রাস্তা


মূল গল্প “দ্য গেটওয়ে অফ দ্য মনস্টার” প্রথম প্রকাশিত হয় The Idler পত্রিকায় 1910 সালে। সেই সময়ে গল্পের অলংকরণ করেছিলেন Florence Briscoe - যা এই অনুবাদের সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে।

কারনাকির কাছ থেকে গল্প, থুড়ি ওর অভিযানের রোমাঞ্চকর আখ্যান শোনার কয়েকটা নিয়ম আছে।

আমাদের কাছে কার্ড মারফৎ আমন্ত্রণ আসবে। কার্ডে লেখা দিনটিতে, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে সময়মতো ৪২৭ নম্বর চেইন ওয়াক-এ ওর বাড়িতে পৌঁছতে হবে। খাওয়াদাওয়া হবে, তবে সেই সময় মূল ব্যাপার নিয়ে কিচ্ছুটি বলা যাবে না। খাওয়ার পর কারনাকি মুখ খুলবে।

সেদিনও তাই হল। ওর কার্ড পেয়ে আমি, জেসপ, টেলর, আর কার্টরাইট ওর বাড়িতে পৌঁছলাম। আদর্শ গৃহস্বামীর মতো কারনাকি আমাদের আপ্যায়ন করল। জমিয়ে ডিনার সারা হল। হাতে চুরুট, পাইপ, কফি এইসব নিয়ে ফায়ারপ্লেসের কাছে বসা হল।

কারনাকি, যাকে ইদানিং অনেকেই কিছুটা ব্যঙ্গ, আর কিছুটা সম্ভ্রম মিশিয়ে ‘গোস্ট-ফাইন্ডার’ বলছে, শুরু করল ওর সাম্প্রতিকতম ভূতান্বেষণের কাহিনি। চোস্ত গল্প-বলিয়ের কথার ওপর আমার কলম চালানো সাজে না, তাই ও যা-যা বলেছিল, সেটাই লিখে দিলাম এখানে।

 

“আমি কোথায় গেছিলাম সেটা বলা যাবে না। এমনকি ক্লায়েন্টের নামটাও বলা বারণ, তবে ধরে নাও তাঁর নাম… হেন্ডারসন।

হেন্ডারসন আমার কাছে এসেছিলেন একটা সমস্যা নিয়ে। লন্ডন থেকে বেশ কিছুটা দূরে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে একটা বিশেষ ঘর আছে। ঘরটাতে নাকি ভূতুড়ে উপদ্রব চলে। এর বেশি কিছু হেন্ডারসনের কথা থেকে বোঝা গেল না। তবু, আমি বলে দিয়েছিলাম, ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

নিজের মতো করে ওই বাড়ির সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর নিয়ে আমি দু’দিন পর হেন্ডারসনের বাড়িতে পৌঁছলাম। তখন সন্ধে নামছে। বাড়িটা যে বহু-বহু পুরোনো, সেটা দেখেই বুঝতে পারছিলাম। ওই বাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন বাসিন্দা, বাটলার… ধরে নাও, তার নাম পিটার, আমার অপেক্ষায় ছিল। হেন্ডারসন তাকে বলে রেখেছিলেন, আমাকে যেন সব রকম ভাবে সাহায্য করা হয়।

একা-একা ডিনার সারা, তাও আবার ওইরকম একটা চুপচাপ বাড়িতে, বড়োই কঠিন কাজ। সময় কাটানোর জন্যই আমি পিটারকে সেই ঘরটা নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে দিয়েছিলাম। তার কথা শুনে বুঝলাম, ‘গ্রে রুম’ নামে পরিচিত ওই ঘরের সমস্যা দুটো।

প্রথমত, প্রতিদিন সকালে দেখা যায় যে ওই ঘরের বিছানার চাদর কুঁচকে-মুচকে ঘরের এক কোণে পড়ে আছে।

দ্বিতীয়ত, এবং আসল সমস্যা হল, ওই ঘরের দরজা মাঝরাতে খুলে যায়, আর তারপর দড়াম করে বন্ধ হয়। কখনও একবার, কখনও একাধিকবার! আর এই পুরো ব্যাপারটা হয় যখন ঘরের দরজায় তালা তো দেওয়া থাকেই, সেই তালার একমাত্র চাবিও ঝোলে প্যান্ট্রিতে রীতিমতো নজরদারদের চোখের সামনে।

আমাকে কথাগুলো বলতে গিয়ে পিটারের ঘাম ছুটে গেছিল। ও খুব স্পষ্টভাবেই স্বীকার করেছিল, প্রায়ই এমন হয় যে না ঘুমিয়ে ও কান পেতে অপেক্ষা করে সেই মুহূর্তটার জন্য যখন তালাবন্ধ গ্রে রুমের দরজাটা খুলে যাবে, আর সপাটে বন্ধ হবে, একবার, দুবার, তিনবার…!

আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ঘরটা সেই রাতেই একবার দেখতে হবে।

আমার কথা শুনে প্রথমে পিটার ভেবেছিল, আমি বোধহয় ঠাট্টা করছি। সেটা করছি না বুঝতে পেরে ও প্রাণপণে আমাকে থামাতে চেয়েছিল। আমি আগেই জানতাম, বেশ কয়েক শতাব্দী ধরেই রাত নামলে ওই ঘরে ঢোকা নিষেধ। তবু আমি একগুঁয়ে হয়ে ওকে বলেছিলাম, ঘরটা তখনই দেখব আর কয়েকটা জায়গায় সিল লাগাব, যাতে কেউ বদমায়েশি করলে সেটা চট করে ধরে ফেলা যায়।

“আপনি বরং দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিন।” আমি হেসেই বলেছিলাম, “আমার পিছু-পিছু ওই ঘর থেকে অন্য কিছুও যাতে বেরিয়ে না আসে।”

“ওই ঘর থেকে কখনও কিছু বেরিয়ে আসে না স্যার।” ক্ষয়াটে গলায় বলেছিল পিটার, “আমাদের এই বাড়ির মতো … কিছু আপনি কোথাও পাবেন না।”

অস্বীকার করব না, যাবতীয় অভিজ্ঞতা নিয়েও আমার বুকটা ধুকপুক করছিল।

 

ঘরটা বিশাল। দেওয়ালে মাথা ঠেকানো একটা বড়ো খাট, দেওয়ালে ঝোলানো কয়েকটা অযত্নে বেরঙা ফটো, ফায়ারপ্লেস, কয়েকটা কুলুঙ্গি, একটা সোফা, আর তিনটে টেবিল, এছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না ঘরটায়। ওই টেবিল আর ম্যান্টেলপিসে যেক’টা মোমবাতি ছিল, সবগুলো জ্বালানোর পর ঘরের অসহ্য দমবন্ধ পরিবেশটা একটু হালকা হল। আমি চারপাশে এক চক্কর লাগিয়েই জানলা, কুলুঙ্গি, ফায়ারপ্লেস, ফটো, সবকিছুর ওপর রিবন লাগিয়ে মোম আর গালা দিয়ে সিল করা শুরু করলাম।

