এক রাতের গল্প


অলংকরণ - অরিজিৎ ঘোষ

সেবার বেড়াতে গিয়ে তিনদিন আটকে পড়ে ছিলাম হোটেলেই। কারণটা আর কিছু নয় বৃষ্টি আর বৃষ্টি। আর সঙ্গে এলোমেলো হাওয়া। পাহাড়ের সবই ভাল তবে বৃষ্টি শুরু হলেই মুস্কিল। দোষ আমারই, সেপ্টেম্বর মাসে পাহাড়ে যায় কেউ? এসেছিলাম ইস্ট সিকিমের অখ্যাত একটা গ্রামে। ওয়েদার যে এত খারাপ হবে বুঝতে পারিনি। আমি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভের কাজ করতাম। নানা জায়গায় ঘুরতে হত কাজের জন্য। কাজের জন্যই এসেছিলাম সিকিমের রংপো। ভাগ্যিস অফিসের কাজ আমি প্রথমদিনেই মিটিয়ে নিয়েছিলাম। কোম্পানি থেকে আমার জন্য একটা নিম্নমানের হোটেল ঠিক করেছিল। অর্ধেক সময় কারেন্ট থাকত না। জেনারেটরও ছিল না। আমার বয়স বছর তিরিশ হবে। বাড়িতে মা, বোন, দিদি, ভাই অনেকের দায়িত্ব। সেই সময় মোবাইল ছিল না। ৯০ এর দশক চলছে। চিঠির যুগ। এখন আমার অনেক বয়স। ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবি। এই ঘটনাটা মনে পড়লে এখনও ভয় লাগে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ভাবলাম লিখে ফেলি। গল্পের পাঠকই বিচার করবেন অলৌকিক বলে সত্যি- ই কিছু আছে কি? না, সবটাই উদ্ভট মস্তিষ্কের কল্পনা? আমি নিজে অলৌকিক কিছু মানি না। স্নায়ুর রোগ থাকলে এরকম অনেক অলৌকিক জিনিস দেখা যায়।

সিকিমে আগেও এসেছি তবে এমন বৃষ্টির মধ্যে পড়িনি কখনও। আমি যে হোটেলে ছিলাম সেখানে সম্ভ্রান্ত লোক বিশেষ আসে না। সেই সময় টুরিস্ট খুব কম ছিল। যে ক'জন ছিল কর্মসূত্রেই এসেছিল আমার মতন। তবে একজন ছিল অন্যরকম। তাঁকে দেখলে সমীহ হত। একমুখ দাড়ি হলেও ভদ্রলোক বেশ সুদর্শন। বয়স চল্লিশের বেশি। বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের লোক, দেখেই মনে হত। ওঁর মধ্যে এমন কিছু ছিল, চট করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। কারোর সঙ্গেই কথা বলতেন না। সব সময় মোটা একখানা বই নিয়ে বসে থাকতেন রিসেপশানে। আদৌ পড়তেন কি-না জানি না, অনেক সময় দেখেছি বই এর দিকে দৃষ্টি নেই ওপরে কিছু দেখছেন, আর কীসব বিড়বিড় করে বলছেন।

একদিন রাত্তিরে মোমবাতির আলোয় ডিনার করছি। বাইরে বৃষ্টি আরও জোরে পড়ছে। ভৌতিক এক রহস্যময় পরিবেশ, আমার মন্দ লাগছিল না। খাবার ঘরে আমি ছাড়াও কয়েকজন ছিল। খেতে খেতে মুখ তুলে দেখি সেই দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক একটু দূরে একটা টেবিলে বসে আছেন এবং আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। কারেন্ট এসে গিয়েছিল তাই বুঝতে পারলাম। আমিও তাকিয়ে রইলাম। উনি কিন্তু চোখ সরিয়ে নিলেন না। নিজের টেবিল থেকে উঠে তিনি চলে এলেন আমার টেবিলে। বললেন, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে এখানে বসতে পারি কি?’

