বুম্বা


বুম্বাকে আমি প্রথম দেখি এক বিয়ে বাড়িতে। নেমন্তন্ন খেতে যাব বলে হাতে একটা মোটাসোটা গল্পের বই নিয়ে বিয়ে বাড়ি ঢুকে দেখি তখনো তেমন কিছু অতিথি সমাগম হয়নি। কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে বুঝলাম একটু তাড়াতাড়িই আসা হয়ে গেছে। যাক, এসেই যখন পড়েইছি, মোটা বইটা কোলের উপর রেখে একটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসলাম।

বিয়ে বাড়ির লোকজন খুব ব্যস্ত সমস্ত হয়ে আসা যাওয়া করছে। বর মশাই কখন আসবে জানা নেই। বাড়িটা একটা একান্ন বর্তি পরিবার। এ বাড়ির সবচাইতে ছোট ছেলের মেয়ের বিয়ে। সে এক কলেজে পড়ায়। মাঝে মধ্যে আমার বইয়ের দোকান থেকে বই টই কিনে থাকে। সেই সুত্রে আলাপ। ওর অনুরোধে দুএকবার কলেজ স্ট্রিট থেকে খুঁজে পেতে দুচারটে দুস্প্রাপ্য বই এনে দিয়েছিলাম। তার নিমন্ত্রণেই বিয়ে বাড়িতে পদার্পণ। আর কাউকে চিনি না বলে একটু চিন্তায় আছি। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, “কে আপনি?”, তো পরিচয় কী দেব সেই নিয়ে মাথা চুলকচ্ছি। পরিচয় যুতসই না হলে বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। জিজ্ঞাসা করলে কী বলব? বইয়ের দোকানদার? আজকাল লোকে বই টই বিশেষ পড়ে না। বইয়ের দোকান চালাই শুনলে লোকে কেমন যেন করুণার চোখে দেখে।

সার দেওয়া চেয়ারে গুটি কতক লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। তারা অতিশয় সাধারণ মাপের। অন্তত এ বাড়ির সাথে খাপ খায় না। দুঃস্থ আত্মীয়ও হতে পারে। ভিতরের ঘরে হালে পানি না পেয়ে হয়ত বাইরে এসে সময় কাটাচ্ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি আট দশ বছরের রোগা পটকা একটা ছেলে চেয়ারে বসে একমনে মোবাইলে ভিডিও গেম খেলে চলেছে। আজকাল এই হয়েছে বাচ্চাদের এক বেয়াড়া ধরণের এ্যাডিকশন। সময় কাটানোর জন্য ভাবলাম এর সাথেই খানিক আলাপচারিতা করা যাক।

আমি নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “কী খেলছ বাবু? আমায় দেখাবে?”

সে মোবাইলের বোতাম টিপতে থাকল। কিচ্ছু বলল না। আমি ওর সাথে কথাবার্তা চালাবার জন্য বললাম, “তুমি স্কুলে পড়? কোন স্কুল, কী ক্লাস?”

ছেলেটি মোবাইলে গেম খেলা বন্ধ করে কানফাটানো তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “এত প্রশ্ন কর কেন তুমি? আমাকে ডিস্টার্ব করছ! বলব কেন তোমাকে? তুমি কে?”

সভয়ে বলে উঠি, “তুমি খেল বাবু। কিছু বলতে হবে না। খেল তুমি, খেল। তোমাকে ডিস্টার্ব করার এতটুকু ইচ্ছে আমার নেই।”

“না খেলব না। তুমি নষ্ট করে দিয়েছ। তুমি বাজে লোক। বিচ্ছিরি।”

“আচ্ছা আচ্ছা বাবু, আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি চলে যাচ্ছি।”

চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াচ্ছি, হটাত তিনি আমার হাতের বই কেড়ে নিয়ে ফ্যারফ্যার করে মোড়ক ছিঁড়ে ফেললেন। মোড়ক উন্মুক্ত, “ছিন্নমস্তার অভিশাপ” বেরিয়ে পড়ল। বিব্রত হয়ে হাত থেকে বই কাড়তে গিয়ে বিপদ হল, তিনি চেয়ারের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে দৌড়াতে লাগলেন। আমিও ছুটি তার পিছন পিছন। সে বাড়ির বারান্দায় উঠে পড়তেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক জিন্স-টপ সুশোভিত, হিলাসনা সুন্দরী। হিল তোলা জুতোর উপর বরতনু ব্যালান্স করতে করতে তিনি তেড়ে এক ধমক লাগালেন, “বুম্বা!!! হোয়াট আর ইউ ডুইং? ফেরত দাও, এখুনি আঙ্কেলের বই ফেরত দাও। নটি বয়, এমন করে কখনো?”

