ঘোষেদের চর্চা


বেনিয়াহাটায় সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত বেণীবরণের মুন্ডু কেউ দেখেনি, তবে সবাই বলে সে আছে। সময় বুঝে সে বেরোয়, আর যাকে একবার দেখা দেয়, তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত। এই বেনিয়াহাটাতেই আমার মামাবাড়ি। স্কুলে গরমের ছুটি পড়তে না পড়তেই আমরা সপরিবারে হাজির হয়ে যাই বেনিয়াহাটায় বিখ্যাত ঘোষবাড়িতে, আর শুধু আমরাই না, গরমের ছুটিতে জুড়ে বসে পিকাই, পিঙ্কি, পিন্টু, পিঁটি, টুবলু, গুবলু, বুবুন, টুবুন, তুলি, ফুলি, অপু, তপু, লোপা, চাঁপা, বটুক, বুম্বা, বনি, রনি, টুটু, পুটু, পুতুল, টুতুল - এই যাঃ, টুতুল নামে কেউ নেই, বলতে বলতে কেমন ফ্লো তে বেরিয়ে গেল। যাইহোক এরকম আরো সমবয়সী আমার মাসতুতো, মামাতো ভাইবোনেরা চলে আসে। সে তখন মামাবাড়ি এমন গমগম করে যে মনেহয় এর বাইরে আর দুনিয়াই নেই। সারাদিন কোলাহল লেগেই থাকে, মাঝে মাঝে মাঝরাত অব্দি। মায়েরা সব বোনেরা একত্র হলে হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতেও অট্টহাসির এমন রোল ওঠে যে সবার ঘুম ভেঙে যায়। ঠিক এই কারণেই গরমের ছুটিতে মামাবাড়ির আশেপাশের কিছু বাড়ির সবাই সপরিবারে ঘুরতে চলে যায়, নাহলে নাকি তারা রাতে ঘুমাতে পারে না। এরকমই কানাঘুষো শোনা যায়, সরাসরি বলার তো আর কারোর সাহস নেই। মায়েদের এরকম হাসি, গল্প, গুজবের কারণেই নাকি এই বাড়িতে চোরেরা ঢুকতে সাহস পেতো না। একবার এক সিঁধেল চোর গবা বাড়ি শুনশান দেখে সিঁধ কেটে সবে বড়দাদুর ঘরে চাবি নিতে যাচ্ছিল সেই সময়ই দিদিমা নাকি খোনাস্বরে অট্টহাসি হেসে ওঠে, বড় সাবধানে কাজ করতে আসা গবাচোর সেই শুনে ভিরমি খায়। তারপর তিনদিন পর সদর হাসপাতালে তার জ্ঞান ফেরে।

বিশাল রাজকীয় এই বাড়ি শুধু আমাদের গর্ব নয়, সারা বেনিয়াহাটারই গর্ব। আমাদের মামাবাড়ির মামা, দাদুদের দাপটেই নাকি এই অঞ্চলে কোনো খুন, চুরি, ডাকাতি নেই। এককালের বড় বড় চোর, ডাকাত মামাবাড়িতে চুরি, ডাকাতি করতে এসে শুধরে গেছে। এখন নাকি তারাই মামাদের জমিতে চাষ আবাদ করে। খুব অলস কোনো চোর হলে তার জন্যও দাদুরা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল - নম্বরমাস্টার। যেমন আকাশে উড়তে থাকা পাখি গোনা, সকালে কবার কোকিল ডেকে ওঠে, কটা বিড়ালকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখা যায়, সন্ধের মুখে শেয়াল কতবার ডেকে ওঠে, গরুর দুধ দুইতে এসে রামধন কবার লাথি খায় এসব গুনে রাখা। পরে প্রতি বছর চৈত্র মাসে বেরোনো “ঘোষেদের চর্চা” বইতে সেসব ঠাঁই পায়। হ্যাঁ, এই বই মামারা নিজেরাই বের করে নিজেদের কাজের ফিরিস্তি দিয়ে। বেনিয়াহাটার সব বাড়িই নাকি এক দু’কপি করে কেনে।

