ধরণী রসাতলে - সুদীপ দেব

কল্পবিজ্ঞানের গল্প

সেই রহস্যময় বাগানবাড়ি

পাহাড়ের কোলে অত্যন্ত দুর্গম জায়গায় এরকম নির্জন বাগানবাড়ি কে বানিয়েছে? কেউ কি আদৌ থাকে ওখানে? থাকলেও বা যাতায়াত করে কীভাবে? যতদূর চোখ যায় কোনও রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। চারিদিকে উঁচু পাঁচিলঘেরা ওই বাগানবাড়ি স্বাভাবিকভাবেই আমার কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছে। জায়গাটা দক্ষিণ ক্রিমিয়ার সিমিজে। প্রথম দেখার পর থেকেই ওই রহস্যময় বাগানবাড়ির প্রতি আমি একটা আকর্ষণ অনুভব করছি। এর সীমানার আশপাশে কোনও বড় গাছ বা এমন কিছু নেই যার ওপরে উঠে ভেতরটা লক্ষ করা যায়। ইতস্তত কিছু বড় পাথর, জুনিপার ঝোপ আর পাইন গাছ ছড়িয়ে রয়েছে। ওই বাড়িতে ঢোকার একটিমাত্র দরজা সবসময় বন্ধ থাকে।

কয়েকদিন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেও কাউকে ওই বাড়ি থেকে বাইরে বেরোতে দেখিনি। ক্রমেই আমার কৌতূহল বেড়েই চলেছে। অনেক খুঁজে একটা বড় পাথরের ওপরে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে উঠে শুধু ভেতরে উঠোনের একটা কোণ দৃষ্টিগোচর হল। একইরকম জনহীন নিস্তরঙ্গ সেই স্থান।

কয়েকদিন এরকম নজর রাখতে রাখতে একসময় কালো পোশাক পরা এক ভদ্রমহিলাকে ওই উঠোনে দেখতে পেলাম। এতে আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। কোনও মানুষ বাস করে মানে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনওভাবে সম্পর্ক রাখতে হয়। নিদেনপক্ষে বাজারহাট করতেও তো বেরোতে হবে রে বাবা!

সেইমতো আমি লোকালয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম। অবশেষে একটা ভাসাভাসা গুজব শুনলাম প্রফেসর ওয়াগনার বলে কেউ একজন থাকেন ওইখানে।

প্রফেসর ওয়াগনার!

এই খবর জানার পর ওই রহস্যময় বাগানবাড়ি সম্পর্কে আমার আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। ওই বিখ্যাত মানুষটি কোনও স্মরণীয় আবিষ্কার করতে চলেছেন কি? যদি তার কোনও আভাস পাই এই আশায় আমি ওই জায়গায় আরও ভালোভাবে আস্তানা গাড়লাম। কোথাও একটা মনে হচ্ছে, যা করছি হয়তো তা ঠিক নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিনে-রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝোপের আড়াল থেকে ওই বাড়ির চৌহদ্দিতে নজর রাখার ব্যাপারটাও এড়াতে পারছি না।

কথায় আছে, যদি লক্ষ্যে অবিচল থাকো তবে সাফল্য মিলবেই।

একদিন ভোরে সূর্যোদয়ের ঠিক পরেই হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেলাম। আমি দম বন্ধ করে পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষা করতে লাগলাম।

দরজা খুলল। ধবধবে সাদা দাড়ি আর ঝুপো গোঁফওলা লালচে-ফর্সামুখো একজন দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় সন্তর্পণে চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বেরিয়ে এলেন। কোনও সন্দেহ নেই, ইনিই প্রফেসর ওয়াগনার।

আশপাশে কেউ নেই এটা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি সমতল ছেড়ে কিছুটা ওপরের দিকে উঠে এলেন। এরপর তিনি এক অদ্ভুত কাণ্ড করতে শুরু করলেন। চারিদিকে বিভিন্ন মাপের বেশ কিছু পাথর পড়ে রয়েছে। ওয়াগনার একটার পর একটা সেই পাথরগুলিকে তোলার চেষ্টা করতে লাগলেন। অদ্ভুত বলছি এই কারণেই যে, পাথরগুলির আকার বা ওজন এতটাই বেশী যে, কোনও প্রতিষ্ঠিত ওয়েট-লিফটারের পক্ষেও সেগুলি তোলা সম্ভব নয়।

ভাবছি, এ কী পাগলের কীর্তি! কিন্তু পরক্ষণেই চরম বিস্ময়ে আর্তনাদ করে উঠলাম। কী অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড! প্রফেসর ওয়াগনার একটা মানুষসমান পাথরের এক প্রান্ত ধরে এমনভাবে তুলে ফেললেন—যেন পাথরখণ্ডটা কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি। তারপর একহাতে সেটা নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলেন।

জানি না কীকরে সম্ভব হয় এমন অবাস্তব ঘটনা। হয় প্রফেসর ওয়াগনার একজন সুপারম্যানের মতো মহাশক্তিধর ব্যক্তি, অথবা—আমার চিন্তা শেষ হওয়ার আগেই প্রফেসর এমন আরেক কীর্তি করলেন যাতে আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

ওয়াগনার প্রস্তরখণ্ডটিকে একটা নুড়ির মতো ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিলেন, সেটা প্রায় ষাট ফুট ওপরে উঠে গেল। আতঙ্কিত হয়ে ভাবছিলাম এই বুঝি সশব্দে পাথরটা মাটিতে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, কিন্তু পাথরটা স্বাভাবিকের থেকে অনেক ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল, আর প্রায় মাটি ছোঁয়ার কিছু আগে ওয়াগনার তাঁর হাত প্রসারিত করে পাথরটাকে লুফে নিলেন।

“হা হা!” ওয়াগনার গমগমে স্বরে হেসে উঠলেন, তারপর পাথরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। পাথরটা কিছুদূর মসৃণভাবে গড়িয়ে গেল, তারপর হঠাৎ ভয়ানকভাবে লাফিয়ে উঠে সশব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

