ওরা কাজ করে


অলংকরণ - অরিজিৎ ঘোষ


একটা বড় পিঁপড়ে। বড় বড় কালো দাঁড়া সহ কালো চকচকে একটা বড় মাপের পিঁপড়ে। নীতা ওটার দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে হাত ঝাড়লো শূন্যে যেন ওটা দেখবে আর পালিয়ে যাবে। পিঁপড়েটা কী বুঝলো কে জানে কাঠের দেওয়ালের তলায় লুকানোর আগে নীতাকে কেমন করে যেন দেখলো বলে মনে হলো। বাবারে!

“এই যে! কী দেখছো অমন করে?” নিলয় হাঁটু গেড়ে ওর পাশে বসে বললো। “আরেব্বাপ! এতো দেখছি কাঠখেকো পিঁপড়ের দল!”

দেওয়ালের গা থেকে একটা ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের টুকরো ভাঙলো নিলয়। ওটার তলাতেও গোটা ছয়েক পিঁপড়ে দেখা গেল। যেগুলো নিজেদের বাঁচাতে এদিকে ওদিকে মারল ছুট। “ওরে বাবারে!” নীতা বলে উঠলো যখন নিলয় ওগুলোর একটাকে ধরে হিংস্র ভাবে দেহ থেকে মুণ্ডুটা ছিঁড়ে ফেললো।

“একটু চুপ করে থাকতে পারো না নাকি? চ্যাঁচাচ্ছো কেন?”

পিঁপড়েটার পাগুলো নড়ছিল, দাঁড়া দুটো কিছু একটা ধরার চেষ্টায় খুলছিল আর বন্ধ হচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল ওটা মরার আগে নিলয়ের কিছুটা মাংস খুবলে খেতে চাইছে।

নিলয় চলে গেলো, গ্যারেজে। ফিরে এলো কয়েক মিনিট পরেই। হাতে নল লাগানো কালো এরোসলের ক্যান। “ওখান থেকে সরে যাও,” বললো নীতাকে। ক্যানের ভেতরে থাকা পদার্থটাকে ব্যবহারের আগে ঝাঁকিয়ে নিলো ভালো করে।

স্প্রিং লাগানো হাতলটা চেপে ধরতেই জেট গতিতে হিসসস শব্দ করে তরলটা বেড়িয়ে এলো নলের মুখ দিয়ে, পড়ল গিয়ে দেওয়ালের গায়ে। নীতা আরো খানিকটা পিছিয়ে গেল উগ্র রাসায়নিকের গন্ধে। জানতে চাইলো নিলয়ের কাছে, “বলছিলাম কি , এর থেকে কোনো বিপদ হবে নাতো?”

সে কথায় পাত্তা না দিয়ে নিলয় ওই বিষ তরল ছিটাতেই থাকলো দেওয়াল জমির কোণ বরাবর। নীতা তাকালো বৃদ্ধা প্রতিবেশিনী মিসেস খান্ডেলওয়ালের দিকে। সুন্দর করে সাজান গোছানো নিজের লনে দাঁড়িয়ে উনি তাকিয়ে আছেন এদিকেই। মিসেস খান্ডেলওয়াল এই সব পোকামাকড় মারা বিষ বা রাসায়নিক একদম পছন্দ করেন না। নীতা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে উনি কী করে কিছু ব্যবহার না করেই সবকিছু এত ভালো ভাবে রাখেন। ঝকঝকে তকতকে সবুজ লন মিসেস খান্ডেলওয়ালের। পাশাপাশি নিজেদের অপরিচ্ছন্ন আগাছা ভর্তি বাগানটার দিকে তাকালে যথেষ্টই খারাপ লাগে নিজের।

বিড়বিড় করে গাল দিতে দিতে নিলয় ফিরে এলো নীতার কাছে। ক্যানটাকে জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছিল। কর্কশ স্বরে, “ধুসস এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল!” বলেই আবার হেঁটে গেল গ্যারেজের দিকে। নীতা ঠোঁট কামড়ে ধরলো। মিসেস খান্ডেলওয়াল ঢুকে গেছেন আর দাঁড়িয়ে নেই লনে, চলে গেছেন ভেতরে।

নীতাও ঢুকে গেল ঘরে। আরো আধ ঘন্টা পর এলো নিলয়, গা থেকে রাসায়নিকের গন্ধ ছাড়ছে। “এ বাবা, কী অবস্থা গো!” নিলয় একবার শুধু চোখ তুলে নীতাকে দেখলো তারপর এগিয়ে গেল রেফিজারেটরের দিকে একটা বিয়ার নেওয়ার জন্য।

“তুমি কি সব পিঁপড়েগুলোকে মেরে ফেলেছো?”