তবে এই সব সম্ভ্রম নাকি একদিনে তৈরি হয়নি। কেউ বলে ইংরেজদের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধে বেনিয়াহাটার এই ঘোষ পরিবারই এই অঞ্চলকে স্বাধীন করে দেয়, এমনকি দেশের স্বাধীনতার ৩০-৪০ বছর আগেই। এই অঞ্চলে ইংরেজরা নাকি আর আসার সাহস পায়নি। আবার কেউ বলে ঘোষদের কাছেই বেণীবরণের মুন্ডু আছে, তাই তাদের কথা না মানলে মৃত্যু নিশ্চিত। আবার অন্যরা বলে, ঘোষদের বাড়িতে সবাই নাকি মানুষ নয় - কিছু ভূতপ্রেতও আছে, মানে যাদের দেখতে দিব্য মানুষ, কিন্তু আসলে নয়। ছোটবেলায় এসব কানাঘুষো বেশি শুনতে পেতাম না, যত বড় হচ্ছি ঠিক কানাঘুষো কানে চলে আসে। তো এবারেও স্কুল ছুটি পড়তেই চলে এলাম মামাবাড়ি। মামাবাড়িতে প্রতিবার ঢুকেই প্রথম একঘন্টা চলে আদর পর্ব, যতই সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করি আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি, নিজের ভাত নিজেই মেখে খেতে পারি এখন, তবু কেউ তেমন গ্রাহ্য করেনা। আদর পর্ব সেরে থাকে প্রণাম পর্ব, মামা-মাসী, হাজাররকম দাদু-দিদা সব এক লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে আর আমরা টপাটপ প্রণাম করে নিই, মুখও দেখি না, একবার এরকম প্রণাম করতে গিয়ে দেখি দুই পায়ের জায়গায় চারপা, তা না বুঝে সেটাও প্রণাম করলে পর হাসির রোলে টনক নড়ে, দেখি প্রণাম করতে করতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গোয়ালের ঠিক বাইরেটায় দাঁড়ানো গরু পয়মন্তীকে প্রণাম করে ফেলেছি। প্রণাম করার সময় আমরা ভাইবোনেরা একটা মজার খেলাও খেলতাম, কে তাড়াতাড়ি সবাইকে প্রণাম করতে পারবে। একবার একটুর জন্য যখন পুটুর কাছে হেরে গিয়ে মনখারাপ করছি, তখন বাইশো মামা (উনি আমাদের বাইশতম মামা তাই) এসে বললো পুটুর হাত ওঁর দুই পা ছোঁয়নি। ব্যস, আমি তো আনন্দে আত্মহারা, সেবার বাইশো মামাকে আমি আমার কাঁচামাখা আমের ভাগও দিয়েছিলাম পরে। তবে সবচেয়ে মজার আর আনন্দের হলো গল্প পর্ব।

আমরা ছোটরা খাওয়াদাওয়া সেরে ঢুঁ মারি পশ্চিমদিকের এক ঘরে। বাড়ির বড় দালান পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় উঠে আবার ওপরের টানা বারান্দা পুরোটা পেরিয়ে গেলে যাওয়া যায় ঐ ঘরে। ঘর তো নয় যেন ডিজনিল্যান্ড। মানে এতকিছু আছে ঘরে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা নিয়ে পড়বো বুঝি না। হরেক রকমের পুতুল, গাড়ি, নানা ধরনের বোর্ড গেম, ক্যারম, মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, স্কুবি,টারজান, হি ম্যান, ব্যাটম্যান, সুপারম্যান সবার বড় বড় পুতুল, সফ্ট টয় সব আছে। তারপর স্লিপ, দোলনা আছে একদিকে। আসলে প্রত্যেকেই যখন মামাবাড়ি আসে তখন বাচ্চাদের জন্য কিছু না কিছু আনে। কোনো নির্দিষ্ট একজনকে না দিয়ে এই ঘরে সেগুলো রাখা হয় আর সবাই মিলে সেগুলো নিয়ে খেলা যায়। এই করতে করতে ঘরটা ভরে উঠেছে খেলার সরঞ্জামে। তো এই ঘরে যখন আমরা খেলি তখন এক দাদু আসেন। আমাদের গল্পদাদু। দাদু এসে নানা জায়গার নানা গল্প বলেন। আমরা সবাই তখন চুপ করে সেগুলো শুনি। কারোর কিছু প্রশ্ন থাকলেও সেগুলোর উত্তর দেন, মা-বাবার মতো রেগে যান না একটুও। সাদা চুল, সাদা দাড়ির সেই দাদু যেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই দেখতে, কিন্তু তিনি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন তা আমরা নিশ্চিত। তাও এবার যখন দাদু এলেন, তখন পুটু বায়না ধরলো সেই সোভিয়েত দেশের রূপকথা বলতে, টুটু রেগে গেল, না তাকে গ্রিক দেশের রূপকথা শোনাতে হবে। চাঁপা বললো, মহাভারত, লোপা বললো রামায়ণ, বনি বললো শেয়ালের গল্প, রনি বললো বাঘের … এরকম ভাবে সবাই বলতেই থাকছিলো আর আমি ভাবছিলাম কখন একটা গল্প শুরু হবে। এদিকে ওদিকে তাকাতে আমার চোখ আটকে গেল দেওয়ালে ঝোলানো একটা ছবিতে। একটা যুবকের ছবি, আঁকা ছবি। আগে দেখেছি কি? মনে পড়ে না। ছবিটা বড় সুন্দর, জীবন্ত। যুবকটি মিটিমিটি করে হাসছে। আমি ইতস্তত করে বলেই উঠলাম, “ওটা কার ছবি দাদু?”

