অলৌকিক সেই খেলা


অলংকরণ - সুমিত রায়

আকাশে মেঘের ঘনঘটা বেড়েই চলেছে। যেকোনও মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। ঋষির কপালে চিন্তার ভাঁজ। অন্ধকার নামার আগে চাঁদিপুর পৌঁছতে পারবে তো?

“এই জন্য আমি বলেছিলাম ট্রেনে চলো। কে শোনে আমার কথা।” পাশ থেকে রাগতস্বরে বলল মেধা। ওর রাগের দোষ নেই। ঋষিকে ও অনেকবার গাড়ি নিয়ে আসতে নিষেধ করেছিল কিন্তু ঋষি ওর কথায় কর্ণপাত করে নি। আসলে ড্রাইভিং ঋষির প্যাশন। হাতে স্টিয়ারিং পেয়ে গেলে ও সব ভুলে যায়। ধনী পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন রকম গাড়ি কেনা ও চালানোর শখটা ও সহজেই পূরণ করতে পারে। এবারে এই নতুন গাড়িটা কেনার পর মেধাকে ও বলেছিল, “চলো কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসি। আমাদের কোম্পানির নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ করার আগে একটু রিফ্রেশমেন্ট হয়ে যাবে।” গাড়ি নিয়ে আসতে মেধার যথেষ্ট আপত্তি ছিল কিন্তু ঋষি নাছোড়। ড্রাইভারও সঙ্গে আনেনি। মুহূর্তের মধ্যে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে গেল। সেই সঙ্গে মুহুর্মুহু বজ্রপাত হচ্ছে। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বাজে। চারিদিকে সর্বগ্রাসী অন্ধকার নেমেছে । গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আর কিচ্ছু কাজ হচ্ছে না। এবার ঋষিরও মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা ভুল হয়ে গেছে। ওরা যে রিসর্ট বুক করে এসেছে সেটা এখনও প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কিন্তু গাড়ি নিয়ে আর এগোনো যাচ্ছে না

“এই দ্যাখ সামনে একটা হোটেল মনে হচ্ছে। আজ রাতটা যদি এখানে থেকে যাই।”

“বুকিং ছাড়া কি রুম পাবো?” ঋষি বলে।

“আরে বাবা চাঁদিপুরে পুরী-দীঘার মত অত ভীড় হয়না তাছাড়া রুম না থাকলেও মানবিকতার খাতিরে ভেতরে একটু বসতে অন্তত দেবে। এই বৃষ্টি-বাজের মধ্যে তোমার গাড়িতে থাকাটা কি খুব নিরাপদ মনে হচ্ছে?”

 

গাড়ি থেকে নেমে রিসেপশন পর্যন্ত আসতেই ওরা ভিজে গেল। রিসেপশনের ছেলেটি জানাল একটাও ঘর ফাঁকা নেই। শুনে ওদের মুখ শুকিয়ে গেল। ঋষি কয়েক মুহূর্ত ভেবে ম্যানেজারকে ডেকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাল। ম্যানেজার ছেলেটি একেবারেই কমবয়সী। মেধা তাকে নিজেদের অবস্থাটা বুঝিয়ে বলল, “ভাই বড় বিপদে পড়েছি। কোনও ব্যবস্থা কি হতে পারে না?”

“একটা রাতের তো ব্যাপার। সকালেই আমরা আমাদের বুক করা রিসর্টে চলে যাব। একটু দেখুন না যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়। টাকা-পয়সা নাহয় ডাবল দেব।” ঋষি বলল।

“দেখুন টাকা-পয়সার ব্যাপার নয়। রুম তো খালি নেই। তবে একটা ব্যবস্থা করতে পারি নিজের রিস্কে।” ম্যানেজার ছেলেটি বলে।

“বুঝলাম না।”

“আসলে এটা হোটেল কাম রিসর্ট । এই বাউন্ডারির মধ্যে সমুদ্রের দিকে ছটা কটেজও আছে কিন্তু ওগুলো এখন বন্ধ ।”

“বন্ধ কেন?”

“সেটা জানিনা। আসলে এই হোটেলটা প্রায় মাস আটেক বন্ধ ছিল রেনভেশনের জন্য। মাস দুয়েক আগে আবার খুলেছে। সব স্টাফও নতুন। আমিও নতুন এসেছি। আমার মনে হয় মালিকপক্ষের কিছু স্পেশাল প্ল্যান আছে কটেজগুলো নিয়ে। যাই হোক আমি নিজের দায়িত্বে একটা কটেজ খুলে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করছি। এই ঝড় জলের রাতে এসেছেন তারওপর ম্যাডাম ভাই বলে ডাকলেন কি করে আপনাদের ফেরাই বলুন।” খুব আন্তরিক ভাবে বলল ছেলেটি। মেধা আর ঋষি অনেকবার ধন্যবাদ জানাল। ম্যানেজার ছেলেটি খুব করিতকর্মা। অল্প সময়ের মধ্যেই একটা কটেজের চাবি খুঁজে, পরিস্কার করিয়ে ঋষিদের পাঠিয়ে দিল সেখানে। কটেজটা ঋষিদের খুব পছন্দ হলো। বৃষ্টির আওয়াজ সেই সাথে সমুদ্রের গর্জন মিলেমিশে বাইরে যেন মহাদেবের প্রলয় নৃত্য হচ্ছে।

 

মেধার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল রাত বারোটা। বাইরে থেকে এখনও অল্প বৃষ্টির আওয়াজ আসছে। পাশে ঋষি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঘুমন্ত ঋষির কপালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল সে । বিছানা ছেড়ে মেধা বাথরুমের দিকে এগোল। কাজ সেরে জলের কলটা বন্ধ করে পেছন ফিরেই মেধা চমকে উঠল। তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ঋষি। তার হাতে একটা লম্বা ছুরি যার ফলাটা বাথরুমের স্বল্প আলোতেও চকচক করছে।

