আপনি কি অপয়া? বা অলক্ষুনে? কোনোদিন এরকম কি হয়েছে আপনার সাথে, যাতে হাত দিচ্ছেন তাই পন্ড? যদি কারুর সাথে এমনটা ঘটে তবে কি বলা হবে তার উপর অশুভের ছায়া পড়েছে? আমাদের এই জটিল জীবনে শুভ অশুভের মধ্যে প্রভেদই বা কতখানি। নিজের সর্বস্ব দিয়ে যদি শূন্য জোটে কারও ভাগ্যে, সে ভাগ্য কি পরমপিতা লিখেছেন না শয়তান!
লুসিফার যখন ঈশ্বরকেই স্বর্গের আসনচ্যুত করার স্পর্ধা করে তার কপালে জোটে পাতালে নির্বাসন। ধরা যাক লুসিফার একা ছিলো না, সহোদর ড্রাকুলাও নির্বাসিত হলো মর্ত্যে। তবে অসহায় জীবদের শাসন করে , তাদের পদতলে পিষ্ট করে আর কতদিন! ড্রাকুলা আর লুসিফার চায় সৃষ্টির উপর একাধিপত্য। যা কেবলমাত্র মাদার অফ্ ইভিলের সান্নিধ্যেই সম্ভব। ভাবছেন মাদার অফ্ ইভিল আবার কে? মার্ভেল কমিকসের মিস্ট্রেস ডেথ নাকি! ব্যাপারটা, একটু খোলসা করেই তাহলে বলি।
উনিশ শতকের ভিক্টোরিয়ান লন্ডন। অভিজাতদের ছাপিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরাই শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তার সাথে বাড়ছে দৈনন্দিন অপরাধ। এই সময় মানুষের সাহিত্য আর বিনোদনেও এসে পড়লো এক পরিবর্তন। খবর কাগজ বা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরোতে লাগলো অলৌকিক অপরাধ মূলক চটুল সব গল্প। জ্যাক দ্য রিপার খুব সম্ভব এই সময়ই লন্ডন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমাদের খুব পরিচিত এই সময়কার অলৌকিক কাহিনী সুইনি টড : দ্য ডেমন বারবার অফ্ ফ্লীট স্ট্রিট। এই সব গল্পের দাম তখন হতো মাত্র এক পেনি। চার্লস ডিকেন্স বা ওই শ্রেণীর সাহিত্যিকদের লেখা এক শিলি়ং দিয়ে না কিনে লন্ডনের জন সাধারণ ওই রহস্য খুন ভূতুড়ে আখ্যানে মন দিলেন। এক পেনির বিনিময়ে হাড় হিম করা ভয় : পেনি ড্রেডফুল।
এই ভিক্টোরিয়ান লন্ডনেই আছে এক পরীর মতো মেয়ে ভেনেসা। তবে সে একা নয়। সংগী তার স্টোকা্রস এর জনপ্রিয় চরিত্র দুর্ধর্ষ ড্রাকুলা আর মেরী শেলীর কালজয়ী সৃষ্টি ফ্র্যাংকেনস্টাইন ও তার মনস্টার। অস্কার ওয়াইল্ড এর ডোরিয়ান গ্রে আর রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ডক্টর জেকিল। পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে? আজ্ঞে না। শো টাইম এর বিখ্যাত সিরিজ পেনি ড্রেডফুলের কয়েকজন চরিত্রের সাথে আপনার পরিচয় করালাম মাত্র। জন লোগানের এই সিরিজে ভয়, প্রেম, ঈর্ষা, প্রতিশোধ সব কিছু মিলে মিশে আছে অলৌকিক কাহিনীর মোড়কে। মিশরীয় মাইথোলজির আমুন রা আর আমাদের পরিচিত শয়তান লুসিফার এর উল্লেখ যেমন আমরা পাই, তার সাথে আছে সমাজে মেয়েদের অবস্থান, অভিজাতদের লালসা ইত্যাদি সমসাময়িক বিষয়ের উল্লেখ ও। পেনি ড্রেডফুল এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য অতি প্রাকৃত ঘটনার প্রেক্ষাপটে কাহিনী হওয়া সত্যেও প্রায় কখনোই বিভৎস দৃশ্য বা জাম্প স্কেয়ারের মাধ্যমে দর্শককে উত্যক্ত না করে সিচুয়েশনাল হরর বা ঘটনার পরতে পরতে ভয় মেশানো। অপূর্ব আর্ট ওয়ার্ক আর সিনেমাটোগ্রাফি, অনবদ্য ডায়লগের বুনন এই সিরিজের সম্পদ। এত কিছুর পরেও প্রথম সিজ্নে গল্পের দানা বাধতে দেরী হওয়া, গোটা সিরিজ জুড়েই কাহিনীর বিক্ষিপ্ত বিন্যাস, থার্ড সিজ্নে ‘ব্লেড অফ্ গ্রাস্’ এপিসোডে ওই উচ্চতায় পৌছেও অযাচিত ভাবে শেষ করে দেওয়া মেনে নেওয়া যায় না। তবে অলৌকিক সংখ্যাতে টিভি সিরিজ এর কথা বলতে এইটেকেই বেছে নিলাম কেন?
