“অনুতাপ করো, সং!” টিকটিক মশাই বললেন। - দীপ ঘোষ

কল্পবিজ্ঞানের গল্প

অলংকরণ: Jim Steranko

“বেশির ভাগ মানুষই সমাজকে মেনে চলে মানুষ হিসেবে নয়, একটা শারীরিক যন্ত্র হিসেবে। খুব কম মানুষই রাষ্ট্রকে বিবেক দিয়ে বিচার করতে যায়, আর যারা যায় তারা বাধ্য হয় রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। তারাই আসল বীর, তারাই আসল শহীদ।”

 

---হেনরি ডেভিড থরেউ, “সামাজিক উশৃঙ্খলতা”

 

মোদ্দা কথা এটাই। তা গপ্পটা কিন্তু মাঝখান থেকে শুরু হবে। তারপরে জানা যাবে শুরুটা কী করে শুরু হয়েছিল। আর শেষটা? ওটা নিজে থেকেই ঠিক শেষ হবে। তবে এই আজব দুনিয়ায় বহুদিন তারা ওকে নিরুপদ্রবে কাজ চালিয়ে যেতে দিয়েছিলেন। আসলে দুনিয়াটা তো সেই শাসনযন্ত্রে তেল মালিশওয়ালাদেরই, তারাই তো এই দুনিয়ার নিয়ম কানুন বানিয়েছেন, সব সেরা মাখন এনে মাখিয়েছেন সমাজের তেল চুকচুকে নাট বল্টুতে। যতক্ষণে তাঁরা বুঝতে পারলেন লোকটা বেশ বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়েছে, অথবা বলা ভালো সমাজের আধপাগলাগুলোর কাছে নায়কের (সরকারী রিপোর্টে সেটাই লেখা হয়েছিল) মর্যাদা পেয়েছে, ততক্ষণে বেশ দেরী হয়ে গেছে। তা এখন টিকটিক মশাইয়ের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না, হাজার হোক তিনিই কানুনের দায়িত্বে আছেন। কিন্তু ওই যা বললাম, ততদিনে ঝামেলাটা বেশ ভালোই পাকিয়েছিল, এ যেন হঠাৎ করে ফিরে আসা কোন প্রাচীন রোগের মহামারী, যে রোগকে বহুদিন আগে এই সমাজ থেকে টিকা দিয়ে নির্মূল করা হয়েছে। তাই ব্যাটা যে কবে কোথা থেকে উদয় হল, কেউ টেরও পায়নি।

কিন্তু সে ততদিনে একটা মুখ আর শরীর পেয়ে গেছিল।

লোকটার নাকি একটা চরিত্রও তৈরি হয়ে গেছিল! ভাবা যায়? কত কষ্ট করেই না সমাজ থেকে ওই বদখৎ জিনিসটাকে বহু শতাব্দী আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ লোকটার সাথে সেই রোগটাও আবার ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে। সমাজের মধ্যবিত্তরা ব্যাপারটাকে ঘৃণার চোখে দেখছিল। অশালীন বাগাড়ম্বর! নৈরাজ্যবাদী! নির্লজ্জ বেহায়া! ---আওয়াজ উঠছিল। আরেকদল লোক এসব দেখে মুচকি হাসছিল, তাঁদের মধ্যে চিন্তা ভাবনার চর্চাটা প্রায় আনুষ্ঠানিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা হত। কিন্তু একেবারে নিচের তলার বাসিন্দারা? তাদের জীবনে তো পাপ-পুণ্য, রুটি-ফুর্তির আর নায়ক-খলনায়কের যথেষ্ট দরকার ছিল। তাই তাদের কাছে সে ছিল একাই বলিভার, নেপোলিয়ান, রবিনহুড বা ডিক বঙ; তাদের ভগবান, তাদের জোমো কেনিয়াটা

আর সমাজের একদম উপরে, পাগলা কেলির মত যারা ক্ষমতার ফ্ল্যাগপোস্টে উঠে বসে আছে? তারা কিন্তু সবসময়েই ভয়ে কাঁটা, সামান্য কাঁপুনি, ছোট্ট ধাক্কা তাদের গদি উলটে দিতে পারে। তাই লোকটা তাদের কাছে ছিল আপদ বিশেষ, এক ছন্নছাড়া পাষণ্ড, ঘৃণ্য বিদ্রোহী, গণশত্রু! মোদ্দা কথা সমাজের সব স্তরের লোক তাকে চিনে গেছিল, কিন্তু তাকে নিয়ে জোরদার আলোচনা চলত সিঁড়ির নিচের ঘরে আর সবথেকে উঁচু বাড়িটার উপরের তলায়।

সুতরাং লোকটার ফাইলটা এসে পৌঁছল টিকটিক মশাইয়ের অফিসে, সাথে ছিল ওর সময়পাঞ্জা আর ধুকধুকি।

টিকটিক মশাই, সবাই তাঁকে ওই নামেই জানে। মানুষটি ছয় ফুটের উপর লম্বা, চুপচাপ ও গম্ভীর। সবকিছু সময়মত চললেই তাঁকে মাঝে মধ্যে কেউ মুচকি হাসতে দেখেছে বলে দাবী করে।

এমনকি সরকারী উঁচু দপ্তরগুলোতেও লোকে ফিসফিস করে তাঁকে টিকটিক মশাই বলেই ডাকে। অথচ ওই অফিসের লোকগুলোই সারা সমাজকে ভয় পাইয়ে ঠান্ডা করে রেখেছে, তারাও যে কাউকে ভয় পেতে পারে, এমনটা কেউ জানত না। তবুও তারাও টিকটিক মশাইকেই ভয় পেত।

তবে কেউ তাঁর মুখের, থুড়ি মুখোশের সামনে অবশ্যই ওই নাম উচ্চারণ করত না।

তোমার ঘটে যদি বিন্দুমাত্র বুদ্ধি থাকে তবে তুমিও তাঁকে ওই নামে ডাকবে না। মনে রাখা ভালো মুখোশের আড়ালের মানুষটা চোখের পলকে তোমার জীবন থেকে মিনিট, ঘন্টা, দিন, এমনকি বছর পর্যন্ত হাওয়া করে দিতে পারে। সবাই ওনাকে তাই মহান সময়রক্ষক বলে সম্বোধন করে, ওতে সম্মানও জানানো হয় আর প্রাণটাও বাঁচে।

