একটি প্লাবনের ইতিবৃত্তকথা

একটি প্লাবনের ইতিবৃত্তকথা
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
অলংকরণ - মৈনাক দাশ


(এ লেখায় লোকজনের নামধাম বদলে দিয়েছি)

“গত শুক্রবার গঙ্গার জল বেড়ে মানিকচকের গোপালপুর এলাকায় বাঁধ ভেঙে জনবসতি অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। ডুবে গেছে ১৫টি গ্রাম। জল বইছে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। ক্রমাগত বর্ষণে ডুবে গেছে মানিকচক, রতুয়া, হরিশ্চন্দ্রপুরের বেশ কিছু জনবসতি। সেচ বিভাগের কার্যনির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার শ্রী-----”

মানুষের নামগুলো বদলায়। বদলায় ১৫, ২৫ এই সংখ্যাগুলো। গোপালপুর কখনো হয়ে যায় ভুতনির চর, কখনো ইংলিশবাজার। গল্পটা কিন্তু একই থাকে। ২০১৩ সালের এই নিউজ রিপোর্টটা পড়ছিলাম আমার ট্যাবে খবরের কাগজের ইন্টারনেট এডিশনে। এর বাইশ বছর আগে প্রায় এই একই রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম রাইটার্সে। টেলিগ্রাফিক মেসেজে। প্রযুক্তি বদলেছে। আমি বদলেছি। বদলায়নি ওই মানুষগুলোর কপাল। ডেভেলপমেন্ট কাকে বলে কে জানে!

| ১ |

১৯৯১ সাল। বাড়ি ছেড়ে ২৫ বছুরে তরুণ মালদা গিয়ে ঠেকেছি জীবিকার তাগিদে। রাজ্যসরকারের সদ্যোনিযুক্ত আমলা। তখনো প্রবেশনের মধুচন্দ্রিমায় বুঁদ। খাইদাই অফিস যাই, হাতেকলমে কাজকর্ম শিখি গুরুজনদের সস্নেহ তাগিদে। দায়দায়িত্ব নেই বিশেষ। পরিসংখ্যান নিয়ে একটা সর্বভারতীয় পরীক্ষা দেয়ার জন্যে পড়াশোনা করছি জোরকদমে। এমনি একদিন কল্যানিতে মাস্টারমশাইয়ের কাছে আসব বলে শুক্কুরবারে সি.এল নিয়েছিলাম। পরীক্ষার তখন দিন কুড়ি বাকি। ডি.এম সাহেব লোকটি ভালো। বলে দিয়েছেন, কেরিয়ার অ্যাডভান্সমেন্টের জন্যে ছুটি কোন সমস্যাই নয়।

সেটা বর্ষাকাল। বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টি নামলো। সে দিন গিয়ে পরের দিনও সে বৃষ্টির বন্ধ হবার কোন লক্ষণ নেই। শুক্কুরবার একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের মকদুমপুর ডাকবাংলোর সামনে এক হাঁটু জল জমে গেছে। এক বছরের সিনিয়র প্রবেশনার অনিমেষদা সেইদিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বললো, “তৈরি হয়ে যাও হে। লক্ষণ ভালো নয়। শুভ্ররা তো কালিয়াচকের দিকে অলরেডি রওনা হয়ে গেছে।”

“ভাল নয় মানে?”

“ভালো নয় মানে ভালো নয়। হরিশ্চন্দ্রপুরের বিডিও-দার সঙ্গে কথা হল সকালবেলায়। ডি.এম ডেকে পাঠিয়েছিল। এক ফাঁকে ডাকবাংলো থেকে ঘুরে গেছে এসে। ফুলহার ফেঁপেছে বলে গেল। বিপদসীমার পঁচিশ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে জল বইছে। গঙ্গাও অলরেডি বিপদসীমা ছুঁয়েছে। রিং ড্যামে বালির বস্তা ফেলবার কাজ শুরু হয়ে গেছে ওদিকে। যা বৃষ্টির রকম দেখছি তাতে এইবারে না ধরলে আজকের দিনটা কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। সকালে উঠে মহানন্দার দিকে গেছিলাম হাঁটতে হাঁটতে। গিয়ে দেখে এসো একবার অবস্থাটা।”

