“মেয়ে,
হয়ত আর কিছু দিন, হয়ত কিছু মাস কিংবা কিছু বছর পর আসবে সেই রাত। যে রাতে তুমি হয়ে যাবে অন্য কারও! পরম মমতায় তোমার ব্লাউজ খুলতে লাগবে অন্য কেউ!
দূরে বহু দূরে .... ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার কথা ভেবে ব্লেড দিয়ে নিজের হাত ক্ষত-বিক্ষত করবে আরেক একজন পুরুষ।
আবার ধর, তোমার শরীরের কথা ভেবে ফ্যান্টাসি করতে করতে হস্তমৈথুনের কৃত্রিম সুখের সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দেবে আরেকজন।
তোমাকে নায়িকা ভেবে নতুন গল্পের প্লট ভাববে কোন লেখক!
আর অন্ধকার এক ছাদে দাঁড়িয়ে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে সিগারেটে দীর্ঘ টান দেবে নিজের জীবনের শেষ দিনের অপেক্ষায় কঠিন ব্যাধিতে জর্জরিত আরেক জন!
দেখছ মেয়ে? কত জন পুরুষের সাথে জড়িয়ে থাকবে তুমি! কারও শরীরের সাথে, কারও মনে সাথে তো কারও অস্তিত্বের সাথে!
এরপরেও কি তুমি বলবে যে ছেলেরা কোন কাজের না? বলতেও পার...
‘চ’ অক্ষরের ফাঁদে আটকে গেছি আমরা!”
হঠাৎ করেই কলমটা থেমে গেল, শরীরটা হুট করেই প্রচণ্ড খারাপ লাগছে ওর।
কাগজটার দিকে তাকাল সে, একটু আগে নিজের লেখা কথাগুলো যেন ক্রমাগত ব্যঙ্গ করে চলেছে তাকে।
আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। আজকাল মাঝে-মাঝে নিজেকেই চিনতে পারে না সে।
“ওই ছায়া আমাকে মুক্তি দেবে কি কখনও? কোন চিহ্ন থাকবে না এই পৃথিবীর বুকে আমার! একটুও না!” আপনমনেই বলে উঠল সে।
আক্ষরিক অর্থেই এই পৃথিবীর বুকে তার আর কোন চিহ্ন থাকবে না।
ত্রিমাত্রিকভাবে ভবনটার ওপরে বেশ সুন্দর করে কিছুক্ষণ পরপর রঙিন অক্ষরে ভেসে উঠছে ‘বোয়ালিয়া থানা’ লেখাটা।
“ভেতরে যেতে পারি?” থানার প্রধান গেটে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কন্সটেবলকে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“কী দরকার?” সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে।
“এই নিন,” বলে আইডেন্টিটি চিপটা তার হাতে তুলে দিলাম।
সেটা নিয়ে পাশের একটা মেশিনে ঢোকাল সে। সাথে সাথে মেশিনটার ওপর থেকে একটা আলো ছড়িয়ে পড়লো আর সেই আলোতে ভেসে উঠলো আমার ত্রিমাত্রিক একটা মূর্তি।
“ইন্সপেক্টর এ. আর. খান আতিক, স্পেশাল ভ্যাম্পায়ার হান্টিং ফোর্স(এস.ভি.এইচ.এফ), বাংলাদেশ।” বলে উঠল সেই মূর্তি।
“স্যার,” বলে হন্তদন্ত হয়ে আমাকে স্যালুট করল বেচারা কন্সটেবল তারপর বলল, “ভেতরে যান স্যার, ওসি সাহেব আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন।”
ভেতরে ঢুকলাম। সকাল সকাল, অফিসারেরা আসতে শুরু করেছেন কেবল।
একটু খুঁজতেই ওসি সাহেবের ঘরটা পেয়ে গেলাম। দরজার ওপর একটা কালো নেমপ্লেটে লেখা রয়েছে:
“শাহনেওয়াজ মুনতাসির,
ওসি, বোয়ালিয়া থানা।”
এক ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখলাম উনি ঘরেই আছেন এবং কম্পিউটারের স্ক্রিনে কী যেন দেখছেন।
“আশা করি আপনাকে বিরক্ত করছি না,” এই বলে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।
“আরে ইন্সপেক্টর খান! আসুন আসুন!” উঠে দাঁড়ালেন ওসি সাহেব, এগিয়ে এসে হাত মেলালেন আমার সাথে। ভদ্রলোক বেশ স্বাস্থ্যবান।
“সকাল সকালই এসে পড়লাম, ভেবেছিলাম আপনি বিরক্ত হবেন,” মৃদু হেসে বললাম আমি।
“আরে কী যে বলেন! বিরক্ত তো হওয়ার কথা আপনার! আপনার ছুটিটাই তো বর্বাদ করে দিলাম মনে হচ্ছে। চা চলবে?”
“না, চা-কফি কিছুই খাই না। আর ছুটি! আমি তো রাজশাহীরই ছেলে। তবে বেশ অনেক বছর পর রাজশাহী এলাম বলতে পারেন।”
“তাই তো শুনলাম। আসলে আপনাকে বিরক্ত করার কোন ইচ্ছাই আমাদের ছিল না। কিন্তু এস.ভি.এইচ.এফ’এ যোগাযোগ করার পর তারাই আমাকে জানায় যে তাদের সেরা অফিসার এখন রাজশাহীতেই ছুটি কাটাচ্ছে!”
“হুম, আমাকেও ফোন দেওয়া হয়েছিল। আর এতে বিরক্তির কিছু নেই, আমি রাজি হয়েছি দেখেই কেসটা আমাকে দেওয়া হয়েছে। না হলে ঢাকা থেকে ওরা অন্য কাউকেই পাঠাত। কিন্তু একটা কথা...”
“কী কথা? বলুন।”
“আপনার কেন মনে হচ্ছে যে এই কেসটা এস.ভি.এইচ.এফ’এর? না, মানে বোঝেনই তো... রাজশাহীতে...”
“তা বলতে পারেন! আমি নিজেও এটা নিয়ে সন্দিহান। রাজশাহীতে এর আগে ভ্যাম্পায়ারের উৎপাতের কথা শোনা যায়নি। আপনি বললেন আপনি রাজশাহীর ছেলে, সেক্ষেত্রে তো আপনার জানারই কথা যে এই শহরটা এমন যে এইখানে একটা সাধারণ খুন হলে গোটা শহরের মানুষ জেনে যায়! যেখানে বড় শহরগুলোতে পাশের ফ্ল্যাটে খুন হলেই মানুষ জানে না! সেখানে ভ্যাম্পায়ার! কিন্তু এই সন্দেহটা প্রথম করেন ডা. নুসরাত।”
“উনি কে?”
“ফরেনসিক স্পেশালিস্ট। দ্বিতীয় মৃতদেহটা পাওয়ার পর থেকেই উনি কথাটা আমাকে অনেকবার বলেছেন। কিন্তু আমি গুরত্ব দিইনি। কিন্তু একই সপ্তাহে আরও চারটা খুনের পর...বোঝেনই তো।”
“উনার কেন এমনটা মনে হয়েছে?”
“প্রতিটা মৃত মেয়েরই গলাতে কামড়ের চিহ্ন আছে, ডাক্তারি পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত যে কেউ ওদের রক্ত চুষে খেয়েছে।”
“এটা তো কোন বিকৃত মস্তিষ্কের খুনীও হতে পারে। এটা যে কোন ভ্যাম্পায়ারের কাজ তা উনি কী করে নিশ্চিত হচ্ছেন?”
“উমম...কথাটা কী করে বলি...আসলে ব্যাপারটা অদ্ভুতই!”
“কী?”
“কোন মৃতদেহেই না, কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি! আপনি তো জানেনই ভ্যাম্পায়ারদের আঙ্গুলের ছাপ পড়ে না কিছুতে!”
“হুম, খবরের কাগজে আরেকটা জিনিস পড়লাম। কী যেন একটা লেখা কাগজ নাকি আটকানো থাকে মৃতদেহগুলোর গায়ে?”
“ও হ্যাঁ হ্যাঁ! প্রতিটি মৃতদেহের গায়েই আঠা দিয়ে একটা কাগজ লাগান ছিল আর তাতে লেখা, ‘আজ রাতটা শুধু তোমারই জন্য!’ অদ্ভুত না?"
“ওগুলোতেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই?”
“নাহ নেই। লেখাগুলোকেও বেশ অপটু মনে হয়েছে, ছোট বাচ্চারা যেভাবে লেখে ঠিক সেইভাবে।”
“হুম, আচ্ছা ওসি সাহেব আমাকে কেসটা একটু খতিয়ে দেখতে হবে, মৃতদেহগুলোকেও দেখতে হবে সাথে ঘটনাস্থলগুলোও।”
“হুম, কবে থেকে কাজ শুরু করতে চাচ্ছেন?”
“আমার ডিপার্টমেন্ট আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শুরু করে দিতে বলেছে। এখন থেকেই শুরু করতে চাচ্ছি। প্রথমে ডা. নুসরাতের সাথে দেখা করতে চাই, আমার সাথে কাউকে দিলে ভালো হয়। বোঝেনই তো, ছুটি কাটাতে এসেছি এমন কেসে ফেঁসে যাব তা তো ভাবিনি।”
“তা তো বটেই, আপনি বসুন, আমি সব ব্যবস্থা করে আসছি,” এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ওসি সাহেব।
আজ থেকে একশো বছর আগেও কেউ হয়ত ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব বিশ্বাস করত না। কিন্তু এই ২০৯৮ সালের পৃথিবীতে ভ্যাম্পায়ার খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার।
ব্যাপারটা অদ্ভুতই। মধ্যযুগ আর প্রাচীনযুগের অনেক বিশ্বাসই আজ সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
কিন্তু এমনটাই তো হয়ে থাকে। যেমন ধরুন প্রাচীন যুগে সুমেরিয়ানরা চন্দ্রবিজয়ের কাহিনী শুনেছিল। যা নিয়ে মধ্যযুগের মানুষ হাসাহাসি করত। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে ঠিকই মানুষ চাঁদ থেকে ঘুরে এসেছে!