ভদ্রতা করে বলি, “থাক থাক, বাচ্চা তো! ছেড়ে দিন। আমি না হয়...”

“ইস, আপনার বইটার কভার ছিঁড়ে গেছে। আপনি নিশ্চই গিফট করছিলেন, এখন...”

ছিন্নমস্তার করাল বদনের দিকে তাকিয়ে বলি, “হেঁ হেঁ, আর একটা মলাট না হয় পাশের দোকান থেকে...”

“বুম্বা, যাও আঙ্কেলকে সরি বল, বল বলছি। ইউ নটি বয়!”

সজোরে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিল বইটা, আমার ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ মাটিতে গড়াগড়ি। মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ধুলো ঝাড়লাম। বইয়ের কারবারি বলে বইয়ের উপর আমার একটু দুর্বলতা আছে। বুম্বার মা ছেলের এক হাত চেপে ধরে আমার মাটি থেকে বই কুড়নোর দৃশ্য দেখতে লাগলেন। তারপর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে অন্তঃপুরে বিলীন হলেন। আমি চললাম ছিন্নমস্তাকে পোশাক পরাতে।

***

কলেজের এক অধ্যাপক প্রায়ই আমার দোকানে আসেন বই কিনতে। তার আবার একটু লেখালেখির বাতিক আছে। এক আধটা বই আমার দোকানে বিক্রি হবার জন্য রেখেও ছিলেন। ক্রেতা না পেয়ে, ধুলোয় বিবর্ণ হয়ে, শোকেসে তারা আজও বিরাজমান। তা তিনি আবার একটা বই লিখেছেন। আমাদের এই মফস্বল শহরে তো আর কলেজ স্ট্রিট নেই। তাই বই ছাপা হয়ে যাওয়ার পর তার মোড়ক উন্মোচন হল তারই বাড়িতে। সেখানে মাঝে মধ্যে সাহিত্যের আসরও বসে। আমি অবশ্য সেই আসরে কোনোদিন আসিনি।

অধ্যাপক আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন একদিন দোকানে স্বয়ং এসে। জানাতে ভুললেন না, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে মিষ্টি মুখের ব্যবস্থাও আছে। জঠর দেবতার পুজো না থাকলে আজকাল কেই বা এমন সব অনুষ্ঠানে যেতে চায়! এও জানা আছে, আমাকেই প্রকাশিত বই বিক্রির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে। উনি আবার একটু সেকেলে, ফেসবুক টুক করেন না। কাজেই বিজ্ঞাপনের অভাবে একটা বইও বিক্রির সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।

অধ্যাপক সামন্তর বাড়িতে গিয়ে দেখি জনা বিশেক লোকের সমাগম হয়েছে তার ড্রয়িং রুমে। বুম্বা সেখানে বিরাট একটা খেলনা এরোপ্লেন নিয়ে সারা ঘর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঢুকতে গিয়ে তাই আমি একটু থমকে গেলাম। প্রমাদ গনলাম, এখানেও বুম্বা?

বুম্বার মা ঘরে ঢুকলেন হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে। আমাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, “আপনি? এখানে?” যেন আমি এক অনাহূত অতিথি।

অধ্যাপক সামন্ত বললেন, “ইনি ইন্দিরা, সম্পর্কে আমার শ্যালিকা হন। আর ইনি বিমল বাবু। স্টেশন রোডে এনার একটা বইয়ের দোকান আছে।”

উপস্থিত অতিথিরা আমার দিকে তাচ্ছিল্য পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। ভাবখানা, বইয়ের দোকানদার বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের অনুস্থানে আবার কী করছে। এমন ভাবার কারণ আছে। আমার না আছে গাল ভর্তি দাড়ি, না আছে কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা। একটা ভদ্রস্থ পাঞ্জাবিও নেই।

