পায়ের ছাপগুলো

পায়ের ছাপগুলো
সই


(১)

সাগরের পার ঘেঁষে সেই পুরানো সূর্যকে লালমেঘ চিরে উঠতে দেখব বলে অনেক আগেই প্রায় ভোররাতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম লজ থেকে। আমাদের লজ থেকে ২ মিনিট হাঁটলেই পায়ের নীচে বালি শুরু হয়ে যায়। এই নিয়ে তিন নম্বর বার আমরা গোপালপুরে, ঝাঊবন ঘেরা সমুদ্রে এলাম। আমরা মানে আমি, উজান, রাকা, নীল, অনি, শ্রুতি এই ছয়জনের গ্রুপ। এই নির্বিঘ্ন কাজকর্মের জীবনে বিঘ্ন ঘটিয়ে যখন একসাথে সময় বের করি আমাদের এই দলটা এক ছুটে চলে আসি এইখানে এই গোপালপুরে। নিতাইদার এই লজটা হচ্ছে আমাদের বাঁধাধরা। দোতলা ছিমছাম একটা বাড়ি। আশেপাশের লজ গুলো যেন একটু দূরেই। দোতলার দুটো ঘর নিই আমরা। একটা ছেলেদের জন্য আর একটায় আমরা তিন সখী।

এবছর ২৬শে জানুয়ারি পড়েছিল শুক্রবারে। একেবারে সোনায় সোহাগা! পুরো ২৮ অব্ধি ৩ দিনের জন্য লম্বা ছুটি পেয়ে গিয়েছি সবাই। শুক্রবার খুব ভোরে রওনা দিয়ে একেবারে সন্ধের মুখে পৌঁছলাম গোপালপুরে। নিতাইদাকে সমস্ত বলা ছিল আগে থেকে। সেও সমস্ত ধরনের এরেঞ্জমেন্ট করে রেখেছিল আমাদের জন্য। নিতাইদার লজের রাঁধুনিটি ছিল একেবারে খাসা, নাম ছিল রসিকা। লজে পৌঁছে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিয়ে দোতলার ব্যালকনিতে আসর বসিয়েছিলাম, নিতাইদাও চলে এসেছিল আর সঙ্গে গরমাগরম পেঁয়াজি, মুড়ি আর রসিকার হাতের স্পেশাল চা। রাস্তার ক্লান্তিতে সবার চোখেই ঘুম জড়িয়ে এসেছিল। তাই সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সমুদ্রের গা ঘেঁষে সূর্যোদয় দেখার লোভ আমার চিরদিনের। তাই খুব সকালে সূর্যফোটার আগেই বেরিয়ে পড়েছি ঘর থেকে। রাকা আর শ্রুতি তখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে তাই ওদের আর ডাকিনি। ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখি উজানদের রুম একেবারে আঁটোসাঁটো বন্ধ। একাই বেড়িয়ে পড়লাম নোনাবালি তীর ধরে হাঁটতে। মৌসুমি ভৌমিকের সেই গানটা ভীষণ মনে আসছে “আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীলজল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ...”। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে হাঁটছি সফেন সমুদ্রকে পাশে রেখে। হঠাৎ কেন জানি না ভীষন একা লাগল! নিস্তব্ধ এই বালির তীরে, এই শীত শীত হাওয়াতে একটা চেনা উষ্ণ স্পর্শ চাইছিল ঠাণ্ডায় মোড়া হাতটা। আবার সেই ফেলে আসা স্মৃতি, আবার সেই... নাহ নাহ মনে করব না সে সেই পুরোনো কথা, কিছুতেই মনে করব না। প্রায় একরকম নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করতে করতে হাঁটার গতি অজান্তেই বেড়ে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা গলার আওয়াজ পাশ থেকে ভেসে এল। চমকে উঠলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম অনেকটাই দূরে চলে এসেছি লজ থেকে। আবার ভেসে এল সেই আওয়াজটা।


(২)

“ভেবে ভেবে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করাটা এবার বন্ধ করলেই ভালো হয়, তাই না?”

