রাজ-হাঁচি


অলংকরণ - সুমিত রায়


এক যে ছিল রাজা। সাত সমুদ্র, তেরো নদী, তেপান্তরের মাঠ, মানে এককথায় সসাগরা পৃথিবী পুরোটাই তাঁর রাজ্য! অথবা তাঁর রাজ্যটাকেই পৃথিবী বলে জানে রাজ্যবাসী! চারিদিকে যতদূর চোখ যায়, রাজার ধ্বজাই উড়ছে। রাজ্যের নাম? কী একটা ছিল যেন, ভুলে গেছি। যাগ্গে, নামে আর কী বা আসে যায় বলুন!

রাজ্যের উত্তরে ছিল রাজার পেল্লাই এক রাজপ্রাসাদ। দেখলে চোখে চমক লাগে। আকাশ ছুঁয়েছে তার চূড়া। আর প্রস্থ? রাজবাড়ীর সীমানা বরাবর পায়ে হেঁটে একবার প্রদক্ষিণ করতেই আস্ত একটি বচ্ছর লেগে যাবে! কী নেই সেই প্রাসাদে! হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, রান্নাঘরে রোজ হাজার কড়াই চাপে। আর কত যে দাস দাসী সারাদিন এদিক ওদিক ছুটেও কুলোতে পারছে না, তার ইয়ত্তা নেই। যারা চোখে দেখেছে তারা জানে, রাজকীয় ব্যাপার একেবারে! বিশ্বাস না হলে শুধিও গিয়ে ও-পাড়ার মোড়ের কেষ্ট মুদিকে।

আজ সেই রাজারই একখানা গল্প বলি।

সক্কাল বেলা। রাজদরবার সবে শুরু হয়েছে। উঁচু সোনার সিংহাসনে সিংহমস্তকে ডানহাত আর বাঁহাত কোলে রেখে, এক পা ভাঁজ করে আর অন্য পা নিচের পা-দানিতে রেখে বসে আছেন রাজরাজেশ্বর। চারপাশে পাত্র, মিত্র ,অমাত্য, মন্ত্রী, সান্ত্রী, চাটুকার, কবি, পণ্ডিত, বদ্যি, সেপাই সব মিলিয়ে রাজসভা একেবারে ঝলমল করছে। ইন্দ্রসভাকেও হার মানায় সেই দৃশ্য। রাজা চুপটি করে বসে কী যেন ভাবছেন। খুব গভীর কিছু হয়তো। রাজা যখন ভাবছেন তখন বাকি সবাইকেই তো ভাবতে হবে! রাজভক্তিতে তো আর ত্রুটি করা যায় না। তাই পাত্র, মিত্র, অমাত্য গম্ভীরমুখে মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন। মাথার টিকি পাঁকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুব দিলেন পণ্ডিত। সান্ত্রী থেকে কবি সবাই ঘন ঘন মাথা নাড়তে লাগলেন। খুব ভাবনার বিষয় বটে!

“হাঁচচ-চো-ওওওওওওওওও”, হঠাৎ এক বিকট হাঁচির শব্দ। কেঁপে উঠল সারা রাজসভা। সান্ত্রী গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মন্ত্রীর ওপর। কবি বেচারা তো ভয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে সোজা গিয়ে পড়লে বাগানের গোলাপ গাছের ঝোপে। পণ্ডিত সেই বিকট শব্দে এমনই হকচকিয়ে গেলেন যে রামায়ণ-মহাভারত সব জগাখিচুড়ি করে সংস্কৃতে কী এক আজব শ্লোক যেন আউড়ে উঠলেন। এককথায় সে এক হুলুস্থূল কাণ্ড আরকি!

মিনিট পাঁচেক পর যখন সবাই একটু সামলে উঠল তখন জানা গেল যে হাঁচির উৎস স্বয়ং মহারাজের শ্রীনাসিকা। অমাত্য মশাই সহাস্যে এগিয়ে এসে বললেন, “আমি আগেই জানতাম এমন হাঁচি রাজ-নাসিকা বই হতেই পারে না।”

সুরকার বললে, “আহা, এমন সুন্দর ছন্দ-লয়ের নান্দনিক মূর্ছনা সাধারণের হাঁচিতে কি হয়?”

