বাড়িটা


অলংকরণ - সুমন মান্না

আজকের গল্প একটা বাড়িকে নিয়ে। সে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগেকার কথা, বুঝলে? সবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, সারা দেশে আস্তে আস্তে দানা বেঁধে উঠছে ইংরেজ শাসকদের ভারতছাড়া করার জন্য আন্দোলন, এরকম একটা সময়ে শহর কলকাতার বুকে তৈরি হয়েছিল বাড়িটা। তারপর বারদুয়েক মালিকানা বদল হয়ে বাড়িটার চাবিগোছা আমার দাদামশাইয়ের হাতে আসে। সময়টা মোটামুটি একান্ন বাহান্ন সাল নাগাদ হবে। উত্তর কলকাতার বাদুড়বাগান এলাকায় তখনকার সার্কুলার রোডের ধারেই একটা দোতলা বাড়ি।

বাড়ির নিচে চওড়া রোয়াক, মাঝে সদর দরজায় ওঠার সিঁড়িটা রোয়াকটাকে দুভাগে ভাগ করেছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে একটা সরু প্যাসেজ চলে গেছে ভেতরবাড়িতে, উঠোনের দিকে। প্যাসেজের দু’ধারে দু’খানা ঘর, উঠোনের একদিকে একটা টানা দাওয়া, তার পাশে হেঁশেল আর খাওয়ার ঘর, উঠোনের আরেকদিকটা একটু পিছল মতো, সেদিকটায় চৌবাচ্চা আর বাথরুম। উঠোনের শেষ প্রান্তে ধাপে ধাপে উঠে গেছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, তার রেলিং কাঠের, সবুজ রং করা। কাঠের দরজা জানলা, দোতলার ঝুলবারান্দা, যেখানে দাঁড়ালে রাস্তা দেখা যায়, তার রেলিং, সবই কাঠের, এবং সবুজ রং করা।

ভাবছ, বাড়িটার বর্ণনা এত খুঁটিয়ে দিতে পারছি কি করে? আরে, এটা যে আমার মামারবাড়ি, আমার ছোটবেলার লম্বা ছুটিগুলো সব যে এই বাড়িটাতেই কাটতো! গ্রীষ্মের দুপুরে কাঠফাটা রোদ্দুরে যখন গোটা পাড়া ঝিমোচ্ছে, তখন আমি দিদার চোখ এড়িয়ে কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতাম ছাদে, সেখান থেকে দেখা যেতো পাশেই গনাগুন্ডাদের বাড়ির নোনাধরা দেওয়াল, ছাদের আলসেয় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কোমরটাকে একটা বিশেষ মোচড়ে বাঁকালেই ওদের বাড়ির দেওয়ালে চোখে পড়তো গুপী গাইন বাঘা বাইনের সেই ভূতেদের দলকে, নানাভাবে হাতছানি দিয়ে তারা সব ডাকতো আমায়। আবার কখনও ছাদে একটা মাদুর পেতে চিৎপাত হয়ে শুয়ে ঘাড়ের নিচে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, চোখদুটো প্রথমে একটু জ্বালা করতো, তারপরেই জ্বালা ভাবটা কেটে গিয়ে একটা ঝিমধরা ভাব আসতো, নীল আকাশে সূর্যের আলোয় কতকিছু লেখা হয়ে যাচ্ছে মনে হতো, আস্তে আস্তে চোখ বুজে আসতো। সারা দুপুর কড়া রোদ খেতাম বলে প্রায়দিনই রাতে গা হাল্কা গরম হতো, দিদার কাছে দুধ রুটি খেয়ে সুজনি চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আবার ফিরে আসতো সেই ঝিমধরা ভাবটা, সেইসঙ্গে মনে হতো আমি যেন একা নই, আরও কারা যেন আমার পাশেই বসেটসে আছে, জ্বরের জলে চোখ ঝাপসা বলে আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি না, জ্বর সেরে গেলেই খুঁজে পাবো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, জ্বর সেরে গেলেই ওই মনে হওয়াটাও কেটে যেতো। সেসময় কাউকে একথা বলতে পারিনি, ভয় পেতাম বড়দের, বড় হয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, ওঁরও নাকি জ্বর হলে ঘুম আসার আগে ওরকমটাই মনে হতো, বছরের পর বছর ধরে। কেন, কেউই জানি না।

