মোবাইল


(বিদেশী গল্প অনুকরণে)

অদ্ভুতভাবে মারা গেল লিলি।

রাজশাহী পার্কে হাঁটছিল ও সেদিন। ভরা বিকেল, তাই আচমকা চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে দেখে অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাল। এমন আবহাওয়া পরিবর্তন আগে দেখেনি কখনও। সন্ধ্যা নামতে এখনও অনেক দেরী। কিন্তু মেঘ করেছে আকাশে, এত দ্রুত যে মনে হচ্ছে ঝড় শুরু হবে যেকোন সময়! রাগে যেন ফুঁসছে মেঘ, থেকে থেকে গর্জে উঠতে শুরু করেছে।

ঝড়ের সময় দুটো কাজ করা মানা, এক তো হচ্ছে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন করা। আরেকটা হলো, গাছের নিচে আশ্রয় নেয়।

দুটোই করে বসল লিলি।

বৃষ্টি ঝরতে শুরু করার সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিল একটা বট গাছের নিচে। তারপর হ্যান্ডব্যাগ হাতড়ে বের করে আনল মোবাইল ফোন।

‘পিয়াল,’ ভাইকে ফোন করল ও। ‘আমি পার্কে আছি। বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি।’

কথা শেষ করার আগেই বজ্র আছড়ে পড়ল গাছটায়। পঁচাত্তর হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ মোবাইল সেট হয়ে আশ্রয় খুঁজে নিল মেয়েটির মস্তিষ্কে। কয়েকবার খিঁচুনি দিয়েই থেমে গেল দেহটা, মোবাইল হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল প্রায় একশো ফুট দূরে।

যে সময়ের ঘটনা, তখনও সিটিসেল কো¤পানি পুরোদমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। রিমের প্রচলন হয়নি। আশ্চর্য হয়ে দেখা গেল, জেডটিই ব্রান্ডের সেটটা এতকিছুর পরেও ঠিক কাজ করছে। লিলিকে কবর দিয়ে আসার পর সেটা চলে গেল পিয়ালের হাতে। কিন্তু ওটাকে দেখলেই যেন ছেলেটার মনে পরে যায় মৃত বোনের কথা। তাই বিক্রি করে দিল মাস শেষ হবার আগেই।

ফয়সাল আহমেদ নামের এক ভদ্রলোক কিনলেন ওটাকে। তাঁর ছেলে, সুমিত আহমেদ, মোবাইল মোবাইল করে বেশ কিছুদিন হলো জ্বালাচ্ছে। নিজে প্রযুক্তির সাথে অতটা পরিচিত নন ফয়সাল। তাই কম দামে মোবাইলটা পেয়ে আর হাতছাড়া করলেন না।

 

‘ধন্যবাদ, বাবা।’ আদ্যিকালের সেটটা হাতে নিয়ে বলল সুমিত। রাগ দেখাবে না খুশি হবে তা বুঝতে পারছে না। মোবাইল একটা থাকলে ভাল হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সেট ওর চাহিদা ছিল না; ওটা দরকার ছিল কেবল বন্ধু-মহলে তাক লাগিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু এখন যে হিতে-বিপরীত হলো। বুঝতে পারছে, জিনিসটা ওর স্বাধীনতা অনেকাংশেই কমিয়ে দেবে। এখন আর ক্লাস চলার ধুয়ো তুলে সন্ধ্যার পর বাইরে চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে না। কলেজ ফাঁকি দিয়ে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘোরার দিনও শেষ।

আবার হাতি যে মরলেও লাখ টাকা। মোবাইল সেট, হোক না তা আদ্যিকালের বা সিটিসেলের, মোবাইল তো। কম কথা না!

ফয়সাল আহমেদ রাজশাহী শহরে বাড়ি বানিয়েছেন অনেক আগেই। আশপাশের ছাত্রদের কাছে মেস হিসাবে ভাড়া দিয়েই তার দিন চলে যায়। খুব একটা বেশি কামান না, দয়ার শরীর তাঁর। প্রায়শই দেখা যায়, অর্ধেক ছাত্রের ভাড়া মাফ করে দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী, মিসেস রোখসানা আহমেদও দয়ালু মানুষ। তাই তিনিও কোন উচ্চবাচ্য করেন না। সুমিত জানে, সংসারে টানাটানি না থাকলেও, ইচ্ছামত বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। তাই নিজেও আর কথা বাড়াল না।

