াল হয়, ততদিনে ব্যক্তিটি দশ বছরের নিদ্রাবস্থা পার করে ফেলেছিলেন। এই অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে, বিজ্ঞান গবেষণার হেতু, এঁর নিদ্রাভঙ্গ করতে নিষেধ করা হয়, এবং “ফ্যানটাসটিক মিউজিয়াম” এ তাঁকে সযত্নে শায়িত রাখা হয়—যাতে ইনি যতদিন ইচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন।

আদেশানুসারে, মিউজিয়াম কতৃপক্ষ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭

দর্শকদের অনুরোধ করা হচ্ছে, কাচের আধারের বায়ুনিকাশি দিয়ে দয়া করে জল ছেটাবেন না।

আমাকে নড়াচড়া করতে দেখে একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন—বোধকরি মিউজিয়ামেরই কর্মচারী হবেন।

ভদ্রলোক একটু বয়স্ক, কিন্তু মুখেচোখে বুদ্ধির ছাপ আছে। পাশের শোকেসে কিছু স্টাফড টিকটিকি সাজিয়ে রাখছিলেন তিনি। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে আমার কাচের আধারটির ঢাকনাটি খুলে দিলেন।

“আরে কী ব্যাপার। উঠলেন যে বড়! কেউ বিরক্ত করল নাকি?” উনি জিজ্ঞেস করলেন।

“আরে না না,” আমি অমায়িক হাসি হেসে বললাম, “আমার ঘুম হয়ে গেলে চিরকালই আমি এভাবে নিজে নিজেই জেগে উঠি। বলতে পারেন এটা কোন শতাব্দী?”

“এটা? এটা একবিংশ শতাব্দী। ২০৭৭ সাল। আপনি পাক্কা এক’শ বছর ঘুমিয়েছেন মশাই।”

“আহ, দারুণ!” আমি কাঁচের বাক্সের বিছানা থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙলাম, “একটা নিটোল ঘুমের চেয়ে ভালো কিছুই হতে পারে না।”

বয়ষ্ক ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, “এবার নিশ্চই আপনাকে নিয়ে আমাকে শহর ঘোরাতে যেতে হবে। আমি আপনাকে সবকিছু দেখাবো, বোঝাবো, আর আপনি বোকা বোকা প্রশ্ন করে আমাকে উত্যক্ত করবেন।” আমি চুপচাপ শোকেসের পাশে পরিপাটি করে সাজানো জামাকাপড়গুলো পেড়ে নিয়ে পরতে পরতে বললাম, “হ্যাঁ ওই আর কি।”

“চলুন তবে। ঝামেলাটা মিটিয়েই নেওয়া যাক।” ভদ্রলোক টুপিটা তুলে নিয়ে মিউজিয়ামের দরজার দিকে হাঁটা লাগালেন।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে এখন সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে নিশ্চই।”

উনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ঠিকঠাক হয়েছে?”

“কেন? দুনিয়াটা? আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম এই নিয়ে। ওরা বলেছিল দুনিয়াটাকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়ে তোলা দরকার—এর মধ্যে শুরু থেকেই অনেক ভুল রয়েছে। তা, সেইসব ভুল কি সব ঠিক করা হয়ে গেছে? পৃথিবীতে কি সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে? মানুষ কি দুঃখ কষ্ট পাপ-তাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে?”

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ—সব ঠিক হয়ে গেছে এখন।” আমার গাইড ভদ্রলোক বলে চললেন, “আপনি যখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন তখন আমরা প্রচুর পরিশ্রম করেছি। দুনিয়াতে এখন সাম্যই সাম্য। কেউ অন্যায় করতেই পারে না, আর সেটা সম্ভবও নয়। অসাম্যের ব্যাঙাচিরা আর কেউ জলে নেই হে—সব ধাড়ি ব্যাঙ হয়ে সাম্যের ডাঙায় লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।”

(উপমাটা আমার মোটেই শোভন লাগল না। তবুও আমি প্রতিবাদ না করাই মনস্থ করলাম।)

আমরা হেঁটে হেঁটে শহর ঘুরতে বেরোলাম। পরিষ্কার আর শান্ত শহর। ভিড়ে ঠাসা নোংরা কলকাতা বলে চেনার উপায় নেই। রাস্তাগুলোর নাম বদলে কেবল নম্বর লেখা। প্রতিটা রাস্তা এক অপরের সঙ্গে প্রায় সমকোণে অবস্থা করছে। শুধু তাই নয়, প্রায় সব রাস্তাই একরকম। ট্রাম, ঘিঞ্জি ঠেলাগাড়ি, গোমড়ামুখো অ্যাম্বাস্যাডরের সারি বিদেয় নিয়েছে। রাস্তাজুড়ে শুধু ইলেকট্রিক গাড়ি। যে কটা মানুষজন দেখতে পেলাম, সবার মুখ অস্বাভাবিকরকম গম্ভীর, আর মুখভঙ্গিও প্রায় একই রকম। দেখলে মনে হয়, যেন সবাই একই পরিবারের সদস্য। প্রত্যেকেই, মায় আমার গাইড সুদ্ধু, একই পোষাক পরে রয়েছে—ধূসর প্যান্ট, ধূসর জোব্বা যেটা আবার কোমরে বেল্ট দিয়ে বাঁধা। প্রতিটা মানুষের মুখ পরিষ্কার করে কামানো, আর সবার মাথার চুলের রঙ—কালো!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এরা সবাই যমজ নাকি?”