“কী প্রশ্নের ছিরি! আমি ঘোড়ার ডিম জানবো কী করে যে সবগুলোকে মারতে পেরেছি কি না? তবে ওদের ওপর অনেক বিষ ছিটিয়ে দিয়েছি এটা বলতে পারি। আরে, এখানে তো একটাও বিয়ার নেই!”

“আছে তো, ওখানেই আছে দ্যাখো। গতকালই তো এক কেস কিনে এনেছি।”

“ভালো কথা। তা সেগুলো গেল কোথায়?”

নীতা ফ্রিজটার কাছে গিয়ে একটা ক্যান বার করে দিলো।

“লুকিয়ে রাখার আবার কী দরকার শুনি?” বিয়ার ক্যানটার ছিপি খুলতেই ভুস ভুস করে ফেনা বের হয়ে এলো। “যত্ত সব!” খেঁকিয়ে উঠলো নিলয়, কারন বিয়ারটা ওর মনের মতো ঠাণ্ডা ছিল না।

নীতা বললো, “ওই জন্যই তো পেছনের দিকে রেখেছিলাম। যাতে বেশি ঠাণ্ডা হয়। ফ্রিজটা যেমন তেমনই তো কাজ করবে।”

“বাগানটা জঞ্জালের আস্তানা হয়েছে,” নিলয় বললো, “পুরো জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে। পচা কাঠ সব – একেবারে খাজার মতো হয়ে গেছে। পিঁপড়েতে ভরতি...”

“কী বড় বড় সব সাইজ! আমাদের একজন কীট পতঙ্গ মারে এমন লোক লাগাতে হবে ও সব পরিষ্কার করার জন্য। তুমি কী বলো?”

“হ্যাঁ, এমন ভাবে বলছো যেন আমার গাছে টাকা ঝুলছে। পাড়বো আর লোক ভাড়া করে নিয়ে চলে আসবো”, ক্যানে শেষ চুমুকটা দিলো। “আরেকটা দাও তো। আর রান্না কখন শেষ হবে? আমার খুব খিদে পেয়েছে।”

***

পরের দিন সকালে নিলয় কাজে চলে যাওয়ার পর নীতা ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুটা ভয়ে ভয়েই সেই জায়গাটায় গেল যেখানে পিঁপড়েগুলোকে দেখা গিয়েছিল। দোমড়ানো মোচড়ানো কুঁকড়ে যাওয়া বড় বড় পিঁপড়ে গুলোর দেহ দেওয়ালটার আশে পাশে ছড়িয়ে পড়ে ছিল। নীতা পিছিয়ে এলো, একটা বড়সড় চকচকে কালো মাথা ভয়ঙ্কর দাঁড়াওয়ালা পিঁপড়ে মুখ বার করেছে আধখাওয়া কালো কাঠের ফাঁক থেকে।

এ বাবা, পিঁপড়ে তো দেখছি এখনও আছে। নিলয় এটা জানতে পারলে মোটেই খুশি হবে না। ক্ষেপে যাবে। মনে মনে কথাগুলো ভেবে নীতা ঠোঁট কামড়ে ধরলো। নিলয় রেগে যাওয়ার অর্থ...

মোটেই ভালো না... একদমই না... নীতার মাথাটা অজান্তেই বার দুয়েক নেতিবাচক ভাবে নড়ে উঠলো। ওর পেছনেই বাগানে রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিসেস খান্ডেলওয়াল। পরনে একটা কালো খষটে রঙের ঢলঢলে ম্যাক্সি, গলায় কালো রঙের একটা ওড়না জড়ানো। উনিও মাথা নাড়ছিলেন। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে বললেন, “এটা ভালো না। একদম ভালো না! কীটনাশক স্প্রে করে ওই ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে মারা একদম ঠিক না!”