ঠিক তেমনই, আজ থেকে একশো বছর আগে ভ্যাম্পায়ারের ধারণাটাকে শুধু কল্পকথা মনে করা হলেও গত পঞ্চাশ বছর ধরে ব্যাপারটা অনেক বদলে গেছে।
এখনকার মানুষ ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস করে। কারণ জিনিসটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।
২০৫০ সালের দিকে বুলগেরিয়ান একজন ডাক্তার সর্বপ্রথম আবিষ্কার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেন।
‘সি-৭৮’ নামের একটি অদ্ভুত ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশের সাথে সাথে রক্তে মিশে যায় এবং একটা সময় পর এটা মানুষের ডিএনএ’র গঠনে পরিবর্তন আনে। মানুষের সবকিছু বদলে যায়। বদলে যায় খাদ্যভ্যাস, চামড়ার রঙ এবং আচার-আচরণ!
মানুষের ক্ষুধা বা তৃষ্ণা মেটানোর উপাদান একটাই হয়ে যায় আর সেটা হলো রক্ত!
সবচেয়ে আজব ব্যাপার হলো এই ভাইরাস মানুষের শরীরকে এমনভাবেই পরিবর্তন করে ফেলে যে, শুধুমাত্র রক্তপান করেই আক্রান্ত মানুষেরা সাধারণ মানুষদের চেয়ে অনেক বেশী সময় বেঁচে থাকতে পারে! শুধু তাই নয়, তাদের শারীরিক শক্তিও প্রচুর বেড়ে যায়!
এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষদের চামড়া শুরুর দিকে আলো একদমই সহ্য করতে পারে না, তবে একজন আক্রান্ত মানুষ বা ভ্যাম্পায়ার যদি দিনের পর দিন সকল যন্ত্রণা সহ্য করেও আলোতে চলাচলের অভ্যাস করে তবে একটা সময়ে এই দুর্বলতা আর থাকে না।
ভাইরাসটি শুধু মানুষের শরীরে নয়, মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মনের মধ্যে অচেনা পরিবেশের প্রতি একটা অদ্ভুত ভীতি কাজ করে, আর এজন্যই কোন স্থান বা বাড়ি থেকে কেউ যদি তাদেরকে ভেতরে যেতে আহবান না করে তবে তারা ভেতরে যেতে পারে না।
কেউ যদি তাদের ভেতরে যেতে বলে তখনই তাদের মস্তিষ্ক বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ভেতরে তাদের কোন ক্ষতির আশংকা নেই এবং এরপরেই তারা ভেতরে যায়!
একজন আক্রান্ত মানুষ যদি আরেকজন আক্রান্ত মানুষকে কামড় দেয়, তবে ওই ভাইরাস ওই মানুষটির শরীরেও প্রবেশ করে এবং একটা সময়ে সেই মানুষটিও ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়।
গোটা পৃথিবীতে প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেছে ভ্যাম্পায়ারের উপদ্রব। মানুষের মাঝেই মানুষের ছদ্মবেশে চলাচল করে এরা আর সুযোগ পেলেই মানুষকে হত্যা করে মেটায় নিজেদের রক্তের তৃষ্ণা।
আজ পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকার ভ্যাম্পায়ার নিধনের জন্য আলাদা সশস্ত্রবাহিনী গঠন করেছে।
বাংলাদেশে ভ্যাম্পায়ার নিধনের দায়িত্ব পালন করে এস.ভি.এইচ.এফ। সেখানকারই একজন কর্মকর্তা আমি, ইন্সপেক্টর এ. আর. খান আতিক।
সত্যি বলতে কী, ডিপার্টমেন্টে আমার এক অদ্ভুত সুখ্যাতি রয়েছে। এর আগে কোন কেসেই বিফল হইনি। ওপরওয়ালাদের যথেষ্ট সুনজরেও আছি, এজন্য বেশীরভাগ কলিগই আমাকে বেশ হিংসা করে। তবে ওসব আমলে নেওয়ার মতো মানুষ আমি নই।
“স্যার, আর একটু পরেই আমরা পৌঁছে যাব,” বলে উঠল সাব ইন্সপেক্টর এনাম। তার কথাতেই যেন বাস্তবে ফিরে এলাম। থানার ওসি মুনতাসির সাহেব একেই আমার সঙ্গী হিসাবে নির্বাচন করেছেন। ছেলেটা ভাল, আমার চেয়ে বয়সে বেশ ছোটই হবে। বিশালদেহী এবং বেশ ভদ্র স্বভাবের মানুষ সে।
“হুম, বুঝলাম এনাম সাহেব,” গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলাম আমি।
“আমাকে দয়া করে তুমি বলেই ডাকবেন স্যার, আমার একটা বিষয় জানার ছিল, যদি কিছু না মনে করতেন,” কাচমাচু করে বলল এনাম।
“অবশ্যই, বল।”
“ভ্যাম্পায়ারেরা অমর হয়, তাই না স্যার? মানে ইমর্টাল?”
“উমম... আচ্ছা, একটু সমস্যা আছে তোমার কথাতে। ঈশ্বরের ব্যাপারটা চিন্তা কর, উনিও তো অমর, ইমর্টাল, তাই না?”
“তা তো বটেই স্যার।”
“ইংরেজী শব্দের প্রয়োগে ভুল আছে তোমার। ইমর্টাল শব্দটা ইশ্বরের সাথেই যায়, উনি অমর! ভ্যাম্পায়ারদের ক্ষেত্রে যে শব্দটা ব্যবহার করা উচিত তা হল ‘আনডেড’ মানে এমন কেউ যে মরে গিয়েও বেঁচে আছে!”
“ঠিক মরে গেছে কি?”
“ঠিক তাও নয়, তবে ওদের শরীরে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ এতোটাই পরিবর্তন হয় যে ওরা আর মানুষ থাকে না। তবে ওরা অমর নয়! চিরকাল বাঁচেও না! একটা সময় মরেই যায়!”
“আমি চিরকালই ইংরেজীতে একটু কাঁচা স্যার।”
“ব্যাপার না। এই ভুলটা অনেক উচ্চশিক্ষিত লোককেও করতে দেখেছি আমি। তা বিয়ে টিয়ে করেছ নাকি এনাম?” পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বললাম আমি।
“হ্যাঁ স্যার, দুই বছর আগে। আপনাদের দোয়াতে একটা বাচ্চাও আছে!” দাঁত বের করে হেসে বলল এনাম।
বাঙালি ছেলেদের এটাই সমস্যা। বিয়ের কথা বললেই এরা খুশি হয়ে ওঠে। কেন যে খুশি হয়, কে জানে! এত সময় চলে গেছে কিন্তু এই ব্যাপারটার কোন পরিবর্তন হয়নি।
“আপনি বিয়ে করেননি স্যার?” আমার দিকে তাকিয়ে বলল এনাম।
“নাহ গো।”
“কেন স্যার?”
“আসলে আমার সিরিয়াস রিলেশনশিপটা ভেঙ্গে যাওয়ার পর আমি এসবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে মা-বাবাও মারা গেলেন। একা জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।”
“স্যার, আপনার সেদিন একজনের কাছ থেকে শুনলাম যে আপনি একজন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলি?”
“হাহাহা... ‘ইঞ্জিনিয়রিং সেক্টরে কেন গেলাম না?’ এই প্রশ্নটাই তো? এতবার এটার উত্তর দিতে হয়েছে যে আমি আজকাল অপেক্ষা করে থাকি যে কখন মানুষ এই প্রশ্নটা করবে!”
“স্যার... আসলে আমারও খুব কৌতুহল ব্যাপারটা নিয়ে।”
“শোন এনাম, ভার্সিটি জীবনের মাঝামাঝি এসে আমি বুঝতে পারলাম যে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর আমার আর কোন ভালোবাসা নেই। আমি শুধু স্কুল আর কলেজ-জীবনের ফ্যান্টাসি মেটাতেই পড়তে এসেছিলাম। আমার ভবিষ্যতেও ওই সেক্টরে ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই নেই।”
“আমরা এসে গেছি স্যার,” এই বলে ফ্লাইং কারটাকে নিচে নামাতে শুরু করল শুরু করল এনাম।
উড়ন্ত গাড়ির রেওয়াজটা শুরু হয়েছিল ২০৪৫ সালের পর থেকে। তারপর যা হয়, পরবর্তী দশবছর শুধুমাত্র ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই এটা ব্যবহার করলেন আর তার দশ বছর পর থেকে প্রায় সবাইই এটাই কিনতে শুরু করল।
আকাশপথে জ্যাম আজকাল ট্রাফিক পুলিশের চিন্তার একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু মানুষ তো জ্যাম এড়ানোর জন্য আবার মাটিতে চলা যানবাহন ব্যবহার করা শুরু করেছে।
গাড়ি থেকে নেমেই ফরেনসিক ল্যাব ভবনটার দিকে দৃষ্টি পড়ল। আর দশটা সরকারী ভবনের মতো এটাও একেবারেই চাকচিক্যহীন। থানা থেকে এতোটা দূরে ফরেনসিক ল্যাব করার কারণটা আমার কখনোই বোধগম্য হয় না!
এত দূরে মৃতদেহ আনতে আনতেই তো অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ভবনের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল একটা গার্ড।
“ডা. নুসরাতের কাছে এসেছি, ভেতরে যেতে পারি?” গার্ডের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল গার্ড। সম্ভবত আমার পিছনে দাঁড়ান পুলিশের পোশাক পড়া এনামের দিকে আটকে গেছিল তার নজর।
“পুলিশের লোক আমরা, ভেতরে যেতে পারি?” আবার বলে উঠলাম আমি। এবার যেন গার্ড আরও অবাক হয়ে পড়ল। সম্ভবত কোন পুলিশ অফিসার এতটা ভদ্রতা দেখাতে পারে ব্যাপারটা ওর জানাই নেই!
