শ্রেষ্ঠ = সমাপ্তি - রুমেলা দাস

উপন্যাস
এপ্রিল, ২০২০

‘তাহলে কি আর কোনও উপায়ই নেই স্যার? আমাদের... আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা কি এভাবেই...? মানুষগুলো একের পর এক মুড়ি মুড়কির মত পটাপট করে মরে যাচ্ছে। কেউ বাঁচাতে পারছে না। বিদেশের হাল দেখেছেন নিউজ চ্যানেলে? রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। নিজের আত্মীয়রাও ছুঁয়ে দেখছে না। আর সেখানে আমাদের দেশের তো মেডিকেল স্ট্রাকচার-ই জিরো। একবার কমিউনিটি স্প্রেড শুরু হলে থামানো খুব একটা সহজ কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। আর...’

‘শাট আপ। আর একটাও কথা নয়। আর একবার বাজে কথা বলেছ কি তোমার জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে নেব। অনেকক্ষণ ধরে তোমার বালের কথা শুনছি। এই রায় কোনওদিন হারেনি। হারতে শেখেনি। বুঝেছ?’ ডেস্কের ওপর সজোরে হাত চাপড়ে চিৎকার করে ওঠে যুবকটি। নাকের পাটা ওঠানামা করে রাগে, উত্তেজনায়। ঘরের নিস্তব্ধ বাতাসে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে বিষাক্ত সে নিঃশ্বাসের আস্ফালন। দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে মিঃ রায়। একনজর দেখলেই বোঝা যায় যুবকটির নিজের প্রতি আস্থা একশো শতাংশেরও বেশি। পিছিয়ে পড়া স্বপ্নেও ভাবতে পারে না সে। তাঁর টিকালো নাক, চওড়া কপাল, দৃঢ় লম্বাটে চিবুক যে কোনো দাম্ভিক পুরুষেরই পরিচয় বহন করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

‘কী হল আকাটের মত দাঁড়িয়ে রইলে কেন? দাদু খুব বলত, বোকা বন্ধুর চেয়ে চালাক শত্রু ঢের ভাল। তোমরা হলে গিয়ে তাই। নেগেটিভ মাইন্ডেড পুওর মধ্যবিত্ত মেন্টালিটি। এতদিন ধরে পুষছি। মাগনায় নাকি? আজও বুঝতে পারলে না কী করে জিততে হয়? কী করে হারাকে মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হয় নিজের ডেস্টিনেশনে? যা... যা... যা... তোকে আর সহ্য করতে পারছি না আমি। বেরো এক্ষুণি।’

ছেলেটা আর একমুহূর্ত দাঁড়ায় না। মাথা নীচু করে দ্রুত পা চালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

কয়েক সেকেন্ড। রায় সরু চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘খট’ করে বন্ধ হয়ে যায় ভারী বাদামি পাল্লাটা। রিভলভিং চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে সে। অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে খানিক ঘোরাফেরা করে হাত কচলায়। কী মনে হতে ভাল করে দরজার ক্ল্যাচ, সবক’টা ছিটকিনি ভেতর থেকে আটকে দেয়। চাপ চাপ জমাট এসির ঠাণ্ডাতেও তাঁর কপালে ফুটে ওঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

সৌমেন যা বলছে এতটা অগ্রাহ্য করা যায় কি? একি ভাবছে ও? হাঁটুর কাছটা কেঁপে উঠছে কি? শেষ একটা মাস বড্ড অগোছালো সবকিছু। রাতে ঘুম হচ্ছে না ভাল করে। আতঙ্ক এমন একটা জ্বর। একবার ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে ঢুকে পড়লে গোটা সিস্টেমটাকে তছনছ করে দেবে। যেমনটা কোভিড ১৯ অদৃশ্য প্রায় হয়ে শরীরে ঢুকে বন্ধ করে দিচ্ছে হৃদযন্ত্র। না... না... না... দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না কোনোভাবেই।

দরজাটা আরেকবার ভাল করে দেখে নিয়েই রায় ঢুকে যায় পাশের ছোট ঘরে। ছড়ানো ছিটানো টেবিল, চেয়ারে ভর্তি এ ঘরটায় শুধুই কাগজপত্র ফাইলের স্তূপাকার।

পশ্চিমদিকের পর্দাটা কিছুটা সরে থাকায় বিকেলের কমলা আলো কাঁচের জানলা ভেদ করে এসে পড়েছে উল্টোদিকের দেওয়ালে। নিভে আসা দিনের আলো তো রোজই দেখে। কিন্তু আজ কেমন যেন অচেনা লাগছে তেরছা কমলা ফালিটা। কেমন ভয়...ভয়...। সহ্য করতে পারছে না। পর্দাটা টেনে টিউব জ্বালায়। দেওয়াল জুড়ে সারি সারি কাঠের তৈরি ওয়ার্ডরোব। হ্যাঁ এটাই তো ওর দুনিয়া। এটাই তো রায়ের স্বপ্ন। প্রকৃতির মন মর্জি এখানে ঢুকতে দেবে না রায়। তাঁর উচ্চতার সমান সমান একটা বন্ধ খোপের কাছে এসে পকেট থেকে চাবি বার করে। খুব তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরিয়ে লকার খুলে ফেলে হাতের কায়দায়।

একটা গাঢ় নীল রঙের ফাইল। ফাইলটা নেওয়ার পর চাবি ঘুরিয়ে লকার বন্ধ করে আবার ফিরে আসে আগের জায়গায়। আরাম করে চেয়ারে বসে ফাইল খুলে হাতে তুলে নেয় একটা কাটিং খরখরে খবরের কাগজ। চোখ চিকচিক করে ওঠে মিঃ রায়ের। কাগজটা মুখের সামনে ধরে খবরটা আরও একবার মনে মনে পড়ে,

মার্চ ৩১, ২০২০

ইতালির চতুর্থতম উপদ্রুত অঞ্চল পিয়েদমোন্ত। গত রবিবার পর্যন্ত ওই অঞ্চলে ৮ হাজার ২০৬ জন করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। রাজধানী তুরিনে গত শনিবার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬৫৮ জন। তবে তুরিন থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মন্তালদো তোরিনেসে গ্রামের কেউ এখনও করোনা আক্রান্ত হয়নি।

ওই গ্রামে ৭২০ জন বাসিন্দার বাস। জন চলতি ধারণা অনুযায়ী সেখানকার কূপের জল থেকে ফরাসি শাসক নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেনাদল নিউমোনিয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ইদানীং নাকি সেখানে কোন উপদেবতার ঘোরাফেরাও লক্ষ করা যাচ্ছে। ওদের মতে তিনিই ওদের বাঁচাতে এসেছেন।

১৮০০ সালের জুন মাসের কাছাকাছি মারোগো অঞ্চলে একটি যুদ্ধের সময় ওই গ্রামে তাঁবু গেড়েছিলেন নেপোলিয়নের সেনাদল। মারোগোতে অস্ট্রিয়ান সেনাদলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিতেছিলেন নেপোলিয়ন। স্থানীয় মানুষের পূর্বপুরুষেরা বলে ওই সময়েও নাকি সামান্য কিছু সময়ের জন্য এইরকম উপদেবতার আবির্ভাব হয়েছিল।

মন্তালদো তোরিনেসের মেয়র সার্জিও গাইত্তি বলেন, ‘বিশ্বাস করা হয় নেপোলিয়নের জেনারেলরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। আর সৌভাগ্যক্রমে কূপের জল খেয়ে বেঁচে যান। যুদ্ধে জয় লাভ করে। সকলের বিশ্বাস, সারা বিশ্বে যখন মড়ক লেগেছে তখন এই অলৌকিক কূপের মধ্যে বসবাসকারী উপদেবতাই গ্রামের মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি রক্ষাকর্তা। দেবতার অলৌকিক শক্তি হয়ে মানুষকে রক্ষা করে চলেছেন।

মন্তালদো গ্রামে মূলত বয়স্ক মানুষের বাস। তবে বেশ কিছু তরুণ পরিবারও এখানে বাস করে। কাজের জন্য অনেকেই প্রাদেশিক রাজধানী তুরিনে যাতায়াত করে থাকেন। তারপরও গ্রামটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা না যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকে আবার বলেন, এখানকার বিশুদ্ধ বাতাস, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা আর মানুষকে সতর্ক রাখতে তাদের উদ্যোগের ফলেই ভাইরাসটি এখনও সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। কারণ হিসেবে ধরা হয়, আশেপাশের কোথাও কোনও শিল্পকারখানা নেই। এটা মূলত কারিগরদের গ্রাম। মেয়র দাবি করেছেন, ‘শুরু থেকেই আমি মানুষদের নিরাপদ থাকতে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তালিকা করে দিই। নিয়মিত হাত ধোয়া, সরাসরি সংযোগ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিই। এলাকার মধ্যে আমরাই প্রথম সব পরিবারকে মাস্ক বিতরণ করেছি।’

সরকার পক্ষ জনসাধারণের সচেতনতার কথা বললেও গ্রামের কূপই যে গ্রামবাসীর রক্ষাকর্তা, তা হলফ করে বলেছেন সবাই। অনেকে আবার একথাও স্বীকার করেছে, কেবল সংবাদমাধ্যমের কাছে মেয়র নিজের কাজের খতিয়ান দিলেও গ্রামে তাঁর কার্যবিধি শূন্য।

কাগজটা মুড়ে আবার ফাইলে রেখে দেয় রায়।

বিশুদ্ধ বাতাস?

অকৃত্রিম প্রকৃতি? আর...?

আর সুপারস্টিশন... কুসংস্কার। যা আজও বিশ্বের মানুষের চিরকালীন সঙ্গী।

কম্বিনেশনটা ফাটাফাটি।

হ্যাঁ... হ্যাঁ... হ্যাঁ, ঠিক এটাই তো চেয়েছিল সে। জানলা দরজার বাইরের শহরটা সেই সুযোগ করে দিয়েছে আরও একবার। নিপাট শব্দহীন একটা শহর। যেখানে উল্লাস নেই, জয় নেই, কথা নেই, অহংকার নেই, আছে শুধু...। আছে শুধু ভয়...। এই ভয়কেই তুরুপের তাস বানাতে হবে। শুধু নেই নেই বলে যে মানুষগুলো বুক ফাটাচ্ছে, নিজের মুঠো ভরে নিয়ে নিতে হবে সেই বহু সংখ্যক ‘নেই’কে। আর কারুর জন্য নয়। অন্তত কুড়ি দিন আগে যে ফুটফুটে প্রাণটা পৃথিবীর আলো দেখেছে। তাকে তো সব সুখ দিয়ে যেতেই হবে। তাকে কোনোভাবেই বুঝতে দিলে হবে না যে পৃথিবীতে সে এসেছে সেখানে সময় একটা কালো খাদ। আর মানুষ সেই খাদ টপকে টপকে, সময়কে চ্যালেঞ্জ দেখিয়ে দেখিয়ে, কখনও এগোবে, কখনও পড়ে যাবে আরও আরও গভীরে।

কপালে গজিয়ে ওঠা বিলবিলে ঘামগুলো বাঁ-হাতে মুছে রিমোটে চাপ দিয়ে আরও কয়েক দাগ ঠান্ডা বাড়িয়ে দেয় রায়। হাতে তুলে নেয় নিজের অ্যান্ড্রয়েড।

একবার... দু’বার... তিনবার... ফোনটা রিং হতেই ওপার থেকে নীচু স্বরে ভেসে আসে একটা নেভা নেভা গলার আওয়াজ,

‘ইয়েস মিঃ রায়...।’

‘আর ইউ রেডি? দ্য অপরচুনিটি হ্যাস কাম। মাস্ট গো ভেরি সুন।’

‘ইয়েস, অফকোর্স।’

ফোনটা ছাড়ে রায়। কান অবধি চওড়া হয়ে ধরা দেয় একটা হিলহিলে শব্দহীন হাসি। যে হাসির অর্থ কেউ জানে না। জানে শুধু এ ঘরের চার দেওয়াল...।

২০৭০, অক্টোবর

মিশকালো পিচরাস্তা ধরে আরও কিছুটা এগোতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ধ্রুব। দু’পাশে সার সার পাইন, ধুপির মহীরুহ। প্রকৃতি যেন তাক লাগিয়ে দেয় প্রতি মুহূর্তে। আজ চল্লিশ বছর ধরে এপথে হাঁটছে। অথচ রোজই যেন নতুন। রোজই যেন অচেনা। চারধারে একটু একটু করে জেগে উঠছে পাখিরা। সত্যিই কী অবাক লাগে তাই না? এত আশঙ্কা, এত জরা, এত ভয় অথচ নির্বিকার এ প্রকৃতি যেন নীল আকাশের বুকে ছবি আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার সাজানো সংসার। ‘রিসেপ’! ধ্রুব-র পৃথিবী। চোখ চলে যায় দূরে মাথার ওপরে সবুজমেশা জঙ্গলটার দিকে। বাবার মুখে শুনেছিল ওখানে নাকি ৫০-৬০ বছর আগে ‘সিঞ্চল ওয়াইল্ড লাইফ স্যানচুয়ারি’ ছিল। তারপর আস্তে আস্তে সব পাল্টে যায়। মানুষ আর ঘরের বাইরে বিশেষ পা বাড়াতে সাহস পায়নি। পদে পদে মৃত্যু ভয়ের আশঙ্কা গ্রাস করেছে যে। মনে মনে হাসে ধ্রুব। তবে কয়েনের উল্টোপিঠের মানুষগুলোও আছে; যাঁরা লোভের হিসেবে ওসব ভয়, আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নিজেদের ভিত শক্ত করতে চেয়ে এসেছে বরাবর।

একদিক থেকে ধ্রুব-র বাবার এখানে এই নেপালিদের গ্রামে আসার সিদ্ধান্তটা নেহাৎ খারাপ হয়নি। অন্তত ধ্রুব-র তো তাই মনে হয়। ওর জন্মের সময় নাকি এ গ্রামের নাম ছিল ‘সিকসিন গ্রাম’। শুনেছে, এই এলাকায় সিঞ্চনার বৃক্ষরোপণ শুরু হয়েছিল, গাছগুলো বিভিন্ন বিভাগ বা সেকশনে বিভক্ত করা হয়েছিল, গ্রামবাসীরা ‘বিভাগ’ শব্দের সঙ্গে কথোপকথন না করে এটাকে ‘সিকসিন’ হিসাবে উচ্চারণ করতে শুরু করেছিল। আর সেই থেকেই ‘সিকসিন’।

অন্ধকার সরে মাথার ওপরে একটু একটু করে ছেয়ে যাচ্ছে হলদে আলোর চাদর। সাতটা বেজে গেছে; ব্রেকফাস্টের সময় হল। আর দেরি করা যাবে না। পা চালাতেই চোরা ছুরির মত হাওয়াটা ধ্রুব-র নাক কান রক্তহীন করে বেরিয়ে গেল যেন। এ সময়টা এমনই। সিকসিনে বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে আমেজি শীত উঁকি মারে। মাথার ঘোমটা টুপিটা কিছুটা এগিয়ে নেয় ও। ঠান্ডা ওর তেমন একটা লাগে না। বরং বাকিরা যখন এই সিজনাল হাওয়াটাকে এড়িয়ে যেতে চায়। ও মুখ খুলে এই টাটকা হাওয়াটা খেতেই এতগুলো বছর সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়ে।

আচমকা খানিক দূর থেকে একটা অস্থির গুনগুন কানে আসে। কেউ কথা বলছে? শুধু একজনের গলার আওয়াজ বলে মনে হচ্ছে না তো?

হ্যাঁ... চোখ চলে যায় এমন দূরত্বে একটা জটলা।

ধ্রুব-র ভুরু দুটো সামনের দিকে এগিয়ে আসে।

কিছু হয়েছে?

