মাতৃ স্নেহ


স্মিতা আর সুস্মিতা তখন খুবই ছোট। বড় বোন স্মিতা পড়ে ক্লাস ফোর আর ছোট বোন সুস্মিতা ক্লাস থ্রি এর ছাত্রী। তাদের মা নীহারিকা দেবী হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার আসার আগেই সব শেষ। এত ছোটাছুটি করে কাজ করা মানুষটি ভিতরে এতটাই ফোঁপড়া। অখিল বাবু স্ত্রীর অকাল বিয়োগে দিশাহারা হয়ে পড়লেন। তাঁর বৃদ্ধা মা বাতের রুগী। তিনি নিজের কাজ কোনমতে করতে পারেন। মা হারানো দুটি ছোট মেয়েকে দেখে তার বুক ফেটে যেত কিন্তু তাদের সঠিক ভাবে আদর যত্ন দিয়ে প্রতিপালন করার শারীরিক ক্ষমতা তাঁর ছিল না।

পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরের দিনই বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। অখিলবাবু নিজের অসহায় অনুভূতি গুলো পাথর চাপা দিয়ে দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে গেলেন। এই কদিন পিসিদের সাথেই এক খাটে শুয়েছে ওরা। বড়দি ওদের নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে চেয়ে ছিলেন কিন্তু সামনেই বাৎসরিক পরীক্ষা তাই অখিল বাবু ওদের ছাড়েন নি। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। তারপর অফিসে ছুটি নিয়ে মেয়েদের সাথে নিয়ে দিদিদের বাড়ি ঘুরে আসবেন এটাই তাঁদের জানিয়ে রাখলেন।

স্মিতা এই কদিনেই যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে। ছোট বোনকে অনেকটাই সামলে রাখে। সুস্মিতা কান্নাকাটি করে। মাকে দেখার জন্য জেদ করে। মায়ের ছবির সামনে বসে অনেক কথা বলে।

অখিল বাবু এতদিন বাদে দুই পাশে দুই মেয়েকে নিয়ে শুয়ে তাদের গল্প বলে অনেক আদর করে ঘুম পাড়ালেন। দুই বোন ঘুমানোর পর তার মনে পড়ল আগামী কাল থেকে ওদের স্কুলে পাঠাতে হবে। স্কুলের দিদিমণিরা কয়েকজন এসেছিলেন। তাঁরা বার বার বলেছেন মেয়েদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।

দুই মেয়ের স্কুলের ড্রেস খুঁজে বার করে কেচে রেখে গেছেন বড়দি। কিন্তু সেগুলি ইস্ত্রি করা হয়নি। বুকের উপর থেকে সাবধানে দুজনের দুটো হাত সরিয়ে রেখে যথা সম্ভব কম আওয়াজ করে উঠে পড়লেন অখিল বাবু। সামনের দেওয়ালে মালা চন্দনে সাজানো নীহারিকার বেশ বড় বাঁধানো ছবি। তার ছড়ানো হাসি ভর্তি মুখ দেখে অখিল বাবুর চোখ জলে ভরে যায়। দুজনে কত স্বপ্ন দেখছেন একসাথে।মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কত পরিকল্পনা করেছেন একত্রে। আজ সব কাজের ভার তার একার অনভ্যস্ত ঘাড়ে দিয়ে নীহারিকা হাসছেন। দুহাতে চোখের জল মুছে আলনার থেকে দুজনের স্কুলের ড্রেস মোজা রুমাল নিয়ে পাশের ঘরে যান অখিল বাবু।

জামাগুলি ইস্ত্রি করে সব পরপর গুছিয়ে রাখেন অখিল বাবু। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে জল খান। মেয়েদের ওয়াটার বটল গুলি হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে ঘরে ফেরেন। ঘরে ঢোকার আগে জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে বিস্ময়ে স্থির হয়ে যান। মেয়েদের মাথার কাছে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে স্নেহ মাখা হাসি হাসছেন নীহারিকা। হয়ত তাঁর মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ নিজের অজান্তেই বার হয়ে গিয়েছিল নিমেষে সব উধাও হয়ে গেল। দৃষ্টিতে আবার সব স্বাভাবিক দৃশ্য। দুই মেয়ে অকাতরে ঘুমাচ্ছে।