এই পুরো সময়টা পিটার দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি ওকে ভেতরে আসতে বললাম, ও এল না। আমি ওকে বললাম চলে যেতে, কিন্তু কর্তব্যের খাতিরেই হোক বা হেন্ডারসনের ভয়ে, ফ্যাকাশে চেহারাতেও ও দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। তবে পিটারের মুখ থেকে বেরোনো টুকরো-টাকরা শব্দ থেকেও বুঝতে পারছিলাম, ও বলতে চাইছে, এই ঘরটা যে ঠিক কতটা বিপজ্জনক, সেটা আমি বুঝতে পারছি না।

বিশ্বাস করো, একে তো ঘরে ঢোকার পর থেকেই মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে গেছিল, তার ওপর পিটারের এই বিড়বিড় শুনে আমার স্নায়ুর ওপর চাপ আরো বাড়ছিল। তবু, নিরেট দেওয়াল ছাড়া আর সবকিছু আমি রিবন আর সিল দিয়ে ঢেকে দিলাম, যাতে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে কেউ ও ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলেই সেটা ধরা পড়বে।

এইসব করতে যে কতটা সময় লাগবে, সেটা ঠিক বুঝতে পারিনি। হঠাৎ, বারান্দার বড়ো ঘড়িতে এগারোটা বাজার শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে উঠলাম। তখন পিটারের অবস্থা যদি তোমরা দেখতে! যদি ঘরে ঢোকার সাহস ওর থাকত, তাহলে ও বোধহয় আমার ঘাড় ধরে ঘর থেকে টেনে বের করত।

আমি কোটটা খুলে সোফায় রেখে কাজ শুরু করেছিলাম। পিটারের মুখচোখ দেখে বুঝলাম যে এরপর আমি ঘরে থাকলে ওরই হার্ট অ্যাটাক হবে। ধীরেসুস্থেই কোটটা পরছিলাম। কিন্তু পিটার প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “আপনি এক্ষুনি বেরিয়ে আসুন স্যার! আপনি বুঝতে পারছেন না, সামনে … খুব বিপদ!”

ম্যান্টেলপিসের ওপরের একটা মোমবাতি তখনই নিভে গেল!

সত্যি বলছি, পিটারের কথার সঙ্গে মোমবাতিটার এই বেমক্কা নিভে যাওয়া মিলে আমার এমন অবস্থা করেছিল, মনে হয়েছিল এক লাফে ঘরের বাইরে চলে যাই! কিন্তু জানতাম, যত ভয়ই পাই না কেন, সেটা প্রকাশ করা যাবে না। তাই নিজেকে সংযত করে, যথাসাধ্য দ্রুত হেঁটে আমি আগে ম্যান্টেলপিসের ওপর থেকে তখনও জ্বলতে থাকা মোমবাতিটা তুলে নিলাম। তারপর অন্য মোমবাতিটা, আর ঘরে জ্বলতে থাকা বাকি মোমগুলোর কাছে গিয়ে সেগুলো নিভিয়ে সবক’টা মোমকে হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

এই সময়টায়, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, ঘরের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, যেন কোনো একটা অদৃশ্য জানলা কেউ খুলে দিয়েছে। এমনকি গ্রে রুমের দরজাটা বন্ধ করার জন্য টানতে গিয়েও আমার মনে হল…

মনে হল, যেন কেউ দরজাটা ঘরের ভেতর থেকে টেনে ধরেছে।

তবু, গায়ের জোরে আমি দরজাটা বন্ধ করলাম, লক করলাম, সিল করলাম, এমনকি চাবির ফুটোটার ওপর আমার একটা কার্ডও সেট করলাম যাতে ভেতর থেকে কেউ লক নিয়ে কারিকুরি করলেই সেটা বোঝা যায়।

পিটারকে সঙ্গে নিয়ে আমি যখন নীচে নামলাম, তখন ওর ফ্যাকাশে মুখ, আর প্রায় কাঁপতে থাকা চেহারা দেখে আমি আরেকবার বুঝলাম, ও বেচারাও এতক্ষণ ধরে কী সাংঘাতিক চাপ সহ্য করেছে!

ঘুমোনোর জন্য তৈরি হতে-হতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল। ইতিমধ্যে, যাতে অন্য কোনো ঘরের দরজা খুলে বা বন্ধ করে কেউ আমাকে চমকাতে না পারে, সেজন্য আমি করিডরে গ্রে রুম আর আমার ঘরের মাঝের সবক’টা দরজায় সিল মেরে এসেছিলাম। ক্লান্তি, আর স্নায়ুর ওপর একটু অপ্রত্যাশিত রকমের চাপ, দুয়ের বশে ঘুম আসতে দেরি হল না।

 

বেশ কিছুক্ষণ পরে, সেটা কতক্ষণ আমি জানি না, গভীর ঘুমের মধ্য থেকেও আমি জেগে উঠলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি, কেন ঘুমটা ভেঙেছে। তারপরেই করিডরের কোথাও দড়াম করে একটা দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পেয়ে মাথাটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, ঘুমের মধ্যেও আমি এমন একটা আওয়াজ পেয়েছিলাম।

এক হাতে মোমবাতি, অন্যটায় পিস্তল নিয়ে দরজা খুললাম। ঠিক করেই রেখেছিলাম, গ্রে রুমে গিয়ে একটা এসপার-ওসপার করব কিন্তু… যা কখনও হয়নি, সেটাই হল তখন।

তোমরা জান, আমি ভীতু নই। ভীতু হলে এই লাইনে আমি টিঁকতে পারতাম না। কিন্তু করিডরে দাঁড়িয়ে দারুণ ভয়ে আমি প্রায় জড়বৎ হয়ে গেলাম!

না! আমি কিছু দেখিনি। অন্তত তখনও কিছু হয়নি দেখার মতো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, যেন নরক থেকে উঠে আসা একটা নোংরা, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই ঘরটার কাছেই। ফলে ঘরটার দিকে আমি এক ইঞ্চিও এগোতে পারছিলাম না।

কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর আমি আর পারলাম না। সুবোধ বালকের মতো নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লক করলাম, খাটে এসে বসলাম, আর সারা রাত জেগে ওই ঘরের দরজার সপাটে বন্ধ হওয়ার শব্দ ও তার প্রতিধ্বনি শুনলাম।

 

অবশেষে আকাশের গা থেকে কালো কম্বলটা সরিয়ে ভোর এল। তার প্রায় ঘণ্টাখানেক আগেই দরজা সপাটে বন্ধ হওয়ার ব্যাপারটা থেমেছিল। ভোর হওয়ামাত্র আমি ফ্রেশ হতে শুরু করেছিলাম। আমি জানতাম যে এমন ঘটনার মাঝে ভয় পেয়ে যাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। অনেক সময় আমাদের অবচেতন মন এই ভয় পাইয়ে দিয়েই আমাদের অনেক কিছু সম্বন্ধে সতর্ক করে। কিন্তু তবু ভয় পেয়ে নিজের ঘরে খাটের ওপর বসে রাত জাগার পর আমি যে বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম, সেটা অস্বীকার করব না।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি পিটার ট্রে-তে আমার জন্য কফি নিয়ে উঠে আসছে। বেচারির চেহারা দেখে বুঝতে পারছিলাম, সারারাত ও-ও ঘুমোয়নি। আমি হাসিমুখে কফির জন্য ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “রাতভোর না ঘুমিয়ে দরজার শব্দ শোনার পর এটা না হলে বিপদ ছিল।” শুনে পিটার বলেই ফেলল, “ঈশ্বর আপনাকে সুবুদ্ধি দিয়েছেন স্যার। আমি তো ভেবেছিলাম, আপনি ঝোঁকের মাথায় না রাতে ওই ঘরে আবার ঢুকে পড়েন!

