হঠাৎ বর্ষা আর আবছা বিপিন


মাত্র ক’দিন আগে “আষাঢ়স্য প্রথম দিবস” চলে গেল। তবু বর্ষা নামি নামি করেও নামছিল না। আজ সকাল থেকে অঝোর ধারায় ঝরছে। এক পার্টি পেমেন্ট দেবে বলেছিল, সমরেশ তাই ভাঙা ছাতাটা নিয়েই বেরিয়ে পড়েছে। অন লাইন শপিং আসার পর থেকে সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় খুব মন্দা। তাও যা দু’চারটে পায়, পার্টি পেমেন্ট দিতে খুব গড়িমসি করে। ডেট ফেল করা চলবে না। ছাতার জল বাইরে না, সব ভিতরেই ঢুকছে। ভিজে একসা হয়ে ধর্মতলায় এম এম এন্টারপ্রাইজে যখন পৌঁছল তখন চারটে বেজে গেছে।

ঝাড়া তিন ঘন্টা বসে থেকেও সে চেক পেল না। পারচেজ অফিসার কোন কাজে বাইরে গিয়ে আটকে গেছে, তাই সই হল না। অগত্যা খালি হাতে ফেরা।

বৃষ্টির ধারা অনেকটা কমলেও পুরোপুরি থামে নি। সমরেশ ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল। পার্কস্ট্রিটের মুখে গিয়ে বাস ধরবে। শরীরে কেমন কাঁপুনি জাগছে। একটু চা খেলে ভালো হত।

ধর্মতলার এই চত্বরে যেমন বড় কর্পোরেট অফিস আছে, তেমন ছোটখাটো নানান অফিস। দূর মফসসল, জেলা সদর, শহরতলি থেকে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এখানে চাকরি ব্যবসা এমন কি রাজনৈতিক সভাসমিতিতে যোগদানের জন্য আসে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে জল ছাড়ে রাস্তার ধারে আর তাদের পেটের খিদে মেটাতে ফুটপাত দখল করে গজিয়ে উঠেছে পাইস হোটেল, চায়ের দোকান আর পানবিড়ির গুমটি। সর্বংসহা মিছিল নগরীর হতশ্রী ল্যাম্পপোস্ট শুধু নীরব দর্শক।

সমরেশ সবে একটা চায়ের দোকানের প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়েছে, কে যেন হাত ধরল। একে কাঁপছিল তার উপর ঠাণ্ডা স্পর্শে আরও কেঁপে উঠল।

—কে?

—আমি, আমি গো দাদা।

ফুটের দোকানের আবছা অন্ধকারে মুখ ভালো করে দেখা গেল না। গলার স্বর অনেক দিনের চেনা মনে হল। সমরেশ কাছে সরে এল।

—বিপিন, তুই? এখানে কী করছিস? ? তোর না অসুখ?

—হ্যাঁ দাদা, বড্ড অসুখ। সারারাত ঘুমোতে পারি না, পেটে অসহ্য ব্যতা। হাসপাতালে এইছিলুম ডাক্তার দেখাতি।

সমরেশের মনে আছে, মাস ছয়েক আগে বড়জেঠি তাদের দেশের বাড়ি কুলতলীর জামতলা থেকে ফোন করেছিল। বলছিল, বাবা সমর, বিপিনের খুব অসুখ। ওর পেটে টিউমার হয়েছে। খুব বড় হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে, এখনই অপারেশান করতে হবে। তোমার জ্যাঠা মারা যাবার পর ওই তিন বিঘে জমির উপর ভরসা করে আমাদের দিন চলছিল। এখন যদি বিপিন সুস্থ না হয় আমাদের কী হবে! শুনেছি তুমি কলকাতায় ভালো চাকরি কর। যদি কিছু টাকা সাহায্য কর তাহলে ছেলের অপারেশানটা হয়। তোমার নামে নাহয় দু’কাঠা বাস্তু লিখে দোব।

—আচ্ছা, দেখব জেঠি, পরে ফোন করব।

আজ ছ’মাস হয়ে গেছে ফোন করে নি সমরেশ। আসলে বলা তো যায় না, জেঠিমা, আমি কোন বড় চাকরি করি না। অফিসে অফিসে অর্ডার সাপ্লাই করে সামান্য যা পাই তাতে মেস খরচ দিয়ে হাতে বেশি থাকে না। ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করত। ভেবেছিল, এবারের পেমেন্টটা পেলে দেশে গিয়ে জেঠির হাতে হাজার দশেক টাকা দিয়ে আসবে। তাও তো পেল না।

—দাদা, আমার শিয়ালদা যাবার বাস আসছে। আমি আসি। তুমি ছুটি পেলে একদিন এস না দেশের বাড়ি।

বিপিন এক লহমায় সমরেশের হাত ছেড়ে ছায়ামূর্তির মত সরে গেল।

ওর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করল, আস্তে যা বিপিন, তোর পেটে টিউমার, লাগবে।

মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না। সমরেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

মেসে পৌঁছে সবে বাথরুম ঘুরে বিছানায় বসেছে এমন সময় ফোনটা এল। বিপিনের নম্বর থেকে।

—হ্যাঁ বল্ বিপিন, ট্রেন পেয়েছিস?

ফোনের ওপার থেকে জেঠিমার গলা ভেসে এল, ট্রেন আর ও কোনদিন ধরবে না বাবা সমর।

সমরেশ অবাক হয়। — কেন?

—আজ ন’দিন হল বিপিন মারা গেছে। কাল ওর কাজ। যদি পার একবার এসো বাবা।