‘সুমিত, একটা কথা বলে রাখি। মোবাইলের খরচ কিন্তু তোমাকে হাতখরচ থেকে বাঁচিয়েই চালাতে হবে। আমি আলাদা টাকা দেব না।’

‘আচ্ছা, বাবা।’

সন্তান হিসেবে সুমিতের তুলনা হয় না। পরিবারের অবস্থা বোঝে ও, প্রায়শই বাবাকে টুকটাক কাজে সাহায্যও করে। তবে হ্যাঁ, এরকম ছোট শহরে উত্তেজনার খোরাক পাওয়া যায় না বললেই চলে। সুমিতের কাছের বন্ধুরা কলেজে পড়ার জন্য ঢাকায় গিয়েছে। ও নিজেও যেতে চেয়েছিল, কিন্তু একমাত্র সন্তানকে কাছছাড়া করতে চাননি ওর বাবা-মা। সেজন্য রাজশাহী কলেজেই পড়তে হয়েছে ওকে। এখন অবশ্য সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে; ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন সেই ছোটবেলা থেকেই, সময় গুণছে তাই। কবে যে ঢাকায় যাবে, জীবনে আসবে চাঞ্চল্য।

বেচারা জানে না, অচিরেই আমূল পরিবর্তন হতে যাচ্ছে ওর পরিবেশের...

একদিন বিকালে, এই সাড়ে চারটার দিকে, আচমকা বেজে উঠল ফোন। ক্রিং ক্রিং...ক্রিং ক্রিং...বিরক্তিকর শব্দটা বেশ কয়েকবার বাজার পর ঘুম ভাঙল সুমিতের। এই নাম্বারটা খুব অল্প কয়েকজনকে দিয়েছে। ওর বাবা-মা, সিজার ওর প্রাণের বন্ধু, স্কুলের পরিচিত কয়েকজন মুখ আর প্রিয়া নামের এক মেয়েকে। ঘুম ভাঙতেই লাফিয়ে উঠল সুমিত, যদি পছন্দের মানুষটার ফোন হয়!

কোনক্রমে ফোনটা টেবিলের উপর থেকে হাতে নিয়েই রিসিভ করে বসল, নাম্বার দেখার ঝক্কিতেও গেল না।

‘হ্যালো?’ বৃদ্ধ একটা কণ্ঠ ওর আশার গুড়ে যেন বালি ঢেলে দিল।

‘হ্যালো।’ ধরেই নিয়েছে সুমিত, রঙ নম্বর থেকে ফোন এসেছে।

‘আমার একটা কাজ করে দিতে হবে,’ কিছুটা অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল কণ্ঠটা। ‘বিলশিমলা গিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করো।’

‘বুঝলাম না...’ বলতে শুরু করল সুমিত।

‘ওকে বোলো আমার রুপোর আঙটিটা ফ্রিজের নিচে আছে। তাহলেই হবে।’

‘কে আপনি?’

‘আমি রিয়াজ। তুমি আমার স্ত্রীকে চেন। মিসেস লাবনী হোসেন। ১০ নং বিলশিমলা, দ্বিতীয় তলায় থাকে। ওকে জানিয়ো।’

‘আপনি নিজেই বলছেন না কেন?’ বিরক্তি ঝরল ছেলেটার গলায়।

‘পারলে কি তোমাকে বলতাম?’ বিরক্ত শোনাল বৃদ্ধকেও। ‘মনে কোরে বোলো কিন্তু যে আঙটিটা ফ্রিজের নিচেই আছে।’

‘আসলে…’

‘ধন্যবাদ।’

কেটে গেল লাইন। এই দ¤পতিকে চেনে ও। বাবার ম্যানেজার ছিলেন লোকটা, আর তার স্ত্রী এসে মাঝে-সাঝে মাকে সাহায্য করতেন। রাজশাহীর মত ছোট জায়গায়, সবাই সবাইকে চেনে। আসলে না চিনে উপায় নেই। প্রায় বছরখানেক আগে আচমকা চাকরী ছেড়ে দেন রিয়াজ, ক্যান্সার ধরা পড়ায়। টাকা-পয়সা যা ছিল, তাই নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে।

আচমকা একটা কথা মনে হতেই ভয় পেয়ে গেল সুমিত ভদ্রলোক ওর নাম্বার পেলেন কোত্থেকে?