‘লোকটা কী সেতো বুঝলাম।’ চিন্তিত গলায় বললেন টিকটিক মশাই, ‘কিন্তু জানতে হবে সে কে? আমার বাঁ হাতের এই সময়পাঞ্জাটায় একটা নাম লেখা আছে, এই নামটা আমায় বলছে এটা একটা লোকের নাম, কিন্তু লোকটা কে? আমার ডান হাতের ধুকধুকিটায় লোকটার জীবনের সময়ের হিসেব আছে, কিন্তু এই সময়টা সে কী করেছে আমায় তা জানতে হবে। নইলে তাকে আমি যোগ্য বিচার করব কী করে?’

টিকটিক মশাই ডাক দিলেন তাঁর কর্মচারীদের, পেয়াদাদের, চ্যালা-চামুণ্ডা যারা আছে, এমনকি দারোয়ানদেরও, ‘কে এই সং? ধরে আনো তাকে।’

টিকটিক মশাই হাসছিলেন না, পাথরের মত কঠিন তাঁর মুখ। কেউ মনে করতে পারল না শেষ কবে টিকটিক মশাই একসাথে এতগুলো কথা বলেছিলেন। তবে দারোয়ানরা তাঁর কথা শোনার সুযোগ বিশেষ পায় না, তাই তারা এতোসব ব্যাপার বুঝতে পারলো না।

কিন্তু আসল কথা হল, ‘কে এই সং?’

সে তখন শহরের তৃতীয় স্তরের উপরের উড়ন্ত হাওয়া-নৌকাটার সাথে লাগানো অ্যালুমিনিয়ামের তক্তাটার ( হু! হাওয়া নৌকাটা সুইসলকিড কোম্পানির হলেও তক্তাটা তার পিছনে জোড়াতালি দিয়ে আটকানো ছিল! ) উপর গুঁড়ি মেরে বসে ছিল। নিচের সারি সারি সাজানো বাড়ি দেখে যেন মনড্রিয়ানের আঁকা ছবির মত লাগছিল। দূরে কোথাও সারি সারি মানুষ তালে তালে বাঁ-ডান-বাঁ করে পা ফেলে দুপুর দুটো সাতচল্লিশ মিনিটের শিফটে টিমকিনের বল বেয়ারিং তৈরির কারখানায় ঢুকছিল। ঠিক এক মিনিটি পরেই ডান-বাঁ-ডান করে পাশের রাস্তা দিয়ে সকাল ৫টায় যারা কাজে ঢুকেছিল সেই কর্মচারীরা লাইন করে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। তার রঙ করা মুখের উপর একটা দুষ্টু হাসি খেলে গেল এক মুহূর্তের জন্যে, তারপরে নিজের ঢেউ খেলানো খয়েরি চুলে একবার হাত বুলিয়ে নিজের রংচঙে সঙের জামাটা একবার ঝেড়ে নিল সে। মনে হল লোকটা যেন এতক্ষণে ঠিক করতে পারল যে সে কী চায়, আর সাথে সাথে হাতের যন্ত্রের একটা লিভারে চাপ দিল সে। চোখের পলকে হাওয়া নৌকাটা রাস্তার পাশের ফুটপাথের কয়েক ইঞ্চি উপর স্থির হয়ে ভাসতে লাগল। হাওয়ার দাপটে চারপাশের সুসজ্জিত তরুণীদের ঘাগরাগুলি তাদের অপ্রস্তুত করে হঠাৎ উড়তে শুরু করল। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই সং তার বুড়ো আঙুলটা কানের মধ্যে ঢুকিয়ে একহাত জিভ কেটে ‘উগগা উগগা উগগা’ বলে মহা শোরগোল বাঁধিয়ে দিল। যদিও চারপাশের লোকগুলো চমকালেও সহজে নিজেদের রাস্তা ছেড়ে নড়ল না। শুধু একটি মেয়ে হোঁচট খেয়ে নিজের হাতের বাক্সগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে ফেলল, দ্বিতীয়টি নিজের অন্তর্বাস ভিজিয়ে ফেলেছিল, আর একটি মেয়ে চলন্ত ফুটপাথের উপর পিছলে পড়ে সেইভাবেই এগিয়ে চলছিল। কলের মানুষরা যদিও সাথে সাথেই ফুটপাথটা বন্ধ করে মেয়েটাকে উঠতে সাহায্য করে, তাও বলা যায় সং একটা ছোটখাটো ঝামেলা বাঁধাতে সফল হয়েছিল। আর তারপরেই একটা দমকা বাতাসের মত সে তার হাওয়া নৌকা নিয়ে উড়ে গেল সেখান থেকে।

‘ইয়াহু!’

এরপর সে সময়-গতি শিক্ষা কেন্দ্রের কার্নিশের উপর তার হাওয়া নৌকাটা দাঁড় করাল। আরেক শিফটের কর্মচারীরা তাদের কাজ শেষ করে চলন্ত ফুটপাথে লাইন দিয়ে দাঁড়াল। বহু বছরের নিয়মিত অভ্যাসে নির্ধারিত জায়গাতেই তারা ফুটপাথ পালটে নতুন রাস্তায় গিয়ে উঠল (তাদের যন্ত্রের মত চলন দেখে কেন জানি না বুসবি বার্কলের সেই ১৯৩০ সালের পুরনো সিনেমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল)। এক সারি উটপাখির মত তাদের লাইনটা এই নতুন রাস্তাটা দিয়ে বড় এক্সপ্রেস রাস্তায় গিয়ে পড়ছিল।