ঠিক সবার বায়না পেরিয়ে দাদুর কানে সেই কথা পৌঁছে গেল। দাদু একটু হেসে বললেন, “ও হলো আমার দাদা। তোমাদের আরেক দাদু। ওর অনেক মজার মজার কাহিনী আছে।”

আমাদের এত দাদু , এত মামা আর এত মাসি যে আমরা জানতেও চাই না ঠিক কারা আসলে কারা। নতুন এক গল্পের আঁচ পেয়ে তাই কালবিলম্ব না করে বললাম, “কি মজার কাহিনী একটা শোনাও না দাদু।” বাকি সবাইইও আমার কথায় তাল মিলিয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু করলো। দাদু হো হো করে হেসে শুরু করলেন।

“তখন দেশ পরাধীন, ইংরেজদের রাজত্ব। জায়গায় জায়গায় বিপ্লব দেখা দিচ্ছে। বাঙালি সন্তানরা কোনো অংশেই কম নয় তা ইংরেজরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। আমাদের এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এলেন চার্লস মুডি। তিনি বেজায় কড়া ধাতের মানুষ। সকাল থেকে রাত কঠোর নিয়ম মেনে চলেন। এদিক থেকে তখন রাজস্ব মানে খাজনা তেমন আদায় হচ্ছে না। গ্রামের চাষিরা সব ফসল ঘরে তুলছে, ইংরেজদের দেবে না। সেপাইরা এসে জোরজুলুম করলেও তারা কিছুতেই খাজনা দেবে না। এক দুজন লোক মরছে তবে তারা পাল্টা মারও দিচ্ছে। সেপাইরা দলবল না নিয়ে এলে ঢোকার সাহস পায় না। তাই ইংল্যান্ড থেকে সোজা তাঁকে এখানে পাঠানো হয়েছে যাতে খাজনা ইংরেজদের ঘরে ঢোকে। আমি তখন ছোট, স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করবো করবো করছি। আমার এই দাদা তিমিরবরণ পড়াশোনার ধার দিয়ে যাননি, তিনি ছিলেন খেলোয়াড়। যেখানে যা পেতেন খেলে ফেলতেন। নিজে নিজেই কত খেলা আবিষ্কারও করতেন। যেমন চুরিলুকো, মাছিকানা, টিক্রেক, বলফুট, কহি, গুলিডাঙ, বসন্ত বউ, গাদি আব্দুল এরকম নানা মজার মজার খেলা। সে গল্প অন্য একদিন বলবো।

তো চার্লস মুডি সাহেব খাজনা না পেয়ে বেজায় খাপ্পা। তিনি নিজে এলেন গ্রামে। ঘোষণা করলেন খাজনা না দিলে তিনি গুলি করে মারবেন সবাইকে। দাদা তখন এগিয়ে গেল। ও পাল্টা বলে উঠলো,

“আমাদের অত ফসল হচ্ছে না। আমাদের একটু সুযোগ দেওয়া হোক।”