পিস্তল দিয়ে রক্তমাংসের দুশমনের মোকাবিলা করা যায় স্যার, কিন্তু ওই ঘরে যা আছে…!”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে গ্রে রুমের দিকে এগোলাম, পিটারও পিছু নিল।

দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম, চাবির ফুটোর ওপর লাগানো আমার কার্ডটা যেমন ছিল, তেমনই আছে। কিন্তু দরজার সিলটা ভেঙে গেছে। সেটাকে পুরোপুরি সরিয়ে আমি, খুউব সাবধানে, দরজা খুলে ঘরে ঢুকলাম।

ঘরে এক নজর বুলিয়ে মনে হল, সব ঠিকঠাক আছে। জানলাগুলো দিয়ে তখন আলো ঢুকছিল। আসবাব সব ঠিকঠাক জায়গাতেই ছিল। আমি একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলতে যাব, তখনই পিটার চেঁচিয়ে বলল, “বিছানার চাদরগুলো দেখুন স্যার!”

তাই তো! বিছানার চাদরগুলো কেউ বিছানা থেকে তুলে ঘরের এককোণে ছুড়ে ফেলেছে।

তার মানে, কাল রাতে এই ঘরে কেউ, বা কিছু ছিল!

পিটার চাদরগুলো তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি ওকে আটকালাম। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমি ঘরের আগাপাস্তালা পরীক্ষা করে বুঝলাম, আমার একটি সিলও কেউ ভাঙেনি। মানুষী বদমাইশির কোনো চিহ্ন না পেয়ে আমি পিটারকে বললাম ঘর গুছিয়ে ফেলতে। ও বিছানা আবার পরিপাটি করে সাজানোর পর আমরা বেরিয়ে এলাম।

ব্রেকফাস্ট, ও এক রাউন্ড হাঁটাহাঁটির পর মাথাটা একটু সাফ হল। ঠিক করলাম, আরো খুঁটিয়ে ঘরটা দেখতে হবে। পিটার, আর একটি কাজের মেয়ের সাহায্য নিয়ে আমি ঘর থেকে সব আসবাব, খাট, এমনকি দেওয়ালের ফটোগুলো অবধি বের করে দিলাম। তারপর আতস কাচ দিয়ে ঘরের ইঞ্চি-ইঞ্চি জায়গা দেখে নিশ্চিত হলাম, সত্যিই ওই ঘরে এমন কেউ বা কিছু আগের রাতে কোনোভাবে এসেছিল, যে পায়ের ছাপ বা আঁচড়, কিছুই ফেলে না!

সবকিছু আগের জায়গায় রেখে দিয়ে, আবার সর্বত্র সিল আর রিবন লাগিয়ে আমি ঘরটা তালাবন্ধ করলাম। ডিনারের পর, পিটারের সাহায্য নিয়ে আমি গ্রে রুমের ঠিক উলটোদিকের দরজায় আমার ক্যামেরা আর ফ্ল্যাশলাইটটা ফিট করলাম। লেন্সের ঢাকনা খুলে আমি সবকিছু একেবারে তৈরি করে রাখলাম, যাতে দরজা খোলা হলেই একটা সুতোয় টান পড়ে, ফ্ল্যাশ ঝলসে ওঠে, আর দরজার ওপাশে যে বা যাই থাকুক না কেন, তার ছবি উঠে যায়।

তারপর শুরু হল আমার অপেক্ষা।

 

মোমবাতি জ্বালিয়ে, ঘড়িতে রীতিমতো অ্যালার্ম দিয়ে, শুতে গেছিলাম। ফলে ঠিক রাত বারোটায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। ড্রেসিং গাউনের পকেটে পিস্তল নিয়ে আমি দরজা খুললাম। হাওয়ায় নিভে গেলে বিপদে পড়ব ভেবে আমি একটা ঢাকা লণ্ঠনের ব্যবস্থা করেছিলাম। সেটারই মৃদু আলোয় বাইরেটা দেখে নিলাম।

করিডর শুনশান! বাড়ি নিস্তব্ধ।

আমি নিজের ঘরের দরজায় গুছিয়ে বসলাম। মুখ রইল গ্রে রুমের দিকে, যেখানে আমার ক্যামেরা অপেক্ষা করছিল কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য।

প্রায় ঘণ্টাদেড়েক পর মনে হল, আমার মাথার পেছনদিকটায় কেমন একটা… অনুভূতি হচ্ছে! মনে হচ্ছে, যেন কিছু একটা ফুঁটছে সেখানে। আমার হাত ঘামতে শুরু করল। মনে হল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

আর তখনই ফ্ল্যাশলাইটের চোখ-ধাঁধানো আলোয় করিডরটা সাদা হয়ে গেল!

তারপরেই এল অন্ধকার। ওই সাদা আলোর তীব্র ঝলকের পর আমার হাতে ধরা লণ্ঠনের আলোটা হাস্যকর লাগছিল। তবু তাতেই আমি বোঝার চেষ্টা করলাম, গ্রে রুম থেকে কেউ, বা কিছু, বেরিয়ে আসছে কি না।

দরজাটা সপাটে বন্ধ হল তখনই।

শব্দটা বাড়িটাকে তো বটেই, মনে হচ্ছিল যেন আমার হাড়ে, দাঁতে, মগজে, সবকিছুতে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে। একটু ধাতস্থ হওয়ার আগেই দরজাটা আবার আওয়াজ তুলল, দড়াম! দড়াম!! দড়াম!!!

তারপর সবকিছু চুপচাপ হয়ে গেল।

তারপর কতক্ষণ কাটল, খেয়াল নেই। কয়েক মিনিট, কয়েক ঘণ্টা, কয়েক যুগ… কিন্তু ওই নিস্তব্ধতা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না! মনে হচ্ছিল, অন্ধকারে, আমার দৃষ্টির আড়ালে, কিছু একটা যেন গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

হঠাৎ আমার হাতে ধরা লণ্ঠনটা নিভে গেল!

সত্যি বলছি, ভয় নয়। আমার তখন অন্য একটা কথা মনে হল।

কী সাংঘাতিক বোকামি করছি আমি! আমার শত্রু কে তা না জেনে, তার শক্তি সম্বন্ধে কিচ্ছু না বুঝে, আমি অন্ধকারে তার সামনে নিজেকে বলির পাঁঠার মতো পেশ করেছি!

উঠে দাঁড়ানো, এক লাফে নিজের ঘরে ঢোকা, আর দরজাটা সপাটে বন্ধ করা, এই কাজগুলো আমি প্রায় যন্ত্রের মতো করে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস! নইলে দরজা দিয়ে কিছু একটা জিনিসের আমার দিকে এগিয়ে আসার অনুভূতি, তারপর দরজাটা বন্ধ করার মুহূর্তে আমার খুব কাছে একটা মৃদু গলা-খাঁকড়ানোর মতো শব্দ শোনার পর আমার অবস্থা, এসব মাথায় রাখতে গেলে আমি পুতুলের মতো অনড় হয়ে যেতাম, আর তারপর যে কী হত…!