“হা হা!” ওয়াগনার আবার হেসে উঠলেন আর তারপরই একটা অমানুষিক লাফ দিলেন। প্রায় বারো ফুট বা তারও বেশী ওপরে উঠে তিনি আমার সমান্তরালে উড়ে আসতে লাগলেন। কিছুদূর আসার পর হয়তো গণনার ভুলেই হঠাৎ তিনি মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়লেন। ঠিক একটু আগে পাথরটা যেমন পড়েছিল তেমনিভাবেই। যদি খাদের দিকটায় পড়তেন তাহলে আর বাঁচানো যেত না। এখন তাঁর সঙ্গে আমার দূরত্ব সামান্যই। মাঝখানে শুধু এই জুনিপার ঝোপটা। মাটিতে পড়ে তিনি হাঁটু চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠলেন। একবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু আবার পড়ে গেলেন।

একটু ইতস্তত করে অবশেষে আমি ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলাম, “কোথায় লেগেছে বলুন? আমি কি সাহায্য করব?”

আমাকে দেখে প্রফেসর একটুও অবাক হলেন না। নির্বিকারভাবে বললেন, “না, ঠিক আছে, থ্যাঙ্ক ইউ। সামলে নিতে পারব।”

আবার তিনি ওঠার চেষ্টা করতেই যন্ত্রণায় তাঁর মুখ বেঁকে গেল। হাঁটুর কাছটা বেশ ভালোভাবেই ফুলেছে দেখতে পাচ্ছি। কারও সাহায্য ছাড়া উনি মোটেও হেঁটে যেতে পারবেন না। অবিলম্বে কিছু করা প্রয়োজন।

“ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে আমাকে ধরে উঠুন দেখি।”

এবার তিনি আর বাধা দিলেন না। একটু নড়তে গেলেই অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুঝতে পারছি। তাঁকে ধরে ধরে বাড়িটার দিকে নিয়ে চললাম। বিশাল ভারী শরীরটা বয়ে নিয়ে যেতে আমারও দম বেরিয়ে যাচ্ছে। তাও কোথাও যেন একটা প্রশান্তি অনুভব করছিলাম। তা শুধু প্রফেসর ওয়াগনারকে দেখতে পাওয়ার কারণে নয়, বরং এই যে তাঁকে কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারছি এটা ভেবে। সামনে তাকিয়ে দেখলাম দরজার কাছে চলে এসেছি। এবার হয়তো উনি আমাকে আর ভেতরে ঢুকতে দেবেন না। কিন্তু না, উনি কিছুই বললেন না। আর আমরা ম্যাজিক চৌকাঠ পেরিয়ে এলাম।

ওই চত্বরে ঢুকে আমি চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। চত্বরের ঠিক মাঝখানটায় একটা যন্ত্র দাঁড় করানো আছে। একধারে মোটা কাচের ঢাকনা দিয়ে আচ্ছাদিত একটা গোলাকার গর্ত দেখতে পাচ্ছি। ওই গর্ত থেকে বাড়ি পর্যন্ত কিছুদূর ছাড়া ছাড়া ধাতব অর্ধবৃত্তাকার হাতলের মতো কিছু বসানো রয়েছে।

ইতিমধ্যেই সেই কালো পোশাক পরা ভদ্রমহিলা—পরে জেনেছিলাম ইনি প্রফেসরের পরিচারিকা—বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং আমাদের দেখে এদিকে ছুটে আসছেন।

মায়াবৃত্ত

ওয়াগনারের অবস্থা বেশ খারাপ। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে, আর চলছে ক্রমাগত ভুল বকা। আশা করি সেই অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানার ফলে আঘাত লেগে প্রফেসরের মস্তিষ্কের কোনও ক্ষতি হয়নি।

বিড়বিড় করে কতরকম বৈজ্ঞানিক ফরমুলা আওড়াচ্ছেন আর মাঝে মাঝেই বিকট স্বরে আর্তনাদ করে উঠছেন। এদিকে সেই পরিচারিকা একইভাবে প্রলাপ করে চলেছেন “হায় ভগবান, এ কী হল? এ কী হল?”

বুঝতে পারলাম, আমাকেই প্রফেসরের প্রাথমিক চিকিৎসা আর শুশ্রূষার ব্যবস্থা করতে হবে।

পরের দিন সকালবেলা ওয়াগনার পরিষ্কারভাবে চোখ মেলে আমার দিকে তাকালেন। দুর্বল কিন্তু সম্পূর্ণ সচেতন কণ্ঠে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ।”

আমি একগ্লাস জল এগিয়ে দিলাম। তিনি জলটা নিয়ে মাথা নেড়ে আমাকে চলে যেতে বললেন। সারারাতের অনিদ্রা আর ক্লান্তির পর আমারও একটু বাইরে খোলা বাতাসে বের হয়ে আসতে ইচ্ছে করছিল। চত্বরের মাঝখানে দাঁড় করানো সেই কিম্ভুতদর্শন যন্ত্রটার দিকে আবার আমার চোখ গেল। আমি সেটার কাছে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরে দেখতে গেলাম।

“দাঁড়াও! আর এগিও না!” সেই ভদ্রমহিলার আর্তনাদ কানে এল। কিন্তু ততক্ষণে আমার হাতে কেউ যেন বিশাল ভারী একটা বস্তু চাপিয়ে দিয়েছে। অদৃশ্য সেই ওজনের ভারে শরীরশুদ্ধ সামনের দিকে ঝুঁকে এল, আমার হাত প্রায় মাটিতে মিশে যাওয়ার উপক্রম হল। অমানুষিক বল প্রয়োগ করে হাতটাকে ছাড়িয়ে আনলাম। হাতটায় কালসিটে পড়ে গেছে আর অসহ্য যন্ত্রণা!