‘হ্যাঁ বসুন না!’ এ ছাড়া আর কিই বা বলতাম?

‘আসলে আজ রাত্তিরটা খুব ভয়াবহ।’ ভদ্রলোকের চোখে মুখে একটা আতঙ্ক দেখতে পেলাম।

আমি হেসে ফেললাম। বললাম,' বৃষ্টি দেখে বলছেন? এরকম রাতেই তেনারা আসেন শুনেছি।’

ভদ্রলোক কিন্তু হাসলেন না। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে আমায় দেখতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ভগবানে বিশ্বাস করেন?’

এবার আর না বলতে পারলাম না। মা এত পুজো আচ্ছা করেন! হাতে ধাগা বেঁধে দিয়েছেন মা দুর্গার। আমরা সবাই মানি ভগবানকে। ভদ্রলোক হেসে উঠলেন। ‘প্লাস থাকলে মাইনাস থাকবে। পজিটিভ এনার্জি থাকলে নেগেটিভ এনার্জি থাকবে। ভগবান থাকলে শয়তানও থাকবে।’

আমি চুপ করে ছিলাম। আমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ভদ্রলোকের চোখে মুখে ভয় ফুটে উঠল আবার। বললেন, ‘জানেন আজ ২১ সেপ্টেম্বর। আমার জন্মদিন।’

‘শুভ জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে।’

আমার শুভেচ্ছায় খুশি হতে পারলেন না। বললেন, ‘আজকের দিনেই সেই ভয়ানক ঘটনাটা ঘটে। আজকের দিনেই সে আমাকে নিয়ে যেতে চায়। আমাকে একটু সময় দিতে পারবেন? আমি আপনাকে সব বলতে চাই। সব কনফেস করব আবার যদি সে আমায় মুক্তি দেয়।’

বললাম, ‘বলুন না! আমরা ঘরে গিয়ে বসি।’ ভদ্রলোক মানসিক ভাবে অসুস্থ। এইসব মানুষের একটু কেয়ার দরকার।

আমরা দোতলায় এলাম। ভদ্রলোককে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। বিছানার ওপর আমি বসলাম আর ভদ্রলোক বসলেন চেয়ারে। নিজের কথা শুরু করলেন।

‘আমি সুমন ব্যানার্জি। এখানেই একটি কলেজে অধ্যাপনা করি। ছোট থেকেই পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলাম। বেড়ে উঠেছিলাম বিত্তশালী পরিবারে। বাবা মা দুজনেই ভাল চাকরি করতেন। আমি কনভেন্টে পড়াশোনা করতাম। কখনও সেকেন্ড হইনি জীবনে। খুব অহঙ্কার ছিল আমার। দেখতেও মন্দ ছিলাম না। আমি নিজে জানতাম আমি সুদর্শন। একদিন স্কুল থেকে কলেজে গেলাম। বোটানি অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম নামি একটি কলেজে। সেখানে প্রচুর মেয়ে বন্ধু হল। আমার মন জয় করার চেষ্টা করতো তারা। আমি সব বুঝতে পারতাম। আর মনে মনে ভীষণ খুশি হতাম। আমার বাড়ির খুব কাছেই থাকত পিসি - পিসেমশাই। পিসি হাউস ওয়াইফ আর পিসেমশাই ব্যাঙ্কে কাজ করতেন। স্বচ্ছলতা ছিল পরিবারে। পিসেমশাই প্রচুর সম্পত্তি পেয়েছিলেন পৈত্রিক সূত্রে। তাঁদের কোনও সন্তান ছিল না। আমি যাতায়াত করতাম প্রায়-ই। ওঁরাও আমাকে খুব ভালবাসতেন। পিসেমশাই এর বাড়ির তরফে আর কোনও আত্মীয় বিশেষ কেউ ছিল না। আমি জানতাম আমি নিজেই একদিন এই বিপুল সম্পত্তির মালিক হবো। কিন্তু আমার মনে কোনও লোভ ছিল না। কারণ আমি যথেষ্ট অর্থবান পরিবারের ছেলে। এবং পড়াশোনাতেও ভাল তাই উজ্জ্বল কেরিয়ার পেতে আমার অসুবিধা হবে না।