হয়ত পুরোটাই দৃষ্টি বিভ্রম। মনের ভুল। নিজেকে আবার শক্ত করে ঘরের ভিতরে ঢুকে রাতের হালকা আলো নিভিয়ে টিউব লাইট জ্বেলে দেন তিনি। দুই মেয়ের মাঝখানে বসে স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। তারপর দুজনের মাঝখানে শুয়ে পড়েন।

কয়েকদিন বাদে মেয়েদের পরীক্ষা শুরু হয়। অখিল বাবু নতুন রান্নার লোক কে সব কিছু বোঝাতে বোঝাতে বাচ্ছাদের পড়া দেখাতে দেখাতে আর নিজের চাকরি সামলাতে নাজেহাল হয়ে যান। তাঁর বৃদ্ধা মা সব দেখেন আর কাঁদেন। শরীর আর মনের ক্লান্তিতে অস্থির লাগে অখিল বাবুর। শুধু তার দুটি ফুটফুটে রাজকন্যা তাঁকে জীবনী শক্তি যোগায়। বাড়ি ফেরার পর থেকে মেয়েদের জন্য পুরো সময়টাই দেন তিনি। আগের মত কাগজ পড়ে বা টিভিতে খবর আর খেলা দেখে সময় কাটানোর বিলাসিতা করার সুযোগ আর তাঁর নেই।

অনেক দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েও অখিল বাবু অনেক ক্ষণ এপাশ ওপাশ করে শেষ অবধি ঘুমিয়ে পড়েন। ভালো ঠান্ডা পড়েছে। দুই মেয়েকে একটা ছোট লেপের তলায় শুইয়ে তিনি নিজে একটা বড় লেপ নিয়েছেন। দুই মেয়ে তাঁর ডানদিকে। ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ তাঁর ভীষণ শীত করে। খুবই ঠান্ডা চারপাশে। যেন বিছানার উপর কেউ জল ঢেলে দিয়েছে।

আধো ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারেন লেপ সঠিক জায়গায় আছে। এইবার তিনি তাকান। দেখেন দেয়ালের দিকে দাঁড়িয়ে নীহারিকা মেয়েদের লেপটা ভালো ভাবে চাপা দিয়ে দিচ্ছেন। আঁতকে উঠে বেড সুইচ জ্বালান অখিল বাবু। কোথাও কিছু নেই। সেই ভীষণ ঠান্ডা ভাবটাও নেই। তাড়াতাড়ি মেয়েদের ভালো করে দেখেন তিনি। খুব আরামে ঘুমাচ্ছে তারা। একটা অজানা ভয়ে অখিল বাবু অস্থির হয়ে ওঠেন। হাতজোড় করে স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে বলেন―“তুমি আর এসো না। ওদের মায়া কাটিয়ে তুমি চলে যাও। ওদের বাঁচতে দাও।”

পরের দিন অফিস না গিয়ে সোজা বড়দির বাড়ি চলে যান অখিল বাবু।মেয়েদের জন্য চিন্তায় তাঁর পাগল পাগল অবস্থা। বড়দির বাড়িতে গিয়ে যা যা ঘটেছে খুলে বলেন তিনি। বড়দি আতঙ্কে সাদা হয়ে যান। জামাইবাবু একটু চিন্তা করে বলেন দুজনকে ওই বাড়ি ছেড়ে অন্ততঃ দুজনকে স্কুলের হোস্টেলে রেখে দিতে হবে। ওদের মায়ের অতৃপ্ত আত্মার হাত থেকে ওদের বাঁচাতে হবে।