সাহিত্যের বিখ্যাত সব নাম আর উনিশ শতকের লন্ডনের আবেদন উপেক্ষা করতে না পেরে নাকি ভেনেসা আইভস্ এর চিরকালীন প্রেমে পড়ে গিয়ে! ওই যে শুরুতে অপয়ার প্রসঙ্গ এনেছিলাম, ভেনেসাকে জানতে হলে এক অভাগার যন্ত্রনা অনুভব করতে হবে। ভেনেসা এই সিরিজের মধ্যমণি। এক এমন চরিত্র যেকোনো সময়ের যেকোনো মেয়ের সাথে কোনো না কোনোভাবে ঠিক একাত্ম হয়ে গিয়েও সে একলা। ইথানের সাথে প্রেম, ডোরিয়ানের সাথে লাস্য, ভিক্টরের প্রতি বাৎসল্য, জনের সাথে সখ্যতা, লুসিফারের প্রতি ক্রোধ অথবা ড্রাকুলার কাছে সমর্পন এই সবেতেই আমরা অন্য অন্য ভেনেসাকে পেয়েছি যে নিজেকে খুজে চলেছে অনবরত। শুভ অশুভের লড়াইয়ে বলি হতে হতে ঈশ্বরের উপর থেকে তার বিশ্বাস চলে গেছে, জীবন তাকে এক পৈশাচিক জয়যাত্রার কান্ডারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে, নিজেকেই সে ভাবছে ‘টাচড বাই দ্য ডেভিল.’ ঠিক যেমন সেই সৃষ্টির শুরু থেকে মেয়েদের কেই আমরা ডাইনি, সতী, বেশ্যা, ধর্ষিতা আরো কত রূপে দেখেছি! ভেনেসা তবু লড়ছে, গুরু তার জোয়ান অফ্ আর্ক! নাকি একজন মনোবিদ! লড়াইটা কোথায়? সেই ভিক্টোরীয় লন্ডনে না ভেনেসার মনে! গোটা সমাজ টাই যেখানে নরক সেইখানে যুঝতে যুঝতে শয়তানের স্নেহধন্যা ভেনেসা সেই নরকের সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠে! কিন্তু মুক্তি, প্রেম, শান্তি এই সব কি আর মেলে? ভেনেসা আইভস্ এর চরিত্রে ইভা গ্রীন অসামান্য। ভূতে পেয়ে হাড় হিম করা প্রলাপ বকার দৃশ্যেও নিজের অরা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। শুধু উনার অলৌকিক সৌন্দর্য এবং অপার্থিব অভিনয়ের জন্যেই ২৭টা এপিসোড দেখে ফেলা যায়। আরেকটি নারী চরিত্র লিলি ফ্র্যাংকেনস্টাইন এর ও উল্লেখ করি। লিলির চরিত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করিয়েছে যে নারী যদি ক্ষমতায় আসে সেও অত্যাচারী হবেই। কারণ সে আজন্ম কাল থেকে দেখে এসেছে যার হাতে শক্তি তার অস্ত্র স্বৈরাচার! তাই নারীও যেদিন ক্ষমতা পাবে সে নিজের স্বাভাবিক কোমলতা, সহনশীলতা বর্জন করবে। আরেকজনের অভিনয়ের কথা না বললেই নয়, ফ্র্যাংকেনস্টাইন এর মনস্টার বা ক্রিয়েচারের চরিত্রে ররি কিনিয়ার মুগ্ধ করেছেন। পেনি ড্রেডফুল সিরিজে ভয় আর দু্ঃখের এক চমৎকার সহাবস্হান। এই দুঃখের এক কান্ডারী যদি ভেনেসা হয় অপরজন নিঃসন্দেহে ক্রিয়েচার বা জন ক্লেয়ার। ‘ব্লেড অফ্ গ্রাস’ এপিসোডের একটি দৃশ্যে রুগ্ন, প্রহৃত ভেনেসাকে জন সামান্য প্রসাধনে সাজিয়ে দেয়! এত যন্ত্রণার অথচ পরিপূর্ণ দৃশ্য আমি সারাজীবন মনে রেখে দেবো। ভেনেসার সাথে জনের সব সংলাপের দৃশ্যগুচ্ছই কবিতাকে হার মানায়। পোয়েট্রি অবশ্য পেনি ড্রেডফুলের এক বড় সম্পদ। ভয়, প্রেম, যন্ত্রনা সবকিছুর নিরবিচ্ছিন্ন দৃশ্যায়ন কবিতাই মনে করায়। অন্তিম এপিসোডে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ এর ওড : ইন্টিমেশনস অফ ইম্ মর্টালিটি তে তারই সমাপতন হয়। মিস আইভস্ আমাদের মনে চিরকালীন জায়গা করে নেন।
এতক্ষণ যদি এই প্রলাপ মন দিয়ে পড়লেনই, তাহলে আর দেরী করবেন না! বৃষ্টিময় গা ছমছমে সন্ধেয় এক পেনির ভয় নেহাৎ মন্দ লাগবে না।