“হ ছার! অবশ্যই যান!” কোনমতে বলল সে।
“একজন গার্ডের কাছ থেকে এত অনুমতি নেওয়ার কী আছে স্যার?” ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বিরক্ত কণ্ঠে বলল এনাম।
“উমম...সীমাবদ্ধতা ভদ্রতা শেখায়, মনে রেখ এনাম।” মুচকি হাসলাম আমি।
“বুঝলাম না স্যার। কী সীমাবদ্ধতা?”
“বাদ দাও, এসেই গেছি, ওই দেখ,” এই বলে সামনের একটা ঘরের ওপরের নেমপ্লেটটা দেখালাম আমি।
ওখানে লেখা রয়েছে:
ডা. নুসরাত পারভীন
ফরেনসিক স্পেশালিস্ট
নিচে লেখা বিরাট বিরাট ডিগ্রীগুলোর নাম পড়ার ধৈর্য্য হল না। তবে বোঝাই যাচ্ছে, যেন তেন ডাক্তার নন তিনি।
বেশ অবাকই হলাম। এরকম ডাক্তারেরা সাধারণত রাজশাহীতে থাকতে চান না। আর এজন্য তাদের দোষও দেই না আমি। সরকারী চাকরী শেষে সন্ধ্যার পর সব ডাক্তারই চেম্বারে বসেন আর চেম্বার ভরে যাওয়ার জন্য যে পরিমাণ রোগী দরকার তা যোগাতে পারে না এই শান্ত শহর।
আমরা সেই ঘরে ঢুকতে যাব ঠিক তখনই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন একজন মহিলা।
“স্যার, ইনিই ডা. নুসরাত,” আমার কানে কানে বলল এনাম।
“আরেহ? কই আপনাদের সেই ভ্যাম্পায়ার স্পেশালিস্ট?” এনামের দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠলেন ডা. নুসরাত।
“এই যে ম্যাডাম, ইনি ইন্সপেক্টর এ. আর. খান,” আমাকে দেখিয়ে বলল এনাম।
ডা. নুসরাতের বয়স ত্রিশের ঘরে হবে, চুলগুলো কিছুটা কোঁকড়া, কপালের মাঝখানে একটা সুন্দর সবুজ টিপ পরে আছেন মহিলা। টিপ ব্যাপারটা বেশ ভালোই লাগে আমার, যদি আজকালের অনেক বাঙালি ললনার কাছেই ব্যাপারটা ‘ক্ষ্যাত’।
“নাইস টু মিট ইউ ইন্সপেক্টর খান,” আমার দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন ডা. নুসরাত।
“নাইট টু মিট ইউ টু, আমাকে আতিক বলে ডাকবেন প্লিজ,” হাত মেলাতে মেলাতে বললাম আমি।
“উমম নিকনেমে কমফোর্ট ফিল করেন? আমারও একটা নিকনেম আছে, ‘মুন’। আজকাল কেউ ওটা ধরে ডাকেই না! যাইহোক, আপনার কাজ কি এখনই শুরু করবেন?” হুট করেই সিরিয়াস হয়ে গেল ডা. নুসরাতের গলা।
“হ্যাঁ, যদি আপনার কোন কাজ না থাকে তবে এখনই আমি মৃতদেহগুলো দেখতে চাই।”
“এই কেসটাই আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আর বলতে গেলে এটাই এখন আমার সবচেয়ে বড় কাজ!” আসুন আমার পিছে পিছে, এই বলে একটা করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন ডা. নুসরাত। তার পিছে পিছে যেতে লাগলাম আমি আর এনাম।
***
আধো-অন্ধকার একটা ঘরে আমাদের নিয়ে ঢুকলেন ডা. নুসরাত। ঘরটা বেশ ঠান্ডা, বোঝাই যাচ্ছিল ওটাই মৃতদেহ রাখার ঘর।
ডা. নুসরাত আলো জ্বালিয়ে দিতেই দেখতে পেলাম ঘরের ঠিক মাঝখানে লম্বা-লম্বিভাবে দাঁড় করান পাঁচটি বিরাটাকৃতির কাচের টিউবের মধ্যে প্রায় অবিকৃত অবস্থানে পাঁচজন মেয়ের মৃতদেহ।
মানুষের মৃতদেহকে অবিকৃত রাখার প্রক্রিয়া আবিষ্কার হয়েছে প্রায় পঁচিশ বছর আগে। ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছে ফরেনসিক সায়েন্স। আজকাল আবার নাকি কিছু কিছু ধনকুবেররাও নিজেদের আত্মীয় স্বজনের মৃতদেহ এইভাবে সংরক্ষণ করে রাখে।
“এদিকে দেখুন,” এই বলে ডা. নুসরাত ঘরের মাঝখানে রাখা যন্ত্রটি চালু করলেন। সেটার ত্রিমাত্রিক পর্দাতে ভেসে উঠল কিছু লেখা:
“বাম দিক থেকে।
১. নাম- সারাহ, বয়স-২১, পরিবারের সাথেই রাজশাহী থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্রেম-সংক্রান্ত কোন ব্যাপার ছিল না। শিমলা পার্কের কাছের রাস্তাতে ২৪ শে জুন মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
২. নাম- নিকিতা, বয়স- ১৭, কলেজছাত্রী, রাজশাহীর স্থানীয় নয়। একটি মেসে থাকত। একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল। ছেলেটি বর্তমানে শোকে পাগলপ্রায়। চার্চ রোডের কাছে মৃতদেহ পাওয়া গেছে ২৬ শে জুন।
৩. নাম- অনিন্দিতা, বয়স-২৮, কর্মজীবি, রাজশাহীর স্থানীয়। স্বামী-সন্তানসহ ভাড়াবাড়িতে থাকত। পর্যটন মোটেলের কাছাকাছি একটি ডাস্টবিনে মৃতদেহ পাওয়া গেছে ২৭ শে জুন।
৪. নাম- কিমি, বয়স- ১৫, রাজশাহীর স্থানীয়। নগরীর একটি হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। রাত্রিবেলা সে নিজের ঘরেই ঘুমিয়ে ছিল বলে জানায় তার পরিবারের সদস্যরা। টি-বাধের কাছে ২৯শে জুন সকালবেলা তার মৃতদেহ দেখে স্থানীয়রা।
৫. নাম- ইমি, বয়স-২৭, ঢাকার বাসিন্দা। একটি প্রজেক্টের কাছে গত দু-মাস ধরে রাজশাহী ছিল। ৩০শে জুন সকালবেলা সে হালকা কাচাবাজার করতে বাড়ি থেকে বের হয় এবং সেদিন দুপুরেই তার মৃতদেহ পাওয়া যায় সিএনবির মোড় এলাকাতে। ওই এলাকা দুপুরবেলা বেশ নির্জন থাকে তাই ওখানে এমন হত্যাকান্ড ঘটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।”
“হুম, যা বুঝলাম সবগুলো খুনই চার্চ রোডের আশেপাশের এলাকাতেই ঘটেছে,” ডা. নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
“আপনি রাজশাহী দেখি ভালোই চেনেন,” বললেন ডা. নুসরাত।
“ওহ! আমি রাজশাহীরই ছেলে, দীর্ঘকাল রাজশাহী থেকে দূরে ছিলাম এটাই।”
“তাই? আমিও এখানকার স্থানীয়! এখান থেকে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। এজন্যই তো পড়ে আছি।”
এইবার বুঝতে পারলাম ডা. নুসরাতের এতো ডিগ্রী থাকা সত্ত্বেও এই শহরে পড়ে থাকার কারণ। আসলে এটা রাজশাহীর অনেক মানুষেরই সমস্যা। এরা এখানেই থেকে যেতে চায়, বড় শহরগুলোর ভিড়-ভাট্টা এদের সহ্য হয় না। তাই সুযোগ পেলে এখানে থিতু হয়ে শিকড় বিস্তার করাই এদের লক্ষ্য।
ততক্ষণে টিউবগুলোর কাছে গিয়ে গভীর মনযোগ দিয়ে মৃতদেহগুলো দেখতে শুরু করেছে এনাম।
“এত দেখে কী হবে? দেখুনতো? পুলিশের লোকেরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে, তেমন কিছুই নেই মৃতদেহগুলোতে। শুধু ঘাড়ের পাশে ওই কামড়ের চিহ্ন আর শরীর আঠা দিয়ে লাগান ওই অদ্ভুত কাগজটা। ওগুলো দেখার কিছুই নেই, তাই সব ডাটা আমি আপনার জন্য এখানে ইনপুট দিয়ে রেখেছিলাম,” আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন ডা. নুসরাত।
“ম্যাডাম, আমাদের কাজই তো এইসব দেখা আর তাছাড়া এই কেসের কোন সূত্রও তো পাচ্ছি না! কী আর করব?” বলল এনাম।
“যতদূর বুঝলাম ইমির কেসটা আলাদা, দিনের বেলাতেই খুন করা হয়েছে মহিলাকে,” ডা. নুসরাতকে বললাম আমি।
“হ্যাঁ আর এই নিয়েই আমার সাথে থানার ওসির বিরোধ, উনি বলছেন যে দিনের বেলা ভ্যাম্পায়ারেরা বের হতে পারে না। আমিও তাই জানি, কিন্তু তবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই কেন? খুনী যদি গ্লাভস ব্যবহারও করে থাকে তবে কামড় যে দিয়েছে সেখানে দাঁতের চিহ্নও তো স্পষ্ট, তাহলে? কোন ডি.এন.এ স্যাম্পলও তো নেই! এমনটা তো ভ্যাম্পায়ারদেরই হয়!”
“উমম, ভ্যাম্পায়ারেরা দিনের বেলাতে বের হতে পারে না ব্যাপারটা ঠিক এমন নেই কিন্তু আর। ওরাও অভিযোজিত হয়েছে। ফলে ওদের অনেকেই দিনের বেলাতেও ঘোরাফেরা করার ক্ষমতা লাভ করেছে।”
“তাই না? দেখুন তো, আমার কথা কেউ মানছে না! আর বর্তমান ফরেনসিক সায়েন্স কিন্তু অতোটাও পিছিয়ে নেই, খুনী যদি হাতে গ্লাভস ব্যবহার করত তবে সেটাও জানা যেত। তবে আমি সেটারও কোন চিহ্ন পাইনি,” চোখদুটো উজ্জল হয়ে উঠল ডাক্তার নুসরাতের।
“তা ঠিক, তবে কিমি নামের স্কুল পড়ুয়া মেয়েটার কেসটা...উমমম...”