একটু অস্বাভাবিক ভাবে চেঁচিয়েই বললাম, “কে? কে বলছেন এটা?”

“না মানে একটু ভালো করে তাকালেই বুঝবেন আমি আপনার ঠিক পাশটিতেই আছি। দেখুন একটু তাকিয়ে!” একটু যেন ব্যঙ্গস্বরেই বলে ওঠে আগন্তুক।

পাশ ফিরতেই সত্যিই, দেখি একজন। বেশ লম্বা, বয়স হয়ত ২৫ থেকে ৩০, একটা হুডি পরেছে। দেখে জানি না কেন গা ছমছম করে ওঠে। হয়ত নির্জনতা ভঙ্গ হল বলে কিংবা হয়তো এই সময়ে কাউকে প্রত্যাশা করিনি এও হতে পারে।

একটু থতমত খেয়ে কিছুটা বিরক্তির স্বরেই বলে উঠলাম, “কে! কে আপনি? এখানে, মানে আমার পাশেই বা কেন? আপনি কি সব বলছেন?”

আগন্তুক বলে উঠল, “ওরে বাবা রে! আরে দাঁড়ান দাঁড়ান! এত প্রশ্ন, একসাথে, আরে একটু দম নিয়ে বলবেন তো! একটা একটা করে বলি?”

ভীষণ অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল কেন জানি না। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। দেখলাম আগন্তুক ব্যাক্তিটিও পাশে পাশে আসছেন। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন। “আমি আপনার মতনই একজন, ঘুরতে এসেছি, যেমন আপনিও সমুদ্রের টানে চলে এসেছেন। আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হল, আমি আপনার পাশে পাশে হাঁটছিলাম কিন্তু আপনি আপনার চিন্তায় এতটাই মগ্ন ছিলেন যে বুঝতেই পারেননি। যাই হোক, তা নিজের সঙ্গে এত যুদ্ধ করেন কেন? এতটা কষ্ট চেপে নিয়ে ভালো লাগে একা থাকতে?”

উফফ এত কথা বলে কেন রে লোকটা, একজন অপরিচিতকে এত কথা... একটু কড়া গলাতেই বললাম, “দেখুন, এত কথা বলে নিজের এনার্জি এভাবে ওয়েস্ট করবেন না, ঘুরতে এসছেন ভালো করে ঘুরুন, অন্যের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে নিজের সকালটা নষ্ট করবেন না”।

“আরে আপনি তো চটে যাচ্ছেন, এত রাগ করছেন কেন? তবে রাগলে আপনাকে বেশ লাগে, নাকটা কেমন ফুলে গেছে!” মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলে ওঠে।

“কোনো অপরিচিত ব্যাক্তির উপর আমার কোনো রাগ নেই। এবার আপনি আসতে পারেন।” কঠিন গলায় বলে উঠলাম।

আবার সেই হাসি নিয়ে বলে ওঠে, “তবে অনুরাগ আছে বুঝি?”

আমি প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, “আচ্ছা অসভ্য আছেন তো আপনি। কাকভোরে ঘুরতে এসে মেয়ে দেখে ফ্লার্ট করা শুরু? অবশ্য আপনাদের মত মানুষ আর কিইবা পারবেন?” আমি মুখ ঘুড়িয়ে উল্টো পথে লজের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম, আর বললাম, “আশা করি আর আমার পাশে পাশে চলবেন না।”

“আহা! আরে এত রাগবেন না প্লিজ! আমিতো এমনি একটু মজা করছিলাম। আসলে আপনাকে দেখে আমার অন্য একজনের কথা ভীষণভাবে মনে পড়ে গেল। সেও ঠিক এভাবেই কথা বলত আপনার মত। তাই, একটু... প্লিজ কিছু মনে করবেন না, খারাপ লাগলে রিয়েলই ভেরি সরি।” অনুনয়ের সঙ্গে বলল আগন্তুক।

“দেখুন একজন অচেনা মানুষের সাথে এই ধরনের কথাবার্তা, তাই... আই এম সরি টুউউ।” আমি বললাম, “তা কার কথা মনে পড়ল শুনি? প্রেমিকা?”