“যমজ?” গাইড খিঁচিয়ে উঠলেন, “যমজ হতে যাবে কোন দুঃখে?”

“কেন? সবকটাকেই তো একইরকম দেখতে। আর সবার মাথার চুলই কালো।” আমি উত্তর দিলাম।

“ওটাই এখনকার চুলের আইনানুগ রঙ।” আমার গাইড উত্তর দিলেন। “চুল কালো করাটাই বিধিসম্মত। যদি কারো চুলের রঙ স্বাভাবিকভাবে কালো না হয়, তাহলে তাকে ডাই করাতে হয়—আর টাক থাকলে বাধ্যতামূলক ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট।”

“কেন?”

“কেন?” গাইডের মুখ দেখে মনে হল বেশ বিরক্ত হয়েছেন ভদ্রলোক। “আপনাকে তো বললামই যে সব মানুষই সমান। এবার ভাবুন, যদি কেউ সোনালী চুল এলিয়ে আপনার সামনে ঘুরে বেড়ায়, আর আপনার চুল কালো হয়, তাহলে আপনার মনে সোনালী চুলের বাসনা জাগতে পারে। তাহলে সাম্যের কী রইল? অথবা কারুর কেশকলাপের কালিমা দেখে আপনি মুচ্ছো গেলেন, আবার কারুর বিরলকেশ বা পক্ককেশ দেখে তাকে তুচ্ছ করলেন, সেক্ষেত্রে অসাম্যটাই কি প্রাধান্য পেত না? আবার ধরুন, কারুর কোমর অবধি চুল, কারুর কাঁধ অবধি। তাই এখানেও মূর্তিমান অসাম্য! তাই এখন নিয়ম হয়েছে, ‘পুরুষ হোক বা নারী—ঘাড়ের নীচে চুল যাওয়া বাড়াবাড়ি!’ এবং ‘ছোট করে ছাঁটো চুল, আর দূর করো প্রকৃতির ভুল!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু কালোই কেন?”

গাইড জানালেন অতশত তিনি জানেন না, তবে তিনি শুনেছেন যে কালোটাই নাকি সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয়েছে।

“কারা স্থির করেছে?”

“সংখ্যাগুরু লোকজন।” এই বলে তিনি মাথার টুপিটা একটু তুলে ঘাড়টা একটু নুইয়ে নিলেন, যেন নীরবে প্রার্থনা করলেন বলে মনে হলো।

চলার পথে কেবল একগাদা পুরুষমানুষই চোখে পড়ল আমার।

“আচ্ছা, শহরে মহিলারা থাকেন না?” আমি বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“কী বলছেন?” আঁতকে উঠলেন গাইডমশাই “আলবাত থাকে। আপনার পাশ দিয়েই তো কয়েক’শ মহিলা চলে গেলেন।”

আমি ঢোঁক গিলে বললাম, “ইয়ে—দেখুন, পুরুষ আর মহিলা আলাদা করার ক্ষমতা আমার ছিল বলেই জানি। কিন্তু সেভাবে মহিলা বলে কাউকে তো দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।”

“কী বলেন!! এই তো এই তো আপনার পাশ দিয়েই যাচ্ছে, দেখুন দেখুন।”

আমি তড়িঘড়ি তাকালাম। একই ধূসর প্যান্ট আর জোব্বা পরা দুজন মানুষ আমার পাশ দিয়ে চলে গেলেন। কিছুই বুঝলাম না!!

“কী করে বুঝলেন যে ওরা মহিলা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“কলারে সাঁটানো ধাতব প্লেটে লেখা নম্বরটা খেয়াল করেননি?” গাইড কিছুটা অবাকই হলেন।

“তা দেখেছি। ওটা দেখে আমি তো ভেবেছিলাম পুলিশ! জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিলাম যে চারপাশে এত পুলিশ, লোকজন নেই!”

গাইড ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে বললেন, “জোড় সংখ্যা হলে পুরুষ আর বিজোড় হলে মহিলা। এবার বোঝা গেল?”

“বাঃ এটা কিন্তু বেড়ে।” আমার বেশ মজা লাগল ব্যাপারটা। “একটু অভ্যেস করে নিলেই আমি শুধু সংখ্যা দিয়েই পুরুষ আর মহিলাদের আলাদা করতে পারব।”

“নিশ্চই—চাইলেই পারবেন।” গাইড ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। কিছুক্ষণ আমরা কোনও কথা না বলে হাঁটতে লাগলাম।

“সংখ্যা কেন? লোকের কি নাম নেই? নাম দিয়েও তো আমরা আলাদা করতে পারি।” আমার মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।

“আরে সে এক কাণ্ড। কারুর নাম অজাতশত্রু, কারুর নাম বিশ্বরূপ, আবার কেউ ছোটু, কেউ পচা, খ্যাঁদা ইত্যাদি। এবার অজাতশত্রু পচার সঙ্গে মিশতে চায় না। খ্যাঁদা আবার বিশ্বরূপের কাছে আসতে কুন্ঠা বোধ করে। তাই এসব উৎপাতকে নির্মূল করার জন্য নামের ঝঞ্ঝাটকেই আমরা দূর করে দিয়েছি। শুধু সংখ্যা দিয়ে আজকাল পরিচিতি তৈরী হয়।”

“সেকী! তাহলে বিশ্বরূপ বা অজাতশত্রুরা ঝামেলা পাকায়নি?”