“ঋষি এটা কি?” আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন করল মেধা।

“ছুরি জানু যেটা এক্ষুনি তোমার পেটে চুমু খাবে।” হিসহিসিয়ে বলল ঋষি। এ কোন ঋষিকে দেখছে মেধা! একে তো সে চেনে না। চোখে যেন শয়তান ভর করেছে ঋষির।

“এ এসব কি বলছ তুমি?” কাঁপা কাঁপা গলায় বলে মেধা। কোনও উত্তর দেয় না ঋষি শুধু মেধার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মেধা পালাবার চেষ্টা করে কিন্তু কোমোডে ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। ঋষি এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে যেন তার কোনও তাড়া নেই। নিজের লক্ষ্যে সফল হবার ব্যাপারে সে বোধহয় নিশ্চিত। দরজার দিকে যাওয়া সম্ভব নয়, ঋষি দাঁড়িয়ে আছে।মেধা পাগলের মতো পালাবার পথ খোঁজে। ঋষি এক পা এক পা করে প্রায় তার কাছে চলে এসেছে। মেধা ডানদিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে হঠাৎ তার শরীরের আঘাতে দেওয়ালের কিছু অংশ ভেঙে পড়ে একজন মানুষ গলে যাওয়ার মত ফোকর সৃষ্টি হয়। সেদিকে বেরিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য ভাবে মেধা ছুটতে থাকে। হঠাৎ করে কিছুতে পা লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় সে। বৃষ্টি থেমে গেছে । মেঘ সরে গিয়ে আকাশে একফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। চাঁদের সেই স্বল্প আলোয় মেধা নিজেকে একটা ঝাউ জঙ্গলের মধ্যে আবিস্কার করল। তার হৃদপিণ্ডটা যেন মিনিটে হাজারবার তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মাটির ওপর বসে থাকে মেধা। পা গুলো ভীষন ব্যথা করছে আর বোধহয় সে উঠে দাঁড়াতে পারবে না এখন। হায় রে অদৃষ্ট! বিধাতা বোধহয় আজ রাতে পঁচিশ বছরের তরতাজা মেয়েটার সমস্ত জীবনীশক্তি শেষ করার আয়োজন করেছে। শুকনো পাতার খচমচ আওয়াজ শুনে মেধার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো। তার আশঙ্কা সত্যি করে ঋষি মৃত্যুদূতের মত এগিয়ে আসছে। কোনও মতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটতে আরম্ভ করল মেধা। মাঝে মাঝেই গাছে ধাক্কা লাগছে। পরনের রাত পোশাকটা জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। তবুও মেধা ছুটে চলেছে বাঁচার আশায়। জোৎস্নার আবছা আলোয় মেধা দেখল এক জায়গায় অনেকগুলো কাঠের গুঁড়ি পড়ে আছে। সেগুলোর পেছনে সে আশ্রয় নিল। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ যেন জবাব দিয়ে দিচ্ছে। শ্যাওলা ধরা গুঁড়িগুলোতে ঠেস দিয়ে মেধা হাঁপাতে লাগলো। চারিদিকে একটা বুনো গন্ধ খেলা করছে। নিজের হৃদস্পন্দন সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। প্রকৃতি তার কান্না বন্ধ করে দিলেও মেধার দু চোখের কোল উপচে শ্রাবণের ধারা নামলো। নোনতা জল এসে তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে। রাতের খোলা কালো আকাশের তলায় শ্যাওলা বিছানো ভিজে মাটির ওপর বসে মেধার মনে একটাই প্রশ্ন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ছে কেন? কেন ঋষি এমন করল? তবে কি মেধাকে শেষ করার জন্যই ও কোনও বারণ না শুনে এখানে এল? কিন্তু হঠাৎ করে কি হলো যে ঋষি এত ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত নিলো? কিচ্ছু মাথায় আসছে না । খানিক পরে মেধার মনে আস্তে আস্তে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিতে লাগলো। ‘ রুহি’ ঋষির প্রাক্তন প্রেমিকা। ঋষির বাবা-মায়ের রুহিকে খুব একটা পছন্দ ছিল না। ওঁদের মনে হয়েছিল রুহির পক্ষে ভালো স্ত্রী বা বৌমা কোনওটাই হওয়া সম্ভব নয়। তাও ছেলের মুখ চেয়ে তাঁরা জোর করে রুহিকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন কিন্তু উল্টো দিকে রুহি ওঁদের সাথে থাকতে রাজি তো ছিলই না তারওপর ঋষিকে শর্ত দিয়েছিল যে ওকে বিয়ে করতে হলে বাড়ির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে ওর বাবার বিজনেস জয়েন করতে হবে। ঋষি রাজি না হওয়ায় ওদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। রুহি একজন এন আর আই কে বিয়ে করে এখন বোস্টনের বাসিন্দা। ঋষি এ সমস্ত কিছুই বিয়ের আগে মেধাকে বলেছিল। ওদের দেখেশুনে বিয়ে। ঋষির মায়ের একটা বিয়েবাড়িতে মেধার সাথে আলাপ হয়েছিল। ঋষি বলেছিল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও কিছু গোপন থাকা উচিত নয় সেই হিসেব মেনে মেধাও বিমানের কথা বলেছিল। তার ওভার পজেসিভনেস, মেধার প্রতিটি পদক্ষেপ কন্ট্রোল করার চেষ্টা এইসব কারণে সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাওয়ার কথা সবকিছু খুলে বলেছিল। বিয়ের আগেই ঋষি আর মেধার মধ্যে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর এই তিন বছরে মেধার মনে অন্তত কোনও ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান কিছু তৈরি হয়নি। ঋষির দিক থেকে কোনও কিছুর খামতি ছিল না। সেই কারণে মাসখানেক আগে যখন রুহি ফোন করে ঋষিকে জানায় যে সে দেশে এসেছে, একবার ঋষির সাথে দেখা করতে চায় মেধা ঋষিকে বাধা দেয় নি বরং বলেছিল তার ইচ্ছে হলে সে রুহির সাথে একবার দেখা করতে পারে। ঋষির প্রতি, তাদের বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতি গভীর বিশ্বাস ছিল মেধার কিন্তু ঋষি নিজেই দেখা করতে চায়নি সটান না বলে দিয়েছিল। মেধাকে প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “আজ তুমি বলছ কিন্তু কাল যদি তোমার মনে সামান্যতমও সন্দেহ দেখা দেয় আমি সহ্য করতে পারব না। আমি কোনও অবস্থাতেই তোমাকে হারাতে পারব না। রুহির সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল পাহাড়ী নদীর মত যেখানে উচ্ছলতা ছিল কিন্তু গভীরতা ছিল না আর তোমার আমার সম্পর্ক মাঝ সমুদ্রের মত। শান্ত,ধীর কিন্তু যার গভীরতা অতলান্ত।” মেধাও পরম নিশ্চিন্তে ঋষির বুকে মাথা গুঁজে দিয়েছিল। সেদিনের সেই বিশ্বাস আজ ক্রমশ অবিশ্বাসের কালো চাদর এসে ঢেকে দিচ্ছে। নিশ্চয় গোপনে রুহির সাথে ঋষির আবার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। হয়ত রুহি ওর বিবাহিত জীবনে খুশি নয় তাই ঋষিকে ডাকছিল আর প্রথমে না বললেও শেষ পর্যন্ত ওর সেই আহ্বান ঋষি উপেক্ষা করতে পারে নি। এছাড়া আর কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছে না মেধা। ফুঁপিয়ে উঠে নিজের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল মেধা। ঋষি ওকে একবার মুখ ফুটে বলতে পারত । যত কষ্টই হোক সে সরে যেত ঋষির জীবন থেকে নাকি বাবা-মা পুরো ব্যাপারটা মেনে নেবেন না বলে ঋষি এই পথ নিয়েছে?