প্রাথমিক চা পর্ব সারা হলে বুম্বার মা বলে উঠলেন, “এবার অধ্যাপক সামন্তর লেখা কবিতার বই – ‘আবার আসিব ফিরে’র মোড়ক উন্মোচন হবে। আপনারা একটু কাছে এগিয়ে আসুন।”

সমবেত করতালিতে সামন্ত মশাইয়ের ড্রয়িং রুম কেঁপে উঠলো। তার চাইতে জোরে কেঁপে উঠল অন্তপুর থেকে এক মহিলা কণ্ঠের আর্তনাদ। বুম্বার মা ভিতরে ছুটলেন। গিফট র‍্যাপে মোড়া কবিতার বইগুলো অনুন্মোচিত রয়ে গেল। সামন্ত মশাই ড্রয়িং রুম ছেড়ে শ্যালিকার পিছন পিছন ছুট লাগালেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, “নিশ্চই বুম্বা কিছু ঘটিয়েছে।”

পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুম্বাকে চিনতে আমার বাকি নেই। যে কোনোরকম দুষ্কর্ম করায় সে সিদ্ধহস্ত। বুম্বা মা সহ ফিরে এলে জানা গেল, সে রান্নাঘরের ওয়াটার ফিল্টারের কল খুলে দিয়ে কোন ফাঁকে পালিয়ে গিয়েছে। রান্নাঘর জলে থৈথৈ। বাড়ির কাজের লোক রেগে আগুন।

কিছুক্ষণ পর বুম্বা ড্রয়িং রুমে ফিরে এসে মুখ গোঁজ করে বসে থাকল। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন সামন্ত মশাইয়ের শ্বশুর মশাই। অনুষ্ঠান শেষে সবার হাতে একটা করে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হল। অধ্যাপককে বিদায় জানিয়ে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি, দেখি আমার প্যাকেটটা বেমালুম বেপাত্তা। বুঝলাম আবার বুম্বার কাজ। আর একটা প্যাকেট চাইতে ভদ্রতায় বাধল। বইয়ের দোকানদার হতে পারি, তাই বলে হ্যাংলা হিসাবে নাম কেনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। অগত্যা ভগ্ন হৃদয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখি মিষ্টির প্যাকেট থেকে একটা একটা করে খাবার পাঁচিলের উপর দিয়ে প্রজেক্টাইল বানিয়ে ছুঁড়ে চলেছে বুম্বা। বেজায় রাগ হল। পিছন থেকে ওর ডান কান ধরে মুচড়ে দিয়ে বলি, “আমার জিনিষের উপরই তোর এত রাগ কেন রে হতভাগা?”

বুম্বা উঠে দাঁড়ালো। তারপর পা দিয়ে আমার পায়ের পাতার উপর সজোরে একটা লাথি কষিয়ে দিল। আমি কঁকিয়ে উঠে আবার ওর কান ধরতে যেতেই দেখি, বুম্বার মা। আমাকে দেখে আবার বলে উঠলেন, “কী বিমল বাবু, বুম্বার সাথে গল্প করছেন বুঝি! আপনার তো বইয়ের দোকান। আসবেন আমাদের বাড়িতে। ওকে গল্প শুনিয়ে যাবেন মাঝে মধ্যে। বেশি দূর না, এই কাছেই থাকি আমরা। জানেন, বুম্বার বাবাও অনেক গল্প জানে। কিন্তু, কি করবে বলুন? সময় পায় না। অফিস নিয়ে সদাব্যস্ত!”

মনে মনে ভাবি, বুম্বাকে গল্প শোনাতে এসে শেষে নিজের প্রাণটাই খোয়াই আর কী! বুম্বার বাবার প্রক্সি দেওয়ার দুর্মতি যেন ইহজীবনে না হয়!

***

তারিণী মোহন সিনিয়ার সেকেন্ডারি স্কুলে আমি নিয়মিত স্কুলের বই সাপ্লাই করে থাকি। অনেকদিন ওরা আমার পেমেন্ট আটকে রেখেছিল। রিসেপ্সনিস্টের অনুমতি নিয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকতেই তিনি একগাদা ফাইলের উপর থেকে চোখ তুলে বলে উঠলেন, “আরে বসুন বসুন বিমল বাবু। আপনার চেক রেডি করাই আছে। সই করে দিয়ে দিচ্ছি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।” বলেই তিনি বেল বাজিয়ে এটেন্ডেন্টকে ডেকে ফাইল আনতে নির্দেশ দিয়ে আবার একমনে কাজ করে যেতে লাগলেন।

আমি এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়াচ্ছি। হটাত প্রিন্সিপালের ঘরের দরজা সজোরে খুলে গেল। বিরক্ত মুখে উনি দরজার দিকে তাকালেন। আমার পিঠের পিছন থেকে কোনও মহিলা কণ্ঠ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “ম্যাম, আবার এই ছেলেটা সাংঘাতিক এক কাণ্ড ঘটিয়েছে”!