আবার সেই দুষ্টু হাসি, এবার দেখা গেল তার বাঁ দিকের একটা দাঁত ভাঙা। সে হাওয়া নৌকাটা নামিয়ে আনল এই সারিটার মাথার উপর। নৌকাটা এক চক্কর দিয়ে লোকগুলোর মাথার উপর এসে স্থির হল। সঙের হাতের যন্ত্রের ছোঁয়ায় সশব্দে নৌকার পিছনের ঢাকনাটা খুলে গেল, আর তার মধ্যে থেকে নানা রঙের আর নানা আকৃতির অসংখ্য জেলি লজেন্স ঝরে পড়তে লাগল রাস্তার উপর, শ্রমিকদের উপর। আজ সে প্রায় দেড় লাখ টাকার জেলি লজেন্স চুরি করে এনেছে।

জেলি লজেন্স! লাখ লাখ, কোটি কোটি জেলি লজেন্স! কত রকমই না তাদের স্বাদ! বেগুনি রঙের আঙুর, হলুদ রঙের লেবু, লাল রঙের রাসবেরি! গোল, শক্ত তাদের বাইরেটা, আর ভিতরে নরম গলে যাওয়া চিনির আঠা দেওয়া। তারা গড়াতে লাগল শ্রমিকদের মাথার উপর, তাদের পায়ের নিচে, রাস্তার উপর, চলন্ত ফুটপাথের গায়ে, সর্বত্র। টিমকিনের শ্রমিকদের মাথায় যেন সেই ছেলেবেলার রঙিন ছুটির দিন ভেঙ্গে পড়ল। তাদের দুনিয়ার সমস্ত নিয়মানুবর্তিতা যেন এই রঙিন জেলি লজেন্সের ঝড়ে উড়ে গেল।

শ্রমিকেরা তাদের লাইন ভেঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে লজেন্স কুড়োতে শুরু করল, তারা উচ্চস্বরে হাসছিল শিশুর মত। কিছু লজেন্স চলন্ত রাস্তার নিচের বেল্টের মধ্যে ঢুকে গেছিল। একটা কর্কশ ডাক ছেড়ে রাস্তাটা হোঁচট খেয়ে থেমে গেল। রাস্তার উপরের লোকগুলো পড়ে গিয়েও হামাগুড়ি দিয়ে লজেন্স মুখে পুড়তে লাগল। যেন আজকে একটা ছুটির দিন, সব কাজ ভুলে, সব নিয়ম ভাঙার দিন, হাসার দিন, পাগলামি করার দিন। কিন্তু…

পাগলামিটা মাত্র সাত মিনিট স্থায়ী হয়েছিল।

সেদিন সবার সাত মিনিট দেরী হয়ে গেল।

বাড়ি পৌঁছতে সাত মিনিট দেরী হল অনেকের।

কারখানার বড় ঘড়িতে সাত মিনিট দেরী হল পরের শিফট শুরু করতে।

ভাঙা রাস্তাও সারাতে গিয়ে দেরী হল ঠিক সাত মিনিট।

সং একটা ডোমিনো এফেক্ট চালু করে দিয়েছিল, আর একের পর এক ঘুঁটি পড়েই চলেছে, ঠক ঠক ঠক।

সবকিছুই মাত্র সাত মিনিট দেরী হয়ে গেছিল। অনেকের কাছে সাত মিনিটটা হয়ত ছোট্ট ব্যাপার, কিন্তু যে সমাজে ঘড়ির মত শৃঙ্খলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় সেখানে সময়ই ভগবান, সেখানে সাত মিনিট একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা।

সুতরাং সঙকে টিকটিক মশাইয়ের সামনে হাজির হবার আদেশ দেওয়া হল। সমস্ত টিভি, রেডিও আর স্পিকারে জোরসে বাজানো হল সেই আদেশ, যাতে সেটা সঙের কানে ভালোভাবে পৌঁছোয়। সন্ধ্যা সাতটার সময় তাকে টিকটিক মশাইয়ের অফিসে হাজিরা দিতে হবে। সাতটা মানে এক্কেবারে কাঁটায় কাঁটায় সাতটা থেকে তারা সঙের জন্যে টিকটিক মশাইয়ের অফিসে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সাড়ে দশটার আগে সঙের কোন পাত্তাই পাওয়া গেল না। তাও সে ব্যাটা তার হাওয়া নৌকায় চড়ে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে ভরমন্ট নামের কোন শহরের চাঁদের আলো নিয়ে একটা বিটকেল গান গেয়ে আবার উধাও হয়ে গেল! একবারও সে ভাবল না যে অতোগুলো লোক তার জন্যে সাতটা থেকে অপেক্ষা করছে একটানা! এই সং ছাড়া এমন সৃষ্টিছাড়া কাজ কি আর কেউ করতে পারে?

কিন্তু সঙের পরিচয়ের থেকেও বড় প্রশ্নটা অন্য। আমাদের এই সমাজ কী করে এমন পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছল যে সঙের হাসি, উদ্ভট গান, বাজে বকা, সাত মিনিট দেরী হওয়া আর দেড় লক্ষ টাকার জেলি লজেন্স তার ভিত নড়িয়ে দিতে পারে?

আর জেলি লজেন্সের কথায় মনে পড়ল, ব্যাটা সং এত টাকার জেলি লজেন্স পেল কোথা থেকে? দেড় লক্ষ টাকা তো মুখের কথা নয়! (আর হ্যাঁ, রাস্তায় দেড় লক্ষ টাকার লজেন্সই ঢালা হয়েছিল। এটা শুধু অনুমান নয়, একদল বিশেষজ্ঞকে আনা হয়েছিল জেলি লজেন্সের দাম হিসেব করার জন্যে। ভুললে চলবে না এই লজেন্স গুনতে গিয়ে তাদের সারা দিনের কাজ নষ্ট হয়েছিল সেদিন!) আরে তার থেকে বড় কথা জেলি লজেন্স এলো কোথা থেকে? অন্তত একশো বছর আগে জেলি লজেন্সের শেষ কারখানাটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

হ্যাঁ, এটাই আপাতত সবথেকে দামী প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর বহু অব্যাখ্যাত রহস্যের মতো এর উত্তরটাও হয়ত আমাদের অজানাই থেকে যাবে!

