নয়-দীয়ার গপ্পো

চতুর্থ পর্ব
নয়-দীয়ার গপ্পো
অলংকরণ - মৈনাক দাশ


মার্চ ২৩, ২০১৫; সোমবার, রাত ১০:৩০

২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো রয়েছে বমি বমি ভাবটা। ক্লোরোফর্ম রন্ধ্রে রন্ধ্রে তীব্রতা ঢুকিয়ে দিয়েছে। রুটির টুকরোটা আর মুখে তুলতে পারলামনা। ইচ্ছেটাও নেই। কাগজটা টান টান করে আরো একবার চোখের সামনে মেলে ধরলাম — “সবই ঠিক আছেক বাবু। লক্ষ্মী ছেল্যার মতো সরে যাও। রাত বড় খতরনক।” পেয়েছি বুকপকেটে। জ্ঞান ফেরার পর। জ্বালা ধরছিল পা-হাতের তলায়। পা ফেলতে সামান্য বেগ পেতে হয়েছিলো বটে। তবু পচা গন্ধ আর কালো জলের ভেজালটা দু-পেয়ে প্রাণীতে এমনভাবে মিশেছে, যেটাকে নিংড়ে না ফেলতে পারলে আমার শান্তি নেই।

ঘর থেকে চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে পা রাখতেই সতীশ দলুই বলেছিল। এমন শরীরের অবস্থায় বাইরে যাবেন না। ক্ষতি হতে পারে। ক্ষতির ভয় করলে এ পেশায় আসতাম না একথা বুঝিয়ে একটা লাঠি জোগাড় করি জীবন ছোঁড়াটার থেকে। লেংচে, খুঁড়িয়ে জোরে জোরে পা টেনে হাঁটতে থাকি। হাঁসখালী যাবো। এ অবস্থায় গাড়ি চালানো মুশকিল। চেষ্টাও করিনি। সময় লাগলেও হাঁটবো স্থির করেই এগোই। পথে একটা রিক্সা পাই।

বিলুর বাড়ি পৌঁছতে লাগে ২০ মিনিট। দাওয়ায় বসে বিলুর মা, বৌ আর মেয়ে। বাবা নেই। কোথায় গেছে বিলু? স্পষ্ট করে জানতে চেয়েছিলাম। সদর যাওয়ার অজুহাতটা এভাবে আর কতদিন চালাবে! রূঢ় প্রশ্নগুলোর উত্তরে নিরুত্তর চাউনি, আমার রাগ বাড়িয়ে দিয়েছিলো দ্বিগুণ। উঠে দাঁড়িয়ে বিলুর মা বলেছিলো। আমার ছেলে ভালো, আমার ছেলে কিছু করেনি। আরো কথা বাড়ালে পুলিশে খবর দেবো বলে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকে। পারদ চড়ছিলো আমার। কয়েকজন প্রতিবেশীকে দেখলাম উঠোনে ঢুকে আসছে। এক মুহূর্তও দাঁড়াইনি আর।

২১ তারিখ ভোরের দিকে অচৈতন্য অবস্থায় আমাকে কয়েকজন নাকি পৌঁছে দিয়েছিল সতীশদার দোকানে। সত্যি, মিথ্যা বিচার করাটা অনাবশ্যক। আমি দেখেছি নিজের চোখেই। আর পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝেছি, আমার ঘোরাফেরা অস্বস্তিতে ফেলছে অনেককেই। সুবীরদাকে ফোন করে জানাই। রাস্তা যে স্মুথ হবে না, তা বারবারই বলেন দাদা।