“হ্যালো ডার্লিং, কোথায় লুকিয়েছ সোনা? আমি তোমাকে খুঁজেই পাচ্ছি না। আজ রাতের এই লুকোচুরি খেলাটা তুমি জমিয়ে দিয়েছ। মজা আসছে খেলে। পালাও পালাও ,আমার হাত থেকে পালাবার চেষ্টা কর। ভোর পর্যন্ত সময় দেখা যাক কে জিততে পারে। তুমি না আমি। হা হা হা।”

ঋষির ভয়ংকর অট্টহাসিতে মেধার অন্তরাত্মা শুধু নয় জঙ্গলের প্রতিটি পাতাও কম্পিত হচ্ছে। মেধা বুঝতে পারছে পালাবার পথ নেই তবুও শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মানুষ বাঁচতে চায়। ঋষির পদধ্বনি ক্রমশ এগিয়ে আসছে। মেধা আবার তার শ্রান্ত, ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে জীবনের সন্ধানে ছুটল। খানিকক্ষণ ছোটার পর মেধা জঙ্গলের বাইরে চলে এল। সমুদ্রের গর্জন শুনে তাকিয়ে বুঝতে পারল এটা বেলাভূমি। এত গভীর রাতে সে কোনও দিন সমুদ্র দেখেনি। আকাশের চাঁদোয়ার নিচে অনন্ত সমুদ্র তার বিশালতা নিয়ে শায়িত। ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাসের তাল-বেতালে নৃত্য। কয়েক মুহূর্তের মুগ্ধতার রেশ কাটতেই মেধা শিহরিত হলো। এতক্ষন জঙ্গলের আলো আঁধারী ছায়াময় পরিবেশ তাকে রক্ষা করেছে কিন্তু এবার সামনে সীমাহীন সাগর আর পায়ের নিচে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রতট। কোথায় লুকোবে সে? পেছনে কাল রূপে তার নিজের স্বামী ধাওয়া করে আসছে। অসহায় ভাবে চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ মেধা দেখতে পেল তার বামদিকে কিছুদুরে একেবারে সমুদ্র ছুঁয়ে একটা দোতলা বাড়ি সম্ভবত পরিত্যক্ত। জোৎস্নার আলো তার ভাঙাচোরা শরীরটা ধুইয়ে দিচ্ছে। পায়ে পায়ে শ্রান্ত মেধা সেদিকে এগিয়ে গেল। তার দু চোখে বৃষ্টি, মনে কালবৈশাখী। ভাঙা দরজার সামনে গিয়ে দুদন্ড ভাবলো সে তারপর পা বাড়াল ভেতরে। কেমন একটা রহস্যময় প্রাচীন গন্ধ ঘরের বাতাসে। অন্ধকারেরও নিজস্ব একটা আলো থাকে। সেই আলোয় মেধা দেখল ঘরময় পুরু ধুলোর আস্তরণ। তার চোখে মুখে মাকড়সার জাল জড়িয়ে যাচ্ছে। মেধার বুকে ক্রমাগত কে যেন হাতুড়ি পিটছে। দ্বিতীয় ঘরটায় প্রবেশ করার সাথে সাথে একঝাঁক চামচিকে মেধার ওপর আক্রমণ করল। এতদিন পরে তারা জীবন্ত মানুষের দর্শন পেয়েছে। মেধা গলা চিরে একটা মর্মভেদী আর্তনাদ করে উঠলো। তার অন্তরের সমস্ত ভয়, আশঙ্কা সব যেন ছিটকে বেরিয়ে এল। দুহাতে করে চামচিকের আক্রমণ ঠেকাতে ঠেকাতে সে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে দৌড়ল। একটা সিঁড়ির মুখে এসে পৌঁছল সে। চিন্তা করার অবকাশ নেই তার কাছে। পলেস্তারা খসে পড়া সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির ছাদে উঠে এল মেধা। সারা ছাদ জুড়ে ভাঙা ইঁটের টুকরো আর লোহার রড ছড়ানো আছে তার মধ্যেই হাঁটু মুড়ে বসে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে মিশে তার কান্নার আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে-বাতাসে।