দাদা যখন এসব বলছে তখন দাদার হাতে টিক্রেক খেলায় ব্যবহৃত ব্যাট পাক খাচ্ছে।

চার্লস মুডি সাহেব দেশ ছেড়ে পাড়াগাঁয়ে এসে বসে আছেন। ইংল্যান্ডের সেই পরিবেশ, খেলাধুলো কিছুই নেই। তাই তিনিও হঠাৎ এক ফন্দি আঁটলেন।

“আচ্ছা, টিমিরাওণ, একটা সুযোগ ডেব টোমায়। হামার সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে হবে। তোমরা জিতে গেলে খাজনা মাফ। আর আমরা জিতলে তিনগুণ বেশি খাজনা।”

দাদা তখন অস্বীকার করে উঠলো, “কোনোমতেই না। আমরা জিতলে তিন বছরের খাজনা মকুব করতে হবে।”

দাদুর কথা শুনে পুরোটাই কেন জানি খুব শোনা শোনা মনে হচ্ছিল। মনে পড়তেই বললাম, “এ তো লগান এর...”

আমার কথা শেষ না হতেই দাদু বললো, “হ্যাঁ, তোমাদের হালের মুভিতে এটাই ব্যবহার করেছে? কপিরাইট মামলা ঠুকে দিতেই পারি আমরা। তবে মনে হয় দাদা অন্যকিছু বলেছিল। শোনো।” দাদু আবার শুরু করলেন।

“হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। দাদা তখন বলেছিল, “আমরা জিতলে আপনাদের এই তল্লাট ছেড়ে চলে যেতে হবে।”

ওভার কনফিডেন্ট মুডি সাহেব বলে দিলেন, “রাজি।”

সরকারি অফিসে কাজ করা দাদার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তার থেকে দাদা খোঁজ নিয়ে জানলো এই ক্রিকেট খেলা আসলে দাদার তৈরি করা টিক্রেক খেলার মতোই। দাদা খুব খুশি হয়ে গেল। এই খেলায় দাদা তো পারদর্শী। তবে সমস্যা দেখা গেল অন্য জায়গায়। দাদাকে টিম তৈরি করতে হবে এগারো জনের। কিন্তু গ্রাম থেকে কেউই তেমন সাহায্য করতে রাজি নয়। কেউ ফসল বা টাকা দেবে না আবার এদিকে দাদা যখন একটা লড়াই করবে ভাবছে তখন কেউ সাহায্য করতেও প্রস্তুত নয়। আসলে খেলাধুলো করতে তারা রাজি নয় তাও এই গোরা সাহেবদের বিরুদ্ধে। যদি খেলার লড়াই করতেই হতো তবে কাবাডির করলে হতো তা না ক্রিকেট! দাদা যতই বোঝানোর চেষ্টা করে যে আসলে চার্লস মুডি কেউই না তাকে ঐ চাল মুড়ির মতো চিবিয়ে ফেলা যায়, ততই সবাই বলতে লাগলো, মাঠে নামলেই ওদের ঐ লাল রঙের গোলা ছুঁড়ে মাথায় মারলে ওরা মরে যাবে।

দাদার টিক্রেক খেলার সঙ্গী দুজন আর আমায় মিলিয়ে ৪জন হলো। আমাদের বংশও তখন এত বড় ছিল না নাহলে আমাদের বাড়ি থেকেই ১১জন যুবককে নামিয়ে দেওয়া যেত। দাদা বাড়ি বাড়ি যায়, কিন্তু কাউকেই আর রাজি করাতে পারে না। কেউ কেউ শাসিয়ে দেয় ম্যাচ হারলে আমাদের পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করবে তারা। দাদার মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়ে কিন্তু দাদাকে আমি জিজ্ঞেস করলেই বলে, “তুই চিন্তা করিস না, আমি বুঝে নেব।”

ম্যাচের দিন আসতেই দাদা আর আমরা তিনজন সাদা টিশার্ট আর সাদা প্যান্ট পরে চলে গেলাম মাঠে। সারা মাঠ ফাঁকা। একদুজন করে গ্রামের লোক ঢুকতে শুরু করেছে মাঠের বাইরে খেলা দেখবে বলে, ঠিক কী খেলা, কেমন যে হয় তার ধারণাই নেই, তাই আগত লোকদের কৌতূহলও বেশি। কেউ কেউ তো বলে বসলো, “তিমির, ভালো করে খেলিস, শুনেছি এ নাকি কই মাছ ধরার মতো খেলা, ঐ লাল গোলা ধরতে হয় ঐভাবে।” আবার কেউ বললো, “না, না এ খেলা ধান ঝাড়াইয়ের মতো, হাতটা ঐরকম ঘুরিয়ে গোলা ছুঁড়তে হয়।”