‘কী হয়েছে সিমন কাকা? কীসের আলোচনা চলছে?’ পা চালিয়ে জটলার কাছে দাঁড়ায় ধ্রুব।

‘খুব চিন্তায় আছি বাবা। নতুন দানব এসেছে। মরব মরব করে জন্ম থেকে সত্যি সত্যি যে ভয় পাচ্ছি। আর বাঁচনের উপায় নেই।’ নেপালি ভাষায় টেনে টেনে বছর সত্তরের বৃদ্ধ ভদ্রলোক মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে যা বলল, তার বাংলা করলে এই দাঁড়ায়।

‘নতুন দানব? বলো কী?’ অবাক হয় ধ্রুব।

‘হ্যাঁ তাহলে আর বলছি কী? এই তো সুষমা থাপা দাঁড়িয়ে আছে বলুক না ওই বলুক।’

‘হ্যাঁ ধ্রুব বাবা। জানোই তো আমার আর সিমন কাকার ভেড়াদুটো পরশু থেকে কোথায় যে পালিয়েছে খুঁজেই পাচ্ছি না। মনটা আনচান করে চলেছে সেদিন থেকেই। জানি পশুরে বাঁধা যায় না। ছোট্ট থেকে হাতে করে বড় করেছি। তাও ঠিক হারিয়ে যাওয়ার আগে থেকেই খুব অস্থির করতে শুরু করেছিল। পরশু সকালে উঠে দেখি, দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে। কত ডাকলাম নাম ধরে। পেলামই না। তারপর ঠিক কাল রাতে মাঝে মাঝেই ঘুম থেকে চমকে চমকে উঠেছি, আর আমার বাচ্চাটার ডাক শুনতে পেয়েছি। চোখ জ্বালা করেছে। অপেক্ষায় থেকেছি কখন আসবে আমার বাচ্চা। ভোরের দিকে চোখটা বুজে এসেছিল। আচমকা চোখ খুলে যায় আমার বাচ্চার আওয়াজে। ডাক শুনে অার স্থির থাকতে পারি না, দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসি, দেখি ঠিক আমার ঘরের সামনে আমার বাচ্চার গলার আওয়াজ হচ্ছে। কিন্তু... কিন্তু ও আমার... আমার বাচ্চা নয়। যে ডাকছিল সে চারপেয়ে নয়, দুপেয়ে। কিন্তু ভগবানের দোহাই বলছি, ডাকটা হুবহু আমার বাচ্চার-ই ছিল।’ সুষমা থাপা একনাগাড়ে কথাক’টা বলে হাঁফাতে থাকে।

‘নির্ঘাৎ তোমার সঙ্গে কেউ ইয়ার্কি করেছে?’ ধ্রুব সন্দেহের গলায় বলে ওঠে।

‘না ধ্রুব বাবা। সুষমার কথা ভুল নয়। আর তুমি যেটা বলছ সেটা আংশিকভাবে আমিও ভাবতাম যদি না ওই একই ডাক, একই জন্তুকে আমি নিজের চোখের সামনে না দেখতাম।’

‘কী বলছ?’

অবাক লাগছে। ভীষণ অবাক লাগছে ধ্রুব-র। জ্ঞান হওয়া থেকে দেখে এসেছে, বুঝে এসেছে ‘রিসেপ’ নিরূপদ্রব নিরীহ একটা গ্রাম। আর পাঁচটা শহুরে আদব কায়দা এখানে নেই। নেই ঈর্ষা, রেষারেষি, এগিয়ে যাওয়ার তাড়া। যে পাঁচ-দশটা নেপালি ঘর রয়েছে, তারা দুনিয়াদারি থেকে সহস্র গুণ দূরে। এককালে এদেরই পূর্বপুরুষ এখানে বহাল তবিয়তে ছিল। কিন্তু অর্থলোভে আর এগিয়ে যাওয়ার তাড়ায় নব্বই শতাংশের বেশি ঘর চলে গেছে এখান থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে, প্রযুক্তির কাছাকাছি। নিতান্তই খুঁটি আঁকড়ে যাঁরা রয়ে গেছে, ধ্রুব মনে করে তাঁরা ওর মতই এ পৃথিবীর জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা কিছু অন্য ধাতুর শরীর।

তাহলে?

মাথাটা কেমন গুলিয়ে যায়। জটলা থেকে নানান প্রশ্ন, নানান কৌতূহল কানে আসছিল ওর। এমনটা তো হবার কথা নয়। এত বছরে এরকম কোনও গুজব আগে শুনেছে বলে তো মনে হচ্ছে না।

মানুষে মানুষে মেশামিশি আজকাল বড় কমে গেছে। পঞ্চাশ ষাট বছর আগে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ‘একা’ থাকার যে খেলাটা মানুষ শুরু করেছিল, প্রকৃতি যেন তাতে সঙ্গত দিয়েছিল। ধ্রুব-র জন্মটা ছিল তেমনই এক ঝড়ের বছর। ২০২০ সাল। কোভিড ১৯-এ ছারখার হয়ে গেছিল গোটা বিশ্ব। রোগটা ছোঁয়াচে ছিল। মানুষে মানুষে যেটুকু সাহচর্য ছিল, সেটুকুও বন্ধ হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে এসেছে কোভিড-২৯, কোভিড-৩৯। আরও কতগুলো অজানা রোগ ল্যাবের গোপন কক্ষে পরীক্ষাধীন। বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে রয়ে গেছে শুধু এক বিষ সন্দেহ।

চিরচিরে হাওয়াটা ধ্রুবকে ঘিরে এগোতে থাকে ওর সঙ্গেই। শরীরে, মনে বড় অস্বস্তি হচ্ছে। রিমার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। একটা মেসেজ তো লিখে রাখাই যায়।

বাইরের ধরাচুড়ো ছেড়ে ঘরোয়া পোশাকে এক মাগ কফি নিয়ে নিজের ফটোনিক্স কম্পিউটার অন করে ধ্রুব। স্ক্রিনে ফুটে ওঠে মা বাবার ঝকঝকে একটা ছবি। ওর জন্মের আগের। জানলা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে রোদ ঢুকছে। ধ্রুব টেবিলটা এগিয়ে নিয়ে যায় তেজিয়াল রোদের মুখোমুখি। যন্ত্র থেকে ধ্রুব শত হস্ত দূরে। সম্বল বলতে এই একটাই। ছেলেপুলের মা-বাপ হয়ে গেলেও বন্ধু-বান্ধবরা হাসাহাসি করত সঙ্গে একটা ফোন পর্যন্ত নেই বলে। মানুষ এখনও বোঝে কম, দেখায় বেশি। ২০৪০-৪১ সাল থেকে ফোনের বিপুল পরিমাণ ব্যবহারের ফলে বিশ্বে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। এপিলেপ্সি, অ্যাজমায় ভুগেছিল আরও বেশি। এসেছিল কোভিড-২৯ এর মত আরেক সংক্রামক ব্যাধি। যার একমাত্র কারণ ছিল টয়লেট সিটের তুলনায় ১০গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া জমে থাকা ফোন। শুধু কি তাই? ‘মায়োপিয়া’, ‘স্লিপ ডিসঅর্ডার’, ‘আর্থ্রাইটিস’, ‘এপিজেনেটিক্স’ সবকিছুর খলনায়ক ফোনের হাই ফ্রিকোয়েন্সি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন। কিন্তু সচেতনতা কোথায়? কলেজ পাশ করার আগে আগেই ধ্রুব ভেবেছিল একটা কিছু ঠিক করবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অলৌকিক দক্ষতার পরিসর যে সীমিত নয় সেটা বুঝেছিল নিজে। সমস্ত বিপক্ষ মতকে একপাশে সরিয়ে রেখে প্রমাণ করেছে সুপার কন্ডাকটিং পদার্থ দিয়ে তৈরি এই কম্পিউটার প্রথম প্রথম অতিশীতল (প্রায় শূন্য কেলভিন) উষ্ণতায় চললেও এখন সব পরিবেশে চলে। রিমা অনেকবার ধ্রুবকে বলেছে সবার সামনে আসতে। ‘রিসেপ’ ছেড়ে দিতে। ও রাজি হয়নি। দরকার কী? এই তো বেশ আছে। বাবা মা যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন বুঝিয়েছিলেন এই পৃথিবীতে নিজেকে যুঝতে গেলে নিজেকেই আগে বাঁচাতে হবে। আর তার জন্য...

‘টুং’ করে একটা শব্দ।

রিমার মেসেজ। ডেট দেখাচ্ছে এক মাস আগের।

খামের চিহ্নটা খুলতেই লেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে,

জানিস ধ্রুব শরীরটা আমার একদম ভাল যাচ্ছে না। সারাদিন ধরে এত ঘাম হচ্ছে। কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না। প্রথমে ভাবলাম বাবার হাই প্রেশারটা হয়ত আমারও। চেকআপ করালাম। তেমন করে কিছু ধরাও পড়ল না। কিছুই ভাল্লাগছে না। ঋকও দুশ্চিন্তায় আছে খুব। ভাবলাম তোকে একটা মেসেজ করে রাখি। অন্য কোনওভাবে তো তোর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও উপায়ই রাখিসনি। পারলে রিপ্লাই করিস।’

‘অন্য কোনওভাবে তো তোর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও উপায়ই রাখিসনি’— এই শেষ কথাটাতেই আজও মন পড়া যায় রিমার। বড্ড অভিমানী। এখনও বড্ড সেনসিটিভ। কিন্তু ওর হঠাৎ এমন একটা অসুস্থতা?

সকাল শুরু হলেই নাকি বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে।

শুরুতেই সুষমা থাপা, সিমন কাকা আর এখন রিমা?

শিরশিরে হাওয়াটা রোদ ঢেকে দিয়েছে। জানলার তেজি রোদটা অভিমানী বাচ্চার মত মুখ লুকিয়েছে কালো মেঘে। ঠান্ডা হাওয়াটার শক্তি বাড়ছে।

বৃষ্টি নামবে কি?

২০১৮, জুন

গোটা হল ভরে গেছে মানুষের কালো মাথায়। তিলধারণের আর বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। মিডিয়া, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, শহরের কেউই হয়ত বাদ নেই। খানিক আগে তো হলের বাইরে সাংবাদিকদের মধ্যে সামান্য হাতাহাতিও হয়ে গেছে। বাকিরা ক্যামেরা তাক করে এতক্ষণে সেসবের মজাদার কয়েকটা ছবি অনলাইন পোর্টালে আপলোডও করে দিয়েছে। ‘ডাক্তার ম্যাথু’র কাছাকাছি যাওয়া এই মুহূর্তে নিরাপদ নয়। তাই নিজের সোর্স খাটিয়ে ঠিক কোনাকুনি একটা সিট বেছে নিল যুবকটি। গুছিয়ে বসে চারপাশটা দেখে নিয়ে পকেট থেকে বার করল ছোট্ট রেকর্ডার-টা। ম্যাথুর কথাগুলো শোনার জন্য এগুলোর খুব প্রয়োজন। এই মুহূর্তে চারিদিকে পৃথিবীর সমস্ত হুল্লোড় জমায়েত হলেও ডাক্তার এলে হয়ত সবটা থেমে যাবে। আবার উল্টোটাও তো হতে পারে। কে বলতে পারে ডাক্তারের কথায় মারাত্মক খেপে উঠল জনতা। তবে যাইহোক বিষয়টা যে আগামীকালের কাগজের হেডলাইন হবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পরিস্থিতি যেদিকেই যাক না কেন, নিজের সিদ্ধান্তে অটল অনড় থাকতে হবে।

মঞ্চের দিকে চোখ পড়তেই বুঝতে পারা যায়, চিকিৎসকের একটা জন পাঁচ-ছয়ের একটা টিম নিজেদের মধ্যে গম্ভীর কিছু একটা আলোচনায় ব্যস্ত। আর ডায়াসের ঠিক সামনের দিকে ঘেরা জায়গাটায় একজন সুট-টাই পরিহিত যুবক মাইক হাতে হলের মধ্যের মানুষগুলোকে শান্ত থাকতে অনুরোধ করছে। কিন্তু মানুষের সেদিকে খেয়ালই নেই। সবার চোখ ডাক্তার ম্যাথুর অপেক্ষায়। মিনিট বিশ-পঁচিশ কাটবার পরেই উপস্থিত সকলের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। গালাগালি যখন আরও উপদ্রবে পৌঁছতে যাচ্ছে ঠিক তখনই মঞ্চে এসে দাঁড়ান ডাক্তার ম্যাথু। খবরে যেটুকু আগে পড়েছিল তাতে ডাক্তারবাবু মধ্যবয়সী হলেও অভিজ্ঞতায় খানিকটা বুড়োটে দেখাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে লক্ষণীয় তাঁর দৃঢ়চেতা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হাসি। আর ওই দীপ্তিপূর্ণ চাহনি। একটু পাগলাটেও কি? নাহলে মঞ্চে পাতা আসনের দিকে না গিয়ে সরাসরি মাইকের সামনে দাঁড়ানো ছেলেটাকে সরতে নির্দেশ দিলেন। সিটি, হাততালি আর ক্যামেরার ঝলকানিতে মেতে উঠেছে গোটা হল। যুবক আঙুলের চাপে অন করে তার রেকর্ডার।

ডাক্তার ম্যাথু বলতে শুরু করলেন,

‘নমস্কার দেশবাসী। নমস্কার আমার সমস্ত শুভাকাঙ্খীকে। আমার শত্রুকেও। আজ হয়ত আপনারা আমার কথাগুলো শুনতে এসেছেন। কাগজের বন্ধুরা নোট নিতে এসেছেন। তবে আজ আমি আমার কথার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন এমন মানুষের সঙ্গে পরিচয় করাব যার কথা হয়ত আপনারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। শুধু আপনারা বললেও ভুল হবে। আমিই কোনোদিন স্বপ্নে ভাবতে পারিনি আমার এই যুগান্তকারী ভাবনায় এমন একজন মানুষকে পাশে পাব। আমি যুক্তরাজ্যের ম্যাথু, এনএইচএস ট্রাস্টচালিত হাল ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালের সাবেক নিউরোসার্জন কাইলি ম্যাথু, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। গত ১০ বছরের আমার এই সাধনায় বারবার বাধা এসেছে। বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ মনে করেন, এটি বাস্তবে সম্ভব নয়। এমনকি জোরের সঙ্গে বলতে পারি ইউরোপ বা আমেরিকার কোনও দেশের সরকারই আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ করে দেয়নি। নৈতিক কারণেই নাকি এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমি তার জন্য তাঁদের দোষ দেখি না। হয়ত তাঁরা ভয় পেয়েছেন। কিন্তু সমস্ত ভয়কে, সমস্ত বাধাকে নিজের গোপন কুঠুরিতে রেখে যিনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, তিনি হলেন ৩১ বছর বয়সী স্পিরিদোনভ।’

ম্যাথু আঙুল নির্দেশ করেন তাঁর ঠিক সামনের দিকে। গোটা হল অবাক হয়ে দেখে ডাক্তারের কাছে গড়িয়ে এসে দাঁড়িয়েছে একটা হুইল চেয়ার। চেয়ারের মধ্যে ঝুঁকে রয়েছে একটা নেতানো শরীর।

কে এই যুবক?

এই আপাত প্রতিবন্ধী যুবকের সঙ্গে ডাক্তার ম্যাথুর সম্পর্কই বা কী?

ম্যাথু আবার বলতে শুরু করেন,

‘জানেন এই মানুষটা ছোট থেকে কী শুনে এসেছে? শুনেছে, ‘এ মানুষ বাঁচে না। বাঁচবেও না। আজ নাহয় কাল আয়ু ফুরোবেই স্পিরিদোনভের।’ কিন্তু আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানই আবার ওর বাঁচা সম্ভব করবে, যদি একটু সাহস করতে পারে। আপনারা হয়ত এক্ষুণি জিজ্ঞেস করবেন আমায়, আমি ঠিক কী করতে চলেছি? তাতে সাফল্য আদৌ আসবে কিনা? আমি বলি, ‘সাফল্যের সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ!’

আচমকা ডাক্তারের কথার মাঝেই মঞ্চের কাছাকাছি প্রথম সারিতে বসা এক সাংবাদিক হাত তোলেন; ডাক্তার ম্যাথু যে বড়সড় একটা রিস্ক নিতে চলেছেন তাতো স্পষ্ট। জানা কথা এরপর একে একে ধেয়ে আসবে প্রশ্ন।

একটু আগে অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে যে ছেলেটা ছিল। সে নিচু স্বরে কিছু বলায় হাত তুলে থাকা একজন অল্পবয়সী মহিলা সাংবাদিক বলেন,

‘আচ্ছা তাহলে আপনার এই গবেষণায় রিস্ক ফ্যাক্টর একেবারেই নেই বলছেন। শুনছিলাম ঘন ঘন হুমকি আসছে টেলিফোনে। যদি কোনও একটা ফল্ট হয় আপনি গোটা ব্যাপারটা সামলাবেন কী করে?’