এর মধ্যে একদিন ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। পিসি আর পিসেমশাই একটি মেয়েকে দত্তক নিলেন। আমার আদরের ভাগীদার এসে গেল। আমি আর আগের মত স্বচ্ছন্দ ভাবে ওই বাড়িতে যেতে পারতাম না। মেয়েটিকে বোন বলে মানতে পারিনি। সম্পূর্ণ উড়ে এসে জুড়ে বসা এক মেয়ে। অজ পাড়া গাঁয়ের মেয়ে। জানি না পিসি আর পিসেমশাই এর মন কী করে জয় করেছিল! নাকে নোলক আর তেলে জবজবে চুল, ডুরে শাড়িকে দেখলেই গা জ্বলে উঠত আমার। কমলা প্রথমে এসেছিল বাড়ির কাজের মেয়ে হয়ে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই সে গুণ করে ফেলল আমার পিসি আর পিসেমশাইকে। ওঁরা আইনসন্মত ভাবে ওকে দত্তক নিলেন। কমলা প্রাইভেটে পড়াশোনা করতে লাগল। ডুরে শাড়ি ছেড়ে রেশমি শাড়ি ধরল। চুলে তেলের বদলে দামি শ্যাম্পুর সুবাস পেতাম। দামি পারফিউম আর ম্যাচিং জুয়েলারিতে নিজেকে সব সময় সাজিয়ে রাখত। এক এক সময় ভুলে যেতাম আমিও, যে একে আমি পচ্ছন্দ করিনা। কমলা পড়াশোনায় ভাল ছিল। মাধ্যমিক ভাল ভাবেই উতরে গেল। কলেজে ভর্তি হল। আমাকে দাদা দাদা করে পাগল করে দিত। বাচ্চা মেয়ে ছিল কতই বা বোঝে সংসারের মারপ্যাঁচ। পিসি মাঝে মাঝে অনুযোগ করতেন আজকাল কম আসি বলে। আমি বলতাম পড়াশোনার চাপে আটকে গেছি। তখন আমি এম.এসসি পড়ছি। ভাই দ্বিতীয়ার সময় আমি বেড়াতে চলে যেতাম প্রতিবার বা মামার বাড়ি যেতাম মামাতো বোনেদের থেকে ফোঁটা নিতে। কমলার হাত থেকে ফোঁটা নিতে রুচি হত না।

একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে দেখলাম কমলা একটি ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে এক পার্কের সামনে। ছেলেটিকে দেখেই মাথায় আগুন জ্বলে উঠল কেন জানি না। খুব লোফারের মত দেখতে। কমলার রুচি আর কত ভাল হবে। ইস, এইভাবে আমার পিসির টাকা নষ্ট করছে। যে টাকায় একদিন আমার সম্পূর্ণ অধিকার হতো।

বাবার মুখে একদিন শুনলাম পিসেমশাই আর পিসি নাকি ওঁদের সমস্ত সম্পত্তি কমলাকে দিয়ে যাবেন। আমি এতদিন জানতাম অর্ধেক সম্পত্তি আমি অন্তত পাবো। পিসির বাড়ি যাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিলাম।

একদিন সকালে শুয়ে ছিলাম নিজের ঘরে। দুমদুম দরজায় ধাক্কা শুনে উঠে বসলাম। আমি শুয়ে থাকলে কেউ আমাকে এভাবে ডাকে না। খুলে দেখি কমলা দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি। আমার ঘরে ঢুকে পড়ল হুড়মুড় করে। আমাকে প্রণাম করল। হাতে বেঁধে দিল রাখী। আমি হাত থেকে রাখী খুলে ফেলে দিলাম ঘরের মেঝেতে। বললাম, ‘আমার ঘরে এভাবে কেন এসেছিস? খুব ভাল করেই জানিস তোকে আমি বোন বলে মনে করিনা। বেরো এখান থেকে!’ এত রুঢ় ব্যবহার সে আমার কাছে আশা করেনি।