আজ কেন এত কথা মনে পড়ছে জানো? এখন আমি মামারবাড়িতেই যাচ্ছি, সামনের সপ্তাহ থেকে বাড়িটা ভাঙা শুরু হবে, তাই এই সপ্তাহের মধ্যে বাড়ির যা কিছু দামী জিনিস বিক্রিবাটা করে দিতে হবে, আর যা কিছু ডেওঢাকনা বাতিল জিনিস, সেসব হয় ওজন দরে বেচে দিতে হবে, নইলে কুচিয়ে পুড়িয়ে উড়িয়ে মিশিয়ে দিতে হবে পঞ্চভূতে। এ বড়ই গুরুদায়িত্ব। মামারা এখন থাকেন গুজরাটের এক শিল্পশহরে, পৈতৃক ভিটেয় ফিরে আসার সম্ভাবনা তাঁর, বা আমার মামাতো ভাই কুশল, কারোরই এই মুহূর্তে নেই। দিদা গত হয়েছেন আজ প্রায় পনেরো বছর হলো, এই বিশাল পোড়ো বাড়ি এতদিন আগলাতেন আমার মা, আর কিছুটা আমি। তা, গত বছর মা চলে গিয়েছেন তাঁর মায়ের কাছে, বাবার মুখ আমার মনে পড়ে না। কাজেই, এখন আমি বন্ধনহীন। চেনা জায়গায় একলা থাকা বড় কষ্টের, স্মৃতিগুলো বড্ড কাঁদায় সারাক্ষণ। বলতে পারো কিছুটা স্মৃতির হাত থেকে বাঁচতেই ব্যাঙ্গালুরুতে ট্রান্সফার নিয়ে নিলাম। পরের মাসে শিফট করব, তাই যাওয়ার আগেই মামারবাড়িটার একটা গতি করে দিয়ে যাচ্ছি। প্রোমোটারকে বিক্রি করা হয়েছে বাড়িটা, আমরা দুটো ফ্ল্যাট পাবো, আর নগদ কিছু টাকা। কাগজপত্র সইসাবুদ সব হয়েই গেছে গতমাসে, মামা এসেছিলেন, যেটুকু বুঝে নেওয়ার বুঝে নিয়ে বাকি আইনি কাজকর্মের জন্য আমাকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে তিনি ফিরে গেছেন তাঁর কর্মক্ষেত্রে।

লক্ষ্য করেছি, ফিরে যাওয়ার আগের ক’দিন তিনি যেন কেমন বাড়িটার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকতেন, ওবাড়িতে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই কেমন যেন কুঁকড়ে যেতেন, দুই একদিন তো আমাকে একাকেই পাঠিয়েছেন, যখন ভ্যালুয়েশন করতে মিউনিসিপ্যালিটির লোক এলো। প্রোমোটার বিশ্বেশ্বর সামন্ত লোক ভালো, তবে মালিকপক্ষের কারও তো থাকা উচিত এসব কাজের সময়। আমি ছেলেমানুষ ছেলে, কত আর বুঝব, তাই জোর করেই মামাকে টেনে নিয়ে যেতাম। ওবাড়িতে ঢুকেই মনে হতো, মামা যেন কি একটা অপরাধবোধে ভুগছেন। বাড়িটার ঘরদোর, দরজা জানলার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না, কিসের থেকে যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, দোতলার ঝুলবারান্দায় তো গেলেনই না, যদিও বারান্দা আর সিঁড়ির কাঠের রেলিং প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। মামার ওই অপরাধবোধের কারণ সেদিন বুঝিনি, এখন বোধহয় অল্প অল্প বুঝতে পারছি।

এই দেখো, কথায় কথায় পৌঁছেই গেলাম,

“হ্যাঁ দাদা, সামনের রাইট টার্নটায় ইউ টার্ন নিয়ে এই রাধাচূড়া গাছটার সামনে দাঁড় করাবেন, ওই ভাজাওয়ালার দোকানটার সামনে।”

বলেই খেয়াল হলো, তাই তো, রাধাচূড়া গাছটা তো দিব্যি আছে, গাছের ডালে সেই কাকেদের বাসাটাও আছে নিশ্চয়ই! ওদের বাসার তো আর অত রক্ষণাবেক্ষণ দরকার হয় না, যে, বছরকয়েক বাসিন্দাদের পা না পড়লেই সেটার ইঁটকাঠ খসে পড়বে, ‘পোড়ো বাড়ি’ বলে দাগিয়ে দেবে চেনামুখেরাও!