‘শুনেছিলাম আপনার আগের পদক্ষেপে সরকার থেকে নাকি অনুমতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল? এরপরের পদক্ষেপে আপনি সাহস পাচ্ছেন কী করে? আপনাকে দেশ থেকে বিতারণের কথাও তো শোনা যাচ্ছে। এত কিছুর পরেও আপনি এগোবেন!’ আরেকজন পত্রকার উঠে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ওদেরই সঙ্গে আসা ছেলেমেয়েগুলো এক এক করে দাঁড়িয়ে নানা উত্তেজনামূলক কথাবার্তা ছুঁড়ে দিতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি মিনিটের মধ্যে এমন ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায় যে হলের মধ্যে কোনও সভ্য মানুষের সভা বা সম্মেলন জাতীয় কিছু হচ্ছে বোঝা যাচ্ছিল না। একটা তুমুল অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। লোকজনের ভিড়ভাট্টা তাদের পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য সরিয়ে কোনও এক ফাঁকে যদি মঞ্চের দিকে চোখ চলে যায় তাহলে দেখা যাবে, ডঃ ম্যাথু যারপরনাই চেষ্টা করে কীসব বুঝিয়ে চলেছেন মানুষগুলোকে। যেন তাঁর এতদিনকার গবেষণায় যতকিছু বিপত্তি সেটুকু বোঝানোর জন্যই এই জমায়েতের সিদ্ধান্ত। যদিও দর্শকের আসনে বসে থাকা যুবকটির মনে হয় ডাক্তারবাবু নেহাৎ-ই বোকা। এধরণের জমায়েত করে ম্যাথু নিজের নিরাপত্তা বা নিজের ইমেজটাকেই খেলো করলেন। ভাবতে ভাবতেই ঘটনাটা ঘটে গেল যেন সেকেন্ডের পলকে। চোখের সামনে জনা পঞ্চাশেক লোক যে হাতের সামনে যা পাচ্ছে ছুঁড়তে থাকে ম্যাথুকে লক্ষ করে। ম্যাথু তখনও কথা বলতে চাইছিলেন। মঞ্চে থাকা মানুষগুলো দৌড়ে গিয়ে আড়াল করেন ডাক্তারবাবুকে। আর হুইল চেয়ারের ওপর সেই নেতিয়ে পড়া শরীরটাকেও।

ম্যাথুর প্রচেষ্টায় যে আরও একবার যবনিকা পড়ল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই নিয়ে সবমিলিয়ে দশ-বারো বার। ম্যাথুর এ পাগলামো কোনও দেশবাসী সহ্য করতে পারে না। সাধারণ লোক, মানুষটাকে স্রেফ খুনে ছাড়া আর কিছু মনে করে না।

নিজের ভেবে রাখা সূত্রগুলোকে মিলিয়ে নেয় যুবক। এক্সিট ডোর দিয়ে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। সত্যি কি পারবে? মনের মধ্যে ভাবনাগুলো গোল গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। উল্টোদিকের ফুটপাথে দাঁড়ালেও হলের লোকের উত্তেজনা বাইরে থেকেও ভালোরকম টের পাচ্ছে। দুটো পুলিশের গাড়ি জোরে হর্ন দিতে দিতে এর মধ্যেই এসে গেছে।

আর ঠিক তখনই চোখে পড়ে হলের পিছনের দিক দিয়ে তিরবেগে বেরিয়ে যায় একটা সাদা চারচাকা। অসম্ভব দ্রুততার মাঝেও গাড়ির পিছনের বোনেটের সঙ্গে বাঁধা হুইলচেয়ারটা দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না গাড়িটা ম্যাথুর। আর প্রতিবন্ধী ছেলেটা ওঁর গাড়িতেই আছে।

তাহলে কি খুব তাড়াতাড়ি একটা কিছু করতে চলেছেন উনি?

থেমে থাকলে চলবে না। ওকেও এগোতে হবে।

প্যান্টের পকেট থেকে ধীরে ধীরে মোবাইলটা বের করে।

আকাশটা আরও একবার অন্ধকারের জন্য তৈরি হয়।

২০২০, আগষ্ট

একটানা একসপ্তাহ বৃষ্টি হওয়ার পর আজ রোদের মুখ দেখা গেছে এইমাত্র। বেড থেকে আলতো করে নেমে লোপা জানলার পর্দাটাকে ঠেলে দেয় উল্টোদিকের দেওয়ালের দিকে। কতদিন হয়ে গেল জানলা খুলতে পারেনি। ভুল বলল। জানলা দরজা খুলতে দেওয়া হয়নি। এটাই যে দস্তুর এখানকার। সৌরীশকে কতকিছু জিজ্ঞাসা করার ছিল। বলার ছিল। কিন্তু জিজ্ঞাসা যে করবে, হাতে হাত রেখে দুটো কথা বলবে সে উপায়টাই বা কোথায়?

লোপা পাঁচ মাসের গর্ভবতী। প্রেগন্যান্সির প্রথম থেকেই নানান সমস্যা হচ্ছিল। তাও নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা তো ও কম করেনি। শেষে পাঁচ মাসের গোড়াতেই ধরা পড়ে কোরোনা পজিটিভ। একটা অদৃশ্য মারণরোগ। যা সেকেন্ডের মধ্যে স্তব্ধ করে দিতে পারে হৃদযন্ত্র। অথচ দেখো শরীরে বিন্দুমাত্র কোনও লক্ষণ নেই। বুঝতেও পারেনি ও। ইউরিন ইনফেকশনের টেস্টেই বিষয়টা সামনে আসে। তারপর থেকেই ডঃ পোরেলের নার্সিংহোমে নজরবন্দি। বাড়ির কারুর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। অন্য কোনও পেশেন্টের পাশে থাকতে পারবে না। এমনকি ডাক্তার, নার্স, আয়ামাসি এলেও এমন সব প্রটেক্টেড বর্ম পরে আসে দেখে মনে হয় লোপা একটা রাক্ষুসী। খারাপ লাগলেও এটাই এখন মেনে নিতে হবে। লোপা মন থেকে চায় না ওর থেকে কারুর শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ুক।

আচ্ছা ও কি বাঁচবে?

টিভিটা বেডের সামনের দিকের সাদা দেওয়ালে ঝোলানো আছে। কিন্তু খুললেই নিজের অজান্তে না চাইলেও ঠিক আঙুলটা বেইমানি করে ওর সঙ্গে। খবরের চ্যানেলগুলোয় চোখ চলে যায়। চারিদিকে শুধু হাহাকার আর হাহাকার। আর তার মধ্যেই লোভী রাজনীতিবিদগুলো নিজেদের আখের গুছিয়ে এর ওর ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্য তৈরি হয়ে আছে। সেদিন আবার একটা অদ্ভুত খবর দেখে। কোন একটা ডাক্তারকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে মানুষ। ডাক্তারটা সম্ভবত বিদেশ থেকে এসেছিল। যেহেতু এই সংক্রামক বিদেশ থেকে ছড়িয়েছে, তাই সকলের ধারণা হয়ত ওই ডাক্তারটাও রোগের বাহক। সত্যি মানুষের ধারণা কী বিচিত্র। লোপা প্রেগনেন্ট হওয়ার আগে থেকেই তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। থাইরয়েড থাকলেই কোনোভাবেই সন্তান না হওয়ার সম্ভাবনা, এই বদ্ধমূল ধারণা প্রতি মুহূর্তে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে ওকে আর সৌরীশকে। তারপরে আজ একসপ্তাহ হল কোরোনা পজেটিভ। সেদিনের কথা আর ভাবতে চায় না লোপা। বরং জীবনের এই ক্ষণগুলোকে জিইয়ে রাখতে চায় নতুন করে।

ফোন ব্যবহার নিষেধ। সেখান থেকেও হবু শিশুর বিপদের সম্ভাবনা। কোভিড ১৯ নাকি সুযোগ পেলেই জরায়ুর প্লাসেন্টা পেরিয়ে গিয়ে বাচ্চার ক্ষতি করতে পারে। তাছাড়া লোপার যদি কোনও সময় শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় সেক্ষেত্রেও...

নাহ ও আর ভাবতে চায় না। দু’দিন আগে নার্সের কাছ থেকে চাওয়া খাতা পেন নিয়ে বসে। লিখতে শুরু করে,

‘আমি লোপা মিত্র। ছোটবেলায় জেনেছিলাম পুরাণে ‘লোপা’ নামের বিদুষী নারীর কথা শুনেই বড়রা অনুপ্রাণিত হয়ে আমার নাম রেখেছেন। কি জানি আমাকে নিয়ে তাঁরা আর কী কী স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিংবা আমি কতটা তার পূর্ণ করতে পেরেছি। কিন্তু মা হওয়ার প্রাথমিক লগ্ন থেকেই আমার একটা কথাই বারবার মনে হয়েছে, আমার শিশু যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। তার জন্য আমাকে যা করতে হবে। আমি তাই করব।

‘আমাকে যা করতে হবে। আমি তাই করব।’ ঠিক এই কথাটা ভাবতে কতদিন ঈশ্বর দেবেন আমি জানি না। তবু মনের সবটুকু জোর নিয়ে আমি লড়ে যেতে প্রস্তুত। ওকে ভূমিষ্ঠ হতেও আমি দেখতে চাই। আর ও বড় হওয়ার প্রতিটা সময়কে মুঠো করে রাখতে চাই...’

‘কি মিসেস মিত্র? কেমন আছেন?’ ডাক্তারবাবু কখন লোপার বেডের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি ও। খাতা পেন তাড়াতাড়ি সরিয়ে উত্তর দেয়,

‘খুব বমি হচ্ছে। সারাদিনে ১৫-২০ বার। মাছ মাংস খেতে একেবারেই ইচ্ছে নেই।’

‘এগুলো তো খুব সাধারণ লক্ষণ। কিন্তু জ্বর বা নিঃশ্বাস নিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি? খেয়াল রাখবেন কিন্তু। আর সবকিছুর ওপরে দরকার প্রবল মানসিক জোর।’

‘সেটা পেশেন্টের ভালোমতোই আছে। আমি তো দেখছি খেতে খেতে বমি পেলে রীতিমত খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে আবার এসে খাচ্ছেন। তবে কিছুদিন হল উনি ওনার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।’ পাশ থেকে অল্পবয়সী একজন নার্স বলে ওঠে।

‘সেটা তো কোনোভাবেই সম্ভব নয় মিসেস মিত্র। এটা যে কী ধরনের সংক্রামক রোগ তাতো জানেন। তাছাড়া আপনি সংক্রামিত হওয়ার পরেই বাড়ির বাকি সকলকেই হোম আইসলেশনে রাখা হয়েছে। ওনারা ১৪ দিনের আগে বাড়ি থেকেই বেরোতে পারবেন না। দৈনন্দিন বাজার দোকান অন্য কাউকে দিয়ে করাতে হবে...’ ডাক্তার আরও কী কী সব বলে যাচ্ছিলেন। সবটা শুনতে ভালো লাগছিল না লোপার। এরপর আরও আধঘন্টা মত ডাক্তার ওকে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলে যান। লোপা অাবার একা একটা নির্জন ঘরে বন্দী হয়ে পড়ে।

পৃথিবীটা কি বিষাক্ত হয়ে গেছে?

লোপাও কি সেই বিষেরই অংশী?

কিন্তু এই শিশুটা? এ তো কোনও অন্যায় করেনি? একটা নিষ্পাপ চোখ নিয়ে গোটা পৃথিবীর আলো দেখার জন্য সে আসছে। একটা মা হয়ে লোপা তাকে কী দিতে পারবে?

হ্যাঁ পারবে, একটা নির্ভাবনায় মোড়া সুস্থ মন। সেটুকুই দেবে লোপা।

৯ মাস পূর্ণ হওয়া অবধি এই মনটাকে সুস্থ রাখতে পারবে তো লোপা?

ইমিউনিটি সিস্টেমকে জোরদার করলে তবেই এই ভাইরাসকে শরীর থেকে তাড়ানো যাবে। কী করে করবে লোপা? কিছু খাবার মুখ তুলতে গেলেই গা গোলাচ্ছে। অথচ...

জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

সেদিন লোপা ভোর রাতের দিকে স্বপ্ন দেখেছিল। ও, সৌরীশ আর ওদের সন্তান কোনও একটা পাহাড়ের কোলে ঘর বেঁধেছে। কত গাছগাছালি কত পাখী কত নির্জনতা...।

এরকম একটা জায়গা লোপা আগে কখনও দেখেনি। কোনওদিন এরকম জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে বলেও মনে পড়ছে না। তবে...?

ওটা কি পৃথিবী? নাকি পৃথিবীর বাইরে সুন্দর একটা নির্বিষ স্থান?

বোকা... লোপা খুব বোকা...।

ওটা তো স্বপ্নই।

শরীরটা হঠাৎ করেই ভীষণ আনচান করে ওঠে। মাথাটা ব্যথা ব্যথা। গা গুলোনো গুলোনো একটা ভাব। এটা তো সবসময়ই থাকে। কিন্তু হাত-পাগুলো আড়ষ্ট হয়ে আসছে কেন?

বিলবিলে একটা যন্ত্রণা গোটা শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধছে। গ্লাস থেকে ঢকঢক করে জল খায় লোপা। বেডের মাথার দিকের রডটা ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। পা দুটো যেন ওর নিজের নয়। এই তো কিছুক্ষণ আগে সব ঠিক ছিল। তাহলে এমন হচ্ছে কেন? পায়ে নতুন করে বল পাচ্ছে না কেন? বুকের বাঁ-দিকটা মোচড় দিচ্ছে যেন। হাত বাড়িয়ে বেডের কাছের সুইচটা টিপতে যায়। আচমকাই গলা চেপে আসে। যেন একশ’টা আসুরিক শক্তি লোপার গলার ওপর চেপে বসে আছে। কিছুতেই ও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে না। ক্রমে একটু একটু করে দম বন্ধ হয়ে আসে লোপার। নিঃশ্বাস নিতে পারে না। পৃথিবীতে একটুও অক্সিজেন অবশিষ্ট নেই কি আর? ওর... ওর কি দমবন্ধ হয়ে যাবে?

ওর সন্তান? ওকে যে বাঁচাতেই হবে?

জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজের মধ্যে অক্সিজেন প্রবেশ করাতে চায় লোপা। কেন... কেন পারছে না। হাত টানটান করে আরও একবার চেষ্টা করে ওদের ডাকার...।

ওরা এলে... কেউ অন্তত এলে...

ঈশ্বর কি ওকে এভাবেই হেরে যেতে দেবে?

ও তো কোনওদিন কারুর ক্ষতি করেনি?

কারুর ক্ষতি চায়ওনি।

চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। গলা বুজে আসে পুরোপুরি। কালো... ঘন কালো ভিড় করে আসে চোখ জুড়ে।

কেবল ওর পৃথিবী জুড়ে একটাই ধ্রুব সত্যি!

ওর সন্তান...!

২০৭১, জানুয়ারি

শেষমেষ আইভির প্রতিবন্ধী বোনটাও? কোথায় যাচ্ছে মানুষগুলো? সুষমা থাপা, সিমন কাকা সেই যে আজব গল্পটা ধ্রুবকে শুনিয়েছিল। তার যেন শেষ নেই। আজ তিন-চার মাস হয়ে গেল কোনও কিছুতেই মন লাগাতে পারছে না। শান্তি তো পাচ্ছেই না।

তবে ধ্রুব একটা ব্যাপার লক্ষ করে দেখেছে, যাঁরা একটু বেশিই অসুস্থ, বেশিই অবসন্ন, তারাই গায়েব হচ্ছে। যদি মানুষগুলো নিজে থেকেই হারিয়ে যায়, তাহলে ঐ গল্পটার কী অর্থ? নিরুদ্দেশ হওয়ার ঠিক পর পরেই তারা কোনও না কোনওভাবে অদ্ভুত রূপ নিয়ে বাড়ির লোককে দেখা দিচ্ছে। এগুলো রটনা না ঘটনা?

ভেড়া কখনও বিকৃত মানুষের রূপ নিতে পারে?

ঘরোয়া পাতলা শরীরের মানুষ কখনও প্রকান্ড চেহারা নিয়ে আসতে পারে?

সতর্ক থাকতে হবে, খুব সতর্ক। নাহলে মানুষগুলো আরও বিপদে পড়তে পারে। রিমার ব্যাপারটাও ক’দিন ধরে ভাবাচ্ছে; এর মধ্যে মেসেজে কয়েকবার কথাও হয়েছে। রিমা যে ধ্রুব-র থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে এটা সত্যি। কিন্তু ঠিক কী সেটা বুঝতে পারছে না। শুধু শারীরিক অসুস্থতার জন্যই কি মেসেজ করেছিল রিমা? নাকি আরও কিছু বলতে চায়?

ধ্রুব জ্ঞান হয়ে থেকে রিমার ছোট্ট পরিবারকে এই গ্রামে থাকতে দেখেছে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ওরা চলে গিয়েছিল। ধ্রুব-র বাবা বলেছিল ওরা শহর ভালোবেসেছিল। এখানে তো যন্ত্র কম, যান কম। তাই মানুষ নিজেকে গেঁয়ো মনে করে। এখনকার ৫-১০টি পরিবার ছাড়া সেসময় রিমাদের মতই হয়ত বাকিরা মনে করেছিল।

তবুও হাজার বিরক্তি, হাজার অজুহাতের মাঝেও কিঞ্চিৎ যোগাযোগটা রয়ে গেছে রিমার সঙ্গে।

এর নাম কী?

এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সেও বুঝতে পারে না ধ্রুব।

এটাকেই কি ভালবাসা বলে?

কে জানে।

শুধু কোনও সময় রিমার কথা ভাবলেই মনে পড়ে যায় সেই ছবিটা। যে ছবিটা ক্যালেন্ডারের পাতার মত ধ্রুব-র মনে একটা স্মৃতি দাগের মত স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। রিমার একটা পা জন্মগত কারণেই বরাবরের দুর্বল। কোমর থেকে সরু লিকলিকে। তা সত্ত্বেও রিমার ছোটবেলায় ছেলেদের মত খেলাধূলার খুব শখ ছিল। একদিন ধ্রুবকে ফুটবল খেলতে দেখে ওর পায়ে পা মেলাতে গিয়ে রিমা ভয়ানক চোট পায় মাথায়। এসব জায়গায় ডাক্তার বদ্যির অভাব চিরকালই। টানা দু’দিন প্রবল জ্বরে বেহুঁশ ছিল রিমা। ওর অভিভাবকেরা অনেক কষ্ট করে ডাক্তার ডেকে এনেছিল; রিমা তাঁর ওষুধেই একটু একটু করে ঠিক হয়েছিল বলে বাড়ির লোক মনে করে। কিন্তু ধ্রুব-র বাবা সৌরীশ বলেছিলেন ওনার ওষুধেই নাকি রিমা উপকার পাচ্ছে। বিপরীতে শহুরে ডাক্তারের চিকিৎসায় কিছু সমস্যা আছে। ব্যাপারটা রিমার বাড়ির লোককে জানালে তারা মেনে নেন না। এদিকে ধ্রুব-র বাবা শহুরে ডাক্তারের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে শুরু করলে রিমার বাবা-মা মন থেকে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাঁরা ভাবেন গ্রামে আটকে রাখার জন্য সৌরীশ অসৎ উদ্দেশ্যে তাঁদের প্ররোচিত করছে। কিন্তু ধ্রুব বড় হয়ে বাবা-র কথাবার্তায় স্পষ্ট না হলেও বারবারই আন্দাজ করেছে সেই ডাক্তারের প্রচেষ্টা খুব একটা ঠিক ছিল না।

কিন্তু কেন?