একটা ছাতা মাথায় দিয়ে অভিরামপুর বাঁধ রোডে উঠে চমকে উঠলাম। মালদা টাউনের একটা দিককে ঘিরে দাঁড়ানো উঁচু বাঁধরাস্তাটার তলা দিয়ে ফুলে ফেঁপে যে জলধারা চলেছে তার সঙ্গে আমাদের এতদিনের চেনা শান্ত মহানন্দার কোন মিল নেই। সেই প্রথম নদীর গর্জন শুনেছিলাম। চাপা, গম্ভীর একটা একটানা শব্দ উঠে আসছে ছুটন্ত জলের ভেতর থেকে। শুনলে ভয় লাগে।

ন'টা নাগাদ অফিসে পৌঁছে পরপর দুটো সার্কুলার পেলাম। একটা সংক্ষিপ্ত। তাতে আগামী পনেরোদিনের জন্য সমস্ত আধিকারিকের ছুটি বাতিল আর সেই সঙ্গে প্রত্যেককে তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের জন্য একই নির্দেশ দেয়ার আদেশ। অন্যটা বেশ লম্বাচওড়া। তাতে আগামী পনেরোদিনের জন্য সমস্ত আধিকারিকের ডিউটি রোস্টার। কন্ট্রোল রুম থেকে ত্রাণকার্য—হাজারো কাজের ভাগ সেখানে। সরকারী জগন্নাথের চাকা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে আসন্ন বিপদের আশংকায়। হাজারো ত্রুটিতে ভরা সেই চাকাই তখন প্রধানত কালিয়াচক, মানিকচক, হরিশ্চন্দ্রপুর, ভুতনির চরের লক্ষ লক্ষ মানুষের একমাত্র ভরসা।

কালেক্টরেট বিল্ডিঙের তলায় দেখি বেশ কিছু খালি ট্রাক দাঁড়িয়ে। নাজারত ডেপুটি কালেক্টর ঘোষদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এত ট্রাক কীসের জন্য ?” ঘোষদা হলেন কালেক্টরেটের সকল কাজের কাজি। যাবতীয় পরিকাঠামোর দায়িত্ব তাঁর হাতে থাকে। এই ট্রাকের বহরও নিশ্চয় তাঁকেই জোগাড় করতে হয়েছে আগের রাত থেকে। ঘুমহীন লাল চোখদুটো ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে এক ধমক দিয়ে উঠলেন, “তা দিয়ে তোমার কী কাজ হে ছোকরা? ও আমায় চিতেয় তোলবার মিছিলে লাগবে আজকে।” আমি আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে বিদেয় হলাম।

আমার ভাগে প্রথমে কন্ট্রোল রুম ডিউটি পড়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি ছোটখাটো একটা কর্মযজ্ঞ চলেছে। কালেক্টরির কনফারেন্স রুম জুড়ে দু তিনটে টাইপরাইটার, টেলিপ্রিন্টার, গুটি তিনেক টেলিফোন ঘিরে বসে গুঞ্জন তুলেছেন একদল মানুষ।

এই কন্ট্রোল রুম হল বন্যানিয়ন্ত্রণের স্নায়ুকেন্দ্রবিশেষ। প্রতিমুহূর্তে অজস্র খবরের আনা নেওয়া, বিভিন্ন নির্দেশের যাওয়া আসা, কলকাতায় রিপোর্ট পাঠানো, সাংবাদিকদের উদগ্র কৌতুহলের পাগলামোকে সামলানো সেই সবকিছুই চলে এইখানে বসে।

সেইখানে এসে বসলাম যখন তখন বেলা বারোটা হবে। জেলার একটা বিরাট বড়ো মানচিত্র টাঙানো রয়েছে দেয়ালে। তার গায়ে বিভিন্ন বিপদগ্রস্ত এলাকায় লালনীল কাগজের টুকরো সেঁটে সদাপরিবর্তনশীল বন্যাপরিস্থিতির আপডেট দেয়া চলেছে। শুভ্র এবং আরো দুতিনজন আধিকারিক সকালে উঠেই বেরিয়ে গিয়েছিল এদের মধ্যে একটা স্পটে। জায়গাটায় গঙ্গা থেকে কিছুটা দূরে দূরে দুটো রিং বাঁধ রয়েছে। তাদের মধ্যে যেটা একেবারে নদীর কাছে তাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বালির বস্তা ফেলে ফেলে ফুঁসে ওঠা জলকে আটকাবার যুদ্ধ চলছে তখন।