অখিল বাবু পরের দুদিন নিজের মনকে প্রস্তুত করলেন। এই দুই মেয়েকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। সদ্য মা হারা দুটো বাচ্ছা কে তিনি দূরে সরাবেন এই কথাটা ওদের বলবেন কি ভাবে? নিজের মায়ের কাছে পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিতেই তিনি কেঁদে ওঠেন।

সেদিন রাতে মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। অখিল বাবু আকাশ পাতাল চিন্তা করেই চলেছেন। ভবিষ্যতের দিনগুলো আরো কঠিন হবে বুঝতে পেরেছেন। স্কুলের সাথে যোগাযোগ করেছেন। প্রধান শিক্ষিকা চেষ্টা করছেন ওদের যাতে একই ঘরে রাখা ব্যবস্থা করা যায়। মেয়েদের এখনো বলা বাকি। দিদিরা বলেছেন যেদিন ওদের হোস্টেলে পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানানো হবে সেদিন ওনারা উপস্থিত থাকবেন। পরীক্ষা শেষ হোক। দুই পিসির বাড়ি বেড়ানো হোক তারপর জানানো হবে। বিপর্যয়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছেন অখিল বাবু অসহায় ভাবে।

হঠাৎ ঘরের ছোট আলোটা নিভে গেল। কাঁচের জানালায় রাস্তার আলো এসে পড়ে। সেটাও দেখা যাচ্ছে না দেখে অখিল বাবু বুঝলেন এলাকায় লোডশেডিং হয়েছে। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেন তিনি। হঠাৎ আবার চারপাশ ভীষণ ঠান্ডা হয়ে যায়। যেন এক নিমেষে ঘরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রী কমে গেল। অদ্ভুত একটা ভয় গ্রাস করে অখিল বাবুকে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে জানান দেয় কেউ বা কিছু একটা তার মাথার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক দূর থেকে যেন কেউ ফিসফিস করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। কান খাঁড়া করে বুঝতে চেষ্টা করেন কথা গুলো।ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় বাক্য গুলি। নীহারিকা অন্য জগতের বাসিন্দা। তাই তার গলার স্বর যেন অনেকটা পাল্টে গেছে। তিনি বলছেন―“ আমার মেয়েদের দূরে পাঠিও না। ওরা যে খুব ছোট। আমি ওদের কোনো ক্ষতি করবো না। ওদের কোথাও পাঠিও না।... পাঠিও না। ...পাঠিও না .." শেষের কথা গুলো ক্রমশ আস্তে হয়ে আসে। যেন দূরে সরে যায় সেই অশরীরী কন্ঠস্বর। আলো জ্বলে ওঠে। শীত কমে গিয়ে আবার স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফিরে আসে। অখিল বাবু উঠে বসে ঘরের বড় আলোটি জ্বালেন। তার শরীরে ঘাম। দুহাতে মুখ ঢেকে তিনি কেঁদে ওঠেন।

পরের দিন অনেক ভেবে ঠিক করেন মেয়েদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাড়ি থেকে মেয়েদের দূরে সরিয়ে দেবেন। দুই দিদি আর মা যা বলছেন তাই হয়ত ঠিক। একদিন নীহারিকা মেয়েদের নিজের কাছে নিয়ে যাবেন।যে চলে গেছে তার জন্য আর শোক না করে এখন শক্ত হয়ে বাচ্ছাদের বাঁচাতে হবে। এভাবে তো নিজের শরীর ও ভেঙে পড়বে। তাঁর মাথায় এতগুলো দায়িত্ব। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কে ফোন করেন তিনি।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি মেয়েদের হোস্টেলে দিয়ে আসতে চান।

এরপর শীতের ছুটিতে তিনি মেয়েদের দিদিদের বাড়ি ঘুরে বেড়ান। মেয়েদের নিয়ে চিড়িয়াখানা জাদুঘরে যান। তারপর একদিন আসে সেই দিন যেদিন মেয়েদের বলতে হয় তাদের ভালোর জন্য তাদেরকে হোস্টেলে পাঠানো হচ্ছে।সেখানে কত বন্ধু থাকবে। কত মজা হবে। দুই বোন কেমন অবাক হয়ে যায়। তারা জানত দুস্টুমি করলে তাদের হোস্টেলে যেতে হবে। বহুবার মা তাদের এই শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। স্মিতা একটু বাদে বলে,