 

পরেরদিন বিকালে দেখা গেল, বিলশিমলার দশ নাম্বার বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে একটি ছেলে।

আসতে চায়নি সুমিত, সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে ফোনকল পেয়ে। কিন্তু কখন যে ওর অবচেতন মন ওকে এখানে নিয়ে এসেছে তা বুঝতেই পারেনি। যা হবার হবে, নিজেকে বুঝ দিয়ে চলে এল বাড়িটার সামনে। মনস্থির করে নিয়ে বাজাল ঘণ্টি।

পরক্ষণেই মনে হলো বোকার মত কাজ করে বসেছে। এখানে আসার দরকারই ছিল না কোন। ফিরে যাবে কিনা ভাবছে, এমন সময় দরজা খুলে গেল। মিসেস হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন দোরগোড়ায়। সুমিতকে দেখে হাসি ফুটে উঠল মুখে। আগে যেমন দেখেছে, বলতে গেলে তেমনই আছেন মহিলা। তবে একটু বয়স্ক মনে হচ্ছে, সেই সাথে শুকিয়েও গিয়েছে বেশ।

‘আরে, সুমিত? তুমি!’ হাসিমুখেই বললেন মহিলা। ‘কেমন আছ?’

‘আমি ভাল আছি, আণ্টি। আপনি কেমন আছেন?’

‘এই তো, বাবা। আছি একরকম।’ অস্বস্তিকর একটা নীরবতা নেমে এল জায়গাটায়। কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা নিজেই ভাঙলেন সেই নীরবতা। ‘ভেতরে এসো?’

‘না, না। বাসায় যাচ্ছিলাম, স্কুল ছুটি হলো।’

‘তোমার আব্বু-আম্মু কেমন আছেন? ছাত্রাবাস কেমন চলছে?’

‘ভাল, সব ভালই আছে।’ সুমিত ঠিক করল, যা বলতে এসেছে তা আর কোন ভণিতা না করে বলেই ফেলবে। ‘আসলে গতকাল একটা ফোনকল এসেছিল। আপনাকে একটা খবর দিতে এসেছি।’

‘কী?’

‘আংকেলের কাছ থেকে এসেছে খবর।। তার আঙটি নাকি ফ্রিজের নিচে আছে…’ বলতে বলতেই থেমে গেল ছেলেটা। মহিলার চেহারার সাদা হয়ে যাওয়াটা ওর নজর এড়ায়নি। মনে হচ্ছিল যেন কেউ তার চেহারায় থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।

‘কী...?’ বিড়বিড় করে বললেন তিনি।

‘বলল যে তার আঙটিটা ফ্রিজের নিচে আছে। এটা বললেই নাকি আপনি বুঝবেন।’

‘ফাইজলামি করছ?’

‘নাহ। সত্যি বলছি!’

‘তোমাকে তো আমি ভাল ছেলে মনে করেছিলাম। তুমি এমন একটা কাজ...’ বলতে বলতেই ফোঁপাতে শুরু করলেন লাবনী, এক মুহূর্ত পর সুমিতের মুখের উপর বন্ধ করে দিলেন দরজা।

হতভম্বের মত কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল বেচারা।

 

সেদিন রাতে, খেতে বসে, কথাচ্ছলে প্রসঙ্গটা তুলল সুমিত। জানাল যে পথে লাবনী আণ্টির সাথে দেখা হয়েছে ওর। তবে ফোন আসার কথা কিছুই বলল না।

‘বেচারী লাবনী!’ মহিলাকে পছন্দই করেন মিসেস রোখসানা। ‘অনেকদিন হলো দেখা হয় না। কবর দেয়ার সময় শেষ দেখেছিলাম।’

‘কার কবর?’ প্রশ্নটা করল বটে সুমিত, কিন্তু উত্তর কী হবে সেটা আঁচ করতে পেরেছে অনেক আগেই।

‘ওর স্বামী, রিয়াজ। মনে নেই? ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিল বেচারা। আশ্চর্যের কথা, বিড়ি-সিগারেট ¯পর্শও করত না। সবই আসলে কপাল।’

লাল হয়ে গেল সুমিত। কেউ একজন ওর সাথে ঠাট্টা করেছে। কে হতে পারে? সিজার? সম্ভব। ব্যাটা একটা হাড়বজ্জাত। তবে এখনো কানে বাজছে কণ্ঠটা, বয়স্ক একটা গলা। কোন সন্দেহ নেই সুমিতের। তরুণ কেউ গলা নকল করলেও এতটা নিখুঁতভাবে করতে পারবে না।