“এই তো মেয়েলী কৌতূহল শুরু!” একটা হাসি টেনে বলল সে।

আমি চটপট বলে উঠি, “হ্যাঁ, মেয়েদের কৌতূহলটা একটু বেশিই। বাই দ্য ওয়ে কথাটা আপনি শুরু করেছেন আমি নয়, তাই...”

“আচ্ছা আচ্ছা, হার মানলাম, মেয়েদের সঙ্গে কি আর বাকযুদ্ধে পেরে ওঠা যায়? হাঃ-হাঃ-হাঃ!” একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, “ওর নাম তিয়াশা। প্রেমিকা নয়, আমার স্ত্রী। চার বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর বিয়ে করি। তিয়াশা অনেকটা ঠিক আপনার মত পুরো পাগলি একটা।” হেসে বলতে থাকে।

“দাঁড়ান, দাঁড়ান। পাগল! আপনি বলতে চাইছেনটা কি? আমি কি এমন করলাম যে আপনার এই কথাটা মনে হল, বলুন? বলুন আগে?” আমি বেশ রেগে গিয়েই বললাম।

সেই হাসিটা মুখে রেখেই তিনি বললেন, “এই যে, ঠিক এই কারণেই আপনি পাগলি। আমি কি বললাম যে আপনি এত্ত রেগে গেলেন?”

আমি বললাম, “আচ্ছা, আচ্ছা, ছাড়ুন। আমি কি আর এক্সপ্লেইন করতে হবে না। তার পরে কি হল বলুন?” মনে মনে যেন বললাম ওই পাগলি নামটা শুনলে আমার যে অন্য আর একজনের কথা বড্ড মনে পড়ে। কারণে অকারণে ঝগড়া, আদর, খুনসুটি।

(৩)

“এই যে কি ভাবছেন? হ্যালো! আরে আপনি কোথায় হারিয়ে যান মাঝে মাঝে?” বলল সে।

ঘোরটা ভাঙতে নিজেকে আবার শোধরাই, বলি, “না, না, কিছু নয় তারপর বলুন!”

“তারপর মানে?”

আমি বললাম, “আহাঃ তারপর মানে… বিয়ে হলো তারপর কি হল? আপনাদের গল্পটা তো বলুন।”

দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে সে বলল, “ গল্প আবার কি! সেই সংসার সংসার খেলা। তবে জানেন কি সব গল্পেই একটা করে টুইস্ট থাকে, আমাদের গল্পেতেও ছিল। বেশ চলছিল সবকিছু, হঠাৎ করে এত কাজের প্রেশার বাড়ল! আর বোঝেনই তো প্রোমোশনের জন্য আজকাল কত খাটতে হয় আইটি সেক্টরগুলোতে”।

“সত্যি আজকাল ভীষণ প্রেশার দেয়… কিন্তু কিইবা করার বলুন উপরে উঠতে চাইলে…!” আমি বললাম, মনে মনে ভাবলাম এই কেরিয়ারের জন্য সব শেষ হয়ে গেল, সময় দিতে না পারা, ইগো প্রব্লেম, ল্যাক অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং, এডজাস্টমেন্টের অভাব, সব শেষ করে দিল। সব শেষ!