নীতা ঘুরে তাকিয়ে বললো, “কী করবো কাকিমা? নিলয় বলছিলো ওগুলো নাকি কাঠখেকো পিঁপড়ে। ওদের না মারলে আমাদের বাগানের ঘরটাকেই নাকি খেয়ে ফেলবে ওরা।”

“তোমার স্বামীই তাহলে কীটনাশক স্প্রে করছিলো? তা সে মানুষ হিসাবে কেমন শুনি?”

“এমনিতে ভালোই... তবে মাঝে মাঝে... একটু...”

মিসেস খান্ডেলওয়াল একটা হাত তুলে ইশারা করে নীতাকে কাছে ডাকলেন। নীতা বৃদ্ধা মহিলাটির খয়েরী দাগে ভরা, ফোলা ফোলা গাঁটওয়ালা ব্যাঁকা আঙুলগুলো দেখে ভাবলো - বাবা কী বিদঘুটে দেখতে হাতটা! ওটা নড়েচড়ে কী করে?

“কী হলো, এদিকে এসো। কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”

অগত্যা নীতা এগিয়ে গেল। বলিরেখায় ভরা মুখ তুলে ফ্যাকাশে নীল চোখ দিয়ে খানিকক্ষণ এক অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন নীতার দিকে মিসেস খান্ডেলওয়াল, তারপর বললেন, “না, তুমি দেখছি মেয়ে হিসাবে ভালোই। একটু শান্তশিষ্ট। বোকা বোকা। বলছিলাম কী তুমি যদি চাও আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি।”

“কী সাহায্য?”

“তুমি কি চাও যে ওই ছোট ছোট প্রাণীগুলো, যারা অনেক কাজ করে দেয় তারা চলে যাক?”

নীতা বললো, “তাহলে তো খুবই ভালো হয় কাকিমা।”

“বেশ, তাহলে জলদি কিছুটা ময়দা, চিনি আর নুন নিয়ে এসো দেখি।”

নীতা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে এলো ওগুলো রান্না ঘর থেকে। বৃদ্ধা মাত্র এক চিমটে ময়দা আর সমপরিমাণ নুন আর চিনি তুলে নিলেন ওর অদ্ভুত আঙুলগুলো দিয়ে। তারপর আরেক হাতের ওপর রেখে ওগুলো ভালো করে মেশালেন। সাথেই বিড়বিড় করে গেলেন কীসব অজানা দুর্বোধ্য ভাষার মন্ত্র। গা শিরশির করে উঠলো নীতার। মিসেস খান্ডেলওয়াল এবার হাতের মিশ্রণটা ছুঁড়ে দিলেন সেইখানটায় যেখান থেকে একটু আগে একটা বড় কালো পিঁপড়ে মাথা বার করে ছিলো। নীতা অবাক হয়ে দেখলো সম্ভবত সেই পিঁপড়েটাই আবার বেরিয়ে এলো বাইরে। ওর পেছন পেছন বেরিয়ে এলো আরো তিনটে... আর তারপরেই এপাশ ওপাশ থেকে শত শত পিঁপড়ের আবির্ভাব হলো আধ খাওয়া কাঠের দেওয়ালটার এখান ওখান থেকে। আরো শত শত সার বেঁধে আসতে শুরু করলো নীতাদের দিকে।

একটা আর্ত চিৎকার ছেড়ে নীতা ওখান থেকে ছুটে সোজা গিয়ে উঠলো বারান্দায়। ঘুরে তাকিয়ে দেখলো মিসেস খান্ডেলওয়াল একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছেন সেই অজানা মন্ত্র। আর পিঁপড়েরা সারিবদ্ধভাবে সব ঢুকে পড়ছে উনার সুন্দর করে ছাঁটা ঘাসের লনটায়।

কিছুক্ষণ বাদে উনি তাকালেন নীতার দিকে। বললেন, “ভয় পেয়ো না। ওরা আর তোমায় কিছু বলবে না। ওরা খুব দক্ষ কর্মী। ওরা কাজ করে! সব কাজ!”