পিছন ফিরতেই শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। আবার বুম্বা। পৃথিবীর যেখানেই যাই, বুম্বা আমার পিছন ছাড়বে না, এটাই সত্য।

প্রিন্সিপাল বিরক্তি এড়াতে পারলেন না, কিন্তু সামনে একজন বাইরের লোক উপস্থিত ভেবেই হয়ত নিজেকে সংযত করে জিজ্ঞেস করলেন, “আবার কী ঘটাল এ? তোমাদের না বলেছিলাম একটু নজরে রেখ ছেলেটাকে...”

“ম্যাম, আজ যা করেছে, ওর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বায়োলজি প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে আমাদের মাছের একোয়ারিয়ামে হাত ঢুকিয়ে মাছ বার করে এনেছে। শুধু তাই না, কোথা থেকে যেন একটা ব্লেড নিয়ে এসে সেই মাছটাকে আবার কেটেওছে।”

“আশ্চর্য। প্র্যাক্টিকাল ক্লাস চলছে, আর কেউ ওকে দেখতে পেল না?”

“তখন ক্লাস ছিল না। নিজের ক্লাস থেকে বেরিয়ে রোজ সারা স্কুল ঘুরে বেড়ায়। গার্জেন কল করেও কিছু করা যায়নি। যেই দেখেছে প্র্যাক্টিকাল রুমে কেউ নেই অমনি...। ভাগ্যিস মাত্র একটা মাছই কেটেছে, নইলে আজ কি যে হত!”

বুম্বা, এতক্ষন তাকে নিয়ে যা আলোচনা হচ্ছে, গম্ভীর মুখে পিছনে হাত রেখে এতক্ষণ শুনে যাচ্ছিল। এবার সে জোরের সাথে প্রশ্ন করে, “বাজার থেকে আমরা যে মাছ কেটে আনি রোজ, তখন কী হয়? আমি কাটলেই দোষ?”

সঙ্গের দিদিমণিটি চেঁচিয়ে উঠে বলে, “এ্যাইইইই, ক্লাস টু এর ছেলে, মুখে আট পাকা কথা কেন রে! এমন ছেলের মুখ থাবড়ে লাল করে দিতে হয়।”

“করে দেখো, আমি তোমার মুখের কী করি!” বুম্বা অস্ফুটে বলে। মনে হয় যেন আমাকে বলল। দিদিমণিটি এত রেগে ছিলেন, বোধহয় কথাটা তার কানে যায়নি।

প্রিন্সিপাল রেগে উঠে বললেন, “গার্জেন কল কর। এখুনি। আজই এই ছেলের টিসি দিয়ে দেব। দুষ্ট গরুর চেয়ে...”

“শূন্য গোয়াল ভাল”, টিকাটি সম্পূর্ণ করল বুম্বা স্বয়ং। দুই দিদিমণির সম্মিলিত চিৎকারে যেন ঘরের মধ্যে বোমা ফাটল। আমি দেখলাম, আজ আর চেক পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই গুটি গুটি সবার অলক্ষ্যে বাইরে চলে এলাম।