সহজ গ্রামবাংলা, আর গ্রামবাংলার মানুষ আজ হারিয়েছে। নদীয়ার মাঝদিয়া জায়গাটা আন্তঃসীমানার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ পথে কালোকারবার আর অন্যায়ের অবাধ যাতায়াত। বাঁশবন, শিমুল গাছ, মাঠ, কলাই ক্ষেত, গাবভেরেন্ডার বেড়া ঘেরা গৃহস্থ বাড়িতে অভাবের ফাঁকে ফাঁকে বিস্তার করেছে রোগ। পাপরোগ। নদীতে বিষজল। পাওয়া যাচ্ছে না জীবিকার প্রয়োজনটুকুও। এ নিয়ে জেলেদের মাঝে চরম ক্ষোভ অসন্তোষ দানা বাঁধছে। কেউ কেউ পেটের দায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধ্যরাতে নদীতে মাছ ধরতে বাধ্য হচ্ছে। ফল জরিমানা জেল। ইউনিয়ন তৈরি হচ্ছে। উপায় বাতলাচ্ছে। অশিক্ষিত, অবুঝদের মাথায় হাত বুলিয়ে কাজ সিদ্ধ করছে অনেকেই। এদিকে কতিপয় অসাধু দাদন ব্যবসায়ী ও জেলেরাও বসে নেই। তারা গভীর রাতেই বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ বসিয়ে তুলে নিচ্ছে মাছ। ভ্রাম্যমান আদালত কেবল নামমাত্র।

বারবার মনে হচ্ছে কি ছিলো ওই বাক্সগুলোয়! কিসের ভয়ে ওরা আমার দিকে তেড়ে আসছিলো। অন্ধকারের মধ্যে খেয়ালই করিনি, পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিল কুকুরটা। লেজের উপরেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম ভুল করে। আর তাতেই সমস্ত বিপত্তি।

এদিকে রফিকের ভাই রহমত কালও এসে কান্নাকাটি করে গেছে। থানায় নাকি ডায়েরীই নিতে চায়নি। উল্টে বলেছে রফিক নাকি পাওনাদারদের থেকে বাঁচতে পালিয়েছে, পরিবার ফেলে। সংসারের উপার্জন যখন এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তখন সমস্ত পরিবারের উপর দিয়ে যে কি যায় তা বুঝতে পারছি, হাতড়াচ্ছি সমাধানের পথটা। রহমত বলছিলো, রোজ সন্ধ্যেবেলা ভাইয়ের ডিঙিতে গিয়ে বসে থাকে মা। হয়তো কোনোদিন কখনো ফিরবে ছেলে এই আশায়।

একনাগাড়ে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের ব্যথাটা চিনচিন করছিলো। মোটা কাপড়ের ব্যান্ডেজটা খুলে দেখেছি। লাল ওষুধে সাদা কি একটা মলম লাগানো। চারটে ধারালো গর্ত, লালচে রক্তে পূর্ণ। টিটেনাস নিতে যেতে হবে। যাতায়াতের পথে চোখে পড়েছিলো ‘শমীক’ দাতব্যলয়ে। আলাপ হলো সরকারি চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাসের সাথে। প্রায় ১০-১৫ জন লাইনে দাঁড়ানো। জিজ্ঞেস করেছিলাম ভিড়ের কারণ। এখানের মানুষ শুধু জীবিকাই হারায়নি, হারাচ্ছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় রসদটুকু। লাইনে দাঁড়ানো প্রায় সকলেই এসেছে হাতে, পায়ে কালচে দাগ চুলকানি নিয়ে। অরিন্দম বাবু বললেন এমনটা নতুন নয়, একবছর যাবৎ চলছে এলাকায় এই চর্মরোগ। চূর্ণীর জলে স্নান কিংবা নিত্যকর্মের ফলে এই রোগ দেখা দিচ্ছে ঘরে ঘরে। জীবনের মায়ের কথা শুনেছিলাম ওর মুখে। তখন বুঝতে পারিনি এর গভীরতা কোন অতলে। এমনকি পেটের সমস্যাও হচ্ছে। রোজই গড়ে ১০-১২জন রুগী আসছে। সমাধান! স্বাস্থ্য আধিকারিকরা স্নান করতে নিষেধ করছে জলে। কিন্তু জীবিকার জন্য নদী ব্যতীত উপায় আর কি আছে। এর প্রতিবাদে মাঝদিয়া সহ সংলগ্ন এলাকায় অধিবাসীরা বরাবরই সরব ছিলেন। শেষমেষ ‘নদী রেসকিউ’ কমিটিও গড়ে উঠেছে।