যাক, এতক্ষণ পর্যন্ত মাঝখানটা তুমি জানলে। এইবার শুরুটা শুরু করা যাক। ধরা যাক শুরুটা হয়েছিল একটা কম্পিউটার ডেস্ক থেকে। সকাল ন’টায় মেইলটা খুলে দেখা, ন’টা পঁয়তাল্লিশে প্ল্যানিং কমিশনের বোর্ডের সাথে দেখা করা, সাড়ে দশটায় টিমের সাথে বিজনেস প্রসেস নিয়ে আলোচনা, এগারোটা পঁয়তাল্লিশে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা, বারোটায় লাঞ্চ, একদিন, প্রতিদিন। চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।

“মিস গ্রান্ট, আমি খুবই দুঃখিত। এখন সাড়ে চারটে বাজে, আর আপনার ইন্টার্ভিউয়ের সময় ছিল আড়াইটে, কিছু করার নেই, নিয়ম সবার জন্যেই, তা তো আর পালটানো যাবে না। কলেজে অ্যাপ্লাই করতে হলে পরের বছরের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে।” চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।

দশটা দশে বাস দাঁড়াবে ক্রিসহেভেনে, তারপর গ্যালসভিল, টোনাওয়ান্ডা জাংশান, সেলবি, ফার্নহস্ট (ইন্ডিয়ানা সিটিতে দাঁড়ায় না কিন্তু এই বাসটা), লুকাস-ভিন, কোলটন (রবিবারে এখনে দাঁড়াবে না)। দশটা পঁয়ত্রিশের এক্সপ্রেস বাসটা শুধু দাঁড়াবে গেলসভিল, সেলবি আর ইন্ডিয়ানা সিটিতে। তবে রবিবার আর অন্য ছুটির দিন এই বাসটা দাঁড়াবে শুধু … চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।

“ফ্রেড সোনা, তোমার জন্যে আমি অপেক্ষা করতে পারলাম না। তুমি তো জানো আমায় পিয়ের কার্টেনের কাছে সাড়ে তিনটের সময় দেখা করতে হবে। আমি তোমায় বলেছিলাম দুটো দশে ঘড়ির নিচে অপেক্ষা করতে। ও ফ্রেড, তুমি সবসময়েই এমন দেরী করে চলো। আমি এত সময় দিতে পারব না তাই দুপুরে একাই খেয়ে নিলাম…” চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।

প্রিয় মিস্টার ও মিসেস এটার্লি, আপনাদের ছেলে জেরাল্ডকে আমরা স্কুল থেকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হলাম। যতদিন না জেরাল্ড সময়ে ক্লাসে আসার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে ততদিন ওর জন্যে স্কুলের সব গেট বন্ধ। জেরাল্ড খুবই বুদ্ধিমান ছেলে এবং পরীক্ষায় ওর ফল অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক, তবুও আমরা ওকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হচ্ছি। ওর থেকে অনেক সাধারণ ছেলেরা যখন সময়ে আসতে পারে তখন ওর না আসার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না। চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।

সকাল ৮-৪৫ এর ভিতর লাইন না দিলে এবারে ভোট দিতে পারবেন না।

দুটোর আগে অফিস থেকে বেরোনো একেবারেই নিষেধ।

“লেখাটা যতই ভালো হোক না কেন, বুধবারের আগে এটা আমার দেখারও দরকার নেই।”

“ভাই, বড্ড দেরী করে ফেললে। কাজটা অন্য একজনকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

প্রতি কুড়ি মিনিট দেরীর জন্যে অর্ধেক দিনের মাইনে কাটা যাবে।

“ইশ বড্ড দেরী হয়ে গেল, ক’টা বাজে রে?”

চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। চলতেই চলতেই চলতেই চলতেই চলতেই চলতেই টিক টিক টিক টিক টিক টিক টিক টিক টিক, আর তারপর একদিন মানুষের প্রয়োজনে সময় থাকে না, আমরাই সময়ের দাস হয়ে পড়ি, সময় রক্ষা করা আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, সূর্যের চলার সাথে তাল মিলিয়ে চলা আমাদের লক্ষ্য এবং নিজেদের বন্দী করে ফেলি কঠোর শৃঙ্খলার বাঁধনে, নইলে এই সমাজ ব্যাবস্থা ভেঙে পড়বে যে।

আর এটা বাড়তেই থাকে যতদিন না কাজে দেরী করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়।

এটা একটা পাপ। তারপর ঘৃণ্য অপরাধ। আর সবশেষে পনেরই জুলাই, ২৩৮৯ সালে ঠিক রাত বারোটার সময় প্রধান সময়রক্ষকের অফিস থেকে ঘোষণা করা হল যে সবাইকে নাম সই করে সময়পাঞ্জা আর ধুকধুকি নিয়ে যেতে হবে। নিয়ম ৫৫৫-৭-এসজিএইচ-৯৯৯ মোতাবিক সময়পাঞ্জা গুলি প্রত্যেক নাগরিকের সময়ের হিসেব রাখবে আর ধুকধুকিগুলো প্রত্যেক ব্যবহারকারীর হৃদয়ের সাথে তালে মেলানো থাকবে। এইভাবে সরকার দিব্বি মানুষের জীবনের সময়টাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার শুরু করে দিল। যদি তুমি দশ মিনিট দেরী করো তোমার কাজে, তাহলে তোমার জীবনের বাকি সময় থেকে দশ মিনিট বাদ গেল। এক ঘন্টা দেরী করলে আরো অনেক বেশি সময় বাদ যাবে। যত বেশি দেরী সময় বাদের অনুপাত ততই বেশি। যদি কেউ সব কাজে দেরী করতেই থাকে রোজ, খুব তাড়াতাড়ি সে কোন এক রবিবার প্রধান সময় রক্ষকের অফিস থেকে বার্তা পাবে যে তার সময় শেষ। আগামী সোমবার দুপুর বারোটায় তার ধুকধুকি এবং তাকে বন্ধ করে দেওয়া হবে, এর মধ্যেই যাকে যা বলার আছে, সেরে নেওয়া ভালো।

আর এইভাবে বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় (একমাত্র টিকটিক মশাইয়ের অফিসই জানে এই সমস্ত হিসেব কী করে রাখা হয়) এক অনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হল। অনৈতিক হলেও সুবিধাজনক তো বটেই! আর তার সাথে দেশপ্রেমীও, সেটাই তো বড় কথা! যুদ্ধটা তো চালাতে হবে। তবে ওই বলে না, যুদ্ধ আর শেষ হয় কই?