আসলে বিশ্বাস জিনিসটাই এতটা ঠুনকো। একবার সেটার ভিত নড়ে গেলে সহজে আর পুরোনো জায়গায় ফিরে আসে না। মেসেজে রিমার শারীরিক অসুস্থতার কথা অস্পষ্টভাবে জানার পর ধ্রুব পড়াশুনা করে দেখে; তাতে আন্দাজ করে ওর ‘হাইপারহাইড্রোসিস’ হতে পারে। বছরের সমস্ত সময় কারুর এত ঘাম হতে পারে? উষ্ণ আবহাওয়ায় কিছুক্ষণ থাকলে বা কোনও ধরণের শারীরিক পরিশ্রম করলে মানুষের শরীর থেকে ঘাম নির্গত হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু কোনও কারণ ছাড়াই শরীরের নির্দিষ্ট কোনও জায়গায় যদি মাত্রাতিরিক্ত ঘাম তৈরি হয়?

রিমার কথা শুনে জেনেছে, সমস্যাটা একটু একটু করে হচ্ছিল। তবে খুব বেশি না হওয়ায় ও তেমন একটা আমল দেয়নি। এখন গোটা ব্যাপারটা আয়ত্তের বাইরে। কোনও ডাক্তারের ওষুধেই কাজ দিচ্ছে না আর। ফলত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। নিজের প্রতি নিজেরই ক্ষোভ জন্মাচ্ছে ওর। অনেক সময় ডায়াবেটিস, লো ব্লাড সুগারে এই ধরণের সমস্যা হতে পারে। আর কর্মহীনতা দিন দিন মানুষকে আরও এসব রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রিমারও হয়ত তেমনই একটা কিছু...

শহরের ওই কেঠো দুনিয়া কি আরও অকেজো করে দিল রিমাকে?

শেষ মেসেজ একটা করেছিল ধ্রুব। এন্ডোস্কোপিক সার্জারির মাধ্যমে ঘাম তৈরি করা গ্রন্থিগুলোর সাথে যুক্ত স্নায়ুগুলোর কার্যক্ষমতা থামিয়ে বিষয়টা নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। রিমা এ বিষয়টা যেকোনো বিশ্বাসযোগ্য ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারে।

মেসেজটা সিন হয়েছে। কিন্তু তারপর থেকে তিন সপ্তাহ হয়ে গেল রিমা কোনও রিপ্লাই দেয়নি।

ক্রমে সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে যেন।

ভাবনার জালগুলো ছিন্ন করে এগিয়ে যায় ধ্রুব।

প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে। ধ্রুব রাত্রিটা কাটার অপেক্ষায় ছিল। রাতের কালো খানিকটা পাতলা হতেই বরাবরের অভ্যাসমত বেরিয়ে পড়েছে পথে। প্রকৃতির কোনও বিরূপতাই যে এই সময়টায় ওকে ঘরে আটকে রাখতে পারে না। আসল কথা হাঁটা অভ্যেসটাই হারিয়ে গেছে। ওর জন্মের সময়েও ‘মর্নিং ওয়াক’ বলে যে একটা দৈনন্দিন কাজ ছিল মানুষ সেটা ভুলতে বসেছে। শহুরে লোক তো বটেই, এ গ্রামেও তেমন পরিশ্রমী মানুষ চোখে পড়ে না। অছিলা সেই রোগের ভয়। বছর পঞ্চাশেক আগে যে মহামারির মারণ সংক্রমণ মানুষের মনে একে একে ধাপে ধাপে ছড়িয়ে গেছে। মানুষ একে একে একেকটা বিচ্ছিন্ন বদ্বীপ হয়ে গেছে। একে অপরের সংস্পর্শে না এসে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে বটে। কিন্তু একশ্রেণীর মানুষের কাজ কমতে কমতে অলস জগদ্দলসম হয়ে পড়ছে। ঘড়ির কাঁটা ধরে শুধু এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো। আবার ও মুড়ো থেকে এ মুড়ো। এর থেকে পরিত্রাণ নেই। কিন্তু ধ্রুব তো সেজন্য পৃথিবীতে আসেনি।

জোরে জোরে পা চালায় ধ্রুব। শিশিরে ভেজা পাতায় উপকার বেশি। বেশি ভাবনাচিন্তা করে লাভ নেই। চার-পাঁচটা পাতা তুলে নিয়েই বাড়ি ফিরবে।

তিনটে রাস্তা যেখানে জুড়েছে। উত্তর-পশ্চিম ঘেরা রাস্তা যেটা পেশক রোডে গেছে, পূর্ব ঘেরা রাস্তা যেটা তিস্তা অবধি, আর দক্ষিণের যোগীঘাটে গিয়ে যেটা সেলফু শিটং এরিয়া ঘুরে রয়েছে। ঠিক সেই মুখটাতেই ক’দিন আগেই গাছটা দেখেছিল ধ্রুব। সুন্দর ঝাঁকড়া পাতার মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল লাল লাল খোঁচা খোঁচা ফুল। দেখেই চিনতে পেরেছিল গাছটা রোদিওলা প্রজাতির। বাবা চিনিয়েছিল ‘ওয়ান্ডার হার্ব’; সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০-৪০০০ ফিট ওপরের শীতল পরিমণ্ডলেই এই ধরণের গাছ জন্মাতে পারে। অনেক বছর আগে ২০১৪ সাল নাগাদ নাকি ভারতের ‘ডিফেন্স ইনস্টিটিউট অব হাই অলটিটিউড রিসার্চ’ প্রথম এই গাছটার সন্ধান পায়। ওরাই বলেছিল এই সেই সঞ্জীবনী। সঞ্জীবনী সুধা। যা খেয়ে রামায়ণের মৃত লক্ষণের প্রাণ ফিরে এসেছিল। রিমা যখন মাথা ঘুরে ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল এটার কথাই প্রথম বাবার মাথায় আসে। ওই তো... দেখতে পাচ্ছে ধ্রুব... কুয়াশা এখানে অনেকটা পাতলা। যেন সূর্য তার নরম আদর পাথরের পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। সারারাতের শিশিরে চুপচুপে ভিজে আছে গাছটা। ওর লাল লাল ফুলগুলো মাথা নুইয়ে ডাকছে যেন ধ্রুব-কে। মনটা ভেতরে ভেতরে কেঁদে ওঠে। যে মানুষগুলো পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলেনি নিজেদের। এগিয়ে যাওয়ার করাল গ্রাস যাঁদের দৌড়তে শেখায়নি। তাঁদের দিকে নজর কেন এই বিষ পৃথিবীর? না... না .... না... এক এক করে তাঁদের হারাতে পারবে না ধ্রুব। কিছুতেই তাঁদের হারাতে দেবে না। বেশ মনে আছে বাবা চলে যাওয়ার কয়েকদিন আগে ধ্রুব-র হাত দুটো বুকের মধ্যে ধরে বলেছিল,

‘বাবা, এই পৃথিবীতে বড় বিষ। তোর মা স্বপ্নে দেখেছিল এই গ্রামকেই। এ যেন ভগবানেরই নির্দেশ। ঈশ্বরকে তো আমরা চোখে দেখতে পাই না। মূর্তি আমাদের কল্পনা। তাই আজীবন প্রকৃতিকে পুজো করে যেতে হবে। প্রকৃতিই আমাদের ঈশ্বর। আর সেই প্রকৃতি যদি একবার রুষ্ট হয় তাহলে কারুর রেহাই নেই। ভুলেও এখান ছেড়ে যাস না। নিঃশ্বাসে বিষ মিশে যাবে।’

শুধু ‘রিসেপ’ নয়, ধ্রুব-র কাছে রিসেপের মানুষগুলোও ঈশ্বরের প্রতিভূ।

আর মাত্র হাত দশেক...।

পকেট থেকে হাত বের করে তালু-দুটোকে মুখোমুখি ঘষে গাছটার সামনে এসে দাঁড়ায়। কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে মুঠির মধ্যে নিতেই, আচমকা কারুর পায়ের শব্দ হতে পিছন ফিরে তাকাতে যায় ধ্রুব।

প্রচণ্ড একটা আঘাত...। যন্ত্রণা...। যেন হাজার হাজার পাহাড় কেউ ওর মাথায় ভেঙে দিল মুহূর্তে। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথাটা। শরীর মুচড়ে পেছন দিকে তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে যায় ওর।

এ কে?

আইভি-র বোন না?

কোমড় থেকে পাতলা হয়ে যাওয়া দশ বছরের মেয়েটা কোনও হুইলচেয়ারে বসে নেই। হঠাৎ করে যেন ম্যাজিকের মত পায়ে বল ফিরে পেয়েছে ও। এও সম্ভব? ধ্রুব-র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে শরীরটা।

কী করে?

ওর নিষ্পাপ মুখ জুড়ে কদর্য মাংসপেশী ঝুলে আছে। চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে। আর... হাতে... বিপুল ভারী এক পাথর।

এ কী দেখছে ও?

মেয়েটা মুখ খোলে। একটা সাংঘাতিক জান্তব ডাক ডেকে ওঠে। ধ্রুব জীবনে কোনওদিন এমন ডাক শোনেনি। শরীরটা টলে ওঠে ওর। হাতে ধরা মাথার পিছনের দিকের জায়গাটা থেকে রক্ত বেরোতে শুরু করেছে।

ধ্রুব কুয়াশা ভেজা পথে এলিয়ে দেয় নিজের শরীরটা। যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে। চোখ জুড়ে নেমে আসে অন্ধকার।

২০১৯, ফেব্রুয়ারি

‘আমার কথাটা ঠিক ধরতে পারছেন না আপনি?’ গলাটা সামান্য তোলে যুবক।

‘আমি ঠিকই ধরেছি। আপনি এখন আসুন। আমি কোনও দালালের সঙ্গে কথা বলি না। দালালের সাহায্যও নিই না। একটা কথা পরিষ্কার করে জেনে রাখুন। আমি ডাক্তার। তাই কোনওরকম প্রলোভনে আমি পা দিই নি। ভবিষ্যতেও দেব না।’ ডাক্তারবাবু গলায় ঝাঁঝ তুলে বলে ওঠেন।

‘আমি আপনাকে প্রলোভন দিতে আসিনি। আমার কথাটা একটু ভাবলে বুঝতে পারবেন। এই গোটা প্রজেক্টে যেভাবে পাবলিক থেকে সরকার খেপেছে তাতে খুব তাড়াতাড়ি আপনি নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে পরবর্তীতে আপনার কোনও কাজ করার আশাও কমে যাবে।’ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে থামে ছেলেটা। মনে তো হচ্ছে কিছুটা কাজ হয়েছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সামনে বসা মানুষটির কপালের ভাঁজ মুখমণ্ডলে চিন্তার ঢেউ তুলেছে। একবছর ধরে হন্যে হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ঘুরেছে। লিবিয়ায় কোরীয় কোম্পানিতে বেগার খেটে কাজ পর্যন্ত করেছে। তা কি এই বুড়োর মুখ ঝামটা খাবে বলে? কেউ... কেউ নেই বুড়োকে সেভ করার জন্য।

ডাক্তার কেমন অন্যমনস্ক হয়ে বলতে শুরু করেন,

‘কিন্তু জানেন এধরণের নার্ভ সার্জারি আমি আগেও করেছি। বছর চার আগেকার কথা। কর্নিয়াল অ্যানেস্থেসিয়া নামক জেনেটিক সমস্যার জন্য একটি ছেলে আমার কাছে আসে। কোনও আশা ছিল না। বাপ-মা দুটো কেঁদে কেটে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। ওদের পয়সাকড়ির কোনও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু ছেলে যদি চোখেই না দেখতে পায়। তাহলে সারাটাজীবন চলবে কী করে? অথচ ছেলেটা যে জন্মগত অন্ধ তাতো নয়। কিকরে যেন একটু একটু করে ও চোখের দৃষ্টি কম হয়ে গেছিল। শুনেছিলাম পড়াশুনাতেও খুব নাকি তুখোড় ছিল...।’

‘হ্যাঁ তুখোড় ছিল বলেই তো বাপ-মা দিক দিশা হারিয়ে ফেলেছিল। নিশ্চয়ই ছেলেকে প্রয়োজনের বেশি চাপ দিয়েছে। এটাই তো স্বাভাবিক। ট্রেস! জীবনের মূলধন হয়েছে তো এই একটাই।’ ডাক্তারের কথার সুর ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছিল যুবক।

‘জানেন মাত্র... মাত্র ৩দিনের মধ্যেই কর্নিয়ার কর্মদক্ষতা ফিরে আসে। পায়ের সুরাল স্নায়ু যোগ করি। ছেলেটা দেখতে শুরু করে। বিশ্বাস করতে পারেন?’

‘হুম বিশ্বাস তো আমি করতে পারি। আই মিন বিশ্বাস করেছি বলেই আমি কিন্তু এতদূর ছুটে এসেছি। আপনি ভাবতে পারেন পরিবার পরিজন ছেড়ে জাস্ট আপনার একটা পজেটিভ উত্তরের আশায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।’

‘আপনি আমাকে পাঁচ থেকে ছ’বার পিং করেছেন। কিন্তু আমার মনের অবস্থাটা...!’

‘আর বেশি দেরি করলে কিন্তু সরকারই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে আপনাকে। সেটা নিশ্চয়ই আমার থেকে আপনি ভাল করে বুঝতে পারছেন। আপনার গোটা প্রজেক্ট ফেলিওর হয়েছে। বুঝতে পারছি যে মানুষটা নিজের প্রাণ অগ্রাহ্য করে এগিয়ে এসেছিল তার কাছে কথা রাখতে না পারায় নিজেকে আপনি নিজেই ব্লেম দিচ্ছেন। কিন্তু ডঃ আমি কিন্তু সবটা আবার শূন্য থেকে শুরু করতে চাইছি। আর সেই কারণেই আমি চাই আপনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। আমি কথা দিচ্ছি সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকে। তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যেই আপনার সফলতা আসতে বাধ্য।’

‘সফলতা?’ ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা যায় ডাক্তারবাবুর। ‘আমি তো সফলতার জন্য গবেষণা করি না। আর বাইরে থেকে এটাকে কি খুব একটা সহজ কাজ বলে মনে হচ্ছে? তা যদি মনে করেন তাহলে ভুল ভাবছেন। এটা কিন্তু নতুন সকেটে একটা লাইট বাল্ব ঢুকিয়ে দেওয়ার মত সহজ কাজ নয়। জানেন এই সার্জারিটা করতে আমার ঠিক ১৮ ঘন্টা সময় লেগেছিল। আর ঠিক সার্জারির আগে আগে ছেলেটা আমার হাত ধরে...’ গলা বুজে আসে ডাক্তারবাবুর।

উফঃ বুড়োটাকে বাগে আনা বেশ শক্ত কাজ। খালি ইমোশনাল কথাবার্তা। নাহ বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না আর। অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। গল্পের শুরুটা তাহলে এখনই করতে হচ্ছে। আসলে এমন একটা নাটুকে অ্যাটমোস্ফিয়ার যে তৈরি হতে পারে সেটা একটু হলেও আন্দাজ করেছিলাম। তাই আগেভাগেই কাল সন্ধের দিকে জোসেফকে দিয়ে কাজটা সেরে রেখেছিলাম। সরকারের একটা ফেক হুমকি চিঠি। হুম যদি একেবারেই না মানেন তাহলে এই ব্যবস্থা।

‘ডঃ সবই তো বুঝলুম। আপনাকে ভাবার জন্য আরও ৭২ ঘন্টা সময় না-হয় আমি দিতেই পারতাম। কিন্তু কাল সারারাত আমি ঘুমোতেই পারিনি। ঘুমোতেই পারিনি যখন এই শমন আমার হাতে আসে...। একবার দেখুন...।’ খানিক থেমে থেমে কথা বলে একটা বাদামি খামের মোড়ক থেকে ধপধপে সাদা কাগজ বের করে ডাক্তারের হাতে দেয় যুবক। কিছুটা অবাক, কিছুটা চিন্তাগ্রস্থ হয়ে উল্টোপিঠের মানুষটা দেখতে শুরু করলেন কাগজটা...!