“আর তারপর থেকেই শুরু হল নিজেদের মধ্যে সমস্যা। জানেন, আমি ভীষণ ম্যানেজ করার চেষ্টা করতাম… বাট আফটার অল আমিও তো একজন মানুষ কতটাই বা পারতাম? সময় দিতে না পারার জন্য রোজের খিটখিট বাড়তে লাগল। তিয়াশার ভীষণ ডিমান্ড ঘুরতে যাওয়া, রেঁস্তোরায় খেতে যাওয়া, শপিং, পার্টি… উফফ আমি আর পারতাম না, অসহ্য হয়ে উঠেছিল সব!” হাঁপাতে লাগল এতটা বলে সে।

আমি বলে উঠলাম, “রিল্যাক্স, রিল্যাক্স! ধীরে বলুন আমি শুনছি।”

“এই সময় হঠাৎ তিয়াশা এসে বলল ও ডিভোর্স চায়, ও পারছে না আমার সাথে সংসার করতে, আমি নাকি ওকে সুখী করতে পারিনি! আমি এইগুলো শুনে জাষ্ট শকড্‌… আমি বারবার বলি, বারবার জানতে চাই কেন ও এরকম আমার সাথে করছে… কিন্তু কিছুতেই ভেঙ্গে বলে না… কিছুতেই না!”, ভীষণ কাঁপা স্বরে আসতে থাকে শব্দগুলো।

আমি জিজ্ঞাসা করি, “তারপর? তারপর কি করলেন?”

আবার বলতে শুরু করলেন তিনি, “আমি দুটো দিন ওর সাথে কথা বলিনি… তারপর ওকে ডেকে বলি যে আমরা যদি দু’জনকে একটু সময় দিই, কোথাও ঘুরে আসি কিছুদিনের জন্য, যদি সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করা যায়… তিয়াশা রাজি হয় তাই আমরা এখানে।”

আমি একটু উত্তেজিত হয়ে বলি, “এটা আপনি খুব ভালো করেছেন, এই চেঞ্জে এসে আপনারা খুব কথা বলুন একে অপরের সাথে। সমস্ত মান-অভিমান মিটিয়ে ফেলুন, আবার একটা ফ্রেশ স্টার্ট করুন… লাইফ সবসময় দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না সবাইকে।” শেষ কথাটার সঙ্গে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল।

“হুম্… আপনি ঠিকই বলেছেন, সুযোগ পেয়েছিল বটে ওরা, একেবারে মোক্ষম সুযোগ।” আগন্তুক ভীষণ তীক্ষ স্বরে বলে উঠল।

“ওরা পেয়েছিল মানে?” বেশ আশ্চর্য হয়েই বললাম কথাটা।

“হুম্-ম...” একটু থেমে আবার বলল, “ওসব ছাড়ুন... আপনার কথা বলুন এবার!”

আমি বললাম, “আমার কথা আবার কি... এই তো ব্যস্ততামোড়া জীবন, একটু ফাঁক পেয়ে বেরিয়ে পড়া নিজের সঙ্গে থাকব বলে... কোনো পিছুটান নেই কোনো বাঁধন নেই... এইতো বেশ!”

“তবুও কি আপনি ভালো আছেন সমুদ্রকে ছেড়ে? আপনি কি ঠিক করেছেন মেহেলি?” বিষন্নভাবে বলে উঠল সে।

“আ-আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার সমুদ্রকে..?” বিস্মিত হয়ে বললাম।

“আপনি বললেন তো আপনার নাম, আর সমুদ্র কি আপনার কাছে থাকে... যতই কাছে যান না কেন সঙ্গে তো থাকে না!” বলল সে।

“আমি আপনাকে কখন আমার নাম বললাম... আমি তো বলিনি... অন্তত আমার সেরকম কিছু মনে আসছেনা!” একটু বিব্রত হয়েই বললাম।

“হ্যাঁ আপনিই বলেছেন... বাট দ্য স্ট্রাইকিং ওয়ার্ড ইজ সমুদ্র! হু ইজ হি? সাম ভেরি স্পেশাল টু ইউ?” বলল সে।

“হ্যাঁ...মানে না... মানে...”,একটু দ্বিধার স্বরেই বললাম, “প্লিজ লেট ইট বি... এই মুহূর্তে ভালো লাগছে না... যদি দেখা হয় আবারও তখন না হয়...”