“মানে? ঘরে এসেও তো ওকে খুন করতে পারে ভ্যাম্পায়ার, তাই না?”
“না, তা পারে না। কারণ ভ্যাম্পায়ারদের কিছু সীমাবদ্ধতা এখনও থেকে গেছে। কোন ভবন থেকে কেউ যদি তাকে ভেতরে আসতে না বলে, তবে সে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। সেক্ষেত্রে এমনটাও হতে পারে যে মেয়েটা ভ্যাম্পারটাকে আগে থেকেই চিনত, কিন্তু জানত না যে ও একটা ভ্যাম্পায়ার। কিন্তু বাড়ির লোকদের নজর এড়িয়ে বাড়িতে ঢুকল কী করে ব্যাটা? যদি আসলেই খুনী একজন ভ্যাম্পায়ার হয়ে থাকে!”
“স্যার এই কিমি মেয়েটার ব্যাপারে আমার একটা কথা আছে, কালকের অনুসন্ধান থেকেই জানতে পেরেছি,” এগিয়ে এসে বলল এনাম।
“হুম বল,” বললাম আমি।
“এই মেয়ের বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। বাড়িতে রয়েছে শুধু মা আর ছোটভাই। ওর মা মানে মিসেস. জুলফিকারের কিছু সমস্যা রয়েছে তাই রাত নটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন ভদ্রমহিলা। মাঝে মাঝেই নাকি বন্ধুদের সাথে রাত দশটার পর লেট নাইট পার্টিতে যেত কিমি, আর রাত বারোটার আগেই ফিরে আসত। ২৮শে জুন রাতেও নাকি ওদের বাড়ির সামনের মোড়ে ওকে নিতে গাড়ি নিয়ে এসেছিল ওর কয়েকজন বন্ধু, কিন্তু কিমি আর পৌঁছেনি! পরে তো ওর মৃতদেহই...”
“আচ্ছা, তার মানে বন্ধুদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিল কিমি আর রাস্তাতে...”
“সেটাই।”
“আর কোন বিশেষ ব্যাপার পেলে কি?”
“না স্যার। আর তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি।”
“চার্চরোডের কাছেই তো ঘটনাস্থলগুলো, তাই না?”
“হুম স্যার।”
“চল একটু ঘুরে আসি।”
“আচ্ছা স্যার।”
“আমাদের এখন যেতে হচ্ছে ডক্টর,” ডা. নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
“কেসটা কি খুব প্যাঁচালো মনে হচ্ছে?” বললেন ডা. নুসরাত।
“অনেক সময় অনেক সহজ কেসও এমন মনে হয়। আচ্ছা শুনুন, ভিক্টিমদের গায়ে লাগানো সেই কাগজটা আমাকে দিন তো। পাঁচকপি লাগবে না, একটা দিলেই হবে।”
“ওহ হুমম! একটু দাঁড়ান,” এই বলে একটা মেশিন চালু করলেন ডা. নুসরাত।
“দেরী হবে কি?”
“পাঁচ মিনিট। আচ্ছা রাজশাহী এলেন কবে? শুনলাম নাকি ছুটি কাটাচ্ছিলেন!”
“এই ধরুন দু-সপ্তাহ আছে। আর ছুটি! এতো বছর পর পুরনো শহরটাকে দেখতে এলাম....”
“উমম... পুরনো শহর থেকে এতো বছর দূরে থাকার কারণ?”
“বিশেষ কোন কারণ নেই, এমনিই।”
“তা পুরনো শহরের এই আকস্মিক নতুন রূপ কেমন লাগছে?”
“হুমম... কিছুটা দরকার আছে! বৈচিত্র দরকার আছে শহরের মানুষের জীবনে, আর এটাই হয়ত খুনীর উদ্দেশ্য!”
বিপপপ... একটা শব্দ শুনতে পেলাম। দেখলাম মেশিনটা থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা প্লাস্টিকের ট্রান্সপারেন্ট প্যাকেট।
সেটা আমার হাতে দিল ডা. নুসরাত। দেখলাম সেটার মধ্যেই কাগজটা রয়েছে। বেশ অপটু হাতের এবরো-থেবরো লেখা, “আজ রাতটা শুধু তোমারই জন্য!”
“খুনীর দেখি বেশী ভালোই কাব্যিক একটা মন আছে,” হেসে ফেললাম আমি।
“ভ্যাম্পায়ার খুনী বললে মনে হয় ভালো হয়,” বলে উঠলেন ডা. নুসরাত।
“এখনও তেমন কোন স্পষ্ট প্রমাণ পাইনি, বাই ডা. নুসরাত, পরে আবার প্রয়োজন হলে বিরক্ত করতে আসব আপনাকে।”
“অবশ্যই,” হাসতে হাসতে জবাব দিলেন ডা. নুসরাত।
আমি আর এনাম হাঁটতে শুরু করলাম।
“ইন্সপেক্টর আতিক,” পেছন থেকে ডাকলেন ডা. নুসরাত।
“হুম,” ঘুরে দাঁড়ালাম আমি।
“ওই কাগজটাতে ওই লাইনটার নিচে দেখুন, অস্পষ্টভাবে একটা সংখ্যা লেখা আছে।”
আমি প্যাকেটটা তুলে দেখলাম। তাইই, সেখানে লেখা রয়েছে ৪১৪৪৪।
“এর মানে কী?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম ডা. নুসরাতকে।
“জানি না, বাকি চারটা কাগজেও এই সংখ্যাটা লেখা আছে। তবে... একটা ব্যাপার!”
“কী?”
“তেমন গুরত্বপূর্ণ নয় যদিও...উমম... ওই লাইনটা আর এই লেখাটা দুটো ভিন্ন কলম দিয়ে লেখা হয়েছে। তবে হাতের লেখা দুটো একজনেরই।”
“আমরা কি এখন চার্চ রোডের দিকে যাব স্যার?” গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত দিয়ে বলল এনাম।
“আচ্ছা এনাম তোমার কাছে কোন কাগজ আছে?” বললাম আমি।
“আছে স্যার।”
“বের কর, কাজ আছে।”
এনাম কাগজ বের করল। আমি পকেট থেকে কলম বের করে কাগজে একটা লাইন লেখলাম।
“এবার তোমার নাম লেখ এই কাগজে,” এনামকে বললাম।
“কেন স্যার?”
“এমনিই, লেখ তো।”
“কলমটা দিন তো স্যার,” এই বলে আমার দিকে হাত বাড়িতে দিল এনাম।
“থাক থাক আর দরকার নেই! আমি যা বুঝতে চাইছিলাম তা বুঝে গেছি।”
“মানে স্যার?
“মানে দেখ, বেশীরভাগ মানুষ এটাই করে, তোমার কাছেও নিশ্চয় কলম আছে?”
“তা আছে!”
“তাহলে আমার কাছে চাইলে কেন?”
“একটা কথা লেখার জন্য আবার কলম বের করব?”
“সেটাই, সেইখানে খুনী দুই কলম দিয়ে লিখবে কেন? এইটাতে একটা ব্যাপারই প্রমাণ হয়, খুনী ওই লাইনটা আর ৪১৪৪৪ সংখ্যাটা দুটো ভিন্ন সময়ে লিখেছে!”
“এমনটা কি হতে পারে না যে দুটো দুজন লিখেছে?”
“নাহ, ডা. নুসরাত তো বললেনই যে দুটো লেখা একজনেরই।”
“তাহলে স্যার এই থেকে আমরা কী সূত্র পাচ্ছি?”
“আপাতদৃষ্টিতে এটা শুধুই একটা তথ্য, আর কিছুই না। চল চার্চ রোডের দিকে চল।”
‘সানরাইজ হাউজিং’ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর এনাম। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।
মৃতদেহগুলো যেসব জায়গাতে পাওয়া গেছে সেসব জায়গা ঘুরে তেমন কোন সূত্রই পাওয়া যায়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষেরা কেবল মৃতদেহগুলোই দেখেছে। তেমন কোন লাভই হয়নি।
তাই এই বিশালাকৃতির ভবনের সামনের চায়ের দোকানটাই ঠিকানা হয়েছে আমাদের। একটু আগেই আমদের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়েছে রোবট চা-ওয়ালা।
“এটাই সম্ভবত এই এলাকার সবচেয়ে বড় বিল্ডিং, তাই না এনাম?” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম আমি।
“হ্যাঁ স্যার, আরেকটা বড় বিল্ডিং আছে তবে সেটা এখান থেকে বেশ দূরে। এই বিল্ডিংএ প্রায় দেড়শো ফ্ল্যাট। অনেক পরিবার থাকে এখানে,” বলল এনাম।
“এমনটাও হতে পারে যে খুনী এই ভবনেরই কেউ, কী বল?” বলে উঠলাম আমি।
“এই ভবনের কেউ না! খুনী একটা প্রেত! একটা ভ্যাম্পায়ার!” এনামের পিছন থেকে চিৎকার করে উঠল কে যেন! ঘটনার আকস্মিকতায় হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে ভেঙ্গে গেল বেচারার। লাফিয়ে উঠল সে।
এই সুযোগে আমি সেই লোকটাকে দেখতে পেলাম। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবক, অগোছালো চুল আর মুখে একটা বেখাপ্পা গোঁফ। দাঁত বের করে হাসছে ব্যাটা।
ততক্ষণে এনামের মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। খপ করে যুবকের একটা হাত ধরে ফেলল সে। তারপর টেনে আনল নিজের কাছে, কলার ধরে ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে বলতে লাগল, “বন্ধু পেয়েছিস আমাকে তোর? উমম? বন্ধু পেয়েছিস?”