‘মৎস্য ধরিব খাইবো সুখে’ বাঙ্গালীর প্রবাদ যেন শুলে চড়ে ঝুলে আছে ফাঁসিকাঠে। প্রশাসন তো প্রহসন। এসবই একের পর এক তুলে ধরেছিলেন ‘নগরদর্পণ’ পত্রিকার সম্পাদক রবীনবাবু ও তাঁর কর্মীরা। হাতে নাতে সেসবের ফলও পেতে হচ্ছে। দপ্তরে অনেকেই আর কাজ করতে চায় না ভয়ে। ভয়টা জোঁকের মত জড়িয়ে আছে সমাজে, জীবনে, যাপনে। সেদিন ফোনে বলছিলেন তিনি নিজেও একদুজনকে অবিশ্বাস করেন। দপ্তরের খবর কেউ হয়তো বাইরে দেয়। নাহলে এতবড় ষড়যন্ত্র হয় কি করে! সেটা আমিও বুঝি। বিশ্বাস শব্দটা খুব ক্ষণস্থায়ী। নাহলে বিলু এমনটা করে কীভাবে, কোন সাহসে! এত বড় নাটক! তবে নাটকের শেষ অঙ্ক দেখার জন্য আমি থাকবো। থাকতে আমাকে হবেই।

মার্চ ২৪, ২০১৫; মঙ্গলবার, রাত ১১:২২

খবরটা এসেছিল ভোরের দিকে। এমন একটা আশঙ্কা আমারও মনে উঁকি দেয়নি, তা নয়। সবাই ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল সামনে। এমন অবস্থায় যেমনটা হয়ে থাকে। কৌতূহল আর আগ্রহ যেন সাধারণ অবস্থার তুলনায় বেড়ে যায় শতগুণ। গন্ধে নাকে রুমাল দিলাম। মৃত বেশ কয়েকদিনের। আরো একবার মুখোমুখি হলাম মাঝদিয়ার পুলিশ সুপারের। চোটপাট নিচ্ছিলেন গেঁয়ো মানুষগুলোর উপর। বডি তোলবার সাথে সাথে আমিও পিছু নি পুলিশের। স্থির করে নিয়েছিলাম আজ আমি ওনার সাথেই থাকবো। কেমন ব্যবস্থা নেন দেখবো। উঠে পড়ি জিপে। গুটখার মশলায় বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিতে দিতে বলেছিলেন, নেশা করে কোনো জেলে হয়তো ডুবেছে আর কি! আপনারা মশাই, দয়া করে এটার কোনো রাজনীতির রং চড়াবেন না। এদের পেটে ভাত না পড়লেও, ফূর্তি বন্ধ থাকে না।

কিন্তু উপরোক্ত দু-দুটো কারণই আমার যুক্তিতে তেমন মিলছিলো না। প্রথমতঃ, মৃতের হাতে, পায়ে দাগ কালচে হয়ে কালশিটে পড়ার মতো হয়ে রয়েছে। নিহত হওয়ার আগে ভারী কোনো আঘাত আটকানোর চেষ্টা বা কোনো কিছুর সাথে ধস্তাধস্তি হওয়ার লক্ষণ। দ্বিতীয়তঃ, করোটি গুঁড়িয়ে ঘিলু প্রায় বেড়িয়ে এসেছে। মগজের গ্রে-ম্যাটার আর হোয়াইট ম্যাটার লাল রক্তের সাথে মিশে চাপ চাপ হয়ে লেগে। বোঝা দায় মৃতদেহটা কার! বাকি শুধু ময়নাতদন্ত। রানাঘাটের বড়বাজার এলাকায় চূর্ণীর চৈতন্য ঘাটে, কাপড় কাচতে এসে বাড়ির মেয়েরা মৃতদেহটা প্রথম দেখে। খবর ছড়িয়ে যায় গোটা এলাকায়।