কবি ততক্ষণে পেছনের গোলাপ-কাঁটা ঝাড়তে ঝাড়তে এসে সভায় ঢুকেছে। আসনে বসার আগেই দু’হাত নেড়ে অদ্ভুত কাব্যিক ভঙ্গিতে বললে, “কী ঘোর মহারব শুনিনু প্রভাতে আজি, উঠিল শত ছন্দ হৃদয় মধ্যে বাজি। ধন্য রাজার রাজা তব এ মধুর হাঁচি।”

চাটুকার এমন সুযোগ কক্ষনো ছাড়ে না। এগিয়ে এসে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পণ্ডিত মাঝে বাধ সেধে বললেন, “মহারাজ, এ কিন্তু যে-সে হাঁচি না, রাজকীয় হাঁচি, মানে যাকে বলে রাজ-হাঁচি। আর যাই হোক অর্থহীন কদাচ নয়। রাজ-নাসিকায় যখন হাঁচির প্রাদুর্ভাব তখন নিশ্চয়ই কোনো গভীর কারণ রয়েছে।”

“ঠিক ঠিক ঠিক”, সমস্বরে বলে উঠলেন সকল সভাসদ।

আঁতকে উঠলেন রাজা। রেশমি রুমালে ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে বার দুয়েক নাক মুছে বললেন, “কী অর্থ পণ্ডিত? অর্থেই যে অনর্থ!”

“শাস্ত্র খুঁজতে হবে মহারাজ। খুব জটিল বিষয় কিনা। আদেশ করুন, পুঁথিপত্র তলব করি।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, এক্ষুণি বসে পড়। কি জানি কী হয়। হাঁচি নিয়ে তো আর হেলাফেলা করা যায় না।” রাজার মুখের কথাখানা শেষ হতে না হতেই রাজ্যের যত পণ্ডিত, মহাপন্ডিত ছিলেন টিকি দুলিয়ে এসে হাজির হলেন রাজসভায়। সাথে শিষ্যের দল, মাথায় কাঁধে কাড়ি কাড়ি পুঁথি-পত্তর, বেদ-বেদান্ত, শাস্ত্র, ব্যাখ্যা, ভাষ্য, টিকা-টিপ্পনি, তস্য টিপ্পনি নিয়ে রাজসভা ছেয়ে ফেললে। তেমন কাণ্ড যে দেখেনি তাকে বলে বোঝানো অসম্ভব।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধে নামল। বিস্তর খোঁজাখুঁজি, তর্ক, বাক-বিতণ্ডার পর সভাপণ্ডিত বললেন, “মহারাজ পাওয়া গেছে কারণ। অভয় দিলে বলি?”

সভা জুড়ে হর্ষধ্বনি উঠল। রাজা বসে বসে ঢুলছিলেন। হঠাৎ এমন হৈ-হট্টগোলে একেবারে হকচকিয়ে উঠলেন। “কী? কোথায়? ডাকাত কোথায়?”

“ডাকাত নয় মহারাজ। রাজ-হাঁচির অর্থ পাওয়া গেছে।”

দু’চোখ গোল করে রাজা বললেন, “পাওয়া গেছে? বলো পণ্ডিত বলো, কী অর্থ?”

ভুঁড়িতে বার দুয়েক হাত বুলিয়ে পণ্ডিত বললেন, “অর্থ খুব গভীর মহারাজ। সুদূরপ্রসারী। অকালকুষ্মাণ্ড পুরাণে লেখা আছে,

‘দিবাভাগে মহালগ্নে নৃপতি-নাসা সুগর্জিতম,

কম্পিতম রাজদ্বারম ঝঙ্কৃতম প্রাসাদ চ,

নৈঋত প্রান্তে মহাবৃক্ষে..............’ ”

“আহ, অর্থটা বলো না, শ্লোক শোনাতে কে বলেছে?” মাঝপথেই ধমকে উঠলেন রাজা।

“অর্থ অতি গূঢ়। এই শ্লোকের সার-কথা হল গিয়ে, রাজ্যের নৈঋত কোণে বটগাছের ওপর শকুনের ডিম ফুটে ছানা জন্মালে রাজ-নাসিকায় সকালবেলার এই মহালগ্নে হাঁচির আবির্ভাব ঘটে। সেই হাঁচি অতি অদ্ভুত এবং গভীর অর্থবহ। তার ঝংকারে রাজপ্রাসাদ কেঁপে ওঠে।”

পণ্ডিতের ব্যাখ্যায় আবার জয়ধ্বনি উঠল সভাজুড়ে।

“উফফ, কী সাংঘাতিক ব্যাপার! কিন্তু এর ফলাফল কী পণ্ডিত?” গম্ভীর গলায় শুধোলেন মহারাজ।

“ফলাফল অভাবনীয় এবং ভীষণ! রাজ-নাসিকায় হাঁচি মানে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস আর উৎস যখন শকুন তখন রাজ্যে মড়ক আসন্ন। দুইপাশে রাহু-কেতু আর মধ্যিখানে ডিগবাজি খাচ্ছে মঙ্গল, শুক্র আর বৃহস্পতি কৌণিকে।”

“কী ভনায়ক!” রাজার দুচোখ ছানাবড়া। “এবার তবে উপায় কী পণ্ডিত?”