সন্ধে ছটার কিছু পরে সেখান থেকে মেসেজ এলো, “এমব্যাংকমেন্ট ব্রিচড। ফলিং ব্যাক টু ইনার রিং।”

এইবার, বন্যার উন্মত্ত শক্তির বিরুদ্ধে তাদের শেষ দেয়ালটা বাঁচাবার যুদ্ধ। সাধারণত ইনার রিং আউটার রিং-এর মত তত শক্তিশালী হয় না। ডি.এম অফিস থেকে সামান্য সময়ের মধ্যেই আদেশ চলে এল। এমারজেন্সি ইভ্যাকুয়েশান শুরু করতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকায়। খবর পাঠানো হল সে ব্লকের বিডিও অফিসে। সেখানকার টেলিফোন কাজ করছে তখনও। প্রৌঢ় ভদ্রলোকের উত্তেজিত গলা ভেসে আসছিল তারের ওপার থেকে, “ট্রাক তো মোটে চারপাঁচটা আছে। গাড়ি পাঠান। ইমিডিয়েট—”
এইবার বুঝতে পারলাম কালেক্টরেটের তলায় জমিয়ে রাখা ট্রাকবাহিনীর রহস্যটা। ফোন রেখে ইন্টারকমে ঘোষদাকে ধরলাম। তিনি তৈরিই ছিলেন দেখা গেল। প্রতি বছরই মোটামুটি সেই একই নাটক চলে তো! জানা গেল ইতিমধ্যে আরো দুটো স্পট থেকেও ট্রাক চেয়ে পাঠানো হয়েছে। একটা আশ্চর্য তেলখাওয়া যন্ত্রের মত কাজ করছিল আমাদের রিকেট রুগির মত সরকারী মেশিনারি। ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে গর্জন তুলে পথে বের হয়ে গেল আঠারোটা ট্রাক।

ওদিকে তখন তিনটে এলাকায় গঙ্গা ফুলহার আর পুণর্ভবার সঙ্গে মরণপণ লড়াই চলেছে মেরামতকর্মীদের। রাত সাড়ে বারোটার সময় প্রথম খবর এলো কালিয়াচকের দিক থেকে। শেষ বাধাটাও সরিয়ে দিয়েছে ক্ষেপে ওঠা নদী। জল ঢুকছে হুড়মুড় করে। তারপর একে একে বাকি জায়গাগুলো থেকেও একই খবর এসে পৌঁছোতে লাগল কন্ট্রোলরুমে। সুবিশাল প্রাকৃতিক শক্তির সামনে মানুষের তৈরি সামান্য বাধা সরে গেছে। সামান্য সরকারী সাহায্য কিছু মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে মাত্র। বাকিরা সেই উদ্দাম জলরাশির সঙ্গে নিজেরাই লড়ছে নিজেদের লড়াইটা। জলবন্দি হয়ে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ।

| ২ |

ত্রাণদপ্তরের ডেপুটি কালেক্টর হরিময়বাবু লোকটি মোটাসোটা, গোলগাল। জীবনে অনেক সাধই তাঁর পূরণ হয়নি। দেখা হলেই অপূর্ণ সমস্ত সাধ আহ্লাদ, অশক্ত শরীর ইত্যাদি নিয়ে বিলাপ করে সময় কাটান। তা, বন্যা উপলক্ষে দেখা গেল তাঁর একটা সাধ পূর্ণ হওয়ার পথ হয়েছে। ব্যাপারটা খুলে বলা যাক।

বাঁধ ভাঙবার পর আরো দুটো দিন কেটে গেছে তখন। আক্ষরিক অর্থেই নাওয়াখাওয়া ঘুচে গেছে কালেক্টরেটের অতগুলো মানুষের। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠারো ঊনিশ ঘন্টাই কাজ চলে। ওরই মধ্যে একটু আধটু বিশ্রাম, এক আধ চুমুক ঘুম চুরি করে নেয়া সদা কৌতুহলী সাংবাদিকদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে। দেখতে পেলেই তো কাগজে ছবি ছেপে যাবে। হরিময়বাবুর ওপরেও চাপ পড়েছে ভালোই। আর তার সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বেড়ে চলেছে তাঁর বিলাপ।