মিসেস খান্ডেলওয়াল আবার হাত নেড়ে কাছে আসতে ইঙ্গিত করলেন নীতাকে। ইচ্ছে ছিল না একদমই, তবু কীসের এক আকর্ষণে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল নীতা। অতি সাবধানে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে। ভয় হচ্ছিলো এই বোধ হয় ওই পিঁপড়ের ঝাঁক ওর গায়ে উঠে পড়বে! “আমার বাগানে এসো!” শুনতে পেলো খান্ডেলওয়ালের কণ্ঠস্বর।

ওখানে যাওয়ার পর বৃদ্ধা একগাল হেসে বললেন, “দ্যাখো,” নিচু হলেন। বসলেন হাঁটু গেড়ে। ঘাস সরালেন। নীতা ভয়ে ভয়ে ওনার ওপর দিয়ে ঝুঁকে দেখলো... ঘাসের তলায় ভর্তি পিঁপড়ে। কিছু আগে ওদের বাড়ি থেকে চলে আসা কালো কাঠ খেকো পিঁপড়েদের সাথেই গিজ গিজ করছে আর অনেক রকমের পিঁপড়ের প্রজাতি। বড়, ছোট। খুদে খুদে, লাল, কালো, মাটি রঙা এমনকি সাদাও। হাজার হাজার পিঁপড়ে। চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। নিশ্চিন্তে ঘাসের তলায়।

“আমার ছোট্ট কর্মীদের দল,” মিসেস খান্ডেলওয়ালের কণ্ঠে আত্মতৃপ্তির আবেশ।

নীতা অবাক হয়ে দেখলো সত্যি চারদিকে পিঁপড়েগুলো কিছু না কিছু করেই চলেছে। কিছু ঘাস ছাঁটছে, কিছু সেই টুকরোগুলো নিয়ে চলে যাচ্ছে ; কেউ বাড়িতে ঢোকার মুখের পথে কিছু পড়লেই সেটা তুলে নিয়ে যাচ্ছে আর পাঁচজনের সাহায্যে; লাল পিঁপড়ের একটা দলকে দেখা গেল খান্ডেলওয়ালের একটা পোশাক যা মেলা ছিল বাগানের তারে সেটা উঠিয়ে নিয়ে ঢুকে গেল বাড়ীর ভেতর।

অবাক বিষ্ময়ে নীতা জানতে চাইলো, “এসব আপনি ওদের দিয়ে কী করে করান?”

“এ আমাদের দেশের পাহাড়ি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর গুপ্ত রহস্য। এসব শিখেছি আমার মায়ের কাছে। তিনি শিখেছিলেন তার মায়ের কাছে। এ এক পরম্পরা। অল্প বয়সে আমাদের বিয়ে হয়। কত কত কাজ করতে হয় শ্বশুরবাড়ীতে। একা কি আর করা যায়।” নিচু হয়ে একটা কালো পিঁপড়েকে হাতে তুলে নিলেন। “তার জন্যেই এদের সাহায্য নিতে হয়। এখন বয়েস হয়ে গেছে। এখনতো আরো বেশি সাহায্য নিতে হচ্ছে।”

নীতা বুঝতে পারছিলো না কতটা অবাক হতে হয় বা হতে পারা যায়। চারপাশ ঘুরে ঘুরে ও অনেকক্ষণ ধরে দেখল কী সুন্দর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে ওরা কাজ করে চলেছে।

“কী গো মেয়ে শিখবে নাকি এই গোপন পদ্ধতি?”