পণ্ডিত উপায়টা বলতেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু মাঝে পড়ে রাজবদ্যি বললে, “মহারাজ, সামান্য সর্দি। অতি নগণ্য ব্যাপার। আদেশ করুন, এক ওষুধে এক্ষুণি সরিয়ে দিই।”

“তোমার অস্পধা তো কম নয় হে বদ্যি। রাজ-হাঁচিকে সামান্য সর্দি বলছো? এটা নগণ্য ব্যাপার? মহারাজ, এ নির্ঘাত দেশদ্রোহী, নইলে রাজ-হাঁচির অবজ্ঞা করে?” গর্জে উঠলেন পণ্ডিত।

“ঠিক ঠিক ঠিক। রাজ-হাঁচি তো আর হেলাফেলার জিনিস নয়। এ ব্যাটা নিশ্চয় দেশদ্রোহী।” রব উঠল সভা জুড়ে।

বদ্যি হাঁচির সাথে দেশের কী সম্পর্ক তা বুঝে ওঠার আগেই রাজা কটমটিয়ে তাকিয়ে আদেশ দিলেন, “ব্যাটার চুলের মুঠি ধরে আচ্ছা করে ঝাঁকিয়ে দাও।”

“জয় মহারাজের জয়”, ধ্বনিতে কেঁপে উঠল রাজসভা।

পণ্ডিত আবার টিকি নেড়ে গম্ভীরভাবে বলতে লাগলেন, “উপায় একটা আছে মহারাজ। কিন্তু বেজায় জটিল।”

“না না, জটিল বলে তো বসে থাকলে চলবে না। তুমি ঝটপট বলে ফেল তো পণ্ডিত।”

পণ্ডিত কানে কলম গুঁজে পুঁথির পাতা উল্টে বললেন, “হাঁচিতত্ত্বসুনিশ্চয় গ্রন্থে আছে যে নৈঋত কোণে জাত শকুন ছানাকে দত্তক নিতে হবে আর রোজ ভোরে সূর্য ওঠার আগে তেপান্তরের মাঠে গিয়ে সেই শকুন ছানাকে মাথায় নিয়ে নাচতে হবে। তবেই কাটবে এই ঘোর সংকট। অন্যথা হলে কিন্তু বিপদ অনিবার্য মহারাজ।”

“না না, অন্যথার প্রশ্নই ওঠে না। এমন ভীষণ বিপদে কি শাস্ত্রের অন্যথা করা যায়?”

সভায় জয়ধ্বনি উঠল পণ্ডিতের নামে। এমন গভীর অর্থ পণ্ডিত ছাড়া আর কেই বা খুঁজতে পারে? ভিড়ের আড়ালে শুধু কে যেন ফিসফিস করে বললে, “অর্থ না ছাই! অর্থের নামে শুধু অর্থ জোগাড়ের ধান্দা।” কিন্তু তাতে তেমন কেউ কর্ণপাত করল না। নিন্দুকেরা তো সর্বত্রই থাকে।

রাজা তখনই আদেশ দিলেন নৈঋত কোণের সেই সদ্যজাত শকুন ছানাকে ধরে আনতে, না পারলে সব ব্যাটার গর্দান! এমন গভীর সমস্যা, গা-ঢিলেমি তো আর করা যায় না। শয়ে শয়ে লোক ছুটল নৈঋত কোণে, বটগাছের ওপর শকুন ছানা খুঁজতে। সে এক পেল্লাই কাণ্ড! সেপাই-সান্ত্রী, মন্ত্রী, লোক-লস্কর,পাইক-বরকন্দাজ সবাই ছুটছে নৈঋত কোণে। সামনে যেই বটগাছ পাচ্ছে তারই মাথায় চড়ে চলছে একেবারে খানাতল্লাশি। কিন্তু এক এক করে দিন পেরিয়ে প্রায় সপ্তাহ হতে চলল, শকুন ছানার তো আর দেখা নেই। অথচ খালি হাতেও ফেরা যাবে না, রাজা ধরে ধরে গর্দান নেবেন। ভীষণ বিপদ!