নিজের বিছানায় বসে, দরজার দিকে পিস্তলটা তাক করে যখন বসেছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, আমার হাত-পা সব রবার দিয়ে বানানো। পিস্তলটাও মনে হচ্ছিল খেলনা। আমি বুঝতে পারছিলাম, হ্যাঁ, আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম যে দরজার ওপাশে কিছু একটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে… যার সামনে আমার গায়ের জোর, বা এই পিস্তলটাও তুচ্ছ।

শেষ অবধি ওইভাবে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। এক টুকরো চক দিয়ে ঘরের মেঝেতে একটা পেন্ট্যাকল, মানে পঞ্চভুজ আঁকলাম, তারপর সেই জায়গাটাতে ঢুকে বসে রইলাম যতক্ষণ না ভোর হয়। এই সময়টা গ্রে রূমের দরজা, কিছুক্ষণ পর-পর, সপাটে বন্ধ হচ্ছিল। সেই আওয়াজ আমার হাড়পাঁজরা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু আমি নড়িনি।

অবশেষে সেই অসহনীয় রাতটা শেষ হল। অন্ধকার পাতলা হওয়ার পর দরজাটা আর আওয়াজ তুলছিল না। পুরোপুরি আলো ফোটার আগে আমি একরকম মরিয়া হয়ে গ্রে রুমের উলটোদিকে রাখা আমার ক্যামেরার লেন্সের ক্যাপটা আটকানোর জন্য এগোলাম। সত্যি বলছি, ভয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল! কিন্তু কিছু করার ছিল না। লেন্সের ক্যাপটা না আটকালে ভোরের আলোয় প্লেটটা নষ্ট হয়ে যেত। আমি কোনোক্রমে সেটুকু করে, ঘরে ফিরে, পেন্ট্যাকলটা মুছে খাটে বসে রইলাম।

আধ ঘণ্টা পর পিটার কফি নিয়ে আমার ঘরের দরজা খটখটাল।

 

আমরা দুজনেই ওই ঘরে গিয়ে দেখেছিলাম, এক কোণে কুঁচকে পড়ে থাকা বিছানার চাদর ছাড়া ঘরের বাকি সব কিছু, যেখানকার যা সব সেখানেই আছে। একটা সিলও ভাঙেনি। এত কষ্ট করে ফটো তোলার চেষ্টা করেও প্লেটটা ডেভেলপ করে দেখলাম, তাতে আধখোলা দরজাটা ছাড়া আর কিছুই আসেনি। একে তো রাতজাগার ফলে স্নায়ুর ওপর চাপ, তায় প্লেটে কিছু না পাওয়ার হতাশা, সর্বোপরি ঘরটায় ঢুকে সিলগুলো পরখ করার সময়েও একটা অদ্ভুত অস্বস্তি… সব মিলিয়ে আমার একদম ভালো লাগছিল না। কিন্তু এও বুঝতে পারছিলাম, পালিয়ে যাওয়া যাবে না। গভীর রাতে এই ঘরে যেই আসুক না কেন, তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া না করে আমি শান্তি পাব না।

দুপুরের খাওয়া সেরে, নিজের সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে আমি আবার গেলাম গ্রে রুমে।

নতুন করে কয়েকটা জায়গায় সিল লাগালাম। তারপর একটা কাজ করলাম যেটা তখন খুব দরকারি বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন ভাবতেও খারাপ লাগছে।

একটা ছোট্ট ঝুড়িতে, নরম বিছানা বানিয়ে, একটা বেড়ালের বাচ্চাকে তার মধ্যে শুইয়ে দিলাম। সেটা গা-হাত চেটে চটপট ঘুমিয়েও পড়ল। ঝুড়িটা ঘরের এক কোণে আমার নজরের মধ্যেই রাখার সময় আমার মাথায় এটা ছিল যে পশুপাখি অনেক সময় সতর্ক করে দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেয়, কিন্তু…

যাইহোক। আগের রাতে লাগানো রিবন, আর ক্রিসক্রস করে থাকা সুতোগুলো সরিয়ে দিলাম সবচেয়ে আগে। তারপর ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে ঠিক একুশ ফিট ব্যাসের একটা বৃত্ত মেপে নিলাম। জায়গাটা হিসপ, মানে এক ধরনের সুগন্ধি লতা দিয়ে বানানো ব্রাশ দিয়ে সাফ করলাম। তারপর জায়গাটা চক দিয়ে আঁকা একটা বৃত্ত দিয়ে চিহ্নিত করে নিলাম। ঠিক করে নিলাম, গ্রে রুমের অনাহূত অতিথির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য ওই বৃত্তাকার জায়গাটাই হবে আমার দুর্গ।

যেসব তন্ত্রমন্ত্রের সাহায্য নিয়ে আমি আমার ওই দুর্গকে সুরক্ষিত করলাম, তার বিস্তারিত বিবরণ তোমাদের কাছে ক্লান্তিকর ঠেকবে। শুধু এটুকু বলি যে পুরোনো বইয়ের পাতা ঘেঁটে জানা সবকিছু দিয়েও যে সবসময় ওই ধরনের… জিনিসের মোকাবিলা করা যায় না, সেটা জানা ছিল বলে আমি পেন্ট্যাকল, ওয়াটার সার্কল, এসব করেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই, ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো করে একটা কথা আমার মাথায় চিড়িক দিয়ে উঠল!

প্রফেসর গার্ডার তাঁর ‘এক্সপেরিমেন্টস উইথ আ মিডিয়াম’ বইয়ে বেশ স্পষ্ট করে বলেছিলেন, মিডিয়ামকে কোনোভাবে একটা ইলেকট্রিকাল ফিল্ডের মধ্যে রাখতে পারলে তার শক্তি একদম চলে যায়। মনে হয় যেন চেতনার অতীত যে জায়গাটার সঙ্গে তার সংযোগ ছিল, সেই জায়গাটা থেকে মিডিয়াম একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সেই সময়ে।

বিস্তর মাথা খাটিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বাঁচতে চাইলে আমাকে ইলেকট্রিসিটির সাহায্য নিতেই হবে। তবে শুধু আলো জ্বালানো নয়। মন বলছিল, যে জিনিসের সামনে পড়তে চলেছি তার হাত থেকে বাঁচতে গেলে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জেনে আসা তথাকথিত ‘ম্যাজিক ফিগারটা’ না জুড়লে বিপদ ঠেকানো যাবে না।

ঠিক করলাম, এমনভাবে ভালভ আর ব্যাটারি দিয়ে জিনিসটা সাজাব, যাতে তার প্রতিটি কোণ চক দিয়ে আঁকা পঞ্চভুজাকৃতি নক্ষত্র, মানে পেন্ট্যাকলের কোণের সঙ্গে মিশে যায়। তাই করলাম। সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করলাম, যাতে আমার ‘ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকল’-এর যেগুলো ভ্যালি, মানে ভেতরে ঢুকে আসা নীচু জায়গা, সেগুলো যেন ওয়াটার সার্কলের নানা জায়গায় রাখা আশীর্বাদী জলের শিশিগুলোর সঙ্গে পেন্ট্যাকল তথা বৃত্তাকার জায়গার কেন্দ্রের সঙ্গে এক রেখায় থাকে।