একটু একটু করে ফ্যাকাসে হয়ে যেতে শুরু করল তাঁর মুখটা। রক্তহীন বিবর্ণ শরীরে একটা মৃত মানুষ চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন মনে হবে, ডাক্তারবাবুর চেহারা ক্ষণিকের মধ্যে যেন সেই রূপ-ই নেয়।

জেট প্লেনের গতিতে চোখের তারা একবার ডানদিক থেকে বাঁ-দিকে। আবার বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে ক্রমাগত সরে সরে যেতে থাকে।

একটা চিঠি।

ডাক্তারবাবু পড়ে চলেছেন। আর প্রেরক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে।

মিনিট দশেক। নিস্তব্ধ ঘরটায় ঝড় তুলে বলে ওঠেন ডাক্তারবাবু,

‘আপনি এটা কোথা থেকে পেলেন? কিভাবে? একজন ভিনদেশি হয়ে কী করে সম্ভব? না ... না ... সরকারি কাগজ কোথায় পেলেন? আমি ডাক্তার ম্যাথু কিছুতেই বিশ্বাস করি না। এরকম একটা ব্লেম? আমি খুনি? আমি... আমি লড়ব, জোসেফকে বলব... ও আমার হয়ে মামলা লড়বে নিশ্চয়ই। এখানকার কারুরই জোসেফের মুখের ওপর কথা বলার সাহস হয় না। এক্ষুণি... আমি এক্ষুণি ওকে একটা ফোন করছি।’ প্রচন্ড নার্ভাস হয়ে ডঃ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। তাঁরা সারা শরীর জুড়ে লক্ষ লক্ষ স্বেদবিন্দু যেন নাগপাশের মত জড়িয়ে ধরেছে। কপালের ভেজা অংশে একবার ডান হাত বুলিয়ে নিয়েই ড্রয়িংরুমের ফোনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেন ঠিক তখনই ছেলেটা বলে ওঠে,

‘দাঁড়ান, ডাক্তার ম্যাথু। বন্ধুকে ফোন করতে যাচ্ছেন। নিশ্চিন্তে ফোন করবেন। তার আগে আপনার হাতের কাগজের পিছনের পাতাটা উল্টে একবার দেখেছেন কি?’

‘কেন ...?’

‘আপনি নিজের চোখে দেখে নিন না।’

ডাক্তার আবার আলুথালু হয়ে এগিয়ে আসেন নিজের টেবিলের কাছে। যেখানে একটু আগে তিনি বসেছিলেন। আর তারপরেই কাগজটাকে তড়িৎ গতিতে হাতের তেলোর পেছন দিকে ঘুরিয়েই কী যেন দেখে আঁতকে ওঠে। সরকারি সিলমোহর? কাগজটা হাতে ধরেই থরথর করে কাঁপতে থাকে তাঁর শরীরটা। তিনি একটু একটু করে মেঝেতে বসে পড়েন।

একটা আর্ত চিৎকারের সঙ্গে মিলেমিশে কান্না বেরিয়ে আসে তাঁর মুখ থেকে।

ঠিক এই মুহূর্তে ডাক্তার ম্যাথু একজন প্রাপ্তবয়স্ক ইতালীয় নিউরোসার্জেন নন; তাঁকে দেখে যে কারো মনে হবে এটি একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু।

২০৭৩, ডিসেম্বর

দিন আসছে। দিন চলেও যাচ্ছে। ধ্রুব শুধু এটুকু বুঝতে পারছে ও বেঁচে আছে। একটা পঞ্চভূতের শরীর নিয়ে এখনও ও এই পৃথিবীতে আছে। আর সেই শরীরটা আছে বলেই তো ও বুঝতে পারছে সাংঘাতিক হাড় কাঁপানো শীত পড়েছে। কাঠের জানলা দরজাগুলো থেকে থেকে হাওয়ায় বিকট শব্দ করে কাঁপছে। সারাজীবনের অভিজ্ঞতা বলছে হাওয়ার দাপটের সঙ্গে সঙ্গে ঝিরিঝিরি তুষারপাতও হচ্ছে বাইরে। লাগাতার। একসপ্তাহ ধরে। সুযোগ এখনই। এখনই কিছু একটা করতে হবে। তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যেই ঘুরছে। তার এতটুকু বেশিও নয়। কমও নয়।

‘চ্যাং’-এর পাত্রটা (স্থানীয় বিয়ার) হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় ধ্রুব। খেতে ইচ্ছে করছে না একদম। কোনওমতে একহাত দিয়ে ধরে একটা শক্ত ‘মোমো’ (মাংস বা সব্জি দিয়ে পিঠার মত খাবার) দাঁতে কেটে অনিচ্ছাভরে থালাটা সরিয়ে দেয়। লোকটা নিশ্চয়ই স্থানীয় কাউকে দিয়ে খাবার বানায়। খাবারগুলো স্থানীয়ভাবেই বানানো। নাহলে ওর ভাষাগত উচ্চারণ শুনে ধ্রুব স্পষ্ট বুঝেছে পিশাচটা এখানকার কখনই নয়।

মুখের সামনের জন্তুটা ঘর্ঘর করে ওঠে। হ্যাঁ ওকে জন্তুই বলবে। কারণ ও তো আর মানুষ নেই। কিন্তু ধ্রুব বেশ বুঝতে পারে মানব শরীরের চাওয়া পাওয়াগুলো ওর ভালরকম আছে। ওটা হাঁটু মুড়ে এগিয়ে আসে ধ্রুব-র কাছে। বোটকা একটা গন্ধে ঝাঁঝিয়ে ওঠে নাক। জন্তুটার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে থাকে ধ্রুব-র সারা শরীরে। ধ্রুব বুঝতে পারে জন্তুটা এখন শরীর চায়। ওর সেই খিদেই একটু একটু করে জেগে উঠেছে। হাত-পা সমেত গোটা শরীরটা এমনভাবে পিচমোড়া করে বাঁধা যে উঠে এক ধাক্কা দিয়ে জন্তুটাকে সরিয়ে বেরিয়ে পড়বে সে উপায়ও নেই। নিজের মুখ ভর্তি দাড়ি আর মাথায় এত অজস্র চুল গজিয়ে গেছে তাতে ধ্রুবকেও জন্তুর থেকে আলাদা করে ভাবতে পারবে না কোনও সাধারণ মানুষ। এই অবস্থায় দেখলে রিসেপের কেউ তো সহজে চিনতেই পারবে না।

‘রিসেপ’!

আহা কতদিন পর নিজের গ্রামের নামটা মনে মনে হলেও একবার উচ্চারণ করল ও।

জন্তুটা আরও খানিকটা এগিয়ে এসেছে। এতদিনে ওর নেচারটা কিছুটা সয়ে গেছে। খাবার সময়টাতে সারাক্ষণ কাছে থাকবে। আর খাওয়া হয়ে গেলেও মুখের খুব কাছাকাছি এসে ঠোঁটদুটোকে নাড়িয়ে বিকট আওয়াজ তুলে ঘর্ঘর ঘর্ঘর করতে করতে কী সব বলবে। ধ্রুব-র সে ভাষা বোঝার ক্ষমতা নেই।

ধ্রুব কিচ্ছু বুঝতে না পারলেও ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দেয়, জন্তুটা মানুষের ভাষাতেই কথা বলতে চায়। ধ্রুব-র মত মানুষ হতে চায়।

জন্তুটা মুখ ফাঁক করতেই বাইরের তুফানটা যেন আচমকা আরও কয়েক দাগ বেড়ে যায়। থরথরিয়ে নড়ে ওঠে পুরো চত্বরটাই।

এই প্রকৃতির খামখেয়ালি ওর চেনা। ওরা যে ধ্রুব-কে দার্জিলিংয়েরই জঙ্গলে কোথাও আটকে রেখেছে এটা নিশ্চিত।

কিন্তু কেন?

আর কতদিন এভাবে আটকে থাকবে ও? চেষ্টা যে করেনি তাতো নয়। দশবার কি তারও বেশিবার হবে। সুযোগ করতে গেলেই কী করে যেন বুঝে যায় লোকটা। আর তখনই সিরিঞ্জে ভরে বিষ ঢুকিয়ে দেয় ওর শরীরে। ধ্রুব টলে। ঝিমিয়ে থাকে। কিন্তু মরে না।

যেদিন প্রথম ওকে তুলে আনা হয় এখানে। সেদিনই ধ্রুব-র শরীরে বিষ ঢোকানো হয়েছিল। ঝিম ঝিম মাথা জুড়ে আলস্যতা নেমে এসেছিল। চোখ বুজতেই সারারাত বাবা বলে গেছিল একটা কথাই,

‘তোর হাতেই প্রাণসুধা আছে, চিন্তা করিস না বাবা। নিজেকে তৈরি কর। মায়ের কথা মনে কর। তোকে তো লড়ে যেতেই হবে।’

ওগুলো অলীক না সত্যি কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি ধ্রুব। তবে এটুকু বুঝেছে বাবা ওকে ছেড়ে যায়নি।

একটার পর একটা সিরিঞ্জের আঘাত আসতে শুরু করেছিল। মনের জোর টিকিয়ে রাখলেও প্রাণটা যেন ফোঁপড়া হয়ে যাচ্ছিল। আর ঠিক তখনই টনক নড়ে ধ্রুব-র। তাইতো? সেদিন মাথায় আঘাত লাগলেও বেশ মনে আছে তার আগেই একগোছা ‘ওয়ান্ডার হার্ব’ ছিঁড়ে নিয়েছিল শক্ত হাতের মুঠিতে। পকেটে পুরেও নিয়েছিল। কিন্তু তারপরেই মাথায় আঘাত আসে। ও পড়ে যায়। আর এরা...

তবে কি বাবা ওই পাতাগুলোর কথাই বলতে চাইছিলেন?

মনে সন্দেহ ছিল। মাথা বলেছিল, যে সঞ্জীবনী প্রাণ বাঁচাতে পারে। তা কোকেনের অ্যান্টিবডি হিসেবে কাজ যে করবে না তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে। বিন্দুমাত্র দেরি করেনি। অলক্ষে দাঁতে কেটে নিয়েছিল পাতার খানিকটা। শরীরের নিস্তেজ অংশগুলোয় যেন নতুন করে রক্ত সঞ্চালন হতে শুরু করেছিল। বুকের ধড়ফড় বন্ধ হয়ে নিজেকে স্থির স্বাভাবিক লাগছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিন্তু ওদের সামনে ধ্রুব নিজের সুস্থতাকে তুলে ধরেনি। গোটা বিষয় জানতে এখনও বেশ কিছুটা বাকি। তারপরই ধ্রুব এগোবে।

কী অসম্ভব পরিকল্পনা করে জায়গাটা বানানো হয়েছে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এই বাড়িটার নিচেই রয়েছে একটা মস্ত ল্যাবরেটরি। তবে ল্যাবরেটরি না বলে ওটাকে নরক বলাই শ্রেয়।

মানুষ এত পিশাচ এত লোভী হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হত না ধ্রুব-র।

থরে থরে পুতুলের মত টেবিলে শুইয়ে রেখেছে মানুষগুলোকে। জন্তুগুলোকে। মানুষ না জন্তু কী বলবে এগুলোকে? হ্যাঁ একটাই উচ্চারণ তখন এগুলোকে দেখে মাথায় আসছিল ধ্রুব-র। ওগুলো প্রাণী। ওদের প্রাণ আছে। ওদের সকলের চামড়ার নিচে ধুকপুক করছে ওদের পৃথিবীতে আসার অস্তিত্ব। একমাত্র এটাই পরিচিতি।

অজস্র কাঁচের বয়াম। তার মধ্যেই উঁকি দিচ্ছিল প্রচুর স্নায়ু, রক্তনালী, লম্বা টিউবে মেরুদন্ড, সুষুম্নাকান্ড। উফ কী ভয়ঙ্কর। চাপ চাপ রক্ত আর চামড়ার আঁশটে গন্ধে ভরে ছিল গোটা জায়গাটা। লোকটা একা ছিল না। আরও দু থেকে চারজন ছিল এই তদারকিতে।

ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে নিচের ঘরটায় টেনে নিয়ে গেছিল লোকটা। দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠেছিল,

‘দ্যাখ, চেয়ে দ্যাখ চিনতে পারছিস। আমার সাজানো বাগান। তোর বাবা কি ভেবেছিল সরকারকে জানিয়ে আমার বাবাকে হারাবে? আমাদের শেষ করে দেবে?’ লোকটার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না ধ্রুব। কিন্তু লোকটা যখন ওর কলার ধরে গুমোট ঘরটার দেওয়ালের কোণের একটা টেবিলে ঠেলে দিয়েছিল। তখন মনের সমস্ত জোর কমে পাথরের মত জড় হয়ে গেছিল ধ্রুব।

‘রিমা?’

এখানে এই ও অবস্থায়?

আর লোকটা ওকে ডেকে এনে সেটা দেখাচ্ছে? তাহলে কি লোকটা জানে?

জানে ওদের কথা? রিমা বলেছে? কিন্তু তাই বা কী করে হয়? একজন বিবাহিত মহিলা নিজের স্বামী সংসার থাকা সত্ত্বেও কেন বলবে? আর তাছাড়া রিমা তো কোনওদিন মেসেজে ওকে কিছু নিজে থেকে জানায়নি। সেই কোন ছোটবেলায়। ভুল। এগুলো তো শুধু ধ্রুব-র মনের ভাবনাই হতে পারে। হয়ত রিমার মনে কিছুই নেই।

চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছিল। রিমার সরু পা’টা গুটিয়ে কুঁকড়ে ছিল ওর বুকের মধ্যে। আর ও সম্পূর্ণ অচৈতন্য হয়ে পড়ে ছিল ভাঙা কাঠের টেবিলটার ওপরে। লোকটা নির্ঘাৎ ওর ওপরে নিজের পরীক্ষা চালাবে। আর তার পরিণতি যে কী ভয়ানক হবে তা ভাবতে পারছে না ধ্রুব।

মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আর খুব গুছিয়ে প্রতিটা পদক্ষেপ চলতে হবে। নাহলেই সর্বনাশ।

দুটো বছর কেটে গেছে এই নরকবাসেই।

উপায় একটা বের করতেই হবে। মনটা তো এখনও কিছুটা পক্ষে আছে ওর। হয়ত মাথাটাও। সে যতই কোকেন শরীরে ঢুকুক না কেন। কিছু এসে যায় না। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরের অাণুবীক্ষণিক ভাইরাস তাকে পৃথিবী থেকে হারিয়ে দিতে বসেছিল ২০২০ সালে। যে ভাইরাস স্তব্ধ করে দিয়েছিল ধ্রুব-র মা লোপার প্রাণ। কিন্তু অদ্ভুত সেই মারণরোগ ধ্রুবকে কোনোভাবেই কব্জা করতে পারেনি।

ধ্রুব তখন বেঁচেছিল। এখনও বেঁচে আছে। যদি সত্যি মৃত্যু আসত, তাহলে কোকেনের এতগুলো ডোজেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। কিংবা পঙ্গু হয়ে রক্ত মাংসের দলা হয়ে পড়ে থাকত। কিন্তু তা হয়নি।

তাই এটুকু বুঝতে পেরেছে এখন ওর মৃত্যু নেই। না... না... না... রিমাকেও চোখের সামনে কিছুতেই জন্তু হতে দেবে না। ওকে বাঁচাবেই। আর তার জন্য আজ রাতেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

ধ্রুব রাতের অপেক্ষায় ছিল। জন্তুটা ‘থুপকা’র থালাটা এনে ওর সামনে রাখে। খিদেতে পেট মোচড় দিচ্ছিল। কিন্তু সমস্ত কিছু ছাপিয়ে ধ্রুব অপেক্ষা করেছিল।

জন্তুটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে প্লেটের সবক’টা মোমো ও তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেয়ে নিয়েছিল। কিছুক্ষণের অপেক্ষা। জন্তুটা বরাবরের মত ধ্রুব-র মুখের কাছাকাছি এসেছিল খাওয়া শেষ হতেই।

ব্যাস।

এক সুযোগে ল্যাবরেটরির অ্যানেস্থেসিয়ার ছোট্ট শিশিটা হাতের ভাঁজ থেকে বের করে সটান ধরেছিল ওর নাকে।

ঝটপট ঝটপট ঝটপট...!

সারা শরীর ঘেমে উঠেছিল ধ্রুব-র।

কী অসম্ভব আসুরিক শক্তি জন্তুটার। নিস্তেজ হতে হতেও হচ্ছিল না।

আচমকা হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে মেঝে মাটি রগড়াতে রগড়াতে ঢুকে পড়েছিল কেউ!

ধ্রুব কোনও বাধা মানেনি। হাত পায়ের বাঁধন আগেই আলগা করে রেখেছিল। উঠে দাঁড়িয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন পথের মাঝে শুয়ে থাকা ভারী কোনও একটা শরীর খানিকটা গড়িয়ে গিয়েছিল ওর হাতের ধাক্কায়।

ধ্রুব-র সময় ছিল না ভাববার।

একটা গোঙানির আওয়াজ।

তারপরেই কান ফাটানো আর্তনাদ; এ যে নারীর কন্ঠস্বর!

দৌড়তে গিয়েও পেছন ফিরে তাকায় ধ্রুব। বাইরের ঝড়ো হাওয়াটা রক্তশূন্য করে দেয় ধ্রুবকে।

নেভা নেভা বাল্বের আলোয় দেখে...

