অপেক্ষা

অপেক্ষা
পিনাকী ঘোষ


— আচ্ছা, কিছুই বোধহয় আর আগের মতো হবেনা, না? সব এলোমেলো হয়ে গেছে?

— গেছেই তো। সবিতা যে সব গুছিয়ে রাখত। কোনও কিছুর আঁচ পেতে দিত না।

— ও তো চলে গেল। আমার জন্যে দাঁড়ালোও না। আমি একা হয়ে গেলাম। সেরিব্রাল স্ট্রোক। আইসিইউ, ভেন্টিলেশন। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে সব শেষ। আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম কাচের দরজার ওপাশ থেকে। মনে হয়েছিল, সবকিছু কেমন যেন নিশ্চল হয়ে গেছে। অথচ অনুপম বিদেশে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করাতেও তো এমন কষ্ট হয়নি!

“এতো ছটফট করছেন কেন? আর তো কিছুক্ষণ। তারপরেই...” হাল্কা আকাশী রঙের ইউনিফর্ম পরা মাঝবয়েসী নার্স মালতী টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা ওষুধ গুছোতে গুছোতে পিছন ফিরেই কথাগুলো বললেন। ক্যাবিনের খোলা জানালা দিয়ে শীতসকালের নরম রোদ খাট পেরিয়ে মেঝেয় এসে লুটোপুটি।

“হ্যাঁ, আর তো কিছুক্ষণ। তারপরেই...” খুব টানাটানা ক্লান্ত স্বরে কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলেন সত্তর ছুঁইছুঁই অনন্ত। তাঁর পরনে ফতুয়া আর পাজামা। ফতুয়ার ওপরে চাপানো হাফ শোয়েটার। মুখভর্তি সাদা চুলদাড়ির মধ্যে অস্থির দুটো চোখ। ঘনঘন এপাশ ওপাশ করায় কম্বলটা গায়ের ওপর থেকে একপাশে সরে গেছে।

“আপনি তো রেডি হয়ে গেছেন দেখছি। কে আসবে আজ?” হাতের কাজ সারতে সারতেই একবার পিছনদিকে মুখ ফিরিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন মালতী।

প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই পাল্টা প্রশ্ন করলেন অনন্ত, “আচ্ছা, ডক্টর রায়চৌধুরী কি এসে গেছেন?”

“কেন? ডক্টর রায়চৌধুরীকে কী দরকার? উনি তো আপনার প্রেসক্রিপশন, অ্যাডভাইস, রিলিজ অর্ডার সবকিছু কাল রাতেই লিখে রেডি করে রেখে গেছেন। বাড়ির লোক এলেই আমরা তাঁকে সব বুঝিয়ে দিয়ে আপনাকে রিলিজ করে দেব। আর একটুখানি তো অপেক্ষা করতেই হবে, তাই না?”, কথাগুলো বলে মালতী তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কপালে ভাঁজ। চোখদুটো বন্ধ করে নিয়েছেন অনন্ত। হ্যাঁ, অপেক্ষা তো করতেই হবে। বিয়াল্লিশ বছর আগেও এমন এক শীতের সকালে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা অবস্থায় সবিতাকে ঢোকানো হয়েছিল লেবার রুমে। তাঁদের প্রথম সন্তান জন্মেই মারা যাবার পর প্রায় দু’বছরের অপেক্ষার শেষ পর্যায়। আশঙ্কা, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা মিলেমিশে একাকার। অথচ প্রথমবার ছিল শুধু অধীর আগ্রহ আর চাপা উত্তেজনা। সেবারে সবিতা একটা ফুটফুটে মেয়ের জন্ম দিয়েছিল। মাথাভর্তি চুল। মোচার কলির মতো খুদিখুদি আঙুল। বেশিক্ষণ বাঁচেনি। নিওনেটাল অ্যাসফিক্সিয়া। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব। অপেক্ষার শেষটা এমন হবে আন্দাজ করা যায়নি। সারা পৃথিবী যেন টলে গিয়েছিল। সবার সামনে চোখের জল ফেলা যায়নি। সবিতাকে সামলানোর জন্যে নিজেকে শক্ত রাখতে হয়েছিল। সবিতার তখন প্রায় উন্মাদের মতো অবস্থা। দ্বিতীয়বার অবশ্য অপেক্ষার শেষটা এমন মর্মান্তিক হয়নি। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনুপম এসেছিল। তাদের একমাত্র সন্তান। পুরোপুরি সুস্থ, স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও তাদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার শেষ ছিলনা। পাছে প্রথমবারের মতো কিছু অঘটন ঘটে যায়। না, বিয়াল্লিশ বছর পেরিয়ে গিয়েও অনুপমের ক্ষেত্রে তেমন কিছু অঘটন ঘটেনি।