ভদ্রমহিলা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রবল আতঙ্কে মাথা নাড়ছেন, “ওহ বাছা, বড় বাঁচা বেঁচে গেছ। একবার ওর মধ্যে গিয়ে পড়লে পুরো চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যেতে।”

হতভম্ব হয়ে আমি আবার ঘরে ফিরে এলাম। প্রফেসরকে এখন আরেকটু সতেজ দেখাচ্ছে।

আমার হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”

আমি ব্যাপারটা খুলে বললাম।

“একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছ।”

আমার অনেক প্রশ্ন ছিল, কিন্তু ওয়াগনারের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে নিবৃত্ত হলাম।

বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর প্রফেসরের ইচ্ছে অনুযায়ী ওঁকে জানালার ধারে নিয়ে এসে বসালাম। আমার কৌতূহল মেটাতে উনি নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন।

“বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। অনেকরকম সূত্র বা নীতিও আবিষ্কার হয়েছে, কিন্তু এই ধরণের শক্তির ওপর খুব কমই কাজ হয়েছে। যেমন ধর, বিদ্যুৎ বা মাধ্যাকর্ষণ। এদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা জেনেছি এবং সাধ্যমতো তাদের কাজেও লাগিয়েছি। কিন্তু তাদের প্রকৃতির আসল রহস্য এখনও অধরাই রয়ে গেছে। তাই এইসব শক্তির পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে আমরা পারিনি। বিদ্যুতের ওপর কিছুটা বেশী নিয়ন্ত্রণ অবশ্য এসেছে। আমরা তাকে সঞ্চয় করতে পারছি, পরিবহন করতে পারছি, আমাদের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে পারছি। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণশক্তির ওপর এখনও সেভাবে নিয়ন্ত্রণ আনা যায়নি। আমাদের দরকারে এই শক্তি ব্যবহার করার পরিবর্তে আমরা নিজেরাই এর মর্জিমতো চলি। যদি বিদ্যুতের মতো এই শক্তিকেও আমাদের ইচ্ছেমতো চালনা করতে পারি, তবে কী অসাধারণ ব্যাপার হবে একবার ভাবো। মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে বশে আনাই হল আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন।”

“আর আপনার সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে। তাই তো!” হঠাৎ যেন পুরো ব্যাপারটাই আমি বুঝতে পেরে গেলাম।

“ঠিক তাই। আমি এমন এক উপায় আবিষ্কার করেছি যার দ্বারা মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তুমি আমার প্রাথমিক সাফল্য নিজের চোখেই দেখেছ। আর তার ফলে কী হল সেটাও।” ওয়াগনার তাঁর জখম হাঁটুতে হাত বুলিয়ে বললেন, “পরীক্ষামূলকভাবে একটা ছোট্ট জায়গায় আমি মাধ্যাকর্ষণ কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। কত সহজেই বড় বড় পাথরগুলিকে তুলে নিতে পারছিলাম সেটা তো দেখলে। ঠিক এর বিপরীত ব্যাপারটা আছে চত্বরের ওই জায়গাটায় যেখানে আর একটু হলে তুমি ঢুকে পড়ে নিজের জীবন খোয়াতে চলেছিলে। ‘মায়াবৃত্ত’।”

জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বললেন, “ওই দেখ, ওই পাখির ঝাঁক এদিকেই আসছে। যদি এদের মধ্যে একটাও ওই মায়াবৃত্তে ঢুকে পড়ে...”

প্রফেসর চুপ করে গেলেন। আর আমি রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় দেখলাম পাখির ঝাঁক উড়ে চত্বরের ঠিক ওপরে চলে এসেছে। হঠাৎ তাদের মধ্যে একটা পাখি ঠিক পাথর পড়ার মতো টুপ করে খসে পড়ল মায়াবৃত্তের ভেতরে। শুধু খসে পড়াই নয়, পড়ে একেবারে কাগজের থেকে একটু মোটা আকারের আক্ষরিক অর্থেই ছবি হয়ে গেল।

“দেখলে?”

একই জিনিস আমারও হতে পারত এই ভেবে আমি ভয়ে বিহ্বল হয়ে গেছিলাম। আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই তিনি বললেন, “হ্যাঁ। তোমার নিজের মাথার ভারেই তুমি প্যানকেক হয়ে যেতে।” একটু হেসে বলে চললেন, “ফিমা, আমার পরিচারিকা, ও বলে আমার যন্ত্র আবিষ্কারের পরে নাকি বেড়ালের উৎপাত কমে গেছে। ওই মায়াবৃত্তে একটা থাবা ফেলার পরেই ওরা সেই যে পিছন ফিরে পালায়, আর এমুখো হয় না।” একটু থেমে প্রফেসর আবার বললেন, “কিন্তু ওদের থেকেও তো আরও ভয়ানক পশু আছে। তাদের হয়তো শ্বদন্ত বা নখ নেই, কিন্তু বন্দুক আর বোমা আছে।

“ভাবো একবার, মাধ্যাকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে কিরকম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বানানো যাবে। এমন এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করা যাবে কোনও শত্রুই যা উল্লঙ্ঘন করতে পারবে না। উড়োজাহাজও ওই পাখিটার মতোই টুপ করে খসে পড়বে। এমনকী কামানের গোলাও সেই সীমারেখা ভেদ করে আসার ক্ষমতা রাখবে না। আবার উলটোদিকেও ভাবো, ধেয়ে আসা শত্রুপক্ষের সৈন্যকে কেমন অসহায়ভাবে আকাশে ভাসিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু আমার আসল আবিষ্কার জানার পর এ সবই বালখিল্য বলে মনে হবে। দুই মেরু ছাড়া এই পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ টান কমিয়ে দেওয়ার উপায় আমি জানি।”

“তা কী করে সম্ভব?”

“শুধুমাত্র পৃথিবীর আবর্তন গতি বাড়িয়ে দিয়ে।” প্রফেসর এমনভাবে কথাটা বললেন যেন একটা লাট্টু ঘোরানোর মতো সহজ ব্যাপার।

“কী? পৃথিবীর আবর্তন গতি বাড়িয়ে দেবেন?”