“পাকিয়েছিল—কিন্তু ওই পচা, খ্যাঁদারাই যাকে বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কিনা।”

“কিন্তু এক নম্বর বা দু’নম্বর তো তিন বা চারের প্রতি নাক কোঁচকাতে পারে। সেটা কীভাবে আটকালেন?”

“প্রথমে সেটাই হচ্ছিল। কিন্তু নিজস্ব সম্পত্তির বিলুপ্তিকরণের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যা তার গুরুত্ব হারিয়েছে। পরিচিতি ইত্যাদি ছোটখাট কিছু কাজে সংখ্যার ব্যবহার করা হলেও, এক’শ নম্বর আজকাল একলাখকে নীচু নজরে আর দেখে না।”

আচমকা আমার মনে পড়ল, ঘুম থেকে উঠে ইস্তক আমি হেঁটে চলেছি। মুখ ধোয়া বা চান কিছুই করা হয়নি। শরীরটা কেমন করে উঠল।

“একটু ধোয়া মোছার ব্যবস্থা করতে পারেন?”

গাইডমশাই মাথা নাড়লেন, “নাহ—আমরা নিজেদের ধুতে পারি না, মানে নিয়ম নেই। একটু অপেক্ষা করুন। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আপনাকে ধুইয়ে দিয়ে চা দেওয়া হবে।”

“ধুইয়ে দেবে?” আমি যারপরনাই অবাক হলাম। “আমাকে আবার কে ধুইয়ে দেবে? আমি গোরু নাকি মশাই?”

“কেন—রাষ্ট্র ধুইয়ে দেবে।”

গাইড ব্যাপারটা জলবৎ তরলং করে বুঝিয়ে দিলেন। মানুষ নিজেকেই নিজে পরিষ্কার করলে সাম্যের দিক দিয়ে বেবাক অসুবিধে। কেউ দিনে তিন চারবার চান করে, কেউ একবারও না। এতে আবার দুই ধরনের শ্রেণীর জন্ম দেয়। একদল বারবার ধোয়াধুয়ি করে তকতকে পরিষ্কার আর একদল একেবারেই না ধুয়ে হাকুজ নোংরা। এ ওকে দেখতে পারে না। এই সুযোগে পুরোনো শ্রেণীসংগ্রাম মাথাচাড়া দেওয়ার উপক্রম হল। তাই রাষ্ট্র স্থির করল যে ওভাবে হবে না। কেউ নিজেকে নিজে পরিষ্কার করবে না। রাষ্ট্র নিজে তাকে ধুইয়ে দেবে। তাই প্রতিটি নাগরিককে রাষ্ট্র অনুমোদিত আধিকারিক এসে দিনে দু’বার ধুইয়ে দেয়।”

বোঝো! কী আর করা। চুপচাপ হেঁটে যেতে লাগলাম।

রাস্তার দুপাশে কেবল সার দিয়ে ঘেরা বড় বড় ইমারত। একই মাপের, একইরকম দেখতে। কোণের দিকে একটা বড় বিল্ডিঙে লেখা “জাদুঘর”। সেরকমই খেয়াল করে দেখলাম বাকিগুলোতেও একইভাবে লেখা রয়েছে “হাসপাতাল”,“সাংস্কৃতিক মঞ্চ”, “চানের জায়গা”, “জিম”, “বিজ্ঞানকেন্দ্র” “শিল্প-প্রদশর্নী” ইত্যাদি। কিন্তু অবাক কাণ্ড—একটা সাধারণ বাড়িও চোখে পড়ল না।

“কেউ কি শহরে থাকে না?” আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।

গাইড তাচ্ছিল্য করে জবাব দিলেন, “আপনি মশাই বড়ই বোকা বোকা প্রশ্ন করেন। থাকবে না কেন? যাবে কোথায়?”

“আমি সেটাই ভাবছিলাম”—নিজেকে বুদ্ধিমান দেখাতে সচেষ্ট হই। “একটাও বাড়ি চোখে পড়ছে না তো—তাই আরকি।”

“আপনি যেরকম ভাবছেন সেরকম বাড়ি এখন আর নেই। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমরা এখন সমাজতন্ত্রী। একটা সঙ্ঘ বা আগেকার দিনে যেটাকে পার্টি বলত, সেই পার্টির সদস্যদের মতই অনাড়ম্বর জীবনযাপন করি। ওদিকে দেখুন—কী দেখছেন? বিশাল বড় বড় গুদোমঘরগুলো দেখতে পাচ্ছেন না? প্রতিটা গুদোমঘরে দশটা বিশাল ঘর রয়েছে। প্রতিটা ঘরে পাতা আছে এক’শটা বিছানা। ঘরে দরকার মত বাথরুম, খাবার ঘর, সাজঘর রয়েছে। ঠিক সকাল সাতটায় ঘন্টা বাজে আর সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। নিজের বিছানা সাফ করে। সাড়ে সাতটায় প্রাতকৃত্যাদি সেরে ফিটফাট হয়ে আসে। ঠিক আটটায় ডাইনিং হলে প্রাতরাশ দেওয়া হয়। হাতে গড়া রুটি, একটু তরকারি আর গরম দুধ। আমরা এখন সবাই নিরামিষাশী হয়ে গেছি কিনা। আসলে নিরামিষাশীদের ভোট গত পঞ্চাশ বছরে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। এবং গত দশবছর ধরে যত নির্বাচন হচ্ছে, ওদেরই রমরমা।