কিন্তু অপেক্ষার শেষ কি হয়েছিল? না। একের পর এক অপেক্ষাকে পেরিয়ে এগিয়ে গেছেন অনন্ত। অনুপম প্রথম থেকেই খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। সবিতার ধ্যানজ্ঞানই ছিল অনুপমের লেখাপড়া। অনন্তকে এব্যাপারে কিছু মাথা ঘামাতে না হলেও তিনি নিঃসাড়ে সবটুকুই খেয়াল রাখতেন। বলা ভালো, সবটুকু নিয়ন্ত্রণ করতেন। অনুপম কী খেতে ভালোবাসে, পড়াশোনার বাইরে তার কী পছন্দ, পোশাকআশাক কখন কী দরকার সবকিছুই অনন্ত যুগিয়ে যেতেন বলার আগেই। ছেলে মানুষ করার জন্যে আত্মীয়স্বজন সবই নীরবে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। যেন দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে যাওয়া একটা লড়াই। ছেলেটা যেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়।

একবার পুজোর ছুটিতে অনুপমের ছোটকাকা হায়দ্রাবাদ থেকে বেড়াতে এসেছিলেন। অনুপমের তখন ক্লাস সিক্স। কিছুদিন বাদেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা। ছোটকাকাকে অনুপম এর আগে বার দু’এক দেখেছিল। একবার পিসির বিয়েতে আর একবার ঠাকুমা মারা যাবার সময়। সব জ্ঞাতিগুষ্টির লোকজন জড়ো হয়েছিল অনুপমদের দেশের বাড়ি হাওড়ায়। সেই দুবার মুখোমুখি দেখা ছাড়া অনুপম আর তার ছোটকাকার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল পোস্টকার্ড। ছোটকাকা বিয়ে করেননি। হায়দ্রাবাদ ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ। অনুপম হবার আগে থেকে সেখানেই।

ছোটকাকা আসছে শুনে অনুপমের আনন্দ আর ধরছিল না। অনন্তর মাথায় তখন অনুপমের অ্যানুয়াল পরীক্ষা। ভাই এসে পৌঁছোনোর আগেই তিনি অনুপমকে ডেকে বললেন, “শোনো, জীবনে আনন্দ আহ্লাদ বারবার আসবে, কিন্তু এই ক্লাসের অ্যানুয়াল পরীক্ষাটা একবারই আসবে তোমার জীবনে। তাই সেটা যাতে ভালো হয় তা যেন মাথায় থাকে। আমি কী বলতে চাইছি, তা আশা করি বুঝতে পারছো।” অনুপম শুধু মাথা নেড়েছিল। সে বাবার কথার অবাধ্য হয়নি। এরপর ভাই বাড়ি এলে তাকেও তিনি হাবেভাবে অনুপমের পরীক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে সে বাড়িতে অনুপমের ছোটকাকা আর আসেনি।

কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল না। চোখ খুলে দেখলেন মালতী টেবিলের ওপর একটা প্যাকেটের মধ্যে সব গুছিয়ে রেখে ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে গেছেন। এবার একটুখানির জন্যে হলেও নিশ্চিন্ত। এখন আর কোনো প্রশ্ন আসবে না। আসলে যেদিন থেকে একা থাকা শুরু সেদিন থেকেই তিনি কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। শুধু নিজের সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে। মনে এসে যায় পুরোনো দিনের সব কথা। ছোটবেলার কথা, স্কুল কলেজ, চাকরিজীবন। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সবিতার সাথে কাটানো দাম্পত্যজীবন। সবকিছু মনে আসে ঘুরেফিরে।

আইসিইউ থেকে সবিতার দেহ নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছিল পীস হ্যাভেন মর্চুয়ারিতে। বোস্টন থেকে বউমা, নাতনিকে নিয়ে অনুপমের এসে পৌঁছতে সময় লাগবে। বিদেশবিভুঁই থেকে আসা বললেই তো আসা নয়। সাদা কাপড়ে মোড়া সবিতাকে হিমঠাণ্ডা ঘরটায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল টানা তিনদিন। বাড়িতে একা অনন্ত। আত্মীয় পরিজন এসে থাকুক, সান্ত্বনা দিক এটা মোটেও পছন্দ ছিলনা তাঁর। সবিতা মারা যাবার খবর পেয়ে যাঁরা হাসপাতালে এসেছিলেন, তাঁরা সেখান থেকে পীস হ্যাভেন অবধি সাথে গেছিলেন। তারপর সবিতাকে সেখানে রেখে দেওয়ার পর খুব শান্ত গলায় অনন্ত তাঁদের বিদায় জানিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে কলঘরে ঢুকে শাওয়ার খুলে তার নীচে যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন তা ঠিক মনে পড়েনা।

অনুপম, আলোলিকা আর তাদের একমাত্র মেয়ে আকাঙ্ক্ষা কলকাতা পৌঁছনোর পর বাকিটা খুব তাড়াতাড়িই মিটে গিয়েছিল। শ্রাদ্ধশান্তি বা কোনো আচার অনুষ্ঠানে অনন্তর মত ছিল না। হয়ওনি। শুধু অনুপমরা বোস্টন ফিরে যাবার আগে একটা শোকসভার আয়োজন করেছিল। ফুল, মালা, চন্দনে সাজানো সবিতার মাঝবয়সের একটা ছবি। মুখের হাসিটায় যেন সব ক্ষমা করে দেওয়ার একটা ভাব। বড় হলঘরটা ধূপ আর রজনীগন্ধার গন্ধে ভরে গিয়েছিল। অনুপমের কিছু বন্ধুবান্ধব, আলোলিকার বাবা-মা, সবিতার বাবারবাড়ির দিকের কিছু আত্মীয়স্বজন, পাড়ার কিছু বয়স্ক মানুষজন। অনন্ত নিজের ঘর ছেড়ে একবারের জন্যেও বেরোননি। আলোলিকা দু’একবার এসে বসার জন্যে অনুরোধ করলেও, অনুপম একবারও আসেনি। আসলেও হয়তো যেতেন না অনন্ত। ভীষণরকম জেদি তিনি।

— যখন খুব দরকার ছিল তখনও তো অনুপম আসেনি।

— কী করে আসবে! এক তো বিদেশ, তারপর কাজের চাপ।

— আচ্ছা, আসা না যাক, ফোন তো করা যেত? সবিতা অপেক্ষা করে থাকতো। আমি অপেক্ষা করে থাকতাম। কিন্তু ফোন বাজতো না। এপ্রান্ত থেকে ফোন করলেও উত্তর দিত ভয়েস মেলবক্স। খুব কালেভদ্রে হয়তো ভেসে আসতো অনুপমের গলা। হয়তো মাসে এক আধবার। কোনো কোনো মাসে হয়তো তাও নয়।