“দেখা করা অব্ধি অপেক্ষা না করে বরঞ্চ আবার শুরু কর, তুমিই তো বললে আলোচনা করলে সব ঠিক হয়ে যেতে পারে... সেও তো তোমায় ভালবাসে আর ভালবাসা সবসময় ধরা দেয় না কিন্তু।” একটু থেমে আবার বলল, “আজ আর থেকো না, ভীষণ কুয়াশা বাড়ছে, আজ সূর্য উঠলেও তুমি দেখা পাবে না... বাই দ্য ওয়ে আমার পরিচয়টা দেওয়া হয়নি, আমি আকাশ, আকাশ চৌধুরি, সবাই চেনে।”

সত্যি হঠাৎ করে যেন একরাশ কুয়াশা ঘিড়ে এল। খুব কাছের জিনিসও দেখা যাচ্ছেনা। রেডিয়াম ক্লকের ডায়াল বলছে ৪.৪৫। সবে ৪৫ মিনিট কেটেছে। কিন্তু মনে হল যেন…! যাই হোক আমি বললাম, “কাল হয়ত আবার দেখা হবে। আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লেগেছে আকাশ, তিয়াশার সাথে ভালো থাকবেন”।

কোনো উত্তর আসে না। একটু চেঁচিয়ে আকাশকে ডাকি তবুও কোনো সাড়া আসে না। ভীষণ অস্বস্তি বোধহয়। ভালো করে কুয়াশা ঠেলে দেখলাম যে কখন আবার এসে পড়েছি লজের কাছে। লজের গেট পেরতেই দেখি একতলার দক্ষিণ দিকের ঘরে আলো জ্বলছে, কি একটা গুঞ্জন যেন ভীষণ আকর্ষণ করছে। অজান্তেই চলে যাই দরজার কাছে, হাত দিতেই খুলে যায় দরজাটা। আর খুলতেই দেখি, দেখি আকাশের ঝুলন্তদেহ। ভীষণ বিস্ময়ে আমি বাকরুদ্ধ। হতভম্ব ভাবটা কাটার পর গভীর আতঙ্ক চেপে ধরে আমায়। একছুটে পালাতে চেষ্টা করি, পারি না। হাত-পা যেন ভীষণ ভারী হয়ে অবশ হয়ে গেছে। গলা দিয়ে স্বর বেরচ্ছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে। আসতে আসতে চোখের সামনে যেন অন্ধকার নেমে এল। ভীষণ অবসন্ন শরীরে হঠাৎ শুনতে পাই একটা ভীষণ ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত বয়ে যাচ্ছে আর তার মধ্যে একটা খুব চেনা কণ্ঠস্বরে ক্ষীণ হয়ে আসা কিছু টুকরো টুকরো কথা, “ওরা পেয়েছিল সুযোগ… মোক্ষম সুযোগ!... ওরা পেয়েছিল সুযোগ… মোক্ষম সুযোগ!”

(৪)

“মেহেলি...মেহেলি...এই মেহেলি!” রাকা চেঁচিয়ে ডাকে।

“মেহেলি...চ্যাঁচাচ্ছিস কেন? ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিস নাকি?” শ্রুতি বলে।

জ্ঞান ফিরতেই দেখি শ্রুতি আর রাকা ঝুঁকে পড়েছে আমায় দেখতে। মুখটা ভেজা ভেজা। ধড়পড় করে উঠে বসি। দৃশ্যটা মনে পড়তেই চেঁচিয়ে উঠি, “আকাশ! আকাশ ওরকমভাবে! কি করে? পুলিশকে ডাকতে হবে, নিতাইদাকে ডাক!” এক নিঃশ্বাসে বলে হাঁপাতে থাকি।

রাকা আমার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকে, “শান্ত হ... শান্ত হ একটু ... তুই স্বপ্ন দেখেছিস মেহেলি!”