এসব করতে-করতে দিনের আলো ফুরিয়ে কখন যে রাত নেমেছে, টেরও পাইনি। তবে আঁধার ঘনাচ্ছে বুঝেই চটপট ওয়াটার সার্কলের নানা জায়গায়, বেশ হিসেব কষে রাখা মোমবাতিগুলো জ্বালালাম। তারপর ব্যাটারি জ্বালিয়ে আমার ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলকে সচল করলাম।

বৃত্তের মধ্যে বসে দেখে নিলাম, আমার ক্যামেরা আর ফ্ল্যাশলাইট, দুটোই ঠিকঠাক আছে। পিস্তলটা সামনে রেখে, চারপাশের আলো দেখে এক মুহূর্তের জন্য বেশ নিশ্চিন্ত লাগল।

 

বেশ কিছুক্ষণ পর, ঘড়ি দেখিনি বলে বলতে পারব না তখন কত রাত, আমার মনে হল, ঘরের মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে! মনে হল, বন্ধ ঘরের মধ্যেও আমি যেন ঠান্ডা, অনেকটা থেঁতলানো রসুনের মতো গন্ধের একটা বাতাসের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। মোমবাতির শিখাগুলো সেই অদ্ভুত হাওয়ায় দুলে উঠছে, ঘরের মধ্যে আলোর পরিমাণটাও একরকম না থেকে যেন বাড়ছে-কমছে!

বুঝতে পারলাম, ঘরের যে কোণে বিছানার চাদরগুলো কুঁচকে পড়ে থাকতে দেখেছি দু’বারই, সেখান থেকেই যেন হাওয়াটা আসছে। কিন্তু কীভাবে…

আর তারপরেই মোমবাতিগুলো নিভে যেতে শুরু করল।

মনে হল, যেন চোখের পলক ফেলার আগেই ওই বৃত্তের সীমা বরাবর জ্বালিয়ে রাখা সবক’টা মোম নিভে গেল। ঘরের আর বাইরের অন্ধকারের বিরুদ্ধে বৃত্তের মধ্যে বন্দি আমার সঙ্গে রইল শুধু ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলের হালকা নীলচে আভাটুকু।

ওই অল্প আলোয় ঘরের মধ্যে বেশিদূর নজর চলে না। তার মধ্যেও মনে হল, ওই অদ্ভুত বাতাসটার সঙ্গে মিশে যেন একতাল অন্ধকার চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে বৃত্তের চারপাশে। মাঝেমধ্যেই আমি অন্ধকারটাকে ঘরের সর্বত্র ঘন হয়ে ওঠা ছায়ায় হারিয়ে ফেলছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল, যেকোনো মুহূর্তে একটা কিছু আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে। ঘেমে ওঠা হাতেও আমি পিস্তলটাকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে একটু সাহস জোগাতে চেষ্টা করছিলাম।

হঠাৎ একটা মৃদু, কোনো সরীসৃপের বুকে হেটে এগোনোর মতো আওয়াজ পেলাম।

দারুণ ভয়ে আমার চুল খাড়া হয়ে উঠেছিল। তবু, মাথা ঠান্ডা রেখে বুঝতে পারলাম, বিছানার চাদরগুলোকে কেউ ধীরে-ধীরে সরিয়ে দিচ্ছে। জঘন্য কোনো অপরাধ করার আগে যেভাবে অপরাধী তার শিকারের দিকে এগিয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই যেন কেউ চাদরগুলোকে টেনে নিচ্ছে নিজের দিকে।

সব থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য। আমার চোখে পলক পড়ছিল না। বিছানার চাদরগুলো অনড় হয়ে কিছুক্ষণ পড়ে রইল খাটের ওপর। তারপর আবার শুরু হল ধীরলয়ে, একটা তেলতেলে মেঝেতে সাপের এগিয়ে যাওয়ার মতো করে চাদরগুলো টেনে নেওয়া।

আমার স্নায়ুগুলো জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় এসে গেছিল। তার মধ্যেও আমার মনে পড়ল, আমার নাগালের মধ্যেই আছে একটা ফ্ল্যাশলাইট, আর একটা ক্যামেরা। বিছানা থেকে নজর না সরিয়েই ক্যামেরার দিকে হাত বাড়ালাম।

তখনই, একটা মারাত্মক রকমের রাগ আর হিংস্রতার সঙ্গে বিছানার চাদরগুলো ছুড়ে ফেলা হল ঘরের ওই বিশেষ কোণে!

ঠিক কীরকম ছিল আমার তখনকার মানসিক অবস্থা, সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না। চোখের সামনে ওই ঘটনাটা ঘটতে দেখে আমার মতো পোড়খাওয়া লোকও… তার চেয়েও বড়ো কথা কী জান? সেই রাতের আসল খেল তখনও শুরুই হয়নি!

আমি যখন ভাবার চেষ্টা করছি, এরপর আমার কী করা উচিত, তখনই মনে হল, আমি যেন দরজার কাছে কিছু একটা আওয়াজ শুনলাম। অনেকটা… অনেকটা কোনো পোকার চিটিরপিটিরের মতো। তারপরেই বুঝলাম, ব্যাপারটা কী।

ঘরের দরজায় লাগানো সিলটা কেউ ভেঙেছে!

ক্যামেরাটা আমি হাতে নিলাম, কিন্তু কিছু করার সুযোগ পেলাম না। ঠিক তখনই দরজাটা বন্ধ হল! সপাটে। মনে হল, যেন আমার কানের গোড়ায় বাজ পড়ল। ফাঁকা ঘরের মধ্যে সেই বিশাল আওয়াজের ধাক্কা সামলানোর আগেই অন্য একটা আওয়াজ আমার কানে এল।

আমি শুনতে পেলাম, বেড়ালের বাচ্চাটা যে ঝুড়িতে রাখা ছিল, সেটা থেকে হালকা ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ উঠছে। পরমুহূর্তেই বেড়ালটা একটা বীভৎস আর্তনাদ করে উঠেই থেমে গেল!

আমি ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালাম। দেখলাম, ঝুড়িটা উলটে গেছে। বেড়ালের বাচ্চাটার শরীর যেভাবে তার থেকে বেরিয়ে ঝুলেছিল, তা থেকে এটাও স্পষ্ট হচ্ছিল যে তার শরীরে আর প্রাণ নেই।

চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে গেলাম, ঘরের মধ্যে যে এসেছে সে অশুভ, এবং চরম ক্ষতিকর।

আলোটা গরম হয়ে উঠছিল। সেটা নেভাতে বাধ্য হলাম। তৎক্ষণাৎ মনে হল, পেন্ট্যাকলের ওই মৃদু নীলাভ আলো ছাড়া ঘরের সর্বত্র যেন একটা অন্ধকারের সমুদ্র তৈরি হয়েছে। দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, সেই সমুদ্রে ঢেই তোলার মতো করে কিছু একটা ঘুরছে বৃত্তের চারপাশে।

ধীরে, অতি ধীরে, আমার চোখ সেই অন্ধকারেও মানিয়ে নিল। তখন আমি ওটাকে দেখতে পেলাম!