“জঘন্য! একেবারেই যা-তা!” সং বলে উঠল। সুন্দরী অ্যালিস ওকে ‘সং এর খোঁজ চাই’ লেখা একটা পোস্টার দেখাচ্ছিল। “একে তো ছবিটা জঘন্য, তার উপরে ব্যাপারটারই কোন মাথামুণ্ডু নেই! আমি কি চোর ডাকাত নাকি? নাকি দেশে এখনো চুরি ডাকাতি হয়?”

“খোঁজ চাই এর কাগজ! তাও আমার জন্যে!”

“তুমি বড্ড ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলো।” অনুযোগ করল সুন্দরী অ্যালিস।

“আমি সত্যিই দুঃখিত সোনা”, সং গাঢ় স্বরে বলল।

“তুমি সবসময়েই তো আমার কাছে ক্ষমা চাও, আর তারপরেই আবার নিজের মত কাজ করো! এভারেট, তুমি এতো নিয়ম ভঙ্গ করো যে আমার খুব খারাপ লাগে।”

“আমি দুঃখিত”, আবার বলল সে আনমনে। এমন সময়ে ঠোট টিপে ধরলে সঙের গালে টোল পড়ে। অ্যালিসের বেশ ভালো লাগে সেটা। “সোনা, আমায় আবার বাইরে যেতে হবে এখন, অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে।” সং চাইছিল না অ্যালিসকে আবার চিন্তায় ফেলতে।

অ্যালিস টেবিলের উপর কফির কাপটা জোরে নামিয়ে রাখল। “ভগবানের জন্যে একটা রাত অন্তত বাড়িতে থাকো এভারেট। রোজ রাতে ওই সঙের পোষাক পড়ে মানুষকে বিরক্ত করতে কি তোমায় যেতেই হবে?”

“হ্যাঁ।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে এভারেট উঠে দাঁড়াল। সঙের টুপিটা মাথার উপর বসিয়ে ঝুলন্ত বলগুলিতে কয়েকবার টোকা দিল সে। তারপর নিজের কফির কাপটা বেসিনে উপুড় করে, ধুয়ে, ড্রায়ারে পুরে রাখল।

“আমায় যেতেই হবে।”

অ্যলিস উত্তর দিল না। নীরবতা ভেঙ্গে খবরের মেশিনটা গরগর করতে লাগল। অ্যালিস মেশিন থেকে কাগজটা টেনে বের করে পড়ে এভারেটের দিকে বাড়িয়ে ধরল। “এটা তোমার জন্যে। তুমি হাস্যকর সব কাজ করছ দিনে দিনে!"

এভারেট এক নিঃশ্বাসে কাগজটা পড়ে ফেলল। টিকটিক মশাই হন্যে হয়ে সং-কে খুঁজছেন। যাই হোক, এভারেট এসবকে আর পাত্তা দেয় না। আজও কাজে যেতে তার দেরী হবে। দরজা পেরোনোর সময় সে আবার ঘুরে তাকালো একবার, অ্যালিসের দিকে চোখ মটকে, মুচকি হেসে বলল, “তুমিও আজকাল বেশ পেঁচিয়ে কথা বলছো!”

অ্যালিস তার সুন্দর টানা টানা চোখ পাকিয়ে বলল, “অসভ্য কোথাকার!”

সং আবার বেরিয়ে পড়ল দরজাটা টেনে দিয়ে। একটু পরেই বাইরে থেকে দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। অ্যালিস ঘন শ্বাস ছেড়ে উত্তেজিতভাবে দরজাটা খুলে ধরল। সং দাঁড়িয়ে ছিল বাইরেই। “সোনা, আমি সাড়ে দশটার মধ্যে ফিরে আসব, কথা দিলাম।”

“কেন আমাকে তুমি এসব বলছো?” কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল অ্যালিস। “তুমি কক্ষনই সময়ে আসতে পারো না। তুমি সব সময় দেরী করো। তবু কেন আমায় বার বার এসব কথা বলো? কেন?”, দরজাটা মুখের উপর বন্ধ করে দিল অ্যালিস।

বন্ধ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে সং ভাবছিল, “সত্যিই, ওর সব কথাই সত্যি। আমি তো সেই দেরী করবই। আমি কোনো দিন সময় রাখতে পারি না। তবু কেন আমি এই বোকা বোকা কথাগুলো বলি ওকে? কেন?”

সং ঘাড় ঝাঁকিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, আজও সে দেরী করবেই।

সং আজ রাতে একটা বাজি পোড়াল প্রথমে। সারা আকাশ আলো হয়ে কয়েকটা শব্দ ভাসতে লাগল হাওয়ায়। “আজ রাতে আটটার সময় আমি ১১৫তম বার্ষিক আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সম্মেলনে থাকব। আশা করি আপনাদের সাথে দেখা হবে।”