সরকারি অফিসের খেলার মাঠে ম্যাচটা হবে। মুডি সাহেব নিজের টিমের প্লেয়ারদের নিয়ে কিছুক্ষণ পর মাঠে ঢোকেন। চারিদিকে লোক দেখে তাঁর ভালোই লাগে। নিজের দেশে খেলা দিনগুলোর কথা হয়তো মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমি দাদার জামার খুঁট ধরে টানলাম।

“কিরে, বাকিরা কোথায়? টস হবে তো এক্ষুণি।”

দাদা মুখটা ছোট করে হাত ঘষতে ঘষতে বললো, “ভাবিস না, শুধু টসটা জিততে হবে।”

টস হলো আর দাদা হেরে গেল। জ্যৈষ্ঠ মাসের সকাল, একটু পরেই বেলা গড়িয়ে সূর্য মধ্যগগনে যাবে। মুডি সাহেব হয়তো ভাবলেন, যত তাড়াতাড়ি এই ইনিংসের ম্যাচ শেষ করা যায় ততই ভালো আর তার একমাত্র উপায় আমাদের আগে ব্যাট করতে পাঠানো। আর তিনি তাই করলেন।

এই চারজনের টিমে কী খেলবো বুঝতে পারার আগেই দেখি আমি ক্রিজের বোলিং এন্ড এ দাঁড়িয়ে। এক লম্বা গোরা সমস্ত পাড়ার দৌড় একা দৌড়ে এসে পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাত ঘুরিয়ে বল করলো। বলটা ছুটলো আর পড়েই বেরিয়ে গেল উইকেটের পাশ দিয়ে। দাদা ব্যাট নড়ানোর সুযোগ পেল না। পরের বলটাও দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেল অফস্টাম্পের পাশ দিয়ে। দাদার কী হাত পা কাঁপছে? অপরপ্রান্ত থেকে দেখে কেমন জানি মনে হচ্ছিল ব্যাটটা ঠকঠক করে কাঁপছে। তারপরের বলে কোনোমতে দাদা কীভাবে জানি ব্যাটে লাগিয়ে চিৎকার করলো, “ছোট।”

আমি ছুটলাম। উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে যখন মুখ তুলে চাইলাম তখন বুঝলাম হাত পা কাঁপা অমূলক নয়। লম্বা গোরা যেন বোম্বাই এক্সপ্রেস, গোঁ গোঁ করে ছুটে আসছে, থামবেই না যেন, আমার কেন জানি মনে হয়েছিল আমি পড়ে যাবো এবার মাটিতে, মাথা ঘুরছে। গোরা হাত ঘুরিয়ে বল করলো, আমার এত ভয় করলো যে আমি ব্যাট হাতে হাত তুলে স্যারেন্ডার করলাম। কিন্তু বলটা আমার আত্মসমর্পণকে পাত্তা না দিয়ে তিনটে উইকেট নিয়ে ছুট লাগালো কিপারের দিকে। আমি বাঁচলাম। আমায় আর ব্যাট করতে হবে না। দাদাকে এতবার খেলতে দেখেই এই অবস্থা আমার, গ্রামবাসীর কেউ নামলে কী হতো তাদের! ভাগ্যিস। কেউ নেই টিমে। সবাই ভিরমি খেত। কিন্তু বাকি সাতজন কোথায়? দাদা যে বললো ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

আমি মাঠের ধারে ছাউনিতে বসলাম, গ্রামের কিছুজন দেখি হাততালি দিলো, লজ্জিত হবো না আনন্দিত, বুঝলাম না ঠিক। দাদার বন্ধু অসিতবরণ নামলো। সেও উঠে চলে এলো পরের ওভারেই, আরেক বন্ধু নবকুমার গেল, আর তারও একই পরিণাম ঘটলো অচিরেই, রান আউট। আমি স্কোরবোর্ড দেখলাম, ২.১ ওভারে ২ রান, ৩ উইকেট। কিন্তু এবার? আর বাকি প্লেয়ার কোথায়? কেউ নামছে না দেখে মুডি সাহেব বললেন, “কি হলো টিমিরাওণ? টোমার আর প্লেয়ার নেই? ইনিংস শেষ? হাহাহাহাহা”