“এত তাড়াতাড়ি কুইট করলে চলে ডার্লিং। গেট আপ গেট আপ। ফাইট মেধা ফা আ আ ইট।” টেনে টেনে অদ্ভুত বিকৃত স্বরে বলল ঋষি।

মেধা চমকে উঠে দেখল কখন নিঃশব্দে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ঋষি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সে। ঋষি এই বাড়িতে ঢুকেছে সে বিন্দুমাত্র বুঝতে পারে নি। কোনও মানুষ এত নিঃশব্দে পদচারণা করতে পারে!

“কি অবাক হচ্ছ আমাকে এখানে দেখে? ভাবতেই পারছনা আমি তোমার ঠিক পেছন পেছন এখানে এসে পড়েছি। কি করব বল আজকের খেলার এটাই রুল আমার তাড়া খেয়ে তুমি বাঁচার চেষ্টা করবে আর আমি চেষ্টা করব তোমাকে শেষ করার।” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ঋষি।

“কেন? কেন ঋষি তুমি এমন করছ? আমাদের বিয়ে, আমাদের ভালোবাসা সব কি মিথ্যে ছিল? বলনা ঋষি?” হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল মেধা।

“ওহ স্টপ দিস ননসেন্স টক। বিয়ে, ভালোবাসা অল আর ভ্যালুলেস ওয়ার্ডস। নাও আর ফালতু বকবক না করে মরার জন্য তৈরি হও। দ গেম ইজ ওভার। সবচেয়ে মজার কথাটা জানো এই গেমের দুজন পার্টিসিপেন্ট তুমি আর আমি। তফাতটা হল আমি স্বেচ্ছায় খেলছি আর তুমি বাধ্য হয়ে । তুমি তো হেরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত জানলেই না জিততে হলে কি করতে হত। ” সাপের মত হিসিসিয়ে বলল ঋষি।

“নাহ, আমি তোমার কাছে হারব না।” চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো মেধা। চোখে মুখে প্রত্যয়। ঋষি আড়চোখে লোহার রড গুলোর দিকে তাকালো।

“কি ভাবছো আমি ওগুলো দিয়ে তোমাকে আটকাবার চেষ্টা করব? না মিস্টার ঋষি মুখার্জী আমি সেটা পারবো না কারণ আমি তোমাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসে ছিলাম। তোমার শরীর থেকে একফোঁটা রক্ত ঝরাতেও আমি পারবো না। তুমি বলেছিলে না তোমার খেলায় আমি হেরে গেছি কিন্তু আমার খেলায় তো আমি জিতবই। আজ হয়ত তুমি অন্য কারুর কিন্তু একদিন তুমি শুধুমাত্র আমার ছিলে। আমার ঋষি তো মারা গেছে তার স্মৃতি বুকে নিয়ে আমি তোমাকে মুক্তি দেব। ভালোবাসার খেলায় আমি জিতবই। “কয়েক মুহূর্ত থেমে ঋষিকে দেখল মেধা। ঋষি ওর কথার মর্ম উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। অভিমান ভরা শান্ত স্বরে মেধা বলল, “ভালো থেকো। সুখে থেকো রুহিকে নিয়ে।” কথা বলতে বলতে ন্যাড়া ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে মেধা। নিচে পাথরের ওপর উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। নিজের হাত দুটো দুপাশে মিলে দিয়ে ঋষিকে শেষবারের মতো দেখল সে।

“এই কি করছ তুমি? আমাকে তুমি হারাতে পার না।” চিৎকার করে উঠল ঋষি। এতক্ষনে সে মেধার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। ছুরিটা নিয়ে তীর বেগে ছুটে আসছে মেধার দিকে। তাকে কোনও সুযোগ দিল না মেধা । নিজের শরীরটাকে পেছন দিকে হেলিয়ে দিল। অভিকর্ষের টানে বাতাস কেটে তার শরীরটা নামতে লাগলো। চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল মেধা।

 

গভীর ঘুমের মধ্যেই ঋষি কানের কাছে কারুর গরম নিশ্বাস অনুভব করল। পরমুহূর্তেই ঠোঁটের ওপর আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া। তার সারা শরীরে কোমল একটা হাত খেলা করে বেড়াচ্ছে। ঋষির শরীরে ক্রমশ উত্তেজনা ছড়িয়ে যাচ্ছে। নরম একটা ঠোঁট তার শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলোয় পাগলের মতো চুমু খেতে লাগলো। ঋষির পুরুষাঙ্গ জানান দিচ্ছে সেই বিশেষ মুহূর্ত আগত। ঋষির তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে গিয়ে সে জড়িয়ে ধরল সেই নারী শরীরকে। ভীষন নরম শরীরটা ঋষির শরীরে মিশে যেতে চাইল। ঋষি তাকে বিছানায় নামিয়ে উপগত হওয়ার উপক্রম করল কিন্তু পরমূহুর্তেই বিছানা ছেড়ে ছিটকে নীচে নেমে দাঁড়ালো।