আগের দিন রাতে আমার ডিউটি পড়েছিল ইংলিশবাজার ব্লকের একটেরেতে। রামকৃষ্ণ মিশনের পেছনদিকটাতে খানিক নিচু জায়গা আছে। সেখানে মহানন্দা এসে ঢুকে পড়েছে। অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাতে লোকজনকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, তাদের হাজারো বায়নাক্কা, মেডিকেল এমার্জেন্সি সামলানো—সেইসব সেরে ভোরভোর ডাকবাংলোতে ফিরে মুখহাত ধুয়ে শান্তির বানানো এককাপ চা খেয়ে ফের ছুটেছি কালেক্টরেটের কন্ট্রোল রুমে। সেখানে ছটা থেকে আমার ডিউটি সেদিন।

কন্ট্রোল রুমে পৌঁছোতে দাদা ডেকে বললেন, “আর্মির হেলিকপটার এসেছে। ত্রাণসামগ্রী এয়ারড্রপ হবে চারপাঁচটা সর্টিতে। একবার গিয়ে একটু দেখে আসবে?”

বৃষ্টি তখন একটু ধরেছে। নিচে নেমে হেলিকপটারের মাঠের দিকে যাবার জন্যে জিপে উঠতে যাবো তা দেখি হরিময়বাবু ছুটতে ছুটতে আসছেন। ভারী শরীরে দৌড়টা অবশ্য খুব দৃষ্টিনন্দন নয়। কাছে এসে বললেন, “হেলিপ্যাডে যাচ্ছ নাকি? আমি উঠে বসি?”

হেসে বললাম, “আরে দাদা, আপনি হলেন ত্রাণকর্তা। ত্রাণবিতরণের প্রাণপুরুষ। আপনি যাবেন না তো কে যাবে। হাঁসফাঁস করে জিপের পেছনদিকে চড়তে চড়তে হরিময়দা মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, “আর ত্রাণকর্তা! আকাশে উড়ে উড়ে খাবারের প্যাকেট ফেলা। কম ঝামেলা! এই বুড়ো বয়সে এত কি সয় ?”

মুখের কথাগুলোর সঙ্গে অবশ্য তাঁর শরীরি ভাষার কোন মিল ছিল না। জীবনে সম্ভবত প্রথমবার হেলিকপটার চড়বার সম্ভাবনায় মুখটা উৎফুল্লই দেখাচ্ছিল তাঁর। মজা করে বললাম, “ঠিকই তো হরিময়দা। অত উঁচু থেকে কোনক্রমে যদি একবার নীচে গিয়ে পড়েন তাহলেই তো চিত্তির।”

“যা বলেছো। এই ডি.এম ছোকরার কি সে কাণ্ডজ্ঞান আছে ? নইলে একজন বয়স্ক মানুষকে এইভাবে”

“ডি.এম বুঝি আপনাকে হেলিকপটারে চড়ে ত্রাণ দিতে যেতে বলেছে ?”

“আরে ধুস্‌। বলবে আবার কী ? ডিপার্টমেন্টটা আমিই তো দেখভাল করি। আমি না গেলে হয় ? শেষে এই নিয়ে দু'কথা শুনিয়ে দেবে’খন। যা মুখ লোকটার!”

“তা বটে। কাউকে তো যেতেই হবে সঙ্গে। তা হরিময়দা আমি বলি কি, আপনার বদলে আমিই না হয় চলে যাচ্ছি। ডি.এম-কে আমি সামলে নেবো'খন। বলে দেবো আপনার হার্টের অসুখ আছে। আকাশে উড়লে টুড়লে শেষে—”

হরিময়বাবু সাত তাড়াতাড়ি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আরে না, না। তা কী হয় ? তুমি বাচ্চা ছেলে, কিছু বুঝবে টুঝবে না, শেষে না গোল বাধে একটা।”

বুঝলাম, মুখে যাই বলুন ফাঁকতালে হেলিকপটারে চড়বার সুযোগটা তিনি হাতছাড়া করতে মোটেই রাজি নন।

হেলিপ্যাডে পৌঁছে হাসি হাসি মুখে হরিময়দা তো তাতে চড়ে বসলেন। কিন্তু খানিক বাদে বায়ুসেনার এক জোয়ান পাইলটের কাছে এসে আরেক জওয়ান ফিসফিস করে কিছু বলতে তিনি ভুরু কুঁচকে হরিময়দার দিকে ফিরে বললেন, “আপনার যাওয়া হবে না স্যার।”