আলোলিকার সাথে অনুপমের পরিচয় হয়েছিল হার্ভার্ডে পিএইচডি প্রোগ্রামে। অনুপমের স্ট্যাটিস্টিক্স আর আলোলিকার ফিজিক্স। পিএইচডি শেষ করে দুজনেই ফ্যাকাল্টিতে। অলোলিকার অবশ্য একবছর বেশি সময় লেগেছিল। তারা দুজনেই সেই সময় থেকে স্টেটসের বাসিন্দা।

বিয়েতে কোনো বাড়ি থেকেই কোনো আপত্তি ছিল না। আলোলিকারা রাণীগঞ্জের আদি বাসিন্দা। বনেদি পরিবার। সে বাবামায়ের একমাত্র মেয়ে। বিয়েটা বেশ ধুমধাম করেই সম্পন্ন হয়েছিল। বিয়ের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তারা বোস্টন ফিরে গিয়েছিল। অনন্তর বেশ মনে পড়ে, তাদের ফেরার দিন সবিতাকে ভীষণ মনমরা লাগছিল। ছেলে বৌকে লুকিয়ে চোখের জলও মুছেছিলেন।

অনন্তর সাথে অনুপমের কথাবার্তা খুবই কম হতো। তাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন সবিতা। ফ্লাইট ধরতে বেরোনোর সময় অনন্ত সবিতাকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করতে বলেছিলেন, তারা আবার কবে আসবে। অনুপমের ছোট্ট জবাব ছিল, দেখি। তারপর গাড়ির দরজা বন্ধের শব্দ, ইঞ্জিনের শব্দের মধ্যে দিয়ে তারা একসাথে বলেছিল, আসছি, সাবধানে থেকো। সবিতা দুগ্গা দুগ্গা বলে কপালে হাত ঠেকালেও অনন্ত পিছন ফিরে ঘরের দিকে হাঁটা দিয়েছিলেন।

তারপর মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে গিয়েছিল। আলেকালে কথা হতো ফোনে। অনুপম সবিতার। তাতে বাড়ি আসার কথা কিছু আলোচনা হতো না। এরপর বিয়ের দুবছরের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা যখন এলো, সবিতার খুব ইচ্ছে হয়েছিল নাতনির মুখ দেখবেন ওদেশে গিয়ে। আলোলিকার মা-বাবা সেই সময়টায় মেয়ের কাছে গিয়ে মাসতিনেক ছিলেন। কিন্তু যাতায়াতের ভাড়া, বাড়ি ফাঁকা ফেলে রেখে অতদিনের জন্যে যাওয়া এসব নানান কথা ভেবে সবিতা অনন্তকে আর কিছু বলেননি। মনের ইচ্ছে মনেই চেপে রেখেছিলেন। অনুপমের এয়ারমেলে পাঠানো কিছু ছবিতেই অনন্ত সবিতা প্রথম দেখেছিলেন তাঁদের নাতনির মুখ। ইমেল বা স্কাইপেও দেখানো যেতো, কিন্তু অনন্ত বাড়িতে কম্পিউটার রাখেননি। যন্ত্র থেকে দূরে থাকাটাই ছিল তাঁর বরাবরের পছন্দ।

— আচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা কি সবিতার মারা যাওয়া সেই সন্তান? ফিরে এসেছে?

— তুমি এসবে কবে থেকে বিশ্বাস করছো?