“কে আপনি? আমাদের বিছানায় কি করছেন?” ঋষির চোখে যেটুকু ঘুমের রেশ ছিল কেটে গেছে। আবছা নীলচে আলোয় সে আবিষ্কার করল তার সাথে যে শরীরী খেলায় মেতে ছিল সে তার স্ত্রী মেধা নয় অন্য কেউ। অপূর্ব সুন্দরী এক নারী। ফিনফিনে সাদা রাত পোশাকে তাকে এত মোহময়ী লাগছে যেন রূপকথার দেশ থেকে উঠে আসা জলপরী। তার শরীরের প্রতিটি ভাঁজ এত স্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান যে সে আকর্ষণকে উপেক্ষা করা বোধহয় স্বয়ং ঈশ্বরেরও অসাধ্য কিন্তু ঋষির সেসব দেখার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই সে বিস্ফারিত চোখে পুরো রুমটায় নজর বুলিয়ে ভয় পেয়ে গেল। কোথাও মেধার অস্তিত্ব নেই। ছুটে গিয়ে একধাক্কায় বাথরুমের দরজা খুলে দেখল সেখানেও মেধার চিন্হ মাত্র নেই।

“মেধা আ আ…। কোথায় তুমি?” চিৎকার করে উঠলো ঋষি।

“সে তো গেছে তার প্রেমিকের সঙ্গে অভিসারে।” লাস্যময়ী ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল সেই মেয়ে।

“মিথ্যে কথা। কি যা তা বলছেন! কে আপনি?” রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে ঋষি।

“আমি নীলাঞ্জনা। ইউ ক্যান কল মি অনলি নীল। আমিও এই হোটেলের বোর্ডার। এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও আমার মত দুঃখী কেউ নেই। বাবা-মা এক বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়েছে। হি কান্ট স্যাটিসফাই মি। বিশ্বাস কর তোমাকে হোটেলের রিসেপশনে দেখেই পাগল হয়ে গিয়েছি আমি। আমার বরটার তো কিছু মুরোদ নেই ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম একা। যখন দেখলাম তোমার বউ তার প্রেমিকের হাত ধরে সমুদ্রের দিকে চলে গেল তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। প্লিজ শুধু আজ রাতের কিছু সুন্দর মুহূর্ত আমাকে দাও। একটু সুখ পেতে দাও আমাকে।” কাতর ভাবে বলে মেয়েটি।

“স্টপ দিস ননসেন্স টক। হাসব্যান্ডের সাথে প্রবলেম তো ডিভোর্স দিয়ে দিন আবার বিয়ে করুন যা খুশি করুন তা বলে এভাবে একজন অচেনা পুরুষের সঙ্গে…..।” ঋষি ঝাঁঝিয়ে ওঠে।

“কেন ঋষি? যে তোমার সাথে বিট্রে করছে তার প্রতি লয়াল থাকার কি দরকার তোমার? প্লীজ ঋষি আমাকে তোমার করে নাও। আয়াম ম্যাড ফর ইউ। তোমাকে না পেলে মরে যাবো আমি।” কথা বলতে বলতে ঋষির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটি। বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে, “তোমার শরীরে আজ আমি আগুন জ্বালিয়ে দেব।”

ঋষি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে মেয়েটির বাহুমুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে মেধা কোথায়? অজানা অচেনা জায়গায় এত রাতে একলা একলা ঘোরার মেয়ে মেধা নয়। এই মেয়েটা ওকে কিছু করেনি তো? এক ঝটকায় মেয়েটিকে বিছানায় ফেলে দিয়ে ঋষি ফুঁসে ওঠে, “সত্যি করে বলুন মেধাকে আপনি কি করেছেন?”

“বললাম তো তোমার বউ কোথায় গিয়েছে।”

“চুপ একদম চুপ। আপনার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। আমার মেধা আপনার মত নোংরা মেয়ে নয়। ওর নামে একটাও বাজে কথা আমি শুনতে চাই না।”

ঋষি বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ করে। সে বুঝে গেছে রুমের মধ্যে এই মেয়েটার সাথে শুধু শুধু কথা বলে লাভ নেই। ম্যানেজার ছেলেটা ভালো। ওর কাছে সাহায্য পেতে পারে।

“স্টপ ঋষি স্টপ। তুমি এভাবে আমাকে হারিয়ে দিতে পারো না।” আহত বাঘিনীর মত গর্জে উঠল মেয়েটি। ঋষি একবার ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ওর নীল চোখদুটো দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঋষির দিকে। সে চোখের আশ্চর্য সম্মোহনী ক্ষমতা। ঋষি আচ্ছন্নের মত এগিয়ে যেতে লাগলো ওর দিকে।

 

খুব আস্তে আস্তে চোখের পাতা খুলল মেধা। বালির ওপর একটা পাথরে ঠেস দিয়ে বসে আছে সে। কিছুটা সময় লাগলো তার মাথাটা পরিষ্কার হতে। কিছু দূরে সেই বাড়িটাকে দেখতে পাচ্ছে।

তার তো বেঁচে থাকার কথা নয় তাহলে? ঋষিই বা কোথায়?

“খুব অবাক লাগছে তাই না মেধা?” চমকে উঠে মেধা দেখল তার সামনে প্রায় ঋষির বয়সীই একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

“আপনি কে?” ক্লান্তি জড়ানো গলায় মেধা প্রশ্ন করে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে তার মনে ভয়, আশঙ্কা আর কিছুই কাজ করছে না।

“ধরে নাও তোমার বন্ধু যে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর জানে।”

“আপনি জানেন আমার সাথে কি হচ্ছে কেন হচ্ছে?” মেধার অসহায় প্রশ্ন।

“হুম, জানি। তার আগে তোমাকে কংগ্রাচুলেট করতে চাই। ইউ হ্যাভ ওন দ গেম।”

“মানে?”