“ছেড়ে দিন ওকে, ছাড়ুন বলছি!” নারী কণ্ঠে আমার পিছন থেকে চিৎকার করে উঠল কেউ যেন।
ঘুরে দাঁড়ালাম। তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সের একটা মেয়ে, সাইকেলে বসে আছে।
“এই আপনাদের বাহাদুরি? খুনী ধরতে পারছেন না? একটা আধ-পাগলাকে ধরে খুব বাহাদুরি হচ্ছে না?” সাইকেল থেকে নামতে নামতে বলল মেয়েটি।
মেয়েটা বেশ লম্বা, সাধারণত বাঙালি মেয়েরা এতোটা লম্বা হয় না, শ্যামলা গায়ের রঙ।
“ওকে ছেড়ে দাও এনাম,” গম্ভীর কণ্ঠে বললাম আমি।
ঝটকা মেরে ছেলেটাকে ছেড়ে দিল এনাম। এনামের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সাথে সাথে সেই মেয়েটার দিকে দৌড়ে গেল সে।
“তুই দ্যাখ তো আফ্রিতা! আমি কি ভুল বলেছি? এইসব তো একজন ভ্যাম্পায়ার করছে! এই বলাতেই উনাদের রাগ,” ফুঁপিয়ে উঠে মেয়েটার হাত ধরল ও।
“তুই তোদের ফ্ল্যাটে যা তূর্য, এখন তোর সাথে কথা বলার ইচ্ছা নেই,” ঠান্ডা গলাতে বলল মেয়েটি।
মাথা নিচু করে হেঁটে চলে গেল ছেলেটি।
“দেখুন ম্যাডাম, আমার পুরো ইউনিফর্ম ভিজিয়ে দিয়েছে আপনার বন্ধু! আর আপনি এখনও বলছেন আমার রাগ হওয়া উচিত নয়! আর পুলিশ নিয়ে আপনাদের এই ধারণা? আমরা কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করছি,” মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল এনাম।
“তা খুনী কি এই দিনের বেলাতে এইখানে বসে আছে নাকি?” বলে উঠল মেয়েটা।
মুখ লাল করে কিছু বলতে যাচ্ছিল এনাম। তাকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম, “দেখুন আমাদের কারণে যদি আপনাদের কোন অসুবিধা হয়ে থাকে তবে আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, মিস..?”
“শুনলেন না, আমার নাম আফ্রিতা? ওই পাগলাটাই তো বলল,” হেসে ফেলল মেয়েটা। ওর হাসিটা খুবই সুন্দর!
“আপনি কি সবসময় এভাবেই কথা বলেন?” পাল্টা হেসে জবাব দিলাম আমি।
“তা বলি। আপনার পরিচয়? আপনিও পুলিশ নাকি?”
“উমম একদিক দিয়ে তাইই। তবে জেনারেল পুলিশ ফোর্সে নেই এখন। ইন্সপেক্টর এ. আর. খান আতিক, এস. ভি. এইচ. ডি,” করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি।
“ওই মাই গড! ভ্যাম্পায়ার হান্টার! আসলেই তবে খুনগুলোর পিছে কোন ভ্যাম্পায়ার জড়িত নাকি? আমি আফ্রিতা অনি, রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ি,” হাত মেলাল মেয়েটা।
“পরিচিত হয়ে ভালো লাগল।”
“আমারও,” এই বলে সাইকেল নিয়ে ভবনের দিকে যেতে লাগল মেয়েটা।
অবাক চোখে ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। বহুকাল কোন মেয়ের দিকে এভাবে তাকাইনি আমি!
আমরা বসে আছি জনাব তৌহিদুর রহমান তৌহিদের ফ্ল্যাটে। সানরাইজ হাউজিং’এর সেক্রেটারি তিনি। ভদ্রলোকের বয়স ত্রিশের কোটায়।
“তো জনাব তৌহিদ, আপনি কতদিন ধরে এখানকার সেক্রেটারি,” জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“দুমাস হল, এই বিল্ডিংএ তিনমাসের জন্য কোন এক ফ্লাটের বাসিন্দাকে সেক্রেটারি নিয়োগ দেওয়া হয়,” উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।
“তা হলে আর একমাস আছে আপনার মেয়াদ?” বলল এনাম।
“হুম সেটাই।”
“আচ্ছা তূর্য নামের একজন ছেলের সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন।”
“কোন তূর্য? পাগলা তূর্য? ভ্যাম্পায়ার পাগলা? ওকে কি খুনী সন্দেহ করা হচ্ছে নাকি?” বলে উঠলেন ভদ্রলোক।
“না না, উনাকে একটু রহস্যময় লেগেছে আমার কাছে। আচ্ছা, ভ্যাম্পায়ার পাগলা? এটা কেন বলা হয়?”
“আর বলবে না! ভ্যাম্পায়ারের ব্যাপারে বিরাট আগ্রহ ওর। ও যখন ভালো ছিল তখন বিল্ডিংএর হ্যালোইন পার্টিতেও ভ্যাম্পায়ার সেজেই আসত ব্যাটা।”
“ভালো ছিল মানে?”
“ও একসময়ে ভার্সিটির খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। তারপর কী যে হয়েছিল। বলতে পারি না! ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে!”
“হুমম, আপনি বিয়ে থা করেননি তাই না মিস্টার তৌহিদ?”
“আমার ঘর দেখেই তো বুঝতে পারছেন,” নিজের অগোছালো ড্রইংরুমটা দেখিয়ে বললেন তৌহিদ সাহেব।
“হুমম, আচ্ছা শুনুন আমাকে তূর্যদের ফ্ল্যাটে নিয়ে চলুন। ওর সাথে কিছু কথা আছে!”
আমাদেরকে তূর্য’র ঘরে নিয়ে গেলেন ওর বাবা হক সাহেব। নিপাট ভদ্রলোক তিনি। উনার কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে পাঁচবছর আগেই মারা গেছেন উনার স্ত্রী মানে তূর্য’র মা।
তূর্য’র ঘরটা একটা দেখার মতো জায়গা। ঘরে মাঝখানে একটা বিছানাতে ঘুমাচ্ছিল সে।
ভ্যাম্পায়ারের একাধিক কস্টিউম, ওই সংক্রান্ত ইংরেজী ও বাংলা প্রচুর বইয়ের সংগ্রহ দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম নকল দাঁতের কয়েকটা পাটি যেগুলোতে সামনের দাঁতদুটো আকারে একটু বড়, ভ্যাম্পায়ারদের যেমনটা হয়।
বইয়ের কালেকশন রীতিমত ঈর্ষনীয়। সাবেক আমলের ব্রাম স্টোকার, সারিডন লে ফানু, আর্থার ম্যাকেন থেকে শুরু এই কালের অনেক ভালো লেখকদের বইও পড়ে ছেলেটা।
“আমার ছেলেকে ডাকব কি?” বললেন হক সাহেব।
“না তার আর দরকার হবে না।”
হুট করে আমার চোখে পড়ল সামনের দিকে একটা টেবিলে রাখা একগাদা খাতার স্তূপ।
“আপনার ছেলে কি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে?” ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“নাহ! আজ দু’বছর হয়ে গেল ও আর পড়াশোনা করে না,” হতাশ কণ্ঠে জবাব দিলেন ভদ্রলোক।
“আচ্ছা, তবে ওই খাতাগুলো কীসের?”
“ওগুলো? ও কবিতা-টবিতা লেখে!”
“কবিতা!”
সানরাইজ হাউজিং এর সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আমরা মানে আমি, এনাম আর তৌহিদ সাহেব। তখন প্রায় সন্ধ্যা হতে চলেছে।
এমন সময় দেখতে পেলাম সামনে দিয়ে হেঁটে আসছে আফ্রিতা নামের সেই মেয়েটা।
“কেমন আছেন তৌহিদ ভাই?” তৌহিদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল সে।
“ভালো আছি গো চন্দ্র, তুমি ভালো?” বললেন তৌহিদ সাহেব।
“এইতো!”
“চন্দ্র! এটা আবার কেমন নাম?” ভাবতে ভাবতে বিরক্তি নিয়ে তৌহিদ সাহেবের দিকে তাকালাম আমি। আর তাকিয়েই চমকে উঠলাম। ভদ্রলোকের চোখে কেমন যেন একটা শূন্য দৃষ্টি। পকেটে হাত দিয়ে কী যেন একটা বের করলেন তিনি। একটা ট্যাবলেট! সেটা খেয়ে নিয়ে খোসাটা একপাশে ফেলে দিলেন তিনি।
“আমার শরীরটা ভালো লাগছে না স্যার, আমি যাই,” এই বলে সোজাসুজি ঘুরে হাঁটা শুরু করলেন তিনি।
“তো, খুনীকে পেলেন?” আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল আফ্রিতা।
“এখন পর্যন্ত না। কফি খাবেন?” রাস্তার অপরপাশের কফিশপটা দেখিয়ে বললাম আমি।
“খাওয়া যায়! তবে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে ফ্ল্যাটে। বোঝেনই তো মা-বাবা ভয় পায়। আজকাল যে হারে মেয়েরা খুন হচ্ছে!” আফ্রিতার মুখে নির্মল হাসি।
“স্যার, আমি বাড়ি যাই তবে, আজকের মতো এইটুকুই থাক কাজ তবে, নাকি?” আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিকে হাসল এনাম।
“আসতে পারি?” কফিশপের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে বললাম আমি।
“আসুন স্যার, আসুন!” এই বলে সরে গেলেন তিনি।
একটা টেবিলে বসলাম আমি আর আফ্রিতা।
“আপনি কফিশপে ঢুকতেও অনুমতি নেন? আপনার মতো ভদ্র পুলিশ অফিসার আমি আগে দেখিনি!” আফ্রিতা কণ্ঠে বিস্ময়।
“সীমাবদ্ধতা,” উদাস কণ্ঠে বললাম আমি।
“মানে?”