ওর বহু পরিচিত একটা জন্তু মানুষকে...!

২০২০, সেপ্টেম্বর

‘ভুল করেছে, খুব ভুল করেছে ডাঃ ম্যাথু। আর ওকেই তার খেসারত দিতে হচ্ছে। কতবার করে ইন্সট্রাকশন দিলাম। অথচ... মাঝখান থেকে আমার টাকাগুলোই নষ্ট হল। কাজে বাধা...’

‘কিন্তু স্যার ডাক্তারবাবু যে চীন থেকে আসছেন, ওখানে পরীক্ষাগারে নিজের গবেষণা চালিয়েছেন, সেটা ভারত সরকার জানল কী করে? আমাদের ব্যাপারটা লিক হওয়ার কোনও প্রশ্নই তো নেই স্যার। পুলিশ যদি কোনওভাবে ট্রেস করতে পারে, হাতে হাতকড়া পড়বে! আমার তো মাথাতেই ঢুকছে না।’

‘সাধে কি আর তোমাকে পাঁঠা বলে ডাকি? চীনে ম্যাথু গবেষণা করছিল। এ প্রসঙ্গে কোনও কথাই ওঠেনি। উঠবেই না। ম্যাথু যে চীন থেকে আসছে, সেটা ইনফ্যাক্ট এখনও কেউ জানে না। তুমি আবার এসব নিয়ে মুখ খুলো না যেন। মনে আছে তো ঘরে বিধবা মা আছে। সব চুলোয় পাঠিয়ে দেব। যে পরিমাণ কোভিড-১৯ পজিটিভ কেস এখন বিদেশ থেকে আসছে। সেই সন্দেহেই ওনাকে... এই সাধারণ ব্যাপারটা তোমার মাথায় ঢুকছে না?’

‘কিন্তু স্যার আপনি তো ইচ্ছে করলে ডাক্তারকে বাঁচাতে পারতেন। ইনফ্যাক্ট উনি তো আমাদের কথাতেই এসেছিলেন। এই সময়টা কেটে গেলে তারপর এলে হয়ত বিপদ কিছুটা হলেও কম হত। তাই নয় কি?’

‘হ্যাঁ বাঁচাতে পারতাম ঠিকই। কিন্তু বাঁচালাম না তার অনেকগুলো কারণ আছে। আপাতত সে কারণগুলো তুমি না জানলেও চলবে।’

‘আর আমাদের প্রজেক্টটা...? ওটার কী হবে স্যার? এতদূর এগিয়ে গিয়ে...।’

‘চলবে... কখনই থেমে যাবে না। বুঝলে? আবার নতুন করে শুরু হবে সবটা। আমি শুরু করব। তোমার মত গাধার মাথা তো আমার নয়।’

ইতালি থেকে চীন। ম্যাথু প্রায় ৭৫৬২ কিমি পথ অতিক্রম করেছিলেন শুধুমাত্র নিজের গবেষণার সফলতার জন্য। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ রায় শেষ সাক্ষাৎ করেছিল ম্যাথুর সঙ্গে। ইতালির সরকার যে কোনোভাবেই তাঁকে সাহায্য করবে না এ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন ডাক্তার। কিন্তু মনে মনে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে তাঁর জন্মভূমি এতটা বিট্রে করতে পারে তাঁর সঙ্গে। তবে তাঁকে এই সম্পর্কে আরও বেশি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছিল স্বয়ং রায়। উদ্দেশ্য একটাই, ম্যাথুর পরিকল্পনা, রায়ের পসার। তার আগে রায় তো এমনি এমনি ইতালিতে পড়ে ছিল না। তখনই রীতিমত স্টাডি করে বুঝেছিল লোকটা চূড়ান্ত উজবুক। নাহলে নিজের ঐরকম একটা প্রজেক্টের গোটা ব্যাপারটা খোলসা করে দেয় ওইভাবে? একটা ইতালীয় যুবককে সটান সবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে ওইরকম একটা বিপজ্জনক অপারেশনে নাকি ছেলেটা সায় দিয়েছে। লোক জানাজানি হয়ে যায়। সরকার ক্ষেপে ওঠে। এদিকে সম্পূর্ণভাবে অসফল হয়ে যায় ম্যাথুর সার্জারিও। মাঝে ইতালির কোনও গ্রামে গবেষণা করেন। কিছুটা সফল হলেও পরে শেষমেষ গোটা বিষয়টা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। দেশ ছাড়েন বাধ্য হয়েই। সেখান থেকে চীন। সেখানেও ১৮ ঘণ্টার অপারেশনে পুরো ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আর তারপর... ভারতের মাটিতে পা দিতে না দিতেই বেঘোরে প্রাণ হারান...

জোসেফ...

হা... হা... হা...

নামটা মনে মনে উচ্চারণ করতেই ঠোঁটের গোড়ায় হাসি খেলে গেল রায়ের।

কী বিশ্বাসটাই না করত ডাঃ ম্যাথু!

আর সেই বিশ্বাসে রায় চিঠিটা তুলে ধরেছিল। জোসেফই ইতালি সরকারের মাধ্যমে শমন পাঠাতে প্রস্তুত ছিল। এই ধরণের মারণ গবেষণা করলে শুধু যে ম্যাথুর ইতালির নাগরিকত্ব যাবে তা নয়, দেশ থেকেও বিতাড়িত হতে হবে অপবাদ দিয়ে।

কিন্তু এতকিছুর পরেও রায়, ম্যাথুকেই নির্বাচন করেছে। নির্বাচন করেছে তার কারণ ম্যাথুর এই অভাবনীয় পরিকল্পনা। আজ নয়... কাল একবার যদি এই পরিকল্পনা সফল হয়... আর তাছাড়া ইতালির সেই করোনামুক্ত গ্রামের পিছনে অলৌকিক ইতিহাসটাকে তো অস্বীকার করা যায় না। লোক উপদেবতা চোখে দেখেছিল। হ্যাঁ, নেপোলিয়নের ঘটনাটায় সামান্য রং চড়ানো ছিল। সেতো মানুষ প্রতি পদেই করে থাকে। হয়ত বিষয়টা আরও কয়েকবার লাগাতার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে গেলেই সফল হবে।

আঃ!

এখনও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ধাপ একে একে করতে হবে। তবেই শান্তি। দেশের অবস্থা এখন টালমাটাল। দেশের জনগণ থেকে নেতা সবাই নিজের পেছন সামলাতে ব্যস্ত। এখনই যদি কাজটা শুরু করে দেওয়া যেত? অপেক্ষা নয় আর; ঠিক এখনই...! যা কিছু ভেবে রেখেছে একে একে ধাপে ধাপে খুব সতর্কভাবে এগোতে হবে।

খবর খুললেই সবার নজর একই দিকে। একই বুলি আওড়াচ্ছে সমস্ত মিডিয়া চ্যানেলগুলো। বুম হাতে গলা ফাটাচ্ছে কচি থেকে বুড়ো সাংবাদিকগুলো। রাজনৈতিক তরজা বসছে সন্ধে হলেই।

চীনের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ভাইরাস গবেষণাগার ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’র ওপর। উহান শহরে অবস্থিত এই গবেষণাগারে প্রাণঘাতী নাকি বিভিন্ন গবেষণা চলছিল। আরও জানা যাচ্ছে চীনের জৈব অস্ত্র প্রকল্প নিয়ে গবেষণা করেছেন ইসরাইলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ড্যানি গোছান। তিনি বলেন, উহান ইনস্টিটিউটের কিছু পরীক্ষাগার গবেষণা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত ক্ষেত্রে চীনের গোপন জৈব অস্ত্র প্রকল্পের সঙ্গে হয়ত সম্পৃক্ত। তবে এগুলো এই প্রকল্পের প্রধান স্থাপনা নয়। এক ইমেইল বার্তায় বলে, বেসামরিক-সামরিক গবেষণার অংশ হিসাবে জৈব মারণাস্ত্র নিয়ে গবেষণার কাজ হয়ে থাকে। প্রশ্নটা হচ্ছে এই ধরণের প্রকল্প অবশ্যই গোপন রাখা হয়।

তবে?

সেখানে সারা বিশ্ব...

‘স্যার... একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল? স্যার... শুনছেন?’

‘হ্যাঁ... হ্যাঁ ... কিছু বলছ?’ আনমনা রায় ছেলেটার কথায় সাড়া দেন।

‘না আসলে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল। কয়েকদিন জিজ্ঞেস করব করব বলেও করা হচ্ছে না কিছুতেই। আসলে আমার মা জানতে চাইছিল।’

‘না ... মানে... আসলে... এসব না বলে কী কথা বলতে চাও বলে ফেলো। তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় নেই আমার। উজবুক।’

‘আপনার ছেলে... আপনার ছেলে ভাল আছে তো?’

‘হুম। ভাল। কেন? শোনো তোমাকে ওসব বেশি মাথা ঘামাতে হবে না। এই ক’দিনে একটা কাজ করতে হবে তোমায়। খুব কেয়ারফুলি। জানবে দেওয়ালেরও কান আছে।’

‘হ্যাঁ স্যার, বলুন। আমি তৈরি আছি। আপনার কাজ করব না তো কার কাজ করব?’

‘মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করো না। যেটা বলছি মন দিয়ে শোনো। কাজকেই ‘মাতৃভবন’, আর ‘চাইল্ডকেয়ার’ নার্সিংহোমের নিউরোসার্জেন ডাক্তার ত্রিপাঠী আর ডাক্তার মুখার্জিকে একবার ফোন করবে। আমার পার্সোনাল নাম্বারটা দিয়ে ওনাদের যোগাযোগ করতে বলবে আমার সঙ্গে। আমি নিজেই ফোন করতে পারতাম। কথা বলতে পারতাম। কিন্তু আমি চাই ওনারা আমাকে ফোন করুন। এই হল তোমার ছোট্ট কাজ...। আশা করি তুমি করতে পারবে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি করে নেব। দেখুন একদম পারফেক্টলি।’

দুজনের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আচমকা টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছে কেউ যেন চাপা গলায় আর্তনাদ করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই তার গলা দিয়ে ‘টুঁ’ শব্দটা পর্যন্ত বেরোচ্ছে না।

মৌনী? হঠাৎ?

এই তো আধঘন্টা হল এল এখানে?

কেন জানে না বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠল।

‘হ্যালো...

কী বলছ কি? এই তো আমি এক্ষুণি এলাম? এর মধ্যে এতকিছু হল কী করে?

সেকেন্ডের মধ্যে রায়ের মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়।

মিঃ রায় ফোনটা কানে নিয়েই পাগলের মত ছুটে যায় দরজার দিকে।

২০৭৩, মার্চ

সূর্যোদয়ের রঙে যেমন অপরূপ লাগে বরফের পাহাড়গুলিকে, তেমনই সূর্যাস্তের কমলা আলো এক অপার্থিব মায়ার পরিবেশ তৈরি করে। ইতিউতি ঝাড়ু গাছের ঝোপ। হয়ত নিচের দিকে ধাপে ধাপে চাষের জমিও কিছু আছে। জায়গাটা ‘রিসেপে’র কাছাকাছি। কিন্তু বনানী তুলনায় অনেক ঘন সেটা আন্দাজ করে নিয়েছে ধ্রুব। আর তাই নিজেদের এত সহজে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে।

ওখান থেকে পালিয়ে রিমাকে কোনওমতে জঙ্গলের মধ্যে রেখে নিজের গ্রামে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু চরম অবাক করা ব্যাপার। কাউকে পায়নি ধ্রুব। একটা মানুষকেও দেখতে পায়নি। গোটা গ্রাম যেন রোদ, ঝড়, বৃষ্টি মাখামাখি হয়ে মৃত কবরের মত দাঁড়িয়েছিল।

চোখ ফেটে জল আসছিল ধ্রুব-র। বুক দুমড়ে মুচড়ে চুরমার হয়ে গেছিল মুহূর্তে। পাগলের মত দৌড়েছিল নিজের ঘরের দিকে। কতগুলো বাদুড় ঝটাপট করে উড়ে বেরিয়েছিল ঘর থেকে। কতগুলো নিশাচরের চোখ জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে নিতান্ত হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিল। ওরা হয়ত বুঝতে পারেনি ওটা ধ্রুব-র ঘর। ওদের নয়। চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ধ্রুব কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। ধুলোয় মলিন হয়ে যাওয়া মায়ের লেখা খাতাটা বুকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

গেল কোথায় মানুষগুলো?

তাহলে কি লোভের থাবা লেগেছে ওদেরও মনে?

তাই বলে গাঁ শুদ্ধু মানুষ ‘রিসেপ’ ফাঁকা করে চলে যাবে?

এটা হতে পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ আছে। কারণটা যে আছে, সেটা ধ্রুব আরও কিছুক্ষণ বাদেই বুঝতে পেরেছিল। গ্রাম থেকে বেরোবার সময়েই বুঝতে পেরেছিল লোকটার বানানো জন্তুগুলো কী করে যেন তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু করেছে ওদের। ভয়ঙ্কর ভারী পায়ের শব্দ। ওদের জোরালো নিঃশ্বাস। আর জান্তব সেই শব্দ ঘর্ঘর ঘর্ঘর করে ক্রমাগত ফাঁকা গ্রামের আদারে বাদারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মন শক্ত করে আবার ঘন জঙ্গলেই পা রেখেছিল ধ্রুব। বাবা বলতেন,

‘বিপদের সময় মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবি না। কিন্তু প্রকৃতিকে বিশ্বাস করতে দু’বার ভাববি না। প্রকৃতি কখনও তাঁর সন্তানকে ফিরিয়ে দেয় না। ফিরিয়ে দিতে পারে না।’

কথাটা এমন করে কানে বাজছিল ওর। মনে হচ্ছিল বুঝি বা এক্ষুণি বড় আশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো কেউ বলে চলেছে। মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কেউ যেন গাইডের মত জীবনপাঠের দরকারি কথাগুলো বলে ওর বুকে বল এনে দিচ্ছে।

কী অদ্ভুত জীবনের গতি!

গোটা গ্রাম ঘুরতে ঘুরতেই সেদিন ভোর ভোর হয়ে এসেছিল। জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতেই ১০-১২টা রেড পান্ডার একটা দল আগে আগে হেলেদুলে এগোচ্ছিল। একটুর জন্য হলেও বুকটা কেঁপে উঠেছিল ধ্রুব-র। যদি ওরা আক্রমণ করে? যদি মানুষ দেখে ভয় পেয়ে নখ দিয়ে খান খান করে দেয় বুক? তবু সাহস করে এগিয়েই তো যেতে হবে। পান্ডাগুলো ভাল করে হাঁটতে পারে না। দৌড়োনো তো দুরস্থ। এরা আগে মাংসাশী ছিল। এখন প্রকৃতির বিবর্তনে, হয়ত বা নিজেদের শারীরিক সুস্থতার জন্য নিরামিষাশী হয়েছে। চলতে চলতে শুধু বিশেষ ধরণের বাঁশের ইন্টারনোড খেয়ে চলেছিল। কেমন একটা প্রচ্ছন্ন মিল খুঁজে পাচ্ছিল নিজের সঙ্গে। ওই অসুস্থ অবস্থাতে মা লিখে গেছেন, ‘কোভিড-১৯ শুধু অসুখ নয়। আমাদের জীবনের মানদণ্ড বোঝাবার এক কড়া নিয়ম। আমরা যদি এখনও এই মানদণ্ডকে না বুঝি, না বুঝতে চেষ্টা করি, তাহলে একে একে এরকমই রোগ আসবে। শহর-গাঁ উজাড় করে চলে যাবে। সবাই বলছে ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়াতে হবে। তবে ভাইরাস পালাবে। কিন্তু বোকা মানুষ জানে না ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়ানোর জন্য কোনও ইমিউনিটি বুস্টারের প্রয়োজন পড়ে না। সেটা একদিনে হঠাৎ করে গজিয়েও ওঠে না। শিশুকাল থেকে ঘরের রান্না করা সবুজ খাওয়া-দাওয়াই একজন ঝড় ঝাপ্টা সহ্য করা মানুষ গড়ে দিতে পারে। আমি নিজেও বাকি মানুষগুলোর মত একই দলে। তাই...’ কেন বারবার মায়ের প্রতিটা লেখা লাইন এভাবে কণ্ঠস্থ হয়ে আছে ওর? কীভাবে জীবনের প্রতিটা ক্ষণ মা না থেকেও তাঁর বলা প্রতিটা কথা মেনে আছে ও। কারণ জীবন ধ্রুবকে বুঝিয়েছে এগুলোই জীবনের সারসত্ত্বা।

কারণ ধ্রুব জানে জীবনের এই অমূল্য কথাগুলো কোনকালেই হারিয়ে যাবে না। বরঞ্চ ৫০ বছর আগের কথাগুলো সদ্য ফোঁটা পাপড়ির মত জীবন্ত হয়ে থাকবে।

চিন্তা হচ্ছিল। নিজের জন্য নয়। অসুস্থ রিমার জন্য। রিসেপ শূন্য। শহরে যাবে কী করে? নাহলে যে ওদের হাত থেকে...। কিন্তু রিমাকে ছেড়ে কী করে যাবে ও? তাহলে কি এই অসুস্থ পৃথিবীর এক কোণে ঐভাবে কদর্য পশু হয়ে শেষ হয়ে যাবে রিমা?