“হ্যাঁ, গতি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কেন্দ্রাতিগ বলও বৃদ্ধি পাবে আর সেই সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের ওপরে থাকা সব বস্তুই হাল্কা হয়ে যাবে। যদি আমার সঙ্গে আরও কয়েকটা দিন থাকতে পারো তাহলে নিজেই ব্যাপারটা দেখতে পাবে।”

“স্বচ্ছন্দে!”

“আমি একটু সেরে উঠলেই আমার এক্সপেরিমেন্ট শুরু করব। আর মনে হয় ব্যাপারটা তোমার ভালোই লাগবে।”

কালঘূর্ণি

কয়েকদিনের মধ্যে প্রফেসর ওয়াগনার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে সমর্থ হলেন। এই চৌহদ্দির এক কোণে মাটির নীচে অবস্থিত তাঁর ল্যাবরেটরিতেই বেশীরভাগ সময় কাটাতে লাগলেন। আমাকে তিনি এখনও ওই ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করার অনুমতি দেননি। সময় কাটানোর জন্য আমায় তাঁর লাইব্রেরীটা ছেড়ে দিয়েছেন।

একদিন সেই লাইব্রেরীতেই বসে আছি, এমন সময় ওয়াগনার হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলেন। দরজা থেকেই উত্তেজিত হয় চিৎকার করে বলতে বলতে আসছেন, “চালু হয়ে গেছে হে, আমার যন্ত্র বৃত্তাকারে ঘুরছে। এবার দেখা পাবে কী হয়।”

ভেবেছিলাম দারুণ কিছু ঘটবে, কিন্তু সারাদিন কেটে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না।

“রহু ধৈর্যং!” প্রফেসর ঝুঁপো গোঁফের আড়ালে মুচকি হেসে বললেন, “কৌণিক গতিবেগের সঙ্গে কেন্দ্রাতিগ বেগ সরল সমানুপাতিক। আর পৃথিবীর আয়তন তো নেহাত কম নয়। বোঝার মতো দ্রুততা আসতে সময় লাগবে।”

পরেরদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর নিজেকে বেশ হাল্কা লাগল। পরীক্ষা করে দেখতে আমি একটা চেয়ার তুলে নিলাম। অনেকটাই ওজন কম। তাহলে কী কেন্দ্রাতিগ বেগ কাজ শুরু করেছে! আমি বারান্দায় এসে ছায়াগুলোর দিকে লক্ষ করে দেখলাম তারা বেশ দ্রুত স্থান পরিবর্তন করছে। এর মানে কী? সূর্য তাড়াতাড়ি প্রদক্ষিণ করছে?

“তাহলে বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়ই?” কিছুদূর থেকে ওয়াগনারের কণ্ঠস্বর কানে এল, “সূর্য আরও তাড়াতাড়ি ঘুরছে হে। দিন-রাত্রির মধ্যে সময়ের ব্যবধান কমছে।”

“কিন্তু এর শেষ কোথায়?” এবার বেশ ঘাবড়ে গিয়েই বললাম।

“সেটা দেখার জন্য তো বেঁচে থাকতে হবে।”

সেইদিন সূর্য অন্যান্য দিনের তুলনায় দু’ঘন্টা আগে অস্ত গেল।

“বুঝতে পারছি এই ঘটনা এতক্ষণে সারা বিশ্বে কীরকম আলোড়ন তুলেছে!” আমি প্রফেসরকে বললাম, “একবার যদি জানা যেত...”

“আমার স্টাডি রুমে একটা রেডিও সেট পাবে।”

আমি ছুটে গেলাম স্টাডি রুমে আর বুঝতে পারলাম এই অতিপ্রাকৃত ঘটনায় গোটা পৃথিবীর জনমানসে কীরকম তোলপাড় চলছে।

কিন্তু এ তো ছিল সবে শুরু। পৃথিবীর আবর্তন গতি ক্রমে বেড়েই চলল আর দিনের দৈর্ঘ্য ক্রমশ আরও কমতে থাকল।

দিনরাত্রির সময়ের দৈর্ঘ্য যখন মাত্র চার ঘণ্টায় এসে দাঁড়িয়েছে তখন প্রফেসর বললেন, “বিষুবরেখার ওপর অবস্থিত সমস্ত বস্তু তাদের ওজনের চার ভাগের একভাগ ইতিমধ্যেই হারিয়েছে।”

“বিষুবরেখার ওপরেই কেন?”

“কারণ যেখানে ঘূর্ণনের ব্যাসার্ধ দীর্ঘতম, পৃথিবীর টান সবথেকে কম থাকে সেখানে—অর্থাৎ কেন্দ্রাতিগ বেগ সেখানেই সর্বাধিক।”

বৈজ্ঞানিকেরা ইতিমধ্যেই ঘটনার বিপদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছেন। নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে বেশী অক্ষাংশের দিকে অনেকেই পালাতে শুরু করেছেন। ওজন কমে যাওয়ার বেশ কিছু সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। একটা ইঞ্জিন বিশাল বড় রেলগাড়ি টেনে নিয়ে যেতে পারছে। মোটর সাইকেলের ইঞ্জিন দারুণ জোরে গাড়ি ছোটাতে সক্ষম হচ্ছে। মানুষেরও ওজন কমার সঙ্গে সঙ্গে শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে আমি যেন আরও প্রফুল্লচিত্ত হয়ে উঠছি।

অবশ্য এর পরেই রেডিওতে প্রথম বিপর্যয়ের খবর সম্প্রচারিত হল। হাল্কা হয়ে যাওয়ায় টলমল করে রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হচ্ছে। অবশ্য বেলাইন হওয়ার পরেও হতাহতের সংখ্যা নগণ্য, কারণ কোচগুলি হাল্কা হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম। হাওয়ার গতিবেগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাতাসে ওড়া ধুলো থিতিয়ে যেতে পারছে না। প্রবল জলচ্ছ্বাসে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