“মানে কিছু না, অর্ডার দিন। আমি কফি সম্পর্কে কম বুঝি।”
অর্ডার দিয়ে দিল আফ্রিতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে গেল কফি।
“আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?” আফ্রিতার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
“অবশ্যই!”
“আপনার চন্দ্র বলে কি কোন নিকনেম আছে নাকি?”
“আরে না না!”
“উমম তবে তৌহিদ সাহেব যে ডাকলেন!”
“ওহ উনি! উনি এভাবেই ডাকেন।”
“এভাবে তো কোন মেয়েকে তার বয়ফ্রেন্ড ডাকে!” ভ্রু কুঁচকে গেল আমার।
“না না তেমন কিছু না! আসলে না উনি সন্ধ্যার পর কেমন যেন হয়ে যান আর এই সময়ে সামনে পড়া সব মেয়েকেই উনি চন্দ্র বলে ডাকেন! কেউ জানে না কেন উনি এমনটা করেন!”
“ওহ আচ্ছা!”
“আপনার ব্যাপারে পেপারে পড়েছি আমি।”
“তাই? কী পড়েছেন?”
“সেরা ভ্যাম্পায়ার হান্টার আতিক! অব্যর্থ!”
“ওসব ওরা বেশী লেখে!”
“আচ্ছা রাজশাহীতে ছুটি কাটাচ্ছেন শুনলাম, তা পরিবারকে নিয়ে আসেননি কেন?”
“পরিবার নেই! বাবা-মা বহু আগেই মারা গেছেন!”
“বিয়ে?”
“এখনও করিনি!”
“এত বয়স হয়ে গেছে তাও কেন বিয়ে করেননি?” এই বলেই ফিক করে হেসে ফেলল আফ্রিতা।
“এতদিন পছন্দের কোন মেয়ে পেয়েছিলাম না তাই!”
অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল আফ্রিতা। লাল হয়ে উঠল ওর গালদুটো। তারপর একটা সময়ে চোখ নামিয়ে নিল ও।
“জানেন, মেয়েরা আজকাল বের হতে ভয় পাচ্ছে, ওই খুনীর ভয়ে! ব্যাপারটা কেমন যেন! আমাদের ছোট শহরে এইসব কী শুরু হল!” কিছুক্ষণ পর বলে উঠল আফ্রিতা।
“আপনার ভয় করে না?”
“নাহ। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না।”
আফ্রিতাকে বিদায় জানানোর পর আবার সেই জায়গাতে গেলাম যেখানে ওষুধের খোসাটা ফেলেছিলেন তৌহিদ সাহেব।
খোসাটা তখনও সেখানে পড়ে ছিল। সেটা তুলে পকেটে ভরে নিলাম আমি। তারপর ফোন করলাম এনামকে।
“কী স্যার, ডেটিং শেষ?” ফোন ধরে হাসতে হাসতে বলল এনাম।
“হাহা...দেখা যাক, শোন এনাম। তূর্যের ব্যাপারে খোঁজ নাও। ওর স্কুল, কলেজ আর ভার্সিটি জীবনের ব্যাপারে। তোমাকে বলতাম না, তবে আমাকে আরও এক জনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। তাই এই দায়িত্বটা তুমিই পালন কর।”
“বিশেষ কিছু স্যার?”
“এমনিই।”
“হয়ে যাবে স্যার।”
পরের দিন সকাল দশটার দিকে গাড়ি নিয়ে এল এনাম।
“তো কাজ কত দূর?” ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললাম আমি।
“খবর পেলাম। আপনার কাজ কত দূর?” পাল্টা চোখ টিপে উত্তর দিল এনাম।
“হুম খোঁজ পেয়েছি, বেশকিছুই জেনেছি। তবে নামটা এখনই তোমাকে বলতে পারছি না, সিলি গেস হয়ে যাচ্ছে কিছুটা, লাকি গেসও হতে পারে, কে জানে?”
“আরে ধুর স্যার! ওই কাজের কথা কে বলছে?”
“তবে কোন কাজ?”
“ওই আফ্রিতা নামের মেয়েটার কী খবর?”
“আরে ধুর! তূর্যের ব্যাপারে কী জানলে বল।”
“হাহাহা...আচ্ছা স্যার, ছেলেটা স্কুল আর কলেজ জীবনে ছাত্র হিসাবে মধ্যম গোছেরই ছিল। তবে গোটা শহরে ওকে বিখ্যাত করে তুলেছিল ওর অ্যাথলেটিজম। ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল, ভলিবল যে খেলাই বলুন না কেন! ও সবগুলোতেই সেরা ছিল। ভার্সিটির সবগুলো টিমেরই ক্যাপ্টেন ছিল সে। ওই যে আফ্রিতা মেয়েটা আছে না? ওর সাথে...”
“কী? রিলেশন?”
“আপনি দেখছি ভয় পাচ্ছেন স্যার!”
“আরে না না! বলে যাও।”
“আফ্রিতার সাথে একই ডিপার্টমেন্টে পড়ত ছেলেটা... এইটুকুই। ছেলেটার প্রেম সংক্রান্ত কোন তথ্য জানতে পারলাম না। ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকেই সম্ভবত ওর এই অবস্থা!”
“হুমম, তূর্য আমাদের সেই খুনী নয় বলেই মনে হচ্ছে এনাম!”
“আপনি যার খোঁজ নিয়েছেন তার ব্যাপারে কী ভাবছেন?”
“তেমন কিছুই না! একটা ছোট্ট সূত্র ধরে এগোচ্ছি। দেখা যাক কী হয়। আজকে তারিখ কত যেন?”
“৩ জুলাই স্যার! আপনার ছুটি সম্ভবত কাল শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাই না?”
“ছুটি আর কই? কাল তো কাজ করেই কাটালাম আর আজও তেমনই হবে মনে হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, ৫ তারিখে আমাকে ঢাকাতে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছিল। তবে সে সময় বাড়ান যাবে। কেসের কাজ শুরুই করলাম কাল!”
“সেটাই স্যার, এখন কোথায় যাবেন?”
“সানরাইজ হাউজিং চল।”
“হেহেহে স্যার, জানতাম ওখানেই যেতে বলবেন!” খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল এনাম।
“আরেহ আপনারা!” আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন তৌহিদ সাহেব।
“এলাম আবার!” হাসতে হাসতে বললাম আমি।
“কোন সূত্র পেয়েছেন কি?”
“তেমন কিছু না, রুটিন ঘোরাঘুরি। তা কোথায় যাচ্ছেন?”
“আর বলবেন না। একটা বেসরকারী কলেজে প্রভাষকের চাকরী করি, সেখানেই যাচ্ছি।”
“বেশ বেশ, কোন বিষয়ের প্রভাষক আপনি?”
“বাংলা!”
ঠিক তখনই আমাদের পাশে চা-পানরত দুই যুবকের মধ্যে একটা বেশ মারামারির মতো অবস্থা হয়েছে। দুজনই দুজনের কলার এটে ধরেছে, বর্ষণ করে যাচ্ছে একাধিক অশ্রাব্য গালি।
এনাম আজ আবার পুলিশের ইউনিফর্ম পরে নেই। তাতে কী? এগিয়ে গিয়ে আইডি দেখাল সে আর তাতেই সেই দুই যুবক ঠান্ডা। কেটে পড়ল তারা।
“চ খুব রহস্যময় অক্ষর, তাই না এনাম সাহেব?” এনামের দিকে তাকিয়ে বললেন তৌহিদ সাহেব।
“কী রহস্য? ধুস!” এনামের কণ্ঠে বিরক্তি।
“দেখুন আমাদের বাঙালিদের বেশীরভাগ গালিগুলোই কিন্তু চ বর্ণটি দিয়ে শুরু হয়! আবার হয়ত কারও জীবনের রহস্যও লুকিয়ে আছে চ তে! তাই না?” এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ভদ্রলোক।
“তা তো বটেই,” অবাক হয়ে বললাম আমি।
কোন দিকে না তাকিয়ে আমাদের দিকে পিছন ঘুরে হাঁটা শুরু করলেন ভদ্রলোক!
“ভদ্রলোকের বেশ কাব্যিক একটা মন আছে, কী বল এনাম,” বলে উঠলাম আমি।
“ওই দেখেন আপনার কবিতা আসছে!” হাসতে হাসতে বলল এনাম।
সোজা তাকালাম। দেখলে পেলাম আফ্রিতাকে। সাইকেল নিয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। আর ওর পাশে হাত নেড়ে ওকে কী যেন বোঝাতে বোঝাতে এগিয়ে আসছে তূর্য।
আমাকে দেখেই হাসি ফুটে উঠল আফ্রিতার মুখে।
“হাই,” বলে উঠল সে।
“হাই, কী খবর?” বললাম আমি।
“এইত ভার্সিটিতে যাচ্ছি, মাঝরাস্তাতে তূর্য ধরে বসল। ভ্যাম্পায়ারের কাহিনী শোনাচ্ছে। শুধু শোনাচ্ছেই না, ও চায় এইসব কাহিনী আপনাকেও আমি বলি!”
“তাই নাকি তূর্য সাহেব, কেমন আছেন আপনি?” হেসে উঠলাম আমি।
“এইত ভালো, উনি আমাকে কিছু বলবেন না তো?” এনামের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলে উঠল তূর্য।
“আরে না না, আপনি বলুন,” অভয় দিয়ে বললাম আমি।
“স্যার! আমি শুনেছি আপনি অনেক বড় ভ্যাম্পায়ার হান্টার। মারছেন না কেন আমাদের শহরের এই ভ্যাম্পায়ারটাকে? আমার খুব ভয় করছে!” হড়বড়িয়ে বলে ফেলল তূর্য।
“হুমম, আসলে কাজটা যে কোন ভ্যাম্পায়ারের তার প্রমাণ এখনও পাইনি। আর সত্যিই যদি খুনী ভ্যাম্পায়ার হয় তবে তাকে মেরে ফেলার এখতিয়ার আমার আছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রথমে তাকে খুঁজে বের করতে হবে আমার। সেটাই তো পারছি না!”