কমলা কেমন থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘দাদা তুমি আমার সঙ্গে কেন এরকম করছ? আজ রাখী আর আজ তোমার জন্মদিন ও। আমি তোমায় শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলাম।’

‘যা এখান থেকে। আমার থেকে দূরে থাকলেই তোর ভাল হবে। জোর করে সম্পর্ক পাতানো যায় না। যেটা তুই ভাল পারিস, কিন্তু আমার কাছে পারবি না। আমি পিসি পিসেমশাই এর মত দুর্বল চরিত্রের নই।’

‘তোমার মধ্যে দেখছি মনুষ্যত্ব বোধ নেই।’ এই কথায় প্রচণ্ড রেগে গেলাম, কমলাকে এক প্রচণ্ড চড় কষিয়ে দিলাম। ও মেঝেতে পড়ে গেল। কমলা আস্তে আস্তে নিজেই উঠে দাঁড়াল। আমার মুখের দিকে একবার তাকাল। সুন্দর দুই চোখে জলের ধারা। আমার মায়া হল না। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। মেঝে থেকে রাখীটা কুড়িয়ে নিল হাতে। তারপর আর দাঁড়াল না বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।’

সুমনবাবু থামলেন। বোতল থেকে একটু জল খেলেন। আমি এতক্ষণ দম বন্ধ করে শুনছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তারপর কী হল’?

‘তারপর আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। সেই দিন কমলা আর বাড়ি ফিরল না। একটা অ্যাকসিডেন্ট কেড়ে নিল ওর জীবন। বাবার মুখে শুনেছি হাতের মুঠিতে তখনও ধরা ছিল সেই রাখী। পিসির সব সম্পত্তি পেয়েছিলাম।’

‘তাহলে কমলা এইভাবে আপনাকে মুক্তি দিল?’

‘নাহ! সে আমাকে মুক্তি দেয়নি।’ চিৎকার করে উঠলেন সুমনবাবু।

‘সেই রাতেই কমলা আমার ঘরে আসে। চোখে জল। মাথার এক জায়গা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। হাতে ধরা সেই রাখী। আমি চেঁচিয়ে উঠি, কিন্তু ও যায় না। কতবার বলেছি আমাকে ক্ষমা করিস তুই। কিন্তু ও শোনে না। প্রথম কিছু বছর সে রোজ আসতো। গত দু বছর ধরে সে এই ২১ সেপ্টেম্বর রাত বেছে নিয়েছে। ওই যে শুনতে পাচ্ছেন না ওর পায়ের শব্দ। নূপুরের শব্দ হচ্ছে ওই তো।’

‘ঝড়ের শব্দ ছাড়া আমি তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। দরজায় যে আঘাতের শব্দ হচ্ছে সেটা ঝড়ের জন্য হচ্ছে।’ মাথা নেড়ে বললাম। সত্যিই মনে হচ্ছে কেউ যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। প্রকৃতিই মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়।