ধ্রুব এখানে আছে। আছে রিমাও। হ্যাঁ, সেদিন সেই পিশাচের ডেরা থেকে ধ্রুব একা পালাতে পারেনি।

মেয়েটা আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হতে এখনও দেরি। কী করবে ধ্রুব? ওদের শক্তি অনেক। হ্যাঁ, সে শক্তির নাম ‘শয়তানি’। মানুষ ক্রমে অকেজো পঙ্গু হচ্ছে। শারীরিক শক্তি কমে যাচ্ছে। কিন্তু দিন দিন বেড়ে চলেছে মস্তিষ্কের আসুরিক শক্তি।

আধো আধো জড়ানো গলায় কথা বলেছে রিমা। ধ্রুব তার কিছুটা বুঝেছে। কিছুটা বোঝবার চেষ্টা করে চলেছে। ছোটবেলায় রিসেপ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে থেকেই যখন গ্রামে ধ্রুব-র সঙ্গে বল খেলতে গিয়ে মাথায় চোট পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে তখনই রিমার বাবার সঙ্গে পরিচয় হয় লোকটার। তারপর একটু একটু করে চিকিৎসা শুরু করে ওর। সুস্থতার স্বপ্ন দেখতে থাকে রিমার অভিভাবকেরা। একটু একটু করে দুর্বল করে দেওয়া হয় রিমাকে। হাই-ডোজের ইনজেকশন ও ওষুধে মেরুদন্ড, স্নায়ু ও ব্লাড ভেসেলগুলো নিজেদের ক্রিয়া কমিয়ে দিতে থাকে। প্রথম প্রথম কাকপক্ষীতেও ব্যাপারটা টের পায় না। বহুদিন পর রিমার শরীরে নানান অসুস্থতা পরিলক্ষিত হলে বিষয়টা গোচরে আসে। কিন্তু ততক্ষণে বেশ অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। কারণ? ততদিনে রিমা আর অাগের রিমা নেই। শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়ে যায়। রিমা কিছুদিন ধ্রুবকে যোগাযোগ করলেও তাই পরবর্তীতে আর পারেনি।

রাত হয়ে গেছিল। গাছের শক্ত ডালপালা দিয়ে বানানো মাথার ছাউনিতে মাথা বাঁচত ঠিকই। কিন্তু প্রকৃতির এই দুর্দান্ত প্রতিকূলতা ধ্রুব-র মনে একটু একটু করে শঙ্কা জাগিয়ে তুলছিল। এভাবে আর কতদিন? কবে এই জঙ্গল থেকে বেরোতে পারবে ও?

ক’দিন ধরে দিনে রাতে অসম্ভব বৃষ্টি হয়ে চলেছে।

পাতলা একটা ঘর্ঘর ঘর্ঘর শব্দ রিমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল।

একটা পাশবিক শব্দ।

ধ্রুব কি পারবে এই জন্তুসম মানুষগুলোকে ফিরিয়ে আনতে?

রিমা যেমন করে ওকে চেনার চেষ্টা করছে। আইভির বোন, শিরু খুড়োর ছেলেটা, আর ওই যে সুশীল থাপা ওরা...? আবার আগের মত ধ্রুবকে আপন করতে পারবে?

এই বিষ পৃথিবীর বুকে এরাই তো নির্বিষ ছিল। যে করে হোক এদের ফিরিয়ে আনতেই হবে। শেষ চেষ্টা করে দেখতেই হবে ধ্রুবকে। ও যে বাবা-মাকে কথা দিয়েছে।

১০
২০২১, মে

‘আমি জানি, আমি খুব ভালরকম জানি তুমি আমার ছেলেকে ঠিক মেরে ফেলবে। শেষ করে দেবে ওকে। ও অনেক পাপ করেছিল নিশ্চয়ই আগের জন্মে। তাই তোমার ছেলে হয়ে জন্মেছে।’ হাউ হাউ করে কাঁদছিল এক আলুথালু চেহারার তরুণী।

‘চুপ একদম। একটাও কথা বলবে না। আস্তে কথা বলো। যা করছি আমাদের ভালর জন্যই। তোমার দেখতে ইচ্ছে না হলে বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে। আমার কিচ্ছু এসে যাবে না।’

‘কী বললে? আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব? আমার সন্তানকে তোমার হাতে পচতে দিয়ে। তার আগে... তার আগে... তোমাকেই... আমি...’ কথা মাঝপথে থামিয়ে বিশাল মাপের একটা কাঁচের ফুলদানি তুলে তরুণী পেছন থেকে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীর মাথায় আঘাত করতে যায়, ঠিক সেই সময়ই যুবক কী মনে হতে সজোরে ঘুরে তাঁর হাত থেকে ফুলদানি কেড়ে নিয়ে ঠাসিয়ে একটা চড় মারে মুখে। মুচড়ে দেয় তরুণীর নরম হাত। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মহিলার মুখ লাল হয়ে যায় কষ্টে। যুবকও দাঁত ঘষে চিৎকার করে ওঠে,

‘মৌনী?’

মেয়েটা মেঝেতে বসে পড়ে পাগলের মত কাঁদতে থাকে। ফুলে ফুলে ওঠে তাঁর পিঠ, গোটা শরীর। নাক মুখ লাল করে নাক টেনে টেনে তখনও বলতে থাকে,

‘আর কত... কত সহ্য করব রায়? এতটা বয়স হয়ে গেল তাও তুমি বদলালে না? কী মোহে তোমার কাছে এসেছিলাম জানি না। তখন কী জানতাম তোমার... তোমার স্বপ্নগুলো এমন সর্বনাশা হবে? আর তোমার পাপেই আমার... আমার সব কিছু শেষ হয়ে যাবে।’

‘মৌনী তুমি আমাকে বিয়ে থেকেই ভুল বুঝে চলেছ। চারদিকটা তাকিয়ে দেখেছ? মানুষ কতটা অসহায়। তা কি তুমি বুঝতে পারছ না? নাকি না বোঝার ভান করছ? তোমার আমার মত সাধারণ মানুষ হয়ে ওরা কোনওমতেই এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে পারত না। তাইতো চেষ্টা করে চলেছি।’ গলাটা একটু যেন খাদে নামায় যুবক।

‘তুমি আমাকে এত বোকা ভেবেছ রায়? আমি যে তোমার সঙ্গে ঘর করছি। তাই তুমি ঠিক করছ না ভুল করছ সেটাও আমি জানি। আমি জানি ডাঃ ম্যাথুকে তুমিই লোক দিয়ে শেষ করেছ। ইতালিতে গিয়ে যখন বছরখানেক ছিলে, তখনই তোমার অভিসন্ধি টের পেয়েছিলাম। আমার মন অজানা কারণেই ‘কু’ ডাকতে শুরু করেছিল। কিন্তু কী কারণে মানুষটাকে মেরে ফেললে আমি জানি না। জানতে চাইও না। এটা জানি কোনও সর্বনাশের বুদ্ধি তোমাকে পেয়ে বসেছে। শেষ না হওয়া অবধি এর শান্তি নেই। সব কাজই করো তুমি লাভ রেখে। লাভ ছাড়া এক-পাও চলো না তুমি। তুমি যে ব্যবসাদার। তুমি যে একটা পিশাচ। একটা দালাল।’

‘কী বললে? আরেকবার... আরেকবার মুখ খোলো...!’ রায়ের ডানদিকের হাতটা আবারও মহিলাকে লক্ষ করে কাঁধ ছাপিয়ে উঠে গেছিল ওপরে ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় কে যেন সজোরে ঠকঠক করে। হাত নামিয়ে দরজার কাছে গিয়ে আইহোলে চোখ রাখে রায়।

খুব তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে যায় বাইরের লনে।

‘স্যার মেশিনটা ব্যাড সিগন্যাল দিচ্ছে। আপনি ফোন করতে বারণ করেছিলেন। তাই ডাঃ ত্রিপাঠি আমাকেই ডেকে নিয়ে যেতে বললেন।’ নিতান্ত ছাপোষা চেহারার একটা ছেলে এসে কথাগুলো বলে ওঠে।

‘বুঝতে পারছি। একটু তাড়াতাড়ি করে ফেললাম হয়ত।’ নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করছিল রায়।

কথা বলতে বলতে ওরা চলে এসেছিল একতলার কোণের ঘরটায়। একজন কমবয়সী ছেলে ক্রমাগতই পায়চারি করছিল বন্ধ দরজার সামনে। সঙ্গের ছেলেটাকে হাত তুলে কিছুটা দূরে দাঁড়াতে বলে রায় এগিয়ে যায় চিন্তান্বিত মুখের যুবকটার দিকে।

প্রশ্ন করে,

‘কী হল ত্রিপাঠি?’

‘না ... না... আমার হয়ত এই কাজটায় আসা উচিৎ হয়নি। এগ্রিমেন্ট ক্যানসেল করে দিন প্লিজ। আফটার অল আমি একটা ডাক্তার। আমি প্রাণ বাঁচাতে চাই। আর...’

‘বাহ বাহ বাহ ডাক্তার ত্রিপাঠি। আপনি তো দেখছি আমাদের রামকৃষ্ণের বুলি আওড়াচ্ছেন। এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন আপনি ধোয়া তুলসীপাতা? সৌমেনকে দিয়ে যখন ফোন করিয়েছিলাম। তখন তো বেশ রাজি হয়ে গেছিলেন! টাকার গন্ধ বড় গন্ধ তাই না? ফালতু কথা ছাড়ুন তো মশাই। জানবেন কাজ শেষ করা না পর্যন্ত আপনার ছুটি নেই।’

‘কিন্তু...’

‘আর কোনও কিন্তু পরন্তু আমি শুনতে চাই না। সবসময় জেনে রাখবেন, ‘Today it hurts, tomorrow it works!’ হে হে হে তত্ত্বকথা শুনলে আমার আবার তত্ত্বকথা বলতে ইচ্ছে করে। বুঝলেন? চলুন..!’

রায় কিছুটা জোর করেই ডাক্তার ত্রিপাঠীর হাত ধরে ঘরের ভেতরে ঢুকে যান। চিরচিরে কাঁপ ধরা ঠান্ডা আর ওষুধ ওষুধ গন্ধটা ঘরে ঢুকতেই আঁকড়ে ধরে মানুষগুলোকে। চারপাশের নিস্তব্ধতা আর চোখের সামনে ছোট্ট শরীরটার বিকৃত গড়ন দেখে রায়ও হয়ত ভেতরে ভেতরে খানিকক্ষণের জন্য থম মেরেছিলেন। তারপরে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়েই ঘরে থাকা বাকি দুই ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘নিউরোমডুলেশনের ডোজটা আরেকটু বাড়িয়ে দাও। গর্দভের মত দাঁড়িয়ে না থেকে।’

ডাক্তার ত্রিপাঠিও এগিয়ে যায়। বাকি দুজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে কী যেন করতে থাকে। রায় এটা ভালমত জানে মাংসপেশির রোগ মাসকুলার ডেস্ট্রিপ হলেও প্যারালাইসিস হতে থাকে। আর যাই হোক, ‘নিউরোমডুলেশন’ স্নায়ু মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডের সঙ্গে একটা সমন্বয় সাধন করে। যে ইতালীয় যুবকটির শরীর ডাক্তার ম্যাথুর শেষ পরীক্ষা নিরীক্ষা ছিল। ম্যাথু বলেছিলেন তাকেও অনেকটা একইভাবে সবল করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু...

শক্ত চোখে রায় তাকিয়ে ছিল। তাঁর হাতের ইশারায় সমস্ত ব্যাপারটা ঘটছে। কিন্তু তিনি মনে মনে জানেন এরা কেউই রাজি নয়। নিতান্ত পয়সার লালসায় এগিয়ে এসেছে।

এসবের দায় তো রায়ের নয়। ওঁর কাজটা ঠিকঠাক পেলেই হবে। তার জন্য যা করতে হবে। তাই করবে ও।

তিনটে মানুষ অপারেশন টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যারপরনাই চেষ্টা করে চলেছে। তাঁরা জানে তাঁরা কেবলমাত্র সময়ের পুতুল। এই ভয়ানক মানুষের হাত থেকে সহজে রেহাই পাওয়া যাবে না।

এরপরের ধাপগুলো হবে একে একে স্টেমলেস প্রতিস্থাপন, রোবটিক ও স্নায়ু সার্জারির সৌজন্য। আবার কখনও কখনও অনেক বড় বড় ডোজে ইমিউনোসা পেশেন্টকে ব্যবহার করতে হয়। এর আগে কোনোদিনই পৃথিবীর কোনও কোণার বিজ্ঞানী কিংবা চিকিৎসক এই সফলতা অর্জন করতে পারেনি। একমাত্র যে বিদেশি মানুষটা হাজার প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগিয়ে আসছিলেন তিনিও পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তার অজান্তেই তাঁর সফলতার একেকটা সূক্ষ্ম বিবরণ রয়ে গেছে সংসারের ওপর পিঠে ওত পেতে থাকা শ্বাপদের কাছে।

আদৌ মানুষের এই শরীর এমন ট্রান্সপ্লান্টকে মেনে নিতে পারবে?

পারবে নিশ্চয়ই পারবে। রায় অন্তর থেকে সেটা মানে। সেটা বিশ্বাস করে।

তাঁর ছোট ছোট চোখগুলোয় একটু একটু করে দীপ্তি ফুটে ওঠে। দেখতে পায় শরীরটা রেসপন্স দিচ্ছে। সামান্য হলেও রেসপন্স দিচ্ছে।

১১
২০৭৫, সেপ্টেম্বর

রিসেপে আবার ফিরে এসেছে ধ্রুব। আবার সাজিয়ে নিতে পেরেছে ওর ঘরখানাকে। আজ তিন-তিনটে বছর হয়ে গেল। নির্জনতার সঙ্গে সম্পূর্ণ লড়াই করে আবার করে চেয়ার টেবিল গুছিয়ে বসতে পেরেছে ওর ফটোনিক্স কম্পিউটারের কাছে। আবার ধরতে পেরেছে কলম। আবার লিখতে শুরু করতে পেরেছে নির্বিষ পৃথিবী গড়ে তোলার কিছু উপায়।

শুধু নির্জনতা বড় ব্যথা দেয় ওকে। কিন্তু তাই বলে থেমে তো থাকা যায় না। একঅর্থে প্রকৃতিই যেন ওকে এই নিস্তব্ধতা উপহার দিয়েছে; সেই কোন জন্মের সময় থেকে। পাঁচ মাসের গর্ভবতী অবস্থাতেই মা লোপার কোরোনা পজেটিভ ধরা পড়ে। গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি। সেসময় সংক্রামক রোগ থেকে মুক্তির এটাই ছিল উপায়। একটু একটু শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে সন্তানের সংক্রামিত হওয়ার ৯০% শতাংশ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ধ্রুব ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সকলের মুখ খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে। কারণ ধ্রুব কোভিড-১৯ এর ধারক ও বাহক কোনোটাই ছিল না। কিন্তু ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রায় ৮ দিনের মাথায় লোপা পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। রেখে যায় তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তান; আর লেখায় ভরা একটা খাতা। যা একটু একটু করে ধ্রুবকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ‘সবুজ দেখো, সবুজ রান্না করো। তবেই হবে ইমিউনিটি। কোনও ইমিউনিটি বুস্টার নয়।’ মৃত্যুর খানিক আগে পর্যন্ত মায়ের লেখা এই কথাগুলোই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে ধ্রুব। এ নিয়েই একের পর এক লিখে গেছে অনলাইন আর্টিকেল। রোগ থেকে মুক্তির উপায় শুধু ওষুধ নয়, মানসিক জোর আর সঠিক দৈনন্দিন জীবনযাপন একজন মানুষকে করে তোলে প্রকৃত শক্তিমান। সেই আদিম, সেই বনজকে মানুষ সহজে ফিরিয়ে আনতে চায় না। আসলে এই অভ্যাসটাই মানুষ বহু বছর আগে পিছনে ফেলে এসেছে শুধুমাত্র কম সময়ে খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাবে বলে। নিজেদের জীবনকে ঝাঁ চকচকে করবে বলে। তাই আজও অনেকটা দুষ্প্রাপ্য দলিলের মত ধ্রুব-র আর্টিকেল পড়ে মানুষে।

লোপার স্বপ্নে দেখা গ্রামটির সঙ্গে ‘রিসেপে’র এই নেপালি গ্রামটার যেন হুবহু মিল। অনেক খোঁজার পর সৌরীশ, ধ্রুব-র বাবা ছোট্ট ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে কলকাতার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন এখানে। তখন থেকে এটাই তাদের স্থায়ী ঠিকানা, অফুরান অক্সিজেনের পূর্ণ প্রাণ।

‘টুং’ করে একটা মেসেজ এল—

রিমার...