“আচ্ছা শোনেন, আপনারা কথা বলেন, আমার ক্লাস আছে,” এই বলে সাইকেলে চড়ে বসল আফ্রিতা।
“খুব ব্যস্ত নাকি আজকে?” হেসে বললাম আমি।
“তা নয়, তবে কফি সন্ধ্যার আগে খেতে পারব না,” এই বলে সাইকেলে প্যাডেল মারতে শুরু করল আফ্রিতা।
“সাবধানে যাস আফ্রিতা! রাস্তাতে ভ্যাম্পায়ার না ধরে বসে!” এই বলে চিৎকার করে উঠল তূর্য।
বালিয়াপুকুরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমি আর এনাম। পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করার জন্যই মূলত এই কাজটা করা। ছোটবেলাতে আমার খুব প্রিয় রাস্তা ছিল এটি।
“এই যে ইন্সপেক্টর আতিক,” নারীকণ্ঠের ডাক শুনতে পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। দেখতে পেলাম ডা. নুসরাতকে। আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন তিনি।
“যাক ভালোই হল, আপনাদের পেয়ে গেলাম। শোনেন আগামীকাল ৪ই জুলাই আমার জন্মদিন, আপনারা সন্ধ্যার পরই বাসায় চলে আসবেন,” হাসতে হাসতে বললেন ডা. নুসরাত।
“ম্যাডাম আমরা আপনার বাড়ির ঠিকানাই জানি না!” দাঁত বের করে হেসে বলল এনাম।
“আরে ওই দেখুন। ওইযে ৮৮ নম্বর বাড়িটা। ওটাই আমার বাড়ি!”
“আপনার সাথে একটু কাজ ছিল ডা. নুসরাত,” বলে উঠলাম আমি।
“কী কাজ?” ডা. নুসরাতকে কিছুটা বিরক্ত মনে হল।
“এখন বলাটা কি ঠিক হবে? আপনাকে আজ অফিসে পাব কখন?”
“অফিসে আজ আমি আর যাব না। জমে থাকা ছুটিগুলো সব কাজে লাগাচ্ছি। আজ থেকেই ছুটি নিলাম। ফিরব ২০ তারিখের পর।”
“এত লম্বা ছুটি?”
“আগামী চৌদ্দ তারিখে আমার বিয়ে তো। তাই আরকি।”
“আচ্ছা, তবে কথাটা কি এখনই বলা যাবে?”
“বলুন।”
“আচ্ছা ডা. নুসরাত ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পর্কে ছোট্ট করে একটা ব্রিফ দিন তো আমাকে।”
“হঠাৎ?”
“দরকার আছে।”
“আচ্ছা, আজ থেকে একশো বছর আগেও ক্যান্সার একদমই জীবনঘাতি একটা রোগ ছিল। এখনও ফাইনাল স্টেজে তাইই। তবে ইনিশিয়াল এবং মিডল স্টেজের ক্যান্সার এখন খুব সহজেই ভালো করা যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতেই এখন এর চিকিৎসা আছে।”
“ক্যাপেসিটাবিন ওষুধটা কেমন কাজে লাগে?”
“ওই ওষুধটা? ওটা তো প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে আমাদের দেশে নিষিদ্ধ। বাইরের কিছু দেশে পাওয়া যায়। ফাইনাল স্টেজের ক্যান্সারে যন্ত্রণা নিরাময়ে বেশ কাজে লাগে ওটা।”
“হুম...ওকে ধন্যবাদ ডক্টর!”
“কথা শেষ?”
“হুমম!”
“আচ্ছা, কাল তবে আসছেন, নাকি?”
“হু আসব।”
সন্ধ্যা হবে হবে অবস্থা। সারাদিন হেঁটে হেঁটেই পার করে দিয়েছি। তেমন কোন কাজই হল না।
“এনাম তুমি তবে বাড়ি চলে যাও, আমাকে তো আবার...”
“চার্চ রোডে যেতে হবে, তাই না স্যার?” হাসতে হাসতে বলল এনাম।
“আহা! এভাবে রিডিকিউল না করলেও তো পারো!” মৃদু হেসে বললাম আমি।
পরের দিন পুরোটা সকালই আমার আর এনামের কেটে গেল স্কুল আর কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করতে করতে।
এই ছাড়া আর করারই বা কী আছে? কোন সূত্র নেই! যে আলো ধরে এগোচ্ছিলাম তাও কেমন যেন হয়ে গেছে।
বেলা বারোটার দিকে এনামকে পাঠালাম ডা. নুসরাতের জন্য গিফট কিনে আনতে।
ও আসার পর দেড়টার দিকে বসলাম কেস নিয়ে আলোচনা করতে।
“আচ্ছা, স্যার আপনি কি এখনও মনে করেন যে খুনগুলো কোন মানুষ করেছে?”
“উমম... আচ্ছা তোমাকে খুলেই বলি। তবে এই ব্যাপারে কাউকে বলবে না ঠিক আছে? অ্যাটলিস্ট কেস সমাধান হওয়ার আগে তো নয়ই!”
“ঠিক আছে স্যার,” উৎসাহ দেখা দিল এনামের চোখে মুখে।
“ক্যাপেসিটাবিন নামে একটা ওষুধ আছে, যেটা বহু বছর আগে ক্যান্সারের ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হত।”
“হ্যাঁ, ডা. নুসরাত বললেন।”
“আমি নেট ঘেটে জানতে পেরেছি যে ঐ ওষুধ নিয়মিত খেলে আঙ্গুলের কোন ছাপ পড়ে না!”
“মানে কী স্যার! মানে খুনী ক্যাপেসিটাবিন খায়? কে সে? তূর্য?”
“আমি বলেছিলাম না একজনের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি? সেই একজন হলেন তৌহিদ সাহেব।”
“উনি!”
“হ্যাঁ! উনি সন্ধ্যার পর সব মেয়েকেই ‘চন্দ্র’ বলে ডাকেন। উনার ভার্সিটিতে পড়ার সময়ে একজন প্রেমিকা ছিল, যাকে তিনি ওই নামে ডাকতেন। উনি কিন্তু এককালে কবিতাও লেখতেন। ওই মেয়েটা উনাকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই উনার এই সমস্যা দেখা দেয়।”
“কী সমস্যা?”
“এটা এক ধরণের মানসিক সমস্যা, যেটা সন্ধ্যার পর হয়ে থাকে। সন্ধ্যার পর রোগীর কাছে অনেক মানুষেরই মুখই সেই মানুষটার মতো মনে হয় যার কথা সে ভাবছে!”
“মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে তৌহিদ সাহেব এই রোগে আক্রান্ত? তো? তাতে কিছুই তো প্রমাণ হয় না!”
“শুধু তাই নয়, সেদিন তৌহিদ সাহেব একটা ওষুধ খেয়ে খোসাটা ফেলেছিলেন। এই দেখ,” বলে ওষুধের খোসাটা এনামের দিকে বাড়িয়ে দিলাম আমি।
“ক্যাপেসিটাবিন!” অবাক হয়ে বলল এনাম।
“হুম! উনি সম্ভবত ফাইনাল স্টেজের ক্যান্সারে আক্রান্ত!”
“মানে উনিই কি...?”
“এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।”
“স্যার আমাদের এখনই তৌহিদ সাহেবের বাড়িটা একবার ভালো করে তল্লাশি করা উচিত,” উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল এনাম।
“মানে কী? লাভ হবে?” অবাক হয়ে বললাম আমি।
“তা জানি না, তবে আমার মাথায় একটা ব্যাপার এসেছে! চলুন স্যার!”
দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে তৌহিদ সাহেবের বাড়িতে দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করেছি আমি আর এনাম।
তৌহিদ সাহেবকে ফোন দিয়ে পাওয়া যায়নি। উনার মোবাইল বন্ধ। এনামের জোড়াজুড়িতেই দরজাটা ভাঙ্গা হয়েছে।
তবে সন্দেহজনক তেমন কিছুই পেলাম না।
“কিছুই তো নেই এনাম! শুধু শুধুই দরজা ভাঙ্গলাম!” তৌহিদ সাহেবের শোবার ঘরে দাঁড়িয়ে উদাস কণ্ঠে বললাম আমি।
“স্যার উনার খাটের নিচটা একবার দেখতে চাই আমি,” এই বলে নিজেই খাটের নিচে ঢুকে পড়ল এনাম।
কিছুক্ষণ পর একটা কাগজ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল সে।
“কী এটা?” জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
কিছু না বলে কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিল এনাম।
বিরক্ত হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন ডা. নুসরাত। এই সময়ে কে এল আবার? সবার তো সন্ধ্যার পর আসার কথা।
দরজা খোলার সাথে সাথেই চমকে গেলেন তিনি!
চমকের ভাবটা ভাঙ্গার সাথে সাথেই আগন্তুকের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করতে গিয়েও আর পারলেন না তিনি। ততক্ষণে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে সে।
“মেয়ে? আমাকে মনে পড়ে?” এই বলে কুৎসিতভাবে হাসতে লাগল আগন্তুক।
“লেখার হাত তো বেশ ভালোই মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের, তা এই দিয়ে কী প্রমাণ হয়?” কাগজটা নামিয়ে রেখে বললাম আমি।
“চ এর ফাঁদ স্যার। চ তে চার, চ তে চৌদ্দ। এবার দেখুন তো, ডা. নুসরাতের দুটো বিশেষ দিনের সাথে মিলছে না? সেই তারিখ যেটা উনার জন্মদিন আর সেই তারিখ যেদিন উনার বিয়ে হবে।”
“বুঝলাম না!”
“মানে ৪১৪৪৪ কে আমরা একচল্লিশ হাজার চারশত চুয়াল্লিশ এইভাবে কেন দেখছি? এটাকে যদি আমরা চার, চৌদ্দ, চুয়াল্লিশ এইভাবে দেখি? তবে?”
“হাহাহা! তবে চুয়াল্লিশ মানে কী?”
“সেটাই তো স্যার!”
হুট করে যেন বিদ্যুৎচমক খেলে গেল আমার মনে!