***

হপ্তা দুয়েক কেটে গেছে। বুম্বার ঘটনা ভুলে গিয়েছি, কারণ স্কুলের দারোয়ান এসে পাওনা চেকটা দিয়ে গেছে। টাকা অনেক ঘটনা ভুলিয়ে দেয়। একদিন সকালে দোকান খুলে সবে বসেছি। এ পাড়ার খিটকেলে বুড়ো রোজকার মতো দোকানের বাইরের টুলে বসে দু নম্বর কাগজ ছেড়ে তিন নম্বরে হাত বাড়িয়েছে। বইয়ের সাথে দুচার খানা খবরের কাগজ না রাখলে মান থাকে না। শুধু খবরের কাগজ পড়া উদ্দেশ্য নয় বুড়োর। দোকান খোলার পর দুখিরাম চাওয়ালার দোকান থেকে বাচ্চা ছেলেটা চা দিয়ে যায়। বয়স্ক মানুষের সামনে একা একা কী আর চা খাওয়া যায়? দুখিরামের ছেলেটাকে আর বলতে হয় না- নিজে থেকেই দুগ্লাস চা রোজ দোকানের কাউন্টারে ঠকাঠক নামিয়ে দেয়। বিনি পয়সায় চা আর খবর সাঁটানো বুড়োর মুন্ডুপাত করতে করতে ধুপকাঠি জ্বালিয়েছি – বামাকণ্ঠ মুখরিত হল, “আরে কাকাবাবু, কেমন আছেন? অনেকদিন দেখি না!”

মুখ তুলে দেখি ইন্দিরা, বুম্বার মা। সাতসকালে মনে হচ্ছে একরাশ জুঁই ফুল যেন! আজ ময়ূরকণ্ঠী রঙের শাড়িতে। খিটকেল বুড়ো একগাল হেসে বলে, “তোমাকে তো ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে মা! ঠিক যেন সরস্বতী। তো এত সকালে কোথায় চললে?”

সাক্ষাত সরস্বতীকে দেখে আমার হাতদুটো আপনা থেকেই বুকের কাছে জড়ো হয়ে নমস্কার জানাল। ইন্দিরা আমাকে দেখে খুশি হয়ে উঠল।

“এইটা আপনার দোকান? আমরা খুব বেশীদিন আসিনি তো, তাই জানতাম না”

“এখন চিনে গেলেন, আর আসতে অসুবিধা হবে না নিশ্চই”, ভদ্রমহিলাকে ভদ্রতা করে বলি।

নাছোড়বান্দা বুড়ো আবার বলে উঠলো, “কোথায় গিয়েছিলে সেজেগুজে, সেটা বললে না তো!”

“আর বলবেন না। বুম্বার স্কুল থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল। ওর বাবা যা ব্যস্ত, তার সময় নেই ছেলের স্কুলে হাজিরা দেওয়ার। আর ছেলেটা যা দুষ্টু হয়েছে না, বলার নয়! স্কুলের টিচারগুলোও হেয়েছে তেমনি। একটা বাচ্চা ছেলের দুষ্টুমি ম্যানেজ করতে পারে না, তারা আবার নিজেদের টিচার বলে!”

আমি হেসে ফেলে বলি, “আবার কী করল বুম্বা?”

“কিচ্ছু না। শুধু একটু বাচ্চাদের টিফিন খেয়ে ফেলেছে। কি কথাটাই না শোনালো! আচ্ছা, আমাদের সময় এমন দুষ্টুমি তো কতজন করত! তার জন্য গার্জেন কল হয়েছে কখনো? হয়নি, বলুন!”

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাই। খিটকেল বুড়ো সরব হয়, “বাচ্চারা তো দুষ্টুমি করবেই। তাদের শাসন করতে হবে, বোঝাতে হবে। ওর বাবাকে বলে দেখ।”

“তবেই হয়েছে কাকাবাবু। তার সময় হলে তো! যত ঝক্কি আমার উপর।”

আমি বুম্বার নামে অভিযোগ দায়ের করবার মতো বলে উঠলাম, “কিন্তু এই সেদিন স্কুলের ল্যাবে গিয়ে যে বুম্বা মাছ ধরে ডিসেকশন করে ফেলল, সেটা কী সমর্থন করা যায় বলুন?”

মুখ ফস্কে বলে ফেলেই ভাবলাম, এবার আর ভবিষ্যতে এনার হাতে একটা বইও বিক্রি হবার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। বুম্বার মা আমার কথায় উত্তেজিত হয়ে কাউন্টারের একেবারে সামনে এগিয়ে এসে বললে, “আপনিও জেনে গেছেন সেকথা? জানেন, আমিও প্রিন্সিপালকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি, আগে আমাকে এক্সপ্লেন করা হোক, বুম্বা ব্লেডটা কোথায় পেল, তারপর ওর বিচার করবেন।”