আমি অবাক হয়ে রাকার দিকে চাই, “স্বপ্ন! আমি স্বপ্ন দেখেছি! আমি হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম, একটা ছেলে, আকাশ আলাপ হল, কথা বললাম কতক্ষণ, হাঁটলাম! আকাশ নিজের কথা বলছিল, ওর স্ত্রী তিয়াশার কথাও বলছিল। তারপর সে চলে যায়। আমি লজের সামনে আসতে একতলাতে দেখি...” আর বলতে পারি না আমি। দৃশ্যটা মনে পড়লেই যেন আমার দমবন্ধ মনে হয়।

শ্রুতি খুব আলতো ভাবে বলে, “ মেহেলি তুই একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিস। কোনো কাহিনী হয়তো ভাবছিলি সেই সব নিয়ে। দেখ সবে ৫টা বাজে। আমরা ঠিক করেছিলাম না ভোরবেলা সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটবো আর সূর্যোদয় দেখব”।

আমি কিছুক্ষণ একদম গুম হয়ে যাই। সবকিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর আমি বলি, “চল ঘুরে আসি, ভালো লাগছে না আর ঘরের মধ্যে।”
রাকা বলে, “হ্যাঁ চল। বেড়িয়ে পড়ি। ছেলেগুলোতো কেউ এখনো ওঠেনি।“

শ্রুতি, রাকা, আর আমি বেড়িয়ে পড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি। অজান্তেই চোখটা ওই ঘরটার দিকে যায়। নাহ, কিচ্ছু নেইতো। মনের মধ্যে যেন একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝড় চলতে থাকে। একটু পরেই পায়ের নীচে বালি চলে আসে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা জিনিস দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি। দমবন্ধ হয়ে আসা গলার স্বরে বলে উঠি, “পায়ের ছাপ!”

শ্রুতি আর রাকা আঙুলের নির্দেশ পথে চেয়ে দেখে সত্যিই একজোড়া পায়ের ছাপ প্রায় ওদেরই পথ ধরে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে চলে গেছে।

শ্রুতি বলে ওঠে, “হয়তো অন্য টুরিস্টের”।

রাকা কি যেন বলতে গেল কিন্তু আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলামনা কিচ্ছু শুনতে পারছিলাম না। আবার যেন চোখ ঘিরে অন্ধকার নামতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই সেন্সলেস।

(৫)

মুখটা ভেজা ভেজা, চারিদিকে কথা আর কে যেন একটা মাথায় হাত বোলাচ্ছে। চোখ চাইতে দেখি সকালের নরম রোদ। ব্যালকনির চেয়ারে বসে আমি আর শ্রুতি মাথায় হাত বোলাচ্ছে। রাকা উজান আর নীলকে কি বলছে। অনি যেন ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছে। আর আমার ঠিক উলটোদিকে নিতাইদা বসে কি যেন ভাবছে।

শ্রুতি বলে ওঠে, “কি রে ঠিক আছিস? ভালো লাগছে এখন?”

শ্রুতির কথায় সবাই সম্বিত ফিরে পায়। নীল বলে ওঠে, “বাপরে! কি ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলি।”

আমি সরাসরি নিতাইদার দিকে চেয়ে বলে উঠি, “আকাশ চৌধুরি কে?”