পৃথিবীর কৌণিক গতিবেগ যখন সতেরোগুণ বৃদ্ধি পেল তখন বিষুবরেখার ওপরে অবস্থিত সমস্ত বস্তু আর মানুষ প্রায় ওজনশূন্য হয়ে পড়ল।

সেই রাতে রেডিওতে শোনা গেল ভয়াবহ সংবাদ। নিরক্ষীয় আফ্রিকা আর আমেরিকা অঞ্চলের মানুষজন কেন্দ্রাতিগ বেগের টানে আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আরও ভয়ঙ্কর খবর ওই সমস্ত অঞ্চলে ইতিমধ্যেই নিশ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়ে গেছে।

“অতিরিক্ত কেন্দ্রাতিগ বেগের কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল হারিয়ে যেতে বসেছে। পৃথিবী আর তাকে ধরে রাখতে পারছে না।” প্রফেসর নির্লিপ্তভাবে বললেন।

“তাহলে তো আমাদেরও একই পরিনতি হবে।” আমি উত্তেজিতভাবে বললাম।

প্রফেসর শ্রাগ করলেন।

“আমাদের সবরকম পরিস্থিতির জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে।”

“কিন্তু এসব আপনি কেন করলেন প্রফেসর? এ তো সারা বিশ্বের বিপর্যয়, সভ্যতার ধ্বংস...”

ওয়াগনার নির্বিকারভাবে বললেন, “কেন করেছি তা পরে নিশ্চয়ই জানতে পারবে।”

“আবার কোনও এক্সপেরিমেন্ট নয় নিশ্চয়ই?...”

“তোমার এভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠার তো কোনও কারণ দেখছি না, এটাকে এক্সপেরিমেন্ট বলে ভাবছ কেন? অন্যভাবেও তো দেখা যেতে পারে। যখন কোনও বিধ্বংসী ঝড় বা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত নিমেষের মধ্যে লক্ষ লক্ষ প্রাণ কেড়ে নেয়, তখন তো কাউকে দোষারোপ কর না। মনে কর না, এটাও সেরকমই একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়।”

ওঁর জবাবে আমি সন্তুষ্ট হলাম না। বরং এই প্রথমবার ওই লোকটা সম্বন্ধে একটা বিদ্বেষ অনুভব করলাম। কোটি কোটি প্রাণের বিনিময়ে এই পাশবিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার সপক্ষে কোনওরকম অজুহাতই যথেষ্ট নয় বলে মনে করি।

যে দ্রুত হারে দিন-রাত্রির সময়ের ব্যবধান কমে আসছে আর তার ফলস্বরূপ যে সমস্ত নিদারুণ সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, এসব শোনার পরে কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ স্থির থাকতে পারে না। আমার নিজের ওপরেও একটা অসহায় ক্রোধ জন্মাচ্ছে। বিভিন্ন দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছে না। সবসময় অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। একটু বেলাগাম নড়াচড়া করলেই ছাদে মাথা ঠুকে যেতে পারে। সব জিনিসপত্রের এত দ্রুত ওজন কমে যাচ্ছে যে আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। ভারী ভারী আসবাবপত্র সামান্য ধাক্কা লাগলেই সরে যাচ্ছে। কলে জলের ধারা খুব কমে গেছে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে জল বাষ্প হয়ে উবে যাচ্ছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনেও যথেষ্ট অসুবিধা হচ্ছে। হাত-পা ভারশূন্য হয়ে পুতুলের মতো লতপত করছে। মাংসপেশির ওজন কমে যাওয়ার কারণে প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রফেসরের পরিচারিকা ফিমা আমার মতোই উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। রান্না করতে গিয়ে তাঁকে রীতিমতো জাগলিং করতে হচ্ছে। হাতা-খুন্তি সব এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে, সেগুলো ধরতে গিয়ে তিনি রান্নাঘরময় নেচে বেড়াচ্ছেন।

আর ওয়াগনার এই সমস্ত দেখে বসে বসে হাসছেন।

আমি একবার ঝুঁকি নিয়ে বাইরে বেরোলাম। নিজেকে ভারী করার জন্য পকেটে বেশ কিছু পাথর ভরে নিলাম। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কূল ছাপিয়ে জল পশ্চিম তটভূমিকে ভাসিয়ে দিয়েছে। সব থেকে বড় কথা—আমার মাথাটা ভীষণরকম টলমল করছে আর দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাতাস কমে গেছে অনেকটাই। পুবদিক থেকে বয়ে আসা অল্প অল্প হিমশীতল হাওয়া আর বেশীক্ষণ থাকবে বলে মনে হয় না... অর্থাৎ শেষের সেই সময় ঘনিয়ে এল বলে। আমি ভাবলাম, কীরকম মৃত্যু অপেক্ষাকৃত কম বেদনাদায়ক হবে। মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়া, নাকি দমবন্ধ হয়ে মরা? দ্বিতীয় অবস্থাটা বেশী কষ্টকর হবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত এই পৃথিবীর কী হয় তা দেখতে পাব।

নাহ, এর থেকে ভালো এক নিমেষেই সব শেষ হয়ে যাক। আমি পকেট থেকে নুড়ি পাথরগুলো বের করে ফেলে দিতে লাগলাম।

“দাঁড়াও,” পাতলা বায়ুমণ্ডলে খুব অস্পষ্টভাবে ওয়াগনারের গলা শুনতে পেলাম, “এবার মাটির নীচে যাওয়ার সময় হয়েছে।”

প্রফেসর তাঁর পরিচারিকাকে বারান্দা থেকে একহাতে ধরে তুলে আনলেন, অন্য হাতে আমাকে ধরে ছুটে চললেন উঠোনের সেই বড় গোলাকার গর্তটার দিকে। আমি ঘোরের মধ্যে তাঁর সঙ্গে সেখানে গিয়ে পৌঁছনোর পর তিনি ভারী দরজাটা খুলে আমাকে নিষ্ঠুরভাবে ঠেলে দিলেন। চেতনা হারাতে হারাতে বুঝতে পারলাম খুব ধীরে ধীরে আমি নিচে পাথরের মেঝেতে নেমে আসছি।

হেঁটমুণ্ডু ঊর্ধ্বপাদ

কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলাম জানি না। জ্ঞান হতে প্রথমেই যেটা অনুভব করলাম তা হল তাজা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। চোখ মেলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম, আমি যেখানে শুয়ে আছি তার কিছু দূরেই মেঝেতে একটা ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছে।

“অবাক হয়ো না, কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঝেটা ছাদ হয়ে যাবে।” ওয়াগনারের কন্ঠস্বর পেলাম, “এখন কেমন বোধ করছ?”