দুপুর একটায় আবার ঘন্টা বাজে—তখন সবাই জড়ো হয়। তখন দেওয়া হয় মোটা চালের গরম ভাত, ডাল-তরিতরকারী, পনির এবং শেষপাতে টক দই। মাঝে সাঝে অবশ্য কড়াপাকের দুটো সন্দেশ কিংবা ঘুগনীও দেওয়া হয়—তবে সপ্তাহে দুদিনের বেশি নয়। পাঁচটার সময় এককাপ গরম চা—ব্যস। রাত দশটায় বাধ্যতামূলকভাবে সব আলো নিভে যায়।

আমরা এখন সবাই সমান। কর্মচারী থেকে বস, বাবু থেকে মেথর সবাই একই সঙ্গে থাকে। কোনও সমস্যা নেই। শহরের এদিকটায় থাকে পুরুষেরা আর ওদিকটায় মহিলারা।”

“আচ্ছা! তাহলে বিবাহিতরা কোথায় থাকে?”

“বিবাহিত বলে এখানে কেউ নেই। বছর তিরিশ আগেই আমরা এসব বিয়ের ঝামেলা চুকিয়ে দিয়েছি। আমাদের সিস্টেমের সঙ্গে বিয়ে ব্যাপারটা ঠিক খাপ খায় না। ‘ছাপোষা জীবন’ জিনিসটা সমাজতন্ত্রের পরিপন্থী। সংসারী মানুষ তার পরিবারের ব্যাপারে বেশি ভাবে, তাই রাষ্ট্রের প্রতি তার আনুগত্য কমে যায়। মানবসভ্যতার ভবিষ্যত চিন্তার চেয়ে তাদের সন্তানাদির ভবিষ্যত চিন্তায় সে বেশি সময় ব্যয় করে। রক্তের বন্ধন, ভালোবাসার বন্ধন ইত্যাদি ব্যাপারগুলো মানুষকে পরিবার নামক একটা ছোট গোষ্ঠীতে আবদ্ধ করে রাখে। তার বাইরে বৃহত্তর মানবসমাজ তার নজরে পড়ে না। পরিবারে উন্নতি, তার নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে অবস্থিত কেবলমাত্র কয়েকটা মানুষের উন্নতির জন্যই সে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। কিন্তু মানবসভ্যতার উন্নতি, তার সুখ, তার ভবিষ্যতের ওপর তার আকর্ষণ কমে যায়।

আমরা দেখেছি, পুরুষ এবং নারী তার সন্তানের জন্য নিজেদের জীবন, সুখ উৎসর্গ করে। উদয়াস্ত অতিরিক্ত খেটে, দরকারের চেয়ে বেশি উপার্জন করে তাদের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করতে চায়। ভালোবাসায় হাবুডুবু খাওয়া পুরুষটি তার প্রিয়তমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নিজেকে আরও যোগ্য করে গড়ে তুলতে চায়, অন্যের থেকে নিজেকে আলাদা করার জন্য তার মনে উচ্চাশার জন্ম নেয়। সে চায় তাকে অন্যরা দেখুক, চিনুক—আর দশটা মানুষের থেকে তার একটা আলাদা অস্তিত্ব বা পরিচিতি তৈরী হোক। এর ফলে সমাজতন্ত্রের মূলসূত্র প্রতিদিন ব্যাহত হতে থাকে। প্রতিটা বাড়ি হয়ে ওঠে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং পরিবারকেন্দ্রিকতার এক একটা পীঠস্থান।

এভাবেই প্রতিটা ঘরের ভেতর থেকে বন্ধুত্ব এবং স্বাধীনতার কালসাপ বেরিয়ে শুধু যে রাষ্ট্রকে দংশন করে তাই নয়, সাধারণের মনকেও বিষিয়ে তোলে। সাম্যের তত্ত্বে আর প্রয়োগে ফাঁক বাড়তে থাকে। পুরুষ তার ভালোবাসার নারীটিকে পৃথিবীর সব নারী অপেক্ষা সুন্দরী ভাবে। এবং বুক ঠুকে সে কথা প্রচার করে বেড়ায়। যত্নবান স্বামীদেরকে তাদের স্ত্রীয়েরা পৃথিবীর সবথেকে উন্নত এবং সাহসী পুরুষ মনে করে। সব সন্তানেরা যে সমান—মায়েরা সেটা মানতেই চায় না। তাদের কাছে নিজের সন্তানই সবার সেরা। সন্তানেরাও এই ধারণার বশবর্তী হয় যে তাদের বাবা-মায়েরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ।

তাই যেদিক থেকেই দেখা যাক না কেন, পরিবারের ধারণাটা সমাজতন্ত্রের জন্য মোটে সুবিধের নয়। ধরে নিন আপনার একটা সুন্দরী বউ আর দুটো ফুটফুটে ছেলেমেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। ওদিক পাশের বাড়ির রামবাবুর বউ মহা দজ্জাল এবং কুঁদুলে। তদের ছানাপোনাও নেই। এখানে সাম্য কোথায়?

আবার দেখুন, পরিবার থাকলে তাতে সুখ-দুঃখের সহাবস্থান থাকতেই হবে। যেখানে সুখ-দুঃখ থাকে, সেখানে সাম্য থাকবে কীভাবে? একটা দুঃস্থ পরিবারে ছোট খাটে শুয়ে একজন নারী চোখের জলে বিছানা ভাসাচ্ছে, অন্যদিকে সম্পন্ন ঘরের অন্য এক নারী তার ছোট্ট বাচ্চার আদো আদো কথা শুনে, তার অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গী দেখে অদরকারে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। বেচারা সাম্য কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে শুনি?