— ওকে দেখার জন্যে সবিতা ছটফট করতো। জন্মানোর পরে পরে তোলা ছবিগুলোই সারা দেখতো, ছবির ওপর হাত বুলাতো।

— তুমিও তো সবিতাকে লুকিয়ে দেখতে ছবিগুলো।

— হ্যাঁ, লুকিয়েই দেখতাম। পাছে আমার দুর্বলতা সবিতাকে আরো দুর্বল করে। আমারও যে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করত তাকে। গলার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে করত। ইচ্ছে করত দিদিভাই বলে কোলে তুলে নিতে। কিন্তু আমি ভালো করেই জানতাম, অনুপম আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। যেটুকু করে, তা কর্তব্যের খাতিরে, চক্ষুলজ্জার খাতিরে। এই নির্মম সত্যিটা সবিতাকে বলতে পারতাম না।

“ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দে কার সাথে কথা বলছেন, কাকু?”, ক্যাবিনের পর্দা সরিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছেন ডক্টর রায়চৌধুরী। রাউণ্ডে বেরিয়েছেন। তাঁকে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে গেলেন অনন্ত।

“থাক থাক। শুয়ে থাকুন। এভাবে উঠতে যাবেন না। আস্তে আস্তে চলাফেরা করবেন। শুনলাম আপনি নাকি আমার খোঁজ করছিলেন? বলুন, কী হয়েছে?”

“একটু বসবে, প্রশান্ত? তোমার সাথে কিছু দরকারি কথা ছিল”। নার্সের কাছে তাঁকে ডক্টর রায়চৌধুরী সম্বোধন করলেও একান্তে তিনি অনুপমের স্কুলের এই বন্ধুটিকে নাম ধরে তুমি করেই বলেন। ক্লাস টুয়েলভ অবধি পড়াশোনা নিয়ে দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ, বাড়ি যাতায়াত ভালোই ছিল। টুয়েলভের পর জয়েন্ট দিয়ে প্রশান্ত এনআরএস-এ মেডিক্যাল আর অনুপম বরানগর আইএসআই-এ। তখন যোগাযোগ কমে গেলেও ছিন্ন হয়নি।

“হ্যাঁ, বলুন। শরীর ঠিক লাগছে তো?” বলে একটু তফাতে রাখা চেয়ারটা টেনে খাটের কাছে এনে অনন্তর মুখের সামনে বসলেন ডক্টর রায়চৌধুরী।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, সেসব ঠিক আছে। পেসমেকার বসানো কি এখন কোনো মেজর অপারেশন নাকি?” বলতে বলতে উঠে বসলেন অনন্ত।

“না তা নয়। তবে সাবধানে তো অবশ্যই থাকতে হবে। এই বয়সে অতো বড় বাড়িতে একা থাকেন”, গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলতে থাকেন ডক্টর রায়চৌধুরী।

“কী করব বলো? কে থাকবে আমার সাথে? তুমি তো জানো, তোমার কাকিমা হঠাৎ করেই চলে গেলেন। এই পাঁচ বছর ধরে আমি একাই আমার অতীত বর্তমান মন্থন করে চলেছি। মাঝে মাঝে ভাবি, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সব ভাবনা ব্যর্থ হয়ে যায়। তবে এবার আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আর তার জন্যেই তোমাকে ডাকা”। কথাগুলো ধীরে ধীরে বলে একটু থামলেন অনন্ত। খাটের মাথার কাছে রাখা টেবিল থেকে জলের বোতল নিয়ে একটু জল খেলেন। ডক্টর রায়চৌধুরী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন অনন্তর দিকে। জল খেয়ে অনন্ত আবার বলতে শুরু করলেন, “আমার হার্ট অ্যাটাক, পেসমেকার বসানো এসবের খবর তুমি অনুপমকে দিয়েছিলে। আর তাই জন্যে ও দেশে আসছে আমাকে দেখতে। আজ বিকেলে কলকাতা পৌঁছে এখানে আসবে আমাকে রিলিজ করিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে। এসব তুমি নিশ্চয়ই জানো। কিন্তু আমি আর অপেক্ষা করতে চাই না।”

“ওহ কাকু, আর তো একটুখানি...”