“এনাম, ডা. নুসরাতের বাড়ির নম্বরটা যেন কত?”
“৮৮ স্যার!”
“ইংরেজী 88 মানে বাংলা ৮৮!”
“মাই গড স্যার!”
“আরেকটা ব্যাপারটা! ডা. নুসরাতের ডাকনাম হল মুন! মুন মানেই তো চন্দ্র!”
“ওহ গড!”
“চারটা বাজতে আর কত দেরী আছে এনাম?”
“আধা-ঘন্টা স্যার,” ঘড়ি দেখে বলল এনাম।
“আমাদের এখনই বের হতে হবে, তুমি ফোর্স রেডি কর,” উঠে দাঁড়ালাম আমি!
হুড়মুড়িয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম ডা. নুসরাতের বাড়িতে।
যা ভেবেছিলাম তাই! এক অদ্ভুত মুখোশধারীর সাথে ধস্তাধস্তি করছেন তিনি!
“ওখানেই দাঁড়ান তৌহিদ সাহেব! আপনার সব খেলা শেষ!” এই বলে পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরলাম আমি।
কিছুক্ষণের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেল মুখোশধারী। তারপর টান মেরে মুখোশটা খুলে ফেলল সে। আমাদের দিকে ঘুরে তাকালেন তৌহিদ সাহেব।
ডা. নুসরাত ততক্ষণে দৌড়ে এসে আমার বামহাত চেপে ধরেছেন।
“ধরেই ফেললেন আমাকে?” উন্মাদের মতো হাসতে লাগলেন তৌহিদ।
“চ এর ফাঁদ! এনামকে ধন্যবাদ দিতে পারেন! ওর কারণেই ব্যাপারটা মাথায় এসেছে!”
“তাই না? ধন্যবাদ এনাম সাহেব!” এই নিজের পকেটে লুকিয়ে রাখা ছুরিটা বের করে নিজের পেটে বসিয়ে দিলেন তৌহিদ!
তৌহিদ সাহেব মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমরা সবাই ভ্যাবদার মতো চেয়ে রইলাম। যেন কোন অদ্ভুত ইন্দ্রজাল গ্রাস করেছে আমাদের।
তারপর হুট করে একজন কন্সটেবল ঘিরে দাঁড়াল তৌহিদ সাহেবের নিস্তেজ দেহটার দিকে।
“উনাকে দেখুন ডা. নুসরাত! এখনই!” চিৎকার করে উঠলাম আমি।
তৌহিদ সাহেবের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, এনাম, ডা. নুসরাত আর ওসি মুনতাসির। বাঁচান যায়নি উনাকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত দুর্বল শরীরটা আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ধকল নিতে পারেনি।
“এই তাহলে খুনী? কোন ভ্যাম্পায়ারের কাজ না?” অবাক হয়ে বললেন মুনতাসির।
“এনামের মাথায় ব্যাপারটা না খেললে আমরা ধরতেই পারতাম না!” বললাম আমি।
“তৌহিদ! ও একটুও বদলায়নি!” দাঁতে দাঁত চেপে বললেন ডা. নুসরাত।
“আপনিই তবে উনার সেই চন্দ্র?” বলে উঠল এনাম।
“হ্যাঁ আমিই! ভার্সিটির শুরু থেকেই প্রেম ছিল আমাদের। কিন্তু একটা সময়ে আমি আর ওর সাথে মানিয়ে চলতে পারিনি। তবে এটা আমি সবসময় মেনে নিয়েছি যে বেচারা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসত।”
“সম্ভবত আপনার বিয়ের খবর উনি কারও কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সেজন্যই উনার এমন উন্মাদ হয়ে ওঠা!”
“আমার না এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে তৌহিদ ওই মেয়েগুলোকে মেরেছে! ওর ক্যান্সার হয়েছিল সেটাও জানতাম না!” কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ডা. নুসরাত।
“উনি মারতে চেয়েছিলেন আপনাকে! কিন্তু রাতের বেলা উনি সব মেয়েকেই আপনি মনে করতেন!” বললাম আমি।
“কিন্তু ওই কাগজগুলো? ওটা তৌহিদের লেখা না! ওর লেখা চিনি আমি! ওর লেখা অনেক চিঠি এখনও আছে আমার কাছে!”
“এটা আমি বলছি। সম্ভবত উনি লেখাগুলো অস্পষ্ট করার জন্য বামহাত দিয়ে ওটা লেখতেন। যাতে করে মানুষ মনে করে যে কোন অপটু হাতে ওগুলো লেখা হয়েছে। আর ৪১৪৪৪ সংখ্যাটা উনি প্রতিটা মেয়েকে খুন করার পরেই লেখতেন। ‘আজ রাতটা শুধু তোমারই জন্য’ কথাটা আগেই লিখে আনতেন কাগজে।”
“আমার জন্য এতগুলো মেয়ের প্রাণ গেল!”
“দেখুন তো এই লেখাটা আপনি চিনেন কি?” এই বলে তৌহিদ সাহেবের ঘরে পাওয়া কাগজটা ডা. নুসরাতের হাতে তুলে দিলাম আমি।
“হ্যাঁ এটা ওরই লেখা!” বললেন ডা. নুসরাত।
“রেখে দিন ওটা, ওটা সম্ভবত আপনার উদ্দেশ্যেই লেখা! এনাম এস।” এই বলে হাঁটতে শুরু করলাম আমি।
“মি. খান, কেস কি তবে ক্লোজড?” পেছন থেকে বলে উঠলেন ওসি মুনতাসির।
“হ্যাঁ! কালকেই ঢাকা ফিরে যাব আমি।”
“আর কোন মৃতদেহ পাওয়া যাবে না আপনি নিশ্চিত?” ওসির গলাতে শংকা।
“যদি পান তবে মনে করবেন মৃত্যুর আগেই হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছেন তৌহিদ সাহেব,” এই বলে হাঁটা শুরু করলাম আমি। আমার পিছে পিছে আসতে লাগল এনাম।
পেছন থেকে শুনতে পেলাম ডা. নুসরাত আবৃত্তি করার মতো করে পড়ছেন সেই কাগজটায় লেখা কথাগুলো:
“মেয়ে, হয়ত আর কিছু দিন, হয়ত কিছু মাস কিংবা কিছু বছর পর আসবে সেই রাত...
“তোমার সাথে কাজ করতে ভালোই লাগল এনাম,” হাসিমুখে বললাম আমি।
“আমারও স্যার। আপনার কথা সারাজীবন মনে থাকবে আর ফেসবুকে তো অ্যাড থাকলামই! জটিল কেস নিয়ে মাঝেই মাঝেই জ্বালাব কিন্তু, হাহাহা!”
“কী বলেছিলাম? অনেক জটিল কেস দেখবে হুট করেই সমাধান হয়ে যায়! এটা যেমন হয়ে গেল!”
“তারপরেও স্যার! আপনার পরামর্শ আমি নেবই!”
“তা বেশ! থাক তবে? আমাকে আবার একটু...”
“চার্চ রোডে যেতে হবে? হাহাহা!”
“রিডিকিউল না করলেও তো পার!”
৪, খুব রহস্যময় একটি সংখ্যা! বলা হয়ে থাকে মানুষের পরিচিত তিনটি মাত্রা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতাকে মানুষ বিবেচনা করে চলে। কিন্তু আরেকটি মাত্রা, মানে সময়কে কেন বিবেচনা করে না? কারণ সময়কে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না! পারে না সময়ের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে। ভ্যাম্পায়ারেরা কিন্তু পারে! তাই চার সংখ্যাটি দিয়ে বোঝায় সময়!
১৪, প্রাচীন শালজমদের চৌদ্দ নম্বর দেবতা ছিলেন খানপো। খানপোকে তুষ্ট করতে বুকের রক্ত উৎসর্গ করতে হতো!
৪৪, ফোরটি ফোর লেগিওনস ওফ হেল! এরা এক অদ্ভুত প্রজাতির ডিমন যাদের রাজা সলোমন নিজেকে একটি বাক্সে বন্দী করে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। কারণ এরা সবাই মানুষের রক্ত খেত! এই সলোমনকেই মুসলমানেরা বলে সুলায়মান(আ)।
৪১৪৪৪ এর আসল অর্থ এই! কাকতালীয় ভাবে ডা. নুসরাত আর তৌহিদ সাহেবের সাথে মিলে গেছে! এনামকে সত্যিকার অর্থেই ধন্যবাদ।
এই শহরের একটা বৈচিত্র দরকার ছিল! আর সেজন্যই এই খুনগুলো হওয়ারও দরকার ছিল। অনুতাপের কোন ব্যাপার এখানে নেই।
“হাই!” বলে উঠল কে যেন।
আমি ঘুরে দেখি আফ্রিতা দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেল থেকে নেমে গেছে সে।
“হাই! কী করছেন আজ?” বলে উঠলাম আমি।
“কফি খাওয়া যাবে!” হাসতে হাসতে বলল আফ্রিতা।
“চলুন তবে কফিশপে!”
এই কফিশপটা বেশ বড় এবং অভিজাত ধরনের। রোবট প্রহরী নিয়োগ করা হয়েছে।
“আসতে পারি?” রোবট প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“যেতে পারেন স্যার!” যান্ত্রিক কণ্ঠে উত্তর দিল সে।
“আপনি এত্ত ভদ্র কেন? অনুমতি না নিয়ে কোথায় ঢোকেন না?” হাসতে হাসতে বলল আফ্রিতা।
“সীমাবদ্ধতা!”
“মানে?”
“মানে কিছুই না, আজ চলুন আমরা একসাথে ডিনারও করি, সময় হবে আপনার?”
“আমার সময় আছে, আপনার কোন কাজ নেই তো? কেস?”
“কেস সলভড! কালকের পত্রিকাতেই দেখতে পাবেন সব!”
“আচ্ছা তবে আপনি ফ্রী?”
“একদম! আজ রাতটা শুধু তোমারই জন্য!” এই বলে আফ্রিতার হাতটা ধরলাম আমি।