আজ রাতে এখানেই থাকব, আগে একদিন এসে একটা ঘর সাফসুতরো করে গিয়েছি, ওইঘরেই একটা বেঁটে কালো আলমারিতে বিছানার চাদর বালিশের ওয়াড় সব গুছিয়ে রাখা আছে, জানি, গামছা, আমার একসেট টিশার্ট বারমুডা, আর মায়ের একজোড়া শাড়িও। মায়ের কাজ খুব গোছানো ছিল তো, হুট করে কখনও এসে পড়লে যাতে অসুবিধা না হয়, তাই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। দ্যাখো দেখি, আমার তো আজ সত্যিই কাজে লাগছে!

রাতের খাবার খেয়েই এসেছি, বিছানা পেতে ঘর থেকে বেরোলাম বাকি ঘরগুলোয় ঘুরে আসব বলে। চারপাশে বড্ড মাকড়সার জাল হয়ে রয়েছে, মুখেচোখে জড়িয়ে যাচ্ছে। আহা, এরা যদি বাড়িটার দেখভাল করতে পারতো, এই মাকড়সা ইঁদুর চামচিকে পায়রার দল, তাহলে আর বাড়িটা ভেঙে স্ট্যান্ড অ্যালোন অ্যাপার্টমেন্ট দাঁড় করাতে হতো না! এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি মামা এসে কেন বাড়িটা থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন!

যে ঘরটায় আমি রয়েছি, তার উল্টোদিকের ঘরটায় পুজো হতো, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো, আর সরস্বতী পুজো। এমনিতে সারা বছরের নিত্যপুজোর ঠাকুরের আসন পাতা থাকতো দোতলায়, দিদার ঘরে, সেখানে রোজ দুবেলা পুজো আচ্চা সেরে দিদা নিচে নামতেন। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো আর সরস্বতীপুজোর দিনে বেশ লোকজন আসতো, পাড়ার লোকেরা, দাদুর, মামার, মায়ের বন্ধুরা, তাই নিচের বড়ঘরেই ব্যবস্থা করা হতো। সেই দুটো দিনে বাড়ি একেবারে গমগম করতো।

সেসব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে উঠোনের দিকে এগোচ্ছি, একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এলো। ধূপ, প্রদীপের সলতে জ্বলা গন্ধ, ফুল, কাটা ফল, দুধ, মধু আর কর্পূরের গন্ধ মেশানো একটা গন্ধ, ঠিক যেন এবাড়ির কোনও একটা ঘরে পুজোর আয়োজন করা হচ্ছে। মনে পড়ল, ছোটবেলার পুজোর দিনগুলোতে এই গন্ধটা সারাক্ষণ ঘিরে থাকতো আমায়। গন্ধটা কোত্থেকে আসছে খুঁজতে খুঁজতে পুজোর ঘরের দরজায় ফিরে এসে থমকে গেলাম।