তাই ভালোবাসা জিনিসটা বড় সাংঘাতিক। ভালোবাসার অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। এই নচ্ছার ভালোবাসার জন্যই এত দুঃখ, কষ্ট, বিরহ, যাতনা, কামনা—সব। মানুষের চিন্তাধারা, তার বিশ্বাস সব টলিয়ে দেয় এই ভালোবাসা। এহেন শত্রুকে দূরে রাখাই শ্রেয়। আপাতত তাই ভালোবাসাকে আমরা বিদায় জানিয়েছি।

তাই এখন বিয়ের ঝঞ্ঝাট নেই। সাংসারিক অশান্তি, দুর্দশা—এসব দূর হয়ে গেছে। বিরহবেদনা, দুঃখ, চোখের জল সব গায়েব। আমরা এখন নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দের মধ্যে বাস করি।”

আমি বললাম, “দারুণ। আপনারা তো অসাধ্যসাধন করেছেন দেখছি। শান্তিই শান্তি। তবে, একটা প্রশ্ন ছিল। নেহাতই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে। বিবাহ নাহলে তো সন্তানাদি আসবে না। তাহলে লোকজন বাড়ে কীভাবে?”

“দূর—এটা আবার একটা সমস্যা নাকি? আপনাদের আমলে গরু মোষ ছাগল মুরগী এসবের জোগান আসত কোথা থেকে শুনি? একইভাবে রাষ্ট্রও মানুষের জোগান দেয়। বৈজ্ঞানিক পরিচর্যায় এবং সংরক্ষণে বাচ্চার জন্ম দেওয়া হয়। জন্মাবার পরেই তাদেরকে মায়েদের থেকে আলাদা করে নিয়ে বিশেষ যত্নে বড় করা হয়। গণ নার্সারী এবং স্কুলে পড়ানো হয় রাষ্ট্রের খরচে। রাষ্ট্র অনুমোদিত ইনস্পেক্টর এসে বাচ্চাদের পরীক্ষা নেন। তিনি ঠিক করে দেন, কোন বাচ্চার কীসে আগ্রহ, বা কোন বাচ্চা কী নিয়ে এগোলে দেশের ও দশের উন্নতি করবে। ঠিক সেইভাবেই বাচ্চাদের ছোট থেকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। কুড়ি বছর বয়সে তাদের ভোটাধিকার জন্মায় এবং তারা নাগরিকত্ব লাভ করে। পুরুষ বা মহিলার ব্যাপারে কোন বাদ-বিচার করা হয় না। সবাইকে সমানাধিকার দেওয়া হয়।”

“কীসের অধিকার?” আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল প্রশ্নটা।

“যাহ বাবা—তাহলে এতক্ষণ কী বললাম আপনাকে?” গাইড বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন—কিছুটা যেন বকেই দিলেন আমাকে।

এরপর চুপচাপ আমরা হেঁটে চললাম আরও খানিকটা। চারপাশে তাকিয়ে কেবল সারিসারি গুদোমঘর ছাড়া আর বেশি কিছু চোখে পড়ল না।

“দোকানপাট কিছু নেই নাকি?”

“নাহ—দোকানের দরকারটাই বা কী? রাষ্ট্র আমাদের খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে, থাকার জায়গা দিচ্ছে, শরীর খারাপ হলে ডাক্তার, হাসপাতালের সুবিধে দিচ্ছে। চান করিয়ে দিচ্ছে, কাপড় পরিয়ে দিচ্ছে—মায় মরে গেলে শ্মশানে পুড়িয়ে অবধি দিচ্ছে। দোকান নিয়ে কী করবে লোকে?”

তাও বটে। ততক্ষণে আমার একটু ক্লান্ত লাগতে শুরু করেছে। কম তো হাঁটা হল না!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা দাদা, এখানে কোথাও একটু ইয়ে পাওয়া যেতে পারে?”

“ইয়ে মানে?” গাইড ভদ্রলোক সন্দেহের চোখে তাকালেন।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “মানে পান করার জন্য, পানীয়।” মদের ব্যাপারটা চেপে গেলাম। কী জানি, কী মনে করবে। রাষ্ট্র কুপিত হতে পারে।

উনি বললেন, “পান করবেন? রাতের খাবারের সঙ্গে একগ্লাস সরবত দেয়, আপনি কি সেটার কথা বলছেন?”

আমি আর কথা বাড়ালাম না! আমি বললেও উনি বুঝতে পারবেন না বোধহয়। অগত্যা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে হল। “হ্যাঁ—আপাতত সেটাই চলবে।”

একটা সুপুরুষ ছেলে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। তাকিয়ে দেখলাম তার একটা হাত নেই। ব্যাপারটা আমার একটু আশ্চর্য লাগল। এই নিয়ে সকাল থেকে হাতবিহীন মানুষজন বেশ কয়েকটা দেখলাম বটে। তাদেরও চেহারাপত্তর বেশ শাঁসেজলে ছিল। আমার মনে প্রশ্নের সোডা আবার বুড়বুড়িয়ে উঠল।