অবশ্যই সরকারী কর্মচারীরা তাকে ধরতে ওখানে হাজির হবে। যথারীতি তারা ধরে নিল সং এবারেও অনেক দেরি করে আসবে। কিন্তু সে এবার কুড়ি মিনিট আগে এসে হাজির হল। তখন পাহারাদাররা ওকে ধরার জন্যে বিরাট বিরাট আঠা মাখানো জাল টাঙ্গাচ্ছিল। বেচারারা কিছু বোঝার আগেই সং একটা বিরাট ভেঁপু বের করে কর্কশ শব্দে চারদিক মাতিয়ে তাদের চমকে দিল। ভয়ের চোটে লোকগুলোর মধ্যে কয়েকজন হাতের দড়ি ছেড়ে দিল আর তার ফলে পুরো জালটা এসে পড়ল তাদের ঘাড়ে। সং অট্টহাসি হাসতে হাসতে বার বার তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল। চারদিকে ভীড় করা ডাক্তারের দলও ফেটে পড়ছিল হাসির দমকে। আসলে তারা ভেবেছিল এটা তাদের অনুষ্ঠানেরই অংশ। তারা বার বার হাততালি দিয়ে আর মাথা ঝাঁকিয়ে সং-কে উৎসাহ দিতে লাগল। শুধু টিকটিক মশাইয়ের লোকগুলিই জানত সং-কে হন্যে হয়ে খুঁজছে সরকারী কর্মচারীরা, কিন্তু তারা তখন জালে জড়িয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছিল।

শহরের অন্য প্রান্তে সেদিন রাতেই মার্শাল ডেলাহ্যান্টি নামের একটি লোক বন্ধ হবার নোটিশ পেল। এই ব্যাপারটার সাথে সং এর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই যে তা ঠিক, তবে টিকটিক মশাইয়ের ক্ষমতার পরিমাণ সম্পর্কে জানতে হলে এই ঘটনাটার দিকে নজর রাখা দরকার। মার্শালের বৌ দরজা খুলেই খয়েরি স্যুট পরা লোকটাকে দেখতে পেল, লোকটার মুখে হতাশা আর দুঃখের মার্কামারা বিজ্ঞাপন। কিছু না বলতেই মার্শালের স্ত্রী সব বুঝে ফেলল, খামটা খোলার আগেই সে জানত ভিতরে কী আছে। এমনভাবে সে খামটা ধরে ছিল যেন ওটার ভিতরে একটা বোমা আছে যেটা যখন তখন ফেটে যেতে পারে। মনে মনে সে ভাবছিল, ‘এটা যেন মার্শালের নামে হয়, হে ভগবান, হে ভগবান, আমি এতো তাড়াতাড়ি মরতে চাইনা।’ ব্যাপারটা খুব নিষ্ঠুর আর বাস্তববাদী শোনালেও বেশির ভাগ মানুষেরই এই অবস্থায় মনের কথা এটাই হয়। খাম থেকে যখন মার্শালের নামই বেরোলো তখন জর্জেট একই সঙ্গে আতঙ্ক ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। “মার্শ ও মার্শ! হায় ভগবান, মার্শ, তোমার সময় শেষ! চিঠি এসেছে। এবার কী হবে গো আমাদের! হায় হায়, এমন কেন হল আমাদের সাথে! ও মার্শ…” সেদিন রাতে তাদের বাড়িতে কেউ ঘুমলো না, চিৎকার, কান্না আর ভয়ে মেশানো সারা রাতে তাদের পক্ষে করার কিছুই ছিল না, কারোরই কিছু করার ছিল না। তবে মার্শাল পালানোর চেষ্টা করেছিল। পরের দিন যখন তার ধুকধুকি বন্ধ করার সময় এলো, ততক্ষণে মার্শাল প্রায় দুশ মাইল দূরের একটা জঙ্গলে পৌঁছে গেছিল। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না, টিকটিক মশাই যখন ঠিক সময়ে মার্শালের ধুকধুকিটা বন্ধ করে দিলেন, তক্ষুনি ছুটতে ছুটতেই তার হার্টটা বন্ধ হয়ে গেল, হুমড়ি খেয়ে পড়ল মার্শাল ডেলাহ্যান্টি, তার মস্তিস্কে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেল। সময় রক্ষা ভবনে ম্যাপের উপর নিভে যাওয়া আলোটার দিকে তাকিয়ে টিকটিক মশাই নির্দেশ দিলেন জর্জেট ডেলাহ্যান্টির নাম পুনর্বিবাহের জন্যে নথিভুক্ত করতে। ওইটাই বোধহয় গোটা ব্যাপারটায় একমাত্র ভালো খবর ছিল। তবে এটা শুনে হেসো না যেন, কারণ সং-এর আসল নাম জানতে পারলে তার কপালেও এই একইভাবে মৃত্যু লেখা আছে।

শহরের বাজারের এলাকাটা সেদিন বৃহস্পতিবারের নিয়ম অনুযায়ী পরিপাটি করে সাজানো হয়েছিল। মেয়েরা হলুদ সিফনের জামা আর ছেলেরা টাইলর টুপি আর বেলুন প্যান্ট পরে ঘুরছিল। সময় বাঁচানোর জন্যে তৈরি নতুন বহুতল বাজারটার সামনে এসে হাজির হল সং, হাতে তার বিটকেল ভেঁপুটা। গলা ফাটানো চিৎকারের সাথে ভেঁপুর শব্দে সবাই ঘুরে তাকালো সং এর দিকে।

“ওদের কথা কেন শোনো তোমরা? ওরা বলার কে যে তোমাদের পিঁপড়ের মত সারাক্ষণ দৌড়তে হবে? নিজের ইচ্ছে মত কাজ করো, ছুটি নাও, এই সুন্দর গ্রীষ্মের দিনটা উপভোগ করো। নরম রোদটা গায়ে মাখো, ঠান্ডা বাতাসে গা এলিয়ে দাও, নিজের ইচ্ছে মত নিজের হিসেবে বাঁচো। সময়ের দাস হয়ো না, রোজ ভয়ে ভয়ে তিল তিল করে মোরো না। টিকটিক মশাই নিপাত যাক!”