আমার সস্তা মোবাইল অসময়ে বেজে ওঠায় কল রিসিভ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুম্বার মায়ের মুখে তার ছেলের দুষ্কর্মের সাফাই শোনা আর হয়ে উঠল না। অপরপ্রান্তে অধ্যাপক সামন্ত। তিনি আবার দশ কপি ‘আবার আসিব ফিরে’ দোকানে রেখে যাবেন বলছেন। বিক্রি না হওয়া বইয়ের চাপে তাকে আর জায়গা নেই। তাকে বোঝাতে লাগলাম, আপাতত দু কপিতেই হবে।

***

সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই নববর্ষ এসে গেল। হালখাতার পাটই রাখিনি দোকানে। শুধু খান পঁচিশেক “বাৎসরিক রাশিফল” কাউন্টারে সাজিয়ে রেখেছিলাম। সবকটি বিক্রি হয়ে গেছে, কাজেই মনের আনন্দে দশ টাকার আলুর চপ আনিয়ে সবে কামড় দিয়েছি, বোমারু বিমানের মতো বুম্বা এলো মায়ের সাথে।

“দাদা, বুম্বাকে একটু আপনার কাছে রেখে যাব। আমার না একটা খুব দরকারি কাজ পড়ে গেছে। বুঝতেই তো পারছেন, ওর বাবা নেই... মানে বাড়ি থাকে না... আজ আবার ওদের ইশকুল ছুটি।”

সর্বনাশের শেষ নেই আজ! বুম্বাকে দোকানে রাখব? পয়লা বৈশাখের শুভ দিনে আশু বিপদ বুঝে আমি বলে উঠি, “আমি, মানে বুম্বাকে সামলানো...”

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বুম্বার সুন্দরী মা শরীরে বিচিত্র ভঙ্গী তুলে, আমাকে বিবশ করে বললেন, “ও কিচ্ছু করবে না। আমি ওকে বুঝিয়ে বলেছি। বুম্বা, নো দুষ্টুমি! আই নো ইউ আর এ গুড বয়...”

“না আআআআ, আমি গুড বয় হতে চাই না। আমি থাকব না। তোমার সাথে যাব।”

বুম্বার চিৎকারে রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা সচকিতে দোকানের দিকে তাকাল। কী করব ভেবে পাচ্ছি না।

“তুমি বরং আঙ্কেলকে পোয়েম শোনাও...।

“না আআআআ, শোনাব না আআআ। আমি কিচ্ছু শোনাব না।”

“বুম্বা বিহেভ ইয়োরসেলফ। তুমি জান, আঙ্কেলের কাছে কত বই। উনি কত গল্প জানেন! তোমাকে উনি গল্প পড়ে শোনাবেন।”

মনে হল, বলে দিই, দোকানের বইগুলো থেকে একটা গল্পও কোনোদিন পড়ে দেখিনি। কোন দুঃখে পড়তে যাব। ময়রা কী তার দোকানের মিষ্টি চেখে দেখে নাকি?

নাছোড়বান্দা বুম্বার মা কিন্তু পনের মিনিটের চেষ্টায় ছেলেকে রাজি করিয়ে ছাড়লেন, একগাদা চিপসের প্যাকেটের বিনিময় মুল্যে। শাড়ির আঁচল উড়িয়ে ইন্দিরার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম নিজের সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করে।

“তোমার মোবাইলটা দেখাও তো?”

চমকে উঠে বুম্বার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমার ফোন দিয়ে তুমি কী করবে?”

“আঃ, যা বলছি কর না। আমি গেম খেলব।”

“আমার মোবাইলটা স্মার্ট নয় বাবা, গেম টেম কিছুই খেলা যায় না।”

“ধুর, ল্যাপটপও নেই দেখছি। নাঃ, তুমি কোনও কম্মের নও।”

“কম্মের হলে কী আর বইয়ের দোকান দিতাম?”

বুম্বা কী বুঝল কে জানে! আমার দশ আটের দোকানের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে, উঠে গিয়ে একটার পর একটা বই টেনে বার করতে লাগল। আমি হাঁ হাঁ করে তেড়ে যেতে গিয়েও থেমে গেলাম। যেদিকে ছেলেটা বই ঘাঁটাঘাঁটি করছে, সেখানে মান্ধাতার আমলের পুরনো ইশকুলের বই রাখা আছে। দুচারটে ছিঁড়ে দিলেও পৃথিবীর বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে না।

আমার মোবাইল বেজে উঠতে ক্যাশ বাক্সের পাশে রাখা মোবাইল তুলে নিলাম। অধ্যাপক সামন্ত। বছরের প্রথম দিনই মুডটা খারাপ হয়ে গেল।

“বিমল বাবু, কেমন আছেন? শুভ নববর্ষ।”

“শুভ নববর্ষ স্যার”, গলার তিক্ততা যতটা সম্ভব ঢেকে ঢুকেই বললাম।

“আমার কবিতার বইগুলোর কিছু হল?”