গাইড ভদ্রলোক দেখলাম উত্তর প্রস্তুত করেই রেখেছিলেন।

“যদি কেউ বেশি সুন্দর হয়, বা বেশি বলশালী হয় - সেটা তো সামাজিক সাম্য নয়। হতে পারে না। তাই সেরকম কিছু হলে রাষ্ট্র সেই মানুষের একটা হাত বা পা কেটে নেয়। একটা গড় সৌন্দর্য বা গড় দৈহিক ক্ষমতার ওপরের লোকজনদের জন্য এই নিদান রয়েছে। এতে তাদের উচ্চ বৈশিষ্ট্য সামান্য খাটো হয়ে গিয়ে আবার গড় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাতে সাম্যের ঠাট বজায় থাকে পুরোমাত্রায়। এসবই প্রকৃতির গণ্ডগোল, বুঝলেন কিনা। আমরা এগুলোকে ঠিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এই যা।”

“কিন্তু প্রকৃতিকে অস্বীকার তো করা যায় না—না যায় তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা।” আমি বলে উঠলাম।

তিনি বললেন, “ঠিকই—যদি সেটা সম্ভব হত, তাহলে তো খুবই ভালো হত। তবে আমরাও ভালোই এগোচ্ছি।” শেষ কথাগুলোর মধ্যে প্রকৃতির সৃষ্টিছাড়া ক্রিয়াকলাপের প্রতি কেমন যেন একটা করুণা ঠিকরে বেরোলো তাঁর কন্ঠস্বরে।

“বেশ—এতো গেল বাইরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা। যেগুলো দেখা যায়, সেগুলো বাহ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু একটা অসাধারণ বুদ্ধিমান মানুষকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“অনেকদিন হলো মানুষের অতিরিক্ত বুদ্ধিবৃত্তিটা আমাদের পক্ষে কোনও সমস্যা সৃষ্টি করেনি। যদি আমরা সেরকম দেখি, একটা ছোটখাট অস্ত্রপোচার করে বুদ্ধির লেভেলটা একটু নামিয়ে গড় লেভেলে এনে ফেলি। ব্যস।”

“তবে আমরা সবকিছুই ‘নামিয়ে’ ফেলতে সিদ্ধহস্ত হয়েছি। এই পদ্ধতিতে হয়ত কোনওকিছু বৃদ্ধি করাটা সম্ভব নয়।” গাইড ভদ্রলোক কিছুটা যেন স্বগোতক্তি করলেন।

আমি বললাম, “আপনার কি মনে হয় না এভাবে হাত-পা কেটে আপনারা অবিচার করছেন মানুষগুলোর ওপর?”

“মোটেই না—একেবারেই না।” গাইড ঘটঘট করে মাথা নাড়লেন।

“আপনি এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?” আমি কিছুটা বিরক্তই হলাম।

“কারণ এই সিদ্ধান্তটা সংখ্যাগরিষ্ঠের।”

“শুধু কি সেজন্যই এগুলো মান্যতা পেয়ে যায়?”

“সংখ্যাগরিষ্ঠরা কখনও ভুল করতে পারে না।” তিনি উত্তর দিলেন।

“বটে! তো যাদের হাত পা কেটে দিচ্ছেন, তারা এগুলো মেনে নেয় এটা ভেবে যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা কোনও ভুল করতে পারে না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

উনি খুবই আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকালেন। “ওরা? ওরা সংখ্যালঘু। ওদের আবার মেনে নেওয়া বা না নেওয়া কী?”

“তার মানে? সংখ্যালঘু বলে তাদের নিজেদের হাত-পা অটুট রাখার অধিকার নেই?”

“সংখ্যালঘুদের কিছুরই অধিকার নেই।”

আমি বললাম, “তাহলে ব্যাপারটা এরকমই দাঁড়াচ্ছে—যদি বাঁচতে চাও, সংখ্যাগুরুর দলে ভিড়ে যাও। তাই তো?”

গাইড ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, “অনেকটা সেরকমই। আর সেটা করাই অধিকাংশ মানুষ সুবিধেজনক বলে মনে করেন।”

শহরে আমার আর মন বসছিল না। কেমন যেন কৃত্রিম, যান্ত্রিক ব্যাপার স্যাপার। একটু শহরের বাইরে যেতে ইচ্ছে করছিল—সবুজের মধ্যে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে। গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, সেরকম কোথাও যাওয়া যাবে কিনা।

গাইড বললেন বটে “নিশ্চই” কিন্তু গলা শুনে মনে হলো না এ বিষয়ে এখনই কিছু করার আগ্রহ তাঁর রয়েছে বলে।

“গড়ের মাঠে যাওয়া যাবে? একটু হাওয়া খেতাম। সবুজ মাঠ। চারপাশে গাছের সারি। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওখানে প্রচুরবার গেছি। মন খারাপ লাগলেই চলে যেতুম। নরম ঘাসে বসে থাকতুম পা ডুবিয়ে। চলুন না।” আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম।

গাইড একটু গলা খাঁকরে বললেন, “ব্যাপারটা সেরকম আর নেই। গড়ের মাঠ এখন রাস্তা। যেগুলো একটা সঙ্গে একটা সমকোণে অবস্থান করছে। ওসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-টর্যকে আমরা হটিয়ে দিয়েছি। জিনিসটা সাম্যের ধারণার সঙ্গে যায় না। কেউ প্রকৃতির কোলে বসে আনন্দ পাবে, অন্যজন বস্তিতে পচবে। একজন এক মাঠ সোনালী ধানের ওপর দিয়ে হাওয়ার দোলা উপভোগ করবে, আর একজন রুক্ষ জমিতে লাল কাঁকড় দেখে কাটাবে! এতে কী করে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় বলতে পারেন?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা মানুষ নিশ্চই এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য বা এক দেশ থেকে অন্য দেশ ইচ্ছেমত ঘুরতে যেতে পারে। তাই না?”