হরিময়দা মুখটা ভেংচে বললেন, “কেন? কেন? আমি এ বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেট, আমাদের ডি.এম আমাকে কাজই দিয়েছেন ত্রাণ বিলির দেখাশোনা করার। আমায় বাদ দিয়ে—”

পাইলট ছেলেটি গোঁফের নীচে একচিলতে হেসে বলল, “আপনার ওজন তো প্রায় নব্বই কিলো হবে স্যার। আপনি সঙ্গে গেলে নব্বই কিলো খাবার আমাদের কার্গোতে কম নিতে হবে। সেটা কিন্তু খুব ভালো হবে না। আমাদের এয়ার ড্রপিং-এর একটা ডেলি টার্গেট দেয়া হয়েছে আপনাদের ডি.এম অফিস থেকে। টার্গেট পুরো না করতে পারলে যদি এক্সপ্ল্যানেশান কল হয় তাহলে আমাদেরও বলতে হবে যে ত্রাণবিভাগের ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে নিয়ে যাবার জন্য সেটা ঘটেছে।”

হরিময়বাবুর মুখটা কালো হয়ে গেল। ভেবেচিন্তে ফের একটা কিছু বলতে গিয়েছিলেন, তা পাইলট সব তর্কে জল ঢেলে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “সরি, কোন নন-এসেনশিয়াল পার্সনকে এ ফ্লাইটে নেয়া যাবে না। আপনি নেমে যান। নাহলে আমি ফ্লাইট শুরু করব না।”

অতএব ছোকরার দিকে একটা বিষ নজর নিক্ষেপ করে হরিময়বাবু হেলিকপটার থেকে নেমে এলেন। মুখটা তাঁর কালো হয়ে গেছে। ছোট ছোট শখ আহ্লাদ, ছোট ছোট নিরাশা— একান্তই মধ্যবিত্ত স্বার্থপরতার জলছবি ফুটছিল আমার চোখের সামনে। মানুষটা খারাপ নন। শুধু মহাপ্লাবনের ট্র্যাজেডির বিরাট সে ক্যানভাসটাকে তাঁর চোখের সামনে থেকে আড়াল করে রেখেছিলো চোখের সামনে দাঁড়ানো একটুকরো আনন্দের ব্যাক্তিগত লোভ। না, শুধু এইজন্য তাঁকে খারাপ লোক কিংবা একটি জীবন্ত কার্টুন আমি একেবারেই বলতে রাজি নই। দারিদ্রের প্লাবনে ডুবতে থাকা গোটা দেশটাকে নিচে ফেলে রেখে ব্যক্তিগত সাফল্যের হেলিকপটারে একচক্কর উড়ান, একটা মার্কিন ওয়ার্ক পারমিট, স্ত্রীপুত্রকে নিয়ে দামী হোটেলে একটা ডিনার, বা সস্তায় টিকেট ম্যানেজ হলে একচুমুক বিদেশ ভ্রমণ—আর কিছু না হোক একবার থাইল্যান্ড ট্রিপ— কেই বা না চায় তা! আমিও তো সে দলের বাইরে নই। হরিময়বাবুকে কেন তবে নাহক দোষ দিই?

গর্জন তুলে রোটরের ঘুর্ণনে ঝড় জাগিয়ে যন্ত্রফড়িং এবারে উড়ে গেল তার গন্তব্যের দিকে। ছবিটা মনে মনে দেখতে পাচ্ছিলাম। পায়ের নিচে জল থইথই দুনিয়া—একদিকে ফুলহার আর অন্যদিকে গঙ্গার প্লাবনের সাঁড়াশি আক্রমণে চিরপরিচিত জায়গাগুলো জলাভূমি হয়ে গেছে। তারই মধ্যে কোন কোন মাথা জাগিয়ে থাকা জায়গায় আটকে পড়া অজস্র মানুষ—আর তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যন্ত্রের পেট থেকে ছিটকে আসছে খাবার, ওষুধের প্যাকেট। সঠিকভাবে নদীকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারবার মাসুল হিসেবে, মানুষের সব হারাবার বিনিময়ে সামান্য রাষ্ট্রীয় ভিক্ষার খেসারত।