“কে এই পাগলটা?” ক্রেতাদের মধ্যে অনেকেই জানতে চাইছিল, কিন্তু তারপরেই তাদের মনে পড়ে গেল এখানে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে এসব শুনতে গিয়ে, কাজে দেরী করা মোটেও ভালো না।

বহুতলের কর্মীদের কাছে ততক্ষণে টিকটিকমশাইয়ের থেকে জরুরী বার্তা চলে এসেছে – বহুতলের উপরের লোকটা কুখ্যাত অপরাধী সং, ওকে ধরার জন্যে যা দরকার কর্মচারীরা তা যেন করে। কর্মচারীরা প্রথমে রাজী হয়নি, এসব করতে গিয়ে তাদের নিজের কাজে দেরী হোক তা কেউ চায় না। টিকটিক মশাইকে তখন বাধ্য হয়ে তাদের বাজারের সব কাজ বন্ধ রেখে সং কে ধরতে বলতে হল। বিপরীত মাধ্যাকর্ষণ সিঁড়ি লাগিয়ে প্রায় পনের জন কর্মচারী বহুতলের ছাদের মাথায় সং এর কাছে পৌঁছে গেল। সরু কার্নিশে হুড়োহুড়ি করে উঠে তারা দেখল সং বেশ কিছুক্ষণ আগেই পালিয়ে গেছে। তবে ততক্ষণে নিচে প্রচুর লোক জমায়েত হয়ে গেছে আর বাজারে সব মিলিয়ে বেশ কয়েক ঘন্টা সব কাজ বন্ধ হয়ে গেল সেদিন। এর ফলে সরকারী অর্থনীতির কেনা-বেচার হিসেবে প্রভাব পড়ল সেদিনের জন্যে। বাজার চাঙ্গা করার জন্যে সরকারী কিছু নীতির পরিবর্তন ঘটানো হল সাথে সাথে। কিন্তু তার ফলে হাওয়া-নাটের বিক্রি বেড়ে গেল বেশ ভালোই, বল্টুগুলো জমতে লাগল গুদামে, আবার বিঘ্নিত হল অর্থনৈতিক অনুপাত। সুতরাং বল্টুগুলো পুরোনো হবার আগেই তড়িঘড়ি সেগুলো দোকানে দোকানে কম দামে পাঠানো শুরু হল। এই তাড়াহুড়োর চোটে বেশ কিছু বাক্স বল্টু হারিয়ে গেল আর এক লরি ভর্তি বল্টু ভুল রাস্তায় গিয়ে আরো একদিন সময় নষ্ট হল। এমনকি এই ঝামেলার আঁচ গিয়ে সিজলস্কিড কোম্পানির শেয়ারেও লাগল।

“সং-টাকে ছাড়া যেন তোমাদের মুখ আমায় দেখতে না হয়”, খুব শান্তমুখে, চিবিয়ে চিবিয়ে, বিপদজনকভাবে বললেন টিকটিকমশাই।

তারা শিকারী কুকুর ব্যবহার করল। তারা উড়ন্ত ক্যামেরা ব্যাবহার করল। তারা সবার ধুকধুকি মিলিয়ে সং-কে খোঁজার চেষ্টা করল। তারা ভয় দেখাল। তারা অত্যাচার করল। তারা পুলিশ আনল। তারা আটক করল। তারা ঘুষ দিল। তারা মিথ্যে বলল। তারা চালাকি করল। তারা ষড়যন্ত্র করল। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করল। তারা রাওল মিটিগং-কে ডাকল (যদিও তাতেও কোনো সুবিধে হল না)। তারা হাতের ছাপ খুঁজল। তারা মিথ্যে প্রমাণ খুঁজল। তারা অপরাধবিদ্যা লাগাল।

এবং শেষ পর্যন্ত সং ধরা পড়ল!

হাজার হোক সং আসলে এভারেট সি মার্ম নামের একটা সাধারণ লোক। সব কিছুতেই দেরী করা ছাড়া তার কোনো বিশেষ ক্ষমতা যে ছিল না।

“সং, তুমি কি অনুতপ্ত?” টিকটিক মশাই জিজ্ঞাসা করলেন।

“গোল্লায় যাও”, সং খেঁকিয়ে উঠল।

“তুমি এখনো পর্যন্ত তেষট্টি বছর, পাঁচ মাস, তিন সপ্তাহ, দুই দিন, বারো ঘন্টা, একচল্লিশ মিনিট, ঊনষাট সেকেন্ড, শূন্য দশমিক শূন্য তিন ছয় এক এক এক ন্যানোসেকেন্ড দেরী করেছ জীবনে। বাঁচার মত আর সময় তোমার হাতে নেই। তোমাকে বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা নেই।”

“অন্য কাউকে ভয় দেখাও গে! তোমাদের বোকার সমাজে যন্ত্রের মত বাঁচা আর তোমার মত জুজুর ভয়ে থাকার থেকে মরে যাওয়া ঢের ভালো।”

“এটাই আমার কাজ। আমি না দেখলে কে সময়কে দেখবে?"

“কে তোমাকে এসব করার অধিকার দিয়েছে? তোমার কোন অধিকার নেই কেউ দেরি করে কাজে এলে তাকে মেরে ফেলার!”

“হুম, বুঝতে পারছি যে আমাদের সমাজের উপযুক্ত তুমি নও, তোমাকে আমাদের সাথে মেলাতে পারছি না।”

“একবার আমার বাঁধনটা খুলে দিয়ে দেখো না চাঁদু, আমার ঘুসির সাথে তোমার মুখটা ঠিক মিলিয়ে দেব।”

“তুমি সমাজের কোনো প্রথাই মানো না!”

“সেটা কবে থেকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হল?”

“এটাই এখন অপরাধ। তোমার চারপাশে তাকিয়ে দেখ, সবাই সেটা মেনে চলছে।”

“আমি মানি না, তোমাদের পৃথিবীটা খুব খারাপ!”

“বাকিরা সেটা ভাবে না। বেশির ভাগ মানুষই নিয়ম ভালোবাসে।”

“আমি সেটা বিশ্বাস করি না। আমার কাছের মানুষেরাও সেটা বিশ্বাস করে না।”

“আচ্ছা তোমার কী মনে হয়? তোমাকে আমরা ধরলাম কী করে?”

“আমার জানার দরকার নেই।”

“অ্যালিস নামে সুন্দরী একটা মেয়ে এসে তোমার নাম বলে গেছে আমাদের কাছে।”

“মিথ্যে কথা! আমি একবর্ণও বিশ্বাস করি না!”