নিতাইদা যেন এইরকমই একটা প্রশ্ন আশা করছিল। খুব শান্ত ও ধীর স্বরেই বলে, “দু’বছর আগে আকাশ চৌধুরি আর ওনার স্ত্রী তিয়াশা চৌধুরি আসেন গোপালপুরেই, আর আমার লজের একতলার দক্ষিণের ঘরটাতেই ওঠে। মেয়েটির বয়স এই তোমাদের মতন আর ছেলেটা হয়ত আর বছর ২-৩ বড় হবে। ২৫শে জানুয়ারি সকাল সকাল ওনার স্ত্রী চলে যায় কিংবা আরো ভালো করে বলতে গেলে তাকে কেউ নিতে এসেছিল। আমি ঘরে সব ঠিকঠাক দেখে তিয়াশাকে কনফার্ম করি। একটা খটকা লাগায় জিজ্ঞাসা করি যে আকাশ কোথায়? তাতে বলে যে আকাশ নাকি কালরাতেই বেরিয়ে গেছে কি একটা দরকারি কাজে অফিস ডেকে পাঠিয়েছে বলে। আসলে আকাশ ছেলেটি বড় ভালো ছিল। স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসত।” গলাটা যেন একটু থমকে যায়, একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, “এরপরে প্রায় ৩-৪ দিন, ঠিক মনে করতে পারছি না, একটা লাশ পাওয়া যায়। মেহেলি যে জায়গাটা বলছে, যেখানে ঝাউবনটা গভীর হতে শুরু করছে সেখানে। এখানকার বাচ্ছারা বালি খুঁড়ে খেলার সময়ই দেখতে পায়। তারপর পুলিশ আসে। আইডি থেকে জানা যায় নামটা… আকাশ চৌধুরি” আবার একটু থেমে বলে, “আমার কানে খবরটা আসায় কৌতূহল নিয়ে থানায় যাই। পুলিশকে জানাই। তারা আমাকে লাশ দেখতে বলে। আমি দেখতে যাই, চিনতেও পারি। পুলিশ জানায় ওকে খুন করা হয় গলায় ফাঁস দিয়ে এবং সেটাও প্রায় অনেকদিন আগেই। আমি পুলিশকে ওর স্ত্রীর ব্যাপারে বলি”।

আমি উত্তেজিত স্বরে বলে উঠি, “তবে কি তিয়াশাই?”

নিতাইদা বলে, “পুলিশের তদন্ত চলে। পরে জানতে পারি পুলিশ তিয়াশা ও রাজীব বলে একটি ছেলেকে ধরেছে।”

আমি বলি, “রাজীব মানে কি যে ছেলেটা তিয়াশাকে নিয়ে যায় ?”

নিতাইদা বলে, “হ্যাঁ। ওই শয়তানটাই।”

হঠাৎ অনি এইসময় বলে, “কিন্তু রাজীবের সঙ্গে কি সম্পর্ক এটা বুঝছি না?”

“রাজীবের সঙ্গেই তিয়াশার অ্যাফেয়ার চলছিল। তিয়াশা চেয়েছিল আকাশকে ডিভোর্স দিয়ে রাজীবকে নিয়ে লাইফ লিড করতে। কিন্তু আকাশ ভীষণ ভালবাসতো তিয়াশাকে তাই যেকোনো ভাবে টিকিয়ে রাখতে চায় বিয়েটা। অজান্তেই আকাশ, রাজীব আর তিয়াশার জীবনের কাঁটা হয়ে ওঠে। আর কাঁটা এলে তাকে উপড়ে ফেলতেই হয়।” একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে আমার কথা বেয়ে।

নিতাইদা বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করে, “তুমি এতকথা জানলে কি করে?”

বেতের চেয়ারটা থেকে উঠে বলি, “আকাশ কিছুটা বলেছিল আর বাকিটা আপনি।”

**************

আমি ধীর পায়ে ঘরে আসি। জানালার ধারে দাঁড়াই। ব্যালকনির ধারে টব সাজান। একটা লালগোলাপ ফুটেছে। আচ্ছা গোলাপ মানে ভালোবাসার প্রতীক। আর গোলাপ কি কখনও কাঁটা ছাড়া মানায়! গোলাপ নিজে একটা বুনোফুল তবুও সে সবচেয়ে সুন্দর। আর ভালোবাসা হচ্ছে আদিম অকৃত্রিম ভীষণ পবিত্র। তিয়াশারা কেন বোঝে না? দূরে তাকিয়ে দেখি সমুদ্রের সেই তীরে এক উচ্ছল আকাশ, মিলিয়ে যাচ্ছে নরম রোদের হাওয়ায় আর সেই হাওয়া নোনাবালি বয়ে এনে দিচ্ছে সমাধির শেষ সোপানে।