|৩|

ততদিনে বৃষ্টির তীব্রতা কমে এসেছে। কোথাও কোথাও জমে থাকা জলে টানও ধরেছে, কিন্তু তখনো জলবন্দী মানুষজনের ঘরে ফেরবার অবস্থা আসেনি। নদীগুলোর জল সামান্য নেমেছে বটে কিন্তু ফের বৃষ্টি নামলে জল আবার বাড়বে। বঙ্গোপসাগরের ওপর তখন আরো একটা ঘুর্ণি তৈরি হয়েছে। আবহাওয়া দফতর তার গতিপ্রকৃতি নিয়ে প্রবাবিলিটির অংক কষে চলেছে অবিরাম। যদি ওড়িশার দিকে চলে যায় তা তাহলে বাঁচোয়া। কিন্তু যদি এদিকে ঘুরে আসে তাহলে ফের একবার বিপদ ঘনাবে এদিকে।

এ সময়টা সাধারণত খুব বিপজ্জনক হয় নানা কারণে। জলে কিঞ্চিৎ টান ধরায় বন্যার শিকার গাছপালা আর পশুপাখির মৃতদেহে পচন ধরে। তার থেকে মহামারী ছড়াবার আশংকা থাকে। খাদ্য, পানীয়, গরম পোশাকের সংকট তীব্র হয়। তীব্র হয়ে ওঠে মানুষের মনের অসন্তোষও। সীমিত আর্থিক ও পরিকাঠামোগত শক্তি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো আর সরকারী দফতরের কর্মচারীরা মুখ বুঁজে কাজ করে যান এ সময় আর তার পাশাপাশি রাজনীতির দাদাদিদিরা এবং মিডিয়া নিজেদের পেশাগত উন্নতির সন্ধানে চালিয়ে যান ক্রমাগত ছিদ্রান্বেষণের কাজ।

এই সময় একদিন ডাক পড়ল ত্রাণ দিতে যাবার কাজে। গন্তব্য ভূতনীর চর। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গঙ্গা আর ফুলহারের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে থাকা এই এলাকাটা। প্রথমে গাড়িতে করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মানিকচক হয়ে মথুরাপুরের কাছাকাছি যদ্দুর যাওয়া যায় এগিয়ে গিয়ে তারপর ফুলহার পেরিয়ে নৌকায় যাত্রা। বন্যাদীর্ণ সে পথে যাত্রার বর্ণনা দিয়ে এ লেখাকে ভারাক্রান্ত করব না। ত্রাণসামগ্রী ভরা নৌকো নিয়ে সেখানে পৌঁছে প্রথম অভ্যর্থনা পেলাম জল ভেঙে এগিয়ে আসা একদল রেগে ওঠা মানুষের কাছে। হাতে লাঠিসোঁটা, দা কুড়ুল যা পেয়েছেন নিয়ে তাঁরা এগিয়ে এসেছেন সরকারী নৌকোর দেখা পেয়ে। অভিযোগ, আমরা হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরছি, আর তোমরা কী সামান্য ত্রাণের বন্দোবস্ত করেছো আমাদের জন্য? অভিযোগ মিথ্যে নয়। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, এতক্ষণ যা পড়লেন তাতে আমাদেরই বা ঠিক কতটা ব্যক্তিগত ত্রুটি ছিল ত্রাণকর্মের এই অপ্রতুলতায়? কার্যনির্বাহী আধিকারিকরা তো পলিসিমেকারের হুকুমের চাকরমাত্র। পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতার জন্য তাঁদের দায়ী করা আর জিনিসের দাম ও মানের ত্রুটির জন্য কোম্পানির সেলসম্যানকে গাল দেয়া একই ব্যাপার। কিন্তু গ্রাহক সেটা বুঝলে তো!

কোনমতে তাঁদের বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠান্ডা তো করা গেল। ত্রাণকর্মের প্রধান ঘাঁটি হয়েছে স্থানীয় একটা স্কুলবাড়িতে। তার ভিটে উঁচু। সেখানে বহু মানুষের আশ্রয়। সেখানে গিয়ে টেবিল চেয়ার সাজিয়ে বসে কাজ শুরু করতে নতুন বিপত্তি। এক উঠতি বিরোধী রাজনৈতিক নেতা তখন সেইখানে বন্যাপরিস্থিতি ও সরকারী ত্রাণকর্মের সরেজমিনে তদন্তে এসেছেন। দুর্মুখ ও ফায়ারব্র্যান্ড নেতা বলে তাঁর তখনই বেজায় সুনাম। কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। কম্বল বিলি হচ্ছে তখন। হঠাৎ দেখা গেল পাশের টেবিলের সামনের লাইন থেকে এক বৃদ্ধ হাউমাউ করে চিৎকার করতে করতে নেতার কাছে গিয়ে হাজির। অভিযোগ, “এনারা আমার কম্বল মেরে দিয়েছেন।”

