ছাদ

ছাদ
সুমনা দাসদত্ত

ছাদের উপর থেকে শুনলাম। নীচে অনেক মানুষের, মানুষীর হাসির কলকল শব্দ। নীচে নামতে ইচ্ছে হলো। কতক্ষণ আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। আমি মানুষের কাছে যাব। পা রাখলাম সিঁড়িতে, এক চুমুক… এক চুমুক… করে নামতে লাগলাম। লোভের সিঁড়িতে পা দিলাম। নামলাম একধাপ, তারপর মায়া, অহংকার, হিংসা সব সিঁড়ি তরতর করে নেমে গেছি অনেকটা। এবার আমি আর পা টিপে টিপে নয়, ঢক ঢক করে নামতে শুরু করেছি। অন্ধকার সিঁড়িতে ধাক্কা খাচ্ছি, তাও নামছি। কিছু পরে পায়েরও আর হুঁশ থাকে না। নীচে নামার ইচ্ছে, মাধ্যাকর্ষণের, ঢালুর ঢলানি স্বভাবে নিজেকে গড়িয়ে দিয়েছি। নামছি… নামছি… শুধু প্রথমে একটু ইচ্ছা, তারপর তাকে আর কোনো চেষ্টা দিতে হয়নি, এমনি এমনিই নেমে যাচ্ছি। হঠাৎ ধড়াস করে পড়লাম নীচে। আঃ আঃ চিৎকারে শরীর জানান দিলো নীচে পড়ে গেছি। আছাড় খেয়ে পড়েছি।

আমার শরীরে এতো রক্ত কেন? সারা শরীর জুড়ে এতো ব্যথা কেন? এই ব্যথার ভারে অসাড় হয়ে পড়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। ওঠার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নেই। অপেক্ষা করছিলাম, যে মানুষদের হাসির টানে এলাম, তারা নিশ্চয় আসবে। ঠিক আসবে, আমাকে তুলবে, তাদের হাসির ভাগ দেবে আমাকে। আরো অনেকক্ষণ কেটে গেলো। নাহ্ এলো না কেউ। হাত বাড়ালো না কেউ। শুধু অন্ধকার ঘিরে ধরলো আমায়। শরীরের যন্ত্রণায়, মনের জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠলাম। নিজের ইচ্ছের উপরই নিজের রাগ হলো। কেন এমন ইচ্ছে হলো আমার? এতো অন্ধকার,কিছুই দেখা যায় না। কিছুই দেখতে পায় না। অবসাদে চোখ বুজলাম। চোখ জুড়ে নীল আকাশের স্বপ্ন এলো। মিথ্যে মনে হচ্ছে এখন সব। কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট। অসীম থেকে সসীমে বিচ্যুতির কষ্ট। আবার আমার ছাদ চাই। আবার আমার আলো চাই। আবার আমার আকাশ চাই। সেখানে তো এমন হতো না। কেউ ভানের ভনিতায় ভোলায় নি। সেখানে তো সব স্বচ্ছ। সেখানে তো সূর্য এসে বলতো, আমি সূর্য। আমি রোজ এসে তোমায় আলো দেব। সত্য দেখবে। স্বচ্ছ দেখবে সব। কোনো লুকোচুরি তো ছিলো না। আমি তো সেই আলোতে দেখেছি, আমার প্রজ্ঞা। কেন নীচে নামতে গেলাম। চোখে অন্ধকারের ঠুলি পড়তে। সেখানে তো আকাশ আমায় বলতো, আমিও যা, তুইও তা। তোর ভিতরেও শূন্য। আমি নিজেকে দেখিয়ে বলতাম... উঁহু এটা আমি। হেসে উঠতো আমার কথায়। বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বুঝিয়ে দিতো। এটা শূন্য। তুই ভাবছিস বৃত্ত। মাথা হাল্কা হয়ে যেত... অবাক হয়ে যেতাম। আরে এমনই আমি লিখেছিলাম অনেকদিন আগে,

যাহাই বৃত্ত তাহাই শূন্য দেখতে একই ঠিক
তুমি বৃত্তে পরিবৃত আমি শূন্যে গোল্লাছুট।

হ্যাঁ তো আমি তো শূন্যই। আমরা ছাদে উঠলে সবাই শূন্য। এখানে চাঁদ এসে বলতো, দেখো বাছা… শূন্য তা কতো সুন্দর। আমার তো কিছুই নেই। আলোটুকুও ধার করা। তবুও অন্ধকারকে স্নিগ্ধ করি। তুমিও বাছা ধার করা প্রাণটুকু নিয়ে অন্ধকারে প্রাণ ঢেলো। সেখানে তো কেউ হাসির লোভ দেখিয়ে এতো ব্যথা দিতো না। সেখানে তো রোজ সূর্য একইরকম আলোর ঠিকানা দিয়ে যেত। চাঁদের আলো ঘুম হয়ে আসতো। আকাশ ব্যাপ্তি দিতো। নাহ্ আর কেউ আসবে না।নিজের ইচ্ছে পতনের ইচ্ছেটুকুর গায়ে থুতু ছিটিয়ে উঠে পড়লাম।

না আমাকে উঠতেই হবে। উঠলাম। নিজেকেই নিজে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। কে আমি? আমি কে? কপালে ফোলা, গালে কালশিটে দাগ, মোচড়ানো কব্জি, এত ভাঙ্গাচোরা আমি? আমি তো আলোর মেয়ে ছিলাম। নাহ্ উঠে দাঁড়ালাম। কপালের ফোলায় বরফ কুচি ঘোষলাম। সব রক্ত মুছে ফেললাম শরীর থেকে। আর মানুষের আশা আমি করি না। নীচে নামার ফল আমি পেয়েও গেছি। আবার আমার আকাশ চাই। আলো চাই। মুক্তি চাই। অবসন্ন শরীরকে টেনে তুলে সিঁড়ির রেলিং-এ হাত রাখলাম। জোর করে উঠছি। পারছি না তবুও উঠছি। উপরে উঠতে হাঁপ ধরছে। কষ্ট হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আর কেউ আঘাত করতে পারছে না। না সিঁড়ি, না রেলিং। কোথাও আর ধাক্কা খাচ্ছি না। আর যন্ত্রনা হচ্ছে না। পায়ের নীচে ভেঙে চলেছি সিঁড়ি, লোভ, লালসা, হিংসা, অহং....