আর একটু হলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, নতুন বলে এখনো দোকানের পোকাদের পছন্দ হয়নি। কদিন যেতে দিন, ওদের পেটেই যাবে, ওইসব দূর্বোদ্ধ কবিতার বই পড়ে কে আর পেট গরম করবে? তার চাইতে বচ্ছরকার দিনে রসগোল্লা কিনে বাড়ি ফিরবে বরং।

আমাকে নিরুত্তর দেখে অধ্যাপক অনুনয় করে বললেন, “একটু প্রচার করুন। কাউন্টারের সামনে রেখে দিন। আপনার ছোট্ট দোকানে বইয়ের ভিড়ে কারো চোখে পড়ছে না। আপনি বুঝতে পারছেন না, জীবনানন্দর পর এমন বই আর কেউ লেখেননি।”

ইচ্ছে হল বুম্বার হাতে অধ্যাপকের বই তুলে দিই। যথার্থ সম্মান পাবে। তাকিয়ে দেখি খুব মনোযোগ দিয়ে বুম্বা একটা বই খুলে দোকানের মেঝেতে বসে পড়ে চলেছে। আমার অমনোযোগ অধ্যাপক অন্তর্যামী হয়ে বোধহয় দেখতে পেলেন। তার গলায় শ্লেষের ঝাঁজ ফুটে উঠল।

“এইজন্যই মফস্বলের বুক সেলারদের কিছু হয় না। কলেজ স্ট্রীটে দেখুন, কিভাবে বই বিক্রি করে ওরা! আপনি তো কলেজ স্ট্রিট যানই না। এখানে বসে বসেই...”

মোবাইলটা কাউন্টারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বুম্বা কী পড়ছে দেখার জন্য ঝুঁকে পড়লাম। বুম্বা আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। তার যেন সময় নেই। বিড়বিড় করে বলল, “এখানে একটা স্টেপে ভুল আছে।”

মেঝেতে উবু হয়ে বসে দেখি বইটা এগারো বারো ক্লাসের কঠিন এক অঙ্কের বইয়ের সল্যুশন, জয়েন্টের পরীক্ষার জন্য অনেক বছর আগে খুব বিক্রি হত। এখন সব উত্তর ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। তাই এ বই কেউ কেনে না। কিন্তু বুম্বা? সে কি করে বুঝে ফেলল অঙ্কের স্টেপে ভুল আছে?

“তোমার কাছে পেন আছে?” বুম্বা এবার গলা উঁচু করে আমার দিকে ফিরল। চোখ দুটো তার যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।

আমি চমক ভেঙে তাড়াহুড়ো করে একগাদা পেন কাউন্টার থেকে তুলে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। বুম্বা বলল, “একটাই যথেষ্ট। আমি স্টেপটা ঠিক করে দিচ্ছি।”

আমি বরাবর অঙ্কে ফেল করে এসে জীবনের এত পথ পেরিয়ে এখন বইয়ের দোকানের মালিক। মাথায় কিছুই ঢুকল না। বিস্ময় বালককে আবিষ্কার করার বিস্ময় এতটাই ঘোর লাগিয়ে দিল, কী করব ভেবে উঠতে পারলাম না। ওর জড়িয়ে ধরে মাথায় তুলে নাচতে নাচতে সারা স্টেশন রোডে ঘুরে বেড়াব, নাকি চকলেটে ওকে মুড়ে দেব কিছুই বুঝতে পারলাম না।

তাক থেকে এক কপি “আবার আসিব ফিরে” তুলে ওর হাতে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “অটোগ্রাফ স্যার, একটা অটোগ্রাফ!”

বুম্বা আমার হাতের থেকে বইটা তুলে নিয়ে মলাটের উপর বড় বড় করে লিখল, ০/০। ওটুকু অঙ্ক আমারও জানা আছে। তাই তার মাথার ঘন চুলগুলো একটু এলোমেলো করে দিলাম।