কিন্তু শেষ অবধি ঈশ্বর মুখ তুলে চাইলেন। জঙ্গলের ভেতর এক বটগাছের ওপর পাখির ছানা পাওয়া গেল। তবে কিসের ছানা তা নিয়ে একটু সন্দেহ থাকলেও অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ঠিক হল যে এটিকে শকুন ছানা হতেই হবে। পণ্ডিতের কথা, শাস্ত্রের বচন তো আর মিথ্যে হতে পারে না। অতএব সেই শকুন ছানাকে নিয়ে সব লোকজন তখনই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে রাজবাড়ী ফিরে গেল। সদ্যজাত শকুন ছানাকে পেশ করা হল রাজসভায়। সবাই ধন্য ধন্য করল। রাজাও দেখে বেজায় খুশি। পারিতোষিক দিলেন প্রচুর। তখনই সকল শাস্ত্রীয় বিধিবিধান মেনে দত্তক নেওয়া হল ছানাকে। প্রথম কাজ সম্পন্ন হল। এবার দ্বিতীয় কাজ অর্থাৎ রোজ ভোরে সূর্য ওঠার আগে এই ছানাকে মাথায় নিয়ে নাচা। তাতেও একফোঁটা গাফিলতি নেই তাঁর। রাজা রোজ ভোর উঠে সূর্য ওঠার প্রায় একঘন্টা আগে তেপান্তরের মাঠে গিয়ে সেই ছানাকে মাথায় তুলে নাচেন। লোকে তাজ্জব বনে যায় মহারাজের নিষ্ঠা দেখে। রাজ্যকে অমঙ্গল থেকে বাঁচাতে ক’জন রাজা এমন করেন। যত দিন যায় সভাসদদের রাজভক্তি আরও ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। কবি নিত্যনতুন গান লিখতে থাকেন মহারাজের মহিমা নিয়ে।

এভাবে প্রায় বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। ছানাটাও বড় হচ্ছে, গায়ে পালক গজিয়েছে বেশ। সভায় রাজার ঠিক ডানপাশে সোনার খাঁচায় থাকে সে।

“এ কেমন শকুন ছানা? দেখলে তো মুরগি ছানা বলে মনে হয়।” কে যেন ফিসফিসিয়ে বললে একদিন ভিড়ের আড়ালে। কথাটা রাজার কানেও বিঁধল।

“এ কী কথা শুনি মন্ত্রী? এটা কি তবে শকুন ছানা নয়?” রাজা শুধোলেন।

লম্বা একটা প্রণাম ঠুকে একগাল হেসে মন্ত্রী বললেন, “ওসব কথায় কান দেবেন না মহারাজ। এগুলো সব দেশদ্রোহী। মিথ্যে কথা রটিয়ে বেড়ায়। এ আলবাত শকুন ছানা। রাজবাড়ীতে থেকে একটু নাদুস-নুদুস চেহারা হয়েছে এই যা। আর শাস্ত্রবাক্য তো মিথ্যে হতে পারে না মহারাজ। “

অকাট্য যুক্তি বটে। রাজাও খুশি হয়ে আবার রাজকার্যে মন দিলেন। কিন্তু সময় তো আর থেমে থাকে না। আরও বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেল। একদিন ভোরে রাজা সেই শকুন ছানাকে নিয়ে বেরিয়েছেন, মাঠে যাবেন নাচতে। তখনও প্রায় অন্ধকার, আলো ফুটতে বেশ দেরি। রাজা মাঠের ঠিক মধ্যিখানে গিয়ে সেই শকুন ছানাকে মাথায় নিয়ে সবে নাচতে শুরু করেছেন হঠাৎ চারদিক থেকে কারা যেন রে রে করে “মুরগি চোর, মুরগি চোর” বলে তেড়ে এল। সেই অন্ধকারে কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকজন ধাঁই-ধপাধপ পেটাতে লাগল রাজাকে ধরে। রাজা যত বলেন “আমি রাজা”, লোকে তত দ্বিগুন উৎসাহে আরও পেটাতে লাগে। কিল চড় লাথি কিছুই বাদ রইল না আর।

উফফ, সে যে কী মার, যে খেয়েছে সেই বোঝে। রাজার ঠিক ক’দিন পর জ্ঞান ফিরেছিল জানা নেই, তবে যদ্দুর জানি রাজাকে জীবনে আর কেউ কোনোদিন হাঁচি দিতে দেখেনি।