ছুটে আসে রফিকের বাড়ির লোকও। অজানা আশঙ্কায় কেঁদে উঠেছিলো রফিকের মা। সকলে ধরেই নিয়েছিলো এটাই হয়তো রফিকের মৃতদেহ। অদ্ভুত লাগছিলো গোটা ঘটনাটায়। রফিক যদি মৃত হয়েও থাকে কে বা কারা আর কেনই বা মারবে তাকে। রহমত চোখ মুছতে মুছতে বলছিলো, দাদার কোনো শত্রু ছিলোনা। কোথাও ধার ছিলো বলেও ওর জানা নেই।

থানার আদরটা একেবারে শ্বশুরবাড়ীর মতোই। গৌতমবাবু রহমতকে বললেন, তোর দাদা ডুবে মরেছে। নেশা করেছিলো। রোজগার মন্দা থাকায় তোরাই ডুবিয়ে মেরেছিস। গালিগালাজ যেন বৃষ্টির মতো চলছিলো লাগাতার। মৃতদেহের পোশাক একেবারেই রফিকের। রহমত এটা বলার পর থেকে, যুক্তির খাঁড়া আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় প্রশাসনের। তাই বাড়ির লোকের কাছে অবিশ্বাসের আর কোনো জায়গা ছিলোনা। মর্গ থেকে বডি ছাড়তে রাত হয়ে যাবে, তাই আমাকে ফিরতে বললেন গৌতমবাবু। কোনোমতে আমি সরলে একটু হালকা বোধ করেন এই আর কি।

থানা থেকে মর্গে ঢু দিয়ে বেরোই দুপুর ২টোর পর। পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছিল। ছাউনি দেওয়া হোটেলে খেতে খেতে ভেবে নি কোথায় যাবো। ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় খাওয়া শেষ করে পা চালাই সেইদিকে। আধখোয়া রাস্তা আর দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ সজোরে নিঃশ্বাস ফেলছে গ্রামগুলোর উপর। কিছুদূর গিয়েই দেখি উত্তপ্ত হাওয়ায় মাঠের উপর ছড়িয়ে থাকা শুকনো ঘাস কাঠকুঠোদের পাক দিয়ে তুলে মাঠময় ঘুরে বেড়াচ্ছে বায়ুকুণ্ডলী হয়ে। এ অঞ্চলে একে বাউলী বলে। মনের তোলপাড় মিশেছে প্রকৃতিতে। আমি এগিয়ে চললাম সেই পথ ধরে যেপথের ধুলোমাখা গন্ধটা আমার খানিক চেনা হলেও, সে পথের মানুষগুলো অচেনাই।

ঠিক যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই মুদিখানার ঝাঁপ হাফ নামানো। দুপুরের খাবার খেতে গেছে দোকানদার। রাতে স্পষ্ট চিনতে না পারলেও, পর পর ঘটনাগুলো ছবির মতো। চোখ বন্ধ করে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াই। এখান থেকে খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট। জোরে জোরে পা ফেলে, প্রায় দৌড়ে যে বাড়ীটার সামনে আসি সেটা একটা কংক্রিটের দোতলা বাড়ী। উঠোনের একপাশে পাশাপাশি ২টো টালির ঘর। দরজা বন্ধ। বাড়ীটা খুব বেশি হলে বছর দশেকের পুরোনো হতে পারে তার বেশী নয়। কার বাড়ী এটা? লক্ষ্য রাখতে হবে। বিপরীত চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে চারবার চা খাই। তিনঘন্টা হয়ে গেছে। তেমন কেউ বাইরে আসেনি। ঢোকেও নি কেউই। দোকানের আড্ডায় মিশে জানতে পারি বাড়ির মালিক দামোদর বেড়া। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কর্মচারী ছিলেন। আর্থিক অস্বচ্ছলতা নেই বললেই চলে। দুই মেয়ে। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বুড়োবুড়ি একাই থাকে। খুব ভালোমানুষ। গ্রামবাসী কেউ যদি কখনো কোনো বিপদে পড়ে, ফিরে যেতে হয়না এনার বাড়ি থেকে। বলতে বলতে দুজন গ্রামবাসীর চোখ ছলছল করে উঠলো দামোদর বেড়ার গুণগানে। তবে এতগুলো কথার মাঝে অন্য কোনো ব্যক্তি ভাড়া হিসাবে থাকে কিনা সেটা ঠিক জানা গেলোনা। তবে চারটে দেশী গরু আছে। গ্রামের দিকে এমনটা থাকেই। কর্তামশাই-এর শরীর ভালো না থাকায় মাঝে মধ্যে কিছু লোক রাখেন। হঠাৎ পকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেট করতে শুরু করলো। সারস্বত চৌধুরী। নদী রেসকিউ কমিটির প্রধান। আমার একটা সই লাগবে। তাই ওনাদের অফিসে যেতে বলছেন। আবেদন জমা দেবেন কেন্দ্রে। মূল বক্তব্য ওজন বাড়াতে জার্নালিস্ট-এর স্বাক্ষর চান। তাতে ওনাদের ওজন বাড়লেও, গ্রামবাংলার দূষণের ওজন কমবে বলে তো আমার মনে হলোনা।