“আমি মিথ্যে বলি না। ও তোমাকে আর সহ্য করতে পারছিল না। ও তোমার মত নয়, ও নিয়ম মানতে চায়, এই সমাজের একজন হতে চায়। ও চায় তোমাকে বন্ধ করে দেওয়া হোক।”

“তাহলে এত তর্ক করছো কেন, করতেই হয় যদি বন্ধ করো, আমারও হাড় জুড়ায়!”

“নাহ, আমি তোমাকে বন্ধ করব না।”

“তুমি একটা গাধা! কী বলছ ঠিক নেই।”

“অনুতাপ করো, সং!” টিকটিক মশাই বললেন।

“গোল্লায় যাও!”

তারপর তারা তাকে কভেন্ট্রিতে পাঠাল। সেখানে তার উপর চিকিৎসা চলল নানারকম। এই চিকিৎসাগুলো খুব পুরোনো, সেই ‘১৯৮৪’ নামের বইটিতে এই ধরনের চিকিৎসার প্রয়োগ লেখা আছে উইনস্টন স্মিথ নামে একটি লোকের উপর। যদিও তারা এই বইটা পড়েনি, তবুও সং এর উপর সেগুলি প্রয়োগ করা চলল একদিন ধরে। তারপর তাকে সরকারী সমস্ত যোগাযোগ যন্ত্রের সামনে পেশ করা হল। উজ্জ্বল চোখের হাসিখুশি সং-কে দেখে মোটেও মনে হচ্ছিল না যে তার মস্তিষ্ক মুছে দেওয়া হয়েছে। তার কাজ যে কতটা ভুল ছিল সেটা সে মেনে নিল, আসলে সমাজের নিয়ম নীতি মেনে চলাই উচিৎ, সময়ে কাজ করার মত আনন্দের আর কিছুই হয় না, শহরের মাঝের বিরাট বড় পর্দাটার উপরে এই কথাগুলোই তার ছবিটা বলে যাচ্ছিল। দর্শকরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, আগেই বোঝা গেছিল লোকটা পাগল, সমাজ যেভাবে চলছে সেই ভাবেই চলা উচিৎ, সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে কেই বা জিততে পেরেছে! আর এসব করার জন্যে কেউ তো আর মাইনে পায় না।

এইভাবেই এভারেট সি মার্মের মৃত্যু হল মানুষের চোখে। এটা যে একটা বড় ক্ষতি সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই, কিন্তু প্রথমেই থরেউ যা বলেছেন, অমলেট বানাতে গেলে তো ডিম ভাঙতেই হবে, সমস্ত বিপ্লবেই কিছু লোক শহীদ হয় না চাইলেও। কারণ এইভাবেই ছোট ছোট ব্যাপারগুলোর মধ্যে দিয়েই পরিবর্তন আসে, আর তখন মনে হয় এগুলোর দরকার ছিল!

ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে, “শ্রদ্ধেয় টিকটিকমশাই, আমার হয়ত এটা বলা ঠিক হচ্ছে না, মানে দয়া করে কিছু মনে করবেন না… আজকে আপনি তিন মিনিট দেরী করে কাজ শুরু করেছেন, তার জন্যে সবাই আর সবকিছু দেরীতে চলছে আজ।”

“অসম্ভব! হতেই পারে না!” মুখোশের পিছনে বিড়বিড় করলেন টিকটিকবাবু। “তোমার ঘড়িটা নিশ্চয়ই ভুল আছে।” এই বলে নিজের অফিসের দিকে ছুট লাগালেন তিনি।


 

১ ডিক বঙ – রিচার্ড বঙ ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত মার্কিন যুদ্ধবিমান চালক।

২ জোমো কেনিয়াটা – কেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি। কেনিয়াকে ব্রিটিশ শাষণ মুক্ত করে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় তাঁর গুরত্ব ছিল অপরিসীম।

৩ পাগলা কেলি – অ্যালভিন শিপরেক কেলি ছিলেন একজন মার্কিন বাজীকর। বহুদিন ধরে উঁচু পোলের মাথায় উঠে বসে থাকা ছিল তাঁর শখ। ১৯২০-৩০ সালে এই জন্যে মার্কিন দেশে তাঁর খুব নামডাক হয়েছিল।

৪ পিট মনড্রিয়ান – বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাৎ ডাচ শিল্পী ও অ্যাবস্ট্রাক্ট নিও প্লাস্টিসিসম ধারার জনক।

৫ বুসবি বার্কলে – আমেরিকার বিখ্যাত নৃত্যনাট্য পরিচালক। তাঁর সিনেমাগুলি সমবেত নাচের মধ্যে দিয়ে জটিল জ্যামিতিক ছন্দ প্রকাশ করার জন্যে বিখ্যাত।

৬ উইনস্টন স্মিথ – জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত বই ‘১৯৮৪’ প্রধান চরিত্র হল উইনস্টন স্মিথ। পার্টি দ্বারা পরিচালিত সমাজের প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ নিয়ে ছিল তার গল্প।

৭ থরেউ – হেনরী ডেভিড থরেউ – ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক। ‘ওয়াল্ডেন’ তার লেখা বিখ্যাত বই। ‘সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স’ তার লেখা বহু চর্চিত প্রবন্ধ।

 

লেখক পরিচিতি – হারলান এলিসনের জন্ম আমেরিকায় ১৯৩৪ সালে। সারা জীবনে তিনি সাতেরশর বেশি গল্প, নভেলা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কমিকসের গল্প, চিত্রনাট্য ইত্যাদি লিখে গেছেন। কোনো নির্দিষ্ট ধারার লেখনীতে তাঁকে বাঁধা মুশকিল হলেও, কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসির জগতে তাঁর অবদান প্রচুর। তাঁর সম্পাদনায় দুটি কল্পবিজ্ঞানের বই এই ধারার মধ্যে নতুন যুগের সূচনা করে বলা হয়। হুগো, নেবুলা প্রভৃতি বহু পুরষ্কার তিনি পেয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।