“অনেকটা ভালো।”

“তাহলে আমার সঙ্গে এসো।” আমার হাত ধরে প্রফেসর স্কাইলাইটের দিকে উড়িয়ে নিয়ে চললেন, “আমার পাতালপুরীর আস্তানা তোমাকে ঘুরিয়ে দেখাই।”

পাশাপাশি তিনটে ঘর রয়েছে। দুটো ঘরে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা আছে। সবথেকে বড় তিন নম্বর ঘরটার মেঝে অথবা ছাদ—আমার ঠিক জানা নেই—সম্পূর্ণ কাচের তৈরি। সমস্যা এটাই যে, আমরা এখন ভারশূন্য অবস্থায় আছি। এই অবস্থায় ঘরময় ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা বেশ কষ্টদায়ক। বারেবারে ঘুরে যাচ্ছি, পিছলে যাচ্ছি। কোনওরকমে আসবাবপত্রগুলোকে আঁকড়ে ধরে সামলাতে হচ্ছে। টেবিলে ঠোক্কর খেয়ে কখনও মাঝশূণ্যে অসহায়ভাবে ভেসে যাচ্ছি। তখন একে ওপরের দিকে হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছি। কোনও জিনিসে ধাক্কা লাগলেই সেটা আশপাশে ভেসে যাচ্ছে। একটা চেয়ার ঘরের মাঝখানে উড়ছে, তার পাশেই একটা গ্লাস। গ্লাসের জল বলের আকার নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

এইসময় চতুর্থ ঘরে যাওয়ার একটা দরজা দেখতে পেলাম। সেখান থেকে একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ আসছে। কিন্তু ওয়াগনার আমাকে সেখানে ঢুকতে দিলেন না। হয়তো ওখানেই রয়েছে পৃথিবীর আবর্তন বাড়িয়ে দেওয়ার যন্ত্র।

শূন্যে উড়ে বেড়ানো শেষ হলে আমরা কাচের ছাদে এসে বসলাম। অবশ্য এটাকে এখন মেঝেই বলা চলে। ইলেকট্রিক বালবটা এখন মাথার ওপরে। জিনিসপত্র কিছুই আর ধরছি না, কারণ ইতিমধ্যেই তাদের বেশীর ভাগ ঘেঁটে গেছে।

ওয়াগনার প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছেন। বোতলের অক্সিজেন থেকে নিশ্বাস নিচ্ছি আর ক্যানে পর্যাপ্ত পরিমানে খাবার আর জল রয়েছে। ভাবলাম, তাহলে আর ওই ভদ্রমহিলাকে বাজারে যেতে হবে না। অভ্যাসে কী না হয়, এখন আর নড়াচড়া করতে অত অসুবিধে হচ্ছে না। পায়ের নিচে তাকিয়ে দেখলাম মোটা কাচের ওপারে আকাশ দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমি একটা গোল আয়নার ওপর দাঁড়িয়ে আছি যার মধ্যে ওপরের আকাশের ছায়া পড়েছে।

পরিচারিকা ভদ্রমহিলা বললেন যে তাঁকে একবার ঘরে যেতে হবে। মাখনটা ভুলে ফেলে এসেছেন।

“কিন্তু আপনি তো যেতে পারবেন না। দরজা খুললেই আপনি পড়ে যাবেন।”

“প্রফেসর আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে যেতে হবে। আমি ওই মাটিতে থাকা হাতলগুলো ধরে ধরে হাতে হেঁটে চলে যাব।”

প্রফেসর ওয়াগনার দেখছি সবকিছুরই ভালোমতো প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন।

তবে ওই ভদ্রমহিলা যে সত্যিই এত দুঃসাহস দেখিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে হেঁটমুণ্ডু ঊর্ধ্বপাদ হয়ে হাতে হেঁটে যাবেন এটা আমি ভাবতে পারিনি।

আমি বললাম, “সামান্য মাখন আনতে যাওয়ার জন্য এতটা ঝুঁকি নেওয়ার কোনও দরকার নেই।”

“যতটা ভাবছ ততটা ঝুঁকি নেই।” প্রফেসর গম্ভীরভাবে বললেন, “আমাদের শরীরের ভার এখন প্রায় কিছুই নেই বলতে গেলে। নিজেদের ধরে রাখার জন্য খুব বেশী শক্তি লাগবে না। আর তা ছাড়া আমাকেও একবার যেতে হবে, আমার নোটবুকটা ফেলে এসেছি।”

“কিন্তু বাইরে তো বাতাস নেই।”

“আমার কাছে বায়ুনিরুদ্ধ হেলমেট আছে।”

ডুবুরীর মতো পোশাক পরে দুজনে বেরিয়ে গেলেন। দুটো দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর বাইরের দরজার থেকে একটা দড়াম করে আওয়াজ পেলাম।

মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে মুখটা মোটা কাচের ওপর চেপে ধরে দেখলাম হেলমেট পরা দুটি অবয়ব মাটির ওপরে উঁচিয়ে থাকা হাতলগুলো ধরে ধরে হাতে হেঁটে বাড়ির দিকে চলেছে। তাঁদের পা আকাশের দিকে উঠে আছে। এমন অপার্থিব দৃশ্য কল্পনা করাও দুঃসাধ্য।