‘কারণ আপনার সাথে তার কোনও শত্রুতা নেই। জানেন আমার স্ত্রী আমাকে পাগল ভেবে ছেড়ে চলে গেছেন! কিন্তু আমি পাগল নইইইই! আমার মা বাবা গত হয়েছেন মনের কষ্ট নিয়ে, যে একমাত্র ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি যক্ষের মত এত সম্পত্তি নিয়ে পড়ে রয়েছি। কমলা সত্যিই আসে প্রতি জন্মদিনের রাতে। কী করে বোঝাই আপনাকে!’ সুমন বাবু দাঁড়িয়ে পড়েন। উত্তেজিতভাবে সারা ঘর পায়চারি করতে লাগলেন। দপ করে ঘরের আলো নিভে গেল। বাইরে জোর বাতাস বইছে। ঘরের দরজা খুলে গেল বিচ্ছিরি একটা শব্দ করে। বললাম, ‘হাওয়ায় খুলে গেছে দরজাটা। এইসব সস্তার হোটেলের ঘরের ছিটকিনিও তেমন মজবুত নয়।’ আমি মোমবাতি ধরালাম। দরজা বন্ধ করতে গেলাম। আমার সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা কিছুর জোর ধাক্কা লাগল। ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপট ছাড়া আর কিছুই নয়। উফ একদলা বরফের সঙ্গে যেন আমার কলিশান লাগল। পড়ে গেলাম মেঝেয়। সুমন বাবু হাসলেন। আমি হেসে বললাম, ‘প্রকৃতির তাণ্ডবকে ভৌতিক কিছু ভাববেন না।’ মোমের আলোয় দেওয়ালে আমাদের নিজেদেরই কালো কালো ছায়া দেখে অসহ্য লাগছে। সুমনবাবুকে আমি হাল্কা ডোজের একটা ঘুমের ওষুধ দিলাম। উনি আমার বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। চেয়ারে বসে আমিও চোখ বুজলাম। মনের মধ্যে অপরাধবোধ থেকে সুমনবাবুর আজ এই দশা। বাথরুমে যাবার দরকার পড়ল। চোখ খুলতেই দেখলাম দেওয়ালে এক কালো বিশাল ছায়া। আস্তে আস্তে সেই ছায়া সুমন বাবুর শরীরের ওপর চেপে বসেছে। আর কিছুই আমি দেখিনি। আমার এতক্ষণের সাহস আমাকে ছেড়ে বিদায় নিল। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। সেই ছায়া অদৃশ্য হল। তারপর দুর্গা নাম জপেছিলাম বাকি রাতটুকু।

সকাল থেকে ঝড় বৃষ্টি একদম কমে গেল। তবে রাস্তা বন্ধ হয়ে সে আরেক গল্প। এদিকে সুমনবাবু একদম সুস্থ হয়ে গেলেন। মনেই হচ্ছিল না এনাকে মানসিক রোগী মনে হচ্ছিল ক'দিন আগেই। আমার সঙ্গে ভালই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সিকিমের বাড়িতে উনি একাই থাকতেন একজন বিশ্বস্ত কাজের লোককে নিয়ে। ওনার এই অসুস্থতা বছরের এই নির্ধারিত সময়েই বা দিনেই দেখা দিত। অনেক চিকিৎসা করেও ভাল হননি। আমাদের মধ্যে পত্রালাপ চলত। আমি বলেছিলাম, ‘আপনি নিজেকে ক্ষমা করে দিন। অনেক কষ্ট নিজেকে দিয়েছেন আর নয়।’ উনি হেসেছিলেন, বলেছিলেন, ‘নাহ। সে আমাকে ক্ষমা করেনি। ওই রাত আমি যেখানেই থাকি লন্ডন বা প্যারিস, কলকাতা বা সিকিম, বড়লোকি হোটেল বা সস্তার হোটেল সে ঠিক আসবে।’ আরও পাঁচ বছর পর এক ২১ সেপ্টেম্বরের রাতে সুমনবাবুর মৃত্যু হয়েছিল ঘুমের মধ্যে। আমাকে ফোনে জানিয়েছিল ওঁর সবসময়ের বিশ্বস্ত হেল্পিং হ্যান্ড মহেন্দ্র। আমিই ফোন করেছিলাম সুমন বাবুকে। মহেন্দ্র জানিয়েছিল গোটা ব্যাপারটা। আমি এখনও ভাবি সেই ঝড় জলের অন্ধকার রাতে দেওয়ালে আর সুমন বাবুর শরীরের ওপর যার কালো অশুভ ছায়া দেখেছিলাম, সে কি সত্যিই ওপার থেকে এসেছিল না আমার মনের কল্পনা! আর বরফের মত ঠাণ্ডা কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার ব্যাপারটাও কেমন যেন অদ্ভুত মনে হয়। কিছুই বুঝতে পারি না, আসলে মনের অসুখ বড় ছোঁয়াচে জিনিস।