ঘরের মধ্যে দেওয়ালের কাছে জলচৌকিতে বসে আছেন সাদা শাড়ি পরা মা সরস্বতী, ঠিক সেই আগের দিনগুলোর মতো, তাঁর সামনে আসনে বসে ঘটে তেল-সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক আঁকছেন তক্কদাদু, মামারবাড়ির বহুকালের পুরনো পুরোহিত ব্রজপতি ভটচায তর্করত্ন, তাঁর এক পাশে বসে ফল কেটে পেতলের থালায় রাখছেন আমার মা, আরেকপাশে বসে ফুল বেলপাতা পঞ্চরত্ন পঞ্চশস্য পঞ্চগব্য সব একে একে থালায় থালায় সাজিয়ে রাখছেন দিদা, একটা একদম নিচু মোড়ায় বসে। দিদার পায়ে ব্যথা, তাই তিনি মেঝেয় বসতে পারতেন না, বহুবছর ধরে। ঘরের একপাশে শতরঞ্চি পাতা, সেখানে চুপ করে বসে আছে পাশের বাড়ির দোলা আর ওর বোন তুলাই, দুজনের পরনেই একই ছিটের দুটো হলদে শাড়ি। হঠাৎ দিদা মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। মুখখানা দেখে বুকটা জুড়িয়ে গেল, কতদিন পর এই মুখটা দেখলাম! শেষ কয়েক বছর নানান অসুস্থতায় মুখ ফুলে গিয়েছিল দিদার, কষ্ট হতো দেখলে, আজকের মুখটা সেই আগের মতো, মনে হলো ছুট্টে গিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে আদর খাই, আগের মতো, জিজ্ঞেস করি কি অন্যায় করেছিলাম আমি যে ফল কাটতে বসা ওই মহিলাকে অত তাড়াতাড়ি নিজের কাছে নিয়ে গেলেন! দিদা নিজেও বড় তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলেন, কেন, সে উত্তরও নিতে হবে। একা থাকলে প্রশ্নগুলো বড় জ্বালায়। এসব ভাবছি, দিদা একগাল হেসে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। তাড়াতাড়ি এগোতে যাবো, আমায় পাশ কাটিয়ে দেখি কে একটা বাচ্চা মতো রোগা ছেলে দৌড়ে গিয়ে দিদাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হেসে কথা বলতে বলতে এদিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। কে ও? চোখ নাক মুখ এক্কেবারে আমার মতো! ও কি তবে আমিই? এতক্ষণে ঘোর কাটলো, এখানে যা যা হচ্ছে তা যে স্বাভাবিক নয়, ওপারে চলে যাওয়া মানুষগুলো এখানে পুজোর জোগাড় করছেন, এ যে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো একখানা ঘটনা, সেটা মাথায় আসতেই সারা শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো। তবে এদের মাঝে আমি কি করছি? মানে, ওই ছোট্ট আমি টা? তারপরেই বুঝতে পেরে হেসে উঠলাম নিজের মনে, ও হো! ও তো আমার ছেলেবেলা। সে তো কবেই মরেহেজে গেছে। যদিও বা একটু বেঁচে ছিলো, এই বাড়িটার সঙ্গে, কাল থেকে বিক্রিবাটা আর পরের হপ্তা থেকে ভাঙাভাঙি শুরু হলে সেও তো হারিয়ে যাবে কালের কোঁচড়ে।

“কই রে, সব গেলি কই? বাউন দা পুজোয় বসে গেছ নাকি? নাতিটাকে নিয়ে এলুম যে, হাতেখড়ি দিইয়ে দিবিনে?”

একটা বছর চারেকের ছেলের হাত ধরে সদর দরজা দিয়ে ঢুকছেন এক প্রৌঢ়া, আরে এঁকে আমি চিনি, দিদার বান্ধবী ইনি, লেবুতলা পার্কের কাছে বাড়ি এঁদের। একবার ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পায়ে পেরেক ফুটে রক্তারক্তি কান্ড হয়েছিল, এঁদের বাড়ি গিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ডিম দেওয়া ঘুঘনি আর চন্দ্রপুলি খেয়ে বাড়ি এসেছিলাম। পায়ের নিচে পেরেকের দাগটা এখনও আছে।

“অ মা, খুকু যে! কি ভাগ্যি, নাতির হাতেখড়ির নামে তাও নবাবনন্দিনীর পায়ের ধুলো পড়ল এবাড়িতে!”

দিদা হইহই করতে করতে এসে এই ‘খুকু’ দিদাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। আর তখনই দুহাতে দুটো শালপাতার থালার বান্ডিল নিয়ে বাড়ি ঢুকলেন মামা। দেখে প্রথমে চমকে উঠলাম, ‘নেই মানুষ’দের ভিড়ে মামা কি করছেন? তবে কি মামাও....? খবরটা পাইনি এখনও? এক মুহূর্তের জন্য পায়ের নিচের মাটিটা দুলে উঠল। হা ঈশ্বর! আমায় এভাবে একেবারে একা করে দিও না, প্লিজ! ওই একটা লোক এখনও আছে, যে আমায় ডাকনামে ডাকে, তাকেও নিয়ে নিও না এমন করে। তারপরেই মনে পড়ল, মামার চেহারা এই এত বছরে প্রায় কিছুই বদলায়নি, চুলে পাক ধরা ছাড়া, কলপ করেন বলে সেটুকুও বোঝা যায় না। তাই হয়তো ভুল ভেবেছিলাম, আসলে এই মামা আমার ছোটবেলার মামা, যুবক মামা। আমার যেমন শৈশব হারিয়ে গেছে, তেমনই মামার তারুণ্য, যৌবনও হারিয়ে গেছে, তাই ছোট্ট আমি-র মতোই যুবক মামাও আজ ‘নেই মানুষ’দের দলে।