ব্যাপারটা ঠাট্টা ছিল না।

 

কয়েকদিন পর, একেবারে আচমকা লাবনী আণ্টির সাথে দেখা হয়ে গেল সুমিতের। বলতে গেলে ভদ্রমহিলায় ওর পথ আটকে দাঁড়ালেন।

‘কেমন আছেন, আণ্টি?’ লজ্জায় মহিলার চোখে চোখ রাখতে পারছে না সুমিত, তাকিয়ে আছে নিচের দিকে।

কিছুক্ষণ পর উত্তর না পেয়ে চোখ তুলে তাকাল। দেখে, ভদ্রমহিলা অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওকে দেখছেন। মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা বলতে চাইছেন তিনি, আবার পারছেনও না। চোখ ভরে আছে পানিতে, তবে ওগুলো আনন্দাশ্রু। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘তুমি আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।’

‘আমি দুঃখিত,’ হড়বড়িয়ে বলে ফেলল সুমিত। ‘আমি জানতাম না যে...’

একহাত তুলে ওকে থামিয়ে দিলেন লাবনী। ‘রিয়াজ মারা গিয়েছে মাস দুয়েক আগে। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওর সেবা করেছি আমি।’

‘আম্মুর মুখে শুনলাম। আমি আসলে…’

‘আমরা আঙটি বানিয়েছিলাম একজোড়া, জানো? রুপার, ও আবার সোনার কিছু পরত না। সাতাশ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল আমাদের। দামী কিছু না। বিয়ের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে বানানো হয়েছিল ওগুলো। আমারটায় ওর নামের আদ্যক্ষর লেখা ছিল, ওরটায় আমার নামের। রিয়াজ মারা যাবার পর, ওর আঙটিটা অনেক খুঁজেছি। আমার কাছে ওটার দাম যে অনেক! খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম, রোগটা ধরা পরার আগে শেষ এই অলংকার দুটোই বানানো হয়েছিল। টাকার দরকার থাকা সত্ত্বেও বিক্রি করিনি। কিন্তু ওটা ওর হাতে ছিল না, অনেক খুঁজেও পাইনি।’ বলতে বলতেই থেমে গেলেন তিনি, টিস্যু বের করে চোখ মুছলেন।

‘তুমি কী করে জানলে আমি জানি না। কিন্তু ফ্রিজের নিচে খুঁজতে গিয়েই পেলাম ওটাকে। শেষের দিকে খুব শুঁকিয়ে গিয়েছিল বেচারা। হয়তো সেজন্যই আঙুল থেকে পড়ে গিয়েছে! তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

সুমিতের মাথায় একবার হাত বুলিয়েই হাঁটা ধরলেন মহিলা। ছেলেটা জানে, এখন আর ওর উপর রেগে নেই ভদ্রমহিলা।

বরঞ্চ ওকে ভয় পাচ্ছেন তীব্রভাবে!

 

সেদিন বিকালে, ঠিক সাড়ে চারটার সময়েই, আবার বেজে উঠল ফোন।

‘আমাকে তুমি চেনো না,’ বলল একটা নারী কণ্ঠ। ‘তবে তোমার পরিচিত একজনের সাথে দেখা হলো। তার কাছ থেকেই পেলাম নাম্বার। বললেন, তুমি চাইলে আমার একটা বার্তা পৌঁছে দিতে পারো।’

‘কী?’ কণ্ঠের ভয় লুকাতে পারল না সুমিত।

‘আমার নাম নিপা হাসান। আমার মায়ের নাম মরিয়ম বেগম। থাকেন উপশহরে, ১৪/৪-এ। ওকে বলবে, শুধু শুধু হাসানকে দোষ দিচ্ছে সে। যা হয়েছে, তাতে কারোই হাত ছিল না। ওরা দু’জন যদি আপোসে সব ঠিক করে নেয়, তাহলে আমি খুব খুশি হবো।’

এবার আর সরাসরি ঠিকানায় গিয়ে উপস্থিত হলো না সুমিত, খোঁজ-খবর নিয়ে গেল। আসলেই ওই ঠিকানায় থাকেন মরিয়ম বেগম। তার বড় কন্যা নিপা হাসান, স্বামী হাসান ফেরদৌস। ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে আসার সময় অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় নিপা, তখন চালক ছিল হাসান।

মরিয়ম বেগমের সাথে দেখাই করল না সুমিত, অনেক হয়েছে। আর এসবে জড়াতে চায় না। আর তাছাড়া, ফোনকলের মাধ্যমে ওকে এসব বলা হয়েছে। এই কথা সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ বিশ্বাস করবে?