“সব জানতে হলে বুঝতে হলে তোমাকে ধৈর্য্য ধরে একটা গল্প শুনতে হবে।”

“বলুন।” সংক্ষিপ্ত উত্তর মেধার।

“তবে শোন। তোমরা যে হোটেলে উঠেছ ওই হোটেলের মালিকের বড়ছেলে ছিল সুমিত। সুমিত বাবা মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বিয়ে করে নীলাঞ্জনা নামে একটি মেয়েকে। ভালোবাসার চরম সীমা যদি কিছু হয়ে থাকে সেই পর্যন্ত সুমিত ভালোবাসতো নীলাঞ্জনাকে। সুমিতের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল রাজেন। সুমিতের অগোচরেই রাজেন, নীলাঞ্জনা আর সুমিতের মধ্যে একটা অদৃশ্য ত্রিভুজ তৈরি হয়ে যায়। বস্তুত রাজেন ছিল ক্যাসানোভা টাইপের ছেলে আর নীলাঞ্জনা সেই সব মেয়েদের দলে পড়ত যারা টাকা আর শরীরের জন্য সব কিছু করতে পারে। বিশ্বস্ততা শব্দটাই এদের দুজনের ডিকশনারিতে ছিল না। ভালোবাসা, বিশ্বাস এসব মূল্যহীন ছিল এদের কাছে। রাজেন সুমিতদের হোটেল চেনেই কাজ করত। সুমিতকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নীলাঞ্জনা এই হোটেলের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন কথা সুমিতের কানে এলেও সে গুরুত্ব দিত না কারণ সে তার নীলকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতো, বিশ্বাস করত। কারুর সাবধান বাণীতে কর্ণপাত করেনি সে কিন্তু একদিন সুমিতের ভাই অনেক কষ্টে সুমিতকে বোঝায় নীলাঞ্জনা আর রাজেনের ওপর নজর রাখার জন্য। সত্যি কথা বলতে কি সুমিত ভাইকে বিশ্বাস করে নয় তাকে ভুল প্রমাণিত করার জন্যই কলকাতা থেকে এখানে ছুটে আসে। তারপরে কি হলো সংক্ষেপে বলছি তোমাকে কারণ খেলা শেষ হতে আর বেশি সময় নেই। তোমরা যে কটেজটায় আছো ওই কটেজের জানালা দিয়ে সুমিত ভেতরের যে দৃশ্যাবলী দেখে তাতে তার পায়ের তলার বালি সরে অকূল সাগরে পড়ে যায় সে। তার ভালোবাসার মানুষটি আর তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু উদ্দাম শরীরী খেলায় মেতে উঠেছে। জানো মেধা দুটো মানুষ যখন পরস্পরকে সত্যিকারের ভালোবেসে মিলিত হয় তখন তাদের সেই মিলন হয় পবিত্র, দৃষ্টিনন্দন কিন্তু যদি তাদের সম্পর্কের মধ্যে নোংরামি থাকে তাহলে তাদের সেই সম্ভোগ দৃশ্য কতটা অশ্লীল, কতটা কদর্য হতে পারে সে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। সুমিত আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না দরজায় ধাক্কা দেয়। সুমিতকে দেখে ওরা বুঝতে পারে ধরা পড়ে গিয়েছে। সুমিত রাগের মাথায় নিজের লাইসেন্সেড রিভলবার বের করে ওদের শাসাতে থাকে , ওটা সব সময় তার সঙ্গে থাকত কিন্তু ও বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেনি রাজেনের কাছেও রিভলবার আছে। শুরু হয় অন্তিম যুদ্ধ। ধস্তাধস্তি করতে করতে রাজেনের গুলি দিকভ্রষ্ট হয়ে সোজা লাগে নীলাঞ্জনার বুকে। জানো মেধা সেই অবস্থাতেও সুমিতের বুকটা তার নীলের জন্য দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যায়। সে তার নীলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে রাজেনের বুকে পরপর তিনটে গুলি চালিয়ে দেয় তারপর রিভলবারে আর একটা গুলি ছিল সেটা নিজের জীবন শেষ করতে সে ব্যবহার করে। শেষ হলো একটা অধ্যায়। এটা এক বছর আগের ঘটনা।”

এতদূর বলে রহস্যময় মানুষটি থামলেন। মেধা মন্ত্রমুগ্ধের মত বলল, “তারপর?”

“তারপর এই কাহিনীতে ঢুকলে তোমরা। সুমিত, নীলাঞ্জনা, রাজেন কারুর আত্মাই মুক্তি পায়নি। তারা প্রেতযোনি লাভ করেছে। গত এক বছরে তাদের আত্মা কিছু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে । আজ সেই অভিশপ্ত দিন। এই দিনে তারা আবার পরস্পরের মুখোমুখি হয়। তুমি এসব ঠিক বুঝবে না আর হাতেও বেশি সময় নেই। যে কোনও মুহূর্তে খেলা শেষ হয়ে যেতে পারে। সুমিত, নীলাঞ্জনা আর রাজেন তিনজনেই ভিডিও গেম খেলতে খুব ভালোবাসতো। আজ তোমাদের ওই কটেজে দেখে ওদের মধ্যে একটা গেম খেলার সিদ্ধান্ত হয়। এই গেমের ভিত্তি নির্ধারিত হয় বিশ্বাস আর ভালোবাসা। দুটো পার্ট এই গেমের। একদিকের প্লেয়ার মেধা মুখার্জী আর তাকে তাড়া করবে যে ভিলেন সে হলো রাজেন আগারওয়াল। অন্য দিকের প্লেয়ার ঋষি মুখার্জী তাকে বাঁচতে হবে নীলাঞ্জনার হাত থেকে। খুব অবাক লাগছে তাই না?”

“আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। আমাকে তো ঋষি তাড়া করেছিল।”

“মেধা, রাজেন এখন প্রেতাত্মা। বললাম না প্রেত যোনি লাভ করার পর প্রত্যেকেই কিছু ক্ষমতার অধিকারী হয়। তুমি প্রথম থেকে ভেবে দেখ হঠাৎ করে বাথরুমের দেওয়াল ভেঙ্গে গেল কি করে। রাজেন তোমার কাছে ঋষির রূপে এসেছিল। এই গেমের রুল অনুযায়ী তুমি ফাস্ট লেভেলেই জিতে যেতে যদি বাথরুম থেকে ভয়ে না পালাতে। যদি বিশ্বাস করতে ঋষি তোমাকে কোনও অবস্থাতেই মারতে পারে না। সেকন্ড লেভেলেও জিততে পারতে যদি মন থেকে সমস্ত অবিশ্বাস দূর করতে পারতে কিন্তু তোমার মনে ঋষির প্রাক্তন প্রেমিকার কথা উদয় হলো। লাস্ট লেভেলে গিয়েও তোমার মন থেকে ঋষির প্রতি অবিশ্বাস দূর হয়নি কিন্তু তুমি জিতে গেলে ভালোবাসার লড়াইতে। তোমার কাছে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তুমি ঋষি রূপী রাজেনকে আঘাত না করে নিজের জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিলে। তুমি যদি একবারও রাজেনকে আঘাত করে ফেলতে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যেতে। তুমি তা না করায় রাজেনের কি পরিণতি হয়েছে দেখ।”

মেধার সামনে বিশাল একটা পর্দা ফুটে উঠল। তার মধ্যে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী চলমান। মেধার শরীরটা ক্রমশ নিচের দিকে পড়ছে আর ছাদের ওপর ঋষির চেহারাটা আসতে আসতে অন্য একটা মানুষের চেহারা নিচ্ছে। যার চোখে ধুর্ততা, চেহারায় হিংস্রতা। মেধা দেখল সেই মানুষটা “না আ আ” বলে চিৎকার করে উঠলো আর সঙ্গে সঙ্গে তার সারা শরীরে আগুন ধরে গেল।

“এই খেলার সেকেন্ড পার্ট এখনও বাকি মেধা। তুমি তো জিতে গেলে তাই তোমার জীবনও বেঁচে গেল। এখন ঋষির ওপর নির্ভর করছে ওর নিজের জীবন আর সুমিতের মুক্তি।”

“মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?”

“এই গেমের রুল অনুযায়ী যদি তুমি আর ঋষি দুজনেই জিততে পারো তবেই সুমিতের আত্মা মুক্তি পাবে কারণ তোমরা জিতে যাওয়ার অর্থ বিশ্বাস আর ভালোবাসার জয়। যেগুলো ভীষন মূল্যবান সুমিতের কাছে। “

“এই খেলার শেষে রাজেন আর নীলাঞ্জনার কি হবে?” মেধা প্রশ্ন করে।

“রাজেন তোমার কাছে হেরে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে মানে প্রেতলোকে চিরকালের জন্য বন্দী সে। ওর আত্মা কোনও দিন মুক্তিও পাবে না আবার মনুষ্য লোকে এসে কারুর ক্ষতি সাধনও করবে না। ঋষি জিততে পারলে নীলেরও একই দশা হবে। যদি ঋষি হেরে যায় তাহলে ওর জীবনীশক্তি নিয়ে নীলের প্রেতাত্মা আরও শক্তি শালী হয়ে যাবে। সুমিতের আত্মাও তার দুঃখ বুকে নিয়ে এই সাগর পাড়ে ঘুরে বেড়াবে।”

“আচ্ছা ওরা তো খুব খারাপ মানুষ ছিল তাহলে খেলার রুল তো নাও মানতে পারে মানে ওদের ধ্বংস হয়ে যাবার ব্যাপারটা…..।”

“মেধা, মনুষ্য লোকের মত প্রেত লোকেরাও কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে তাছাড়া রাজেন আর নীলের মত সুমিতও কিছু ক্ষমতার লাভ করেছে তাই খেলার পরিণতি তার নিয়ম অনুযায়ী হতে বাধ্য।”

“খুব ভালোবাসতেন নীলাঞ্জনাকে তাই না?”

মেধার প্রশ্নে রহস্যময় মানুষটি ওর দিকে ফিরে তাকায়। মেধা স্মিত হেসে বলে, “আজও আপনি নীলাঞ্জনাকে পরম যত্নে নীল বলে ডাকেন।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমিত বলে, “এখন তোমার ভালোবাসার পরিণতি কি হয় দেখা যাক।”

পর্দায় ফুটে উঠলো কটেজের সেই রুম। ঋষিকে দেখতে দেখতে মেধার চোখের পাতা ভিজে এলো। ঋষি তাকে এত বিশ্বাস করে অথচ সে ঋষিকে এত খারাপ ভাবছিল! নিজের ওপরই ঘেন্না হচ্ছে মেধার। একটু পরে “ওহ শিট! নীল তুমি এটা করতে পারো না। ইট মাস্ট বি এ ফেয়ার গেম।” নিজের বাম হাতের তালুতে ঘুঁসি মেরে বলল সুমিত। মেধা অবাক হয়ে তাকাতে সুমিত উত্তেজিত ভাবে বলল, “নীল সম্মোহনী শক্তি প্রয়োগ করছে ঋষির ওপর। ঋষি একবার ওর বশে চলে এলে ঋষিও শেষ আর আমিও।”

মেধা কাঁদো কাঁদো হয়ে প্রশ্ন করে, “ওকে আটকানোর উপায় নেই?”