ওয়াটার সার্কেল, মানে আশীর্বাদী জলভরা ছোটো শিশিগুলো বসিয়ে যে বৃত্তাকার জায়গাটা আমি চিহ্নিত করেছিলাম, তার কাছ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল ওটা। মনে হচ্ছিল, যেন অন্ধকারেরই কিছুটা অংশ জমাট বেঁধে একটা প্রকাণ্ড মাকড়সার আকার নিয়েছে! তবে খুব কাছে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলেই ছ্যাঁকা লাগার মতো করে ওটা ছিটকে পিছিয়ে যাচ্ছিল আবার।

ঘুরেই চলছিল ওটা। বারবার। কিন্তু একটা সময়ে, সেটা কতক্ষণ পর তা আমি সত্যিই বলতে পারব না, কারণ মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে ওটা আমার চারপাশে ঘুরছে, ওটা ঘুরপাক খাওয়া বন্ধ করল।

দেখে নয়, বরং অনুভব করছিলাম, জিনিসটা আরো জমাট বাঁধছে। একটা মরিয়া চেষ্টা করার আগে যেমন পাঁয়তারা কষা হয়, তেমন করে ওটা যেন নিজেকে তৈরি করছে।

তারপর ওটা আমার দিকে ধেয়ে এল!

আমি হাঁটু মুড়ে বসেছিলাম। কী ঘটছে সেটা ভেবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু তবু, আমার শরীর নিজে থেকেই ছিটকে গেল পেছন দিকে। ঘেমে যাওয়া ডান হাত দিয়ে আমি পিস্তলটা তুলে তাক করার চেষ্টা করলাম। তবে যখন দেখলাম… যখন দেখলাম যে আমার ওয়াটার সার্কেল আর অন্যসব বাধা পেরিয়ে জিনিসটা সোজা আমার দিকে আসছে, আমি বোধহয় ভয় পেয়ে চেঁচিয়েই উঠেছিলাম!

একেবারে শেষ মুহূর্তে, জিনিসটা যখন আমার থেকে বড়োজোর কয়েক ফুট দূরে, ওটাকে ছিটকে পিছিয়ে যেতে দেখলাম আমি! মনে হল, যেন কিছু একটা শক্তি, যার জোর ওই জমাট বাঁধা অন্ধকারের চেয়েও বেশি, জিনিসটাকে দূর করে দিল আমার সামনে থেকে।

ঠিক কতক্ষণ লেগেছিল স্বাভাবিক হতে, বলতে পারব না। একটু-একটু করে বুঝতে পারলাম, আমি নিরাপদ!

তলিয়ে দেখে বুঝলাম, আমার নড়াচড়ার ফলে কোনো এক সময় একটা জলভরা শিশি উলটে গেছিল। তার ফলেই জিনিসটা ওয়াটার সার্কেল ভেঙে এগোনোর সুযোগ পেয়েছিল। সামান্য ওই শিশিটুকুই উলটে গিয়ে, আমার ‘দুর্গে’ ঢোকার মতো একটা রাস্তা বানিয়ে দিয়েছিল জিনিসটার জন্য।

আরো বুঝলাম, জিনিসটা আসলে একটা বিশাল হাত!

অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকেও আমি হাতটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম, ওটা আছে। ঘরের মধ্যেই আছে। আর সুযোগ খুঁজছে, যাতে আমার নাগাল পাওয়া যায়।

মাঝে হাতটা মরা বেড়ালের বাচ্চাটাকে তুলে নিল। আর তারপর সেটাকে মাটিতে আছড়ে চলল! বিশ্বাস করো, সেই ভোঁতা আওয়াজটা শুনতে-শুনতে আমার মনে হচ্ছিল, যেন নরকবাস করছি!

কিছুক্ষণ পর সেটাও থেমে গেল। তারপর দরজাটা একটু খুলেই সপাটে বন্ধ হল। স্নায়ুর ওই টানটান অবস্থার মধ্যে দরজার আওয়াজটা একেবারে দাঁতে-দাঁত ঠেকিয়ে দিল আমার।

একটু পরেই হাতটা আবার আমার দিকে ধেয়ে এল!

না, আমাকে কোনোভাবে তৈরি হওয়ার সুযোগ দেয়নি হাতটা। অসাবধানে আমার একটা হাত রাখা ছিল ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলের একটা বাহুর ওপর। ঠিক সেই বরাবর হাতটা আমার দিকে ছুটে এসেছিল।

অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে আমি হাতটা সরিয়ে পেছনদিকে ঠিকরে গেলাম।

হাতটাও ঠিক পেন্ট্যাকলের ওপর এসে শক খাওয়ার মতো ছিটকে সরে গেল।

বুকের ভেতর এত জোরে আওয়াজ হচ্ছিল, যে মনে হচ্ছিল উত্তেজনা আর ভয়েই আমার কিছু একটা হয়ে যাবে। হাতটার আর আমার নাগাল পাওয়ার দরকার হবে না। তবু, সেই অবস্থাতেও, আমি একটু তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম, এই নিয়ে পরপর যে দুটো ‘দুর্ঘটনা’ হাতটাকে আমার কাছ অবধি পৌঁছতে দিল, সেগুলো কি সত্যিই ঘটনাচক্রে হয়েছিল?

নাকি, আমার অজান্তেই হাতটা আমাকে দিয়ে এমন কিছু করাচ্ছে, যাতে ও আমার নাগাল পায়?

কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে আমি হঠাৎ নিজের পা-টা লম্বা করে দিলাম। ভাবটা করলাম, যেন আমার অজান্তেই পা-র ধাক্কা লেগে একটা জলভরা শিশি উলটে গেছে। শিশিটা কাত হয়ে একটু জল পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু সতর্ক ছিলাম বলে সেটাকে চটপট সোজা করে দিতে পেরেছিলাম আমি।

তবু, সেই সময়টুকুতেও হাতটা আমার দিকে এগিয়ে এসেছিল। আমার মুখ থেকে খুব সামান্যই দূরত্বে ছিল ওটা, তবে কোনো কারণে, কিছু একটাতে ধাক্কা খেয়ে, ওটা আবার ছিটকে গেছিল পেছনে। আমার নাগাল না পেলেও জিনিসটার সঙ্গে জড়িত একটা হিংস্র, অশুচি, অশুভ শক্তি আমার চেতনায় এমনভাবে ঘা দিয়েছিল যে মনে হয়েছিল… আমি আর কোনোদিন আমার ভেতরের শুদ্ধতাকে ঠিক আগের মতো চেহারায় ফিরে পাব না!

পেন্ট্যাকলের মাঝে গুঁড়ি মেরে আমি আবার অপেক্ষা করতে থাকলাম। এবার শুধু হাতটাকে নয়, আমি নিজেকেও সতর্ক নজরে রাখছিলাম। একটু আগের ঘটনা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমার দুর্বল হয়ে আসা স্নায়ুর ওপর কোনোভাবে জোর খাটিয়ে ওয়াটার সার্কেলকে ভাঙা হচ্ছে। ফলে হাত-পা টানটান করতে গেলে, বা বসার ভঙ্গিটা বদলাতে গেলেও মনে হচ্ছিল, আমাকে দিয়ে কিছু করানো হচ্ছে না তো?