“হ্যাঁ তা যেতে পারে।” গাইড বললেন। “তবে কিনা গিয়ে লাভ কিছু নেই। সব দেশই এখন একই রকম। রাস্তা ঘাট, বাড়ি, প্রকৃতি, মানুষ এবং নিয়ম—সব জায়গায় এক।”

“কী মুশকিল। আপনাদের কি কোনও আমোদ আহ্লাদ নেই? বিনোদন বলে বস্তু নেই? সিনেমা থিয়েটার হয় না?” আমি আকুলভাবে জিজ্ঞেস করলাম।

গাইড মাথা নেড়ে বললেন, “না ওসব আর হয় না। নাটক বা রঙ্গমঞ্চের মেজাজখানা সাম্যের ধারণাকে ঠিক আত্তীকরণ করতে পারে না। সব অভিনেতাই মনে করে তার চেয়ে ভালো অভিনেতা আর কেউ নেই। মুশকিলটা হল, একদল বাইরের লোকও সেরকমই মনে করে। আপনাদের সময়েও কি এমনই ছিল?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ—এরকমই। তবে আমরা এসবগুলোকে পাত্তা দিতাম না বিশেষ।”

গাইড দাঁতের ফাঁকে হেসে বললেন, “হেঁ হেঁ—আমরা দিই। আমাদের ‘রঙ্গ-ভঙ্গ’ নামে যে সংস্কৃতির ওপর নজরদারী দল রয়েছে, তারা অনেক আলোচনা করে নিদান দেয় যে এসব নাটক-ফাটক, সিনেমা ইত্যাদি অত্যন্ত খারাপ এবং সমাজের পক্ষে হানিকারক। ওদের দলে সব শক্তপোক্ত গরম-রক্ত ছেলেছোকরা রয়েছে। তাই ওরা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটও পেয়েছে ভালোরকম। তারপর থেকেই এখানে নাটক, সিনেমা, থিয়েটার সব উঠে গেছে।”

আমি হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা বেশ। তাহলে কি বই পড়াও নিষেধ নাকি?”

“তা নয়—কিন্তু বই বিশেষ লেখা হয় না যে। এখন মানুষের জীবনে প্রেম নেই, বিরহ নেই, দ্বন্দ্ব নেই, স্বার্থের সংঘাত নেই, বিত্তের অসম বন্টন নেই, ধনী দরিদ্র ভেদাভেদ নেই, দুঃখ বেদনা, কামনা, তাড়না এসব কিছুই নেই। এমন একটা নিঁখুত নিস্তরঙ্গ সমাজে কে লিখবে আর কী নিয়েই বা লিখবে? তবে মানব সমাজের ভবিষ্যত নিয়ে লেখালেখি করা যেতেই পারে।”

“ওহ—কিন্তু যেসব বই আগে লেখা হয়ে গেছে, মানে সব কালজয়ী বইগুলো? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল-শরদিন্দু, বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র… আপনারা সেগুলো নিয়ে করেছেনটা কী?” আমি কঁকিয়ে উঠলাম প্রায়।

“ওসব জ্বালিয়ে দিয়েছি আমরা। ফালতু বই। ওগুলোতে ভুলভাল একগাদা ধারণা দেওয়া ছিল। তাছাড়া মানুষ যখন ভাগ্যের হাতে পরাধীন ছিল, দাসত্বের শৃঙ্খলে, রিপুর তাড়নায় আবদ্ধ নিপীড়িত ছিল, ওগুলো তখনকার বই। এখন ওগুলোর কোনও মূল্য নেই।”

গাইডের কথা থেকে জানতে পারলাম পুরাকালের সমস্ত শিল্প, স্থাপত্যকে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশই পূর্বোল্লিখিত কারণবশত আর বাকীগুলো রঙ্গ-ভঙ্গের লোকেদের পছন্দ হয়নি, ওগুলোকে সাম্য বিরোধী মনে করেছে তারা। আপাতত ওরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কোনও নতুন শিল্প, কলা বা স্থাপত্য এখন সৃষ্টি হয় না। ওসব রাষ্ট্রদ্রোহিতা। শিল্প মানুষকে ভাবতে শেখায়। আর ভাবনা চিন্তা করা মানুষ সাধারণভাবে বাঁচতে চায় না। একটা সুবিধে অবিশ্যি আছে। অধিকাংশ মানুষই চিন্তা বা গভীর ভাবনায় অপারগ। তাই তাদের ভোটেই ‘রঙ্গ-ভঙ্গ’ এর রমরমা।

একই কারণে এখন কোনও খেলাধূলা বা কোনও কম্পিটিশনও হয় না। কারণ প্রতিযোগিতা পার্থক্য তৈরী করে, আর তাতে সাম্য বিঘ্নিত হয়।”

আমি বললাম, “একজন মানুষ দিনে কতক্ষণ কাজ করে?”

“মাত্র তিনঘণ্টা। বাকি সময়টা পুরো আমাদের নিজেদের।” উনি জানালেন।

“এই তো। দারুণ—এবার বলুন এই বাকি একুশ ঘন্টায় আপনারা করেন কী?” আমি উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“বিশ্রাম করি।”

“কী? একুশ ঘন্টা ধরে বিশ্রাম নেন?”