হয়তো সত্যিই ব্যাপারটা মোটের ওপর সহজ। কিন্তু ওই ভদ্রমহিলার যদি মাথা ঘোরে? এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে দেখলাম ওয়াগনার আর তিনি বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে আবার দুজনকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। প্রায় মাঝামাঝি আসার পর এমন একটা ঘটনা ঘটল যা দেখে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেল।

ভদ্রমহিলার হাত থেকে মাখনের কৌটোটা ফস্কে গেল, আর তিনি সেটা ধরার চেষ্টায় হাতলটা ছেড়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই উনি মহাশূন্যের দিকে ধেয়ে চললেন।

ওয়াগনার তাঁকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা করলেন। হঠাৎ তিনি তাঁর কোমর থেকে একটা দড়ি বের করে হাতলের সঙ্গে বেঁধে নিলেন। দড়ির অপর প্রান্তটা ধরে ভদ্রমহিলার দিকে লাফ দিলেন। প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েও একটুর জন্য নাগাল পাচ্ছেন না। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর দিকে। ভদ্রমহিলাও হাত বাড়িয়ে তাঁকে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেন্দ্রাতিগ বেগ তাঁকে ততক্ষণে আরও কিছুটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে। দুজনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলল। ওয়াগনার সেই দড়িটা বেয়ে বেয়ে মহাশূন্যের থেকে পৃথিবীর দিকে ফিরে আসতে লাগলেন।

দেখতে পাচ্ছি, দূরে সেই হতভাগ্য মহিলা হাত নাড়তে নাড়তে বিলীন হয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় রাত্রির অন্ধকার নেমে এসে এই মৃত্যুদৃশ্যের ওপর যবনিকা ফেলে দিল।

ভদ্রমহিলার মনের অবস্থাটা অনুমান করে আমি আপাদমস্তক কেঁপে উঠলাম। তাঁর শেষ পরিনতি কী হবে? তাঁর অবিনশ্বর দেহ অনন্তকাল ধরে ওই মহাশূন্যে ঘুরতে থাকবে।

আমি এতটাই বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম যে কখন ওয়াগনার এসে আমার পাশে বসেছেন সেটা খেয়াল করিনি।

“কী সুন্দর মৃত্যু। তাই না?”

আমি দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করলাম। এখন কিছু বলতে গেলেই এই লোকটার প্রতি ঘৃণা উদ্গিরণ করে ফেলব।

আমি বরং আমার পায়ের নীচের ওই আকাশগর্ভের বীভৎসতার চিন্তায় নিজেকে নিমগ্ন করি। এত পরিষ্কার আকাশ এর আগে কখনও দেখিনি। চিরাচরিত সেই নীল রঙ উধাও। একে আকাশ না বলে মহাশূন্য বলাই যুক্তিযুক্ত। পৃথিবীর আকর্ষণশক্তি শুধু আমাদের দেহকেই নয়, বরং মনকেও আর ধরে রাখতে পারছে না। আমি এই পার্থিব অস্তিত্বের নশ্বরতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে গেছি। মানুষের দেহ আর মন একইসঙ্গে জন্ম নেয় এই পৃথিবীর বক্ষে, এই মহাকাশের আচ্ছাদনে, ওই মহাশূন্যের গর্ভে...

আমি যখন এইসব আকাশপাতাল চিন্তা করছি সেইসময় আমার সামনে ঘটে চলেছে অভূতপূর্ব সব ঘটনা। ছোট ছোট নুড়ি, মাঝারি পাথর ইতিমধ্যেই ভূপৃষ্ঠ থেকে মহাশূন্যের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এখন একটা গোটা টিলা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলল অনন্তের সন্ধানে। চোখের নিমেষে দিন আর রাত্রি পরিবর্তিত হচ্ছে। একটা আলোর রেখার মতো সূর্য উদয় হচ্ছে আর অস্ত যাচ্ছে। তারপরই চলেছে রাতের তারাদের মিছিল। তারপর আবার সূর্য... আবার নক্ষত্র... এইরকমই এক সূর্যালোকের ঝলকে আমি দেখতে পেলাম বাইরের পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। দূরে জলহীন সমুদ্রপৃষ্ঠ আর বিধ্বস্ত লোকালয় দেখা যাচ্ছে। এই তাহলে পৃথিবীর শেষ।

কিন্তু না... এখনও প্রাণের স্পন্দন আছে... রেডিও থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে...

দুই মেরুতে এখনও সর্বোচ্চ প্রভাব পড়েনি। র‍্যাঙ্গল আইল্যান্ডে একমাত্র টিঁকে থাকা রেডিও স্টেশন থেকে সিগনাল আসছে... উত্তরের অপেক্ষায় আছে ওরা... কিন্তু কোনও সাড়া নেই... একসময় বেতার তরঙ্গও নিস্পন্দ হয়ে গেল। সারা পৃথিবীতে নেমে এল অনন্ত স্তব্ধতা।

দিন আর রাত্রি এত ত্বরিতগতিতে আসা-যাওয়া করছে যে সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে। কালো আকাশে একটা আলোর রেখা সূর্যের গতিশীলতা বোঝাচ্ছে। পৃথিবীর আকর্ষণশূন্য হয়ে চাঁদ অনেক দূরে সরে গিয়ে ছোট্ট বিন্দুর মতো লাগছে।

মেঝের কাচের আচ্ছাদনের মধ্যে তীব্র আলোড়ন অনুভব করতে পারছি। এটা ভাঙতে আর খুব বেশী দেরী নেই, আর সেইসঙ্গে আমিও ওই মহাশূন্যে ভেসে যাব...

কে আমার পেছনে বিড়বিড় করছে? ওহ, প্রফেসর ওয়াগনার।

অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। পৃথিবীর পাগল গতি আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। একটা বড় শ্বাস টেনে নিলাম...