নেতার মুখে বর্ষার মেঘ জমে উঠল। সুযোগটা বেশ জম্পেশ। চোখদুটি ঘুরিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে তিনি টেবিলে কর্মরত আধিকারিকটির সামনে গিয়ে রণং দেহি ভাব নিয়ে দাঁড়ালেন। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের দলের মধ্যে সবচেয়ে পোড়খাওয়া আধিকারিকটি গিয়ে পড়লেন গন্ডগোলের মধ্যে।

নেতার কন্ঠে গোলাবর্ষণ হল, “ইনি এটা কী বলছেন?”

বয়স্ক আধিকারিকটি এমন অনেক নেতা দেখেছেন তাঁর দীর্ঘ কার্যকালে। বুদ্ধি না হারিয়ে শান্ত গলায় বললেন, “কাইন্ডলি আমাকে একটু দেখতে দিন।”

“দেখবেন আর কী ? আচ্ছা ঠিক আছে—দেখুন—”

আধিকারিক তখন বৃদ্ধের মুখোমুখি হলেন, “নাম কী?”

“ইছমাইল শেখ।”

“বাড়ি?”

ইছমাইল শেখ তাঁর ঠিকানা বললেন। রেজিস্টারের পাতায় খোঁজাখুঁজি করে খানিক বাদেই খুঁজে পাওয়া গেল, দিনদুই আগে আসা ত্রাণকর্মীদের থেকে জনৈক মুনির শেখ টিপছাপ দিয়ে দুটি কম্বল নিয়েছেন। ঠিকানা এক। বাবার নামের জায়গায় ইছমাইল শেখের নাম।

“এই তো তোমার ছেলে এসে কম্বল নিয়ে গেছে। তাহলে? এটা কি জাল?”

বৃদ্ধ একটু থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেলেন।

সুযোগটা নিলেন আমাদের সিনিয়র। বললেন, “তাহলে ডাকাই তোমার ছেলেকে? এসে সাক্ষী দিক? সরকারী কাজে মিথ্যে কথা বললে—”

বৃদ্ধ একটু অপ্রস্তুত ভাব করে তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। জোলো হাওয়া দিচ্ছিল তখন। বিকেল হয়ে এসেছে। একটা ছেঁড়া লুংগি আর গামছায় দুর্বল কাঠামোটা থরথর করে কাঁপছিল তাঁর। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, “দুটা কম্বল বাড়িতে নে যেতে সে মাগী দুটাই নিয়ে নেছে। একটা তার আর তার শৌহরের জন্যে আর অন্যটা ছাওয়ালগুলোর জন্য। আমাদের বুড়াবুড়ির কম্বল নাই।”

“কিন্তু, সরকারী নিয়ম যে চাচা। পরিবার পিছু দুটোর বেশি কম্বল আমরা দেবো কেমন করে? দেখো না কত লোক এখনো একটাও কম্বল পায়নি?”

নেতাও দেখা গেল ব্যাপারটার মর্মার্থ টের পেয়েছেন ততক্ষণে। বেশ একটা কিংকর্তব্যংবিমূঢ় অবস্থা চলছে তখন হঠাৎ ইসমাইল শেখ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলে, “বাপ মায়ের খেয়াল রাখতে পারেনা অমন ছাওয়ালে আমার কাজ নাই। লিখে নেন ওরে আমি ত্যজ্য করলাম আজ থিকে। আমার আর বিবির আলাদা পরিবার। লেখেন, নাম লেখেন। দুটা কম্বল আমাদের লাগে—”