“নাহ, তিনজনে যখন খেলাটা তৈরি করি আমি এইদিকটা ভেবে দেখিনি। গেমের রুলসে উল্লেখ নেই বলে আমি ওকে আটকাতেও পারব না। বেঁচে থাকতে ওদের বিশ্বাস করার যে ভুলটা করেছিলাম আবার সেই একই ভুল করে ঋষিকে বিপদের মুখে ফেলে দিলাম। নীল এখনও একই রকম রয়ে গেছে। নীতিহীন, ছলনাময়ী।” হতাশ স্বরে বলল সুমিত।

“নাহ এটা হতে পারে না। আমার ঋষির কিছু হবে না।” কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মেধা। ঋষি এগিয়ে যাচ্ছে বিছানার দিকে যেখানে ফুটন্ত লাভার মত উত্তপ্ত যৌবন নিয়ে বসে আছে নীলাঞ্জনা। তার মনুষ্য শরীরটা চিতার আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেলে কি হবে আজ সে প্রেত শক্তি বলে যৌনতার মাদকতায় পূর্ন এই শরীর ধারণ করেছে। মেধা পর্দার দিকে তাকিয়ে ঋষির নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে তারপর উন্মাদের মত সেদিকে ছুটে যায়।

 

নীলাঞ্জনার ঠোঁটে ক্রূর হাসি খেলা করছে। সুমিতকে সে মুক্তি পেতে দেবে না। বেচারা সুমিত প্রেতযোনি থেকে আর ওর মুক্তি ঘটবে না। রাজেনটা বোকার মতো হেরে গেল। চিরকালই ওর মাথাটা মোটা। সেদিন যদি বোকার মতো সুমিতের সাথে লড়াই করতে না যেত আজ তাহলে ওরা বেঁচে থাকতো। কেঁদেকেটে ক্ষমা চেয়ে সুমিতকে সে ঠিক আবার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিত আর সুযোগ বুঝে শেষ করতো। তার বদলে আজ প্রেতিনি হয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। ঋষি তার খুব কাছে চলে এসেছে। হেরে গেলে সুমিত তুমি হেরে গেলে। কি বলেছিলে তুমি ভালোবাসা নাকি চিরন্তন! আমার আর রাজেনের মত কিছু মানুষ তাকে কলুষিত করেছে। ভালোবাসা নাকি কখনও হারে না! যত বোগাস কথাবার্তা! কিন্তু ঋষি এরকম করছে কেন? দুহাতে নিজের মাথাটা চেপে ধরে ঝাঁকাচ্ছে!

 

মোহগ্রস্থের মত ঋষি বিছানায় বসে থাকা মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু তার মনের মধ্যে এরকম উথাল পাতাল হচ্ছে কেন? কার মুখটা বারবার জলছবির মত চোখের সামনে ভেসে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে? কে ও? মনে হচ্ছে খুব কাছের খুব নিজের কেউ। কি নাম ওর? এত চেনা লাগছে কেন? ঋষির কানে হঠাৎ একটা রিনরিনে আওয়াজ ভেসে এল। কেউ ওকে ডাকছে। পাগলের মতো ওর নাম ধরে চিৎকার করছে। এদিকে সামনের মেয়েটি ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তার উন্মুক্ত যৌবন ভোগ করার জন্য। এই মেয়েটিই বা কে? ঋষি কেন ওর কাছে যাবে? আস্তে আস্তে ঋষির ঘোর কেটে আসছে। মেধা, মেধা,মেধা…. এই একটা নাম মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঋষি আচমকা চিৎকার করে উঠলো, “মেধা আ আ …...তুমি কোথায়?”

“নাহ, আমি এভাবে হারতে পারি না। না আ আ…..।” মরণ চিৎকার বেরিয়ে এল নীলাঞ্জনার গলা থেকে।

“তুমি হেরে গেছ নীল।”

সুমিত অবাক হয়ে রুমের মধ্যে আরও দুজন মানুষের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। তারই বয়সী একজন পুরুষ আর অন্যজন তার স্ত্রী মেধা যার ছেঁড়া পোশাক, কেটে ছিঁড়ে যাওয়া হাত, মুখ আর বিধ্বস্ত চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার ওপর দিয়ে কোনও ঝড় বয়ে গেছে।

“মেধা তুমি কোথায় ছিলে? এমন অবস্থা কেন তোমার?” ঋষির উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।

প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে মেধা দৌড়ে এসে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুহাতে তাকে শক্ত করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমি ঠিক আছো তো? ও তোমার কোনও ক্ষতি করে নি তো?”

নীলাঞ্জনার দু চোখে জিঘাংসার আগুন কিন্তু তার কিচ্ছু করার নেই খেলা শেষ। শর্ত অনুযায়ী তাকে এবার চির বন্দিনী হয়ে থাকতে হবে প্রেতলোকে।

“গুড বাই নীল। ঋষির ভালোবাসা আর বিশ্বাস ওকে তোমায় সম্মোহন থেকে মুক্ত করে দিয়েছে।” সুমিত শেষ বিদায় জানায় তার ভালোবাসার মানুষকে। নীলাঞ্জনার শরীরটা আস্তে আস্তে আগুনের গ্রাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।

বিস্মিত ঋষির বলে, “আ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলব। আমরা জিতে গেছি ঋষি। ভালোবাসার খেলায় আমরা জিতে গেছি।” খুশির ছোঁয়া মেধার কন্ঠে।

 

মাথার ওপর অন্তহীন আকাশ, সামনে অকূল পাথার। মেধা আর ঋষি দাঁড়িয়ে আছে পরস্পরের হাত ধরে সামনে সুমিত।

“এমনি করেই দুজনে দুজনকে ভালোবেসো, পরস্পরের বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো। ভালো থেকো তোমরা আর ভালো থাকুক ভালোবাসা।”

সুমিতের অবয়বটা ধীরে ধীরে আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল নীল আকাশের বুকে। দিগন্তে তখন কনে বউয়ের মত সিঁদুরে রাঙা লাজুক সূর্য উঁকি দিচ্ছে।