―“আমরা খুব ভালো মেয়ে হয়ে থাকবো বাবা। বনুকেও সামলে রাখবো। আমাদের কেন হোস্টেলে পাঠাবে? আমরা কি করেছি।”

অখিল বাবু ছিটকে রাস্তায় বার হয়ে যান। বড় মেয়ের প্রতিটি কথা তার মাথায় গেঁথে যায়। এবার কি করবেন তিনি ভেবে পান না।

ঘন্টা খানেক বাদে দুই মেয়ের জন্য দুটি সুন্দর পুতুল কিনে বাড়ি ঢোকেন তিনি। দুই মেয়ে আশ্চর্য ভাবে চুপ হয়ে গেছে দেখে বড়দি চুপিচুপি বললেন উনি ওদের বুঝিয়েছেন মাত্র এক বছরের জন্য ওরা যাচ্ছে হোস্টেলে। বাবাকে এর মধ্যে অফিস থেকে অনেক দূর দেশে যেতে হবে তাই এই ব্যবস্থা।

বড়দি এত বড় মিথ্যা বললেন বাচ্ছাদের। এটা ঠিক হলো না ভুল হলো ভবিষ্যৎ বিচার করবে। ব্যাগ গোছানো হলো অনেক গুলো। স্কুলের দেওয়া তালিকার বাইরে কিছু দেওয়ার নিয়ম নেই। মন খারাপ হলেও অখিল বাবু হাসি মুখে মেয়েদের জিনিষ গোছালেন। নতুন পুতুল পেয়ে মেয়েরা খুশি। পরের দিন সকালে সবাই যাবেন একসাথে ওদের হোস্টেলে পৌঁছাতে।

একটু রাতে ঘুমালো মেয়েরা। অনেক গল্প বলতে হলো ওদের। অখিল বাবুর চোখে ঘুম নেই। ভিতরে ভিতরে রক্তাক্ত হয় মন। মাঝরাতে ঘুম আসে। হঠাৎ খুব ঠান্ডা লেগে তাঁর ঘুম ভাঙে। তিনি জানতেন আজ নীহারিকা আসবে। আসবেই। বাধা দেবে মেয়েদের নিয়ে যেতে দেবে না। অখিল বাবু চোখ খুলে তাকান। পায়ের কাছে অস্পষ্ট নীহারিকা। অখিল বাবু দেখেন নীহারিকা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে সামনে রাখা বেড সুইচ জ্বালিয়ে দেন অখিল বাবু। সব ঠিক আছে যেমন থাকা উচিৎ।

পরের দিন তিনটি ট্যাক্সি ভাড়া করে ওদের ঠাকুমা বাদে সবাই গেলেন স্মিতাদের হোস্টেলে পৌঁছাতে। দোতলার একটি ঘরে ওদের থাকার জায়গা হয়েছে পাশাপাশি দুটি খাটে। ঘরটি বেশ বড়। মাথার দিকের জানালা দিয়ে নীচে স্কুলের দিকে যাওয়ার রাস্তা, খেলার মাঠ দেখা যায়। পরপর ছয়টি খাট। দেওয়ালে তাক করা আছে। সেখানে নিজেদের জিনিষ পত্র বই রাখার জায়গা। দুটি আলমারী আছে স্টীলের। তাতে জামাকাপড় রাখে মেয়েরা।

স্মিতাদের ঘরে দুটি ক্লাস এইটের ছাত্রী বাকি দুটি ফাইভ এর ছাত্রী। ওদের সব কিছু জিনিষ গুছিয়ে রেখে দিল পিসতুতো দিদি তুয়া। আশেপাশে প্রচুর গাছ। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। মেয়েদের জায়গাটা পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারেন অখিলবাবু।