একটা হাসির অট্টরোল উঠছিল চারদিকে। নেতার মুখের বজ্রবিদ্যুতও উধাও হয়ে গেছে ততক্ষণে। একটা তিক্ত, বিষাক্ত, অন্ধকার কমেডির সামনে দাঁড়িয়ে বুকের মধ্যে মোচড় দিচ্ছিল আমার। কেন মরতে এ চাকরি করতে এলাম আমি? ভালোই তো ছিলাম আমার শহরের চারদেয়ালের মধ্যে, আমার লিটল ম্যাগ, আমার রবীন্দ্রসদনের গান, আমার মার্কস, মাওসেতুং, রবীন্দ্রনাথ, মহীনের ঘোড়াগুলি, আমার সিস্টেমকে তীক্ষ্ণ ভাষায় গালাগাল করবার কাগুজে বিপ্লবকে সঙ্গে নিয়ে রঙিন একটা ইন্টেলেকচুয়াল ফানুসের ভেতর। কেন মরতে আমার দেশকে দেখতে এসেছিলাম এই নরকে?

সরকারী নিয়ম। তার হাকিম হেলে তো হুকুম হেলে না। অতএব বুড়োকে কম্বল দেবার অবস্থা তখন আমাদের নেই। অবশেষে সেদিন আমাদের মান বাঁচিয়েছিল এক নববিবাহিত কৃষকদম্পতি। তখনো সন্তান আসেনি তাদের ঘরে। নিজেদের ভাগের একটা কম্বল তুলে দিয়েছিল তারা ক্রন্দনরত বৃদ্ধের হাতে।

|৪|

এবং সাংবাদিককুল। কিছু মনে করবেন না। আপনাদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠ অনেকেই আছেন। কিন্তু অন্যরকম মানুষেরও অভাব নেই। সেই প্লাবনের দিনগুলোতে একদিন হঠাৎ একটা কাগজে ছবিসহ রিপোর্ট দেখে চমকে উঠেছিলাম। তীব্রবেগে ছুটে যাওয়া জলরাশির ছবি সেখানে। তলায় ক্যাপশান, সরকারী অবহেলায় এইভাবেই ভেসে যাচ্ছে মালদার জনপদ।

ছবিটা যে জায়গায় তোলা সেটা আমার চেনা। সাংবাদিকটিকেও দেখেছি সর্বদাই কন্ট্রোল রুমের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে স্কোপ জোগাড়ে ব্যস্ত থাকতে। প্লাবিত জেলার কোন জায়গাতেই তিনি তাঁর মহামূল্যবান প্রাণটি নিয়ে খবর খুঁজতে যান নি। শুধু অভিরামপুর বাঁধ রোডের ওপর থেকে নিচে বয়ে চলা মহানন্দার একটা কৌশলী ছবি তুলে জুতমতো একটা ক্যাপশান লাগিয়ে দিয়েছেন নীচে। তখনো পোড়খাওয়া আমলা হয়ে উঠিনি তো, চামড়াটা খানিক পাতলা ছিল। তাই বড় বেজেছিল ঘটনাটা। লোকটাকে আর দেখিনি সেখানে কখনো। সম্ভবত নিরাপদে বাড়ি ফিরে গিয়ে তারপর এই ধাষ্টামোটা তিনি করেছিলেন আমাদের নিয়ে।

উত্তরকথন

এরপর দু’দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে। আমরা নাকি অনেক উন্নতি করেছি। বিদেশে চাকরি চলে যাবার আদুরে নাম হয়েছে হি হ্যাজ বিন ব্যাঙ্গালোরড! এতই প্রতাপ আমাদের এখন বিশ্ব অর্থনীতির বাজারে। গোল্ডেন কোয়াড্র্যাঙ্গল, রাস্তাঘাট, শিল্প, বাণিজ্য, ডিপ্রেশনের সফল মোকাবিলায় জগতজোড়া নাম হয়েছে এ দেশের। কিন্তু তবু বছর বছর ভারতের বহু জায়গার বর্ষা এলেই সেই একই খবর দেখতে পাই। জায়গার নাম বদলায়। সংখ্যাগুলো বদলায়। জলমগ্ন গ্রামের সংখ্যা, মৃত মানুষের সংখ্যা, ক্ষতি হয়ে যাওয়া ফসলের অর্থমূল্যের সংখ্যা—আরো কত সংখ্যাই বদলে বদলে যায় প্রতিবার। শুধু গল্পটা একই থাকে। শুরু করেছিলাম যেকথাটা দিয়ে, ফের সেই কথাটা দিয়েই তাই শেষ করি, ডেভেলপমেন্ট তাহলে কাকে বলে দাদা? কার ডেভেলপমেন্ট?