মনটা ভার হয়ে এলো। এসব কান্ড দেখে ভয় পাওয়ার কথা হয়তো, কিন্তু আমার ভয় করছে না, কষ্ট হচ্ছে। আপনজনদের দেখে কেউ কখনও ভয় পায় কি? এই যে আমি ছুট্টে গিয়ে ওই ফল কাটতে বসা মহিলার কোলে মুখ গুঁজে দিতে পারছি না, তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বলে উঠতে পারছি না, “মা, তুমি কোত্থাও যাওনি, এই তো আমার কাছে আছো, তাই না?” বলতে পারছি না, “মা, আমাদের বাড়িতে এখন আর বাগানটা নেই, তুমি বাড়ি চলো, আবার নতুন করে সব গাছ লাগাবো।” এই না পারায় ভয়ের চেয়ে কষ্টটাই তো বেশি হচ্ছে। এই কষ্ট বুকে নিয়েই বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করিয়ে দিয়ে আমায় চলে যেতে হবে ব্যাঙ্গালুরু।

নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিলাম কষ্টটার হাত থেকে। এভাবে চলতে পারে না। তার চেয়ে বরং অন্য ঘরগুলো ঘুরে দেখি। যদি ওই ছোট্ট আমিটার সঙ্গে আলাপ জমাতে পারতাম, বেশ হতো। দুজনে মিলে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখা যেতো।

“আমায় খুঁজছো? কি বলবে বলো?”

চমকে তাকিয়ে দেখি আমার জামা ধরে টানছে ছোট্ট আমি, সেই কুড়ি বছর আগের তাতাই। কি আশ্চর্য, আমায় দেখতে পাচ্ছে! ভাবতে ভাবতেই শুনি,

“আমিই শুধু তোমায় দেখতে পাচ্ছি, বাকিরা না। অন্য ঘরগুলো ঘুরে দেখবে তো? এসো, হাত ধরো আমার।”

এগিয়ে চললাম দুজনে। উঠোনের ধারে খাওয়ার ঘর, দরজায় শেকল টানা। একটা ভাঙা চেয়ার টেনে তাতে উঠে ‘ঝনাৎ ‘ শব্দে শেকল খুলে ফেলল তাতাই।

“এসো “

ঘরে ঢুকে দেখি কালো কাঠের গোল টেবিলটা আর ছ’খানা চেয়ার ঠিক তেমনিই আছে, টেবিলের পাশে জালের দরজা দেওয়া মিটসেফটাও, আর তার চারটে পায়ার নিচে বসানো চারটে প্লাস্টিকের বাটি, পিঁপড়ের হাত থেকে বাঁচতে যেগুলোয় ঢালা হতো জল বা কেরোসিন।

“তাতাই, মনে আছে তোর, মিটসেফের ওপর সারে সারে বিস্কুটের কৌটো সাজানো থাকত, মেরী বিস্কুট আমি খেতে চাইতাম না, মা গজগজ করতো, দিদা চিনি বিস্কুট বের করতো মাকে থামিয়ে!”

“আমি এখনও খাই চিনি বিস্কুট”, রিনরিনে গলায় বলে উঠল তাতাই।

“তা তো খাবেই! মামারবাড়ির আদরে রয়েছ যে! আমার মতো হাত পুড়িয়ে রাঁধতে হলে বুঝতে।”

“তুমি খাবে? দিই দাঁড়াও।”

মিটসেফের ওপরে রাখা একটা বয়াম থেকে চিনি বিস্কুট বের করে আমার হাতে দিলো তাতাই, নিজেও নিলো। দুজনে দুটো চেয়ারে বসে কুড়মুড় করে বিস্কুট খেতে খেতে এটা সেটা গল্প করতে লাগলাম।

কথা বলতে বলতে নিজেরই অদ্ভুত লাগছে। বিকেল অব্দিও ভাবতে পেরেছিলাম, নিজের অতীতের সঙ্গে আড্ডা মারব এভাবে? একে কি বলা যায়? ভূতুড়ে ঘটনা? নাকি অদ্ভুতুড়ে?

খাওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছি, হঠাৎ পায়ের নিচটা দুলে উঠছে মনে হলো। মাথা ঘুরছে? রেলিংটা ধরে ফেললাম। নাহ, কাঁপুনি থামছে না। ভূমিকম্প নয় তো?

“নেমে এসো, নেমে এসো শিগগির, পালাতে হবে তোমায়। ভূমিকম্প হচ্ছে।” আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে চলল তাতাই। ততক্ষণে অশ্বত্থের চারা গজানো দোতলার দেওয়ালে ধরা চিড়টা আরও চওড়া হচ্ছে আমার চোখের সামনেই, চোখ ফেরাতে পারছি না, চিৎকার করে বলছি তাতাইকে,

“ছেড়ে দে তাতাই, এখানেই থাকব, থাকতে দে আমায়, এই তো আমার শেকড়, এ ছেড়ে কোথায় যাবো আমি?”

তাতাই শুনছে না,

“না না, এ বাড়ি আর তোমার জন্য নয়, এবাড়ি এবার ভূত হতে চলেছে, এখানে তোমার আর জায়গা হবে না। তোমায় আলোয় যেতে হবে, তোমায় বাঁচতে হবে, আমাদের জন্য, আমাদের এখানে তোমার থাকার জায়গা এখনও তৈরি হয়নি, যাও, বেরিয়ে যাও এক্ষুনি!”

“তাতাই, শোন ভাই”, নিজেকে কি ভাই বলে ডাকা যায়? ওই অবস্থাতেও মাথায় এলো প্রশ্নটা,

“এই বাড়িটার ওপাশে আমার নিজের আর কেউ নেই ভাই। আমায় এখানেই জায়গা দে একটু, এখানে আমার মা আছে, মাকে ছেড়ে কোথায় যাবো বল?”

“না না, চলে যাও, চলে যাও এখান থেকে, এখানে অতীত হয়ে বাঁচতে তুমি পারবে না। আমরা সবাই তোমার দিকে তাকিয়ে আছি, তোমার মধ্যে বাঁচব বলে আমরা দিন গুনি রোজ। তুমি বর্তমান, ভবিষ্যতের তোমাকে আমাদের কথা জানানোর জন্য তোমায় আলোয় থাকতে হবে, ফিরতে হবে ওধারে। যাও, ফিরে যাও।”

“তাতাই, একটি বার মায়ের সঙ্গে...”

“না, দুর্বল কোরো না নিজেকে। আচ্ছা, দাঁড়াও, একটা জিনিস দিই, সঙ্গে রেখো।”

যেঘরে কালো বেঁটে আলমারিটা থাকে, সেঘরে ঢুকল তাতাই। গোটা বাড়িটা অদ্ভুতভাবে কাঁপছে, উঠোনের ওপাশে বাথরুমের একটা দেওয়াল বোধহয় ভেঙে পড়ল হুড়মুড়্ করে, এপাশের দেওয়ালগুলোর চিড়ের দাগও বেড়ে চলেছে। বাঁচতে হলে পালাতে হবে সত্যিই, পালিয়ে বাঁচতে পারব কি? এখানে যে রয়ে গেল আমার শেকড়!

আমার ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে বেরিয়ে এলো তাতাই, আরেক হাতে একটা চৌকোনা মোড়ক, খবরের কাগজে মোড়া।

“নাও, তোমার জিনিস। আর, এটা সঙ্গে রেখো, সবসময়। এতেই আমরা আছি, থাকব চিরকাল। মন খারাপ কোরো না, পালাও এক্ষুনি।” বলে একরকম ঠেলে বাড়ির বাইরে বের করে দিলো তাতাই আমায়। এইটুকু ছেলের গায়ে এত জোর! আমি তো এমনটা ছিলাম না। তখন অবশ্য আর ভাবার সময় নেই।

বাড়ি ভেঙে পড়ার হুড়মুড় আওয়াজ পিছনে ফেলে রেখে কাঁধে ব্যাকপ্যাক আর হাতে চৌকোনা মোড়কটা নিয়ে এসে দাঁড়ালাম রাস্তায়, ল্যাম্পপোস্টের নিচে। পাড়ার লোকে সেখানে জড়ো হয়েছে ইতিমধ্যেই, ভূমিকম্প হলে রাস্তায় নেমে আসাই দস্তুর। আমায় ঘিরে ধরে শুরু হয়ে গেল প্রশ্নপর্ব,

“তুমি শুভদার ভাগ্নে তো? এই পোড়ো বাড়িতে রাত কাটাতে এসেছিলে?”