বাবা পিসিরা চলে যাওয়ার সময় বনু খুব কাঁদলেও স্মিতা নিজেকে সামলে নেয়। সে এটুকু বুঝেছে এক বছরের জন্য নয় এবার থেকে এখানেই তাদের থাকতে হবে। বনুকে আদর করে বুঝিয়ে দেয় এই তো আর তিন চার মাস বাদেই গরমের ছুটিতে আবার তারা বাড়ি যাবে। হোস্টেলের বড় দিদিরা তাদের ঘিরে ধরে সান্ত্বনা দেয়।

ক্লাস এইটের মেয়ে দুটির নাম ববিতা আর কৃষ্ণা। তারা নিজেরা গোপনে গোপনে পরিকল্পনা করে নতুন আসা বোন দুটিকে নিয়ে একটু মজা করতে হবে। ওরা যখন রাতে ঘুমাবে খুব করে ভয় দেখাতে হবে। অনেক দিন হোস্টেলে কোনো চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটে নি। তরঙ্গহীন জীবনে একটু জোয়ার আনা দরকার। কৃষ্ণার আগের ক্লাসের বই একটা পিচ বোর্ডের বাক্সে ভরে খাটের তলায় রাখা আছে। মাঝরাতে স্মিতারা ঘুমিয়ে পড়ার পর দুজনে উঠে আগে থেকে খালি করে রাখা বাক্সটিকে বাইরে আনে। বাক্সটি উল্টো করে মাথায় চাপানো হবে। চোখের সামনে দেখার জন্য দুটো আর কানের সামনে দুটো বড় গর্ত করে রাখা আছে বাক্সের গায়ে। দুই কানে দুটি টর্চ রেখে বাক্সটি মাথায় উল্টে পরে নেয় কৃষ্ণা। টর্চের আলো বার হয় বাক্সের ভিতর থেকে। উপরে সাদা কাপড় চাপা দিয়ে এগিয়ে যায় সে দুই বোনের খাটের দিকে। পিছনে নাকি সুরে ওদের নাম ধরে ডাকতে থাকে ববিতা। স্মিতার ঘুম ভেঙে যায়। বোনকে আঁকড়ে ধরে সে। অস্ফুটে কেঁদে ওঠে―“মা গো।”

হঠাৎ স্মিতা দেখে তাদের পায়ের কাছে মা দাঁড়ানো। ভীষণ রাগে চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। চেয়ে আছেন তিনি ওই সাদা ভূতটার দিকে। ধপাস করে সাদা ভূতটা পড়ে গেল। ববিতা প্রচন্ড জোরে আর্তনাদ করে ওঠে। সবাই জেগে যায়। স্মিতা দেখে মা অদৃশ্য হয়ে গেছেন।

পরের দিন সব অভিভাবকদের ডেকে পাঠানো হয়। কৃষ্ণার জ্ঞান আসে অনেক দেরিতে। নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। অখিল বাবু দৌড়ে আসেন মেয়েদের দেখতে। ছোট মেয়ে কিছুই দেখেনি কিন্তু সবার চিৎকারে ভয় পেয়েছে সে।

বাড়ি নিয়ে কয়েকদিন ওদেরকে রাখার অনুমতি পেয়ে গাড়ি ডাকেন অখিলবাবু। কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে না হলে বড় মেয়ে এত হাসিখুশি হয়ে গেল কি করে এটা বুঝতে পারেন না তিনি। গাড়িতে উঠে জানালার ধারে বসে স্মিতা উপরের জানালার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে হাসি মুখে। অখিল বাবু উপরের দিকে তাকিয়ে দেখেন জানালার গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নীহারিকা। হাসি মুখে টা টা করছেন বড় মেয়েকে। চোখের পলকে উবে যান নীহারিকা। মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে অখিলবাবুর।

গাড়িতে উঠে ড্রাইভার কে কোনমতে বলেন―“চলিয়েভাইসাব।” ধুলো উড়িয়ে গাড়ি দৌড়ায় বাড়ির উদ্দেশ্যে।