আজ মনটা বড় অস্থির হয়ে আছে। সত্যি কি রফিক ওটা? যদি হয় তবে কি করে? কি দোষ করেছিলো ও! আর যদি নাহয় তবে কে! বিলু কোথায় লুকিয়ে ? বাক্স নিয়ে ওই লোকগুলো কি নিয়ে বচসা করছিলো!

মার্চ ২৫, ২০১৫; বুধবার, রাত ৯:৪৫

আবেদনপত্রের প্রথম পয়েন্টেই মৃত রফিক মোল্লার পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবি। মৃতদেহ রফিক মোল্লারই কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার আগেই সারস্বতবাবু লিখে ফেলেছেন। আজকাল একজনের মারা যাওয়াটা অন্যের ফ্রেম হওয়ার একটা রেসিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোকজনের মুখে শুনছি, এই কমিটির দেখা মেলে নির্বাচনের সময়ই কিংবা রাজনৈতিক কোনো ইস্যু দেখা দিলে। নয়তো সারাবছর আর্থিক অনটনে জর্জরিত জেলে পরিবারগুলোকে ফিরেও দেখেনা এনারা। সারস্বতবাবু সার সত্য বুঝেছেন, রফিক অভাব অনটনের জ্বালায় আত্ম-হনন করেছে। আর এর জন্য ধর্ণায় বসবেন তিনি। রাজ্য সরকার এমনকি প্রয়োজনে কেন্দ্রেও। শুধু আমাকে হেডলাইনে ওনার কমিটিকে একটু হাই-লাইট করে দিতে হবে। প্রাসঙ্গিক কথোপকথনে চোখ চলে যাচ্ছিলো ওনার ড্রয়িংরুমে। মাঝদিয়ায় এমন উচ্চবিত্তের বসবাস চোখ টাটায় বৈকি। হালফ্যাশনের পেন্টিং থেকে দামি গালিচা সবই রয়েছে। আমার মনোভাব হয়তো আন্দাজ করেছিলেন তিনিও। একটু ভণিতা গাইলেন। পিতা কোনো বিদেশি কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন তাই কৃতিত্বটা তাঁরই।