হাতটা আমার চারপাশে ঘুরছিল। ঘরের মধ্যে সেই হাওয়াটাও বইছিল, যেটা আমি পেয়েছিলাম আগের রাতে। ঠান্ডা, একটা অদ্ভুত গন্ধমাখা, গায়ের প্রতিটি লোম খাড়া করে দেওয়া সেই হাওয়া আমার শরীর-মনের ওপর যে কী ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছিল তা … তা আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না।

অবশেষে ভোর হল। সবচেয়ে আগে বন্ধ হল ওই হাওয়া। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আমি বুঝতে পারলাম, হাতটা ঘরের কোথাও নেই। আলো বাড়ল, আকাশ থেকে চুঁইয়ে নেমে এসে সেই আলো ঘরকেও ভরিয়ে তুলল। ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলের মৃদু নীল আলোটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে এসেছিল। তবু, পুরোপুরি দিন না হওয়া অবধি আমি আমার দুর্গ ছেড়ে বেরোনোর কোনো চেষ্টা করিনি। বেশ কিছুক্ষণ পর, যখন শুধু আলো নয়, অন্যান্য আওয়াজ থেকেও বুঝতে পারছিলাম যে রাত, এবং তার আড়ালে ওত পেতে থাকা বিভীষিকাটি বিদায় নিয়েছে, তখনই আমি চক দিয়ে আঁকা ওই বৃত্তের বাইরে বেরোলাম। বেশি কিছু করার অবস্থায় ছিলাম না। কোনোক্রমে গ্রে রুম থেকে বেরিয়ে দরজাটা লক করলাম। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুলাম। পিটার এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ওর আনা কফিটা নিঃশব্দে শেষ করলাম। পিটার নিজেও কোনো কথা বলল না, চুপচাপ কাপটা নিয়ে চলে গেল। আমি বিছানায় শুলাম। তারপর ঘুমোলাম না অজ্ঞান হলাম, অত জানি না।

 

দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হব-হব করছে, তখন আমার ঘুম ভাঙল। ফ্রেশ হয়ে, অত বেলায় লাঞ্চের বদলে যা পাওয়া যায় তাই খেয়ে, আবার গ্রে রুমে ঢুকলাম। আমার প্রথম কাজ ছিল মৃত বেড়ালটার একটা সদ্গতি করা, নইলে পিটার এবং ওই বাড়ির অন্যদের শুধুশুধু ভয় আর কষ্ট পেতে হবে। ওটাকে বাড়ির পেছনের জংলা জায়গায় পুঁততে গিয়ে ছায়ারা আরো লম্বা হয়ে গেল। তারপর ওই ঘরে ঢুকে আমি ঘরের ওই কোণটার ওপর মনোনিবেশ করলাম যেখানে বিছানার চাদরগুলো ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। সেই বিশেষ হাওয়াও যেহেতু ওই কোণ থেকেই এসেছিল, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এখানেই কিছু একটা আছে।

সাদা চোখের খোঁজাখুঁজিতে কিছু পেলাম না। কিন্তু দেওয়ালের গায়ে লাগানো প্যানেল আর মেঝের জোড়ের জায়গায় কয়েকটা গর্ত করে সেখানে সরু শিক ঢুকিয়ে দেখতে গিয়েই একটা জিনিস পেলাম! বেশ কসরত করে ওটাকে দেওয়ালের নীচের সেই গর্ত থেকে বের করে জানলার কাছে নিয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম, জিনিসটা একটা আংটি!

একটা অদ্ভুত ধূসর ধাতু দিয়ে পঞ্চভুজাকৃতি তারার আকারে বানানো হয়েছে আংটিটাকে। তবে তাতে কোণগুলো উঠে নেই, বরং একেবারে মসৃণ হয়ে রয়েছে। যাঁরা এই জগতটা নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা জানেন, পঞ্চভুজাকৃতি নক্ষত্রের পাঁচটা শীর্ষদেশ যদি ঠিকঠাক আগলানো হয়, তাহলে সেটা একটা রক্ষাকবচ। কিন্তু এই আংটিটা তা নয়। যদি এতে ওই পাঁচটা কোণ উঁচু হয়ে থাকত, তাহলে এটা উপত্যকাকে পাঁচটা পাহাড় দিয়ে ঘিরে রাখার মতো করে ধারককে সুরক্ষিত করত। তার বদলে এটা কিছু একটার জন্য রাস্তা হিসেবে কাজ করছে!

তার মানে, একদা হেন্ডারসন পরিবারের সম্পত্তি, এবং দীর্ঘ অদর্শনে প্রায় কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া তথাকথিত ‘লাক রিং’ বা সৌভাগ্যের আংটি আমি খুঁজে পেয়েছি!

হেন্ডারসন পরিবারের কোনো এক পূর্বপুরুষ ক্রুসেডে গিয়ে এই আংটিটা নিয়ে এসেছিলেন। যে অবস্থায়, যেখান থেকে আংটিটা পাওয়া গেছিল তাই নিয়ে বিস্তর গল্প আছে। আমি এই পরিবার, তথা গ্রে রুম নিয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়েই সেগুলো শুনেছিলাম। এই আংটিটা এক কালে বংশানুক্রমে বাবা থেকে ছেলের কাছে যেত, তাতে নাকি পরিবারের সৌভাগ্য অটুট থাকত। কিন্তু আংটিটা যেন কখনও পরা না হয়, এ ব্যাপারে একেবারে কড়া আদেশ ছিল।

শুধু, স্যার হালবার্ট, হেন্ডারসনের এক পূর্বপুরুষ, এই আদেশ মানেননি। নেশার ঘোরে বাজি ধরে ভদ্রলোক একরাতে আংটি পড়ে শুতে যান। এই গ্রে রুমটিই ছিল তাঁর শোয়ার ঘর। পরদিন সকালে হালবার্টের স্ত্রী এবং শিশুপুত্রের মৃতদেহ পাওয়া যায় এই ঘরের খাটে। বীভৎসভাবে গলা টিপে মারা হয়েছিল দু’জনকেই! সবার সন্দেহ এসে পড়ে হালবার্টের ওপর। লোকে ভাবে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাগে বা বিরক্তিতে তিনিই দুজনকে মেরেছেন। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য হালবার্ট এই ঘরেই পরের রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরও একই দশা হয়। তারপর থেকেই গ্রে রুমে রাত কাটানো বন্ধ হয়ে যায়। পাকেচক্রে আংটিটাও হারিয়ে যায়।

 

কমে আসা আলোয়, জানলার ধারে আংটিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা দানা বাঁধতে শুরু করল।

আমি জানতাম, গ্রে রুমে যদি আমি রাত কাটাই, তাহলে সেই রাতে একটা চরম চেষ্টা হবেই আমার নাগাল পাওয়ার জন্য। আমি এও জানতাম, যদি কোনোভাবে অশুভ শক্তি, মানে যেটা দানবিক হাতের আকারে ওই ঘরে জেগে উঠছে অন্ধকার নামলে, এই আংটিটা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে সে আমার নাগাল পাবে না।

আমি তৈরি হলাম সেই রাতের জন্য।

তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও আমার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করতে, বিশেষ করে ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলটিকে ঠিকঠাক সাজাতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। যখন আমি আংটিটা নিয়ে পেন্ট্যাকলের মধ্যে ঢুকে বসলাম, তখন রাত নেমেছে। আমার প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু প্রাণের মায়া ছিল বলেই পিস্তল হাতে নিয়ে, মোমবাতির হলুদ আর পেন্ট্যাকলের হালকা নীল আলোয় আলোকিত পরিবেশে বসে আমি ঘরের ওই কোণটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, যেখান থেকে বাতাস বয়েছিল আগের রাতে।

প্রায় ঘণ্টাদুয়েক কাটল। মাঝে কয়েকবার আমার মনে হয়েছিল, বিপদ আমার খুব কাছে এসেছে। কিন্তু সতর্ক থেকেও আমি কিছু দেখতে বা শুনতে পাইনি।

রাত তখন বারোটা। আমার হঠাৎ মনে হল, সেই হাওয়াটা অনুভব করছি।

আর… সেটা আসছে আমার পেছন থেকে!