“ভগবান বাঁচিয়েছেন তোমায়! কি হতো বলো তো?”

“আসছে হপ্তা থেকে বাড়ি ভাঙার কথা ছিল না? শুভদাকে বলেছিলাম একগাড়ি রাবিশ লাগবে আমার, তার আগেই এভাবে...”

কথাগুলোকে পাশ কাটিয়ে জটলা থেকে একটু দূরে সরে এসে সঞ্জুমামার দোকানের সিঁড়িতে বসে হাতের প্যাকেটটার দিকে মন দিলাম। খবরের কাগজের মোড়কটা খুলতেই বেরিয়ে এলো কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি, হলদেটে হয়ে এসেছে, তাও চেনা যায় সবাইকেই। ছবিটার মাঝখানে চেয়ারে বসে আছেন মায়ের ঠাকুমা, তাঁর দুপাশে দাঁড়িয়ে আছেন আমার দাদু আর দিদা, তাঁদের দুজনের দুপাশে বাবা আর মা, মায়ের কোলে এক্কেবারে কচি আমি। মায়ের ঠাকুমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে সদ্য দাড়িগোঁফ গজানো মামা।

ছবিটা বুকে আঁকড়ে ধরে বাঁধ ভেঙে আসা চোখের জলটাকে আটকালাম কোনওমতে, এখানে কেউ আমার কান্নার মানে বুঝবে না, ভাববে সম্পত্তি তছনছ হয়ে গেছে বলে কাঁদছি। মুখ তুলে দেখলাম, কর্পোরেশনের টাঙিয়ে দেওয়া ‘বিপদজনক বাড়ি’ নোটিশবোর্ডটা সদর দরজার ভাঙা দেওয়ালের পাশে কাৎ হয়ে পড়ে আছে। আর, সেই ভাঙা দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে তাতাই।

“তাতাই!” অস্ফুটে ডেকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, হাত নেড়ে ও তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল। ওখানে তো শুধুই ইঁটকাঠের স্তুপ, ওখানে কোথায় খুঁজে পাবো তাতাইকে, আমার মাকে, আমার ফেলে আসা অতীতকে? কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লাম রাস্তায়। এখন সামনে অনেক কাজ, সবার আগে মামাকে ফোন করতে হবে, আমাদের অতীতের মৃত্যুসংবাদ জানাতে হবে, তারপর বেরোতে হবে বাড়িটার মৃতদেহ নিয়ে, সৎকারের কাজে।

“হে অতীত, শক্তি দাও আমায়, তোমরা ছাড়া এই মুহূর্তে আমায় আর কে ভরসা দেবে বলো? তোমরা এভাবে ছেড়ে যেয়ো না!”

ছবিটা বুকে চেপে বিড়বিড় করতে লাগলাম৷ আস্তে আস্তে বুকের ভেতরটা শান্ত হয়ে এলো। কার যেন আলতো ছোঁয়া মনে হলো সারা গায়ে প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে। কে যেন আমার কাঁধে নরম হাত রাখলো। চোখ তুলে দেখলাম, কাউকে দেখতে পেলাম না। পাবো না, জানতাম। পাড়ার লোকেও একে একে সবাই চলে যাচ্ছে। একটা ভেঙে পড়া পোড়ো বাড়ির জন্য কে আর রাতের ঘুম নষ্ট করে!

ভাঙা বাড়িটার সামনে রাস্তার ধারে বসে রইলাম আমি, আমায় ঘিরে বাকি রাতটুকু আগলে রইলো আমার অতীত। পুবের আকাশ লাল হতে শুরু করতেই ফোনটা পকেট থেকে বের করলাম, মামার নম্বরটা ডায়াল করতে হবে।