‘এখন আমি আগের থেকে ভাল আছি। সবটাই তোমার জন্য। ঋক আর আমি আলাদা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছি। আসলে ওর পরিবার থেকে আমাকে মেনে নিতে পারলেও আমার শরীরটাকে মেনে নিতে পারছিল না। আমি...’

নাহ আজ আর নতুন করে ধ্রুব-র মনে কোনও কষ্ট জমা হচ্ছে না।

তবু একজনকে তো তার আগের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পেরেছে। এটাই বা কম কি?

আর এটা সম্ভব হয়েছে সেই অদৃশ্য ঈশ্বরের হাত ধরে। যাকে ওর মা-বাবা দুজনেই ‘প্রকৃতি’ বলে ডাকত। যাকে যুগ যুগ ধরে উপলব্ধ করে যেতে হবে। যা গ্রহের সমস্ত প্রাণের অফুরান প্রাণশক্তি।

অসুস্থ রিমাকে নিয়ে রিসেপের অদূরে পাইনের জঙ্গলে থাকতে শুরু করলেও দিন দিন প্রয়োজনীয় খাবার আর প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে আরও দুর্বল হয়ে পড়ছিল ওরা। কিন্তু বাইরে বেরোলেও চরম শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার আতঙ্ক ঘিরে থাকত। এই অবসন্নতার মাঝেই আচমকা একদিন গোটা জঙ্গলে ‘কুল বার্নিং’ শুরু হয়ে যায়। হাঁটু পর্যন্ত উচ্চতার আগুন ভূমিজুড়ে জ্বলতে শুরু করে গোটা বন জুড়ে। সারা জঙ্গলে চূড়ান্ত অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। পশু পাখিরা প্রাণের তাগিদে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। ধ্রুব নিজেও ভালরকম জানত এই আগুন ছোট ছোট ডালপালা থেকে শুরু করে শুকনো পাতার মত দাহ্য উপাদান সবই পুড়িয়ে দেয়। ছাড়ে না প্রাণীকেও। কিন্তু রিমাকে নিয়ে ওই সময়ে বন থেকে বেরোনো খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। দাবানলের আগুন প্রথমে শুষ্ক বনভূমি বা ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ এলাকা থেকে হলেও পাইনজাতীয় সবুজ কচি ডালপালা পোড়াতে বেশি সময় নেয় না। আর কিছু মাথায় ছিল না তখন। মাথায় ছিল না সেসব জান্তবদের কথা, না অন্য কোনও বিপদের সম্ভাবনা, না নিজের জীবনের ঝুঁকি। রিমাকে সাবধানে প্রায় পাঁজাকোলা কোলে তুলে প্রাণের তাগিদেই দৌড়তে শুরু করেছিল ধ্রুব। দৌড়... দৌড়... আর দৌড়! উন্মাদের মত দৌড়। অসহায়ের মত দৌড়। কতক্ষণ দৌড়েছিল জানে না ধ্রুব। জানে গায়ে হাতে সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা করলেও কারা যেন ওকে আর ওর ওপরে ভারী হয়ে পড়ে থাকা আরেকটা শরীরকে ঘিরে ভয়ানক চিৎকার করছিল। কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিল ধরাধরি করে। ধ্রুব চোখ খুলতে পেরেছিল। কিন্তু বাধা দেওয়ার মত আলাদা করে কোনও শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি।

টানা তিনমাস হাসপাতালে থাকার পর বুঝেছিল দাবানলের খবর অনেক আগেই রাজ্য সরকারের কাছে পৌঁছেছিল। ওরাই অগ্নি প্রতিরোধ রাসায়নিক পদার্থ নিক্ষেপ করতে গোটা জঙ্গল ঘিরে ফেলেছিল। আর বন আর লোকালয়ের মাঝামাঝি রিসেপের বিপরীত দিকে অন্য এক পথে ছুটতে ছুটতে এসে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে জ্ঞান হারায় ধ্রুব। সঙ্গে রিমাও।

হ্যাঁ রিমাকে ওই জন্তুগুলোই পশু বানিয়েছে। পশু বানাতে চেয়েছে।

কমলেশ রায়ের পুত্র...

নাহ ওর নাম জানে না ধ্রুব। ওর একটাই নাম হতে পারে, ‘লোভ’। রিমার অসুস্থতার পর পরেই ধ্রুব-র বাবা প্রথমবার ভয়ানক অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। ধ্রুব তখন ছোট, তাই সেসময় সেই বিষয়ের কার্য-কারণ তেমন করে জানতে পারেনি। জেনেছিল অনেক পরে...

মিঃ রায়। পুরো নাম কমলেশ রায়। তিনিই ছিলেন সৌরীশের কলেজে ‘আয়ুস’ নিয়ে আয়ুর্বেদিক পড়াশোনার সময়ের বন্ধু। ধ্রুব-র বাবা বরাবরই ছোট থেকে গাছ গাছড়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করতেন। তাঁর এই ভালোবাসাই প্রতিযোগিতায় দৌড়নো পৃথিবীর কাছে তাঁকে অন্য সমস্ত বিষয় এড়িয়ে ওই পথেই নিয়ে গেছিল। তিনি ভাবতেন এতেই মানুষের সেবা করা যাবে। এ দৌড়ে ফলাফল বেশ শ্লথ। তাই বাড়ির লোক সৌরীশকে আয়ুর্বেদ পড়ায় উৎসাহ দিত না খুব একটা। এর মাঝেই কলেজ ক্লাশে গিয়ে আলাপ হয় কমলেশ রায়ের কাছে। বেশ কয়েকবার সৌরীশের প্রজেক্ট অসৎ উপায়ে হস্তগত করার কারণে দুই বন্ধুর বিবাদও হয়। এর বেশ কিছুদিন ক্লাশ করার পর কমলেশ রায় পড়া ছেড়ে দেয়। বনেদি বাড়ির ছেলে। হাতে অঢেল পয়সা। আর এগিয়ে যাওয়ার অদ্ভুত নেশাই হয়ত কমলেশকে অন্য পথে নিয়ে গেছে ভাবে সৌরীশ।

কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘোরে সবার অলক্ষ্যে। বন্ধু কমলেশের সঙ্গে অাবার দেখা হয়ে যায় রিমার অসুস্থতার সময়েই। কমলেশকে কোনও এক উপায়ে রিমার বাড়ির লোক কলকাতা থেকে নিয়ে আসে। রিমার বাড়ির লোকের শহুরে ডাক্তারের ওপরে বিশ্বাস থাকলেও সৌরীশের কেন জানে না মনে হয়েছিল চিকিৎসার কোথাও নিশ্চয়ই কোনও গোলযোগ আছে। নাহলে সুস্থ হওয়ার বদলে রিমা ক্রমাগত নিস্তেজ হয়ে পড়ছে কেন? বন্ধুর অতীতের খোঁজ খবর শুরু করে দেয়। নিজেই বাচ্চা মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। সৌরীশ রিমাকে ‘ওয়ান্ডার হার্ব’ ছাড়াও আরও কী কী পথ্য দিয়েছিলেন। সৌরীশ চেয়েছিলেন রিমা সুস্থ হোক। কিন্তু গোটা ব্যাপারটায় রিমার বাড়ির লোক ধ্রুব-র বাবার ওপর আস্থা হারিয়ে কমলেশের সঙ্গেই নিয়মিত যোগাযোগ রেখে ‘রিসেপ’ ছেড়ে চলে যায়।

রিমা যে ধ্রুব-র জীবনে ঠিক এভাবে ফিরে আসবে তা ভাবতেও পারেনি।

রিমা পর্দার আড়ালে থাকা বাকি কথাগুলো না বললে সবটা হয়ত পরিষ্কারভাবে জানা সম্ভবও হত না।

হ্যাঁ, কমলেশ রায়ই যোগাযোগ করেছিল ইতালীয় নিউরোসার্জেন ডাক্তার ম্যাথুর সঙ্গে। যিনি ক্রমাগত ২০ বছর ধরে নিরলস প্রচেষ্টা করে গেছেন এক অবিশ্বাস্য চিকিৎসার। পরীক্ষা করেছিলেন চীনের গবেষণাগারে। পরীক্ষা করেছিলেন ইতালির রাজধানী তুরিন থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে মন্তালদো তোরিনেসে গ্রামেও। কিন্তু আংশিক হলেও সম্পূর্ণ সফল হতে পারেননি।

‘হেড ট্রান্সপ্লান্ট’ পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা। একেকটা সার্জারিতে লেগে যায় ২০ থেকে ২৫ ঘন্টাও। কিন্তু ডাক্তার ম্যাথুর এই চিকিৎসায় সরকার থেকে আসে বাধা। ইতালীয় সরকারসহ ইউরোপের নানা দেশ ম্যাথুর অপারেশনে নিষেধাজ্ঞা জানায়,

‘এ ধরণের চিকিৎসা হতে শুরু করলে সমাজের এক শ্রেণীর লোকই বিশেষ সুবিধা পাবে। ফলে অনেক অসৎ উপায় সাধিত হবে।’

সেই সময়ই কীভাবে যেন কমলেশ রায় ডাক্তার ম্যাথুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। উদ্দেশ্য একটাই ম্যাথুকে যেনতেন প্রকারেন নিজের কাজে লাগানো। স্পাইনাল কর্ডসহ মাথার সংযোগ স্থাপন করে এমন একটি মানুষ বানানো; যা সমস্ত ভাইরাসকে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করে বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে। বিপন্ন অভাবী পরিবারে টাকা দিয়ে তাদের সবল শরীর নিয়ে কোনওভাবে ধনী পরিবারের দুর্বল মানুষের মধ্যে জুড়ে দিতে পারলেই উদ্দেশ্য সফল। লাভ লাখ লাখ। কিন্তু এ প্রস্তাবে কোনোভাবেই ডাক্তার ম্যাথু রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু শেষমেষ এক ইতালীয় যুবককে যখন সবার সামনে এনে ডাক্তার পরীক্ষার কথা ঘোষণা করেন। এবং অপারেশনে যুবকটি মারা গেল। তখন দেশ জুড়ে বিপুল উন্মাদনা শুরু হয়ে যায়। সেই সুযোগটাই নেয় কমলেশ।

দীর্ঘ এক বছরের বেশি ইতালিতে কাটিয়ে রায় বন্ধুত্ব করেন ডাক্তার ম্যাথুর বন্ধু জোসেফের সঙ্গে। একে একে সমস্ত চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যাদি তাঁর হাতে চলে আসে। বুকে বল আসে আরও। রায় দেশে ফিরলে বিশ্ব জুড়ে আরেক উপদ্রব শুরু হয় যায়। ২০২০ সাল। কোভিড-১৯। সময়টা কাজে লাগায় কমলেশ। মিথ্যা ফাঁদে ভারতে ডাকে ম্যাথুকে। জনগণের মধ্যে সে সময়ের বিপুল অস্থিরতা। সংক্রমণের ভয়। ম্যাথু মারা যায়। হয়ত কমলেশের সামান্য অঙ্গুলি হেলনেই। স্পষ্ট কোনও প্রমাণ নেই কারুর কাছেই।

এরপর একটু একটু করে কয়েকজন অর্থলোভী মানুষের সহায়তায় এই অপারেশন শুরু করে।

কীভাবে ঠিক কোন উপায়ে তা জানা নেই।

জানা আছে শুধু তাঁর মৃত্যুর পরেও চলতে থাকে এই বিপজ্জনক অপারেশন। হয়ত কমলেশ রায় তাঁর নিজের পুত্রের উপরেও কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। করতে চেয়েছিলেন মানুষের চেয়েও বিপুল শক্তিশালী। কিন্তু প্রকৃতি এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মস্তিষ্কে মানুষ সে থাকে ঠিকই। কিন্তু তার শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ হয়ে যায় লোমশ। পশুসম। বীভৎস।

হয়ত বাবার কাছ থেকে রিসেপের ঘটনাবলী তার জানা ছিল। মনে জমে ছিল ধ্রুব-র পরিবার নিয়ে ঘৃণা...।

আর তাদের সবচেয়ে দরকার ছিল নির্জনতা। ‘রিসেপ’ ছিল তার উপযুক্ত জায়গা।

আর তারপরেই সুন্দর এই গ্রামের মানুষগুলোকে নিজের দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে। এখানেরই জঙ্গলে লুকিয়ে। কমলেশের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেই রিমার চিকিৎসা করত। ক্রমে এর মাঝে পারিবারিক চিকিৎসক হিসাবে রিমার পঙ্গু শরীরেও কিছু অসামঞ্জস্য প্রতিস্থাপন হয়। রিমা বা ওর পরিবার আগে জানতে বা বুঝতে না পারলেও রিসেপের জঙ্গলে যখন কমলেশের পিশাচ বংশধর নিজের ল্যাবরেটরির গড়ে তোলে, তখন কতকটা জ্ঞানে, কতকটা অজ্ঞানে রিমা ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারে।

কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ বার্তা কি কেউ উপেক্ষা করতে পারে?

আইভির ছোট্ট বোন... সুষমা থাপার পোষ্য... রিসেপ থেকে একে একে মানুষ, জীব হারাতে শুরু করে। হয়ত মানুষে মানুষে যোগসাধনে তারা সফল হয়ে উঠছিল না। তাই একের পর এক পশুকেও নিজেদের কাজে লাগাতে থাকে। কিন্তু সৃষ্টি কি স্রষ্টার হাত ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে? যে ম্যাথু মাথা প্রতিস্থাপনে একটি মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের কথা ভেবেছিলেন। কমলেশ রায় ভেবেছিলেন তার উল্টোটাই। তাই হয়ত সবটা অধরাই রয়ে গেল। গ্রামের একের পর এক মানুষ, প্রাণী গায়েব। তাদের বিকট দর্শন মানুষকে বিচলিত করতে থাকে।

প্রকৃতি হয়ত অলক্ষে হেসেছিলেন।

দাবানলের বিপুল অগ্নিগ্রাসে ছারখার হয়ে যায় আগ্রাসী সে মৃত্যুসম কারখানা।

শেষ হয়ে যায় পৃথিবীর বুকে ‘মানুষ’ নামক ভাইরাসের আরেক জঘন্য অপরাধের নিদর্শন।

বুকের ভেতরটা এখনও কেঁপে কেঁপে ওঠে ধ্রুব-র। গোটা ব্যাপারটা মিডিয়ায় জানিয়েছিল সে। দাবালন নিভলে অসংখ্য বন্য প্রাণীর মৃতদেহের মধ্যে ভিন্ন চেহারার কিছু মৃতদেহ চোখেও পড়েছিল তাঁদের। কিন্তু ল্যাবরেটরি? নাহ সেসবের কোনও উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রিমার শরীরের ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশেল ওকে ভিন্ন এক পশুর চেহারা দিয়েছে। তবে একটু একটু করে মন তার আবারও আগেকার সুস্থতায় ফিরছে।

সেই ছটফটে, ধ্রুব-র হাত ধরে থাকা একটা মিষ্টি মেয়ে রিমা। তার প্রিয় বন্ধু রিমা।

নিস্তব্ধ আছে।

প্রকৃতি আছে।

সবুজ আছে। ধ্রুব-র কাছে আছে মা লোপা আর বাবা সৌরীশের পরিণত সুশিক্ষা।

কিন্তু প্রকৃতির পায়ে পায়ে বেড়ে ওঠা সেই মানুষগুলো? ধ্রুব চলে যাওয়ার পর ওরাও কি ভয়ে গ্রামছাড়া হয়েছে?

কিন্তু কোথায়?

ওরা যে শহরের পথ চেনে না।

আচমকা শরীরটা বড্ড অস্থির করে ওঠে ধ্রুব-র।

এখন কি মাঝরাত?

কিছুর যেন একটা শব্দ;

কোথায়...?

স্বপ্ন দেখছে নাতো?

থেমে থেমে... আরও আরও কাছে এগিয়ে আসছে শব্দটা...।

ঘুম চোখে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে।

বিছানা ছেড়ে উঠে, জানলা দিয়ে দূরের জঙ্গলটায় দিকে তাকায়।

মনে হচ্ছে শব্দটা ঠিক ওইদিক থেকেই আসছে।

হ্যাঁ এইবার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।

ঘর্ঘর... ঘর্ঘর... ঘর্ঘর...

ঠিক যেন...।

রিসেপের আকাশের বুকে একটাও তারা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

 

লেখিকার কথা: পৃথিবী বদলাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষগুলোও। যে মানুষ একসময় শ্রেষ্ঠ হয়ে এগিয়েছিল। তারাই ভবিষ্যতের সর্বনাশ। কে বলতে পারে এমন দিনও আমরা দেখতে পাব যেখানে যে মানুষ চকমকি পাথর ঠুকে একদিন আগুন জ্বালিয়ে পশু শিকার করেছিল। সে বড় আয়েশে নিজের প্রজাতিরই ভক্ষণ করছে। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার দৌড়। আমাদের লোভ একটু একটু করে সেই পর্যায়েই পৌঁছচ্ছে। তবে আমরা আশাবাদী, এ আকাশ একই থাকবে। আর সেই আকাশের এক কোণায় থাকবে একটি ‘ধ্রুবতারা’; হ্যাঁ, সে সত্যের দিকে সেই ধ্রুব অনন্তের দিকে তাকিয়েই তো আমাদের পথ চলা।