নীতা কী উত্তর দেবে ভেবে পেলোনা। মিসেস খান্ডেলওয়াল নীতার হাত দুটো নিজের খসখসে উষ্ণ হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, “আমারতো কোনও মেয়ে নেই। এ মন্ত্র শুধু মেয়েদের নিজস্ব। তোমাকে দেখে আমার ভালো লেগেছে। যদি চাও আমি শেখাতে পারি।”

প্রথম প্রথম ভয় লাগলেও কিছু দিনের মধ্যেই নীতা শিখে নিলো কীভাবে ময়দা, নুন আর চিনি মিশাতে হয়। কীভাবে উচ্চারণ করতে হয় অজানা ভাষার দুর্বোধ্য মন্ত্র। কোন মন্ত্রে ওদের ডাকতে হয় আর কোন মন্ত্র বলে ওদের কাজ করাতে হয়। কালো কাঠখেকো পিঁপড়েগুলো থেকে ওর ভয় কাটছিল না। কিন্তু বৃদ্ধা জানালেন ওরাই সবচেয়ে শক্তিশালী। ভারি ভারি কাজ যেমন ওজনদার কিছু বয়ে আনার জন্য ওদেরকেই দরকার। ধীরে ধীরে সে ভয় কাটলো নীতার। এখন ওর বাড়িঘর মিসেস খান্ডেলওয়ালের মতোই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে।

নিলয় এই পরিষ্কার থাকার ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেও এ নিয়ে বিশেষ কিছু বলেনি। কাজের কারণে বাড়িতে বেশি থাকতোও না। নীতাও সতর্ক থাকতো এ ব্যাপারে। নিলয় বাড়ি থাকলে ও পিঁপড়েদের ডাকতো না কাজ করে দেওয়ার জন্য। মিসেস খান্ডেলঅয়াল অবশ্য বলেছিলেন ওদের দিয়ে রাতে কাজ করিয়ে নিতে। সেটা সম্ভব হয়নি নীতার পক্ষে।

দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু মানব জীবনে ভাগ্য কি আর সব সময় একরকম থাকে। নিলয়ের কাজটা গেল। এখন প্রায় সারাদিন সে বাড়িতেই থাকে। আর্থিক অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাড়ি ঘর আবার নোংরা। নীতা পিঁপড়েদের ডাকতেও পারছে না। নিলয়ের মদ খাওয়ার মাত্রাটা বেড়েছে ভালো মতোই। তাল মিলিয়ে বাড়ছে নীতার ওপর শারীরিক অত্যাচারের মাত্রা।

এরকমই এক রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না নীতার। নিলয় নেশার ঘোরে ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। নীতা উঠে গেল রান্নাঘরে। ময়দা, চিনি আর নুন মিশিয়ে ডাক দিলো ছোট্ট কর্মীদের। আবার আগের মতো গোটা বাড়ী পরিষ্কার হয়ে গেল।

পর পর কয়েকটা রাত ভালোয় ভালোয় কেটে গেলেও নবম দিনের মাথায় ঘুম ভেঙে গেল নিলয়ের। বাথরুমে যাওয়ার জন্য। আর সেখানে তখন পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত ছিল লাল পিঁপড়ের দল। নেশা গ্রস্থ কণ্ঠে প্রায় ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো নিলয়, “নীইইইইতাআআআ!!! শিগগিরি এদিকে এসো। সর্বনাশ... এরা সব কোথা থেকে এলো... হাজার হাজার লাল পিঁপড়ে!!! পিঁপড়ে মারা বিষ আর আছে ঘরে?”

“আ...আমি জ জানি না...”

“কি? কী জানোনা শুনি? ওগুলো কোথা থেকে এলো?”

“বিষ বোধহয় নেই।”

“হ্যাহ! নেই বললেই হলো! সরো দেখি...”

নীতা কী করবে বুঝে পাচ্ছিলো না। কারণ ও জানে এখনো দু”ক্যান কীটনাশক আছে ড্রয়ারে। হাত জড়ো করে বললো, “শোনো লক্ষীটি কিছু করতে হবে না। ওসব কীটনাশক দেওয়ার দরকার নেই। ওরা এমনিতেই চলে যাবে।”

নিলয় ওর কথাগুলো শুনে অদ্ভুত চোখে তাকালো, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “আমি কী করবো না করবো সেটা কি তুই শিখাবি? কেরে তুই কুত্তা কোথাকার! ওগুলো কামড়ালে কী হবে জানিস হারামজাদি! হঠ আমার সামনে থেকে।”