দারুণ আতঙ্কে আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল। শক খাওয়ার মতো করে পেছনে ফিরে আমি বুঝতে পারলাম, হাওয়াটা আসছে ওই আংটি থেকে।

ওই দানব যে রাস্তা দিয়ে এই ঘরে, এই দুনিয়ায় ঢোকে, আমি সেটাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছি!

নিজের ভুল নিয়ে আক্ষেপ করার সময়টুকুও আমার কাছে ছিল না। চেষ্টা করছিলাম আংটিটা তুলে নিয়ে সেটাকে আমার ‘দুর্গের’ বাইরে ছুড়ে ফেলতে। কিন্তু একটা জীবন্ত জিনিসের মতো সেটা পিছলে বেরিয়ে গেল আঙুলের ফাঁক দিয়ে! আরেকবার সেটা তুলতে গিয়েই মনে হল, কিছু একটা জিনিসে ধাক্কা খাচ্ছি।

দেখতে পেলাম, হালকা কুয়াশা, বা কালো ধোঁয়ার মতো করে কিছু একটা বেরিয়ে আসছে আংটিটা থেকে, ওই হাওয়ায় ভর দিয়ে। বুঝলাম, সেই দানবিক হাতটা, আমার পাশেই, ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকল তথা ওয়াটার সার্কলের মধ্যে, জমাট বাঁধছে!

না। আমি আর কিছু ভাবিনি। অতটা ভয় পেলে হয়তো অন্য কেউ জড়বৎ হয়ে যেত। কিন্তু আমি এক লাফে পেন্ট্যাকলের ভালভ, জলের শিশি, চক দিয়ে আঁকা বৃত্ত, সব পেরিয়ে বাইরে এসে পড়লাম।

হাতটা কোনো প্রকাণ্ড শিকারি প্রাণীর মতো থাবা মারল আমার দিকে। কিন্তু আগের রাতে ঠিক যা হয়েছিল, এবারও তাই হল। একটা অদৃশ্য প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে হাতটা আবার পিছিয়ে গেল পেন্ট্যাকলের মধ্যে।

আমি গ্রে রুমের দরজাটা খোলার চেষ্টা করলাম! সাপের চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে যাওয়া প্রাণীর মতো ওই হাতটা থেকেও আমি নজর সরাতে পারছিলাম না। তবু, কোনোভাবে, আমি দরজাটা খুলে করিডরে বেরিয়ে আসতে পারলাম। দরজাটা সজোরে বন্ধ করা, পকেট হাতড়ে চাবিটা বের করা, সেটা দিয়ে দরজাটা তালাবন্ধ করা, প্রায় দৌড়ে নিজের ঘরে ঢোকা, আর ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে পড়া: এই কাজগুলো আমি ভেবে করিনি, কারণ ভাবতে গেলে হয়তো পারতাম না। হয়তো অজ্ঞানই হয়ে যেতাম!

তবে একটা দৃশ্য আমার মনে ছিল, আছে, থাকবে।

একটা বিশাল, কালো হাত বারবার চেষ্টা করছে পেন্ট্যাকলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে, কিন্তু পারছে না!

 

আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বা, একথাই বলা ভালো যে অবসাদ, ক্লান্তি, ভয়, সাংঘাতিক বিপদের হাত থেকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা পাওয়ার অনুভূতি, সব মিলিয়ে আমার শরীর আর মনের ওপর অচেতনতার একটা পুরু চাদর টেনে দিয়েছিল। পিটার কফি নিয়ে এসে আমাকে না তুললে আমি কতক্ষণে উঠতাম, কে জানে!

কফি খেয়ে, ফ্রেশ হয়ে, আমি পিটারকে নিয়ে গ্রে রুমে গেলাম।

ঘরের মোমবাতিগুলো তখনও জ্বলছিল। পেন্ট্যাকলের নীল আলোগুলো নিষ্প্রভ হয়েও টিঁকে ছিল। আমার গড়া সেই দুর্গের মধ্যে নিতান্ত সামান্য চেহারায় পড়ে ছিল আংটিটা।

ঘরের অন্য কিচ্ছুটি ছোঁয়া হয়নি।

দানবটা ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলের ওই গণ্ডি পেরোতে পারেনি!

আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজাটা তালাবন্ধ করলাম। আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে, ব্রেকফাস্ট সেরে, আমি বেরোলাম কিছু জরুরি জিনিস নিয়ে আসতে। দুপুরের মধ্যেই আমি সেসব নিয়ে ফিরে এলাম ওই বাড়িতে। জিনিসগুলো ছিল একটা অক্সি-হাইড্রোজেন জেট, আর দুটো সিলিন্ডার। আমি সেসব নিয়ে গ্রে রুমে ঢুকলাম, পাঁচ মিনিটে আংটিটা একটা গরম ধাতুর পিণ্ডে পরিণত হল।”

 

কারনাকি কথা থামিয়ে, কোটের পকেট থেকে একটা কাগজে মোড়া কিছু একটা জিনিস বের করে আমায় দিল। আমি সযত্নে কাগজের মোড়কটা খুলে দেখলাম, তার মধ্যে রয়েছে ধাতুর একটা ছোট্ট বলের মতো জিনিস। অনেকটা সীসার মতো রঙ সেটার, কিন্তু অনেক বেশি উজ্জ্বল।

“হুম!” জিনিসটা আমরা সবাই নেড়েচেড়ে দেখার পর আমি জানতে চাইলাম, “তা এরপর কি ঘরটাতে আর কিছু… মানে আর কোনো সমস্যা হয়নি?”

“নাঃ!” পাইপে তামাক ঠেসতে-ঠেসতে বলল কারনাকি, “আমি সেই রাতে, এবং তারপর আরো দু’রাত ওই ঘরেই ঘুমিয়েছিলাম। প্রথমে তো পিটারের হার্ট অ্যাটাকই হয়ে যাচ্ছিল আমার পরিকল্পনা শুনে, কিন্তু তৃতীয় রাতের মধ্যে ও অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। আমার তো মনে হচ্ছিল, ঘরটা একেবারে সাধারণ, আর পাঁচটা ঘরের মতোই হয়ে গেছে বলে বেচারি একটু মুষড়েই পড়েছে!

আসলে রাস্তা! একটা রাস্তা খোঁজে শুধু ওরা। সেটা পেলেই দানব হোক বা মানব, অন্ধকার ঢুকে পড়তে পারে আমাদের ঘরে, আমাদের দুর্গে!”