সইটা ঝুলিয়ে রেখে বের হই রফিকের বাড়ির দিকে। সান্ত্বনা নয়, একটু সাহস। রফিকের ভাইয়ের মতো আমিও মেনে নিতে পারছিলামনা ওর এই মৃত্যু। শুধু পোশাক দেখে একটা মানুষকে কিভাবে চেনা যায়। যতটা দেখেছি ওকে তাতে ওর মনের জোর ছিলো সাংঘাতিক। বলতো, পুকুর ইজারা নিয়ে আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করবে। বউ গর্ভবতী। তাই ওকে তো ভাবতেই হবে। তাই আত্মহত্যার বিষয়টাও ভিত্তিহীন লাগছে। চৌকাঠ জুড়ে বিষণ্নতা। টালির চালে লতানো লাউয়ের ডগা। জড়িয়ে জাপটে ধরে আছে ঘরটাকে। উঠোনে বসে ওর স্ত্রী। আমাকে দেখেই ঘরে উঠে যায়। রহমত আরো দুজন ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। আমি ওর ঘরটা দেখতে চাই। জীর্ণ ইঁটের পরতে পরতে অমোঘ এক দৈন্যতা যেন ফুটে উঠছে গোটা দেওয়ালে। চারপায়া দড়ির খাটের নিচে একটা বাক্স নজড়ে পড়ে। দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করি। জামাকাপড়ের ফাঁকে ভাঁজ করা কিছু কাগজ। ওদের অনুমতি নিয়ে কাগজটা হাতে নিতেই দেখি, তাতে নগদ প্রায় ৩০,০০০ টাকা ধার নেওয়ার রশিদ কাটা। তারিখ দেওয়া রয়েছে ১৬ই মার্চ। অর্থাৎ ওর নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন। বিনিময় দুটো মকরবালা। রহমতকে জিজ্ঞেস করি, এর মধ্যে ও কি কোনো টাকা ধার নিয়েছিলো! তেমনটা স্পষ্ট করে ওরা কেউই বলতে পারলোনা। রফিকের স্ত্রীও এ সম্পর্কে কিছু জানেনা। তবে মকরবালা যে সত্যি নেই বাড়িতে সেটা দেখে এসে সকলে নিশ্চিত করলো। স্ট্রেঞ্জ! আরেকটা কাগজ খুলে দেখি, একটা স্মারকলিপি। তাতে মৎস্যজীবীদের আর্থিক অনুদানের বিস্তারিত কিছু তথ্য লেখা আছে। কেমন যেন ঘোঁট পাকিয়ে যাচ্ছে।

রফিকের ভাইকে বললাম, কাল এ তল্লাটের দাদন ব্যবসায়ী বা টাকা ধার দেয় এমন লোকের কাছে নিয়ে যেতে। রাজি হয় ওরা। শিবনিবাসের দুজন এমন লোকের কাছে ওরা প্রয়োজনে কখনো যেত। তবে সুদ এত চড়া যে, বাঁধা দেওয়া জিনিষ পাওয়া তো যায়ই না উল্টে জমিজমাও বেহাত হয়ে যায়। তাই ওদিক আর ওরা মাড়ায় না। কাগজে কোনো সই বা নাম লেখা না থাকায় বোঝা যাচ্ছেনা রফিক ঠিক কার কাছ থেকে টাকা ধার করেছে। আর একটা বিষয় স্ট্রাইক করছে, টাকা যে রফিক ধার করেছিলো সেটা সম্পর্কে পুলিশই বা এতটা শিওর হয়েছিলেন! ফেরার পথে ফোন করি গৌতম রায়কে। যেন আমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন, মৃতের মুখের বিকৃতি ঘটিয়েছে নদীর তলদেশের কোনো জলজ প্রাণী। আর হাত পায়ের আঘাতগুলো নাকি নেশা করে পড়ে গিয়ে থাকবে। বললেন, আমার কলকাতা ফেরার আগে একদিন জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে। আমার সঙ্গে আলাপটা তেমন জমেনি। ভোলবদলের আরেক নাম গৌতম রায়। কলকাতা ফেরানোর কত ইশারাই না করছেন। আহা! সন্ধ্যে নাগাদ অভিরূপকে জানাই সবটা। আমার ক্লাসমেট। মেধাবী, ইয়ারদোস্ত। আমার এই জ্বালাতন দেখা হলে সুদে আসলে উশুল করবে বলেছে। WMC(পশ্চিমবঙ্গ মেডিকেল কমিশন) উচ্চ্পদস্থ পদে কর্মরত। রফিকের ব্যাপারটা বলে থানা, উপজেলার নাম, ডিটেইল জানাই। খবর পাবো কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। আশা রাখি কালকের দিনটা একটু হলেও অন্যরকম হবে।