নীতা একটুও নড়লো না। সেটা দেখে টেনে এক থাপ্পড় কষালো নিলয়। ছিটকে পড়ে গেল নীতা। টলতে টলতে ওখান থেকে চলে গেল নিলয়। ওর ফিরে আসার আগেই মন্ত্র পড়ে সব পিঁপড়েদের ওখান থেকে সরিয়ে দিলো নীতা। কীটনাশকের ক্যান দুটো হাতে নিয়ে ফিরে এলো নিলয়। একটাও পিঁপড়ে দেখতে না পেয়ে আরও ক্ষেপে গেল। চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললো নীতাকে। মুখে অশ্রাব্য গালাগাল। একটুও চিৎকার না করে মুখ বুঁজে সব অত্যাচার সহ্য করলো নীতা।

পরের দিন বিয়ার কেনার জন্য বাড়ি থেকে বের হল নিলয়।

দরজায় বেল বাজলো। দরজা খুলে নীতা দেখলো মিসেস খান্ডেলওয়াল দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধা ভেতরে ঢুকলেন না। নীতার আঘাত বিধস্ত ফোলা ফোলা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সব শুনেছি আমার ছোট্ট কর্মীদের কাছ থেকে। তোমার স্বামী তোমায় মেরেছেন।”

নীতা আমতা আমতা করে বললো, “গতকাল বাথরুমে পিঁপড়েদের দেখে ফেলেছিল।”

“জানি গো মেয়ে সব জানি। একেবার আমার সাথে যা করেছিল খান্ডেলওয়াল। সে আবার কাঁটা লাগানো বেল্ট দিয়ে মারতো আমাকে।”

“আপনার স্বামী।”

“হ্যাঁ, আমার প্রথম স্বামী। ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম আমরা। অনেক অনেক বছর আগে।”

নীতা কৌতূহলের সাথে জানতে চাইলো, “প্রথম স্বামী মানে! আপনার কজন স্বামী?”

“পাঁচজন। আমার ভাগ্যি খারাপ গো মেয়ে। ভালো কেউ জোটেনি। কেউ মাতাল, কেউ জুয়ারি... সব, সব কটা নচ্ছার। আমরা মেয়েরা মনে করি স্বামী ছাড়া আমাদের জীবন অচল। আর ওই হতচ্ছাড়াগুলো মনে করে আমরা ওদের সব রাগ হজম করার যন্ত্র।”

নীতা হতবাক হয়ে ভাবলো , কত বয়েস এই মহিলার?

“শোন গো মেয়ে আসলে একমাত্র ওরাই সবচেয়ে ভালো। ওই ছোট্ট কর্মীরা। কারোর ওপর অত্যাচার করে না।”

নীতা যন্ত্রের মতো মাথা নাড়লো।

মিসেস খান্ডেলওয়াল বললেন, “কী গো মেয়ে জানতে ইচ্ছে করছে নিশ্চয় আমার পাঁচ পাঁচটা স্বামীর কী হলো?” নীতা কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই পিছন দিকে ঘুরে কী যেন শুনলেন মন দিয়ে। তারপর বললেন, “সময় করে এসো একবার। সব বলবো, চাইলে আরও কিছু নতুন প্রাচীন মন্ত্রও শিখিয়ে দিতে পারি। এখন চলি। তোমার স্বামী দেবতাটি চলে এসেছেন প্রায়।”

ওইদিন বিকেলেই নীতা সুযোগ পেয়ে গেল মিসেস খান্ডেলওয়ালের কাছে যাওয়ার। একটা ফোন এলো, কী এক জরুরী কাজে বেরিয়ে গেল নিলয়।

অনেক রাত করে নেশাগ্রস্থ নিলয় ফিরে এসে বললো, “খুব খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি ডিনার সাজাও!”

নীতা হেসে বললো, “সব রেডি। তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসো।”

পরোটার পাশে রাখা স্যূপের মতো জিনিসটার দিকে তাকিয়ে নিলয় জানতে চাইলো, এটা আবার কী?

নীতা রহস্যময় চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, “এটা পাশের বাড়ির কাকিমা রান্না করা শিখিয়ে দিয়েছেন। মাশরুমের স্যুপ। দারুণ খেতে। উনার প্রথম স্বামী খেতে খুব ভালবাসতেন।”

[Lois Tilton এর Small Workers গল্পের ছায়ায়]