“আপনি!” আমি রাগে ফেটে পড়লাম, “কেন করলেন আপনি? জবাব দিন। মানবসভ্যতাকে, এই পৃথিবীর প্রাণীজগতকে ধ্বংস করে কী পেলেন আপনি... আপনাকে উত্তর দিতেই হবে! এক্ষুনি... এই মুহূর্তে পৃথিবীর গতিবেগ কমিয়ে দিন, নয় তো...”

কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনও ভাবান্তর লক্ষ করলাম না, তিনি একইভাবে মাথা নেড়ে চললেন।

“কী হল? কথা বলুন!” আমি চিৎকার করে ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে গেলাম ওঁর দিকে।

“আমার আর কিছুই করার নেই... আমার হিসেবে কোথাও ভুল থেকে গেছে।”

“তাহলে সেই ভুলের মাশুল আপনাকে দিতে হবে।” আমি ওয়াগনারের গায়ের ওপর লাফিয়ে পড়ে তাঁর টুঁটি টিপে ধরলাম... আর সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম পায়ের নিচের দরজা ভেঙে গিয়ে সরে যাচ্ছে। সেই ফাঁক গলে আমি মহাশূন্যের দিকে ভেসে চললাম, তখনও ওয়াগনারের গলাটা বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরে রয়েছি...

উচিত শিক্ষা

আমার চোখের সামনে প্রফেসর ওয়াগনারের হাসিহাসি মুখ। হতবুদ্ধি হয়ে আমি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে তারপর আশেপাশে চোখ বোলালাম।

এক সুন্দর সকাল। দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশের শামিয়ানা। কিছুদূর থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছে। বারান্দার বাইরে দুটি দুধসাদা প্রজাপতি খুনসুটিতে মেতে দৃশ্যটিকে আরও মোহময় করে তুলেছে। পরিচারিকা ভদ্রমহিলা একটা মাখনের বাটি নিয়ে হেঁটে চলে গেলেন...

“কী হল ব্যাপারটা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।” বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে প্রফেসরকে জিজ্ঞাসা করলাম।

ঝুঁপো গোঁফের আড়ালে মুচকি হেসে প্রফেসর বললেন, “আমাকে মাফ কোরো, তোমার অনুমতি না নিয়ে... এমনকী তোমার সঙ্গে বিন্দুমাত্র পরিচিত না হয়েও তোমাকে আমার পরীক্ষার কাজে ব্যবহার করেছি বলে। যদি তুমি আমার সম্বন্ধে জেনে থাকো তাহলে আমার গবেষণার বিষয়বস্তু নিশ্চয়ই শুনে থাকবে। কীভাবে একজন মানুষের ঘুমের মধ্যে তার জ্ঞান, চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সেই ব্যাপারে আমি দীর্ঘদিন কাজ করছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার মস্তিষ্কের দুটি অংশকে পৃথকভাবে চালনা করতে সমর্থ হয়েছি। এর ফলে পরিশ্রান্তি এবং ঘুমকে জয় করতে পেরেছি।”

“হ্যাঁ, শুনেছি বটে।”

ওয়াগনার মাথা নাড়লেন, “বেশ। কিন্তু সবাই সেটা পারবে না। তাই আমি শিক্ষার সহায়ক হিসেবে সম্মোহনকে কাজে লাগানোর কথা ভাবলাম। অবশ্য প্রথাগত শিক্ষাকেও এক ধরণের সম্মোহনই বলা চলে। আজ সকালে যখন আমি হাঁটতে বের হলাম তখন জুনিপার ঝোপের আড়ালে তোমাকে দেখতে পাই। তোমার এই লুকিয়ে নজর রাখার ব্যাপারটা আজই নিশ্চয়ই প্রথমবার নয়, তাই তো?” তাঁর চোখে রসিকতার ঝিলিক খেলে গেল।

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।

“তাই আমি ঠিক করলাম তোমাকে সম্মোহন করে তোমার এই অযাচিত কৌতূহলের জন্য একটা ছোট্ট শিক্ষা দিতে হবে।”

“তার মানে? তাহলে সবই কি...”

“শুধুই সম্মোহন—যে মুহূর্তে তুমি আমাকে প্রথম দেখেছিলে তার পর থেকে সবটাই। কিন্তু একদম বাস্তবের মতো মনে হল কি না বল? আর এই যা অভিজ্ঞতা হল সারা জীবনেও তুমি ভুলতে পারবে না। মহাকর্ষের সূত্র আর কেন্দ্রাতিগ বলের প্র্যাকটিকাল শিক্ষার থেকে কোনও অংশে কম নয়। তুমি অবশ্যই নিজেকে একজন বাধ্য আর অতীব ভাবপ্রবণ ছাত্র হিসেবে প্রমাণ করেছ। যদিও শেষের দিকটায় একটু বেশীমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলে...”

“কত সময় ধরে চলেছিল এই পাঠ?”

প্রফেসর ওয়াগনার এক ঝলক নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “দু’মিনিটের বেশী নয়। বেশ সফল প্রযুক্তি, কী বল?”

“কিন্তু ওই যে উঠোনের ওপরে কাচের আচ্ছাদন দেওয়া পাতালপুরী বা মাটিতে পোঁতা হাতলগুলো...” চত্বরের দিকে তর্জনী নির্দেশ করতে গিয়ে আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলাম! পুরো উঠোনটাই তো ফাঁকা, কিছুই নেই।

“তাহলে ওগুলোও সম্মোহন ছিল?”

“একদম তাই। কিন্তু আমার ফিজিক্সের ক্লাস নিশ্চয়ই তোমার ক্লান্তিকর লাগেনি, তাই তো?” প্রফেসর মুখ তুলে হাঁক পাড়লেন, “ফিমা, কফি হয়ে গেছে? চলো ব্রেকফাস্ট সেরে নিই।”

মূল রাশিয়ান গল্প: Alexander Belyaev-এর “Over the abyss”