দাদা কী যেন বলছে হাত পা নেড়ে। আমি এত দূর থেকে বুঝলাম না। হঠাৎ দাদা মাঠের একদিকে হাত দেখালো, সবাই ঐ দিকে চাইলো, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। মাঠের দিকে দৃষ্টি এনেই বেমালুম বোকা বনে গেলুম। এ কে? কোত্থেকে এলো? মাঠ ফুঁড়ে এলো নাকি? মাথায় একটা হ্যাট, আর সারা শরীরে কালো কাপড়। কালো জামা, কালো প্যান্ট এমনকী মুখেও কালো রুমাল বাঁধা। চোখদুটো শুধু দেখা যাচ্ছে সারা শরীরের। আর কী দশাসই চেহারা! যেমন লম্বা, তেমন চওড়া। হাট্টাকোট্টা ইংরেজরাও এই লোকটার সামনে কেমন জানি ইঁদুর মনে হলো। ইংরেজদের সবাই মাঠের নানা দিকে ছড়িয়ে গেল ধীরে ধীরে। সেই গোরা বল করতে এলো, দাদা কোনোমতে একরান দিতে সেই কালো লোকটা ব্যাটের সুযোগ পেল। দাদা চিৎকার করে উঠলো, “মারুন স্যার।”

‘স্যার?’ আমি প্রশ্ন করে নিজেই এর উত্তর দিতে যাবো ভাবছিলাম। কিন্তু যা দেখলাম তাতে আমার মুখ হাঁ হয়েই রয়ে গেল। বলটা কোত্থেকে এসে পড়লো আমাদের পাশে। সারা মাঠজুড়ে নিস্তব্ধতা। শুধু দাদা ব্যাট তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচছে। পরের বল এলো, আবার ছয়, তার পরের বলও, শেষ বলে এক রান নিয়ে স্ট্রাইক রাখলো লোকটা নিজের কাছে।

এরুপর থেকে ৪০ ওভার অব্দি যা হলো তা কল্পনাতীত। প্রতি প্রথম ৫ বল ছয় আর শেষ বলে এক রান। হাজার রানের বেশি লক্ষ্য দেখে মুডি সাহেব কেমন যেন সত্যিই মিইয়ে মুড়ি হয়ে গেলেন। সাহেবরা ব্যাট করতে নামলেন। ঐ দুর্ধর্ষ খেলোয়াড়ের মতোই আপাদমস্তক কালোতে ঢেকে মাঠে নেমে গেল বাকি আরো ছয়জন। এবারও এরা যে কোত্থেকে এলো বুঝলাম না। মাঠের চারিদিকে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল তারা। নড়েও না চড়েও না, একইভাবে হাঁটুটা সামান্য মুড়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো তারা। একজন বল করতে গেলো। অল্প দৌড়ে যেই বল ছুঁড়লো দেখি উইকেট ভেঙে পড়ে গেছে। গোরা সাহেব ব্যাট তোলারও সময় পাননি। মুডি সাহেব নামলেন। কালো মানুষটা আবার বল করলো, বলটা মাটিতে পড়ে বাউন্স করেই সোজা হেলমেটে। মুডি সাহেব মাথা ধরে বসে পড়লেন। সরকারি অফিসের লোকরা ছুটে এলো। তাঁর প্রাথমিক সেবা শুশ্রূষা করার সময় দেখা গেল তাঁর মুখ পুরো ফ্যাকাশে। তিনি কোনোমতে উঠে ওভারের তৃতীয় বল ফেস করতে দাঁড়ালেন। কালো মানুষটা ছুটলেন বল হাতে। তাকে দৌড়তে দেখে মনে হলো যেন খ্যাপা ষাঁড় দৌড়েছে। উইকেটের সামনে মুডি সাহেব নড়তে লাগলেন, যেন কোনদিকে যাবেন তা খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার বলটা মাটিতে পড়ে কানের ধার দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেল। মুডি সাহেব তখন বসে হাত পা ছুঁড়তে লাগলেন।