 

ক্রিং ক্রিং...ক্রিং ক্রিং

আজকাল খুব বাজতে শুরু করেছে ফোনটা।

‘আমার নাম রাকিব, রাকিব চৌধুরী। নিপা হাসানের কাছ থেকে তোমার নাম্বার পেয়েছি। আমার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে? ওর স্বামী ধোঁকাবাজি করছে, আরেক মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছে স¤পর্কে। আমার মেয়েটার সাথে দেখা করে বলবে…’

‘আমার মায়ের সাথে দেখা করতে হবে। তিনি আমাকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন প্রায়। যদি জানতে পারেন যে আমি এখানে সুখেই আছি, তাহলে হয়তো…’

‘মিস নাহিদার সাথে দেখা করতে হবে। আমি ওর বড় বোন।’

এভাবেই চলতে লাগল দিনের পর দিন। কয়েকসপ্তাহ পর দেখা গেল, একেক দিনে সাতটা-আটটা করেও ফোন আসছে!

কিন্তু একটা বার্তাও পৌঁছে দিল না সুমিত।

এই ঘটনার কথা ও আব্বু-আম্মুকে বলতে চায়, বলতে চায় প্রিয়াকে...সিজারকে। কিন্তু বলি-বলি করেও বলতে পারে না। সবাই যে ওকে পাগল ঠাউরাবে!

মৃতদের সাথে যোগাযোগের একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছে ও। কেন জানে না, জেডটিই ব্র্যান্ডের এই মোবাইল ফোনটা পরকালের সাথে সংযোগ স্থাপনেও সক্ষম। কীভাবে এসব সম্ভব হলো, কে জানে? তবে সম্ভব যে হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

ওপারেও নিশ্চয়ই খবর ছড়িয়ে পড়েছে। তাই তো বেড়ে গিয়েছে ফোন কলের সংখ্যা।

‘আমার চাচাকে বোলো…’

‘আমার স্ত্রীর সাথে একটু দেখা করতে পারবে...?’

‘মামাদের জানা দরকার...’

ক্রিং ক্রিং শব্দটা হওয়ামাত্র এখন আঁতকে ওঠে সুমিত। আর সহ্য হচ্ছে না ওর। শেষ পর্যন্ত একেবারে বন্ধ করে রাখল মোবাইলটা। কাপড়-চোপড়ের নিচে চাপা দিয়ে ভুলতে চাইল ওটার অস্তিত্ব। তারপরেও যেন কল্পনাতেও ওর পিছু ছাড়ল না যন্ত্রটা।

দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল বেচারা। ভূত দেখে, স্বপ্নে হানা দেয় গা থেকে মাংস খসে আসা লাশ। মনে হয় যেন ওর কামরার বাইরেই অপেক্ষা করছে, ওর সাথে কথা না বলে যাবে না।

 

ছেলেকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন ফয়সাল এবং রোখসানা আহমেদ।

ছেলে ঠিকমত খায় না, ঘুমায় না। লেখাপড়াতেও মন নেই আর। ভয় পেয়ে গেলেন তাঁরা। আঁতকে উঠলেন সম্ভাবনাটার কথা চিন্তা করে।

তাঁদের সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়েনি তো?

অনেক ভেবে-চিন্তে একদিন রাতের খাবারের পর বসলেন সুমিতকে নিয়ে। সরাসরি প্রশ্ন করলেন না, এই বয়সী বাচ্চাদেরকে ওভাবে প্রশ্ন করা যায়-ও না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এটা-সেটা জানতে চাইলেন তারা।

আচমকা রোখসানা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার ফোন কোথায়?’