ডক্টর রায়চৌধুরী কথাটা শেষ করার আগেই অনন্ত কিছুটা অসহিষ্ণু হয়েই বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রশান্ত, সেই জন্যেই তো বলছি আমি আর অপেক্ষা করতে চাই না। জীবনের এতটা দিন অবধি আমি শুধু অপেক্ষাই করে এসেছি। হাতেগোনা কিছু অপেক্ষার শেষ ছিল সুখের, বাদবাকি সবটাই যন্ত্রণার। আজ থেকে আমি সব অপেক্ষা ছেঁটে ফেললাম। জীবনে একটাই অপেক্ষা রইল। তা হ’ল মৃত্যু। তোমাকে এতোসব বলছি কারণ তোমাকে আমি অনুপমের পরেই স্থান দিই। এরপর আমি যা করতে চাই তার জন্যে তোমার সাহায্য লাগবে। কথা দাও তুমি সাহায্য করবে।” ডক্টর রায়চৌধুরীর ডানহাতটা নিজের দু’হাতের মধ্যে নিয়ে চেপে ধরলেন অনন্ত।

চরম এক অস্বস্তির মধ্যে পড়লেন ডক্টর রায়চৌধুরী। মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা একটা মানুষের কী এমন সাহায্যের দরকার যা শুধু তাঁকেই করতে হবে! তিনি বরাবরই অনন্তকে দেখে এসেছেন একজন বলিষ্ঠ পুরুষ হিসেবে। তাঁর কথা অমান্য করার সাহস অনুপম বা প্রশান্ত কারুরই ছিল না। এবারও তার অন্যথা হ’ল না। কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো ডক্টর রায়চৌধুরী বলে ফেললেন, “বেশ, বলুন কী সাহায্য দরকার।”

অনন্তর চোখদুটোয় এক অদ্ভুত স্থিরতা নেমে এলো। ডক্টর রায়চৌধুরীর চোখে চোখ রেখে তিনি বলতে শুরু করলেন, “অনুপম কলকাতা পৌঁছোনোর আগেই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাই। হাসপাতালের সব খরচ আমি মিটিয়ে দিয়েছি। কাগজপত্র যা সব এখান থেকে দিয়েছে তা আমি আমার কাছেই রাখছি। বাড়ি গিয়ে আর কয়েকটি দরকারি জিনিস আমাকে নিতে হবে। তারপর আমি হাঁটা দেবো আমার পথে। তুমি এখন এখান থেকে আমার বাড়ি যাবার ব্যবস্থা করে দাও। ভয় পেয়োনা, মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকলেও, মৃত্যুকে আমি নিজে বেছে নেবো না।”

“কাকু, প্লীজ, আপনি একটু বুঝতে চেষ্টা করুন...”

বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে অনন্ত বললেন, “আমি ভীষণ ক্লান্ত, প্রশান্ত। আমার এবার ছুটি চাই। বিকেলে অনুপম যখন এখানে আসবে তুমি তাকে বুঝিয়ে বোলো। ওকে বাড়ির এই ডুপ্লিকেট চাবি, আমার মোবাইল ফোন আর এই চিঠিটা দিও।”

ডক্টর রায়চৌধুরী দেখলেন বালিশের পাশে পুরোনো আমলের একটা মোবাইল ফোন আর একগোছা চাবি চাপা একটা খোলা চিরকুট। অনন্তর কাঁপাকাঁপা হাতে লেখা—


স্নেহের অনুপম,
আমি চললাম। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন ভালো থাকার জন্যে। বাড়িতে যা রইল তা তোমাদের। তোমরা ভালো থেকো। আমার ফেরার অপেক্ষা কোরো না।
তোমার বাবা

মোবাইল, চাবির গোছা আর আর চিরকুটটা হাতে তুলে নিতে নিতে ডক্টর রায়চৌধুরী দেখলেন অনন্ত এগিয়ে চলেছেন দরজার দিকে। দরজা পেরিয়েই আকাশ। কাঁধ থেকে অপেক্ষার বোঝাটা নেমে যাওয়ায় আজ তিনি উড়ে যাবেন।