“মানে—বিশ্রাম নিই, চিন্তা করি—গল্প করি।”

“কী চিন্তা করেন? কী নিয়ে গল্প করেন?”

“এই যেমন—কী দুর্দশাগ্রস্থ জীবন ছিল আমাদের। আর এখন কী অসাধারণ নিশ্চিন্ত জীবন কাটাচ্ছি আমরা! আর হ্যাঁ—মানব সভ্যতার ভবিষ্যত নিয়েও আলোচনা করি।”

“আবার মানবসভ্যতার ভবিষ্যত?” আমি হাঁপিয়ে উঠি। “ওই এক জিনিস নিয়ে কথা বলতে আপনাদের ক্লান্তি আসে না?”

“নাহ—মোটেই না।”

“বেশ—তাহলে বলুন দিকিনি আমাদের ভবিষ্যতটা ঠিক কী?”

“মানে এভাবেই দিন যাবে। আরও অনেক অনেক সাম্য আসবে। মানুষের ভেদাভেদ আরও দূর হবে—একটার জায়গায় দুটো করে ভোটাধিকার পাওয়া যাবে…”

“বুঝেছি বুঝেছি। আর বলতে হবে না। আচ্ছা, এসব ছাড়া আর কি কিছু নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেন না? যেমন ধরুন ধর্ম?”

“কীরকম?”

“আপনাদের কোনও ধর্ম আছে?”

“নিশ্চই!”

“ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন আপনারা?”

“একশবার।”

“কী নাম সেই ঈশ্বরের?”

“সংখ্যাগরিষ্ঠ।”

“আর একটাই প্রশ্ন করব। এই যে এতক্ষণ ধরে আপনার মাথা খাচ্ছি, মানে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলছি, তাতে আপনি কি কিছু মনে করলেন?” আমি বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলাম।

“একদমই না। আরে এটা তো আমার তিনঘণ্টা কাজের মধ্যেই পড়ে।”

“বাঃ বেশ বেশ। আপনাকে বিরক্ত করেছি জানলে মরমে মরে যেতাম। আসলে কী জানেন আমার শেষ প্রশ্নটা অন্য। আমি জানতে চাইছিলাম এখানে কেউ আত্মহত্যা করে কিনা?”

“নাহ—এরকম কিছুই এখানে কখনো শোনা যায়নি।”

আমাদের চারপাশ দিয়ে চলে ফিরে বেড়ানো মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালাম। প্রতিটা মুখে কেমন যেন একটা বিষাদময় ভাব। ধৈর্যের মেকি পরতের নীচে একটা ক্লিষ্ট মুখ যেন লুকিয়ে রয়েছে। এমন মুখভঙ্গি খুব চেনা মনে হল আমার। কোথায় যেন দেখেছি।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এরকম শান্ত, ক্লিষ্ট, ভেবলে যাওয়া মুখচ্ছবি আমি বহুবার দেখেছি। দেখেছি আমার সময়কার গরু, ছাগলগুলোর মুখে। যাদের আমরা পুষি, দরকারমত কেটে খাই—আর লালন পালন করি।

কিন্তু এ-কী! চারপাশের লোকগুলোর মুখচ্ছবি আচমকা এরকম ঝাপসা হয়ে আসছে কেন? আমার গাইডই বা গেলেন কোথায়? আর আমি ফুটপাতেই বা গড়াগড়ি খাচ্ছি কেন? আর ওই চিৎকারটাই বা কীসের? আরে ওটাতো আমার বাড়িওয়ালা আশুবাবুর হেঁড়ে গলা। আশুবাবু এখানে এলেন কী করে? তাহলে কি আশুবাবুও আমার মতন এক’শ বছর ঘুমোচ্ছিলেন?

আশুবাবু চিৎকার করে বলছেন, এখন নাকি সবে দুপুর বারোটা বাজে। কিন্তু সাড়ে চারটের আগে তো আমি পরিষ্কার হতে পারব না! কিন্তু আমার শরীরে কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে, গরমও লাগছে খুব। উফফ—একী, আমি বিছানায় শুয়ে আছি কেন?

তাহলে কি এটা পুরোটাই স্বপ্ন ছিল? আমি কি আবার বিংশ শতাব্দীতে ফিরে এসেছি?

জানলার বাইরে শুনতে পারছি চিরকালীন হকারের ডাক। রাস্তা দিয়ে চলাচল করা ট্রাম, বাস, গাড়ির আওয়াজ। মানুষ লড়াই করছে, নিজের শেষ শক্তি দিয়ে উন্নতির চেষ্টা করছে—জীবনে এগিয়ে যাওয়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

তারা হাসছে, খেলছে, কাঁদছে, ভালোবাসছে—মারামারি করছে, বুকে টেনে নিচ্ছে একে অপরকে। দুঃখে উদ্বেল হয়ে উঠছে। সুখে হেসে উঠছে। ভুল করছে, পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। একে অপরকে সাহায্য করছে—এক কথায়, জীবন জীবনের মত চলেছে।

আর আমাকে এখন দিনে তিনঘন্টার বেশিই কাজ করতে হবে অফিসে। যেটা শুরু হবার কথা ছিল সকাল দশটায়। কী মরতে যে কাল এতগুলো চুরুট ফুঁকলাম কে জানে। তাছাড়া সাম্য আর সোমরস—দুটোর মাত্রাটা কাল একটু চড়েই গিয়েছিল!

জেরোম কে জেরোম রচিত “দ্য নিউ ইউটোপিয়া” কাহিনী অবলম্বনে