কুঁচকে গেল সুমিতের চেহারা।

‘অনেকদিন হলো তোমাকে ওটা ব্যবহার করতে দেখি না।’ বললেন ফয়সাল আহমেদ।

‘পরীক্ষা সামনে।’ জবাব দিল সুমিত। ‘দরকারও হয় না খুব একটা। সবার সাথে তো দেখাই হয়। আর তাছাড়া, ফোন ব্যবহার করতেও ভাল লাগে না।’

হাসলেন ফয়সাল, রাতটা ভালই কেটেছে তাঁর পরিবারের। তাই আর বেশি চাপ দিলেন না। কেবল বললেন, ‘দরকার মনে করলে আমাকে দিতে পারো। আর একেবারে প্রয়োজন মনে না করলে বিক্রিও করে দেয়া যায়।’

‘তাহলে তো খুব ভাল।’ আনন্দে যেন লাফিয়ে উঠল সুমিতের মন। সাথে সাথে ফোনটা এনে দিয়ে দিল আব্বুকে।

অনেকদিন পর, দুঃস্বপ্নহীন একটা রাত কাটাল সুমিত আহমেদ।

 

এক সপ্তাহ পরের কথা।

বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন ফয়সাল আহমেদ। বাসায় টিঅ্যা-টি ফোনের লাইনটা বেশ কয়েকদিন ধরেই ঝামেলা করছিল। সেটা ঠিক করতে লোক এসেছে। মাঝে-মধ্যে সেদিকে তাকিয়ে দেখছেন।

সামনেই টেবিলের উপর পড়ে আছে সুমিতের ফোনটা। বেচব-বেচব করেও বেচা হয়নি। আজকেই কিছু একটা করতে হবে। মনে মনে ভাবলেন তিনি। বুঝতে পেরেছেন যে সুমিতের আসলে সেট পছন্দ হয়নি। তাই ঠিক করেছেন, নতুন আরেকটা কিনবেন। বন্ধুদের সাথে বান্দরবনে গিয়েছে ছেলেটা, ফিরলেই উপহার দেবেন দামী একটা সেট।

আচমকা দরজায় দেখা গেল মিসেস রোখসানাকে। স্ত্রীকে শোবার ঘরে রেখে এসেছিলেন ফয়সাল আহমেদ। শরীর ভাল নেই ভদ্রমহিলার। তাই শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলেন। অবশ্য এখন দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি অসুস্থ।

‘কী হলো?’ জানতে চাইলেন ফয়সাল আহমেদ। একসাথে বিশ বছর হলো সংসার করছেন। তাই স্ত্রীকে দেখেই বুঝতে পারছেন যে কোন একটা সমস্যা হয়েছে। এত লম্বা সময় ঘর করলে, সব কথা মুখে বলতে হয় না।

‘টিভিতে দেখলাম…’ বলেই থেমে গেলেন মিসেস আহমেদ।

‘কী দেখলে?’

‘সুমিত...বান্দরবনের রাস্তায় নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’ কেঁদে ফেলবেন যেন মিসেস রোখসানা। নাহ, কোন খারাপ খবর পাননি তিনি। আসলে কোন খবরই পাচ্ছেন না, সেজন্যই আরও বেশি ভেঙে পড়েছেন মনে মনে। ‘খবরে দেখাল, একটা বাস নাকি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ওতে কলেজ-পড়–য়া অনেকগুলো বাচ্চা ছিল। অনেকেই নাকি মারা গিয়েছে।’

‘ওটা তো সুমিতের বাস না-ও হতে পারে। বছরের এই সময়টায় অনেকেই বেরাতে বেরোয়। তাই বাসের তো কোন অভাব নেই।’

‘কিন্তু সময় যে মিলে যায়। আজ সকালেই সুমিতের বান্দরবনে পৌঁছবার কথা।’

‘সিজারদের বাসায় ফোন করেছ?’ সুমিতের বন্ধুদের মাঝে একমাত্র সিজারেরই নিজস্ব ফোন আছে। ছেলেটা নিশ্চয়ই হোটেলে পৌঁছে জানিয়েছে বাড়িতে। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল ফয়সাল আহমেদের টিঅ্যা-টি লাইন তো নষ্ট। ফোন করার কোন উপায় নেই।

পরক্ষণেই দেখতে পেলেন মোবাইল ফোনটাকে। ‘ফোন লাইন ঠিক করছে। এটা দিয়ে ফোন করা যায়।’

বলেই যন্ত্রটাকে হাতে তুলে নিলেন তিনি...

...ক্রিং...ক্রিং...

ঠিক সেই মুহূর্তেই বাজতে শুরু করল ওটা।

অবাক হয়ে গেলেন ফয়সাল আহমেদ। তাড়াতাড়ি রিসিভ বাটনটা চাপলেন ফোনের।

‘হ্যালো, আব্বু।’ ওপাশ থেকে সুমিতের কণ্ঠ শোনা গেল। ‘আমি বলছি।’