মার্চ ২৬, ২০১৫; বৃহস্পতিবার, রাত ১০টা

ইতিমধ্যে তিনটে জায়গা ঘোরা হয়ে গেছিলো, শিবনিবাস হাঁসখালী জুড়ে। আজ পায়ে হেঁটে যায়নি। বিশেষ সময় লাগেনি তাই। নাহ, কারুর কাছেই গত কয়েকদিনে রফিক এসেছিলো বলে জানা গেলোনা। বিষয়টা শুধু আবছা জমাট বেঁধে থাকলো মাথার চারপাশে। অভিরূপ রাতে জানিয়েছিলো, মৃত ব্যক্তির আঘাত ছিলো পায়ে, ডান হাতে গুরুতর। গলা টিপে শ্বাসরোধ করে প্রথমে খুন করা হয়। তারপর ভারী ওজনের কিছু চাপিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয় মুখ, মাথা। করোটি তাই গুঁড়িয়ে গেছে অনেকটা অংশ জুড়েই। খুনি পেশাদার না হলে এমনটা করা সম্ভব নয়। রিপোর্টের একটা স্ক্যানও, মেইল এ পাঠিয়ে দিয়েছে। এত কিছু জানার পর, মিথ্যেগুলোকে মেনে নেওয়া যায় যায়না। প্রকাশ আমি করবোই।

এদিকে চূর্ণীর জলের দুর্গন্ধে অসুস্থ হয়ে পড়ছে কাছাকাছি গ্রামের লোক। ভিড় বাড়ছে সরকারি হাসপাতালে। মাঝে মাঝে দূষণ নিবারণের রব তোলে কমিটি ও সংসদগুলো। তারপর সময় বাড়ার সাথে সাথে ঝিমিয়ে যায়, থিতিয়ে পড়ে সমগ্র কার্যকারিতা। একে অপরের গায়ে কাদা ছোঁড়ে। তলিয়ে যাচ্ছে সমাজ।

গত সপ্তাহে চূর্ণী নদীর জল সংগ্রহ করে, তা বোতলজাত করে পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে। সামাজিক সংস্থা ‘প্রাণ বাঁচাও, জল বাঁচাও’- কারখানা থেকে বর্জ্য আসা ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনার আর্জি জানিয়েছে বাংলাদেশের প্রশাসনকে। এই মর্মে নদীয়া জেলার পরিচালন সমিতি(NDAPS)-এর প্রতিনিধিরা ভারতের মন্ত্রিমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কারখানা থেকে ক্রমাগত বর্জ্য পদার্থ নির্গত হয়ে তা নদীতে পড়ার অভিযোগ ওঠার পরই গত বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনাল (এনজিটি)-এর পশ্চিমাঞ্চল বেঞ্চ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক নির্দেশ দেয়। নির্দেশে বলা হয়, কারখানাগুলো থেকে বর্জ্য পদার্থ বের হয়ে তা যাতে নদীর জলে না মেশে তার ব্যবস্থা করা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সহমতের ভিত্তিতে ভারত সরকারের অর্থায়নে একটি ‘ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ স্থাপনের কথা বলা হয়। যদিও এখনো পর্যন্ত সেই প্রক্রিয়া একটুও এগোয়নি। এখনকার গ্রামবাসীদের অভিযোগ বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্তবর্তী শহর দর্শনায় অবস্থিত ৮০বছরের পুরনো সুপার এন্ড কোম্পানির তিনটি ইউনিট আছে। বছরের পর বছর ধরে এই কারখানা থেকেই বের হওয়া বর্জ্য পদার্থ পড়েছে মহানন্দা নদীতে। পরে সেটাই মিশেছে চূর্ণীতে। দূষিত হচ্ছে জল। তবে গত কয়েক মাসে এই দূষণ অত্যধিক বেড়েছে। নদীর ধারে বাস করা প্রায় ৬ লাখ মানুষ ও ৫০০০ মৎস্যজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতি বছর কয়েক টন মাছ মারা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে জঘন্য এক পরিস্থিতির শিকার মানব ও মানব সমাজ।

(ক্রমশঃ)