“টিমিরাওণ, এসব কি? এভাবে কেউ করে? এসব কী টিমিরাওণ, আমি খেলবো না যাও। এত জোরে কেউ বল করে? বল যে দেখাই যাচ্ছে না। টিমিরাওণ আমি গেলাম, তুমি সব নিয়ে নাও, আমি খেলবো না, আমি খেলবো না।”

বলে কেমন জানি বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে কাঁদতে প্যাড, গ্লাভস পরে দৌড় লাগালেন। মাঠের চারিদিকে এ দৃশ্য দেখে হাসির শোরগোল পড়ে গেল। সবাই মাঠের মধ্যে এসে দাদাকে তুলে নিয়ে নাচতে লাগলো। অদূরে দাঁড়িয়ে রইলো সাতটি থাম। তারা একভাবে দাঁড়িয়ে রইলো, তাদের চেহারা দেখে কারোর আর সাহস হলো না তাদের কাছে ঘেঁষতে। শুধু আমি আমার কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না। আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তাদের সামনে।

“আপনারা কারা?”

কোনো উত্তর এলো না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা দাদার বন্ধু বা স্যার?”

কোনো উত্তর নেই। আমি তখন কি বলবো ভেবে না পেয়ে বললাম, “একবার রুমাল নামাবেন?”

সাতজনই সোজা তাকিয়েছিল। এই কথায় সাতজনের ঘাড় একসঙ্গে আমার দিকে ঘুরলো। সবাই একসঙ্গে রুমাল নামালো। তারপর যা দেখলাম তা ঐ ভরদুপুরে জনা একশো লোকের উপস্থিতিতেও আমার শরীরের প্রতিটা স্নায়ুকে শিথিল করে দিল, যেন কেঁপে উঠলো শরীরের প্রতিটি কোষ। সাতজনের মুখই আসলে আমার মুখ। আমার, এই তিমিরবরণের ভাই বেণীবরণের।”

এই বলে গল্পদাদু থামলেন। আমরা সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”

দাদু কেমন যেন উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। যেন মন এখানে নেই। দাদু বিড়বিড় করলেন, “তারপর ইংরেজরা সবাই তল্লাট ছেড়ে চলে গেল। দিয়ে গেল অফুরান সম্পত্তি, সবটাই, শুধু আমাদের পরিবারকে। দাদা, বাবা শপথ নিলো গ্রামের স্বার্থে খরচ হবে সব।”

“আর ঐ লোকগুলো? ঐ সাতটা লোক?” টুবলুর প্রশ্ন।

দাদু টুবলুর মুখের দিকে চাইলেন। “তারা সবাই আমাদের বাড়িতে থাকা শুরু করলো। এক নিমেষে আমাদের সব কাজ তারা করে দিত। মাঠে লাঙ্গল দেওয়া, মাছ ধরা, নারকেল পাড়া, গ্রামে স্কুল তৈরি করা, ফসল ফলানো, ফসল কাটা, এমনকী এই বাড়িও তাদেরই তৈরি। সবটাই তারা অতি দ্রুত করে দিত। শুধু একটাই সমস্যা থেকে যাচ্ছিল, তাদের ঐ কাজ করা, ঐ বেশভূষা দেখে গ্রামের লোক হঠাৎ হঠাৎ ভিরমি খেত। তাই বাবা এক উপায়ের খোঁজ করলেন।”

“কি উপায়?”

“একজন মানুষকে তাদের দুনিয়ায় যেতে হবে তাহলেই তারা মানুষের দুনিয়ায় মানুষের মতো থাকতে পারবে।”

“মানে? মানে কি? তাহলে কী তারা...”

কথা শেষ করতে পারলাম না। মাথাটা কেমন ঝিম ধরতে শুরু করলো।

দাদু বললেন, “আজ আর কিছু নয় দাদুভাইরা।

আজ আমি আসি? তোমার ঘুমিয়ে যাও।”

গল্পদাদু এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কী যেন একটা হয়ে গেল, দেখি আমি ঢুলে পড়ছি। চোখ বন্ধ হতে হতে দেখলাম পুটু, পুতুলরাও শুয়ে পড়েছে। গল্পদাদু এলে প্রতিবারই কী এমনটাই...? দাদু, দাদু নিজের নামটা কী যেন বললো? কি যেন…? ঠিক মনে পড়ছে না।